০৬. সিন্ধু নদীর তীরে

ছয়

হিজরী সাত-শো চৌত্রিশ সাল। মহরম মাসের পয়লা রাত্রি মোতাবেক ইংরেজী ১৩৩৩ খ্রষ্টাব্দের ১২ই সেপ্টেম্বর। মাথার ওপর মহরমের নূতন চাঁদ। আমরা এসে পৌঁছলাম সিন্ধু ও ভারত সাম্রজ্যের সীমান্তে পাঞ্জাব (সিন্ধু) নদীর তীরে; প্রথমেই এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করলেন সুলতানের গোয়েন্দা কর্মচারীরা। তারা আমাদের সম্বন্ধে জ্ঞাতব্য বিষয়ের লিখিত বিবরণী পাঠিয়ে দিলেন মুলতানের শাসনকর্তার কাছে। সিন্ধু থেকে রাজধানী দিল্লী পদব্রজে পঞ্চাশ দিনের পথ। কিন্তু সরকারী ডাক-ব্যবস্থায় গোয়েন্দা কর্মচারীদের পুত্র সুলতানের হাতে পৌঁছতে লাগে মোটেই পাঁচ দিন। ভারতে ডাক চলাচলের ব্যবস্থা দুই প্রকার। প্রথমত: ঘোড়সওয়ার দূতের সাহায্যে চালিত ডাক। প্রতি চার মাইল পথের এক তৃতীয়াংশ গেলেই পাওয়া যায় একটি করে লোকালয়। লোকালয়ের বাইরে তিনটি তাবু খাটানো। তাবুর মধ্যে তৈরী হয়ে বসে থাকে ডাক হরকরা। তাদের প্রত্যেকের হাতেই দেড় গজ লম্বা একটা লাঠি। লাঠির মাথায় পিতলের ঘন্টা বাধা। এক হাতে পত্র আর অপর হাতে ঘন্টা বাধা লাঠি নিয়ে প্রথম ডাক হরকরা। শহর থেকে বেরিয়েই প্রাণপণে দৌড়াতে আরম্ভ করে। এদিকে ঘন্টার আওয়াজ কানে। যেতেই তাবুর হরকরা তৈরী হয়ে দাঁড়ায় দৌড়বার জন্য। তারপর আগের লোকটা পৌঁছতেই পত্ৰখানা ছিনিয়ে নিয়ে ঘন্টা বাজাতে-বাজাতে সেও দৌড়াতে আরম্ভ করে। এমনি করে পত্রখানা গন্তব্য স্থানে গিয়ে পৌঁছে। ঘোড় সওয়ার ডাকের চেয়েও শেষোক্ত ডাক কিন্তু দ্রুতগামী। অনেক সময় এ-উপায়ে সুলতানের জন্য খোরাসান থেকে ভারতবর্ষে ফল আমদানী করা হয়। ভারতে খোরাসানী মেওয়ার কদর খুব বেশি। ঠিক একই উপায়ে আবার নামকরা অপরাধীদের (Criminals) এক স্থান হতে অন্য স্থানে। নেওয়া হয়। অপরাধীকে খাঁটিয়ার ওপর তুলে বাহকরা মাথায় করে বয়ে নিয়ে যায়। সুলতান যখন দৌলতাবাদে বাস করেন তখন কংক (গঙ্গা) নদী থেকে তার পানীয় জল-বাহকেরা এই উপায়েই বয়ে নিয়ে আসে। অথচ দৌলতাবাদ থেকে গঙ্গা চল্লিশ দিনের পথ।

গোয়েন্দা কর্মচারী কোনো নবাগতের বিষয় লিখে পাঠালে সুলতান তা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন। কর্মচারিরাও এ-ব্যাপারে খুব যত্ন নিয়ে থাকেন। নবাগত বিদেশীর চেহারা ও পোষাক-পরিচ্ছদ কেমন, সঙ্গে কত লোকজন, ক’টি বাদী, চাকর, পশুই বা ক’টি সব কিছুর বিবরণ সুলতানকে লিখে পাঠানো হয়। তার আচার ব্যবহার থেকে আরম্ভ করে হাবভাবের খুঁটিনাটি কিছুই বাদ পড়ে না।

সিন্ধুর রাজধানী মুলতানে পৌঁছে নবাগত ব্যক্তিকে অপেক্ষা করে থাকতে হয়। সুলতানের অনুমতি-পত্রের জন্য। তাকে কতটুকু আতিথেয়তা দেখাতে হবে অনুমতি পত্রের সঙ্গে তারও নির্দেশ সুলতানের কাছ থেকেই আসে। এখানে বিদেশী লোকদের। মর্যাদা ঠিক করা হয় তার কাজকর্ম ও চলাফেরার হাবভাব দেখে। কারণ, তার বংশ পরিচয় থাকে সকলের অজ্ঞাত। সুলতান মাহমুদ বিদেশীদের সম্মান করেন নিজের অধীনে তাদের শাসনকর্তা বা অপর কোনো উচ্চপদে বহাল করে। তার সভাসদ, রাজকর্মচারী, উজির, হাকিম ও আত্মীয় স্বজনের অধিকাংশই বিদেশাগত। তাঁর হুকুম অনুসারেই এখানেই বিদেশীদের উপাধি হয়েছে ‘আজিজ’ বা মাননীয়।

বাদশার কোনো অনুগ্রহ লাভের জন্য দরবারে হাজির হলেই কিছু না-কিছু উপঢৌকন সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। প্রতিদানে বাদশা সেই উপঢৌকনের বহুগুণ ফিরিয়ে নেয়। প্রজাসাধারণ যখন এই উপঢৌকন আদান-প্রদানের ব্যাপারে অভ্যস্থ হয়ে উঠলো, ভারত ও সিন্ধুর মহাজনগণ তখন প্রজাদের হাজার-হাজার দিনার ধার দিয়ে অথবা উপঢৌকনের সামগ্রী জোগান দিয়ে সাহায্য করতে লাগল। মহাজনরা বিদেশী আগন্তুকদের প্রয়োজন মতো টাকা তো ধার দেয়ই; অধিকন্তু নিজেরাও খাটে। তারপর নবাগত ব্যক্তি একদিন সুলতানের সঙ্গে দেখা করে যে মূল্যবান উপঢৌকন পায় তার থেকেই তাদের দেনা পরিশোধ হয়। মহাজনদের এ ব্যবসায়টি বেশ লাভজনক। সিন্ধুতে পৌঁছে আমাকেও এই পন্থাই অনুকরণ করতে হলো। একজন মহাজনের কাছ থেকে আমি ঘোড়া, উট ও শ্বেতকায় পেলাম। এবং সেই সঙ্গে আরো কয়েকটি প্রয়োজনীয় জিনিষ সংগ্রহ করে নিলাম। এছাড়া গাজনার এক ইরাক সওদাগরের কাছ থেকে আগেই আমি ত্রিশটি ঘোড়া, একটি উট এবং এক বোঝা তীর কিনেছিলাম। সে গুলোও পরে সুলতানের দরবারে সওগাত দিয়েছি। এই মহাজনটি কিছুদিনের জন্য খোরাসানে চলে যায় এবং ভারতে ফিরে এসে আমার কাছ থেকে প্রাপ্য টাকা আদায় করে নিয়ে যায়। একমাত্র আমাকে দিয়েই সে বহু টাকা মুনাফা করে একজন খ্যাতনামা মহাজন বা সওদাগর বলে গণ্য হয়। এ-ব্যাপারে বহু বছর পরে এই মহাজনটির সঙ্গে আমার একবার দেখা হয় আলেসো বন্দরে। আমার যথাসর্বস্ব তখন বিধর্মীরা লুট করে নিয়ে গেছে। সে-অবস্থায় এ-লোকটির শরণাপন্ন হয়ে কোনো সাহায্যই আমি সেদিন পেলাম না।

সিন্ধু নদী পার হয়ে আমাদের পথ আরম্ভ হলো নলখাগড়ার ভিতর দিয়ে। এই বনেই জীবনের প্রথম আমি একটি গণ্ডার দেখতে পেলাম। ক্রমাগত দু’দিন হাঁটার পর আমরা এসে পৌঁছলাম জানানী নামক এক শহরে। সিন্ধু নদীর তীরে জানানী সুন্দর একটি শহর। এর অধিবাসীদের বলা হয় সামিরা। সাতশো বারো খ্রীষ্টাব্দে আল-হাজ্জাজ এর কাল থেকে এদের পূর্বপুরুষরা এখানে বসবাস করেছে। এরা কারো সঙ্গেই কখনো একত্র আহার করতে রাজী হয় না। এমন কি আহারের সময় কাউকে দেখাও দেয় না। তাছাড়া নিজেদের গণ্ডীর বাইরে কখনো বিয়ে-থা করতে বা দিতে রাজী হয় না। জানানী ছেড়ে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম সিওয়াসিতান (সেহওয়ান) নামক এক বড়ো। শহরে। শহরটার বাইরেই বালুকাময় মরুভূমি। একমাত্র বাবলা জাতীয় গাছ ছাড়া এ মরুভূমিতে অপর কোনো গাছপালার চিহ্নই নেই। এখানকার নদীর তীরবর্তী অঞ্চলেও একমাত্র লাই ছাড়া বড়ো একটা কিছুই ফলে না। অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য যোয়ার ও মটরের তৈরী রুটি। তাছাড়া এখানে পাওয়া যায় প্রচুর মাছ আর মোষের দুধ, এরা ছোটো এক প্রকার টিকটিকি জাতীয় জীবের মাংস খায়। এ ক্ষুদ্র জীবটিকে এদের খেতে দেখেই আমার কিন্তু ঘৃণার উদ্রেক হয়। আমি কখনো ও-জিনিষ খেতে রাজী হইনি।

আমরা সিওয়াসিতানে এসে পৌঁছি গ্রীষ্মের সবচেয়ে গরমের সময়টায়। অসহ্য গরম। আমার সঙ্গীরা তো প্রায় উলঙ্গই কাটাতে লাগল। তারা শুধু কোমরে জড়াতো এক টুকরা কাপড় আর কাঁধে ভিজিয়ে রাখতে এক টুকরা। গ্রীষ্মের প্রবল উত্তাপে অল্পক্ষণের মধ্যেই কাপড় শুকিয়ে যেতো, অনবরত তারা সে কাপড় পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতো।

এই শহরেই আমি খোরাসানের প্রসিদ্ধ চিকিৎসক আলা-অল-মুলকের প্রথম সাক্ষাৎ পাই। এক সময়ে তিনি ছিলেন হিরাতের কাজী। সেখান থেকেই ভারতে আসেন এবং সিন্ধুর লাহারী শহরের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। আমি তাঁর সঙ্গেই এ-অঞ্চলে ভ্রমণে বের হব সঙ্কল্প করি। শাসনকর্তা আলা-অল-মুলকের পনর-খানা জাহাজ। নিজের লটবহর এবং লোকজন নিয়ে এই সব জাহাজের সাহায্যে তিনি নদী-পথে যাতায়াত করেন। জাহাগুলোর একখানার নাম ‘আহাওড়া-দেখতে ঠিক আমাদের দেশের এক মাস্তুল ও ছোট্ট পালওয়ালা জাহাজের মতো কিন্তু পাশে চওড়া, লম্বায় ঘোট। আহাওড়ার মধ্যখানে সিঁড়িওয়ালা কাঠের তৈরি একটি কেবিন। কেবিনটির উপরিভাগে স্বয়ং আলা-অল মুলকের বসবার আসন। তাঁর সামনে বসেন আমীর ওমরাগণ, দক্ষিণ ও বামে বসে। ক্রীতদাসের দল, নিচে দাঁড় টানে চল্লিশজন দাড়ী। আহাওড়ার সঙ্গে-সঙ্গে দু’পাশে চলতে থাকে অপর চারখানা জাহাজ। তার দু’খানায় থাকে পতাকা এবং দামামা শিক্ষা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র আর গায়কের দল। প্রথমেই বেজে ওঠে দামামা আর শিক্ষা, তারপর আরম্ভ হয় গান। এমনি করে একটার পর একটা চলতে থাকে ভোর হতে শুরু করে মধ্যাহ্ন-আহারের সময় অবধি। আহারের সময় হলেই জাহাজগুলো একত্র সংলগ্ন করা হয়। গায়ক ও বাদকের দল আহাওড়ায় গিয়ে ওঠে। শাসনকর্তার আহার শেষ না হওয়া। অবধি সেখানে একটানা গান বাজানো চলতে থাকে। শাসনকর্তার আহার শেষ হলে অপর সবাই আহার করে। তারপর জাহাজ আবার চলতে থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যা হলে নদীর তীরে তাবু খাটানো হয়। শাসনকর্তা তীরে অবতরণ করলে পুনরায় নৈশ আহারের আয়োজন হয়। নৈশ-আহারে দলের প্রায় সকলেই তাঁর সঙ্গে যোগদান করে। রাত্রে এশার নামাজের পর তাবুতে পালা করে প্রহরীদল স্থাপন করা হয়। এক দলের কাজ শেষ হলেই দলের একজন চীৎকার করে সময় ঘোষণা করে। তারপর ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গেই বেজে ওঠে দামামা আর শিঙ্গা। ফজরের নামাজ শেষ হলেই আহারের পর। আবার যাত্রা শুরু হয়।

এমনি করে পাঁচদিন চলার পর আমরা এসে পৌঁছলাম আলা-অল-মূলকের এলাকা লাহারী শহরে। সমুদ্রতীরে সিন্ধুনদীর মোহনায় লাহারী একটি চমৎকার শহর। এখানে বড়ো রকমের একটি পোতাশ্রয় আছে। য়েমেন, ফার এবং অন্যান্য বহু দেশের লোকজন সর্বদা এখানে যাতায়াত করে। এজন্য এখানকার খাজাঞ্চীখানার আয় খুব বেশি। আলা-অল-মূলক আমাকে বলেছিলেন, শুধু এই শহরের বার্ষিক রাজস্বের পরিমাণ ষাট লক্ষ মুদ্রা। এ-আয়ের বিশ ভাগের এক ভাগই স্বয়ং শাসনকর্তার প্রাপ্য। একদিন ঘোড়ায় চড়ে আলা-আল-মুলকের সঙ্গে আমি লাহারীর শত মাইল দূরে তারানা নামক এক সমতল ভূমিতে বেড়াতে যাই। যেখানে দেখতে পেয়েছিলাম বিভিন্ন জানোয়ার ও মানুষের অসংখ্য প্রস্তর-মূর্তি। মূর্তিগুলোর অধিকাংশই তখন বিকৃত ও বিধ্বস্ত-কোনটার মাথা, কোনটার বা পা মাত্র অবশিষ্ট আছে। যব, মটর, কলাই, মসুর প্রভৃতি শস্যের। আকৃতি বিশিষ্ট কতকগুলো পাথরও সেখানে রয়েছে। আর রয়েছে শহরের ও গৃহের প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ। খোদাই-করা পাথরের প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট একটি অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষও আমাদের দৃষ্টিগোচর হল। প্রকোষ্ঠের মধ্যস্থলে খোদাই করা পাথরের একটি বেদী। বেদীর উপরে পিঠমোড়াভাবে বদ্ধ অবস্থায় একটি মানুষের মূর্তি। জায়গাটায় দুর্গন্ধময় পানির একটা নহরও আছে। একটি দেয়ালের গায়ে রয়েছে ভারতীয় অক্ষরে শিলালিপি।

এ-শহরে পাঁচদিন কাটাবার পর আলা-অল-মূলক রাহা-করচ বাবদ প্রচুর উপঢৌকন দিয়ে আমাকে বিদায় দিলেন। অতঃপর আমি রওয়ানা হলাম বাকার শহরের উদ্দেশ্যে। সুন্দর শহর এই বাকার। সিন্ধু নদীর একটি খাল বাকার শহরকে দ্বিধা-বিভক্ত করেছে। খালের উপরে চমৎকার একটি মুসাফিরখানা। রাহাগীদের এখানে বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়। বাকার ছেড়ে আমি উপস্থিত হই উজ (উ) শহরে। শহরটি অপেক্ষাকৃত বড়ো। চমৎকার বাজার এবং কোঠাবাড়ীবিশিষ্ট এই শহরটি নদীর পারে অবস্থিত। সে সময় শরীফ জালাল উদ্দিন আল-কিজি এখানকার শাসনকর্তা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক আর দয়ালু। আমাদের উভয়ের মধ্যে বেশ হৃদ্যতা জন্মেছিল। তার সঙ্গে আমার পুনরায় সাক্ষাৎ হয়-আমি যখন দিল্লীতে অবস্থান করছিলাম তখন। সুলতান। মাহমুদ দৌলতাবাদ রওয়ানা হবেন, আমাকে বলে গেলেন রাজধানীতে অবস্থান করতে। শরীফ জালাল উদ্দিন সে-সময় আমার কাছে প্রস্তাব করলেন, সুলতান ফিরে না আসা পর্যন্ত তার নিজের জমিদারীর আয়ে আমার ব্যয় নির্বাহ করতে। কারণ আমার নিজের খরচের জন্যে অনেক টাকার দরকার। আমি তার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে মোট পাঁচ হাজার দিনার তার জমিদারীর আয় থেকে পেয়েছিলাম। খোদা যেন শত গুণে এর প্রতিদান তাঁকে দেন!

উজ থেকে আমি হাজির হই মুলতানে। মুলতান সিন্ধুর রাজধানী এবং প্রধান আমীরের বাসস্থান।

মুলতান যেতে দশ মাইল দূরে একটি নদী, নাম খসরু-আবাদ। নদীটি বড়ো। নৌকার সাহায্য ছাড়া পার হবার উপায় নেই। যারা এখানে নদী পার হতে আসে, তাদের জিনিষ-পত্ৰ তল্লাশী করা হয়। সওদাগররা এ-পথে যা কিছু নিয়ে আসে তার এক–চতুর্থাংশ এখানে কর বাবদ দিয়ে যেতে হয়। প্রতিটি ঘোড়ার জন্য দিতে হয় সাত দিনার। আমার জিনিষ-পত্রও তল্লাশী হবে এ-প্রস্তাব আমার কাছে বিরক্তিকর মনে হল। সাধারণ লোকে যাই মনে করুক, আমার সঙ্গে মূল্যবান তেমন কিছুই ছিল না। খোদার অনুগ্রহে সে-সময়ে মূলতান শাসনকর্তার একজন উপচ্চপদস্থ কর্মচারী সেখানে এসে হাজির হন। তার হুকুমে আমি সেবার তল্লাশীর হাঙ্গামা থেকে রেহাই পাই। নদীর তীরেই আমাদের রাত্রি কাটাতে হল। পরদিন ভোরে দেখা হল স্থানীয় পোষ্ট মাষ্টারের সঙ্গে। শহরে বা জেলার যেখানে যা-কিছু ঘটে বা বিদেশের যে-কেউ আসে আগে তার সম্বন্ধে যথাযথ সংবাদ সুলতানকে পৌঁছে দেওয়া এ-ব্যক্তির কাজ। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয় জমে ওঠে। তাকে সঙ্গে করেই আমি সুলতানের শাসনকর্তা কুতুব-আল-মূলকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই।

কুতুব-অল-মুলকের সম্মুখে হাজির হতেই তিনি নিজে দাঁড়িয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং করমর্দন করে পার্শ্বে আসন গ্রহণ করতে বললেন। আমি তাঁকে উপহার দিলাম শ্বেতকায় একজন গোলাম, একটি ঘোড়া এবং কিছু কিমিস ও বাদাম। কাউকে উপহার দেওয়ার পক্ষে এ-সব জিনিষই উত্তম। কারণ, কিসমিস, বাদাম এ-দেশে জন্মায় না, খোরাসান থেকে আমদানী করতে হয়। শাসনকর্তার আসনটি কার্পেট মোড়া বেদীর উপরে। সিপাহসালাররা বসেন তার দক্ষিণে ও বামে, সাধারণ সৈনিকরা পাতে। সৈনিকদল পর্যবেক্ষণের কাজ তার সাক্ষাতেই হয়ে থাকে। তিনি কতকগুলো ধনুক রাখেন কাছে। কোনো সৈনিক তীরন্দাজের দলে ভর্তি হতে এলে তাকে একটা ধুনক দেওয়া হয় টানতে। ধুনকগুলো দৃঢ়তার তারতম্য হিসাবে পর-পর সাজানো থাকে। ধনুক ব্যবহারে সৈনিক যে পরিমাণ শক্তির পরিচয় দেয় তার প্রাপ্য বেতন সেই অনুপাতে নির্ধারিত হয়। কেউ ঘোড়সওয়ার সৈনিক হতে এলে তাকে দেওয়া হয় একটা ঘোড়। ঘোড়াটা কদমে চলতে থাকবে, সে অবস্থায় সৈনিক তার হাতের বর্শা দিয়ে। লক্ষ্য ভেদ করবে। তাছাড়া নিচু দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় একটা আংটা, ঘোড়সওয়ার চলন্ত ঘোড়র উপর থেকে চেষ্টা করে বর্শার সাহায্যে আংটাটা তুলে নিতে। চেষ্টা যার সফল হয় সেই সবচেয়ে ভাল ঘোড়সওয়ার। যারা ঘোড়সওয়ার তীরন্দাজ হতে চায় তাদের জন্য মাটিতে ফেলে রাখা হয় একটা বল। চলন্ত ঘোড়র উপর থেকে। বলটাকে বিদ্ধ করতে হবে তীর দিয়ে। এ ব্যাপারে যে যতটুকু সফলকাম হবে তার বেতন সে অনুপাতে কম-বেশি হবে।

আমাদের মূলতান পৌঁছবার ছ’মাস পরে একদিন বাদশার একজন কর্মচারী এসে হাজির। তাঁর সঙ্গে এলেন পুলিশের প্রধান কর্মকর্তা। তারা এলেন আমাদের দিল্লী যাত্রার আয়োজন করতে। প্রথমেই তারা আমার ভারত আগমণের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। ভারতের সুলতানকে সম্মান করে বলা হতো খোন্দআলম বা দুনিয়ার প্রভু। তাদের প্রশ্নের। উত্তরে আমি বললাম, খোন্দআলমের খেদমতে এসেছি তার অধীনে চাকুরী করব বলে। সুলতানের হুকুম ছিল, ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে না এলে খোরসানের কাউকে ভারতে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয় না। আমার উত্তর শুনে তারা একজন কাজী এবং একজন দলিল লেখককে ডাকলেন। আমার ও আমার সঙ্গীদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সাক্ষী-সাবুদ রেখে রীতিমত একটা দলিল তৈরি হল। সঙ্গীদের কেউ-কেউ অবশ্য স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রস্তাবে অসম্মত হল। অতঃপর আমাদের মধ্যে শুরু হল রাজধানী দিল্লী যাত্রার আঞ্জাম। মূলতান থেকে দিল্লী বিভিন্ন জনপদের মধ্যে দিয়ে একটানা চল্লিশ দিনের পথ। আমার সহযাত্রীদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন তিরমিজের কাজী খোদাওজাদা। তিনি রওয়ানা হয়েছেন স্ত্রী ও পুত্রকন্যাদের নিয়ে। মূলতানের চল্লিশ জন বাবুর্চি এসেছে তার সঙ্গে। প্রতি রাত্রে তারা আহার্য প্রভৃতি তৈরি করে।

মূলতান থেকে রওয়ানা হয়ে আমরা এসে পৌঁছি আবুহার নামক শহরে। ভারতের মাটিতে পা দিয়ে ঐটিই আমাদের প্রথম শহর। এ-শহরের পরেই এক দিনের পথব্যাপী। বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি। সমতল ভূমির শেষপ্রান্তে দূরধিগম্য পর্বতশ্রেণী-হিন্দু বিধর্মীদের বাস স্থান। তাদের অনেক মুসলমান শাসনাধীনে রায়ত। শাসনকর্তার নিযুক্ত একজন মুসলিম সর্দারের অধীনস্থ গ্রামে তারা বাস করে। আর অবশিষ্ট সবাই বিদ্রোহী এবং যোদ্ধা। পার্বত্য দূর্গে বসবাস করে এবং লুটতরাজের জন্যে দল বেঁধে বেরিয়ে আসে। এ-পথে আসতেই আমাদের সঙ্গে একদল দস্যুর সাক্ষাৎ হয়। ভারতবর্ষে আমার সঙ্গে দস্যুর সংঘর্ষ ঐ প্রথম। আমাদের প্রধান দলটি আবুহার ত্যাগ করে এসেছিল খুব। ভোরে। আমি আমার ক্ষুদ্র দলবল নিয়ে অপেক্ষা করেছিলাম মধ্যাহ অবধি। আরবী, পারশী ও তুর্কী মিলিয়ে আমাদের দলে ছিলাম মোট বাইশ জন ঘোড়-সওয়ার। সমতল ভূমিতে পৌঁছতেই আশিজন বিধর্মী এসে আমাদের আক্রমন করে। তাদের মধ্যে মাত্র দু’জন ছিল ঘোড়-সওয়ার। আমার সঙ্গীরা সবাই ছিল সাহসী এবং সুদক্ষ। যুদ্ধে বিপক্ষের একজন ঘোড়সওয়ার এবং বার জন পদাতিক মারা গেল। শত্রু পক্ষের একটি তীরে আমি এবং অপর একটি তীরে আমার ঘোড়াটি আহত হয়ে পড়ল। খোদা আমাকে রক্ষা করলেন, তাদের তীরগুলো মোটেই দ্রুতগামী ছিল না। আমাদের দলের আরও একজনের ঘোড়া আহত হয়েছিল। শত্রুদের যে-ঘোড়াটা আমরা ধরেছিলাম সেটাই তাকে দেওয়া হলো। আহত ঘোড়াটা হত্যা করে আমাদের দলের তুর্কীদের দেওয়া হলো খেতে। মৃত বিধর্মীদের মাথাগুলো কেটে নিয়ে আমরা আবুবকরের প্রাসাদে গিয়ে যখন পৌঁছলাম, রাত্রি তখন দ্বিপ্রহর। মাথাগুলো দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হলো।

দু’দিন পরে আমরা হাজির হলাম আজুদাহান (পাপত্তন) শহরে। ছোট এই শহরটির মালিক ধর্মপ্রাণ শেখ ফরিদউদ্দীন। তাঁর সঙ্গে দেখা করে আমি তাবুতে ফিরছিলাম, দেখতে পেলাম আশেপাশের লোকজন সবাই ছুটাছুটি করে বেরিয়ে। আসছে। আমাদের দলেরও অনেকে তার মধ্যে আছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, একজন হিন্দু কাফেরের মৃতদেহ দাহ করবার আয়োজন হয়েছে। মৃত ব্যক্তির স্ত্রীকেও। সেই সঙ্গে দাহ করা হবে। দাহকার্যের পর আমার সঙ্গীরা এসে বলল, এই হিন্দু নারী। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মৃতদেহটি আলিঙ্গন করেই ছিল।

এ-ঘটনার পর প্রায়ই দেখেছি মূল্যবান পোষাক ও অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে চলেছে। ঘোড়-সাওয়ার হিন্দুনারী। তার পশ্চাতে থাকে অনুসারী দল; সম্মুখে বাজতে থাকে দামামা ও জয়ঢাক। তার সঙ্গে থাকে ব্রাহ্মণগণ। হিন্দুধর্মে ব্রাহ্মণরাই বর্ণশ্রেষ্ঠ। সুলতানের রাজত্বে হিন্দুদের সতীদাহের জন্য সুলতানের অনুমতি চাইতে হয় এবং চাইলেই তার অনুমতি পাওয়া যায়। স্বামী মৃত দেহের সঙ্গে স্ত্রীকে দাহ করা হিন্দুদের। পক্ষে একটি প্রশংসনীয় কাজ; কিন্তু অবশ্য কর্তব্য নয়। কোনো পরিবারে সতীদাহ হলেই সে পরিবারের সম্মান বেড়ে যায় এবং সতীত্বেরও প্রশংসা হয়। কোনো বিধবা সহমরণে সম্মত না-হলে তাকে মোটা কাপড় পরাতে হয়, এবং আত্মীয়-পরিজনের মধ্যে থেকেই বিষাদময় জীবন যাপন করতে হয়; কিন্তু কেউ সহমরণে বাধ্য করতে পারে না।

একবার আমজরি (ধর এর নিকটবর্তী আমঝেরা) শহরে আমি তিনজন বিধবাকে দেখেছিলাম। তাদের তিনজনেরই স্বামী যুদ্ধে নিহত হয়েছে এবং তারা সহমরণে স্বীকৃত হয়েছে। মূল্যবান পোক সজ্জিত হয়ে এবং গন্ধদ্রব্য মেখে তারা এক একটি ঘোড়ায় সওয়ার হয়েছে। প্রতিজনের ডান হাতে একটি নারকেল, বাঁ হাতে মুখ দেখার আর্শি। তাদের ঘিরে চলেছে ব্রাহ্মণ এবং আত্মীয়-স্বজনের দল। আগে আগে চলেছে জয়ঢাক, দামামা আর শিক্ষা বাদকের দল। সঙ্গের বিধর্মীরা প্রত্যেকেই বিধবাদের মারফত স্ব-স্ব মৃত পিতা, মাতা বা বন্ধুর কাছে শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের অনুরোধ জানাচ্ছে। বিধবারাও মৃদু হেসে সম্মতি জানাচ্ছে। সতীদাহ কিভাবে করা হয় দেখবার জন্যে সঙ্গীদের নিয়ে। ঘোড়ায় চড়ে আমি তাদের অনুসরণ করলাম। তিন মাইল পথ গিয়ে আমরা এসে। পৌঁছলাম একটা অন্ধকার জায়গায়। জায়গাটা সেঁতসেঁতে এবং ঝাড়াগাছে পূর্ণ। তার। মধ্যে রয়েছে চারিটি বেদী। বেদীর ওপর একটি করে পাথরের মূর্তি। বেদীগুলোর মধ্যস্থলে একটি ক্ষুদ্র জলাশয়। গাছের নিবিড় ছায়ায় জলাশয়টি এ-ভাবে ঢেকে আছে। যে, সূর্যের আলো সেখানে কখনও প্রবেশ করতে পারে না। জায়গাটা মনে হয় নরকের মত–খোদা আমাদের সে নরক থেকে রক্ষা করুন।

সেখানে গিয়েই জলাশয়ে নেমে বিধবারা তাদের কাপড় জামা ও গহনা খুলে ফেলল। সেগুলো সবই ভিক্ষাস্বরূপ দান করা হলো। তারপর তাদের প্রত্যেককে। একখানা করে মোটা কাপড় দেওয়া হলো। তারই এক অংশ কোমরে জড়িয়ে বাকি অংশে তারা মাথা কাঁধ ঢাকলো। জলাশয়ের কাছে নিচু জায়গায় আগুন জ্বালা হয়েছে। আগুনের শিখা যাতে বেড়ে ওঠে সেজন্য ঢেলে দেওয়া হয়েছে তিলের তেল। জনপনর। দাঁড়িয়ে আছে সরু কাঠ নিয়ে আর জনদশেক রয়েছে কাঠের মোটা-মোটা টুকরো নিয়ে। জয়ঢাক ও দামামা বাজনাওয়ালারা বিধবাদের আসবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আগুন দেখে যাতে বিধবারা ভয় না পায় সে-জনন্য কয়েকজনে কম্বল ধরে আগুন ঢেকে রেখেছে। বিধবাদের একজনকে দেখলাম, এসে তাদের হাত থেকে কম্বলটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল। তারপর বলে উঠল, আগুন দেখিয়ে আমাকে ভয় পাওয়াবে? এ যে আগুন তা আমি জানি। আমাকে ছেড়ে দাও। এই বলে সে জোড়হাত মাথায় ঠেকিয়ে আগুনকে নমস্কার করে তার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই মুহূর্তে এক সঙ্গে জয়ঢ়ক, দামামা আর সিঙ্গা বেজে উঠল। প্রথমে সরু কাঠগুলো নিক্ষেপ করা হলো। অতঃপর বিধবা নারী যাতে না নড়তে পারে সেজন্যে মোটা কাঠগুলো তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো। সবাই ভীষণ সোরগোল করে উঠল। আমার সঙ্গীরা যদি তাড়াতাড়ি করে পানি এনে আমার মুখে ছিটিয়ে না দিতো তাহলে আমি ঘোড়া থেকে পড়েই যেতাম। এরপরই সেখান থেকে চলে এলাম।

গঙ্গানদীতে ডুবে আত্মহুতি দেবার প্রথাও ভারতীয়দের মধ্যে প্রচলিত আছে। গঙ্গানদীতে হিন্দুরা তীর্থস্নানে যায় এবং চিতাভস্ম নিক্ষেপ করে। তারা বলে থাকে, গঙ্গা স্বর্গের নদী। গঙ্গায় ডুবে যারা আত্মাহতি দিতে যায় তারা বলে যে, কোনো পার্থিব কারণে তারা ডুবে মরছে না, ডুবে মরছে কুশাই (গোশাই) এর সান্নিধ্য লাভের জন্যে। তাদের ভাষায় গোশাই ঈশ্বরের নাম। গঙ্গায় ডুবে যারা মরে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করে দাহ করা হয় এবং দেহাবশেষ পুনরায় গঙ্গায়ই নিক্ষেপ করা হয়।

এবার আমাদের পূর্বের আলোচ্য বিষয়ে ফিরে আসা যাক। আজুদাহান থেকে রওয়ানা হয়ে চার দিন চলার পর আমরা এসে হাজির হলাম সারাসাতি (সারসুতি বা সিরসা) শহরে। এখানে উৎকৃষ্ট ধরণের এক প্রকার চাউল পাওয়া যায়। সে চাউল রাজধানী দিল্লীতে রপ্তানী হম্‌।এ-শহরের রাজস্বের আয় খুব বেশী; কিন্তু আয়ের সঠিক পরিমাণ কত তা আমার মরণ নেই। সেখান থেকে আমরা যাই হাসিতে। হাসি সুন্দরভাবে তৈরী জনবহুল একটি চমৎকার শহর। শহরটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। দু’দিন পরে হাসি থেকে আমরা এসে হাজির হলাম মাসুদাবাদে। মাসুদাবাদ দিল্লী থেকে দশ দিনের পথ। সেখানে আমরা তিন দিন কাটাই। সুলতান সে সময় রাজধানীর বাইরে কনৌজে ছিলেন। কনৌজ দিল্লী থেকে দশ দিনের পথ। সুলতানের উজির এবং বেগমমাতা তখন রাজধানীতে হাজির ছিলেন। আমাদের অভ্যর্থনার জন্যে উজির কয়েকজন উপযুক্ত কর্মচারী পাঠিয়ে ছিলেন। দূতের সাহায্যে পত্র দিয়ে সুলতানকে তিনি আমাদের আগমন সংবাদও পাঠিয়েছিলেন। মাসুদাবাদে আমরা যে তিনদিন কাটালাম তারই মধ্যে সুলতানের জবাব এসে হাজির হল। কাজী, চিকিৎসক, শেখ আর আমীরদের কয়েকজন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। অতঃপর আমরা মাসুদাবাদ থেকে রওয়ানা হয়ে পালাম নামক একটি গ্রামের কাছে এসে বিশ্রাম করলাম। পরের দিন পৌঁছলাম দিল্লীতে।

ভারতের প্রধান নগর দিল্লী যেমনি বিশাল, তেমনি ঐশ্বর্যশালী। শক্তি ও সৌন্দর্যের চমৎকার সমন্বয়। দিল্লী নগর যেরূপ প্রাচীরে ঘেরা, পৃথিবীতে তার তুলনা নেই। শুধু ভারতেরই নয়–সমগ্র মুসলিম প্রাচ্যের বৃহত্তম নগর দিল্লী।

দিল্লী নগর আশেপাশের চারটি শহর নিয়ে গঠিত। প্রথমটি হিন্দু বিধর্মীদের তৈরী খাঁটি দিল্লী। এ-শহরটি মুসলমান দখলে আসে ১১৮৮ খৃস্টাব্দে। দ্বিতীয় শহরটির নাম। সিরি। সিরি খলিফার বাসস্থানরূপেও পরিচিত ছিল। আব্বাসীয় বংশের খলিফা মুস্তাসিরের পৌত্র গিয়াস উদ্দিনকে সুলতান এ-শহরটি দান করেছিলেন। তৃতীয় শহরটির নাম তোগলকাবাদ। বর্তমান সুলতানের পিতা সুলতান তোগলক এ-শহরের নির্মাণকর্তা। শহরটি নির্মাণের একটি বিশেষ কারণ আছে। পূর্ববর্তী কোন এক সুলতান মোহাম্মদ তোগলককে একবার পরামর্শ দিয়েছিলেন ঠিক এ-জায়গাটিতে একটি শহর তৈরী করতে। সুলতান তোগলককে সেদিন পরিহাস করে বলেছিলেন, তুমি যখন সুলতান হবে তখন এখানে শহর তৈরী করো। খোদার ইচ্ছায় কালক্রমে তিনি সুলতান হলেন এবং এখানে সত্যই একটি শহর নির্মাণ করে নিজের নামে তার নাম করণ করলেন। চতুর্থ শহরটির নাম জাহানপানা। বর্তমান সুলতানের বাসস্থানরূপে এটি পৃথক। করা। তিনিই এ-শহরটি নির্মাণ করেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল একটি প্রাচীর দিয়ে তিনি শহর চারিটি একত্র ঘিরে ফেলবেন। এ-প্রাচীরের কিছুটা তৈরী হলে তার বিপুল ব্যয়ের বিষয় বিবেচনা করে তিনি সে কাজ ত্যাগ করেন।

দিল্লীর প্রসিদ্ধ মসজিদটি বিস্তৃত জায়গা জুড়ে তৈরী। মসজিদের দেয়াল, ছাদ ও মেঝে সাদা মার্বেলের তৈরী। সুন্দরভাবে চৌকোণ করে কাটা পাথরগুলো সীসা দিয়ে। আঁটা। মসজিদের কোথাও কাঠ ব্যবহার করা হয়নি। এবং তেরটি গুম্বুজ সবই পাথরের তৈরী। মিম্বরটিও পাথরের তৈরী। মসজিদের মধ্যস্থানে বিস্ময়কর একটি মিনার। মিনারটি কি ধাতুর তৈরী কেউ তা বলতে পারে না। এখানকার একজন বিদ্বান ব্যক্তি বলেছেন মসজিদের মিনারটি হাত কুশ’ বা সপ্ত ধাতুর মিশ্রণে প্রস্তুত। মিনারের এক। আঙ্গুল চওড়া একটি অংশ পালিশ করা হয়েছে। সে অংশটি বেশ চঞ্চকে। লোহা এর উপর কোন দাগ কাটে না। মিনারটি ত্রিশ হাত লম্বা। পুব দিকের প্রবেশ দ্বারে পাথরের উপরে দুটি পিতলের মূর্তি ফেলে রাখা হয়েছে। যে-কোন মসজিদে ঢুতে বা বেরিয়ে যেতে মূর্তিগুলোর উপর পা দিয়ে যায়। পূর্বে এ স্থানটিতে একটি দেব মন্দির ছিল। পরে দিল্লী মুসলমান অধিকারে এলে এটিকে মসজিদে পরিণত করা হয়। মসজিদের উত্তরাংশে মিনার। এর সঙ্গে তুলনা হয় এমন একটি মিনারও ইসলাম-জগতে আর নেই। সুউচ্চ এ-মিনারটি লাল পাথরের তৈরী এবং কারুকার্যময় লিপি-শোভিত। মিনারের মাথার গোলকটি উজ্জ্বল শ্বেতপাথরের তৈরী এবং উপরের ছোট গোলকগুলো স্বর্ণ নির্মিত। উপরে উঠবার সিঁড়িটি এত প্রশস্ত যে, একটি হাতী উপরে উঠে যেতে পারে। একজন বিশ্বাসযোগ্য লোকের মুখে শুনেছি, পাথর নিয়ে একটি হাতাঁকে তিনি ঐ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যেতে দেখেছেন। সুলতান কুতুবউদ্দিন মসজিদের পশ্চিমাংশে এর চেয়েও উচ্চ একটি মিনার প্রস্তুত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার এক তৃতীয়াংশ তৈরী হতেই তিনি এন্তেকাল করেন। এ-মিনারটি পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য বস্তু। এ-মিনারের সিঁড়ি দিয়ে পাশাপাশি তিনটি হাতী উপরে উঠে যেতে পারে। এ-অসমাপ্ত মিনারের এক-তৃতীয়াংশই উচ্চতায় অপর মিনারটির সমান। কিন্তু অসমাপ্ত মিনারটি প্রশস্ত বলে দেখতে এতটা উচ্চ মনে হয় না।

দিল্লীর বাইরে প্রকাণ্ড একটি জলাশয়ের নামকরণ হয়েছে সুলতান লালমিশের নামে। দিল্লীর অধিবাসীরা এখান থেকেই পানীয় জল সংগ্রহ করে। বৃষ্টির জলে পূর্ণ এ জলাশয়টি দু’মাইল লম্বা এবং এক মাইল চওড়া। এর মধ্যস্থলে চৌকোণ পাথরে তৈরী দু’তলা একটি অট্টালিকা। জলাশয়টি যখন পরিপূর্ণ থাকে তখন শুধু নৌকাযোগে এ অট্টালিকায় যাওয়া যায়, অন্য সময় সর্ব-সাধারণ নৌকার সাহায্যে ছাড়াই যেতে পারে। এর ভেতর একটি মসজিদও আছে। প্রায় সর্বদাই মসজিদটি মুছল্লিদের দ্বারা পূর্ণ থাকে। জলাশয়ের পাড়গুলো শুকিয়ে গেলে এখানে ইক্ষু, শশা, তরমুজ ও লাউ প্রভৃতি গাছ লাগানো হয়। তরমুজ ও লাউগুলো আকারে ছোট কিন্তু খেতে মিষ্টি। দিল্লীও খলিফার আবাসস্থানের মধ্যবর্তী স্থানে বৃহত্তর আরও একটি জলাশয় আছে। এর চারিপার্শ্বস্থ চল্লিশটি অট্টালিকায় গায়ক ও বাদ্যকরগণ বাস করে।

দিল্লীর জ্ঞানী ও ধার্মিক অধিবাসীদের মধ্যে এমাম কামালউদ্দিন ছিলেন অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ ও স্ত্র। দিল্লী নগরের বাইরের এক গুহায় তিনি বাস করতেন এবং গুহাবাসী। বলে পরিচিত ছিলেন। আমার একজন ক্রীতদাস বালক একবার পালিয়ে যায়। কিছুদিন পর তাকে আমি দেখতে পাই একজন তুর্কীর গৃহে। আমি বালকটিকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করি। কিন্তু শেখ কামালউদ্দিন আমাকে সে কাজে নিবৃত্ত করেন। তিনি বলেছিলেন বালকটি তোমার পক্ষে ভাল হবে না, তাকে না আনাই উচিত। তুর্কী ভদ্রলোক আমার সঙ্গে রফা করতে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি আমাকে একশত দিনার দিয়ে বালকটিকে নিজের কাছে রেখে দেন। এর ছয় মাস পরে একদিন ঐ বালক তার মনিবকে হত্যা করে। সুলতানের বিচারে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় তুর্কীর পুত্রদের হাতে। অবশেষে তারাও বালকটিকে হত্যা করে হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করে। শেখের এ অলৌকিক শক্তি দেখে আমি তার প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হয়ে পড়ি এবং পার্থিব জগৎ ছেড়ে নিজের যা-কিছু ছিল সব গরীর দুঃখীদের বিলিয়ে দেই। কিছু দিন আমি তার সঙ্গে বাস করেছিলাম; তাকে দেখতাম তিনি দশ দিন রোজা রাখেন এবং রাত্রির অধিকাংশ সময় দাঁড়িয়ে এবাদৎ করেন। এমাম কামালউদ্দিনের সঙ্গে কিছুদিন কাটানোর পর। সুলতান আমাকে ডেকে পাঠান এবং তার ফলে আমি পুনরায় পার্থিব জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি।

সমস্ত মানুষের মধ্যে এই সুলতানের সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছিল একাধারে রক্তপাত করা এবং দান ধ্যান করা। তার দ্বারে হয়ত দেখা যেত একজন দরিদ্রকে বিত্তশালী হতে অথবা একজন জীবন্ত লোককে প্রাণদান করতে। এর কোন ব্যতিক্রম প্রায়ই হতো না। তার দানশীলতা ও সাহস এবং অপরাধীদের প্রতি অত্যাচার ও নির্মম ব্যবহারের অনেক। গল্প পাঠানদের মধ্যে প্রচলিত আছে। তা হলেও তিনি ছিলেন সবচেয়ে এবং সাম্য ও সুবিচার দেখতে সর্বদাই প্রস্তুত থাকতেন। তাঁর দরবারে ধর্মীয় সব অনুষ্ঠানগুলোই কঠোরভাবে পালন করা হতো। নামাজ আদায়ের জন্যও তিনি কঠোর ব্যবস্থা করতেন এবং নামাজে অবহেলা দেখালে কঠিন শাস্তি বিধান করতেন।

তার মধ্যে সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তার দানশীলতা। এ-সম্বন্ধে এমন কতকগুলো গল্প আমি বলব, যার চমৎকারিত্ব অপর যে-কোন গল্পকে ছাড়িয়ে যায়। আমি খোদা, ফেরেস্তাগণ এবং পয়গম্বরকে সাক্ষী রেখে বলতে পারি,সুলতানের অসাধারণ দয়া দাক্ষিণ্যের সে সব গল্প বর্ণে বর্ণে সত্য। আমি জানি, যে-সব কাহিনীর বর্ণনা আমি দেব, তার কিছুটা অনেকেরই কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে, কেউ কেউ অসম্ভব বলেও মনে করবেন। কিন্তু-যা কিছু আমি স্বচক্ষে দেখেছি, যার ভেতরে আমি নিজেও অংশতঃ জড়িত ছিলাম, তার সম্বন্ধে সত্য কথা না বলে উপায় কি?

দিল্লীতে সুলতান মাহমুদের যে প্রাসাদ তা’ দার-সারা নামে পরিচিত। দার-সারার দরওয়াজা ছিল অনেকগুলি। প্রথম দরওয়াজায় থাকত দ্বাররক্ষীর দল, তার একটু দূরে জয়ঢাক ও শানাই বাদকেরা। এদের কাজ হল যখন কোন আমীর ওমরাহ বা বিখ্যাত। কোন ব্যক্তি দরবারে আসেন তখন নিজের নিজের বাজানো এবং আগন্তকের নাম। ঘোষণা করা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দরওয়াজায় ঠিক একই ব্যবস্থা। প্রথম দরওয়াজার। বাইরে আছে কয়েকটি বেদী। বেদীর উপরে মোতায়েন থাকে একদল জল্লাদ, তাদের ভিতর নিয়ম হল, বাদশাহ কারও প্রাণদণ্ডের আদেশ দিলে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে। দরবার-গৃহের সামনে। সেখানেই তার প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা। প্রাণদণ্ডের পরে লাশটি সেখানেই তিনরাত্রি ফেলে রাখা হয়।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় দরওয়াজার মধ্যবর্তী স্থানে একটি প্রকাণ্ড বেদীর উপরে বসে প্রদান নকিব। নকিবের হাতে সোনার রাজদণ্ড। মাথায় স্বর্ণও মণিমুক্তা খচিত পাগড়ী। পাগড়ীর উপরে ময়ুরের পালক। দ্বিতীয় দরওয়াজা দিয়ে এগিয়ে গেলেই সুবিস্তৃত দরবার-গৃহ। দর্শকদের বসবার নির্দিষ্ট স্থান।

তৃতীয় দরওয়াজায় যে বেদী আছে তাতে বসে লেখক বা মুন্সীগণ। সুলতানের অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া অপর কেউ যাতে এ-দরওয়াজা দিয়ে ঢুকতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা মুন্সীদের একটি প্রধান কাজ। অনুমতি প্রাপ্ত ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে কর্মচারীদের কে কে আসবে তারও নির্দেশ সুলতানই দেন। এই দরওয়াজার কেউ এলেই মুগীরা তৎক্ষণাৎ তার পরিচয় এবং আগমনের সময় লিখে রাখে। সাধারণতঃ মাগরেবের নামাজের পরে সুলতান এগুলো দেখেন। মুসীদের আরেকটি কাজ হল, প্রাসাদে যারা অনুপস্থিত থাকে তাদের হিসেব রাখা। সুলতানের অনুমতি নিয়ে অথবা বিনা অনুমতিতে প্রাসাদের কেউ যদি তিন দিন বা তার বেশী অনুপস্থিত থাকে তবে পুনরায় অনুমতি লাভের আগে প্রাসাদে ঢুকতে পায় না। যদি কেউ অসুস্থতা বা অন্য কোন অজুহাত দেখায় তবু নিজের ক্ষমতানুযায়ী কিছু উপঢৌকন নিয়ে আসতে হয়। সুলতানের জন্য।

তৃতীয় দরওয়াজা পার হয়েই আরেকটি প্রকাণ্ড দরবার-গৃহ। এটির নাম হাজার উস্তান বা হাজার স্তম্ভ। স্তম্ভগুলির সবই কাঠের তৈরী। স্তম্ভের মাথায় কাঠের কারুকার্য খচিত সুদৃশ্য ছাদ। ছাদের নীচেই বসে সুলতানের আম দরবার।

সাধারণ নিয়মানুযায়ী সুলতানের দরবার বসে অপরাহ্নে; কিন্তু অনেক সময় সকালের দিকেও তিনি দরবার ডাকেন। একটি ছোট বেদীর উপরে সাদা কাপের্ট বিছানো, তারই উপর সুলতানের মসনদ। পায়ের উপর পা রেখে তিনি বসেন। তার পাশে দুটি আর পেছনে একটি প্রকাণ্ড তাকিয়া। সুলতান আসন গ্রহণ করলে উজির দাঁড়ান তার সামনে, তারপর পদানুসারে অন্যান্য কর্মচারীরা। তখন নকিবরা উচ্চস্বরে বিসৃমিল্লাহ’ উচ্চারণ করে। প্রায় শতেক শান্ত্রী এসে দাঁড়ায় সুলতানের ডাইনে আর শতেক দাঁড়ায় বামে। তাদের কারো হাতে থাকে ঢাল, তলোয়ার, কারো হাতে তীর–ধনুক। অন্যান্য কর্মীরাও ডাইনে ও বামে সারি বেধে দাঁড়ায়। তারপর রাজকীয় সাজে সাজিয়ে সেখানে আনা হয় ষাটটি ঘোড়া। ঘোড়াগুলির অর্ধেক দাঁড় করানো হয় ডাইনে অর্ধেক বামে। তারপরে আনা হয় পঞ্চাশটি হাতী। হাতীগুলির পিঠে রেশমী বস্ত্রের আচ্ছাদন। দাঁত মোড়ানো হয়েছে লোহা দিয়ে। হাতীর এই লোহা বাঁধানো দাঁত দিয়ে প্রাণদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আসামীদের হত্যা করা হয়। প্রতিটি হাতীর উপর একজন করে মাহুত। মাহুতের হাতে ছোট কুঠার জাতীয় একটি লোহার অস্ত্র। হাতীর পিঠে প্রকাণ্ড সিন্দুকের মত একটি বস্তু। এর ভিতর কমবেশী কুড়িজন যোদ্ধা অনায়াসে থাকতে পারে। এই হাতীগুলিকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে মাথা নত করে সুলতানকে যথারীতি কুর্ণিশ করতে। হাতীগুলি যখন একযোগে সুলতানকে কুর্ণিশ করে, নকিব, নায়েব ও দেওয়ান প্রভৃতি কর্মচারীরা তখন পুনরায় উচ্চস্বরে ‘বিসমিল্লাহ্’ বলে উঠে। এরপর একে একে লোকজন এসে যখন নিজ-নিজ নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়ায় নকিবরা তখনও বিবিল্লাহ্’ বলে। আগন্তকের পদ-মর্যাদানুসারে বিসমিল্লাহ্ বলার সুরের উচ্চতা বাড়ানো বা কমানো হয়। বিধর্মী এসে যদি সুলতানকে কুর্ণিশ জানায় তাহলে নকিবেরা বিসমিল্লাহর পরিবর্তে বলে ওঠে খোদা তোমাকে সুপথে চালিত করুন।

যদি সুলতানের জন্য কোন উপঢৌকন নিয়ে কেউ দরওয়াজায় এসে হাজির হয়, নকিবরা তখন সুলতানকে গিয়ে সে খবর পৌঁছায়। সুলতানের কাছে পৌঁছতে তিন জায়গায় তিনবার তাদের কুর্ণিশ জানাতে হয়। আগন্তুককে নিয়ে যাবার হুকুম পেলে প্রথমে একজন পরিচারকের হাতে উপঢৌকনের বস্তু পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরিচারক সেগুলি নিয়ে সুলতানের কাছে দাঁড়ায়। এরপর সুলতান আগন্তককে কাছে ডাকেন। আগন্তককেও যেতে-যেতে তিনবার কুর্ণিশ জানাতে হয়। তাকে সর্বশেষ আরেকবার কুর্ণিশ করতে হয় সুলতানের কাছে পৌঁছে। সুলতান তখন অত্যন্ত আদর সহকারেই আগন্তককে সম্বোধন করেন ও যথারীতি কুশলাদি জিজ্ঞাসা করেন। আগন্তক তেমন উপযুক্ত পাত্র হলে সুলতান তার সঙ্গে মোসাহেফা করে বা আলিঙ্গন দিয়ে তাকে সম্মানিত করেন। পরে উপঢৌকনের জিনিষগুলি হাত দিয়ে নেড়ে দেখে নিজের সন্তুষ্টি জ্ঞাপন করেন; এবং উপঢৌকন দাতাকে উৎসাহিত করেন। সুলতান আগন্তকদের অনেক সময় সম্মানসূচক পোষাক দান করেন এবং সেই সঙ্গে কিছু নগদ অর্থ দিয়ে থাকেন।

সুলতান যখন কোন দেশভ্রমনের পরে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন তখন তার হাতীগুলিকে সাজানোনা হয় সুন্দর করে। মোলটি হাতীর উপরে রঙ্গীন রেশমী মোলটি ছাতা। ছাতাগুলি সোনা ও জহরতের কারুকার্য খচিত থাকে। পথের স্থানে স্থানে তৈরী করা হয় কয়েকতলা উঁচু কাঠের মঞ্চ। মঞ্চগুলিও মণ্ডিত করা হয় রঙ্গীন রেশমী বস্ত্র দিয়ে। মঞ্চের প্রত্যেক তলায় নৃত্যরত সুসজ্জিত নর্তকীর দল। প্রত্যেকটি মঞ্চের মধ্যস্থানে চামড়ার তৈরী জলাধার। তার ভিতর রাখা আছে সুপেয় সরবৎ। দেশী-বিদেশী নির্বিশেষে সবাইকে সরবৎ পান করতে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে বিতরণ করা হয় পান সুপারী। দুই সারি মঞ্চের মধ্যবর্তী পথেও কাপড় বিছিয়ে দেওয়া হয়। সুলতানের অশ্ব তার উপর দিয়েই যায়। পথের দুপাশের বাড়ীর দেয়ালগুলিতেও রঙ্গীন কাপড় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। নগরের প্রবেশদ্বার থেকে আরম্ভ করে প্রাসাদ পর্যন্ত এভাবে সাজানো হয়। সুলতানের গোলামদের থেকে বাছাই করা একদল পদাতিক মিছিলের সম্মুখভাগে চলতে থাকে। তাদের সংখ্যা হবে কম করেও কয়েক হাজার। মিছিলের পেছনে থাকে জনসাধারণ এবং সৈন্যদল।

একবার সুলতানের রাজধানীতে প্রত্যাবর্তনের সময় দেখেছিলাম হাতীর পিঠে রাখা। হয়েছে তিন চারিটি গুতি (Catapults)। সুলতানের রাজধানীতে পদার্পণের সময় থেকে শুরু করে প্রাসাদের প্রবেশ পর্যন্ত সর্বক্ষণ সেই গুতির সাহায্যে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা নিক্ষেপে করা হচ্ছে দর্শক জনসাধারণকে উদ্দেশ্য করে।

এখন আমি সুলতানের দানশীলতা ও উদারতার কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি।

শেহাবউদ্দিন ছিলেন কাজরুণের একজন প্রসিদ্ধ সওদাগর। সে সময়ে আল কাজীরুণী নামে ভারতেও একজন খ্যাতনামা সওদাগর ছিলেন। দুজনের মধ্যে বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। আল-কাজরুণীর দাওয়াত পেয়ে একবার শেহাবউদ্দিন এলেন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। সুলতানের জন্য মুল্যবান উপহার সামগ্রী তিনি সঙ্গে এনেছিলেন। দুইবন্ধু উপহারের জিনিসপত্র নিয়ে সুলতানের কাছে আসবার পথে একদল বিধর্মীর দ্বারা আক্রান্ত হন। বিধর্মীরা আল-কাজারুণীকে পথেই হত্যা করে এবং সমস্ত মালপত্র অপহরণ করে। সওদাগর শেহাবউদ্দিন কোন রকমে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেন। তাই লুণ্ঠন ও নরহত্যার সংবাদ কানে যেতেই সুলতান শেহাবউদ্দিনকে ত্রিশ হাজার দিনার দিয়ে স্বদেশে পাঠিয়ে দিতে হুকুম করলেন। কিন্তু সওদাগর শেহাবউদ্দিন তাতে রাজী হলেন না। তিনি বলে পাঠালেন আমি এজন্য আসিনি। আমি এসেছিলাম মহামান্য সুলতানকে দর্শনের বাসনা নিয়ে। শেহাবউদ্দিনের কথা পুনরায় সুলতানকে লিখে জানানো হলো। সুলতান পরম সন্তুষ্ট হয়ে হুকুম করলেন শেহাবউদ্দিনকে সসম্মানে দিল্লীতে নিয়ে আসতে। শেহাবউদ্দিন দিল্লী পৌঁছে সুলতানের সঙ্গে দেখা করতেই তিনি তাকে মূল্যবান উপহার দিয়ে সমাদর জানালেন। তারপরে কয়েক দিন শেহাবউদ্দিনকে অনুপস্থিত দেখে সুলতান তার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। শুনা গেল তিনি অসুস্থ। সুলতান একথা শুনেই তার একজন পারিষদকে হুকুম করলেন খাজাঞ্চীখানা থেকে এক লক্ষ স্বর্ণ টংগা (তা) বের করে শেহাবউদ্দিনকে দিতে। (এক টগা মরক্কোর আড়াই দিনারের সমান) এ টাকা দিয়ে ভারতীয় যে কোন পণ্য কিনে দেশে নিয়ে যাবার স্বাধীনতাও শেহাবউদ্দিনকে দেওয়া হলো। সুলতান হুকুম দিলেন শেহাবউদ্দিনের সওদা কিনা শেষ হবার আগে সে সওদা আর কেউ যেনো না কিনে। তাছাড়া সম্পূর্ণ লোক-লস্কর ও সাজসরঞ্জামসহ তিনখানা জাহাজও সুলতান মঞ্জুর করলেন শেহাবউদ্দিনকে পৌঁছে দিতে। শেহাবউদ্দিন হরমুজ দ্বীপে গিয়ে প্রকাণ্ড একটি গৃহ নির্মাণ করলেন। আমি পরে এ-গৃহটি দেখেছিলাম এবং শেহাবউদ্দিনকেও দেখেছিলাম সর্বস্বান্ত হয়ে সিরাজের সুলতানের কাছে দান ভিক্ষা করতে। ভারতের ধন-দৌলতের রীতিই ছিল এই। ক্কচিৎ এখান থেকে ধন-দৌলত নিয়ে কেউ স্বদেশে ফিরে যেতে পারে। যদি কখনও কেউ ধন-দৌলত নিয়ে যায় তবে এমন এক বিপদে সে পড়বে যার ফলে অচিরেই তাকে যথাসর্বস্ব খোয়াতে হবে। হরমুজের বাদশাহ ও তার ভ্রাতুস্পুত্রদের মধ্যে এক গৃহবিবাদের ফলে শেহাবউদ্দিন সব কিছু ছেড়ে হরমুজ ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন।

ডাক্তার শামসউদ্দিন ছিলেন একাধারে দার্শনিক এবং স্বভাব কবি। তিনি একবার সুলতানের প্রশংসাসূচক একটি কবিতা রচনা করলেন। কবিতাটিতে ছিল সাতাশটি স্তবক। সুলতান প্রতিটি স্তবকের জন্য কবিকে এক হাজার রৌপ্য দিনার পারিতোষিক দিলেন। এর আগে এ-ধরণের কাব্যরচনার জন্য কোন সুলতানই এত বেশী টাকা পারিতোষিক দেন নাই। তারা সাধারণতঃ দিয়েছেন একটি কবিতার জন্যে এক হাজার দেহরাম অর্থাৎ বর্তমান সুলতানের দানের তুলনায় দশ ভাগের এক ভাগ। সিরাজে সাজউদ্দিন নামে একজন কাজী ছিলেন। তার জ্ঞান ও ধর্মপ্রাণতার খ্যাতি শুনে সুলতান তাঁকে দশ হাজার রৌপ্য দিনার পাঠিয়ে দেন। এ ছাড়া সমরখন্দের নিকটে সাগার্জ নামক এক জায়গায় বোরহানউদ্দিন নামে একজন ধর্মপ্রচারক ও ইমাম ছিলেন। তিনি অর্থব্যয়ের ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত উদার। অনেক সময় তিনি নিজের যথাসর্ব ব্যয় করে বসে থাকতেন এবং অপরকে কিছু দেবার প্রয়োজন হলে অনায়াসে ঋণ গ্রহণ করতেন। সুলতান ইমাম বোরহানউদ্দিনের কথা শুনে তাকে চল্লিশ হাজার দিনার পাঠিয়ে দিলেন এবং সেই সঙ্গে দিল্লীতে আগমনের জন্য তাকে আমন্ত্রণ করে পাঠালেন। ইমাম পারিতোষিক গ্রহণ করে নিজের ঋণ পরিশোধ করলেন কিন্তু সুলতানের কাছে এসে দেখা করতে অস্বীকার করলেন। বলে পাঠালেন, “যে সুলতানের সম্মুখে গিয়ে পণ্ডিত ব্যক্তিদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, আমি সে সুলতানের কাছে যেতে রাজী নই।”

ভারতের একজন আমীর একবার কাজীর দরবারে নালিশ করলেন, সুলতান তার ভাইকে বিনা কারণে হত্যা করেছেন। সুলতান নিরস্ত্র অবস্থায় পদব্রজে গিয়ে কাজীর দরবারে হাজির হলেন এবং যথারীতি কাজীকে অভিবাদন করলেন। সুলতান কাজীকে আগেই নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন দরবারে সুলতানের উপস্থিতিতে দণ্ডায়মান না হতে। কাজেই সুলতান কাজীর সম্মুখে সাধারণ আসামীর মত দাঁড়িয়ে রইলেন এবং কাজী সুলতানের সম্মানার্থে উঠে দাঁড়ালেন না। তাকে মামলায় রায় দিতে হলো সুলতানের বিরুদ্ধে। সুলতান সে রায় বিনাদ্বিধায় মেনে নিলেন এবং রায়ের মর্মানুসারে ফরিয়াদীকে সন্তুষ্ট করে বিদায় করলেন। আরেকবার একজন মুসলমান সুলতানের কাছে টাকা পাবে বলে নালিশ করলো। কাজী সুলতানের বিরুদ্ধে ডিগ্রি দিলেন এবং সুলতান ডিগ্রির টাকা পরিশোধ করলেন।

একবার ভারতে ও সিন্ধুতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। এক মণ গমের দাম হলো ছয় দিনার। সুলতান হুকুম দিলেন, আবাল বৃদ্ধ বনিতা বা আমীর ফকির নির্বিশেষে দিল্লীর প্রতিটি অধিবাসীকে ছয় মাসের আহার্য রাজকীয় শস্য-ভাণ্ডার থেকে খুলে দিতে। রাজকর্মচারীরা দিল্লীর অধিবাসীদের নামের তালিকা করে ফেললো। সবাই দলে দলে এসে ছয় মাসের বরাদ্দ আহার্য নিয়ে যেতে লাগলো।

দরিদ্রের প্রতি সুলতানের করুণা, সুবিচার, অসাধারণ দয়া-দাক্ষিণ্য প্রভৃতি যেসব সদ্‌গুণের কথা বলেছি, সে সব থাকা সত্ত্বেও তিনি নিষ্ঠুর কম ছিলেন না। এমন কি কথায় কথায় তিনি রক্তপাত করতে কসুর করতেন না। তিনি ছোট বড় সকল রকম অপরাধেরই শাস্তি বিধান করতেন। কিন্তু অপরাধীকে শাস্তি দিতে গিয়ে তিনি কখনও অপরাধীর পদমর্যাদা বা তার বিদ্যাবত্তার প্রতি লক্ষ্য রেখে শাস্তির তারতম্য করতেন না। প্রতিদিন শত শত লোককে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে, পিঠমোড়া বেঁধে সুলতানের দরবারে আনা হতো এবং তাদের মধ্যে কাউকে প্রাণদণ্ড, কাউকে প্রহার অথবা অমানুষিক ভাবে শারীরিক জ্বালা যন্ত্রণা দেওয়া হতো। তার রীতি ছিল একমাত্র শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন প্রত্যেক কয়েদীকে কয়েদখানা থেকে বের করে দরবার-গৃহে আনা হবে। শুক্রবার দিনটি কয়েদীদের বিশ্রামের জন্য নির্দিষ্ট। সেদিন তারা কিছুটা পরিষ্কার। পরিচ্ছন্ন থাকতে পারে এবং কথঞ্চিৎ আরামে থাকতে পারে।

মাসুদ খাঁ নামে সুলতানের একজন বৈপিত্রেয় Hেalf-brother) ভাই ছিলেন। তার মা ছিলেন সুলতান আলাউদ্দিনের কন্যা। মাসুদ খার মতো সুন্দর সুপুরুষ আমার জীবনে খুব কমই দেখেছি। তিনি বিদ্রোহের আয়োজন করছেন বলে সুলতান একবার সন্দেহ করলেন। তাই মাসুদ ধাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। মাসুদ সুলতানের ভয়ে বিশেষ করে তার দেওয়া অকথ্য শারীরিক জ্বালা যন্ত্রণার ভয়ে অপরাধ স্বীকার করলেন। তিনি জানতেন এ ধরনের অপরাধের জন্য কাউকে সন্দেহ করা হলে স্বীকারোক্তি আদায় না করা পর্যন্ত সুলতান যে অসহ্য শারীরিক অত্যাচার করতে হুকুম করেন তা সত্যিই অমানুষিক। সে অত্যাচারের চেয়ে মৃত্যুবরণ করা বরং শ্রেয়। হতভাগ্য মাসুদের স্বীকারোক্তি শুনে সুলতান হুকুম করলেন, বাজারের প্রকাশ্য স্থানে নিয়ে তার মাথা কেটে ফেলতে এবং শুধু তাই নয়, সেই সঙ্গে তার মৃতদেহ যথারীতি তিন দিন সেই প্রকাশ্য স্থানে ফেলে রাখতেও তিনি হুকুম দিলেন।

সুলতানের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ করা হয় তার ভিতর সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগটি হলো প্রজাদের দিল্লী শহর ত্যাগ করতে বাধ্য করা। এর কারণ হলো, প্রজারা নাকি সুলতানকে কুৎসিত গালাগালি দিয়ে চিঠি লিখৃতো। সেই চিঠি খামে ভরে রাত্রির আঁধারে তারা নিক্ষেপ করতে দরবার-গৃহে। চিঠির উপরে লিখিতভাবে অনুরোধ থাক্ততা, সুলতান ছাড়া অপর কেউ যেনো সে চিঠি না পড়েন। সুলতান সে সব চিঠি খুলে দেখতেন, তাকে উদ্দেশ্য করে গালাগালি বর্ষণ ছাড়া আর কিছুই তাতে নেই। এর কফলে সুলতান স্বভাবতঃই নিজকে অত্যন্ত অপমাণিত বোধ করতে লাগলেন। অবশেষে ক্রোধান্ধ সুলতান মনস্থ করলেন, দিল্লী শহরকে তিনি শ্মশানে পরিণত করে ছাড়বেন। এ সঙ্কল্পের পরেই তিনি দিল্লীর অধিবাসীদের সমুদয় বিষয়-সম্পত্তি কিনে ফেললেন এবং দিল্পী ত্যাগ করে তাদের সবাইকে দৌলতাবাদে গিয়ে বসবাস করতে আদেশ করলেন। তারা দিল্লী ছেড়ে যেতে প্রথমে অস্বীকার করলো। কিন্তু সঙ্গেসঙ্গে সুলতান ঘোষণা করে দিলেন, তিন রাত্রি পার হয়ে যাবার পরে কেউ যেনো দিল্লীতে অবস্থান না করে। অধিকাংশ লোকই দেশত্যাগের এ মর্মান্তিক আদেশ মেনে নিল, কেউ অবশ্য নিজনিজ গৃহে লুকিয়ে রইলো। সুলতান সমস্ত গৃহ-তল্লাসীর হুকুম দিলেন। সুলতানের অনুচরেরা দিল্লীর রাস্তায় দু’জন লোকের দেখা পেল। তাদের একজন বিকলাঙ্গ ও আতুর, অপর জন অন্ধ।

সুলতানের সম্মুখে তাদের হাজির করা হলো। সুলতান তৎক্ষণাৎ হুকুম দিলেন তাদের যথোপযুক্ত শাস্তিবিধানের। সুলতানের হুকুম অনুসারে আতুর লোকটিকে যুদ্ধকালীন পাথর নিক্ষেপের যন্ত্রের সাহায্যে দূরে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হলো। অন্ধ লোকটির প্রতি হুকুম হলো, তার পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে নেওয়া হবে দিল্লী থেকে দৌলতাবাদ চল্লিশ দিনের পথ। হতভাগ্য অন্ধের দেহ পথেই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো, শুধু পা দু’খান গিয়ে পৌঁছলো দৌলতাবাদ। সুলতানের এ কুকীর্তি দেখে সবাই নিজ নিজ আসবাবপত্র এবং অন্যান্য সামগ্রী ফেলেই দিল্লী পরিত্যাগ করলো। ফলে দিল্লী একটি পরিত্যক্ত শহরে পরিণত হলো। একজন অতি বিশ্বস্ত লোক আমাকে বলেছেন, এ-ঘটনার পরে একদিন রাত্রে সুলতান গিয়ে প্রাসাদের ছাদের উপর উঠলেন এবং দিল্লী শহরের চতুর্দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কোন গৃহে একটি প্রদীপও দেখতে পেলেন না। এমনকি কোথাও সামান্য আগুনের চিহ্ন বা ধূম উঠতেও দেখলেন না। এ দৃশ্য দেখে তিনি বলে উঠলেন “এতদিনে আমার মনে শান্তি এসেছে, আমার রাগ প্রশমিত হয়েছে। তারপরে তিনি অন্যান্য শহরের বাসিন্দাদের লিখে পাঠান দিল্লী শহরে এসে। বসবাস করতে। তার ফলে এই হলো যে, যারা দিল্লীতে এলো তাদের পরিত্যক্ত শহরগুলো তো ধ্বংস হলোই অধিকন্তু দিল্লীও আর আগের মতো জনবহুল নগরীতে পরিণত হলো না। তার কারণ দিল্পী সারা দুনিয়ার অন্যতম বৃহৎ শহর। ঠিক এই অবস্থায় আমরা এসে দিল্লী পৌঁছলাম। দিল্লী তখন জনবিরল শুন্য শহর।

এবার আমাদের আসল কথায় ফিরে আসা যাক। আমরা রাজধানীতে কি করে পৌঁছলাম এবং সুলতানের অধীনে চাকুরী গ্রহণ করে কি ভাবে আমার ভাগ্য ফিরে এলো। তাই এখন বলছি। আমরা দিল্পী যখন পৌঁছলাম সুলতান তখন রাজধানীর বাইরে। ছিলেন। আমরা প্রাসাদে উপস্থিত হয়ে প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় দরওয়াজা অতিক্রম। করতেই প্রধান নকীব আমাদের নিয়ে হাজির হলেন প্রশস্ত একটি দরবার গৃহে। এখানে উজির আমাদের প্রতীক্ষা করছিলেন। তৃতীয় দরওয়াজার পরবর্তী এই বিশাল কক্ষই হাজার উসতান’ নামে পরিচিত। সেখানে হাজির হতেই উজির আভূমি নত হয়ে আমাদের অভিবাদন জানালেন; আমরাও প্রায় তেমনি ভাবে তাকে প্রত্যাভিবাদন জানালাম। সুলতানের মসনদের উদ্দেশে নত হয়ে আমরা অঙ্গুলী দ্বারা মাঠি স্পর্শ করলাম। আমাদের এ অনুষ্ঠানটি শেষ হবার পরেই নকীব বিছমিল্লাহ’ বলে চীৎকার করে উঠলো এবং আমরা সবাই প্রস্থান করলাম।

অতঃপর সুলতানের মাতার প্রাসাদে গিয়ে আমরা তাকে কিছু উপঢৌকন দিলাম এবং আমাদের জন্য নির্দিষ্ট বাসগৃহে প্রবেশ করলাম। আমাদের সেই গৃহে আসবাব-পত্র গালিচা, মাদুর, তৈজসপত্র, বিছানা প্রভৃতি প্রয়োজনীয় সব কিছুই মোতায়েন দেখতে পেলাম। ভারতে ব্যবহৃত বিছানা খুবই হালকা। একজন লোকই অনায়াসে তা বহন করতে পারে। সফরে যেতে হলে সবাই তার বিছানা নিয়ে যায় এবং একটি বালক ভৃত্য তা মাথায় বহন করে মনিবের অনুসরণ করে। চারটি কুদাননা পায়ার সঙ্গে আড়াআড়ি চার টুকরা কাঠ জুড়ে এবং সেই সঙ্গে রেশমী বা সূতী ফিতা বুনে এ বিছানার সৃষ্টি। এ বিছানায় শুলে নরম অন্য কিছুরই দরকার হয় না। বিছানার সঙ্গে দুটি তোসকও দেওয়া হয়েছে, সেই সঙ্গে আছে বালিশ আর বিছানার চাদর। সবই রেশমী। এখানকার রীতি। হলো, তোষক বালিশের উপরে সূতী বা রেশমী আবরণী ব্যবহার করা। ময়লা হলে আবরণীটি ধুইয়ে ফেললেই মিটে যায়, বিছানা বরাবর পরিষ্কারই থেকে যায়।

পরদিন ভোরে আমরা গেলাম উজিরকে ছালাম করতে। তিনি আমাকে এক হাজার রৌপ্য মুদ্রাসহ দুটি তোড়া উপহার দিলেন। দিয়ে বললেন, “এ যৎসামান্য অর্থ দেওয়া হলো আপনার মাথা ধোওয়ার (সম্মানের জন্য। এছাড়া আর দিলেন চিক্কণ ছাগ-লোমে তৈরী একটি পোক। আমার সঙ্গী ভৃত্য ও গোলামদের একটি তালিকা তৈরী করে। তাদের চার পর্যায়ে ভাগ করা হলো। প্রথম পর্যায়ে যারা তারা প্রত্যেক পেলে দুশো দিনার; দ্বিতীয় পর্যায়ে দেড়শো দিনার; তৃতীয় পর্যায়ে একশো এবং সর্বশেষ বা চতুর্থ পর্যায়ে যারা তারা পেলো পঁয়ষট্টি দিনার। তারা সংখ্যায় ছিল প্রায় চল্লিশ জন। সবাই মিলে তারা মোট পেলে চার হাজার দিনারের বেশী। অতঃপর ঠিক হলো সুলতানের অতিথির বরাদ্দ। আমাদের জন্য বরাদ্দ হলো হাজার পাউণ্ড ভারতীয় ময়দা, হাজার পাউণ্ড গোশত সেই সঙ্গে ঘি, চিনি, সুপারী পান কতটা ঠিক আমার স্মরণ নেই। ভারতীয় প্রতি পাউণ্ডের ওজন হলো মরক্কোর বিশ পাউণ্ড বা মিনারের পঁচিশ পাউণ্ডের। সমান। পরে সুলতান আমার নামে কয়েকটি গ্রাম লিখে দিয়েছিলেন। তার বার্ষিক আয় ছিল প্রায় পাঁচ হাজার দিনার।

সাওয়াল মাসের ৪ঠা তারিখে (৪ঠা জুন ১৩৩৪খ্রীঃ) সুলতান ফিরে এলেন রাজধানী থেকে সাত মাইল দূরবর্তী তিলবাত দূর্গে। উজির আমাদের হুকুম করলেন সেখানে গিয়ে সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে। আমরা দূর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। সুলতানকে উপহার দেবার জন্য ঘোড়া উট, ফলমূল তরবারী প্রভৃতি সঙ্গে নিয়ে দূর্গের প্রবেশ দ্বারে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একে একে দর্শনার্থীদের ভিতরে নিয়ে জরির কাজ করা মূল্যবান পরিচ্ছদ উপহার দেওয়া হলো। আমার পালা যখন এলো আমি ভিতরে গিয়ে দেখতে পেলাম সুলতান একখানা কেদারায় বসে আছেন। প্রথমে আমি তাকে একজন সুলতান ওমরাহ্ বলে ভুল করেছিলাম। আমি দু’বার তাকে কুর্ণিশ করার পরে সুলতানের একজন অন্তরঙ্গ ওমরাহ বলে উঠলেন “বিছমিল্লাহ্, ইনি মওলানা বদরউদ্দিন।” এখানে সবাই আমাকে বদরউদ্দিন বলে সম্বোধন করতো। মওলানা” (আমাদের প্রভু) পণ্ডিত ব্যক্তিদের উপাধি। আমি সুলতানের দিকে এগিয়ে যেতেই তিনি আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন এবং হাত ধরে রেখেই পাণীতে বললেন, “আপনার আগমন শুভ হয়েছে। আপনি নিঃসঙ্কোচে এখানে থাকুন। আপনার প্রতি খাতির যত্ন ও আমার অনুগ্রহের কোন অভাব হবে না। বরং সে সবের কথা আপনার মুখে শুনে আপনার দেশবাসীরা আপনার। সঙ্গে এসে যোগদান করবেন। এরপর তিনি আমার নামধাম জিজ্ঞেস করলেন। আমি তার যথাযথ উত্তর দিলাম। আমাদের এই আলাপ আলোচনা প্রসঙ্গে যত বারই তিনি কোন উৎসাহ ব্যঞ্জক কথা বললেন ততবারই আমি তার হস্তচুম্বন করলাম। এভাবে সাতবার আমি সুলতানের হস্তচুম্বন করলাম। সমস্ত দর্শনেচ্ছুরা পরে একত্রিত হলে। সুলতান এক ভোজের আয়োজন করে তাদের আপ্যায়িত করলেন।

অতঃপর সুলতান প্রায়ই তার সামনে বসে আহার করতে আমাদের ডাকতেন। তখন তিনি আমাদের কুশলাদি জিজ্ঞাসা করতে ভুলতেন না।

তিনি সবাইর জন্য ভাতা নির্দিষ্ট করে দিলেন। আমার ভাতা বরাদ্দ হলো বছরে বার হাজার দিনার। এছাড়া আগে যে তিনটি গ্রাম লিখে দিয়েছিলেন তার সঙ্গে আরও দুটি গ্রাম যোগ করে দিলেন।

একদিন উজির এবং সিন্ধুর শাসনকর্তা এসে আমাদের বললেন,”সুলতান বলেছেন, আপনাদের ভেতর উজির, সিপাহ্ সালার, হাকিম, শিক্ষক বা শেখ হবার যোগ্যতা যার আছে সুলতান তাকে সে পদে নিয়োজিত করবেন। উপস্থিত সবাই প্রথমে চুপ করে রইলেন। কারণ, তারা এসেছিলেন কিছু ধনদৌলত লাভ করে দেশে ফিরে যাবেন এই আশায়। তাদের কেউ নিজ-নিজ বক্তব্য পেশ করার পরে উজির আমাকে আরবীতে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার বক্তব্য কি?”

আমি বললাম,”ওজারত বা অন্য কোন পদ আমার কাম্য নয়। কাজীগিরি বা শেখগিরি আমার পেশা। পূর্বপুরুষরাও তাই করতেন।”

সুলতান আমার এ জবাবে খুব খুশী হয়েছিলেন। পরে আমাকে প্রাসাদে ডেকে দিল্লীর কাজীর পদে আমাকে বহাল করেন।

***

টিকা

পরিচ্ছেদ ৬

১। মুসলিম দেশগুলিতে ডাক ব্যবস্থা পুরাতন যুগের মতো একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান ছিল– রাজ্যের প্রয়োজনীয় ব্যাপার সত্বর আদান-প্রদানের জন্য এর ব্যবহার চলতে-সাধারণ নাগরিকদের ব্যবহারে লাগতো না।

২। সামিরদের প্রথা এত পরিষ্কারভাবে তাদের হিন্দু থেকে উৎপত্তির নির্দেশ দেয় যে আরব সামিরাদের সঙ্গে তাদেরকে মেলানো একটি কাল্পনিক বংশধারা বলে মনে হয়, যেটা তাদের ইসলাম গ্রহণের সময় থেকে হিসেব করা হয়। মনে হয় এই সব সামিরা হচ্ছে রাজপুত। সামাস- এরা এ সময়ে নিম্ন সিন্ধুর প্রভু হয়ে বসেছিল। অতএব জানানি সম্ভবতঃ রোহনি এবং সেওয়ানের মাঝের অর্ধপথে অবস্থিত ছিল।

৩। সিন্ধুদেশ গ্রীষ্মের তাপ পড়ে জুন এবং জুলাই মাসে। ইব্‌নে বতুতা যখন সেপ্টেম্বর মাসে সিন্ধুতে পৌঁছেন সেখানে বর্ণনার মধ্যে ন’মাসের একটা ফাঁক পড়েছে বলে দেখা যায়। খুব সম্ভব তার বিবরণ কিছুটা স্থানচ্যুত–অথবা কাফেলা কিছুটা অস্বাভাবিক তাপ ভোগ করেছিল।

৪। ইব্‌নে বতুতা নিম্নে বছেন যে ভারতে প্রদেশের শাসক এবং উঁচু পদের কর্মচারীকে রাজা উপাধি দেওয়া হয়।

৫। লাহারির ধ্বংসাবশেষ (“ল্যারিবান্দার”) রাহু প্রণালীর উত্তর দিকে পড়ে আছে- করাচি থেকে ২৮ মাইল দক্ষিণ-পূর্ব এবং এর দ্বারাই এটা স্থানচ্যুত হয়েছিল ১৮০০ সালে এর অগভীর প্রবেশ পথের জন্য। “সমুদ্র উপকুলে” কথাটি বলা ঠিক হয় না। কেননা সমুদ্র তীর কয়েক মাইল ভিতর পর্যন্ত জনশূণ্য-কারণ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু প্রবাহের সময় সেটা নিয়ত প্লাবিত থাকে।

৬। ইব্‌নে বতুতা যে ধ্বংসাবশেষের কথা বলেছেন সেটা নিশ্চিতরূপে চেনা যায়নি। হেই বছেন এগুলি মোরা-মারির ধ্বংসাবশেষ হতে পারে, লাহারি থেকে আট মাইল উত্তর-পূর্বে এবং এ কথাও বলা হয়েছে। (প্রথমে কানিংহাম কর্তৃক) যে এগুলি দেবুল বা দেবলের। এ স্থানটি ছিল সিন্ধু তীরে অবস্থিত পূর্বের বন্দর, করাচী থেকে ৫৪ মাইল পূর্ব-দক্ষিণ-পূর্বে। ৭১০ ৭১৫ খ্রীষ্টাব্দে সিন্ধুদেশ আক্রমণের সময় আরবগণ এটা দখল করেছিলেন এবং পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।

৭। বাশার (ইণ্ডিয়ার গেজেটিয়ারের বুখুর) হচ্ছে সিন্ধু নদের একটি দূর্গ বেষ্টিত দ্বীপ-সুকুর এবং রোহরের মাঝখানে অবস্থিত।

৮। এই নদীটি ছিল রুইর পুরাতন প্রণালী। এটা সে সময়ে সম্মিলিত ঝিলাম এবং চেনাবকে মুলতানের নিয়ে যুক্ত করেছিল।

৯। আজুদাহান আবুহানের আগে আসা উচিৎ ছিল।

১০। কুশাই ক্কচিৎ কৃষ্ণকে বুঝায়। এটা হচ্ছে ফরাসী আরবদের ইঙ্গিত। সম্ভবতঃ এর অর্থ গোসাই। মানে ধর্মীয় গুরু। (“একটি দেবতার নামও”। প্লটের হিন্দুস্তানী ডিনারী)।

১১। মাসুদাবাদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে নাজাফগড়ের এক মাইল পূর্বে এবং পালেম। ষ্টেশনের উত্তর দিয়ে ছ’ মাইল পশ্চিমে।

১২। মধ্যযুগীয় দিল্লীর ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে বর্তমান শহরের দশ মাইল খানিক দক্ষিণে ‘খাশ দিল্লী’ জাহানপানা, এবং সিরি একটি ধারাবাহিক শ্রেণী সাহরাওলি থেকে উত্তর-পূর্বে তোলাবাদ বাশ দিল্লীর চার মাইল পূর্বে এবং আধুনিক তোলাবাদের দু মাইল পূর্বে। সুলতান মাহমুদ কর্তৃক এ শহরগুলির যে ক্ষতি সাধন করা হয়েছিল সে সব আর কখনো পূরণ করা হয়নি। এ কথা ইনে বতুতা নিম্নে উল্লেখ করেছেন। অতঃপর ১৩৯৮ সালে তৈমুর তৈমুল ক) আবার এ শহরগুলির উপর ধ্বংসকার্য করে যান। নতুন দিল্লী নির্মাণ করেন মোগল সুলতান শাজাহান (১৬২৭-৫৮)। দিল্লীর প্রথম যুগের মুসলিম সুলতানদের কিছু বিবরণ পাওয়া যাবে। ভূমিকার ২২-২৪ পৃষ্ঠায়।

১৩। নিম্নে কুতুব মিনার এবং আলাই মিনারের বিবরণের ন্যায় এখানেও ইব্‌নে বতুতার হিসাব অতিরঞ্জিত হয়েছে। চন্দ্রগুপ্তের লোহস্তম্ভ মুত্রা থেকে আনা হয়েছিল এবং দিল্লীতে স্থাপিত হয়েছিল এর প্রতিষ্ঠাতা কর্তৃক এগারো শতাব্দীতে। এটার ব্যাস ১৬ ইঞ্চি এবং উচ্চতা ২৩ ফিট। কুতুব মিনারের উচ্চতা ২৩৮ ফিট, আই মিনারের অসম্পূর্ণ অংশের উচ্চতা (ইব্‌নে বতুতা এটা ভুলক্রমে কুতুবুদ্দিনের বলেছেন) ৭০ ফিট এবং তিনি যতটা বলেছেন ততটা প্রশস্ত নয়।

১৪। এখানে সুলতান মুহাম্মদ ইব্‌নে তুগলকের যে চরিত্র আঁকা হয়েছে সেটা সম্পূর্ণভাবে ঐতিহাসিক। ভূমিকা দ্রষ্টব্য।

১৫। দৌলতাবাদ বা দেণ্ডগিরি হায়দারাবাদ (দেকান) রাজ্যের উত্তর-পশ্চিমে। সুলতান মুহাম্মদ এটাকে তার রাজধানী করতে চেয়েছিলেন দক্ষিণ ভারতে সামরিক অভিযানের কেন্দ্র হিসাবে স্থানটির শুরুত্বের জন্য। দু বার (বা তিনবার) তিনি দিল্লীর সমস্ত জনতাকে এখানে স্থানান্তরিত করার চেষ্টা করেছিলেন। ভাগ্যের পরিহাসে তার জীবদশাতেই এটা দেকানের বাহমনী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা দখল করে নিয়েছিলেন। পরিচ্ছেদ ৭, টীকা ৭ দ্রষ্টব্য। ১৬। এ সংস্করণে যে অধ্যায়টি স্থান পায়নি তেমনি একটি পূর্বের অধ্যায়ে ইব্‌নে বতুতা শেখ শিহাব উদ্দীনের ইতিহাস বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করেছেন। সুলতানের অধীনে চাকুরী করার অসম্মতি প্রকাশের দ্বারা তিনি তার বিরাগভাজন হন এবং দিল্লীর নিকটে মাটির তলায় সুরঙ্গ করে কয়েক বছর কাটান। এ সুরঙ্গের তলায় কয়েকটি কামরা, গুদামঘর, রান্নাঘর এবং গোসলখানা ছিল। অতঃপর পুনরায় তাকে দরবারে তলব করা হলে তিনি প্রকাশ্যে মুহাম্মদ শাকে বিশ্বাসঘাতক বলেন-এবং তার উক্তি ফিরিয়ে নিতে বলা হলে তিনি তাতে অসম্মতি জানান এবং দণ্ডিত হন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *