সুইস ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন একটা ছবি বানাবে–বাংলাদেশের কৃষক পরিবার নিয়ে ছবি। তাদের জীবনচর্যার গল্প।
এই ছবি বানানোর সঙ্গে বেশ ভালমত জড়িয়ে পড়লাম। কাহিনী আমার। পরিচালনা টেলিভিশনের খ্যাতিমান পরিচালক নওয়াজীশ আলি খানের। ক্যামেরার দায়িত্ব নিলেন মিশুক চৌধুরী, শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে মিশুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। ছবির ব্যাপারে প্রবল উৎসাহ। মূল চরিত্র ডলি জহুর, আসাদুজ্জামান নূর এবং আবুল খায়ের করবেন। অয়োময়ের লাঠিয়াল মোজাম্মেল হোসেন সাহেবও রইলেন। মোটামুটি শক্ত টিম। তিনজন শিশুশিল্পীও নেয়া হয়েছে। তারা ডলি জহুরের তিন কন্যার ভূমিকায় অভিনয় করবে। এই তিন শিশুশিল্পীও দেখা গেল অভিনয়ের ব্যাপারে প্রথম শ্রেণীর।
দলবল নিয়ে আমরা চলে গেলাম ময়মনসিংহ। পুরো শুটিং হবে আউটডোরে। জয় বাংলা বাজারে হতদরিদ্র এক কৃষক পরিবারের বসতবাড়ি আমরা দশ দিনের জন্যে ভাড়া নিয়ে নিলাম। তারা বাড়ি-ঘর, হাঁস-মুরগি ফেলে অন্যত্র চলে গেল। আমরা সেই সবই একটু এদিক-ওদিক করে নিজেদের পছন্দমত সাজিয়ে নিলাম।
বিপুল উৎসাহে কাজ শুরু হল।
রাতের বেলা থাকি একটা ডাকবাংলোয়। ডাকবাংলোটা শহর থেকে দূরে ব্রহ্মপুত্র নদীর পাশে। ভারী সুন্দর। সকালবেলা চলে যাই শুটিং স্পটে। কখনো রাত একটা দুটোর আগে ফেরা হয় না। এই জাতীয় কাজ বাইরে থেকে দেখতে খুব একঘেঁয়ে এবং বিরক্তিকর মনে হতে পারে কিন্তু যারা কাজটা করেন তাঁদের আগ্রহ এবং আনন্দ থাকে সীমাহীন। একটামাত্র ক্যামেরায় কাজ হচ্ছে। প্রতিটি জিনিস বারবার খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে। একটা টেকের জায়গায় দশটা টেক নেয়া হচ্ছে। যেন প্রথম শ্রেণীর ছবি তৈরি হয়। কোন খুঁত যেন না থাকে।
.
প্রথম দিনের ঘটনা। আমরা সবকিছু এখনো গুছিয়ে উঠতে পারি নি। ক্যামেরা এসেছে, লাইট ঢাকা থেকে এখনো পৌঁছে নি। লাইটের জন্য অপেক্ষা। আমরা ডাকবাংলোয় আছি। দুপুরের দিকে স্পটে যাব। সরকারী নাশতা তৈরি হচ্ছে। সময় লাগবে। চায়ের প্রবল তৃষ্ণা বোধ করছি। বাইরের কোন দোকানে চা পাওয়া যায় কি-না সেই খোঁজে বের হয়ে পড়লাম। জায়গাটা শহর থেকে দশ মাইল দূরে। দোকানপাট কিছু নেই। অনেক খুঁজে খুঁজে খুপসি চায়ের দোকান একটা পাওয়া গেল। আমি এত দরিদ্র চায়ের দোকান দেখি নি। তার সমল হচ্ছে তিনটি মাত্র চায়ের কাপ এবং কাঁচের বৈয়ামে ভরা গোটা পাঁচেক টোস্ট বিসকিট। দেখেই মনে হচ্ছে মাস তিনেক আগে কিনে বৈয়ামে ভরা হয়েছে। কাস্টমার জুটে নি। ভবিষ্যতে জুটবে তাও মনে হচ্ছে না। খালি গায়ে একটা ছেঁড়া লুঙ্গি পরে দোকানের মালিক বসে আছে। তার পাশে চার-পাঁচ বছর বয়েসী ফুটফুটে একটা মেয়ে। তারও খালি গা। এই দোকানের আয়ে ওদের সংসার কিছুতেই চলতে পারে না।
আমি বললাম, চা খাওয়াতে পারবেন?
জ্বী পারব। বসেন। এটু দিরং হইব। চুলা নিভা।
লোকটা একটা টুল এনে দোকানের বাইরে রেখে অতি যত্নে গামছা দিয়ে মুছে দিল। আমি চায়ের জন্যে অপেক্ষা করছি। সবরকম প্রতীক্ষাই কষ্টকর কিন্তু চায়ের প্রতীক্ষায় আনন্দ আছে। আমি দেখলাম বাপ-মেয়ে দুজনই মহা উৎসাহে চুলায় আগুন ধরাবার চেষ্টা করছে। দুজনই মনে হচ্ছে আনাড়ি। দুজনই দুজনকে ধমকাচ্ছে। প্রচুর ঠু, খবরের কাগজে প্রচুর বাতাসের পর আগুন ধরল। কেতলি চাপিয়ে দেয়া হল। আমি শুনলাম, মেয়েটি তার বাবাকে ক্ষীণ স্বরে বলছে, আমারে এক কাপ চা দিবা বাজান?
বাবা মেয়েকে চাপা ধমক দিল, এক কাপ চা এক টেকা। চিনি লাগে, দুধ লাগে। চুপ কইরা বইয়া থাক।
আমি লোকটিকে বললাম, ভাই আমাকে দুকাপ চা দেবেন।
জ্বি আইচ্ছা স্যার। আর দেরি নাই, হইয়া আসছে।
দুকাপ চা ছোট মেয়েটি আমার কাছে নিয়ে এল। আমি এক কাপ হাতে নিয়ে তাকে বললাম, এই চা তোমার জন্য। নাও, খাও।
মেয়েটি বিস্মিত হয়ে একবার বাবার দিকে তাকাচ্ছে, একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি বললাম, বোস এই টুলটায়। এসো, এক সঙ্গে চা খাই।
মেয়েটা আমার পাশে বসল এবং খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে বড়দের মত চা খেতে লাগল। আমি আড়চোখে মেয়ের বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখে-মুখে রাজ্যের বিস্ময়। মনে হচ্ছে তার দীর্ঘ জীবনে এমন রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটে নি। অথচ আমি যা করেছি অন্য যে-কেউ তাই করত। আমি হয়ত একটু বেশি করেছি। চা খাবার জন্য মেয়েটিকে আমার পাশে বসিয়েছি। কিন্তু তার জন্যে এতটা বিস্মিত কেউ হবে! আমার নিজের খানিকটা অস্বস্তি লাগতে লাগল।
চায়ের দাম দেবার সময় বললাম, আপনার চা ভাল হয়েছে। আমি মাঝে মাঝে আপনার দোকানে এসে চা খেয়ে যাব।
লোকটা বিড়বিড় করে বলল, আপনের যখন মনে চায়, আসবেন। নিশুতি রাইতেও যদি আপনে আমার দোকানের সামনে আইসা মেকু বইল্যা ডাক দেন।
আমি আপনেরে চা বানায়ে দিমু।
কি বলে ডাকতে হবে?
মেকু। আমার নাম মেকু। আমি এই দোকানেই মেয়েরে নিয়া ঘুমাই।
আচ্ছা, আমার জানা রইল। গভীর রাতে যদি চায়ের পিপাসা পায় আমি আপনার দোকানের সামনে এসে মেকু বলে ডাক দেব।
দুপুরের দিকে স্পটে চলে গেলাম। প্রথমদিনে রাত দুটা পর্যন্ত কাজ হল। কাহিনীর বড় অংশই রাতে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লাইটিং দেখতে হচ্ছে। বৃষ্টির রাত আমাদের যেমন দরকার, চাঁদনি রাতও দরকার।
রাত তিনটায় ডাকবাংলোয় ফিরে এলাম। নওয়াজীশ ভাইকে বললাম, চা খাবেন না-কি?
তিনি মহাবিরক্ত হয়ে বললেন, রাত তিনটার সময় কে আপনাকে চা বানিয়ে দেবে? সব সময় রসিকতা ভাল লাগে না।
আসুন, খুঁজে দেখি কিছু পাওয়া যায় কিনা। গরমও পড়েছে। খোলা হাওয়ায় হাঁটাহাঁটি করলে ভাল লাগবে।
উনি বের হলেন। মোজাম্মেল সাহেবও এলেন। আমরা চায়ের সন্ধানে যাচ্ছি। শুনে আবুল খায়েরও লাফিয়ে উঠলেন। যে কোন ধরনের অ্যাডভেনচারে এই মানুষটির প্রবল উৎসাহ।
আমি তাঁদের দোকানের সামনে নিয়ে গেলাম। দোকান বন্ধ। ঝাপ ফেলা। আমি তিনবার ডাকলাম–মেকু, মেকু, মেকু।।
ঝাঁপ খুলে মেকু এবং মেকু-কন্যা বের হয়ে এল। কেউ কোন কথা বলল না। সবার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে প্রবল উৎসাহে চুলা ধরাতে শুরু করল। নওয়াজীশ ভাই বললেন, ব্যাপারটা কি বলুন তো?
আমি উদাস গলায় বললাম, ব্যাপার কিছু না। ঐ লোকটার নাম মেকু। আমি মেকুর সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতায় চলে এসেছি। যখনি চা খেতে ইচ্ছা হবে, এই দোকানের সামনে এসে তিনবার মেকু বললেই চা চলে আসবে।
আমি ধরেই নিয়েছিলাম ঘটনাটায় সবাই মজা পাবেন। দেখা গেল, যতটা মজা পাবেন বলে আমি ভেবেছিলাম তাঁরা তার চেয়েও দশ গুণ বেশি মজা। পেলেন। ডাকবাংলোয় ফিরে শুধু মেকুর গল্প।
মোজাম্মেল সাহেব গল্প বলার ব্যাপারে খুব পারদর্শী। তিনি চোখ বড় বড় করে হাত নেড়ে বলছেন,
অদ্ভুত কাণ্ড। জনমানব নেই। নিশুতি রাত। একটা বন্ধ ঘরের সামনে হুমায়ূন ভাই গিয়ে দাঁড়ালেন। গম্ভীর গলায় তিনবার বললেন–মেকু মেকু মেকু–ওমি চিচিং ফাঁক–দোকানের ঝাপ খুলে গেল।
মেকু রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল। পরদিন ভোরেই আসাদুজ্জামান নূর গেলেন মেকুকে দেখতে। এক কাপ চা খেয়ে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিলেন। মেকু লজ্জিত গলায় বলল, অত বড় নোটের ভাঙতি নাই।।
নূর বললেন, ভাঙতি দিতে হবে না। এটা আপনি রেখে দিন। আমি হচ্ছি জমিদার মানুষ–ছোট মির্জা। আপনি বোধহয় আমাকে চেনেন না।
জ্বে-না।
টেলিভিশন দেখলে বুঝতেন যে পঞ্চাশ টাকা ছোট মির্জার হাতের ময়লা। টেলিভিশনে কখনো দেখেন নি?
জে-না।
পরদিন রাতের কথা। আমাদের মেকাপম্যান উত্তম খুব বেজার মুখে আমাকে এসে বলল, স্যার আপনের কথা তো ঠিক না।
কোন্ কথাটা ঠিক না?।
আমি ঐ দোকানের কাছে গিয়ে অনেকবার মেকু বলে ডাকছিলাম। কেউ ঝাঁপ খুলল না।
চলুন তো ভাই যাই–দেখি কি ব্যাপার।
আবার আমার সঙ্গে একটা দল জুটে গেল। আমি তিনবার মেকু বলতেই ঝাঁপ খুলে গেল। পিতা-কন্যা ঝাপিয়ে পড়ল চুলা ঠিক করতে। বোঝা গেল–মেকু অন্য কারো ডাকে ঘরের ঝপ খুলবে না। ডাকতে হবে আমাকে। এই বিশেষ ব্যবস্থাটা শুধুমাত্র আমার জন্যই। অন্য কারো জন্যে নয়।
কদিন মেকু খুব জমজমাট ব্যবসা করল। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সবাই চা খেয়ে আসছে। নওয়াজীশ আলি খান মেকুকে একটা লুঙ্গি কিনে দিলেন।
আমাদের যাত্রার সময় হয়ে এল। শেষ চা খেতে গিয়েছি। প্রথমবারের মত এবারো একা একা গেলাম।
মেকু বলল, শুনলাম আইজ রাইত যাইতেছেন গিয়া।
আমি বললাম, হ্যাঁ।
আপনে যদি মনে কিছু না নেন, আমি আফনেরে এক কাপ চা খাওয়াইতে চাই। এটু ইজ্জত করতে চাই।
মনে কিছু করব না। ইজ্জত করুন।
মেকু চা বানাল। গ্লুকোজ বিসকিটের একটা প্যাকেট ছেঁড়া হল। সম্ভবত ইজ্জত করার উদ্দেশ্যেই প্যাকেটটা কেনা হয়েছে। আমি চা খেলাম, বিসকিট খেলাম।
চলে আসবার সময় লক্ষ্য করলাম মেকু বিষণ্ণ মুখে চুপচাপ বসে আছে। বাচ্চা মেয়েটি হঠাৎ উঠে এসে পা ছুঁয়ে আমাকে সালাম করে চোখ মুছতে লাগল। এই মেয়েটির সঙ্গে আমার একবারই কথা হয়েছে। আর কখনো কোন কথা হয় নি। আমি বলেছিলাম, বসো আমার পাশে, এসো একসঙ্গে চা খাই। অথচ আজ তার চোখে পানি এসে গেল। কি এমন করেছি আমি? আমি তো মেয়েটার নামও জানি না। একবার ইচ্ছা হল ফিরে গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করি। পরমুহূর্তেই মনে হল–কি দরকার?