০৬. সুভাষণ প্রদানের গোপন তথ্য
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার অব্যবহিত পরে আমি লন্ডনে দু’ভাই স্যার রোক ও স্যার কেইথ স্মিথের সাক্ষাৎলাভ করি। তারা সদ্য লন্ডন হতে অস্ট্রেলিয়ায় বিমান সফর সমাপ্ত করেছেন, এই সাফল্যজনক সফরের জন্যে অস্ট্রেলিয়া চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে এবং তাঁরা নাইট উপাধি পেয়েছেন।
মনোরম দৃশ্যের খ্যাতনামা চিত্রগ্রাহক কেল্টিন হার্লি এই সফরকালে কিছু পথ তাদের সাথে ছিলেন এবং মুভি ক্যামেরায় ছবি তুলেছেন। আমি তাঁদের এই সফর সম্পর্কে বক্তৃতা শেখাই এবং বক্তৃতা পরিবেশনের পদ্ধতি শিক্ষা দেই। লন্ডনের ফিলারমনিক হলে চার মাস ধরে দিনে দু’বার করে বক্তৃতা চলে। একজন বিকালে অপরজন রাতে বক্তৃতা করেন।
তাঁদের অভিজ্ঞতা ছিল একইরূপ, কেননা, তাঁরা পাশাপাশি বসেই বিশ্বের অর্ধেক ভ্রমণ করেছেন, তাঁদের বক্তৃতার বিষয়ও ছিল অভিন্ন এবং শব্দগত ভাবেও ছিল মিল এতৎসত্বেও বক্তৃতার ধারণা কিন্তু একইরূপ শোনাত না।
এই বক্তৃতার শব্দের সাথে আরো একটি জিনিস ছিল সেটি হচ্ছে বলার ধরন, প্রকাশ ভঙ্গি। ”আপনি কী বলবেন তার চাইতে কীভাবে বলবেন সেটা অধিক মূল্যবান।”
একবার এক সঙ্গীতানুষ্ঠানে জনৈকা তরুণীর পাশে আমি বসেছিলাম। আমি দেখেছি, কাজুরকা বাজানোর সময় সে তরুণী বই পড়ছে, এর কারণ হচ্ছে সুর তার বোধগম্য হচ্ছিল না। অতঃপর শিল্পী যখন আকর্ষণীয় অঙ্গভঙ্গিতে একটি সুর পরিবেশন করতে শুরু করে তরুণীটিও তখন বই বন্ধ করে মঞ্চের দিতে তাকায় নিবিষ্ট চিত্তে, শোনে সে সুর নিবিষ্ট চিত্তে, যদিও সে সুরের কোনো অর্থ তার মর্মে পশছিল না, সুর প্রকাশের ভঙ্গি, পরিবেশনের ভঙ্গি তরুণীটিকে জাগিয়ে তোলে, আকর্ষিত করে, না বুঝলেও তন্ময় হয়ে শোনে, তরুণী আনন্দ পায়।
খ্যাতনামা রুশ চিত্র শিল্পী ব্ৰলফ একবার তার এক ছাত্রের একটি চিত্র সংশোধন করেন। ছাত্রটি তার সংশোধিত চিত্রটির প্রতি দেখেন এবং বিস্মিত কণ্ঠে বলেন।”আপনার ক্ষুদ্র আঁচড়ের ফলে চিত্রটিই পরিচিত হয়ে গেছে।” ব্রুফ বলেন, “ক্ষুদ্র আঁচড়েই শিল্পের জন্ম।” শিল্পের মতো ভাষণ প্রদানের ক্ষেত্রেও এটি একইভাবে সত্য।
শব্দ চয়নের ক্ষেত্রেও এটি একইভাবে প্রযোজ্য। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি পুরাতন প্রবাদ আছে, কী বিষয়ে বলা হচ্ছে তা নয়, কীভাবে বলা হচ্ছে তার উপরই সাফল্য নির্ভর করে।
সুবাচন ভঙ্গি যে কোনো সামান্য বিষয়কেও গুরুত্বপূর্ণ, আকর্ষণীয়, হৃদয় গ্রাহী করে তোলে। আমি সবসময় এটা লক্ষ্য করেছি যে, কলেজে বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় যেসব ছাত্র জয়লাভ করতো তাদের সবার জয় বিষয়বস্তুর জন্যে হত না, হত প্রকাশ ভঙ্গির জন্যে। যে বক্তা প্রাঞ্জল, আকর্ষণীয় ও সুললিত ভাষায় বক্তৃতা করতে পারতেন, বিষয়টি যাই হোক না কেন তার ভাষণ হয় হৃদয়গ্রাহী।
”একটা ভাষণে তিনটি জিনিস থাকে,“ বলেছেন লর্ডমলে, সেগুলো হচ্ছে, কে বললেন, কীভাবে বললেন এবং এগুলোর মধ্যে শেষটির গুরুত্বও কম নয়। এটা কী বাড়িয়ে বলা? মোটে না। বাস্তব অনুসন্ধান করলে আপনি এর সত্যতার প্রমাণ পাবেন।
লর্ড এডমান্ডবার্ক লিখিত ভাষণগুলো এতো সুন্দর, যুক্তিপূর্ণ তথ্যসমৃদ্ধ ও রসপূর্ণ হত যে তা আজো কথাসাহিত্যের ক্লাসিক হিসাবে পাঠ করা হয়। কিন্তু এটা সত্য যে বক্তা হিসবে বার্ক ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তাঁর বক্তৃতা করার ক্ষমতা ছিল নড়বড়ে। বক্তব্যকে তিনি করতে পারতেন না আকর্ষণীয় ও জোরদার; এবং হাউস অব কমন্সে তাঁকে বলা হত ‘ডিনারবেল’। যখন তিনি কিছু বলতে দাঁড়াবেন তখন অন্যান্য সদস্যরা হাঁচি দিতেন, কাশি দিতেন, তালগোল পাকিয়ে দলবদ্ধভাবে বেরিয়ে যেতেন।
আপনি আপনার সকল শক্তি দিয়ে যে কোনো ব্যক্তির উপর ইস্পাত জ্যাকেট বদ্ধ বুলেট নিক্ষেপ করতে পারেন, ঠিক মতো না লাগলে সে আঘাতে তার কাপড়ে আঁচড় পড়বে না। কিন্তু যদি কিছু পাউডার কোনো ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করেন বা ছিটান তা হবে সামান্য কিছু হলেও তার গায়ে পড়বে। সুতরাং বক্তৃতায় ইস্পাত বর্মাচ্ছাদিত বুলেটের চাইতে পাউডার সদৃশ কাহিনী অনেক ভালো, ফলপ্রসু। সুতরাং বক্তৃতার কালে বক্তব্য হতে বাচনভঙ্গির উপর জোর দেয়া, গুরুত্ব দেয়া অনেক বেশি ভালো; ফলপ্রসূ।
সুভাষণের গোপন কথা :
বক্তৃতাদানের পদ্ধতি সম্পর্কে বহু অন্তহীন ও একঘেয়ে কথা লেখা হয়েছে। এর ওপর নিয়ম কানুনের বহু পর্দা যোগিয়ে এটিকে আরো গুপ্ত রহস্যপূর্ণ করে তোলা হয়েছে, পুরাতন ধরনের বাকপটুতা বিষয়টিকে আরো ঘৃণিত ও বিদ্রুপাত্মক করে তুলেছে। ব্যবসায়ীরা পুস্তকের দোকানে বক্তৃতা সম্পর্কে বই অনুসন্ধান করতে গিয়ে যে সব বই পান সেগুলোর অধিকাংশই তাদের জন্যে অপ্রয়োজনীয়। সামাজিক অগ্রগতি সত্ত্বেও স্কুলে ছাত্রদের আজো ওয়েবেষ্টার এবং এনগারসোল পড়নো হয় যা কোনো অবস্থাতেই যুগোপযোগী নয়, যার স্টাইল হয়ে পড়েছে সেকেলে। মিসেস এগনার সেকে অথবা মিসেস ওয়েবেস্টার যে ধরনের টুপি পরতো আজ কেউ সে ধরনের টুপি পরলে হবেন উপহাস্যের পাত্র। তাঁদের স্টাইল অনুসরণও হবে ব্যঙ্গাত্মক।
গৃহযুদ্ধের পর বক্তৃতার ধরন এবং বক্তৃতাদান পদ্ধতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। সময়ের সাথে সঙ্গতি রাখতে হলে, তাল মিলাতে হলে টেলিগ্রামের গতিতে পদ্ধতি বদলাতে হবে। অর্থহীন বাক্য, আজকের যুগে কোনো শ্রোতাই শুনবেন না, সহ্য করবেন না।
আধুনিক শ্রোতারা, তারা সংখ্যার পনেরো জন অথবা হাজার জন হতে পারেন, কামনা করেন যে, বক্তা যা বলবেন, সরাসরি বলবেন, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে শ্রোতারা, তারা সংখ্যার পনেরো জন অথবা হাজার জন হতে পারেন, কামনা করেন যে, বক্তা যা বলবেন, সরাসরি বলবেন, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলবেন না, যা বলবেন সহজভাবে বলবেন, সাবলীল ভাবে বলবেন, যাতে শ্রোতারা সরাসরি তা বুঝতে পারে। এমন ভাবে বলবেন, ঠিক যে ভাবে তিনি কথাবার্তা বলেন।
সাধারণ কথোপকথনে তিনি যেভাবে কথা বলেন, সেভাবে বলবেন, তবে বক্তৃতা কালে জোর একটু বেশি দিতে হবে অর্থাৎ বড় করে বলতে হবে। এমনভাবে বলতে হবে যাতে শ্রোতারা শুনতে পায়। একজনের সাথে কথা যেভাবে বলেন চল্লিশ জনের সামনে বলতে ঠিক সেরূপ ধ্বনিতে বলা চলবে না, বড় করে শব্দ পরিষ্কার করে বলতে হবে যাতে শুনতে ও বুঝতে কারো অসুবিধা না হয়।
নাবাদার খনিতে মার্কটোয়েনকে একজন শ্রমিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি এখন যেভাবে বক্তৃতা করছেন এটাই কী আপনার স্বাভাবিক গলার বাকপটুতা?
শ্রোতারা চান বক্তার ‘স্বাভাবিক গলার বাকপটুতা’ নিম্নস্বরও নয়, গলাফাটা চিৎকারও নয়?
ঘরোয়া বৈঠকে বক্তৃতা আর প্রকাশ্য জনসভায় বক্তৃতা এক নয়, ঘরোয়া পরিবেশে অনুসৃত পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রকাশ্য সভায় সফল হওয়া যায় না। বলেছেন জন হেনরী স্মিথ!
আমি একজন বিশিষ্ট উপন্যাসিকের বক্তৃতার কথা বর্ণনা করেছি। সে হলরুমে তিনি বক্তৃতা করেছেন। ঠিক সেই হলরুমে, কয়েক মাস পরে স্যার অলিভার লজ বক্তৃতা করেন। সেই বক্তৃতাটি শোনার সুযোগও আমার হয়েছিল। তাঁর বক্তব্য বিষয়টি ছিল এ্যাটম ও বিশ্ব। অর্ধশতাব্দী তিনি এই বিষয়টির উপর অধ্যয়ন, গবেষণা, পরীক্ষা ও চিন্তা করেছেন। সুতরাং বিষয়টি তার মন হৃদয় মস্তিষ্ক ও জীবনের সাথে সংযুক্ত। বিষয়টির আগাগোড়া তাঁর নখদর্পণে। এতৎসত্ত্বেও বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়ে তিনি হঠাৎ বোবা হয়ে পড়েন। কারণ তিনি বক্তৃতা করতে অভ্যস্ত ছিলেন না। বিষয়টি তিনি জানতেন, ভালো ভাবেই জানতেন, কেহ প্রশ্ন করলে অত্যন্ত সহজ সরল ও সাবলীল ভাষায় তা বুঝিয়ে দিতে পারতেন,প্রশ্নকর্তাকে পরিতৃপ্তি দিতে পারতেন, সন্তুষ্ট করতে পারতেন। এ্যাটম বা অনুসম্পর্কে প্রশ্নকর্তাও তার সদুত্তর পেতেন। তিনি এমনভাবে বলতে পারতেন শুনে মনে হত তিনি যা দেখছেন ভাবছেন বুঝছেন অনুভব করছেন আমরা ঠিক তাই দেখছি ভাবছি বুঝছি অনুভব করছি। কিন্তু বক্তৃতা প্রদান তা নয়।
বিষয়টি জানা ছিল বলে তিনি অবস্থা কটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। এর ফল কী হয়? তিনি আকর্ষণীয় বক্তৃতা করেন। শ্রোতাদের বিমোহিত করেন। তিনি একজন শক্তিমান বক্তা বলে প্রমাণিত হন। কিন্তু আমি নিশ্চিত ভাবে জানি, তিনি নিজেকে তেমন ভাবেন না। আমি এটাও নিশ্চিত যে কিছু লোক বুঝতে পেরেছে তিনি মোটেই সুবক্তা নন।
এই বই পড়ে যদি আপনি বক্তৃতা করতে শুরু করেন শ্রোতারা আপনার বক্তৃতা শোনে তাহলে আমাকে কোনোরূপ কৃতিত্ব দেয়া প্রয়োজন নেই। কারণ শ্রোতারা শুনলেই বক্তা হওয়া যায় না বা বক্তৃতা হয় না, বক্তৃতা হবে সেটি যে বক্তৃতা আপনি শিখে গেলেও শ্রোতারা কোনো ভাবেই ধরতে পারবে না যে আপনি শিখা বক্তৃতা পেশ করেছেন। আপনার বক্তৃতায় সেরূপ স্বাভাবিকতা থাকতে হবে। যে বক্তা বক্তৃতাকারে স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে পারেন, শ্রোতা তাকে সুবক্তা বলে মনে করেন, তাঁর বক্তৃতা করার ধরনও বা যাই হোক না। সুতরাং স্বাভাবিকতা রক্ষা করতে পারায় সুভাষণের একটি বিশেষ গুণ।
হেনরি ফোর্ডের উপদেশ :
“সকল ফোর্ডই প্রায় একরূপ” একটি প্রচলিত প্রবচন কিন্তু যে কোনো দু’ব্যক্তি ঠিক একরূপ হয় না। বিশ্বের প্রতিটি জীবই স্বতন্ত্র, এখানে নতুন যে আসে তার সাথে পুরাতনের হুবহু মিল থাকে না, পুরাতন একই রূপ নিয়ে আবার আসে না। একজন তরুণকে তার নিজের সম্পর্কে ঠিক এই ধারণা গ্রহণ করতে হবে, তাকে ঐরূপ ব্যক্তিত্ব অর্জন করতে হবে যা তাকে অন্যান্য হতে স্বতন্ত্র করে এবং সে গুণই তার মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। সমাজ ও শিক্ষালয় তার এরূপ গুণগত উৎকর্ষ সাধনে সাহায্য করতে পারে, আমাদিগকে একই রূপ করে তোলার প্রচেষ্টা ঠিক নয়? সুতরাং নিজেকে স্বতন্ত্র করে তোলার ক্ষেত্রে নিজেরও বিশেষ চেষ্টা অবশ্যই থাকতে হবে।
বক্তৃতা শেখার ব্যাপারে বিষয়টি আরো সত্য। এ বিশ্ব সংসারে আপনার মতো কোনো মানুষ নেই। লাখ-লাখ লোকের দুটি চোখ, নাক ও মুখ আছে, কিন্তু তাদের কারো চেহারাই আপনার সাথে মিলবে না, এবং তাদের মধ্যে কেহ-কেহ অবশ্য আপনি যে ভাবে বলেন ঠিক সেভাবে কথা বলতে সক্ষম হতে পারেন। অন্য কথায়, আপনার একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব আছে। বক্তা হিসাবে এটা আপনার বিশেষ মূল্যবান গুণ। দৃঢ়তার সাথে এগুলোর উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা করুন। ফলে আপনার বক্তব্য জোরদার হবে, এভাবেই আপনি গুরুত্ব অর্জন করতে সক্ষম হবেন।
স্যার অলিভার লজ যে বক্তৃতা করতেন তা অন্যান্যদের থেকে স্বতন্ত্র হত, কারণ তিনি নিজেও ছিলেন। স্বতন্ত্র ব্যক্তি। মানুষের দাড়িগোঁফ ও চুলহীন মস্তিষ্ক যেমন একরূপ না ঠিক সেভাবে দুজনের বক্তৃতা একরূপ হয় না। যদি কেহ লয়েড জর্জকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুকরণ করতে চায় তাহলে সে ব্যর্থ হবে, হতে বাধ্য।
আমেরিকায় সবচাইতে প্রসিদ্ধি অর্জনকারী বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় সিনেটর স্টিফেন এ. ডগলাস আব্রাহাম লিংকনের মধ্যে, ১৮৫৮ সালে ইলিনয়েচ শহরে। লিংকন ছিলেন লম্বা ও ছিপছিপে, ডগলাস ছিলেন বেঁটে ও মোটা। শরীরের মতো এই দু ব্যক্তির চরিত্র, মনোভাব ব্যক্তিত্ব এবং স্বভাবও ছিল ভিন্ন ধরনের।
ডগলাস ছিলেন বিশ্বের সেরা সংস্কৃতিবান ব্যক্তি, লিংকন এসেছিলেন নিম্নস্তর হতে সম্মুখ ভাগে। ডগলাসের অঙ্গভঙ্গি ছিল মাধুর্যপূর্ণ। লিংকনের অঙ্গভঙ্গি ছিল এলোমেলো। ডগলাসের বক্তব্য হত ব্যঙ্গ কৌতুকপূর্ণ, লিংকন ছিলেন শ্রেষ্ঠতম গল্পকার। ডগলাসের ভাষা ছিল সহজতর। লিংকন উপমা ও উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করতেন। ডগলাস ছিলেন গর্বিত ও কর্তৃত্ব প্রয়াশী। লিংকন ছিলেন নম্রও ক্ষমাশীল, ডগলাস চিন্তা করতে পারতেন দ্রুত। লিংকনের মানসিক ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত শ্লথ। ডগলাস ঘূর্ণিঝড়ের প্রেরণা ও গতি নিয়ে বক্তৃতা করতেন। লিংকন নির্ঞ্ঝাট ও বিবেচক।
এই দুজনেই ছিলেন সফল বক্তা, সুবক্তা। কারণ তারা দু’জনই ছিলেন সচেতনও সাহসী। তাঁদের মধ্যে কেহ যদি অন্যকে অনুসরণ করতে চাইতেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই ব্যর্থ হতেন। কিন্তু তাঁরা তাঁদের পথ অনুসরণ করেই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সুতরাং তাদের অনুসরণ করুন।
এটা একটি সহজ নির্দেশ। কিন্তু এটা অনুসরণ করা কি সহজ? না তা নয়। মার্শাল ফেচ যুদ্ধ কৌশল সম্পর্কে বলেছেন, এটা বোঝা খুবই সহজ, কিন্তু কাজে লাগানো, বাস্তবায়িত করা অত্যন্ত কঠিন, এই নির্দেশের ক্ষেত্রে তা সত্য।
শ্রোতাদের সামনে স্বাভাবিক হতে হলে অভ্যাস প্রয়োজন। অভিনেতারা তা জানেন। চার বছরের একটি ছেলে বা মেয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে কোনো কিছুই স্বাভাবিক ‘আবৃত্তি করতে পারে কিন্তু সে শিশুর বয়স এখন ২৪ অথবা ৪৫ বছর হয় তখন কি তার পক্ষে ঠিক সেভাবে আবৃত্তি করা সম্ভব? চার বছরের শিশুর বোধশক্তি ছিল না, তাই সে পেরেছিল স্বাভাবিক হতে। কিন্তু বয়োবৃদ্ধির পর সেরূপ বোধশক্তি হীন হওয়া কি সম্ভব? এরূপ অনমনীয় শক্তি অর্জন করে বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তব্য পেশ করবেন বলে আশা করা, ঘুঘু সদৃশ ব্যক্তিও করতে পারবে না।
কোনো ব্যক্তিকে বক্তৃতা দান শেখানো ও প্রশিক্ষণ দেয়া তার স্বাভাবিক শক্তির ওপর আর একটি বিশেষ কিছু চাপানো হয়, এটা শুধুমাত্র তার তোতলানি বন্ধ করা, তাকে স্বাভাবিক করা এবং কোনো ব্যক্তি ধাক্কা মেরে ফেলে দিলে পড়ে যাওয়া মানুষটি যেরূপ ভাবে কথা বলে সেরূপ কথা বলতে তাকে উপযুক্ত করে তোলা। শত-শত বার আমি বক্তাদের তাদের বক্তৃতাদান কালে থামিয়ে দিয়েছি এবং তাদের মানুষের মতো বলতে উৎসাহিত করেছি। শত-শত রাতে আমি মানুষকে স্বাভাবিক নিয়মে বক্তৃতা করাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ঘরে ফিরেছি। বিশ্বাস করুন, আমি কথাকে যেভাবে বলে ফেলেছি, কাজটা কিন্তু তত সহজ নয়।
এবং আপনি এই ক্ষেত্রে স্বাভাবিকতা অর্জন করতে পারেন একমাত্র অভ্যাসের দ্বারা। আপনি অভ্যাস করলে দেখতে পারেন যে, আপনি অলঙ্কার পূর্ণ ভাষায় কথা বলতে পারছেন, স্বাভাবিক নিয়মে দ্রুততার সাথে কিছু প্রকাশ করতে পারছেন, “এখানে কি ভুল আছে, অনুসন্ধান করুন, সংশোধন করুন।” অতঃপর শ্রোতাদের মধ্যে থেকে এমন একজনকে বেছে নিন যাকে আপনি সবচাইতে বোকা মনে করেন। ভুলে যান সে সেখানে অন্য কোনো লোক আছে। তার সাথে কথা বলুন। কল্পনা করুন যে, সে আপনাকে কোনো প্রশ্ন করছে এবং আপনি তার উত্তর দিচ্ছেন। সে যদি দাঁড়ায় এবং কথা বলে এবং আপনাকে উত্তর দিতে হয়, তাহলে আপনার আলোচনা হয়ে পড়বে প্রশ্নোত্তর মূলক, স্বাভাবিক প্রত্যক্ষ। সুতরাং ঠিক এভাবে কল্পনা করে বক্তৃতা দান অভ্যাস করুন।
আপনার মন অতদূরে নিয়ে যান যেখানে প্রশ্ন করতে ও উত্তর দিতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ, আপনার বক্তব্য পেশকালে আপনি বলতে পারেন, “আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন আমার কাছে এর কি প্রমাণ আছে? আমার হাতে এর যথেষ্ট প্রমাণ আছে এবং তা হচ্ছে এই”অতঃপর কল্পিত প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকুন। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে করা যায়। এটা করলে বক্তৃতায় একঘেয়েমি দূর হয়। বক্তৃতা হয় অধিকতর প্রত্যক্ষ, আনন্দদায়ক কথোপকথন মূলক।
সরলতা, প্রচেষ্টা এবং সর্বোপরি আন্তরিক আগ্রহ আপনাকে সাহায্য করবে। যখন কোনো ব্যক্তি হয় তার অনুভূতির প্রভাবে প্রভাবিত, তার মনোভাব ঠিক সেভাবেই প্রকাশিত হয়। অনুভূতির প্রভাব তাকে দিয়ে কথা বলায়। সুতরাং যে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে কথা বলতে পারেন, কাজ করতে পারে এবং এই কাজ ও কথা হয় স্বাভাবিক।
পরিশেষে যে কথাটি বলতে হয়, তা হচ্ছে আপনি যা বলবেন তাতে মন প্রাণ ঢেলে দিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে, স্বচ্ছ গতিতে তা প্রকাশের চেষ্টা করুন?
“আপনি কখনো ভুলবেন না” ইয়েল ধর্মশাস্ত্র স্কুলে বক্তৃতা কালে বলেছিলেন ডিন ব্রাউন, “সে বর্ণনা, বা সেবা সম্পর্কে লন্ডন শহরে শোনা বক্তৃতায় পুনরাবৃত্তি করেছিলেন আমার এক বন্ধু। এই প্রচারের উদ্যোক্তা ছিলেন জর্জ ম্যাকডোনাল্ড। তিনি সেদিন সকালে সেবা সম্পর্কে একাদশ অধ্যায় পাঠ করেন। ধর্মশাস্ত্রের ওপর বক্তৃতা করার সময় বিশ্বাস কী তা আমি আপনাদের কাছে বলবার চেষ্টা করব না। তত্ত্বের অধ্যাপকেরা আছেন যারা এ বিষয়টি আপনাদের ভালো বোঝাতে পারবেন। আমি শুধু আপনাদের বিশ্বাস অর্জনে সাহায্য করবো। তিনি কথাগুলো এমন ভাবে বললেন যে, সকল শ্রোতার মনে একটা বিশ্বাসের জন্ম নিল। কেননা তার কাজের সাথে সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর হৃদয়ের। আর বক্তৃতা হয়েছিল প্রাঞ্জল, তা ছিল তার হৃদয় উৎসারিত বক্তব্য।”
তাঁর কাজের সাথে অন্তরের সমন্বয় বা সংযোগ ঘটেছিল, এটাই গোপন তথ্য। এতৎসত্ত্বেও আমি জানি যে, এই উপদেশ তেমন জনপ্রিয় নয়। সাধারণ ছাত্ররা আরো সাধারণ নিয়ম চান, নিশ্চিত কিছু চান। এমন কিছু চান যাতে তিনি হাত দিতে পারেন। গাড়ি চালানোর যেমন নিয়ম আছে, চান ঠিক তেমন নিয়ম।
এটাই তিনি চান, আমিও তাকে দিতে চাই। এটা তার জন্যে সহজ হবে, আমার জন্যেও সহজ হবে। এ ধরনের নিয়ম আছে, সেখানে শুধু সামান্য ত্রুটি আছে, যা অবশ্য ব্যবহার্য নয়। তাহলে বক্তৃতা স্বাভাবিক ভাবে মন দিয়ে রসকষপূর্ণ বক্তব্য পেশ করতে পারবেন। আমার যৌবনে আমি তাদের জন্যে বহু সময় নষ্ট করেছি; কিন্তু তাদের নাম এই পৃষ্ঠায় উল্লেখ করার উপযুক্ত হয় নি। জনবিলিং একদা বলেছিলেন, সংসারে এমন অনেক কিছু আছে যা সবার জন্য প্রয়োজনীয়।
জনসভায় বক্তৃতাকালে আপনি কি এই কাজগুলি করবেন?
জনসভায় বক্তৃতা বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার, আরো বিস্তারিত ভাবে প্রকাশ করার জন্যে আমরা এক্ষেত্রে স্বাভাবিক বক্তব্যের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করব। এটা করতে গিয়ে আমার মনে দৌদুল্যমানতা এসেছিল। তবে আমি আমার সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি, “আমার ওপর চাপ দিলে আমি সব কিছু ঠিক ভাবে বলতে পারি, কিন্তু আপনার বেলায় এটি সত্য নাও হতে পারে। চাপ দিলে হয়তো বা আপনি যা জানা আছে তাও ভুলে গিয়ে কাঠের ঘোড়ার মতো হয়ে যেতে পারেন।”
আপনি গতরাতে এসব নিয়ম পালন করেছেন অচেতন মনে। কেননা, নৈশ ভোজে আপনি বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। সুতরাং একমনে অচেতন মনের উপরই চাপ প্রয়োগে সুফল পাওয়া যায়। কিন্তু সচেতন মনে বক্তৃতা করতে হলে প্রয়োজন অভ্যাস।
প্রথমত : ‘গুরুত্বপূর্ণ’ শব্দের উপর জোর দিন অন্য শব্দকে সহযোগী হিসাবে গ্রহণ করুন :
আলাপ আলোচনাকালে আমরা শব্দের একটি সিল্যাবলের উপর বিশেষ জোর দেই, অন্য শব্দগুলোকে সাধারণ ভাবেই উচ্চারণ করি। যেমন-মাংসসুংলেটস, এট ট্রাক-শাস, এন-ভাই রনমেন্ট। বাক্যের ক্ষেত্রেও আমরা ঠিক একই কাজ করি। আমরা একটি বাক্যের একটি বা দুটি শব্দের উপর নিউইয়র্কের পঞ্চম এ্যাভিনিউস্থ এম্পায়ার স্ট্রেট-বিল্ডিং এর মতো জোর দেই।
এই পদ্ধতিটা কোথাও অপরিচিত পদ্ধতি নয়। আপনি যত্রতত্র এরূপ জোর দিয়ে উচ্চারণ করবেন। আপনি নিজেও সবসময় কোনো কোনো শব্দ উচ্চারণে শব্দাংশে জোর দেন, বাক্যে কোনো-কোনো শব্দে জোর দেন, ভবিষ্যতে দিবেন।
এখানে একটি উদাহরণ দেয়া হচ্ছে। নিম্নের বড় অক্ষরের লেখা শব্দগুলোর উপর জোর দিয়ে প্রশ্ন পড়ুন। ফলে কি বুঝতে পারছেন? ভেবে দেখবেন।
আমি যে কাজেই হাত দিই না কেন সফল হই, কেননা আমি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সে কাজে হাত দেই। মানব সমাজের উপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ গ্রহণে আমি ইতঃস্তত করি না–নেপোলিয়ন।
এই লাইনগুলো পাঠের পদ্ধতি একটি নয়। অন্য বক্তা এটিকে অন্য ভাবেও পাঠ করতে পারেন, জোর দেয়ার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। এটা বক্তার উপরই নির্ভরশীল।
নিম্নপঙক্তিগুলো জোর দিয়ে পাঠ করার চেষ্টা করুন, অতঃপর এটার তাৎপর্য উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। আপনি কি কিছু শব্দের ওপর জোর দিয়ে অন্যগুলো দ্রুত উচ্চারণ করে শেষ করতে চান না?
যদি
না থাকে সাহস নির্যাতন হবে না বন্ধ,
করা যাবে না, প্রতিরোধ,
মোকাবেলা।
মনে যদি না থাকে নিশ্চিত বিশ্বাস।
বিজয় অসম্ভব, ব্যর্থ হবে ছলাকলা।
রণক্ষেত্র, কুসুম শয্যা নয়।
শক্তি আছে যার জয় তারই হয়।
আগে বা পরে এ ব্যক্তিরই হয় জয়,
আত্মবিশ্বাসে নেই যার কোনো
সংশয়।–এ্যানন।
দৃঢ় প্রত্যয়ের চাইতে সম্ভবত আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নেই। যে বালক, কালে মহান ব্যক্তি হবে অথবা হবে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি তাকে হাজার বাধা অতিক্রমের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে চলতে হবে, বাধা অতিক্রম করতে হবে। শত বাধা-বিপত্তিতে ও হতাশ না হয়ে তাকে এগিয়ে যেতে হবে দৃঢ় পদক্ষেপে–থিওডর রুজভেল্ট।
দ্বিতীয়ত : আপনার স্বর পরিবর্তন করুন :
কথোপকথনে আপনার শব্দের ধ্বনি বা স্বরের উত্থান-পতন হয় উঁচু-নিচু, যেন সমুদ্রের তরঙ্গ, মহা সাগরের ঊর্মি। কেন? কেহই জানেন না, এবং কেহই এটা ব্যাখ্যা করতে পারেন না। এর ফলাফল আনন্দদায়ক এবং এটাই প্রকৃতির নিয়ম, আমরা কখনো এটা করতে শিখি না, এটা আমাদের আয়ত্বে আসে, যেমন শিশু জন্মায়, কিন্তু শ্রোতাদের সামনে দাঁড়াতে গেলে আমাদের স্বর অনেক সময় হয়ে যায় অশ্রাব্য, যেন আমরা দাঁড়িয়েছি নেভাদা মরুতে।
যখন আপনি বক্তৃতা করার কোনো কিছু পাবেন না, বিশেষ করে আপনার স্বর এক ঘেয়ে মনে হবে তখনই আপনি একটু থামুন, নিজে-নিজে ভেবে নিন, “আমি একটি কাঠের যন্ত্রের মতো কথা বলছি, এসব লোকের সামনে কথা বলতে হলে নম্রভাবে বলতে হবে, স্বাভাবিক হতে হবে।”
এই ধরনের চিন্তা কি আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করবে? অবশ্যই কিছু সাহায্য করবে। সামান্য কিছুক্ষণের বিরতি আপনাকে সাহায্য করবে। অভ্যাস থাকলে আপনার সমস্যার সমাধান অবশ্যই আপনি করতে পারবেন।
অথচ স্বর নামিয়ে অথবা ভুলে আপনি প্রয়োজনীয় একটি প্রবাদ বাক্য বলতে পারেন। ব্রকলীনের কংগ্রেস দলীয় মন্ত্রী ডা: এস পার্কস ক্যাডম্যান প্রায়ই এরূপ করতেন, স্যার অলিভার জজ, ব্রাইস ও রুজভেল্ট এরূপ করতেন। খ্যাতনামা প্রায় সকল বক্তা এরূপ করতেন, অর্থাৎ এরূপ করে তারা কণ্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণ করতেন।
নিম্নবর্ণিত বাক্যগুলোর পাঠে আপনার স্বাভাবিক স্বরকে নিচে নামান। দেখুন কি ফল লাভ করেন।
আমার একটি ছাড়া কোনো গুণ নেই এবং সে গুণটি হচ্ছে হতাশ না হওয়া। বলেছেন মার্শাল ফেচ।
শিক্ষার মূল লক্ষ্য জ্ঞান নয়, কর্ম। বলেছেন হার্বাট স্পেন্সার।
আমার ৮৬ বছরের জীবনকালে আমি বহু লোককে সাফল্য অর্জন করতে দেখেছি, দেখেছি শত-শত লোক একমাত্র বিশ্বাসের কারণেই সফল হয়েছে। বলেছেন, কার্ডিন্যাল গিবনস।
তৃতীয়ত:-বক্তৃতার ধারা পরিবর্তন করুন :
যখন কোনো শিশু কথা বলে অথবা যখন আমরা সাধারণ আলোচনায় অংশ নিই, আমরা আমাদের কথার ধারা পরিবর্তন করি অব্যাহত ভাবে। এটা আনন্দ ধারণাকে দৃঢ়ও বদ্ধ মূল করে প্রতিষ্ঠা করা চলে।
মিশৌরী ইতিহাস সমিতি প্রকাশিত ওয়াণ্টার ভি. স্ট্রিভেন্স, এর রিপোর্টারস লিংকন এ বলা হয়েছে যে, লিংকন নিম্নলিখিত ভাবে একটি পয়েন্টের ওপর জোর দিতেন :
তিনি দ্রুততালে বহু শব্দ বলে যেতেন, অতঃপর একটি শব্দ ও প্রবাদে এসে তার ওপর জোর দিতেন, বিশেষ জোর দিয়ে উচ্চস্বরে আওড়াতেন, পরিশেষে বিদ্যুৎ চমকের মতো দ্রুত গতিতে বাক্য সমাপ্ত করতেন।একটি বা দুটি শব্দের ওপর, যে গুলোর ওপর তিনি জোর দিতেন এত বেশি সময় ক্ষেপণ করতেন যে, পরবর্তী ডজন শব্দ বলতেও অতবেশি সময় প্রয়োজন হত না।
এই পদ্ধতি সহজে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিশেষত আমি প্রায়ই সাধারণ ভাষণে কার্ডিন্যাল গিবনের একটি বিবৃতি উল্লেখ করতাম, অর্জিত সাহসের ধারণার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে চাইতাম। সুতরাং আমি কতিপয় শব্দের ওপর এত বেশি জোর দিতাম যেন ঐ শব্দ দ্বারা আমি অভিভূত। আপনি কি নিম্নবিষয়টি শব্দ করে পাঠ করে, একই পদ্ধতি অনুসরণে ফলাফল নোট করেন? বিবৃতির বড় শব্দগুলোর ওপর জোর দিন।
মৃত্যুর স্বল্পকালে আগে কার্ডিন্যাল গিবন বলেছেন, “আমার বয়স ছিয়াশি বছর। আমি বহুলোককে সাফল্য অর্জন করতে দেখেছি, যাদের মধ্যে শতশত ব্যক্তি সফল হয়েছেন বিশ্বাস গুণে এবং এটি বিশেষ গুরুতুপূর্ণ। সাহস হীন কোনো ব্যক্তিই সাফল্য অর্জন করতে পারে না।
এভাবে চেষ্টা করে বলুন ”তিনকোটি ডলার।” এটা এমন ভাবে দ্রুত বলুন যাতে এটা অত্যন্ত নগণ্য অর্থ বলে মনে হয়। এবার অত্যন্ত ধীর গতিতে বলুন, ‘তিন কোটি ডলার।” এমন গতানুগতিকভাবে বলুন যেন এটি অতবেশি অর্থাৎ তেমন গুরুত্ব লাভ না করে। তিন কোটি ডলারের চাইতে ত্রিশ হাজার ধ্বনির শব্দ কি বড় নয়?
চতুর্থ : গুরুত্বপূর্ণ ধারণার আগে ও পরে বিরতি :
লিংকন বক্তৃতাকালে প্রায়ই হাসতেন। যখন কোনো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের মনে আস্থা সৃষ্টি করতে চাইতেন তখন তিনি সে পয়েন্টটি বলার আগে বক্তৃতা থামিয়ে শ্রোতাদের দিকে দৃষ্টি দিতেন, সরাসরি তাদের চোখে-চোখে তাকাতেন, কিন্তু কয়েক মুহূর্ত কিছু বলতেন না। হঠাৎ এই থেমে পড়ার ফলও হত হঠাৎ গণ্ডগোলের মতো। এটা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। এটার পরে কী আসছে তার প্রতি সকলকে মনোযোগী, সতর্ক ও সজাগ করে তুলত। উদাহরণ স্বরূপ ডগলাসের সাথে তাঁর প্রখ্যাত বিতর্ক যখন শেষ হয়ে আসছিল, তখন তার পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে পড়েছিল, তিনি নিজেও যখন হয়ে পড়েছিলেন হতাশ, তখন তিনি তাঁর সুদীর্ঘ কাল অনুসৃত পদ্ধতি অনুসরণে নিজেকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন।
বক্তৃতার উপসংহার টানতে গিয়ে হঠাৎ তিনি থেমে যান এবং কয়েক মুহূর্ত নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন, অর্ধ অমনোযোগী, অর্ধ বন্ধুরূপী মুখগুলোর প্রতি তাকান, দেখতে পান যে, তারা সকলেই যেন গভীর সমুদ্রে অবগাহন করার মতো তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন, কারো-কারো চোখ সজল, হস্তদ্বয় তিনি বন্ধ করেন, যেন এগুলোও ক্লান্ত, অতঃপর তিনি তার অদ্ভুত কণ্ঠস্বরে বলেন, “বন্ধুগণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে জর্জ ডগলাস অথবা আমি যেই নির্বাচিত হই না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু যেগুলো আজ আমরা আপনাদের সামনে পেশ করলাম। সেগুলো অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ, সে কোনোরূপ ব্যক্তি স্বার্থের বহু উর্ধ্বে এবং এগুলো যে কোনো ব্যক্তির রাজনৈতিক ভাগ্যের চাইতে অনেক বড়। এবং বন্ধুগণ, (এখানেও তিনি থামেন এবং দর্শক শ্রোতাদের চোখের দিকে তাকান) তাই এই প্রশ্নটি চির জাগরুক থাকবে। ডগলাস অথবা আমার কণ্ঠখানি স্তব্ধ হয়ে যাবে চিরতরে, যখন আমরা ঢলে পড়ব মৃত্যুর কোলে যখন আমরা মিশে যাব মাটিতে তখনো প্রশ্নটি থেকে যাবে। সুতরাং এগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করুন।”
“এই সাধারণ শব্দগুলো,“ লিখেছেন একজন জীবনীকার, “তাদের মনপ্রাণ আকর্ষণ করে।”
যে সব শব্দ বা প্রবচনের উপর জোর দিতেন লিংকন সে-সব শব্দের শেষেও থামতেন। ও সব শব্দের উপর বিশেষ জোর দিতেন বলে সেগুলোর অর্থও প্রকাশের সাথে সাথে স্পষ্ট হয়ে যেতো, শ্রোতাদের হৃদয়ে পশতো।
স্যার অলিভার লজ বক্তৃতাকালে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা প্রকাশের আগে পরে থামতেন, একটি বাক্যে তিন বা চার বারও থামতেন, কিন্তু তিনি তা করতেন নিতান্ত স্বাভাবিক নিয়মে ও গতিতে। আলিভারের পদ্ধতি বিশ্লেষণ করলে সবার পক্ষে এটা বোঝা অত্যন্ত সহজ হবে।
“আপনার নীরবতা দ্বারা”, বলছেন কিপলিং ”আপনার বক্তব্য সুস্পষ্ট হয়।” বক্তৃতাকালে যথা সময়ে ন্যায়সঙ্গতভাবে নীরবতা পালন করা গেলে তার ফল হয় সবচাইতে উত্তম। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি, এতৎসত্ত্বেও কিন্তু নবীন বক্তারা তা উপেক্ষা করে থাকেন।
হলম্যান এর বক্তৃতা হতে অংশটি উদ্ধৃত করছি এবং এতে আমি নীরবতার জন্য কতিপয় স্থান নির্দিষ্ট করেছি। আমি বলি না যে, আমি নির্দিষ্ট করেছি শুধু তাই-ই নীরবতার কেন্দ্র হবে এবং উত্তম কেন্দ্র হবে। আমি শুধু বলি যে, এভাবে স্থান নির্দিষ্ট করা চলে। কোথায় থামতে হবে তার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন নেই। এটা নির্ভর করে অর্থ এবং অনুভূতির উপর। একই বিষয়ে প্রদত্ত বক্তৃতায় আজ আপনি যে সব স্থানে থামলেন কাল সেসব স্থানে না থেমে; নীরব না থেকে অন্যত্র থামতে পারেন, নীরব থাকতে পারেন। নিম্ন উদ্ধৃত অংশটি কোনোরূপ নীরবতা ছাড়া একবার পাঠ করুন। অতঃপর আবার পাঠ করুন; থামুন যে-সব স্থানে আমি কমার চিহ্ন দিয়েছি, এই থামার ফলাফল কী?
“পণ্য বিক্রি একটি সংগ্রাম” (থামুন এবং সংগ্রাম শব্দের অর্থ অনুধাবন করুন) “এবং একমাত্র যোদ্ধারাই এতে জয় লাভ করতে পারেন।” (থামুন এবং পুরো তাৎপর্য অনুধাবন করুন।)”আমরা এই অবস্থা পছন্দ নাও করতে পারি কিন্তু আমরা এই অবস্থা সৃষ্টি করি নি এবং পরিবর্তনও করতে পারি না।” (থামুন) ”বিক্রি, ব্যবসায় নামার সময় পূর্ণ সাহস নিয়ে নামুন; (থামুন) ”যদি তা না করেন।” (থামুন এবং কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকুন,)” যতবার আপনি বিজয়ী হবার চেষ্টা করবেন তত বারই পরাজিত হবেন এবং পরিশেষে আপনি দেনাদার হয়ে পড়বেন, “(থামুন)”। “ভীত ব্যক্তি কখনো প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে পারে না (থামুন এবং অর্থ অনুধাবন করুন)”সব সময় এটা স্মরণ রাখুন” (থামুন এবং পুরো অর্থ বোঝার চেষ্টা করুন), “যে খেলোয়াড় বলকে নিজের আয়ত্তে রেখে গোল মুখে এগিয়ে যায় সে সব সময়, যে খেলোয়াড় বল পেয়ে দূর থেকে তা গোলে ফেলার চেষ্টা করে, তার চাইতে ভালো,“ (থামুন এবং নীরবতা পালন।) “দৃঢ় হলে গোল দেয়া তার পক্ষেই সহজতর।”
নিম্ন উদ্ধৃতিটি শব্দ করে, জোর দিয়ে অর্থ বুঝে পড়ুন। কোথায় কোথায় থামবেন তা ঠিক করুন।
আমেরিকার বিশাল মরুভূমি ইদাহো নিউম্যাক্সিকো বা আরিজোনায় অবস্থিত নয়। এটা প্রায় আমেরিকানের টুপির নিচে-অবস্থিত, কারণ, বিশাল আমেরিকান মরুভূমি হচ্ছে বাস্তব মরুভূমি নয়, মস্তিষ্কের মরুভূমি। অর্থাৎ মস্তিষ্কের অনুর্বরতাই হচ্ছে মরুভূমি। জে. এন. কনক্স।
মানুষের সর্বরোগ হর কোনো মহৌষধ নেই, যা আছে তা হচ্ছে প্রচার। অধ্যাপক ফক্স ওয়েল।
দু’জনকে আমার সন্তুষ্ট করতে হবে। তারা হচ্ছেন ভগবান এবং গারফিল্ড। গারফিল্ডের সাথে আমাকে সংসারে চলতে হবে এবং সংসার ধর্ম শেষে যেতে হবে ভগবানের কাছে–জেমস, এ গারফিল্ড।
এই অধ্যায়ে আমি যে সব নির্দেশ দিয়েছি তা অনুসরণ করেও বক্তারা শতশত ভুল করতে পারেন। যে কোনো বক্তা সাধারণ ভাবে যে রূপ স্বরে কথা বলেন ঠিক সে স্বরে বক্তৃতা শুরু করতে পারেন। অতঃপর তিনি স্বরে পরিবর্তন আনতে পারেন, এতে সময় সময় ভুল করে অসুবিধা জনক পরিস্থিতিতেও পড়তে পারেন। যে কোনো লোকের দৈনন্দিন কথাবার্তা বলার পদ্ধতিতেও উন্নতি বিধান করা প্রয়োজন। আপনার স্বাভাবিক কথাবার্তা বলার পদ্ধতি সঠিক করুন, অতঃপর সেভাবে বক্তৃতা করার চেষ্টা করুন।
সংক্ষিপ্ত সার :
১। বক্তৃতায় শব্দ ছাড়া আরো কিছু আছে। তা হচ্ছে কীভাবে বক্তৃতা দেয়া হল তা অর্থাৎ পদ্ধতি। “আপনি কি বলবেন তার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কী ভাবে বললেন।”
২। বহু বক্তা শ্রোতাদের অবজ্ঞা করেন, তাদের মাথার ওপর দিয়ে অথবা মেঝের দিকে তাকিয়ে বক্তৃতা করেন। তাদের বক্তৃতা হয় স্বগতোক্তি। এই বক্তব্য শ্রোতার মন আকর্ষণ করে না, বক্তা ও শ্রোতার সম্পর্কের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়। এই ধরনের বক্তৃতা অর্থহীন ও ব্যর্থ হয়।
৩। সাধারণ বাচন ভঙ্গিতে প্রদত্ত সুভাষণ হয় ফলপ্রসু, ঘরোয়া পরিবেশে যেভাবে কথা বলা হয় ঠিক সেভাবে বক্তৃতা করার চেষ্টা করলে তার ফলও ভালো হয়। জন স্মিথ ঠিক এই পদ্ধতি অনুসরণ করতেন।
৪। প্রত্যেক লোকেরই কথা বলার ক্ষমতা আছে। এতে আপনার মনে কোনো প্রশ্ন জাগলে নিজের মন থেকেই এর উত্তর পেতে পারেন। একজন লোককে, যাকে আপনি সব চাইতে নিরীহ ও নির্বোধ বলে মনে করেন, তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিন। সে ওঠে দাঁড়িয়ে যে কথা বলবে তা সুমধুর হবে না, তবু তাতে গতি থাকবে। আমরা চাই যে, আপনি বক্তৃতা মঞ্চে ধাক্কা খেয়ে জেগে উঠুন, এটা করতে হলে প্রয়োজন অভ্যাস। অন্যদের অনুকরণ করবেন না। আপনি অব্যাহত ভাবে কথা বলতে পারলে, নিজস্ব ভঙ্গিতে বক্তৃতা করতে পারলে বিশ্বেশ্রেষ্ঠ বক্তা হবেন। সুতরাং বক্তৃতায় আপনার ব্যক্তিত্ব, চরিত্র বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করুন।
৫। শ্রোতাদের সামনে এমনভাবে বক্তৃতা করুন, যেন তারা আপনার বক্তৃতা শোনার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে এবং আপনার সাথে কথা বলছে, তারা যদি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে, তা হলে আপনার বক্তৃতা নিশ্চিতভাবেই উন্নত হবে এবং দ্রুত হবে। সুতরাং কল্পনা করুন যে, কেহ আপনাকে প্রশ্ন করছে এবং আপনি তার পুনরাবৃত্তি করছেন। উচ্চ শব্দে বলুন, “আপনি প্রশ্ন করতে পারেন আমি কীভাবে এটা জানলাম? আমি আপনাকে বলব। এটা নিতান্ত স্বাভাবিক দেখাবে। কিন্তু এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে আপনার বক্তৃতার গতি বাড়বে, বক্তৃতা ভালো হবে।
৬। আপনার বক্তব্য বিষয়ের ওপর মনপ্রাণ ঢেলে দিন। আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করলে বক্তৃতা ভালো হবে।
৭। কথোপথনের সময় আমরা অবচেতন মনে চারটি কাজ করি। কিন্তু জনসভায় বক্তৃতা কালে আপনি তা কি করেন?
অধিকাংশ লোক তা করে না!
(ক) একটি বাক্যের গুরুত্বপূর্ণ শব্দের ওপর জোর দিয়ে অন্য শব্দকে কি সাধারণ ভাবে উচ্চারণ করেন? এবং, কিন্তু, প্রতিটি শব্দের পর আপনি কি সম-মনোযোগ দেন অথবা মাসা-সুসেটস বলতে সু-র ওপর যেভাবে জোর দেন ঠিক সেভাবে প্রত্যেক শব্দের কোনো না কোনো সিল্যাবলের ওপর জোর দেন?
(খ) ছোট শিশু কথা বলার সময় তার স্বরের যেভাবে উত্থান-পতন হয় আপনার কথা বলার সময়ও কি তা হয়?
(গ) কথা বলায় আপনার কি গতি পরিবর্তন হয়? আপনি কি সাধারণ শব্দের চাইতে যার ওপর গুরুত্ব বেশি দেন সে শব্দকে ঠিক সেরূপ জোর দিয়ে প্রকাশ করেন?
(ঘ) আপনার গুরুত্বপূর্ণ ভাব প্রকাশের আগে ও পরে কি আপনি থামেন, নীরবতা পালন করেন?