দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
১৮৮২, ২৭শে অক্টোবর
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়, নবানি গৃহ্ণাতি নরোঽপরাণি ৷
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যান্যানি সংযাতি নবানি দেহী ৷৷
[গীতা — ২/২২]
সমাধিমন্দিরে — আত্মা অবিনশ্বর — পওহারী বাবা
নৌকা আসিয়া লাগিল। সকলেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখিবার জন্য ব্যস্ত। ভিড় হইয়াছে। ঠাকুরকে নিরাপদে নামাইবার জন্য কেশব শশব্যস্ত হইলেন। অনেক কষ্টে হুঁশ করাইয়া ঘরের ভিতর লইয়া যাওয়া হইতেছে। এখনও ভাবস্থ — একজন ভক্তের উপর ভর দিয়া আসিতেছেন। পা নড়িতেছে মাত্র। ক্যাবিনঘরে প্রবেশ করিলেন। কেশবাদি ভক্তেরা প্রণাম করিলেন, কিন্তু কোন হুঁশ নাই। ঘরের মধ্যে একটি টেবিল, খানকতক চেয়ার। একখানি চেয়ারে ঠাকুরকে বসানো হইল, কেশব একখানিতে বসিলেন। বিজয় বসিলেন। অন্যান্য ভক্তেরা যে যেমন পাইলেন, মেঝেতে বসিলেন। অনেক লোকের স্থান হইল না। তাঁহারা বাহির হইতে উঁকি মারিয়া দেখিতেছেন। ঠাকুর বসিয়া আবার সমাধিস্থ। সম্পূর্ণ বাহ্যশূন্য! সকলে একদৃষ্টে দেখিতেছেন।
কেশব দেখিলেন, ঘরের মধ্যে অনেক লোক, ঠাকুরের কষ্ট হইতেছে। বিজয় তাঁহাকে ত্যাগ করিয়া গিয়া সাধারণ ব্রাহ্মসমাজভুক্ত হইয়াছেন ও কন্যার বিবাহ ইত্যাদি কার্যের বিরুদ্ধে অনেক বক্তৃতা দিয়াছেন, তাই বিজয়কে দেখিয়া কেশব একটু অপ্রস্তুত। কেশব আসন ত্যাগ করিয়া উঠিলেন, ঘরের জানালা খুলিয়া দিবেন।
ব্রাহ্মভক্তেরা একদৃষ্টে চাহিয়া আছেন। ঠাকুরের সমাধি ভঙ্গ হইল। এখনও ভাব পূর্ণমাত্রায় রহিয়াছে। ঠাকুর আপনা-আপনি অস্ফুটস্বরে বলিতেছেন, “মা, আমায় এখানে আনলি কেন? আমি কি এদের বেড়ার ভিতর থেকে রক্ষা করতে পারব?”
ঠাকুর কি দেখিতেছেন যে, সংসারী ব্যক্তিরা বেড়ার ভিতরে বদ্ধ, বাহিরে আসিতে পারিতেছে না, বাহিরের আলোকও দেখিতে পাইতেছে না — সকলের বিষয়কর্মে হাত-পা বাঁধা। কেবল বাড়ির ভিতরের জিনিসগুলি দেখিতে পাইতেছে আর মনে করিতেছে যে, জীবনের উদ্দেশ্য কেবল দেহ-সুখ ও বিষয়কর্ম, কামিনী ও কাঞ্চন? তাই কি ঠাকুর এমন কথা বলিলেন, “মা আমায় এখানে আনলি কেন? আমি কি এদের বেড়ার ভিতর থেকে রক্ষা করতে পারব?”
ঠাকুরের ক্রমে বাহ্যজ্ঞান হইতেছে। গাজীপুরের নীলমাধববাবু ও একজন ব্রাহ্মভক্ত পওহারী বাবার কথা পাড়িলেন।
একজন ব্রাহ্মভক্ত (ঠাকুরের প্রতি) — মহাশয়, এঁরা সব পওহারী বাবাকে দেখেছেন। তিনি গাজীপুরে থাকেন। আপনার মতো আর-একজন।
ঠাকুর এখনও কথা কহিতে পারিতেছেন না। ঈশৎ হাস্য করিলেন।
ব্রাহ্মভক্ত (ঠাকুরের প্রতি) — মহাশয়, পওহারী বাবা নিজের ঘরে আপনার ফটোগ্রাফ রেখে দিয়েছেন।
ঠাকুর ঈষৎ হাস্য করিয়া, নিজের দেহের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলেন, ‘খোলটা’!