ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
সুবৰ্ণরেখা।
বালির চর বুকে করিয়া নদীটিা সারাদিন পড়িয়া থাকে। স্বল্প জল এখানে ওখানে বালির মধ্য দিয়া বহিয়া যায়। নদীর মাঝখানে বড়ো বড়ো কালো পাথরের চাই প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো পড়িয়া আছে। উপরের প্রখর নীল আকাশ ধূসর দিগন্তের সহিত একটা অদ্ভুত বৈষম্য সৃষ্টি করিয়াছে। মাটির রঙ লাল। জমি সর্বত্র উঁচুনিচু। স্থানটিতে কেমন একটা বৈবাগ্যের ভাব আছে, মাটিব গৈরিক রঙটির মতো।
মৌপাহাড়িতে লোকজন কম। দিনের বেলায় মনে হয় কিসের উপলক্ষে যেন ছুটি হইয়া গিয়াছে–সবাই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। সন্ধ্যার সময় একটা কালো চাদর ক্রমশ সবকিছু ঢাকিয়া ফেলে। ঝিঁঝি এবং অন্যান্য পতঙ্গের ডাকের মধ্যে দিয়া রাত্রি মৌপাহাড়িকে গ্ৰাস করিয়া লয়। অপু ইহার ভিতরে কী একটা যেন খুঁজিয়া পাইয়াছে। মানুষের সঙ্গ–কেবল কাজল এবং হৈমন্তী ছাড়া–তাহার কাছে আর কাম্য নহে। বইখাতা বগলে দিনের প্রায় সময়টাই সে বাহিরে ঘুরিয়া কাটায়।
নদীর ধারে একখানি বড়ো পাথরের উপর বসিয়া সে লেখে। জীবনকে সে অলসভাবে একদিক হইতে দেখে নাই। তাহার দেখা বিচিত্র জীবনের কথা সে আগামী যুগের জন্য রাখিয়া যাইবে। লিখিতে লিখিতে কখনও মুখ তুলিয়া দেখে সামনে সুবর্ণরেখার বিস্তৃত বক্ষ, ওপারে প্রান্তরের গৈরিক প্রসার। পড়ন্ত সূর্যালোকে নদীর বালির মধ্যে মিশ্ৰিত অভ্রকণা চিক্ চিক করিতেছে। আকাশে বাতাসে কীসের একটা অস্পষ্ট ইঙ্গিত অপুকে বিচলিত করে। কী একটা এখনই করিতে হইবে, কী একটা করিবার আছে–কিন্তু কিছুতেই করা হইতেছে না। শরীরের মধ্যে একটা বিচলিত ভাব বাড়িয়া ওঠে। মনে হয়, সবটাই বাকি রহিল, নির্দিষ্ট কাজের ভগ্নাংশও করা হইল না। যাহা জানিবার ছিল, তাহার কণামাত্রের আস্বাদন হইল মাত্র।
শরীর লইয়া অপু খুবই বিব্রত। নিশ্চিন্দিপুর ছাড়িয়া আসার পর মৌপাহাড়িতে তিন-চার বৎসর কাটিল, কিন্তু স্বাস্থ্যের খুব একটা উন্নতি হয় নাই। প্রায়ই বুকে একটা যন্ত্রণা হয়। মাথা ভার ঠেকে, অম্বল হয়। এসব কথা সে কাহাকেও বলে না। অসুখ গা সওয়া হইয়া গিয়াছে। সন্ধ্যা ঘনাইলে লেখা বন্ধ করিয়া নক্ষত্রের আলোয় বাড়ি ফিরিতে ফিরিতে হঠাৎ ছোট টিলেটার গা ঘেঁষিয়া বিশাল বৃহস্পতি গ্রহটাকে উঠিতে দেখিয়া তাহার অসুখের কথা বিস্মরণ হইয়া যায়। সেতারের জলদের মতো জীবনটা কাহার হাতের স্পর্শে যেন বাজিতেছে। কীসের স্পর্শে যেন জীবনের রঙ বদলাইতেছে, সুরের পরিবর্তন ঘটিতেছে।
সুবৰ্ণরেখার ধারে বসিয়া অপু নদীর সঙ্গে নিজের মিল খুঁজিয়া পায়। একা থাকিলেও মনে হয় না সে একা আছে। কাহার উপস্থিতি যেন রহিয়াছে আশেপাশে, অনুভব করা যায় কেহ পেছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, সে চোখ ফিরাইলে সরিয়া যায় দূরে।
একদিন একটা কাণ্ড ঘটিল। অপু বসিয়া লিখিতেছে, একটা প্ৰজাপতি আসিয়া বসিল তাহার খাতার পাতায়। সে হাত বাড়াইয়া ধরিতে গেলে সেটা উড়িয়া একটু দূরে একটা পুটুস গাছের উপর বসিল। অপুর কেমন মনে হইল, সুন্দর প্রজাপতিটাকে ধরিতেই হইবে। এক টুকরা পাথর খাতার উপর চাপা দিয়া সে উঠিল।
প্রজাপতিটা ধরা গেল না। গাঢ় লাল আল বাদামী ডানাওয়ালা পতঙ্গটা তাহাকে দূর হইতে দূরে লইয়া গেল। এক ঝোপ হইতে অন্য ঝোপ করিতে করিতে অপু আচ্ছন্নের মতো দৌড়াইল। বাতাস অপুর চুল অবিন্যস্ত করিয়া দিল, তাহার ধুতিতে চোরাকাঁটা লাগিয়া গেল। পাথরে লাগিয়া পায়ের এক জায়গা কাটিয়াও গেল, কিন্তু প্ৰজাপতির নাগাল পাওয়া গেল না।
মাইলখানেক দৌড়াদৌড়ি করিয়া অপু নিজের বসিবাব জায়গায় ফিরিয়া আসিল। পাথরের উপর রাখা খাতার পাতা বাতাসে অল্প অল্প উড়িতেছে, চাপা আছে বলিয়া একেবারে উড়িয়া যায় নাই।
অপু পাথরটার এক কোণে বসিয়া শূন্যদৃষ্টিতে সুবৰ্ণরেখার দিকে তাকাইয়া রহিল।
বয়স বাড়িবাব সঙ্গে সঙ্গে কাজলের দুষ্টামি কমিয়াছে। আগের মতো লাফালাফি করিতে আর ভালোবাসে না। মৌপাহাড়িতে তাহার সমবয়সী কম। সমবয়সীদের সঙ্গে কখনই তাহার বন্ধুত্ব গড়িয়া ওঠে নাই। বয়সে যাহারা অনেক বড়, তাহদের সঙ্গেই বরং কাজলের জমে ভালো।
একদিন কয়েকটা ছেলে মিলিয়া মাইলতিনেক দূরের একটা পাহাড়ে বেড়াইতে গিয়াছিল। কাজলের মনে হইয়াছিল ছেলেগুলি এক একটি আস্ত বর্বব। ঢিল কুড়াইয়া ভীষণ জোরে ছুঁড়িতেছে, লাফাইতেছে, চিৎকার করিতেছে, নিজেদের মধ্যে তুচ্ছ কারণে মারামারি করিতেছে। অথচ চারিপাশে কেমন সুন্দর পাহাড়ি পরিবেশ। নির্জন স্থানে স্তব্ধতা খা খাঁ করিতেছে। মাঝে মাঝে বাসায় ফেরা কী এক ধরনের পাখি মাথার উপর দিয়া মধুর সুরে ডাকিয়া যাইতেছে। সব মিলাইয়া বেশ ঘনিষ্ঠ আনন্দময় পরিবেশ। ছেলেরা এসব মোটেই বুঝিতেছে না। কাজল ক্রমশ বিরক্ত হইয়া উঠিল। বড়ো গোলমাল করে ইহারা। তাহার মনের সঙ্গে ইহাদের কোন যোগাযোগ নাই। থামাইবার জন্য সে কিছুদিন আগে পড়া একটা গল্প শুরু করিল, কিন্তু সে গল্পে কেহ উৎসাহ পাইল না।
ধীরে ধীরে অল্প বয়সেই কাজলের ভিতর একটা বোধ জাগিয়া উঠিতেছিল, তাহার সহিত অন্যের মনের মিল হয় না–হইবে না।
সে একা থাকে। অপু প্রচুর বই আনি যা দিয়াছে। অনেক বিদেশী সাহিত্যের অনুবাদ সে পড়িয়া শেষ করিয়াছে। অপু তাহাকে নিজে ইংরাজি শিখাইতেছে, যাহাতে কাজল শীঘ্রই বিশ্বসাহিত্যে প্ৰবেশলাভ করিতে পারে, কাজলও অসাধারণ দক্ষতা দেখাইয়া ইংরাজি ভাষা শিক্ষায় অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছে। সন্ধ্যায় দুই ঘণ্টা তাহাকে বাবার কাছে বসিয়া পড়িতে হয়।
চোখের সামনে তাহার এ কী জগতের দ্বার খুলিয়া যাইতেছে! এ কী আনন্দ আর আলোর জগৎ। পৃথিবীর সাধারণ অকিঞ্চিৎকর বস্তুও এ আলোর স্পর্শে অসাধারণ হইয়া উঠিতেছে। এমনভাবে যাহারা তাহাকে পৃথিবীটা দেখিতে শিখাইয়াছে, তাহাদের কাছে সে কৃতজ্ঞ থাকিবে।
ফরাসী ছোটগল্পের অনুবাদ পড়িয়া প্রথম তাহার চোখ ফুটিয়াছিল। রোজাকার জীবনে দেখা সামান্য ঘটনা লেখকদের হাতে এক গভীর তাৎপর্য লাভ করিয়াছে। এক জায়গায় একটি বৃষ্টির বর্ণনা এবং অপর জায়গায় একটি জ্যোৎস্নারাত্রির বর্ণনা তাহাকে পাগল করিয়া দিয়াছিল। এখনও বর্ষার দিনে এবং জ্যোৎস্নারাত্ৰিতে গল্প দুটিকে সে মনে করিয়া থাকে।
একটু বয়স হওয়ায় সে বাবাকে চিনিতে পারিতেছে। বাবার কেমন একটা আলাদা অস্তিত্ব আছে, সে বুঝিতে পারে। সেটা বাবার সাংসারিক অস্তিত্ব নহে–অন্য কিছু। সবকিছুর ভিতরে থাকিয়াও বাবা সব কিছু হইতে আলাদা। একদিন বাবাকে বড়ো অদ্ভুত লাগিয়াছিল। বেড়াইতে যাইবে বলিয়া বাহির হইতে গিয়া সে দেখিল বাবা উঠানের প্রান্তে ইউক্যালিপটাস গাছটার নিচে শতরঞ্চি পাতিয়া বসিয়া লিখিতেছে। হয়তো কিছু মনে আসিতেছে না, কোন উপযুক্ত শব্দ খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না, তাই বাবা কলমটা হাতে ধরিয়া উদাসভাবে দূরে তাকাইয়া আছে। ডানদিকের কাঁধটা একটু নিচু দেখাইতেছে। ফরসা, ঋজু দেহ বাবার। হঠাৎ বাবার জন্য ভীষণ মায়া হইল, ভীষণ-ভীষণ ইচ্ছা হইল বাবার কোলের কাছে গিয়া মুখ গুজিয়া থাকে। শরীরের ভিতরের প্রতি শিরায় সে পিতার জন্য ভালোবাসার স্রোত অনুভব করিল। বাবার শরীর মোটে ভালো যাইতেছে না–বাবা কাহাকেও বলে না, কিন্তু কাজল জানে।
হৈমন্তীর বাবা সুরপতিবাবু একদিন মৌপাহাড়িতে আসিয়া হাজির হইলেন। কী কাজে জামসেদপুর আসিয়াছিলেন-পথে মৌপাহাড়ি ঘুরিয়া যাইতেছেন। হৈমন্তী দৌড়াইয়া আসিয়া প্ৰণাম করিল। অপু ব্যস্ত হইয়া পড়িল খাওয়াইবার আয়োজনের জন্য। কাজল প্রথমটা একটু থতমত খাইয়াছিল, কিন্তু লজ্জা কাটিয়া গেলে দেখিল দাদু খুব ভালোমানুষ। কাজলকে ডাকিয়া তিনি বলিলেন, আজকে সারাদিন আমি তোমার সঙ্গে গল্প করব দাদু, কেমন?
হৈমন্তী বলিল–তুমি দু’একদিন থাকবে তো বাবা?
–না মা, সময় নেই হাতে একদম। পরের কাজে আসা—
আপত্তি টিকিল না। দুই দিন থাকিয়া যাইতে হইল। সারাদিন কাজল আর দাদুর গল্প চলিত, অপু যোগ দিতে পারিত না। সে একখানি বড়ো উপন্যাস লিখিতেছে। সন্ধ্যান্য উঠানে শতরঞ্চি পাতিয়া বসিয়া অপু শ্বশুর মহাশয়ের সহিত কথাবার্তা বলিত। সুরপতিবাবু জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ লোক। জীবনের তিক্ত এবং মধুর দুই দিকের সহিতই নিবিড় পরিচয় আছে। পরলোকে অত্যন্ত বিশ্বাসী। সন্ধ্যায় পরলোক লইয়া অপুর সহিত কথা হইল।
দুই দিনের বেশি সুবপতিবাবু থাকিতে পারিলেন না। যাইবার সময় অপুকে শরীরের প্রতি বিশেষ যত্ন লাইতে বাব বার বলিয়া গেলেন। হৈমন্তীকে আড়ালে ডাকিয়া বলিলেন–তোর কপাল ভালো হৈম যে এমন স্বামী পেয়েছিস।
জামাই সত্যিই বড়ো ভালো, এমন মানুষ দেখা যায় না। কাজলকে গোপনে দুইটি টাকা দিয়া তিনি ছাত-ব্যাগ সহ রওনা হইলেন। অপু তাঁহাকে ট্রেনে তুলিয়া দিতে গেল।
ট্রেনে তুলিয়া দিয়া ফিরিবার সময় অপুর বুকে কেমন একটা যন্ত্রণা বোধ হইল। বাঁদিকে একটা চিনচিনে ব্যথা, কমিতেছে না। বুকে হাত দিয়া অপু কিছুক্ষণ বসিল, কিছু হইল না। মাথাটা বেশ ঘুরিতেছে, অপু ঠিক করিল। ডাক্তারের কাছে একবার ঘুরিয়া যাইবে।
স্থানীয় ডাক্তার বিশ্বনাথ সোম অপুকে দেখেন, ডিসপেনসারিতে ঢুকিতেই তিনি অপুর মুখ দেখিয়া অবাক হইয়া বলিলেন–কী হয়েছে অপূর্ববাবু? বসুন, ওই চেয়ারটাতে, হ্যাঁ–
যন্ত্রণা বাড়িতেছিল। মাথার মধ্যে যেন বিমঝিম বাজনা। বিশ্বনাথবাবু নাড়ি দেখিয়া কমপাউন্ডারকে ডাকিলেন–সুরেন, মেজার গ্লাসে পনেরো ড্রপ কোরামিন চট করে নিয়ে এসো।
কোরামিন খাইয়া অপু একটু সুস্থ বোধ করিল। বিশ্বনাথবাবু প্রেসার লাইলেন। খুব হাই।
–কিছুদিন বিশ্রাম নিন। এরকম বারবার হওয়াটা তো ভালো নয় রায়মশায়! খাওয়াদাওয়া নিয়মমাফিক, আমাকে প্রতি হগুপ্তায় একবার করে দেখিয়ে যাবেন।
অপু বাহিরে আসিল। রাস্তায় লোক কম। মাথার ভিতরটা এখনও পুরাপুরি পরিষ্কার হয় নাই। একটু হাঁটিলেই মনে হইতেছে আবার মাথা ঘুরিয়া উঠিবে। ডাক্তার বিশ্রাম লইতে বলিয়াছে, এইবার তাহাকে বিশ্রাম লইতে হইবে। একটা উপন্যাস সে লিখিতেছে, শেষ হওয়ার পূর্বে বিশ্রাম নাই। উপন্যাসটা শেষ করিয়া। তবে ছুটি।
ক্লান্ত শরীর-সামনে একটা উপন্যাস লিখিবার পরিশ্রম। হঠাৎ অপুর নিকট ‘ছুটি’ শব্দটা অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক বোধ হইল।
কলিকাতা হইতে প্ৰকাশকের পত্ৰ আসিল, লেখাটা তাহদের শীঘ্র প্রয়োজন। দেরি করিলে আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা।
সকালে জলখাবার খাইয়া অপু লেখা শুরু করে, দুপুরে খাইবার সময় বাদ দিয়া সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ক্ৰমাগত লেখে। সন্ধ্যায় ক্লান্ত দেহে একটু নদীর দিকে বেড়াইতে যায়। ফিরিয়া আসিয়াই আবার রাত্ৰি বারোটা পর্যন্ত লেখে। শরীরের উপর অত্যন্ত অত্যাচার হইতেছে। উপন্যাসটি অপু হৃদয় উজাড় করিয়া লিখিবে। অপরিণত বয়সের ভাবারেগ আর নাই, এখন জীবন,সত্য উপলব্ধি করিবার সময়।
কোন সময় লিখিতে লিখিতে মাথা একেবারে ফাঁকা হইয়া যায়, হাত-পা অবশ হইয়া আসে। কলামটা টেবিলে নামাইয়া অপু অনুভব করে, শরীর ভাঙিয়া আসিতেছে-আচ্ছন্নের মতো সে কাজ করিয়া যাইতেছে। কিছুটা লোভে লোভেও বটে। কাজটা শেষ হইলে আপাতত ছুটি।
হৈমন্তী আসিয়া বকে–রেখে দাও তো! এরকম খাটলে শরীর দুদিনে ভেঙে পড়বে। শোবে চলো।
অপু চুলের ভিতর হাত চালাইতে চালাইতে বলে–আর একটু, এই চ্যাপ্টারটা শেষ করে ফেলি।
হৈমন্তী বুঝাইয়া পারে না।
একদিন অপু টেবিলেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। হাত হইতে কলম খসিয়া পড়িয়াছিল। খাতার উপর মাথা রাখিয়া অপু স্বপ্ন দেখিতেছিল, মধ্যপ্রদেশের সেই বন্যজীবনটা আবার ফিরিয়াছে। সে তেজী ঘোড়ার সওয়ার হইয়া আদিগন্ত হাঁটুসমান জঙ্গলে তীব্ৰবেগে ভ্ৰমণ করিতেছে। কালপুরুষ পশ্চিম দিগন্ত ছুঁই-ছুঁই করিয়াছে। বাতাসে সেই সজীব ভাবটা।
বাধা দিবার কেহ নাই, মহাশূন্যে গাঢ় অন্ধকারে ভীমরেগে ধাবমান উল্কার মতো জীবন আবার ফিরিয়াছে। চিন্তা নাই, দুঃখ নাই, ক্ষোভ নাই-স্বপ্নের মধ্যেই সব পাইবার তৃপ্তি তাহাকে আচ্ছন্ন করিতেছে। খুব জোরে ঘোড়া ছুটাইয়াছে সে। দৌড়-দৌড়-দৌড়। সামনে কালোমত কী একটা আসিতেছে, বিশাল পাহাড়ের মতো। সে ঘোড়ার রাশ টানিল।
ঘুম ভাঙিয়া সে কলমটা আবার তুলিয়া লইল, কিন্তু আর লিখিবার উৎসাহ নাই। স্বপ্ন এখনও মাথার মধ্যে ঘুরিতেছে। অর্থটা বোঝা যাইতেছে না বলিয়া অস্বস্তি হইতেছে। টেবিলের ওপাশে জানালা খোলা, হু-হু বাতাস আসিয়া কাগজ-পত্ৰ এলোমেলো হইতেছে। সবাই ঘুমাইয়া, কেবল বহুদূরের কোন সাঁওতাল বস্তির ক্লান্ত মাদলের শব্দ এখনও শোনা যায়।
চিঠি লিখিবার প্যাডটা টানিয়া লইয়া অপু মনে করিয়া করিয়া বহু পুরাতন বন্ধু আর আত্মীয়দের এক-একখানা চিঠি লিখিল। অনেককে লেখা হইল না, তাহাদের ঠিকানা মনে নাই। লিখিল–ভালো আছো? অনেকদিন খবর নিতে পারিনি, স্বার্থপরের মতো নিজের ভেতরে নিজেকে গুটিয়ে বসে ছিলাম। কিন্তু মানুষ এক বাঁচে না, তোমাদের সবাইকে আমার জীবনে বড়ো দরকার। আমাকে মনে রেখো, একেবারে ভুলে যেয়ো না যেন। মানুষের মধ্যে বেঁচে আছি—এ বোধটা আমার জীবনে যেমন প্রয়োজন, তোমাদের জীবনেও তেমনি।
চিঠিগুলি লিখিতে রাত শেষ হইয়া গেল। পূর্বদিকের টিলোটার পাশের আকাশে লাল রঙ ধরিল। মেঘের লম্বা স্তরগুলিকে দেখাইতেছে যেন আঁকা ছবি। আলো ফু দিয়া নিভাইয়া অপু বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল।
বিকালে অপু ছেলেকে ডাকিয়া বলিল–খোকা চল, বেরুই কোথাও।
উঁচুনিচু লালমাটির ডাঙা ধরিয়া দুইজনে কিছুক্ষণ হাঁটিল। অনুচ্চ একটি পাহাড়ের কাছে আসিয়া অপু বলিল–আয়, এখানে বসি।
দুইটা ছোট পাথরে দুইজনে বসিল। কাজল বলিল–বাবা, সেই যে গল্পটা। নির্জন দুর্গে একলা রাজকুমারী থাকতো, সেটা আজ শেষ করো।–
সে কথা কানে না লইয়া অপু, ডাকিল-খোকা।
-কী বাবা?
-আমার কাছে উঠে আয় তো একটু।
কাজল বাবাব কোল ঘেঁষিয়া দাঁড়াইল।
–খোকা, তুই আমায় ভালোবাসিস?
উত্তর না দিয়া কাজল বাবাব বুকে মুখ গুজিয়া রহিল। তাহার বয়সী ছেলের পক্ষে ইহা বিসদৃশ হইলেও, বাবা ও মায়ের আদর পাইলে সে এমনি করিয়া থাকে।
অপু ছেলের মাথায় হাত বুলাইতে লাগিল। সূর্যাস্তের রঙে রঞ্জিত প্রান্তরে সে অনেকক্ষণ ছেলের সহিত বসিয়া রহিল। ক্রমে আলো কমিয়া কীটপতঙ্গের গুঞ্জন শুরু হইল। অপু উঠিয়া ছেলের হাত ধরিল।
–চল, বাড়ি চল, তোর মা ভাববে।
বাবার হাত ধরিয়া কাজল হাঁটিতেছিল। বাবা আজ এত গম্ভীব কেন?
কী একটা প্রাণী সুড়ৎ করিয়া রাস্তা পার হইল, অন্ধকারে দেখা গেল না। হয়তো মেঠো ইঁদুর। বাড়ি ফিরিতেই হৈমন্তী বলিল–তোমাকে বলে আর পারা গেল না। এত দেরি করে ফিরিতে হয়। খাবাব এদিকে জুড়িয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেল–
অপু কাজলের হাত ছাড়িয়া দিয়া অদ্ভুত ছেলেমানুষির সুরে বলিল– আর করব না। হৈমন্তী, সত্যি বলছি- আর কখনও না–
রাত্ৰে শুইয়া অপু, হৈমন্তীকে ডাকিল–হৈমন্তী।
–কী গো?
–বাইরে কেমন জ্যোৎস্না উঠেছে দেখেছি?
সুন্দর জ্যোৎস্নায় উঠান ভাসিতেছে। অষ্টমী তিথি, চাঁদ দিগন্তের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। বিষণ্ণ অথচ সুন্দর জ্যোৎস্না।
হৈমন্তী বলিল–সুন্দর।
–চল, একটু বাইরে গিয়ে বসি। ঘরে ভালো লাগছে না।
ঘুমন্ত কাজলের চারপাশে মশারি গুজিয়া দিয়া দুইজনে উঠানে গিয়া বসিল। শব্দহীন রাত্রি। চাঁদের আলোয় একটু বসিতেই কেমন একটা আবেশ জড়াইয়া আসে দেহে-মনে।
-হৈমন্তী, কাল আমার উপন্যাস শেষ হয়ে যাবে। বড়ো ভালো লাগছে। যা লিখতে চেয়েছিলাম–ঠিক সেই রকমটি হল না, কিন্তু অনেকখানি পেরেছি বলে মনে হচ্ছে।
কাছেই কোথাও ঝিঁঝি ডাকিতে শুরু করিল।
–ছোটবেলায় দূরে তাকিয়ে ভাবতাম, ওই যেখানে আকাশ আর মাটি মিলেছে, তার ওপারেই আছে রূপকথার ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর দেশ। তেমনি আমার লেখায় একটা দূর দিগন্তের ইঙ্গিত রয়েই গেল। সারাজীবন আমিও এগুলাম, স্বপ্নটাও মরীচিকার মতো পিছিয়ে গেল।
হৈমন্তী অপুর হাঁটুতে হাত রাখিয়া বলিল–তোমার জীবনে কি কোন দুঃখ আছে?
–না, আমি পবিপূর্ণ, আমি তৃপ্ত। কারণ আমি বুঝেছি সন্ধানেই আনন্দ, প্ৰাপ্তিতে পরিসমাপ্তি। আমি পথ চলতে ভালোবাসি হৈমন্তী। আমি পথের শেষ চাই না।
দুইজনে কোন কথা না বলিয়া বসিয়া রহিল। বিবি ডাকোব বিবাম নাই। চাঁদ ইউক্যালিপটাস গাছ দুইটাব মাঝখান দিয়া ধীরে ধীরে নামিয়া পড়িতেছে। তাহাদের ছায়া ক্রমশ দীর্ঘ হইতে দীর্ঘতর হইয়া আসিল। চাঁদের আলো স্নান হইবাব সঙ্গে সঙ্গে নক্ষত্রগুলি উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে। বাতাস একবার গাছের পাতায় হালকা দোলা দিল।
–হৈমন্তী।
–কী?
–না, থাক–
হৈমন্তী অপুর হাত ধরিয়া বলিল–বলো না, কী বলবে।
অপু একবার আকাশের দিকে তাকাইল, তারপর বলিল—বলা যায় না, বলা যায় না। ভাষা জানি নে—
পরের দিন সকালে যদু পিওন আসিল মনি অর্ডার দিতে। কিছুদিন আগে কাগজে হৈমন্তীর গল্প বাহির হইয়াছিল। তাহার পারিশ্রমিক পনেরোটি টাকা আসিয়াছে। যদু পিওন এমনি মনি অর্ডার আগেও কয়েকবার বিলি করিয়াছে। মৌপাহাডির নিরালায় হৈমন্তী বেশ কয়েকটি গল্প লিখিয়াছে।
মনি অর্ডার ফর্মে হৈমন্তী সই করিতেছে, অপু আসিয়া পিছনে দাঁড়াইল।
— বঙ্গবাণীর টাকাটা এলো বুঝি?
হৈমন্তী ফিরিয়া মুখ টিপিয়া হাসিল।
যদু, পিওন বলিল–এই তল্লাটে এমন রোজগেরে বৌ আর দেখিনি বাবু।
হৈমন্তী হাসিয়া বলিল– তোমাকে আর বকবক কবতে হবে না যদুদা। এই টাকাটা নাও, বাচাঁদের মিষ্টি কিনে দিয়ো।
টাকা দুইটি হাত পাতিয়া লইয়া বলিল–দিদির আরও অনেক মনি অর্ডার আসুক।
হাসিতে হাসিতে যদু চিঠির ব্যাগ তুলিয়া রওনা দিল।
সারাদিন অপু টেবিলেই বসিয়া রহিল। লিখিতে লিখিতে কখন যে দিন কাটিয়া গেল কে জানে। উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ের শেষ বাক্যটি লেখা হইয়া গেল। স্তূপাকার কাগজগুলির দিকে তাকাইয়া অপুর অবাক লাগিল। শেষ হইয়া গিয়াছে। বিনিদ্র রাত্রির বেদনা-অনুভূতির ফল ওই কাগজগুলি। এইবার প্যাকেটবন্দী হইয়া কলিকাতায় যাইবে, নাকের উপর চশমা নামিয়া আসা বৃদ্ধ কম্পোজিটার বানান করিয়া করিয়া কম্পোজ করিবে।
শরীরে ভীষণ ক্লান্তি। এত পরিশ্রম সে একসঙ্গে কখনও করে নাই। ডান হাত ব্যথায় টনটন করিতেছে, হৈমন্তীকে ডাকিয়া অপু বলিল– একটু গরমজল করে দাও তো, হাতটা বড্ড বাথা করছে, ড়ুবিয়ে রাখব।
কাজ মিটিয়া গেল। সামনে অব বড়ো কোন কাজ নাই। অপু আপনমনে বেড়াইতেছিল। ছেলেবেলাকার অভ্যাসমত হাতে সরু কঞ্চির মতো একটা লাঠি লইয়াছে। অনেকক্ষণ ঘুরিবার পর মনে হইল, সে আজ ভীষণ অন্যমনস্ক। অনেক পুরাতন কথা মনে পড়িতেছে। অনেক পুরাতন মুখ। অপৰ্ণার কথা বড়ো বেশি মনে আসিতেছে। তাহাকে কিছু দেওয়া হয় নাই–তখন অপুর পয়সা ছিল না। অথচ অপর্ণা হাসিমুখে অবস্থার সহিত খাপ খাওয়াইয়া নিয়াছিল–কখনও অভিযোগ করে নাই। বড়ো সিঁদুরের টিপ পরা অপর্ণার সলজ্জ মুখখানি আজ অনেকদিন বাদে মনে পড়িয়া গেল। তাহার চিবুকের টোলটা সে স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছে।
কাশীতে যখন বাবা মারা যায়–উঃ কী দিন গিয়াছে। কনকনে শীতের রাত্রে সেই গঙ্গাস্নান করিয়া বাড়ি ফেরা।
সবার হইতে বেশি মনে পড়ে মাকে। কখনও কিছু চায় নাই, আশা করে নাই। অপু সুখে থাকিলেই সুখী হইত। মনসাপোতার বাড়িতে ফিরিয়া তাহার প্রতি ছাত্রীর অভিভাবকদের সদয় ব্যবহারের কথা সে মাকে খুশি করিবার জন্য বানাইয়া বানাইয়া বলিত। মা সরল মনে সব বিশ্বাস করিত। ছিন্নবেশ-পরা মায়ের হাস্যময়ী চেহারা মনে পড়িয়া যায়।
ঘুরিতে ঘুরিতে সুবর্ণরেখার তীরে আসিয়া পড়িয়াছে অপু। বসিলে মন্দ হয় না। যে পাথরটার উপর বসিয়া সে লিখিত, জুতা ছাড়িয়া তাহার উপর অপু বসিল। জনপ্রাণী নাই কোনদিকে। সুবর্ণরেখার শূন্য বুকটা খা-খাঁ করিতেছে। কয়েকটি বক একপায়ে নদীর চরে ধ্যানমগ্নের মতো দাঁড়াইয়া। সূর্য যেন জ্বলিতেছে। অপুর মনে হইল, সবদিকে কেমন একটা নাই-নাই ভাব। আকাশ বিক্ত। এতটুকু মেঘ নাই। নদীর বুক রিক্ত, জল নাই। দিগন্ত পর্যন্ত প্রান্তর রিক্ত, নদীর ওপারে কেবল একটিমাত্র পলাশ গাছ বিপুল একটি প্রাকৃতিক কবিতার যতিচিহ্নের মতো সোজা মাথা তুলিয়া আছে। গাছটার সর্বাঙ্গে যেন আগুন। নিঃস্ব প্রান্তরের পটভূমিতে পুষ্পিত পলাশগাছটাকে সামান্য এতটুকু সত্ত্বনার মতো দেখাইতেছে।
এমনি একটা দিনে কলিকাতা হইতে মায়ের জন্য সামান্য কিছু জিনিস কিনিয়া গ্রামের পথে হাঁটিয়া মনসাপোতায় ফিরিয়াছিল। দরজা খুলিয়া তাহাকে দেখিয়া মা কি খুশিই না হইয়াছিল! মাকে জড়াইয়া আদর করিলে কেমন সুন্দর গন্ধ পাওয়া যাইত মায়ের গায়ে।
মাকে মনে পড়িতেছে। ছোটবেলায় মা তাহাকে পাঠশালায় যাইবার জন্য খুব সকালে ঘুম হইতে তুলিয়া দিত, নিজের হাতে সাজাইয়া হাতে বই দিয়া বলিত–যাও বাবা, পাঠশালায় যাও। তুমি লেখাপড়া শিখে মানুষ হলে বংশে্র নাম উজ্জ্বল হবে।
সে কি মানুষ হইতে পারিয়াছে? অথবা মা কি অন্য কিছু চাহিয়াছিল, যা সে হইতে পারে নাই?
একদিন রাগ করিয়া সে মায়ের দেওয়া তালের বড়া ছুঁড়িয়া উঠানে ফেলিয়া দিয়াছিল। অনেকদিন আগের ঘটনাটা। মায়ের কত কষ্টে জোগাড় করা জিনিসে তৈয়ারি।
এসব মনে করিয়া তাহার চোখে জল আসিতেছে কেন? আশ্চর্য! ইহা কি কাঁদিবার সময় হইল? এমন সুন্দর পরিবেশে? কিছু দূরে নদীর বাঁকের মুখটায় বালির উপর তাপতরঙ্গ থর থর করিয়া কাঁপিতেছে, আকাশে সূর্য, ধূ-ধূ প্ৰান্তর-সব মিলাইয়া স্বরলিপির তীব্র মধ্যমের মতো।
একটা ঢিল তুলিয়া জোরে নদীর দিকে ছুঁড়িল, বেশ জোরে। সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করিল বুকের বাঁদিকে যন্ত্রণা শুরু হইয়াছে। সামনে হইতে জোরে ধাক্কা মারিলে যেমন হয়, তেমনি ভাবে বুকে হাত দিয়া কিছুটা ছিটকাইয়া পিছনে সরিয়া আসিলা। মুহূর্তে মাথা কী রকম খালি হইয়া গেল। সূর্যটা যেন একবার কাছে আসিতেছে, সঙ্গে সঙ্গে আবার দূরে সরিয়া যাইতেছে।
অপু অনুভব করিল, পা দুইটা তাহাকে আর দাঁড় করাইয়া রাখিতে পাবিতেছে না। পাথরটার গায়ে হেলান দিয়া সে মাটিতে বসিয়া পড়িল। ব্যথাটা বাড়িতেছে-শ্বাস লাইতে কষ্ট হইতেছে। খুব গভীর ঘুম আসিবার আগে যেমন হয়, শরীরে তেমনি অবসাদের ভাব। দেহে-মনে অবসাদ মাকড়সার জালের মতো জড়াইয়াছে। সে কি এইখানে একটু ঘুমাইবে?
বাবা বাড়ি আসিয়া বলিতেছে–দুৰ্গা কই? তার জন্য শাড়ি কিনে এনেছি যে—
বাবা থলির ভিতর হইতে অনেক জিনিস বাহির করিতেছে। হঠাৎ অপুর মনে হইল–সত্যিই তো, দিদি কই? তাহাকে সবাই কোথায় হারাইয়া ফেলিয়াছে। দিদিকে খুঁজিতে হইবে।
ঘুম-ঘুম-ঘুম-। বুক বাহিয়া চিনচিনে ব্যথাটা উপরে উঠিতেছে। যন্ত্রণা ততটা আর বোধ হইতেছে না, তাহার খুব ঘুম পাইয়াছে। কানের কাছে তীক্ষ্ণস্বরে একটা পাখি ডাকিয়া উঠিল। নিশ্চিন্দিপুরে সেই পাখিটা যেমন ডাকিত। সামনের ওই ব্যাপ্তির ভিতর কোথায় যে বাজনা বাজিতেছে। গম্ভীরনাদ বীণার উদারার তারে আলাপের মতো। তারের উপর এক-একটি আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে সে একটু একটু ঘুমাইয়া পড়িতেছে। হাত-পায়ের সমস্ত শক্তি চলিয়া গিয়াছে। আর সে চলিতে পরিবে না, সমস্ত জীবনে অনেক ঘোরা হইয়াছে–এইবার সে একটু বিশ্রাম করিয়া লইবে। এইখানেই বিশ্রাম করিবে।
আশবার্টন সাহেব বলিতেছে–East opened my eyes, Roy, it really enthralls me, this call of the mysterious-this mystic span of the river–
অ্যাশবার্টনকে দেখিয়া সে উঠিবার চেষ্টা করিল। সে শুইবে না। সে অনড় হইয়া থাকিবে না–কিছুতেই না। কিন্তু শরীর তাহার কথা মান্য করিতেছে না। তাহাকে কেহ উঠাইয়া দিতেছে না। কেন?
ওই বড়ো পাথরটার আড়ালে যে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে সে চিনিতে পারে নাই। এইবার সে বাহির হইয়া সামনে আসিয়াছে।
লীলা!
–পোর্তোপ্লাতায় যাবে না অপূর্ব? তুমি যে বলেছিলে সোনা উদ্ধার করে আনবে সমুদ্রের তলা থেকে?
হ্যাঁ, যাইতে হইবে বৈকি! অতল সমুদ্রের নিচে তাহার জন্য যে রত্ন অপেক্ষা করিয়া আছে, তাহাদের সে সূর্যের আলোয় বাহির করিয়া আনিবে।
–খোকা কোথায় গেল, খোকা? খোকা, আমার পাশে আয়–এইখানটায়। কোল ঘেঁষে বোস, উঠে যাসনে কোথাও। আমি তোকে কলকাতা থেকে সেই বইটা এনে দেবো এবার। উঠে যাস নে বাবা আমার–তোকে না দেখে আমি যে মোটে থাকতে পারি না।
তাহার মা বলিতেছে—ঘুমো অপু, ঘুমো। আহা বে, বড় খাটুনি গেছে তোর—
ঘুমাইয়া পড়িবার আগে অপু জোর করিয়া একবার তাকাইল। দেখিল, লাল ফুল ফুটিয়া থাকা পলাশ গাছটার পাশ দিয়া একটা পথ সমস্ত প্ৰান্তরকে দ্বিধাবিভক্ত করিয়া দূরে দিগন্তে মিশিয়া গিয়াছে।