ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
আবদুল গণি শহরে যে নূতন বাড়িটি প্রস্তুত করিয়াছেন তাহা তাঁহার অফিস ঘর ও শহরের সদর স্থল হইতে কিছু দূরে।
তিনতলা মাঝারি অবয়বের বাড়িটি, প্রাচীর বেষ্টিত। ঘরের সম্মুখে প্রাচীরের মধ্যেই নবীন শ্যামল দূর্বাচ্ছাদিত ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের মাঝখানে একটা পুকুরের চারিধারে লতাগুল্ম শোভিত ফুটপাথ। বহিঃদরজার পার্শ্বের ভিতরের দিকে একটি আলোক স্তম্ভ। সারারাত্রি সেখানে বাতি জ্বলে।
তখন ঊষা হইয়াছিল। লতা-পত্রের গায়ে গায়ে বিন্দু বিন্দু শিশির জমিয়াছিল। ঊষার স্নিগ্ধ বাতাস রহিয়া রহিয়া বহিতেছিল। দুইটি সুন্দ। যুবতী পুকুরের ধারে পদচারণা করিতেছিলন। বলা বাহুল্য বাড়ির ভিতর কাহারও প্রবেশ করিবার অধিকার ছিল না। প্রতিবেশী ছেলেমেয়ে বা বউ-ঝিদের আসার কোনো বাধা ছিল না।
লতা-পত্রের মাঝখানে হালিমা ও তাহার ভাবিকে বড় সুন্দর দেখাইতেছিল। পরীবালা বলিয়া ভ্রম হইতেছিল। তাহাদের অঙ্গ হইতে মাধুরীর স্নিগ্ধ জ্যোতি বিকীর্ণ হইতেছিল।
কিছুক্ষণ হাঁটিয়া তাহারা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করিলেন। নিচের তলায় একখানা টেবিলের সম্মুখে আবদুল গণি বসিয়া সংবাদপত্র পাঠ করিতেছিলেন। হালিমা ও কুলসুম পার্শ্ব দিয়া উপরে উঠিয়া গেলেন।
আবদুল গণি ও হালিমার মাতা কোরান পাঠ করিতেছিলেন। হালিমা ও কুলসুম প্রবেশ করিলে তাহারা কোরান পাঠ বন্ধ করিলেন। হালিমার মাতা রহিমা জিজ্ঞেস করিলেন, কোথায় গিয়েছিলে মা?
কুলসুম কহিলেন-পুকুর পাড়ের বাতাস সকাল বেলায় মধুর লাগে। রহিমা হাফিজাকে কহিলেন-বু, বিকেল বেলা পুকুরে আমরা ছিপ দিয়া মাছ ধরবো।
হাফিজা আবদুল গণির মায়ের নাম। হালিমার দিকে ফিরিয়া কহিলেন–হালিমা, তুই তোর ভাবির সঙ্গে চা তৈরি কর।
কুলসুম শাশুড়ীকে জিজ্ঞেস করিলেন–ক’টি হুইল আছে?
রহিমা বলিলেন-তোমরা দুটো নেবে, আমরা দুই জা দুটো নেবো! ঠিক ঠিক চারটি হুইলই আছে।
হাফিজা কহিলেন : চারের মসলা আছে তো?
কুলসুম : না, তা তো নেই।
আবদুল গণি আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। হালিমা যেমন ছিলেন তেমনি দাঁড়াইয়া রহিলেন।
আবদুল গণি কহিলেন–মসলার জন্য এখনই লোক পাঠাচ্ছি।
দুপুর ভরিয়া হালিমা ও কুলসুম চার প্রস্তুত করিলেন। শেষ বেলায় সূর্যকর যখন স্নান হইয়া আসিল, তখন হাফিজা, রহিমা, কুলসুম ও হালিমা ছোট পুকুরটির ধারে হুইল হাতে বসিলেন।
পুকুরের পশ্চিম ধারে বসিলে হাফিজা ও রহিমা।
অর্ধ ঘণ্টার মধ্যে একটা মাছও ধরিল না। হালিমা বিরক্ত হইয়াছাই, একটা মাছও পুকুরে ধরছে না। মাছ নেই। তখন হলিমার মা হুইল আকর্ষণ করিলেন।
একটা ছোট এক হাত রুই ঘাটের উপড় পড়িয়া লাফাইতে লাগিল।
উৎসাহে হালিমা ও কুলসুম হুইল ফেলিয়া পশ্চিম ঘাটে আসিলেন। আবদুল গণি ঘরের মধ্যে বসিয়া ব্যবসায়ের খাতা পত্র দেখিতেছিলেন। মাছ ধরা পড়িয়াছে জানিয়া তিনিও হাসিতে হাসিতে বাহিরে আসিলেন। হালিমা, কুলসুম, আবদুল গণি, রহিমা ও হাফিজা এক জায়গায় বসিয়া আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। এইখানেই মাছ ধরা শেষ হইল।
আবদুল গণি হুইলগুলি গুটাইয়া ঘরে রাখিয়া আসিলেন।
সেদিন রাত্রিকালে আহারের খুব ঘটা হইল। কোর্মা, পোলাও, মাছ, দই, ফিনী, হালুয়া, পারাটা, ভাজি, ডাল প্রভৃতি নানাবিধ রসনাতৃপ্তিকর খাদ্যের বন্দোবস্ত হইল। পাচিকা কুলসুম ও হালিমা। আবদুল গণি রান্না ভালো হইয়াছে বলিয়া ভাবি সাহেবাকে প্রশংসা করিলেন। কুলসুম কহিলেন-রান্নার জন্য হলিমাকেই তারীফ করা উচিত, কারণ হালিমাই রাঁধিয়াছেন, আমি কেবল একটু যোগাড় দিয়াছি মাত্র।
আবদুল গণি কহিলেন–হালিমা বেশ রাঁধতে পারে। আমি এটা জানতাম না। হালিমা গম্ভীর মুখে প্রশংসা গ্রহণ করিল।
রহিমা, হাফিজা, আবদুল গণি একস্থানে আহার করিতেছিলেন। হালিমার হাতের প্রস্তুত সুন্দর একখানি দস্তরখানের উপর তাহারা খাইতেছিলেন।
সেখানে কোনো কাঁচ বা চীনা মাটির বাসন ছিল না। সুন্দর দামী পরিপাটীরূপে নির্মিত কাঁসার শক্ত গ্লাস বরতনেই দস্তরখানের শোভাবর্ধন করিতেছিল। যে সব দ্রব্য নিজের দেশে প্রস্তুত হয় না, সে সব জিনিস আবদুল গণি ব্যবহার করেন না। তিনি বলেন, এতে জাতির অগৌরব কালির রঙ্গে ফুটে উঠে। পরের দেওয়া দানে ভদ্র সাজতে যাওয়া কাপুরুষের পক্ষেই সম্ভব।
আবদুল গনি পানি চাহিলেন।
হলিমা সোরাই হইতে কেওড়া দেওয়া পানি গ্লাসে ঢালিয়া আবদুল গণির হাতে দিলেন।
কুলসুম তাহার শাশুড়ীদ্বয়কে—’আর একটু দেই–আর একখানা গোস্ত-একটু চাটনী দেই’ বলিয়া বালিয়া হয়রান করিতেছিলেন। রহিমা ও হাফিজা সমস্বরে কহিতেছিলেন-না মা, আর কাজ নেই, তুমি আমাদেরকে মেরে ফেলবে দেখছি।
.
সপ্তম পরিচ্ছেদ
অনেক দিন শহরে থাকিয়া হালিমা ভাবি ও চাচি সহ বাড়ি ফিরিয়া আসিয়াছিলেন।
একখানি পুস্তক লইয়া ছাদের উপর হালিমা পড়িতেছিলেন, কুলসুম শুনিতেছিল। হালিমা জিজ্ঞেস করিলেন–ভাবি বিয়ে জিনিসটা সুখের কিন্তু ছেলেপিলে হলে জীবনের ঝঞ্ঝাট খুব বেড়ে ওঠে।
কুলসুম : তা বেড়ে ওঠে বৈকি?
হালিমা : বেশি জ্বালা হয়, রাতদিন ঘ্যানঘ্যানানি, বাহ্যি আর প্রস্রাবে। শীতকালে শুয়ে আছে-লেপের ভিতর বেশ আরামে, সেখানেই খোকা পায়খানা করবেকী বিপদ? লেপ তোষক, বিছানা-চাঁদর সব বরবাদ হয়ে যায়।
কুলসুম : ছেলেকে সব সময় মাইয়ের দুধ না দিলে এই বিপদের হাত থেকে অনেকটা উদ্ধার পাওয়া যায়। বাইরের স্ত্রীলোকদের হাতে ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া দোষ। সন্তানের জন্য স্বতন্ত্র বিছানা চাই। নিজের কছে শোয়াবে না। তিন তিনটি ভালো ‘ফিডিং’ বোতল কিনে রাখতে হয়, দুধ গরম করে নেবার জন্য একটা ছোট স্পিরিট ল্যাম্প রাখতে হয়। মোটা ছোট ছোট ৮/১০ খানা তোয়ালে রাখা উচিত। মাই-এর দুধ না দিলে বিশেষ ক্ষতি–দুধ না হলে অনেক মা গরুর দুধ দিয়ে থাকেন, তাতে খোকার অসুখ হয় না। ভার বিছানার উপর খোকাকে শোয়াবে না, দুই এক মিনিটের জন্য আদর করে শোয়ালে দোষ নেই। কাপড় না দিয়ে থোকা খুকিকে কোলে নিতে নেই। পেশাবে কাপড় পচে অল্প দিনেই ছিঁড়ে যায়। রাত্রিকালে শিয়রে দুধ, স্পিরিট ল্যাম্প, ফিডিং বোতল রেখে দিতে হয়। বোতলে দুধ পুরে নল শিশুর মুখের ভিতর ভরে দিলে মোটেই কাঁদে না কিংবা মাকে জ্বালাতন করে না। সারারাত্রি মায়ের কোলের জন্য খোকা কাঁদতে থাকলে প্রসূতির স্বাস্থ্য নষ্ট হয়। বিছানা, কাপড়-চোপড় নষ্ট হয়ে যায়। শুধু খোকাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে চলবে na, গৃহিণীকে সব দিকে চাইতে হইবে। নিজের একটুখানি সুযুক্তি ও বন্দোবস্তের অভাবে অনেক সময় স্বামীকে সেবা-সুখ দিতে পারা যায় না, নিজের জীবনের কষ্টও বেড়ে ওঠে। ছেলের কোমরের সঙ্গে একটা মোটা লেঙ্গটের মতো আবরণ বেঁধে রাখবে, তাতে হঠাৎ কাপড় বা ঘর নষ্ট হবার সম্ভবনা থাকে না। ভাত রাঁধা বা রান্নাঘরের কাজের জন্য দাসী রাখার পক্ষপাতী আমি নই; শুধু ছেলে রাখার জন্য একটা মেয়ে চাকর রাখা হয়। এই মেয়ে চাকরটিকে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবার তাগিদ দিতে হবে। নিজে সাবান ব্যবহার কর বা না কর এই দাসীটি যেন প্রত্যহ স্নানের সময় সাবার ব্যবহার করে, সে যেন কখনও ময়লা কাপড় না পড়ে, তার কাপড় নিজের কাপড়ের সঙ্গে বোপর বাড়ি যাওয়া চাই। দাসী জুটলে নিজের কাজ নিজেকে করতে হবে–আলসেমি করে কখনও নোংরা থাকবে না।
হালিমা : বিছানাপত্র কিরূপ হওয়া চাই?
কুলসুম : ছোট ছোট ছেলেপিলের জন্য ভালো বিছানার দরকার নেই। কোনো দরিদ্র রমণীর দ্বারা মোটা কাথা সেলাই করে তাদের জন্য ব্যবহার করবে। আদর করে খোকাকে ফরাশে শোয়ালে পেশাবে ফরাশ পচে যায়; এই ধরনের আদর তাদের বিরক্তিকর। ছেলেপিলের বিছানা স্বতন্ত্র হবে স্বামীর জন্য যে বিছানা রচনা করবে তা যেন ছেলেপিলের বাহ্য প্রস্রাবে নোংরা না হয়। একটা তোষক, একখানা বিছানার চাঁদর ও একটা বালিশ এই-ই একটা শয্যার জন্য যথেষ্ট।
হালিমা : পরবার কাপড়-চোপড় কীরূপভাবে কোথায় রাখতে হবে? স্বামীর নিজের ও সকলের কাপড় এক জায়গায় রাখা উচিত, না আলদা আলাদা করে রাখা ভালো?
কুলসুম : প্রত্যেকের কাপড় আলাদা আলাদা করে রাখা উচিত। প্রত্যেকের জন্য স্বতন্ত্র ব্রাকেটের ব্যবস্থা না করতে পারলে দড়ি ঝুলিয়ে নেবে।
হালিমা : ছোট ছোট ছেলের জন্যও ভিন্ন ভিন্ন ব্রাকেটের দরকার? তাদের তো বেশি কাপড় থাকে না।
কুলসুম : বেশি কাপড় না থাকলেও শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য শিক্ষা দেবার জন্য তাদের আপন কাপড় নিজের মতো আলাদা আলাদা করে রাখতে বলবে। যেখানে সেখানে কাপড় চোপড় ফেলে রাখা তাদের একটা বদ অভ্যাস।
হালিমা : সত্যি তারা বড় জ্বালাতন করে। মামার ছেলেরা এখানে কয়দিনের জন্য এসেছিল, তাদের দৌরাত্মে অমারা অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। মারামারি, শোরগোল, কাদাকাটি হরদম লেগেই ছিলো। প্রতি সন্ধ্যায় কে-কেথায় জুতো ফেলেছে ঠিক নেই–বাতি জ্বেলে সারা উঠান খুঁজে বেড়ান একটা নিত্য-নৈমিত্তিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্নানের সময় কোথায় কাপড় কোথায় গামছা ঘর বার তোলপাড় করে।
কুলসুম : পা না ধুয়ে বিছানার উপর লাফিয়ে উঠা তাদের আর একটা বদ অভ্যাস। বোকা মায়ের মতো ছেলেমেয়েকে কখনও প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়।
হালিমা : ঘরের বারান্দায় ফুলের গাছ রাখা কেমন?
কুলসুম : ফুলের গাছ বারান্দায় রাখা ঠিখ নয়। দুই একটা ছোট গাছ রেখে দেওয়া যেতে পারে। ঘরের ধারে বা বারান্দায় জঙ্গল করে রাখলে মশার উপদ্রব বাড়তে পারে।
হালিমা : বাড়িতে ফুলের বাগান না থাকলে মন নিষ্ঠুর হয়ে উঠে।
কুলসুম : সে তো নিশ্চয়। প্রত্যেক বাড়ির সম্মুখে একটা স্বল্পবিস্তৃত ময়দান এবং একটি সজীব শ্যামল ফুল বাগান থাকা চাই। মনকে আধ্যাত্মিক ভাবাপন্ন করবার এক প্রকৃত পন্থা হচ্ছে–প্রকৃতির সবুজ গাছপালার সঙ্গে যোগ রাখা। যারা গাছপালার সৌন্দর্য উপভোগ করতে জানে না তাদের মন কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের সংসারী দৃষ্টিহীন প্রাণে কোমলভাবের উদ্রেক হয় না।
হালিমা : চন্দ্রকরোজ্জ্বল নৈশ গগনের নিচে জীবনের বন্ধুকে নিয়ে প্রাণভরা হাস্যময়ী বৃক্ষ পল্লবীর মাঝখানে নিশি কাটিয়ে দেওয়া কী সুন্দর, কী স্বর্গীয়!
কুলসুম : সত্যি! কেবল পবিত্রতা ও প্রেমের মঙ্গল দৃশ্য! মরবার সময় প্রিয়ের বাহুর উপর মাথা রেখে এমন স্থানেই মরা উচিত।
হালিমা : সংসারের সব কাপড়গুলিই কি বোপর বাড়ি দিতে হবে?
কুলসুম : সব কাপড় ধোপার বাড়ি পাঠান অনেক পরিবারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। ধোপর বাড়ি দিতে পারলে ভালোই হয়। কারণ নিজেরা কাপড় ধুলে দুই-এক দিনেই ময়লা হয়ে যায়। প্রতি সাত দিনে বিশ-কুড়িখানা কাপড় বাড়িতে ধোয়া কঠিন। প্রতি ১৫ দিনে ধোপাকে কাপড় দেবে। পরবার কাপড় ছয়খানা, কি আটখানা থাকা চাই। তা হলে আর নোংরা কাপড়ে বের হতে হবে না। নোংরা বিছানা, বালিশের ওয়াড় সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য। সর্বদা পরিচ্ছন্ন থাকা চাই। যাদের দুই একখানা কাপড় বেশি নাই তারা সেগুলি বাড়িতে ধুয়ে নেবেন। দুই-একখানা কাপড় থাকা লজ্জার বিষয় নয়–লজ্জা অপরিষ্কার থাকায়। বিনা চাঁদরে বিছানা এবং বিনা ওয়াড়ে বালিশ ব্যবহার করবে না।
হালিমা : ধোয়া কাপড়-চোপড় পরলে মনে অহঙ্কার আসে কি?
কুলসুম : ছিঃ, কেন অহঙ্কার আসবে? পরিষ্কার থাকা দরকার তাই পরিষ্কার থাকা। মনে অহঙ্কার আসা বড় লজ্জার কথা। যাদের পরিষ্কার থাকার অভ্যাস হয়েছে, তারা যে অপরিষ্কার বা নোংরা কাপড় পরা কোনো লোককে দেখে ঘৃণা কাবে–সেটাও অন্যায়। অনেক জ্ঞানী ভদ্রলোক আছেন, যারা ময়লা নোংরা কাপড়ে থাকেন, অবশ্য অনেক জ্ঞানী লোক নোংরা কাপড়ে থাকেন বলে সেটাকে গুণ বলে স্বীকার করে নিতে হবে না।
হালিমা : পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকাই দরকার বটে; ছোট ছেলেপেলেকে পরিষ্কার রাখা কিন্তু অসম্ভব।
কুলসুম : ছেলেপেলেরা ধূলামাটির মধ্যে মানুষ হয়ে উঠে সেই ভালো। ছোটকাল তাদের মন বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে গেলে হয়তো ভবিষ্যতে খারাপ হতে পারে। তবে মাঝে মাঝে অর্থাৎ প্রতি সাত দিনে তাদের গা পরিষ্কার করে দেওয়া উচিত।
হালিমা : রান্নাঘরেই কাপড় ময়লা হয় বেশি। —
কুলসুম : কেন? রান্নাঘরে সব সময়ে কাঁধের উপর একখানা করে গামছা রাখবে। কখনও পরনের কাপড়ে হাত মুছবে না। অনেক মেয়ে ও বধূর কাপড়ে হাত মোছার অভ্যাস আছে। এ একটা খারাপ অভ্যাস।
হালিমা : আমি দেখেছি, অনেক পরিবার প্রায়ই জিনিসপত্র, কাপড়-চোপড় হারায়। হারাবার অর্থ কোথায় থাকে কারো ঠিক থাকে না। খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির সবসুদ্ধ লোক হয়রান হয়। অনেক পরিবারে এটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। ওগো আমার কাপড় কোথায় গেল–আমার গামছা কী হল–আমার জ্যাকেট কে নিয়েছে–আমার জুতা কই ইত্যাকার হাঁকাহাঁকি, চীৎকার হরদম চলতে থাকে।
কুলসুম : এমন ধারা অমনোযোগী, বিশৃঙ্খল পরিবারে হয়ে থাকে। প্রত্যেকের কাপড়, জিনিস আলাদা জায়গায় থাকলে আর বিড়ম্বনা না। বোপা কাপড় দিয়ে গেলে যার যার কাপড় তার তার কাছে থাকবে। একখানা রুমালের জন্য চব্বিশ গণ্ডা বাক্স হাতড়িয়ে বেড়ান বাড়িসুদ্ধ লোকের পক্ষে বিরক্তিকর। যে জিনিস যেখানে থাকা দরকার সেই জিনিস ঠিক সেই জায়গায় রাখতে হবে। পরিবারের মধ্যে যদি সেয়ানা কারো ঠিক জায়গায় জিনিসপত্র রাখবার অভ্যাস না থাকে, তবে তার সঙ্গে ঝগড়া-ফ্যাসাদ না করে তার কাজটি নিজেই করে দেবে। প্রত্যেকের জন্য স্বতন্ত্র গামছা থাকা উচিত। বাড়ির প্রত্যেকের জিনিস নির্দিষ্ট স্থানের একটু এদিক-ওদিক যাতে না থাকে, সেদিকে গৃহিণীর বিশেষ দৃষ্টি আবশ্যক।
হালিমা : থালা, বাটি এ সব নিত্য পরিষ্কার করা বড় জ্বালা, অথচ না পরিষ্কার করলেও ব্যবহার করা যায় না।
কুলসুম : নিত্য সকাল বেলা থালা, বাটি ছাই দিয়ে বেশ মাজতে হবে। চিনা মাটির বা কাঁচের বাসনপত্র বিশেষ মাজতে হয় না। ছেলেপেলে যে বাড়িতে আছে, সে বাড়িতে এ বিলাসিতার প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। বিদেশী জিনিস দিয়া জিনিসের দ্ৰতা করা ও বিলাস প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেওয়ায় গৌরব নেই–বরং তাতে লজ্জাই বেশি। কোনো কোনো হতভাগা মনে করে, চিনামটির বাসন ব্যবহার করলে তাদের বংশ মর্যাদা বেড়ে যাবে। মনুষ্যত্ব, জ্ঞান ও মহত্ত্বই যে মানুষকে বড় করে-এ তারা জানে না। বিদেশী বণিকেরা দয়া করে তাদের বিবাহ মজলিশ ও মিলাদ মাহফিলের শোভাবর্ধন করে-লজ্জার কথা, ঘৃণার কথা। নিজেদের কোনো শক্তি নেই, পরের অনুগ্রহে তাদের মর্যাদা বাড়ে। থালা বাটি নিজে পারলে নিজেই মেজে যথাস্থানে গুছিয়ে রাখবে। যে দাসীরা ভিতরে ভিতরে বড় অপরিষ্কার, তাদের থালা বাটি মাজতে না দেওয়াই ভালো। উপায় না থাকলে তারাই মাজবে।
হালিমা : বড় পরিবারে রাশি রাশি থালা জোটে।
কুলসুম : বড় পরিবার হলে একজনের পক্ষে পরিবারের সকল কাজ সুচারুরূপে সম্পাদন করা খুব ভয়ানক কথা। এক পরিবারে অনেক লোক না থাকাই ভালো। এতে সমাজ দুর্বল হয়ে পড়ে। কতগুলি লোক অকারণে আলসে ও কুঁড়ে হয়। যার যার ভাবনা সেই সেই ভাববে, বিলেতে ছেলে বড় হলে তাকে পৃথক করে দেওয়া হয়। অনেক লোক এক সঙ্গে থাকলে বাড়ির বৃদ্ধ মাতা-পিতাকে বিপন্ন ও দুর্দশাগ্রস্ত হতে হয়।
হালিমা : ভাবি!
কুলসুম : জি।-।
হালিমা : ভাবি, আপনাকে ডাকলে সব সময় ‘জি’ বলেন কেন–আমি তো ছোট। আপনি আমার ভাবি-ভাইয়ের বউ।
কুলসুম : ভদ্রতার পরিচয় দেওয়ায় দোষ কী?
হালিমা : পোশাক-পরিচ্ছদ কীরূপ হওয়া দরকার?
কুলসুম : যেমন পর, এমনি হবে।
হালিমা : মুসলমান মেয়েকে হিন্দুর মেয়ে হতে চিনে নেবার তো কোনো উপায় থাকবে না।
কুলসুম : যে পুরুষেরা নিজেদের বিশিষ্টতা ঠিক রাখে, তারাই জাতি গঠন করে। নারী যদি পোশাকের দ্বারা আমাদের বিশিষ্টতা রক্ষা করেন–তবে তা ভালোই হয়–ভিন্ন জাতির পোশাক পরে নিজের অসম্মান হয়-এও ঠিক।
হালিমা : ভাবি, তুমি সব সমযে সেমিজ, কোর্তা, ব্যবহার করো কী করে?–এতে কষ্ট হয় না?
কুলসুম : পুরুষ জামা, জুতা, কোট, পাতলুন পরে সব সময়ে অফিসে বসে থাকে কী করে? গরম লাগে বলে কি খালি গা থাকা যায়? মেয়ে মানুষের পক্ষে এক কাপড় পরে থাকা। বড়ই দোষের।
হালিমা : ছেলে হলে সেমিজ পরা চলে না। খোকা জামা ছিঁড়ে মাই খেতে চায়। গা ভরে পেশাব করে।
কুলসুম : ছেলে হলে কি কাপড় জামা ফেলে দিয়ে নেংটা হয়ে থাকতে হবে? ফিডিং বোতল মুখের কাছে ধরলেই তো কাজ চলতে পারে। রাত-দিন-টানাটানি করাবার দরকার কি? এক রকম বোতল আছে তাতে একবার সের দেড়েক মতো গরম দুধ যদি ভরে রাখা যায়, তা হলে সেই দুধে ২৪ ঘণ্টা চলে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঠাণ্ডাও হয় না। দিনে রাতে। যতবার ইচ্ছা ফিডিং বোতলে দুধ ঢেলে খোকাকে খাওয়ান যায়।
হালিমা : মাইতে দুধ জমলে মাই ফুলে ওঠে না? অবস্থায় না কুলোলে মাই এর দুধ ছাড়া উপায় কী?
কুলসুম : এক রকম যন্ত্র আছে। ডাক্তারখানায় পাওয়া যায়-তাই দিয়ে দুধ গেলে ফেললে মাই জ্বালা করে না। দুধে যদি প্রসূতির কষ্ট হয়, তবে ডাক্তারের সাহায্য নেওয়া উচিত। দরিদ্র অবস্থার কথা ভাবলে চলবে না–খোকার জন্যে দুধ চাই-ই চাই। দুধ যে তার আহার। একেবারে নিরুপায় হলে মাই-এর দুধ দেবে। এজন্য তোমাকে খালি থাকতে হবে না।
হালিমা : হিন্দু মেয়েরা জুতো পায়ে দেয় না–কারণ কী?
কুলসুম : কারণ কি, তা তো জানি না। রান্নাঘরের পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করবার জন্য হয়তো তারা জুতো ব্যবহার করে না।
হালিমা : এক একটা তাদের অন্যায় রীতি। পায়খানায় যাবার সময় জুতো খুলে রেখে গেলেই হয়। তার পর হাত-পা ধুয়ে বা অজু করে রান্নাঘরে প্রবেশ করতে পারবে। আসল কথা তারা বড় কুসংস্কারাচ্ছন্ন।
কুলসুম : তাই ঠিক।
হালিমা : কী জুতো ব্যবহার করা ভালো?
কুলসুম : মেয়েদের পক্ষে বিশেষ করে আমাদের দেশের মেয়েরা বুট বা সু পরতে পারে না। তাতে তাদের কাজের অসুবিধা হয়। চটি বা পামসু জুতোই প্রশস্ত। যে সব বাড়িতে চেয়ার-টেবিল আছে সেখানে মেয়েরা মাঝে সু পরতে পারে। অনেকবার জুতো খোলা অসুবিধা বলেইচটি ব্যবহার করতে হবে।
হালিমা : আচ্ছা ভাবি, আপনাকে তো গয়না পরতে দেখি নে–কারণ কী? গয়না না পরলে কী করে রূপ ফোটে? ভদ্রসমাজে কীভাবে বের হওয়া যায়।
কুলসুম : আমার গয়না না পরবার কারণ আছে-সে কারণ তোমাকে বলবো না। হালিমা আব্দার ধরিয়া কহিল-কারণ বলতেই হবে।
কুলসুম বলিলেন-তুমি বড় দুষ্ট-কারণ বলছি শোন, রেলে ভ্রমণ করবার সময় দেখেছি মেয়েরা লোককে গয়না দেখাবার জন্য কাপড় সরিয়ে হাতখানি বাইরে ঝুলিয়ে রেখে দেয়। সব মেয়েরই এই দস্তর। গয়না পরলেই স্ত্রী লোকের মন অহঙ্কারে ভরে ওঠে। গয়না ও রূপের চটক দেখাবার জন্য তারা অস্থির হয়ে ওঠে। নিজের মনকে এইভাবে বিভ্রান্ত করে তুলতে আমি অত্যন্ত ঘৃণা বোধ করি।
হালিমা : তা হলে কি আপনি গয়না পরতে একদম নিষেধ করেন?
কুলসুম : না, তা করি না। তোমার মতো সুন্দরীর গায়ে যদি গয়না ওঠে তা হলে রূপ শত গুণে বেড়ে উঠবে। বোন, কত মেয়ে মানুষ ছেঁড়া কাপড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে–কত ভদ্রঘরের মেয়ে অভাবে বিবস্ত্র হয়ে আছে–আমি কি করে এদের সামনে গয়না পরে রূপ দেখাই, বড় লজ্জা ও বেদনা হয়। এ বড় মানুষেমির ডঙ্কা বাজাতে চাই নে। বাইরের রূপ ও চটকের মূল্য কী? মনের উন্নতি, সৎস্বভাব নিরহঙ্কার ব্যবহার এবং আত্মমর্যাদাবোধ। মানুষের সৌন্দর্যের মূল্য। তুমি ছেলে মানুষ তোমার গয়না মানাবে ভালো।
হালিমা : ভাই বাড়ি এলে তো আপনি গয়না পরেন, দিনে সাতবার সিঁথি তোলেন–দিনে দুই তিনবার কাপড় বদলান।
কুলসুম হাসিয়া কহিলেন–পাগলি, বিয়ে হলে বুঝবে স্বামীর সম্মুখে এলে মেয়ে মানুষের মনে কি আনন্দ হয়। স্বামীর সম্মুখে পেত্নীর মতো থাকা নারীর পক্ষে অশোভন। প্রেম, মোহ যত পার স্বামীর সম্মুখে সৃষ্টি কর–আপত্তি নেই। এতে স্বামীও আনন্দ পান।
হালিমা : কি কি গয়না পরা উচিত?
কুলসুম : হাজার গণ্ডা গয়না পরে লাভ নাই–গয়না দুদিনের মোহ সৃষ্টি করে। খোদার দেওয়া সৌন্দর্যই যথেষ্ট। মোটামুটি হার, বালা, সোনার চুড়ি, অনন্ত ব্যবহার করবে। গয়না পর আর না-পর সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে, চুলগুলি ঠিক করে রাখবে?
হালিমা : মেখলা, নথ, মল-এসব?
কুলসুম : ওগুলির মধ্যে ভয়ঙ্কর মাদকতা মাখান থাকে। এ সব স্বামী ছাড়া যদি বাড়িতে আর কেউ না থাকে তা হলে ব্যবহার করা যায়। সাবধান! লোক দেখানোর জন্যে গয়না পরবে না–স্বামী মনোরঞ্জনের জন্যেই গয়না পরতে হয়–মনে যেন অহঙ্কার না আসে–অহঙ্কার এলে খোদার অভিশাপ আসে। যে মানুষ পায়ের তলে থাকতে লজ্জা বোধ করে না, তাকেই খোদা বড় করেন। পায়ের তলে থাকার অর্থ আত্মার অবনত অবস্থা নয়–কিংবা শয়তান লোকের প্রভাব স্বীকার করা নয়।
হালিমা : স্বামীর জন্যেই যে গয়না পরতে হবে, এটা জানতাম না।
কুলসুম : অন্যায় কথা। রাস্তাঘাটে কিংবা কুটুম্বের বাড়ি যেতে হলে, পায়ে অলতা পরে ফ্যাশন করে বের হবার দরকার কী? তোমার অনেক গয়না আছে–তুমি বড় মানুষের বউ-এসব কাউকে জানিয়ে লাভ কী? লোকে তোমাকে গরিব মনে করে, করুক। যে সমস্ত অসভ্য মেয়ে মানুষ গয়না ও অর্থ দেখে সম্মান জানাতে আসে, তাদের সম্মান নিয়ে দরকার নেই। যারা সৎস্বভাব, জ্ঞান ও মানসিক সৌন্দর্যকে সম্মান জানাতে জানে না, সে অভাগীদের সঙ্গে না মেশাই ভালো। গয়না ও চিত্তের চটক দেখিয়ে কারো নিকট হতে সম্মান আদায় করতে যেয়ো না।
হালিমা; ভাবি, তুমি পাতলা ফিনফিনে শাড়ি পর না, কারণ কী?
কুলসুম : এসব বড্ড কাম-গন্ধ মাখান, বড় মোহ সৃষ্টি করে, স্বামী ছাড়া অন্য করো কারো সামনে এসব পরতে নাই। অশালীন পোশাক ছেড়ে আমাদের ভদ্র পোশাক পরাই উচিত।
হালিমা : আমরা যে অনেক দিন থেকে শাড়ি পরতে অভ্যস্ত হয়েছি। নূতন পোশাক পরলে আমাদের সঙ্গিনীরা হাসবেন না?
কুলসুম : মুসলমান নারীদের অতি চমৎকার পোশাক আছে–পরলে দিব্যি দেখায়। আসল কথা পোশাকের নিজের কোনো সৌন্দর্য নাই–সভ্য, শিক্ষিত, বীর-প্রসবিনী জননীরা যা পরেন তাই ভালো। যে জাতির ভিতর অধিকাংশ মানুষ কাপুরুষ, যারা জগতকে কিছু দিতে পারে না–যারা পরকে বাঁচাতে জানে না, অপরের অনুগ্রহে বেঁচে আছে, যাদের নৈতিক ও সামরিক শক্তি নেই, তারা ভালো পোশাক পরলেও কদর হয় না। মানুষই পোশাক পরিচ্ছদকে অনেকাংশে সৌন্দর্য দেয়। তুমি কি ইচ্ছা কর–আমরা আমাদের বিশিষ্টতা হারিয়ে জগতে কৃপার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকি?
হালিমা : না, কিছুতেই না!
অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হালিমা পুনরায় কহিল–গরমের ভিতর চুল নিয়ে বড় জ্বালা হয়-ইচ্ছা করে চুলগুলি কেটে ফেলে দেই। কেউ কেউ গরমের মধ্যে চুল তাড়াতাড়ি করে ঝুঁটি করে রেখে দেয়।
কুলসুম : ছিঃ ছিঃ, দেখলে ঘৃণা হয়!
হালিমা : সব সময় খোঁপা করে রাখা কি সম্ভব?
কুলসুম : কেন, বেণী করে রাখলেই হয়। একটা বেণীতে অশান্তি সৃষ্টি হবার কোন কথা নাই, দেখতেও পরিপাটি। লাল ফিতে দিয়ে মুখটা এঁটে রাখবে–দেখলে মনে হবে, একটা গোলাপ গাছ মাথায় একটা প্রস্ফুটিত কুসুম নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হালিমা : বৌ কী করে মানুষকে তার মাথা দেখাবে?
কুলসুম : কেন স্বামী দেখবে। কুন্দ দন্তের মুক্তা শোভা, লোহিত ওষ্ঠের স্মিত হাসি, বিস্ফারিত নয়নের মোহন কটাক্ষ, চঞ্চল চরণের মাধুরী লীলা-এসব স্বামীকে দেখাবে। সতী-সাধুনীর কলহসি, বীণা বিন্দিত কণ্ঠ রাগিণী, সরল রসিকতা সবই স্বামীর হৃদয়রঞ্জনে ব্যয়িত, পথের মানুষের জন্য নয়।
হালিমা : কোনো কোনো নারী স্বামীর সম্মুখে পেত্নী–বাইরে বেরুতে হলে রানী হয়ে বের হন।
কুলসুম : তারা কি ধরনের স্ত্রী লোক তা আমি বুঝি না।
হালিমা : আঁচলে চাবি পরা কী রূপ? দেখতে মন্দ লাগে না।
কুলসুম : বাজারে আঁচলে পরবার জন্য এক রকম চাবির গোছা কিনতে পাওয়া যায়, তাই কিনে অনেক মেয়ে পরেন। বাক্স নাই অথচ চাবি আঁচলে গুঁজে লোককে দেখাতে হবে, এটা নীচতা। নিজের বাক্স থাকে সুবিধার জন্য তবে চাবি আঁচলে বেঁধে রাখতে পারে, নইলে নয়।
হালিমা : আলতা পরা কেমন?
কুলসুম : খুব ভালো। সুন্দর চরণপদ্মকে আলতা দিয়ে রাঙা করলে খায়ের সৌন্দর্য বড়ই বাড়ে। সুন্দরীরা আলতা পরা পায়ে যখন হাঁটতে থাকে, তখন মুগ্ধ মাটি কাঁপতে থাকে।-স্বামী অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন। তবে আলতার চেয়ে মেহেদী পরা ভালো, তাতে পা ভালো থাকে।
হালিমা : রাস্তাঘাটে আলতা পরে বের হওয়া কি উচিত?
কুলসুম : নিতান্তই বেহায়ামি। স্বামীর সম্মুখ ছাড়া অন্য কোনো জায়গায় নারী নিজেকে। শ্রীভূষিত করবে না। শ্রী অর্থ যা পুরুষের মনে মুহূর্তের মাঝে মাদকতা সৃষ্টি করে। যে পোশাক পরলে বা যে ভাবে বের হলে মানুষের তরলভাব আসা অসম্ভব বা সহজ নয় সেই পোশাক নিয়ে বাড়ির বাইরে বের হবে। তরল ভাব-উদ্দীপক চরণ বিক্ষেপ, বিলাসময় অঙ্গভঙ্গি এসব স্বামী ছাড়া অন্য কেউ যেন না দেখে। এ সবেরই মধ্যে আবার নারীর নারীত্ব। অস্বীকার করে নিতান্ত পুরুষের মতো স্বামীর সম্মুখে গম্ভীর বদখত হয়ে দাঁড়াতে যেয়ো না। তা হলে স্বামী বিরক্ত হবেন। নারী স্বামীর কাছে হবে একখানা মূর্তিমতী কবিতা, সেখানে জ্ঞান-আনন্দ, দুই-ই পাওয়া যায়।
হালিমা : নারীদের পান তামাক খাওয়া কেমন?
কুলসুম : পান খাওয়া মন্দ নয়। পান খেয়ে লাল ঠোঁটে যুবতী যখন কথা বলেন, তখন বড়ই সুন্দর দেখায়। এতে শরীরের কোনো উপকার হয় না, আরামের একটা উপকরণ। তামাক কোনো কোনো মহিলা খেয়ে থাকেন, এতে মুখের সৌন্দর্য নষ্ট হয়।
হালিমা : হাত মোছার জন্যে সর্বদা একখানা গামছা ব্যবহার করা উচিত। অনেকে আঁচলে হাত মোছেন, আমারও অভ্যাস ছিল।
কুলসুম : রান্নাঘরে সর্বদা একখানা গামছা কাঁধের উপর ফেলে রাখতে হয়। অনেক নোংরা মেয়ের পাছার কাপড় ও আঁচলে হাত মোছবার অভ্যাস আছে। কোমরে একখানা রুমাল গুঁজে রাখাও মন্দ নয়।
হালিমা : অনেক মানুষ হঠাৎ মাটিতে বসে পড়বার অভ্যাস আছে।
কুলসুম : ঐটি বড় মন্দ অভ্যাস। এতে যেমন কাপড় খারাপ হয় অন্য দিকে মনেরও তেমনি অবনতি হতে থাকে। মনের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়ে। যে বাড়িতে চেয়ার আছে, মেয়েরা সেইসব চেয়ার ব্যবহার করবেন। চেয়ার না থাকলে লম্বা বেঞ্চ, টুল বা ফরাস পাতা তক্তপোষে বসবেন। মাটিতেও পাটির উপর বসা যায়। রান্না ঘরে মাটিতে বসে রান্না না করাই ভালো। চুলগুলি মাটি থেকে দুই হাত উঁচুতে হওয়া উচিত, এতে খাবার জিনিসে ধুলোমাটি বা ময়লা ছড়ানোর ভয় থাকে না।
হালিমা : আতর মাখা ভালো, না এসেন্স মাখা ভালো? সুগন্ধি মাখা কি বিলাসিতা?
কুলসুম : মাঝে মাঝে একটু আধটু মাখতে পার। আতরই আমাদের জন্য প্রশস্ত। আতর মাখার সম্মুখে যে থাকে তার মুখে বা কাপড়ে একটু লাগিয়ে দেবে। সামান্য দরিদ্র। হলেও তাকে একটু সুগন্ধি দেবে। একা একা গন্ধ-দ্রব্য মাখতে নেই।
হালিমা : কদিন পরে সাবান মাখা উচিত?
কুলসুম : আজকাল অনেক মেয়ে নিত্য সাবান ব্যবহার করেন। নিত্য সাবান ব্যবহারে বিশেষ আবশ্যকতা নেই। যারা সৌন্দর্য বাড়াবার জন্যে সাবান ব্যবহার করেন তারা ভুল করেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য সাবান ব্যবহার করা উচিত। নিত্য সাবান মাখলে গায়ের চামড়া শিথিল হয়ে যেতে পারে। সাতদিন বা পনের দিনে ব্যবহার করা উচিত।
হালিমা : যে সে সাবান ব্যবহার করা য় কি?
কুলসুম : না, যে সে সাবান ব্যবহার করলে চর্মের অনিষ্ট হতে পারে। কোনো ভালো। বিশ্বাসযোগ্য কোম্পানীর নিকট থেকে সাবান খরিদ করা উচিত।
হালিমা : মাথায় সব সময় সুগন্ধি তেল দেওয়া সকলের পক্ষে কি সম্ভব?
কুলসুম : অসম্ভব নিশ্চয়ই, দেশের লোক ভয়ঙ্কর গরিব, কোনো রকমে শাক পাতা খেয়ে এরা বেঁচে থাকে। ছোট ছোট সুগন্ধি তেলের শিশি রীতিমতো মাখলে ২/৩ দিনে শেষ হয়। নারিকেল তেল মাখলেও মাথাগরম হয়। অনেক লোক আছে তারা যেমন দরিদ্র তেমনি জোচ্চোর। ভেজাল দিয়ে জিনিসপত্র একদম নষ্ট করে ফেলে। এই জুয়াচুরি ও চুরির কারণ হয়তো দারিদ্র ও অভাব। যাই হোক, তেল না মাখ সেও ভালো, ভেজাল দেওয়া নারিকেল তেল ব্যবহার করবে না–মাথায় টাক পড়বে, মাথা গরম হবে। সুগন্ধি তেলেও অনেক জোচ্চোরি আছে। তেল সংগ্রহ করতে খুব সাবধানতা অবলম্বন করা চাই। যদি ভালো খাঁটি তেল সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তা হলে খাঁটি সরষের তেল ব্যবহার করতে পারা যায়। যে সরষের তেল বাজারে বিক্রি হয় তারও বিশ্বাস নেই। কেবল ভেজাল। কেবল ভেজাল! ভেজালে বাঙালি জীবন রসাতলে যাচ্ছে।
হালিমা : দেশের এই দরিদ্র দূর করবার উপায় কী?
কুলসুম : বিলাসী পুরুষগুলির কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। পাছে স্ত্রী অসন্তুষ্ট হন এই ভয়ে তারা অসঙ্কোচে সংসারে বিলাসিতার প্রশ্রয় দিচ্ছেন। ছেলে-বুড়ো, ধনী-মজুর যদি প্রতিজ্ঞা করে যে, তারা দেশীয় জিনিস ছাড়া বিদেশী জিনিস কিনবে না, তা হলেই আমাদের দুঃখ দারিদ্র ঘুচতে পারে-নইলে রক্ষা নেই, বাঙালির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
হালিমা : আমি প্রতিজ্ঞা করলাম আজ হতে দেশী দ্রব্য ছাড়া বিদেশী দ্রব্য ব্যবহার করবো। মোটা কাপড় পরতে পারি কিন্তু আমার ভাই-ভগ্নীকে মরে যেতে দেখতে পারি না।
কুলসুম : আবেগে হালিমাকে বুকের সহিত চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন, হে আমার। পরদুঃখকাতরা প্রিয়তমা। আশীর্বাদ করি যেন তুমি তোমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পার। দেশের আর্ত দুঃখী মানুষকে ফেলে প্রাণহীনের মতো শুধু নামাজ পড়লে কী লাভ হয়? খোদা হৃদয়হীনের নামাজ দিয়ে কী করবেন? খোদা দরিদ্রের বেশে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে বেড়ান-ইসলামই তার খবর রাখে।
.
নবম পরিচ্ছেদ
পাহাড়ের পার্শ্বদিয়া দুইটি হাতি যাইতেছিল। একটার পিঠে হালিমা ও কুলসুম বসিয়াছিলেন। দুইজনের হাতে দুইটি বন্দুক ছিল। অন্যটির পৃষ্ঠে আবদুল গণি, তাহার মা ও চাচি। আবদুল গণির হাতেও, একটা বন্দুক ছিল।
চারিজন বরকন্দাজ দীর্ঘ লাঠি ও ছড়ি লইয়া হাতির পশ্চাৎ হাঁটিতেছিল।
আজ আবদুল গণি, রহিমা, হাফিজা, কুলসুম ও হালিমা সখ করিয়া শিকারে বাহির হইয়াছেন। হাতি দুইটির মধ্যে একটি ভট্টাচার্যদের। বরকন্দাজেরা কাহাকেও হাতির খুব। নিকটে আসিতে দিতেছিল না। হালিমার ব্যবহারে কোনো অসুবিধা হইতেছিল না।
তখন বেলা এক প্রহর হইবে। বাড়ি হইতে সকলে নাস্তা করিয়া আসিয়া ছিলেন। সঙ্গেও কিছু খাবার ছিল। সারাদিন শিকার অন্বেষণে পাহাড়ে কাটাইবেন–দুপুর বেলা ‘ওসমান ঝরনার নিকটবর্তী বড় পাহাড়ী গাছটার নিচে আহার করিবেন। ঘি, ডাল, চাল, মুরগী হাতির পিঠের উপর বাঁধিয়া দেওয়া হইয়াছিল। মুরগীর ডাকে হাতি ভয় পাইতেছিল বলিয়া সেগুলি আলী আহমেদের হাতে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। আহমদ বালক ভূত্য।
হঠাৎ ঝোঁপের আড়াল হইতে একটি মুরগী বাহির হইল। আবদুল গণি ইশারা করিয়া জানাইলেন, যে যেখানে আছ সেইখানে থাক। মুরগী কক্ কক্ করিয়া মাটি খুঁড়িতেছিল–এতগুলি শিকারী তাহার চারিপার্শ্বে দাঁড়াইয়া তাহা সে আদৌ লক্ষ্য করিতেছিল না।
তাহার ডাক শুনিয়া আর একটা কালো মোরগ আসিল। আবদুল গণি ইঙ্গিত করিয়া কুলসুমকে লক্ষ্য করিতে অনুরোধ করিলেন–হয়তো তিনি হালিমাকেই শিকার মারিবার আনন্দ দিতে ইচ্ছা করিতেছিলেন।
কুলসুম হালিমাকে কহিলেন–হালিমা, তুমি মোরগটার উপর সন্ধান কর–আমি মুরগীটিকে সন্ধান করি।
দেখিতে না দেখিতে কয়েকটি ছানা লইয়া আর একটি মুরগী সেখানে আসিল। কুলসুম বলিলেন-এতগুলি শিশুর মাকে হত্যা করে কাজ নেই।
হালিমা বলিলেন–কিন্তু তিনটি যেরূপভাবে একস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, গুলি ছুঁড়লে যে কার গায়ে লাগবে বলা যায় না। একটু অপেক্ষা করা যাক।
হঠাৎ মোরগটি উড়িয়া উপরের ডালে বসিল। হয়তো সে শিকারীর গন্ধ পাইয়াছিল। বিলম্ব না করিয়া হালিমা গুলি ছুঁড়িলেন, সঙ্গে সঙ্গে শিকার পড়িল। উৎসব কোলাহলে বনভূমি মুখরিত হইল। আহমদ উৎসাহে দৌড়িয়ে গিয়ে ধরিল।
সকলেই হাতি হইতে নামিলেন, মোরগটাকে নাড়িয়া চাড়িয়া আনন্দ লাভ করিতে লাগিলেন।
প্রায় অর্ধ ঘণ্টা পর তাঁহারা পুনরায় হাতির পিঠে উঠিলেন।
তোফেল কহিল–মিঞা, বাম ধারে আর একটু অগ্রসর হলে সেই হরিণের আড্ডায় পৌঁছবে। তোফেল ভৃত্য। আবদুল গণি কহিলেন–চল, সেই দিকে যাই।
তাঁহারা পুনরায় অগ্রসর হইতে লাগিলেন বনভূমির শ্যাম শোভার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কুলসুম কহিলেন এই পাহাড়ের মাঝে একখানা কুটির তৈরি করলে হয়।
হালিমা : সত্যি, সংসারের কর্মকোলাহল হতে যদি নির্জন পাহাড়ের মাঝে কিছুক্ষণ থাকা যায়; তা হলে মনের সঙ্কীর্ণতা দূর হয়।
কুলসুম : এইজন্য হয়তো ফকির দরবেশরা এবাদত সাধনার জন্য পাহাড়কে ভালো স্থান মনে করেন।
হালিমা : শুনেছি কবির নির্জন শ্যাম-লতা পত্রাচ্ছাদিত পাহাড় প্রান্তরে হ্রদের পার্শ্বে বাস করেন। সেখানে তার গভীর ও সূক্ষ্ম ভাবের সন্ধান পান।
কুলসুম : হ্যাঁ তাই। মাঝে মাঝ সংসারের কাজ থেকে বিদায় নিয়ে দূরে যাওয়া উচিত–তাতে মনকে নূতন দৃষ্টি দেওয়া হয়। অতি আপনার জন যারা, তাদের সঙ্গ ছেড়ে মাঝে মাঝে দূরে যাওয়া ভালো। এতে নূতন নূতন জ্ঞান ও ভাবের সঙ্গে পরিচয় হয়।
হালিমা : স্ত্রীলোকের পক্ষে পাহাড়ে বাস করা সম্ভব নয়।
কুলসুম : স্ত্রীলোকের পক্ষে নির্জন আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন একটু অসুবিধা জনক বটে।
হালিমা : আমাদের এই পাহাড়ে ঘর তুলে আবাস প্রস্তুত কি সম্ভব? বাঘ এসে ঘাড় মটকে দিতে পারে। বাঘের ভয়ে চিন্তা ও ভাব পালিয়ে যায়।
কুলসুম : এখানে আবাস প্রস্তুত সম্ভব নয়। এমন এক স্থান ঠিক করা চাই, যেখানে বাঘের ভয় নাই, জিনিসপত্র পাওয়া যায় প্রাকৃতিক দৃশ্য ভাবময় করুণাভরা। কিছু কিছু বসতি থাকে। কিন্তু কোনো বিবাদ নেই।
হালিমা : আমাদের এই পাহাড়ে দিনরাত থাকবার সুবিধা না হতে পারে। খুব প্রাতকালে এলাম আবার সন্ধ্যাবেলা চলে গেলাম-এমন হলে কেমন হয়।
কুলসুম : বেশ হয়। রাতে থাকলেও যে ক্ষতি হবে তা নয়, তবে একটু কেমন কেমন লাগে। হালিমা : ভাইকে একখানা কুটির তুলতে বলুন। কোন জায়গাটা ভালো?
কুলসুম : যে জায়গাটার শোভা খুব মনোহর এবং যেখানে মানুষের যাতায়াত আছে।
হালিমা : একটু উঁচুস্থানে হওয়া চাই।
কুলসুম : যেখান হতে বহু দূর পর্যন্ত নজর চলে।
হালিমা : ঘরের চারদিকে প্রাচীর থাকবে কি?
কুলসুম : না, তাতে পাহাড়ে থাকার আমোদ নষ্ট হবে।
হালিমা : চারদিকে রেলিং থাকবে?
কুলসুম : হ্যাঁ।
হালিমা : একটা রান্নাঘরও থাকবে। কুলসুম। তা থাকলে মন্দ হয় না, প্রয়োজন হলে রান্না পর্যন্ত হতে পারে।
হালিমা : ঘরের মধ্যে একটা ছোট লাইব্রেরি থাকবে, কেমন?
কুলসুম : পাহাড় ঘুরে বেড়াবে, না পড়বে? পাহাড়ের শ্যাম মাধুরী, গল্প চিন্তা এই সবই যথেষ্ট। যদি দিন-রাত্রে সমানভাবে থাকবার সুবিধা হয়, তা হলে কিছু পুস্তক রাখা ভালো। একটা টেবিল বসবার জন্যে একটা ফরাস বা খান কতক চেয়ার থাকলেই যথেষ্ট। কাগজ কলম সব সময়েই দরকার। একটি ছোট বাক্স বা আলমারীতে কাগজ-কলম রেখে দিতে হয়। পাহাড়ের মধ্যে মনে যে সব চিন্তা উদয় হয়, সে সব কাগজে লিখে রাখা উচিত। পণ্ডিত ও কবিরা পাহাড়ে বা নির্জন মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যেই নাকি ভালো ভালো উপকরণ সংগ্রহ করেন।
হালিমা : মৃদু সতর্ক-কণ্ঠে কুলসুমের গায়ে ঠেলা দিয়া বলিলেন-হরিণ! হরিণ।
কুলসুম : আবদুল গণিকে ইশারা করিয়া জানাইলেন সম্মুখে হরিণ দেখা গিয়াছে। সকলেই নিশ্চল পাষাণ মূর্তির মতো স্থির হইয়া গেলেন।
রাইফেল বন্দুক–দূর হইতেই শিকার লক্ষ করা যায়। হাতির পৃষ্ঠ হইতেই আবদুল গণি বন্দুক তুলিলেন। মুহূর্তের মধ্যে একটা বিরাট হরিণ পাহাড়ের সবুজ ঢালুর উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া গেল।
আবার আনন্দ কোলাহল।
আহমদ দৌড়াইয়া গিয়া অর্ধমৃত হরিণের গলা ঠিক করিয়া ধরিল, কাঁটায় বাঁধিয়া তাহার কাপড় ছিঁড়িয়া গিয়াছিল, কিন্তু সেদিকে তাহার ভ্রুক্ষেপ ছিল না।
হাতি হইতে সকলেই নামিলেন। হালিমা, কুলসুম ও আবদুল গণির উৎসাহের সীমা রহিল না। তোফেল তাড়াতাড়ি হরিণটাকে জবেহ করিয়া দিল।
মুখ টান দিবার পূর্বে রক্তধারা আহমদের মুখে ও মাথায় যাইয়া লাগিল। অতঃপর একটা গাছের ছায়ায় বসিয়া তাহারা কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিলেন।
ঠিক হইল, এত বড় হরিণ যখন সামান্য এই কয়জনের পক্ষে বেশি হইয়া পড়িবে, তখন আপতত সেটাকে রান্না করিয়া কাজ নাই। শিকার আরও কিছু পাওয়া দরকার, আরও দুই একটা মুরগী বা ছোট এক-আধটা হরিণ পাইলে সুবিধা হয়।
বাম ধারে সহসা একটা মিহিন উচ্চ ভয়াবহ চীৎকার শোনা গেল। তাহা কোনো বিপন্নার আর্তনাদ বা ব্যধের আস্ফালন নহে। হরিণ যখন নির্জন পাহাড়ের শীর্ষে দাঁড়াইয়া ডাকে তখন সমস্ত বনভূমি প্রতিধ্বনিত হইতে থাকে।
আবদুল গণি সকলকে সেখানে অপেক্ষা করিতে বলিয়া তোফেলকে সঙ্গে লইয়া চীৎকার লক্ষ্য করিয়া বনে প্রবেশ করিলেন। তোফেল হালিমা বিবির বন্দুক লইল।
উদ্বেগে সকলে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। পনের মিনিট কটিল। অদূরে প্রতিধ্বনি করিয়া শব্দের পর শব্দ হইল। তোফেলের আনন্দসূচক চীৎকার শুনিয়া জানা গেল গুলি ব্যর্থ হয় নাই।
তোফেল এরফান ও কাজেমকে ডাকিল।
হাফিজ, রহিমা, কুলসুম ও হালিমা লতাপাতার ভিতর দিয়া মাথা নোয়াইয়া দেখিতে লাগিলেন।
হালিমার মুখোনি তখন প্রসন্ন ও ঈষৎ হাসিমাখা। উল্লাস চাঞ্চল্যে চোখে-মুখে-রক্ত লাবণ্য বিন্দু বিন্দু মুক্ত সদৃশ ফুটিয়া উঠিয়াছিল।
বনান্তের ফাঁক দিয়া কপাল ও চিবুকে সূর্যরশ্মি পড়িয়া তাহাকে অভিনব করিয়াছিল। তোফেল শিকার টানিয়া আনিল। ছোট একটা হরিণ-সেটা ছাগলের মতো। অতপর তাঁহারা হরিণ দুইটি ও মুরগী লইয়া নির্ধারিত স্থান অভিমুখে যাত্রা করিলেন। ঝরনাটির নাম ‘ওসমান ঝরনা’–নির্জন স্থান ছায়াময় ও পুচ্ছাদিত। সেখানে যাইয়া তাহারা আহারের আয়োজন করিলেন।
বালক ভৃত্যের সাহায্যে কুলসুম ও হালিমা নানা প্রকার খাদ্য প্রস্তুত করিলেন। বেলা যখন দুইটা তখন রান্না শেষ হইল। ছোট স্নানের তাবুটি তুলিয়া কুলসুম ও হালিমা স্নান করিলেন।
আহারাদি শেষ করিতে করিতে বেলা চারটা বাজিয়া গেল।
তোফেল ও আহমদ কহিল–আপনাদের হাতে আজ এমন তৃপ্তিসহ আহার করলাম, এরূপ তৃপ্তি সহকারে জীবনে কখনও আহার করি নি।
.
দশম পরিচ্ছেদ
হালিমা : ভাবি, ছালাম-আলায়কুম।–বাহির হইতে হালিমা ঘরের মধ্য প্রবশ করিলেন।
হালিমা কুলসুমের পার্শ্বে বসিয়া কহিলেন–ভাবি, বিয়ের পর স্বামীর প্রতি অনুরাগ জন্মে তা কি বেশি দিন স্থায়ী হয় না?
কুলসুম : স্বামী যেমন বিয়ের পর বৎসরখানেক পর স্ত্রীর জন্য তত পাগল হন না-রমণীরাও তেমনি স্বামীর প্রতি অনুরাগ হারান।
হালিমা : বড় কষ্টের কথা।
কুলসুম : অনুরাগ বা প্রবল আকর্ষণের জ্বালা অনুভব না করলেও কথা ও ব্যবহারে তা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যে দম্পতিতে তা না হয় তাদের মধ্যে নিত্য কলহ হয়। শান্তির পরিবর্তে অশান্তি এসে দেখা দেয়।
হালিমা : পুরুষের কথা শুনেছি, স্ত্রীলোকের কীভাবে মতিচ্ছন্ন হয় তা জানতে চাই।
কুলসুম : কারো প্রতি যদি আকর্ষণ অনুভব না করা যায়, তবে আর তার কথা মনে থাকে না। বয়সের গুণে স্ত্রীলোকের মনে এক সময় পুরুষের জন্য ব্যাকুলতা জন্মে–যখন এই ব্যাকুলতা দূর হয়, তখন তারা স্বামীকে দায়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে প্রাণের আবেগে নয় কিংবা প্রেমেও নয়। বিবাহ হয়েছে করা কী? স্বামীর ভাত রাঁধতে হবেই।
হালিমা : আশ্বর্য! মেয়ে মানুষের মনে এত শোচনীয় পরিবর্তন হয়!
কুলসুম : খুবই বিস্ময়ের কথা। সকল ক্ষেত্রেই কি এরূপ হয়? প্রাণের জ্বালাময় আকর্ষণে আগুন না থাকুক–একটা স্নিগ্ধ-শান্ত কর্তব্য গন্ধ মাখা অনুরাগ ধারা বইতে থাকবে তো। দিবারাত্রি স্বামীকে চোখে চোখে রাখবারে আকাক্ষা না থাক, স্বামীর জন্য বেদনা বোধ থাকা চাই। যখন কাপড় নেই, যখন ছেলেদের জন্য খেলনা দরকার, যখন চাল ফুরিয়ে গিয়েছে তখনই স্বামীর আবশ্যকতা অনুভব করা আর অন্য সময় গম্ভীর হয়ে বসে থাকা বা
নীরস কর্কশ কথা বলা–নারীরজীবনের বড় খারাপ কথা। স্বামীর মৃত্যুতে অনেক রমণী ভাত কোথায় পাবে এই ভাবনায় কাঁদে-মমতায় নয়। তার জীবনের প্রিয় বন্ধু মরে গেলো, এজন্য সে কাঁদে না। যখন বিয়ে হয় তখন মুখে হাসি ধরে না–পুরানো হলে রমণীর মুখ স্বামীর সম্মুখে আর তত প্রফুল্ল হয় না। কারণ, তখন তার মনে আসক্তি থাকে না।
হালিমা কানে হাত দিয়া কহিলেন, ওমা, আর শুনতে চাই নে। ভাবি এসব আমি বিশ্বাস করি নে।
কুলসুম : খোদার কাছে প্রার্থনা করি, তুমি যেন এইসব বিশ্বাস না কর। ছিঃ ছিঃ! যে মেয়ে মানুষ এত নীচতার পরিচয় দেয়, সে বড়ই হতভাগিনী। শিক্ষা না হলে মনের অবনতি ঘটে, যে স্ত্রীলোকের শিক্ষা নেই মনও তাদের ছোট। সর্বদা স্বামীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। কোনো কোনো রমণী সদ্ব্যবহার কাকে বলে তা বোঝে না। স্বামী যাতে সন্তুষ্ট থাকেন তাই করলেই তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা হলো। স্ত্রীলোকেরা স্বামীর বাড়িতে যখন একটু আসন করে নেন–তখন স্বামীকে বাজে জিনিস বলে মনে করেন, তখন আর স্বামীর কোনো উপদেশ গ্রাহ্য করেন না। মনে করেন আমি তো একজন হয়েছি। ছেলেপেলে হলে কোনো কোনো নারীর মনে বিলক্ষণ অহঙ্কার জন্মে। এসব কথা বলতে কষ্ট হয় কিন্তু তবুও না বলে পারছি না। তারা মনে করেন যখন ছেলেপেলে হয়েছে তখন আর আমাদের পায় কে? স্বামী কোনো কারণে স্ত্রীর উপর অসন্তুষ্ট হলে তারা মনে মনে হাসতে থাকেন। স্বামী হয়তো দুঃখে মরে যান, স্ত্রী মজার সঙ্গে পালঙ্কে বসে কৌতুক করেন। ভাবেন এই আপদটার যদি বিশেষ অসুবিধে হয়ে থাকে তা হলে দেখুক না। এইসব স্ত্রীলোক নারী জাতির কলঙ্ক। যাদের মধ্যে বিদ্যা নাই, বুদ্ধি নাই, জ্ঞান নাই, যারা একটা পয়সা উপায় করতে পারে না, তাদের আবার
অহঙ্কার কীসের? স্বামীর গৌরবেই স্ত্রীলোকের গৌরব। স্বামীকে বাদ দিয়ে মেয়ে মানুষের। কীসের গৌরব? বি, এ, পাস বা বিত্তশালিনী বউ হলে না হয় আলাদা কথা। টাকা সম্মানের লোভে স্বামী-স্ত্রীর কোনো দোষ ধরে না। আবার লেখাপড়া জানা মেয়ে, বউ বেহায়া বা। প্রাণহীন হন না, স্বামীকে বাতাস করতে তার গা টিপে দিতে, স্বামীর আদর-যতে করতে। লজ্জা, কষ্ট বা অপমান বোধ হয় না। তিনি স্বামীর পা ধুয়ে দিতে আনন্দ বোধ করেন, দাসীরূপে নয়-বন্ধুরূপে। তিনি ভাবেন, পুরুষ পত্নী ও পুত্রের জন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণ দেয়, অতএব,স্বামীকে খেদমত করলে তার অপমান হবে না। পরীর সুখের কথা মনে করে পুরুষ কামানের সম্মুখে যেয়ে দাঁড়ায়–সেই পুরুষের কাছে নারীর শুধু কৃতজ্ঞতা নয়–সহৃদয়তা দেখান একান্ত আবশ্যক। এতে অপমান কী? এইতো আনন্দ! সহৃদয়তা ও সেবার দ্বারাই প্রেম প্রণয় হয়। নেশা কয়দিন থাকে? স্বামীর হাতে গামছাখানি এগিয়ে দেওয়া, তাড়াতাড়ি জুতো, ছাতি ঠিক করে দেওয়া, স্বামী কোনো জিনিস খুঁজতে থাকলে নিজে খুঁজতে আরম্ভ করা, স্বামীর জন্যে এক বদনা পানি ভরে রাখা, এসব হৃদয়তা ছাড়া আর কিছু না। এতে স্বামী সন্তুষ্ট হন। এসব কাজে অসম্মান নেই–এসব বন্ধুত্বের প্রীতি অবদান।
হলিমা : সে তো নিশ্চয়ই।
কুলসুম : ও পাড়ার মধুর মা তার বড় তিনটি ছেলের সঙ্গে যোগ হয়ে বুড়ো স্বামীকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
হালিমা : মাগী তো বড় শয়তানী।
কুলসুম : বেচারা স্বামীর গায়ে এখন জোর নেই কিনা! বিবাহিত জীবনের পিপাসা এখন কেটে গিয়েছে কিনা!
হালিমা : তাড়িয়ে দিয়েছে না রাগ করে বের হয়ে চলে গিয়েছে?
কুলসুম : নিজে যদি রাগ করে বের হয়ে চলে গিয়েই থাকে, তাই বলে কি তাকে ফিরিয়ে আনা যায় না? স্বামীকে বাড়ির বাইরে রেখে কি করে এরা ভাত খায়, আমোদ আহ্লাদ করে। এটা তাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া আর কি? স্বামী তো নয় যেন বাড়ির ভৃত্য। দাস দাসী, ছেলে-পেলে, টাকাকড়ি, দালান-সম্পত্তি পেয়ে অনেক নারীর মনে অহঙ্কার আসে।
হালিমা : একেবারে দোজখে যাবে।
কুলসুম : ওমা, এই সমস্ত স্ত্রীলোকের দোজখ বলে ভয় আছে, তুমি মনে কর? ক’টি মেয়ে মানুষের দোজখের ভয় আছে, শতকরা একজনারও না। যারা নামাজ পড়ে, তারাও দেখাদেখি পড়ে, খোদার মমতায় নয়–দোজখের ভয়ে নয়। মন যাদের অনুন্নত তারা। আবার কি ছাই নামাজ পড়বে? অন্ধ বিশ্বাস, মূর্খতা ও কুসংস্কারের ফলে রমণী যা তা করে, তাতে তাদের একটুও লজ্জা হয় না। দোজখের আগুনের কথা, পরকালের কষ্টের কথাগুলিকে অনেক রমণী রসিকতা করে ভীত না হয়ে হাসতে থাকে।
হালিমা : গর্বিত স্ত্রী যে স্বামীর সঙ্গে এমন ব্যবহার করে–আচ্ছা, স্বামী যদি রেগে একটা ভয়ানক কিছু করে বসে?
কুলসুম : সাত ছেলের মাকে কেউ তালাক দেয় না। হালিমা : দিলে কী হয়?
কুলসুম : দিলে দুঃখের একশেষ। কঁদতে জীবন যায়-পথের ভিখারিণী হতে হয় ছেলেরা বাপের বাড়ি থুয়ে মার সঙ্গে যায় না। যতই যা করপেটের চিন্তায় সব উৎসাহ মায়া নিবে যায়। তালাক দিলে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে স্ত্রীলোকের যেতেই হবে–না যেযে। উপায় নেই। তবে এরূপ ভয়ানক কাজ কোনো স্বামী করে না। মূর্খ স্ত্রীলোক না বুঝে স্বামীর সঙ্গে অনেক সময় দুর্ব্যবহার করে। তাই বলে তাকে হত্যা করা মানুষের কাজ নয়। সহ্য করাই পৌরুষ, প্রতিশোধ নেওয়া কাপুরুষতা।
হালিমা : তা হলে পুরুষকে অত্যাচারী রমণীদের অত্যাচার সয়ে থাকতে হবে। এতে যে জীবনের অনেক শক্তি কমে যায়। ঘরের ভিতর অশান্তি ও বেদনা ভোগ করে, কোনো পুরুষ কোনো কর্ম করতে পারে না।
কুলসুম : স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া-ফ্যাসাদ না করে বা তাকে দূর করে না দিয়ে সতর্ক করে দেওয়া উচিত। তাদের কথার উত্তর না দেয়াটাই কর্তব্য। অনেক সময় পুরুষেরা স্ত্রীর অত্যাচারে নূতন স্ত্রী গ্রহণ করেন এবং স্বতন্ত্র সংসার প্রতিষ্ঠা করেন। অভাগিনীদের এই দুরবস্থার কারণ তাদের নিজের দোষ।
হালিমা : স্বামী যখন দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেন,তখন আগেকার স্ত্রীর মনে কি খুব কষ্ট হয়?
কুলসুম : খুব কষ্ট হয়–কিন্তু তখন আর উপায় থাকে না–চিরদিনের জন্যে সে স্বামী হারা হয়।
হলিমা : সখের বসে কোনো স্বামী নূতন স্ত্রী গ্রহণ করে নাকি?
কুলসুম : তোমার মতো সাধ্বী পতিগতপ্রাণ, সদালাপী, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুন্দর স্ত্রী যার ঘর উজ্জ্বল করবে, সে কোনো দুঃখে নতুন স্ত্রী গ্রহণ করবে? স্ত্রীলোকের রূপ অপেক্ষা কথা বলার শক্তি স্বামীকে গভীরভাবে মুগ্ধ করে। আনারী অসভ্য স্বামীর কাছে আদর না। থাকতে পারে, কিন্তু শিক্ষিত লোকের কাছে আছে।
হলিমা : স্বামীকে কথার দ্বারা মুগ্ধ করা কি কম কথা? মেয়ে মানুষের এমন শক্তি কোথায়??
কুলসুম : নারীর মুখের একটা জ্ঞানপূর্ণ মধুর কথা, স্বামী দশটি বলেই গ্রহণ করেন। সুতরাং ভয়ের কোনো কারণ নেই।
হালিমা : নারীর লেখাপড়া শেখা নিতান্ত আবশ্যক।
কুলসুম : পুরুষ জাতির মঙ্গলের জন্য-বাঁচিবার জন্য-পুরুষকে পাপ ব্যভিচার থেকে রক্ষা করিবার জন্য বিদ্যালাভ করা আবশ্যক। বিদ্যা ব্যতীত নারী যে পশু অপেক্ষা অধম।