০৬. সুলতানা

শামা জেগে আছে। একটু আগে ঘড়ি দেখেছে তিনটা দশ। চোখ জ্বালা করছে। যদিও চোখ জ্বালা করার কোনো কারণ নেই। সে চোখ বন্ধ করে আছে। রোদের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ জ্বালা করার প্রশ্ন আসত। ঘর অন্ধকার। যখন ঘুমুতে গিয়েছিল তখন গরমে শরীর ঘেমে যাচ্ছিল। এখন শীত শীত লাগছে। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। রাত যতই বাড়ছে ফ্যানের গতি মনে হয় ততই বাড়ছে। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে কী? আশেপাশে কোথাও বৃষ্টি না হলে এতটা ঠাণ্ডা লাগার কথা না।

শামা আবারো ঘড়ি দেখল। রেডিয়ামের ডায়াল দেয়া ঘড়ি। অন্ধকারে বিড়ালের চোখের মতো জ্বলে। এখন বাজছে তিনটা বার। মাত্র দু’মিনিট পার হয়েছে, শামার কাছে মনে হচ্ছে অনন্তকাল। অনিদ্রা রোগ মানুষকে এতটা কষ্ট দেয় তা তার জানা ছিল না। তার ছিল বালিশ ঘুম। বালিশে মাথা লাগানো মাত্র ঘুম। আজ এ-কী যন্ত্রণা হলো? আগে চোখ জ্বালা করছিল, এখন মুখ জ্বালা করছে। এই জ্বলুনি কি শেষ পর্যন্ত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে? বিছানায় শুয়ে না থেকে ভেতরের বারান্দায় চলে গেলে কেমন হয়! ভেতরের বারান্দায় কাঠের চেয়ারটা আছে। চেয়ারের পায়াটা আবার ভেঙেছে। আবদুর রহমান সাহেব আবার ঠিক করেছেন। এই নিয়ে তিনবার হললা। চেয়ারে বসে সকাল হওয়া দেখা। অনেক দিন সকাল হওয়া দেখা হয় না। আজ দেখবো না তা করা যাবে। না। ফজরের আজান হতেই মা-বাবা দু’জনই উঠে পড়বেন। তাঁরা অজু করতে এসে দেখবেন তাদের বড় মেয়ে একা একা বারান্দায় বসে আছে। মনের কষ্টে মেয়ে সারা রাত ঘুমুতে পারে নি। তাঁরা দু’জনই খুবই দুঃখিত হবেন। সেটা হতে দেয়া যায় না। শামা মনের কষ্টে ঘুমুতে পারছে না, এটা ঠিক না। তার মনে কষ্ট নেই। তবে তার খারাপ লাগছে।

খারাপ লাগলেই সেই খারাপ লাগাটা অন্যকে দেখাতে হবে কেন? আজ তার জন্যে খারাপ একটা রাত যাচ্ছে। রাতটা কোনো মতে পার করতে পারলে সব ঠিক হয়ে যাবে। একজন লোকের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। যেকোনো কারণে বিয়েটা ভেঙে গেছে। এটা এমন কোনো বড় ঘটনা না। এই লোকের সঙ্গে বিয়ে হলে তার এক ধরনের ছেলেমেয়ে হত। অন্য আরেক জনের সঙ্গে বিয়ে হলে অন্য ধরনের ছেলেমেয়ে হবে। ব্যাস এইতো! এর বেশি আর কী?

তিনটা কুড়ি বাজে। এই শেষবার ঘড়ি দেখা। শামা ঠিক করে ফেলল সকালের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আতাউর নামের মানুষটার ব্যাপারে সে কিছু ভাববে না। আংটিটা ফেরত পাঠাতে হবে। ভাগ্যিস সে আংটি আঙুলে আর পরে নি। আতাউরের সঙ্গে শেষবার কি শামা কথা বলবে? হ্যাঁ বলবে, শামা হিসেবে বলবে না। এশা হয়ে বলবে। এই একটা ভাল সুবিধা হয়েছে। এশা সেজে সে অনেক কিছু বলতে পারছে। যাকে বলা হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

শামা ভেবেছিল বাসর রাতে পুরো ঘটনাটা আতাউরকে হাসতে হাসতে বলবে এবং মানুষটার হতভম্ব মুখ দেখবে। মানুষটা নিশ্চয়ই খুব লজ্জা পাবে। বিড়বিড় করে বলবে, তুমি এমন মেয়ে! আশ্চর্য! তখন শামা হঠাৎ শুরু করবে একটা ভূতের গল্প। সে খুব ভাল ভূতের গল্প বলতে পারে। তার নানিজানদের বাড়ির পেছনের জঙ্গলে বার তের বছর বয়েসী একটা মেয়ের ডেডবডি পাওয়া গিয়েছিল। মেয়েটা কে? কোথেকে এখানে এসেছে, কেউ কিছু জানে না। ফুটফুটে চেহারা, মাথাভর্তি চুল। ঠোটের কোণায় হাসির রেখা। পুলিশ এল তদন্ত হলো। কিছুই বের হলো না। মেয়েটার কবর হলো গ্রামের মসজিদের পেছনের কবরস্থানে। তারপর শুরু হলো যন্ত্ৰণা। গভীর রাতে মেয়েটার কান্না শোনা যায়। লোকজনদের ফিসফিস করে বলে এই তোমরা আমাকে কবর দিলে কেন? আমি হিন্দু। আমার নাম লীলাবতী। গ্রামের লোকজন অস্থির হয়ে পড়ল। শেষে সবাই মিলে সালিস করে ঠিক করল কবর খুঁড়ে মেয়েটার ডেডবডি বের করে শশানে নিয়ে পোড়ানো হবে। কবর খোড়া হলো, দেখা গেল কবরে কিছুই নেই। কাফনের কাপড়টা শুধু পড়ে আছে।

ভূতের গল্প শেষ করে শামা ভয় কাটানোর জন্যে একটা মজার গল্প বলবে। যে গল্প বলবে সেটাও ঠিক করা। গল্পটা সবচে’ সুন্দর বলতে পারে তৃণা। তবে সে নিজেও খারাপ বলে না। এক পথচারী অন্য একজনকে জিজ্ঞেস করল, ভাই শুনুন, এই রাস্তাটা কি হাসপাতালের দিকে গিয়েছে? উত্তরে সেই লোক বলল, রাস্তার কি অসুখ হয়েছে যে রাস্তা হাসপাতালের দিকে যাবে?

গল্পগুজব শেষ হবার পর মানুষটাকে পুরোপুরি চমকে দেবার জন্যে সে বলবে, আচ্ছা শুনুন, অনেক গল্প করা হয়েছে। এখন আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। গতকাল রাতেও ঘুমুই নি। ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আমি ঘুমাব। ঘুমের মধ্যে আপনি কিন্তু আমার গায়ে হাত দেবেন না। ঘুমের সময় কেউ আমার গায়ে হাত দিলে আমার খুব খারাপ লাগে। এই বলেই সে পাশ ফিরে শুয়ে গভীর ঘুমের ভান করবে। লোকটা কী করবে? বাধ্য ছেলের মতো চুপচাপ পাশে বসে থাকবে?

 

আজান হচ্ছে। সুলতানা উঠেছেন। রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছেন। চুলায় চায়ের কেতলি বসিয়ে তিনি তাঁর স্বামীকে ডেকে তুলবেন। দু’জনে ফজরের নামাজ পড়ে এক সঙ্গে চা খাবেন। তারপর আবার ঘুমুতে চলে যাবেন। ঘণ্টা খানিক ঘুমিয়ে আবার উঠবেন। এই ওঠা ফাইনাল ওঠা। আগেরটা সেমিফাইনাল। এই রুটিনের কোনো ব্যতিক্রম শামা তার জীবনে দেখে নি। শামা এবং তার বাবা রুটিনের মধ্যে আটকা পড়ে গেছেন। মানুষ অতি দ্রুত রুটিনে আটকা পড়ে যায়। ভালবাসাবাসিও কি এক সময় রুটিনের মধ্যে চলে আসে? রুটিন করে একজন আরেক জনকে ভালবাসে।

শামা বিছানায় উঠে বসল। সে ঠিক করল এক কাপ চা নিয়ে ছাদে চলে যাবে। ছাদে হাঁটতে হাটতে চা খাবে। চা খেতে খেতে গুছিয়ে নেবে এশা। সেজে আজ কী কী কথা আতাউর নামের মানুষটাকে বলবে। কথা বলবে কিনা সেটাও ভাবার ব্যাপার আছে। এখন আর কথা বলে কী হবে! তবু সে হয়ত বলবে। কারণ তার কথা বলতে ইচ্ছা করছে। কথা বলতে হবে ন’টার আগে। নটার সময় মানুষটা নিশ্চয়ই অফিসে চলে যাবে। শামা কলেজ বাদ দিয়ে ঘরে বসে থাকতে পারে। মানুষটা পারবে না। তাকে বেঁচে থাকতে হলে অফিস করতে হবে। বেতন তুলতে হবে। সে নিশ্চয়ই রুটিনে ঢুকে পড়া মানুষ।

এখন বাবার গলা পাওয়া যাচ্ছে। বাবার অসুখটা তাহলে সেরে গেছে। তিনি রোজদিনের মতো নামাজ পড়বেন। কোরান তেলাওয়াত করবেন। তারপর ছোট্ট ঘুম ঘুমাতে যাবেন। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে অফিসের দিকে রওনা হবেন। তাঁর জীবন আগের মতোই চলবে। শামার জীবনও হয়ত আগের মতোই চলবে। এক সময় আতাউর নামের লোকটার কথা মনেও থাকবে না। অনেক অনেক দিন পর তার নিজের মেয়ে বড় হবে। সে তার বান্ধবীর বিয়ে দেখে বাসায় ফিরে মা’র সঙ্গে গল্প করতে বসবে তখন হয়ত শামা হঠাৎ করে বলবে, জানিস আমার একজনের সঙ্গে বিয়ে প্রায় ঠিকই হয়ে গিয়েছিল। লোকটার নাম আতাউর। আমি ঠাট্টা করে বলতাম খাউর।

তার মেয়ে বলবে, ছিঃ মানুষের নাম নিয়ে ঠাট্টা করা ঠিক না। নামটাতে সে রাখে নি। বাবা মা রেখেছে।

শামা বলবে, তা ঠিক। তখন আমার বয়স কম ছিল। ঠাট্টা তামাশা করতে খুব ভাল লাগত।

উনার সঙ্গে বিয়ে হলো না কেন?

আমার বাবা কোনো খোঁজখবর না নিয়েই বিয়ে ঠিক করেছিলেন তো। শেষে তিনি জানতে পারলেন, কিছু সমস্যা আছে।

কী সমস্যা? জানি না কী সমস্যা, বাবা বলেন নি।

শামা আবারো বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার নিজের মেয়েটার কথা ভাবতে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি তার একটা মেয়ে আছে। এবং মেয়েটা এখন গুটিমুটি মেরে তার পাশে শুয়ে আছে। মেয়েটার গায়ের গন্ধ পর্যন্ত তার নাকে লাগছে। গাদাফুলের পাতা কচলালে যে গন্ধ আসে সেই গন্ধ। আচ্ছা মেয়েটার সুন্দর একটা নাম থাকা দরকার না? তার যেমন দুই অক্ষরে নাম সে রকম দু’অক্ষরের নাম। দু’অক্ষরের নাম হলে নামটা অনেকক্ষণ মুখে রাখা যাবে। টেনে লম্বা করা যাবে। তার নামটা যেমন শামা, আ-টা অনেকক্ষণ মুখে রাখা যায়। ইচ্ছামত টেনে লম্বা করা যায়। আচ্ছা মেয়েটার নাম আশা হলে কেমন হয়? আতাউরের আ আর শামার শা। কী অদ্ভুত কাণ্ড! আতাউর এখন এল কীভাবে? শামা দু’হাত দিয়ে কল্পনার মেয়েটাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। মেয়েটা উহ’ বলে চিৎকারও করল, কারণ তার চুল মা’র বালিশের নিচে আটকে গেছে। এইসব চিন্তার কোনো মানে হয় না থাক, নিজের মেয়েকে নিয়ে চিন্তাটা আপাতত থাকুক। অন্য কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করা যাক। মজার কোনো বিষয়। আনন্দের কোনো বিষয়।

শামার ঘুম পাচ্ছে। এখন আর ঘুমুতে ইচ্ছা করছে না। এখন ঘুমিয়ে পড়লে দশটার আগে আর ঘুম ভাঙবে না। আতাউরকে টেলিফোন করা যাবে না। টেলিফোন করতেই হবে। এশা সেজে টেলিফোন। পর্দার আড়াল থেকে কথা বলা। এই মজার টেকনিকটা শামা তার মেয়েকে শিখিয়ে দিয়ে যাবে।

শামার ঘরের দরজায় কে যেন হাত রাখল। দরজার কড়ায় সামান্য শব্দ হলো। তারপরই সুলতানার গলা শোনা গেল। তিনি কোমল স্বরে বললেন, শামা চা খাবি?

শামা বলল, হ্যাঁ। আয় তোর বাবার সঙ্গে চা খা। তোর বাবা তোকে ডাকছে। শামা দরজা খুলে বের হলো। মা’র দিকে তাকিয়ে বলল, আমি যে জেগেআছি তুমি জানতে?

সুলতানা বললেন, হ্যাঁ।

কীভাবে জানতে? আমার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। আমি কোনো সাড়া শব্দও করি নি।

সুলতানা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোরা তিন ভাইবোনের যে-কোনো একজন জেগে থাকলে বুঝতে পারি। আমার নিজেরো তখন ঘুম হয় না। তাদের মধ্যে সবচে’ বেশি রাত জাগে এশা। বাবা আমার সঙ্গে চা খেতে চাচ্ছেন কেন?

মনে হয় কিছু বলবে। বিয়ে যে ভেঙে গেল কেন ভাঙল। এইসব হয়ত তোকে বলবে।

আমি বাবার কাছ থেকে কিছু শুনতে চাচ্ছি না। তুমি শুনে নাও। তারপর যদি ইচ্ছা করে আমি তোমার কাছ থেকে শুনব। ইচ্ছা না করলে শুনব না।

সুলতানা মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন, বাবা ডাকলে কখনো না করতে। নেই। তোকে ডেকেছে তারপর যদি না যায় তাহলে মনে কষ্ট পাবে। মা’র মনে কষ্ট দিলে কিছু হয় না, কিন্তু বাবার মনে কষ্ট দিলে তার ফল খুব খারাপ হয়। আবদুর রহমান সাহেব শামাকে দেখে একটু নড়ে চড়ে বসলেন। তাঁর হাতে চায়ের কাপ। কাপে চুমুক দিতে যাচ্ছিলেন। চুমুক না দিয়ে কাপ নামিয়ে নিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। শামা বলল, তুমি কিছু বলবে?

আবদুর রহমান সাহেব নরম গলায় বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আগে বোস তারপর বলি। শামা বসল। আবদুর রহমান সাহেব নিজেই মেয়ের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতে দিতে বললেন, আমি হলাম বোকা মানুষ। আমি নিজে বোকা তার মাও বোক। দুই বোকা মিলে বিরাট ভুল করে ফেলেছি। এই ভুলের মা বাপ নেই। খোঁজ খবর না নিয়ে তার বিয়ে ঠিক করে ফেললাম। ছেলেও আসা যাওয়া শুরু করল। কী অবস্থা!

শামা বলল, আসা যাওয়া শুরু করে নি বাবা। একদিনই এসেছিল।

সেই একদিন আসাটাও তো ঠিক না। তোর মা যত্ন করে আবার ভাত খাইয়েছে। তুই আবার তাকে নিয়ে নিউ মার্কেটে বান্ধবীর জন্যে উপহার কিনতে গেলি। তোর মা’র কাছে শুনেছি এক রিকশায় গিয়েছিস। কী ঘিন্নাকর অবস্থা! তোর অবশ্যি দোষ নেই। দোষটা আমার। আমি গ্রীন সিগন্যাল দেয়ার কারণেইতো বাসায় এসে ভাত খাওয়া শুরু করল। চিন্তা করলেই আমার কেমন যেন লাগে।

একটা মানুষ একবেলা ভাত খেয়েছে এটা এমন কোনো ব্যাপার না বাবা। কতজনইতো আমাদের বাসায় খেয়েছে। তাতে কী হয়েছে?

আবদুর রহমান সাহেব মেয়ের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। হতাশ গলায় বললেন, অনেক কিছুই হয়েছে। এতো নরম্যাল ছেলে না। পাগল।

সুলতানা হতভম্ব গলায় বললেন, পাগল মানে?

মাথার অসুখ। প্রায়ই হয়। তখন কাউকে চিনতে পারে না। দরজা তালাবন্ধ করে রাখতে হয়। এমন অবস্থায় এরা অসুখ গোপন করে বিয়ে দিতে চাচ্ছিল। মানুষের ধারণা আছে না- বিয়ে দিলে পাগল ভাল হয়। তাই ভেবেছে। কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে দিয়ে দেবে। পাগল ভাল হয়ে যাবে। আমার মেয়ে হবে পাগল ভাল করার ট্যাবলেট। এই ছেলের আগেও একবার বিয়ে ঠিকঠাক হয়েছিল। পানচিনি হয়েছে। মেয়েপক্ষ খবর পেয়ে পরে বিয়ে ভেঙে দেয়। গতকাল আমি ছেলের বড় বোনের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি ঘটনা স্বীকার করেছেন। ছেলে যেমন বজ্জাত, আত্মীয়স্বজনরাও বজ্জাত। ধরে এদের চাবকান উচিত। জুতা পেটা করা উচিত। এরা শিয়াল কুকুরেরও অধম।

শামা বলল, এইসব কেন বলছ?

বলব না?

না বলবে না। বিয়ে ভেঙে গেছে ফুরিয়ে গেছে। গালাগালি করবে কেন?

আমি এমন কী গালাগালি করলাম। তুই এত রাগ করছিস কেন?

জানি না কেন রাগ করছি। আমার ভাল লাগছে না। বাবা আমি উঠলাম।

আবদুর রহমান সাহেব চাপা গলায় বললেন, ছেলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে পারে। উল্টাপাল্টা বোঝানোর চেষ্টা করতে পারে। একেবারেই পাত্তা দিবি না। কী সর্বনাশ! আমার মেয়েটাকে আরেকটু হলে একটা পাগলের হাতে তুলে দিচ্ছিলাম!

শামা বাবার সামনে থেকে উঠে চলে এল।

 

হ্যালো আমি এশা।

বুঝতে পারছি। তুমি কেমন আছ?

আমি ভাল আছি। আপনার গলাটা এমন লাগছে কেন? মনে হচ্ছে আপনি না, অন্য কেউ কথা বলছে।

আমার মন ভাল নেই। মন ভাল না থাকলে আমার গলার স্বর বদলে যায়।

মন ভাল নেই কেন? বিয়ে ভেঙে গেছে বলে?

আতাউর জবাব দিল না। শামা কিছুক্ষণ জবাবের জন্যে অপেক্ষা করল। জবাবের জন্যে অপেক্ষা করে ভালই হললা। পরের প্রশ্নটা কী করা যায় ভাবার সময় পাওয়া যাচ্ছে। কঠিন কঠিন কিছু প্রশ্ন করা উচিত। কঠিন প্রশ্নগুলি মাথায় আসছে না। বরং উল্টোটা হচ্ছে, শামার গলা ভার ভার হয়ে আসছে।

এশা।

জি।

তোমরা সবাই আমাকে খুব খারাপ ভাবছ তাই না?

আমি ভাবছি না, তবে অন্যরা ভাবছে।

তুমি ভাবছ না কেন?

কারণ আমি আপনাকে খুব ভাল কখনো মনে করি নি। বাবা মনে। করেছেন, এই জন্যেই বাবা মনে কষ্ট পাচ্ছেন। আর আপা খুব কষ্ট পেয়েছে। সে অবশ্যি কষ্টের কথাটা কাউকে বলে নি, কিন্তু আমি বুঝতে পারি।

ও আচ্ছা।

আমি বয়সে অনেক ছোট। কিন্তু আমি কি আপনাকে একটা উপদেশ দেব?

দাও।

আপনার বিয়ে করা উচিত হবে না। আপনিহত মোটামুটি ধরনের অসুস্থ না। বেশ অসুস্থ। আমার কথা কি ভুল?

না ভুল না। আমি যখন অসুস্থ হই, বেশ ভালই অসুস্থ হই। আমাকে তালাবন্ধ করে রাখতে হয়। অসুখটা সেরে গেলে পুরনো অনেক কিছু ভুলে যাই।

এই অসুখ সারবে ডাক্তাররা কি এমন কথা বলেছেন।

না বলেন নি। বরং উল্টোটা বলেছেন। বলেছেন— বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অসুখটা বাড়বে।

অসুখের ব্যাপারটা গোপন করাটা কি আপনার ঠিক হয়েছে?

না, ঠিক হয় নি। খুব অন্যায় হয়েছে।

অন্যায়টা করলেন কেন?

তোমার আপাকে দেখে মনে হলে আমার অসুখটা সেরে গেছে। আর কোনোদিন হবে না। যে অসুখ হবে না আগ বাড়িয়ে সে অসুখের কথা বলতে ইচ্ছা করল না।

আপার আগে আপনার আরো একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা হয়েছিল। তাদেরকেও আপনার অসুখের কথা জানান নি। ঐ মেয়েটিকে দেখেও কি মনে হয়েছিল আপনার অসুখ সেরে গেছে?

আতাউর চুপ করে রইল। এশা বলল, আচ্ছা থাক, এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না। আপনি কিছু বলতে চাইলে বলুন, আমি টেলিফোন রেখে দেব।

আমি তোমার আপার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। তুমি কি ব্যবস্থা করে দেবে? তাকে দু’একটা কথা বলতে চাই।

কী কথা? এটা তোমার আপাকে বলব। তোমাকে না।

আপার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাবেন না। কারণ আপা আপনার সঙ্গে কখনো কথা বলবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া আপার অন্য জায়গায় বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। ছেলের নাম আশফাকুর রহমান। ছেলে মেরীলেন্ড ইউনিভার্সিটির টিচার। মনে হচ্ছে বিয়েটা হয়ে যাবে। এই অবস্থায় কি আপার উচিত আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা?

উচিত না।

আমি আজ রাখি? আপনি ভাল হয়ে যান এর বেশি আর কী বলব।

সেটা সম্ভব না। আমি খুবই অসুস্থ। শোন এশা, তোমার সঙ্গে সরাসরি আমার কখনো কথা হয় নি শুধু টেলিফোনে কথা হয়েছে। শুধুমাত্র তোমার কথা শুনে আমি তোমাকে যে কী পরিমাণ পছন্দ করেছি সেটা একমাত্র আমিই জানি। তোমাকে আমার মনে হয়েছে খুবই কাছের একজন।

এখনো কি মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ, এখনো মনে হচ্ছে।

বড় আপার বিয়েতে আপনাকে দাওয়াত দিলে আপনি কি আসবেন?

হ্যাঁ আসব।

আপনার লজ্জা করবে না।

করবে। তারপরেও আসব। তোমার আপার কাছে শুনেছি তুমি একটা ছেলেকে খুব পছন্দ কর। তোমরা খুব শিগগিরই না-কি বিয়ে করবে। তোমার বিয়েতেও আমি আসব। দাওয়াত না করলেও আসব।

শামা টেলিফোন নামিয়ে রাখল। সে অবাক হয়ে লক্ষ করল তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। নিজের ওপরই তার রাগ লাগছে। এর কোনো মানে হয়? কেন তার চোখ দিয়ে পানি পড়বে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *