দুরদানার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর আমার জীবনের ভারসাম্য পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেল। হঠাৎ করে আমি সবার বিশেষ মনোযোগের পাত্র হয়ে উঠলাম। যেখানেই যাই, সবাই আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। আমি মনে করতে আরম্ভ করলাম, ঢাকা শহরের সবগুলো চেনা-জানা মানুষের চোখ আমার দিকে ক্যামেরার মতো তাক করে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার থেকে বই ইস্যু করতে গিয়েছি। বইয়ের নাম এবং নম্বর লিখে স্লিপ দিয়ে অপেক্ষা করছি। সেদিন ভিড় কম ছিল। দাড়িঅলা কেরানি ভদ্রলোক মুখে বড় মতো পানের খিলিটা ঠেসে দিয়ে একটা ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নামই তো জাহিদ হাসান। আমি বললাম, হাঁ, কেন? তিনি চুনের বোঁটায় কামড় দিয়ে বললেন, না কিছু না। এমনিতেই জানতে চাইলাম। সেদিন গুলিস্তানের কাছে ইউনুস জোয়ারদারের বোন দুরদানা বেগমের সঙ্গে আপনাকে দেখলাম কিনা। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো, হারামজাদা, দুরদানা বেগমের সঙ্গে দেখেছ, তাতে তোমার বাপের কি, কত লোকই তো কত মেয়ে মানুষের সঙ্গে এক রিকশায় যাতায়াত করে। কিন্তু আমি কিছু বলতে পারি নি।
বাংলা একাডেমীর কি একটা অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছি। পাগলা জগলুল দূর থেকে ছুটে এসে আমার পাশ ঘেঁষে বসল। তারপর বলল, দেখি ভাতিজা একটা সিগারেট বের করো তো দেখি। আমি প্রমাদ গুণলাম। জগলুলের পাল্লায় পড়লে সহজে ছাড়া পাওয়ার উপায় নেই। আমি নীরবে একটা স্টার সিগারেট বের করে তাকে দিলাম। সে সিগারেট নিল বটে, কিন্তু ভীষণ অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বলল, ভাতিজা এখনো তুমি স্টার সিগারেট খাও? আমি বললাম, চাচা এটাইতো আমার ব্র্যান্ড। জগলুল নাকে-মুখে ধোয়া ছেড়ে বলল, না ভাতিজা, তোমার কথাটা মনে ধরল না। তুমি ইউনুস জোয়ারদারের বোনের সঙ্গে প্রেম করে বেড়াও। যে মেয়ে সাইকেল চালায়, প্যান্ট-শার্ট পরে। একেবারে আপটুডেট মেয়ে। এখন তো দেখছি সে মেয়ে তোমাকে কলা দেখিয়ে চলে যাবে। বুঝলে ভাতিজা, এই ধরনের মেয়েকে বশে রাখতে হলে অনেক কায়দা-কানুন জানা চাই। ফকিরনির পোলার মতো চলাফেরা করলে চলবে না। ভাল সিগারেট খেতে হবে, ভাল জামা-কাপড় পরতে হবে। ভাল জায়গায় যেতে হবে। বুঝলে ভাতিজা, বয়সকালে আমরাও প্রেম করেছি। একটা নয়, দুটো নয়, এক সঙ্গে পাঁচ-পাঁচটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছি। কখন কি করতে হবে, আমি তোমাকে সব বাতলে দেব, এবার চাচার হাতে দশ টাকার একটা নোট রাখ দেখি।
আমি বললাম, চাচা, আজ তো আমার কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেই। জগলুল বলল, ভাতিজা, নাই বললে পার পাবে না। ভালয় ভালয় দশ টাকা চালান করে দাও। নইলে লোকজনের সামনে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব। এতদিন জগলুলকে পাগল বলে জানতাম। আজ দেখলাম, লোকটা কম নীচও নয়। আমি রীতিমতো রেগে গিয়ে বললাম, ঠিক আছে, আপনি হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিন। প্রায় ছফিট লম্বা লিকলিকে মানুষটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে লাল চোখ করে বলল, এখনো বলছি, ভালয় ভালয় টাকাটা দিয়ে দাও। আমি গো ধরে রইলাম। তারপর জগলুল চিৎকার করে বলতে আরম্ভ করল, তুমি ইউনুস জোয়ারদারের বোনের সঙ্গে ফুর্তি করে বেড়াও। মানুষ কি জানে না ইউনুস জোয়ারদার একটা খুনি। তার দলের লোকেরা গ্রামে-গঞ্জে মানুষ খুন করে বেড়াচ্ছে। লোকের ধন-সম্পদ লুটপাট করছে। ভাইয়ের দেমাকেই তো বোনটা সাইকেলে চড়ে সবাইকে পাছা আর বুক দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। এইসব কথা শুনে আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। জগলুলের মাথায় বসিয়ে দেবার জন্যে আমি একটা ফোল্ডিং চেয়ার উঠিয়ে নিলাম। সভাস্থলে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হলো। একাডেমীর লোকেরা এসে আমাদের দুজনকে আলাদা করে দিলেন।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা একাডেমী থেকে অনুষ্ঠান শেষ করে শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে এসেছি। আমার পেছন পেছন দুজন তরুণ এসে আমার বিপরীত দিকে বসল। আমি চা খেয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখি, তরুণ দুজনও আমার পেছন পেছন আসছে। আমার কেমন যেন গা ছমছম করতে আরম্ভ করল। যেই ছাতিম গাছটার গোড়ায় এসেছি, দুজনের মধ্যে একজন পেছন থেকে ডাক দিল, এই যে ভাই, একটু দাঁড়ান। আমি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে কি কিছু বলছেন? তরুণ দুজন আমার শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালো। দুজনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বেঁটেটি আমাকে প্রশ্ন করল, আপনি কি ইউনুস জোয়ারদারের দল করেন? আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। সহসা মুখে কোনো কথা যোগাল না। লম্বা যুবকটি আমার গায়ে ঠেলা দিয়ে বলল, কি ভাই, কথা বলছেন না কেন? আমি দেখলাম গতিক সুবিধের নয়। বললাম, ইউনুস জোয়ারদার বলে কাউকে আমি চিনিনে। তরুণটি হু হু করে হেসে উঠল, ইউনুস জোয়ারদারকে চেনেন না, তাই না? তার বোনটিকে চিনলেন কেমন করে? একেবারে খাসা মাল। কি ভাই, চুপ কেন, কথা বলেন। আমি বললাম, আপনারা অসভ্যের মতো কথা বলছেন। বেঁটে তরুণটি আচমকা দুহাত দিয়ে আমার গলা চেপে ধরে বলল, শালা, অসভ্য কাকে বলে চিনিয়ে দিচ্ছি। তারপর দুজনে মিলে অবিরাম আমার গায়ে কিল-চড় মারতে থাকল। আমার শরীর বরাবরের মতো দুর্বল। আমি বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। তরুণ দুটি আমাকে মারতে মারতে একরকম আধমরা করে ছাতিম তলায় ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল।
অনেকক্ষণ হুঁশ ছিল না। মাঝ রাতে যখন জ্ঞান ফিরে এল, দেখলাম, আমি ছাতিমতলায় পড়ে আছি। আমার শরীর ধুলোকাদায় লেপ্টে গেছে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নাড়াবার ক্ষমতা আমার নেই। অনেক কষ্টে সে রাতে কোনো রকমে হোস্টেলে ফিরতে পেরেছিলাম। পুরো সপ্তাহটা ঘরের মধ্যে আটকে থাকতে হয়েছিল। তবু ওই মার খাওয়ার ঘটনা আমি কারো কাছে প্রকাশ করিনি। ড. মাহমুদ কবিরের সতর্ক করে দেয়ার কথা আমার মনে পড়ল। যে মেয়ের ভাই সন্ত্রাসী রাজনীতি করে, যে মেয়ে প্যান্ট-শার্ট পরে, সাইকেল চালিয়ে আসা-যাওয়া করে, তার সঙ্গে মেলামেশা করার মূল্য তো আমাকে দিতেই হবে। সীমানা ভাঙা কি সহজ কথা! এখন আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু এ পথে একবার যখন পা বাড়িয়েছি আর তো ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। লাঞ্ছনা-গঞ্জনা যা কিছু আসে সব আমাকে একাই ভোগ করতে হবে। সান্ত্বনা প্রকাশ করবে, সমবেদনা জানাবে, এমন কাউকে আমি পাব না। মার খেয়েছি কথাটি আমি কোনো লোকের কাছে বলিনি। কারণ মার খাওয়ার কথা বলার মধ্যে আমি অপমান ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাইনি। তবু হপ্তাখানেক পর যখন ঘরের বাইরে এলাম, গভীর বেদনার সঙ্গে হজম করতে হলো, সরকারি দলের ছাত্ররা আমাকে মারতে মারতে আধমরা করে ফেলে গিয়েছিল, একথা সবাই জেনে গিয়েছে। এই প্রথম উপলব্ধি করলাম, আমি একটা গ্যাড়াকলের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছি। এখন আমি যেখানেই যাব, এরপর রাজরোষ আমাকে অনুসরণ করতে থাকবে।
আবার ড. মাহমুদ কবিরের আরেকটি চিরকুট পেলাম। তিনি আমাকে সন্ধ্যেয় তার বাড়িতে যেতে বলেছেন। আমি ঠিক করলাম, যাব না। কারণ তার ওখানে গেলে তিনি হুঁকোয় লম্বা টান দিয়ে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলবেন, কি হে ছোকরা, এখন কেমন বোধ করছ! তখন তো আমি তোমাকে সাবধান করে দিয়েছিলাম। তিনি যে একজন মস্ত বড় ভবিষ্যদ্বক্তা এই সত্যটি প্রমাণ করার জন্যে তার বাড়ি অবধি ছুটে যাওয়ার মধ্যে কোনো অর্থ খুঁজে পেলাম না। অপমান-লাঞ্ছনা যা কিছু আসুক, আমি একাই সহ্য করব। কারুর সহানুভূতি আমার প্রয়োজন নেই।
হঠাৎ করে আমি শহিদ হওয়ার দৃষ্টি দিয়ে সমস্ত মানব-সম্পর্ক বিচার করতে আরম্ভ করলাম। শহিদের হৃদয়ের আবেগ-অনুভূতি নিয়ে আমি তামাম দুনিয়াটাকে দেখতে আরম্ভ করলাম। ইউনুস জোয়ারদার মানুষটিকে আমি কোনোদিন নিজের চোখে দেখিনি, কথা বলিনি। তিনি কি দিয়ে ভাত খান এবং কোথায় কোথায় যান, কিছুই জানি নে। তার রাজনীতির বিন্দুবিসর্গ সম্পর্কেও আমার কোনো ধারণা নেই। তারপরেও আমার মনে হতে থাকল জোয়ারদারের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। আমি ভীষণ কৌতূহলী হয়ে তার সম্পর্কে নানান তথ্য সংগ্রহ করতে লেগে গেলাম। ধীরে ধীরে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটা ধারণা আমার মনে জন্ম নিতে আরম্ভ করল। শহরের দেয়ালে দেয়ালে আলকাতরার লিখন দেখে আমার মনে হতে থাকল ইউনুস জোয়ারদার ধারে-কাছে কোথাও লুকিয়ে রয়েছেন এবং আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পেতে রেখেছেন। আমি রিভলবার দিয়ে শ্রেণীশত্রু খতম করার কাজে অংশগ্রহণ করি নে, তার দুপুরে আড়তদারের আড়তে হামলা করি নে, পুলিশ কিংবা রক্ষী বাহিনীর সঙ্গে সামনা-সামনি বন্দুকযুদ্ধে নামি নে, গ্রাম-গঞ্জের বাজারে কারফিউ জারি করে গণশত্রুদের ধরে এনে গণ-আদালতে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করি নে। চেয়ারম্যান মাও সে তুঙের নামে স্লোগান দিয়েও গাঁও-গেরামের জমাটবাঁধা অন্ধকার কাঁপিয়ে তুলি নে, গোপন দলের হয়ে চাঁদা সংগ্রহ করি নে, গাঢ় আলকাতরার অক্ষরে দেয়ালে লিখন লিখি নে, গোপন দলের সংবাদ আনা-নেয়া করি নে। তাদের ইশতেহারও বিলি করি নে। কোনো কাজে অংশগ্রহণ না করেই কেমন করে আমি মানসিকভাবে ইউনুস জোয়ারদারের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম।
নিজের অজান্তেই আরেকটি গোপন পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে গেলাম। সেই পৃথিবী চোখের সামনে দৃশ্যমান পৃথিবীর কোনো নিয়ম রক্ষা করে না। সেখানে সূর্য ভিন্ন রকম আলো ছড়ায়, চাঁদ ভিন্ন রকম কিরণধারা বিতরণ করে, সেই পৃথিবীর আকাশে ভিন্ন রকমের গ্রহ-নক্ষত্র শোভা বিস্তার করে। শিশুদের চোখে ম্যাজিক ল্যান্টার্নের ফোকর দিয়ে যেমন মায়া-জগতের চেহারা মূর্ত হয়ে ওঠে, আমিও দুরদানার মধ্য দিয়ে একটি গোপন পৃথিবীর নিবিড় স্পর্শ অনুভব করে একা একা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিলাম। দুরদানা যখন আমার সামনে এসে দাঁড়াতো, আমার শরীরের সমস্ত রক্ত মিছিল করে উজানে ছুটতে থাকত। তরল রঙিন মদের নেশার মতো আমার চেতনার মধ্যে সোনালি বুদ্বুদ খেলা করত।
দুরদানা একটি মেয়ে, একটি অজানা পৃথিবীর প্রতীক। এই ভাবনাটাই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। তার স্তন জোড়ার আকৃতি কি রকম, অন্য মহিলার মতো তারও একখানা যৌনাঙ্গ আছে কি না, মাসে মাসে তারও রক্তস্রাব হয় কি না এবং যন্ত্রণা সে অনুভব করে কি না- এসব কথা কখনো আমার ধর্তব্যে আসে নি। একজন যৌবনবতী নারীর রূপ ধরে আমাদের দেশের ইতিহাসের পাল্টা স্রোত, যা গ্রামে গঞ্জে সর্বত্র হাজার বছরের বাঁধন ঠেলে বেরিয়ে আসার জন্যে রক্তপাত ঘটাচ্ছিল, সেই প্রবাহটার সঙ্গেই দুরদানা আমার পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিল। নারী আসলে যা, তার বদলে যখন সে অন্যকিছুর প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়, তখন তার আকর্ষণ করার শক্তি হাজার গুণ বেড়ে যায়।
একটানা বেশ কয়েকটা মাস ঘোরের মধ্যে কেটে গেল। নিজের দিকে তাকাবার মোটেও ফুরসত পাই নি। এক শুক্রবারে ঘুম থেকে উঠে ঘরের চেহারা দেখে সারা গা কুটকুট করতে থাকল। অনেকদিন থেকে ঘরে ঝাড় পড়ে নি। দেয়ালের চারপাশে, ছাদে ঝুল জমেছে, তাতে অজস্র মাকড়সা বাসা বেঁধেছে। বালিশ ময়লা। বিছানার চাদর অনেকদিন বদলানো হয়নি। এখানে-ওখানে কাগজপত্র ছড়িয়ে আছে। আমি নাস্তা শেষ করে এসে প্রথমে ঝুল ঝাড়লাম। তারপর বিছানার চাদর, বালিশের ওসার, তোয়ালে এইসব সাবান মেখে বালতিতে ডুবিয়ে রাখলাম। নতুন চাদর বের করে বিছানায় পেতে দিলাম, বালিশে নতুন ওসার লাগালাম। বইপত্রগুলো গোছগাছ করলাম। অনেকগুলো চিঠির জবাব দেয়া হয়নি। মনের মধ্যে অপরাধবোধের পীড়ন অনুভব করলাম। মায়ের পর পর তিনটে চিঠির কোনো জবাব দিইনি। ঠিক করলাম, প্রথমে মাকে, তারপর চাচাকে চিঠি লিখব। বাকি চিঠিগুলোর জবাব অন্য সময় দেব। কাপড়-চোপড় পরিষ্কার এবং চিঠিপত্র লেখায় অর্ধেক বেলা চলে গেল। ফলে আমি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। দুপুরবেলা খেয়ে এসে বিছানায় পিঠ রেখেছি, এমন সময় দরজায় একে একে তিনবার টোকা পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দিতেই একজন বুড়োমতো ভদ্রলোক আমাকে সালাম দিলেন। আগন্তুক বেশ লম্বা, মুখেছাগল দাড়ি। পরনে পাজামা এবং লম্বা নীল রঙের শার্ট। শার্টের তিনদিকে পকেট। দেখলাম, তার ওপরের পাটির দুটো দাঁত নেই। আমি ভদ্রলোককে বসতে বললাম এবং কি কারণে এসেছেন জানতে তিনি একগাল অমায়িক হেসে জানালেন, তার তেমন বিশেষ উদ্দেশ্য নেই। আমার সঙ্গে অল্পস্বল্প কথাবার্তা বলতে এসেছেন। আমার সঙ্গে তার কখনো পরিচয় হয়েছিল কি না জানতে চাইলাম। ভদ্রলোক এবারও হেসে জানালেন, না, আমার সঙ্গে তার মৌখিক পরিচয় হয়নি বটে, তবে তিনি আমাকে চেনেন। নানা-সভা-সমিতিতে তিনি আমার বক্তৃতা শুনেছেন। আমার কথাবার্তা শুনে খুব পছন্দ হয়েছে। তাই আজ পরিচয় করতে ছুটে এসেছেন।
ভদ্রলোকের কথাবার্তা শুনে আমার বুকের ছাতি একটুখানি ফুলে উঠল । তার দিকে সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরলাম। তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন এবং জানালেন, পান, সিগারেট, চা কিছুই খান না। কেবল দুপুরে এবং রাতে খাওয়ার পর মুখশুদ্ধির জন্য অর্ধেক করে হরতকি খেয়ে থাকেন। মৃদু হেসে এও জানালেন, হরতুকি সেবনের এই অভ্যাস তিনি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক অম্বিকা বাবুর কাছ থেকে পেয়েছিলেন। হরতুকি খুব উপকারী জিনিস। এ ছাড়াও তিনি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে পুরো এক গ্লাস ত্রিফলা-ভেজানো পানি পান করে থাকেন। আর এই পানির গুণ এত বেশি যে, পিত্তচড়া, অগ্নিমান্দ্য এসব রোগ ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারে না। ভদ্রলোকের কথাবার্তা শুনে তার ওপর আমার ক্রমশ শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই রকম একজন সাত্ত্বিক স্বভাবের মানুষ সভা-সমিতিতে আমার বক্তৃতা শুনে আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন শুনে মনটা খুশিতে গান গেয়ে উঠতে চাইল।
আমার উম্মা, বিরক্তি সব কোথায় চলে গেল। আমি তরিবতসহকারে ভদ্রলোক কোথায় থাকেন জানতে চাইলাম। ভদ্রলোক জানালেন, তিনি আমার খুব কাছেই নীলক্ষেতের একটা অফিসে ছোটখাট গোছের কাজ করেন। তার আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি খুকখুক করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, অত্যন্ত তুচ্ছ ব্যাপার। স্যার, শুনলে আপনার হাসি পাবে। আমি বললাম, তবু আপনি বলুন। তিনি এক গ্লাস পানি খেতে চাইলেন। আমি পানি ভর্তি গ্লাসটা তার সামনে বাড়িয়ে দিলাম। তিনি আস্তে আস্তে ঢোক গিলে গিলে সবটুকু পানি পান করলেন। তারপর মুখ খুললেন, স্যারকে প্রতিদিন দুরদানা বেগমের সঙ্গে চলাফেরা করতে দেখি। এরকম ভাল দাগহীন মেয়ে আমি কম দেখেছি। প্যান্ট-শার্ট পরে একটু পাগলামি করলে কি হবে, একেবারে খাঁটি মেয়ে। ওই মেয়ের মধ্যে কোনোরকম নোংরামি থাকতে পারে না। আসলে স্যার আমরা মুসলমানরা যতই পর্দা-পর্দা বলে যতই চিৎকার করি না কেন, পর্দা করলেই যে মানুষের স্বভাবের পরিবর্তন হয়ে যাবে, এটা কোনোদিন ঠিক হতে পারে না। যাকে বলে ঘোমটার মধ্যে খেমটা নাচ, সে তো সব জায়গাতেই চলছে।
ভদ্রলোক যেই দুরদানার নাম উচ্চারণ করলেন, আমি সচকিত হয়ে উঠলাম। কারণ এ-পর্যন্ত দুরদানার ব্যাপার নিয়ে যত মানুষ আমার সঙ্গে কথা বলেছে, সবার কাছ থেকেই একটা প্রচ্ছন্ন বিপদের ইঙ্গিত পেয়েছি। ভদ্রলোকের মতলবখানা কি আমি আঁচ করতে চেষ্টা করলাম। আমার চোখে-মুখে একটা কঠোরতার ভাব ফুটে উঠল। সেটা ভদ্রলোকের দৃষ্টি এড়ালো না। তিনি জানালেন, তার নাম ইউনুস মোল্লা। দুরদানা বেগমের ভাইয়ের নামে নাম। তাই দুরদানা বেগমের প্রতি একটা ভ্রাতৃসুলভ স্নেহ অনুভব করে থাকেন এবং এই স্নেহের টানেই তিনি আমার কাছে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বললেন, স্যার, নামে নামে মিল হয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। যেমন ধরুন ইউনুস জোয়ারদার সাহেবকে আমি কখনো চোখে দেখি নি। তবু তার দুঃসাহসী কাজের কথা শুনতে শুনতে আমার একটা ইয়ে, মানে আগ্রহ জন্মে গেছে। বোঝেন তো স্যার নামে নামে মিল চুম্বকের মতো একটা আকর্ষণ সৃষ্টি করে। তাই স্যারের কাছে এলাম। ইউনুস জোয়ারদার সাহেব সম্পর্কে কিছু জানার খুব খায়েশ । আমি জানালাম, জোয়ারদারের নাম তার মতো আমিও শুনেছি। কিন্তু তাকে কোনোদিন চোখে দেখি নি। আমার কথা শুনে ইউনুস মোল্লা সাহেব অবাক হওয়ার ভঙ্গি করলেন, কী যে বলেন স্যার। বোনের সঙ্গে এত খাতির অথচ ভায়ের ব্যাপারে কিছুই জানেন না। এটা কেমন করে হয়। আজ না জানতে পারেন, একদিন তো জানতে পারবেন, বেগম সাহেব আপনাকে না জানিয়ে কি পারবেন? স্যার, এরপর থেকে আমি আপনার কাছে যাওয়া-আসা করতে থাকব। অবশ্য, স্যার যদি বিরক্ত না হন। আমার কেমন জানি সন্দেহ হলো। আমি বললাম, ইউনুস সাহেব, ঠিক করে বলুন তো আপনি কি করেন? তিনি বিনয়ে বিগলিত হয়ে জানালেন, অদৃষ্টের ফেরে তাকে অতিশয় তুচ্ছ কাজ করতে হচ্ছে। তিনি নীলক্ষেত ব্রাঞ্চের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর । বুঝলাম, পেছনে গোয়েন্দা লেগেছে।
পাগলা জগলুল আমার ভেতরে একটা বিশ্রী জিনিস ঢুকিয়ে দিয়েছে। আগের মতো জামা-কাপড় পরে আমি নিশ্চিত হতে পারি না। আমার কাপড়-চোপড় দুরদানার একটা বিবেচনার বিষয়ে হতে পারে আগে চিন্তাও করি নি। এখন পোশাক-আশাকের ব্যাপারটা আমার প্রধান মনোযোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন্ প্যান্টের সঙ্গে কোন্ শার্টটা পরলাম, ম্যাচিং ঠিকমতো হলো কি না, এসব জিনিসে দৃষ্টি দিতে হচ্ছে। অসম্ভব কষ্টের সঙ্গে আবিষ্কার করলাম, আমার শার্টগুলো অত্যন্ত বিশ্রী, প্যান্টগুলোর কোনো ছিরিছাঁদ নেই। পরে লজ্জা নিবারণ করা যায় কোনোমতে। পোশাকের ভেতর দিয়ে একজন মানুষের রুচি-সংস্কৃতি প্রকাশিত হয়, এসব কথা কোনোদিন ঘুণাক্ষরেও মনে আসে নি। তাই ধার করে নতুন জামা-কাপড় বানাতে হলো। আগে একটা শার্ট একনাগাড়ে চার-পাঁচদিন পরতাম। এখন দুদিনের বেশি পরলে দুর্গন্ধে নিজের শরীরটাই গুলিয়ে উঠতে থাকে। ঘন ঘন লন্ড্রিতে পাঠাবার মতো পয়সা আমার নেই। নিজের হাতে পরিষ্কার করে তারপর ইস্তিরি করি । ইস্তিরি করা শিখে নিতে হয়েছে। আমার নিজের ইস্তিরি ছিল না। কেনার পয়সাও ছিল না। আমার এক বন্ধুর বড় বোনের বাড়িতে একটা ইস্তিরি নষ্ট হয়ে পড়ে ছিল, সেই অকেজো জিনিসটাকেই মেরামতের দোকান থেকে সারাই করে কোনোরকমে কাজ চালিয়ে নিই।
এক ছুটির দিনে কাপড় ইস্তিরি করছিলাম। পুরনো মালে নির্ভর করার উপায় নেই। তার বেশি হলে কাপড় পুড়ে যাবার সম্ভাবনা। রেগুলেটার ঠিকমতো কাজ করছিল না। আবার যদি হাতেটাতে লেগে যায়, শক খেয়ে পটল তুলতে হবে। তাই সুইচ বন্ধ করে ভাবছিলাম, এখন কি উপায়! ঘেমে সারা শরীরে আমি নেয়ে উঠছিলাম। এইরকম একটা অবস্থার মধ্যে ঘরে ঢুকল সেই বুড়ো দারোয়ান হাফিজ। সে আমার হাতের দুআঙুলে লম্বা একটা স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে বলল, স্যার আর একুয়া মেম ছাব। তারপর খুব ধারালো একটা হাসি ছুঁড়ে দিল। এটা এমন এক ধরনের হাসি, দেখলে সারা শরীরে জ্বালা ধরে যায়। অথচ কিছু বলার উপায় নেই। এই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে বললাম, দুরদানা এসেছে? হাফিজ একটা জবর জবাব দিল, না স্যার, এইটা মেমছাব, দেখলে চিনন যায়, দুরদানা তো ফুল ছাব। অপমানটা আমি গায়ে মাখলাম না। বললাম, পাঠিয়ে দাও।
অন্তত মিনিট তিন পর আমার ঘরে একটি মেয়ে ঢুকল। মেয়ে আমি ইচ্ছে করেই বলেছি, কারণ ভদ্রমহিলা হিসেবে তাকে মেনে নিতে আমার মন সায় দিচ্ছিল না। তার গায়ের রঙ অসম্ভব রকম ফরসা। একখানা ফিনফিনে রেশমের শাড়ি তার শরীর ঢেকে রেখেছে। শরীরের প্রতিটি বাঁক স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। পানের রসে তার ঠোঁট দুটো লাল। মুখের ভাবে একটা অকালপকৃতার ছাপ। মাথার চুলগুলো ছোটছোট। এ ধরনের মেয়ে সচরাচর চোখে পড়ে না। মেয়েটির বয়স নেহায়েৎ কম হয়নি। কিন্তু বাড়টা ঠেকে আছে। অবশ্য এ কারণেই তাকে ভদ্রমহিলা বলা যাবে কি না তাই নিয়ে আমি ইতস্তত করছিলাম! অবশ্য ভদ্রমহিলা দামি কাপড়-চোপড় পড়লেও তার পরার ধরন আপনা থেকেই একটা আনাড়িপনা জানান দিয়ে যাচ্ছে। তার পোশাক-আশাক দেখলে মনে হবে, ওগুলো পরা হয় নি, শরীরের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
আমি বললাম, বসুন। মেয়েটি চেয়ারের ওপর থপ করে বসে, কোনোরকম ভূমিকা না করেই জানিয়ে দিল, আমার নাম কল্পনা আখতার লুলু। আমি এবার ইডেন থেকে বিএ ফাইনাল দেব এবং হোস্টেলেই থাকি। আমার আব্বা ছিলেন জগন্নাথ কলেজের এক্স ভাইস প্রিন্সিপাল জালালুদ্দিন হায়দার চৌধুরী। কল্পনা প্রতিটি শব্দ চিবিয়ে চিবিয়ে এমনভাবে উচ্চারণ করে, যা মনের মধ্যে গেঁথে যায়। কিন্তু তার দাঁতগুলো খুবই সুন্দর। আমি বললাম, লুলু, আপনার আব্বা কি এখন বেঁচে নেই? মেয়েটি যেন তেড়ে এল, আমার আব্বার সংবাদে আপনার কাজ কি? আমি আপনার সঙ্গে ঝগড়া করতে এসেছি। দুরদানার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আমি সব রকম অসম্ভব অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্যে তৈরি থাকতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। আমি বললাম, লুলু, আমি কোথায়, কিভাবে আপনার ক্ষতি করলাম? মেয়েটি মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল। মশাই, আপনি ন্যাকার মতো কথা বলবেন না। কি ক্ষতি করেছেন আপনি নিজে জানেন না? সত্যি সত্যি আমাকে মাথায় হাত দিয়ে চিন্তা করতে হলো, কখন, কোথায় কীভাবে মেয়েটির ক্ষতি করলাম। আমি বললাম, লুলু, আপনি বোধহয় ভুল করেছেন। আপনি যাকে তালাশ করছেন, আমি সে ব্যক্তি নই। আপনার সঙ্গে আমার কোথাও কোনোদিন দেখাই হয়নি। সুতরাং ক্ষতি করার প্রশ্নই ওঠে না। আমার কথা শুনে কল্পনা আখতার লুলু টেবিল থেকে পানির বোতলটা তুলে নিয়ে মেঝের ওপর ছুঁড়ে মারল। ঝনঝন করে বোতলটা ভাঙল। ভাঙা কাঁচের কুঁচি ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল। আমি ভাবলাম, মহামুশকিলে পড়া গেল। আবার পাগলটাগল নয়তো?
লুলু বলল, আপনাকে আমি খুব ভালভাবে চিনি। আপনার নাম জাহিদ হাসান। আপনি অত্যন্ত নোংরা চরিত্রের মানুষ। আপনাকে চিনতে আমার বাকি আছে! আপনার সঙ্গে মেলামেশা করার পর থেকে দুরদানা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। আপনি তাকে নষ্ট করেছেন। আপনাকে একদিন দেখে নেব। তার কথাবার্তার ধরন দেখে মজা পেয়ে গেলাম। আমি বললাম, না লুলু, দুরদানাকে আমি নষ্ট করি নি। আমাদের সম্পর্ক এখানো পোশাকের বাঁধন অতিক্রম করে নি। লুলু কালির দোয়াতটা উঁচিয়ে ধরে বলল, আমার ইচ্ছে হচ্ছে এটা আপনার মুখে ছুঁড়ে মারি । বুঝলাম, এই মেয়ের সঙ্গে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। মানে মানে এখন বিদেয় করতে পারলেই বাঁচি। আমি বললাম, আপনি সত্যি করে বলুন তো দুরদানা কি আপনাকে বলেছে আমি তাকে নষ্ট করেছি? লুলু টেবিলে থাবা বাজিয়ে বলল, নষ্ট করবার বাকি কি রেখেছেন, এখন দুরদানা আমার সঙ্গে ঘুমোতে চায় না, সে বাড়ি গিয়ে শাড়ি সালোয়ার কামিজ পরতে চায়। এসব তো আপনার কাছ থেকেই শিখেছে। আমি তাজ্জব বনে গেলাম। এ কেমন ধারা নালিশ! বাঙালি মেয়ে মাত্রই তো শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজ পরে। দুরদানাও যদি পরে, তাহলে অন্যায় কোথায়! দুরদানা শাড়ি পরুক, সালোয়ার কামিজ পরুক সে তার ব্যাপার। লুলু, আমার অপরাধ কোথায়? এবার লুলু চিৎকার করে বলতে আরম্ভ করল, আপনি নিজে মজা মারার জন্য তাকে মেয়ে বানাবার ষড়যন্ত্র করছেন। আমি চাই দুরদানা সব সময়ে পুরুষ মানুষের মতো পোশাক পরবে। মেয়েমানুষের পোশাকে তাকে একবারও দেখতে চাইনে। আপনাকে এক্ষুনি কথা দিতে হবে, আপনি জীবনে কোনোদিন আর দুরদানার সঙ্গে মিশবেন না। দুরদানা সারাজীবন আমার এবং একমাত্র আমার থাকবে। আমাদের পুরুষ মানুষের প্রয়োজন নেই। আমরা দুজনই যথেষ্ট। আপনাকে আমার কথায় রাজি হতে হবে। নইলে এক্ষুনি জোরে চিৎকার দিয়ে লোকজন জড়ো করে জানিয়ে দেব, আপনি আমার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছেন। ভেবে দেখলাম এ মেয়ের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। লুলু যদি সত্যি সত্যি চিৎকার দেয় এবং বলে যে, আমি তার ওপর চড়াও হয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছি, তাই শুনে লোকজন ছুটে আসবে এবং সবাই তার কথা সত্যি বলে মেনে নেবে। আমি আল্লার নাম নিয়ে শপথ করে বললেও কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না। এই আপদ কি করে বিদায় করা যায়, চিন্তা করতে লাগলাম।
অগত্যা আমাকে বলতে হলো, লুলু আপনার কথা আমি মেনে নিলাম। আমি আর কোনোদিন দুরদানার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করব না এবং তার সঙ্গে সম্পর্কও রাখব না। লুলু বলল, মুখের কথায় চলবে না। আপনাকে স্ট্যাম্পে লিখে দিতে হবে। সে সত্যি সত্যি ব্যাগের ভেতর থেকে তিন টাকার স্ট্যাম্প বের করে আনল। আমি তার কথামতো লিখে দিলাম, আমি অমুকের পুত্র জাহিদ হাসান এই মর্মে অঙ্গীকার করিতেছি যে, জীবনে দুরদানা নাম্নী মহিলার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করিব না এবং কোনো প্রকার সম্পর্কও রাখিব না। আমার কাছ থেকে সই আদায় করে কল্পনা আখতার লুলু গমিত হলো। কিন্তু আমি একটা বড় ধাক্কা খেলাম। দুরদানা কি সমকামী?
.
০৭.
মাঝখানে বেশ কিছুদিন আমার সঙ্গে দুরদানার দেখা হয়নি। তার ছোট বোনের শরীর খারাপ যাচ্ছিল। তাই নিয়ে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। আমি তার বাড়িতে একখানা পোস্টকার্ড লিখে চৌদ্দ তারিখ সন্ধ্যেবেলা উয়ারিতে খানে খানানের বাড়িতে খাওয়ার নিমন্ত্রণের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। আসলে আমাদের বন্ধুটির নাম আব্দুর রহিম খান। তার দরাজ দিলের পরিচয় পেয়ে খানকে খানেখানান করে নিয়েছিলাম।। আকবরের নওরতনের একজন ছিলেন খানে খানান।
দুরদানা সাড়ে পাঁচটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির। সে সবসময় ঘড়ির নির্দেশ মেনে চলে। যদি পাঁচটায় আসবে বলে, সব সময় লক্ষ্য রাখে সেটা যেন পাঁচটা পাঁচ মিনিটে না গড়ায়। সাইকেলের চাবিটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বলল, জাহিদ ভাই, আজ রাতে সাইকেলটা আপনার এখানে থাকবে। কাল ক্লাস করতে এলে নিয়ে যাব। উয়ারি থেকে আসার পথে আপনি আমাকে বেবি ট্যাক্সিতে নাখালপাড়া অবধি পৌঁছে দেবেন। বেশ কিছুদিন থেকেই আমার মনটা খচ খচ করছিল। দুরদানার সঙ্গে দেখা হয় নি তাই সুযোগ হয় নি জেনে নেয়ার । আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, তুমি কল্পনা আখতার লুলু বলে কোনো মেয়েকে চেন? দুরদানা জবাব দিল, চিনব না কেন! আপনার সঙ্গে তার দেখা হলো কোথায়? বললাম, সে হোস্টেলে এসেছিল এবং অনেক আজেবাজে কথা বলে গিয়েছে। প্রথমে সে অবাক হওয়ার ভঙ্গি করল। তারপর রেগে গেল। পকেট থেকে প্যাকেট বের করে লাইটার জ্বালিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। একটা লম্বা টান দিয়ে ধোয়া ছেড়ে বলল, শালীর সাহস তো কম নয়। সে আপনাকে পর্যন্ত বিব্রত করতে ছুটে এসেছে। জানেন জাহিদ ভাই, মেয়েটি আমাকে অস্থির করে তুলেছে। একথা বলতে গিয়ে দুরদানা ফিক করে হেসে ফেলল। আমার যত ছেলে বন্ধু আছে সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে এসেছে, খবরদার, তোমরা দুরদানার সঙ্গে মিশবে না। দুরদানা আমার বর।
দুরদানার সঙ্গে কোনোদিন আমার এ ধরনের কথাবার্তা হয়নি। তার সম্পর্কে আমার মনে যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল, তাতে হাতুড়ির আঘাত লাগছিল এবং একটু একটু করে বার্নিশ ঝরছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি বলতে পার, লুলু যা বলেছে তাতে কোনোরকম সত্যের স্পর্শ নেই? আমার কথা শুনে দুরদানা কাঁধ আঁকালো, তারপর বলল, আমাকে শার্ট-প্যান্ট পরা দেখে কোনো মেয়ে যদি মনে করে আমি তার ইয়ে, শুনতে তো আমার বেশ লাগে। কথাগুলো হজম করতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। সেটা দুরদানার দৃষ্টি এড়ালো না। বলল, জাহিদ ভাই, আপনি আচাভুয়ো ধরনের মানুষ। সংসার অনেক জটিল। এখানে কত ধরনের মানুষ । সেসব ভেবে আর কি হবে। নিন, কাপড়-চোপড় পরে নিন। সন্ধ্যে হয়ে এল। তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে কাপড়-চোপড় পরতে লাগলাম।
সারা পথে দুরদানার সঙ্গে আমার একটিও কথা হয়নি। খানে খানানের বাড়ি এসে যখন পৌঁছুলাম, আকাশে নিবিড় করে মেঘ জমেছে। ঘন ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। খানে খানান দরজা খুলে দিয়ে খুশিতে একরকম নেচে উঠে বলল, দেখছ তো আসমানের অবস্থা। একটু পরেই বিষ্টি নামবে। আমার কাছে বিসমিল্লাহ খানের মিয়া কি মল্লার এবং মেঘ মল্লার রাগের শানাইয়ের রেকর্ড দুটোই আছে। এখনই শানাই শোনার উপযুক্ত সময়। কাজের লোকটা চা দিয়ে গেল। সে রেকর্ড এবং প্লেয়ার আনতে ভিতরে গেল। আকাশ ভেঙে বর্ষা নেমে এল। খানে খানান প্লেয়ারে রেকর্ড চাপিয়ে দিল। সে বলল, আমরা রেকর্ড শুনতে শুনতে অন্য সবাই এসে পড়বে।
খানে খানান হলো সেই ধরনের মানুষ, নিজেকে অন্যদের কাছে জাহির করে যৌন পুলকের মতো এক ধরনের নিবিড় আনন্দ অনুভব করে। সে বিসমিল্লাহর রেকর্ড কিনেছে নিজের গভীর পিপাসা মেটাবার জন্যে নয়, অন্যেরা বলবে, খানে খানান ছেলেটা বেশ রুচিবান, বিসমিল্লাহর শানাই সে নিয়মিত শোনে- এই জন্যে। খানে খানানের সবকিছুই এ ধরনের। আজ সন্ধ্যেয় দুরদানাকে নিমন্ত্রণ করে আনার মধ্যেও যে এ ধরনের একটা সঁক দেখানোর ব্যাপার আছে, সেটা ক্রমাগত টের পেতে আরম্ভ করেছি। দুরদানা বাংলাদেশে ভীষণ আলোচিত মহিলা। তাকে নিয়ে ফাজিল কলাম লেখকেরা রবিবাসরীয় সংখ্যায় আজেবাজে ফিচার লেখে। কেউ কেউ অবশ্য ভাল কথাও লিখে থাকে। সবকিছু মিলিয়ে দুরদানার একটা ভাবমূর্তি দাঁড়িয়ে গেছে। সেই জিনিসটি খানে খানানের বন্ধু-বান্ধবের কাছে জানান দেয়ার জন্যই আজকের এই আয়োজন। দুরদানাই আজকের নিমন্ত্রণের প্রধান উপলক্ষ। আমি ফাউ ছাড়া কিছু নই। যেহেতু একা নিমন্ত্রণ করলে দুরদানা আসবে না, তাই আমাকেও ডাকা হয়েছে। আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঘরের ভেতর বিসমিল্লাহর শানাইতে মেঘমল্লার বেজে চলেছে। নিসর্গের সঙ্গীত ধারার সঙ্গে বিসমিল্লাহর শানাইয়ের সুর মিলেমিশে কী অপূর্ব মায়ালোকের জাদু রচনা করে যাচ্ছে। আমি দুচোখ বন্ধ করে আছি। সুরের সূক্ষ্ম কারুকাজের প্রতিটি মোচড় আমার ভেতরের গোপন দরজা একটা একটা করে খুলে দিচ্ছে। মুহূর্তেই আমি অপার্থিব জগতের বাসিন্দা হয়ে গেলাম। জগতে এত সুন্দর জিনিস আছে! অকারণে আমার দু’চোখ ঠেলে পানি বেরিয়ে আসতে চাইছে। আহা, কতদিন এমন হৃদয় দ্রাবক বাজনা শুনি নি! খানে খানান দুরদানার সঙ্গে বকর বকর করছে। বিসমিল্লাহ খানের শানাই, আকাশে তুমুল বৃষ্টি আর এদিকে বাড়িতে রান্না হচ্ছে খিচুড়ির সঙ্গে হাঁসের ভুনা মাংস। সবকিছুর এক আশ্চর্য মনিকাঞ্চন সংযোগ। তার বন্ধুবান্ধব যারা আসবে, তাদেরও কেউ ফ্যালনা মানুষ নয়। ধানমণ্ডি থেকে আসবে মনসুর। তার বাবা লয়েড ব্যাংকের জিএম। আর আসছে বনানী থেকে মেহবুব। সে আগামী সপ্তাহে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্যে আচমকা চলে যাচ্ছে। আসবে জুম্মন খাঁ, বাংলাদেশী পপ গানের রাজা। গান গেয়ে জুম্মন শহর-বন্দর মাত করে ফেলেছে। এমনি করে খানে খানান সম্ভাব্য অতিথিদের নাম বলে নিজে উদ্দীপিত হয়ে উঠছিল এবং আমাদেরও তাক লাগিয়ে দিল। এক জায়গায় আটকে গিয়ে ঘ্যার-ঘ্যার আওয়াজ করতে লাগল। পিনটা সঞ্চালিত হচ্ছিল না। আমি খানে খানানকে ডেকে বললাম, দোস্ত, এরকম ঘ্যার-ঘ্যার আওয়াজ আসছে কেন? সে বলল, রেকর্ডারটার এক জায়গায় ফাটা আছে। সেখানটায় আটকে গিয়েছে। দাঁড়াও বদলে দিই।
ঠিক এই সময় আমরা বাইর থেকে দরজা-জানলায় প্রচণ্ড ধাক্কানোর আওয়াজ শুনতে পেলাম। ভেতরের ঘরে বসে আছি। তবু একসঙ্গে অনেক মানুষের গলার আওয়াজ এবং চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। এমন বিশ্রী সব গালাগাল করছে, শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়। খানে খানান দ্রুত দরজার দিকে উঠে গেল এবং ফাটা রেকর্ডটা সেই একই জায়গায় ক্যার ক্যার শব্দ তুলে ঘুরতে লাগল। না আমি, না দুরদানা- কেউই প্লেয়ারটা বন্ধ করে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না। খানে খানানের সঙ্গে বাইরের লোকজনের তখন উত্তপ্ত বাদানুবাদ চলছে। সব কথা আমাদের কানে আসছে।
কিছুক্ষণ পর খানে খানান ঘরে ঢুকে ফিসফিস করে বলল, দোস্ত, মস্তবড় মুসিবত। ভয়ে তার মুখমণ্ডল ফ্যাকাসে। ঠিকমতো আওয়াজ বের হচ্ছিল না। সে ফিসফিস করে কখনো থেমে, কখনো তুতলিয়ে যা বলল, তার অর্থ দাঁড়ায় এরকম: গত বছর দুরদানা এই পাড়ার পিন্ধু নামের একটা ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পিটিয়েছিল। সেই ছেলেটাই আমার সঙ্গে দুরদানাকে এই বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে। টিঙ্কু অনেক লোকজন নিয়ে এসে বাড়ি ঘেরাও করেছে। তারা বলছে, তাদের হাতে দুরদানাকে তুলে দিতে হবে। নইলে দরজা ভেঙে তারা ঘরে ঢুকবে এবং দুরদানাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। সে কাঁপতে কাঁপতে বলল, আমি বলেছি, তোমরা এসেছিলে, কিন্তু চলে গিয়েছ। যদি ঘরে ঢুকে তোমাদের পায়, দুরদানাকে তো নিয়ে যাবেই, আবার ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে আস্ত রাখবে না। এখন উপায়?
এটা নতুন নয়। এরকম বহু অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। আমরা দুজন চুপচাপ কাউকে কিছু না বলে পেছন দিককার কিচেনের পাশের দরজাটা খুলে দু বাড়ির সীমানা-দেয়ালের মধ্যবর্তী আধ হাত প্রস্থ সরু পথ ধরে যতটা সম্ভব দ্রুত অগ্রসর হতে থাকলাম। পথটা পার হয়ে বড় রাস্তায় এসে পড়লাম। তুমুল বর্ষার কারণে রাস্তায় মানুষজন ছিল না। সেটা আমাদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। অনেকটা পথ পার হয়ে বলধা গার্ডেনের সামনে এসে যখন একটা খালি রিকশায় উঠে বসলাম, তক্ষুনি ধারণা জন্মালো আমরা এবারের মতো বেঁচে যেতে পেরেছি।
রিকশায় উঠেই প্রথম টের পেলাম আমাদের পরনের কাপড়চোপড়ের সব ভিজে চুপসে গেছে। দুরদানার দিকে তাকানোর উপায় ছিল না। তার জামা দ্বিতীয় চামড়ার মতো বুকের সঙ্গে একসা হয়ে লেগে রয়েছে। স্তন দুটো ফুটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমার কেমন লজ্জা লাগছিল। বৃষ্টি হচ্ছিল আর সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া দিচ্ছিল। অকাল বৃষ্টি। ভীষণ শীত লাগছিল। হঠাৎ করে আমি একটা কাজ করে বসলাম। দুরদানার মুখটা নিজের কাছে টেনে এনে চুমু দিতে লাগলাম। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামছে। শোঁ-শোঁ হাওয়া বইছে। এমন জোরে বইছে যে, মাঝে মাঝে রিকশাসুদ্ধ আমাদের উড়িয়ে নিতে চাইছে। আমার মনে হলো, সব মিথ্যে, বৃষ্টি মিথ্যে, হাওয়ার বেগ মিথ্যে। কেবল এই চুমুটাই সত্যি। আমি জানতাম না দুরদানাকে চুমো দেয়ার আকাক্ষা আমি কতদিন থেকে রক্তের ভেতর লালন করে আসছিলাম। যেহেতু আমার দুরদানার মুখ চুম্বন করতে হবে, সেজন্যেই খানে খানানের বাড়িতে টিঙ্কু দলেবলে হামলা করেছিল। আমাদের জন্যই এমন প্রবল বেগে হাওয়া বইছে, এমন মুষলধারে বিষ্টি পড়ছে। এই বজ্র-বিদ্যুতে আঁকা বর্ষণমুখর রাতটা আমাদের।
রিকশাঅলাকে বাতাসের প্রতিকূলে যেতে হচ্ছিল। সেজন্য অত্যন্ত ধীরগতিতে সে এগোচ্ছিল। যত ইচ্ছে আস্তে যাক, দুরদানার নাখালপাড়ার বাড়িতে পৌঁছতে বাকি রাত কাবার হয়ে যাক, কিছু যায় আসে না। দুরদানা সরে এসে আমার আরো কাছ ঘেঁষে বসল। আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম। মাথার ভিজে চুলের গন্ধ নিলাম। এক সময়ে তার বুকে হাত রাখলাম। ভীত-সংকুচিত পায়রার ছানার মতো দুটো স্তন স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমি স্তন দুটো নিয়ে খেলা করতে আরম্ভ করলাম। আমার সমস্ত চেতনা তার স্তন যুগলের ওঠা-নামাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল। এই তুরীয় অবস্থার মধ্যেও একটা জিনিস আমার কাছে ধরা পড়ল। দুরদানার বাম স্তন ডানটির তুলনায় অনেক পরিমাণে ছোট। আমার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকল, এ কেমন করে হলো! বাম স্তনটা ছোট কেন? তারপর আরেকটা প্রশ্ন জন্ম নিল। দুরদানার বাম স্তনটা দৃষ্টির আড়াল করার জন্যেই কি সে এমন আঁটোসাঁটো শার্ট পরে বুকটা চেপে রাখে।
এই সময় রাস্তার লাইট চলে গেল। দুরদানা বাচ্চা মেয়ের মতো আমার কাঁধের ওপর তার মাথাটা রেখে ফিসফিস করে বলল, জাহিদ ভাই, আমার খুব খারাপ লাগছে। পিরিয়ড শুরু হয়েছে। এখন ভীষণ ব্লিডিং হচ্ছে। গুলিস্তানে গিয়ে একটা বেবি ট্যাক্সি ধরবেন। তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়া প্রয়োজন । আমার ভেতরে বিস্ফোরণ শুরু হয়ে গেল। দুরদানারও তাহলে পিরিয়ড হয়! তার শরীর থেকে তীব্র বেগে রক্ত ধারা নির্গত হয়! দুরদানা আরেকটা চেহারা নিয়ে আমার কাছে ধরা দিতে আরম্ভ করেছে। অ-মেয়েমানুষ দুরদানা এতদিন আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তার মেয়েমানুষী পরিচয় বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি ভেতরে ভেতরে একরকম শঙ্কিত হয়ে উঠলাম । একে নিয়ে আমি কি করব? একে তো কোনোদিন ভালোবাসতে পারব না। গুলিস্তানে এসে একটা স্কুটারে চাপিয়ে তাকে নাখালপাড়া রেখে এলাম।
.
০৮.
মাস তিনেক পর। একরাতে ঘুমিয়ে আছি হোস্টেলে একটা লোক এসে সংবাদ দিয়ে গেল রাজাবাজারের বাসার কাছে কে-বা-কারা হুমায়ুনকে গুলি করে খুন করে গেছে। তাকে দেখার জন্য তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ছুটলাম। আমি যখন গিয়েছি তখন সব শেষ। হুমায়ুনকে বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। নিথর নিস্তব্ধ। মাথার বাঁ-দিকটা একটা বড়সড় আমের মতো ফুলে উঠেছে। আমার বুকটা জ্বালা করছিল। হুমায়ুনের বউটার একটা বাচ্চা হয়েছে, তিন মাসও হয়নি। আমি কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। হাসপাতালেই কান্নাকাটির ধুম লেগে গিয়েছিল। তার বউ ক্ষণে ক্ষণে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলছিল।
আমার বন্ধু হাবিবুল্লা আমাকে একপাশে টেনে নিয়ে কানে কানে বলল, জাহিদ ভাই, আপনি এখান থেকে তাড়াতাড়ি কোথাও চলে যান। একটু পরেই কে খুন করেছে তাই নিয়ে জল্পনাকল্পনা শুরু হবে। সবাই আপনাকে দায়ী করতে চেষ্টা করবে। কারণ ইউনুস জোয়ারদারের গ্রুপের সঙ্গে হুমায়ুনদের গ্রুপের অনেকদিন থেকে রাজনৈতিক শত্রুতা চলছে। হুমায়ুনকে নিশ্চয়ই ইউনুস জোয়ারদারের লোকেরাই খুন করেছে। আমার চট করে মনে পড়ে গেল, হুমায়ুন আমাকে হাজি শাহবাজের মসজিদের পাশে একদিন বিকেলবেলা ডেকে নিয়ে দুরদানার সঙ্গে মেলামেশা করতে বারণ করেছিল আমি তার কথায় রাজি না হওয়ায় একটা পিস্তল বের করে আমাকে খুন করার ভয় দেখিয়েছিল। আমি ভয় পেতে রাজি না হওয়ায় হুমায়ুন ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেছিল। হায়রে হুমায়ুন, তুমি এমন করুণভাবে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছ! হুমায়ুনের মৃত্যুর পর থেকে মজিদ মামা, যিনি সব সময় ছোট ছোট পানের খিলি মুখে পুরে দিতেন, সাইকেলে যাওয়া-আসা করতেন, আর কোনোদিন তার দেখা পাওয়া যায় নি।
.
প্রিয় সোহিনী, দুরদানার গল্পটা এরকমভাবে শেষ হয়েছে। তুমি খুব অবাক হচ্ছ, না ? অমন জমজমাট একটা সম্পর্ক, বলা নেই, কওয়া নেই আপনা থেকেই ছেদ পড়ে গেল! কিন্তু তার ভেতরের কাহিনী তোমার কাছে খুলে বলতে চাই। দুরদানা এবং আমি দুজনাই অনুভব করেছিলাম, আমাদের ভেতরকার তাজা সম্পর্কটা আপনা থেকেই মরে যাচ্ছে। গাছের একটা ডাল যেমন করে শুকিয়ে যায়, প্রক্রিয়াটা অনেকটা সেরকম। আমরা দুজনাই অনুভব করছিলাম যে আমাদের ভেতরে সম্পর্কের মধ্যে সেই সজীব রাসায়নিক পদার্থের ঘাটতি পড়তে শুরু করেছে। এখনো দুরদানা প্রায়ই আমার ঘরে আসে। তার সাইকেলের পেছনে চেপে আমি নানা জায়গায় যাই। মানুষ নানারকম অশ্লীল মন্তব্য ছুঁড়ে মারে, এসব আমার মন্দ লাগে না। একবার লালমাটিয়ার কাছে চারজন যুবক দুরদানাকে সাইকেল থেকে নামতে বাধ্য করে। আমাকেও বাধ্য হয়ে নামতে হয়। তারা দুরদানাকে কিছুই বলল না, কেবল আমাকে রাস্তার একপাশে নিয়ে গিয়ে আচ্ছা করে পিটিয়ে দিল। তাদের একজন বলল, হারামজাদা, হিজরার বাচ্চা, নুনু কাইটা তুতে লাগিয়ে দিমু। একজন মাগির পেছনে সাইকেল চেপে বেড়াতে শরম করে না? তারা সত্যি সত্যি আমার শরীর থেকে প্যান্ট খুলে নিয়ে উলঙ্গ করে রাস্তায় ছেড়ে দেয়ার জন্যে টানাটানি করছিল। ভাগ্যিস পুলিশ এসে পড়েছিল, তাই রক্ষে।
.
সেদিন একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। ঠিক করলাম, আর দুরদানার সাইকেলের পেছনে চাপব না। দুরদানাও তারপর থেকে আমাকে সাইকেলের পেছনে চাপতে বলে নি। তা সত্ত্বেও দুরদানা আমার কাছে আসত, আমি দুরদানার কাছে যেতাম। এটা একটা পুরনো অভ্যেসের জের। ট্রেনের ইঞ্জিন বন্ধ করার পরেও যেমন অন্তর্গত বেগের ধাক্কায় কিছুদূর পর্যন্ত সচল থাকে, এও ঠিক তেমনি। আমাকে দেখে দুরদানার চোখের তারা নেচে উঠত না। আমিও দুরদানাকে দেখে অস্তিত্বের গহনে সেই সজীব রাসায়নিক শক্তির প্রতিক্রিয়া অনুভব করতাম না।
কী একটা শক্তি আমাদের দুজনের হাত ধরে দৃঢ়ভাবে পরস্পরের বিপরীত দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল। এই শক্তিটাকে ইতিহাস বলব, না মহাকাল বলব, এখনো স্থির করতে পারি নি। আমাদের জীবনের ভেতর দিয়ে মহাকাল কীভাবে কাজ করে, তার বিবরণ হাজির করতে চেষ্টা করব এখানে।
হুমায়ুন খুন হওয়ার পর চারদিকে একটা জনরব উঠল যে, ইউনুস জোয়ারদারের লোকেরাই তাকে খুন করেছে। হুমায়ুন যে গোপন রাজনীতির সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল, সে বিষয়ে আমার সামান্যতম ধারণাও ছিল না। হুমায়ুন যেসব কথা আমাকে বলত, যে ধরনের অস্থিরতা অনুভব করত, সেসবের অর্থ আমার কাছে এখন জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। লোকজনকে আরো বলাবলি করতে শুনলাম, হুমায়ুনের গ্রুপ একবার মাঝখানে ইউনুস জোয়ারদারের প্রাণের ওপর হামলা করেছিল, তার বদলা স্বরূপ জোয়ারদারের গ্রুপ হুমায়ুনের প্রাণটা নিয়ে নিল। হুমায়ুনের খুন হওয়ার পর মানুষজন নানারকম রটনা করতে আরম্ভ করল। কেউ কেউ বলল, যেহেতু দুরদানার সঙ্গে আমার একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তাই হুমায়ুনের খুন হওয়ার পেছনে আমারও একটা গোপন ভূমিকা ছিল। এই অভিযোগ আর কেউ নয়, উত্থাপন করলেন শিক্ষক শফিকুল ইসলাম। ব্যতিক্রমী মহিলাদের শফিক সাহেব তার নিজের উদ্যানের ফল বলে মনে করতেন। আমার মতো একজন গাঁও-গেরামের মানুষ, একটা চিতাবাঘিনী চরিয়ে বেড়াবে, শফিক সাহেব এটা কিছুতেই মেনে নেন নি। তিনি মনে করতেন, তার ব্যক্তিগত জমিতে আমি বেড়া ভেঙে প্রবেশ করে অনধিকার চর্চা করছি। তিনি কখনো আমাকে ক্ষমা করতে পারেন নি। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর শফিক সাহেব বলে বেড়াতে থাকলেন, আমি হুমায়ুনের বিধবা বউকে বিয়ে করার জন্যেই তাকে খুন করেছি। তিনি ছিলেন সরকারি দলের লোক। অনেক মানুষ তার কথা বিশ্বাস করে ফেললেন। আমার যাওয়া-আসার পথে মানুষজন আমার দিকে আঙুল তুলে দেখাতে আরম্ভ করল। সত্যি সত্যি আমিই হুমায়ুনকে খুন করেছি কি না, এমন একটা সংশয় আমার ভেতরেও জন্ম নিতে আরম্ভ করল। খুনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও আমি নিজেকে খুনি ভাবতে আরম্ভ করলাম। মানুষ তো নিজের অজান্তেও অনেক জঘন্য অপরাধ করে বসে। সমস্ত ধর্মতো পাপবোধের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। যেহেতু মানুষ হিসেবে তোমাকে জন্ম নিতে হয়েছে, তুমি পাপী।
এই সময় একদিন আরেক ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে আমার হোস্টেলে দর্শন দিলেন সেই এসবি-র ইউনুস মোল্লা। ইউনুস মোল্লা নিজেকে মনে করতেন ইউনুস জোয়ারদারের মিতা। এই মিতার সম্পর্কে অল্পস্বল্প সংবাদ জানার জন্যেই আমার কাছে আসতেন। তিনি বলতেন, যেহেতু নামে নামে মিলে গেছে, তাই মিতার সম্পর্কে জানার অধিকার তার আছে। আজ মোল্লা সাহেবের নতুন চেহারা দেখলাম। তিনি কোনোরকম ভণিতা না করেই জানালেন, আমাকে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে মালিবাগ স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসে যেতে হবে। না, ভয়ের কোনো কারণ নেই, এই যাব আর আসব। শুধু তারা আমার কাছ থেকে কিছু সংবাদ জানতে চান। পুরো দুমাস ধরে আমাকে স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসে যেতে হলো এবং আসতে হলো। কতরকম জেরার সম্মুখীন যে হতে হয়েছিল, সে কথা বয়ান করে লাভ নেই। ওই পরিস্থিতিতে দুরদানার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো । এছাড়া সে কোথায় যেন আত্মগোপন করল, কিছুই জানতে পারলাম না। মহাকালের খাড়ার আঘাতে আমরা পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম।
জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ হবে। ইংরেজি কাগজের প্রথম পাতায় টুকরো একটা খবর পড়ে আমি চমকে উঠলাম। ইউনুস জোয়ারদার শট ডেড। এক কোণায় ইউনুস জোয়ারদারের একটা ঝাঁপসা ছবি ছাপা হয়েছে। আমি নিজের চোখে কোনোদিন ইউনুস জোয়ারদারকে দেখি নি। এই ঝাঁপসা ছবিটার দিকে তাকানো মাত্রই আমার বুকে মমতার ঢেউ উথলে উঠল । কি কারণে বলতে পারব না, আমি মনে করতে আরম্ভ করলাম, ইউনুস জোয়ারদার আমার ভাই, আমার বন্ধু, আমার সন্তান। তার মৃত্যু-সংবাদে আমার চোখের সামনেকার গোটা পৃথিবীটা দুলে উঠল। তিনি আমার কেউ নন। তার দলের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তবু আমার মনে হলো, আমার দু’চোখের দৃষ্টি নিভে গেছে। নিশ্বাস নিতে ভয়ানক কষ্ট হচ্ছিল। এই অবস্থায় দুদিন পায়ে হেঁটে একা একা ঢাকা শহরের পথে পথে ঘুরে বেরিয়েছি। ইউনুস জোয়ারদার কোন জাদুমন্ত্র বলে, জানিনে, আমার ভেতরে অনাগত পৃথিবীর যে স্বপ্ন জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, তার মৃত্যুতে সেই পৃথিবীটাই ছারখার হয়ে গেল। আমি কেন বেঁচে থাকব! কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কারো কাছে প্রকাশ করে মনোবেদনা হালকা করব, সে উপায়ও নেই। কে শুনবে আমি শোকভর্তি একটা জাহাজের মতো ঢাকা শহরে অনবরত পথ হাঁটছিলাম। তিনদিন পর গলগল করে রক্তবমি করলাম এবং তিন মাসের জন্যে আমাকে হাসপাতালে স্থায়ী ডেরা পাততে হলো। কী করে যে বেঁচে ফিরে এসেছি, সেটা আমার কাছে এখনো অবিশ্বাস্য ব্যাপার মনে হয়।
প্রিয় সোহিনী, ইউনুস জোয়ারদার খুন হওয়ার এক বছর না যেতেই একদিন রেডিওতে ঘোষণা শুনলাম, দেশের রাষ্ট্রপতি, বাংলার নয়নমণি মুজিব সপরিবারে আততায়ীদের হাতে খুন হয়েছেন। প্রিয় সোহিনী, নীল নির্মেঘ আকাশ থেকে আমার মাথায় কে যেন একটা তাজা ব ছুঁড়ে দিল। প্রিয় সোহিনী, আমি এক অভাগা, কেবল দুঃখের গাথা লেখার জন্যেই যেন আমার জন্ম।
মহাকালের খাঁড়া আমার আর দুরদানার সম্পর্কই শুধু নষ্ট করে নি, এই খাঁড়া ঝলসে উঠে হুমায়ুনকে নিরস্তিত্ব করেছে, ইউনুস জোয়ারদারের গর্দান নিয়েছে, সপরিবারে শেখ মুজিবকে পরপারে পাঠিয়ে দিয়েছে। হুমায়ুন জোয়ারদারকে খুন করতে চাইলে, জোয়ারদার হুমায়ুনকে খুন করে বদলা নিলেন। শেখ মুজিব জোয়ারদারকে হত্যা করলেন। সেনাবাহিনীর জওয়ানরা শেখকে খুন করল। জিয়া, তাহের, খালেদ মোশাররফ, মঞ্জুর- কাকে কার হত্যাকারী বলব? আমি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি, মহাকালের খাঁড়ার আঘাতে তাদের একেকজনের মুণ্ডু ভাদুরে তালের মতো গড়িয়ে পড়ল। আমি কাকে কার বিরুদ্ধে অপরাধী বলে শনাক্ত করব? এঁরা সবাই দেশপ্রেমিক, সবাই স্বাধীনতা সংগ্রামী। জননী স্বাধীনতা মহাকালের রূপ ধরে আপন সন্তানের মুণ্ড নিয়ে গেণ্ডুয়া খেলতে আরম্ভ করেছে। প্রিয় সোহিনী, কার অপরাধ একথা জিজ্ঞেস করবে না। আমরা সবাই শরীরের রক্ত-প্রবাহের মধ্যে ঐতিহাসিক পাপের জীবাণু বয়ে বেড়াচ্ছি। সেই ইতিহাস প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। আমরা কেমন যুগে, কেমন দেশে জন্মগ্রহণ করেছি, ভাবো একবার!
প্রিয় সোহিনী, এরপর তুমি দুরদানা সম্পর্কে প্রশ্ন করে আমাকে বিব্রত করবে না আশা করি। তবু তোমার কৌতূহল দূর করার জন্য বলব, সে এই ঢাকা শহরেই আছে। তার স্বামী-সংসার আছে, ছেলেমেয়ে আছে। চাকরিবাকরি করে। অবশ্য অনেক আগে সাইকেল চালানো ছেড়ে দিয়েছে। এখন নিজের হাতে গাড়ি চালায়। এসব মামুলি সংবাদে আর কাজ কি? তবু আমি অকপটে বলব, দুরদানার কাছে আমার ঋণের পরিমাণ সামান্য নয়। তার স্পর্শেই আমি ইতিহাসের মধ্যে জেগে উঠতে পেরেছি। এ সামান্য ব্যাপার নয়। সব মানুষ জীবন ধারণ করে। কিন্তু ইতিহাসের স্পর্শ অনুভব করে না। আশা করি, এই ব্যাপারটাকে তুমি প্রকৃত গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করতে চেষ্টা করবে। দুরদানার প্রতি কোনোরকম সন্দেহ-সংশয় মনের কোঠায় এক পলকের জন্যও ঠাই দেবে না। এই যে আমি তোমার অভিমুখে যাচ্ছি দুরদানা হচ্ছে তার প্রথম মাইলফলক। দুরদানা একা নয়, আরো অনেক নারীর জীবন আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাদের সবার কথা আমাকে তোমার কাছে বলতে হবে। নইলে আমি তোমার দিকে যাওয়ার শক্তি এবং নির্ভরতা অর্জন করতে পারব না। আগেই বলেছি, কাজটা কঠিন, খুবই কঠিন। পাঁজরে পাঁজরে আঘাত করে অস্তিত্বের ভেতর থেকে নিমজ্জিত নারীদের তুলে আনতে হচ্ছে। প্রিয়তমা আমার, সুন্দরী আমার, তুমি আমাকে এই দুঃসাধ্য দায়িত্ব সম্পাদনের সাহস দিয়েছ, প্রেরণা দিয়েছ। তুমি আমার ভবিষ্যৎ। আমার ভবিষ্যৎ আছে বলেই আমি অতীতকে আবিষ্কার করতে পারছি। যদি তোমাকে ভাল না বাসতাম, এই কাহিনী কোনোদিন লিখতে পারতাম না। আমি নিজের কাছে নিজে শুদ্ধ হয়ে ওঠার তাগিদেই আমার জীবনের নারীদের কথা বয়ান করে যাচ্ছি। লক্ষ্মী আমার, প্রিয়তমা আমার, আমার জীবনে এত বিচিত্র ধরনের নারীর আনাগোনা দেখে আমাকে ঘৃণা করো না। মানুষ একজন মাত্র নারীকেই মনে-প্রাণে কামনা করে। আর সেই সম্পূর্ণ নারী জগতে মহামূল্যবান হীরক খণ্ডটির চাইতেও দুর্লভ। তাই খণ্ড-খণ্ড নারীকে নিয়েই মানুষকে সন্তুষ্ট থাকার ভান করতে হয়। তোমার মধ্যে একটা অখণ্ড নারীসত্তার সন্ধান আমি পেয়েছি। আমার কেমন জানি আশঙ্কা হয়, এই কাহিনী যখন আমি শেষ করব, তুমি হয়তো এই বিশাল পৃথিবীর কোথাও হারিয়ে যাবে। তবু আমার সুখ, আমার আনন্দ, আমার প্রাণের সমস্ত উত্তাপ কেন্দ্রীভূত করে একটি সম্পূর্ণ নারীকে আমি ভালোবাসতে পেরেছি। জীবনে ভালোবাসার চাইতে সুখ কিসে আছে?
.
০৯.
প্রিয় সোহিনী, মৃগনয়না আমার, এবার আমি তোমার কাছে কন্যা শামারোধের কাহিনী বয়ান করতে যাচ্ছি। একটুখানি চমকে উঠছ, না? ভাবছ, শামারোখের নামের সঙ্গে হঠাৎ করে কন্যা শব্দটি যোগ করলাম কেন? কারণ তো একটা অবশ্যই আছে। সেই কারণ ব্যাখ্যা দাবি করে। শামায়োখের সঙ্গে আমার পরিচয় হওয়ার অন্তত বারো বছর আগে তার কুমারী জীবনের অবসান ঘটেছে। আর আট বছর আগে স্বামীর কাছে একটি পুত্র সন্তান রেখে দাম্পত্য সম্পর্কের ছেদ টেনে বেরিয়ে এসেছে। এই বেরিয়ে আসা জীবনে তার হৃদয়ের স্বল্পকালীন, দীর্ঘকালীন নানা অগ্ন্যুৎপাতের সংবাদও আমি বিলক্ষণ জানি। সুন্দরী মহিলাদের নামের সঙ্গে যখন হৃদয়ঘটিত অপবাদ যুক্ত হয়, তখন তাদের সৌন্দর্য এবং আকর্ষণ ক্ষমতা অনেক অনেক গুণে বেড়ে যায়। নীতিবাগীশেরা শামায়োখের জীবনের অতীত বৃত্তান্ত বিশ্লেষণ করে নানান দাগে দাগী হিসেবে তাকে চিহ্নিত করবে, সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমি যখন তাকে প্রথম দেখি, আমার মনে হয়েছিল, সৃষ্টির প্রথম নারীর সান্নিধ্যে এসে দণ্ডায়মান হয়েছি। এই অপূর্ব সৌন্দর্যময়ী আমাকে দিয়ে যা-ইচ্ছে-তাই করিয়ে নিতে পারে। তার একটি কটাক্ষে আমি মানব সমাজের বিধিবিধান লংঘন করতে পারি। শামারোখকে প্রথমবার দর্শন করার পর আমার যে অনুভূতি হয়েছিল প্রকাশ করার জন্যে আমাকে কবির শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। কবিরা ভাল মানুষ। আমরা অনেক সময় মনের ভেতর ঘাই-মারা অনুভূতি প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পাইনে, কবিরা আমাদের মতো অক্ষম মানুষদের কথা চিন্তা করে আগেভাগে সেসব সুন্দরভাবে প্রকাশ করে রেখেছেন। প্রয়োজনীয় মুহূর্তে রেডিমেড জামা-কাপড়ের মতো সেগুলো আমরা ব্যবহার করতে পারি। শামায়োখকে প্রথম দেখার পর আমার মনে এই পঙক্তিগুলো বিদ্যুতের মতো চমক দিয়ে জেগে উঠেছিল:
‘ষষ্ঠ দিন শ্রম অন্তে প্রভু,
অপূর্ব বিস্ময় ভরে করে উচ্চারণ
পরবর্তী সৃষ্টি হবে দিব্যি অনুপম।
তখনই ডাগর আঁখি মেলেছে নন্দিনী
মরি, মরি দৃষ্টি হেরি,
আপন অন্তর তলে বিধাতাও
উঠেছে শিহরি।’
সেই সৌন্দর্য দেখার পর স্বয়ং স্রষ্টা মহাশয়কেও নিজের হৃদয়-গভীরে শিউরে উঠতে হয়। সেই একই স্বর্গজাত সৌন্দর্যের প্রতি তাজিমের নিদর্শনস্বরূপ শামারোধের নামের সঙ্গে কন্যা শব্দটি যোগ করলাম। প্রিয় সোহিনী, এই ‘কন্যা’ শব্দটি যুক্ত করে আমি মস্ত বিপাকে পড়ে গেলাম। তুমি প্রশ্ন করবে, যে মহিলা স্বামী-পুত্র ছেড়ে বেরিয়ে আসে, যেখানে-সেখানে হৃদয়ের অগ্ন্যুৎপাত ঘটায়, তার কন্যাত্ব বহাল থাকে কেমন করে? আমি তর্ক করার মানুষ নই। তবু প্যাচালো বিতর্কে যাতে জড়িয়ে পড়তে না হয়, তাই সময় থাকতে বলে রাখতে চাই, কোনো কোনো নারী আছে যারা সবসময় কন্যাত্ব রক্ষা করে চলতে পারে। সন্তান জন্ম দিলে বা পুরুষ বদলালে তাদের কন্যা-জীবনের অবসান ঘটে না। প্রিয় সোহিনী, আমি ধরে নিচ্ছি, শামারোখ সম্বন্ধে তোমার মনে একটি সহানুভূতির ভাব সৃষ্টি হয়েছে, সুতরাং আমি নির্বিবাদে তার কাহিনীটা তোমার কাছে প্রকাশ করতে পারি। সুন্দরের প্রতি সহানুভূতি জিনিসটার একটা খারাপ দিক আছে। ইচ্ছে করলেও তাকে খারাপভাবে আঁকা সম্ভব হয় না। তাই, শামারোখ আসলে যা ছিল, আর আমি যা বয়ান করছি, তার মধ্যে একটা হেরফের থেকেই যাচ্ছে।
কন্যা শামারোধের সঙ্গে কিভাবে পরিচয় ঘটল, সে ঘটনাটি আমি তোমার কাছে তুলে ধরতে চাই। ঘটনা বললে সুবিচার করা হবে না। পেছনে একটা ইতিহাস আছে। সেটা বিবৃত করছি। একদিন বিকেলবেলা হোস্টেলে ঘুম থেকে উঠে স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। ঘুমের মধ্যে আমি মাকে স্বপ্নে দেখলাম। তিন মাস আগে মা মারা গেছেন। আমি তার একমাত্র ছেলে। মায়ের মৃত্যুর সময় আমি কাছে ছিলাম না । মৃত্যুর পর এই প্রথমবার তাকে স্বপ্নে দেখলাম। পুরো স্বপ্নটা অস্পষ্ট এবং ঝাঁপসা। বারবার একাগ্র মনোযোগে স্বপ্নটা জীবিত করার চেষ্টা করছি। এই সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলে দেখি ইংরেজি বিভাগের পিয়ন বাটুল। এই লম্বা লিকলিকে চেহারার তরুণটির নাম বাটুল কেন, আমি বলতে পারব না। যাহোক, সে আমাকে সালাম করার পর জানালো বিভাগের চেয়ারম্যান ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী আমাকে সালাম দিয়েছেন। অতএব, আমাকে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে আর্টস বিল্ডিংয়ের দোতলায় সালামের তত্ত্ব নিতে ছুটতে হলো।
আমি দরজা ঠেলে বিভাগীয় চেয়ারম্যান ড. শরিফুল ইসলামের অফিস ঘরে প্রবেশ করলাম। কারেন্ট নেই, পাখা চলছে না। বেশ গরম। ড. চৌধুরী জামার বোতাম খুলে ফেলেছেন। তার বুকের লম্বা লম্বা লোমলো দেখা যাচ্ছে। বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর ছড়ানো বই-পুস্তক। তিনি কিছু একটা লিখছিলেন। আমাকে দেখে হেসে উঠতে চেষ্টা করলেন। ড. চৌধুরীকে হাসতে দেখলে আমার একটা কথা মনে হয়। ভদ্রলোক ওই হাসিটা যেন দোকান থেকে কিনে এনেছেন। এমনিতে কৃষ্ণকান্তি, যখন গাম্ভীর্য অবলম্বন করেন, বেশ মানিয়ে যায়। কিন্তু তিনি যখন বড় দাঁতগুলো দেখিয়ে এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ তুলে হেসে ওঠেন, সেটাই। আমার কাছে ভয়ংকর বিদঘুঁটে মনে হয়।
আমার ভাগ্য ভাল বলতে হবে। হাসিটা অল্পের মধ্যেই তার প্রসারিত মুখগহ্বরের ভেতর কোথাও উধাও হয়ে গেল। তিনি একটু তোয়াজ করেই বললেন, বসো জাহিদ। পকেটে সিগারেট থাকলে খেতে পার। কোনোরকম সংকোচ করার প্রয়োজন নেই। আমি বাটুলকে চা আনতে বলেছি। আর পাঁচ-ছটা লাইন লিখলেই হাতের লেখাটা শেষ হয়ে যাবে।
আমি সিগারেট ধরালাম। তিনি লেখা শেষ করছেন। এরই মধ্যে বাটুল চা দিয়ে গেল। হাতের লেখা কাগজের স্লিপগুলো পিন দিয়ে গেঁথে একটা ফাইলের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলেন। ততক্ষণে পাখা চলতে আরম্ভ করেছে। তিনি গ্লাস থেকে পানি খেয়ে মন্তব্য করলেন, বাঁচা গেল। আজ সারাদিন যা গরম পড়েছে। তারপর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, তোমার চেয়ারটা একটু এদিকে নিয়ে এসো। আমি চেয়ারটা তার মুখোমুখি নিয়ে গেলাম। চা খাওয়া শেষ হলে তিনি জামার খুঁটে চশমার কাঁচ দুটো মুছে আমার দিকে ভাল করে তাকালেন। তারপর বললেন, তোমাকে একটা দুঃখের কথা বলতে ডেকে এনেছি। আমার শরীরে একটা আনন্দের লহরি খেলে গেল। তাহলে তিনি আমাকে তার ব্যক্তিগত দুঃখের কথা বলার উপযুক্ত মানুষ ধরে নিয়েছেন। নিজের কাছেই আমার মূল্য অনেকখানি বেড়ে গেল। কোনো সুন্দরী মহিলা যদি বলতেন, আমি তোমাকে ভালোবাসি, অতখানি খুশি হয়ে উঠতাম কি না সন্দেহ। ড. চৌধুরীর বুকের ভেতরে নিবিড় যত্নে পুষে রাখা দুঃখের কথাটা শোনার জন্যে অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম।
বাটুলকে ডেকে চায়ের খালি কাপ এবং গ্লাস নিয়ে যেতে বললেন। তারপর আমার দিকে তাকালেন, শোনো, তোমার গুরু আবুল হাসানাত সাহেবকে থামাও। তিনি আমাদের ডিপার্টমেন্টকে নষ্ট করে ফেলার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছেন। তার কথা শুনে আমি তো সাত হাত জলে পড়ে গেলাম। আবুল হাসানাত বুড়ো মানুষ। বেশ কিছুদিন আগে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে রিটায়ার্ড করেছেন। চিরকুমার। রান্নাবান্না, বাজার, দাবা এবং বই নিয়ে সময় কাটান। কারো সাতে-পাঁচে থাকেন না, তিনি কী করে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টকে নষ্ট করবেন। ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরীর অভিযোগটা আমার কাছে হেঁয়ালির মতো শোনালো। সত্যি সত্যিই বলছি, এরকম একটা কথা তার মুখ থেকে শুনব, তার জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। ড. চৌধুরীর কথার মধ্যে উত্তাপ ছিল, ঝাঁঝ ছিল। দেখতে পেলাম তার কালো মুখমণ্ডলটা লাল হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। আমি বুঝতেই পারছিলাম না, তিনি আবুল হাসানাত সাহেবের ওপর অতটা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন কেন? অবশেষে ড চৌধুরী আমার কাছে তার ক্ষোভ-দুঃখ এবং মনোকষ্টের আসল কারণটা খুলে বললেন। এই ঢাকা শহরে বীণা চ্যাটার্জির মতো এক সুন্দরী মহিলা এসেছে এবং এসেই মহিলা আবুল হাসানাত সাহেবের ঘাড়ের ওপর চেপে বসেছে। আবুল হাসানাত সাহেব সেই সন্দেহজনক চরিত্রের মহিলাটিকে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে চাপিয়ে দিতে চাইছেন। ভাইস চ্যান্সেলর আবুল হাসানাতের আপন মানুষ। চেষ্টা করেও কোনোভাবে ঠেকাতে পারছেন না। যদি একবার এই মহিলা ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পায়, তাহলে ছাত্র-ছাত্রীদের নৈতিক চরিত্র বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
আমি একটুখানি ভাবনায় পড়ে গেলাম। বীণা চ্যাটার্জির সম্পর্কে আমি জানতাম। এই মহিলার আদি নিবাস কলকাতায়। এখন আমেরিকা, বিলাত, না ফ্রান্স- কোথায় থাকেন, সঠিক কেউ বলতে পারে না। মহিলার খেয়াল চেপেছিল, তাই সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে এসেছিলেন। চেষ্টা-চরিত্র করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তার কপালে ভাইফোঁটা পরিয়ে দিয়েছিলেন। এই দৃশ্যটি টিভিতে দেখানো হয়েছিল। দুদিন পরেই রয়টার একটি সংবাদ প্রকাশ করে সবাইকে জানিয়ে দেয়, বীণা চ্যাটার্জি আসলে একজন আন্তর্জাতিক পতিতা। তাই নিয়ে একটা মস্ত কেলেঙ্কারি হয়েছিল। একজন সুন্দরী পতিতা কী করে প্রধানমন্ত্রী অবধি পৌঁছতে পারে, একটা দৈনিক প্রশ্ন তুলেছিল। কিন্তু একজন সুন্দরীর গতিবিধি কতদূর বিস্তৃত হতে পারে, সে ব্যাপারে সেই দৈনিকের কলাম লেখক ভদ্রলোকের কোনো ধারণা ছিল না।
আমি অত্যন্ত কুণ্ঠিতস্বরে ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরীকে বললাম, বীণা চ্যাটার্জির সঙ্গে ওই মহিলার মিল থাকতে পারে, কিন্তু আবুল হাসানাত সাহেবের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক? কী সম্পর্ক এখনো বুঝতে পারলে না, তিনি চোখ ছোট করে একটা ইঙ্গিত করলেন। কী সম্পর্ক যদি এখনো বুঝতে না পার, তাহলে তুমি মায়ের পেটে আছ। বুঝলে, মেয়েমানুষ, তাও আবার যদি সুন্দরী হয়, তার ফাঁদ থেকে আর কারো রক্ষে নেই। তোমার গুরু ওই মেয়েমানুষটার পাল্লায় পড়ে সব ধরনের অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন। ঠ্যাকাও। এখনো যদি ঠ্যাকাতে না পার, সামনে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবে না।
আমি বললাম, স্যার, আপনার কথা যদি সত্যিও হয়, আমি কি করতে পারি? তিনি পেপার ওয়েটটা তুলে নিয়ে টেবিলে দুম করে রাখলেন। তোমরা চারদিকে বলে বেড়াচ্ছ মুক্তিযুদ্ধ করেছ, যদি এত বড় অন্যায়টা আটকাতে না পার, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ যে করেছ, আমরা কি করে সেটা বিশ্বাস করব? স্পষ্টত বিরক্ত হয়েই ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরীর অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। তার চরিত্রের একটা নতুন দিক দেখতে পেলাম। আবুল হাসানাত সাহেব একজন মহিলার সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে তাকে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরের চাকরি দেয়ার জন্যে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন, কথাটা আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হেঁটে হেঁটে আমি শাহবাগের দিকে যাচ্ছিলাম। আমার মনে নানা রকম চিন্তা ঝিলিক দিচ্ছিল। এক সময়ে ভাবতে আরম্ভ করলাম, আবুল হাসানাত সাহেব যদি সত্যি সত্যিই সুন্দরী এক মহিলার প্রেমে পড়েও থাকেন, তাতে দোষের কি আছে? তার বয়স সবে ষাট পেরিয়েছে। বৃটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ঊননব্বই বছর বয়সে উনিশ বছরের মেয়েকে বিয়ে করেছেন। আবুল হাসানাত সাহেবকে সারাজীবন নারী সঙ্গ বর্জিত অবস্থায় কাটিয়ে কেন অন্যের প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে? ব্যাপারটা চিন্তা করতে পেরে আমার ভীষণ ভাল লাগল। নিজে নিজেই হাততালি দিয়ে উঠলাম। আবুল হাসানাত স্যার যদি হুট করে একটি সুন্দরী মহিলাকে বিয়েও করে ফেলেন, বেশ হয়। নতুন একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হবে। যুক্তি দিয়ে বিচার করে দেখলে অনেক কিছুই তো সম্ভব মনে হয়। বাস্তবে কি সব তেমনি ঘটে?
ড. শরিফুল ইসলামের কথাগুলো কতদূর সত্যি পরখ করে দেখার একটা ইচ্ছে আমার মনে তীব্র হয়ে উঠল। আমি সরাসরি শাহবাগ থেকে রিকশা চেপে টিচার্স ক্লাবে চলে এলাম। ক্লাবের লাউঞ্জে ঢুকে দেখি আবুল হাসানাত সাহেব দৈনিক বাংলার সালেহ চৌধুরীর সঙ্গে দাবা খেলছেন। আমি সেখানে গিয়ে বসলাম। তারা দুজন খেলায় এমন বিভোর যে, আমি পাশে বসেছি কারো চোখে পড়ে নি। দান শেষ হওয়ার পর সালেহ চৌধুরী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কখন এসেছ? আবুল হাসানাত সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মৌলবী জাহিদ হাসান, কি খবর? তিনি আমাকে কেন মৌলবী সম্বোধন করেন, তার কারণ আমি কোনোদিন নির্ণয় করতে পারি নি। হাতের ইশারায় বেয়ারাকে ডাকলেন। বেয়ারা এসে দাঁড়ালে তিনি বললেন, মৌলবী জাহিদ হাসানকে এক পেয়ালা চা দাও, আর কি খাইবার চায় জিগাইয়া দ্যাখো। খেলা শেষ হতে সাড়ে দশটা বেজে গেল।
আবুল হাসানাত যখন বাড়ির দিকে পথ নিয়েছেন আমি তাকে অনুসরণ করতে থাকলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর তিনি আমাকে অনুসরণ করতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আপনে কিছু কইবেন নিকি? আবুল হাসানাত সাহেব সবসময় ঢাকাইয়া ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। ঢাকাইয়া ভাষায় যে কোনো ভদ্রলোক পরিপাটি আলাপ করতে পারেন, আবুল হাসানাত সাহেবের কথা না শুনলে কেউ সেটা বিশ্বাস করতে পারবে না। আমি বললাম, স্যার, আমি কি আপনার সঙ্গে আপনার বাড়িতে আসতে পারি? তিনি বললেন, কোনো জরুরি কাম আছে নিকি? আমি বললাম, একটু আছে। তিনি বললেন, ঠিক আছে, আইয়েন। তারপর আর কথাবার্তা নেই, দুজন হাঁটতে থাকলাম।
বাড়িতে পৌঁছুবার পর তিনি বললেন, আপনে একটু বইয়েন। তিনি পাজামাটা ছেড়ে লুঙ্গি পরলেন। লুঙ্গিটা নানা জায়গায় ছেঁড়া দেখে আমার অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। তার সেদিকে খেয়াল নেই। হুঁকোয় টান দিয়ে গলগল করে ধোয়া ছাড়লেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আইছেন কিয়রলায়, হেইডা কন। আমার শরীর ঘামতে আরম্ভ করেছে। বার বার চেষ্টা করলাম। ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী যে কথাগুলো আমাকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, সেভাবে উচ্চারণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি আমতা আমতা করতে আরম্ভ করলাম। আবুল হাসানাত স্যার মোলায়েম একটা ধমক দিয়ে বললেন, কি কখনের আছে কইয়া ফ্যালেন। আমি কোনোরকম লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বলতে থাকলাম, আজ বিকেল বেলা ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী আমাকে হোস্টেল থেকে তার অফিসে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর বলেছেন, আপনি নাকি ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে একজন খারাপ অথচ সুন্দরী মহিলাকে চাকরি দেয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছেন। তাছাড়া আরো অনেক খারাপ কথা বলেছেন, সেগুলো আমি মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারব না।
আমার কথা শুনতে শুনতে তার হুঁকো টানা বন্ধ হয়ে গেল। তিনি চশমা জোড়া খুলে টেবিলের ওপর রাখলেন। তারপর আমার চোখের ওপর তার চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ইংরেজিতেই বলতে থাকলেন, ওয়েল আই ইউজড টু নো দ্যাট ইয়ংম্যান সালমান চৌধুরী। ফর সামটাইম উয়ি শেয়ারড সেম ফ্ল্যাট ইন লন্ডন। মোস্ট ওফটেন দ্যাট গার্ল শামারোখ ইউজড টু ভিজিট সালমান এ্যান্ড দেওয়ার ভেরি ক্লোজ। তারপর ঢাকাইয়া জবানে বলতে থাকলেন, চার-পাঁচ দিন আগে দুইজন একলগে আমার বাড়িতে আইস্যা কইলো, শামারোখের নিকি ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে চাকরি অইছে। কিন্তু শরীফ তারে জয়েন করতে দিতাছে না। দে রিকোয়েস্টেড মি টু ইনকোয়ার হোয়েদার শরীফ ওয়ান্টস হার এ্যাট অল ইন হিজ ডিপার্টমেন্ট। আমি শরীফরে জিগাইলাম, বাবা, মাইয়াডারে তুমি চাকরি দিবা। শরীফ প্লেইন জানাইয়া দিল, হে তারে নিব না। দিজ ইজ অল । হোয়েন সালমান কেম এগেইন, আই টোল্ড হিম, শরীফ ডাজ নট ওয়ান্ট হার ইন হিজ ডিপার্টমেন্ট। আমি বললাম, তিনি তো আমাকে অনেক আজেবাজে কথা বলেছেন। আবুল হাসানাত সাহেব আমার চোখের ওপর চোখ রেখে বললেন, মৌলবী জাহিদ হাসান, আই ন্যারেটেড দ্যা ফ্যাক্ট টু ইউ। লেট শরীফ টেল, হোয়াটেভার হি ওয়ান্টস। তারপর তিনি অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে হুঁকো টানতে আরম্ভ করলেন। সেই দিনই ড. শরিফুল ইসলামের প্রতি একটা খারাপ মনোভাব জন্ম নিল। মুখ দিয়ে তেতো ঢেকুর উঠতে থাকল। আমি যখন চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি, আবুল হাসানাত সাহেব বললেন, অত রাইতে খাবার পাইবেন না, খাইয়া যাইবেন।
প্রতিটি ঘটনার একেকটা মর্মবেগ থাকে। যখন ঘটতে আরম্ভ করে এক জায়গায় স্থির থাকে না, অনেক দূর গড়িয়ে যায়। কন্যা শামারোধের সঙ্গে আমিও জড়িয়ে গেলাম। আবুল হাসানাত সাহেবের সঙ্গে কথা বলার তিন-চারদিন পর আমি বাংলা একাডেমীতে গিয়েছিলাম। আমাদের একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। সে উপলক্ষে বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে চাঁদা ওঠাচ্ছিলাম। আসলে কেউ স্বেচ্ছায় চাঁদা দিতে চাইছিল না। বলতে গেলে, টাকাটা আমি কেড়েই নিচ্ছিলাম।
সুয়িং ডোর ঠেলে ইব্রাহিম সাহেবের ঘরে ঢুকে দেখি একজন অনিন্দ্য সুন্দরী বসে রয়েছেন। পরনে শিফনের শাড়ি। বয়স কত হবে? তিরিশ, পঁয়ত্রিশ, এমন কি চল্লিশও স্পর্শ করতে পারে। এ ধরনের মহিলার বয়স নিয়ে কেউ চিন্তা করে না। প্রথমে চোখে পড়ল তার বড় বড় চোখ। চোখের কোটরের ভেতরে মণি দুটো থর থর কাঁপছে। সামান্য পানিতে পুঁটি মাছ চলাচল করলে পানি যেমন আস্তে আস্তে কাঁপতে থাকে, তেমনি তার চোখের ভেতর থেকে এক ধরনের কম্পন অনবরত বেরিয়ে আসছে। আমার বুকটা কেঁপে উঠল। আমি চলে আসব কি না, চিন্তা করছিলাম। টেবিলের অপর প্রান্ত থেকে ইব্রাহিম সাহেব কথা বলে উঠলেন, জাহিদ ভাই, আপনি এসেছেন খুব ভাল হয়েছে। আসুন, আপনাকে এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। তারপর তিনি একজন জনপ্রিয় গায়িকার নাম উল্লেখ করে বললেন, এই মহিলা তার ছোট বোন। নাম মিস…। মিস আর ইব্রাহিম সাহেবকে তার মুখের কথা শেষ করতে দিলেন না। তিনি ফুঁসে উঠলেন, আপনি আমাকে বোনের নামে পরিচয় করিয়ে দেবেন কেন? আমার নিজেরও একটা নাম আছে। বসুন ভাই, আমার নাম শামারোখ । আমি প্রতিটি বর্ণ আলাদা করে উচ্চারণ করলাম, শা মা রো খ। ছোটবেলায় শোনা একটা পুঁথির কয়েকটা চরণ মনে পড়ে গেল: ‘আহা কন্যা শামারোখ, / নানান মতে দিলা দুঃখ। / আসিলাম বিয়ার কাজে, / ঘরে যাইব কোন লাজে, / মোকে জিজ্ঞাসিলে কি দিব উত্তর।’ আমি চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, আমি আপনাকেই খুঁজছি। ভদ্রমহিলার সেই বিশাল চোখের তারা কেঁপে উঠল। তিনি মাথাটা একপাশে এমন সুন্দরভাবে হেলালেন, দেখে আমার মনে হলো, পৃথিবীতে বসন্ত ঋতুর আবির্ভাব ঘটেছে, অথবা সমুদ্রের জোয়ারে পূর্ণিমার ছায়া পড়েছে। তিনি বললেন, বলুন, কি কারণে আপনি আমাকে খুঁজছেন। আমি চাঁদার রসিদ বইটা তার সামনে এগিয়ে ধরে বললাম, আমাদের অনুষ্ঠানের জন্যে আপনাকে পাঁচশ’ টাকা চাঁদা দিতে হবে। ভদ্রমহিলা অপেক্ষাকৃত ক্ষুণ্ণ কণ্ঠে বললেন, আমার চাকরি নেই, বাকরি নেই, বেকার মানুষ। অত টাকা আমি কেমন করে পাব? আমি বললাম, আপনি অনেক টাকা রোজগার করেন, আমি শুনেছি। কে বলেছে? আমি বললাম ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী আমাকে বলেছেন আপনার হাতে অনেক টাকা। আমার শেষের কথাটা শুনে মহিলা হু হু করে কেঁদে ফেললেন। কান্নাজড়ানো কণ্ঠেই তিনি বললেন, ড. শরিফুল ইসলাম আমাকে চাকরিতে জয়েন করতে দিচ্ছেন না, আর ওদিকে প্রচার করছেন আমার হাতে অনেক টাকা। তার দু’চোখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় জল নেমে সুন্দর গাল দুটো ভিজিয়ে দিয়ে গেল। ফোঁটা গোলাপের পাপড়ির ওপর স্থির শিশির বিন্দুর মতো দেখাচ্ছিল চোখের জলের সেই ফোঁটাগুলো। আমার যদি ক্ষমতা থাকত অশ্রুবিন্দুগুলো কোনোরকমে উঠিয়ে নিয়ে সারাজীবনের জন্য সঞ্চয় করে রাখতাম। আরো পাঁচশ টাকা আমাকে চাঁদা ওঠাতে হবে। সুন্দরীর চাঁদপনা মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে কাব্য রচনা করলে সে টাকা আমার হাতে আসবে না। টাকা যদি তুলতে না পারি, আগামীকালকের অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে । অগত্যা উঠতে হলো। ভদ্রমহিলাকে সান্ত্বনার কোনো বাক্য না বলেই আমি গোঁয়ারের মতো ইব্রাহিম সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
দুপুরের তাতানো রোদে পুড়ে, ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে হোস্টেলে ফিরলাম। চাঁদা ওঠানোর চাইতে শহরের কুকুর তাড়িয়ে বেড়ানো, পেশা হিসেবে যে অনেক ভাল একথা হাড়ে হাড়ে অনুভব করছি। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় শরীর ছড়িয়ে দিয়ে দেখি চোখে কিছুতেই ঘুম আসছে না। কন্যা শামারোখের পুরো চেহারাটা বারবার মানস দৃষ্টির সামনে ভেসে উঠছিল। তার শরীরের রূপ আমার মনের ভেতর জোছনার মতো জ্বলছে। তার পদ্মপলাশ দুটো চোখ, চোখের ভুরু, আলতোভাবে কোলের ওপর রাখা দুধে-আলতা রঙের দুটো হাত, হাত সঞ্চালনের ভঙ্গিমা আমার মনে ঘুরে ঘুরে বার বার জেগে উঠছিল। কোমর অবধি নেমে আসা ঢেউ-খেলানো কালো চুলের রাশি, তাতে মাঝে মাঝে রূপোলি আভাস, অবাক হয়ে ভাবছি, এত অল্প সময়ের মধ্যে আমি এতকিছু দেখে ফেললাম কেমন করে! ফোঁটা গোলাপের পাপড়ির ওপর স্থির হয়ে থাকা শিশির বিন্দুর মতো অশ্রুবিন্দুগুলো আমার মানসপটে অনপনেয় ছাপ রেখে গেছে। একটা অপরাধবোধের পীড়নে আমার শরীর অসম্ভব রকম ভারি হয়ে উঠছিল। মহিলার সঙ্গে আমি নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছি।
আমার কিছু একটা করা দরকার। বিছানা থেকে তড়াক করে উঠে জামা-কাপড় পরলাম। তারপর ড. শরিফুল ইসলামের অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। তিনি অফিসেই ছিলেন। আমাকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। বুঝতে বাকি রইল না তিনি বিরক্ত হয়েছেন। কোনো ভূমিকা না করেই আমি বললাম, স্যার, আপনি যে মহিলার ব্যাপারে কথা বলেছিলেন, তাই নিয়ে আমি আবুল হাসানাত সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছি। আজ সকালবেলা বাংলা একাডেমীতে সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। আমি সে বিষয়ে আপনার সঙ্গে দুচার মিনিট কথা বলতে চাই। তিনি কী একটা লিখছিলেন, কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বললেন, এক্ষুনি আমার অফিস থেকে বেরিয়ে যাও। তার হুকুম শুনে আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল টেবিল থেকে পেপারওয়েটটা তুলে নিয়ে চুলের মাঝখানে যেখানে তার সিঁথি, সেখানটায় সজোরে একটা আঘাত করে রক্ত বের করে আনি। আমার মাথাটা ঠিকমতো কাজ করেছিল। নইলে অন্যরকম কিছু একটা ঘটে যেত। এই ধরনের কিছু একটা অঘটন যদি ঘটিয়ে ফেলি সব অধ্যাপক সাহেবদের সবাই মিলে আমাকে জেলখানা অথবা পাগলা গারদ- দুটোর একটাতে পাঠাবেন। রাগে-অপমানে আমার নিজের শরীর কামড়াতে ইচ্ছে করছিল। এই ভদ্রলোক আমাকে ঘর থেকে তার অফিসে ডেকে এনে তার লেঠেল হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন, আজ যখন আমি তার কাছে গিয়ে সরাসরি বিষয়টা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি আমার দিকে দৃষ্টিপাত না করেই বলে দিলেন, আমার অফিস থেকে বেরিয়ে যাও। মুশকিলের ব্যাপার হলো, আমি তাকে পেটাতে পারছি নে, শালা-বানচোত বলে গাল দিতে পারছি নে, অথচ অপমানটাও হজম করতে কষ্ট হচ্ছে খুব ।
খুব তাড়াতাড়ি ডানে-বাঁয়ে না তাকিয়ে হোস্টেলে ফিরে গিয়ে একটানে একখানা চিঠি লিখে বসলাম । তার বয়ান এরকম: জনাব, আমাদের এই যুগে এই দেশে মানুষে মানুষে সমান মর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক এক বছর, এক মাস, এমন কি এক সপ্তাহও স্থায়ী হয় না। কেননা মর্যাদাবিনাশকারী শক্তিগুলো সমাজের শরীরের মধ্যেই ওঁৎ পেতে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতেও আপনার সঙ্গে অন্যূন আট বছর আমি কাজ করেছি। আমার চরিত্রের মধ্যে কোনো শক্তি ছিল এ দাবি আমি করব না। আপনি যে দয়া করে আমাকে আপনার সঙ্গে কাজ করতে সম্মতি দিয়েছেন, সেটা নিঃসন্দেহে আপনার মহানুভবতার পরিচায়ক। এই সমস্ত কথা স্মরণে রেখে আমি আপনার কাছে একটা প্রশ্ন রাখতে চাই। যে কথাটা আপনি আমাকে ঘর থেকে লোক পাঠিয়ে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারেন, সেই একই বিষয় আপনার ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে, এমন কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়! আমি আশা করছি, আপনি একটা জবাব দেবেন। নইলে আমার পদ্ধতিতে আপনার এই আচরণের জবাব দেবার চেষ্টা করব। আপনারা আমাকে তুচ্ছ মনে করলেও নিজের কাছে আমার একটা মূল্য আছে। চিঠিটা লিখে একটা খামে ভরলাম। ওপরে নাম লিখলাম ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী। পকেটে চিঠিটা নিয়ে আবার ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে ফিরে এলাম। দেখি বাইরে বাটুল বসে বসে ঢুলছে। তাকে ভাল করে জাগিয়ে চিঠিটা দিলাম। বললাম, তোমার সাহেবকে দেবে এবং সন্ধ্যের আগে একটা জবাব নিয়ে আসবে, মনে থাকে যেন। আমি ঘরেই আছি।
আমার ধারণা ছিল আমার চিঠি পাঠ করে ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন এবং আমাকে কি করে বিপদে ফেলা যায়, তার উপায় উদ্ভাবনের জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠবেন। ওমা, সন্ধ্যের একটু আগে দেখি সত্যি সত্যিই বাটুল আমার চিঠির জবাব নিয়ে এসেছে। খামটা ছিঁড়ে বয়ানটা পাঠ করলাম। ড, শরিফুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, জাহিদ, আমি সত্যি সত্যিই দুঃখিত। নানা কারণে মন খারাপ ছিল। কিছু মনে করো না। হঠাৎ করে কিছু একটা করে বসবে না। তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। শেষ কথা, তোমাকে বলতে চাই যে, অ্যাপিয়ারেন্স এবং রিয়্যালিটির মধ্যে অনেক ফারাক, সেটা তলিয়ে বুঝবার চেষ্টা করো। চিঠিটা পাঠ করে আমার রাগ কিছু পরিমাণে প্রশমিত হলো। সে সন্ধ্যেয় কোথাও গেলাম না। হোস্টেলের সামনের লনে বসে কন্যা শামায়োখের কথা চিন্তা করে কাটিয়ে দিলাম।
তারপরের সন্ধ্যেবেলা ড. মাসুদের বাড়িতে আমার খাওয়ার নিমন্ত্রণ ছিল। বেগম মাসুদ অত্যন্ত স্নেহশীলা। আমার মায়ের মৃত্যুর পর অনেকবার বাড়িতে ডেকে নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েছেন। তিনি রাঁধেনও চমৎকার। এই ভদ্রমহিলার বাড়ি থেকে যখনই খাওয়ার নিমন্ত্রণ আসে আমি মনে মনে ভীষণ উল্লসিত হয়ে উঠি। খাওয়ার লোভটা তত নয়, যতটা তার নীরব মমতার আকর্ষণ। সেদিন সন্ধ্যেয় ড. মাসুদের বাড়ির দরজায় বেল টিপতেই তিনি স্বয়ং দরজা খুলে দিলেন। কোনোরকম ভূমিকা না করেই বললেন, জাহিদ মিয়া, আবার তুমি একটা দুর্ঘটনার জন্ম দিয়েছ। কোথায় কখন কি করে আরেকটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসলাম, বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকালাম। তিনি আমার মনোভাব খানিকটা আঁচ করে নিজেই বললেন, তুমি দুতিনদিন আগে ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে গিয়ে শামারোখকে চাকরি দিতে হবে এই মর্মে নাকি ধমক দিয়েছ! তিনি তোমাকে তার অফিস থেকে বের করে দিলে, আবার চিঠি লিখে ক্ষমা প্রার্থনা করেছ। তার কথা শুনে আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। জানতে চাইলাম, একথা আপনাকে কে বলেছে? ড. মাসুদ জানালেন, আজকের মর্নিং ওয়াকের সময় ড. চৌধুরী নিজে তাকে একথা বলেছেন। তখন আমি বাধ্য হয়ে তার কাছে ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী আমাকে বিকেলবেলা কীভাবে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে আবুল হাসানাত সাহেবের কুকীর্তির কথা বয়ান করলেন, সবকিছু জানালাম। আরো বললাম, কথাটা আমি হাসানাত সাহেবের কাছেও উত্থাপন করেছিলাম। হাসানাত সাহেব কি জবাব দিয়েছেন, সেটাও প্রকাশ করলাম। গতকাল বাংলা একাডেমীতে চাদা তুলতে গিয়ে কোন্ পরিস্থিতিতে কন্যা শামারোখের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, কিছুই বাদ দিলাম না। অবশ্য স্বীকার করলাম, আমি ড. শরিফুল ইসলামের অফিসে গিয়ে বিষয়টা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি আমাকে কিছুই না বলে অফিস থেকে বের করে দিয়েছেন। তারপর আমি হোস্টেলে এসে একটা চিঠি লিখে তার বেয়ারার কাছে রেখে এসেছিলাম এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গে আমার চিঠির একটা জবাব পাঠিয়ে দিয়েছেন।
আমার কথা শেষ হলে ড. মাসুদ কন্যা শামারোখ সম্পর্কে বলতে আরম্ভ করলেন। তিনি জানালেন, শামারোখদের বাড়ি যশোর। তার বাবা একজন গোবেচারা ধার্মিক মানুষ। তারা সাত বোন। সব কটি বোন লেখাপড়ায় অসম্ভব রকম ভাল এবং অপূর্ব সুন্দরী। শামারোখ করাচিতে লেখাপড়া করেছে। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে লেকচারার হিসেবে কাজ করত। সে সময়ে এক সুদর্শন সিএসপি অফিসারের সঙ্গে তার বিয়ে হয় এবং শামারোখ একটি পুত্র সন্তানের মা-ও হয়। কিন্তু বিয়েটা টেকে নি। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর ধরপাকড় করে একটা স্কলারশিপ যোগাড় করে লন্ডনে চলে যায় এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রাইপস শেষ করে। সে সময় সে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক কার্যকলাপে জড়িত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সহায়তায় সে ইংরেজি বিভাগে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরের চাকরিটি পেয়ে যায়। তাকে চাকরি পেতে কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় নি। কারণ আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেব ছিলেন বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর এবং বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা যখন রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর মোতাহের আহমদ চৌধুরী প্রাক্তন উপাচার্য এবং দেশের রাষ্ট্রপতির সুপারিশ রক্ষা করা একটা কর্তব্য বলে মনে করলেন। তাকে যখন চূড়ান্ত নিয়োগপত্র দেয়া হলো, ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী একেবারে কঠিনভাবে বেঁকে বসলেন। তিনি তার ডিপার্টমেন্টের সব শিক্ষক সঙ্গে নিয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানিয়ে দিলেন, এই মহিলা যদি শিক্ষক হয়ে ডিপার্টমেন্টে আসে, তাহলে ডিপার্টমেন্টের সব শিক্ষক একযোগে পদত্যাগ করবেন।
ড. মাসুদ তাদের কাজের লোক আকবরকে তামাক দিতে বললেন। আকবর তামাক সাজিয়ে দিলে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, শোনো, তারপরে একটা মজার কাণ্ড ঘটল। ভাইস চ্যান্সেলর সাহেবের তো ছুঁচো গেলার অবস্থা। একদিকে তিনি নিয়োগপত্র ইস্যু করেছেন, অন্যদিকে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের সব শিক্ষক মিলে পদত্যাগের হুমকি দিচ্ছেন। এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার বুদ্ধি সরবরাহ করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ রেজিস্ট্রার সাঈদ সাহেব। তিনি অ্যাপ্লিকেশন ফরম তন্ন তন্ন করে ঘেঁটে একটা খুঁত আবিষ্কার করলেন। শামারোখ, তালাকপ্রাপ্তা মহিলা। কিন্তু চাকরির দরখাস্তে সে নিজেকে কুমারী বলে উল্লেখ করেছে। এই খুঁতটি ধরা পড়ার পর ভাইস চ্যান্সেলর সাহেব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন এই নিয়োগপত্র বাতিল করা হয়েছে, এ মর্মে একখানা চিঠি লিখে জানিয়ে দেয়া হবে, কেননা প্রার্থিনী তার নিজের সম্পর্কে সত্য গোপন করেছেন, তাই তার নিয়োগপত্র বাতিল করা হলো। কিন্তু চিঠিটা ইস্যু করার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার বুড়ো আবু আব্দুল্লাহ গোলমাল বাঁধিয়ে বসলেন। তিনি যুক্তি দেখিয়ে বললেন, প্রার্থিনী সত্য গোপন করেছেন, একথা চাকরির নিয়োগপত্র দেয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেন চিন্তা করেন নি। প্রার্থিনী সত্য গোপন করে অন্যায় করলেও বিশ্ববিদ্যালয় যদি সে অপরাধে নিয়োগপত্র বাতিল করে বসে, তাহলে তার চাইতেও বড় অন্যায় করা হবে। আবু আব্দুল্লাহ সাহেব এক কথার মানুষ। তিনি ভেবে-চিন্তে যা স্থির করেন, তার থেকে এক চুল টলানো একরকম অসম্ভব। এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে সবার শরীর থেকে যখন কালো ঘাম দরদর ঝরছিল, আবারো মুশকিল আসানের ভূমিকা গ্রহণ করলেন রেজিস্ট্রার সাঈদ সাহেব। তিনি সবাইকে পরামর্শ দিলেন, আপনারা আব্দুল্লাহ সাহেবের বড় জামাই আজিজুল হাকিম সাহেবের কাছে যান। তিনি আমার ক্লাস ফ্রেন্ড। আমি একটা চিঠি দিয়ে দিচ্ছি। আজিজুল হাকিম সাহেব যদি আব্দুল্লাহ সাহেবকে বোঝাতে রাজি হন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এই মহিলার চাকরি হলে, ছাত্র-ছাত্রীদের নৈতিক চরিত্র বলতে কিছুই থাকবে না। তাদের নৈতিক চরিত্র সুরক্ষার স্বার্থেই তাকে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে আসতে দেয়া উচিত হবে না। আবু আব্দুল্লাহ সাহেব ভীষণ পিউরিটান স্বভাবের মানুষ। কোনোরকমের স্থলন-পতন তিনি একেবারে বরদাশত করতে পারেন না। রেজিস্ট্রার সাহেব আশ্বাস দিলেন, আপনারা হাকিম সাহেবের কাছেই যান, কাজ হবে। ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরীরা যখন আজিজুল হাকিম সাহেবের মাধ্যমে আবু আব্দুল্লাহকে সবিস্তারে বললেন এবং বোঝালেন, তখন আবু আব্দুল্লাহ সাহেবও অন্য সবার সঙ্গে একমত হয়ে জানিয়ে দিলেন, অবিলম্বেই ভদ্রমহিলাকে জ্ঞাত করা হোক, সত্য গোপন করার জন্য আপনার নিয়োগপত্র বাতিল করা হলো। ড. মাসুদ জানালেন, তোমাকে যখন ড. চৌধুরী ডেকে নিয়েছিলেন, তখনো আবু আব্দুল্লাহ সাহেবের মতামতটা পাওয়া যায়নি। তোমাকে যেদিন অফিস থেকে বের করে দিলেন, সেদিন নিয়োগপত্র বাতিলের চিঠিটা ইস্যু করা হয়ে গেছে। ড. মাহমুদ তার দীর্ঘ বক্তব্য যখন শেষ করলেন, আমার মনে হতে থাকল, আমি একটা উল্লুক। কত কম জেনে আমি ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি। নিজের গালে নিজের চড় মারতে, ইচ্ছে হলো। সবাই যতটা বিশদ জানে, আমি তার বিন্দুবিসর্গও জানিনে কেন? আমার কপালে অনেক দুঃখ আছে। সবকিছুই আমি সবার শেষে জানতে পারি। আমি আমার মায়ের গর্ভ থেকে সবার শেষে জন্ম নিয়েছি। পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি ফুরিয়ে যাবার পর দুর্গতির বোঝা বয়ে বেড়াবার জন্যেই যেন আমার জন্ম হয়েছে। আমার অজান্তে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
আমরা খেতে বসলাম। বেগম মাসুদের মাংস রান্না বরাবরের মতোই চমৎকার হয়েছে। অনেকদিন এমন ভাল খাবার খাই নি। বলতে গেলে গোগ্রাসে গিলছিলাম। আর পেটে খিদেও ছিল খুব। ড. মাসুদ তার দুর্বল দাঁতে হাড় চিবানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন এবং সেই ব্যর্থতা চাপা দেয়ার জন্য ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে আমার লেখা চিঠিটার কথা উত্থাপন করলেন, তাহলে তুমি ড. চৌধুরীর কাছে ক্ষমা চেয়ে চিঠিটা লিখেছ? আমি বললাম, স্যার, কথাটা ঠিক নয়, বরং তিনিই আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখেছেন। তিনি দুধের বাটিতে চুমুক দিতে দিতে বললেন, কার কথা বিশ্বাস করব, তোমার, না ড. চৌধুরীর? আমি বললাম, কার কথা বিশ্বাস করবেন সে আপনার মর্জি। আপনি যদি দেখতে চান, তাহলে চিঠিটা দেখাতে পারি। তিনি হেসে বললেন, তুমি তো একজন রিসার্চ স্কলার আর ড. চৌধুরী একজন পুরোদস্তুর প্রফেসর। আমাকে ড. চৌধুরীর কথাই বিশ্বাস করতে হবে। কথাটা শুনে আমার সারা শরীরে আগুন লেগে গেল। আমি ক্রুদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, সত্যি বলার একচেটিয়া অধিকার কি শুধু প্রফেসরদের? রিসার্চ স্কলাররা কি সত্যি বলতে পারে না? তিনি বললেন, তোমার তো কথার জবাব আমি দিতে পারব না। একজন প্রফেসর এবং রিসার্চ স্কলার একই বিষয়ে যখন কথা বলে, আমি প্রফেসরের কথাকেই সত্যি বলে ধরে নেব, যেহেতু আমি নিজে একজন প্রফেসর। তার সত্যাসত্য নির্ণয়ের এই আশ্চর্য থিয়োরির কথা শুনে আমি পাতের ভাত শেষ না করেই উঠে দাঁড়ালাম। রাগের চোটে সুস্বাদু মাংসের বাটিটা হাতে করে তুলে নিয়ে নিচে ফেলে দিলাম এবং একবারো পেছন ফিরে না তাকিয়ে হোস্টেলে চলে এলাম।
তার পরের দিন কয়েকটা কাজ করে বসলাম। আমার সম্প্রতি প্রকাশিত প্রবন্ধ বইয়ে ড. মাসুদ যে মন্তব্য লিখে দিয়েছিলেন জাহিদ হাসানের মতো পাঁচটি মেধাশালী তরুণ পেলে আমি বাংলাদেশ জয় করতে পারি, আমার প্রকাশককে সেটা বাদ দিতে অনুরোধ করলাম। সেদিন সন্ধ্যেবেলা একটা কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান ছিল। আমি অনুষ্ঠানে ঘোষণা দিয়ে বসলাম, ড. মাসুদ এ পর্যন্ত আমাকে তার লিখিত যে সমস্ত বই-পুস্তক উপহার দিয়েছেন, সবগুলো পঁচিশ পয়সা দানে এই অনুষ্ঠানে বেচে দিতে যাচ্ছি।
.
১০.
প্রিয় সোহিনী, আমার জীবন নিতান্তই দুঃখের। তবু আমি ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেব। এই দুঃখের কথাগুলো আমি নিতান্ত সহজভাবে তোমার কাছে প্রকাশ করতে পারছি। তুমি আমার মধ্যে সঞ্চারিত করেছ যে সাহস, আমাকে তা আমার গভীরে ডুব দেয়ার প্রেরণা যুগিয়েছে। এখন আমার মনে হচ্ছে, যদি তোমার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ না হতো, আমি কস্মিনকালেও নিজের ভেতরে এই খোঁড়াখুঁড়ির কাজে প্রবৃত্ত হতে পারতাম না। তুমি আমার অস্তিত্বের শিয়রে দাঁড়িয়ে আছ। তাই প্রতিদিনের সূর্যোদয় এমন সুন্দর রঙিন প্রতিশ্রুতি মেলে ধরে, প্রতিটি সন্ধ্যা অমৃতলোকের বার্তা বহন করে আমার কাছে হাজির হয়, পাখির গান এমন মধুর লাগে, বাতাসের চলাচলে প্রাণের স্পন্দন ধ্বনিত হয়, পাতার মর্মরে কান পাতলে চরাচরের গহন সঙ্গীত একূল-ওকূল প্লাবিত করে দোলা দিয়ে বেজে ওঠে। আমার ভেতরটা সুরে বাঁধা তার-যন্ত্রের মতো হয়ে উঠেছে, যেন একটুখানি স্পর্শ লাগলেই অমনি বেজে উঠতে থাকব। তুমি আমাকে বাজিয়ে দিয়েছ, জাগিয়ে দিয়েছ। যে ঘনীভূত আনন্দ প্রতিটি লোমকূপে তুমি সঞ্চার করেছ, সেই স্বর্গজাত অশরীরী প্রেরণার বলে আমার কাহিনী তোমার কাছে চোখের পানিতে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে বয়ান করে যাচ্ছি।
প্রিয় সোহিনী, এমন অনেক ভাগ্যবান মানুষ আছে, কোনো রকমের বিপদ আপদ যাদের একেবারেই স্পর্শ করে না। শহরের নির্ঝঞ্ঝাট রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার মতো গোটা জীবন, তারা অত্যন্ত মসৃণভাবে কাটিয়ে যায়। কোনোরকম দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় না, বিপদ-আপদের মোকাবেলা করতে হয় না। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সারাটা সময় তারা যেন সিনেমা দেখেই কাবার করে। আমি কোন্ রাশির জাতক বলতে পারব না। আমার জীবন ভিন্ন রকম। আমি যেখানেই যাই না কেন, বিপদ-আপদ আমাকে অনুসরণ করতে থাকে। প্রিয় সোহিনী, আমি হলাম গিয়ে সেই ধরনের মানুষ, যারা পুকুর পাড়ের লাশ পুকুর পারে কবর না দিয়ে ঘরে বয়ে নিয়ে আসে। এখন আমি তোমার কাছে, কন্যা শামারোখকে নিয়ে যে জটিলতায় জড়িয়ে গেলাম, সে কথাটা বলব। কবিতা পাঠের আসরে আমাকে উপহার দেয়া ড. মাসুদের সবগুলো বই পঁচিশ পয়সা দামে বেচে দিলাম। সে কথা তো বলেছি। ক্রেতা পেতে আমার অসুবিধে হয় নি। কারণ ড. মাসুদ অনেকগুলো বই লিখেছেন, তার কোনোটার কলেবরই নেহায়েত তুচ্ছ করার মতো নয়। সবগুলোই ঢাউস এবং পরীক্ষার পুলসিরাত পার হওয়ার মোক্ষম সহায়। সুতরাং পঁচিশ পয়সা দামে তার চাইতেও বেশি দামে কিছু বই কিনে নেয়ার লোকের অভাব হলো না। আমি তো ড. মাসুদের সত্য নির্ণয়ের অভিনব পদ্ধতির প্রতিবাদ করেই তার উপহার করা বইগুলো বেচে দিলাম। বেচে দিয়ে মনে মনে আত্মপ্রসাদ অনুভব করলাম। ড, মাসুদকে যা হোক সুন্দর একটা শিক্ষা দিলাম তো। একজন প্রফেসর মিথ্যে বললেও সত্য মনে করতে হবে, কারণ তিনি নিজে একজন প্রফেসর। আর একজন রিসার্চ স্কলার সত্য বললেও তিনি ধরে নেবেন বিষয়টা আসলে মিথ্যে! ড. মাসুদ আমার শিক্ষক। তাকে আমি প্রকাশ্যে গালগাল করতে পারি নে। আচমকা তার ওপর হামলা করে বসতে পারি নে। অথচ একটা অপমানবোধ আমার ভেতরে দাবানলের মতো জ্বলছিল। কিছু একটা না করে কিছুতেই স্বস্তিবোধ করতে পারছিলাম না। তার উপহার করা বইগুলো স্রেফ পঁচিশ পয়সা দামে বেচে দিয়ে আমি অনুভব করতে থাকলাম, শিক্ষক হিসেবে তিনি যে স্নেহ-মমতা আমাকে দিয়েছেন, তার সবকিছু আজ ঝেড়ে ফেলে দিলাম।
তারপর কি ঘটল, শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার মহলে রটে গেল, আমি ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরীর অফিসে ঢুকে তাকে ধমকে দিয়ে বলেছি, তিনি যদি কন্যা শামারোখকে ডিপার্টমেন্টে আসার পথে কোনো রকমের বাধা দেন, তাহলে তার বিপদ হবে। আর আমার ধমকে একটুও ভয় না পেয়ে তিনি বেয়ারা দিয়ে আমাকে অফিস থেকে বের করে দিয়েছেন। এ খবর ড. মাসুদের কানে গেল। তিনি আমাকে এরকম কোনো কিছু করা ভাল নয়, সেটা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য বাড়িতে ডেকে নিয়েছিলেন। আমি ড. মাসুদকে অপমান করেছি, তার স্ত্রীকে অপমান করেছি, কাজের লোককে ধরে মেরেছি এবং ডাইনিং টেবিল থেকে ভাত তরকারি তুলে নিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছি- দেখতে-না-দেখতে এসব গল্প পাঁচ কান হয়ে গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল।
আমি একজন সামান্য রিসার্চ স্কলার। মাসের শেষে মোট বারোশ টাকা আদায় করার জন্যে ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান এবং সুপারভাইজার- দুজনের দ্বারস্থ হতে হয়। দুজনের একজন যদি সই দিতে রাজি না হন, তাহলে স্কলারশিপের টাকা ওঠানো সম্ভব হয় না। এর পরপরই যখন কন্যা শামারোখঘটিত সংবাদ ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের কানে গেল, তিনি আমার স্কলারশিপ ওঠানোর ফরমে সই করতে অস্বীকৃতি জানালেন। প্রিয় সোহিনী, চিন্তা করে দেখো কী রকম বিপদের মধ্যে পড়ে গেলাম। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা বলতে যা দাঁড়ায়, আমার অবস্থাও হলো সেরকম। শিক্ষকেরা জাতির বিবেক এ কথা সত্য বটে। এই বিবেকনামীয় ভদ্রলোকেরা সময়বিশেষে কী রকম নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারেন, আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।
সর্বত্র আমাকে নিয়ে নানারকম কথা হতে থাকল। কেউ বললেন, আমার সঙ্গে কন্যা শামারোখের বিশ্রী রকমের সম্পর্ক রয়েছে। আবার কেউ কেউ বললেন, না, প্রত্যক্ষভাবে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। তবে কন্যা শামারোখ ঢাকা শহরে বিনা মূলধনে যে একটি লাভের ব্যবসা ফেঁদে বসে আছে, তার খদ্দের জোগাড় করাই আমার কাজ। নিষিদ্ধ গালির পরিভাষায় ভেড়য়া। যে ভদ্রলোক জীবনে কোনোদিন কন্যা শামারোখকে চোখে দেখেন নি, তিনিও তাকে নিয়ে দুয়েকটি আদিরসাত্মক গল্প অনায়াসে ফেঁদে বসলেন। আমি শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের মুখ থেকেই শুনলাম, কন্যা শামারোখ অর্ধেক রাত ঢাকা ক্লাবে কাটায়। নব্য-ধনীদের গাড়িতে প্রায়শই তাকে এখানে-ওখানে ঘুরতে দেখা যায়। মাত্রাতিরিক্ত মদ্য পান করলে যেমন তার মুখ দিয়ে অনর্গল অশ্লীল বাক্য নির্গত হয়, তেমনি বস্ত্রের বন্ধন থেকে শরীরটাও আলগা হতে থাকে। এই সমস্ত কথা যত শুনলাম, ততই ভয় পেতে আরম্ভ করলাম। কোথায় আটকে গেলাম আমি! অদৃষ্টকে ধিক্কার দিলাম। জেনেশুনে এমন একজন মহিলার সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে গিয়ে এমনি করে প্রত্যেকের বিরাগভাজন হয়ে উঠলাম! কোনো কোনো মানুষের রাশিই এমন যে বিপদ তাদের প্রতি আপনিই আকৃষ্ট হয়। সুন্দরী শামায়োখের মূর্তি ধরে একটা মূর্তিমান বিপর্যয় আমার ঘাড়ে চেপে বসল। আপনা থেকে ডেকে এনে যখন ঘাড়ে বসিয়েছি, তখন ভাবতে আরম্ভ করলাম, আমি, একমাত্র আমিই শামারোখের ত্রাণকর্তা। তাকে সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধার করার পবিত্র ব্রত আমি গ্রহণ করেছি। তার পদ্মপলাশ অক্ষিযুগল থেকে বেরিয়ে পড়া গোলাপ পাপড়ির ওপর শিশির বিন্দুর মতো অশ্রুকণাগুলো দৃষ্টিপটে ক্রমাগত জেগে উঠতে থাকল। আমরা ঢাকা শহরের একটা সংকীর্ণ বৃত্তের মধ্যে বাস করি। এই বৃত্তের সবাই সবাইকে চেনে। কোনো কথা গোপন থাকে না। এখানে কেউ যদি প্রচণ্ড জোরে হ্যাঁচ্চো করে তার আওয়াজ সবার কানে এসে লাগে। আবার যদি কেউ অস্বাভাবিকভাবে বায়ু ত্যাগ করে বাতাস তার কটু গন্ধ অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে অন্য সবার নাসারন্ধ্রে বয়ে নিয়ে যায়। কন্যা শামারোখের ব্যাপারে প্রফেসর সাহেবদের সঙ্গে আমার যে একটা ভজকট বেঁধে গেল, সে-কথাও সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। শিক্ষক সাহেবদের পরিমণ্ডলে আমার ভয়ংকর দুর্নাম রটে গেল। এমনকি অতিরিক্ত মর্যাদা-সচেতন কেউ কেউ ড. শরিফুল ইসলাম চৌধুরী এবং ড. মাসুদের দিকে আঙুল তুলে বললেন, আপনারা দুজনেই আশকারা দিয়ে দিয়ে এ অসভ্য ছেলেটাকে এমন দুঃসাহসী করে তুলেছেন, ডিপার্টমেন্টে একটা নষ্ট মহিলাকে চাকরি দিতে হবে, তাই নিয়ে হুমকি-ধমক দেয়ার স্পর্ধা রাখে। এখন বুঝুন ঠ্যালা!
এই আপাতনিরীহ শিক্ষকদের ক্রোধ তেঁতুল কাঠের আগুনের মতো। সহজে নিভতে চায় না, নীরবে নিভৃতে জ্বলতে থাকে। পাথরের তলায় হাত পড়লে যে রকম হয়, আমারও সে রকম দশা। তবু আমি স্কলারশিপটা ছেড়ে দিয়ে শিক্ষক সাহেবদের আওতা থেকে পালিয়ে যেতে পারছি নে। আবার প্রশান্ত মনে গবেষণার কাজেও আত্মনিয়োগ করব, তারও উপায় নেই। পরিণাম চিন্তা না করে ভীমরুলের চাকে ঢিল ছুঁড়ে বসে আছি। অবশ্য আমাকে উৎসাহ দেয়ার মানুষেরও অভাব ছিল না। কন্যা শামায়োখ অত্যন্ত সুন্দরী। এই সময় আমি আবিষ্কার করলাম তার সম্পর্কে আমি যত জানি অন্য লোকেরা তার চাইতে ঢের ঢের বেশি জানে। তারা বলল, ঠিক আছে জাহিদ, তুমি লড়াই চালিয়ে যাও। আমরা তোমার সঙ্গে আছি। সুন্দরী হওয়া কি অপরাধ? একজন ভদ্রমহিলাকে চাকরির নিয়োগপত্র দিয়ে বাতিল করার কি অধিকার আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ভুল স্বীকার করে নিয়ে ভদ্রমহিলাকে অবশ্যই চাকরিতে পুনর্বহাল করতে হবে।
এক সময় কন্যা শামায়োখের কানে এই সব রটনার কথা গিয়ে পৌঁছুলো। আমি একটা চিঠি পেলাম। চিঠিটা এসেছে হোস্টেলের ঠিকানায় এবং লিখেছে কন্যা শামায়োখ। লিখেছে, প্রিয় জাহিদ, বাংলা একাডেমীতে আপনার কথাবার্তা শুনে আমার মনে আপনার সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা জন্ম নিয়েছিল। পরে বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, আপনি আমার ব্যাপারে সুপারিশ করতে গিয়ে শক্তিমান মানুষদের কোপদৃষ্টিতে পড়ে গেছেন। ব্যাপারটা আমাকে ভীষণ ব্যথিত করেছে। আপনার সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় হয়নি। বাংলা একাডেমীতে এক ঝলক দেখেছিলাম বটে, কিন্তু তাকে পরিচয় বলা চলে না। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মহিলার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে আপনি যে স্বেচ্ছায় বিপদ ঘাড়ে নিলেন, আপনার এই মহানুভবতা আমাকে মুগ্ধ এবং বিস্মিত করেছে। আমি আগামী ৪ অক্টোবর শুক্রবার সকাল দশটায় আপনার হোস্টেলে এসে ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। আমরা এক আজব সময়ে বসবাস করছি। নিজের স্বার্থের প্রশ্ন না থাকলে কেউ কারো জন্য সামান্য বাক্য ব্যয় করতেও কুণ্ঠিত হয়। সুতরাং অনুরোধ করছি শুক্রবার দশটায় আপনি হোস্টেলে থাকবেন। তখন আপনার সঙ্গে ভাল করে পরিচয় হবে।
কন্যা শামায়োখের হাতের লেখা খুবই সুন্দর। সচরাচর মেয়েলি হাতের লেখা যে রকম হয়, তার চাইতে একটু আলাদা। সুন্দর কাগজে সবুজ কালিতে চিঠিটা লিখেছে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অনেকবার পড়লাম। মামুলি অর্থের বাইরে আরো কোনো অর্থ আছে কি না, বার বার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করতে চেষ্টা করলাম। কন্যা শামারোখের চিঠিটা পাওয়ার পর মনে হতে থাকল, আমার সমস্ত অপমান-লাঞ্ছনার পুরস্কার পেয়ে গেছি। এর বেশি আর কি চাইবার ছিল! কন্যা শামারোখ আগামী ৪ অক্টোবর শুক্রবার আমার সঙ্গে দেখা করতে আমার হোস্টেলে আসবে এর চাইতে বড় সংবাদ আমার জন্য আর কি হতে পারে! বিপদের আশঙ্কা, অসহায়তার ভাব এক ফুকারে কোথায় উধাও হয়ে গেল! বুকের ভেতর সাহসের বিজলি ঝিলিক দিতে থাকল। কন্যা শামারোখের জন্যে আমি সমস্ত বিপদআপদ তুচ্ছ করতে পারি।