অধ্যায় ৬ — সিলা ও ক্যারিবডিস অথবা সাম্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ
আজকের দিনে অনেকেই বলে থাকেন সাম্যবাদ এবং ফ্যাসিবাদই হলো রাজনীতি ক্ষেত্রে একমাত্র বিকল্প, এবং যিনি একটাকে সমর্থন করেন না তিনি প্রকারান্তরে অপরটিকে সমর্থন করেন। আমি এই উভয় তন্ত্রের বিরোধী, বিকল্প হিসেবে এই দুটির কোনো একটিকেই আমি সমর্থন করতে অপারগ। আর আমি যদি ষোড়শ শতকের লোক হতাম তবে প্রটেস্টান্ট কিংবা ক্যাথলিক হতাম। প্রথমে আমি সাম্যবাদ সম্পর্কে আমার আপত্তিগুলো লিপিবদ্ধ করব। অতঃপর ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে। তারপর দেখবো এই দুটি তন্ত্রের মধ্যে কোথায় মেলে।
যখন আমি একজন সাম্যবাদী (Communist) সম্পর্কে বলি, আমি এমন একজন ব্যক্তিকে বোঝাই যিনি তৃতীয় আন্তর্জাতিকের মতবাদগুলো কবুল করেছেন। এক হিসেবে প্রথম যুগের খ্রিস্টানরা কম্যুনিস্ট ছিলেন, মধ্যযুগের অনেকানেক গোষ্ঠীই অনুরূপ ছিলেন। কিন্তু ঐ হিসেবটা আজ আর চলে না। আমি কেন কম্যুনিস্ট নই তার কারণগুলো পর্যায়ক্রমে উপস্থাপন করছিঃ
১. আমি মার্কস-এর দর্শন সমর্থন করতে অপারগ। Materialism and Emperio-Criticism আরো কম সমর্থন করি। আমি বস্তুবাদী নই। যদিও ভাববাদ থেকে আমার অবস্থান ততধিক দূরে। আমি বিশ্বাস করি না যে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের জন্য কোন প্রকার দ্বান্দ্বিকতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দ্বান্দ্বিকতায় বিশ্বাস মার্কস গ্রহণ করেছিলেন হেগেল থেকে, বাদ দিয়েছিলেন এর যৌক্তিক ভিত্তি অর্থাৎ ভাবের প্রাথমিকতা। মার্কস বিশ্বাস করতেন যে মানবিক বিকাশ পরবর্তী স্তরে এক হিসেবে হবে প্রগতি; এই বিশ্বাসের পক্ষে আমি কোনো যুক্তি দেখতে পাই না।
২. মার্কস-এর মূল্যতত্ত্ব আমি গ্রহণ করতে পারি না, আরো পারি না উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্বের তিনি যে আকৃতি দিয়েছেন তা। কোনো পণ্যের বিনিময় মূল্য ঐ পণ্য উৎপাদনে যে শ্রম লেগেছে তার সমানুপাতিক, এই তত্ত্ব, যা মার্কস রিকার্ডো থেকে গ্রহণ করেছিলেন, তা রিকার্ডোর খাজনা-তত্ত্ব দ্বারাই ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। আর অনেক আগেই ঐ তত্ত্ব অ-মার্কসীয় অর্থনীতিকরা বর্জন করেছেন। উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে আছে, যা অন্যত্র মার্কস নিজেই বাতিল করে দিয়েছেন। মার্কসের অর্থশাস্ত্রে যৌক্তিক সমগ্রতা নেই, বরং তা গঠিত হয়েছে পুরাতন মতবাদ গ্রহণ ও বর্জনের উপর। এই গ্রহণ ও বর্জনের কাজটা চলেছে পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে যুক্তি খাড়া করার অনুকূলে।
৩. কোনো একজন মানুষকে অভ্রান্ত গণ্য করা বিপজ্জনক ব্যাপার। এর ফল দাঁড়ায় অবশ্যম্ভাবীরূপে অতি-সরলীকরণ। বাইবেলের আক্ষরিক অনুপ্রেরণার ঐতিহ্য মানুষকে পবিত্র গ্রন্থ খোঁজার জন্য প্রস্তুত করে তুলেছে। কিন্তু কর্তৃপূজা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী।
৪. সাম্যবাদ গণতান্ত্রিক নয়। সর্বহারার একনায়কতন্ত্র আসলে সংখ্যালঘুর একনায়কতন্ত্র। এই সংখ্যালঘু শাসকশ্রেণিতে পরিণত হয়। ইতিহাসের সাক্ষ্য এই যে, শাসনকার্য শাসকশ্রেণির স্বার্থেই পরিচালিত হয়ে থাকে। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে প্রভাবিত হলেই শুধু ব্যতিক্রম দেখা যায়। এই শিক্ষা শুধু ইতিহাসের নয়, মার্কসেরও। সাম্যবাদী রাষ্ট্রে শাসকশ্রেণির ক্ষমতা এমনকি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পুঁজিবাদী শ্রেণির চেয়ে বেশি। এই শ্রেণি যতদিন সামরিক বাহিনীর আনুগত্য ধরে রাখতে পারবে ততদিন ক্ষমতা খাঁটিয়ে এমন সুবিধা আদায় করতে পারে যা পুঁজিবাদীদের ক্ষমতার সমান ক্ষতিকর। ক্যুনিজম সর্বদাই সাধারণের কল্যাণের জন্য কাজ করবে মনে করা বোকামিপূর্ণ ভাববাদ ছাড়া কিছু নয়, এবং এটা মার্কসীয় রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের বিরোধী।
৫. ফ্যাসিবাদ ছাড়া অন্য যে কোনো তন্ত্রের চেয়ে কম্যুনিজম মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করে অনেক বেশি। বিশেষত বুদ্ধিজীবীর স্বাধীনতা। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার পূর্ণ একীকরণ অত্যাচারের এমন ভয়ানক যন্ত্র তৈরি করে যাতে কোনো প্রকার ব্যতিক্রম ঘটার ছিদ্রপথ থাকে না। এমন ব্যবস্থায় প্রগতি অনতিবিলম্বে অসম্ভব হয়ে পড়বে, কারণ আমলাদের চরিত্রই এই যে নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ছাড়া অন্য যে কোনো প্রকার পরিবর্তনে তারা বাধা প্রদান করে থাকে। যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনা সম্ভব হয় এ জন্য যে আপতিকভাবে অজনপ্রিয় ব্যক্তি বেঁচে থাকতে সমর্থ হন। কেপলার জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা করে জীবন ধারণ করেছেন, ডারউইন টিকে ছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদ লাভ করে। মার্কস পেয়েছেন, এঙ্গেলস কর্তৃক মানচেস্টারের সর্বহারাদের শোষণের অংশ। অজনপ্রিয়তা সত্ত্বেও বেঁচে না থাকার অনুরূপ সুযোগ সাম্যবাদী শাসনের অধীনে সম্ভব নয়।
৬. সমকালীন মার্ক্সীয় সাম্যবাদী চিন্তায় মেধার চেয়ে কায়িক শ্রমকে বেশি গৌরবময় করে তোলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এতে মেধাকর্মীদের শত্রুতে পরিণত করা হচ্ছে, অথচ এরা হয়তো সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা দেখতে পেতেন এবং এই মেধাকর্মীদের সহায়তা ব্যতিরেকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সংগঠন কমই সম্ভব।
৭. শ্রেণি-যুদ্ধের পক্ষে প্রচারের দরুন ঐ যুদ্ধ এমন সময়ে বেঁধে যেতে পারে যখন পরস্পরবিরোধী পক্ষের শক্তি কম বেশি সমান, কিংবা এমন সময়েও সংগঠিত হতে পারে যখন পাল্লাটা পুঁজিবাদীদের পক্ষেই ভারী। যদি পুঁজিবাদী পক্ষের শক্তি অধিকতর ভারী হয় তাহলে ফল দাঁড়াবে প্রতিক্রিয়ার যুগ। যদি উভয় পক্ষের শক্তি মোটামুটি সমান হয় তাহলে যুদ্ধের আধুনিক পদ্ধতির জন্য, সভ্যতার ধ্বংসসাধন সম্ভব, সঙ্গে-সঙ্গে পুঁজিবাদী ও সাম্যবাদী উভয় পক্ষের বিলুপ্তি ঘটবে। আমি মনে করি, যেখানে গণতন্ত্র চালু আছে, সেখানে সমাজতন্ত্রীদের উচিত জনগণকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কাজ করা, শুধু বিরোধী পক্ষের অবৈধ বলপ্রয়োগ রোধের জন্যই শক্তি প্রয়োগ করা উচিত। এই পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্রীদের শক্তির পাল্লা এতটা ভারী হবে যে পরিণামী যুদ্ধ হবে খুব সংক্ষিপ্ত, যুদ্ধের তীব্রতাও এতটা হবে না যে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে।
৮. মাকর্স এবং ক্যুনিজমে এতটা ঘৃণা রয়েছে যে, কম্যুনিস্টদের দিয়ে আশা করা যায় না যে, বিজয়ী হবার পর তারা ঈর্ষাপরায়ণতার স্থান রাখবেন না। তাহলে দেখা যাচ্ছে নিষ্পেষণের পক্ষে যুক্তি বিজয়ী পক্ষের বেলায় দৃঢ়তর, বিশেষত বিজয় যদি অর্জিত হয়ে থাকে হিংস্র ও সন্দিগ্ধ যুদ্ধের ফলে। এই ধরনের যুদ্ধের পর বিজয়ী দলের সুস্থ পুনর্গঠনের মেজাজ থাকবে বলে মনে হয় না। মাকর্সবাদীরা ভুলে যান যে যুদ্ধের নিজস্ব মনস্তত্ত্ব রয়েছে, যা ভয় থেকে উৎসারিত হয়ে থাকে এবং মূল বিবাদের কারণ থেকে তা স্বতন্ত্র।
কম্যুনিজম ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে থেকে একটিকে বেছে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই বলে যে মনে করা হয় তা সুনিশ্চিতভাবে আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ক্ষেত্রে খাটে না। সম্ভবত ইতালি এবং জার্মানির ক্ষেত্রেও নয়। ইংল্যান্ডে এক সময় ক্রোমওয়েলের অধীনে ফ্যাসিবাদ ছিল। ফ্রান্সে ছিল নেপোলিয়নের অধীনে, এর কোনোটিই পরবর্তীকালে গণতন্ত্র আসতে প্রতিবন্ধক হতে পারে নি। রাজনৈতিক ভবিষ্যতের প্রশ্নে রাজনীতির ক্ষেত্রে অপরিপক্ক জাতি সর্বশ্রেষ্ঠ দিক নির্দেশক হতে পারে না।
ফ্যাসিবাদের প্রতি আপত্তি ক্যুনিজমের প্রতি আপত্তির চেয়ে সরল এবং এক হিসেবে আপত্তিগুলো আরো মৌলিক। সামগ্রিকভাবে কম্যুনিস্টদের লক্ষ্যের সঙ্গে আমি এক মত; আমি অমত পোষণ করি তারা যে উপায় অবলম্বন করতে চান সে ব্যাপারে। ফের বলি, তাদের লক্ষ্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। কিন্তু ফ্যাসিবাদীদের ক্ষেত্রে, তাদের উপায় ও উপেয়, উভয় ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে।
ফ্যাসিবাদ একটি জটিল আন্দোলন; এর জার্মান ও ইতালীয় আকৃতির মধ্যে ফারাক বিস্তর। অন্য কোনো দেশে যদি এর প্রসার ঘটে তবে সেখানে আরো ভিন্ন আকার নিতে পারে। তবে এর কিছু আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যা না থাকলে তা আর ফ্যাসিবাদ থাকবে না। ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রবিরোধী, জাতীয়বাদী, পুঁজিবাদী, এবং এই তন্ত্রের আবেদন মধ্যবিত্ত শ্রেণির সেই অংশের প্রতি যারা আধুনিক উন্নয়নে ভোগান্তির শিকারে পরিণত হয়েছে এবং আশঙ্কা করে যে সমাজতন্ত্র কিংবা ক্যুনিজম প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের ভোগান্তি আরো বাড়বে। ক্যুনিজম ও গণতন্ত্রবিরোধী, তবে তা একটা সময়ের জন্য, অন্তত যতক্ষণ তাদের তাত্ত্বিক ঘোষণা প্রকৃত নীতি হিসেবে গ্রহণ করা চলবে, উপরন্তু ক্যুনিজমের লক্ষ্য হলো মজুরের সেবা করা, আর এই মজুররাই উন্নত দেশগুলোর সংখ্যাগুরু অংশ। কম্যুনিস্টরা চান সমগ্র জনগোষ্ঠী মজুর দ্বারা গঠিত হোক। ফ্যাসিবাদ আরো মৌলিক অর্থে গণতন্ত্রবিরোধী। রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসেবে এরা বৃহত্তম সংখ্যার মহত্তম মঙ্গল নীতি গ্রহণ করে না। এরা কতিপয় ব্যক্তি, জাতি এবং শ্রেণিকে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে নির্বাচন করে এবং এই নির্বাচিতদেরকেই শুধু বিবেচনায় আনে। অবশিষ্ট জনগোষ্ঠীকে ঐ পছন্দ করা ব্যক্তিদের সেবার কাজে নিয়োজিত হতে বাধ্য করা হয়।
ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতা লাভের জন্য সংগ্রামকালে জনসংখ্যার একটা অংশের কাছে আবেদন রাখতে হয়। জার্মানি ও ইতালিতে ফ্যাসিবাদ মূল কর্মসূচির যা কিছু জাতীয়তাবাদ বিরোধী তা বর্জন করে সমাজতন্ত্রের ভেতর থেকে গজিয়ে উঠেছে। সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধির ধারণা ফ্যাসিবাদ গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই পরিকল্পনা সমগ্র জগতের উপকারের জন্য না হয়ে, একটি দেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থে কাজ করবে এবং এই স্বার্থ উদ্ধার করা হয় যত না দক্ষতা বাড়িয়ে তার চেয়ে বেশি মজুর ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অ-জনপ্রিয় অংশের উপর নিষ্পেষণের মাত্রা চড়িয়ে। যে শ্রেণিগুলো ফ্যাসিবাদের বদান্যতার পরিধির বাইরে অবস্থান করে তারা খুব বেশি হলে স্বপরিচালিত জেলখানায় বসবাসের সুযোগ পায়; ফ্যাসিবাদ এর চেয়ে বেশি কিছু করার ইচ্ছেও পোষণ করে না।
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রধান আপত্তিই এখানে যে এই তন্ত্রে সমগ্র মানবতার একটি নির্বাচিত অংশকেই শুধু গুরুত্ব প্রদান করা হয়ে থাকে। সন্দেহ নেই, সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার শুরু থেকেই ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিরা বাস্তব ক্ষেত্রে অনুরূপ নির্বাচন করে আসছেন; কিন্তু খ্রিষ্টধর্ম তত্ত্বগতভাবে সবসময়ই মানবাত্মাকে স্বনির্ভর সত্ত্বা হিসেবে স্বীকার করেছে; এই সত্তা অপরকে গৌরবান্বিত করার হাতিয়ার নয়। আধুনিক গণতন্ত্র খ্রিষ্টধর্মের নৈতিক আদর্শ থেকে শক্তি লাভ করেছে এবং রাষ্ট্রের কর্ণধারদের ধনী ও শক্তিমানদের স্বার্থে একান্তভাবে মনোযোগ দেয়া থেকে ভিন্নমুখী করার ব্যাপারে অবদান রাখে। এক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ প্রাচীন প্যাগানবাদের জঘন্যতম আদর্শে প্রত্যাবর্তন।
ফ্যাসিবাদ সফল হলে পুঁজিবাদের অকল্যাণকর দিক প্রতিকারের জন্য কিছুই করবে; বরং পুঁজিবাদকে জঘন্য পর্যায়ে উন্নীত করবে। শ্রমিকদের বলপূর্বক কায়িকশ্রমে নিয়োগ করা হবে। তাদের জুটবে শুধু খোরাকি। এই শ্রমিকদের কোনো প্রকার রাজনৈতিক অধিকার থাকবে না, পছন্দ করা স্থানে থাকা ও কাজের স্বাধীনতা থাকবে না এবং সম্ভবত তাদের স্থায়ী পারিবারিক জীবনও থাকবে না; বস্তুতপক্ষে তারা ক্রীতদাসে পরিণত হবে। জার্মানি যেভাবে বেকার সমস্যার মোকাবিলা করে তাতে এই ব্যাপারগুলোর সূচনা হয়তো লক্ষ্য করা যেতে পারে। বাস্তবিকপক্ষে এটা গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত পুঁজিবাদের অনিবার্য ফল এবং রুশদেশে শ্রমিকের অনুরূপ দাসত্ব অবস্থা যে-কোনো প্রকার একনায়কতন্ত্রের অনিবার্য ফসল। অতীতে দেখা গেছে, স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে এসেছে ক্রীতদাসপ্রথা কিংবা ভূমিদাসত্ব।
ফ্যাসিবাদ সফল হলে এসবই ঘটবে। তবে এই তন্ত্র স্থায়ীভাবে সফল হবে না। কারণ ফ্যাসিবাদের পক্ষে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। নাৎসিদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো ভারিশিল্প, বিশেষ করে ইস্পাত এবং রসায়নশিল্প। ভারিশিল্প জাতিগতভাবে সংগঠিত হলে আজকের দিনে যুদ্ধ সূচনায় সর্বাধিক প্রভাব খাটায়। প্রত্যেক সভ্য দেশের সরকার যদি ভারি শিল্পের সেবাদাস হিসেবে কাজ করে, বর্তমানে তা ভালো মতোই হতে দেখা যাচ্ছে-তাহলে অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধ এড়ানো যাবে না। ফ্যাসিবাদের প্রত্যেক বিজয়ে যুদ্ধ নিকটে চলে আসে; আর যুদ্ধ যখন আসবে তখন ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বলে মনে হয়।
অবাধ বাণিজ্যনীতি, সমাজতন্ত্র কিংবা কম্যুনিজমের মতো ফ্যাসিবাদের কোনো সুশৃঙ্খল নীতিমালা নেই। মূলত এটি একটি আবেগতাড়িত প্রতিবাদ, অংশত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সেই সদস্যদের (যেমন ক্ষুদ্র দোকানদার) যারা আধুনিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত, এই ক্ষতির কারণ বিশৃঙ্খল শিল্পপতিগণ, যাদের ক্ষমতার লোভ নিজেদের শক্তিশালী মনে করাকে বাতিকে পরিণত করেছে। ফ্যাসিবাদ যুক্তিবিবর্জিত, এই কারণে যে এই তন্ত্র সমর্থকদের অভিলাষ পূরণ করতে পারে না। তাছাড়া ফ্যাসিবাদের কোনো দর্শন নেই। শুধু একটা মনঃসমীক্ষণ রয়েছে। এই তন্ত্র সফল হলে ফল দাঁড়াত সর্বগ্রাসী দুর্ভোগ। কিন্তু এই তন্ত্র যুদ্ধ সমস্যার সমাধান দিতে পারে না বলে দীর্ঘ সময়ের জন্য সফল হবে না।
আমি মনে করি না, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার ফ্যাসিবাদ গ্রহণের সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ এই দেশ দুটিতে প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের ঐতিহ্য এতটা প্রবল যে তা এটা অনুমোদন করবে না। সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে এই বোধ কাজ করে যে জনগণের ব্যাপারের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে এবং রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের অধিকার হারাতেও সে ইচ্ছে করবে না। সাধারণ ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন তাদের কাছে খেলাধুলার (যেমন ডার্বি) মতো ঘটনা, অতএব এসব না থাকলে জীবন নিরানন্দ হয়ে পড়বে। ফ্রান্স সম্পর্কে এত সুনিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ফ্রান্স যদি ফ্যাসিবাদ গ্রহণ করে তাহলে আমি অবাক মানবো। যুদ্ধের সময়ে সাময়িকভাবে ফ্যাসিবাদ গ্রহণ করতে পারে, তবে সেটা ব্যতিক্রমী ঘটনা হবে।
কিছু কিছু আপত্তি আছে-আমার কাছে এই আপত্তিগুলো তর্কাতীত, এবং কম্যুনিজম এবং ফ্যাসিজম উভয় তন্ত্রের ক্ষেত্রে তা সমানভাবে খাটে। উভয় তন্ত্রে একটা সংখ্যালঘু শ্রেণি পূর্বকল্পিত নক্সা অনুসারে জনগণকে বলপূর্বক ছাঁচে ঢেলে তৈরি করতে চায়। মানুষ মেশিন তৈরির জন্য বিভিন্ন উপাদানকে যে মূল্য দেয় ফ্যাসিবাদে জনগণের মূল্যও তদনুরূপ। প্রক্রিয়ার ভেতর উপাদানে অনেক পরিবর্তন আসে। কিন্তু যে পরিবর্তন ঘটে লক্ষ্য অনুসারে, অন্তর্নিহিত কোনো উন্নয়নের সূত্রে নয়। যেখানে প্রাণীকুল নিয়ে কথা, বিশেষত মানুষের ব্যাপারে, স্বতঃস্ফূর্ত প্রবৃদ্ধি নির্ধারিত ফল দেয়, ভিন্ন ফল হতে পারে শুধু বাধ্য করলে কিংবা জোর জবরদস্তির দরুন। জ্বণতত্ত্ববিদগণ দুই মাথা-ওয়ালা প্রাণী জন্ম দিতে পারে কিংবা এমন প্রাণী যার নাক এমন জায়গায় গজিয়েছে যেখানে পায়ের আঙুল থাকার কথা। কিন্তু এই দানবিকতা জীবনের জন্য খুব সুখকর নয়। অনুরূপভাবে ফ্যাসিস্ট এবং কমুনিস্টদের মনে সমাজের একটা সমগ্র চিত্র থাকার ফলে ব্যক্তিসত্তাকে দুমড়ে মুচড়ে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচের জন্য উপযুক্ত করে তুলতে চায়। যাদের ছাঁচের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত করে তোলা সম্ভব হয় না তাদের হত্যা করা হয় কিংবা পাঠিয়ে দেয়া হয় বন্দীশালায়। আমি মনে করি না যে, এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি, যা ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত আবেগকে অস্বীকার করে, নৈতিক বিচারে সমর্থনযোগ্য, এবং এটা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে সুফল হবে। গুল্ম কেটে-ছেটে ময়ূরের আকার দেয়া যেতে পারে, এবং অনুরূপ উৎপীড়ন দ্বারা একইভাবে মানুষকে বিকৃত রূপ দেয়া যায় কিন্তু গুল্ম মোচড়ানোর সময় নিষ্ক্রিয় থাকে, অপরদিকে মানুষ, একনায়কের অভিলাষ যাই হোক না কেন, সব সময় সক্রিয় থাকে, এক ক্ষেত্রে না হলেও অপর ক্ষেত্রে। মালির কাছ থেকে শেখা কাটা-ছাঁটার জন্য কাঁচি চালানোর বিদ্যা গুল্ম বিতরণ করতে পারে না, কিন্তু বিকৃত মানব সন্তান সব সময়ই অপেক্ষাকৃত বিনয়ী ব্যক্তিকে কাঁচি চালানো শেখাতে সমর্থ। কৃত্রিমভাবে ব্যক্তিচরিত্র তৈরির প্রতিক্রিয়া হয় জন্ম দেয় নিষ্ঠুরতা কিংবা ঔদাসীন্য, সম্ভবত উভয়ই পর্যায়ক্রমে জন্মে। এবং এই ধরনের চরিত্রগুণসম্পন্ন জনগণের কাছ থেকে কোনো ভালো কাজ আশা করা যায় না।
আরেক ব্যাপার হলো, একনায়কের উপর নৈতিক ফলশ্রুতি, যে সম্পর্কে ক্যুনিস্ট ও ফ্যাসিস্ট উভয় পক্ষই যথেষ্ট বিবেচনা করেন না। ধরা যাক, মানুষ হিসেবে একনায়ক যদি অত্যল্প মানবিক সহানুভূতিসম্পন্ন হন তাহলে তিনি প্রথমে খুবই নির্দয় হবেন এবং ব্যক্তিগত লক্ষ্য হাসিলের জন্য যে কোনো প্রকার নিষ্ঠুরতা করতে পিছপা হবেন না। তাত্ত্বিক কারণে মানুষকে ভুগিয়েছেন বলে তিনি শুরুতে যদি সহানুভূতি পোষণ করেন। তাহলে তাকে কঠোর চরিত্রের অধিকারী উত্তরসূরির কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে কিংবা নিজের মানবিক গুণাবলি কমিয়ে ফেলতে হবে। আর যদি তাই করেন তাহলে তিনি, যে ব্যক্তি সংগ্রাম করেন নি, তার চেয়ে বেশি ধর্ষকামী হয়ে উঠবেন। উভয় ক্ষেত্রে সরকার নির্দয় ব্যক্তিদের হাতে চলে যাবে, তাদের ক্ষমতাপ্রেম নির্দিষ্ট ধরনের সমাজ গড়ার অভিলাষের ছদ্মবেশ ধারণ করবে। স্বেচ্ছাতন্ত্রের অনিবার্য নিয়মে একনায়কতন্ত্রের প্রাথমিক লক্ষ্যের মধ্যে যা কিছু ভালো ছিল (থেকে থাকলে) তা ক্রমে ক্রমে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে এবং একনায়কের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা হয়ে দাঁড়াবে রাষ্ট্রযন্ত্রের নগ্ন লক্ষ্য।
যন্ত্রের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা জন্ম দিয়েছে, যাকে আমরা বলতে পারি, ম্যানিপুলেটরদের ফ্যালাসি। এতে ব্যক্তি ও সমাজকে নিষ্প্রাণ বস্তু গণ্য করা হয়, আর ম্যানিপুলেটরদের গণ্য করা হয় স্বর্গীয় সত্তা হিসেবে। মানুষ চিকিৎসায় পরিবর্তিত হয় এবং চিকিৎসক চিকিৎসার ক্রিয়াফল হিসেবে নিজেও বদলে যান। কাজেই সামাজিক গতিবিদ্যা অত্যন্ত দুরূহ বিজ্ঞান, একনায়ককে বোঝার জন্য এই বিজ্ঞান যতটা জানা প্রয়োজন আমরা তার চেয়ে কম জানি। সাধারণ মানিপুলেটরের কাছে, রুগীর স্বাভাবিক বৃদ্ধির অনুভূতি কৃশ হয়ে পড়ে; ফল কিন্তু তার আশানুরূপ হয় না, অর্থাৎ রুগী পূর্ব পরিকল্পিত প্যাটার্নে নিষ্ক্রিয়ভাবে মিশে যায় না বরং বৃদ্ধি হয় রুগ্নতা ও বিকৃতি এবং যে প্যাটার্ন জন্ম নেয় তা হাস্যকর ও বিকট। গণতন্ত্র এবং ধৈর্যের পক্ষে চূড়ান্ত মনস্তাত্ত্বিক যুক্তি হলো, স্বাধীন বৃদ্ধি, চলাফেরার স্বাধীনতা এবং অ-প্রশিক্ষিত স্বাভাবিক জীবনযাপন আবশ্যিক, মানুষকে যদি বিকট দৈত্যে পরিণত হতে না হয়। সে যাই হোক, আমি যেমন বিশ্বাস করি, কম্যুনিস্ট এবং ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্র সমানভাবে অগ্রহণযোগ্য, তেমনি এই বোধটাও দুঃখজনক যে, ঐ দুটিকে একমাত্র বিকল্প মনে করা হয়, এবং গণতন্ত্রকে মনে করা হয় সেকেলে। যদি লোকেরা সে রকমই মনে করে তাহলে তারাও তাই হবে; অন্যরকম ভাবলে হবে না।