০৬. হরু ঘোষালের আধখানা দাড়ি

হরু ঘোষালের আধখানা দাড়ি কামাইয়া বাকিটা রাখিয়া দেওয়ায় তারা নাপিতের যতই পরিহাস-রসিকতা প্রকাশ পাইয়া থাকুক এবং গ্রামের লোকে প্রথমটা হরু ঘোষালের সেই অর্ধনারীশ্বরবৎ রূপ দেখিয়া হাসিয়া ব্যাপারটা যতই হাস্যকর করিয়া তুলুক,–প্রতিক্রিয়ার পালাটা কিন্তু সহজ ও আদৌ হাস্যকর হইল না; অত্যন্ত ঘোরালো এবং গম্ভীর হইয়া উঠিল।

হরিশ মণ্ডল প্রবীণ মাতব্বর ব্যক্তি লোকটির সূক্ষ্ম বোধশক্তিও আছে। সে-ই প্রথম বলিল–হাসিস না তোরা, হাসির ব্যাপার এটা নয়। গায়ের অবস্থাটা কি হল একবার ভেবে দেখেছিস?

সকলেই হাসির বেগের প্রবলতা খানিকটা সংবরণ করিয়া হরিশের মুখের দিকে চাহিল। হরিশ গম্ভীরভাবে বলিল—ঘোর অরাজক।

ভবেশ পাল—ছির কাকাস্থূল ব্যক্তি, তবুও বুদ্ধিমত্তার ভান তাহার আছে, সে-ও গম্ভীর হইয়া বলিলতা বটে।

দেবনাথ হাসি-তামাশায় যোগ দিবার মত লোক নয়;সে ব্যাপারটা অনুমান করিয়া লইয়া বলিল—এ আপনারা আটকাবেন কি করে? গায়ের জোটান আছে আপনাদের? ওই কামার-ছুতোরের পঞ্চাইতি আসরে ছিরু দ্বারিক চৌধুরীর অপমান করলে, চৌধুরী উঠে চলে গেল, জগন ডাক্তার তো এই না—উন্টে অনিরুদ্ধকে উস্কে দিলে।

ভবেশ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল হরিনাম সত্য হে! কলিশেষে এক বর্ণ হইবে যবন-এ কি আর মিথ্যা কথা বাবা? এমনি করেই ধৰ্মকৰ্ম্ম জাতজরম সব যাবে।

হরিশ বলিল-ওদিকে লুটনী দাই কি বলছে জান? আমার বউমায়ের নমাস চলছে তো! তাই বলে পাঠিয়েছিলাম যে, রাত-বিরেতে কোথাও যদি যাস তবে আগে খবর দিয়ে যাস যেন! তা বলেছে—আমাকে কিন্তু নগদ বিদেয় করতে হবে।

গভীর চিন্তায় বিভোর হইয়া ভবেশ বলিল—হুঁ।

হরিশ বলিরাজা বিনে রাজ্যনাশ যে বলে—কথাটা মিথ্যে নয়। আমাদের জমিদার যে হয়েছে সে থেকেও না থাকা!

দেবনাথ সঙ্গে সঙ্গে বলিল—জমিদারের কথা বাদ দেন। জমিদার আমাদের খারাপ কিসের? এ কাজ তো জমিদারের নয়—আপনাদের। আপনারা কই শক্ত হয়ে বসে ডাকুন দেখি মজলিস। ঘাড় হেঁট করে সবাইকে আসতে হবে। আসবে নাচালাকি নাকি? বিপদ-আপদ কি নাই তাদের? লোহাতে মুড় বাধিয়ে ঘর করে সব? চৌধুরীকে ডাকুন-জগন ডাক্তারকে ডাকুন ডেকে আগে ঘর বুঝুন। তারপর কামার, ছুতোর, বায়েন, দাই, ধোপা, নাপিত এদের ডাকুন, আর ন্যায্য বিচার করুন। তাদের পাওনাটা কড়ায় গণ্ডায় পাবার ব্যবস্থা করতে হবে।

হরিশ মাতব্বরদের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল—এ দেবনাথ কিন্তু বলেছেন ভাল! কি বলেন গো সব?

ভবেশ বলিল—উত্তম কথা!

নটবর বলিল হাঁ, তাই করুন তা হলে।

দেবনাথের উৎসাহের সীমা ছিল না, সে বলিল-আজই বসুন সব সন্ধের সময়! আমি আসর করে দিচ্ছি, স্কুলের চল্লিশ বাতির আলো দিচ্ছি; খবরও দিচ্ছি সকলকে। কি বলছেন সব?

হরিশ আবার সকলের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল—কি গো?

—তা বেশ খানিকটা তামাক আর আগুনের যোগাড় রেখে বাপু।

****

বহুকাল পর চণ্ডীমণ্ডপের আটচালাটা আবার আলোকোজ্জ্বল হইয়া গ্ৰাম্যমজলিসে জমিয়া উঠিল। ত্রিশ বৎসর পূর্বেও এই আটচালা ও চণ্ডীমণ্ডপ এমনিভাবে নিত্য সন্ধ্যায় জমজমাট হইয়া উঠিত। গ্রাম্য-বিচার হইত, সংকীর্তন হইত, পাশা-দাবাও চলিত; গ্রামখানির সলাপরামর্শের কেন্দ্ৰস্থল ছিল এই চণ্ডীমণ্ডপ ও আটচালা। গ্রামে কাহারও কোনো কুটুম্ব সজ্জন আসিলে—এই চণ্ডীমণ্ডপেই বসানো হইত। ক্রিয়া-কর্ম-অন্নপ্রাশন, বিবাহ, শ্ৰাদ্ধ—সবই এইখানে অনুষ্ঠিত হইত। কালগতিকে ধুলার অবলেপনে অবলুপ্তপ্রায় বহু বসুধারার চিহ্ন এখনও শিবমন্দিরের দেওয়ালে এবং চণ্ডীমণ্ডপের থামের গায়ে অঙ্কিত দেখা যায়। তখন গ্রামে ব্যক্তিগত বৈঠকখানা বা বাহিরের ঘর কাহারও ছিল না। জগন ডাক্তারের পূর্বপুরুষ জগনের পিতামহই কবিরাজ হইয়া বাহিরের ঘর বা বৈঠকখানার পত্তন করিয়াছিল। প্রথমে সে অবশ্য এই চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়াই রোগী। দেখিত। তারপর অবস্থার পরিবর্তনের জন্যও বটে এবং জমিদারের গোমস্তার সঙ্গে কি কয়েকটা কথান্তরের জন্যও বটে কবিরাজ ঔষধালয় ও বৈঠকখানা তৈয়ারি করিয়া ঔষধালয় খুলিল এবং সেখানে পান ও তামাকের সাচ্ছল্যে মজলিস জমাইয়া চণ্ডীমণ্ডপের মজলিসে ভাঙন ধরাইয়া দিল। তারপর ক্ৰমে ক্ৰমে অনেকের বাড়িতেই একটি করিয়া বাহিরের ঘরের পত্তন হইয়াছে। সেইগুলিকে কেন্দ্ৰ করিয়াই সমগ্র গ্রাম জুড়িয়া এখন অনেকগুলি ছোট ছোট মজলিস বসে। কেহ। কেহ বা একাই একটি আলো জ্বালিয়া সম্মুখের অন্ধকারের দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া বসিয়া। থাকে। তবে এখনও জগন ডাক্তারের ওখানেই মজলিসটি বড় হয়। জগনের রূঢ় দাম্ভিকতা সত্ত্বেও রোগীর বাড়ির লোকজন সেখানে যায়; আরও কয়েকজন যায়—ডাক্তারের অর্ধ-সাপ্তাহিক খবরের কাগজের সংবাদের প্রত্যাশায়। দেবনাথ ঘোষ এত বিরূপতা সত্ত্বেও যায়। সেই চিৎকার করিয়া কাগজ পড়ে, অন্য সকলে শোনে। অসহযোগ আন্দোলন তখন শেষ হইয়াছে, স্বরাজপার্টির উগ্র বক্তৃতায় এবং সমালোচনায় কাগজের স্তম্ভগুলি পরিপূর্ণ। শ্রোতাদের মনে চমক লাগে—স্তিমিতগতি পল্লীবাসীর রক্তে যেন একটা উষ্ণ শিহরন অনুভূত হয়।

আজ চণ্ডীমণ্ডপের মজলিসে দেবনাথই সকলকে সম্ভাষণ জানাইতেছিল, সে-ই উদ্যোক্তা, মজলিস আরম্ভ হইবার পূর্ব হইতেই আসর সে বেশ জমাইয়া তুলিয়াছে। চণ্ডীমণ্ডপের বাহিরের দেবস্থলের আঙিনায় পুরনো বকুল গাছটি গ্রামের ষষ্ঠীতলা, একটি বাসুদেব মূর্তি সেখানে গাছের শিকড়ের বন্ধনে একেবারে অ্যাঁটিয়া বসিয়া আছে; সেইটিই ষষ্ঠীদেবী বলিয়া পূজিত হয়। সেখানে একটা মোটা শুকনা ডাল জ্বালিয়া আগুন করা হইয়াছে। আগুনের চারিপাশে গ্রামের জনকতক হরিজন আসিয়া বসিয়া গিয়াছে। ভদ্ৰ সজ্জনেরা প্রায় সকলেই আসিয়াছে। কেবল দ্বারকা চৌধুরী, জগন ডাক্তার, ছিরু পাল এবং আরও দু-একজন এখনও আসে নাই।

চল্লিশ বাতির আলোয় আলোকিত চণ্ডীমণ্ডপটির উপরের দিকে চাহিয়া ভবেশ বলিল–দেখতে বেশ লাগছে বাপু।

হরিশও একবার চারিদিক দেখিয়া লইয়া বলিল—এইবার কিন্তু একবার মেরামত করতে হবে চণ্ডীমণ্ডপটিকে। বলিয়া সে সপ্রশংস কণ্ঠে বলিল—কি কাঠামো দেখ দেখি! ওঃ কি কাঠ!

দেবনাথ বলিল—ষড়দলে কি লেখা আছে জানেন?—যাবচ্চন্দ্রার্কমেদিনী। মানে চন্দ্ৰ-সূর্যপৃথিবী যতদিন থাকবে, এও ততদিন থাকবে।

—তা থাকবে বাপু। বলিহারি বলিহারি! ভবেশ পাল অকারণে উচ্ছ্বসিত এবং পুলকিত হইয়া উঠিল।

ঠিক এই সময়েই দ্বারকা চৌধুরী লাঠি হাতে টুকটুক করিয়া আসিয়া বলিলেন—ওঃ, তলব যে বড় জোর গো!

দেবনাথ ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া গেল; জগন ডাক্তার ও ছিরু র জন্য আবার সে দুটি ছেলেকে দুজনের কাছে পাঠাইয়া দিল। কিন্তু জগন ডাক্তার আসল না, সে স্পষ্ট বলিয়া দিয়াছে—তাহার সময় নাই। চোখে চশমা লাগাইয়া সে নাকি খবরের কাগজ পড়িতেছে। ছিও আসে নাই; তাহার জ্বর হইয়াছে, তবে সে বলিয়াছে,-পাচজনে যা করবেন তাই আমার মত।

ছিরুর এই অযাচিত বিনয়ে দেবনাথ অত্যন্ত আশ্চর্য হইয়া গেল।

****

ছিরুর কথাটা অস্বাভাবিকতা দোষে দুষ্ট; বিনয়ের ধার ছিরু পাল ধারে না। জ্বর তাহার হয়ই নাই। সে নির্মম আক্ৰোশে গর্তের ভিতরকার আহত অজগরের মত মনে মনে পাক খাইয়া ঘুরিতেছিল। বাড়ির ভিতরে দাওয়ার উপর উবু হইয়া বসিয়া সে প্রকাও বড় কাটায় ক্রমাগত একঘেয়ে টান টানিয়া যাইতেছিল ও প্রখর নির্নিমেষ দৃষ্টিতে উঠানের একটা বিন্দুর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বসিয়া ছিল। নানা চিন্তা তাহার মাথার মধ্যে ঘুরিতেছে।

ঘরে আগুন লাগাইয়া দিলে কি হয়! মনটা আনন্দে চঞ্চল হইয়া ওঠে। পরক্ষণেই মনে হয়, না। সদ্য সদ্য আক্ৰোশের বশে একটা কিছু করিয়া বসিল আবার হয়ত ফ্যাসাদে পড়িতে হইবে। আজই পঞ্চাশ টাকা জমাদার বন্ধুকে দিতে হইয়াছে। ই লইয়া তাহার মা এখনও গজগজ করিয়া তাহাকে গালি পাড়িতেছে।

–মর, তুই মক্ রে! এমন রাগ তোর! একটু সবুর নাই! হাদাগাড়োল গোয়ার কোথাকার, পঞ্চাশ টাকা আমার খলখল করে বেরিয়ে গেল! আমার বুকে বাঁশ চাপিয়ে দে তুই—আমার হাড় জুড়োক।

শ্ৰীহরি সেদিকে কানই দিতেছে না। অন্য সময় হইলে এতক্ষণে সে বুড়ির চুলের মুঠো ধরিয়া উঠানে আছাড় মারিয়া ফেলিয়া নির্মম প্রহার আরম্ভ করি। কিন্তু আজ সে নিষ্ঠুর প্রতিহিংসার চিন্তায় একেবারে মগ্ন হইয়া গিয়াছে।

অনিরুদ্ধ ওপার হইতে রাত্রি নটা-দশটার সময় ফেরে। অন্ধকারে অতর্কিত আক্রমণে না। সঙ্গে গিরিশ ছুতোর থাকে। থাকিলেই বা, দুজনকে ঘায়েল করিয়া দেওয়াই বা এমন কি কঠিন? শ্ৰীহরিরও মিতে আছে। মিতে গড়াঞী সানন্দে তাহাকে সাহায্য করিবে।

পরক্ষণেই সে চমকিয়া উঠিল। ধরা পড়িলে ফাঁসি হইয়া যাবে। তাহার সে চমক এত স্পষ্টভাবে পরিস্ফুট যে তাঁহার ক্ষীণদৃষ্টি বুড়ি মা পর্যন্ত দেখিয়া ফেলিল। অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় সে বলিল—মর মুখপোড়া! ছোট ছেলের মত চমকে উঠে যেন দেয়ালা করছে।

শ্ৰীহরি অত্যন্ত কঠিন দৃষ্টিতে মায়ের দিকে একবার ফিরিয়া চাহিল, পরক্ষণেই দৃষ্টি ফিরাইয়া হুঁকা হইতে কল্কেটা নামাইয়া দিয়া বলিল—এই! শুনচি? কল্কেটা পাল্টে দিয়ে যা।

কথাটা বলা হইল তাহার স্ত্রীকে। ছিরুর স্ত্রী রন্ধনশালে ভাতের হাঁড়ির দিকে চাহিয়া বসিয়া ছিল। পাশেই ল্যাম্পের আলোয় ছিরু র বড় ছেলেটা বই খুলিয়া একদৃষ্টে বাপের দিকে চাহিয়া বসিয়া আছে। শীর্ণ, রুণ, বছর দশেকের ছেলেটা-গলায় একবোঝ মাদুলি-বড় বড় চোখে অদ্ভুত স্থির মূঢ় দৃষ্টি। চিন্তাগ্ৰস্ত বাপের প্রতিটি ভঙ্গিমা সে লক্ষ্য করিতেছে। শ্ৰীহরির ছোট ছেলেটা প্রায়-পঙ্গু এবং বোবা, সেটাও একপাশে বসিয়া আছে মুখের লালায় সমস্ত বুকটা অনবরত ভিজিতেছে। বড় ছেলেটি উঠিয়া আসিয়া কল্কেটা লইয়া গেল। শ্ৰীহরি ছেলেটার দিকে একবার চাহিল। ছেলেটা অদ্ভুত, শ্ৰীহরির মার খাইয়াও কাঁদে না, স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া থাকে। ছেলেটার জন্য এখন তাহার মাকে প্রহার করা কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। মাকে যেন আগলাইয়া ফেরে। মারিলে পশুর মত হিংস্র হইয়া ওঠে। সেদিন সে প্রহাররত শ্ৰীহরির পিঠে একটা সুচ বিধাইয়া দিয়াছিল। ছেলেটার দিক হইতে দৃষ্টি ফিরাইয়া শ্ৰীহরি স্ত্রীর দিকে চাহিল—বিশীর্ণ গৌরবর্ণ মুখখানা উনানের আগুনের আভায় লাল হইয়া উঠিয়াছে—চামড়ায় ঢাকা কঙ্কালসার মুখ! শ্ৰীহরি দৃষ্টি ফিরাইয়া লইল।

হ্যাঁ, আর এক উপায় আছে! অনিরুদ্ধের অনুপস্থিতিতে পঁচিল ডিঙাইয়া পদ্ম কামারনীকে বাঘের মত মুখে করিয়া–শ্ৰীহরির বুকখানা ধকধক করিয়া লাফাইতে লাগিল। দীর্ঘাঙ্গী সবলদেহ কামারনীর সেই দা-খানা কিন্তু বড় শাণিত! চোখের দৃষ্টি তাহার শীতল এবং ক্র। সেদিন দা-খানার রৌদ্র প্রতিফলিত ছটায় ছিরুর চোখ ধাধিয়া গিয়াছিল।

বায়েনদের দুর্গা–কামারনীর চেয়ে দেখিতে অনেক সুী। যৌবন তাহার উচ্ছ্বসিত; দেহবর্ণে সে গৌরী; রঙ্গরসে, লীলা-লাস্যে সে অপরূপা। কিন্তু সে বহুভোগ্যা, সেই কারণেই তাহার আকর্ষণ শ্ৰীহরিকে আর তেমন বিচলিত করে না। দুর্গার দাদা পাতু আবার তাহার নামে জমিদারের কাছে নালিশ করিয়াছে। স্পৰ্ধা দেখ বায়েনের! শ্ৰীহরির মুখে তাচ্ছিল্যের ব্যঙ্গহাস্য ফুটিয়া উঠিল! জমিদারের ছেলের সোনার নিমফলের গোট তাহার কাছে বন্ধক আছে। অকস্মাৎ শ্ৰীহরি উঠিয়া পাঁড়াইল।

শ্ৰীহরির স্ত্রী কল্কেতে নতুন তামাক সাজিয়া আনিয়া নামাইয়া দিল। কিন্তু তামাক শ্ৰীহরিকে আর আকর্ষণ করিল না। দেওয়ালে-পো পেরেকে ঝুলানো জামাটা হইতে বিড়ি-দেশলাই বাহির করিয়া লইয়া সে চলিয়া গেল। অন্ধকার গলিপথে-পথে ঘুরিয়া সে হরিজন-পল্লীর প্রান্তে আসিয়া উপস্থিত হইল।

প্রচণ্ড কলরব উঠিতেছে। পল্লীর প্রান্তে বহুকালের বৃদ্ধ বকুলগাছ, গ্রামের ধর্মরাজতলা সেখানে প্রতি সন্ধ্যায় উহাদের মজলিস বসে। গান বাজনা হয়, ভাসান, বোলান, ঘেঁটু-গানের মহলা চলে—আবার এক-একদিনে দুর্নিবার কলহও বাঁধিয়া ওঠে। আজ কলহ বাঁধিয়াছে। শ্ৰীহরি একটা গাছের অন্ধকারের মধ্যে আত্মগোপন করিয়া কান পাতিয়া শুনিতে আরম্ভ করিল।

পাতু বায়েনই আস্ফালন করিয়া চিৎকার করিতেছে।

দুর্গারও তীক্ষকণ্ঠের আওয়াজ উঠিতেছে—ভাত দেবার ভাতার লয়, কিল মারার গোঁসাই। দাদা সাজছে, দা-দা! মারবি ক্যানে তু! আমার যা খুশি আমি তাই করব। হাজার নোক আসবে আমার ঘরে, তোর কি? তোর ভাত আমি খাই?

সঙ্গে সঙ্গে দুর্গার মা-ও চিৎকার করিতেছে। শ্ৰীহরি হাসিল,—ও! এ যে তাহাকে লইয়াই আন্দোলন চলিতেছে।

সহসা একটা মতলব তাহার মাথায় খেলিয়া গেল। গাছের আড়াল হইতে বাহির হইয়া সে নিঃশব্দে অগ্রসর হইল দুৰ্গাদের বাড়ির দিকে। বকুলগাছটার ওপাশে পল্লীটা খাঁখাঁ করিতেছে। মেয়ে পুরুষ সব গিয়া জুটিয়াছে ওই গাছতলায়। শ্ৰীহরি সন্তৰ্পণে ঢুকিয়া পড়িল দুৰ্গাদের বাড়িতে। বাড়ি অর্থে প্রাচীর-বেষ্টনহীন এক টুকরো উঠানের দুইদিকে দুখানা ঘর, একখানা দুর্গা ও দুর্গার মায়ের অপরখানা পাতুর। শ্ৰীহরির তীক্ষ্ণদৃষ্টি পাতুর ঘরখানার দিকে। শ্ৰীহরি হতাশ হইল। দরজাটা বন্ধ-দাওয়াটাও শূন্য।

একটা কুকুর অকস্মাৎ গো গো শব্দ করিয়া ছুটিয়া পলাইয়া গেল। বোধহয় চুরি করিয়া কাঁচা চামড়ার টুকরা খাইতে আসিয়াছিল। শ্ৰীহরি হাসিয়া একটা বিড়ি ধরাইল, সুকৌশলে হাতের মধ্যে সেটাকে সম্পূর্ণভাবে লুকাইয়া টানিতে টানিতে বাহির হইল। দুর্গার জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইবে কে জানে? আবার সে গাছের আড়ালে আসিয়া দাঁড়াইল।

ওদিকে কিন্তু ঝগড়াটা ক্রমশই প্রবলতর হইয়া উঠিতেছে। শ্ৰীহরি আবার একটা বিড়ি ধরাইল। কিছুক্ষণ পরে সে গাছতলা হইতে বাহির হইয়া জ্বলন্ত বিড়িটা পাতুর চালের মধ্যে

জিয়া দিয়া দ্রুত লঘুপদে আপন বাড়ির দিকে চলিয়া গেল।

ওদিকে চণ্ডীমণ্ডপেও ভদ্ৰ সজ্জনদের প্রবল আলোচনা চলিতেছে।

শ্ৰীহরি হাসিল।

কিছুক্ষণ পরেই গ্রামের ঊর্ধ্বলোকে অন্ধকার আকাশ রক্তাভ আলোয় ভয়াল হইয়া উঠিল। আকাশের নক্ষত্ৰ মিলাইয়া গিয়াছে। উৎক্ষিপ্ত খড়ের জ্বলন্ত অঙ্গার আকাশে উঠিয়া ফুলঝুরির মত নিবিয়া যাইতেছে। মাঝে মাঝে হাউই-এর মত প্ৰজ্বলিত বাখারিগুলি সশব্দে বাগানের মাথায় ঠিকরাইয়া পড়িতে লাগিল। আগুন! আগুন! ভয়ার্ত চিৎকার—শিশু ও নারীর উচ্চ কান্নার রোলে

শূন্যলোকর বায়ুতরঙ্গ মুখর, ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিল।

নিমেষে বকুলতার জটলা এবং তাহার পরই চণ্ডীমণ্ডপের মজলিস ভাঙিয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *