–এসেছ তাহলে? জয়মোহন সোজাসুজি ছেলের দিকে তাকালেন না। যেন বিবর্ণ দেওয়ালটার সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। অথবা ফিকে মেরে যাওয়া পুরনো ছবিটার সঙ্গে।
আদিত্য সোফায় বসে পড়ল। হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময়েও মনে হচ্ছিল শরীরে আবার জোর ফিরে এসেছে, আজ থেকেই নতুন উদ্যমে কাজে লেগে পড়া যায়, ট্যাক্সিতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন ছেড়ে গেল শরীরটা। বহির্বিশ্বের কোলাহল ঝাঁ ঝাঁ ঝাঁপিয়ে পড়ল কানের পর্দায়, পোড়া পেট্রল ডিজেলের গন্ধে নাড়িভুঁড়ি গুলিয়ে উঠল। ধীরে ধীরে অবশ হয়ে এল দেহ। গোটা পথ তিতির আর কন্দর্প কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে, হাসি তামাশাও করছিল, আদিত্য কোনও কথাতেই মন দিতে পারেনি। প্রাণপণে শরীরের হৃত বল ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিল সে। তবু শেষ রক্ষা হল না। ট্যাক্সি থেকে নামার মুহূর্তে আঁধার ঘনিয়ে এল চোখে। হাঁটু কেঁপে গেল।
এখনও কাঁপছে। হাতের থাবায় থর থর দুই ঊরু চেপে ধরল আদিত্য। ঘন ঘন নিশ্বাস টানছে। পূর্ণ করে নিতে চাইছে ফুসফুস।
তিতির বাবার কাঁধে হাত রাখল, জল খাবে?
–খেতে পারি। তালুটা শুকিয়ে গেছে।
জল খেয়ে খানিকটা স্থিত হল আদিত্য। সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজল।
জয়মোহনের টেবিলে আজ তাস নেই। আড়চোখে তিনি দেখছেন ছেলেকে, তোমার শরীর এখনও সারেনি মনে হচ্ছে?
না, অনেকটা সেরেছে। নইলে কি হাসপাতাল ছাড়ে!
–কে জানে, হাসপাতাল তো রুগী তাড়াতে পারলে বাঁচে। তোমার মুখচোখ এখনও ভাল নয়।
না না, সত্যি আমি ভাল আছি। এই একটু উইকনেস আর কি। পথের একটা ধকল গেল।
–হুম। পেটে বেদনা-টেনা নেই তো আর?
আদিত্য ফ্যাকাসে হাসল, তেমন একটা নেই। তবে জিভের স্বাদ একেবারে গেছে। স্রেফ সেদ্ধ সেদ্ধ খাওয়া!
–নিজের অত্যাচার নিজেকেই শাস্তি দেয়। আশা করি শিক্ষাটা পেয়েছ।
আদিত্য চোখের পাতা খুলল। জয়মোহন দেওয়ালের ছবির দিকেই তাকিয়ে আছেন। টিউবলাইটের আলো টেরচাভাবে পড়ে তাঁর মুখের অর্ধাংশ আলোকিত, বাকিটা ছায়াময়। যেটুকু দৃশ্যমান সেটুকুনিও যেন বড় বেশি ক্লিষ্ট, ভাঙাচোরা, বড় বেশি বৃদ্ধ মনে হচ্ছিল আদিত্যর। তাদের পিতাপুত্রের সম্পর্ক এখন যে স্তরে এসে ঠেকেছে তাতে বাবার মুখ বড় একটা দেখা হয়ে ওঠে না আর। এখন তো দেখা শুধু বিতৃষ্ণায়। ক্রোধে। এই মুহূর্তে স্থির তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুখটিকে কেমন অচেনা লাগছিল আদিত্যর।
এত নিকট-মানুষ কী করে যে এমন অচেনা হয়ে যায়!
তিতির ডাকল, চলো বাবা, এবার ওপরে যাবে তো?
বাবার কাছে আর একটু থাকার ইচ্ছে আদিত্যর। মুখ ফুটে প্রকাশ করল না আকাঙ্ক্ষাটা। ঘুরিয়ে বলল, এক্ষুনি উঠলে হাঁপিয়ে যাব। আরেকটু রেস্ট নিয়ে নিই।
–আমি তাহলে ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে ওপরে যাই? দরজার কাছে থামল তিতির, তুমি একা একা সিঁড়ি ভেঙে উঠতে পারবে?
–পারব। না পারলে ডাকব তোকে।
–তুমি এখন কি খাবে? হরলিকস?
আদিত্য নাক কুঁচকোল।
-মা চিকেনস্যুপ করে রেখেছে, দিয়ে যাব?
–পরে দিস। এখন কিছু খেতে ভাল লাগছে না।
জয়মোহন জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ রে তিতির, চাঁদু তোর সঙ্গে গেল, ফিরল না তো?
–ফিরেছে। তিতির সিঁড়ি থেকে উত্তর দিল, মেশিনঘরে মা’র সঙ্গে কথা বলছে।
–ও। বউমাও তাহলে ফিরে এসেছে। আপন মনে বললেন জয়মোহন।
আদিত্য আলগা প্রশ্ন করল, ইন্দ্রাণী বুঝি বাড়ি ছিল না?
বাড়িতে আর কতটুকুন থাকতে পায় বেচারা! স্কুল থেকে ফিরেই সারাক্ষণ অর্ডার পেমেন্ট ডেলিভারি… আজও তো ডালহাউসি না কোথায় বেরোল পেমেন্ট কালেকশানে।
–ও।
জয়মোহন সোফা থেকে উঠে পড়লেন। অস্থির পা। এদিক ওদিক হাঁটছেন। থামলেন। কি যেন বলতে চাইছেন। গলা খাঁকারি দিয়ে বলেই ফেললেন, শরীরটা সেরে উঠলে এবার অন্তত কাজেকর্মে একটু মন-টন দাও। বয়স তো অনেক হল।
হুঁ, একটা কিছু তো করতেই হবে।
–একটা কিছু কেন? প্রেসটাকেই দ্যাখ। বউমা একটু ছুটি পায়। একা হাতে আর কত দিন সামলাবে! বাইরে বাইরে ঘোরা, প্রেসে বসে প্রুফ দেখা, স্কুল, ছেলেমেয়ে…
–কেউ যদি শখ করে খাটে, আমি কী বলব? স্কুলের চাকরিতে তো এখন ভালই মাইনে, এখন আর এক্সট্রা বাৰ্ডন নেওয়ার দরকার কী?
জয়মোহন বহুকাল পর ছেলের সঙ্গে নরম করে কথা বলার উৎসাহ পাচ্ছেন যেন, ঠিকই তো, এক্সট্রা বাৰ্ডন নেবে কেন? তোরই তো প্রেস, এবার তুই চালা।
কথাটা যে এদিকেই ঘুরে যাবে আদিত্য ভাবেনি। একটু অসহিষ্ণুভাবে বলল, লেটার প্রেসের ব্যবসা ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে বাবা, ওসব আর চলে না।
–কে বলল চলে না? বউমা কত অর্ডার পাচ্ছে, দুর্লভরা প্রায় দিন ওভারটাইম করে…
করুক গে, ওতে তেমন প্রফিট নেই। আমি জানি।
–তুমি জেনে বসে আছ? বউমা বুঝি তবে বেগার খাটে?
–অতশত জানি না। সে আমার পোষাবে না। আমি অন্য কিছু করব।
জয়মোহন থমকে গেলেন, দু-এক মুহূর্ত চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে, অন্য কিছু মানে? কী করবি তুই?
করব একটা। হালকাভাবে বলল আদিত্য, প্ল্যানটা ভাঙল না।
জয়মোহনের স্বরে রুক্ষতা বাড়ছিল, কি করবি খুলে বলা যায় না?
আদিত্য রঘুবীরের মুখটা দেখতে পাচ্ছিল। ভাঁটার মতো চোখবিশিষ্ট এক দৈবপ্রেরিত পুরুষ। রহস্য করার ভঙ্গিতে হাসল একটু, আহা চটছ কেন? শুরু করলে তো দেখতেই পাবে।
–আমি দেখতে চাই না। আমি জানতে চাই।
আদিত্য দম নিল, উত্তেজিত হচ্ছ কেন? প্রেশার বেড়ে যাবে যে। হাইপার টেনশানের রুগীর কি মাথা গরম করা ভাল?
–তার মানে প্রেসটা তুই দেখবি না?
সম্ভব নয়।
বউমা এত কষ্ট করে মরা ব্যবসাটাকে দাঁড় করাল…! জোরে জোরে নিশ্বাস পড়তে শুরু করেছে জয়মোহনের, কপালের শিরা দপদপ। হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়লেন, লজ্জা করে না বলতে? এক সময়ে তুইই না প্রেস প্রেস করে নেচেছিলি?
শুধু নাচেইনি আদিত্য, তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু করেছিল। সে এক লম্বা ইতিহাস। মহাভারতও বলা যায়। প্রায় অষ্টাদশ পর্বের। তার কর্মকাণ্ডের অমর কাহিনী।
সেই মহাভারতের আদিতে ছিল দুধ-পর্ব। জয়মোহনের ব্যবসা ভাগীরথীতে ডুবে যাওয়ার পরই আদিত্যর মাথায় দুধ ঢুকল। পাড়ার এক হাফ-মস্তানের সঙ্গে পার্টনারশিপে দুধের এজেন্সি। এসব এজেন্সিতে সবাই প্রায় মানথলি কার্ড করায়, আদিত্য বলল, নো। ডেলি দুধ, ডেলি ক্যাশ। বলেই বিপদ! আদিত্য মুখচোরা মানুষ, চেনাপরিচিতরা মাঝে মাঝে ধারে দুধ নিয়ে যায়, মুখ ফুটে কিছুতেই আর পয়সা চাইতে পারে না আদিত্য। মাস কয়েক পর দুধ-কোম্পানিকে ড্রাফট দেওয়ার সময় ব্যাপারটা নজরে পড়ল পার্টনারের। তুড়ে গালাগাল করল আদিত্যকে। ফল হল উলটো। গোঁয়ার আদিত্য পার্টনারের ওপর চটে গিয়ে আরও বেশি করে দুধ বিলি শুরু করল। মাসিমা, দুধ নিয়ে যান, এ গভর্নমেন্টের গরুর দুধ নয়, দারুণ ছানা হবে। বউদি, জমিয়ে ক্ষীর করুন। এই বুলি, একটা দুধে তোদের হয় নাকি? আরেকটা নে। আহা, পয়সার কথা কে শুনতে চেয়েছে? খা, প্রাণের সুখে খা।
সাত দিন ধরে দুধের নদী বয়ে গেল পাড়ায়। তারপর শুরু হল মুষল পর্ব। পার্টনার লোকাল পার্টির হোমরাচোমরা, তাদের দল তখন গোটা ভারতবর্ষে প্রবল প্রতাপে দাপাচ্ছে, সেই জোশে সে দিল একদিন আদিত্যকে পিটিয়ে। এমনিতে আদিত্য ঘাড়বোলা ধরনের নিরীহ, কিন্তু খেপলে সে একেবারে মহিষাসুর। সে-ও পরদিন নিজেদেরই দুধের দোকানে ভাঙচুর করে এল খানিক, হাফ-মস্তানের বাড়ি গিয়ে তুমুল চেঁচামিচি করল, আছড়ে ভেঙে দিয়ে এল তার কাচের টেবিল। তারপর কদিন পাড়ায় সে কী টেনশান! এই লাগে তো সেই লাগে। তা শেষ পর্যন্ত তেমন কিছুই ঘটল না। হুড়মুড় করে ইলেকশান এসে গেল, হাফ-মস্তানের পার্টি হেরে ভূত, সেই ছোকরাও পাড়া ছেড়ে ধাঁ। দুধ ব্যবসা কফিনে।
এরপর ভোজ পর্ব। ইন্দ্রাণী তখন মরিয়া হয়ে লিভ ভ্যাকান্সিতে ঢুকেছে একটা স্কুলে, বাপ্পা বছর সাতেকের, তিতিরের তখন চারও পোরেনি। কলেজের এক বন্ধু আদিত্যকে অনেক দিন ধরে তাতাচ্ছিল, দুজনে মিলে নামল ক্যাটারিং-এর ব্যবসায়। প্রাথমিক পুঁজিপাটা এবারও জয়মোহনের। কিছুটা ইচ্ছেয় দিলেন তিনি, কিছুটা অনিচ্ছায়। ইচ্ছের কারণ ছেলে যদি বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে একটু থিতু হয়ে দাঁড়াতে পারে। অনিচ্ছার হেতু দুধপর্বের শিক্ষা।
তা এ ব্যবসা চলেছিল কিছু দিন। প্রায় বছর দেড়েক। সঙ্গী বিমল বলিয়ে-কইয়ে ছেলে, স্পোকেন ইংলিশে তুখোড়, ঝটঝট বেশ কটা বিয়ে অন্নপ্রাশন শ্রাদ্ধ ধরে ফেলল। কাজ এগোচ্ছিল ভাল। রান্নাবান্নার গুণমানের ওপর আদিত্যর কড়া নজর, বিমল সামলায় নিমন্ত্রিতদের আদর-আপ্যায়ন। ঝঞ্ঝাট এল কাজকর্ম একটু বাড়ার পর, যখন দিনে দুটো তিনটে কনট্র্যাক্ট এক সঙ্গে জুটছে। দুই বন্ধু স্থির করল যে, নিমন্ত্রণ বাড়ি যে সামলাবে, তার প্রফিটটা তার। বিমল ঠিকই চালাতে লাগল, আদিত্যর হয়ে গেল মুশকিল। তার এস্টিমেট ভুল হয়, পোলাও কম পড়লে মুরগি বেঁচে যায় ডেকচি ডেকচি, পাহাড়ের মতো চপ কাটলেট জমে যায়। প্রথম প্রথম তো আদিত্যর দারুণ ফুর্তি। যা খাবার বাঁচে বেশির ভাগ বাড়িতে নিয়ে চলে আসে। তিন দিন ধরে বাড়ির সবাই চপ ফ্রাই গেলে। পাড়াপড়শি বন্ধুবান্ধবরাও পোলাও-মাংসে বঞ্চিত হয় না।
কিন্তু এভাবে আর চলে ক’দিন! ব্যবসার মূলে টান পড়তে আরম্ভ করল। তখনও আদিত্যর মদের নেশাটা তেমন পাকাপোক্ত হয়নি, খায় মাঝে সাঝে, কখনও কখনও বেহেড হয়েও ফেরে, আবার হয়তো টানা পনেরো দিন ছুঁয়েও দেখে না বোতল। এক দিনই খুব বেশি টেনে ফেলেছিল, বিমল বেঁকিয়ে চুরিয়ে দু-চার কথা শুনিয়ে দিল তাকে, যেন মদ খেয়েই ব্যবসার টাকা ওড়াচ্ছে আদিত্য। মুখে আদিত্য বলল না কিছু শুধু ব্যবসাটা আলাদা করে নিল। আর পুরোপুরি গেঁথে গেল কাদায়।
এই রকম এক সময়ে প্রেসের উদযোগ পর্বের সূচনা। এক পৈতে বাড়িতে আড়াইশো ফিশফ্রাইএর পর্বতের সামনে বসে আছে আদিত্য, গুমোট গরম আর তার পরের ভারী বৃষ্টিতে অর্ধেক নিমন্ত্রিত গরহাজির, যারা এসেছে তারাও ফ্রাই-এর বহর দেখে গলায় আঙুল ডুবিয়ে বমি করতে চায়, কারণ আদিত্য তখন মরিয়া লাভের আশায় কচি হাঙর ছাড়া আর কিছুর ফ্রাই করে না, আদিত্য গালে হাত দিয়ে ভাবছে কতগুলো ফ্রাই নর্দমায় ফেলবে আর কতগুলোই বা দিয়ে যাবে পৈতেবাড়িতে, সেই মাহেন্দ্রক্ষণে তার রণেনের সঙ্গে দেখা।
রণেন আদিত্যর ন্যাংটোবেলার বন্ধু। একসঙ্গে দুজনে স্কুলে পড়েছে, হজমি খেয়েছে, নিষিদ্ধ বই চেখেছে, মৈথুনরত কুকুরদের একসঙ্গে ঢিল ছুঁড়েছে দুজনে। এছাড়া লেকে বিড়ি খাওয়া, স্কুল কেটে উত্তমসুচিত্রা এসব তো আছেই। কলেজে গিয়ে দুজনে দুদিকে ছিটকে গেল। রণেন পড়ল ইঞ্জিনিয়ারিং, আদিত্য জেনারেল স্ট্রিম। পাড়া ছেড়েও চলে গেল রণেন। বহুকাল পর পৈতেবাড়িতে দেখা হয়ে দুজনেই উচ্ছ্বসিত, আদিত্যর দুর্দশা দেখে রণেন তো হেসে খুন।
প্রেসের পরামর্শটা রণেনই দিল। পরামর্শ, না দুর্বুদ্ধি, আদিত্য অবশ্য আজও বুঝে উঠতে পারেনি। প্রথমটায় আদিত্যর মতো ভোলেভোলা ইনসানও এক ঢোঁকে বুদ্ধিটা গেলেনি। সে প্রিন্টিং প্রেসের কিছুই বোঝে না, তাদের ক্যাটারিং-এর মেনুকার্ড পর্যন্ত নিজে ছাপাতে যায়নি কোনওদিন, বিষাক্ত সিসে ফিশে নিয়ে কাজ হয় বলে পা পর্যন্ত রাখেনি প্রেসে, সে করবে ওই ব্যবসা! নিজে!
রণেন ভাজা হাঙর খেতে খেতে তাকে বুঝিয়ে দিল লাভ লোকসানের খতিয়ান। না লোকসানও নয়, শুধুই লাভের হিসেব। সঙ্গে কয়েকটি মহৎ টোপ। রণেন তখন এক টাইপ ফাউন্ড্রির ইঞ্জিনিয়ার, সে ধারে বিশ তিরিশ কেজি টাইপ দেবে। ক্যানিং স্ট্রিটের দুজন বড় কাগজ-ডিলারের সঙ্গেও তার দহরম মহরম, তাদের ঘর থেকে ক্রেডিটে কাগজ তুলতে পারবে আদিত্য। ভাল মেশিনও রণেন সস্তায় পাইয়ে দেবে।
শুনতে শুনতে আদিত্যর বুকে দুন্দুভি বাজছিল। আহা, এ যেন কাগজ ছাপা নয়, নোট ছাপা। ব্যস, ক্যাটারিং ডকে।
পরদিন থেকেই অভিযান শুরু। রণেনের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বেশ কিছু প্রিন্টিং মেশিন দেখা হয়ে গেল। নতুন দেখে, পুরনো দেখে, ঠিক পছন্দসই আর হয় না। হয়তো বা কান ঘেঁষে বেঁচেই যেত আদিত্য, কিন্তু বিধি বাম। শয়তান অলক্ষে হেসে একটা ভাল সেকেন্ডহ্যান্ড হাইডেলবার্গ মেশিনের সন্ধান দিয়ে দিল। চ্যান্ডেল অ্যান্ড প্রাইস সিস্টেমের মেশিন, পুরনো হলেও বেশ ঝকঝকে চেহারা, হাফ ডিমাই সাইজে কাগজ ছাপা যায়। শয়তানের কৃপায় দামও কম, মাত্র চল্লিশ হাজার। মেশিন দেখে, দাম শুনে রণেন উচ্ছ্বসিত, দেখাদেখি আদিত্যও। ঘনিয়ে এল যুদ্ধ পর্ব।
আদিত্যর হাতে টাকাকড়ি তখন প্রায় শেষ। বাবা বউ কাউকে না জানিয়ে মার দুজোড়া বালা বিক্রি করে আদিত্য মেশিন অ্যাডভান্স করে চলে এল। তারপর শুরু হল জয়মোহনের ওপর চাপ। টাকা দাও। টাকা দাও। জয়মোহন তখন ঠেকে ঠেকে ঘাঘু, ফুৎকারে ছেলের বাই উড়িয়ে দিলেন। পরে গিন্নির বালা বেচা হয়েছে শুনে রেগে অগ্নিশর্মা। তবে তিনি ছেলের চুলের ডগাও ছুঁতে পারলেন না। তার আগেই শুরু হয়ে গেল তাঁর ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ। হিটলারি কায়দাতে বাঙালি ঢঙ মিশিয়ে। সারাদিন কান্নাকাটি করেন শোভনা, সারারাত আত্মহত্যার ভয় দেখান, কারণে অকারণে মাথা ঠোকেন দেওয়ালে। আমার খোকন এতদিনে একটা রাস্তা খুঁজে পেল, তুমি তাকে একটুও সাহায্য করবে না! এর সঙ্গে আদিত্যর ফোয়ারা তো ছুটছেই। আগলাক, আগলাক, টাকা নিয়ে যক্ষ হয়ে বসে থাকুক। শালা বাপ তো নয়, দশরথ। সব দরদ শুধু মেজ ছেলের জন্যে। সুদীপের অপরাধ তার জীবনের প্রথম চাকরিটা হয়েছিল বাবার সুপারিশে। ইন্দ্রাণী তখন না পারে শাশুড়িকে থামাতে, না পারে আদিত্যকে। দুমুখো আক্রমণে শেষ পর্যন্ত সাদা পতাকা তুললেন জয়মোহন। আদিত্যর দুই ব্যবসায় তাঁর অনেক গিয়েছে, তবু একটা ফিক্সড ডিপোজিটের টাকা তুলে দিয়ে দিলেন। তাতেও হল না। শুভাশিসের তখন ঘন ঘন যাতায়াত এ বাড়িতে, তার কাছ থেকে ধার নিল বাকিটা। আদিত্যর তীব্র আগ্রহে সেও খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল, ইন্দ্রাণীর বারণ না শুনেই দিয়ে দিল হাজার বিশেক।
এবার শল্য পর্ব। টাকা তো জোগাড় হল, কিন্তু জায়গা কই? বউবাজার কলেজস্ট্রিট পাড়ার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ধাতে সইবে না, কাছেই কোথাও ঘর-টর চাই। তখনই আদিত্যর শুভানুধ্যায়ীরা কানে ভাসিয়ে দিল গ্যারেজঘরটার কথা। তিয়াত্তরের গোড়ার দিকে নিজের ল্যান্ডমাস্টারটা বেচে দিয়েছিলেন জয়মোহন, তারপর থেকে গ্যারেজ ফাঁকাই পড়ে ছিল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে ফাঁকা নেই। সুদীপের আগের অফিসের ডেপুটি ম্যানেজার তখন গাড়ি রাখছে গ্যারেজটায়। সুদীপ তখন সেই ওষুধ কোম্পানির জুনিয়ার অ্যাকাউন্টস অফিসার, সদ্য বিয়ে করেছে। সেই পড়ল ফাঁপরে। অফিস-বস্ পাবলিক গ্যারেজে গাড়ি রেখে রোজ তেল চুরির দুখভরা কহানী শোনাত, সুদীপই যেচে তাকে খুলে দিয়েছে গ্যারেজঘর। এখন কোন্ মুখে তাকে হঠায়? দাদাকে সে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল, বাবার কাছে গিয়ে গাঁইগুই করল, রুনাও নববধুর লাজ বিসর্জন দিয়ে শাশুড়িকে অনুরোধ করল, কিন্তু ভবি ভুলবার নয়। ওই গ্যারেজঘরই চাই। সুদীপও এর পর পাল্টা চিৎকার জুড়ল। বাড়িতে ওই সব ঘটাংঘট চলবে না। উটকো লোক দরজায় ভিড় করবে। বাড়ির শান্তি বিঘ্নিত হবে। রায়বাড়ির ফ্যামিলি প্রেস্টিজ নেই? দুই ছেলের টাগ-অফ-ওয়ার দেখে চুল ছিঁড়ছেন জয়মোহন, আদিত্য দুম করে একদিন গদা চালিয়ে সুদীপের ঊরু ভেঙে দিল। অফিসবসের ড্রাইভারকে অকারণে যাচ্ছেতাই অপমান করে বসল। নিজে তালা কিনে লাগিয়ে দিল গ্যারেজঘরের শাটারে।
বেচারা সুদীপ আর কী করে! কলকাতায় তো আর দ্বৈপায়ন হ্রদ নেই যার পাড়ে সে ভগ্নঊরু নিয়ে শুয়ে থাকবে! অগত্যা স্যারের হাতেপায়ে ধরে ক্ষমা চাইল, বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বন্ধ করে রইল টানা দু মাস।
শুরু হয়ে গেল আদিত্যর প্রেস। কর্ম পর্ব। ঘটাংঘট।
ক’দিন আদিত্য খুব খাটল। অফিসে অফিসে ব্যাগ নিয়ে ঘোরে, দপ্তরিপাড়ায় যায়, পরিচিতদের বৃত্তটি তার বেশ বড়, তাদের দৌলতে কাজও জুটল মন্দ না। কিন্তু আদিত্যর উৎসাহ কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের মতো, বড় দ্রুত কমতে থাকে। আদিত্য আবিষ্কার করল এ ব্যবসাতেও প্রচুর চোরাবালি। ভাগ্যবলে যে মেশিনম্যানটিকে সে প্রথম থেকে পেয়েছিল, সে লোকটি ভাল। দুর্লভ দাস। ফাঁকিবাজ নয়, ব্যবহারটি মধুর, আদিত্যকে খুব সম্মান দিয়ে কথা বলে, কাজেকর্মে বেশ দক্ষ। কিন্তু কম্পোজিটাররা? উফ!
প্রথম এল গড়বেতার এক মায়াবী তরুণ। স্বপ্নালু চোখ, কোমল মুখ, ভারি মিতভাষী। মাস দুয়েকের মধ্যে আদিত্যর মনে হল প্রেসঘর যেন কেমন হালকা হালকা ঠেকছে। কিসে এত হালকা লাগে? ক’দিনেই টের পেল ঘরটা নয়, হালকা হয়ে গেছে টাইপবক্স। তক্কে তক্কে থেকে বুঝল রোজ মুঠো মুঠো টাইপ সরাচ্ছে ছেলেটা। একদিন কাজ সেরে বেরোনোর সময় ধরলও ছেলেটাকে, তোমার পকেট দেখব। মায়াবী তরুণ স্বপ্নালু চোখ মেলে বলল, আপনি আমাকে সন্দেহ করছেন দাদা? ছিঃ! আদিত্যর ঘাড় ঝুলে গেল, পকেট বোঝাই টাইপ নিয়ে চিরতরে বিদায় নিল প্রথম কম্পোজিটার। দ্বিতীয় জন বারুইপুরের। একমাসও টেকেনি সে। দশ টাকা মাইনে বেশি পেয়ে যাদবপুরের এক প্রেসে চলে গেল। তৃতীয় জন বিরাটির। সপ্তাহে রুটিন করে তিন দিন ডুব মারত, আদিত্য খোঁজখবর করে দেখল, তার কাজে ডুব মেরে বউবাজার পাড়ায় খেপ খাটে সে।
এদের নিয়ে আদিত্য সর্ষেফুল দেখছে, তার ওপরেও শতেক হ্যাপা। এই কাটারের কাছে যাও। ওই বাইন্ডারের কাছে যাও। ব্লকমেকারদের পিছন পিছন দৌড়ও। এত কি সে পারে!
যা পারে তা অবশ্য সে করেছে। পাড়ার পুজোর বিল হ্যান্ডবিল ফ্রি ছাপিয়ে দিয়েছে। বন্ধুরা পিঠ চাপড়ে ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে নিয়ে গেছে। ছাপা খরচ দূরস্থান, কার্ডের পয়সাটাও চাইতে পারেনি আদিত্য।
আদিত্যর দম শেষ হয়ে যাচ্ছিল।
কাজ সময় মতো না ওঠার দরুন নতুন অর্ডার বন্ধ। বকেয়া পেমেন্টের জন্য নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে অফিসগুলো। ঠিক টাইমে ডেলিভারি না পেয়ে বাড়ি বয়ে খিস্তিখাস্তাও করে গেল অনেকে। কাগজের দোকানে টাকা বাকি। বাইন্ডিংখানায় টাকা বাকি। রণেনের ফাউন্ড্রিতে টাকা বাকি। রণেনের বউ ইন্দ্রাণীকে এসে কথাও শুনিয়ে গেল কিছু।
শেষে আদিত্যর আঁকড়ে ধরার একমাত্র মহীরুহটিরও পতন হল। তার মা মারা গেলেন।
বিষাদপর্ব শুরু হল। আদিত্য ঢুকে গেল কুঠুরিতে। মুহ্যমান ব্যাঙ হয়ে। লোকজন এলে সাড়া করে না। প্রেসে যায় না। দিনরাত বুকে গোদা পাশবালিশ চেপে শুয়ে থাকে। আর সন্ধে হলেই সোমরস।
ওদিকে গোবদা মেশিন নিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে দুর্লভ।
ঠিক তখনই প্রেসঘরে পা দিল ইন্দ্রাণী। স্কুলের চাকরি তখন তার পার্মানেন্ট, দুপুরের দিকে প্রেসে বসতে শুরু করল সে। শুভাশিসের সুপারিশে নতুন অর্ডার এল। বেশির ভাগই ডাক্তারদের প্যাড, ডাক্তারদের কার্ড, নার্সিংহোমের ছোটখাট কাজ। অহোরাত্র পাহারা দিয়ে দিয়ে তুলে ফেলল কাজগুলো। ধীরে, কিন্তু একটু একটু করে আশার আলো জ্বলল। এক পরিচিতের সুবাদে আর এক পরিচিত, এক কাজের সুবাদে অন্য কাজ, এই করে করে আয়তন বাড়ল ব্যবসার। একজন কম্পোজিটারে আর চলে না, বছর দুয়েক হল আরেকটা রানিং কম্পোজিটার রেখেছে। একটা মেশিনে কাজ ওঠাতে মাঝে মাঝেই হিমসিম দশা হয়। ইচ্ছে করলে অর্ডার ডেলিভারি পেমেন্টের জন্য লোক রাখতে পারে, রাখেনি। এখনও সবই নিজের হাতে করে ইন্দ্রাণী। এই স্থিতিশীল দশাতেও।
আদিত্য সব জানে। সে যে একদম প্রেসে যায় না তা নয়, মাঝে মধ্যে যায়। মন হলে অল্প স্বল্প প্রুফ দেখে, ইন্দ্রাণীর হুকুম মতো এক আধদিন বাইন্ডার কাটারদের ঘরেও ঢুঁ মেরে আসে।
কিন্তু প্রেস এখন আর তার নিজের নয়। ইন্দ্রাণীর।
ওই প্রেসের জন্য কেন নতুন করে মাথা ঘামাবে আদিত্য! ফুঃ।
জয়মোহন ঝুম হয়ে বসে। সদ্য রোগফেরত ছেলের ওপর হঠাৎ চেঁচামেচি করে ফেলে বেশ অবসন্ন যেন। ঘাড় নিম্নমুখী, মুখ অল্প হাঁ, ফুসফুস অনভ্যস্ত দাসের মতো চালু রাখতে চাইছে রক্তসংবহন।
আদিত্যরও জিভ খরখরে, তালু শুকিয়ে গেছে। খরখরে জিভ বোলাল তালুতে। বলল, কেন যে চেঁচাও! শরীরে সয় না তোমার, জানোই তো।
জয়মোহন মুখ তুললেন। কষ্ট করে হাসলেন একটু, কেন যে তুই প্রেসটা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাস না, আমি বুঝি।
–বোঝো?
–হুঁ। হিংসে। বউমা পারল, তুই পারলি না, এটাই তোকে পোড়ায়, না রে খোকন?
বহুক্ষণ পর আদিত্যর হাসি পেয়ে গেল। হিংসে? হিংসে শুধু মানুষকে ছোটই করে না, কখনও চরিত্রে ব্যক্তিত্বও এনে দেয়। আদিত্য জানে। কিন্তু ওই অনুভূতিটা যে তার মনে জন্মালই না কোনওদিন! অজস্র কারণ থাকা সত্ত্বেও।
আদিত্য টুকটুক হাঁটু নাচাল, তোমার ঢিলটা লাগল না বাবা। আমার ওসব হিংসে টিংসে নেই। জানো না মালখোররা হিংসুটে হয় না!
জয়মোহন তিড়িং করে উঠলেন, কত বার করে বলেছি না, আমার সামনে তুই ওই ভাষায় কথা বলবি না!
–যাহ বাবা, আমি তো মালখোরই। তুমিই তো বলো।
–আমি বলি বেশ করি। তুই কেন বলবি রে হারামজাদা?
–এটা কিন্তু বিলো দা বেল্ট হয়ে যাচ্ছে বাবা।
–বিলো দা বেল্ট আবার কি? তোর পাছায় লাথি কষানো উচিত। তুই বউটার জীবন নষ্ট করেছিস, ছেলেমেয়ের জীবন নষ্ট করছিস, আমাদের সুখশান্তি নষ্ট করেছিস, তোর কথা ভেবে তোর মা দগ্ধে দগ্ধে মরেছে, আমার ব্যবসার সর্বনাশ করেছিস। আমার অমন চালু তেল সাবানের ব্যবসা…একটা ব্যাংক লোনও রিপে করেছিলি তুই?
–থামো থামো। একটা বুনো সাইক্লোনের মেঘ আছড়ে পড়ল আদিত্যর বুকে। দুর্বল শরীরে সর্বশক্তি দিয়ে ভেতরের রাগটাকে হিম করে ফেলল আদিত্য। আজ সে কিছুতেই স্নায়ুর ওপর দখল হারাবে না। দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, অনেক দিন ধরে তুমি তোমার ব্যবসা ওঠা নিয়ে আমাকে খোঁটা দিচ্ছ। আজ একটা ফয়সালা হওয়া দরকার।
-কিসের ফয়সালা রে অকম্মার ধাড়ি! তুই শুয়ে বসে থেকে আমার ব্যবসাটা ডোবাসনি?
ননাআ। কেন ডুবেছে শুনতে চাও? বললে এ বাড়িতে তোমার সম্মান থাকবে?
–কিসের ভয় দেখাচ্ছিস তুই আমাকে? কী করেছি আমি?
–কোম্পানির টাকা তুমি রেসের মাঠে ওড়াওনি? শেয়ার মার্কেটে ফাটকা খেলতে গিয়ে কত হেরেছিলে তুমি? পাঁচ লাখ? দশ লাখ? কত? আমাকে তো তুমি তোমার বিজনেসের লাশ আগলাতে বসিয়েছিলে! ভেবেছিলে ন্যালাখ্যাপা ছেলে, কিচ্ছুটি টের পাবে না, তাই না? নিজে লুটে পুটে খেয়ে, আমার ঘাড়ে সব লায়েবিলিটি, অ্যাঁ?
জয়মোহন এত বড় ধাক্কার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, আমূল কেঁপে উঠেছেন। একটি শব্দও মুখ থেকে বেরোল না। সামনে ঝুঁকে পড়ে দম নেওয়ার চেষ্টা করছেন, পারছেন না। তামাটে মুখ নীল।
আদিত্য চাপা স্বরে বলল, – এসব কথা আমি বলতে চাইনি কোনওদিন। তুমি বলতে বাধ্য করলে। একটা লোক সবে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে, তার সঙ্গে কোথায় হাসি মুখে দুটো কথা বলবে, তা নয় শুধু গালাগাল! যাও, সরবিট্রেট মুখে রেখে শুয়ে পড়ো গে যাও।
জয়মোহন অনড়। আদিত্য উঠে দাঁড়াল। প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হয়েছে মাথায়। মস্তিষ্কের কোষগুলো তরল নেশা চাইছে। সমগ্র দেহকাণ্ড জুড়ে এক জংলি ষাঁড় দাপাদাপি করছে তার। সব প্রাণরস এখন অঙ্গার।
রেলিং খামচে আদিত্য ধাপে ধাপে সিঁড়ি ভাঙছিল। সাত-আট দিন পর আবার যেন পেটে বল্লমের খোঁচা!
দোতলায় সুদীপদের ঘর যথারীতি বন্ধ। রুনা ছেলে নিয়ে রোজকার মতোই বেরিয়েছে। আদিত্য সোজা নিজের ঘরে ঢুকে গেল। কোনও দিকে না তাকিয়ে। বিছানায় শোওয়ার আগেই ছুটে এসেছে তিতির। টুক করে ঘরের আলো জ্বেলেছে। বাবার মুখচোখ দেখে ভয় পেয়ে গেল, তোমার কষ্ট হচ্ছে বাবা?
আদিত্য বালিশে মাথা রেখে পা ছড়িয়ে দিল, না।
–তুমি প্যান্ট-শার্ট বদলাবে না! কাচা পাজামা-পাঞ্জাবি রেখে দিয়েছি!
–থাক। পরে বদলাব।
তিতির আদিত্যর কাছে এসে ঝুঁকল, –তোমার এখন কোনও ওষুধ নেই?
না।
তিতির সন্দিগ্ধ চোখে বাবাকে দেখছিল, –মা’র সঙ্গে দেখা হয়েছে? মাকে ডেকে দেব?
–আহ, আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দে। আলো নিবিয়ে দরজাটা টেনে দিয়ে যা।
ঘর ধূসর অন্ধকারে ভরে গেছে। দয়ামায়াহীন, কর্কশ অন্ধকার। এ অন্ধকার মানুষকে একটুও রেহাই দেয় না। চোখ বন্ধ রেখেও অন্ধকারের ক্রূরতা এড়াতে পারছিল না আদিত্য। তার সমস্ত স্নায়ু দু আঙুলে পেঁচিয়ে যেন টানছে কোনও আলোহীন শক্তি। টাং টাং শব্দ অনুরণিত হচ্ছে মাথায়।
তবে আদিত্যর রাগ চড়তেও যতক্ষণ, পড়তেও ততক্ষণ। এই হ্যাড্ডাম ফ্যাড্ডাম সে তো চায়নি, তবু কেন বাবার সঙ্গে মুষ্টিযুদ্ধটা হয়েই গেল আজ! এত দিন ধরে সঞ্চয় করে রাখা গোপন বিষটুকু কেন উগরে দিল! এ কি অসংযম? না চিত্তের মূঢ়তা? নাকি নেশার সর্বগ্রাসী টান? যার পিপাসায় আকুল হয়ে আছে শরীর!
বাড়ি ফিরেই বুড়ো মানুষটার শঙ্কা আর উদ্বেগমাখা যে মুখটা প্রথম দেখেছিল, সেটাই আদিত্যর মনে বাজছিল বার বার।
আদিত্যর দুচোখ জলে ভরে গেল। আদিত্য কাঁদছিল। আর আশ্চর্য, কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল এক সময়ে। স্বল্পস্থায়ী ঘুম ছিঁড়েও গেল। ইন্দ্রাণী এসেছে ঘরে।
পলকের জন্য বিভ্রম এসেছিল আদিত্যর। এটা ঘর, না হাসপাতাল? পিট পিট চোখে ইন্দ্রাণীকে দেখল কয়েক সেকেন্ড।
ইন্দ্রাণীর হাতে খাবারের থালা। বিছানার ধারে টুল টেনে থালাটা রাখল। থালায় চার পিস টোস্ট, ছানা, সামান্য সেদ্ধ সবজি। বাটিতে টলটল করছে মুরগির স্যুপ। নুন গোলমরিচ ছড়ানো। একটা জলের বোতল আর গ্লাস পাশে রেখে বলল, তোমার জন্য আলাদা করে জল ফুটিয়েছি। এ জল ছাড়া অন্য জল খাবে না কিন্তু।
হাসপাতাল ফেরত রুগণ স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর এই প্রথম সংলাপ!
আদিত্য উঠে বসে বোতলের দিকে হাত বাড়াল। গ্লাসে না ঢেলে বোতল থেকেই সরাসরি খানিকটা জল ঢালল গলায়।
ইন্দ্রাণী বলল, আগে জল খাচ্ছ কেন? খেয়ে নাও।
বড় তেষ্টা। আদিত্য বিড় বিড় করে বলল কথাটা। খাবারের দিকে দেখল, এত আমি খেতে পারব?
–যতটুকু পারো খাও।
–দীপুরা কেউ এল না যে? বাড়ি ফেরেনি?
–এসেছিল। ঘর অন্ধকার দেখে ডাকেনি।
বাপ্পা?
বাপ্পা এখনও আসেনি। কোথায় কোথায় যে ঘুরে বেড়ায় আজকাল! এদিকে সামনে পরীক্ষা! একদম বই নিয়ে বসে না।
–ও। কথা খুঁজে না পেয়ে স্যুপে চামচ ডোবাল আদিত্য। জিভে ছোঁয়াতেই গৃহের অনুভূতি। বাড়ি ঢোকার পরে এই প্রথম। সুস্বাদু স্যুপ বেশ কয়েক চামচ খেয়ে ফেলল। ইন্দ্রাণী খুব যত্ন করে বানিয়েছে বোঝা যায়।
ইন্দ্রাণীকে একটু পাশে বসতে বলবে আদিত্য? একটু যদি বসে? কয়েক সেকেন্ড?
চাওয়াটা কি খুব বেশি হয়ে যাবে?
ইন্দ্রাণীর মুখ অসম্ভব শান্ত। কপালে একটি ভাঁজও নেই।
আদিত্য কাঁপা কাঁপা স্বরে ডাকল, ইন্দু…!
.
০৭.
মুহূর্তের জন্য শরীর শিরশির করে উঠেছিল ইন্দ্রাণীর। মুহূর্তের জন্যই। এমন গাঢ় স্বরে তাকে খুব কমই ডাকে আদিত্য।
কয়েক পল মানুষটাকে দেখে নিয়ে ইন্দ্রাণী বলল, –কিছু বলবে তুমি?
আদিত্য পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল, –দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোস না।
ইন্দ্রাণী ছেলের খাটে গিয়ে বসল। নিচু স্বরে বলল, বলো কি বলবে।
আদিত্য তক্ষুনি কিছু বলল না। সুদীপদের ঘর থেকে অ্যাটমের তীক্ষ্ণ সরু স্বর উড়ে আসছে। রুনা বোধহয় জোর ফলাচ্ছে ছেলের ওপর। হয়তো খাওয়া নিয়ে। নয়তো শোওয়া। নয় পড়া। অথবা অন্য কোনও মহতী আকাঙ্ক্ষায়।
খাওয়া থামিয়ে আদিত্য ওঘরের দিকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। যেন দেওয়াল ফুঁড়ে দেখছে কিছু। হঠাৎই অন্যমনস্কভাবে বলল, –দীপুর বউটা বড় মারকুটে।
–অ্যাটমও একটু বেশিই চেঁচায়। অকারণে।
–ছেলের পেছনে অত লেগে থাকার দরকার কি?
যাকে ছেলে মানুষ করতে হয়, সেই বোঝে।
–তাও তো বটে।
–কী বলবে বলো, আমার সময় কম।
— হ্যাঁ বলি। আদিত্য দু ঢোঁক জল খেল, –তোমার খাটুনি খুব বেড়ে গেছে, না ইন্দু? চিরটা কাল খেটে মরলে।
–যে যেমন কপাল নিয়ে জন্মায়।
এবার তোমাকে ঠিক বিশ্রাম দেব। একটা ভাল লাইন পেয়েছি।
–তাই। ইন্দ্রাণী বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখাল না। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি বাথরুমে যাবে তো? ঘুরে এসো। তোমাকে ওষুধ দিয়ে আমি নীচে যাব।
বাধ্য বালকের মতো বাথরুমে যাচ্ছে আদিত্য, ইন্দ্রাণী আদিত্যর হাঁটাটা দেখছিল। চলার ভঙ্গি এখনও বেশ অসুস্থ। একটু বা লগবগে। যেন একটা ভর পেলে সুবিধে হত মানুষটার।
তিতির ওষুধ প্রেসক্রিপশন বাপ্পার টেবিলে সাজিয়ে রেখে গেছে, আদিত্য বাথরুম থেকে ফিরতেই পর পর তাকে ওষুধগুলো খাইয়ে দিল ইন্দ্রাণী। নিপুণ সেবিকার মতো। দম দেওয়া যন্ত্রের মতো। একটা তরল, দুটো বড়ি। আদিত্যর মুখ দেখে বুঝতে পারছে আরও কিছু বলতে চায় লোকটা, তবু খুব একটা আমল দিল না। আলমারির থেকে মশারি বার করে টাঙিয়ে দিল খাটের ছত্রিতে।
পাজামা-পাঞ্জাবিতে নিজেকে বদলে নিয়েছে আদিত্য। বসে আছে নিজের বিছানায়। খানিকটা বায়নার সুরে বলল, –এখন শুয়ে পড়ব? আমার ঘুম তো কেটে গেছে।
যাক, তবু শুয়ে থাকো। ইন্দ্রাণী মশারির কোণ গুজছিল। ঝট করে মনে পড়ে গেল কথাটা। কদিন ধরেই খচখচ করছে। সোজা হয়ে বলল, –দীপু যে গত রোববার হসপিটালে গিয়েছিল, তোমার সঙ্গে কিছু কথা হয়েছে?
-কী ব্যাপারে?
–চাঁদু বলছিল, দীপু নাকি এই বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট বানাতে চায়। এই নিয়ে তোমাকে কিছু বলেছে?
—হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই রকম কি একটা বলছিল বটে। মন দিয়ে শোনা হয়নি।
সুদীপ তা হলে কথাটা আদিত্যকেও বলেছে! তার মানে অনেকটাই এগিয়েছে তলে তলে! আদিত্যর ঠাকুর্দার আমলের বাড়িটার প্রতি ইন্দ্রাণীর যে তেমন কোনও মোহ নেই, তা সুদীপ ভালমতোই জানে। তবু কেন ইন্দ্রাণীর কাছে লুকোচ্ছে কথাটা। ফ্ল্যাট হয় তো হোক না, ইন্দ্রাণী কি বাধা দিতে যাবে?
ইন্দ্রাণী সামান্য ঝাঁঝিয়েই উঠল, –কোথায় মন থাকে তোমার? কি বলল সেটাও একটু ভাল করে শুনতে পারোনি? শুধু নিজের সুখ। নিজের সুখ।
আদিত্য ম্লান হয়ে গেল। মিন মিন করে বলল, ঠিক আছে, আমি দীপুকে আবার জিজ্ঞেস করে নেব।
–না, দীপুকে এই নিয়ে আর একটা প্রশ্নও করবে না।
–ঠিকই তো, দীপুর সঙ্গে কেন কথা বলব? বাবার সঙ্গে কথা বলি। বাবাই তো এবাড়ির মালিক। কথাটা বলেই কেমন চুপসে গেল আদিত্য। হঠাৎই উৎকণ্ঠা মাখা গলায় প্রশ্ন করল, -ডাক্তার কি রাত্তিরে আসবে?
না। শুভাশিসের আজ কাজ আছে। কাল আসতে পারে।
–আজ এলে ভাল হত। বাবাকে একটু চেক করে যেত।
ইন্দ্রাণী ভুরু কুঁচকে তাকাল, –কেন? কী হয়েছে বাবার?
শরীরটা মনে হল ভাল নয়। আদিত্য ঢোক গিলল, –তখন কথা বলতে গিয়ে বেশ হাঁপাচ্ছিল।
জালের ভেতর কুঁজো হয়ে বসে আছে আদিত্য। ঠিক যেন ফাঁদে পড়া এক মানুষ! ইন্দ্রাণীর হঠাৎ কেমন মায়া হল। মানুষটার সবই আছে। হৃদয় আছে। হৃদয়ের প্রসারতা আছে। টান-ভালবাসা আছে। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো লোভ-কাম-নেশা কোনও কিছুরই কমতি নেই। অথচ কিছুই আবার তেমন করে নেইও। যেন প্রলম্বিত শৈশবে বিচরণ করে মানুষটা।
এমন একটা লোকের সঙ্গে কী কথা বলবে ইন্দ্রাণী! ইন্দ্রাণী নরম করে বলল, বাবার ভাবনা আমরা ভাবছি। তুমি নিজের শরীরটাকে আগে সারাও তো দেখি। কী চেহারা করেছ!
আদিত্য ফ্যালফ্যাল চোখে তাকাল, –আমি একটা খুব বাজে লোক, তাই না ইন্দু? অপদার্থ। গোঁয়ার। নেশাড়ু।
ইন্দ্রাণী কোমল ভ্রূকুটি করল, –সবই তো বোঝো। এখনও নিজেকে একটু বদলাতে ইচ্ছে করে না?
এবার বদলে যাব। আদিত্য শিশুর মতো হাসল, –মাইরি জীবনে আর কোনওদিন মাল ছোঁব। মা কালীর দিব্যি।
–থাক, মা কালীকে তুলে আর নিজের পাপ বাড়িও না।
ইন্দ্রাণী বিছানার পাশ থেকে সরে এল। মনটা ভারী হয়ে আসছিল তার।
.
এ বছর প্রচণ্ড গরম পড়েছে। কবির ভাষায় যাকে বলে দারুণ অগ্নিবাণ, বৈশাখের শুরু থেকে তাই হেনে চলেছে সূর্য। শহরের পিচরাস্তা গলে যাচ্ছে তবু মাসভর তাপের কমতি নেই দিনমানে। ক’দিন হল অবশ্য আবহাওয়ার পরিবর্তন এসেছে একটু। তাপের সঙ্গে সারাদিন গরম শুকনো বাতাস বইত, বন্ধ হয়েছে সেই হাওয়াটা। তার বদলে এসেছে এক অসহ্য বাষ্পময় গুমোট। সূর্য উঠতে না উঠতেই গুমোট শুরু হয়ে যায়, দুপুরে ঘামভেজা শরীরে হাঁসফাস করে মানুষ, বিকেল হলেই কোথা থেকে ছুটে আসে একটা ছোট্ট কালো মেঘ। নিমেষে বিশাল আকার ধারণ করে গোটা আকাশের দখল নিয়ে নেয় মেঘটা। সাঁই সাঁই ঝড় ওঠে। ঠাণ্ডা হাওয়া আসে শনশন। রুপোলি বিদ্যুতে চিরে যায় আকাশ। বৃষ্টি নামে। ঝমঝম ঝমাঝম। বড় জোর মিনিট দশেক। দিনের ক্লেদ মুছে যায়, মানুষজনকে সুখ বিলিয়ে উধাও হয়ে যায় মেঘখণ্ড। সন্ধে হতেই আকাশ জুড়ে জলসা বসায় তারারা। ভারি মনোরম এক বাতাস বয়। বুক জুড়োনো। বহুক্ষণ।
আজও যেন আকাশের সেরকমই মতিগতি। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাপের ঝাঁঝটা টের পাচ্ছিল ইন্দ্রাণী। চিট পিট গরমে ঘাড় গলা ভিজে যাচ্ছে, বনবন পাখার নীচেও চ্যাটচ্যাট করছে গা।
বিছানা ছেড়ে এক কাপ চা করে খেয়ে নিল ইন্দ্রাণী। দোতলাতেই। চটপট স্নানটাও সেরে নিল। যতক্ষণ শরীর ঠাণ্ডা থাকে ততক্ষণই আরাম। আজ রবীন্দ্রজয়ন্তী, ছোটখাট একটা ফাংশান আছে স্কুলে। ছাত্রীরা নাচবে, গাইবে, আবৃত্তি করবে, ক্লাস টেনের মেয়েরা ছোট নাটকও করবে একটা। স্কুলের সব টিচারকেই এসব অনুষ্ঠানে শেষ অবধি থাকতে হয়। প্রায় অলিখিত আইন। স্কুলের পর আজ একবার বাপের বাড়িও যাবে ইন্দ্রাণী।
আলমারি থেকে ইন্দ্রাণী একটা লাল পাড় সাদা তাঁতের শাড়ি বার করল। স্কুলে সে সাদা শাড়ি পরে যাওয়াই পছন্দ করে, আর আজ তো পরতেই হবে। এটাও আইন।
শাড়ি পরতে পরতে আয়নায় তিতিরকে দেখতে পাচ্ছিল ইন্দ্রাণী। এই গরমেও দু পা মুড়ে ঘুমোচ্ছে মেয়ে। পুবের জানলার পর্দা ভেদ করে এক টুকরো আলো এসে পড়েছে তিতিরের পাশ-ফেরা মুখে। ওইটুকু রশ্মিতেই তিতিরের মুখখানি যেন আধফোঁটা রজনীগন্ধার মতো অমলিন।
তিতিরকে দেখে মাঝেমাঝে ইন্দ্রাণীর আর একটা মেয়ের মুখ মনে পড়ে যায়। তারও বয়স ষোলো। অপরাহ্নবেলায় স্কুল থেকে ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরছে মেয়েটা। ফিরেই ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে দিল পড়ার টেবিলে। স্কুলের জামা বদলে ঝটপট পরে নিয়েছে রঙিন স্কার্ট-ব্লাউজ। আবার ছুটছে। ছুটতে ছুটতে জলখাবার খাওয়া। ছুটতে ছুটতে মা’র বকুনি। ছুটতে ছুটতে বন্ধুদের আড্ডায়। হি হি হা হা। ওই বয়সে কত রকম যে গল্প থাকে মেয়েদের! গল্প। শুধুই গল্প। স্বপ্নের। কল্পনার। বিশ্বাসের। নিষিদ্ধ রোমাঞ্চের। যত না কারণে হাসি, তার বেশি অকারণে। তারপর যেই রাস্তার বাতিটি জ্বলল, ফেরো নিজ নিকেতনে। সেখানে ভাইয়ের সঙ্গে নিত্যনতুন খুনসুটি। বইখাতার দুনিয়ায় ডুব। রেডিওতে অনুরোধের আসর। এই কুলে আমি আর ওই কুলে তুমি। আবার পড়াশুনা। আবার স্কুল। পরীক্ষা। গরমের ছুটি। পুজোর ছুটি। বাবা। মা। ভাই। তারপর? তারপর?
তারপর মেয়েটাকে নিয়ে ভাবতে গেলেই সব কেমন গুলিয়ে যায়। গোপন ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে ইন্দ্রাণীর বিশ্ব।
কোমরে কুঁচি গুঁজে কাঁধে প্লিটগুলোকে সাজাল ইন্দ্রাণী। তিতিরকে দেখে মাঝে মাঝে একটা আতঙ্কও হয় তার এখন। কেন যে হয়! তিতির তো সম্পূর্ণভাবেই তার আত্মপ্রতিকৃতি। প্রায় প্রতিবিম্বসদৃশ! ওই আধফোঁটা রজনীগন্ধাকে সে যে বহুবার ভূণ অবস্থায় হত্যা করতে চেয়েছিল, লক্ষ বার মৃত্যুকামনা করেছে তার, সেসবও তো এখন প্রায় বিস্মৃত অতীত, কেউ জানবেও না কোনওদিন, তবুও কেন এই ভয়?
ইন্দ্রাণী কাঁধে ছোট ব্রোচ লাগাল। কপালে এক বিন্দু লাল টিপ। মেয়েকে আলতো ঠেলল, –তিতির ওঠ, আমি বেরোচ্ছি।
তিতির চমকে উঠে বসল। তার ঘুম খুব পাতলা, প্রায় তিতির পাখির মতোই। বোধহয় কোনও স্বপ্নও দেখছিল সে, এখনও তার রেশ লেগে আছে ঘন আঁখিপল্লবে।
ইন্দ্রাণী আয়নায় ফিরে আলগা সিঁদুর ছোঁয়াল সিঁথিতে, –আমি আজ দুপুরে ফিরব না, মনে আছে তো?
তিতির দু চোখ রগড়ে বুঝি স্বপ্নটুকু মুছল। ঘাড় কাত করল এক দিকে।
বাবার খাওয়া দাওয়ার ওপর একটু নজর রাখিস।
হুঁ।
দিন দশেক হল বাড়ি ফিরেছে আদিত্য, এখন সে অনেকটাই তাজা। তবে এখনও চোখে চোখে রাখতে হয় তাকে। তার জিভের স্বাদ বরাবরই তামসিক, এর মধ্যেই ছোটখাট উৎপাত শুরু করেছে রান্নাঘরে। পরশু সন্ধ্যার মার কাছ থেকে জোর করে কষা আলুর দম নিয়ে খেয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে আবার পেটে ব্যথা ওঠার উপক্রম। নেশাটা এখনও শুলোয়নি, এইটুকুই যা বাঁচোয়া। শুভাশিস পই পই করে বলে দিয়েছে সামান্য অনিয়মেই এসব রুগীদের গ্যাসট্রিক ধরে যায়। আরও মাসখানেক আদিত্যকে সাবধানে রাখতে হবে।
ইন্দ্রাণী বলল, -দেখিস আবার যেন উল্টোপাল্টা খেয়ে না বসে।
তিতির ছোট্ট হাই তুলে হাসল, –চান্স নেই। আমি আজ বাবাকে নামতেই দেব না।
–হুঁহ কী আমার পাহারাদার রে! কালও তো বেরিয়ে গেছিল! মোড়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল।
-সে তো মাত্র একবার। আজ আর হবে না।
তিতির উঠে বাথরুমে গেল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বাপ্পার গলা। ভাইবোনে বাথরুমের দখল নিয়ে লড়াই বেধে গেছে।
ইন্দ্রাণী প্যাসেজে এল–তুই আজ এত তাড়াতাড়ি উঠেছিস যে!
বাপ্পার পরনে শর্টস, গা খালি। বাথরুমের দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে সে। ইন্দ্রাণীকে দেখে বলল, –দ্যাখো না মা, বলছি আমার কাজ আছে, তাড়াতাড়ি বেরোব, তোমার মেয়ে…
তিতির হাউমাউ করে উঠল, –আমি ওকে কিছু বলিনি মা। ওই আমাকে টেনে বার করে দিল।
–মিথ্যে কথা।
–তুই মিথ্যেবাদী।
ইন্দ্রাণী চোখ পাকাল, –আস্তে। চেঁচিও না। সবাই ঘুমোচ্ছ। বাপ্পা, তিতিরকে ছেড়ে দাও।
তিতির বাপ্পাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল।
বাপ্পা গজ গজ করছে, –এটা কিন্তু জাসটিস হল না মা।
ইন্দ্রাণী হাসি চাপতে পারল না। তালঢ্যাঙা চেহারা হয়েছে ছেলের, এক দিন অন্তর দাড়ি কামায়, এখনও ঠোঁট ফোলানোর অভ্যেসটা গেল না। হাসতে হাসতেই বলল, জাসটিস পরে হবে। এই সকালে তুই চললি কোথায়?
বলব না।
–এখন বেরোচ্ছিস, ফিরবি কখন?
বলব না।
–তোর না পরশু থেকে পরীক্ষা? বই নিয়ে বসবি না তুই?
বলব না। বলেই বাপ্পার দাঁত বেরিয়ে গেছে, দুৎ, ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা আবার পরীক্ষা নাকি? সব্বাইকে পাস করিয়ে দেয়।
-তুই বড় ফাঁকিবাজ হয়ে যাচ্ছিস বাপ্পা।
–তুমি বড় কিপটে হয়ে যাচ্ছ মা। বাপ্পা আবদেরে শব্দ দিয়ে ভোলাতে চাইছে ইন্দ্রাণীকে, তুমি বেরিয়ে গেলে প্রবলেম হত, পঞ্চাশটা টাকা ছাড়ো তো। আরজেন্ট দরকার।
গত সপ্তাহেই তো দুশো টাকা নিলি! এর মধ্যে শেষ?
–ও টাকা একটা কাজে লেগে গেছে।
কী কাজ?
ক্রমশ প্রকাশ্য। তবে নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, তোমার টাকা ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট হয়নি। হবেও না। দাও দাও, টাকাটা দাও।
বাপ্পা কিছু চাইলে কেন যে না দিয়ে পারে না ইন্দ্রাণী!
ইন্দ্রাণী কপট রাগে বলল–নাও, মনের সুখে ওড়াও।
বাপ্পা দু আঙুলে টাকাটা নাচাচ্ছে, ধরো এটা লোন। উইথ ইন্টারেস্ট ফেরত দিয়ে দেব।
–হুঁ, সেই ভরসাতেই তো আছি! ইন্দ্রাণী একটা নিশ্বাস চেপে পায়ে চটি গলাল, –যে চুলোয় খুশি যাও, দয়া করে ঘরে ঢুকে দুমদাম বাবার ঘুম ভাঙিও না।
তিতির বেরোতেই লম্ফ দিয়ে বাথরুমে সেঁধিয়ে গেছে বাপ্পা। দরজা বন্ধ করেও একটু ফাঁক করল, আমি তোমার হাজব্যান্ডকে কখনই ডিসটার্ব করি না মা। তোমার হাজব্যান্ডই আমাকে ডিসটার্ব করে। বাই হিজ রয়াল প্রেজেন্স। বলেই সশব্দে দরজা বন্ধ করেছে।
বাপ্পার স্বভাব পুরো সুদীপ বসানো। কথাবার্তা হাবভাব হাঁটাচলা সব কিছুতেই বড়কাকা তার আইডল। তার নির্ভরস্থলও। ভূত ভবিষ্যৎ অনেক কিছু নিয়েই কাকার সঙ্গে পরামর্শ চলে তার। লেখাপড়াতে বাপ্পা মন্দ নয়, হায়ার সেকেন্ডারিতে ফার্স্ট ডিভিশন ছিল, চেষ্টা করলে সায়েন্স-এর কোনও সাবজেক্টে অনার্স নিতে পারত, নেয়নি। তার বদলে অ্যাকাউন্টেসিতে অনার্স পড়ছে। কাকার কথায়। সুদীপের মতে, সায়েন্সের একটা সাধারণ ছাত্র হয়ে বিএসসি এমএসসি পড়ার চেষ্টা করার থেকে কমার্সের উঁচু দিকের ছাত্র হলে আখেরে বেশি লাভ। বাপ্পা অসাধারণ মেধাবী কিছু নয়, বৈজ্ঞানিক, গবেষক কোনও কিছুই হওয়ার তার সম্ভাবনা নেই, তবে কেন সে ফালতু ওদিকে ঘষটাবে! কথাটা ভুলও তো নয়। বাপ্পা যদি তার বড়কাকার কথাও মেনে চলে মন্দ কি! না হয় বাপ্পা সুদীপের মতোই হল! একটু উদারতাও থাকবে, একটু আত্মকেন্দ্রিকতাও থাকবে। আবার এ-জগতে চলার মতো ব্যবসায়িক বুদ্ধিটুকুও। এই না যথেষ্ট!
নীচে নেমে ইন্দ্রাণী একটু নিশ্চিন্ত হল। রান্নাঘরে সন্ধ্যার মা এসে গেছে। দুপুরে ইন্দ্রাণী বাড়ি ফিরবে না, সন্ধ্যার মা আজ ডুব মারলে বেশ অসুবিধেই হত।
বড়সড় রান্নাঘর অদৃশ্য পাঁচিল তুলে দু ভাগ করা। এক দিকে মিনতি চায়ের জল চড়িয়েছে, অন্য দিকে সন্ধ্যার মা। এবার ধীরে ধীরে এ বাড়ির দিন শুরু হবে।
সন্ধ্যার মা বলল, –চা হয়ে গেছে বউদি, খেয়ে বেরোও না।
ইন্দ্রাণী ঘড়ি দেখল। সাতটা পাঁচ। আটটার আগে ফাংশান শুরু হবে না, আর এক কাপ চা খেয়ে যাওয়াই যায়। কি ভেবে বলল, –থাক।
কন্দর্প ঘরে নেই। ফেরেনি এখনও। কাকডাকা ভোরে লেকে জগিং করতে চলে যায় সে। ফ্রি হ্যান্ডও করে। ফিগার ঠিক রাখা সম্পর্কে সে বেশ সচেতন। ফিরতে ফিরতে আটটা বাজে তার। সকালের প্রথম চা সে বাড়ির বাইরেই খায়।
বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে ইন্দ্রাণী রুটিন মতো শ্বশুরের ঘরের দরজা ঠেলল। ঘুমোচ্ছন জয়মোহন। উঁচু বালিশে মাথা রেখে। মৃদু মৃদু নাক ডাকছে। আদিত্য বাড়ি ফেরার পর থেকেই শরীরটা সুবিধের নেই শ্বশুরমশাইয়ের। নিজের ঘরের নিভৃত কোণটি ছেড়ে বেরোনই না বড় একটা। কথাবার্তা কম বলছেন, অবরে সবরে টিভি দেখেন, অনেক রাত অবধি হাঁপান বসে বসে। এই সকালের দিকেই যা একটু গভীর নিদ্রা আসে তার।
বড়ছেলেকে নিয়ে কি বেশি দুর্ভাবনা শুরু হয়েছে মানুষটার! নাকি মেজছেলে বেশি চাপ সৃষ্টি করছে। অথবা ছোটছেলের বাউন্ডুলে জীবন নিয়ে দুশ্চিন্তা! জয়মোহনের যা অসুখ তাতে কোনও উদ্বেগই মাত্রায় স্থির থাকে না, চড় চড় চড়তে থাকে পর্দা।
ইন্দ্রাণী আস্তে দরজাটা টেনে দিল। আহা ঘুমোন, ঘুমোন শান্তিতে। যেটুকুনি সময়ে ঘুমোয় মানুষ সেটুকুই তো মুক্তি।
বাইরে এক কুৎসিত সকাল গোমড়া মুখে ইন্দ্রাণীর প্রতীক্ষায়। সূর্যদেব এরই মধ্যে পূর্ণ মহিমায় ভাস্বর, তবে তাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। ধোঁয়া ধুলোর আড়াল থেকে জ্বলন্ত আগুনের পিণ্ড মেঘনাদের মতো তাপ নিক্ষেপ করে চলেছে। পথচারীদের বিরক্ত দৃষ্টি বার বার আকাশের দিকে, প্রভাতফেরির শিশুরা গলদঘর্ম, দূর থেকে ভেসে আসা রবীন্দ্রসঙ্গীতও কেমন এক অপ্রসন্ন ভাব গুলে দিচ্ছে বাতাসে।
ইন্দ্রাণীর স্কুল যাদবপুরে। বাড়ি থেকে হাঁটা আর বাস মিলিয়ে মিনিট পনেরো লাগে। মাঝারি সাইজের স্কুল। আটশো মতন ছাত্রী। জনা কুড়ি শিক্ষিকা। স্বাধীনতার পর পরই স্কুলটা হয়েছিল, এ অঞ্চলে মোটামুটি নাম আছে কাদম্বিনী গার্লস স্কুলের, গত বছরও মাধ্যমিকে প্রথম একশো জনের মধ্যে এই স্কুলের দুটি মেয়ে ছিল।
স্কুলে পৌঁছে ইন্দ্রাণীর খানিকটা ভাল লাগল। অল্পবয়সীদের চঞ্চলতার একটা আলাদা মাদকতা আছে, এদের সান্নিধ্যে এলে হৃদয়ের অনেক ভারই সাময়িকভাবে লঘু হয়ে যায়। স্কুলে এসে বহুদিনই এই অনুভূতি হয়েছে ইন্দ্রাণীর। আজও হচ্ছিল। রাশি রাশি কিশোরী এক আনন্দোৎসবের প্রস্তুতিতে হুটোপুটি করছে, লম্বা করিডোর ধরে ছুটে যাচ্ছে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত, সিঁড়ি বেয়ে দুপদাপ উঠছে, হুড়মুড় নামছে, একটি মেয়ে চিৎকার করে ডেকে চলেছে বান্ধবীকে, উত্তর না দিয়ে হাসিতে লুটিয়ে পড়ছে বান্ধবী, এই সমস্ত শব্দই যেন ধমনীতে রক্তের প্রবাহ বাড়িয়ে দেয়। আজও দিচ্ছিল।
উৎসব শুরু হতে হতে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গেল। হেডমিস্ট্রেস নীলিমাদি একটু দেরি করে এসেছেন, সেই জন্য। নীলিমা অত্যন্ত রাশভারি ধরনের মহিলা। বছর পঞ্চান্ন বয়স, অবিবাহিতা, মেয়েরা তাকে যমের মতো ভয় পায়। অন্যের দেরি হলে তিনি প্রকাশ্যেই বিরক্তি প্রকাশ করেন, কিন্তু নিজের সম্পর্কে কোনও কথা ওঠা তার পছন্দ নয়। কারণ থাকলেও না। আজকের উৎসবটি পরিচালনা করছে নিবেদিতা আর সুলেখা। দুজনেই প্রায় ইন্দ্রাণীর সমবয়সী। ছোট্ট একটু অনুষ্ঠান হবে, তবু তার জন্যই তারা রীতিমতো সিরিয়াস। তাদের হাতে হাতে লিখিত অনুষ্ঠানসূচি ঘুরছে। আধ ঘণ্টার গীতিআলেখ্যটি ভাব ও ভাষার সুতোয় গেঁথেছে নিবেদিতা, ক্লাস নাইনের একটি মেয়েকে দিয়ে শেষ মুহূর্তেও সেটা রিহার্সাল করাচ্ছে টিচার্স কমন রুমে। মেয়েটির থেকেও নিবেদিতার গলা অনেক বেশি আবেগে থরথর।
তা শেষ পর্যন্ত উৎসব মন্দ হল না। ছাত্রীরা তাদের সাধ্যমতোই নাচ গান অভিনয় করল। ছাত্রীদের পর দুজন শিক্ষিকাও গান গাইল। অণিমা আর রেবা। অণিমার গলা প্রায় পেশাদার শিল্পীদের মতোই, সে প্রত্যেক বারই দুটি করে গান গায়, আজও গাইল। রেবা একবার স্টেজে উঠলে নামতেই চায় না। প্রতিটি গান শেষ করে সে একবার সহশিক্ষিকাদের দিকে তাকায়, একবার ছাত্রীদের দিকে, তারপর আবার হারমোনিয়ামের বেলো টানতে শুরু করে। স্কুলের সেক্রেটারির বোন সে, তার স্বামী স্থানীয় রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাবশালী, শিক্ষিকাদের মধ্যেও তার একটা বড়সড় ঘোঁট পাকানোর দল আছে, তাকে নীলিমাও সমঝে চলেন।
ইন্দ্রাণী ঘন ঘন ঘড়ি দেখছিল। কমলিকাকে বার দুয়েক খোঁচালও–কিরে এ যে এগারোটা বেজে গেল, আমরা উঠব না?
দাঁড়াও, আগে রেবার সাধ মিটুক।
সাধ মিটতে মিটতে আমাদের যে প্রাণ বেরিয়ে যাবে। ইন্দ্রাণী ফিসফিস করল, আনন্দধারা কেমন বেসুরে গাইল দেখলি? আ আ আ আ টেনেই যাচ্ছে। অসহ্য।
সুলেখা রেবার উপদলের সক্রিয় সদস্যা, সে ইন্দ্রাণীর ফিসফিস শুনতে পেয়েছে। মধুর হেসে ইন্দ্রাণীকে বলল, তুই তো ভাল গাইতিস এককালে, একটা গা না।
ধুস, আমি আর গান গাই না।
–গা না একটা। তোর এত ভাল গলা ছিল। কথাটা বলেই নিষ্ঠুর হেসে হেডমিস্ট্রেসের দিকে তাকিয়েছে সুলেখা, ইন্দ্রাণীকে একটা গাইতে বলুন না বড়দি, কত দিন ওর গান শুনিনি!
স্কুলে ইন্দ্রাণী পারতপক্ষে কারুর সম্পর্কে মন্তব্য করে না। একটু এড়িয়ে এড়িয়ে থাকে। ক্লাস নেয়, যেটুকু দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয় সেটুকু পেশাদারি দক্ষতায় পালন করে, দলাদলিতে থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। কেন যে আজ মন্তব্যটা করে ফেলল!
ইন্দ্রাণী বলল, –কবে কোন কালে গাইতাম, গান আমি ভুলেই গেছি।
–একটা চেষ্টা করুন না ইন্দ্রাণীদি, ঠিক পারবেন।
–হ্যাঁ ইন্দ্রাণীদি, আজ আমরা আপনার গান শুনবই।
–গাও ইন্দ্রাণী। মেয়ে দারোগার গলায় হুকুম ছুঁড়লেন নীলিমা, –গান অ্যালজেব্রার ফরমুলা নয়, লোকে অত সহজে ভোলে না।
অগত্যা ইন্দ্রাণীকে উঠতেই হল। হারমোনিয়াম টেনে বসল স্টেজে। স্কুলের হলে ছোট স্থায়ী মঞ্চ। পিছনে রবীন্দ্রনাথের বাঁধানো ছবি। ফুল। ফুলের মালা। ধূপ। ইন্দ্রাণী চোখ বুজল। বুকটা ঢিপঢিপ করছে। কত কাল পর হারমোনিয়ামের রিডে আঙুল ঘুরছে। কাঁপছে। চোখ খুলল।
চোখের সামনে স্কুল নেই, ছাত্রীরা নেই, শিক্ষিকারা নেই, শুধুই এক মেঘলা আকাশ। রজনীগন্ধার গন্ধ মাখা। ধূপের সুরভি মাখা।
সহসা কাল মুছে গেল। ইন্দ্রাণী পিছিয়ে গেছে একুশটা বছর।
কলেজ সোশালে গান গাইছে ইন্দ্রাণী। সামনেই এক জোড়া জ্বলজ্বলে চোখ। ঠিক সেকেন্ড রো’তে বসে আছে শুভাশিস। চোখ বার বার ফিরে যায় চোখে। আঁখিতে আঁখি ভেসে থাকে।
কী গান গেয়েছিল সেদিন ইন্দ্রাণী? ওই যুবকের চোখে চোখ রেখে? মনে পড়ছে না। কিছুতেই মনে পড়ছে না।
পরের লহমাতেই মনে পড়ে গেছে। হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে! কেউ নয়, কাউকে নয়, শুধু শুভাশিসকেই গান শোনাচ্ছে লাজুক তরুণী। সাক্ষী এক সজল আকাশ।
দু’চোখ ভরে গেল বাষ্পে। ইন্দ্রাণীর ক্লান্ত স্বর গেয়ে উঠল, ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে।
.
০৮.
একি! কী হয়েছে তোমার? ঘরে পা রেখেই ইন্দ্রাণী শিউরে উঠল।
ধীরাজ বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছেন। মুখ শুকনো। গালভর্তি খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি। একটা পা সামান্য মোড়া, অন্য পা ছড়ানো। ছড়ানো পায়ের পাতা মোচার মতো ফুলে আছে।
মেয়েকে দেখে ধীরাজের নিষ্প্রভ চোখে আলো জ্বলে উঠল, –এসেছিস তুই!
–এই দশা হল কী করে? কোথায় পড়লে?
ইন্দ্রাণীর ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন উমা, বললেন, –আর বলিস না, বুড়ো বয়সে তোর বাবা এমন এক একটা কীর্তি করে বসে!
কয়েক দিন আগেই ফুটন্ত জল পড়ে হাত পুড়েছিল ধীরাজের। দুপুরে উমা ঘুমোচ্ছিলেন, তাঁকে না ডেকে নিজে নিজেই চা করতে গিয়েছিলেন, তার থেকেই ওই বিপত্তি।
ইন্দ্রাণী অধীর স্বরে বলল, হয়েছিলটা কি? ভূমিকা ছেড়ে আসল কথাটা বলবে?
গত মঙ্গলবার পেনশন তুলতে গেছিল, ভিড়ের চাপে…
ধীরাজ বললেন, –আমি বলছি। এক তারিখ তো মে ডে-তে ব্যাঙ্ক বন্ধ ছিল, তিন তারিখেও কি একটা যেন…কি যেন ছিল গো?
উমা বললেন, ব্যাঙ্ক স্ট্রাইক।
–হ্যাঁ হ্যাঁ, বুধবার তো স্ট্রাইক ছিল। দেওয়ালে দেওয়ালে সব চার্টার অফ ডিমান্ডস টাঙিয়েছে…দশ দফা না বারো দফা দাবি…
–আহ। মেয়ে যা জিজ্ঞেস করছে সেই কথা বলো।
–ও হ্যাঁ। তা হয়েছে কি, আমি পেনশন তোলার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, একটু আগে আগেই বেরিয়েছিলাম…ক’টা নাগাদ যেন?
উমা গোমড়া মুখে খাটের এক ধারে বসলেন, –আবার বেলাইনে ঢুকে গেলে?
-না না বলছি তো। এই সাড়ে ন’টা নাগাদ বেরোলাম। গ্যাসটা শনিবার ফুরিয়ে গেছে, আগে নামটা লেখালাম গিয়ে। কবে দেয় না দেয়! ওদের তো আবার সাপ্লাইয়ের ঠিকঠাকানা নেই। আগের বার তো তেইশ দিনে…।
ধীরাজের কথাবার্তা ইদানীং একেবারেই অসংলগ্ন। পারম্পর্যহীন। সতেরো বছর আগে একমাত্র ছেলে তনুময় নিরুদ্দেশ হওয়ার পর থেকেই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছেন মানুষটা। তার আগেও যে খুব নিখুঁত ফিটফাট মাপজোপা ছিলেন তা নয়। বাসে ছাতা ফেলে আসছেন, ডিম কিনতে গিয়ে পান কিনে আনছেন, ভুল বাসে উঠে অফিস পৌঁছতে দেরি করে ফেলছেন, এসব ঘটনা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে ইন্দ্রাণী। তবু যেন এত অন্যমনস্ক ছিলেন না মানুষটা! এখন যা দশা, প্রকৃত কাহিনী তাঁর মুখ থেকে উদ্ধার করাই দুরূহ।
ইন্দ্রাণী তবু ঠাণ্ডা মাথায় তাঁকেই প্রশ্ন করে করে জানল ঘটনাটা। মাসের এক তারিখ আর তিন তারিখ বনধ, দু তারিখ খুব ভিড় হয়েছিল ব্যাঙ্কে। বিশাল লাইন পেনশনভোগী বৃদ্ধদের। ধীরাজ টোকেন নিয়ে বসেছিলেন, হঠাৎ ক্যাশ কাউন্টারে গোলমাল। কাউন্টারের ছেলেটি বুঝি কোনও এক সহকর্মিণীর সঙ্গে হাসি-মশকরা করছিল, ঘণ্টাভর দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃদ্ধ অসহিষ্ণু হয়ে কিছু বিরূপ মন্তব্য করে ফেলেন। পত্রপাঠ কাউন্টার থেকে উঠে চলে যায় ছেলেটি। বৃদ্ধের দলও উত্তেজিত, সবাই মিলে ছোটেন ম্যানেজারের ঘরে। ম্যানেজার ছেলেটিকে অনেক বোঝায়, কিন্তু ছেলেটি অনড়। টেটিয়া বুড়োকে ক্ষমা চাইতে হবে। বৃদ্ধরাও অবিচল। ক্ষমা! ওই অভদ্র ছোকরার কাছে? কক্ষনও না। ম্যানেজার এসে বসুন কাউন্টারে।
এমত মহারণের মাঝে ধীরাজ নার্ভাস হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন। তিনি আজন্ম ভীতু ধরনের মানুষ, বাসের কন্ডাক্টরের সঙ্গে কোনও যাত্রীর বচসা লাগলে সেই বাস থেকে নেমে যেতে পারলে বাঁচেন, ব্যাঙ্কের ভেতরে ওই চেঁচামিচিতে হাত-পা কাঁপছিল তাঁর। হঠাৎ আবার কাউন্টার খোলার রব ওঠে, তাড়াহুড়ো করে ব্যাঙ্কে ঢুকতে যান ধীরাজ, উত্তেজিত ও উৎপীড়িত গ্রাহকদের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে যান তিনি। ব্যাঙ্ক কর্মচারীরা তখনও গ্রাহকদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরেছে না জিতেছে সেই দ্বন্দ্বে বিভোর, তারা কেউ এগিয়ে আসেনি ধীরাজকে তুলতে। সৌভাগ্যক্রমে পাড়ারই একজন তাঁকে উঠিয়ে পৌঁছে দিয়ে যায় বাড়িতে। টোকেন জমা দিয়ে পেনশনের টাকাটাও।
সব শুনে ঝুম হয়ে দু দণ্ড বসে রইল ইন্দ্রাণী। মাত্র ন দিন এখানে আসেনি, তার মধ্যেই এই অ্যাক্সিডেন্ট! মির্জাপুর বৈঠকখানার দিকে প্রায়ই আসতে হয় তাকে। এলেই ঢুঁ মেরে যায় বাপের বাড়িতে। সপ্তাহে এক দিন দু দিন তো বটেই। টানা সতেরো বছর ধরে এটা তার রুটিন। ক্কচিৎ কখনও ব্যতিক্রম হয়েছে এই নিয়মের।
বাবাকে দেখতে দেখতে বুকটা কনকন করছিল ইন্দ্রাণীর। এতটুকু ছোট্টখাট্টো শরীর! হাড়পাঁজরা বেরিয়ে আছে! বোতলের কাচের মতো চশমার নীচে নিষ্প্রাণ বড় বড় চোখ! টকটকে ফর্সা রঙে বাদামি ছায়া! বিছানায় বসে আছে জবুথবু! কী যে করে ইন্দ্রাণী এই বাবাকে নিয়ে! সামনের আশ্বিনে বাবার বয়স হবে ঊনসত্তর। আজকাল এটা তেমন বয়সই নয়, বহু মানুষই এই বয়সে চাকরি খুঁজে বেড়ায়। বাবার তেমন রোগব্যাধিও নেই, তবু যেন বড় বেশি নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। দৃষ্টি নিয়ে আসছে, মস্তিষ্ক ক্রমশ দুর্বল, স্মৃতিশক্তি প্রায় শূন্য। তবু একা সব কাজ সামলাতে হয় মানুষটাকে। বাজার। রেশন। ইলেকট্রিক বিল। মুদির দোকান। গ্যাস। কেরোসিন। ইন্দ্রাণী যখনই আসে, যথাসাধ্য করে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সে আর কতটুকুন?
সহসা বাতাসে আছড়ে পড়ে এক অদৃশ্য চাবুক। মলিন দেওয়ালে ফুটে ওঠে এক জোড়া বিস্ফারিত চোখ। বিস্ময় মাখা। যন্ত্রণা মাখা। ঘৃণা মাখা।
কোথায় যে চলে গেল তনুটা! বাবা-মা’র মুখ চেয়েও কি তনু এখন ফিরে আসতে পারে না? এ জীবনে ইন্দ্রাণীর মুখ না হয় আর নাই দেখল!
ইন্দ্রাণী বিষণ্ণ মুখে বলল, –তোমরা আমাকে একটা খবর দিতে পারোনি?
উমা শ্বাস চেপে বললেন, কাকে দিয়ে খবর দিই বল?
–পাশে টুনুমাসিদের বাড়ি থেকে একটা ফোন করতে পারতে।
ধীরাজ বলে উঠলেন, আমি তোর মাকে বলেছিলাম, তোর মা করল না।
উমা অপ্রস্তুত স্বরে বললেন, –ওকে মিছিমিছি ব্যস্ত করে কি লাভ হত? বেচারার নিজেরই বলে মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল অবস্থা! আদিত্যকে নিয়ে কম ঝক্কি গেল!
–ও ঝক্কি তো আমার থাকবেই মা। না মরা পর্যন্ত।
বালাই ষাট। ও আবার কি ছিরির কথা! তা আদিত্য এখন আছে কেমন?
আছে। দিব্যি আছে।
শরীর একটু ফিরেছে?
–শুয়ে বসে স্যুপটা জুসটা খাচ্ছে, শরীর তো না ফেরার কথা নয় মা।
–আহা, ওভাবে বলছিস কেন? কত বড় একটা ধাক্কা সামলে উঠল।
ইন্দ্রাণী কথা বাড়াল না। বাবার পায়ের কাছে গিয়ে বসল। আলতো করে হাত বোলাল ফোলা জায়গাটায়। বেশ গরম হয়ে আছে। ভারী গলায় বলল, ডাক্তার দেখিয়েছ?
–দেখিয়েছি।
কাকে?
বিশ্বাস ডাক্তারকে। দিলু ডেকে এনেছিল।
দিলু মানে দিলীপ। পাড়ার পুরনো বাসিন্দা। তিন-চারটে বাড়ি পরেই থাকে। ইন্দ্রাণীর থেকে বছর পাঁচেকের বড়। বিয়ে থা করেনি। ফুটবল মাঠ, পাড়ার ক্লাব আর কর্পোরেশনের চাকরি নিয়ে সদা ব্যস্ত। পাড়ার দুর্জনেরা বলে, এক সময়ে নাকি ইন্দ্রাণীর ওপর ঘোরতর দুর্বলতা ছিল দিলীপের। ইন্দ্রাণী মানে না। এ বাড়িতে চিরকালই দিলুর সহজ যাতায়াত।
ইন্দ্রাণী প্রশ্ন করল, –ডাক্তার কী বলল? মুচকেছে?
–তাই তো বলেছিল। মলম দিয়েছে, পেন কিলারও দিয়েছিল কয়েকটা।
–এক্সরে করতে বলেনি?
ব্যথা না কমলে করতে বলেছে।
কমেছে?
কই আর! কালও তো সারা রাত উঃ আঃ করছিল।
ধীরাজ করুণ মুখে বললেন, –পা তো মাটিতে রাখতেই পারছি না। বাথরুমে যেতে গেলেও তোর মা’র কাঁধে ভর দিয়ে…
–তবু এক্সরেটা করাওনি? ইন্দ্রাণী ঘুরে তাকাল মার দিকে, জানো কত সময়ে চুলের মতো সরু ফ্র্যাকচার হয়! ডিসলোকেশানও হতে পারে! গোড়াতেই ট্রিটমেন্ট না হলে কত দিন ভোগাবে তার ঠিক আছে!
বুঝি। কিন্তু কি করে নিয়ে যাই বল? আমি কি একা টানতে পারি?
–দিলুদাকে বলতে পারতে।
–তাকে আর কত বলি! ডাক্তারবদ্যি করল, দুবেলা খবর নিয়ে যায়, নিজে থেকে বুড়োবুড়ির যা হোক কিছু বাজার করে দিয়ে যাচ্ছে…
–তবুও মেয়েকে খবর দেওয়া যায়নি?
রাগ করিস কেন? তুই-ই তো দেখিস। ভাবলাম খবর পেলেই তো হাঁচোড়-পাচোড় করে ঢাকুরিয়া থেকে মানিকতলা ছুটে আসবি, বরং দেখি আর কটা দিন! যদি কমে যায়!
ইন্দ্রাণীর বুক মুচড়ে উঠল। আসল কথা টাকা। টাকা নেই! এ জি বেঙ্গলের সাধারণ চাকরি করা বাবা ক’টা টাকা আর পেনশান পায়! বড় জোর হাজার দেড়েক। সঙ্গে ফিক্সড ডিপোজিটের সুদ মেরে কেটে তিন-চারশো। এই টাকাতে বাড়িভাড়া আছে, দুটো প্রাণীর খাওয়া আছে, ওষুধবিষুধ আছে, ছোটখাট লোকলৌকিকতা আছে। মা’র আবার প্রেশার হাই, সারা মাস প্রেশারের বড়ি খেতে হয়, তার একটা খরচা আছে। এর পরও কি একশো-দেড়শো টাকা হুট বলতে বার করা যায়! অথচ মা সে কথা মুখ ফুটে বলবে না। কিছুতেই না। ইন্দ্রাণী দিতে চাইলেও হাঁ-হাঁ করে উঠবে। অদ্ভুত সব থিয়োরি মা’র! মেয়ের টাকা মানে অন্য সংসারের টাকা! বিবাহিত মেয়ের নিজের রোজগারেও মা বাবার অধিকার নেই!
ইন্দ্রাণী গম্ভীর মুখে বলল, আমি আজ ডাক্তার এক্সরে সব করিয়ে তবে যাব। উঁহু, তর্ক নয়, আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। ভাতটাত আছে?
–এক্ষুনি ফুটিয়ে দিচ্ছি। উমা খুশিতে ঝলমল, যা, ঝট করে চান সেরে চলে আয়। গরমে তো একেবারে বেগুনপোড়া হয়ে এসেছিস!
–তা তো হয়েছিই। যা রোদ্দুর!
পাখার তলায় বসেও ঘাম শুকোচ্ছিল না ইন্দ্রাণীর। আঁচলে মুখ মুছল ভাল করে। দ্বিধান্বিতভাবে বলল, –চান যে করব, জল আছে?
–ওই আছে একরকম। তোদের বাড়ির মতো আয়েশ করে হবে না, তবে হয়ে যাবে।
–দিবাকরদারা জল ঠিক দিচ্ছে এখন?
–আধ ঘণ্টা করে দেয়। দু বার। ছিরছির করে পড়ে।
–আমি কি আর একবার ওদের সঙ্গে কথা বলব?
–থাক, বার বার বলে কেন মুখ নষ্ট করবি! ওরা তো চায়ই আমরা কষ্ট-টষ্ট পেয়ে উঠে যাই।
–আবার কি কিছু শুনিয়েছে নাকি?
–শোনাতে হয় না, হাবেভাবে বোঝা যায়।
ধীরাজরা এ বাড়িতে এসেছেন প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর। ইন্দ্রাণী তখন খুবই ছোট, তনুময় হয়নি। আগে তাঁরা থাকতেন বিডন স্ট্রিটের পাশে এক গলিতে। বাড়িটা বেশ প্রাচীন, তবে মন্দ ছিল না। বিশাল বিশাল সাইজের ঘর, প্রায় হলঘরের মতো। বড় বড় দরজা জানলা। এক টুকরো ছাদ। চিলেকোঠায় ঠাকুর ঘর। শুধু নিজেদের ব্যবহারের জন্যই একটা আলাদা গঙ্গাজলের ট্যাঙ্ক। দোতলার রেলিংয়ের বারান্দা। সেই বারান্দায় দাঁড়ালে সোজা হেদুয়ার জল দেখা যায়। ভাড়াও ছিল অনেক কম, মাত্র ষাট টাকা। বহরমপুর থেকে কলকাতায় চাকরি করতে এসে প্রথম ওই বাড়িটাতেই নতুন বউ নিয়ে উঠেছিলেন ধীরাজ। তা সেই বাড়ি কপালে সইল না। কলকাতায় অবাঙালি ব্যবসায়ীদের ভিড় তখন বাড়তে শুরু করেছে, উত্তর প্রদেশের এক কালোয়ার মাত্র আশি হাজার টাকায় কিনে নিল গোটা বাড়ি। কিনেই একতলা দোতলার ভাড়াটেকে নোটিস। একতলার দত্তরা গ্রাহ্যই করল না, দোতলার ধীরাজ ভয়ে চুপসে গেলেন। কালোয়ারটি বোধহয় ধীরাজের নাড়ি টের পেয়েছিল, হেদুয়ার মোড়ে তিন-চারটে জবরদস্ত চেহারার লোককে পিছনে দাঁড় করিয়ে, মধুর ভাষায় ভয় দেখাল একদিন। তনুময় তখন সবে উমার পেটে এসেছে, গর্ভবতী স্ত্রী আর শিশুকন্যা নিয়ে পড়িমড়ি করে মানিকতলার এই বাড়িতে উঠে এলেন ধীরাজ। এ বাড়ির ঘর তিনটে আগের বাড়ির মতো বড় না হলেও ছোট বলা যায় না। ভেতরের দিকে একটা চওড়া বারান্দা আছে, এক ফালি উঠোনও। যখন এসেছিলেন তখন নতুন ছিল বাড়িটা, ধীরাজরাই এ বাড়ির প্রথম ভাড়াটে।
আগের বাড়ির স্মৃতি ইন্দ্রাণীর কাছে খুবই আবছা। শুধু রেলিংতোলা বারান্দাটুকু যা চোখে ভাসে কখনও-সখনও। প্রখর দুপুরে, সূর্য যখন মাঝগগনে, মাথার কাঠের ঘেরাটোপ দিয়ে ছেঁড়া-ছেঁড়া রোদ্দুর এসে পড়ত বারান্দায়, ঝিলমিল একটা ঢেউ খেলত সারা দুপুর। বাকি সব সময়েই বারান্দা ছায়ায় মোড়া। ঘুলঘুলিতে বুকুমবুকুম পায়রার ডাক। ওই ছেঁড়া ছেঁড়া রোদ্দুরের ঢেউ, ছায়ার নিঃশব্দ ঘোরাফেরা আর পায়রার বুকুম-বুকুম এখনও মাঝে মাঝে ইন্দ্রাণীর স্বপ্নে আসে। বহু দূরে ভাসমান ছবির মতো। রহস্যময়। অস্পষ্ট।
তবে ওই বাড়ির প্রতি ইন্দ্রাণীর তেমন কোনও টান নেই। থাকার কথাও নয়। তার যা টান ভালবাসা সব এই মানিকতলার বাড়িটাকে ঘিরেই। এখানেই সে অনেক কিছু পেয়েছে। মুক্তোদানার মতো শৈশব। পান্নারঙ কৈশোর। প্রথম যৌবনের হীরকদ্যুতি। ইন্দ্রাণীর শৈশবের সব চেয়ে স্মরণীয় প্রাপ্তিও এখানে এসেই। তার ভাই। ছোট্ট ইন্দ্রাণীর মনে বহু দিন বদ্ধমূল ধারণা ছিল, তনু বুঝি লুকিয়েছিল এই বাড়ির কোনও আনাচে-কানাচে, টুক করে একদিন কি করে যেন খসে পড়ল মার কোলে! ভাইকে আদর করার সময়ে যেন এই বাড়িরই নতুন নতুন গন্ধটা পেত ইন্দ্রাণী।
ধীরাজ উমাও এখানে এসে স্বস্তি পেয়েছিলেন। বিডন স্ট্রিটে বাড়িঅলার তেমন প্রত্যক্ষ অস্তিত্ব ছিল না, তারা থাকত শ্যামবাজারে, মাসে মাসে এক বুড়োবাবু এসে ভাড়া নিয়ে যেত, ব্যস। এখানে মাথার ওপর বাড়িঅলা। অচিরেই তাদের সঙ্গে গলায় গলায় ভাব হয়ে গেল। একতলা থেকে মোচা শুক্তুনি যাচ্ছে দোতলায়, দোতলা থেকে নেমে আসছে হরেক রকম আচার। ওপরের মনোতোষবাবু এককালে সশস্ত্র বিপ্লবীদলে ছিলেন, মুরারিপুকুর বোমা মামলায় জেলও খেটেছেন, তিনি তো তনুময়ের জন্মের পর একেবারে আত্মহারা! যেন নিজেরই ঘরে নাতি এসেছে। তাঁর স্ত্রী তনুময়ের জন্য সর্ষের বালিশ বানিয়ে দিলেন, মনোতোষবাবু সংগ্রহ করে আনলেন খাঁটি ইটালিয়ান জলপাইয়ের তেল। ইন্দ্রাণী সারাক্ষণ ঘুরছে ওপরের পুতুলদির পায়ে পায়ে। ওপরেই স্নান, ওপরেই খাওয়া, ওপরেই ঘুম।
কবে থেকে যে সেই ঘনিষ্ঠতায় চিড় ধরতে শুরু করল! পঁয়ষট্টিতে মনোতোষবাবু যখন মারা গেলেন তখনও সম্পর্ক তত তিক্ত হয়নি, তিনি বিদায় নেওয়ার বছর দশেকের মধ্যে শত্রুতা তুঙ্গে। আপোসি ধীরাজ যথাসাধ্য ভাড়া বাড়ালেন। দেড়শো থেকে ধাপে ধাপে আড়াইশো। আড়াই থেকে সাড়ে তিন। মনোতোষের ছেলে দিবাকর সাধারণ এক ড্রাফটসম্যান। সে এই ভাড়াতে ভীষণ অসন্তুষ্ট। তার স্ত্রী যখন তখন ওপর থেকে ময়লা ফেলছে নীচে, কারণে অকারণে জল কমিয়ে দিচ্ছে, ছুতো পেলেই চারটি কথাও শুনিয়ে দেয় ঠারে ঠোরে। ধীরাজদের ঘরের কলি পর্যন্ত ফেরানো হয়নি আজ এক যুগ। তনুময় নেই, ইন্দ্রাণী থাকে না, এই নির্বিরোধী বুড়োবুড়িকে ঘাড় ধরে তোলাও মুশকিল, তাই বোধহয় তাদের আক্রোশও বেড়ে চলেছে দিন দিন। ছোটবেলায় যে দিবাকর ঘুড়ি ওড়ালে ইন্দ্রাণী তনুময় বিশ্বস্ত পার্শ্বচরের মতো লাটাই ধরে থাকত সেই দিবাকর এখন যেচে ইন্দ্রাণীর সঙ্গে বাক্যালাপ পর্যন্ত করে না। সামনাসামনি পড়লে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। ছেলেমেয়ে তিনটেকেও মহা ত্যাঁদোড় তৈরি করেছে। এইটুকু গেঁড়ি গেঁড়ি ছেলেমেয়ে তিতিরকে দেখে অসভ্য অঙ্গভঙ্গি করে! বাপ্পা তো রেগেমেগে চড়ই কষাতে গিয়েছিল একদিন।
ইন্দ্রাণী রাগত স্বরে বলল, –ওদের হাবভাব তোমাদের অত বোঝার দরকার কি? একদম চোখ কান বুজে থাকবে।
–তাই তো থাকি, উমা উদাস, –জানিস পয়লা বৈশাখ রাতুলরা উঠে গেল। ওখানে নতুন ভাড়াটে আসছে। দু হাজার টাকা ভাড়া। পঁচিশ হাজার সেলামি। তার ওপর আবার বাড়ি সারানোর জন্য দশ হাজার আগাম। রাতুলরা মাত্র চারশো টাকায় ছিল।
ইন্দ্রাণী মা’র শেষ কথাগুলো শুনছিল না, প্রশ্ন করল, –কোথায় গেল রাতুলরা?
–গড়িয়া। রাতুল বড় বাড়ি করেছে। যাওয়ার দিন রাতুলের মা’র আনন্দ যদি দেখতিস!
রাতুল তনুর খুব বন্ধু ছিল। একই সঙ্গে ভর্তি হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। যাদবপুরে। রাতুল মেকানিকাল, তনু সিভিল। হায়ার সেকেন্ডারির আগে থেকেই রাজনীতিতে মন চলে গিয়েছিল তনুর। রাত জেগে নানান লিফলেট পড়ত, গোপন রাজনৈতিক পত্রপত্রিকাও। কলেজে ঢুকেই পুরোদস্তুর ঝাঁপিয়ে পড়ল নকশালপন্থী আন্দোলনে। রাতুলও সঙ্গে ছিল তার।
তনুদের আন্দোলন কবেই থেমে গেছে। মুক্তির দশকের স্বপ্ন এখন প্রাগৈতিহাসিক ছলনা। রাতুল এখন পুরোপুরি গৃহী। সি এম ডি এর প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার। বউ সুন্দরী আধুনিকা। ফুটফুটে একটা মেয়েও আছে, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ছে। ফুল ফ্যামিলি বছরে পনেরো দিন মুসৌরি নৈনিতাল বেড়াতে যায়। একটা বাড়িও হাঁকিয়ে ফেলল। মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে।
আর তনু?
একটা জমাট ডেলা গলায় নিয়ে বাথরুমে এল ইন্দ্রাণী। আধো অন্ধকার অপরিসর জায়গাটুকুতে সার সার জলপাত্র। গোটা পাঁচেক বালতি আর গামলায় জল টলটল। কী কষ্ট করে জল সঞ্চয় করে মা! ইন্দ্রাণী কিছুতেই প্রাণে ধরে জলটা খরচ করতে পারছিল না। মগে একটু তুলে মুখে চোখে ছিটোল শুধু।
বাহাত্তরের সেই কালসন্ধ্যায় রাতুলই সংবাদটা এনেছিল। ইন্দ্রাণীর শ্বশুরবাড়িতে। তনু সাংঘাতিকভাবে আহত। এক ডাক্তারের ফ্ল্যাটে গোপনে চিকিৎসা চলছে তার।
এক বৈশাখ মাসে কমিউনিস্ট পার্টির নতুন বিভাজন দিয়ে যে সংগ্রামের প্রকাশ্য সূচনা, তার শহুরে ধারাটি তখন প্রায় স্তিমিত। সশস্ত্র সংগ্রাম, সাংস্কৃতিক বিপ্লব সব তখন স্তব্ধপ্রায়, চারদিকে কেবল রাজনৈতিক খুনজখম আর পুলিশের বলগাহীন অত্যাচার। গত এক দেড় বছরে বারাসত, ডায়মন্ডহারবার, কোন্নগরে বেশ কয়েকটা গণহত্যা হয়ে গেছে, এদের সকলকে ছাপিয়ে গেছে বরানগর কাশীপুর। সেখানে রাজনৈতিক প্রতিশোধের নেশায়, মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার তাণ্ডবে, দেড়শো জনেরও বেশি টাটকা যুবক শেষ। আন্দোলনের নেতারা চরম মতানৈক্যে ভুগছেন। শহরে সংগ্রাম মুলতুবি রাখার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
তনুময় তখনও বাড়িছাড়া। এক দিকে পুলিশ খুঁজছে তাকে, অন্য দিকে বিপক্ষ দলের অস্ত্রধারীরা। তারই মধ্যে গোপনে এক আধ দিন মাঝরাতে বাড়ি আসে তনু, ভোরের আগে পালিয়ে যায়। ছেলের জন্য চিন্তায় চিন্তায় ধীরাজ উমার বিনিদ্র রাত কাটে। এই বুঝি তনুর কিছু ঘটে গেল!
এমন সময়ে ওই মারাত্মক খবর! ইন্দ্রাণী উদভ্রান্তের মতো রাতুলের সঙ্গে তক্ষুনি ছুটেছিল। তখনও নিয়তির খেলা টের পায়নি সে।
ডাক্তারের ফ্ল্যাটের বেল টিপতেই দরজা খুলেছে ডাক্তার। ইন্দ্রাণী তড়িৎস্পৃষ্ট। শুভাশিস! তিন বছর পর সেই প্রথম শুভাশিসের সঙ্গে দেখা।
শুভাশিসকে সেই মুহূর্তে কী অচঞ্চল দেখাচ্ছিল! তার বুকেও যে আফ্রিকান ড্রাম বাজছে, এতটুকু বুঝতে পারেনি ইন্দ্রাণী।
শান্ত স্বরে শুভাশিস ডেকেছিল, –এসো। তনুময় আমার কাছেই আছে।
শুভাশিসের তখনকার ফ্ল্যাটটা বেশ ছোট্ট। দু কামরার। চেতলায়। ভেতরের ঘরে শুয়েছিল তনু। দরজা থেকে ওই ঘরের দূরত্ব কতটুকুই বা, বড় জোর দশ বারো পা। ওইটুকু পথ অতিক্রম করতে কত আলোকবর্ষ হেঁটেছিল ইন্দ্রাণী! বিছানায় আধো অচেতন শুয়ে আছে একমাত্র ভাই, কাঁধে উরুতে তার পাইপগানের গুলির ক্ষত, মাথায় লোহার রডের আঘাত, তবু ইন্দ্রাণীর চোখ বার বার ঘুরে যায় অন্য দিকে। একটা ধারালো নখ আঁচড়ে ফালা ফালা করে দেয় হৃৎপিণ্ড।
.
..আদিত্যের সঙ্গে বিয়ের মাত্র এগারো দিন বাকি। কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় একটু আগে দুই পার্টিতে বোমাযুদ্ধ হয়ে গেছে। পুলিশে পুলিশে চারদিক ছয়লাপ। প্রেসিডেন্সি কলেজের পাশের গলিতে তখনও পড়ে এক তরুণের টাটকা মৃতদেহ। কলেজ স্কোয়্যারে একা একা দাঁড়িয়ে ইন্দ্রাণী। ত্রস্ত। উদ্বিগ্ন।
শুভাশিস আসবে। শুভাশিস কথা দিয়েছে আসবে। আজই নিতে হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
মাথার ওপর বৃষ্টিহীন শ্রাবণের চড়া রোদ্দুর। বাতাসে বারুদের ঘ্রাণ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় গেল ইন্দ্রাণীর।
শুভাশিস এল না।
ইন্দ্রাণী বিপদ ভয় তুচ্ছ করে খুঁজছে শুভাশিসকে। হাসপাতালে গেল, নেই। কলেজে নেই। মরিয়া হয়ে শুভাশিসের হোস্টেলে। সেখানেও নেই শুভাশিস। আগের দিন সকালেই নাকি চলে গেছে কলকাতার বাইরে। কবে ফিরবে কেউ জানে না।…
রাতুল চলে যাওয়ার পর ফ্ল্যাটে মাত্র তিনটি প্রাণী। প্রতিপক্ষ দলের শিকার হয়ে একজন অসাড় পড়ে আছে বিছানায়, একজন কাঠের পুতুলের মতো তার শুশ্রূষা করে যাচ্ছে, তৃতীয় জন স্থবির। নির্বাক। পুরনো অপমানে বিদীর্ণ হচ্ছে তার হৃদয়।
তনুর তখনও বিপদ পুরোপুরি কাটেনি, জ্ঞান এসে এসে চলে যাচ্ছে। ইন্দ্রাণী যখন রাত সাড়ে দশটা নাগাদ বাড়ি ফেরার জন্য উঠেছে, তখনই শুভাশিস ডাকল পিছন থেকে, –তুমি কি আমার সঙ্গে একটাও কথা বলবে না রানি?
ইন্দ্রাণী কঠিন মুখে বলেছিল, কী বলব?
কিছু বলার নেই! আমাকে গালাগাল করতে পারো, আমার গায়ে থুতু ছেটাতে পারো, বাট ডু সামথিং।
কী লাভ?
–তোমার লাভ নেই, আমার আছে। আমি যে সব বলতে চাই রানি।
–কৈফিয়ত?
–না। কনফেশান।
কেন সেদিন দেখা হয়েছিল শুভাশিসের সঙ্গে? কেন তনুর বন্ধুরা তনুকে নিয়ে গিয়েছিল শুভাশিস সেনগুপ্তর কাছেই? আরও তো অনেক ডাক্তার ছিল কলকাতায়?
সেদিন যদি শুভাশিসের সঙ্গে দেখা না হত কত অন্যরকম হতে পারত সব কিছু। তনু হারিয়ে যেত না! বাবা মা এমন অবলম্বনহীন হয়ে পড়ত না! ইন্দ্রাণীর বুকেও বিঁধে থাকত না অসংখ্য গোপন কাঁটা!
স্যাঁতসেতে কলঘরে উমার জমানো জল থেকে বাষ্প উঠছে। বাষ্পটুকু মেখেও শরীরের জ্বালাপোড়া ভাবটা যাচ্ছিল না ইন্দ্রাণীর।
খাওয়ার সময়ে উমা বললেন, –যদি রাগ না করিস তো একটা কথা বলি?
গরম ভাতে আলুসেদ্ধ ঘি মেখে গোগ্রাসে খাচ্ছে ইন্দ্রাণী। ক্ষিদে তো পেয়েছিলই, কিন্তু ক্ষিদেটা যে কত জব্বর খেতে বসে টের পাচ্ছে। স্কুলের মিষ্টির প্যাকেট হজম হয়ে গেছে কখন। আলুসেদ্ধ ভাত এখন যেন অমৃত। খেতে খেতেই বলল, বলে ফেলো।
উমা গলা নামালেন, –বেলেঘাটায় তারাপীঠ থেকে এক সাধু এসেছে, ভূত ভবিষ্যৎ সব নাকি বলে দেয়!
–তাই বুঝি?
–তোর বিশ্বাস হচ্ছে না! টুনুর ননদ গিয়েছিল, সাধুবাবা বলেছিলেন সাত দিনের মধ্যে মেয়ের জন্য ভাল পাত্রের সন্ধান এসে যাবে, তিন দিনের মাথায় টুনুর ননদাই একটা ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের খবর পেয়ে গেছে!
-বাহ, দারুণ গপ্পো তো! কাক তাল গাছে বসল, ওমনি তাল খসে পড়ল!
–ওরকম করছিস কেন? চল না একবার।
–গিয়ে?
উমা চুপ করে গেলেন। ইন্দ্রাণীরও খাওয়ার গতি ধীর হয়ে গেল। মৃদু স্বরে বলল, ওসব করে আর কী হবে মা! অনেক তো করলে!
উমা বড় করে শ্বাস ফেললেন, –শুধু আমি কেন, তুইও একবার দর্শন করে আসতে পারিস।
আমি! কেন?
–আদিত্যর ভরিষ্যৎ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন সাধুবাবা!
–তা আমি কেন? যার ভবিষ্যৎ জানতে চাও তাকেই নিয়ে যাও। তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব।
–স্বামীর ভবিষ্যৎ আর স্ত্রীর ভবিষ্যৎ কি আলাদা হয় রে বোকা? যে কেউ একজন গেলেই হল।
তুমি যে এখনও কোন যুগে পড়ে আছ মা! ইন্দ্রাণী হাসল, –শোনো, তোমার জামাইয়ের ভবিষ্যৎ বলবে এমন সাধুবাবা এখনও জন্মায়নি। কৈলাস থেকে স্বয়ং শিব নেমে এলেও তোমার জামাইকে সেলাম ঠুকে ষাঁড়ের পিঠে চেপে হাওয়া মারবে। বলবে, ওরেব্বাস এ যে আমার ওপরে তিন কাঠি!
মেয়ের কথার ভঙ্গিতে উমাও হাসছেন, –যাই বলিস বাপু, যখন মা বলে এসে প্রণামটি করে, তখন কিন্তু মনটা একেবারে জুড়িয়ে যায়।
আদিত্যর ওপর উমার অসীম স্নেহ। নেশাভাঙ সব কিছু মিলিয়ে আদিত্যই তাঁর কাছে সাক্ষাৎ শিব।
ইন্দ্রাণী মাকে আর খোঁচাল না। বলল, –ঠিক আছে, এর মধ্যে এসে একদিন নিয়ে যাবখন।
উমা চারাপোনার ঝোল ঢেলে দিলেন মেয়ের পাতে। কয়েক সেকেন্ড চুপ। আবার একটা লম্বা খাস পড়ল, আমি তো ভবিতব্য মেনেই নিয়েছি। তোর বাবার জন্যই যাওয়া। মানুষটার দিকে আর তাকানো যায় না।
ইন্দ্রাণী খাওয়া থামিয়ে মাকে দেখছিল। একঘেয়ে সুরে বিনবিন করে চলেছেন উমা, সন্ধে হলেই নেশার মতো টিভি খুলে বসবে। কি দেখে, না নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা! কাগজ খুলেও শুধু একটাই জিনিস পড়ার নেশা! নিরুদ্দেশের খবর আর দুর্ঘটনার খবর! কোথায় কোন বেওয়ারিশ বডি পাওয়া গেল… রেল দুর্ঘটনায় কারা মরল তাদের নাম ধাম! যত দিন যাচ্ছে, তত এই পাগলামিটা বাড়ছে। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে….
–আহ মা, থামবে? ইন্দ্রাণী প্রায় ককিয়ে উঠল, –আর কোনও কথা নেই তোমার? এতক্ষণ এসেছি, একবার তো কই নাতি নাতনির খবর জিজ্ঞেস করলে না?
বাইরে হঠাৎ ঝমঝম শিলাবৃষ্টি শুরু হয়েছে। সামনের উঠোনে আছড়ে আছড়ে পড়ছে বড় বড় বরফের গুলি। পড়েই ভেঙে চৌচির। কাচের টুকরোর মতো ছিটকোচ্ছে চারদিক। সপ্লিনটার হয়ে।
তারা তো ভালই আছে। বেঁচেবর্তে আছে। উমা আঁচলের খুঁটে চোখ মুছলেন।
ইন্দ্রাণী বলল, –ঘরে যাই চলো। একটু গড়িয়ে নিই, তারপর বাবাকে নিয়ে বেরোব।
উমা দূরমনস্ক। ফিসফিস স্বরে বললেন, –তোর কী মনে হয় রে ইনু?
–কিসের কী?
–ছেলেটা কি এখনও বেঁচে আছে?
.
০৯.
তিতিরই প্রথম দেখল রঘুবীরকে। প্রেসঘর থেকে।
একটু আগে-আগেই সাজগোজ সেরে নেমে এসেছিল তিতির। বন্ধুরা আসবে। দেবস্মিতা হিয়া আর ঝুলন। দুপুরে আজ তাদের সিনেমার প্রোগ্রাম। জন্নৎ আউর জাহান্নম। ঝুলনের টিকিট কেটে রাখার কথা।
দুটো বাজতে দশ। আড়াইটের আগে বন্ধুদের আসার চান্স নেই। সদরের সামনে পায়চারি করতে করতে প্রেসঘরে উঁকি দিয়েছিল তিতির।
দিয়েই অবাক। অ্যাটম! দিব্যি টুলে পা ঝুলিয়ে বসে গল্প করছে মেশিনদাদুর সঙ্গে।
–কি রে, তুই না গরমের ছুটির টাস্ক করতে বসেছিলি? উঠে এসেছিস যে?
অ্যাটমের মুখে ধূর্ত হাসি, –জিওগ্রাফির আনসার করাতে করাতে মা নিজেই ঘুমিয়ে পড়ল।
তুইও সঙ্গে সঙ্গে কাট্টিস? কাকিমার যদি একবার ঘুম ভাঙে…
–মিনতিদি চা না দিলে মার ঘুম ভাঙবেই না। পরমানন্দে পা নাচাচ্ছে অ্যাটম, -মিনতিদি বেরিয়ে গেছে, আমি দেখেছি।
–মহা শয়তান হয়েছিস তো তুই!
–অ্যাই দিদিভাই, দশটা পয়সা দে না।
কী করবি?
–অ্যাটম চোখের ইশারায় মেশিনদাদুকে দেখাল।
মেশিনম্যান দুর্লভ দাস হাসছে মিটিমিটি। এক তাড়া কাগজ গোছ করতে করতে ঘাড় দোলাচ্ছে, –বিনি পয়সায় হবে না গো দাদুভাই। দশটা পয়সা দাও, একটা স্বপ্ন কিনে নিয়ে চলে যাও। আর রাতভর মজাসে দ্যাখো।
মেশিনদাদু খেলাটা অ্যাটমের সঙ্গেও শুরু করেছে! বছর সাত আট আগেও মেশিনদাদুর সঙ্গে তিতিরের খুব জমত খেলাটা। পাঁচ পয়সা দিলে একটা স্বপ্ন। দিনে একটার বেশি স্বপ্ন কখনই নয়।
ট্যাঁকে পয়সাটা গুঁজে মেশিনদাদু বলত, চোখ বোজো।
তিতির বলত, বুজেছি।
–এই নাও স্বপ্ন। এইইই দুটো ডানা লেগে গেল তোমার পিঠে। ওড়ো এবার। ওড়ো। উড়ছ? এবার সোওওজা আকাশে উঠে যাও। আকাশে কত তারা ঝিকমিক করছে দেখতে পাচ্ছ? কোন তারাটাকে ছোঁবে তুমি? বেশ, ওই সবজে তারাটাকে ছোঁও আগে। ওর নাম পুষ্যা। এবার চলো হস্তার কাছে। স্বাতীর সঙ্গেও একবার দেখা করবে নাকি?
কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! স্বপ্নটা রাত্তিরে সত্যি সত্যি চলে এসেছে তিতিরের ঘুমে। দু হাতে মেঘ সরিয়ে ডানা মেলে উড়ছে তিতির!
এককালে এ রকম কত স্বপ্ন যে মেশিনদাদুর কাছ থেকে কিনেছিল তিতির! মাছ হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। পিঁপড়ে হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। ফুল হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। প্রজাপতি হওয়ার স্বপ্ন। গাছ হওয়ার স্বপ্ন।
তিতির হাসতে হাসতে বলল, তোমার স্বপ্নের রেটটা বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে?
দুর্লভ ঘাড় দুলিয়েই চলেছে, মাগগিগণ্ডার বাজার রে দিদি। ওই দামে আর পেরে উঠি না।
–তা বলে একেবারে ডবল? পাঁচ পয়সা থেকে দশ পয়সা?
–আলু পটলের দামই তো পাঁচ-দশ গুণ বেড়ে গেল রে, স্বপ্নের দাম তো একশো গুণ বাড়া উচিত, ঠিক কি না?
দুই কম্পোজিটার রোবটের মতো টাইপ সেট করে চলেছে। তার মাঝেই ঘাড় ঘুরে যাচ্ছে এক আধবার। মধ্যবয়সী দুই কর্মী পুরুষের মুখেও হাসির আলগা ছোপ।
তিতির দু দিকে মাথা নাড়ল। মেশিনদাদুটা এখনও একই রকম রয়ে গেল। মনেও। চেহারাতেও। পঞ্চান্নতে যা, পঁয়ষট্টিতেও তাই। সেই বুড়োটে মার্কা কুঁজো শরীর। মাথা জোড়া চকচকে টাক। কুচকুচে কালো ফ্রেমের চশমা। পরনে সদাসর্বদা ধুতি ফুলশার্ট। টায়ারের চটি। আর যখনই দ্যাখো সঙ্গে একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ রয়েছে। একটা লম্বা ডাঁটির ছাতাও। যার কাপড় ক্রমে কালো থেকে ধূসর।
ছোট্টখাট্টো মানুষটিকে দেখে প্রথম দিন কী অবাকই না হয়েছিল তিতির! এই মেঠো লোকটা অত বড় একটা মেশিন চালাবে!
মেশিন চালু হতেই বাপ রে কী দাপট লোকটার! এই সুইচ টেপে! ওই মেশিনের অংশ খুলে ঝ্যাট ঝ্যাট কালি মাখিয়ে দেয়! ঠকঠক মেশিনের এখান ঠোকে, ওখান ঠোকে! বাবার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে, হাত কাজ করে চলেছে অন্য দিকে! ঝাঁই ঝাঁই কাগজ লাগিয়ে যাচ্ছে মেশিনে! যেই না কাগজ গেল, বিশাল ভারী একটা কালো চাকা আপনাআপনি লাফিয়ে ছাপ ফেলে দিল কাগজে! অবলীলায় কথা বলতে বলতে লোকটা সরাচ্ছে কাগজ! আবার ভরছে! আবার সরাচ্ছে! ভরছে! একটি বারের জন্যও ফিরে তাকায় না মেশিনের দিকে! কী উদাসীন, অথচ কী নিখুঁত!
অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে ছোট্ট তিতির একদিন ভাব জমাল লোকটার সঙ্গে। দিন শেষে কাজের পালা সাঙ্গ করে হাত পা ধুয়ে দুর্লভ দাস তখন আবার নিপাট হাটুরে।
ভয়ে ভয়ে তিতির জিজ্ঞাসা করেছিল, –অ্যাই, তুমি কি ম্যাজিশিয়ান?
গামছা পরিপাটি ভাঁজ করে ক্যাম্বিসের ব্যাগে রাখছিল দুর্লভ, তিতিরের প্রশ্নে তার চোখ পিটপিট, হুম, আমি জাদুকর। কিন্তু তুমি কী করে টের পেলে দিদিভাই?
বা রে, ম্যাজিক না জানলে কেউ মেশিনের দিকে না তাকিয়ে কাগজ ছাপাতে পারে?
দুর্লভ হা হা হেসে উঠেছিল। বাবাহ, ওইটুকু জিরজিরে মানুষটার হাসিতেও কী জোর! হাসতে হাসতেই নোকটা যেন হুবহু ম্যানড্রেক হয়ে গেল!
তিতিরের চোখ গোল গোল, কার কাছে ম্যাজিক শিখলে গো?
–সে ছিল বটে এক খোঁড়া জাদুকর। ম্যাজিকটা তার কাছেই শেখা গো দিদি।
ধ্যাৎ, জাদুকর আবার খোঁড়া হয় নাকি?
–হয় গো হয়। ওই জাদু শেখাতে শেখাতেই তো খোঁড়া হয়ে গেল বেচারা।
–কেন?
–সে অনেক লম্বা গল্প গো দিদি। শুনবে তুমি?
উত্তেজনায় দুর্লভের শার্ট খামচে ধরেছিল তিতির, হ্যাঁ শুনব। এক্ষুনি শুনব।
–তো শোনো। সেই জাদুকরটা ছিল ভারি অদ্ভুত। ম্যাজিক শেখা শেষ হলে শিষ্যরা যখন তাকে গুরুদক্ষিণা দিতে চাইত, তখন সে বলত, দক্ষিণা দিবি? বেশ। দে তবে, আমার ঠ্যাং-এ একটা জোরসে লাঠির বাড়ি মেরে দে। তারা হাঁ হাঁ করে উঠত, তা কী করে হয় গুরুজি? তুমি আমাদের শিক্ষা দিলে, আমরা কি তোমাকে মারতে পারি? তা জাদুকর বলত, সেই জন্যই তো মারবি। অন্যকে কিছু শেখালে মানুষের মনে অহঙ্কার দানা বাঁধে। লোকের কাছ থেকে পাওয়ার আশা বাড়ে, যাকে বলে কিনা লোভ। জানিসই তো অহঙ্কার আর লোভেই মানুষের পতন। সেই অহঙ্কার আর লোভ যাতে মনে বাসা না বাঁধে তাই আমার এই বিধান। তা যারা ম্যাজিক শেখে তারা আর কি করে? দিত গুরুর পায়ে একটা করে লাঠির ঘা। সেই ঘা খেতে খেতেই লোকটা শেষে খোঁড়া হয়ে গেল।
গল্পের মাথামুণ্ডু বোঝেনি তিতির, শঙ্কিত প্রশ্ন করেছিল, –তুমি যদি আমাকে ম্যাজিক শেখাও তোমাকেও কি মারতে হবে?
–সেরকমই তো গুরু জাদুকরের নির্দেশ দিদিভাই।
নির্দেশটা মনঃপূত হয়নি তিতিরের, কাগজ ছাপার কাজটাও তাই শেখা হয়ে উঠল না আর। তবে দোস্তিটা সে দিন থেকেই জমে গেল। দুর্লভ দাস বনে গেল তার মেশিনদাদু। অফুরন্ত আজগুবি গল্পের ভাঁড়ার। স্বপ্ন বেচার ফেরিঅলা।
দুর্লভ দাসের বাড়ি সেই মেদিনীপুরের কোন গণ্ডগ্রামে। হাওড়া থেকে প্রথমে বাগনান যাও, সেখান থেকে বাসে মানকুর ঘাট, তারপর নৌকো। রূপনারায়ণ বেয়ে শিলাই নদী। শিলাই নদীর পাড় থেকে আরও ক্রোশ খানেক হেঁটে তবে ফণিমনসা গ্রাম। দেশগাঁয়ে একটা চালাবাড়ি আছে দুর্লভের, বিঘে দুয়েক জমিও। তে-ফসলি উর্বর জমি। ছোট মেয়েজামাই দেখভাল করে। বড় দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছে হাওড়ায়। একজনকে বাকসিতে, অন্যজনকে আমতায়। বহুকালের বিপত্নীক দুর্লভ এখন কালেভদ্রে দেশে যায়, গড়িয়ার এক মেসেই তার স্থায়ী বসবাস। প্রথম যৌবনে কলকাতায় পা রেখে শহরটার মোহে পড়ে গিয়েছিল, মোহ এখন মায়া। সময় পেলেই একা একা চরে বেড়ায় শহরের রাস্তায়। তিতিরদের প্রেসের ওপরও তার এক আজব মমতা।
তিতির হাসতে হাসতে অ্যাটমের হাতে একটা দশ পয়সা দিল, –নে, দাদুর ঝুলি থেকে শিগগিরই একটা স্বপ্ন বার করে নে।
মেশিনে চাপানোর আগে ফ্রেমে আঁটা টাইপ পরখ করছে দুর্লভ। পয়সা খুঁটে গুঁজে বলল, –আজ কিসের স্বপ্ন চাই? মাছ, না পাখি?
ধুস, আমি রোজ রোজ মাছ পাখি নেব না। আমাকে একটা যুদ্ধ দাও।
যুদ্ধের কি স্বপ্ন হয় নাকি দাদুভাই?
-কেন হবে না? একদল সোলজার আক্রমঅঅণ বলে তেড়ে যাচ্ছে, আরেক দল আক্রমঅঅণ করে তেড়ে আসছে…তুমি টিভিতে দ্যাখোনি?
টিভি তো যন্ত্র দাদুভাই, যন্ত্র থেকে কি স্বপ্ন বার করা যায়?
যায়ই তো। আমার সব বন্ধুরা যুদ্ধের স্বপ্ন দেখে। আমি ছাড়া।
–ও সব বাজে স্বপ্ন। এসো, আমি বরং তোমাকে একটা নতুন স্বপ্ন দিই। বিশাল এক সমুদ্রের স্বপ্ন। মনে করো তুমি নীল জল হয়ে গেছ…
–না। ও স্বপ্ন বিচ্ছিরি। অ্যাটম চেঁচিয়ে উঠল, –আমি যুদ্ধের স্বপ্নই চাই। আমার সব বন্ধুরা স্বপ্ন দেখে ফাইট প্র্যাকটিস করে আসে, আর রোজ টিফিনে আমাকে হারিয়ে দেয়। আমিও স্বপ্নে ফাইট প্র্যাকটিস করে সকলকে হারিয়ে দেব।
দুর্লভ কেমন নিবে গেল, –যুদ্ধের স্বপ্ন আমার কাছে তো নেই দাদুভাই।
–তা হলে একটা এমনি মারপিট দাও। ঢিসুম ঢিসুম।
–তাও নেই।
অ্যাটম যেন চিন্তায় পড়ে গেছে, মাথা চুলকোতে চুলকোতে পা দোলাচ্ছে। হঠাৎ বলল, –একটা স্টারট্রেক দাও তা হলে। সুইচ টিপব, অন্য প্ল্যানেটে চলে যাব। পথে কেউ পড়লে গুলি করে উড়িয়ে দেব। তুমি মিস্টার স্পককে দ্যাখোনি? খাড়া খাড়া কান? দেখে মানুষ মনে হয়, অথচ মানুষ নয়!
–নাহ। দু দিকে মাথা নাড়ে দুর্লভ।
অ্যাটম খেপে যায়, তা হলে তোমার কি আছে? ফাইটিং নেই, মেশিনগান নেই, সুপারম্যান নেই, স্পাইডারম্যান নেই, মিস্টার স্পকও নেই। আমি তোমার কাছ থেকে পয়সা দিয়ে পচা স্বপ্ন কিনব কেন? বলেই দুর্লভের খুঁট থেকে পয়সাটা টেনে বার করে নিয়েছে অ্যাটম। কেউ কিছু বোঝার আগে এক ছুট্টে ঢুকে গেছে বাড়িতে।
বিমর্ষ মুখে মেশিনে ম্যাটার তুলছে দুর্লভ। টুকটুক কয়েকটা নাটবলটু ঠুকল। রোলার দিয়ে কালি বোলাল চাকায়।
তিতির ঠোঁট টিপে হাসছিল, –কি, অ্যাটমের কাছে ফেল মেরে গেলে তো?
–শুধু অ্যাটম কেন রে দিদি। গত মাসে বাকসি গেলাম, বড় খুকির কাছে, সেখানেও দেখি আমার দুই নাতি মেশিনগান নিয়ে যুদ্ধ করছে! আলপথে দাঁড়িয়ে! মনে হচ্ছে তোদের টিভির দৌলতে এ বার আমার ব্যবসাটা লাটে উঠল।
–তা কেন? তুমিও টিভি দেখে দেখে পোক্ত হয়ে নাও। নতুন কায়দায় ব্যবসা জমাও। একটু ভায়োলেন্স ফায়োলেন্স দাও।
–স্বপ্ন তো আর ট্রেনের লজেনচুস নয় রে দিদি যে, যা হোক করে আমায় বেচতে হবে। ম্রিয়মাণ দুর্লভ ঝট করে তিতিরের দিকে ফিরেছে, –আচ্ছা দিদি, তোদের টিভির কি মন আছে? নিজের মতো করে ভাবতে পারে?
–তা পারে না।
দুর্লভ উদাস, –যে নিজে ভাবতে পারে না, সে পৃথিবীতে বেশি দিন টিকতেও পারে না। তা সে কি বা মানুষ, কি বা যন্ত্র। তোরাই একদিন ঘাড়ে করে ওই বাক্সকে নর্দমায় ফেলে দিবি, দেখে নিস।
দুর্লভের উদাসীনতা তিতিরের মধ্যেও যেন চারিয়ে যাচ্ছিল। আনমনা চোখ বাইরের রাস্তায়।
আর ঠিক তক্ষুনি সামনে রঘুবীর!
ঠাঠা কুকুরতাড়ানো রোদ্দুরে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। ড্যাবড্যাব দেখছে তিতিরদের বাড়িটাকে।
তিতির এগোবে কি এগোবে না ভাবার আগেই লোকটা হাত নেড়ে ডাকল তিতিরকে, –এই যে খুকি, শোনো একটু। তুমি আদিত্যবাবুর মেয়ে না?
তিতিরের মেজাজ মুহূর্তে খাট্টা। স্কার্ট ব্লাউজে তাকে একটু ছোটখাট দেখায় ঠিকই, তা বলে লোকটা তাকে খুকি বলে ডাকে কোন সাহসে! বাসট্রামের কন্ডাক্টাররাও আজকাল তিতিরের সঙ্গে দিদি আপনি ছাড়া কথা বলে না।
মুখে যথাসম্ভব প্রবীণত্ব আনল তিতির, –আপনি হসপিটাল থেকে কবে রিলিজড হলেন?
-আজ নিয়ে ধরো গিয়ে দশ দিন। ফালতু কটা দিন বেশি আটকে রাখল।
কমপ্লিটলি সেরে গেছেন? তিতির আরও ভারিক্কি।
–পেটের ব্যথা আমার অঙ্গের ভূষণ খুকি। এই যেমন ধরো আমার দাড়িগোঁফ। রেখেছি আছে, কামিয়ে ফেললেই নেই। অথচ আবার গজাবে। ব্যথাটাও তেমনি। লোকটা হে হে হাসছে, যাও খুকি, তোমার বাবাকে ডেকে দাও।
তিতির ভুরু কুঁচকোল, বাবা এখন ঘুমোচ্ছে।
–ঘুম থেকে তুলে দাও। বলো রঘুবীর চাটুজ্যে এসেছে।
–ঘুমোলে বাবাকে ডাকা বারণ। বাবা রাগ করে।
আমার নাম শুনলে রাগবেন না, লাফিয়ে বেরিয়ে আসবেন। কী নাম বলবে বলো তো?
তিতির বেজার মুখে বলল, -রঘুবীরবাবু।
-বাবু ফাবু নেই। শুধু রঘুবীর। রঘুবীর চাটুজ্যে। ওফ, রোদ্দুরটাও আজ চড়িয়েছে বটে! যাও, তাড়াতাড়ি ডাকো। ওঁর প্রয়োজনেই আমার এত দূর আসা। বলেই সুট করে বড় ঘরে ঢুকে পড়েছে লোকটা। তিতিরকে একটুও পাত্তা না দিয়ে সোজা বসে পড়ল লম্বা সোফায়। খাকি প্যান্টের পকেট থেকে বিড়ি বার করল, আঙুলে ঘোরাচ্ছে। জংলা ছোপ বুশশার্টের ওপরের বোম দুটো খুলে দিল। হুকুমের স্বরে তিতিরকে বলল, –ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে যাও তো খুকি। আর এক গ্লাস জল এনে দাও।
বিরক্তির থেকেও এ বার তিতিরের অস্বস্তি হচ্ছিল বেশি। বাবার বন্ধুরা বড় একটা বাড়িতে আসে না, এলেও তাদের দেখে দাদুর মাথায় রক্ত চড়ে যায়। এ রকম একটা অমার্জিত বে-সহবত লোক বাবার খোঁজে এসে বড় ঘরে বসে পড়েছে দেখলে দাদু হয়তো কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দেবে। তাছাড়া লোকটা তিতিরের হাফ-চেনা, কদিন যা হসপিটালে দেখেছে, বাবার সঙ্গেও কতটুকু ঘনিষ্ঠতা কে জানে, এই উটকো লোকের হাতে গোটা একতলাটা ছেড়ে যাওয়া কি উচিত হবে? নীচে এখন মিনতিদি সন্ধ্যার মা নেই, দাদুও ঝিমোচ্ছে নিজের ঘরে, ছোটকা আউট, ভরদুপুরে একা একতলায় তিতির এখন কী যে করে? অ্যাটমকে হাঁক মেরে ডেকে পাহারায় বসাবে?
ঝটিতি রান্নাঘর থেকে কাচের গ্লাসে জল নিয়ে এল তিতির। লোকটার হাতে না দিয়ে রাখল সেন্টার টেবিলে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়েও ফিরে এল বড় ঘরের দরজায়।
সন্তর্পণে পর্দার আড়াল থেকে তিতির লক্ষ করছিল রঘুবীরকে। এক ঢোকে জল শেষ করে আপন মনে আড়মোড়া ভাঙছে লোকটা। শব্দ করে করে হাতের আঙুল মটকাল। লাল গোল্লা গোল্লা চোখ ঘুরছে চার দেওয়ালে। সিলিং-এ। হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। কাচের আলমারির সামনে গিয়ে চোখ ছোট করে কাপ-মেডেলগুলো দেখছে। আলমারিতে চাবি দেওয়া থাকে না, লোকটা কিছু সরাবে না তো? না, বড় বড় পা ফেলে লোকটা এবার দাদুর বাবার ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ডান হাতের তর্জনী ঘষছে দেওয়ালে। আচমকাই গমগমে গলায় বলে উঠল, কী হল খুকি, তুমি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে কেন? বললাম না, বাবাকে খবর দাও!
ওরেব্বাস! লোকটার মাথার পিছনেও চোখ আছে নাকি! ভীষণ চমকে তিতির দুদ্দাড়িয়ে ওপরে ছুটল। বাবার ঘরে ঢুকেও হাঁপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে ঠেলল আদিত্যকে।
দুপুরের ঘুমটি আদিত্যর বড় প্রিয়। রাতের ঘুম তার ন্যায্য পাওনা, দুপুরেরটা উপরি। আদিত্যর ভাষায় এ ঘুম হল স্টেশনের টিকিট চেকারদের পকেটে জমে ওঠা খুচরো পয়সা। একে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার কী যে সুখ!
এই সুখটুকুর জন্যই এ জীবনে কোনও বাঁধাধরা চাকরি করা হয়ে উঠল না আদিত্যর।
জয়মোহনের ব্যবসা যখন ডুবুডুবু তখন আদিত্য একবার একটা চাকরিতে ঢুকেছিল। এক ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে। নিজের চেষ্টাতেই। কাজটা খুব ভারী ছিল না, অ্যাকাউন্টসের খাতাপত্র লেখা, সেলস পারচেজ দেখা, এই সব। মাইনেও মন্দ নয়, সব মিলিয়ে সাড়ে ছশো। তা সে চাকরি আদিত্যর পোষাল না। ওই ঘুমেরই কল্যাণে। দুপুরের টিফিনটি পেটে পড়লেই কী যে হত! রাজ্যের ঢুলুনি এসে জড়ো হত চোখের পাতায়! হাটের মাঝে ভুসভাস নাক ডেকে উঠত! প্রথম কিছুদিন অফিস কলিগরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল, নিজেদের মধ্যে হাসাহাসিও, হঠাৎ একদিন অফিসের এক ফক্কড় বেফাঁস মন্তব্য করে বসল। এক ঘর পুরুষ-মহিলার সামনে রসিয়ে রসিয়ে বলল, আহা রে ঘুমোবে না! সারা রাত ওভারটাইম খাটলে কি আর দিনের ডিউটি করা যায়! দেখুন দেখুন, রাত জেগে জেগে আদিত্যদার চোখের নীচে কেমন কালি পড়ে গেছে! বলেই আদিত্যর দিকে তাকিয়ে গাল-জোড়া হাসি, বউদিও কি আপনার মতো সারা দিন ঢোলে আদিত্যদা।
ছোকরার কথার কায়দায় সে এক কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি অবস্থা! গোটা অফিস হেসে কুটিপাটি। লজ্জার চোটে পরপর ক’দিন ঘুম তাড়ানোর জন্য খুব মেহনত করল আদিত্য। করিডোরে হনহন পায়চারি, দারোয়ানের কাছ থেকে খৈনি, অফিস ছেড়ে ডালহাউসি পাড়ায় এলোমেলো চরকি, কিছুই বাদ দিল না। মরিয়া হয়ে লালদিঘিতে মাছ ধরা পার্টিদের পাশে বসে একদিন গল্পও জুড়তে চেষ্টা করেছিল। সিটে বসলেই আবার সেই ভুবনমোহিনী ঘুম! সেই ভুসভাস নাক ডাকা! শেষে মাইনেটা নিয়ে ধুৎতেরি বলে ছেড়ে দিল চাকরি, গোঁত খেয়ে ফিরে এল বাবার ব্যবসায়। চাকরির চিন্তাকে সেদিন থেকেই চিরবিদায়।
কিন্তু আজ অত সাধের ঘুমটি ভাঙতেও আদিত্য মোটেই খেপচুরিয়াস নয়। রঘুবীরের নাম মন্ত্রবত ক্রিয়া করেছে। তিতিরকে অবাক করে ধড়মড় উঠে বসল বিছানায়, রঘুবীর এসে গেছে। বসা, বসা। আমি এক্ষুনি আসছি।
তিতির হাঁ হয়ে বাবাকে দেখল দু পলক, তবে নীচে এসে লোকটার প্রতি মনোযোগী হওয়ার সুযোগ পেল না সে। বন্ধুরা দরজায়।
ঝুলনের পরনে ফ্যাকাসে নীল জিনস আর সাদা টিশার্ট। দেবস্মিতা হিয়া সালোয়ার কামিজ। তিনজনেই তিড়িংবিড়িং লাফাচ্ছে।
হিয়া ধমকের সুরে তাড়া লাগাল, –এই চল চল, ভীষণ দেরি হয়ে গেছে।
দেবস্মিতা হাত ঝাপটাল, ইশ, ফার্স্ট সিনটা মিস হলে আমি মরেই যাব। স্টার্টিং-এ দারুণ একটা গান আছে।
ঝুলন বলল, –তোর জন্যই তো দেরি হল! তুই ড্রেস করতে এত সময় নিলি! ম্যাচিং টিপ চাই! ম্যাচিং নেলপালিশ চাই!
-কী করব, ম্যাচিং মেকআপ ছাড়া বেরোলে দিদি যে ভীষণ ক্যাট ক্যাট করে!
–ইইহ, কী দিদির চামচি রে!
–যা বলেছিস। আহ্লাদী না আহ্লাদী!
–পরে ঝগড়া করিস। চল চল।
কোনওক্রমে বাবার বার্তাটুকু রঘুবীরকে ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল তিতির। বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার মজাই আলাদা। উল্টোপাল্টা ভাবনারা ফুড়ত করে উড়ে পালায়।
গ্রীষ্মদুপুরের ঝাঁঝকে তুড়ি মেরে চার বন্ধু ছুটছে হুড়মুড়িয়ে। দশ পা ছোটে, তিন পা হাঁটে, আবার ছোটে বিশ পা। জনহীন রাস্তায় কোত্থেকে এক সাইকেল রিকশা ঝুলনের দিকে ধেয়ে এল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দু চোখ টিপে বন্ধ করেছে ঝুলন, যেন না দেখতে পেলেই রিকশাটা হাওয়ায় ভ্যানিশ হয়ে যাবে! রাস্তার মধ্যিখানে ঝুলনের স্ট্যাচু দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছে বাকি তিনজন। হাসতে হাসতে সিনেমার তাড়া ভুলে গেল। হাসতে হাসতে হাসির ঝরনা হয়ে গেল চার টিনএজার।
সেই ঝরনা বয়েই চলেছে। বয়েই চলেছে। দুনিয়া জুড়ে এখন শুধু হাসি আর হাসি। চতুর্দিকে এত হাসির উৎসের মাঝে কী করে যে গোমড়া থাকে মানুষ!
ঘামে থসথস লোকটা কেমন হাঁটতে গিয়ে হাঁসফাস করছে দ্যাখ! হিহি। মাথায় আবার রঙিন লেডিজ ছাতা! হিহিহি। দ্যাখ দ্যাখ গলন্ত পিচে কুকুরটার পায়েও কেমন ছ্যাঁকা লাগছে! হি হি হি হি।
রাস্তা টপকে এক লাফে বাস স্টপে পৌঁছে গেল ঝুলন! মাঝপথে বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে হিয়া তিতির! হিহি। তিতির হিয়াকে সাহায্য করতে গাড়ির স্রোত রুখে দিল টিঙটিঙে ট্রাফিক পুলিশ! হিহি হিহি। এমা, দেবস্মিতা কিছুতেই পার হতে পারছে না। আবার একটা ইয়া বড় লরি। হিহি হিহি। হিয়া তিতির ঝুলন মিনিবাসের পাদানিতে, দেবস্মিতা হ্যান্ডেল ছুঁতেই ছেড়ে দিল বাসটা! হিহি হিহি! দেবস্মিতার জন্যই বাস আবার দাঁড়িয়ে গেছে হিহিহিহিহি। সদ্য কৈশোরোত্তীণা চার যাত্রিণী পেয়ে অন্যমনস্কতার ভনিতায় চুল সেট করে নিচ্ছে রুক্ষ-মুখ কন্ডাক্টার! হিহি। হেল্পারের গলা হঠাৎ হুবহু মিঠুন। হিহিহিহি। টিকিট কাটতে এসে কন্ডাক্টার জ্যাকি শ্রফের লুক দিচ্ছে! হিহি হিহি। অ্যাই অত হাসিস না, বাসসুদ্ধ সবাই দেখছে হাঁ করে! হিহি। সিনেমাহলের সামনে ভিড়, কী ভিড়! কত লোক টিকিট না পেয়ে কেমন কেবলুশ মুখে দাঁড়িয়ে আছে দ্যাখ! হিহি। অন্ধকার হলে লাইটম্যান সিটে আলো না ফেলে দেবস্মিতার মুখে টর্চ মেরে ফেলেছে! হিহিহিহি। সামনের রো-এর দুটো ছেলে তিতিরদের দেখতে পুরো একশো আশি ডিগ্রি ঘাড় ঘুরিয়ে ফেলল! আহা রে, ভেঙে না যায়! হিহিহি। অ্যাই বি সিরিয়াস! হিহি। চতুর্মুখী হাসির ফোয়ারাকে দাদু-স্বরে ধমক দিল এক আধবুড়ো! হিহিহিহি। তোরা হাসি থামাবি! হিহি। আমির খান গাছের আড়ালে চুমু খাচ্ছে জুহি চাওলাকে! চিমটি কাটছিস কেন! হিহি।
শো ভাঙার পর বহতা ঝরনা খানিক ধীর লয়ে ফিরল। ছবিটা ভালই ছিল, প্রচুর নাচগান আছে, পরিমিত মারপিট আছে, উদ্দাম প্রেমও আছে অনেক। শুধু শেষ দৃশ্যে নায়ক-নায়িকার জোড়া মৃত্যু একটু মনমরা করে দিয়েছে চারজনকে। নীরবে ভেলপুরি খেতে খেতে জুহি আমিরের শোকে মৌনতা পালন করছে চারজন।
দেবস্মিতা শোকার্ত স্বরে বলল, –আমির মরে গেছে আমি ভাবতেই পারি না।
হিয়া ভেলপুরি শেষ করে কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিল, তুই কি রে! খালি আমিরকেই দেখলি, জুহির ডেথটা বুঝি ডেথ নয়?
–আমির ইজ আমির। আমির সামনে থাকলে আমি আর কাউকে দেখিই না।
–এক কাজ কর, আমিরকে প্রোপোজ করে একটা চিঠি লিখে ফ্যাল।
–দুৎ, ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েও আছে।
–সো হোয়াট! আরেকটা করবে। ফিল্ম স্টাররা ইচ্ছে করলেই যটা খুশি বিয়ে করতে পারে।
তিতির বলল, –শুধু ফিল্মস্টার বলছিস কেন? বস্তিস্টাররাও পারে। আমাদের মিনতিদির বর তিনটে বিয়ে করেছে, সন্ধ্যার মা’র বর দুটো।
দেবস্মিতা ফোঁস করে শ্বাস ফেলল, ছেলেদের কী মজা রে! যা খুশি তাই করতে পারে।
হিয়া গোমড়া হয়ে গেল, -মেয়েরা করে না? একটার বেশি বিয়ে মেয়েরাও করতে পারে।
-সে তো ডিভোর্স করে। কথাটা বলে ফেলেই তিতির আড়ষ্ট হয়ে গেল। হিয়া কিছু মনে করল না তো?
হিয়ার মা বাবার বছর পাঁচেক হল ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। বাবা-মা’র সংঘর্ষের সময় হিয়া ভীষণ স্পর্শকাতর হয়ে গিয়েছিল। একটুতে কেঁদে ফেলত, একটুতে রেগে যেত, সামান্যতম হাসিঠাট্টাকেও বিদ্রূপ ভেবে অনর্থ করত বহু সময়ে। এখন অবশ্য হিয়া অনেকটা সামলে গেছে। বছর দুয়েক আগে আবার বিয়ে করেছে হিয়ার মা।
তিতিরের অপ্রস্তুত মুখ হিয়া খেয়ালই করেনি, ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, –ডিভোর্স করে বিয়ে করা তো আইন মেনে করা। এ ছাড়া কর্ডলাইন নেই? কত মেয়ে হাজব্যান্ডকে শিখণ্ডী খাড়া করে অন্যের সঙ্গে ম্যান অ্যান্ড ওয়াইফ লাইফ লিড করছে তার খবর রাখিস? এই মহিলারা তোদের ওই মিনতিদিদের বরগুলোর থেকে অনেক বেশি ডার্টি। আই হেট দেম। আই হেট দেম।
চকিত উত্তেজনায় হিয়ার শ্যামলা মুখে আঁধার নেমেছে। তিতির দেবস্মিতা থতমত চোখে দেখছিল হিয়াকে। হিয়ার বুকে আবার কোনও নতুন কাঁটা ফুটল কি?
ঝুলন খানিকটা তফাতে দাঁড়িয়েছিল, হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, –অ্যাই দ্যাখ দ্যাখ!
কী?
–এ দিকে নয়, তোদের পেছনে।
তিতির চমকে ঘুরল।
পাঁচ-ছ হাত দূরে ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে এক মোটরবাইক। বাইকে বসে তাদের দিকেই তাকিয়ে এক তরুণ! হলদে টিশার্ট! গলায় চেন! হাতে স্টিলের বালা!
.
১০.
ছেলেটার চোখে চোখ পড়তেই মুখ ঘুরিয়ে নিল তিতির।
দেবস্মিতা জিজ্ঞাসা করল, কে রে? তোর চেনা?
–চেনা নয়, চেনা হতে চায়। ঝুলন ছেলেটার দিক থেকে চোখ সরায়নি, মনে হয় আমাদের ওদিকেই থাকে।
-কী করে বুঝলি?
–দু দিন টিভি সেন্টারের সামনে আমার গায়ের কাছে এসে মোটর সাইকেল থামিয়েছে। একদিন ফলো করে আমাদের হাউজিং-এও ঢুকেছিল। আজ দেখছি এখানেও হাজির!
–তোর আবার বেশি বেশি! হয়তো এটা চান্স অকারেন্স। হয়তো ছেলেটা এমনিই সিনেমা দেখতে এসেছে।
–মোটেই না। আমাকে ফলো করেই এসেছে। আমার যেন এখন মনে হচ্ছে তখন ওকে ঢাকুরিয়া বাস স্ট্যান্ডেও দেখেছি। পেট্রল পাম্পের দিকটায় দাঁড়িয়েছিল।
তিতির হাঁ হয়ে শুনছিল। যখন সে বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে থাকে তখন অজস্র সিগনাল বিব বিব করে তার মাথায়। কী ঘটবে, কী ঘটছে তার একটা আগাম ইঙ্গিতও পেয়ে যায় সে। কিন্তু বাইরে বেরোলে সে কেমন যেন দিশেহারা হয়ে পড়ে। চারপাশের কে কাকে কিভাবে দেখছে, কখন দেখছে, কেন দেখছে–কিছুই গোচরে আসে না তার।
হিয়া এখন আবার স্বাভাবিক, ক্ষণকাল পূর্বের উত্তেজনার চিহ্নমাত্র নেই মুখেচোখে, ফিকফিক হাসছে সে। বলল, তুই তোর অর্ণবকে বল না, অর্ণব ওকে শুইয়ে দেবে।
গত বছর থেকে ঝুলন লেক গার্ডেন্সের একটা ক্লাবে ক্যারাটে শিখছে, অর্ণবের সঙ্গে তার সেখানেই পরিচয়। অর্ণব সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র, ক্যারাটেতে সদ্য ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছে, ঝুলনের সঙ্গে একটা নরম সরম সম্পর্কও গড়ে উঠেছে তার। তিতিররা সবাই জানে। ঝুলন নিজেই গল্প করেছে।
ঝুলন বলল, অর্ণব লাগবে না, ওই ছেলেকে আমি একাই হ্যান্ডেল করতে পারি। আমি শুধু ওর সাহসের লিমিটটা দেখতে চাইছি।
দেবস্মিতা বলল, –বি স্পোর্টিং ঝুলন। রাস্তাঘাটে এ রকম একটু আধটু হয়ই। ছেলেটার হয়তো তোকে খুব পছন্দ হয়েছে! হোয়াটস সো রঙ ইন ইট?
নাথিং রঙ। কিন্তু আপেল আঙুর দেখার মতো করে দেখবে কেন? দ্যাখ দ্যাখ চোখ দুটো দ্যাট। ঝুলন কাঁধ নাড়াল, ধরব নাকি?
তিতির শিউরে উঠল, ধরে?
–স্ট্রেট জিজ্ঞেস করব হোয়াট ডাজ হি এক্সপেক্ট? আ হিট? অর আ কিক?
দেবস্মিতা হেসে উঠল, –যদি বলে ফ্রেন্ডশিপ?
বন্ধু হতে চাইলে রাস্তায় ইরিটেট করবে কেন? আসবে, কথা বলবে, চলে যাবে। প্লেন অ্যান্ড সিম্পল।
ফোলা ফোলা গাল ছেলেটি এবারে বেশ উসখুস করছে। গম্ভীর মুখে দেখছে চারদিক। মাঝে মাঝে গভীর চিন্তামগ্ন ভঙ্গিতে পর্যবেক্ষণ করছে আকাশ। তারই ফাঁকে ঠারেঠোরে দেখে নিচ্ছে ঝুলনদেরও।
হিয়া ছেলেটাকে অপাঙ্গে দেখে নিল, না রে, এ শুধু ফ্রেন্ডশিপের কেস নয়, একটু ফকার ফ্রেন্ডশিপেরও ভাব আছে। তোকে নিয়ে ফ্লাই করতে চায়।
হিয়ার কথায় খিলখিল হেসে উঠেছে দেবস্মিতা ঝুলন। তিতিরও। হাসির তোড়ে রথে উপবিষ্ট রোমিও হকচকিয়ে গেছে। হঠাৎ কি ভেবে বাইকে স্টার্ট দিয়ে মানে মানে কেটে পড়ল ছোকরা।
ঝুলন বুড়ো আঙুল তুলল, –দেখলি! মরালি কত কাওয়ার্ড!
দেবস্মিতা বলল, -হেববি ভড়কি খেয়েছে।
–মনে পাপ আছে বলেই ভড়কি খেয়েছে। এই তো সেদিন দুটো ছেলে স্মার্টলি আমার সঙ্গে আলাপ করল, গোলপার্কে আমার সঙ্গে নামল, আমাকে কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়াল, আমরা অ্যাড্রেস এক্সচেঞ্জ করলাম, আমি ওদের বাড়িতেও ইনভাইট করেছি, বাপি মার কাছে ওদের গল্প বলেছি…
তিতিরের হৃৎপিণ্ড ধড়াস ধড়াস করছিল। ঝুলনের মতো করে তার ভাববার ক্ষমতাই নেই। তাদের পাশের নতুন ফ্ল্যাটবাড়ির একটা ছেলে খুব টেরিয়ে টেরিয়ে দেখে তাকে, বারান্দায় গিয়ে একটু দাঁড়ালেই সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটাও পাঁচতলার ব্যালকনিতে হাজির! ছেলেটাকে রাস্তায় ধরে তিতির কখনও জিজ্ঞাসা করতে পারবে, তুমি কী চাও? অসম্ভব। তিতির তখন বারান্দা থেকে সরে আসতে পারলে বাঁচে! কেউ যদি যেচে আলাপও করে তিতিরের সঙ্গে, তিতির কি ঝুলনের মতো করে কথা বলতে পারবে? কোল্ড ড্রিঙ্কস খাবে? সেই গল্প আবার বাড়িতে এসে বলবে মাকে! ওরে বাবারে!
বেলা পড়ে এল। একটা নরম হলুদ আলো ছড়িয়ে গেছে পথেঘাটে। এই আলোতে এখন কোনও কিছুই অসুন্দর নেই। মানুষের অসহ্য ভিড় না। যানবাহনের কর্কশ চিৎকারও না। কদর্য শহরের গায়ে সোনার কাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছে শেষ সূর্য।
হাঁটছে চার বন্ধু। ভিড় ঠেলে। হেলে দুলে।
হিয়া বলল, –এই আমাদের বাড়ি যাবি?
-এখন? ঝুলন ঘড়ি দেখল। তার বাবা আটটার আগে বাড়ি ফেরে না, মা’রও আজ অফিসে কি মিটিং আছে, ফিরতে দেরি হবে, একা বাড়িতে ভূতের মতো বসে থাকতে একটুও ভালবাসে না ঝুলন। অলস মেজাজে বলল, –তা যাওয়া যায়। গেলে কী খাওয়াবি?
-কী খাবি বল? ঠাম্মা আজকাল বাড়িতে দারুণ পিৎজা বানাচ্ছে। চিজ আর ক্যাপসিকাম দিয়ে। আজ বোধহয় ঠাম্মা কুলপিও বসিয়েছে।
কুলপির নামে ঝুলন এক পায়ে খাড়া।
দেবস্মিতা ক্ষীণ আপত্তি জানাল, –হিয়াদের বাড়ি গেলে দেরি হয়ে যাবে রে। তার চেয়ে আমাদের বাড়ি চল, আমাদের বাড়ি থেকে সবার বাড়ি সমান দূর।
ঝুলন মুখ বেঁকাল, –তোদের বাড়ি! সুস্মিতাদি এখন বাড়ি আছে না?
হুঁ। তা আছে।
–তা হলে বাবা আমি যাচ্ছি না। সুস্মিতাদি ধরলেই আবার লেখাপড়া নিয়ে জ্ঞান মারতে আরম্ভ করবে। কেন যে তোর দিদিটা জে এন ইউ থেকে ফিরল! হ্যাঁ রে তোর দিদিকে দিল্লি থেকে তাড়িয়ে দেয়নি তো?
দেবস্মিতা মিইয়ে গেল। সুস্মিতা তার থেকে সাত বছরের বড় হওয়ার সুবাদে এখনও তাদের নার্সারির মেয়ে মনে করে। জে এন ইউ থেকে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশানে এম এ করে দিন পনেরো হল কলকাতায় ফিরেছে। বাড়িতে এখন তার চরম দাপট। মর্ডান ফ্যাশান থেকে মর্ডান ওয়ার্ল্ড সবেতেই তার অগাধ পাণ্ডিত্য। মাধ্যমিকে সুস্মিতা থার্ড হয়েছিল, সুস্মিতাই দেবস্মিতার একমাত্র আদর্শ হওয়া উচিত এ কথা সকাল সন্ধে বাবা মার মুখ থেকে শুনতে হয় দেবস্মিতাকে। শুনতে হয় বন্ধুদের টিটকিরিও। নিজের দিদিটিকে নিয়ে যথেষ্ট হীনম্মন্যতায় ভোগে দেবস্মিতা।
তিতির বলল, তোরা যা রে, আমি যাব না।
হিয়া চোখ পাকাল, –কেন?
-মা বাড়ি ফিরে আমাকে না দেখলে হেভি রেগে যায়।
–বেশি খুকিপনা করিস না তো! আজ বাদে কাল হয়তো কলেজে ভর্তি হবি, এখনও এত ম্যা ম্যা কিসের?
ঝুলন বলল, চল না রে তিতির। রেজাল্ট বেরিয়ে গেলে আমরা কে কোথায় ছিটকে যাব তার ঠিক আছে! আর হয়তো এমন জমিয়ে আড্ডা মারাই হবে না।
তিতির দুর্বল হয়ে পড়ছিল, তবু দোটানা ভাবটা যাচ্ছিল না। ছোটবেলা থেকেই তার ওপর মার কড়া নির্দেশ, যেখানেই থাকো অন্ধকার হওয়ার আগে বাড়ি ফিরবে। আজ কি একবার ভাঙবে নিয়মটা?
ঠিক এই গোধূলি সন্ধের মুহূর্তে বাড়ির পরিস্থিতি কী রকম সেটাও মনশ্চক্ষে দেখে নিতে চাইল তিতির। ষণ্ডামার্কা দাড়িয়ালটা আছে, না গেছে? দাদুর যদি লোকটার সঙ্গে মোলাকাত হয়ে থাকে তা হলে নির্ঘাত বাবার সঙ্গে একটা ফাইটিং হয়ে গেছে। মির্জাপুরের দপ্তরিপাড়া হয়ে মা মানিকতলাতে যাবে আজ, ওখানে দাদুভাই-এর পায়ের চোট এখনও পুরোপুরি সারেনি, মা কি ফিরতে পারবে আটটার আগে? এত ভিড়, এত জ্যাম…!
পোস্তদানা মনটাকেও একবার টোকা দিয়ে দেখল তিতির। উঁহু, তিনি আজ নীরব। অর্থাৎ বড় কিছু ঘটছে না।
তিতির মনস্থির করে ফেলল। যাবে। মা তো তার কোনও কাজেই পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয় না, আজ নয় আরও একটু বকলই। দাদা তো রোজই দেরি করে ফেরে, সে না হয় একদিন…!
হিয়ার বাড়ি যাদবপুর স্টেশনের পুব দিকে। আট-দশ বছর আগেও এ অঞ্চলে একটা গ্রাম গ্রাম ভাব ছিল, এখন শহর এ দিকে দ্রুত পাখা মেলে দিয়েছে। প্রচুর হাল ফ্যাশানের বাড়ি, ফ্ল্যাটবাড়ি, দোকান বাজার আর মানুষে জমজমাট চারদিক। একটা লম্বা টানা ঝিল ছিল এখানে, এখন তার চারপাশ বাঁধিয়ে নাম হয়েছে লেক। লেক ছাড়িয়ে আরও কিছুদূর গেলে বাস মিনিবাসের স্ট্যান্ড। তার পাশেই হিয়াদের ছোট্ট একতলা বাড়ি। ছিমছাম। আধুনিক।
হিয়ার ঘরের দেওয়াল জুড়ে সার সার পোস্টার। সবই পুরুষ খেলোয়াড়দের। উইম্বলডন ট্রফি হাতে বরিস বেকার। বোলিং অ্যাকশনে কপিলদেব নিখঞ্জ। অডি গাড়ির বনেট ছুঁয়ে রবি শাস্ত্রী। গোঁফজোড়া হাসিতে কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত। ময়ূরনীল টিশার্টে হিম্যান ইমরান খান। কাঁধে বুট দিয়েগো মারাদোনা।
তিতির হিয়ার খাটে শুয়ে পোস্টারগুলো দেখছিল। যখনই আসে, দেখে। ইশ, তার যদি হিয়ার মতো একটা নিজস্ব ঘর থাকত! পোস্টারে পোস্টারে ঠিক ভরিয়ে ফেলত দেওয়াল।
তবে ওই সব ছবি নয়, তিতিরের পছন্দ অন্যরকম। ক্রিকেট ফুটবল টেনিস তিতির মাঝে মাঝে দেখে টিভিতে, দাদার সঙ্গে বসে, কিন্তু খেলাধুলোর মানুষরা তাকে তেমন টানে না। ফিল্মস্টারদের ছবিও দেওয়ালে ঝুলছে ভাবতে ভারি অস্বস্তি হয় তিতিরের। অন্ধকার ঘরে তিতির নিদ্রামগ্ন, দেওয়াল থেকে সার সার মানুষ অশরীরী আত্মার মতো দেখছে তাকে, দৃশ্যটা কল্পনা করলেই কী যে বেআব্রু লাগে নিজেকে! না, কোনও মানুষ নয়, তিতিরের দেওয়ালে থাকবে শুধু অপরূপ নিসর্গ। উত্তাল নায়াগ্রা জলপ্রপাত। সফেন প্রশান্ত মহাসাগর। অ্যামাজনের নিবিড় অরণ্য। সোনারঙ আদিগন্ত সাহারা। গম্ভীর হিমালয়।
আরও একটা ছবির খুব শখ আছে তিতিরের। গড়িয়াহাটের এক দোকানে দেখেছিল পোস্টারটা। বর্ণময় গোলাপক্ষেতের মাঝখানে ছোট্ট একখানা কাঠের দোতলা বাড়ি।
তিতিরের স্বপ্নের বাড়ি। তিতিরের স্বপ্নের বাগান। ছোট্ট শ্বাস পড়ল তিতিরের। দাদাটা যেন কী! একটুও শখ নেই পোস্টারের! সারাক্ষণ শুধু ঝ্যাং ঝ্যাং গান! দাদার শখ থাকলে সেই অজুহাতে তিতিরও তো কিছু ছবি সাঁটতে পারত দেওয়ালে!
দেবস্মিতাও বিছানায় গড়াচ্ছে। গজল আর পপ সঙ ঝুলনের ভীষণ প্রিয়, হিয়ারও, কোণের কাবার্ড থেকে হিয়ার ক্যাসেটগুলো বার করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে ঝুলন।
দেবস্মিতা ফিসফিস করে বলল, –অ্যাই তিতির, একটা জিনিস লক্ষ করেছিস?
-কী?
–হিয়ার টেবিলটা দ্যাখ। রনির আগের ছবিটা চেঞ্জ করে একটা কারেন্ট ছবি লাগানো হয়েছে।
হুঁ। রনিটা অনেক বড় হয়ে গেছে, না?
–হিয়ার মা’র সঙ্গে আমার একদিন মেট্রো রেলে দেখা হয়েছিল।
–তাই? কথা বলল তোর সঙ্গে?
-কেন বলবে না? সত্যি কথা বলতে কি আমিই প্রথমে চিনতে পারিনি। সেই কবে ফাইভ সিক্সে দেখেছি। মাসি আমাকে ডেকে খুব আদর করল, পড়াশুনোর কথা জিজ্ঞেস করল…।
রনি ছিল সঙ্গে?
–দেখলাম না তো। মাসি অফিস থেকে ফিরছিল বোধহয়।
–ভাবতে কেমন খারাপ লাগে না রে? মাসির কাছে রনি, মেসোর কাছে হিয়া, …এ ভাবে ছেলেমেয়ে ভাগাভাগি…
–হিয়া তো প্রত্যেক শনিবার যায় মাসির কাছে। রনিও এ বাড়িতে আসে। রবিবার। বাবা-মা’রা ডিভোর্স করেই খালাস, কষ্ট তো…। দেবস্মিতা কথাটা শেষ করতে পারল না, হিয়া বড় ট্রেতে অনেকগুলো কুলপি নিয়ে ঢুকেছে, পিছনে হিয়ার ঠাকুমা।
হিয়ার ঠাকুমার বয়স প্রায় সত্তর, দেখে যদিও ষাটের বেশি মনে হয় না। হাসিখুশি, কিন্তু ব্যক্তিত্বময়ী চেহারা। ঘরেও তাঁর সাজসজ্জা টিপটপ, কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরেন, পায়ে সর্বদা বাহারি চপ্পল।
দেবস্মিতা তিতির সামান্য অপ্রতিভ বোধ করছিল। এরা তাদের কথা কিছু শুনে ফেলেনি তো!
মধুর হেসে হিয়ার ঠাকুমা বললেন, আজ তো পিৎজা ব্রেড নেই রে ভাই। হিয়া যদি আগে বলে যেত…! তোরা ফ্রেঞ্চ টোস্ট খাবি?
ঝুলন লাফ দিয়ে একটা কুলপি তুলে নিল, –শুধু ফ্রেঞ্চ কেন ঠাম্মা? জার্মান ইটালিয়ান রাশিয়ান সব টোস্ট খেতে পারি।
দেবস্মিতা বলল, তুমি বানালে আমি ইডলিও খেতে রাজি ঠাম্মা। যদিও ওই খাদ্যটি আমার দু চক্ষের বিষ।
হিয়ার ঠাকুমা বললেন, –তুই কেন চুপ রে তিতিরপাখি?
অস্বচ্ছন্দ ভাব কেটে গেছে তিতিরের, তবু তিতির উত্তর দিল না, মৃদু হাসল শুধু। হিয়ার ঠাকুমাকে তিতিরের ভীষণ ভাল লাগে। তিনি কাছে এলেই অদ্ভুত এক শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয়ে পড়ে সে। ভদ্রমহিলা খুব অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। শ্বশুরবাড়ি বাপেরবাড়ি কারুর সাহায্য না নিয়ে একাই মানুষ করেছেন হিয়ার বাবা আর পিসিকে। সামান্য একটা প্রাইমারি স্কুলের চাকরি সম্বল করে। কত ঝড়ঝাপটা, কত অপবাদ গঞ্জনা সহ্য করে যে সেই দিনগুলো কেটেছিল, তার গল্প নিজেই তিনি শুনিয়েছেন তিতিরদের। অথচ একটি বারও অভাব অপমানের কথা তুলে খেদ জানাননি। কারুর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগও নেই তাঁর।
তিতির একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল, –আচ্ছা ঠাম্মা, তুমি কী করে হাসতে হাসতে ওই সব খেতে না পাওয়া দিনগুলোর গল্প বলো গো?
হিয়ার ঠাকুমা বলেছিলেন, দুর বোকা, এটাও বুঝতে পারলি না? দুঃখ কষ্টের দিন মানুষ যদি লড়াই করে পার করে দিতে পারে, তবে সেটাই হয়ে ওঠে মানুষের কাছে সব থেকে সুখের স্মৃতি।
-যাহ, কষ্টের দিন আবার সুখের স্মৃতি হয় নাকি?
–হয় রে হয়, লড়াই করে বেঁচে থাকাতেই তো জীবনের সুখ। যে জীবনে কোনও ওঠাপড়া নেই, উদ্বেগ দুশ্চিন্তা নেই, সে জীবন হল চেনে বাঁধা কুকুরের জীবন। ও তো পানসে।
নিজে নিজেই দেশবিদেশের অনেক রান্না শিখেছেন তিনি, সেলাই ফোঁড়াই-এর হাতটিও তাঁর ভারী চমৎকার। ছোটবেলায় হিয়ার সমস্ত জামা হিয়ার ঠাকুমাই তৈরি করে দিতেন। নতুন নতুন ডিজাইন দিয়ে। কোনওটা আমব্রেলা কাট, কোনওটাতে ঘন হাকোবা কাজ, কোনওটাতে শুধু ফ্রিল আর ফ্রিল। ছেলে-ছেলের বউ বিবাদ করে আলাদা হওয়ার পর তাঁর সবটুকু জুড়ে এখন শুধু হিয়া আর হিয়া। বাবার থেকেও ঠাকুমার সঙ্গে হিয়ার সম্পর্ক অনেক বেশি নিবিড়।
ঠাকুমা চলে গেছেন। ঝুলন একটার পর একটা কুলপি শেষ করে চলেছে, কচকচ করে তৃতীয়টা শেষ করার পর যখন চতুর্থটার দিকে হাত বাড়িয়েছে দেবস্মিতা ঝুলনের হাত চেপে ধরল, –অ্যাই কী হচ্ছে কী! তুই একাই সব খাবি নাকি?
ঝুলন দেবস্মিতার হাত সরিয়ে আর একটা কুলপি প্লেটে তুলল। গম্ভীর মুখে বলল, –এ দুটো আমি খাচ্ছি না, অর্ণব খাচ্ছে।
–মানে!
–অর্ণবটা এত কুলপি খেতে ভালবাসে, ওর নাম করে আমিই খেয়ে নিলাম।
উউউ, খুব যে প্রেম? এদিকে বাসে ট্রামে যে বন্ধু বাড়াচ্ছিস, অর্ণব রেগে যাবে না?
ঝুলন ভীষণ অবাক হল, –কেন, রাগবে কেন! ওরা তো এমনি বন্ধু নয়, ওরা তো মাউন্টেনিয়ার! শুশুনিয়াতে ট্রেনিং ক্যাম্প করে এসেছে। অক্টোবরে নেপাল যাবে, এভারেস্ট বেসক্যাম্পে ট্রেনিং করতে।
তিতির জোরে হেসে উঠল, –মাউন্টেনিয়ার বন্ধু হলে অর্ণব বুঝি জেলাস হবে না?
ঝুলন রেগে গেল, –অর্ণব জেলাস হলে আমার কী? কারা আমার বন্ধু হবে সে তো আমি ডিসাইড করব। তা ছাড়া অর্ণব জানেই তো আমি ও সব ডেঞ্জারাস স্পোর্টস কিরকম পছন্দ করি। ইনফ্যাক্ট আমি ঠিকই করে ফেলেছি হায়ার সেকেন্ডারির পর আমি মাউন্টেনিয়ারিং শিখব।
হিয়া এ বার খোঁচাচ্ছে ঝুলনকে, –পাহাড়ে উঠলে অর্ণব কিন্তু তোর হাত থেকে স্লিপ করে যাবে।
আমার তাতে কলা।
দেবস্মিতা কুলপি চুষতে চুষতে অশ্লীল ভঙ্গিতে চোখ টিপল, –কোথায় অর্ণবই পাহাড়-টাহাড় এক্সপ্লোর করবে, তার বদলে তুই..
–অ্যাই ভাল হবে না বলে দিচ্ছি। ঝুলন কটমট করে তাকাল।
হিয়া তবু খেপাচ্ছে, –হ্যাঁ রে ঝুলন, তুই যখন অর্ণবের সঙ্গে কথা বলিস কী ভাষায় ডায়ালগ চালাস রে? হুঃ হাঃ হুঃ। মানে আই লাভ ইউ? হাঃ হুঃ হাঃ। মানে আই হেট ইউ?
ঝুলনও হাসছে এতক্ষণে, –তোদের বলব কেন?
বলতে হবে না, জানি। ওদের খালি একটাই ভাষা, না রে তিতির?
কী বল তো?
–যে ভাষায় আমির খান জুহি চাওলার সঙ্গে কথা বলছিল। গাছের আড়ালে গিয়ে। ঠিক কি না?
উফ। আবার সিনেমাটার কথা মনে করিয়ে দিলি তো! দেবস্মিতা পাঁচমনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, –আমিরটা কেন মরে গেল রে? আমি আজ রাত্তিরে ঘুমোতেই পারব না।
স্টুপিডের মতো কথা বলিস না তো। সিনেমা ইজ সিনেমা। হিয়ার বেতের চেয়ারে গা ছড়িয়ে দিয়েছে ঝুলন, –তোর আমির খানও দেখগে যা নিজের ডেথ সিন দেখে হ্যা হ্যা করে হাসছে। আর ইনি এদিকে ফুলটুসির মতো ফোঁপাচ্ছেন! রিয়েল লাইফ আর সিনেমা এক নয়, এটা বুঝিস না?
রিয়েল লাইফে এ রকম হয় না বুঝি? তিতির দেবস্মিতার পক্ষ নিয়ে ফেলল, –রোজ কাগজে যে এত এত প্রেমের জন্য সুইসাইডের খবর পড়ি সেগুলো কি ফলস?
হিয়া পা তুলে বসল বিছানায়, –ফলস কে বলেছে? পৃথিবীটাতে কি বোকার কমতি আছে? প্রেম ইটসেলফ ইজ বোকামি।
–তার মানে রোমিও জুলিয়েট বোকা? হীর রনঝা বোকা? লায়লা মজনু বোকা? সিরি ফরহাদ বোকা?
–বোকা বললে বোকারাও লজ্জা পাবে। এরা হল বিশ্ব গাড়ল।
–যা বলেছিস। আমি তো বাবা ভাবতেই পারি না আমি একটা ছেলের সঙ্গে ট্রেন লাইনে গলা দিয়ে দিলাম! পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে পড়লাম! ওরে বাবাহ, কী জোর লাগবে রে। হাড় গুঁড়িয়ে যাবে!
তিতির ব্যথিত চোখে ঝুলনের দিকে তাকাল, অভিশাপ দিল মনে মনে। তুই যখন মাউন্টেনিয়ারিং শিখবি তখন এমনিই পড়ে হাড়গোড় ভাঙবে তোর। তোর কপালে বয়ফ্রেন্ড টিকতেই পারে না।
ফ্রেঞ্চ টোস্ট এসে গেছে। প্রেমের জন্য আত্মহত্যা ভুলে চার বন্ধু এক সঙ্গে লাফ দিয়েছে খাবারে। বয়সের ধর্ম মতোই এক কথা থেকে আরেক কথায় চলে যায় তারা। ঝরনা থেকে নদী হয়, নদী ফিরে ঝরনা। লাফিয়ে লাফিয়ে এক পাথর থেকে অন্য পাথরে যায়, আবার নামে সমতলে।
তিতির হঠাৎ প্রশ্ন করল, –এই আমাদের রেজাল্ট কামিং উইকেই বেরোচ্ছে নাকি রে?
দেবস্মিতা হাউমাউ করে উঠল, –ইশ, দিলি তো আড্ডাটা চৌপাট করে! আমি বলে কত কষ্টে পরীক্ষার কথাটা ভুলে আছি!
ঝুলন বলল, –তোর আবার চিন্তা কিসের? কোয়েশ্চেন পেয়ে পরীক্ষা দিতে বসেছিলি…
–মোটেই কোয়েশ্চেন পাইনি। মিথ্যে কথা।
–তোদের টিউটোরিয়ালে পরীক্ষার আগে যে সাজেশান দিয়েছিল তার থেকে নাইনটি পারসেন্ট অঙ্ক কমন আসেনি?
টিউটোরিয়ালে তো দেয়নি, অনিতা দিয়েছিল। ওর স্যার কোত্থেকে একটা সাজেশান পেয়েছিল সেটাই তো আমাকে… আমি কি জানতাম ওগুলোই পরীক্ষায় আসবে?
–তুই তো আমাদের সাজেশানটা দিসনি! সেলফিশ কোথাকার।
ঝুলনের কড়া কড়া কথা এতক্ষণ বেশ উপভোগ করছিল তিতির। পরীক্ষার আগের দিনই দেবস্মিতার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার অথচ দেবস্মিতা তখনও তাকে সাজেশানের কথা কিছু জানায়নি। সেই কোন নার্সারি থেকে এক সঙ্গে পড়ছে তারা, এতদিনের সঙ্গীদেরও ডিচ করল দেবস্মিতা, এই কি বন্ধুত্ব! তিতিরের ছোট কাকার কথাই ঠিক। ছোটকা বলে, বন্ধু পাওয়া এ জীবনে বড় কঠিন রে তিতির। যারা একটু ওপরে উঠে যায় তারা বন্ধুকে ভাবে চামচা। যারা একটু নীচে পড়ে থাকে তারা ভাবে বন্ধু তাকে চালবাজি দেখাচ্ছে। আর যারা সমান সমান, তারা তো কখনওই বন্ধু নয়। তারা সবাই রেসের ঘোড়া। চান্স পেলেই বন্ধুকে ল্যাং মেরে ট্র্যাক থেকে বার করে দেয়।
ঝুলন চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ করেই চলেছে। দুর্বল ঢালের আড়াল থেকে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দেবস্মিতা। হিয়া তিতিরকে থামানোর চেষ্টা করল বার কয়েক, পারছে না। হাল ছেড়ে দুজনেই বসে রইল চুপচাপ। দেবস্মিতা যখন তার তূণ থেকে কান্নার ব্রহ্মাস্ত্র প্রায় বার করে ফেলেছে, তখনই হিয়ার ঠাকুমা ঢুকলেন ঘরে। তাঁকে দেখে ঝুলন দেবস্মিতা উচ্চগ্রামে তাদের অভিযোগ জানাতে শুরু করেছে। একটি বর্ণও বোধগম্য হচ্ছিল না হিয়ার ঠাকুমার। দু হাতে কান চাপা দিয়ে বললেন, ওরে চুপ কর চুপ কর, এরপর তো আমি কালা হয়ে যাব।
দুজনেই ক্রোধে রক্তবর্ণ, দুজনেরই নাসারন্ধ্র ফুরিত, দুজনেই ফুঁসছে বিজাতীয় বিদ্বেষে।
হিয়ার ঠাকুমা বললেন, বুঝতে পারছি তোদের পরীক্ষা নিয়ে কোনও ঝগড়া হচ্ছে।
তিতির কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, আমারই ভুল হয়েছে। আমি রেজাল্টের কথাটা না তুললেই পারতাম!
–এই তো সবে জীবনের প্রথম পরীক্ষাটা দিয়েছিস, এখনই তোরা মারপিট করে মরছিস? এরপর বাকি জীবনটা কী করবি?
ঘরের ভারী আবহাওয়া ক্রমে শীতল হয়ে আসছে। হিয়ার ঠাকুমা স্নিগ্ধ গলায় বললেন, হ্যাঁ রে মেয়েরা, তোরা যে পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে ঝগড়া করছিস, জীবনে কে কি হতে চাস তাই নিয়ে কিছু ভেবেছিস?
কেউ কোনও রা কাড়ছে না, অগত্যা হিয়াই বরফ ভাঙল, তুমি তো জানই আমি ডাক্তার হতে চাই।
-থাম তো। ঠাকুমা স্নেহের ধমক দিলেন, তুই হবি ডাক্তার! এখনও কারুর আঙুল কেটে গেলে ঘর থেকে পালাস! ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ দেখলে চোখ বুজে বসে থাকিস! মরা আরশোলা দেখলেও ভয়ে সিঁটিয়ে যাস! তুই যদি ডাক্তার হোস তা হলেই হয়েছে!
হিয়া লজ্জায় অধোবদন। রাগ ঝগড়া দুঃখ ভুলে হিহি হাসছে বাকি তিনজন।
ঝুলন শিশুর মতো হাত তুলল, আমি এক্সপ্লোরার হব ঠাকুমা।
-কী আবিষ্কার করবি?
হিমালয়েই কত অজানা জায়গা পড়ে আছে।
–তোর বাবা মা তোকে ছাড়বে? তাদের একমাত্র মেয়ে তুই!
বাপি একটু ক্যাচোর-ম্যাচোর করবে, আমাকে ছেড়ে বাপি থাকতেই পারে না। মা নো প্রবলেম। নিজেই তো ক’দিন আগে অফিস কলিগদের সঙ্গে ট্রেকিং করে এল মা।
ঠাকুমা দেবস্মিতার দিকে তাকালেন, –তুই তো এদের মধ্যে লেখাপড়ায় সব থেকে ভাল, তুই কী হবি?
দেবস্মিতা একটু ভেবে বলল, –দিদি বলছিল আমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া উচিত।
–দিদির কথা ছাড়, তোর নিজের কী ইচ্ছে বল?
দেবস্মিতা মাথা চুলকোল, বাবার ইচ্ছে হায়ার সেকেন্ডারির পর আমি জেনারেল স্ট্রিমে যাই। ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রি নিয়ে এম এসসি করে তারপর রিসার্চ।
–আর তোর মা’র কী ইচ্ছে?
বাবার যা ইচ্ছে, মা’রও তাই।
হিয়ার ঠাকুমা বালিকার মতো হেসে উঠলেন, ওরে মেয়ে, আমি তোর ইচ্ছের কথা জিজ্ঞেস করছি।
দেবস্মিতা মাথা চুলকেই চলেছে। চুলকেই চলেছে।
তিতিরও মনে মনে উত্তর খুঁজছিল। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে সে তেমন করে এখনও কিছু ভাবেইনি। আচ্ছা, নান হলে কেমন হয়? তাদের স্কুলের সিস্টারদের মতো? সিস্টার ভেরোনিকা! সিস্টার সুজান! সিস্টার অ্যানিস! সিস্টার সুজান যখন স্কুলের চ্যাপেলে বাইবেল পড়েন, কী অপূর্ব স্বর্গীয় সুষমায় ভরে যায় শান্ত হলঘরটা! সিস্টারের লম্বা সাদা পোশাক থেকে অদ্ভুত এক জ্যোতি বেরোয় তখন! এক পবিত্র আলোকবলয়!
মনের সাধ মুখ ফুটে প্রকাশ করতেই বন্ধুরা হিহি করে হাসছে। ঝুলন হিয়াকে চিমটি কেটে গড়িয়ে পড়ল বিছানায়।
হিয়ার ঠাকুমা তীক্ষ্ণ চোখে দেখছেন তিতিরকে, –এই বয়সে এত বৈরাগ্য কেন রে?
না…মানে…
–নান হওয়া কত কঠিন জানিস? নিজের সব সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দিতে হয়। এ কাজ ঝুলনের এক্সপ্লোরার হওয়ার থেকে অনেক অনেক বেশি কঠিন। এ তো শুধু পাহাড় সমুদ্র জয় করা নয়, এ হল নিজের ভেতরের প্রকৃতিকে জয় করা। জাগতিক কামনা বাসনা লোভ ক্রোধ সব কিছুকে নিজের বশে আনা। এ কাজ পারবি তুই?
বাড়ি ফেরার পথেও হিয়ার ঠাকুমার কথাগুলো কানে বাজছিল তিতিরের। সদরের সামনে এসে সব চিন্তা উবে গেল। প্রথম দিন বেপরোয়া হতে গিয়ে নটা বেজে গেছে প্রায়, না জানি মা আজ কতটা রগড়াবে!
নাহ, পবিত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষার গুণ আছে। অনেক দিন পর তিতিরের পিসি এসেছে বাড়িতে, জোর গজল্লা চলছে দাদুর ঘরে। পরশু রাত্রে পিসিদের পাড়ায় একটা লোমহর্ষক চুরি হয়ে গেছে তারই সবিস্তার ব্যাখ্যান করছে পিসি, মা আর কাকিমা মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে শুনছে সেই কাহিনী। অ্যাটমেরও উত্তেজনায় চোখ বড় বড়। দাদুই একমাত্র চোখ বুজে নির্বিকার।
তিতিরকে কেউ খেয়ালই করল না। ইন্দ্রাণীও না। এ যাত্রা পার পেয়ে গেল তিতির। জুড়ে গেল গল্পগাছায়।
নিশুত রাতে আজব এক স্বপ্ন দেখল তিতির। স্কুলের চ্যাপেলে বুক উঁচু ডেস্কের পিছনে দাঁড়িয়ে তিতির বাইবেল পাঠ করছে। পরনে শ্বেতশুভ্র ক্রিশ্চান সন্ন্যাসিনীর সাজ। কিন্তু কণ্ঠস্বরটা তার নয়, সিস্টার সুজানের। সামনে বসা অসংখ্য বাচ্চা বাচ্চা মেয়ে সুর করে গেয়ে উঠল,
–আওয়ার ফাদার হুইচ আর্ট ইন হেভেন
হ্যালোয়েড বি দাই নেম,
দাই কিংডম কাম, দাই উইল বি ডান
অ্যাজ আর্থ অ্যাজ ইট ইজ ইন হেভেন…
প্রার্থনাসঙ্গীতের সঙ্গে একটা সেতার ঝঙ্কৃত হয়ে চলেছে। কখনও ক্ষীণ হয়ে আসে বাজনা, কখনও জোর। কিন্তু বেজেই চলেছে।
হঠাৎই গানের সুর ছিঁড়ে খুঁড়ে চ্যাপেলের দরজায় ধাক্কা মারছে একটা লোক, ভিখিরির মতো চেহারা। শতচ্ছিন্ন জামাকাপড়। উসকো-খুসকো চুল।
নেশার ঝোঁকে টলছে লোকটা!
লোকটার মুখ দেখতে পাচ্ছিল না তিতির। বড় আবছা সব কিছু। সহসা চেঁচিয়ে উঠেছে মলিন আগন্তুক, –তিতির ফিরে আয়। তিতির ফিরে আয়।
বাবা!
ঝপ করে ঘুম ভেঙে গেল। তিতির অন্ধকারে চোখ খুলেছে। স্কুল নেই, চ্যাপেল নেই, মলিন আগন্তুকও নেই। শুধু বাজনার ঝঙ্কারটা রয়ে গেছে, মথিত করছে নিবিড় রাত্রিকে।
বেশ কয়েক সেকেন্ড পর তিতির বুঝতে পারল। অনেক দিন পর মাঝরাতে সেতার বাজাচ্ছে ছোটকা।
রাতবাতির নীলচে আলোয় ভরে আছে নিশীথকক্ষ। পাখার হাওয়া ঘরময় চরকি খেয়ে মরছে। ছবিহীন ক্যালেন্ডার ছপছপ শব্দ তুলছে দেওয়ালে। রাত্রি এখন বড় শূন্য, অতি বিশাল।
শূন্যতাকে আরও শূন্য করে সেতারে মীড় টানছে কন্দর্প। যেন মীড় নয়, যন্ত্রণায় কেঁপে কেঁপে উঠছে বাড়িটা। তিতিরও।
খানিক পরে চোখ মুছে পাশ ফিরল তিতির। ফিরেই চমকেছে। মা জেগে আছে! মার চোখ কড়িবরগার দিকে স্থির।