০৬. সেদিন তেমন কিছু গোলমাল হলো না

সেদিন তেমন কিছু গোলমাল হলো না। কিছু তরকারিও দিলে পাতে। তবু গত কয়দিন ধরে যেমন ব্যবহার করছিল, তার চেয়ে যেন কিছুটা ভালো। ভূতনাথ নিজের মনে মনে লজ্জিত হলো। ঠাকুরের ওপর অন্যায় করে সে অবিচার করছিল এ ক’দিন। হয় তো তার কোনো হাত নেই। আসলে তার জবা দিদিমণিই হয় তো। ভাঁড়ার থেকে চাল-ডাল তরকারি দেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। জবাময়ীর তাচ্ছিল্যের প্রমাণ ভূতনাথ তো আগেই পেয়েছে। যেদিন ব্ৰজরাখালের সঙ্গে সে প্রথম চাকরি হবার দিন এসেছিল। বাপ-মা–পিসীমা’র দেওয়া নামই সকলের থাকে। জবার নামও রেখেছিল সুবিনয়বাবুর কালীভক্ত হিন্দু বাবা। নিজের নামের জন্যে সকলকে পরের ওপরেই নির্ভর করতে হয়। তা ছাড়া ‘ভূতনাথ’ নামটার মধ্যে কোথায় যে হাস্যকরতা আছে তা ভেবে পাওয়া যায় না। সকলেরই ঠাকুর-দেবতার নাম। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের একজন দেবতা মহেশ্বর

—তাঁরই এক নাম ভূতনাথ! আর সুবিনয়বাবুর বাবার নামই তো রামহরি। রামহরি ভট্টাচার্য। তার বেলায়!

সেদিন সুবিনয়বাবুই গল্প করেছিলেন প্রথম যেদিন দীক্ষা নিলাম সে কী কাণ্ড ভূতনাথবাবু—শুনুন তবে—

জবা সুবিনয়বাবুর মাথার পাকা চুল তুলে দিচ্ছিলো। বললে— আমি সে গল্প দশবার শুনেছি বাবা।

–তুমি শুনেছো মা, কিন্তু ভূতনাথবাবু তো শোনেন নি—কী ভূতনাথবাবু, আপনি শুনেছেন নাকি। তারপর ভূতনাথের উত্তরের প্রতীক্ষা না করেই বললেন–আর শুনলেই বা—ভালো জিনিষ দশবার শোনাও ভালো বলে সুবিনয়বাবু গল্প শুরু করেন–

এই যে ‘মোহিনী-সিঁদুরে’র ব্যবসা দেখছেন, এ আমার বাবার। বাবা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু, তান্ত্রিক, কালীভক্ত। ছোটবেলায় মনে পড়ে-বাড়ির বিগ্রহ কালীমূর্তির সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্যান করছেন—‘ত্বমেকং জগৎকারণং বিশ্বরূপং’–।কালীমন্ত্র জপ করতে করতেই তিনি স্বপ্নে এই মন্ত্র পান। সেই মন্ত্রপূত সিঁদুরই ‘মোহিনী-সিঁদুর’ নামে চলে আসছে। তা বাবা ছিলেন বড় গরীব, ওই যজন-যাজন নিয়েই থাকতেন, কিন্তু বোধ হয় দারিদ্র্যের জন্যেই দয়াপরবশ হয়ে কালী ওই মন্ত্র দিয়েছিলেন যাতে সংসারে স্বাচ্ছল্য আসে—আমরা মানুষ হই—দু মুঠো খেতে পাই— মনে আছে খুব ছোটবেলায় বাবা শেখাতেন—বাবা তোমরা কোন্ জাতি? তারপর নিজেই বলতেন—বলো, আমরা ব্রাহ্মণ।

আবার প্রশ্ন—কোন্ শ্রেণীর ব্রাহ্মণ? নিজেই উত্তর দিতেন বলল, দাক্ষিণাত্য বৈদিক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। তারপর প্রতিদিন পূর্বপুরুষের নাম মুখস্ত করাতেন।

—তোমার নাম কী?

—তোমার পিতার নাম কী?

—তোমার পিতামহের নাম কী?

পিতামহ, প্রপিতামহ, বৃদ্ধপ্রপিতামহ-সকলের নাম মুখস্ত করাতেন আমাদের। এখনও চোখ বুজলে দেখতে পাই তাঁকে, বুঝলেন ভূতনাথবাবু–। মনে আছে আমি ছোটবেলায় হুকে। কলকে নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসতুম। দিনের মধ্যে অন্তত দশ-বারোটা মাটির কলকে ভাঙতুম—তা বাবা দেখতাম সেই উঠোনের ধারে বসে বসে আমার জন্যে মাটির কলকে তৈরি করে শুকিয়ে পোড়াচ্ছেন। তখন এক পয়সায় আটটা কলকে সে-পয়সাও খরচ করবার মতো সামর্থ্য ছিল না তাঁর।

তারপর অবস্থা ফিরলো। “মোহিনী-সিঁদুরের কৃপায় চালা থেকে পাকা বাড়ি হলো—দোতলা দালান কোঠা হলো—মা’র গায়ে গয়না উঠলো। আর আমি এলাম কলকাতায় পড়তে। সেই পড়াই আমার কাল হলো, আমি চিরদিনের মতো বাবাকে হারালাম। গল্প বলতে বলে হঠাৎ থেমে যান সুবিনয়বাবু।

জবা বলে-থামলেন কেন—বলুন–

সুবিনয়বাবু তেমনি চোখ বুজে মাথা নাড়তে লাগলেন—না আর বলবো না—তোমাদের আমার গল্প শুনতে ভালো লাগে না।

—না, ভালো লাগে বাবা, ভালো লাগে, আপনি বলুন-জবা আদরে বাবার গায়ের ওপর ঢলে পড়লো।

—আপনার ভালো লাগছে, ভূতনাথবাবু—সুবিনয়বাবু এবার ভূতনাথের দিকে চোখ ফেরালেন।

ভূতনাথ বললে—আপনি আমাকে ‘আপনি’ ‘আজ্ঞে বলেন— আমি বড় লজ্জা পাই।

—তবে তাই হবে—আচ্ছা, তুমি মা একবার জানালা দিয়ে দেখে এসো তত তোমার মা ভাত খেয়েছেন কি না?

জবা চলে গেল।

সুবিনয়বাবু বলতে লাগলেন—যেবার সেই ডায়মণ্ডহারবারে ঝড় হয়—সেই সময় আমার জন্ম-সে এক ভীষণ ঝড়, বোধ হয় ১৮৩৩ সাল সেটা-কলকাতায় সেই প্রথম গুলাউঠো হলো—জন্মেছি ঝড়ের লগ্নে—সারাজীবনটা কেবল ঝড়ের মতনই বয়ে গেল, দীক্ষাও নিলাম আর পৈতেও ত্যাগ করলাম—বাবাকেও একটা চিঠি লিখে দিলাম সব জানিয়ে—বাবা খবর পেয়ে নিজেই দৌড়ে এলেন। এসে নিয়ে গিয়ে দেশে একটা ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রাখলেন একমাসের মধ্যে আর ঘরের বাইরে বেরোতে পারলাম না—আমি একেবারে বন্দী।

জবা এসে বললে–মা এখনও ভাত খায়নি—বলেছে আপনাকে খাইয়ে দিতে হবে।

-ও, তা হলে বাবা, আমি জবার মাকে ভাত খাইয়ে আসি, আবদার যখন ধরেছেন তখন কিছুতেই তো আর ছাড়বেন না।

ভূতনাথের বিস্মিত দৃষ্টির দিকে চেয়ে বললেন—জবার মা’র অসুখটা আবার বেড়েছে কি না কাল থেকে বেশ ভালো থাকেন মাঝে মাঝে—কিন্তু আবার…

সুবিনয়বাবু চলে গেলেন। যাবার সময় বললেন—তুমি বসো মা জবা, ভূতনাথবাবুর সঙ্গে গল্প করো—আমি তোমার মাকে ভাতটা খাইয়ে আসছি।

হঠাৎ ভূতনাথ কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে উঠলো। তবু কথা বলতে চেষ্টা করলে–তোমার মা’র এ-রকম অসুখ কতদিনের?

জবা মাথা নিচু করে বসেছিল, কথাটা শুনেই মাথাটা বেঁকিয়ে চাইলে ভূতনাথের দিকে। বললে—আপনি আবার আমার সঙ্গে কথা কইছেন!

—কেন? ভূতনাথ অবাক হয়ে গেল—কেন? এমন কোনো কড়ার ছিল নাকি যে জবার সঙ্গে কথা বলতে পারবে না সে।

–যদি আমি আবার হেসে ফেলি। সেদিন সুনীতি-ক্লাশে বাবা রিপোর্ট করে দিয়েছেন।

-সুনীতি-ক্লাশ? সে কোথায় আবার?

—সুনীতি-ক্লাশ জানেন না, যেখানে আমি বোজ রোববার সকালবেলা যাই। এ সপ্তাহে সবার রিপোর্ট ভালো, সুজাতাদি আর স্মৃতিদিরা দুজনেই এবারে very good পেয়েছেন, সরল, সুবল, ননীগোপাল…

–ননীগোপাল? কোন ননীগোপাল? কী রকম চেহারা বলল তো-ভূতনাথ উদগ্রীব হয়ে উঠলো। সেই গঞ্জের স্কুলের হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর ছেলে যদি হয়!

—চেনেন নাকি তাকে? ভারি দুষ্ট, আমাকে বাবা যা পয়সা দেন হাতে, জানতে পারলেই কেড়ে নেবে-খালি লজেঞ্জ খাবে। মিস পিগট যদি একবার জানতে পারেন—নাম কাটা যাবে ওর।

ভূতনাথ বললে—একদিন যাবদ তোমাদের সুনীতি-ক্লাশে দেখবে আমাদের ননীগোপাল কি না—

—আপনাকে যেতে দেবে কেন?

—তুমি বলবে আমি তোমার দাদা।

—আপনি তত হিন্দু, আপনি কী করে আমার দাদা হবেন! যারা ব্রাহ্ম তারাই শুধু ওখানে যেতে পায়।

-কী শেখায় সুনীতি-ক্লাশে?

–নীতি শিক্ষা দেয়–সত্য কথা বলা, গুরুজনদের ভক্তি করা, পরমেশ্বরের উপাসনা করা আর ব্ৰহ্ম সঙ্গীত।

—তোমার গান আমার খুব ভালো লাগে, সেদিন শুনেছিলাম—

—আমি রাঁধতেও পারি—আমার জন্মদিনে আমি মুরগী বেঁধেছিলাম—সবাই…।

—তোমরা মুরগী খাও? ভূতনাথ অবাক হয়ে গেল।

–রোজ রোজ খাই।

—কে রাঁধে?

—কেন ঠাকুর—ওই যে ঠাকুর আছে—ও—

-–ঠাকুর তত হিন্দু।

—তা হোক, রাঁধে—আপনি খান না? বাবা বলেন-মুরগ খেলে শরীর ভালো হয়—

ভূতনাথের কেমন যেন গা ঘিন ঘিন করতে লাগলো। তা হোক—চাকরি করতে হলে এ-সব উৎপাত সহ্য করতে হবে। হঠাৎ ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—আচ্ছা, ভাঁড়ারের জিনিষ কে বের করে দেয় বোজ?

—আমি, কেন? ও তো লেখা আছে সব ‘র আমল থেকে—আমি সেই দেখে দেখে বের করে দিই—আগে মা-ই দিতে, তারপর আমার ভাই মারা যাওয়ার পর থেকেই মা’র শরীর খারাপ হয়ে গেল—আমিই তারপর থেকে…কিন্তু ও-কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

ভূতনাথ উত্তর দেবে কি না ভাবছে এমন সময় সুবিনয়বাবু এসে পড়লেন। বললেন—তোমার মাকে খাইয়ে একেবারে ঘুম পাড়িয়ে এলাম মা,—তা যাক গে যে-কথা বলছিলাম ভূতনাথবাবু—সেই দীক্ষা নেবার পর—সুবিনয়বাবুর গল্প চলতে লাগলো। পুরোনো দিনের কাহিনী। ঝড়ের লগ্নে জন্ম। ঘরের মধ্যে বসে থাকতেন সুবিনয়বাবু। আর দলে দলে গ্রামের আশে পাশের বাড়ির মেয়েরা জানালা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখতো। পৈতে ত্যাগ করেছে, ধর্ম ত্যাগ করেছে, এ কেমন অদ্ভুত জীব। কেউ কেউ মা’কে জিজ্ঞেস করতো-মাঠাকরুণ তোমার ছেলে কথা কয়? মুড়ি খেতে দেখে মেয়েরা অবাক হয়ে গিয়েছে–এই তো মুড়ি খাচ্ছে মাঠাকরুণ,

এ তো সবই আমাদেরই মতন।

ভাত খেতে বসে ভূতনাথের এই সব গল্পের কথাই মনে পড়ছিল। খাওয়ার পর উঠে হাত ধুয়ে চলে যাবার সময় ঠাকুর হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ালো-বাবু

–কী বলো–

ঠাকুরের চোখ দুটো যেন জ্বলছে। লাল টকটকে। ভয় পাবার মতন। গাঁজা খায় নাকি?

ঠাকুর ভূতনাথের আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে বললেবাবুর কাছে আপনি আমার নামে নালিশ করেছেন?

—নালিশ! ভূতনাথ অবাক হয়ে গেল।

—হ্যাঁ নালিশ! কিন্তু এ-ও বলে রাখছি, আমাদের সঙ্গে এমনি করলে এখানে আপনি তো টিকতে পারবেন না

—সে কি, কী বলছো ঠাকুর তুমি?

—হ্যাঁ, ঠিকই বলছি, কত কেরানীবাবুকে দেখলাম, যদি ভালো চান তো বুঝে শুনে চলবেন—বলে হন্ হন্ করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

ঘটনাটা এক মিনিটের বটে। প্রথমটা থতমত লাগিয়ে দেয়। কিন্তু একটু ভাবতেই ভূতনাথ শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ালো। খুব সামান্য ঘটনা তো নয়। আর একদিনও দেরি করা চলবে না এর পর। কিন্তু কী-ই বা উপায় আছে! নিজের টেবিলে এসে আবার কাজে মন দিলে ভূতনাথ। কিন্তু চোখের সামনে কিছু যেন স্পষ্ট দেখা যায় না। ঝাঁ ঝাঁ করছে মাথা। চাকরির জন্যেই সমস্ত অপমান আজ সহ্য করতে হলো তাকে।

হঠাৎ বাইরে থেকে ঘরে ঢুকলেন সুবিনয়বাবু।

মুখ তুলতেই চোখোচোখি হয়ে গেল। যথারীতি কুশল প্রশ্ন করে চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ভূতনাথ হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে পেছন পেছন গিয়ে বললে—আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল স্যার

থমকে দাঁড়ালেন তিনি। এমন করে কখনও তো কথা বলে ভূতনাথবাবু! বললেন—খুব জরুরী কথা? কেমন যেন তোমাকে উদ্বিগ্ন দেখছি ভূতনাথবাবু?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি আর এখানে খাবো না কাল থেকে। আমার চাল নেওয়া যেন বন্ধ হয়—

কথাটা শুনে চুপ করে রইলেন সুবিনয়বাবু। একবার চেয়ে দেখলেন ভূতনাথের দিকে। কিন্তু দাড়ি গোঁফের প্রাচুর্যের মধ্যে মুখের কোনো ভাবান্তর প্রকাশ পেলো না। তারপর হঠাৎ ‘আচ্ছা তাই হবে’–বলে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলেন।

ভূতনাথ নিজের টেবিলে এসে আবার বসলো। কাজ করতে আর মন বসে না। এখানে খাওয়া তো বন্ধ, তারপর! তারপর ব্ৰজরাখাল ভরসা। ব্রজরাখালকে মুক্তি দিতে পারলে না ভূতনাথ। এবারও সেই ব্রজরাখালেরই ওপর নির্ভর করতে হবে।

কিম্বা যদি খাওয়ার কোনো বন্দোবস্ত না হয়, তাকে অন্য কোনো চাকরির চেষ্টা দেখতে হবে। ব্রজরাখাল ওদিকে চেষ্টা করতে থাকুক, ভূতনাথ নিজেও ঘুরে চেষ্টা করবে। তারপর যা হয় হোক।

কিন্তু বিকেলবেলা আপিস থেকে বেরোবার আগেই হঠাৎ ডাক এল।

ফলাহারী পাঠক এসে বললে—মালিক আপনাকে একবার ডাকছে,কেরানীবাবু—

ফলাহারী পাঠকের হাসি মুখ দেখে ভূতনাথের কেমন যেন অবাক লাগলো। জিজ্ঞেস করলে—কী ব্যাপার ফলাহারী।

ফলাহারী বললে—নিজের চোখে গিয়ে দেখুন বাবু–

দোতলায় নয়। একতলায় ওপরে ওঠবার রাস্তাতেই সুবিনয়বাবুর গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। একেবারে রান্নাঘরের দিক থেকেই শব্দটা আসছে।

সামনে গিয়ে ভূতনাথ আরো অবাক। সুবিনয়বাবু একলা নন। জবাও পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

সুবিনয়বাবু সিংহ-গর্জনে বলছেন—রাখ রাখ হাত বেড়ি রাখ— এখনি ঘর থেকে বের হয়ে যা

ঠাকুর ঠক ঠক করে সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপছে।

সুবিনয়বাবু আবার চিৎকার করে উঠলেন—বেরিয়ে যা এখনি, এক মুহূর্তও আর তোকে স্থান দেওয়া চলবে না—বেরিয়ে যা, হাতা বেড়ি রাখ—

জবা পাশে দাঁড়িয়ে চুপ করে সব শুনছে—

হঠাৎ ভূতনাথকে দেখেই সুবিনয়বাবু বললেন—ঠাকুর তোমায় কী বলেছে ভূতনাথবাবু বলো তো? এসো এদিকে সামনে এসো–

ভূতনাথ কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেল। সুবিনয়বাবুর এ-মূর্তি কখনও সে দেখেনি আগে। বললে-তেমন কিছু বলেনি আমাকে ঠাকুর—আপনি…।

সুবিনয়বাবু হঠাৎ জুতোসুদ্ধ পা’টা মেঝের ওপর সজোরে ঠুকে বললেন—আঃ, কী বলেছে তাই বলে? বাজে কথা শুনতে চাই না

—আজ্ঞে ও বলেছিল ওদের সঙ্গে এমন করলে আমি এখানে টিকতে পারবো না-ওই পর্যন্ত আমাকে অপমান কিছু করেনি

সুবিনয়বাবু বললেন-তা হলে বলতে আর বাকি রেখেছে কি? তোমায় দু’ ঘা জুতো মারলে কি সন্তুষ্ট হতে ভূতনাথবাবু? বলে ঠাকুরের দিকে ফিরে বললেন—যা তুই, এ-বাড়ির চাকরি গেল তোর—এখানে তো টিকতে পারলিই নে, গায়েও টিকতে পারবি কি না পরে ভাববো–

যে-কথা সেই কাজ। আর মুহূর্ত মাত্র দেরি নয়। ঠাকুর নিজের কাপড়-গামছা গুছিয়ে পুটলি বেঁধে নিয়ে তৈরি হলো। ” তারপর চোরের মতন দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল নিঃশব্দে।

সেদিনকার সেই ঘটনায় ভূতনাথের মনটা যেন কেমন বিমর্ষ হয়ে গিয়েছিল। সুবিনয়বাবু বলেছিলেন—তোমরা ইয়ং বেঙ্গল বড় মিমিনে ভূতনাথবাবু, সেইজন্যেই সবাই তোমাদের অপমান করতে সাহস পায়-গুণ্ডার ভয়ে মেয়েদের পুরে রেখেছে পর্দার মধ্যে আর ওদিকে গোরার ভয়ে তেত্রিশ কোটি লোক দেশটাকে পরাধীন করে রেখেছে—তোমাদের গলায় দড়ি জোটে না—

ঠিক এমন কথা সুবিনয়বাবুর মুখ থেকে শোনবার আশা করেনি ভূতনাথ। আমতা আমতা করে বললে—আমি কিন্তু বুঝতে পারিনি—

সুবিনয়বাবু আরো উত্তেজিত হয়ে উঠলেন—তা হলে বলতে চাও-জবা মা মিথ্যে কথা বলেছে–

হঠাৎ জবার দিকে চোখ পড়তেই জবা বলে উঠলো—আমি যে নিজের কানে সব শুনেছি ভূতনাথবাবু, আপনি ঠিক বলুন তো ঠাকুর আপনাকে শাসিয়ে ছিল কি না?

ভূতনাথ বললে কিন্তু সে তো অন্য কারণে–

—কী কারণে, বলুন—জবা জবাবের জন্যে উদগ্রীব হয়ে রইলো।

ভূতনাথ কী উত্তর দেবে বুঝতে পারলে না। একটু ভেবে বললে—ঠাকুর বলছিল, আমি নাকি পেট ভরে খেতে পাই না বলে আপনার কাছে নালিশ করেছি।

সুবিনয়বাবু বললেন—আমার তো তাই বক্তব্য—তুমি এতদিন নালিশ করোনি কেন ভূতনাথবাবু?

জবা বাবার দিকে চেয়ে জবাব দিলে—ভূতনাথবাবু বোধ হয় ভেবেছিলেন আমি কম করে ভাড়ার বার করে দিই।

—তুমি তাই ভেবেছিলে নাকি, ভূতনাথবাবু?—সুবিনয়বাবু জিজ্ঞেস করলেন।

ভূতনাথ কিছু জবাব দেবার আগেই জবা বললে আপনি যা ভেবেছিলেন বাবা, ভূতনাথবাবু তেমন লোক নন। দেখলেন তো, ব্ৰজরাখালবাবু বলেছিলেন—সরল পাড়াগাঁয়ের ছেলে—এখন বুঝুন—আচ্ছা, আপনাকে কম খেতে দিয়ে আমার কী স্বার্থ আছে বলুন–আপনার সঙ্গে আমার কীসের সম্পর্ক? আপনি চাকরি করবেন, মাইনে নেবেন, পেট ভরে খেয়ে যাবেন সেটা আপনার ন্যায্য পাওনা-অসুবিধে হয় নালিশ করবেন–

—ঠিক কথা, জবা ঠিক কথাই বলেছে—তুমি এতদিন নালিশ করোনি কেন ভূতনাথবাবু?

জবা তেমনি উত্তেজিত হয়ে বলে চললো—উনি ঠাকুরের কথাই ধ্রুব বলে জেনেছিলেন, আর আমাকেই চোর বলে ঠিক করেছিলেন–তাই রাগ করে আপনার কাছে ভাত খাবেন না বলেছিলেন— বাবা আপনি ভূতনাথবাবুকে জিজ্ঞেস করুন তো সত্যি করে উনি বলুন যা বলছি আমি সত্যি কি না?

–সত্যি তুমি তাই ভেবেছিলে নাকি ভূতনাবাবু?

জবা আবার বলতে লাগলো—কিন্তু ভাগ্যিস আমি নিজের কানে শুনতে পেলাম কথাটা। উত্তেজনার মুখে জবা যেন আরো কী কী সব বলে গেল, সব কথা ভূতনাথের কানে গেল না। ঘটনাচক্র এমনই দাঁড়ালো যেন ভূতনাথই আসল অপরাধী ভূতনাথই যেন সমস্ত ষড়যন্ত্রের মূলে। আসামী একমাত্র সে-ই। সুবিনয়বাবু আর তার মেয়ে দুজনে মিলে ভূতনাথের অপরাধেরই যেন বিচার করতে বসেছেন। ভূতনাথের চোখ কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগলো।

যখন আবার তার সম্বিৎ ফিরে এল তখন খেয়াল হলো সুবিনয়বাবু বলছেন—অন্যায় যারা করে তাদের যতখানি অপরাধ, সেই অন্যায় যারা ভীরুর মতো সহ্য করে তাদের অপরাধও কি কম সুরেন বাড়য্যে মশাই-এর কথাটা ভাবব তো একবার, একরকম বিনাদোষেই তাঁর সেদিন চাকরি গেল— ভাবো একবার গোরাদের অত্যাচারের কথা–পয়সা দিয়েও রেলের কামরায় সাহেবদের সঙ্গে একসঙ্গে যাবার অধিকার নেই—সত্যি কথা বললে হয় রাজদ্রোহ-বুটের লাথির চোটে চা-বাগানের কুলির পিলে ফেটে গেলেও প্রতিবাদ করলে হয় জেল—এমনি করে আর কতদিন অত্যাচার সহ্য করবে ভূতনাথবাবু? একদিকে গোঁড়া বামুনদের অত্যাচার, বিলেত গেলেই, মুরগী খেলেই জাতিচ্যুত। আর একদিকে সাহেবদের লাথি-ইয়ং বেঙ্গল তোমরা, তোমরাই তো ভরসা—আমরা আর ক’দিনের–

অভিভূতের মতে কখন যে ভূতনাথ রাস্তায় বেরিয়েছে, কখন বাড়ির পথে চলতে শুরু করেছে খেয়াল ছিল না। গোলদিঘীর কাছে আসতেই খোলা হাওয়ার স্পর্শ লেগে সমস্ত শিরা উপশিরাগুলো যেন আবার সজীব হয়ে উঠলো। ভূতনাথের মনে হলো যেন কিছুক্ষণ আগে তার আপাদমস্তক বেঁধে কেউ চাবুক মেরে ছেড়ে দিয়েছে। সমস্ত শরীরে যেন এখনও তার যন্ত্রণার সঙ্কেত। সুবিনয়বাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে আসবার সময় সে তো কিছু বলে আসেনি। আত্মপক্ষ সমর্থনের কথা নয়। কিন্তু ওদের ভুল সংশোধনের চেষ্টাও তো ও করতে পারতো। কিম্বা ক্ষমা ভিক্ষা। জবাকে নীচ প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা তো তার ছিল না। ঠাকুরকেই সে তত অবিশ্বাস করে এসেছে। ঠাকুরের বিরুদ্ধে অভিযোগই তো সে করতে গিয়েছিলো।

আবার ফিরলে ভূতনাথ। চারদিকে বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। তবু যত অন্ধকারই হোক, যত রাত্ৰিই হোক আজ, ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে ফিরে গিয়ে আবার তাকে দুজনের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। ক্ষমা চাইতে হবে।

পাশে একটা মদের দোকান। উগ্র গন্ধ নাকে এল। ভেতরে বাইরে ভিড়। সামনে মাটির ওপর বসে পড়েছে ভাড় নিয়ে লোকগুলো। আবছা অন্ধকারেও যেন হঠাৎ চমকে উঠলো ভূতনাথ! ঠাকুর না!

ভালো করে চেয়ে দেখবার সাহস হলো না তার। এক ঘণ্টা আগে যার চাকরি গিয়েছে সে-ও বুঝি বসে গিয়েছে এখানে ভাঁড় নিয়ে। হন্ হন্ করে পা চালিয়ে সোজা চলতে লাগলো ভূতনাথ। ঠাকুর তাকে দেখতে না পেলেই ভালো। অপ্রকৃতিস্থ মানুষ ভূতনাথের যুক্তিগুলো বুঝবে না ঠিক।

আরো আধ ঘণ্টা পরে যখন ভূতনাথ ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে গিয়ে পেঁছিলো তখন সদর দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দরজা খুলে দিলে বৈজু দারোয়ান। বললে—আবার ফিরে এলেন যে কেরানীবাবু?

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে-বাবু কোথায়?

-ওপরে।

সোজা মন্ত্রচালিতের মতো ওপরে গিয়ে বড় হলঘরে কাউকে দেখতে পাওয়া গেল না। এদিক-ওদিক সব দিকে চেয়ে দেখলে ‘ভূতনাথ। অন্দরে যাবে কি না ভাবছে—হঠাৎ হাবার মা সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো—

হাবার মা বললে—বাবু এখন মাকে খাওয়াচ্ছেন।

—আর দিদিমণি?

—নিচে রান্নাঘরে।

সেই সিঁড়ি দিয়ে আবার তেমনি করে নিচে নেমে এসে সোজ। রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ালো ভূতনাথ। চারজন ঝি সাহায্য করছে। জবাকে। জবা রান্না করছে। এ দৃশ্য হয় তো এ-বাড়ির লোকের কাছে নতুন নয়—কিন্তু ভূতনাথের কাছে অভিনব মনে হলো। পেছন থেকে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ দেখতে লাগলো জবাকে। হঠাৎ সেই অবস্থায় ভূতনাথের মনে হলো জবাই তো এ-বাড়ির আসল গৃহিণী।

পেছন ফিরে কী একটা জিনিষ নিতে গিয়ে হঠাৎ নজরে পড়লো।

নজরে পড়তে জবাও অবাক হয়ে গিয়েছে। বললে—একি, আবার ফিরে এলেন যে আপনি–বাবা তো ওপরে।

ভূতনাথ প্রথমটা কেমন নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। তারপর বললে—তোমার সঙ্গেই আমার দরকার ছিল জবা—আজকে আমার সত্যি বড় অন্যায় হয়ে গিয়েছে—বাবাকে বলল তিনি যেন আমাকে ক্ষমা করেন

আরো যেন কী কী বলবার ছিল ভূতনাথের, কিন্তু আর কিছু তার মুখ দিয়ে বেরোলে না।

জবা হেসে ফেললে। বললে—আশ্চর্য, এই কথা বলতেই আবার এখন ফিরে এলেন নাকি?

ভূতনাথ কী উত্তর দেবে ভেবে পেলে না!

জবা এবার হো হো করে হেসে উঠলো। বললে—যে আপনার নাম রেখেছিল, তার দূরদৃষ্টির প্রশংসা করছি—তারপর একটু থেমে জিজ্ঞেস করলে কিন্তু কেন? কেন আপনি ক্ষমা চান বলুন তো?

ভূতনাথ একটু ইতস্তত করে বললে—আমার জন্যেই তো তোমায় আজ রান্নাঘরে ঢুকতে হয়েছে–আমার জন্যেই তো ঠাকুরকে।

জবা বললে—রান্না করতে আমি ভয় পাই না ভূতনাথবাবু, কারণ বাবা যার-তার হাতের রান্না খান না—ঠাকুর নেহাৎ দেশের লোক ছিল তাই…আর…কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কখ—আপনি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছেন তো?

ভূতনাথ বুঝতে পারলে না। বললে—কীসের ভয়?

—জাত যাওয়ার ভয়।

–কেন?

—এবার থেকে তো আমিই রান্না করবো—ভুলে যাচ্ছেন কেন? আমি তো ম্লেচ্ছো।

কথাটা ভাববার মতন। ভূতনাথও হঠাৎ কথাটার জবাব দিতে পারলে না।

জবা বললে—আজ বাসায় গিয়ে ভাবুন—সমস্ত রাত ধরে সেইটেই ভাবুন আগে—তারপর কাল যা বলবেন, সেই ব্যবস্থা করবে—এখন রাত হয়ে গেল–আপনি বাড়ি যান বরং—বলে উনুনে আর একটা হাঁড়ি চড়িয়ে দিলে।

ভূতনাথ নির্বোধের মতো আস্তে আস্তে বাইরে চলে আসছিল। অন্ধকারে রাস্তায় পা বাড়াতে গিয়ে পেছনে যেন জবার গলার আওয়াজ পেলে—

—শুনুন।

ভূতনাথ আবার ফিরলো।

জবা বললে–বৈজুকে সঙ্গে নিয়ে যান—রাত্তির হয়ে গিয়েছে—এদিককার রাস্তাটা খারাপ—আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসুক ও–

ভূতনাথ মুখ তুলে জবার চোখের দিকে চেয়ে দেখলে। কথাটার মধ্যে বিদ্রূপের খোঁচা আছে যেন!

কিন্তু অন্ধকারে জবার মুখ স্পষ্ট দেখা গেল না।

ভূতনাথ আর সময় নষ্ট না করে রাস্তায় পা বাড়ালো। কেন মিছিমিছি সে আবার ফিরে এল। কার কাছে সে ক্ষমা চাইলে! কে জানে, কী সমাজের মানুষ এরা সবাই। রাধা, আন্না, হরিদাসী তারা তো কেউ এমন আড়ষ্ট করে কথা বলতো না। শহরের সব মেয়েরাই কি এমনি? না শুধু ব্রাহ্মসমাজের মেয়েরাই এই রকম।

ভূতনাথ চলতে চলতে বললে—না, সঙ্গে কারোর যাবার দরকার হবে না—আমি মেয়েমানুষ নই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *