০৬. হোটেল থেকে বেরিয়েই

আমাদের হোটেল থেকে বেরিয়েই যে চৌমাথার কথা বলেছিলাম, সেটা দিয়ে ডাইনে ঘুরলে পড়ে শুক্র পথ। এই শুক্র পথ দিয়ে কিছু দূর গেলেই এখানকার সুপার মার্কেট। একটা বেশ বড় ছাতওয়ালা চত্বরের চারদিক ঘিরে দোকানের সারি। কোনটা যে কীসের দোকান বোঝা মুশকিল, কারণ প্রায় সবকটাতেই সব কিছুই পাওয়া যায়। জামাকাপড় ঘড়ি ক্যামেরা রেকডার রেডিয়ো ক্যালকুলেটার কলম পেনসিল টফি চকোলেট—কী না নেই, আর সবই অবশ্য বিদেশি জিনিস।

‘ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে ভাই তপেশ’, একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন লালমোহনবাবু।

‘কেন?’

‘এসব দোকান কী আর আমাদের জন্যে? এখানে আসবে জন ডি রকফেলার, কি বোম্বাইয়ের ফিল্ম স্টার!’

শেষ পর্যন্ত আর লোভ সামলাতে না পেরে পৌনে দু’ মিটার জাপানি টেরিউলের ট্রাউজারের কাপড় কিনে ফেললেন লালমোহনবাবু। এই গেরুয়া টাইপের রংটা লামাদের দেশে মানাবে ভাল, কী বলো তপেশ?’

আমাকে বাধ্য হয়ে বলতে হল লামাদের দেশটা আসলে হল তিব্বত, নেপালের শতকরা আশি ভাগ লোকই হিন্দু।

ট্রাউজারস আগামীকাল বিকেলে চারটেয় রেডি থাকবে, ট্রায়াল লাগবে না। লোকে দু’ দিনের জন্য এসেও কোট-প্যান্ট করিয়ে নিয়ে যায় কাঠমাণ্ডু থেকে, আর তার ফিটিংও হয় নাকি দিব্যি ভাল।

হোটেলে ফিরে এসে দেখি, ফেলুদা তার খাটে বসে নোটবুকটা খুলে কী যেন লিখছে। বলল, ‘বোস। ডাক্তারকে কল দিয়েছি।’

ডাক্তার? ডাক্তার আবার কেন? শরীর-টরীর খারাপ হল নাকি ফেলুদার?

আমরা দু’জনে সোফায় বসে ফেলুদার দিকে চেয়ে রইলাম রহস্য উদঘাটনের অপেক্ষায়।

ফেলুদা আরও দু’ মিনিট সময় নিল। তারপর খাতাটাকে পাশে সরিয়ে রেখে একটা চারমিনার ধরিয়ে বলল, ‘হরিনাথ চক্রবর্তী মশাইয়ের ছেলেকে যে ইনজেকশন দিয়েছিল, সেই ডঃ দিবাকরকে একটা কল দিয়েছি। ধর্ম পথে স্টার ডিসপেনসারিতে বসেন। তাঁর সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার। কিছু পয়সা খসবে, ভিজিট নেবে, তা সে আর কী করা যায়!’

‘আমাদের এই তদন্তে ওষুধপত্রের একটা বড় ভূমিকা আছে বলে মনে হচ্ছে!’ লালমোহনবাবু মন্তব্য করলেন।

ফেলুদা তার কথাগুলোর ওপর বেশ জোর দিয়ে বলল, ‘শুধু ভূমিকা নয়, আমার ধারণা প্রধান ভূমিকা।’

‘সেই যে সার্জিক্যাল অ্যাসিডের কথা অনীকেন্দ্র সোমের নোটবুকে লেখা ছিল, সেটা কী—’

‘সার্জিক্যাল নয়, লাইসার্জিক অ্যাসিড। এল এস ডি। অবিশ্যি—’

ফেলুদা আবার খাতাটা হাতে তুলে নিয়েছে, তার কপালে ভাঁজ।

‘এল এস ডি অক্ষরগুলোর আরেকটা মানে হতে পারে। সেটা এই কিছুক্ষণ হল খেয়াল হয়েছে। এল এস ডি—লাইফ সেভিং ড্রাগস, অর্থাৎ যে ড্রাগ বা ওষুধের উপর মানুষের মরণ-বাঁচন নির্ভর করে। যেমন টেট্যানাস-রোধক ইনজেকশন। বা পেনিসিলিন, টেরামাইসিন, স্ট্রেপটোমাইসিন, টি বি-র ওষুধ, হার্টের ওষুধ। আমার তো মনে হচ্ছে—’

ফেলুদা আবার খাতাটার দিকে দেখল। তারপর বলল—

“A-B-র বিষয় জানা দরকার” কথাটাও এই সব ওষুধের বিষয়েই বলা হয়েছে। এ বি হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিকস। মিঃ সোম বোধ হয়—বোধহয় কেন, নিশ্চয়ই—এই সব ড্রাগ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করতে চাচ্ছিলেন। রিং আপ পি সি এম, ডি ডি সি—পি সি এম তো প্রদোষচন্দ্র মিত্র, আর ডি ডি সি নির্ঘাত আমাদেরই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ডিরেকটোরেট অফ ড্রাগ কন্ট্রোল। সোম নিশ্চয় কোনও ওষুধ নিয়ে গিয়েছিল সঙ্গে, যেটা সে এই ড্রাগ কন্ট্রোলকে দিয়ে টেস্ট করাতে চেয়েছিল। আশ্চর্য। লোকটা যেরকম মেথডিক্যালি এগোচ্ছিল, তাতে তো মনে হয় ও ইচ্ছে করলে আই আই টি-র প্রোফেসরি ছেড়ে গোয়েন্দাগিরিতে নেমে পড়তে পারত।

‘আর C P নিয়ে যে ব্যাপারটা ছিল?’

‘ওটা সহজ। সি পি হল ক্যালকাটা পুলিশ। আস্ক সি পি অ্যাবাউট মেথডস্ অ্যান্ড কেসেস—অর্থাৎ পুলিশকে জিজ্ঞেস করতে হবে কত রকম ভাবে ওষুধ জাল হয়, আর আগে এ রকম জালের কেস কী কী ধরা পড়েছে।’

‘তা হলে তো খাতায় যা লেখা ছিল তার সবই—’

কলিং বেল।

আমি উঠে গিয়ে দরজা খুললাম।

যিনি ঢুকলেন, তাঁকে দেখলে বেশ হকচকিয়ে যেতে হয়, কারণ এত ফিটফাট ডাক্তার এর আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বয়স ষাটের মধ্যে, বিলিতি পোশাকটা নিশ্চয়ই কাঠমাণ্ডুর সেরা টেলারের তৈরি, চশমার সোনার ফ্রেমটা বিলিতি, হাতের সোনার ঘড়িটা নিশ্চয়ই পেশেন্টের কাছ থেকে পাওয়া।

ফেলুদা খাটে ছিল বলে ভদ্রলোক অনুমান করে নিলেন সেই রুগী। আমি খাটের পাশে একটা চেয়ার দিয়ে দিলাম। ফেলুদা উঠে দাঁড়িয়েছিল, এখন খাটেই বসল।

‘কী ব্যাপার?’

ভদ্রলোক বাংলা বলবেন আশা করিনি, কারণ ‘দিবাকর’ পদবিটা হয়তো বাংলা নয়। তারপর মনে হল এখানকার অনেকেই তো কলকাতায় গিয়ে পড়াশুনা করেছে। ইনিও নির্ঘাত মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা।

‘এই নিন।’

ফেলুদা বালিশের তলা থেকে একটা খাম বার করে ভদ্রলোককে দিল। ডাক্তার কিঞ্চিৎ হতভম্ব।

‘এটা—’

‘ওটা আপনার ফি। আর এইটে আমার কার্ড।’

কার্ড মানে ফেলুদার ভিজিটিং কার্ড, যাতে নামের তলায় ওর পেশাটা লেখা আছে।

ভদ্রলোক কার্ডটার দিকে দেখতে দেখতে চেয়ারে বসলেন।

‘আমি জানি, আপনার কাছে ব্যাপারটা এখনও পরিষ্কার হচ্ছে না,’ বলল ফেলুদা, ‘কিন্তু কয়েকটা কথা বললেই আপনি বুঝতে পারবেন।’

ডাক্তারের ভাব দেখে বুঝলাম, তিনি সত্যিই এখনও অন্ধকারে রয়েছেন।

ফেলুদা বলল, প্রথমেই বলি দিই, আমি একটা খুনের তদন্ত করছি। খুনটা হয়েছে কলকাতায়, কিন্তু আমার ধারণা খুনি এখানে রয়েছে। আমি সেই ব্যাপারে কিছু তথ্য সংগ্রহ করছি। আমার বিশ্বাস আপনি আমাকে কিছুটা সাহায্য করতে পারেন।’

খুন শুনেই ভদ্রলোকের ভুরুতে ভাঁজ পড়েছে। বললেন, ‘কে খুন হয়েছে?’

‘সেটা পরে বলছি,’ বলল ফেলুদা, ‘আগে একটা জিনিস একটু ভেরিফাই করে নিই—হরিনাথ চক্রবর্তীর ছেলেকে তো আপনি অ্যান্টি-টেট্যানাস ইনজেকশন দেন?’

‘হ্যাঁ, আমিই।’

‘ইনজেকশনটা বোধ করি আপনার স্টক থেকেই এসেছিল?’

‘হ্যাঁ। আমার ডিসপেনসারির স্টক।’

‘কিন্তু তাতে কাজ দেয়নি!’

‘তা দেয়নি, কিন্তু তার জন্য আমাকে রেসপনসি—’

‘আপনি ব্যস্ত হবেন না, ডঃ দিবাকর। দায়িত্বের প্রশ্ন এখনও আসছে না। ইনজেকশন দিয়েও লোকে টেট্যানাসে মরেছে এমন ঘটনা নতুন নয়। সাধারণ লোক সেটা মেনেই নেয়। হরিনাথবাবুও তাঁর ছেলের মৃত্যু মেনেই নিয়েছেন। কিন্তু ডাক্তার হয়ে, হিমাদ্রি চক্রবর্তীর মৃত্যুর কী কারণ, সে সম্বন্ধে হয়তো আপনার কোনও মতামত থাকতে পারে।’

‘কারণ একটা নয়,’ বললেন ডাঃ দিবাকর, ‘প্রথমত সে নিজেই জানত না তার ইনজুরি কখন হয়েছে। তার বন্ধু বলেছে পনেরো-ষোল ঘণ্টা আগে। সেটা যদি ষোল না হয়ে ছাব্বিশ হয়, দেন দ্য ইনজেকশন মাইট হ্যাভ বিন টু লেট। দ্বিতীয়ত, সে ছেলে আগে কোনও কালে প্রিভেনটিভ নিয়েছে কি না সেটারও কোনও ঠিক নেই। নেওয়া থাকলে ইনজেকশনে কাজ দেবার সম্ভাবনা থাকে বেশি। ছেলে বলছে মনে নেই, বাবা বলছে নিয়েছে। হরিনাথবাবুর কথা, খুব বেশি নির্ভর করা যায় না। ওঁর স্ত্রী আর ছেলে মারা যাবার পর থেকে আমি দেখেছি ভদ্রলোকের মাঝে মাঝে মেমরি ফেল করে।’

ফেলুদা বলল, ‘হিমাদ্রির মৃত্যুর পর ওর বন্ধু কি আপনার ডিসপেনসারি থেকে কোনও ইনজেকশনের অ্যামপুল নেয়?’

‘নিয়েছিল।’

‘অ্যান্টি-টেট্যানাস?’

‘হ্যাঁ।’

‘সেটা আপনি জানলেন কী করে? সে কি আপনার সঙ্গে দেখা করেছিল?’

‘দেখা করেছিল বললে ঠিক বলা হবে না। সে আমার চেম্বারে ঢুকে এসে আমায় জানিয়ে দিয়ে যায় যে আমিই তার বন্ধুর মৃত্যুর জন্য দায়ী। আর সেটা যে সে খুব নরম ভাবে জানিয়েছিল তা নয়।’

‘এই বন্ধুটিই খুন হয়েছে।’

‘মানে?’

‘হিমাদ্রি চক্রবর্তীর বন্ধু। অনীকেন্দ্র সোম।’

ডাঃ দিবাকর অবাক হয়ে চেয়ে আছেন ফেলুদার দিকে। ফেলুদা বলে চলল—

‘সে আপনার দোকান থেকে ওষুধ নিয়ে কলকাতা গিয়েছিল ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করাবে বলে। সম্ভবত সে-কাজটা তার করা হয়ে ওঠেনি। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে ইনজেকশনে ভেজাল ছিল। সে চেয়েছিল যে আমার সাহায্য নিয়ে এই জাল ওষুধের চোরা কারবারটা একবার তলিয়ে দেখবে।’

‘আমার ডিসপেনসারি থেকে কোনও জাল ওষুধ বেরোয়নি,’ দৃঢ় স্বরে বললেন ডাঃ দিবাকর।

‘আপনি কি ওষুধ খাঁটি কি না পরীক্ষা করে ইনজেকশন দেন?’

ভদ্রলোক রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।

‘হাউ ইজ দ্যাট পসিবল? এমারজেন্সি কেস, তখন আমি ওষুধ পরীক্ষা করব, না ইনজেকশন দেব?’

‘আপনার ডিসপেনসারির ওষুধ আসে কোত্থেকে?’

‘হোলসেলারদের কাছে থেকে। তাতে ব্যাচ নাম্বার থাকে, এক্সপায়ারি ডেট থাকে—’

‘সে সবই যে জাল করা যায় সেটা আপনি জানেন? ছাপাখানার সঙ্গে বন্দোবস্ত থাকে চোরা কারবারিদের সেটা জানেন? নাম-করা বিলিতি কোম্পানির লেবেল পর্যন্ত ছাপাখানার ব্যাকডোর দিয়ে চলে যায় এই সব জালিয়াতদের হাতে সেটা আপনি জানেন?’

ডাঃ দিবাকরকে দেখে বেশ বুঝতে পারলাম যে তিনি এ কথার যুৎসই উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না।

‘শুনুন ডঃ দিবাকর,’ ফেলুদা এবার একটু নরম সুরে বলল, ‘আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি যে, ঘুণাক্ষরে কেউ ব্যাপারটা জানবে না। আপনি স্টক থেকে একটা অ্যান্টি-টেট্যানাসের অ্যামপুল নিয়ে তার ভেতরের পদার্থটি ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করে তার রিপোর্ট আমাকে দিন। সময় বেশি নেই, সেটা বুঝতেই পারছেন।’

ডাঃ দিবাকর ধীরে ধীরে উঠে পড়লেন চেয়ার থেকে। ‘কাল একটা জরুরি কেস আছে,’—দরজার দিকে যেতে যেতে বললেন ভদ্রলোক—‘কাল সম্ভব না হলে পরশু জানাব।’

‘আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ; এবং আপনাকে এভাবে উত্যক্ত করার জন্য আমি ক্ষমা চাইছি।’

আমরা যে একটা সাংঘাতিক গোলমেলে ব্যাপারের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি সেটা বেশ বুঝতে পারছি। আর, যতই নতুন নতুন ব্যাপার শুনছি, ততই অনীকেন্দ্র সোম লোকটার উপর শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে। এমন একজন লোকের এভাবে খুন হওয়াটা যে ফেলুদা কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারবে না সেটা খুবই স্বাভাবিক। কুকরিটার জন্য দু’ নম্বর বাটরাকেই খুনি বলে মনে হয়; কিন্তু তা না হয়ে যদি অন্য কেউও হয়, ফেলুদা তাকে শায়েস্তা না করে ছাড়বে না।

ফেলুদা আগেই বলে রেখেছিল যে খাবার পরে একবার ঘুরতে বেরোবে, তবে সেটা কী উদ্দেশ্যে সেটা আন্দাজ করতে পারিনি। দরবার স্কোয়ারের দিকে যাচ্ছি দেখে মনে একটা সন্দেহ উঁকি দিল, আর সেটা যে ঠিক, সেটা বুঝতে পারলাম যখন পুরনো প্যালেসের সামনে খোলা জায়গাটায় এসে ফেলুদা বলল, ‘এবার বল কোন গলিটায় গিয়েছিলি দুপুরে।’

রাত্তিরে দরবার স্কোয়ারের চেহারা একেবারে অন্যরকম। এখান থেকে ওখান থেকে মন্দিরের ঘণ্টা শোনা যাচ্ছে, এরই মধ্যে কোত্থেকে যেন হিন্দি ফিল্মের গান ভেসে আসছে। ট্যুরিস্টদের ভিড় আর সাইকেল-রিকশার ভিড় কাটিয়ে আমরা গলিটার মুখে গিয়ে পড়লাম। ‘এটার নাম আগে ছিল মারু টোল’, বলল ফেলুদা, ‘হিপিরা এর নতুন নাম দিয়েছে পিগ অ্যালি—শুয়োর গলি।’

পাই শপগুলোর পাশ দিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম আমাদের সেই তিব্বতি দোকানটার দিকে।

দোকানটা এখনও খোলা রয়েছে। দু’একজন খদ্দেরও রয়েছে কাউন্টারের এদিকে, আর পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সকালের সেই মহিলা। সেই পুরুষটা নেই।

ফেলুদা দোকানের বাইরে থেকেই ভেতরটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিল। দোতলা বাড়ির এক তলায় দোকানটা। দোতলায় রাস্তার দিকে দুটো পাশাপাশি জানলা, দুটোই বন্ধ। কাঠের পাল্লাগুলোর একটার ফাটলের মধ্যে দিয়ে ঘরের ভিতর একটা ক্ষীণ আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

দোকানের ডান পাশে একটা সরু চিলতে গলির পরেই একটা তিনতলা হোটেল, নাম হেভেনস্ গেট লজ। স্বর্গদ্বার বলতে চোখের সামনে যে দৃশ্যটা ভেসে ওঠে তার সঙ্গে কোনও সাদৃশ্য নেই।

ফেলুদা হোটেলটার ভিতরে গিয়ে ঢুকল, পিছনে আমরা দু’জন।

‘হাউ মাচ ডু ইউ চার্জ ফর রুমস হিয়ার?’

কাউন্টারে একটা রোগামতন লোক বসে একটা ছোট্ট পকেট ক্যালকুলেটরের উপর পেনসিলের ডগা দিয়ে টোকা মেরে মেরে হিসেব করে একটা খাতায় লিখছে। লোকটা নেপালি কি ভারতীয় সেটা বোঝা গেল না। ফেলুদা তাকে প্রশ্নটা করেছে।

‘সিঙ্গল টেন, ডাব্‌ল ফিফটিন।’

কাউন্টারের সামনে খোলা জায়গাটার এক পাশে একটা খালি সোফা, তার উপরে দেওয়ালে তিনটে পাশাপাশি টুরিস্ট পোস্টার, তিনটেতেই হিমালয়ের কোনও না কোনও বিখ্যাত শৃঙ্গের ছবি।

‘ঘর খালি আছে?’ ফেলুদা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল।

‘ক’টা চাই?’

‘একটা সিঙ্গল একটা ডাবল। দোতলার পুবদিকে হলে ভাল হয়। অবিশ্যি নেবার আগে একবার দেখে নেওয়া দরকার।’

কাউন্টারের ভদ্রলোক যাকে বলে স্বল্পভাষী। মুখে কিছু না বলে শুধু একটা বেল টিপলেন, তার ফলে একটি নেপালি বেয়ারার আবির্ভাব হল। ভদ্রলোক তার হাতে একটা চাবি দিয়ে আমাদের দিকে একবার শুধু দেখিয়ে দিয়ে আবার হিসেব করতে লেগে গেলেন।

বেয়ারার পিছন পিছন সিঁড়ি উঠে আমরা সোজা চলে গেলাম পুবমুখো একটা প্যাসেজ দিয়ে। ডাইনের শেষ ঘরটা চাবি দিয়ে খুলে দিল বেয়ারা।

ঘরের বর্ণনা দেবার কোনও মানে হয় না, কারণ ফেলুদা যে ঘর ভাড়া করতে আসেনি সেটা খুব ভাল করেই জানি।

যেটা বলা দরকার সেটা এই যে, ঘরটার পুব দেয়ালে একটা জানালা রয়েছে যেটা দিয়ে তিব্বতি দোকানের দোতলার একটা জানালা এক পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে।

লালমোহনবাবু যতক্ষণ খাটের গদি-টদি টিপে, বাথরুমের বাতি জ্বালিয়ে ভিতরটা দেখে, টেবিলের দেরাজ খোলা কি না দেখে, আমরা যে সত্যিই ঘর নিতে এসেছি—এমন একটা ধারণা বেয়ারার মনে ঢোকানোর চেষ্টা করছেন, ততক্ষণে আমি আর ফেলুদা যা দেখার দেখে নিলাম।

দোকানে দুপুরে যে তিব্বতি লোকটাকে দেখেছিলাম, সে বসে আছে ওই টিমটিমে বাতি-জ্বালা ঘরটার ভেতর। তার কাঁধ অবধি দেখা যাচ্ছে। তবে বেশ বোঝা যায় সে কোনও একটা কাজে ব্যস্ত। তার পিছনে কার্ড বোর্ডের প্যাকিং কেসের স্তুপ দেখে মনে হল, সে হয় বাক্স থেকে জিনিস বার করছে, না হয় বাক্সের মধ্যে পুরছে।

আরেকজন লোক রয়েছে ঘরের ভেতর, তবে তার শুধু ছায়াটা দেখা যাচ্ছে। সে যে ঘাড় নিচু করে তিব্বতিটার কাজ দেখছে সেটা বোঝা যায়।

হঠাৎ আমার বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল।

ছায়াটা পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করেছে।

সিগারেট মুখে গোঁজার পর আরেকটা জিনিস বার করল পকেট চাপড়িয়ে।

লাইটার।

এবার লাইটারটা জ্বালানো হল।

বাঁ হাতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *