ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – হোসেন শাহী বংশ
১
আলাউদ্দীন হোসেন শাহ
বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে আলাউদ্দীন হোসেন শাহের নামই সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত। ইহার অনেকগুলি কারণ আছে। প্রথমত, আলাউদ্দীন হোসেন শাহের রাজ্যের আয়তন অন্যান্য সুলতানদের রাজ্যের তুলনায় বৃহত্তর ছিল। দ্বিতীয়ত, বাংলার অন্যান্য সুলতানদের তুলনায় হোসেন শাহের অনেক বেশি ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন (অর্থাৎ গ্রন্থাদিতে উল্লেখ, শিলালিপি প্রভৃতি) মিলিয়াছে। তৃতীয়ত, হোসেন শাহ ছিলেন চৈতন্যদেবের সমসাময়িক এবং এইজন্য চৈতন্যদেবের নানা প্রসঙ্গের সহিত হোসেন শাহের নাম যুক্ত হইয়া বাঙালীর স্মৃতিতে স্থান লাভ করিয়াছে।
কিন্তু এই বিখ্যাত নরপতি সম্বন্ধে প্রামাণিক তথ্য এ পর্যন্ত খুব বেশি জানতে পারা যায় নাই। তাঁহার ফলে অধিকাংশ লোকের মনেই হোসেন শাহ সম্বন্ধে যে ধারণার সৃষ্টি হইয়াছে, তাঁহার মধ্যে সত্য অপেক্ষা কল্পনার পরিমাণই অধিক। সুতরাং হোসেন শাহর ইতিহাস যথাসম্ভব সঠিকভাবে উদ্ধারের জন্য একটু বিস্তৃত আলোচনা আবশ্যক।
মুদ্রা, শিলালিপি এবং অন্যান্য প্রামাণিক সূত্র হইতে জানা যায় যে, হোসেন শাহ সৈয়দ বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং তাঁহার পিতার নাম সৈয়দ আশরফ অল-হোসেনী। ‘রিয়াজ’-এর মতে হোসেন শাহের পিতা তাঁহাকে ও তাঁহার ছোট ভাই য়ুসুফকে সঙ্গে লইয়া তুর্কিস্থানের তারমুজ শহর হইতে বাংলায় আসিয়াছিলেন এবং রাঢ়ের চাঁদপুর (বা চাঁদপাড়া) মৌজায় বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন; সেখানকার কাজী তাঁহাদের দুই ভাইকে শিক্ষা দেন এবং তাঁহাদের উচ্চ বংশমর্যাদার কথা জানিয়া হোসেনের সহিত নিজের কন্যার বিবাহ দেন। স্টুয়ার্টের মতে হোসেন আরবের মরুভূমি হইতে বাংলায় আসিয়াছিলেন। একটি কিংবদন্তী প্রচলিত আছে যে হোসেন বাল্যকালে চাঁদপাড়ায় এক ব্রাহ্মণের বাড়ীতে রাখালের কাজ করিতেন; বাংলার সুলতান হইয়া তিনি ঐ ব্রাহ্মণকে মাত্র এক আনা খাজনায় চাঁদপাড়া গ্রামখানি জায়গীর দেন; তাঁহার ফলে গ্রামটি আজও পর্যন্ত একানী চাঁদপাড়া নামে পরিচিত; হোসেন কিন্তু কিছুদিন পর তাঁহার বেগমের নিবন্ধে ঐ ব্রাহ্মণকে গোমাংস খাওয়াইয়া তাঁহার জাতি নষ্ট করিয়াছিলেন। এই সমস্ত কাহিনীর মধ্যে কতখানি সত্য আছে, তাহা বলা যায় না। তবে চাঁদপুর বা চাঁদপাড়া গ্রামের সহিত হোসেন শাহের সম্পর্কের কথা সত্য বলিয়া মনে হয়, কারণ এই অঞ্চলে তাঁহার বহু শিলালিপি পাওয়া গিয়াছে।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁহার ‘‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ (মধ্যলীলা, ২৫শ পরিচ্ছেদ) লিখিয়াছেন যে, রাজা হইবার পূর্বে সৈয়দ হোসেন “গৌড়-অধিকারী” (বাংলার রাজধানী গৌড়ের প্রশাসনের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী) সুবুদ্ধি রায়ের অধীনে চাকুরী করিতেন; সুবুদ্ধি রায় তাঁহাকে এক দীঘি কাটানোর কাজে নিয়োগ করেন এবং তাঁহার কার্যে ত্রুটি হওয়ায় তাঁহাকে চাবুক মারেন; পরে সৈয়দ হোসেন সুলতান হইয়া সুবুদ্ধি রায়ের পদমর্যাদা অনেক বাড়াইয়া দেন; কিন্তু তাঁহার বেগম একদিন তাঁহার দেহে চাবুকের দাগ আবিষ্কার করিয়া সুবুদ্ধি রায়ের চাবুক মারার কথা জানিতে পারেন এবং সুবুদ্ধি রায়ের প্রাণবধ করিতে সুলতানকে অনুরোধ জানান। সুলতান তাহাতে সম্মত না হওয়ায় বেগম সুবুদ্ধি রায়ের জাতি নষ্ট করিতে বলেন। হোসেন শাহ তাহাতেও প্রথমে অনিচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন, কিন্তু স্ত্রীর নির্বন্ধাতিশয্যে অবশেষে সুবুদ্ধি রায়ের মুখে করোয়ার (বদনার) জল দেওয়ান এবং তাঁহার ফলে সুবুদ্ধি রায়ের জাতি যায়।
এই বিবরণ সত্য বলিয়াই মনে হয়, কারণ কৃষ্ণদাস কবিরাজ দীর্ঘকাল বৃন্দাবনে হোসেন শাহের অমাত্য এবং সুবুদ্ধি রায়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু রূপ-সনাতনের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করিয়াছিলেন। সুবুদ্ধি রায়ও স্বয়ং শেষজীবনে বহুদিন বৃন্দাবনে বাস করিয়াছিলেন, সুতরাং কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁহারও সহিত পরিচিত ছিলেন বলিয়া মনে হয়। অতএব কৃষ্ণদাস যে পূর্ব্বোক্ত কাহিনী কোন প্রামাণিক সূত্র হইতেই সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই।
পর্তুগীজ ঐতিহাসিক জোআঁ-দে-বায়োস তাঁহার ‘দা এসিয়া’ গ্রন্থে লিখিয়াছেন যে পর্তুগীজদের চট্টগ্রামে আগমনের একশত বৎসর পূর্বে একজন আরব বণিক দুইশত জন অনুচর লইয়া বাংলায় আসিয়াছিলেন; নানা রকম কৌশল করিয়া তিনি ক্রমশ বাঙলার সুলতানের বিশ্বাসভাজন হন ও শেষপর্যন্ত তাঁহাকে বধ করিয়া গৌড়ের সিংহাসন অধিকার করেন। কেহ কেহ মনে করেন যে, এই কাহিনী হোসেন শাহ সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। কিন্তু জোআঁ-দে-বারোস ঐ আরব বণিকের যে সময় নির্দেশ করিয়াছেন, তাহা হোসেন শাহের সময়ের একশত বৎসর পূর্ববর্তী।
যাহা হউক, হোসেন শাহের পূর্ব-ইতিহাস অনেকখানি রহস্যাবৃত। কয়েকটি বিবরণে খুব জোর দিয়া বলা হইয়াছে যে তিনি বিদেশ (আরব বা তুর্কিস্তান) হইতে আসিয়াছিলেন, কিন্তু এ সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না। কোন কোন মতে হোসেন শাহ বিদেশাগত নহেন, তিনি বাংলা দেশেই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। ফ্রান্সিস বুকাননের মতে হোসেন রংপুরের বোদা বিভাগের দেবনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। হোসেন শাহের মাতা যে হিন্দু ছিলেন, এইরূপ কিংবদন্তীও প্রচলিত আছে। বাবর তাঁহার আত্মজীবনীতে হোসেন শাহের পুত্র নসরৎ শাহকে “নরসৎ শাহ বঙ্গালী’ বলিয়াই উল্লেখ করিয়াছেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘‘চৈতন্যচরিতামৃত এবং কবীন্দ্র পরমেশ্বরের মহাভারতে ইঙ্গিত করা হইয়াছে যে, হোসেন শাহের দেহ কৃষ্ণবর্ণ ছিল। এই সমস্ত বিষয় হইতে মনে হয়, হোসেন শাহ বিদেশী ছিলেন না, তিনি বাঙালীই ছিলেন; যে সমস্ত সৈয়দ-বংশ বাংলা দেশে বহু পুরুষ ধরিয়া বাস করিয়া আসিতেছিল, সেইরূপ একটি বংশেই তিনি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।
সিংহাসন লাভের অব্যবহিত পূর্বে হোসেন শাহ হাবশী সুলতান মুজাফফর শাহের উজীর ছিলেন বিভিন্ন ইতিহাসপ্রন্থে ও বাবরের আত্মজীবনীতে এ কথা উল্লিখিত হইয়াছে, ইহার সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই। ইতিহাসগ্রন্থগুলির মতে মুজাফফর শাহের উজীর থাকিবার সময় হোসেন একদিকে তাঁহাকে বৈধ অবৈধ নানাভাবে অর্থ সংগ্রহের পরামর্শ দিতেন ও অপর দিকে তাঁহার বিরুদ্ধে প্রচার করিতেন; ইহা খুবই নিন্দনীয়। যে ভাবে হোসেন প্রভুকে বধ করিয়া রাজা হইয়াছিলেন, তাঁহারও প্রশংসা করা যায় না। তবে মুজাফফর শাহও তাঁহার প্রভুকে হত্যা করিয়া রাজা হইয়াছিলেন। সেই জন্য তাঁহার প্রতি হোসেনের এই আচরণকে “শঠে শাঠ্যং সমাচরয়েৎ” নীতির অনুসরণ বলিয়া ক্ষমা করা যায়।
মুদ্রা ও শিলালিপির সাক্ষ্য হইতে জানা যায় যে, হোসেন শাহ ১৪৯৩ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর হইতে ১৯৯৪ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসের মধ্যে কোন এক সময়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সিংহাসনে আরোহণের সময় যে তাঁহার যথেষ্ট বয়স হইয়াছিল, সে সম্বন্ধে অনেক প্রমাণ আছে।
বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থের মতে মুজাফফর শাহের মৃত্যুর পরে প্রধান অমাত্যেরা একত্র সমবেত হইয়া হোসেনকে রাজা হিসাবে নির্বাচিত করেন। তবে, ‘ফিরিশতা’ ও ‘রিয়াজ’-এর মতে হোসেন শাহ অমাত্যদিগকে লোভ দেখাইয়া রাজপদ লাভ করিয়াছিলেন। হোসেন অমাত্যদিগকে বলিয়াছিলেন যে তাঁহারা যদি তাহাকে রাজপদে নির্বাচন করেন, তবে তিনি গৌড় নগরের মাটির উপরের সমস্ত ধন সম্পত্তি তাহাদিগকে দিবেন এবং মাটির নীচে লুকানো সব সম্পদ তিনি নিজে লইবেন। অমাত্যেরা এই সর্তে সম্মত হইয়া তাহাকে রাজা করেন এবং গৌড়ের মাটির উপরের সম্পত্তি লুঠ করিয়া লইতে থাকেন; কয়েক দিন পরে হোসেন শাহ তাঁহাদিগকে লুঠ বন্ধ করিতে বলেন; তাঁহারা তাহাতে রাজী না হওয়ায় হোসেন বারো হাজার লুণ্ঠনকারীকে বধ করেন; তখন অন্যেরা লুঠ বন্ধ করে; হোসেন নিজে কিন্তু গৌড়ের মাটির নীচের সম্পত্তি লুঠ করিয়া হস্তগত করেন; তখন ধনী ব্যক্তিরা সোনার থালাতে খাইতেন; হোসেন এইরূপ তেরশত সোনার থালা সমেত বহু গুপ্তধন লাভ করিলেন।
এই বিবরণ সত্য হইলে বলিতে হইবে হোসেন শাহ সিংসাহনে আরোহণের সময় নানা ধরনের ক্রুর কুটনীতি ও হীন চাতুরীর আশ্রয় লইয়াছিলেন।
বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থের মতে হোসেন রাজা হইয়া অল্প সময়ের মধ্যেই রাজ্যে পরিপূর্ণ শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করেন। এ কথা সত্য, কারণ সমসাময়িক সাহিত্য হইতে ইহার সমর্থন পাওয়া যায়। ইতিহাসগ্রন্থগুলির মতে ইতিপূর্বে বিভিন্ন সুলতানের হত্যাকাণ্ডে যাহারা প্রধান অংশ গ্রহণ করিয়াছিল, সেই পাইকদের দলকে হোসেন শাহ ভাঙিয়া দেন এবং প্রাসাদ রক্ষার জন্য অন্য রক্ষিদল নিযুক্ত করেন; হাবশীদের তিনি তাঁহার রাজ্য হইতে একেবারে বিতাড়িত করেন; তাহারা গুজরাট ও দক্ষিণ ভারতে চলিয়া গেল; হোসেন সৈয়দ, মোগল ও আফগানদের উচ্চপদে নিয়োগ করিলেন।
হোসেন শাহের সিংহাসনে আরোহণের প্রায় দুই বৎসর পরে (১৪৯৫ খ্রী) জৌনপুরের রাজ্যচ্যুত সুলতান হোসেন শাহ শর্কী দিল্লির সুলতান সিকন্দর শাহ লোদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন এবং পরাজিত হইয়া বাংলায় পলাইয়া আসেন। বাংলার সুলতান হোসেন শাহ তাঁহাকে আশ্রয় দেন। ইহাতে ক্রুদ্ধ হইয়া সিকন্দর লোদী বাংলার সুলতানের বিরুদ্ধে একদল সৈন্য প্রেরণ করিলেন। হোসেন শাহও তাঁহার পুত্র দানিয়েলের নেতৃত্বে এক সৈন্যবাহিনী পাঠাইলেন। উভয় বাহিনী বিহারের বাঢ় নামক স্থানে পরস্পরের সম্মুখীন হইয়া কিছুদিন রহিল, কিন্তু যুদ্ধ হইল না। অবশেষে দুই পক্ষের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হইল। এই সন্ধি অনুসারে দুই পক্ষের অধিকার পূর্ববৎ রহিল এবং হোসেন শাহ সিকন্দর লোদীকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে সিকন্দরের শত্রুদের তিনি ভবিষ্যতে নিজ রাজ্যে আশ্রয় দিবেন না। সিকন্দরও হোসেনকে অনুরূপ প্রতিশ্রুতি দিলেন। ইহার পর সিকন্দর লোদী দিল্লিতে ফিরিয়া গেলেন। দিল্লির পরাক্রান্ত সুলতানের সহিত সংঘর্ষের এই সম্মানজনক পরিণাম হোসেন শাহের পক্ষে বিশেষ গৌরবের বিষয়, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।
হোসেন শাহ তাঁহার রাজত্বের প্রথম বৎসর হইতেই মুদ্রায় নিজেকে “কামরূপ-কামতা-জাজনগর-উড়িষ্যা-বিজয়ী” বলিয়া অভিহিত করিতে এবং এই রাজ্যগুলি বিজয়ের সক্রিয় চেষ্টা করিতে থাকেন। কয়েক বৎসরের চেষ্টায় তিনি কামতাপুর ও কামরূপ রাজ্য সম্পূর্ণভাবে জয় করিলেন। ঐ অঞ্চলে প্রচলিত প্রবাদ অনুসারে হোসেন শাহ বিশ্বাসঘাতকতার সাহায্যে কামতাপুর (কোচবিহার) ও কামরূপ (আসামের পশ্চিম অংশ) জয় করিয়াছিলেন; কামতাপুর ও কামরূপের রাজা খেন-বংশীয় নীলাম্বর তাঁহার মন্ত্রীর পুত্রকে বধ করিয়াছিলেন সে তাঁহার রাণীর প্রতি অবৈধ আসক্তি প্রকাশ করিয়াছিল বলিয়া, তাহাকে বধ করিয়া তিনি তাঁহার পিতাকে নিমন্ত্রণ করিয়া তাঁহার মাংস খাওয়াইয়াছিলেন; তখন তাঁহার পিতা প্রতিশোধ লইবার জন্য গঙ্গাস্নান করিবার অছিলা করিয়া গৌড়ে চলিয়া আসেন এবং হোসেন শাহকে কামতাপুর আক্রমণের জন্য উত্তেজিত করেন। হোসেন শাহ তখন কামতাপুর আক্রমণ করেন, কিন্তু নীলাম্বর তাঁহার আক্রমণ প্রতিহত করেন। অবশেষে হোসেন শাহ মিথ্যা করিয়া নীলাম্বরকে বলিয়া পাঠান যে তিনি চলিয়া যাইতে চাহেন, কিন্তু তাঁহার পূর্বে তাঁহার বেগম একবার নীলাম্বরের রাণীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহেন; নীলাম্বর তাহাতে সম্মত হইলে হোসেন শাহের শিবির হইতে তাঁহার রাজধানীর ভিতরে পালকী যায়, তাহাতে নারীর ছদ্মবেশে সৈন্য ছিল; তাহারা কামতাপুর নগর অধিকার করে; ১৪৯৮-৯৯ খ্রীষ্টাব্দে এই ঘটনা ঘটিয়াছিল।
এই প্রবাদের খুঁটিনাটি বিবরণগুলি এবং ইহাতে উল্লিখিত তারিখ সত্য বলিয়া মনে হয় না। তবে হোসেন শাহের কামতাপুর-কামরূপ বিজয় যে ঐতিহাসিক ঘটনা, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই, কারণ ‘রিয়াজ, বুকাননের বিবরণী এবং কামতাপুর অঞ্চলের কিংবদন্তী-সমস্ত সূত্রই এই ঘটনার সত্যতা সম্বন্ধে একমত। ‘আসাম বুরঞ্জী’র মতে কোচ রাজা বিশ্বসিংহ হোসেন শাহের অধীনস্থ আটগাঁওয়ের মুসলমান শাসনকর্ত্তা “তুরকা কোতয়াল”কে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করিয়া কামতাপুর-কামরূপ রাজ্য পুনরধিকার করেন। কথিত আছে যে ১৫১৩ খ্রীষ্টাব্দের পরে কামতাপুর রাজ্য হইতে মুসলমানরা বিতাড়িত হইয়াছিল। এই সব কথা কতদূর সত্য, তাহা বলা যায় না।
ঐ সময়ে কামরূপের পূর্ব ও দক্ষিণে আসাম ও অহোম রাজ্য অবস্থিত ছিল। রাজ্যটি দুর্গম পার্ব্বত্য অঞ্চলে পরিপূর্ণ হওয়ার জন্য এবং এখানে বর্ষার প্রকোপ খুব বেশি হওয়ার জন্য বাহিরের কোন শক্তির পক্ষে এই রাজ্য জয় করা খুবই কঠিন ব্যাপার ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে শিহাবুদ্দীন তালিশ নামে মোগল সরকারের জনৈক কর্মচারী তিহার তারিখ-ফতে-ই-আশাম’ গ্রন্থে লিখিয়াছেন যে, হোসেন শাহ ২৪,০০০ পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া আসাম আক্রমণ করেন, তখন আসামের রাজা পার্ব্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। হোসেন শাহ আসামের সমতল অঞ্চল অধিকার করিয়া সেখানে তাঁহার জনৈক পুত্রকে (কিংবদন্তী অনুসারে ইহার নাম “দুলাল গাজী”) এক বিশাল সৈন্যাবহিনী সহ রাখিয়া নিজে গৌড়ে ফিরিয়া গেলেন। কিন্তু যখন বর্ষা নামিল, তখন চারিদিক জলে ভরিয়া গেল। সেই সময়ে আসামের রাজা পার্ব্বত্য অঞ্চল হইতে নামিয়া হোসেনের পুত্রকে বধ করিলেন ও তাঁহার সৈন্য ধ্বংস করিলেন। মীর্জা মুহম্মদ কাজিমের ‘আলমগীরনামা’ এবং গোলাম হোসেনের ‘রিয়াজ-উস্-সলাতীন’-এ শিহাবুদ্দীন তালিশের এই বিবরণের পরিপূর্ণ সমর্থন পাওয়া যায়। কিন্তু অসমীয়া বুরঞ্জীগুলির মতে বাংলার রাজা “খুনফৎ” বা “খুফৎ” (হুসন) “বড় উজীর” ও “বিৎ মালিক” (বা “মি মানিক”) নামে দুই ব্যক্তির নেতৃত্বে আসাম জয়ের জন্য ২০,০০০ পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য এবং অসংখ্য রণতরী প্রেরণ করিয়াছিলেন; এই বাহিনী প্রায় বিনা বাধায় অনেকদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়; তাঁহার পর আসামরাজ সুহুঙ্গ মুঙ্গ তাহাদের প্রচণ্ড বাধা দেন; দুই পক্ষের মধ্যে নৌযুদ্ধ হয় এবং তাহাতে মুসলমানরা প্রথম দিকে জয়লাভ করিলেও শেষ পর্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়; “বড় উজীর” পলাইয়া প্রাণ বাঁচান; কিছুদিন পরে তিনি আবার “বিৎ মালিক” সমভিব্যাহারে আসাম আক্রমণ করেন; ইতিমধ্যে আসামরাজ কয়েকটি নদীর মোহনায় ঘাঁটি বসাইয়া তাঁহার প্রধান সেনাপতিদের মোতায়েন করিয়া রাখিয়াছিলেন; বাংলার সৈন্যবাহিনী জলপথ ও স্থলপথে সিংরী পর্যন্ত অগ্রসর হইয়া সেখানকার ঘাঁটি আক্রমণ করে ও এখানে বহুক্ষণব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে অসমীয়া সেনাপতি বরপুত্র গোহাইন বাংলার বাহিনীকে পরাজিত করেন। “বিৎ মালিক এবং বাংলার বহু সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত হইয়াছিল, অনেকে বন্দী হইয়াছিল; “বড় উজীর” এবারও স্বল্পসংখ্যক অনুচর লইয়া পলাইয়া গিয়া প্রাণ বাঁচাইলেন; তাঁহাদিগকে অসমীয়া বাহিনী অনেক দূর পর্যন্ত তাড়া করিয়া লইয়া গেল।
মুসলমান লেখকদের লেখা বিবরণে এবং অসমীয়া বুরঞ্জীর বিবরণে কিছু পার্থক্য থাকিলেও এবিষয়ে কোন সন্দেহ নাই যে হোসেন শাহের আসামজয়ের প্রচেষ্টা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হইয়াছিল।
আসামের “হোসেন শাহী পরগণা” নামে পরিচিত একটি অঞ্চল এখনও হোসেন শাহের স্মৃতি বহন করিতেছে।
উড়িষ্যার সহিতও হোসেন শাহের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হইয়াছিল। মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে মনে হয়, হোসেন শাহের রাজত্বের প্রথম বৎসরেই উড়িষ্যার সহিত তাঁহার সংঘর্ষ বাধে। ঐ সময়ে পুরুষোত্তমদেব উড়িষ্যার রাজা ছিলেন। ১৪৯৭ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার মৃত্যু হয় এবং তাঁহার পুত্র প্রতাপরুদ্র সিংহাসনে আরোহণ করেন। প্রতাপরুদ্রের দীক্ষাগুরু জীবদেবাচার্যের লেখা ‘ভক্তিভাগবত’ মহাকাব্য হইতে জানা যায় যে, সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতাপরুদ্রকে বাংলার সুলতানের সহিত যুদ্ধে লিপ্ত হইতে হইয়াছিল।
হোসেন শাহের মুদ্রা ও শিলালিপি, ‘রিয়াজ-উস্ সলাতীন’ এবং ত্রিপুরার ‘রাজমালা’র সাক্ষ্য অনুসারে হোসেন শাহ উড়িষ্যা জয় করিয়াছিলেন।
পক্ষান্তরে, উড়িষ্যার বিভিন্ন সূত্রের মতে উড়িষ্যারাজ প্রতাপরুদ্রই হোসেন শাহকে পরাজিত করিয়াছিলেন। জীবদেবাচার্য ‘ভক্তিভাগবত’-এ লিখিয়াছেন যে পিতার মৃত্যুর ছয় সপ্তাহের মধ্যেই প্রতাপরুদ্র বাংলার সুলতানকে পরাজিত করিয়া গঙ্গা (ভাগীরথী) নদীর তীর পর্যন্ত অঞ্চল অধিকার করিয়াছিলেন। প্রতাপরুদ্রের তাম্রশাসন ও শিলালিপিতে বলা হইয়াছে যে প্রতাপরুদ্রের নিকট পরাজিত হইয়া গৌড়েশ্বর কাঁদিয়াছিলেন এবং ভয়াকুল চিত্তে স্বস্থানে প্রস্থান করিয়া আত্মরক্ষা করিয়াছিলেন। প্রতাপরুদ্রের রচনা বলিয়া ঘোষিত সরস্বতীবিলাস’ গ্রন্থে (১৫১৫ খ্রষ্টাব্দ বা তাঁহার পূর্বে রচিত) প্রতাপরুদ্রকে “শরণাগত জবুনা-পুরাধীনশ্বর হুশনশাহ-সুরত্রাণ-শরণরক্ষণ” বলা হইয়াছে, অর্থাৎ প্রতাপরুদ্র শুধু হোসেন শাহের বিজেতা নহেন, তাঁহার রক্ষাকর্ত্তাও! উড়িয়া ভাষার লেখা জগন্নাথ মন্দিরের মাদলা পাঞ্জী’ ও সংস্কৃত ভাষায় লেখা কটকরাজবংশাবলী’ গ্রন্থের মতে বাংলার সুলতান উড়িষ্যা আক্রমণ করিয়া উড়িষ্যার রাজধানী কটক এবং পুরী পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল জয় করিয়া লন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের প্রায় সমস্ত দেবমূর্ত্তি তিনি নষ্ট করেন, জগন্নাথের মূর্ত্তিকে দোলায় চড়াইয়া চিল্কা হ্রদের মধ্যস্থিত চড়াইগুহা পর্বতে লইয়া গিয়া রাখা হইয়াছিল বলিয়া উহা ধ্বংস হইতে রক্ষা পায়। এই সময়ে প্রতাপরুদ্র। দক্ষিণদিকে অভিযানে গিয়াছিলেন, এবং সংবাদ পাইয়া তিনি দ্রুতগতিতে চলিয়া আসেন এবং বাংলার সুলতানকে তাড়া করিয়া গঙ্গার তীর পর্যন্ত লইয়া যান। মাদলা পাঞ্জী’র মতে ১৫০৯ খ্রীষ্টাব্দে এই ঘটনা ঘটিয়াছিল। এই সূত্রের মতে চউমূৰ্হিতে প্রতাপরুদ্র ও হোসেন শাহের মধ্যে বিরাট যুদ্ধ হয় এবং এই যুদ্ধে পরাজিত হইয়া হোসেন শাহ মান্দারণ দুর্গে আশ্রয় লন। প্রতাপরুদ্র তখন মান্দারণ দুর্গ অবরোধ করেন। প্রতাপরুদ্রের অন্যতম সেনাপতি গোবিন্দ ভোই বিদ্যাধর ইতিপূর্বে হোসেন শাহের কটক আক্রমণের সময়ে কটক রক্ষা করিতে ব্যর্থ। হইয়াছিল, সে এখন হোসেন শাহের সহিত যোগ দিল; হোসেন শাহ ও গোবিন্দ বিদ্যাধর প্রতাপরুদ্রের সহিত প্রচণ্ড যুদ্ধ করিয়া তাঁহাকে মান্দারণ হইতে বিতাড়িত করিলেন। মান্দারণ হইতে অনেকখানি পশ্চাদপসরণ করিয়া প্রতাপরুদ্র গোবিন্দ বিদ্যাধরকে ডাকিয়া পাঠাইলেন এবং তাহাকে অনেক বুঝাইয়া সুজাইয়া আবার স্বদেশে আনয়ন করিলেন; ইহার পর তিনি গোবিন্দকে পাত্রের পদে অধিষ্ঠিত করিয়া তাহাকেই রাজ্য শাসনের ভার দিলেন; হোসেন শাহ আর উড়িষ্যা জয় করিতে পারিলেন না। এই বিবরণের সমস্ত কথা সত্য না হইলেও অনেকখানিই যে সত্য, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।
যাহা হউক, দেখা যাইতেছে যে হোসেন শাহ ও উড়িষ্যারাজের সংঘর্ষে উভয়পক্ষই জয়ের দাবি করিয়াছেন।
বাংলার চৈতন্যচরিগ্রন্থগুলি–বিশেষভাবে ‘চৈতন্যভাগবত’, ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ ও ‘চৈতন্যচন্দ্রোদয় নাটক’ হইতে এ সম্বন্ধে অনেকটা নিরপেক্ষ ও নির্ভরযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায়। এগুলি হইতে জানা যায় যে, হোসেন শাহ উড়িষ্যা আক্রমণ করিয়া সেখানকার বহু দেবমন্দির ও দেবমূর্ত্তি ভাঙিয়াছিলেন ও দীর্ঘকাল ধরিয়া তাঁহার সহিত উড়িষ্যার রাজার যুদ্ধ চলিয়াছিল। চৈতন্যদেব যখন দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের শেষে নীলাচলে প্রত্যাবর্তন করেন (১৫১২ খ্রীষ্টাব্দ), তখন বাংলা ও উড়িষ্যার যুদ্ধ বন্ধ ছিল। বাংলা হইতে চৈতন্যদেবের নীলাচলে প্রত্যাবর্তনের (জুন ১৫১৫ খ্রী) অব্যবহিত পরে হোসেন শাহ আবার উড়িষ্যা অভিযান করেন।
জয়ানন্দ তাঁহার ‘চৈতন্যমঙ্গলে লিখিয়াছেন যে উড়িষ্যারাজ প্রতাপরুদ্র একবার বাংলা দেশ আক্রমণ করিবার সঙ্কল্প করিয়া সে সম্বন্ধে চৈতন্যদেবের আজ্ঞা প্রার্থনা করিয়াছিলেন, কিন্তু চৈতন্যদেব তাঁহাকে এই প্রচেষ্টা হইতে বিরত হইতে বলেন; তিনি প্রতাপরুদ্রকে বলেন যে, “কালবন রাজা পঞ্চগৌড়েশ্বর” মহাশক্তিমান; তাঁহার রাজ্য আক্রমণ করিলে সে উড়িষ্যা উৎসন্ন করিবে এবং জগন্নাথকে নীলাচল ত্যাগ করিতে বাধ্য করিবে। চৈতন্যদেবের কথা শুনিয়া প্রতাপরুদ্র বাংলা আক্রমণ হইতে নিরস্ত হন। এই উক্তি কতদূর সত্য বলা যায় না।
এতক্ষণ যে আলোচনা করা হইল, তাহা হইতে পরিষ্কার বুঝিতে পারা যায় যে, ১৪৯৩-৯৪ খ্রীষ্টাব্দে হোসেন শাহের সহিত উড়িষ্যার রাজার যুদ্ধ আরম্ভ হয়। ১৫১২ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ১৫১৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এই যুদ্ধ বন্ধ ছিল। কিন্তু ১৫১৫ খ্রষ্টাব্দে হোসেন শাহ আবার উড়িষ্যা আক্রমণ করেন এবং স্বয়ং এই অভিযানে নেতৃত্ব করেন। কিন্তু এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে কোন পক্ষই বিশেষ কোন স্থায়ী ফল লাভ করিতে পারেন নাই।
হোসেন শাহ এবং ত্রিপুরার রাজার মধ্যেও অনেক দিন ধরিয়া যুদ্ধবিগ্রহ চলিয়াছিল। ইহা ‘রাজমালা’ (ত্রিপুরার রাজাদের ইতিহাস) নামক বাংলা গ্রন্থে কবিতার আকারে বর্ণিত হইয়াছে। ‘রাজমালা’র দ্বিতীয় খণ্ডে (রচনাকাল ১৫৭৭ ৮৬ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে) হোসেন শাহ ও ত্রিপুরারাজের সংঘর্ষের বিবরণ পাওয়া যায়। ঐ বিবরণের সারমর্ম নিম্নে প্রদত্ত হইল।
হোসেন শাহের সহিত ত্রিপুরারাজের বহু সংঘর্ষ হয়। ১৫১৩ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বেই ত্রিপুরারাজ ধন্যমাণিক্য বাংলার সুলতানের অধীন অনেক অঞ্চল জয় করেন। ১৪৩৫ শতকে ধন্যমাণিক্য চট্টগ্রাম অধিকার করেন ও এতদুপলক্ষে স্বর্ণমুদ্রা প্রকাশ করেন। হোসেন শাহ তাঁহার বিরুদ্ধে গৌরাই মল্লিক নামক একজন সেনাপতির অধীনে এক বিপুল বাহিনী পাঠান। গৌরাই মল্লিক ত্রিপুরার অনেক অঞ্চল জয় করেন, কিন্তু চণ্ডীগড় দুর্গ জয় করিতে অসমর্থ হন। ইহার পর তিনি চণ্ডীগড়ের পাশ কাটাইয়া গিয়া গোমতী নদীর উপরদিক দখল করেন, বাঁধ দিয়া গোমতীর জল অবরুদ্ধ করেন এবং তিন দিন পরে বাঁধ খুলিয়া জল ছাড়িয়া দেন; ঐ জল দেশ ভাসাইয়া দিয়া ত্রিপুরার বিপর্যয় সাধন করিল। তখন ত্রিপুরারাজ অভিচার অনুষ্ঠান করিলেন; এই অনুষ্ঠানে বলিপ্রদত্ত চণ্ডালের মাথা বাংলার সৈন্যবাহিনীর ঘাঁটিতে অলক্ষিতে পুঁতিয়া রাখিয়া আসা হইল। তাঁহার ফলে সেই রাত্রেই বাংলার সৈন্যরা ভয়ে পলাইয়া গেল।
১৪৩৬ শকে ধন্যমাণিক্যের রাইকছাগ ও রাইকছম নামে দুইজন সেনাপতি আবার চট্টগ্রাম অধিকার করেন। তখন হোসেন শাহ হৈতন খাঁ নামে একজন সেনাপতির অধীনে আর একটি বাহিনী পাঠান। হৈতন খাঁ সাফল্যের সহিত অগ্রসর হইয়া ত্রিপুরারাজ্যের দুর্গের পর দুর্গ জয় করিতে থাকেন এবং গোমতী নদীর তীরে গিয়া উপস্থিত হন। ইহাতে বিচলিত হইয়া ধন্যমাণিক্য ডাকিনীদের সাহায্য চান। তখন ডাকিনীরা গোমতী নদীর জল শোষণ করিয়া সাত দিন নদীর খাত শুষ্ক রাখিয়া অতঃপর জল ছাড়িয়া দিল। সেই জলে ত্রিপুরার লোকেরা বহু ভেলা ভাসাইল, প্রতি ভেলায় তিনটি করিয়া পুতুল ও প্রতি পুতুলের হাতে দুইটি করিয়া মশাল ছিল। অর্গলমুক্ত জলধারায় বাংলার সৈন্যদের হাতি ঘোড়া উট ভাসিয়া গেল, ইহা ভিন্ন তাহারা দূর হইতে জ্বলন্ত মশাল দেখিয়া ভয়ে ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল; তারপর ত্রিপুরার লোকেরা তাঁহার নিকটবর্তী একটি বনে আগুন লাগাইয়া দিল। বাংলার সৈন্যেরা তখন পলাইয়া গেল, তাহাদের অনেকে ত্রিপুরার সৈন্যদের হাতে মারা পড়িল। ত্রিপুরার সৈন্যরা বাংলার বাহিনীর অধিকৃত চারিটি ঘাঁটি পুনরধিকার করিল। বাংলার বাহিনী ছয়কড়িয়া ঘাঁটিতে অবস্থান করিতে লাগিল।
এখন প্রশ্ন এই, ‘রাজমালা’র এই বিবরণ কতদূর বিশ্বাসযোগ্য। ধন্যমাণিক্য অভিচারের দ্বারা গৌরাই মল্লিককে এবং ডাকিনীদের সাহায্যে হৈতন খাকে বিতাড়িত করিয়াছিলেন বলিয়া বিশ্বাস করা যায় না। এইসব অলৌকিক কাণ্ড বাদ দিলে ‘রাজামালা’র বিবরণের অবশিষ্টাংশ সত্য বলিয়াই মনে হয়। সুতরাং এই বিবরণের উপর নির্ভর করিয়া আমরা এই সিদ্ধান্ত করিতে পারি যে হোসেন শাহ ধন্যমাণিক্যের সংঘর্ষের প্রথম পর্যায়ে ধন্যমাণিক্যই জয়যুক্ত হন এবং তিনি খণ্ডল পর্যন্ত হোসেন শাহের রাজ্যের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিকার করিয়া লন। দ্বিতীয় পর্যায়ে ধন্যমাণিক্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত জয় করেন, কিন্তু প্রতিপক্ষের আক্রমণে তাঁহাকে পূর্বাধিকৃত সমস্ত অঞ্চল হারাইতে হয় এবং গৌড়েশ্বরের সেনাপতি গৌরাই মল্লিক গোমতী নদীর তীরবর্তী চণ্ডীগড় দুর্গ পর্যন্ত অধিকার করেন; গৌরাই মল্লিক গোমতী নদীর জল প্রথমে রুদ্ধ ও পরে মুক্ত করিয়া ত্রিপুরারাজের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটাইয়াছিলেন। তৃতীয় পর্যায়ে ধন্যমাণিক্য আবার পূর্বাধিকৃত অঞ্চলগুলি অধিকার করেন, কিন্তু হোসেন শাহের সেনাপতি হৈতন খাঁ প্রতি-আক্রমণ করিয়া তাহাকে বিতাড়িত করেন এবং তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিয়া গোমতী নদীর তীরবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত অধিকার করেন। এইবার ত্রিপুরা-রাজ গোমতী নদীর জল প্রথমে রুদ্ধ ও পরে মুক্ত করিয়া তাহাকে বিপদে ফেলেন। তাঁহার ফলে হৈতন খাঁ পিছু হটিয়া ছয়কড়িয়ায় চলিয়া আসেন। ত্রিপুরারাজ ছয়কড়িয়ার পূর্ব পর্যন্ত হৃত অঞ্চলগুলি পুনরধিকার করেন, ত্রিপুরারাজ্যের অন্যান্য অধিকৃত অঞ্চল হোসেন শাহের দখলেই থাকিয়া যায়।
মধ্যযুগে কাম রাজ্য
‘রাজমালা’র বিবরণ পড়িলে মনে হয়, ধন্যমাণিক্য বাংলার খণ্ডল পর্যন্ত যে অভিযান চালাইয়াছিলেন, তাহা হইতেই হোসেন শাহের সহিত তাঁহার সংঘর্ষের আরম্ভ হয় এবং ১৪৩৫ শক বা ১৫১৩-১৪ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে হোসেন শাহ ত্রিপুরারাজকে প্রতি-আক্রমণ করেন নাই। কিন্তু সোনারগাঁও অঞ্চলে ১৫১৩ খ্রীষ্টাব্দে উত্তীর্ণ হোসেন শাহের এক শিলালিপি পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে থওয়াস খান নামে হোসেন শাহের একজন কর্মচারীকে ত্রিপুরার “সর-এ-লস্কর” বলা হইয়াছে। ইহা হইতে মনে হয় যে, ১৫১৩ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যেই হোসেন শাহ ত্রিপুরার সহিত যুদ্ধে লিপ্ত হইয়া ত্রিপুরার অঞ্চলবিশেষ অধিকার করিয়াছিলেন। কবীন্দ্র পরমেশ্বর তাঁহার মহাভারতে লিখিয়াছেন যে হোসেন শাহ ত্রিপুরা জয় করিয়াছিলেন। শ্রীকর নন্দী তাঁহার মহাভারতে লিখিয়াছেন যে তাঁহার পৃষ্ঠপোষক, হোসেন শাহের অন্যতম সেনাপতি ছুটি খান ত্রিপুরার দুর্গ আক্রমণ করিয়াছিলেন, তাঁহার ফলে ত্রিপুরারাজ দেশত্যাগ করিয়া “পর্বতগহ্বরে” “মহাবনমধ্যে” গিয়া বাস করিতে থাকেন; ছুটি খানকে তিনি হাতি ও ঘোড়া দিয়া সম্মানিত করেন; ছুটি খান তাঁহাকে অভয় দান করা সত্ত্বেও তিনি আতঙ্কগ্রস্ত হইয়া থাকেন। এইসব কথা কতদূর যথার্থ তাহা বলা যায় না। তবে হোসেন শাহের রাজত্বকালে কোন সময়ে ত্রিপুরার বিরুদ্ধে বাংলা বাহিনীর সাফল্যে ছুটি খান উল্লেখযোগ্য অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন–এই কথা সত্য বলিয়া মনে হয়।
হোসেন শাহের সহিত আরাকানরাজেরও সম্ভবত সংঘর্ষ হইয়াছিল। চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই মর্মে প্রবাদ প্রচলিত আছে যে হোসেন শাহের রাজত্বকালে আরাকানীরা চট্টগ্রাম অধিকার করিয়াছিল; হোসেন শাহের পুত্র নসরৎ শাহের নেতৃত্বে এক বাহিনী দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে প্রেরিত হয়, তাহারা আরাকানীদের বিতাড়িত করিয়া চট্টগ্রাম পুনরধিকার করে। জোআঁ-দে-বারোসের ‘দা এশিয়া’ এবং অন্যান্য সমসাময়িক পর্তুগীজ গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, ১৫১৮ খ্রীস্টাব্দে আরাকানরাজ বাংলার রাজার অর্থাৎ হোসেন শাহের সামন্ত ছিলেন। চট্টগ্রাম অধিকারের যুদ্ধে পরাজয় বরণ করার ফলেই সম্ভবত আরাকানরাজ হোসেন শাহের সামন্তে পরিণত হইয়াছিলেন।
হোসেন শাহ ত্রিহুতের কতকাংশ সমেত বর্তমান বিহার রাজ্যের অনেকাংশ জয় করিয়াছিলেন। বিহারের পাটনা ও মুঙ্গের জেলায়, এমন কি ঐ রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত সারণ জেলায়ও হোসেন শাহের শিলালিপি পাওয়া গিয়াছে। বিহারের একাংশ সিকন্দর শাহ লোদীর রাজ্যভুক্ত ছিল। সিকন্দর শাহ লোদীর সহিত সন্ধি করিবার সময় হোসেন শাহ তাঁহাকে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন যে ভবিষ্যতে তিনি সিকন্দরের শত্রুতা করিবেন না এবং সিকন্দরের শত্রুদের আশ্রয় দিবেন না। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি শেষ পর্যন্ত পালিত হয় নাই। সারণ অঞ্চলের একাংশ হোসেন শাহের এবং অপরাংশ সিকন্দর শাহের অধিকারভুক্ত ছিল। লোদী রাজবংশ সম্বন্ধীয় ইতিহাসগ্রন্থগুলি হইতে জানা যায় যে, সারণে সিকন্দরের প্রতিনিধি হোসেন খান ফর্মূলির সহিত হোসেন শাহ খুব বেশি ঘনিষ্ঠতা করিতে থাকায় এবং হোসেন খান ফমূলির প্রাধান্য দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে থাকায় সিকন্দর শাহ ক্রুদ্ধ হইয়া ফর্মূলির বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন (১৫০৯ খ্রী); তখন হোসেন শাহ ফলিকে আশ্রয় দেন। সিকন্দর শাহ লোদীর মৃত্যুর (১৫১৭ খ্রী) পর তাঁহার বিহারস্থ প্রতিনিধিদের সহিত হোসেন শাহ প্রকাশ্যভাবেই শত্রুতা করিতে আরম্ভ করেন।
হোসেন শাহের রাজত্বকালেই বাংলাদেশের মাটিতে পর্তুগীজরা প্রথম পদার্পণ করে। ১৫১৭ খ্রীষ্টাব্দে গোয়র পর্তুগীজ কর্তৃপক্ষ বাংলা দেশে বাণিজ্য সুরু করার অভিপ্রায়ে চারিটি জাহাজ পাঠান, কিন্তু মধ্যপথে প্রধান জাহাজটি অগ্নিকাণ্ডে নষ্ট হওয়ায় পর্তুগীজ প্রতিনিধিদল বাংলায় পৌঁছিতে পারেন নাই। ১৫১৮ খ্রীষ্টাব্দে জোআঁ-দে-সিলভেরার নেতৃত্বে একদল পর্তুগীজ প্রতিনিধি চট্টগ্রামে আসিয়া পৌঁছান। সিলভেরা বাংলার সুলতানের নিকট এদেশে বাণিজ্য করার ও চট্টগ্রামে একটি কুঠি নির্মাণের অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু সিলভেরা চট্টগ্রামের শাসনকর্ত্তার একজন আত্মীয়ের দুইটি জাহাজ ইতিপূর্বে দখল করিয়াছিলেন এবং চট্টগ্রামের খাদ্যভাবে পড়িয়া একটি চাল-বোঝাই নৌকা লুণ্ঠন করিয়াছিলেন বলিয়া চট্টগ্রামের শাসনকর্ত্তা তাঁহার প্রতি বিরূপ হন ও তাঁহার জাহাজ লক্ষ্য করিয়া কামান দাগেন। পর্তুগীজরা ইহার উত্তরে চট্টগ্রাম অবরোধ করিয়া বাংলার সামুদ্রিক-বাণিজ্য বিপর্যস্ত করিল। চট্টগ্রামে শাসনকর্ত্তা এই সময়ে কয়েকটি জাহাজের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিলেন, তাই তিনি সাময়িকভাবে পর্তুগীজদের সহিত সন্ধি করিলেন। কিন্তু জাহাজগুলি বন্দরে পৌঁছিবামাত্র তিনি পর্তুগীজদের প্রতি আক্রমণ পুনরারম্ভ করিলেন। তখন সিলভেরা আরাকানে অবতরণের এবং সেখানে বাণিজ্য সুরু করার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্তু সিলভেরা জানিতে পারিলেন যে আরাকানে অবতরণ করিলেই তিনি বন্দী হইবেন। এই কারণে তিনি নিরাশ হইয়া সিংহলে চলিয়া গেলেন।
হোসেন শাহ গৌড় হইতে নিকটবর্তী একডালায় তাঁহার রাজধানী স্থানান্তরিত করিয়াছিলেন। এই একডালার অবস্থান সম্বন্ধে ইলিয়াস শাহের প্রসঙ্গে পূর্বেই আলোচনা করা হইয়াছে। সম্ভবত ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য এবং ক্রমাগত লুণ্ঠনের ফলে গৌড় নগরী শ্রীহীন হইয়া পড়ায় হোসেন শাহ একডালায় রাজধানী স্থানান্তরিত করিয়াছিলেন।
অনেকে মনে করিয়া থাকেন হোসেন শাহ সর্বপ্রথম সত্যপীরের উপাসনা প্রবর্তন করেন। এই ধারণার কোন ভিত্তি আছে বলিয়া মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে, সত্যপীরের উপাসনা যে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের পূর্বে প্রবর্তিত হয় নাই, তাহা মনে করিবার যথেষ্ট কারণ আছে।
হোসেন শাহের বহু মন্ত্রী অমাত্য ও কর্মচারীর নাম এপর্যন্ত জানিতে পারা গিয়াছে। ইহাদের মধ্যে মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়েরই লোক ছিলেন। নিম্নে কয়েকজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া গেল।
১। পরাগল খান : ইনি হোসেন শাহের সেনাপতি ছিলেন এবং হোসেন শাহ কর্ত্তৃক চট্টগ্রাম অঞ্চলের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইয়াছিলেন। ইঁহারই আদেশে কবীন্দ্র পরমেশ্বর সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় মহাভারত রচনা করেন।
২। ছুটি খান : ইনি পরাগল খানের পুত্র। ইহার প্রকৃত নাম নসরৎ খান। ইহার আদেশে শ্রীকর নন্দী বাংলা ভাষায় মহাভারত রচনা করিয়াছিলেন। শ্রীকর নন্দীর বিবরণ অনুসারে ছুটি খান লস্করের পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন এবং ত্রিপুরার রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়াছিলেন।
৩। সনাতন : সনাতন হোসেন শাহের মন্ত্রী ও সভাসদ ছিলেন এবং তাঁহার বিশিষ্ট উপাধি ছিল “সাকর মল্লিক” (‘সগীর মালিক’, অর্থ ছোট রাজা)। সনাতন হোসেন শাহের অন্যতম ‘দবীর খাস’ বা প্রধান সেক্রেটারীও ছিলেন। হোসেন শাহ তাঁহাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন ও তাঁহার উপর বিশেষভাবে নির্ভর করিতেন। চৈতন্যদেবের সঙ্গে দেখা হইবার পর সনাতন রাজকার্যে অবহেলা করেন এবং উড়িষ্যা-অভিযানে সুলতানের সহিত যাইতে অস্বীকার করেন। তাঁহার এই “অপরাধের” জন্য হোসেন শাহ তাঁহাকে বন্দী করিয়া রাখিয়া উড়িষ্যায় চলিয়া যান। কারারক্ষককে উৎকোচদানে বশীভূত করিয়া সনাতন মুক্তিলাভ করেন ও বৃন্দাবন যাত্রা করেন। তিনি চৈতন্য মহাপ্রভুর একজন প্রিয় ভক্ত ছিলেন।
৪। রূপ : ইনি সনাতনের অনুজ। ইনিও হোসেন শাহের মন্ত্রী এবং দবীর খাস’ ছিলেন। দীর্ঘকাল চাকুরী করিবার পরে রূপ-সনাতনের সংসারে বিরাগ জন্মে এবং চৈতন্যের উপদেশে সংসার ত্যাগ করিয়া বৃন্দাবনে চলিয়া যান। অতঃপর রূপ সনাতন গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম্মের ভাষ্য রচনায় অবশিষ্ট জীবন অতিবাহিত করেন।
বল্লভ (সনাতন-রূপের ভ্রাতা), শ্রীকান্ত (ইহাদের ভগ্নীপতি), চিরঞ্জীব সেন (গোবিন্দদাস কবিরাজের পিতা), কবিশেখর, দামোদর, যশোরাজ খান (সকলেই পদকর্ত্তা), মুকুন্দ (বৈদ্য), কেশব খান (ছত্রী) প্রভৃতি বিশিষ্ট হিন্দুগণ হোসেন শাহের অমাত্য, কর্মচারী চিকিৎসক প্রভৃতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অনেকের ধারণা, ‘পুরন্দর খান’ নামে হোসেন শাহের একজন হিন্দু উজীর ছিলেন। এই ধারণা সত্য নহে।
হোসেন শাহের রাজ্যের আয়তন অত্যন্ত বিশাল ছিল। বাংলা দেশের প্রায় সমস্তটা এবং বিহারের এক বৃহদংশ তাঁহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইহা ভিন্ন কামরূপ ও কামতা রাজ্য এবং উড়িষ্যা ও ত্রিপুরা রাজ্যের কিয়দংশ অন্তত সাময়িকভাবে তাঁহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল।
এখন আমরা হোসেন শাহের চরিত্র সম্বন্ধে আলোচনা করিব। এক অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে হোসেন শাহ বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁহার অভ্যুদয়ের পূর্বে পরপর কয়েকজন সুলতান অল্পদিন মাত্র রাজত্ব করিয়া আততায়ীর হস্তে নিহত হইয়াছিলেন। এই অবস্থার মধ্যে রাজা হইয়া হোসেন শাহ দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপন করিয়াছিলেন, বিভিন্ন রাজ্য জয় করিয়া নিজের রাজ্যভুক্ত করিয়াছিলেন এবং সুদীর্ঘ ছাব্বিশ বৎসর এই বিরাট ভূখণ্ডে নিরুদ্বেগে অপ্রতিহতভাবে রাজত্ব করিয়াছিলেন, ইহা অল্প কৃতিত্বের কথা নহে।
‘তবকাৎ-ই-আকবরী’ ‘তারিখ-ই-ফিরিশতা’ ও ‘রিয়াজ-উস্-সলাতীনে’র মতে হোসেন শাহ সুশাসক এবং জ্ঞানী ও গুণীবর্গের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন; ইহার ফলে দেশে পরিপূর্ণ শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়; তিনি গণ্ডক নদীর কূলে একটি বাঁধ নির্মাণ করিয়া রাজ্যের সীমানা সুঝক্ষিত করেন; রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ, সরাইখানা ও মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং আলিম ও দরবেশদের বহু অর্থ দান করেন।
হোসেন শাহের রাজত্বকালে তাঁহার বা তাঁহার অধীনস্থ কর্মচারীদের দ্বারা বহু সুন্দর সুন্দর মসজিদ, ফটক প্রভৃতি নির্মিত হইয়াছিল। তাহাদের মধ্যে গৌড়ের “ছোট সোনা মসজিদ” এবং “গুমতি ফটক” এখনও বর্তমান আছে। ইহাদের শিল্পসৌন্দর্য অসাধারণ।
হোসেন শাহের রাজত্বকালে দেশে অশুভ ঘটনাও কিছু কিছু ঘটিয়াছিল। বৃন্দাবনদাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ হইতে জানা যায় যে, ১৫০৯ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার রাজ্যে দুর্ভিক্ষ হইয়াছিল। এই জাতীয় দুর্ভিক্ষের জন্য হোসেন শাহকে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করা না গেলেও পরোক্ষ দায়িত্ব তিনি এড়াইতে পারেন না। … …
কয়েকজন মুসলমান পণ্ডিতের সঙ্গে হোসেন শাহের গোলযোগ সম্বন্ধে কিছু সংবাদ পাওয়া যায়। ইহাদের মধ্যে একজন ফার্সী ভাষায় একটি ধনুর্বিদ্যা বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন এবং তৎকালীন গৌড়েশ্বর হোসেন শাহকে এই গ্রন্থ উৎসর্গ করেন। দ্বিতীয় মুসলমান পণ্ডিত হোসেন শাহের কোষাগারের জন্য একখানি ঐশ্লামিক গ্রন্থের তিনটি খণ্ড নকল করেন; তৃতীয় খণ্ডের পুস্পিকায় তিনি হোসেন শাহের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়াছেন। এই বই হোসেন শাহই উৎসাহী হইয়া নকল করাইয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়। কিন্তু এই নকল করানোর মধ্যে তাঁহার বিদ্যোৎসাহিতার বদলে ধর্মপরায়ণতার নিদর্শনই বেশি মিলে।
ভুলবশত হোসেন শাহকে মালাধর বসুর পৃষ্ঠপোষক মনে করায়ও এইরূপ ধারণা প্রচলিত হইয়াছে যে হোসেন শাহ পণ্ডিত ও কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করিতেন।
আমাদের ইহা মনে রাখিতে হইবে যে, হোসেন শাহ কোন কবি বা পণ্ডিতকে কোন উপাধি দেন নাই (যেমন রুকনুদ্দীন বারবক শাহ্ দিয়াছিলেন), এবং বৃন্দাবনদাস ‘চৈতন্যভাগবতে একজন লোককে দিয়া বলাইয়াছেন, “না করে পাণ্ডিত্যচর্চ্চা রাজা সে যবন।” সুতরাং হোসেন শাহ বিদ্যা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বলিয়া সিদ্ধান্ত করা সমীচীন নহে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের একটি পর্বকে অনেকে ‘হোসেন শাহী আমল’ নামে চিহ্নিত করিয়া থাকেন। কিন্তু এরূপ করার কোন সার্থকতা নাই। কারণ হোসেন শাহের রাজত্বকালে মাত্র কয়েকখানি বাংলা গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল। এই গ্রন্থগুলির রচনার মূলে যেমন হোসেন শাহের প্রত্যক্ষ প্রভাব কিছু ছিল না, তেমনি এই সমস্ত গ্রন্থ রচিত হওয়ার ফলে যে বাংলা সাহিত্যের বিরাট সমৃদ্ধি সাধিত হইয়াছিল, তাহাও নহে। কেহ কেহ ভুল করিয়া বলিয়াছেন যে হোসেন শাহের আমলে বাংলার পদাবলী-সাহিত্যের চরম উন্নতি ঘটে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পদাবলী সাহিত্যের চরম উন্নতি ঘটে হোসেন শাহের রাজত্ব অবসানের কয়েক দশক বাদে,–জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস প্রভৃতি কবিদের আবির্ভাবের পর। অতএব বাংলা সাহিত্যের একটি অধ্যায়ের সঙ্গে বিশেষভাবে হোসেন শাহের নাম যুক্ত করার কোন সার্থকতা নাই।
হোসেন শাহ সম্বন্ধে আর প্রচলিত মত এই যে, তিনি ধর্ম্মের ব্যাপারে অত্যন্ত উদার ছিলেন এবং হিন্দু-মুসলমানে সমদর্শী ছিলেন। কিন্তু এই ধারণাও কোন বিশিষ্ট তথ্য দ্বারা সমর্থিত নহে। হোসেন শাহের শিলালিপিগুলির সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায়, তিনি একজন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন এবং ইসলামধর্ম্মের মাহাত্ম প্রতিষ্ঠা ও মুসলমানদের মঙ্গল সাধনের জন্যই বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলেন। হোসেন শাহ গোঁড়া মুসলমান ও পরধর্মদ্বেষী দরবেশ নূর কুত্ত্ব আলমকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করিতেন এবং প্রতি বৎসর নূর কুল্ আলমের সমাধি প্রদক্ষিণ করিবার জন্য তিনি পদব্রজে একডালা হইতে পাণ্ডুয়ায় যাইতেন।
হোসেন শাহ হিন্দুদের উচ্চপদে নিয়োগ করিতেন, ইহা দ্বারা তাঁহার হিন্দু মুসলমানে সমদর্শিতা প্রমাণিত হয় না। হিন্দুদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের প্রথা ইলিয়াস শাহী আমল হইতেই চলিয়া আসিতেছিল। সব সময়ে সমস্ত পদের জন্য যোগ্য মুসলমান কর্মচারী পাওয়া যাইত না, অযোগ্যদের নিয়োগ করিলে শাসনকার্যের ক্ষতি হইবে, এই কারণে সুলতানরা ঐসব পদে হিন্দুদের নিয়োগ করিতেন। হোসেন শাহও তাহাই করিয়াছিলেন। সুতরাং এ ব্যাপারে তিনি পূর্ববতী সুলতানদের তুলনায় কোনরূপ স্বাতন্ত্রের পরিচয় দেন নাই।
হোসেন শাহের রাজত্বকালে চৈতন্যদেবের অভ্যুদয় ঘটিয়াছিল। চৈতন্যচরিত গ্রন্থগুলি হইতে জানা যায় যে, চৈতন্যদেব যখন গৌড়ের নিকটে রামকেলি গ্রামে আসেন, তখন কোটালের মুখে চৈতন্যদেবের কথা শুনিয়া হোসেন শাহ চৈতন্যদেবের অসাধারণত্ব স্বীকার করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহা হইতেও তাঁহার ধর্মবিষয়ে উদারতা প্রমাণিত হয় না। কারণ চৈতন্যদেব হোসেন শাহের কাজীর কাছে দুর্ব্যবহার পাইয়াছিলেন। হোসেন শাহের সরকার তাঁহার অভ্যুদয়ে কোনরূপ সাহায্য করে নাই, বরং নানাভাবে তাঁহার বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছিল। এ ব্যাপারও বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে সন্ন্যাসগ্রহণের পরে চৈতন্যদেব আর বাংলায় থাকেন নাই, হিন্দু রাজার দেশ উড়িষ্যা চলিয়া গিয়াছিলেন; বাংলায় থাকিলে বিধর্মী রাজশক্তি তাঁহার ধর্মচর্চ্চার বিঘ্ন ঘটাইতে পারে ভাবিয়াই তিনি হয়তো উড়িষ্যায় গিয়াছিলেন। হোসেন শাহ কর্ত্তৃক চৈতন্যদেবের মাহাত্ম স্বীকার যে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, সে কথা চৈতন্যচরিতকারেরাই বলিয়াছেন। ইহাও লক্ষণীয় যে হোসেন শাহ চৈতন্যদেবের ক্ষতি না করিবার আশ্বাস দিলেও তাঁহার হিন্দু কর্মচারীরা তাঁহার উপর আস্থা স্থাপন করিতে পারেন নাই।
চৈতন্যচরিগ্রন্থগুলির রচয়িতারা কোন সময়েই বলেন নাই যে হোসেন শাহ ধর্মবিষয়ে উদার ছিলেন। বরং তাঁহারা ইহার বিপরীত কথা লিখিয়াছেন। বৃন্দাবনদাস চৈতন্যভাগবতে’ হোসেন শাহকে “পরম দুর্বার” “যবন রাজা” বলিয়াছেন এবং চৈতন্যদেব ও তাঁহার সম্প্রদায় যে হোসেন শাহের নিকটে রামকেলি গ্রামে থাকিয়া হরিধ্বনি করিতেছিলেন, এজন্য তাঁহাদের সাহসের প্রশংসা করিয়াছেন। চৈতন্যচরিতগুলি পড়িলে বুঝা যায় যে, হোসেন শাহকে তাঁহার সমসাময়িক হিন্দুরা মোটেই ধর্মবিষয়ে উদার মনে করিত না, বরং তাঁহাকে অত্যন্ত ভয় করিত। অবৈষ্ণবরা প্রায়ই বৈষ্ণবদের এই বলিয়া ভয় দেখাইত যে, “যবন রাজা” অর্থাৎ হোসেন শাহ তাঁহাদের ধরিয়া লইয়া যাইবার জন্য তোক পাঠাইতেছেন।
সমসাময়িক পর্তুগীজ পর্যটক বারবোসা হোসেন শাহ সম্বন্ধে লিখিয়াছেন যে, তাঁহার ও তাঁহার অধীনস্থ শাসনকর্ত্তাদের আনুকূল্য অর্জনের জন্য প্রতিদিন বাংলায় অনেক হিন্দু ইসলামধর্ম গ্রহণ করিত। সুতরাং হোসেন শাহ যে হিন্দু-মুসলমানে সমদর্শী ছিলেন, সে কথা বলিবার কোন উপায় নাই।
উড়িষ্যার ‘মাদলা পাঞ্জী’ ও বাংলার চৈতন্যচরিগ্রন্থগুলি হইতে জানা যায় যে, হোসেন শাহ উড়িষ্যা-অভিযানে গিয়া বহু দেবমন্দির ও দেবমূর্ত্তি ধ্বংস করিয়াছিলেন। শেষবারের উড়িষ্যা-অভিযানে হোসেন শাহ সনাতনকে তাঁহার সহিত যাইতে বলিলে সনাতন বলেন যে, সুলতান উড়িষ্যায় গিয়া দেবতাকে দুঃখ দিবেন, এই কারণে তাঁহার সহিত তিনি যাইতে পারিবেন না।
যুদ্ধের সময়ে হোসেন শাহ হিন্দুধর্ম্মের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাইয়াছেন দেবমন্দির ও দেবমূর্ত্তি ধ্বংস করিয়া। শান্তির সময়েও তাঁহার হিন্দুর প্রতি অনুদার ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া যায়। তাঁহার মনিব সুবুদ্ধি রায় তাঁহাকে একদা বেত্রাঘাত করিয়াছিলেন, এইজন্য, তিনি সুবুদ্ধি রায়ের জাতি নষ্ট করেন। হোসেন শাহ যখন কেশব ছত্রীকে চৈতন্যদেবের কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, তখন কেশব ছত্রী তাঁহার, কাছে চৈতন্যদেবের মহিমা লাঘব করিয়া বলিয়াছিলেন। ইহা হইতে মনে হয়, হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রতি হোসেন শাহের পূর্ব-ব্যবহার খুব সন্তোষজনক ছিল না।
হোসেন শাহের অধীনস্থ আঞ্চলিক শাসনকর্ত্তা ও রাজকর্মচারীদের আচরণ সম্বন্ধে যে সব তথ্য পাই, সেগুলি হইতেও হোসেন শাহের হিন্দু-মুসলমানে সমদর্শিতা সম্বন্ধীয় ধারণা সমর্থিত হয় না। চৈতন্যভাগবত’ হইতে জানা যায়, যখন চৈতন্যদেব নবদ্বীপে হরি-সঙ্কীর্তন করিতেছিলেন এবং তাঁহার দৃষ্টান্ত অনুসরণে অন্যেরাও কীর্তন করিতেছিল, তখন নবদ্বীপের কাজী কীর্তনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’র মতে কাজী একজন কীর্তনীয়ার খোল ভাঙিয়া দিয়াছিলেন এবং কেহ কীর্তন করিলেই তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিয়া জাতি নষ্ট করিবেন বলিয়া শাসাইয়াছিলেন।
‘‘চৈতন্যচরিতামৃত’ হইতে জানা যায় যে, হোসেন শাহের অথবা তাঁহার পুত্র নসরৎ শাহের রাজত্বকালে বেনাপোলের জমিদার রামচন্দ্র খানের রাজকর বাকী পড়ায় বাংলার সুলতানের উজীর তাঁহার বাড়ীতে আসিয়া তাহাকে স্ত্রী-পুত্র সমেত বন্দী করেন এবং তাঁহার দুর্গামণ্ডপে গরু বধ করিয়া তিন দিন ধরিয়া তাঁহার মাংস রন্ধন করান; এই তিন দিন তিনি রামচন্দ্র খানের গৃহ ও গ্রাম নিঃশেষে লুণ্ঠন করিয়া তাঁহার জাতি নষ্ট করিয়া অবশেষে তাঁহাকে লইয়া চলিয়া যান। ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ হইতে আরও জানা যায় যে, সপ্তগ্রামের মুসলমান শাসকর্ত্তা নিছক গায়ের জোরে ঐ অঞ্চলের ইজারাদার হিরণ্য মজুমদার ও গোবর্ধন মজুমদারের নিকট সুলতানের কাছে তাঁহাদের প্রাপ্য আট লক্ষ টাকার ভাগ চাহিয়াছিলেন, তাঁহার মিথ্যা নালিশ শুনিয়া হোসেন শাহের উজীর হিরণ্য ও গোবর্ধনকে বন্দী করিতে আসিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের না পাইয়া গোবর্ধনের পুত্র নিরীহ রঘুনাথকে বন্দী করিয়াছিলেন; সর্বাপেক্ষা আশ্চর্যের বিষয়, সুলতানের কারাগারে বন্দী হইবার পরেও সপ্তগ্রামের শাসনকর্ত্তা রঘুনাথকে তর্জনগর্জন ও ভীতি-প্রদর্শন করিতে থাকেন।
বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের ‘মনসামঙ্গল’ হোসেন শাহের রাজত্বকালে রচিত হয়। এই গ্রন্থের “হাসন-হুসেন” পালায় লেখা আছে যে মুসলমানরা “জুলুম” করিত এবং “ছৈয়দ মোল্লা”রা হিন্দুদের কলমা পড়াইয়া মুসলমান করিত।
হোসেন শাহের রাজত্বকালে তাঁহার মুসলমান কর্মচারীরা হিন্দুদের ধর্মকর্ম লইয়া উপহাস করিত। বৈষ্ণবদের কীর্তনকে তাহারা বলিত “ভূতের সংকীর্তন”।
কেহ কেহ বলিতে পারেন যে হোসেন শাহের মুসলমান কর্মচারীদের বা প্রজাদের হিন্দু-বিদ্বেষ হইতে সুলতানের হিন্দু-বিদ্বেষ প্রমাণিত হয় না। কিন্তু হোসেন শাহ যদি হিন্দুদের উপর সহানুভূতি-সম্পন্ন হইতেন, তাহা হইলে তাঁহার কর্মচারীরা বা অন্য মুসলমানরা হিন্দু-বিদ্বেষের পরিচয় দিতে ও হিন্দুদের উপর নির্যাতন করিতে সাহস পাইত বলিয়া মনে হয় না। তাহা ছাড়া, হোসেন শাহও যে খুব বেশি হিন্দুদের প্রতি প্রসন্ন ছিলেন না, সে কথাও চৈতন্যচরিগ্রন্থগুলিতে লেখা আছে। ‘চৈতন্যচরিতামৃতের এক জায়গায় দেখা যায়, নবদ্বীপের মুসলমানরা স্থানীয় কাজীকে বলিতেছে যে নবদ্বীপে হিন্দুরা “হরি হরি” বলিয়া কোলাহল করিতেছে একথা শুনিলে বাদশাহ (অর্থাৎ হোসেন শাহ) কাজীকে শাস্তি দিবেন। চৈতন্যভাগবতে দেখা যায়, হোসেন শাহের হিন্দু কর্মচারীরা বলিতেছে যে হোসেন শাহ “মহাকালযবন” এবং তাঁহার ঘন ঘন “মহাতমোগুণবুদ্ধি জন্মে”। নৈষ্ঠিক বৈষ্ণবরা হোসেন শাহকে কোনদিনই উদার মনে করেন নাই। তাহাদের মতে হোসেন শাহ দ্বাপর যুগের কৃষ্ণলীলার সময়ে জরাসন্ধ ছিলেন।
সুতরাং হোসেন শাহ যে অসাম্প্রদায়িক-মনোভাবসম্পন্ন ছিলেন এবং হিন্দুদের প্রতি অপক্ষপাত আচরণ করিতেন, এই ধারণা একেবারেই ভুল।
অবশ্য হোসেন শাহ যে উকট রকমের হিন্দু-বিদ্বেষী বা ধর্মোন্মাদ ছিলেন না, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। তিনি যদি ধর্মোন্মাদ হইতেন, তাহা হইলে নবদ্বীপের কীর্তন বন্ধ করায় সেখানকার কাজী ব্যর্থতা বরণ করার পর স্বয়য়ং অকুস্থলে উপস্থিত হইতেন এবং বলপূর্বক কীর্তন বন্ধ করিয়া দিতেন। তাঁহার রাজত্বকালে কয়েকজন মুসলমান হিন্দু-ভাবাপন্ন হইয়া পড়িয়াছিলেন। চৈতন্যচরিতগ্রন্থগুলি হইতে জানা যায় যে শ্রীবাসের মুসলমান দর্জি চৈতন্যদেবের রূপ দেখিয়া প্রেমোন্মাদ হইয়া মুসলমানদের বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করিয়া হরিনাম কীর্তন করিয়াছিল; উৎকল সীমান্তের মুসলমান সীমাধিকারী ১৫১৫ খ্রীষ্টাব্দে চৈতন্যদেবের ভক্ত হইয়া পড়িয়াছিল; ইতিপূর্বে-নির্যাতিত যবন হরিদাস হোসেন শাহের রাজত্বকালে স্বাধীনভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতেন এবং নবদ্বীপে নগর-সংকীর্তনের সময়ে সম্মুখের সারিতে থাকিতেন। তাঁহার পর, হোসেন শাহেরই রাজত্বকালে চট্টগ্রামের শাসনকর্ত্তা পরাগল খান ও তাঁহার পুত্র ছুটি খান হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ মহাভারত শুনিতেন। হোসেন শাহের রাজধানীর খুব কাছেই রামকেলি, কানাই-নাটশালা প্রভৃতি গ্রামে বহু নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব বাস করিতেন। ত্রিপুরা-অভিযানে গিয়া হোসেন শাহের হিন্দু সৈন্যেরা গোমতী নদীর তীরে পাথরের প্রতিমা পূজা করিয়াছিল। হোসেন শাহ ধর্মোন্মাদ হইলে এ সব ব্যাপার সম্ভব হইত না।
আসল কথা, হোসেন শাহ ছিলেন বিচক্ষণ ও রাজনীতিচতুর নরপতি। হিন্দুধর্ম্মের প্রতি অত্যধিক বিদ্বেষের পরিচয় দিলে অথবা হিন্দুদের মনে বেশি আঘাত দিলে তাঁহার ফল যে বিষময় হইবে, তাহা তিনি বুঝিতেন। তাই তাঁহার হিন্দুবিরোধী কার্যকলাপ সংখ্যায় অল্প না হইলেও তাহা কোনদিনই একেবারে মাত্রা ছাড়াইয়া যায় নাই।
. অনেকের ধারণা, হোসেন শাহই বাংলার শ্রেষ্ঠ সুলতান এবং তাঁহার রাজত্বকালে বাংলা দেশ ও বাঙালী জাতি চরম সমৃদ্ধি লাভ করিয়াছিল। এই ধারণা একেবারে অমূলক নয়। তবে বাংলার অন্যান্য শ্রেষ্ঠ সুলতানদের সম্বন্ধে হোসেন শাহের মত এত বেশি তথ্য পাওয়া যায় না, সে কথাও মনে রাখিতে হইবে। হোসেন শাহের রাজত্বকালেই চৈতন্যদেবের অভ্যুদয় ঘটিয়াছিল বলিয়া চৈতন্যচরিতগ্রন্থগুলিতে প্রসঙ্গক্রমে হোসেন শাহ ও তাঁহার আমল সম্বন্ধে বহু তথ্য লিপিবদ্ধ হইয়াছে। অন্য সুলতানদের রাজত্বকালে অনুরূপ কোন ঘটনা ঘটে নাই বলিয়া তাঁহাদের সম্বন্ধে এত বেশি তথ্য কোথাও লিপিবদ্ধ হয় নাই। সুতরাং হোসেন শাহই যে বাংলার শ্রেষ্ঠ সুলতান, এ কথা জোর করিয়া বলা যায় না। ইলিয়াস শাহী বংশের প্রথম তিনজন সুলতান এবং রুকনুদ্দীন বারবক শাহ কোন কোন দিক দিয়া তাঁহার তুলনায় শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করিতে পারেন।
হোসেন শাহের শিলালিপির সাক্ষ্য হইতে দেখা যায়, তিনি ১৫১৯ খ্রীষ্টাব্দের আগস্ট মাস পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। সম্ভবত তাঁহার কিছু পরে তিনি পরলোকগমন করিয়াছিলেন। বাবরের আত্মকাহিনী হইতে পরিষ্কারভাবে জানা যায় যে, হোসেন শাহের স্বাভাবিক মৃত্যু হইয়াছিল।
২
নাসিরুদ্দীন নসরৎ শাহ
আলাউদ্দীন হোসেন শাহের মৃত্যুর পর তাঁহার সুযোগ্য পুত্র নাসিরুদ্দীন নসরৎ শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে দেখা যায় যে পিতার মৃত্যুর অন্ত ত তিন বৎসর পূর্বে নসরৎ শাহ যুবরাজপদে অধিষ্ঠিত হন এবং নিজ নামে মুদ্রা প্রকাশ করিবার অধিকার লাভ করেন। কোন কোন ইতিহাসগ্রন্থের মতে নসরৎ শাহ হোসেন শাহের ১৮ জন পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন এবং পিতার মৃত্যুর পরে তিনি তাঁহার ভ্রাতাদের কোন অনিষ্ট করিয়া তাহাদের পিতৃদত্ত বৃত্তি দ্বিগুণ করিয়া দেন।
‘রিয়াজ-উস্-সলাতীন’ এবং অন্য কয়েকটি সূত্র হইতে জানা যায় যে, নসরৎ শাহ ত্রিহুতের রাজা কংসনারায়ণকে বন্দী করিয়া বধ করেন এবং ত্রিহুত সম্পূর্ণভাবে অধিকার করার জন্য তাঁহার ভগ্নীপতি মখদুম আলমকে নিযুক্ত করেন। ত্রিহুতে প্রচলিত একটি শ্লোকের মতে ১৫২৭ খ্রীষ্টাব্দে এই ঘটনা ঘটিয়াছিল।
হোসেন শাহের রাজ্য বাংলার সীমা অতিক্রম করিয়া বিহারের তিতরেও অনেকখানি পর্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিল বটে, কিন্তু পাশেই পরাক্রান্ত লোদী সুলতানদের রাজ্য থাকায় বাংলার সুলতানকে কতকটা সশঙ্কভাবে থাকিতে হইত। নসরৎ শাহের সিংহাসনে আরোহণের দুই বৎসর পরে লোদী সুলতানদের রাজ্যে ভাঙন ধরিল; পাটনা হইতে জৌনপুর পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল প্রায় স্বাধীন হইল এবং এই অঞ্চলে লোহানী ও ফর্মুলি বংশীয় আফগান নায়করা প্রাধান্য লাভ করিলেন। নসরৎ শাহ ইঁহাদের সহিত মৈত্রী স্থাপন করিলেন।
এদিকে ১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দে বাবর পাণিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীকে পরাস্ত ও নিহত করিয়া দিল্লি অধিকার করিলেন এবং দ্রুত রাজ্যবিস্তার করিতে লাগিলেন। আফগান নায়কেরা তাঁহার হাতে পরাজিত হইয়া পূর্ব ভারতে পলাইয়া গেলেন। ক্রমশ ঘর্ঘরা নদীর তীর পর্যন্ত অঞ্চল বাবরের রাজ্যভুক্ত হইল। ঘর্ঘরা নদীর এপার হইতে নসরৎ শাহের রাজ্য আরম্ভ। বাবর কর্ত্তৃক পরাস্ত ও বিতাড়িত আফগানদের অনেকে নসরৎ শাহের কাছে আশ্রয় লাভ করিল। কিন্তু নসরৎ প্রকাশ্যে বাবরের বিরুদ্ধাচরণ করিলেন না। বাবর নসরতের কাছে দূত পাঠাইয়া তাঁহার মনোভাব জানিতে চাহিলেন, কিন্তু ঐ দূত নসরৎ শাহের সভায় বৎসরাধিককাল থাকা সত্ত্বেও নসরৎ শাহ খোলাখুলিভাবে কিছুই বলিলেন না। অবশেষে যখন বাবরের সন্দেহ জাগ্রত হইল, তখন নসরৎ বাবরের দূতকে ফেরৎ পাঠাইয়া নিজের দূতকে তাঁহার সঙ্গে দিয়া বাবরের কাছে অনেক উপহার পাঠাইয়া বন্ধুত্ব ঘোষণা করিলেন। ফলে বাবর বাংলা আক্রমণের সঙ্কল্প ত্যাগ করিলেন।
ইহার পর বিহারের লোহানী-প্রধান বহার খানের আকস্মিক মৃত্যু ঘটায় তাঁহার বালক পুত্র জলাল খান তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হইলেন। শের খান সূর দক্ষিণ বিহারের জায়গীর গ্রহণ করিলেন। ইতিমধ্যে ইব্রহিম লোদীর ভ্রাতা মাহমুদ নিজেকে ইব্রাহিমের উত্তরাধিকারী বলিয়া ঘোষণা করিয়াছিলেন। তিনি জৌনপুর অধিকার করিলেন এবং বালক জলাল খান লোহানীর রাজ্য কাড়িয়া লইলেন। জলাল খান হাজীপুরে পলাইয়া গিয়া তাঁহার পিতৃবন্ধু নসরৎ শাহের কাছে আশ্রয় চাহিলেন, কিন্তু নসরৎ শাহ তাঁহাকে হাজীপুরে আটক করিয়া রাখিলেন। শের খান প্রমুখ বিহারের আফগান নায়কেরা মাহমুদের সহিত যোগ দিলেন। অতঃপর তাহারা বাবরের রাজ্য আক্রমণ করিলেন। কিন্তু শের খান শীঘ্রই বশ্যতা স্বীকার করিলেন। অন্যদের দমন করিবার জন্য বাবর সৈন্যবাহিনীসমেত বক্সারে আসিলেন। জলাল লোহানী অনুচরবর্গ সমেত কৌশলে নসরতের কবল হইলে মুক্তিলাভ করিয়া বক্সারে বাবরের কাছে আত্মসমর্পণ করিবার জন্য রওনা হইলেন।
‘রিয়াজের মতে নসরৎ শাহও বাবরের বিরুদ্ধে এক সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করিয়াছিলেন। কিন্তু বাবরের আত্মকাহিনীতে এরূপ কোন কথা পাওয়া যায় না। বাবর নসরতের নিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে কোন প্রকাশ্য প্রমাণ পান নাই। তিনি তিনটি সর্তে নসরৎ শাহের সহিত সিন্ধ করিতে চাহিলেন। এই সর্তগুলির মধ্যে একটি হইল, ঘর্ঘরা নদী দিয়া বাবরের সৈন্যবাহিনীর অবাধ চলাচলের অধিকার দিতে হইবে। কিন্তু বাবর বারবার অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও নসরৎ শাহ সন্ধির প্রস্ত বি অনুমোদন করিলেন না অথবা অবিলম্বে এই প্রস্তাবের উত্তর দিলেন না। এদিকে বাবর চরের মারফৎ সংবাদ পাইলেন যে বাংলার সৈনাবাহিনী গণ্ডক নদীর তীরে মখদূম-ই-আলমের নেতৃত্বে ২৪টি স্থানে সমবেত হইয়া আত্মরক্ষার ব্যবস্থা সুদৃঢ় করিতেছে এবং তাহারা বাবরের নিকট আত্মসমর্পণেচ্ছু আফগানদের আটকাইয়া রাখিয়া নিজেদের দলে টানিতেছে। বাবর নসরৎ শাহকে ঘর্ঘরা নদীর এপার হইতে সৈন্য সরাইয়া লইয়া তাঁহার পথ খুলিয়া দিতে বলিয়া পাঠাইলেন এবং নসরৎ তাহা না করিলে তিনি যুদ্ধ করিবেন, ইহাও জানাইয়া দিলেন। কয়েকদিন অপেক্ষা করিয়াও যখন বাবর নসরতের কাছে কোন উত্তর পাইলেন না, তখন তিনি বলপ্রয়োগের সিদ্ধান্ত করিলেন।
বাবর বাংলার সৈন্যদের শক্তি এবং কামান চালনায় দক্ষতার কথা জানিতেন, সেইজন্য বক্সারে খুব শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী লইয়া আসিয়াছিলেন। এই সৈন্যবাহিনী লইয়া বাবর জোর করিয়া ঘর্ঘরা নদী পার হইলেন। তাঁহার ফলে ১৫২৯ খ্রীষ্টাব্দের ২রা মে হইতে ৬ই মে পর্যন্ত বাংলার সৈন্যবাহিনীর সহিত বাবরের বাহিনীর যুদ্ধ হইল। বাংলার সৈন্যেরা প্রশংসনীয়ভাবে যুদ্ধ করিল; তাহাদের কামান-চালনার দক্ষতা দেখিয়া বাবর মুগ্ধ হইলেন; তিনি দেখিলেন বাঙালীদের কামান-চালনার হাত এত পাকা যে লক্ষ্য স্থির না করিয়া যথেচ্ছভাবে কামান-চালাইয়া তাহারা শত্রুদের পর্যুদস্ত করিতে পারে। দুইবার বাঙালীরা বাবরের বাহিনীকে পরাস্ত করিল। কিন্তু তাহারা শেষ রক্ষা করিতে পারিল না, বাবরের বাহিনীর শক্তি অধিক হওয়ায় তাহারাই শেষপর্যন্ত জয়ী হইল। যুদ্ধের শেষদিকে বসন্ত রাও নামে বাংলার একজন বিখ্যাত হিন্দু বীর অনুচরবর্গ সমেত বাবরের সৈন্যদের হাতে নিহত হইলেন। ৬ই মে দ্বিপ্রহরের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ হইয়া গেল। বাবর তাঁহার সৈনাবাহিনী সমেত ঘর্ঘরা নদী পার হইয়া সারণে পৌঁছিলেন। এখানে জলাল খান লোহানী তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন বাবর জলালকে বিহারে তাঁহার সামন্ত হিসাবে প্রতিষ্ঠা করিলেন।
কিন্তু নসরৎ শাহ এই সময়ে দূরদর্শিতার পরিচয় দিলেন। ঘর্ঘরার যুদ্ধের কয়েকদিন পরে মুঙ্গেরের শাহজাদা ও লস্কর-উজীর হোসেন খান মারফৎ তিনি বাবরের কাছে দূত পাঠাইয়া জানাইলেন যে বাবরের তিনটি সর্ত মানিয়া সন্ধি করিতে তিনি সম্মত। এই সময়ে বাবরের শত্রু আফগান নায়কদের কতকাংশ পর্যদস্ত, কতক নিহত হইয়াছিল, কয়েকজন বাবরের নিকট বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিল এবং কয়েকজন বাংলায় আশ্রয় লইয়াছিল; তাঁহার উপর বর্ষাও আসন্ন হইয়া উঠিতেছিল। তাই বাবরও সন্ধি করিতে রাজী হইয়া অপর পক্ষকে পত্র দিলেন। এইভাবে বাবর ও নসরৎ শাহের সংঘর্ষের শান্তিপূর্ণ সমাপ্তি ঘটিল। বাবরের সহিত সংঘর্ষের ফলে নসরৎ শাহকে কিছু কিছু অঞ্চল হারাইতে হইল এবং এই অঞ্চলগুলি বাবরের রাজ্যভুক্ত হইল।
‘রিয়াজ’-এর মতে বাবরের মৃত্যুর পর যখন হুমায়ুন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তাঁহার কিছুদিন পরে নসরৎ শাহের কাছে সংবাদ আসে যে হুমায়ুন বাংলা আক্রমণের উদ্যোগ করিতেছেন; তখন নসরৎ হুমায়ুনের শত্রু গুজরাটের সুলতান বাহাদূর শাহের কাছে অনেক উপহার সমেত দূত পাঠান-উদ্দেশ্য তাঁহার সহিত জোট বাঁধা। এই কথা সত্য বলিয়া মনে হয় এবং সত্য হইলে ইহা হইতে নসরৎ শাহের কূটনীতিজ্ঞানের একটি প্রকৃষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়।
বাবর ভিন্ন আর যেসব শক্তির সহিত নসরৎ শাহের সংঘর্ষ হইয়াছিল, তন্মধ্যে ত্রিপুরা অন্যতম। ‘রাজমালা’র মতে নসরৎ শাহের সমসাময়িক ত্রিপুরারাজ দেবমাণিক্য চট্টগ্রাম জয় করিয়াছিলেন। পক্ষান্তরে মুহম্মদ খান মঞ্জুল হোসেন কাব্যে লিখিয়াছেন যে তাঁহার পূর্বপুরুষ হামজা খান ত্রিপুরার সহিত যুদ্ধে বিজয়ী হইয়াছিলেন। হামজা খান সম্ভবত চট্টগ্রামের শাসনকর্ত্তা ছিলেন এবং সময়ের দিক্ দিয়া তিনি নসরৎ শাহের সমসাময়িক। সুতরাং নসরৎ শাহের সহিত ত্রিপুরারাজের যুদ্ধ হইয়াছিল বলিয়া বুঝা যাইতেছে, তবে এই যুদ্ধে উভয়পক্ষই জয়ের দাবি করায় আসলে ইহার ফল কী হইয়াছিল তাহা বলা কঠিন।
‘অহোম বুরঞ্জী’তে লেখা আছে যে, নসরৎ শাহের রাজত্বকালে–১৫৩২ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা কর্ত্তৃক আসাম আক্রান্ত হইয়াছিল; ঐ বৎসরে “তুরবক” নামে বাংলার সুলতানের একজন মুসলমান সেনাপতি ৩০টি হাতি, ১০০০টি ঘোড়া এবং বহু কামান লইয়া অহোম রাজ্য আক্রমণ করেন এবং তেমনি দুর্গ জয় করিয়া সিঙ্গরি নামক দুর্ভেদ্য ঘাঁটির সম্মুখে তাঁবু ফেলিয়া অপেক্ষা করিতে থাকেন। বরপাত্র গোহাইন এবং রাজপুত্র সুক্লেনের নেতৃত্বে অহোমরাজের সৈন্যেরা সিঙ্গরি রক্ষা করিতে থাকে। অল্পকালের মধ্যেই দুই পক্ষে খণ্ডযুদ্ধ শুরু হইয়া গেল। কিছুদিন খণ্ডযুদ্ধ চলিবার পর সুক্রেন ব্রহ্মপুত্র নদ পার হইয়া মুসলমানদিগকে আক্রমণ করিলেন। মুসলমানরা প্রথমে তুমুল যুদ্ধের ফলে ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িলেও শেষপর্যন্ত জয়ী হইল। এই যুদ্ধে আটজন অহোম সেনাপতি নিহত হইলেন, রাজপুত্র সুক্রেন কোনক্রমে প্রাণে বাঁচিয়াও মারাত্মকভাবে আহত হইলেন, বহু অহোম সৈন্য জলে ডুবিয়া মরিল, অন্যেরা সালা নামক স্থানে পলাইয়া গেল। অহোমরাজ সৈন্যবাহিনী পুনর্গঠন করিয়া বরপাত্র গোহাইনের অধীনে রাখিলেন।
নসরৎ শাহের রাজত্বকালে পর্তুগীজরা আর একবার বাংলা দেশে ঘাঁটি স্থাপনের ব্যর্থ চেষ্টা করে। সিলভেরার আগমনের পর হইতে পর্তুগীজরা প্রতি বৎসরেই বাংলাদেশে একটি করিয়া জাহাজ পাঠাইত। ১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দে রুই-ভাজ পেরেরার অধিনায়কত্বে এইরূপ একটি পর্তুগীজ জাহাজ চট্টগ্রামে আসে। পেরেরা চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছিয়া সেখানে অবস্থিত খাজা শিহাবুদ্দীন নামে একজন ইরানী বণিকের পর্তুগীজ রীতিতে নির্মিত একটি জাহাজ কাড়িয়া লইয়া চলিয়া যান।
১৫২৮ খ্রীষ্টাব্দে মাতিম-আফলো-দে-মেলোর পরিচালনাধীন একটি পর্তুগীজ জাহাজ ঝড়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া বাংলার উপকূলের কাছে আসিয়া পড়ে। এখানকার কয়েক জন ধীবর ঐ জাহাজে পর্তুগীজদের চট্টগ্রামে পৌঁছাইয়া দিবার নাম করিয়া চকরিয়ায় লইয়া যায়। চকরিয়ার শাসনকর্ত্তা খোদা বশ খান জনৈক প্রতিবেশী ভূস্বামীর সহিত যুদ্ধে এই পর্তুগীজদের নিয়োজিত করেন, কিন্তু যুদ্ধে জয়লাভের পর তিনি তাহাদের পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মুক্তি না দিয়া সোরে শহরে বন্দী করিয়া রাখেন। ইহার পর আর একদল পর্তুগীজ অন্য এক জাহাজে করিয়া চকরিয়ায় আসিলেন এবং তাঁহাদের সব জিনিস খোদা বখশ খানকে দিয়া আফলো-দে-মেলোকে মুক্ত করিবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু খোদা বখশ খান আরও অর্থ চাহিলেন। পর্তুগীজদের কাছে আর কিছু ছিল না। দে-মেলো সদলবলে পলাইয়া ইহাদের সহিত যোগ দিতে চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হইলেন; তাঁহার রূপবান তরুণ ভ্রাতুষ্পুত্রকে ব্রাহ্মণেরা ধরিয়া দেবতার নিকট বলি দিল; অবশেষে পূর্ব্বোক্ত খাজা শিহাবুদ্দীনের মধ্যস্থতায় আফসো-দে-মেলো প্রচুর অর্থের বিনিময়ে মুক্ত হন এবং পর্তুগীজরা শিহাবুদ্দীনকে তাঁহার লুণ্ঠিত জাহাজ জিনিসপত্র সমেত ফিরাইয়া দেয়। শিহাবুদ্দীন বাংলার সুলতানের সহিত একটা বিষয়ের নিষ্পত্তি করিবার জন্য ও ওরমুজ যাইবার জন্য পর্তুগীজ জাহাজের সাহায্য চাহেন এবং তাঁহার বিনিময়ে পর্তুগীজদের বাংলায় বাণিজ্য করিবার ও চট্টগ্রামে দুর্গ নির্মাণ করিবার অনুমতি দিতে নসরৎ শাহকে সম্মত করাইবার চেষ্টা করিতে প্রতিশ্রুত হন। গোয়র পর্তুগীজ গভর্নর এই প্রস্তাবে সম্মত হইলেও এ সম্বন্ধে কিছু ঘটিবার পূর্বেই নসরৎ শাহের মৃত্যু হইল।
নসরৎ শাহ ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। গৌড়ে তিনি অনেকগুলি মসজিদ নির্মাণ করাইয়াছিলেন। আহার মধ্যে বিখ্যাত বারদুয়ারী বা সোনা মসজিদ অন্যতম। অনেকের ধারণা গৌড়ের বিখ্যাত ‘কম্ রসুল’ ভবনও নসরৎ শাহ নির্মাণ করাইয়াছিলেন; কিন্তু আসলে এটি শামসুদ্দীন য়ুসুফ শাহের আমলে নির্মিত হইয়াছিল। নসরৎ শাহ কেবলমাত্র এই ভবনের প্রকোষ্ঠে একটি মঞ্চ নির্মাণ করান এবং তাঁহার উপরে হজরৎমুহম্মদের পদচিহ্ন-সংবলিত একটি কালো কারুকার্যখচিত মর্মর-বেদী বসান। নসরৎ শাহ অনেক প্রাসাদও নির্মাণ করাইয়াছিলেন।
নসরৎ শাহের নাম সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের কয়েকটি রচনায়–যেমন শ্রীকর নন্দীর মহাভারতে এবং কবিশেখরের পদে–উল্লিখিত দেখিতে পাওয়া যায়। কবিশেখর নসরৎ শাহের কর্মচারী ছিলেন।
নসরৎ শাহের রাজ্যের আয়তন খুব বেশি ছিল। প্রায় সমগ্র বাংলা দেশ বিহুত ও বিহারের অধিকাংশ এবং উত্তর প্রদেশের কিয়দংশ নসরৎ শাহের অধিকারভুক্ত ছিল।
‘রিয়াজ’এর মতে নসরৎ শাহ শেষজীবনে জনসাধারণের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার করিয়া তাঁহার রাজত্বকে কলঙ্কিত করেন; এই কথার সত্যতা সম্বন্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। বিভিন্ন বিবরণের মতে নসরৎ শাহ আততায়ীর হস্তে নিহত হইয়াছিলেন; রিয়াজে’র মতে তিনি পিতার সমাধিক্ষেত্র হইতে ফিরিতেছিলেন, এমন সময়ে তাঁহার দ্বারা দণ্ডিত জনৈক খোঁজা তাঁহাকে হত্যা করে; বুকাননের বিবরণীর মতে নসরৎ শাহ নিদ্রিতাবস্থায় প্রাসাদের প্রধান খোঁজার হাতে নিহত হন।
৩
আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহ (দ্বিতীয়)
নাসিরুদ্দীন নসরৎ শাহের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। ইনি দ্বিতীয় আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহ, কারণ এই নামের আর একজন সুলতান ইতিপূর্বে ১৪১৪ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন।
সুলতান হইবার পূর্বে ফিরোজ শাহ যখন যুবরাজ ছিলেন, তখন তাঁহার আদেশে শ্রীধর কবিরাজ নামে জনৈক কবি একখানি ‘কালিকামঙ্গল’ বা ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রচনা করেন–এইটিই প্রথম বাংলা ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য, এই কাব্যটিতে শ্রীধর তাঁহার আজ্ঞাদাতা যুবরাজ “পেরোজ শাহা” অর্থাৎ ফিরোজ শাহ এবং তাঁহার পিতা নৃপতি “নসীর শাহ” অর্থাৎ নাসিরুদ্দীন নসরৎ শাহের নাম উল্লেখ করিয়াছেন। শ্রীধর সম্ভবত চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোক, কারণ তাঁহার ‘কালিকামঙ্গলের পুঁথি চট্টগ্রাম অঞ্চলেই পাওয়া গিয়াছে। ইহা হইতে মনে হয়, নসরৎ শাহের রাজত্বকালে যুবরাজ ফিরোজ শাহ চট্টগ্রাম অঞ্চলের শাসনকর্ত্তা ছিলেন এবং সেই সময়েই তিনি শ্রীধর কবিরাজকে দিয়া এই কাব্যখানি লেখান।
অসমীয়া বুরঞ্জী হইতে জানা যায়, নসরৎ শাহ আসামে যে অভিযান প্রেরণ করিয়াছিলেন, তাহা নসরতের মৃত্যুর পরেও চলিয়াছিল। ফিরোজ শাহের রাজত্বকালে বাংলার বাহিনী আসামের ভিতর দিকে অগ্রসর হয়। অতঃপর বর্ষার আগমনে তাহাদের অগ্রগতি বন্ধ হয়। ১৫৩২ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে তাহারা খলাধরিতে (দরং জেলা) উপনীত হয়। অহোমরাজ বুরাই নদীর মোহনা পাহারা দিবার জন্য শক্তিশালী বাহিনী পাঠাইলেন এবং পরিখা কাটাইলেন। মুসলমানরা তখন ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীরে সরিয়া গিয়া সালা দুর্গ অধিকার করিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু দুর্গের অধ্যক্ষ তাহাদের উপর গরম জল ঢালিয়া দিয়া তাহাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করিলেন। দুই মাস ইতস্তত খণ্ডযুদ্ধ চলার পর উভয় পক্ষের মধ্যে একটি বৃহৎ স্থলযুদ্ধ হইল। অহোমরা ৪০০ হাতি লইয়া মুসলমান অশ্বারোহী ও গোলন্দাজ সৈন্যের সহিত যুদ্ধ করিল এবং এই যুদ্ধে তাহারা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হইয়া দুর্গের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করিল। প্রায় এই সময়েই ফিরোজ শাহ প্রায় এক বৎসর রাজত্ব করিবার পর তাঁহার পিতৃব্য গিয়াসুদ্দীন মাহমূদের হস্তে নিহত হন। অতঃপর গিয়াসুদ্দীন সিংহাসনে আরোহণ করেন।
৪
গিয়াসুদ্দীন মাহমূদ শাহ
‘রিয়াজ’-এর মতে গিয়াসুদ্দীন মাহমূদ শাহ নসরৎ শাহের কাছে ‘আমীর’ উপাধি লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু মাহমূদ শাহ সম্ভবত নসরৎ শাহের রাজত্বকালে বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়াছিলেন–মুদ্রার সাক্ষ্য হইতে এই কথা মনে হয়। গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহের পূর্ব নাম আবদুল বদ্। তিনি আব্দ্ শাহ ও বদর শাহ নামেও পরিচিত ছিলেন।
গিয়াসুদ্দীন মাহমূদ শাহ শের শাহ ও হুমায়ুনের সমসাময়িক। তাঁহাদের সহিত মাহমুদ শাহের ভাগ্য পরিণামে এক সূত্রে জড়িত হইয়া পড়িয়াছিল। প্রামাণিক ইতিহাসগ্রন্থগুলি হইতে এ সম্বন্ধে যাহা জানা যায়, তাঁহার সারমর্ম নিম্নে প্রদত্ত হইল।
গিয়াসুদ্দীন মাহমূদ শাহ বিহার প্রদেশ আফগানদের নিকট হইতে জয় করিবার পরিকল্পনা করেন এবং এই উদ্দেশ্যে কুত্ত্ব খান নামে একজন সেনাপতিকে প্রেরণ করেন। শের খান সূর ইহার বিরুদ্ধে প্রথমে ব্যর্থ প্রতিবাদ জানান, তারপর অন্যান্য আফগানদের সঙ্গে মিলিয়া কুত্ত্ব খানের সহিত যুদ্ধ করিয়া তাঁহাকে বধ করেন। বাংলার সুলতানের অধীনস্থ হাজীপুরের সরলস্কর মখদূম-ই-আলম (মাহমূদ শাহের ভগ্নীপতি) মাহমূদ শাহ্ ভ্রাতুষ্পুত্রকে হত্যা করিয়া সুলতান হওয়ার জন্য তাঁহার বিরুদ্ধে ত্রিহুতে বিদ্রোহ করিয়াছিলেন; মখদূম-ই-আলম ছিলেন শের খানের বন্ধু। তিনি কুত্ত্ব খানকে সাহায্য করেন নাই, এই অপরাধে মাহমূদ শাহ তাঁহার বিরুদ্ধে এক সৈন্যবাহিনী পাঠাইলেন। এইসময়ে শের খান বিহারের অধিপতি নাবালক জলাল খান লোহানীর অমাত্য ও অভিভাবক ছিলেন। শের খানের কাছে নিজের ধনসম্পত্তি জিম্মা রাখিয়া মখদূম-ই-আলম মাহমূদ শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে গেলেন, এই যুদ্ধে তিনি নিহত হইলেন।
এদিকে জলাল খান লোহানী শের খানের অভিভাবকত্ব সহ্য করিতে না পারিয়া মাহমূদের কাছে গিয়া তাঁহার অধীনতা স্বীকার করিলেন এবং তাহাকে অনুরোধ জানাইলেন শের খানকে দমন করিতে। মাহমূদ জলাল খানের সহিত কুত্ত্ব খানের পুত্র ইব্রাহিম খানকে বহু সৈন্য, হাতি ও কামান সঙ্গে দিয়া শের খানের বিরুদ্ধে পাঠাইলেন। শের খানও সসৈন্যে অগ্রসর হইলেন। পূর্ব বিহারের সূরজগড়ে দুই পক্ষের সৈন্য পরস্পরের সম্মুখীন হইল। শের খান চারিদিকে মাটির প্রাকার তৈরী করিয়া ছাউনী ফেলিলেন; ঐ ছাউনী ঘিরিয়া ফেলিয়া ইব্রাহিম খান তোপ বসাইলেন এবং মাহমূদ শাহকে নূতন সৈন্য পাঠাইতে অনুরোধ জানাইলেন। প্রাকারের মধ্য হইতে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করিয়া শের খান ইব্রাহিমকে দূত মারফৎ জানাইলেন যে পর দিন সকালে তিনি আক্রমণ করিবেন; তারপর তিনি প্রকারের মধ্যে অল্প সৈন্য রাখিয়া অন্য সৈন্যদের লইয়া উঁচু জমির আড়ালে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। সকালে ইব্রাহিম খানের সৈন্যদের প্রতি একবার তীর ছুঁড়িয়া শের খানের অশ্বারোহী সৈন্যেরা পিছু হটিল; তাহারা পলাইতেছে ভাবিয়া বাংলার অশ্বারোহী সৈন্যেরা তাহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিল। তখন শের খান তাঁহার লুক্কায়িত সৈন্যদের লইয়া বাংলার সৈন্যদের আক্রমণ করিলেন, তাহারা স্থিরভাবে যুদ্ধ করিতে লাগিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত পরাজিত হইল এবং ইব্রাহিম খান নিহত হইলেন। বাংলার বাহিনীর হাতি, তোপ ও অর্থ-ভাণ্ডার সব কিছুই শের খানের দখলে আসিল। ইহার পর শের খান তেলিয়াগড়ি (সাহেবগঞ্জের নিকটে অবস্থিত) পর্যন্ত মাহমূদ শাহের অধিকারভুক্ত সমস্ত অঞ্চল অধিকার করিলেন। মাহমূদ শাহের সেনাপতিরা–বিশেষত পর্তুগীজ বীর জোআঁ-দে-ভিল্লালোবোস ও জোআঁ কোরীয়া–শের খানকে তেলিয়াগড়ি ও সকরিগলি গিরিপথ পার হইতে দিলেন না। তখন শের খান অন্য এক অপেক্ষাকৃত অরক্ষিত পথ দিয়া বাংলা দেশে প্রবেশ করিলেন এবং ৪০,০০০ অশ্বারোহী সৈন্য, ১৬,০০০ হাতি, ২০,০০০ পদাতিক ও ৩০০ নৌকা লইয়া রাজধানী গৌড় আক্রমণ করিলেন। নির্বোধ মাহমূদ শাহ তখন ১৩ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দিয়া শের খানের সহিত সন্ধি করিলেন। শের খান তখনকার মত ফিরিয়া গেলেন। ইহার পর তিনি মাহমুদ শাহেরই অর্থে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করিয়া এক বৎসর বাদে মাহমুদের কাছে “সার্বভৌম নৃপতি হিসাবে তাঁহার প্রাপ্য নজরানা বাবদ” এক বিরাট অর্থ দাবি করিলেন এবং মাহমূদ তাহা দিতে রাজী না হওয়ায় তিনি আবার গৌড় আক্রমণ করিলেন। শের খানের পুত্র জলাল খান এবং সেনাপতি খওয়াস খানের নেতৃত্বে প্রেরিত এক সৈন্যবাহিনী গৌড় নগরীর উপর হানা দিয়া নগরীটি ভস্মীভূত করিল এবং সেখানে লুঠ চালাইয়া ষাট মণ সোনা হস্ত গত করিল।
এই সময়ে হুমায়ুন শের খানকে দমন করিবার জন্য বিহার অভিমুখে রওনা হইয়াছিলেন। তিনি চুনার দুর্গ জয় করিয়াছেন, এই সংবাদ শুনিয়া শের খান বিচলিত হইলেন। তিনি ইতিমধ্যে বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা রোটাস দুর্গ জয় করিয়াছিলেন। মাহমূদ শাহ গৌড় নগরীকে প্রাকার ও পরিখা দিয়া ঘিরিয়া আত্মরক্ষা করিতেছিলেন। শের খানের সেনাপতি খওয়াস খান একদিন পরিখায় পড়িয়া মারা গেলেন। তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা মোসাহেব খানকে ‘খওয়াস খান’ উপাধি দিয়া শের খান গৌড়ে পাঠাইলেন। ইনি ৬ই এপ্রিল, ১৫৩৮ খ্রী তারিখে গৌড় নগরী জয় করিলেন। তখন শের খানের পুত্র জলাল খান মাহমূদের পুত্রদের বন্দী করিলেন; মাহমূদ শাহ স্বয়ং পলায়ন করিলেন, শের খান তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করায় মাহমুদ শের খানের সহিত যুদ্ধ করিলেন এবং এই যুদ্ধে পরাজিত ও আহত হইলেন। শের খান হুমায়ুনের নিকট দূত পাঠাইলেন, কিন্তু মাহমূদ হুমায়ুনের সাহায্য চাহিলেন এবং তাঁহাকে জানাইলেন যে শের খান গৌড় নগরী অধিকার করিলেও বাংলার অধিকাংশ তাঁহারই দখলে আছে। হুমায়ুন মাহমূদের প্রস্তাবে রাজী হইয়া গৌড়ের দিকে রওনা হইলেন। শের খান বকুণ্ডা দুর্গে গিয়াছিলেন; তাঁহার বিরুদ্ধে হুমায়ুন এক বাহিনী পাঠাইলেন। তখন শের খান তাঁহার বাহিনীকে রোটাস দুর্গে পাঠাইয়া স্বয়ং পার্ব্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় লইলেন। শোণ ও গঙ্গার সঙ্গমস্থলে আহত মাহমূদ শাহের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া হুমায়ুন গৌড়ের দিকে রওনা হইলেন। জলাল খান হুমায়ুনকে তেলিয়াগড়ি গিরিপথে এক মাস আটকাইয়া রাখিয়া অবশেষে পথ ছাড়িয়া দিলেন। এই এক মাসে শের খান গৌড় নগরের লুণ্ঠনলব্ধ ধনসম্পত্তি লইয়া ঝাড়খণ্ড হইয়া রোটাস দুর্গে গমন করেন। হুমায়ুন তেলিয়াগড়ি গিরিপথ অধিকার করিবার পরেই গিয়াসুদ্দীন মাহমূদ শাহের মৃত্যু হইল। অতঃপর হুমায়ুন বিনা বাধায় গৌড় অধিকার করেন (জুলাই, ১৫৩৮ খ্রীষ্টাব্দ)।
নসরৎ শাহের রাজত্বকালে বাংলার সৈন্যবাহিনী আসামে যে অভিযান শুরু করিয়াছিল, মাহমূদ শাহের রাজত্বকালে তাহা ব্যর্থতার মধ্য দিয়া সমাপ্ত হয়। ফিরোজ শাহের রাজত্বকালে বাংলার বাহিনী অসমীয়া বাহিনীকে পরাস্ত করিয়া সালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য করিয়াছিল। অসমীয়া বুরঞ্জী হইতে জানা যায়, ১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলার মুসলমানরা জল ও স্থলে তিন দিন তিন রাত্রি অবিরাম আক্রমণ চালাইয়াও সালা দুর্গ অধিকার করিতে পারে নাই। ইহার পর অসমীয়া বাহিনী বুরাই নদীর মোহনায় মুসলমান নৌবাহিনীকে যুদ্ধে পরাস্ত করে। মুসলমানরা আর একবার সালা জয় করিবার চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হয়। ইহার পর তাহারা দুইমুনিশিলার যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়; তাহাদের ২০টি জাহাজ অসমীয়ারা জয় করে এবং মুসলমানদের অন্যতম সেনাপতি ও ২৫০০ সৈন্য নিহত হয়।
ইহার পর হোসেন খানের নেতৃত্বে একদল নূতন শক্তিশালী সৈন্য যুদ্ধে যোগ দেয়। ইহাতে মুসলমানরা উৎসাহিত হইয়া অনেকদূর অগ্রসর হয়। কিছুদিন পরে ডিকরাই নদীর মোহনায় দুই পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজিত হইল; তাহাদের মধ্যে অনেকে নিহত হইল; অনেকে শত্রুদের হাতে ধরা পড়িল। ১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে হোসেন খান অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া ভরালি নদীর কাছে অসমীয়া বাহিনীকে দুঃসাহসিকভাবে আক্রমণ করিতে গিয়া নিহত হইলেন, তাঁহার বাহিনীও ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল।
আসাম-অভিযানে ব্যর্থতার পরে মুসলমানরা পূর্বদিক হইতে অসমীয়াদের এবং পশ্চিম দিক হইতে কোচদের চাপ সহ্য করিতে না পারিয়া কামরূপও ত্যাগ করিতে বাধ্য হইল।
গিয়াসুদ্দীন মাহমূদ শাহের রাজত্বকালেই পর্তুগীজরা বাংলা দেশে প্রথম বাণিজ্যের ঘাঁটি স্থাপন করে। পর্তুগীজ বিবরণগুলি হইতে জানা যায় যে, ১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দে গোঁয়ার পর্তুগীজ গভর্নর নুনো-দা-কুনহা খাজা শিহাবুদ্দীনকে সাহায্য করিবার ও বাংলায় বাণিজ্য আরম্ভ করিবার জন্য মারতিম-আফসো-দে-মেলোকে পাঠান। পাঁচটি জাহাজ ও ২০০ লোক লইয়া চট্টগ্রামে পৌঁছিয়া দে-মেলো বাংলার সুলতানকে ১২০০ পাউণ্ড মূল্যের উপহার পাঠান। সদ্য ভ্রাতুষ্পুত্ৰ-হত্যাকারী মাহমূদ শাহের মন তখন খুব খারাপ। পর্তুগীজদের উপহারের মধ্যে মুসলমানদের জাহাজ হইতে লুট করা কয়েক বাক্স গোলাপ জল আছে আবিষ্কার করিয়া তিনি পর্তুগীজদের বধ করিতে মনস্থ করেন; কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি পর্তুগীজ দূতদের বধ করিয়া বন্দী করেন। অন্যান্য পর্তুগীজদের বন্দী করিবার জন্য তিনি চট্টগ্রামে একজন লোক পাঠান। এই লোকটি চট্টগ্রামে আসিয়া আফলো-দে-মেলো ও তাঁহার অনুচরদের নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করিল। ভোজসভায় একদল সশস্ত্র মুসলমান পর্তুগীজদের আক্রমণ করিল। দে-মেলো বন্দী হইলেন। তাঁহার ৪০ জন অনুচরের অনেকে যুদ্ধ করিয়া নিহত হইলেন, অন্যেরা বন্দী হইলেন; যাঁহারা নিমন্ত্রণে আসেন নাই, তাহারা সমুদ্রতীরে শূকর শিকার করিতেছিলেন। অতর্কিতভাবে আক্রান্ত হইয়া তাঁহাদের কেহ নিহত, কেহ বন্দী হইলেন। পর্তুগীজদের এক লক্ষ পাউণ্ড মুল্যের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিয়া হতাবশিষ্ট ত্রিশজন পর্তুগীজকে লইয়া মুসলমানরা প্রথমে অন্ধকূপের মত ঘরে বিনা চিকিৎসায় আটক করিয়া রাখিল, তাঁহার পর সারারাত্রি হাঁটাইয়া মাওয়া নামক স্থানে লইয়া গেল এবং তাঁহার পর তাহাদের গৌড়ে লইয়া গিয়া পশুর মত ব্যবহার করিয়া নরক-তুল্য স্থানে আটক করিয়া রাখিল।
পর্তুগীজ গর্ভনর এই কথা শুনিয়া ক্রুদ্ধ হইলেন। তাঁহার দূত আন্তোনিও-দে সিভা-মেনেজেস ৯টি জাহাজ ও ৩৫০ জন লোক লইয়া চট্টগ্রামে আসিয়া মাহমূদ শাহের কাছে দূত পাঠাইয়া বন্দী পর্তুগীজদের মুক্তি দিতে বলিলেন; না দিলে যুদ্ধ করিবেন বলিয়াও জানাইলেন; মাহমূদ ইহার উত্তরে গোঁয়ার গভর্নরকে ছুতার, মণিকার ও অন্যান্য মিস্ত্রী পাঠাইতে অনুরোধ জানাইলেন, বন্দীদের মুক্তি দিলেন না। মেনেজেসের দূতের গৌড় হইতে চট্টগ্রামে ফিরিতে মাসাধিককাল দেরী হইল; ইহাতে অধৈর্য হইয়া মেনেজেস চট্টগ্রামের এক বৃহৎ অঞ্চলে আগুন লাগাইলেন এবং বহু লোককে বন্দী ও বধ করিলেন। তখন মাহমূদ মেনেজেসের দূতকে বন্দী করিতে আদেশ দিলেন, কিন্তু দূত ততক্ষণে মেনেজেসের কাছে পৌঁছিয়া গিয়াছে।
ঠিক এই সময়ে শের খান সূর বাংলা আক্রমণ করেন। তাঁহার ফলে মাহমুদ শাহ গৌড়ের পর্তুগীজ বন্দীদের বধ না করিয়া তাহাদের কাছে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা সম্বন্ধে পরামর্শ চাহিলেন। ইতিমধ্যে দিয়াগো-রেবেলো নামে একজন পর্তুগীজ নায়ক তিনটি জাহাজসহ গোয়া হইতে সপ্তগ্রামে আসিয়া মাহমূদ শাহকে বলিয়া পাঠাইলেন যে পর্তুগীজ বন্দীদের মুক্তি না দিলে তিনি সপ্তগ্রামে ধ্বংসকাণ্ড বাধাইবেন। মাহমূদ তখন অন্য মানুষ। তিনি পর্তুগীজ দূতকে খাতির করিলেন এবং রেবেলোকে খাতির করিবার জন্য সপ্তগ্রামের শাসনকর্ত্তাকে বলিয়া পাঠাইলেন। গোঁয়ার গভর্নরের কাছে দূত পাঠাইয়া তিনি শের খানের বিরুদ্ধে সাহায্য চাহিলেন এবং তাঁহার বিনিময়ে বাংলায় পর্তুগীজদের কুঠি ও দুর্গ নির্মাণ করিতে দিতে প্রতিশ্রুত হইলেন। রেবেলোর কাছে তিনি ২১ জন পর্তুগীজ বন্দীকে ফেরৎ পাঠাইলেন এবং আফন্সে-দে-মেলোর পরামর্শ প্রয়োজন বলিয়া তাঁহাকে রাখিয়া দিলেন। মাহমূদ ও দে-মেলো উভয়ের নিকট হইতে পত্র পাইয়া পর্তুগীজ গভর্নর মাহমূদকে সাহায্য পাঠাইয়া দিলেন। শের খানের বিরুদ্ধে জোআঁ দে ভিল্লাললাবোস ও জোআঁ কোরীআর নেতৃত্বে দুই জাহাজ পর্তুগীজ সৈন্য যুদ্ধ করিল, তাহারা শের খানকে “গরিজ” (‘গড়ি’ অর্থাৎ তেলিয়াগড়ি) দুর্গ ও “ফারানডুজ” (পাণ্ডুয়া?) শহর অধিকার করিতে দিল না। শের খানের সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইলেও মাহমূদ পর্তুগীজদের বীরত্ব দেখিয়া খুশী হইলেন। আফসো-দে-মেলোকে তিনি বিস্তর পুরস্কার দিলেন। তাঁহার নিকট হইতে পর্তুগীজরা অনেক জমি ও বাড়ী পাইল এবং কুঠি ও শুল্কগৃহ নির্মাণের অনুমতি পাইল। চট্টগ্রাম ও সপ্তগ্রামে তাহারা দুইটি শুল্কগৃহ স্থাপন করিল। চট্টগ্রামেরটি বড় শুল্কগৃহ, অপরটি ছোট। পর্তুগীজরা স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান অধিবাসীদের কাছে খাজনা আদায়ের অধিকার এবং আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা লাভ করিল। সুলতান পর্তুগীজদের এত সুবিধা ও ক্ষমতা দিতেছেন দেখিয়া সকলেই আশ্চর্য হইল। বলা বাহুল্য ইহার ফল ভাল হয় নাই। কারণ বাংলা দেশে এইরূপ শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করিবার পরেই পর্তুগীজরা বাংলার নদীপথে ভয়াবহ অত্যাচার করিতে সুরু করে।
পর্তুগীজরা ঘাঁটি স্থাপনের পর দলে দলে পর্তুগীজ বাংলায় আসিতে লাগিল। কিন্তু কাম্বের সহিত পর্তুগীজদের যুদ্ধ বাধায় পর্তুগীজ গভর্নর আফসো-দে মেলোকে ফেরৎ চাহিলেন এবং মাহমূদকে বলিলেন যে এখন তিনি বাংলায় সাহায্য পাঠাইতে পারিতেছেন না, পরের বৎসর পাঠাইবেন। মাহমূদ পাঁচজন পর্তুগীজকে সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতির জামিন স্বরূপ রাখিয়া দে-মেলো সমেত অন্যান্যদের ছাড়িয়া দিলেন। ইহার ঠিক পরেই শের শাহ আবার গৌড় আক্রমণ ও অধিকার করেন। পর্তুগীজ গভর্নর পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মাহমূদকে সাহায্য করিবার জন্য ৯ জাহাজ সৈন্য পাঠাইয়াছিলেন। কিন্তু এই নয়টি জাহাজ যখন চট্টগ্রামে পৌঁছিল, তাঁহার পূর্বেই মাহমূদ শের খানের সহিত যুদ্ধে পরাজিত হইয়া পরলোকগমন করিয়াছেন।
গিয়াসুদ্দীন মাহমূদ শাহ নিষ্ঠুরভাবে নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রকে বধ করিয়া সুলতান হইয়াছিলেন। তিনি যে অত্যন্ত নির্বোধও ছিলেন, তাহা তাঁহার সমস্ত কার্যকলাপ হইতে বুঝিতে পারা যায়। ইহা ভিন্ন তিনি যৎপরোনাস্তি ইন্দ্রিয়পরায়ণও ছিলেন; সমসাময়িক পর্তুগীজ বণিকদের মতে তাঁহার ১০,০০০ উপপত্নী ছিল।
মাহমূদ শাহের কর্মচারীদের মধ্যে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। বিখ্যাত পদকর্ত্তা কবিশেখর-বিদ্যাপতি যে মাহমূদ শাহের কর্মচারী ছিলেন, তাহা ‘বিদ্যাপতি’ নামাঙ্কিত একটি পদের ভণিতা হইতে অনুমিত হয়।