সুধীর তিরোধানে সমস্ত সংসার ওলোটপালট হইয়া গেল। না আছে শৃঙ্খলা, না আছে শ্ৰী। সব চেয়ে আশ্চর্য এই, মানুষগুলিও তাহাদের মুখের চেহারার সঙ্গে সঙ্গে মনের চেহারাও বদলাইয়া ফেলিয়াছে। বাঁচিয়া থাকিয়া সংসারের এই অবস্থা দেখিলে, সুধী নিশ্চয়ই বনবাসী হইত।
নমিতা এখন এই সংসারে কায়াহীন ছায়ামাত্র—এখানে তাহার আর প্রয়োজন নাই, সে যেন তাহার জীবনের সার্থকতা হারাইয়া বসিয়াছে। নমিতা যেন একটা নিৰ্বাপিত প্রদীপ—অন্ধকারে তাহার নিৰ্বাসন। বিকাল-বেলা নমিতা বারান্দায় চুপ করিয়া বসিয়াছিল, পিঠের উপর ঘন চুল নামিয়া আসিয়াছে, বসিবার ভঙ্গীটিতে একটি অসহায় ক্লান্তি। এইবার নমিতা কি করিবে, কোথায় যাইবে, কিছুই ভাবিয়া কিনারা করিতে পারিতেছে না। এই সংসারে উপবাসী ভিক্ষুকের মত কৃপাপ্রার্থিনী হইয়া তাহাকে কাল কাটাইতে হইবে ভাবিয়া তাহার অসহায় মন সঙ্কুচিত হইয়া উঠিল। অথচ এই বিস্তীর্ণ পৃথিবীতে এই সামান্য ক্ষুদ্র গৃহকোণটি ছাড়া তাহার পা ফেলিবার স্থানই বা কোথায়? স্বামীর কাছে অপ্রতিবাদ আত্মদানের ফাঁকে সে স্বামীকে ভালবাসিতে চেষ্টা করিয়াছিল বটে, কিন্তু সেই প্রেম সন্তানস্নেহ দ্বারা রঞ্জিত হয় নাই। তাই সুধী-র মৃত্যুতে অরুণা শোক করিয়াছেন সুধী-রই জন্য, নমিতা শোক করিয়াছে তাহার নিজের জন্য, তাহার এই অবাঞ্ছিত নিরুপায় বৈধব্যের ক্লেশ ভাবিয়া। এই বৈধব্যপালনে সে না পাইবে আনন্দ, না-বা তৃপ্তি। কিন্তু ইহাকে লঙ্ঘন করিবার মত বিদ্রোহাচরণের উদ্দাম শক্তিও তাহার নাই। মাথা পাতিয়া এই কৃত্রিম অনুশাসনের অত্যাচার তাহাকে সহিতে হইবে।
প্রদীপ কখন যে নিঃশব্দে পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহা নমিতা টের পাইলে নিশ্চয়ই মাথার উপর ঘোম্টা টানিয়া দিত। সে দুই হাতে জানালার শিক্ ধরিয়া তেমনি বসিয়া রহিল। যেন দুই হাতে দুইটা দুর্লঙ্ঘ্য বাধা ঠেলিয়া ফেলিবার জন্য সে সংগ্রাম করিতেছে। নমিতার মূর্তিতে এই প্রতিকারহীন বেদনার আভাস দেখিয়া, প্রদীপের মন ম্লান হইয়া উঠিল। কণ্ঠস্বর আর্দ্র করিয়া সে কহিল,—“নমিতা, আমি চল্লাম।”
নমিতা চমকিয়া উঠিল। বেশবাস তাড়াতাড়ি পরিপাটি করিয়া প্রদীপের মুখে তাহার নামোচ্চারণ শুনিয়া, সে একটি ক্ষীণ রোমাঞ্চ অনুভব করিতে করিতে স্তব্ধ হইয়া রহিল। আজ সুধীর অবর্তমানে নমিতার পরিচয়—সে একমাত্র নমিতা-ই; প্রদীপ তাহাকে সম্বোধন করিবার আর কোন সংজ্ঞা খুঁজিয়া পাইল না। নমিতার ইচ্ছা হইল, অনেক কিছু বলিয়া নিজেকে একেবারে হালকা করিয়া ফেলে —এই অপরিমেয় স্তব্ধতার সমুদ্রে পড়িয়া সে একা-একা আর সাঁতার কাটিতে পারিতেছে না। প্রদীপ ও তাহার মধ্যে যে-পরিচয় নিবিড় হইয়া উঠিতেছিল, মৃত্যু আসিয়া তাহার মধ্যে অনতিক্রম্য বাধা বিস্তার করিয়া দিয়াছে। তাই নমিতা কোনো কথাই বলিতে পারিল না, স্বামীর অবর্তমানে প্রদীপের কাছে নমিতার পরিচয়—আর বন্ধু নয়, মৃত বন্ধুর বিধবা-বধু মাত্র,—দেহের সঙ্গে-সঙ্গে আত্মাকেও তাহার আজ নিমীলিত অবগুণ্ঠিত করিয়া রাখিতে হইবে। জগতে তাহার সত্তাহীনতাই এখন প্রধান সত্য।
নমিতাকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া প্রদীপ কহিল,—“পারিবারিক সম্পর্কে তোমার নিকটে না থাকলেও আমি তোমার আত্মীয়, নমিতা। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের সংসার আজকাল পরিবারকে ছাড়িয়ে উঠেছে, সেখানে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয়ের বাধা নেই। অতএব প্রয়োজন বোধ কবৃলে আমাকে কাজে লাগাতে কুণ্ঠা কোরো না। আমি আপাতত তোমাদের ছেড়ে চল্লাম বটে, কিন্তু হয়তো আবার আমাকে ফিরে আসতে হবে। ট্রেনের সময় বেশি নেই; আচ্ছা, আসি। নমস্কার!” বলিয়া প্রদীপ দুই হাত জোড় করিয়া নমস্কার করিল।
এইরূপ অনড় জড়পদার্থের মত বসিয়া থাকাটা অস্বস্তিকর মনে হওয়াতে নমিতা উঠিয়া দাঁড়াইল; কিন্তু যে-নমিতা একরাত্রে হৃদ্যতার আবেগে অত্যন্ত প্রগল্ভ হইয়া উঠিয়াছিল, সে আজ নীরবে সামান্য নমস্কারটুকু পৰ্য্যন্ত ফিরাইয়া দিতে পারিল না। সুধী যেন তাহার ব্যক্তিত্বকে লুণ্ঠন করিয়া নিয়াছে; ভাঙা চশমার খাপের মতই সে আজ অপ্রয়োজনীয়, নিরর্থক।
নমিতাকে দাঁড়াইতে দেখিয়া প্রদীপ ফিরিল। নিভৃতে বলিবার জন্যই সে নমিতার কাছাকাছি রেলিঙ ধরিয়া দাঁড়াইল; কহিল, “সংসারের খরচের খাতায় তুমি নাম লেখাবে—এই আত্ম-অপমান থেকে তুমি নিজেকে রক্ষা কোরো। তোমার মূল্য খালি সুধী-র স্বামীত্বই নির্ধারণ করেনি। স্ত্রী হওয়া ছাড়াও তোমার বড় পরিচয়। আছে—তুমি নারী, তুমি স্বপ্রধান। একজনের মৃত্যুর শাস্তি তোমাকেই সারা জীবন সয়ে’ বিড়ম্বিত হতে হবে—তা নয়, নমিতা। মৃত্যু যদি সুধী-র পক্ষে রোগমুক্তি হয়, তোমার পক্ষে দায়িত্বমুক্তি। সে-কথা ভুলে তোমার পাপ হবে।” বলিয়া ভাবাবেগের আতিশয্যে প্রদীপ হঠাৎ রেলিঙের উপর নমিতার একখানি হাত চাপিয়া ধরিল।
সেই দৃশ্যটি দুর হইতে অবনীবাবু দেখিলেন। তিনি নীচে নামিতে ছিলেন, থমকিয়া দাঁড়াইলেন। দৃশ্যটা তাহার চোখে মোটেই ভাল লাগিল না; ভাল লাগিল না নয়, তাঁহার মন মুহুর্তের মধ্যে প্রদীপের প্রতি বিমুখ হইয়া উঠিল। অবনীবাবু জানিতেন, স্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হইবার পথে সুধী প্রদীপের জন্য কোনো বাধাই রাখে নাই; এই পরিবারে প্রদীপ অবারিত অভ্যর্থনাই লাভ করিয়াছে। সুধী বাঁচিয়া থাকিলে নমিতার সঙ্গে প্রদীপের এই সান্নিধ্য হয়তো অবনীবাবুর চোখে বিসদৃশ বা অসঙ্গত ঠেকিত না, কিন্তু সুধীর অবর্তমানে প্রদীপের এই সৌহার্দ্য তাহার কাছে শুধু অন্যায় নয়, অনধিকারজনিত অপরাধ বলিয়া মনে হইল। নিমেষে পূৰ্বাৰ্জিত সমস্ত উদারতা বিসর্জন দিয়া, অবনীবাবুর মন ঘৃণায় সঙ্কুচিত হইয়া উঠিল।
প্রদীপ বিদায় লইয়া চলিয়া যাইতেই নমিতা আবার তেমনি রেলিঙ ধরিয়া বসিয়াছে। আন্দোলিত মনকে শান্ত করিবার চেষ্টায় সে তাহার মা’র মুখ স্মরণ করিতেছিল, এমন সময় পেছন হইতে অবনীবাবু ডাকিলেন : “বৌমা!” সহসা ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে বাড়ি-ঘর-দোর দুলিয়া উঠিলেও নমিতা এত চমকাইত না। শ্বশুরের মুখে এমন কর্কশ ডাক শুনিতে সে অভ্যস্ত ছিল না। সংশয়ে তাহার মন ছোট হইয়া গেল। দুই চোখে নীরব কাকুতি নিয়া সে উঠিয়া বঁড়াইল। অবনীবাবু কণ্ঠস্বর একটুও স্নিগ্ধ করিলেন না; কহিলেন,—“প্রদীপ চলে গেল বুঝি? তোমার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে অত ঘটা করে’ থিয়েটারি ঢঙে কী বলছিল ও?”
নমিতার মন শত রসনায় ছি ছি করিয়া উঠিল। তাহার দেবতুল্য শশুর এত সন্দিগ্ধ ও সঙ্কীর্ণচিত্ত হইয়া উঠিয়াছেন ভাবিয়া নিদারুণ অপমানে নমিতার আত্মা ক্ষত-বিক্ষত হইতে লাগিল। কিন্তু মুখ ফুটিয়া কিছু প্রতিবাদ করিবার সাহস হইল না। এ-যুগে মাতা বসুন্ধরার কাছে আশ্রয় চাহিলে প্রার্থনা পূর্ণ হয় না, তাই নমিতা তেমনি অচল নিষ্প্রাণ প্রতিমার মত দাঁড়াইয়া-দাঁড়াইয়া ঘামিতে লাগিল। কিন্তু কিছু একটা তাহার বলা দরকার, শ্বশুর-ঠাকুরের মুখ সন্দেহে ও ঘৃণায় কুটিল হইয়া উঠিয়াছে। ভয়ে ও দুঃখে তাহার কণ্ঠস্বর ফুটিতে চাহিল না, তবুও প্রাণপণ চেষ্টায় ভয়কে দমন করিয়া সে কহিল,—“আমাদের খোঁজ নিতে আবার আসবেন বলে গেলেন।”
—“আবার আসবে?” অবনীবাবু এত চেঁচাইয়া উঠিলেন যে, পাশের ঘর হইতে অরুণাও আসিয়া দাঁড়াইলেন: “এবার এলে রীতিমত তাকে অপমানিত হতে হবে। পরস্ত্রীর সঙ্গে কি-ভাবে আলাপ করূতে হয় সে-সৌজন্য পর্যন্ত শেখেনি, ঘোটলোক অতন্দ্র কোথাকার! আবার আসবে! কিসের জন্য আবার আসা হবে শুনি? তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, বৌমা—”
মুখ পাংশু করিয়া অরুণা বলিয়া উঠিলেন,—“কি, কি হয়েছে?”
কথাটার সোজা উত্তর না দিয়া অবনীবাবু কহিলেন,—“মুখ দেখে লোক চেনা যায় না, যত সব মুখোস-পরা জানোয়ার। বিশ্বাসের সম্মান যে রাখতে না পারে, তার মত হীনচরিত্র আর কেউ নেই। আবার আসবে সে! আসুক না।” বলিয়া রাগে ফুলিতে-ফুলিতে অবনীবাবু ফিরিলেন; ব্যাপারটা খোলসা করিয়া বুঝিতে অরুণাও তাহাকে অনুসরণ করিতে দেরি করিলেন না।
কোথা দিয়া যে কি হইয়া গেল, নমিতা কিছুই আয়ত্ত করিতে পারিল না। বজ্রাহত লোক যেমন স্তম্ভিত হইয়া থাকে, তাহার বুদ্ধিবৃত্তি তেমনি আড়ষ্ট হইয়া রহিল। লক্ষ্য করিল তাহার পা কাঁপিতেছে; সে রেলিঙ ধরিয়া আবার বসিয়া পড়িল। তাহার মন কাচের বাসনের মত ভাগ্যের এই নিষ্ঠুর মুষ্ট্যাঘাতে শতধা চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া গেছে। শরীরের এই অমানুষিক ক্লেশভোগের সঙ্গে মনেরও এই জঘন্য লাঞ্ছনা তাহাকে সহিতে হইবে, ইহা সে তাহার নিরানন্দ ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত করিতে গিয়াও কোনোদিন কল্পনা করে নাই।
অথচ, পরস্ত্রীর প্রতি প্রদীপের এই অসৌজন্যকে সে মনে-মনে তিরস্কার করিতে বিবেকের সায় পাইল না। প্রদীপ যদি তাহার হাতে অনাবিল বন্ধুতা-রস উৎসারিত করিয়া দিতে চায়, হাত পাতিয়া। সে তাহা গ্রহণ করিবে না-নমিতার মন এত কঠিন বা অনুদার নয়। ইহা ভাবিতেই তাহার বিস্ময়ের আর অবধি ছিল না যে, যে-প্রদীপ এত দিন তাহার বন্ধুর রোগশয্যার পার্শ্বে না-ঘুমাইয়া, অক্লান্ত সেবা। করিয়া সকলের কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছিল, সে সহসা এক মুহূর্তের আচরণে এমন কলুষিত হইয়া দেখা দিল! অথচ সেই আচরণটিতে নমিতা কোনো অন্যায় স্বীকার করিতে পারিল না। মানুষের যখন দৃষ্টিভ্রম হয়, তখন সে দড়িকেও সাপ ভাবে, এবং দড়ি হইতে আত্মরক্ষা করিতে গিয়া সাপের গর্ত্তেই পা ফেলে। আজ নমিতার হৃদয়ের সকল স্তব্ধতা ঠেলিয়া শোকাশ্রুধারা নামিয়া আসিল। সেই অশ্রু তাহার মৃত স্বামীর উদ্দেশে নয়, নিজের দুরপনেয় দুর্ভাগ্যের জন্য নয়—একটি অপমানিত অনুপস্থিত বন্ধুর প্রতি।