০৬.
এসব এতদিন আগের কথা যে ঘটনাগুলো কোনটা আগে কোনটা পরে ঠিক মনে নেই, তবে ওই একটা গোটা বছর আমার জীবনে আর সব বছর থেকে একেবারে আলাদা, এ-বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই।
মনে আছে সে বছরটা খাওয়া-দাওয়া বেড়ানো-বুড়োনো এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। সকলের মুখে সর্বদা ওই এক কথা, কে জানলায় লোহার শিক বসালে, কে লোহার সিন্দুক কিনল, সেটা কোথায় রাখা হল, কার গয়নাগাটি ব্যাঙ্কে জমা হল, কে সেসব সেখানে পৌঁছে দিল– এইসব।
নেপু বলত, বাঃ, চোরদের তো ভারি সুবিধে হয়ে গেছে, একটু কানখাড়া করে থাকলেই হল, সব খবর পেয়ে যাবে। কার কার কুকুর আছে, তাদের মধ্যে কারা কামড়ায়? কার ঘরে বন্দুক আছে, কে কে সেসব ছুঁড়তে জানে কিছুই কারো জানতে বাকি থাকল না।
ওই ঘটনার পর যেই পিসিমা সন্ধ্যে বেলায় আলোয়ান মুড়ি দিয়ে আমাদের বারান্দায় উঠেছেন, মা আর জেঠিমা ওঁকে জেরা করতে লেগে গেলেন। ততক্ষণে পিসিমারও রাগ পড়ে গেছে, অনেক কথার উত্তর দিলেন। সবাই সেসব শুনতে এমনি মেতে গেল যে, মাছওয়ালি বুড়ি এক চুবড়ি বিকেলে-ধরা পাহাড়ে কইমাছ নিয়ে এসে ডেকে ডেকে, সাড়া না পেয়ে ফিরেই যাচ্ছিল। ভাগ্যিস আমি বুদ্ধি করে জ্যাঠামশাইকে বললুম, নাহলে সেদিন মাছ খাওয়া হয়েছিল আর কী!
পিসিমারা তো গিয়ে জেঠিমার শোবার ঘরে ঢুকলেন। আমিও একটু পরে সেখানে গিয়ে শুনি মা বলছেন, যাই বল ঠাকুরঝি, ওই বুড়োর নাতি-নাতনিরা কে কোথায় আছে খোঁজ করা উচিত।
জেঠিমা বললেন, আর তাই যদি হয় যে সোনার নস্যির কৌটো উদ্ধার করা ওদের উদ্দেশ্য, তবে সে তো হয়েই গেছে, তবু চুরি থামে না কেন?
পিসিমা জেঠিমার খাটের ওপর পা গুটিয়ে বসে বললেন, তোরা কিছুই জানিস না নাকি? জুয়ো খেলায় আর চুরি করাতে, যতই সফল হওয়া যায় ততই নেশা লেগে যায়।
মারা চুপ করে থাকছেন দেখে আবার বললেন, তাহলে তোদের সত্যি কথাটাই খুলে বলি। তোরা যেন আবার পাঁচকান করিস নে।
কৌটো নাহয় চুরি গেছে কিন্তু তার ঢাকনিটা আছে তো? এই এত বড়ো হিরের প্রজাপতি বসানো ঢাকনিটাই তো আসল। সেটি তো আর ওরা পায়নি। আমার তো মনে হয় সেটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে, এ আর কিছু নয়।
মা অবাক হয়ে বললেন, সেটি বুঝি ব্যাঙ্কে পাঠাওনি? পিসিমাকে যেন বিরক্ত মনে হল।
আরে তবে বলছি কী, খুঁজে পেলে তো পাঠাব। সে যে কোথায় রেখেছি সে আর কিছুতেই মনে করতে পাচ্ছি নে।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, চোররা পাবে কি, আমিই পাচ্ছি না!
জেঠিমা বললেন, এই যদি ব্যাপার হয় তো গুটেকে সন্দেহ করা কেন?
মা-ও আর থাকতে না পেরে আসল কথাটাই বলে বসলেন, আর পরশু বোর্ডিঙের মাসিমার টাকাগুলো দেখে অমন করে চলে গেলে কেন?
পিসিমা অমনি টুক করে খাট থেকে নেমে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললেন, ওমা, বাগানে এই শীতের মধ্যে ও আবার কীসের চারা গজিয়েছে রে? যাই, একবার দেখেই আসি।
এই বলে বাগান দেখার নাম করে সেখান থেকে দে পিটান।
জেঠিমারা বোধ হয় খুব রেগে গেলেন, তাই এতক্ষণ কিছু বলেননি, এবার হঠাৎ আমার দিকে ফিরে খুব ধমকধামক করতে লাগলেন, এইটুকু মেয়ে, তবু বড়োদের কথা শোনা; হেন-তেন কত কী!
আর একটু রাত হলে জগদীশদা এসে নীচু গলায় বললে, ও মামিমা, তোমরা কি একটা খুব ভালো চাকর রাখতে চাও? দশ টাকা মাইনে, দু-বেলা পেট ভরে ভাত, দু-বেলা চা-জলখাবার, বছরে চারখানি কাপড়, ব্যস্।
জেঠিমা বললেন, ঠাকুর ছুটি চাইছে, লোক অবিশ্যি আমাদের সত্যি দরকার, কিন্তু অত চায় কেন?
জগদীশদা কপালে চোখ তুলে বললে, অত মানে কী? তার বদলে কী পাচ্ছ জান? সাক্ষাৎ একটি দ্রৌপদী! ওর রান্না যদি একবার খাও তো সারাজীবন হা-হুঁতাশ করে মরবে! চপ-কাটলেট রাঁধে তো দাঁতের মধ্যে কুরকুর করে ওঠে, আবার মুখে যেতেই মিলিয়ে যায়।
মাংস রাঁধে যেন ক্ষীর। আর পায়েস-পিঠে বাঙালি হয়ে জন্মানোর দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। রাখ তো বলো, গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, ডেকে আনি। খুব ভালো লোক, খুব চেনা আমার।
জেঠিমা বললেন, তা রাখলে মন্দ হয় না, ঠাকুর তো পাস পার্মিট করিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে রয়েছে। তার দু-মাস মানেই সাত মাস। তাই তাকে আন তো দেখি।
জগদীশদা এক দৌড়ে গিয়ে একমুখ দাড়ি গোঁফওয়ালা একটা লোককে ধরে নিয়ে এল।
আমার জেঠিমা উঠে এসে লণ্ঠনটা তুলে ধরে মুখ দেখতে লাগলেন। চোখে আলো পড়াতে সে লোকটা চোখ পিটপিট করতে লাগল।
আমি অবাক হয়ে বললুম, ইয়ার্কি পেয়েছ জগদীশদা? এই তোমাদের সেই চোরের সর্দার গুটে না?
জেঠিমা চমকে উঠে আরেকটু হলেই লণ্ঠনটা ফেলে দিচ্ছিলেন। জগদীশদা আমাকে এক ধমক, তুই থাম দিকিনি। যত বড়ো মুখ নয় তত বড় কথা!
গুটেও বিরক্ত হয়ে বলল, অত তেজ কীসের তোমার, দিদি? জানো আমি ম্যাট্রিক পাশ? গোয়েন্দাগিরির সার্টিফিকেট আছে আমার। ট্যাক্স দিই।
জেঠিমা বাধা দিলেন, আচ্ছা আচ্ছা ঢের হয়েছে, করবে তো রাঁধুনিগিরি, তা অত সার্টিফিকেট দিয়ে কী হবে? দেখো, তোমাকে আমি রাখতে পারি ওই মাইনেতে, কিন্তু তাহলে তুমি খালি মন দিয়ে রাঁধাবাড়া করবে। গোয়েন্দাগিরি যা করবার আমরা করব, আমাদের সার্টিফিকেট না থাকতে পারে, কিন্তু খাতায় নাম লেখা আছে। বুঝলে।
বাবুরা বাজার করে দেবে, আমি দু-বেলার ভাড়ার বের করে দেব, মেজোবউ কুটনো কুটে দেবে, আর তুমি কী রাঁধাবাড়া হবে সব নিজে ঠিক করে, মশলা বেটে, দু-বেলা রাঁধবে, ব্য। তোমার পেছনে আমরা ম্যাও ধরে বেড়াতে পারব না বলে রাখলাম। এবার একটু তদন্ত করবার তাহলে ফুরসত পাব।
গুটে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললে, গোয়েন্দাগিরিটাই হল গিয়ে আমার পেশা, মাঠাকরুন, সেটাই ছেড়ে দিলে যে একেবারে রাঁধুনে বামুন বনে যাব।
জেঠিমা আশ্চর্য হয়ে বললেন, মাইনে নিয়ে, দু-বেলা পেটপুজো করে, লোকের বাড়ি রান্নার কাজ করবে আর রাঁধুনে বনবে না, সেটা কী করে হয় বাছা? আমার কথা ভালো না লাগে তো অন্য জায়গায় চেষ্টা করতে পার। তবে পুলিশে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেটা মনে রেখো।
গুটে একটু রেগে গেল, যা হয় একটা বললেই হল কিনা মাঠাকরুণ! পিসিমার কথায় আমাকে যদি পুলিশে ধরে তো ক্ষতি হবে কার?
গুটে আরও কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ততক্ষণে জগদীশদা গিয়ে বাবা আর জ্যাঠামশাইকে ধরে এনেছে। তারাও চপ কাটলেট মুর্গ-মসল্লামের নাম শুনে ছুটতে ছুটতে এসে হাজির!
হ্যাঁ, হ্যাঁ, গুটেকে রাখা হোক। জগদীশ ওকে ক-দিন খাটের তলায় লুকিয়ে রাখতে পারে? না হে গুটে, তুমি এখন থেকেই কাজে বহাল হলে। বাপ! পনেরো বচ্ছর ধরে রোজ দু-বেলা শাক-চচ্চড়ি আর মাছের ঝোল খেয়ে খেয়ে খাওয়ায় ঘেন্না ধরে গেছে-না! তা, কাল সকালে কী রাঁধছ বলো!
এই নিয়ে মহা একটা শোরগোল হয়েছিল। শেষ অবধি জ্যাঠামশাই বললেন যে, আমাদের বাড়ির মধ্যে গুটে গোয়েন্দাগিরি করবে না। কিন্তু রোজ সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার মধ্যে রাঁধাবাড়া সেরে ঢাকাটুকি দিয়ে চলে যাবে। আবার সাড়ে দশটায় জ্যাঠামশাই শুতে যান, তার মধ্যে ফিরে আসা চাই। তাই শুনে গুটে মহা কাওম্যাও লাগাল, ও বাবা! রাতে আমি বেরুতে পারব না, আমার ভূতের ভয় করে!
জেঠিমা দারুণ চটে গেলেন। নবাব! চাকরের কাজ করবেন, তার আবার ভূতের ভয়! ওসব বড়োমানুষি এখানে চলবে না বলে রাখলুম!
কিন্তু যে যাই বলুক মুর্গ-মসল্লামের কথা শুনে অবধি, বাবা জ্যাঠামশাই গুটেকে ছাড়তে রাজি নন। বাবা বললেন, বেশ, তা হলে রোজ বেলা এগারোটার মধ্যে রান্না সেরে বেরিয়ে যাবে, চারটের সময় ফিরে এসে চায়ের জল চাপাবে।
বলেই বাবা একটু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, হারে, দিনে বেরুলে তোকে পুলিশে ধরবে না?
গুটে সলজ্জ হেসে বললে, না স্যার, আমি লেডি সেজে থাকব। এর মধ্যে দু-দিন ও-রকম সেজে ইন্সপেক্টর বাবুর বাড়ি গিয়ে লেবু বেচে ওনাদের পরখ করে এসেছি। তবে আপনারা কিন্তু আমাকে শশীকলা বলে ডাকবেন। তাতে কোনো দোষ হবে না। শশীকলা হল গিয়ে আমার স্ত্রীর নাম, সে দেশে থাকে, জানতেও পারবে না। আপনাদের কোনো ভয় নেই, কাল সকালের মধ্যে দাড়ি চেঁচে শাড়ি পরে কেমন কাজে লেগে যাই দেখবেন।
যাবার আগে জগদীশদা বাবাকে বলল, দেখবেন মামা, ওটি একটি রত্ন। আপনার ঠাকুর ফিরে এলেও ওকে আপনার ছাড়তে ইচ্ছে করবে না। তখন কিন্তু আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে বলে রাখলাম। ততদিনে আশা করছি এদিককার গোলযোগ চুকেবুকে যাবে।
গুটে কিন্তু খুব আপত্তি করতে লাগল, ও আবার কী কথা, স্যার? গোলযোগ চুকে গেলেও আমাকে এ-রকম চাকরি করতে হবে নাকি? আমি হলাম গিয়ে গোয়েন্দা, অন্য কোথাও তদন্ত করতে চলে যাব।
জগদীশদা বিরক্ত হয়ে বললে, রাখো! তোমার তদন্তের চাইতে তোমার রান্না শতগুণে ভালো।
তারপর বাবাকে বললে, মামা, বড়ো উপকার করলেন, তার পুরস্কার হাতে হাতে ওই গুটের হাতেই পেয়ে যাবেন রোজ দু-বেলা!
০৭.
এমনি করে শশীকলাদিদি আমাদের বাড়িতে এসে জুটলেন। মা-বাবা, জ্যাঠামশাই, জেঠিমা, জগদীশদাদা আর আমি ছাড়া কেউ আসল ব্যাপারটা জানল না, নেপুও না। ওকে বলা মানেই অপূর্বদাকে বলা, তার মানেই খবরের কাগজে ছেপে দৈওয়া।
তবে একথা সত্যি শশীকলাদিদি খাসা রাঁধে। প্রথম দিনটা মা-জেঠিমা একটু খেইমেই করেছিলেন, বড় ঘি খরচ করে, ওঁরা রান্নাঘরে গেলে তেড়িয়া হয়ে ওঠে ইত্যাদি। কিন্তু একবার রান্না খেয়ে আর টু শব্দটি করলেন না। একমনে এর ওর বাক্স সার্চ করতে লাগলেন।
দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল। আমাদের সকলের ইস্কুল-টিস্কুল কবে খুলে গেল, নতুন বছরের পড়াশুনো শুরু হয়ে গেল, গোছ গোছা সব নতুন বই খাতা এল। কী সুন্দর যে তাদের গন্ধ, নাক লাগিয়ে পড়ে থাকতে ইচ্ছে করত।
নেপু দিস্তে দিস্তে হলদে কাগজ কিনে এনে, এক ভাঁড় ময়দার লেই বানিয়ে খাতার মলাট দিতে লেগে গেল। অথচ পড়াশুনো করবে কচু!
চুরিটুরি গুলোও কমতে কমতে একরকম বন্ধই হয়ে গেল। যাদের ধরা হয়েছিল, তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই কোনোরকম প্রমাণ না পাওয়াতে বেশিরভাগই ছাড়া পেয়ে গেল। দেখলুম দিব্যি চেকনাই শরীর করে সব দলে দলে বেরিয়ে এলেন।
বিকেলে জগদীশদার পিসিমা আমাদের বাড়িতে এলেন।
দ্যাখ দিকিনি কাণ্ডটা! গুরুদেব সেখান থেকে আধখানা হয়ে এলেন, তবু তার কাছে সব কথা খুলেই বলে ফেললাম। শুনে বললেন, কৌটো গেছে আবার পাওয়া যাবে, কিন্তু হিরের প্রজাপতি দেয়া ঢাকনিটে হাতছাড়া করার কোনো মানেই হয় না, ওটি ওঁর চরণে জিম্মা করে দিলে আর কারো বাবার সাধ্যি থাকবে না খুঁজে বের করে।
কিন্তু সে যে কোথায় লুকিয়ে রেখেছি কিছুতেই মনে করতে পাচ্ছিনে। গোটা বাড়িটাকে ওলটপালট করে ফেললাম, তবু পেলাম না! কী করা যায় বল দিকিনি? ওটি এখন চুরি গেলেও তো টের পাব না! গুটেকে কেন যে তাড়ালাম! সে থাকলে ছোঁকছোঁক করে ঠিক বের করে দিত!
মা জেঠিমা এ ওর মুখের দিকে তাকালেন, মা একটু আমতা আমতা করে অন্য কথা পাড়লেন, আচ্ছা, ঠাকুরঝি, সেদিন মাসিমার হাতে পুরোনো টাকা দেখে অমন করে ছুটে চলে গেলে কেন, সে তো বললে না?
পিসিমা দু-চোখ কপালে তুলে বললেন, ওমা বলিনি বুঝি? দ্যা দিকি কাণ্ড। তবে শোন, আমার বাবা চোখ বুজলে, শ্রাদ্ধশান্তির আগের দিন, ওঁর খাটের তলা থেকে বিরাট এক লোহার ট্রাঙ্ক বেরুল, এমন ভারী যে একা আমি সহজে নাড়াতে পারি নে!
একদম কানায় কানায় এই বড়ো বড়ো ভারী ভারী রুপোর টাকায় ঠাসা, একেবারে অবিকল বোর্ডিঙের মাসিমার ওই টাকার মতন! তখন আর সময় ছিল না, কে কোথা থেকে দেখে ফেলবে এক মুঠো তুলে ভালো করে দেখবার জন্যে আঁচলে বেঁধে ফেলে বাকি আবার বন্ধ করে ফেললাম। সে কি বন্ধ হয়! বাক্সের ডালায় চেপে বসে তবে বন্ধ করতে হল! অথচ শ্রাদ্ধশান্তির পর ডালা খুলে দেখা গেল কেবল ছেঁড়া কাগজ আর পুরোনো বই দিয়ে ঠাসা!
জেঠিমা বললেন, ওমা! অত সব নিলে কে?
পিসিমা প্রায় কেঁদেই ফেলেন, কে নিল বুঝবে কে? এমনকী, যখন টাকার কথা বললাম কেউ বিশ্বাসই করে না। বলে হ্যাঁ, এর বাড়ি ওর বাড়ি খেয়ে বেড়াত, ওর আবার অত টাকা আসবে কোত্থেকে?
পিসিমা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। মা বললেন, তারপর মাসিমার হাতে ও টাকা দেখে বুঝি ভাবলে যে তোমার গুলোই কেউ সরিয়েছে? বাড়ি গিয়ে কী দেখলে?
পিসিমা বললেন, দেখলাম আমার পঁচিশটে টাকা ঠিকই আছে। অথচ এগুলোও সেইরকমই দেখতে বটে! কী জানি, কত কী মনে হচ্ছে!
শশীকলাদিদি এতক্ষণ দোরগোড়া থেকে সব শুনছিল, কেউ টের পায়নি। এবার একটা ছোটো নোটবই আর কপিং পেনসিল বের করে বলে উঠল, আচ্ছা, আপনার বাবা মারা যাবার সময় বাড়িতে কে কে ছিল?
পিসিমা বললেন, তোমার তাতে কী, বাছা? তবে বলতে কোনো বাধা নেই, বাড়িতে ছিল না বিশেষ কেউ, বুড়ো কি আর কাকেও চটাতে বাকি রেখেছিল! ছিলাম আমি, আর জগদীশের বাবা ঘেঁটু আর আমার অধরা, তার মেয়ে রেবতী আর আমাদের চাকর রামভজন। তাদের কাকেও সন্দেহ করা যায় না, পুরোনো লোক, নিকট আত্মীয়, বিশ-পঁচিশ বছরের সব জানা। তা ছাড়া তাদের বাক্স প্যাটরা খুলিয়ে নিজে দেখেছিলাম, তাইতেই তো সকলের সঙ্গে চিরকালের ছাড়াছাড়ি!– ও কী শশীকলা, আমার সব কথা টুকে রাখছ কেন? না মেজোবউ, বড়োবউ, এ আমি ভালো বুঝি নে!
শশীকলাদিদি লজ্জা পেয়ে বললে, না, মানে, বাবু আমাদের সবাকার নাম লিখিয়েছেন কি না, তাই সময় পেলেই একটু চেষ্টাচরিত্তির করি।
জেঠিমা শুকনো গলায় বললেন, সময় কোথায় পেলে বাছা?
শশীকলাদিদি আর দাঁড়াল না।
পিসিমা চলে গেলে পর জেঠিমা রান্নাঘরে গিয়ে শশীকলাদিদিকে আচ্ছা করে বকে দিলেন।
মেয়েমানুষের অত কী বাপু? বলছি না টিকটিকির কাজ আমরা করব, তুমি রাঁধাবাড়া নিয়ে থাকবে। বেলা এগারোটা থেকে চারটে অবধি বাড়ির বাইরে তুমি যা ইচ্ছে করতে পার, তার ওপর আমাদের হাত নেই কিন্তু এখন তুমি আমাদের রাঁধুনি– দাও শিগগির খাতা!
বলে খাতাখানা টেনে নেন আর কী! শশীদিদিও কিছুতেই দেবে না, উলটে মহা হউমাউ লাগল! তাই শুনে বাবা জ্যাঠামশাই ছুটে এলেন, আহা, করো কী করো কী, অ্যাদ্দিন বাদে চাট্টি ভালো-মন্দ খেয়ে বাঁচছি, তা তুমি দেখছি সব পণ্ড করে দেবে! না, না, তোমার খাতা দিতে হবে না, এখন যাও দিকিনি রান্নাঘরের দিকে, আপগানি কাটলেট করবে বলেছিলে না?
বাস্তবিক শশীকলাদিদির সে রান্নার স্বাদ আজও আমার মুখে লেগে রয়েছে। কাজেই নেপু, আমি, বড়দা ইত্যাদি সবাই ওর ওপর মহাখুশি ছিলাম।
সন্ধ্যে বেলা পড়ার ঘরে অঙ্ক কষছি, এমন সময় শশীকলাদি এসে হাজির!
ও দিদি, বলোই-না সে টাকা দেখেছিলে নাকি?
আমি নেপুর দিকে তাকিয়ে বললুম, কোন টাকা?
সে বললে– ওই যে বুড়ো মলে পব বাক্স থেকে উধাও হল, তারপর বোর্ডিঙের বড়ো মাসিমা ঠিক সেইরকম দেখতে টাকা তোমার কাছে রাখতে দিলেন? দেখি-না একবারটি।
নেপু রেগে গেল, আঃ শশীকলাদিদি, তুমি দেখছি আমাকে কাল বকুনি খাওয়াবে। এমনিতেই অঙ্ক হয় না।
সে চলে গেলে আমাকে জিজ্ঞেস করল, কোন টাকা রে?
আমি বললুম, হ্যাঁ, সে আমি তোমায় বলি আর তুমি গিয়ে কাপ্তান অপূর্বর কাছে লাগাও আর কী!
নেপু অঙ্কটঙ্কর কথা ভুলে গেল।
অপূর্বদার বিষয় তুই কী জানিস শুনি? জানিস ইন্টার-কলেজিয়েট সাঁতারের জন্যে উনি মেডেল পেয়েছিলেন? তা ছাড়া ভাগ্যিস ওঁর দল রাতে পাড়ায় পাড়ায় টহল দেয়, তাই চোরবাছাধনরা আর টু শব্দটি করতে পারছেন না!
বললুম, রেখে দাও!ওঁর নাকের সামনে আমাদের ইস্কুলে অমন কাণ্ড হয়ে গেল, ভারি আমার ওস্তাদ রে!
নেপু তাই শুনে একটু মুচকি হেসে বললে, সে বিষয়ও কিছু এগোয়নি ভেবেছিস নাকি তোরা? শিগগির একদিন সব চোখ ট্যারা হয়ে যাবে দেখিস!
এমনি সময় শশীকলাদিদি দরজায় মুখ বাড়িয়ে বলল, গরম গরম চপ ভেজেছি, খাবে নাকি দু-একটা?
এরপর তো আর কোনো কথাই হতে পারে না।
ওসব ছোটো জায়গায় সেকালে কারো ঘরের কথা কারো জানতে বাকি থাকত না। দু-দিনেই একথা জানাজানি হয়ে গেল যে জগদীশদার সঙ্গে অপূর্বদার কিছু নিয়ে মন কষাকষি চলেছে।
সত্যি আগে দেখতুম দু-জনায় ভারি ভাব, কিন্তু আজকাল দেখা হলেই আমাদের কাছে জগদীশদা অপূর্বর্দার খুব নিন্দেমান্দা করতে শুরু করল। প্রথমটা বেশ মজা লাগত।
পরে নেপুকে গিয়ে বলতুম আর সে তো রেগে টং!
ওই স্টুপিডটাকে এ-বাড়িতে আসতে দিস কেন রে? যার নিজের পকেট থেকে নিজেদের সোনার কৌটো চুরি যায়, অথচ নিজে টের পায় না, সে আবার একটা মানুষ নাকি? অপূর্বার সঙ্গে ও ব্যাটার তুলনা! কীসে আর কীসে, সোনায় আর সিসেয়! কই অপূর্বদা তো জগদীশদার বিষয় কিছু বলতে আসেন না!
শশীকলাদিদি যে কখন এসে আমাদের পেছনে দাঁড়িয়েছে সে আমরা টের পাইনি। সে বললে, তা সে বলবে কেন? একটা ধর্ম আছে তো? জগদীশবাবুর কাছে রাশি রাশি ঘুস খেয়েছে-না!
নেপু বললে, কী আবার ঘুস খেয়েছে?
শশীকলাদিদি জিভ কেটে বললে, না, না, ও কিছু না। বলে তাড়াতাড়ি সরে পড়ল।
এবার আর মাসিমার ওই টাকাগুলোর কথা নেপুকে না বলে পারলুম না। নেপু তো হাঁ!
কই, দেখা তো টাকাগুলো?
আস্তে আস্তে বইয়ের তাকের কাছে গিয়ে দেখি তাক তোলপাড় করে কে খোঁজাখুঁজি করেছে!
নেপু বললে সর্বনাশ! তবে তো সেগুলোও গেছে! না হেসে পারলুম না। তাকের তলা থেকে আমার পুরোনো জুতোটা টেনে বের করে তার মধ্যে থেকে টাকা বের করে নেপুকে দেখালুম।
নেপু ওগুলোকে নেড়েচেড়ে বললে, এখন এর এক-একটার দাম হয়তো পঁচিশ টাকা। সাধে মাসিমা কাছে রাখতে ভয় পান। দে আমাকে, অপূর্বার কাছে রেখে দিই, কারো বাবাঠাকুর টেরটি পাবে না!
দিলুম না কিছুতেই।
ওদিকে জগদীশদাদের বাড়িতেও মহা গোলমাল। পিসিমার গুরুদেব কায়েমি হয়ে বসেছেন। এমনিতে পিসিমার মুখের ওপর কিছু বলতে জগদীশদা সাহস পায় না, এবার কিন্তু দারুণ একচোট ঝগড়া হয়ে গেল! জগদীশদা বললে, দ্যাখো, তোমার গুরুদেবকে এবার কাশীবাসী হতে বলল, নইলে ভালো হবে না। একবার শ্রীঘর ঘুরে তো যথেষ্ট চেঞ্জ হয়েছে, আবার এখানে কেন? তা ছাড়া সন্নিসি মানুষের অত কী রে বাবা! রোজ রোজ গাওয়া ঘি, খ্যাসরাপাতি চালের ভাত, ছানার বড়া! কই আমাকে তো এর সিকির সিকিও দাও না! অথচ খালি খালি বলল, টাকা দাও, টাকা দাও। বলি, তোমার গুরুদেবকে পুষবার জন্যে তো আর আমি আপিসে চাকরি করি না!
পিসিমাও রুখে উঠলেন, ওরে হতভাগা! গুরুদেব শিবের মাথায় বেলপাতা দিলেন, তবে-না চাকরি পেলি! আবার বড়াই! যা আছে তোর সব-ই তো গুরুদেবের দয়াতে।
জগদীশদা বললে, ইস্, তা তো বটেই! এই বাড়ি আমার ঠাকুরদা দেননি আমাকে? গয়নাগাটি, টাকাকড়ি সবই আমার হত, তুমি যদি মাঝখান থেকে সেগুলো মেরে না দিতে! যাক গে, ওকে এখন ভালোয় ভালোয় কেটে পড়তে বলো দিকিনি।
চ্যাঁচামেচি শুনে গুরুদেবও এসে হাজির! রাগের চোটে মুখের রং পাকা আম, চুলদাড়ি খাড়া। চেঁচিয়ে বললেন, তাই কেটিয়ে যাবে রে। তখন তোর কী অবস্থা হয় দেখিয়ে দেব। দে বেটি, কৌটোর সে পতাঙ্গটো দে, লিয়ে যাই।
পিসিমা গুরুদেবের পায়ে পড়ে বললেন, আর দুটো দিন সময় দেবেন ঠাকুর, কোথাও খুঁজে পাচ্ছি নে যে।
জগদীশদা তো থ!
খবরদার পিসিমা, বুড়োকে এ-বাড়ি থেকে কোনো জিনিস দিতে পারবে না।
পরে পিসিমা জেঠিমাকে বলেছিলেন যে জগদীশদার যে আবার এত তেজ এ তার ধারণার বাইরে ছিল। বললেন, কী বলব তোদের, ওকে দেখে নেকড়ে বাঘের কথা মনে হচ্ছিল। গুরুদেব বেচারা আর কথাটি না বলে, পোঁটলা-পুঁটলি বেঁধে রওনা! একটু টিপিন পর্যন্ত দিতে পারলাম; মাঝের ঘরে দাঁড়িয়ে চোখ রাঙিয়ে জগদীশ বললে, একটা সটির দানা পর্যন্ত দেবে না! উঃ! রাঁধিনি, খাইনি, পেট জ্বলে গেল! ফলপাকুড় কিছু থাকে তো দে।
মা সন্দেশ আর পাকা কলা এনে দিয়ে বললেন, জগদীশ কী খেল?
পিসিমা বললেন, ও ব্যাটার কথা আর বলিস না। প্রফুল্ল কেবিন থেকে একরাশ গিলে এল। ভাবছি আজ তোদের এখানেই শোব!
০৮.
সত্যি সত্যি রাতটা পিসিমা থেকে গেলেন। শুলেন আবার আমার খাটে। সারারাত ঘুমুব কী? খালি খালি ঠান্ডা খড়খড়ে পা দুটো আমার লেপের মধ্যে গুঁজে দিয়ে গরম করতে চেষ্টা করতে লাগলেন।
হঠাৎ কড়াৎ করে ছিটকিনি খোলার শব্দ শুনে উঠে বসলুম। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি শশীকলাদিদি, টর্চ হাতে নিয়ে, রান্নাঘরের দোরে তালা লাগিয়ে খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে গেল।
বিছানায় ফিরে এসে কাউকে কথাটা জানাব কি না ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লুম। সকালে রোজকার মতন শশীকলাদিদিকে ঘোমটা মাথায় ডিম রুটি পরিবেশন করতে দেখে জিজ্ঞেস করলুম, শশীদিদি কাল রাতে কোথায় গেছলে?
শশীকলাদিদি এমনি চমকে উঠল যে ঘোমটা খসে গেল, তখুনি সেটাকে টেনে দিয়ে বললে, রাত দুপুরে আবার যাব কোথায়?
বললুম, কেন, পষ্ট দেখলুম রান্নাঘরে তালা দিয়ে বেরুলে।
শশীদিদি দারুণ চটে গেল, না বাপু! বাড়ির ছেলেপুলেরাও পেছনে লাগলে তো পারা যায়। তা হলে তো কাজ করা দায় হয়ে ওঠে!
অমনি বাবা, জ্যাঠামশাই, নেপু, বড়দা সবাই আমাকে তাড়া!
খবরদার, ওর পেছনে লাগবে না বলছি। না, না, ও ছেলেমানুষ কী দেখতে কী দেখেছে, ওর কথায় কান দিয়ো না।
তারপর শশীকলাদিদির দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে নেপু জিজ্ঞেস করলে, ও কী? মুখে কাপড় জড়িয়েছ কেন? দাঁত ব্যথা নাকি?
শশীদিদিও অমনি ঘাড় নেড়ে বললে যে হ্যাঁ, ভীষণ দাঁত কনকন!
আমি তো হেসে বাঁচি নে, কারণ ঘোমটা খোলার সময় পষ্ট দেখেছিলুম শশীদিদির গালে চড় খাওয়ার পাঁচ আঙুলের দাগ।
চা খাবার পর পিসিমাকে বাড়ি পৌঁছোতে গিয়ে জেঠিমা আর আমি অবাক! দরজা জানলা সব হাট করে খোলা। জিনিসপত্র তচনচ। দেয়ালের ছবি ওলটানো, আলমারির বই মাটিতে, তোশক বালিশ ফালা ফালা। ভাঁড়ারের তালা ভাঙা, শিশি বোতল, বাক্স ভঁড় সব নীচে। বাড়িতে জনমানুষের সাড়া নেই।
এতক্ষণ বাদে পিসিমা ভাড়ার ঘরের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
ওরে জগদীশ, ওরে লক্ষ্মীছাড়া, গুরুদেবকে অশ্রদ্ধা করেছিলি বলেই-না তোর এ দশা হল! ভাঁড়ারের এই অবস্থা আর তুই কি আর আছিস রে!
কিছুতেই থামেন না। জেঠিমা পিঠ থাবড়াতে লাগলেন, আমি একটা পুরোনো খবরের কাগজ দিয়ে হাওয়া করতে লাগলাম। কিন্তু পিসিমা সমানে চাঁচাতে লাগলেন, ওরে হতভাগা! তুই মলে আমার প্রজাপতি কে খুঁজে দেবে বল?
ঠিক সেই সময় সামনের স্নানের ঘরের দরজা খুলে, উশকোখুশকো চুল আর লাল টকটকে চোখ নিয়ে জগদীশদা বেরুল। জামাকাপড় ছেঁড়া, গা-ময় কালশিটে আর আঁচড়কামড়। ভাঙা গলায় বললে, থামো দিকিনি!
পিসিমাও অমনি হাত-পা এলিয়ে ভিরমি!
সেই সময় লাবণ্যদি আর লতিকাদি এসে না পড়লে কী মুশকিলেই যে পড়া যেত! জগদীশদা ওঁদের দেখে এক দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে ছিটকিনি!
শেষটা লাবণ্যদিরা ধরাধরি করে পিসিমাকে খাটে শুইয়ে মাথায় ঘড়া ঘড়া জল ঢাললেন, তবে পিসিমা চোখ মেলে চাইলেন।
চেয়েই বললেন, বিছানা ভেজালে, এখন শুকুবে কী করে শুনি?
লতিকাদি শুনবেন কেন, বললেন, জল ঢালব না তো কী, আরেকটু হলেই যে চোখ উলটে গেছিল! বলে নিজেরাই হাতে হাতে ভঁড়ার ঘর গুছুতে লেগে গেলেন। আমাকে বললেন, ছোকরা চাকরটা গেল কোথায়, গুদোমে গিয়ে খোঁজ নে।
দেখি সে এইমাত্র কোত্থেকে যেন ফিরে, চকচকে পামশু খুলে রেখে, পা ধুচ্ছে। বলল নাকি অপূর্বদা ওকে কাল রাত নটার বাইস্কোপে পাস দিয়েছিলেন, ম্যানেজার ওর দোস্ত কি না। রাতে আর ফেরেনি, কোন বন্ধুর বাড়িতে খেয়েদেয়ে শুয়ে ছিল। এ বাড়ির রাঁধাবাড়ার তো কিছু ঠিক নেই। কাল দুপুরেও দোকানে গিয়ে তেলেভাজা দিয়ে মুড়ি দিয়ে খেয়ে আসতে হয়েছিল। এখানে আর বেশিদিন ওর কাজ করার ইচ্ছে নেই। আরও কী কী যেন বলতে যাচ্ছিল, লাবণ্যদিরা ডাকাডাকি করাতে আর বলা হল না।
ওর হাতে চিঠি লিখে লাবণ্যদিই থানায় পাঠালেন। জগদীশদা অনেক ডাকাডাকি করাতেও ঘরের দোর খুলল না। শেষটা জেঠিমা পিসিমার কাছে থাকলেন, লাবণ্যদিদিদের সঙ্গে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। আমার একটুও যেতে ইচ্ছে করছিল না।
ততক্ষণে পিসিমা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসেছেন। এঁটে খোঁপা বেঁধে লাবণ্যদিদিদের বললেন, একটু দাঁড়িয়ে যাও বাছা। আমার জন্যে অনেক করলে, দু-জনায় এই শিশি দুটো নিয়ে যাও দিকিনি। ধরো লতিকা, লেবুর ঝাল আচার। ওটা সামান্য একটু গেঁজে গেছে, কিন্তু দু-দিন
রোদ্দুরে দিয়ে নিলেই কেউ টেরও পাবে না। আর লাবণ্য, তুমি বাছা এই পেয়ারার জেলিটা নিয়ে যাও। কালো দেখে মনে কোরো না যে খেতে খারাপ খারাপ জিনিস আমার হাতে বেরোই না কখনো, তবে ওই একটু কালচিটে রং ধরে গেছে। এ কি আর আমি সহজে হাতছাড়া করি, নেহাত কোন অজাতে-বেজাতে ছুঁয়ে দিয়েছে, তার কোনো ব্যামোটামো ছিল কিনা তাই-বা কে জানে। আচ্ছা বাছা, এসো তা হলে, আমার এই বেলা অবধি জপ সন্ধ্যে কিছুই হল না।
এই বলে আমাদের সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। আমাকে কিন্তু কিছু দিলেন না। অথচ লেবুর আচার, পেয়ারা-জেলি আমিও যথেষ্ট ভালোবাসি।
বাড়ির বাইরে এসেই দেখি শীতের রোদ্দুরে সারা শহরটা ঝিমঝিম করছে। দূরে মাথার ওপর ঘন নীল আকাশে দুটো চিল ঘুরছে। ঝাউ গাছের পাতা বাতাসে দুলছে, কোত্থেকে যেন কমলা লেবুর গন্ধ আসছে। কে বলবে জগদীশদাদের বাড়ির মধ্যে এত কাণ্ড!
আমাদের চান-খাওয়া সারা হয়ে যাবার কত পরে জেঠিমা ফিরলেন। মা আর অরুণাবউদি ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, খিদেও পেয়েছিল বোধ হয়, ওঁদের আবার চান করে উঠেই না খেলেই নয়! জেঠিমা এসে ঢুকতেই দু-জনে কী হল, কী হল করে হামলে পড়লেন।
জেঠিমা মাথায় দু-ঘটি জল ঢেলে, একসঙ্গে খেতে বসে বললেন, সে এক কাণ্ড, বুঝলি মেজোবউ, বাড়িঘর ডালের কাঠি দিয়ে নাড়া, অথচ ঠাকুরঝি বলে কী, না কিছু হারায়নি। আবার হারায়নি বলে রাগ কত! বলে কি না, কই করুক তো কেউ আমার মতো জ্যাম জেলি, অথচ একটা ছোটো শিশি অবধি নিল না! কেন, আমার জিনিস খারাপ নাকি? নাকি, তোরাই ভালো জিনিস দেখলে চিনিস না? চুরি করতে এইচিস অথচ কোনটা ভালো কোনটা মন্দ জানিস না! এ আবার কেমনধারা চোর! শেষটা পুলিশ ইন্সপেক্টর লোকজন নিয়ে এসে পড়াতে পিসিমাকেও থামতে হল, আর জগদীশদাকেও বেরিয়ে আসতে হল। বেরিয়েই পুলিশদের ওপর রাগমাগ করতে লাগল।
ট্যাক্স নেবার বেলায় সব ঠিক আছেন, অথচ নিজের বাড়িতে নিরাপদে ঘুমুতে পারব না, ঠ্যাঙাড়ের দল এসে মেরে পিটিয়ে জিনিস নষ্ট করে দিয়ে চলে যাবে! কেন, থানার লোকেরা করে কী?
কিন্তু জগদীশদা নিজে কিছুই বলতে পারে না। ক-টা লোক, কোন দিক দিয়ে এল, কেমন চেহারা, সঙ্গে হাতিয়ার ছিল কি না কিছুই জানে না!
মা হেসে বললেন, তা জানবে কী করে? সাড়া পেয়েই বোধ হয় স্নানের ঘরে ঢুকেছিল। আমি বললুম, ওমা, না, তাহলে অমন বেদম পিটল কী করে ওকে?
ব্যস্, সবাই মিলে আমাকে সে কী বকুনি! জ্যাঠা মেয়ে, বড়োদের কথায় কথা বলতে আসে, এইসব। চুপ করে সব শুনলুম, কিছু বললুম না।
সন্ধ্যে বেলা পড়ছি, নেপু গেছে তার গুরুঠাকুর অপূর্বদার বাড়ি, কী নাকি জরুরি দরকার! হেসে বাঁচি নে। এমন সময় শশীকল্লাদিদি আস্তে আস্তে দোর গোড়ায় দাঁড়াল।
ও দিদি, সবই তো জানো, এদিকে আমি যে গাল ব্যথায় মলাম। উঃ, দাঁতের গোড়াসুদ্ধ নড়িয়ে দিচ্ছে বোধ হয়! দাও-না, ওই যে কী বড়ি আছে তোমাদের, নইলে আর তো পারছি না!
তাকিয়ে দেখি শশীদিদির গাল ফুলে চালকুমড়ো! বললুম, দেব, যদি বল কে মেরেছে।
শশীকলাদিদি শিউরে উঠে বলল, ও দিদি, দাও দিদি লক্ষ্মীটি, তোমাকে এক্ষুনি গরম পেঁয়াজি খাওয়াব। কুটে রেখে এসেছি ও ঘরে, কড়াইতে তেল ঢেলেছি, দাও দিদি, পায়ে পড়ি!
আমি উঠে বললুম, তা হলে বলবে না? এই আবার বসলুম।
শশীদিদি প্রায় কেঁদে ফেলে, ও কী আবার বসলে কেন? না দিলে যে মরে যাব! বলব কোন সাহসে, ফালা করে চিরে ফেলবে যে! তবু এইটুকু বলছি যে জগদীশবাবুকে রোগা পটকা দেখে মনে কোরো না যে ওনার হাতে জোর নেই!– দাও দিদি দুটো বড়ি!
বড়ি নিয়ে শশীকলাদিদি চলে গেলে পর, নেপু এসে জুতো খুলতে খুলতে বলল, অপূর্বদার খুব জ্বর, সর্দিকাশি। বেরুতে পারছেন না, তাই আমাকে একটা কাজ দিয়েছেন।
আমি কিছুই বিশ্বাস করিনি। মুখে বললুম, কাকে? তোকে? আর হাসতে পারি নে বাবা।
০৯.
অবিশ্যি নেপু কী বলে না বলে আমি থোড়াই কেয়ার করি। তবু এর দু-দিন পরে যখন একদিন বিকেলে জঘন্য নোংরা প্যান্ট-শার্ট পরে এসে, এক ঘণ্টা ধরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, ভিজে হাত দিয়ে চেপে চেপে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, তুই অপূর্বার যত খুশি নিন্দে করতে পারিস, কিন্তু তোদের নেকি লাবণ্যদিদিমণি দারুণ খাতির করেন। জানিস, ওঁকে এক বোতল পেয়ারা-জেলি পাঠিয়েছেন?
তখন অবাক না হয়ে পারলুম না।
নেপু আমার দিকে না তাকিয়ে, মুখটাকে আয়নার খুব কাছে নিয়ে গিয়ে মাথার মাঝখানকার খাড়া চুলগুলোকে প্লেন করতে করতে বলল, জানিস, অপূর্বদা রোজ সকালে একমনি মুগুর ভাঁজেন! তারপর এক-পো শেকড়ওয়ালা কঁচা ছোলা খান। আমাকেও খেতে বলেছেন, তা তোদের বাড়িতে কি ওসব হবার জো আছে? বলতে-না-বলতে মা তেড়ে আসবেন! জানিস, অপূর্বদা একবার একটা পাগলা মোষের শিং চেপে ধরে, এমনি করে এক মোচড় দিয়ে, তাকে রাস্তার মাঝখানে একেবারে কুপোকাত-এর বেশি আর বলা হল না, কারণ কায়দাটা দেখাতে গিয়ে, নেপুর হাত থেকে চিরুনি ছুটে গিয়ে, জানালার কাছে পড়াতে, কাচ ভেঙে চৌচির আর নেপু জিভ কেটে পগার পার। একা একা কত হাসব?
কিন্তু আজকাল আর খেয়ে-দেয়ে কোনো সুখ নেই, বাবা জ্যাঠামশাইদেরও মন খারাপ! শশীকলাদিদি কেমন যেন বিগড়ে আছে, কখনো বলে দাঁত ব্যথা, বলে পেট কামড়াচ্ছে। মোটে রান্নাঘরের দিকে যায় না। মা জেঠিমাকে আবার হাঁড়ি ঠেলতে হচ্ছে।
সবাই মিলে শশীদিদির কম তোয়াজ করা হয়নি। মুখে গলায় গরম জলের সেঁক, কাগজি লেবু দিয়ে কই মাছের ঝোল-ভাত, হেন-তেন কত কী। আমার যেন বাড়াবাড়ি মনে হয়, কিন্তু আমাদের কথা তো আর তখন কেউ শুনত না।
ও বাড়িতে জগদীশদার শরীর ভালো নেই, তার ওপর সারাক্ষণ গুম হয়ে থাকে। পিসিমা রোজ রোজ এসে বলেন ওঁর নাকি ভয় ভয় করে। শেষটা মাদের বলে-কয়ে, ও বাড়িতে নেপুর আর আমার শোবার ব্যবস্থা করে নিলেন।
বেশ ভালো লাগত। রাতে আমরা ওখানেই খেতুম। পিসিমা নিজের হাতে লুচি, বেগুনভাজা, আলুর দম, ক্ষীর, এইসব করতেন। খাবার সময় ওঁদের ছোটোবেলাকার কত গল্প বলতেন। জগদীশদার বাবা কীরকম দুষ্টু ছিলেন, আর উনি নিজে কী ভালো! ওঁরা নাকি খুব বড়োলোক ছিলেন, পাড়ার লোকের চোখ টাটাত। তারপর জিজ্ঞেস করলেন বোর্ডিঙের মাসিমার টাকাগুলো ফিরিয়ে দিয়েছি কি না? বললুম, মা রাখতে মানা করেছেন, তাই দিয়ে এসেছি। তাই শুনে পিসিমা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আমার বাবার টাকার মতন দেখতে ওগুলো। ওরই মধ্যে পুলিশরা দু-চারদিন এসে জগদীশদাকে দিয়ে সেই রাতের কথা সব লিখিয়ে নিয়ে গেল। নাকি তিন-চারজন দারুণ ষণ্ডা লোক এসে জগদীশবাবুকে চেয়ারের সঙ্গে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলেছিল। তবু যখন জগদীশদা বলতে লাগল বাড়িতে আর সোনাদানা কিছু নেই, তখন নাকি রেগেমেগে, চুল টেনে, কান মলে, একাকার করে দিল।
জগদীশদাও ছেড়ে কথা বলেনি। তবে হাত-পা বাঁধা, কী আর করতে পারে, কষে দুকথা শুনিয়ে দিয়েছে। ব্যাটাদের কান লাল হয়ে উঠেছিল।
পুলিশরা চলে গেলে, পিসিমার ওপর জগদীশদার সে কী রাগ! ওর বিশ্বাস ওর ওপর রেগে, পিসিমার গুরুদেব তাঁর শিষ্যদের দিয়ে এইসব করাচ্ছেন। আমাদের সামনেই পিসিমাকে ডেকে বললে, হিরের প্রজাপতি বসানো ঢাকনিটা কোথায় রেখেছ বলোই-না। ভুলে গেছি আবার কীরকম কথা? সমস্ত বাড়ি তচনচ করেও পাওয়া যায় না, ও আবার কীরকম লুকোবার জায়গা?
পিসিমা হাউ হাউ করে কেঁদে বললেন, পেলে তো গুরুদেবকেই দিয়ে দিতাম।
নেপু আর আমি সকালে উঠে গিয়ে পড়াশুনা করি, স্নান করে খেয়ে ইস্কুলে যাই, বিকেলে জলখাবার খেয়ে এবাড়ি চলে আসি। সঙ্গে আবার হাতের লেখার খাতা আর পদ্য মুখস্থর বই নিয়ে আসতে হয়।
আমাকে পৌঁছে দিয়ে নেপু অপূর্বর্দার কাছ থেকে একবার ঘুরে আসে। ফিরে এসে, রোজ মিথ্যে করে বলে– অনাথদার কাছে অঙ্ক বোঝাতে গেছলুম; এইসব। কারণ আজকাল অপূর্বদার নাম শুনলেই জগদীশদা রেগে যায়।
আমাদের বাড়িতে শশীকলাদিদিকে নিয়ে খুব গোলমাল চলেছে। তার নাকি আজকাল রোজ চোখে ব্যথা করে। তাই নিয়েই একদিন রাতে জগদীশদার কাছে এল।
পিসিমা রান্নাঘরে, নেপু ফেরেনি, আমি খাটের পায়ের দিকে মাটিতে বসে ভূতপ্রেত পড়ছি, সেদিকে কারো নজর পড়েনি।
শশীকলাদিদি খুব গজগজ করতে লাগল, এবার আমার পাওনা টাকা চুকিয়ে দিয়ে ছুটি দিয়ে দেন, বাবু। নইলে একেবারে রাঁধুনি বামনি বনে যাব।
জগদীশদা এক ধমক দিয়ে বলল, গুটে, খবরদার! তোর পেছনে-না পুলিশ ঘুরছে? বলেছি তো গোলমাল চুকে গেলে তোকে আমার এখানেই চাকরি দেব। ক-দিন চুপ করে থাক, যাবার কথা মুখে আনবি নে!
শশীদিদি বললে, কী চাকরি দেবেন বাবু? আমি পাসকরা গোয়েন্দা, আমি তো আর বাবুর্চি নই।
জগদীশদা চটে গেল, চোপ! তুই একটা থার্ড ক্লাস টিকটিকি কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস বাবুর্চি! যার যেটা কাজ! আর দেখ, ফের যাবার কথা মুখে এনেছিস কি আমি সেই সাইকেলের ব্যাপারটা বলে দেব! তাই শুনে শশীদিদির মুখে আর কথাটি নেই! জগদীশদা আরও কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক সেই সময়, পড়বি তো পড়, আমার হাত থেকে বইটা ঝুপ করে পড়ে গেল।
দু-জনেই প্রথমে দারুণ চমকে গেছিল, তারপর আমাকে দেখে সে কী রাগ! ভাগ্যিস ঠিক সেই সময় রাঁধাবাড়া সেরে কলতলা থেকে পিসিমা আমাকে ডাকলেন, নইলে আর রক্ষে ছিল না।
শশীদিদি সুড়ুত করে কোথা দিয়ে যে কেটে পড়ল টেরও পেলুম না! ভীষণ রেগে গেছলুম। পরদিন সকালে মাকে সব বলে দিলুম। মা তো রেগে কই!
তুমি তো আচ্ছা মেয়ে শশীকলা! কাজকর্মের নাম নেই, দু-বেলা থালা থালা ভাত ওড়াবে আর দিব্বি পাড়া বেড়াবে! তোমার মাইনে কাটা হবে!
শশীদিদিও মার মুখের ওপর ভীষণ বেয়াদপি করতে লাগল।
যান, আপনারা অন্য লোক দেখুন গে, এত কাজ আমার পোষায় না। একটা গোটা পরিবারের প্রত্যেকটা লোক যে এ-রকম সাংঘাতিক পেটুক হতে পারে এ আমি ভাবতে পারতাম না!
তাই শুনে জেঠিমা বউদি-টউদি সবাই মিলে মহা চেঁচামেচি লাগালেন। তারপর বাবা জ্যাঠামশাইরা বাড়ি ফেরবার আগেই আমাকে শশীদিদির মাইনের হিসেব কষিয়ে, তার হাতে দিয়ে, তাকে বিদেয় করে দেওয়া হল।
আমি বার বার বলতে লাগলুম, ও শশীদিদি, যেখানে-সেখানে ঘুরো না, তোমাকে পুলিশে ধরবে। সটান জগদীশদার কাছে চলে যাও।
শশীদিদির কী দেমাক! চোখ ঘুরিয়ে বললে, সেখানে যেতে আমার বয়ে গেছে। তা আমার জন্যে তোমায় ভাবতে হবে না। একটা চাকরি নাহয় খেয়েই দিয়েছ, জান রাজরাজড়ারা আমাকে লুফে নেবে। কই রাঁধুক তো কেউ আমার মতো হোসেনি কারি! তা যতই লাগানি ভাঙানি করনা কেন!
বলে এক হাত ঘোমটা টেনে বড়ো বড়ো পা ফেলে চলে গেল!
রাত্রে আমার কাছে সব কথা শুনে জগদীশদা এমনি রাগারাগি করতে লাগল যে, শেষপর্যন্ত নেপু, পিসিমা আর আমি আমাদের বাড়িতে চলে আসতে বাধ্য হলুম!
পরদিন সকালে পিসিমা মা জেঠিমার সঙ্গে সঙ্গে তরকারি কুটতে কুটতে বললেন, আসল কথা তোদের বলাই হয়নি। আমার বাবা ছিলেন লাখপতি, কিন্তু এমনি হাড়কিপটে যে লোকে বলত সকালে ওঁর নাম করলে হাঁড়ি ফাটে। তোরা এখানে ওঁর যে নাম জানিস সেটা ওঁর নাম নয় মোটেই। সেই সব্বনেশে বুড়োর ভয়ে নাম ভাড়িয়ে এখানে এসে ঘাপটি মেরে ছিলেন। এখন পর্যন্ত নাকি লোকে ওঁকে এখানে-ওখানে খুঁজে বেড়াচ্ছে!
সে যাক গে, এখানে বাকি জীবনটা ভগবানের নাম করে কাটিয়ে, শেষটা যখন চোখ বুজলেন, থাকবার মধ্যে রইলাম আমি আর জগদীশের বাবা। আর তাল তাল সোনাদানা আর গোছ গোছ টাকা!
শুনে মা জেঠিমা কুটনো ফেলে গালে হাত দিয়ে বললেন, দেখছ কী কাণ্ড! তা সে সব গেল কোথায়? তোমাদের তো দেখি মাসকাবারে বেশ টানাটানি!
পিসিমা দুঃখু করে বললেন, আরে সে কথা আর বলিস নে! বাবার শ্রাদ্ধের পর কে যে সব চেঁচেপুঁছে নিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। ওই যা দুটো-একটা বাবার পা টেপার সময় বাঁ-হাতে করে সরিয়ে রেখেছিলাম, সে ছাড়া আর কিছু পেলাম না। আমি আর থাকতে না পেরে বললুম, বাঁ-হাতে করে সরানো মানে কী?অমনি মা জেঠিমা চোখ পাকিয়ে উঠলেন, তোর সব কথাতে কী দরকার? যা পড়গে যা!
আমি সরে গিয়ে দরজার ওপাশে বসলাম। পড়া আমার কখন হয়ে গেছে। পিসিমা বলতে লাগলেন, সে এক মজার ব্যাপারে। বাবা বলতেন সিন্দুকের মধ্যে কোনো দামি জিনিস রাখতে হয় না। কারণ চোররা এসে আগেই সিন্দুক ভাঙে, বাক্স খোলে। তাই বাবা করতেন কী, গয়নাগাটি টাকাকড়ি পুটলি বেঁধে চ্যবনপ্রাশের টিনের পেছনে, চ্যাঙারি করে খাটের নীচে, কাগজে মুড়ে যেখানে-সেখানে ফেলে রাখতেন। বাবাও চোখ বুজলেন আর সেসব হাওয়া! ওই দু-চারটে যা আমার কাছে ছিল, তাই-বা রাখতে পারছি কই? জগদীশটা তো অত দামের কৌটো হারাল, হিরের প্রজাপতিটাও খুঁজে পাচ্ছি নে।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, একটু হেসে পিসিমা আবার বললেন, তবে একটা ভালো হয়েছে এই যে সে বুড়োও আরও কৌটো ভরে নাতনির বিয়েতে সিঁদুর দিতে পারবে না!
সবচাইতে আশ্চর্য ব্যাপার হল যে প্রায় এক বছর ধরে এত সব হাঙ্গামার পর আবার আমাদের শহর আগেকার মতন চুপচাপ হয়ে গেল। আবার সবাই বলতে লাগল, এখানে কোনো দিনও কিছু হয় না, বিশ্রী একটা জায়গা। আবার ডিমওয়ালার, রুটিওয়ালার কাছ থেকে সবাই এর। বাড়ির ওর বাড়ির খবর জোগাড় করতে লাগল। আমার একটুও ভালো লাগত না। এত যে জিনিস গেল, চোর ধরা পড়বে কবে?
শশীদিদির জন্য মন কেমন করত, রোজ নেপুকে আমাকে এটা-ওটা ভেজে খাওয়াত। অথচ সেই যে চলে গেল আর তার টিকিটির দেখা নেই। নিজের বাক্সটা অবধি নিয়ে গেল না, তাতে অবিশ্যি কাগজপত্র ছাড়া কিছু ছিল না। আমরা আবার আগের মতো শাক-চচ্চড়ি খেতে লাগলাম। রোজ খেতে বসে বাবারা শশীদিদির জন্যে আক্ষেপ করতেন।
তবে জগদীশদাদের বাড়িতে খানিকটা অদলবদল হল। সেই যে পিসিমার ওপর চটে গেল, সেই থেকে জগদীশদার পিসিমার সঙ্গে কথা বন্ধ। রোজ রাত্রে এক টুকরো কাগজে পরদিন কী কী খাবে, তার একটা ফর্দ লিখে পিসিমার দরজায় আলপিন দিয়ে এঁটে রাখত!
শেষটা একদিন সন্ধ্যে বেলায় একগাল হাসি নিয়ে আমাদের বাড়িতে দেখা করতে এল। জেঠিমার তক্তপোশের ওপর কেঠো-কেঠো ঠ্যাং দুটো তুলে বসে বললে, কলকাতায় আমার খুব ভালো চাকরি হয়েছে, আমি কাল সকালের মোটরেই চলে যাচ্ছি। দিন, চাট্টি পায়ের ধুলো দিন। তবে ওই একটা দুঃখ থেকে গেল, গুটেকে হারালাম।
জগদীশদা চলে গেলে আমাদের খুব মন কেমন করছিল। এমন সময় বিকেল বেলায় নেপু বাড়ি এল, মাথা ধরা, পেট ব্যথা আর জ্বর নিয়ে।
নেপুর মাম্পস হল, আমার মাম্পস হল, বড়দার মাম্পস্ হল, শংকর ঠাকুর দেশ থেকে ফেরবামাত্র ওর মাম্পস হল। সব গাল ফুলে চাল কুমড়ো, ইস্কুল যাওয়া, কাজকম্ম, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ।
শুধু আমাদের নয়, শহরসুদ্ধু সকলের মাম্পস হল–পিয়োনদের, পুলিশদের, দোকানদারদের, মাস্টারমশাইদের, এমনকী ডাক্তারবাবুর স্ত্রীর পর্যন্ত মা হল।
ছেলেদের ইস্কুল, মেয়েদের ইস্কুল, পাহাড়তলির প্রাইমারি ইস্কুল সব বন্ধ হয়ে গেল। বোর্ডিঙের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যাদের মাম্পস হয়নি, তাদের সব বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল।
লাবণ্যদি, লতিকাদিও একটা বড়ো দল মেয়ে নিয়ে কলকাতা চলে গেলেন। যাবার আগে আমাকে কত আদর করে গেলেন।
নেপুর অপূর্বদাও গেলেন। যাবার আগে গালফুলো নেপুকে দেখতে এলেন। উনি চলে গেলে পর নেপু বললে, অপূর্বদা আমাকে একটা ভারী কাজ দিয়ে গেছেন। কী, তা বলব না।
আমার তো শুনতে ভারি বয়ে গেছে! এমনিতেই ভীষণ গাল টনটন করছে, খিদে খিদে পাচ্ছে।