সাহিত্যিকদের মধ্যে কে কেমন খেতে পারেন সেই আলোচনা-প্রসঙ্গেই কথা উঠল নিশিকান্তর, আমাদের পণ্ডিচেরীর নিশিকান্ত, যার কবিখ্যাতি কাতোর অবিদিত নেই। বৈঠকের বন্ধুরা সবাই আমাকে চেপে ধরলেন ভোজন-রসিক নিশিকান্তর গল্প বলতেই হবে, বিশেষ করে তার খাবার গল্প।
বৈঠকের গাল্পিক বন্ধু বললেন–এই কবি নিশিকান্তই না আপনাকে নেংটি ইঁদুরের মাংস রান্না করে খাওয়াতে গিয়েছিল? সেই ঘটনাটাই আমাদের বলুন!
আমি আপত্তি জানিয়ে বললাম—ইঁদুরের মাংস খাওয়াটা এমন কিছু একটা বাহাদুরির গল্প নয় যা সবাইকে জাঁক করে বলা চলে। কৈশোর জীবনে কতরকম ঝোঁকই না ঘাড়ে চাপে আর কত কুকীর্তিই না করা হয়। সবই কি আর বলা যায়? তবে এটুকু বলতে পারি—ইঁদুরের মাংস সে-শুধু আমাকে একাই খাওয়াবার চেষ্টা করে নি। সঙ্গে আরও দুজন ছিল। টুনাং নামে ছিল একজন কর্মী ছেলে, শান্তিনিকেতন ইস্কুলে সে-ছিল আমার সহপাঠী। দুর্দান্ত ডানপিটে। আর ছিল আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন-এর পুত্র শ্রীক্ষেমেন্দ্রমোহন সেন–যাকে শান্তিনিকেতনের সবাই কঙ্কর নামে চেনে।
কঙ্করদা বয়সে ছিলেন আমাদের চেয়ে তিন চার বছরের বড়, বুদ্ধিতেও তুখোড়। আমরা, পাড়ার ছেলেরা একবাক্যে তাঁকে দলপতি মেনে নিয়েছিলাম।
আমাদের পাড়াটা ছিল শান্তিনিকেতনের একেবারে দক্ষিণপ্রান্তে। মাটির দেয়াল আর খড়ের ছাউনি দেওয়া এক সারিতে আট-দশ ঘর। পাড়ার নাম গুরুপল্লী। বিদ্যালয়ের বিশিষ্ট শিক্ষকরা সপরিবারে এই পল্লীতে থাকতেন। এই পল্লীর প্রতিবাসীদের মধ্যে ছিল আত্মীয়তার নিবিড় ও মধুর সম্পর্ক। পাড়ার ছেলেমেয়েদের মধ্যে বয়ঃজ্যেষ্ঠরা ছিলেন দাদা ও দিদির মত, কনিষ্ঠেরা ছিল ছোট ভাইবোন। এই সম্পর্কের মধ্যে কখনও আপন-পর ভেদ ছিল না।
কঙ্করদা উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার অনেক কিছুই পেয়েছেন। পাণ্ডিত্যের কথা অবশ্য আমি বলতে পারব না, তবে পৈত্রিক বিশেষ যে গুণটি তিনি পেয়েছেন তা হচ্ছে তার অপূর্ব রসিকতা।
একবার শান্তিনিকেতনের এক পারসী অধ্যাপক মিস্টার মরিস কঙ্করদাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন
তোমার বাবা সংস্কৃতে বিরাট পণ্ডিত, কিন্তু তোমার নাম কঙ্কর রাখলেন কেন?
কঙ্করদা তৎক্ষণাৎ বললেন–কেন? এও তো সংস্কৃত শব্দ। কং করোতি যঃ সঃ ইতি কঙ্কর।
মরিস সাহেব অবাক হয়ে বললেন– তোমার নামের এমন একটা সংস্কৃত অর্থ আছে তা তো জানতাম না। কিন্তু কং কথার মানেটা কি!
কং অর্থাৎ রসিকতা। এটা পালি শব্দ, হীনযান বা মহাযান-এ পাবেন না, চীনযান-এ আছে। এই বলেই কঙ্করদা মরিস সাহেবের সামনে থেকে দে-চম্পট, পাছে আবার চীনযানটা কী জিজ্ঞাসা করে বসেন।
কঙ্করদার উপস্থিত বুদ্ধির জোরে একবার আমরা বাঘের মুখ থেকে বেঁচে এসেছি। সে-ঘটনা বলি : শান্তিনিকেতনের পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে আম-কাঠাল লিচু-পেয়ারা ও নানাবিধ দেশী ফল ও ফুলের বাগান পরিবৃত একটি বাড়ির পূর্ব অংশে থাকতেন রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ওই বাড়িরই পশ্চিম অংশে থাকতেন দ্বিজেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বীপেন্দ্রনাথ। বাড়িটার নাম নীচুবাংলা। দ্বীপেন্দ্রনাথকে আশ্রমবাসী সকলেই দীপবাবু বলে ডাকতেন। তাঁর উপর তখন ছিল আমপরিচালনার ভার। রাসকারী মানুষ, কিন্তু তার অরটি ছিল সমুদ্রের মতই বিরাট।
বর্ষাকালের এক দুপুরে কঙ্করদা এসে খবর দিলেন, নীচুবাংলার বাগানে প্রচুর পেয়ারা হয়েছে। কঙ্করদা এমনিভাবে প্রায়ই আমাদের বুদ্ধি যোগান, আমরা তার অনুরক্ত সেনানী, সর্বদাই আদেশ পালনের জন্য পা বাড়িয়েই আছি।
ঠিক হল দুপুরে সবাই যখন দিবানিদ্রায় মগ্ন সেই সময় পেয়ারা পাড়তে হবে। কঙ্করদা বললেন—না রে, দীপুবাবু আজকাল পাহারা দেবার জন্য গাছতলায় লোক বসিয়ে রাখেন। তার চেয়ে শেষরাত্রে টর্চের আলো নিয়ে পেয়ারা পাড়াই সমীচীন।
নিশিকান্ত বললে—রাত্রে শুনেছি একটা নেপালী দারোয়ান বন্দুক নিয়ে পাহারা দেয়, এতে আমি নেই।
ডানপিটে বর্মী টুনাং বললে—কুছ পরোয়া নেই। দুপুরেই পেয়ারা পাড়ব। আমাকে কেউ ধরতে পারবে না। তোমরা শুধু দূর থেকে নজর রেখে পাহারাদার লোকটা কোনদিকে থাকে। বিপদ বুঝলেই ইশারা করবে, আমি গাছ থেকে এক লাফে নেমে ছুট লাগাব।
স্থির হল কঙ্করদা দূর থেকে ইশারা করবেন, টুনাং গাছে চড়বে, আমি তলায় দাঁড়িয়ে পেয়ারা কুড়ব।
পরিকল্পনা যখন প্রস্তুত তৎক্ষণাৎ তা কাজে পরিণত করা চাই। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আমরা নীচুবাংলার বাগানে ঢুকেছি। টুনাং চক্ষের নিমেষে মগডালে উঠে জল-ভেজা পেয়ারা ধপাধপ ফেলছে আর আমি তা কুড়তে ব্যস্ত।
হঠাৎ ভারিক্কী গলার বাজখাঁই আওয়াজ উঠল—
বয়, ছোঁড়াগুলোকে ধরে আন তো।
বয় ছিল দীপুবাবুর চব্বিশ ঘণ্টার অনুরক্ত ভৃত্য। ভৃত্য বললে তাকে ছোট করা হয়। সে ছিল দীপুবাবুর ফ্রেণ্ড, ফিলসফার অ্যাণ্ড গাইড। বালক বয়সেই সে দীপুবাবুর ভৃত্যরাজতন্ত্রে উজির-নাজির হয়ে ঢুকেছিল, যৌবনে সে হয়েছিল একচ্ছত্র সম্রাট। বালক বয়সে বয় নামেই সে সকলের পরিচিত, তার পৈত্রিক নাম শান্তিনিকেতনিকরা কেউ কখনও জানতেন না।
চক্ষের নিমেষে টুনাং টার্জনের মত এক ডাল থেকে আরেক ডালে ঝুলতে বুলতে লাফ মেরে মাটিতে পড়েই টেনে দৌড়। আমি তখনও পেয়ারা পকেটস্থ করতে ব্যস্ত, কখন যে মালী আর চাকর মিলে জন-চারেক লোক এসে ঘিরে ফেলেছে টেরই পাই নি। বমাল ধরা পড়লাম! তাকিয়ে দেখি কঙ্করদা আমার আগেই ধরা পড়েছেন, টুনাং ততক্ষণে পগার পার। আমাদের দুজনকে হাজির করা হল দীপুবাবুর সামনে। দীপুবাবুকে আমরা বাঘের মত ভয় করতাম। আর পড়বি তো পড় সেই বাঘের মুখেই। দীপুবাবুর দুই প্রিয়পাত্রের আমরা দুই পুত্র। বয়ঃজ্যেষ্ঠ কঙ্করদা, সুতরাং তাকেই উদ্দেশ করে দীপুবাবু মেঘমন্দ্রস্বরে বললেন–
পেয়ারা পাড়ার অনুমতি নিয়েছিলে?
আজ্ঞে না।
কটা পেয়ারা পেরেছ?
সঙ্গে সঙ্গে হাফ প্যান্ট আর জামার পকেটে যে-কটা পেয়ারা ছিল বার করে সামনে রাখলাম।
দীপুবাবু পেয়ারাগুলোর দিকে তাকিয়ে একটু বেদনাহত কণ্ঠে বললেন— ঈ, এই সব কচি-কচি পেয়ারাগুলো পেড়ে নষ্ট করলে? বড় হলে তো তোমরাই খেতে, আর দু-চারটে দিন অপেক্ষা করতে পারলে না?
এইটুকু বলেই কঙ্করদার দিকে তাকিয়ে বললেন–
আচ্ছা কঙ্কর, তুমিই বল। আমি যদি তোমার বাগানে গিয়ে এইভাবে গাছের ডালপালা ভেঙ্গে কচি পেয়ারা পেড়ে তছনছ করতাম, তোমার মনে কি দুঃখ হত না?
কঙ্করদা সঙ্গে সঙ্গে মুখে একটা অমায়িক হাসি এনে হাত কচলাতে কচলাতে সলজ্জ স্বরে বললেন–
আজ্ঞে আপনি আমার বাগানে পেয়ারা পাড়তে যাবেন সে-সৌভাগ্য কি আমার কোন দিন হবে?
এই কথা শোনার পর দীপুবাবু আর কপট গাম্ভীর্য ধরে রাখতে পারলেন। সহাস্যে বললেন–বাপের উপযুক্ত পুত্ৰই বটে। বয়, ছোঁড়া দুটোকে কিছু লেবেঞ্চুস দিয়ে দে।
কঙ্করদার উপস্থিত কং অর্থাৎ রসিকতার গুণে সেদিন শাস্তির বদলে লজেন্স নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। আর পালিয়েছিল বলে টুনাং-এর তখন কী দুঃখ।
আগেই বলেছি, কঙ্করদা ছিলেন নানারকম বুদ্ধি বাতলানোর বাদশা আর আমরা ছিলাম তার হুকুমবরদার। কঙ্করদা স্থির করলেন গুরুপল্লীর জন্য একটা
সংবাদপত্র প্রকাশ করতে হবে এবং তার নাম হবে গুরুপল্লী সমাচার। কঙ্করদার মুখ দিয়ে একটা কিছু নতুন প্ল্যান বেরলেই হয়, আমি ছিলাম এসব ব্যাপারে ঝড়ের আগে এটো পাতা।
দৈনিক সংবাদপত্রের আকারের একটা পেস্ট-বোর্ড সংগ্রহ করে ফেললাম, কিছু ফুল্যাপ সাদা কাগজও। ময়দা জাল দিয়ে লেই তৈরী করতে দেরি হল না। কঙ্করদা ছিলেন পত্রিকার একাধারে সম্পাদক, বার্তাসম্পাদক, রিপোর্টার, নিজস্ব সংবাদদাতা ইত্যাদি। আমার হাতের লেখা কিছুটা রাবীন্দ্রিক ধাঁচের ছিল বলে আমি ছিলাম তার মুদ্রাকর। রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর লণ্ঠন জেলে আমরা দুজনে গুরুপল্লী সমাচার প্রস্তুত করতাম এবং ভোরবেলা কাক-কোকিল ডাকবার আগেই গুরুপল্লীর সামনের একক বাঁশঝাড়টার গায়ে তা লটকে দিয়ে অসিতাম। সকাল হলে ইস্কুলে যাবার আগে বাড়ির ছোট্ট ঘরের জানলার পাল্লাটা একটু ফাঁক করে দেখতাম সংবাদপত্রের প্রচার কতখানি হল অর্থাৎ পাঠক সংখ্যা কতজন। দুঃখের বিষয় আমাদের সমবয়সী দু-চার জন পাঠক ছাড়া বিদগ্ধ পাঠকদের সে-পত্রিকা আকর্ষণ করতে পারে নি। তা না করুক। আমরা দ্বিগুণ উৎসাহে পত্রিকা প্রকাশ অব্যাহত রেখেছিলাম।
বুধবার ছিল আমাদের ছুটি। সেদিনের সমাচারে থাকত গুরুপল্লীর বিভিন্ন মাস্টারমশাইদের নিয়ে টিপ্পনী। এক বুধবারের কাগজে সংবাদ পরিবেশিত হল :
গুরুপল্লীতে গরু বিভ্রাট
দুই গুরুর মধ্যে দাঙ্গাহাঙ্গামার উপক্রম
[ নিজস্ব সংবাদদাতা প্রদত্ত ]
সংবাদে প্রকাশ গুরুতর কোন এক মাস্টারমশাইয়ের গৃহপালিত গরু পার্শ্ববর্তী মাস্টারমশাইয়ের রান্নাঘর সন্নিকটস্থ তরকারির ক্ষেতে অনধিকার প্রবেশ করিয়া কচি ঢাড়শ খাইয়া তছনছ করিয়াছে। ক্ষেতের মালিক প্রতিবাদ জানাইলে তুমুল বাদবিতণ্ডা শুরু হয়। বিষয়টি উচ্চ আদালতে (গুরুদেবের সন্নিকটে) উপস্থাপিত হইবার পূর্বেই অনরারী ম্যাজিস্ট্রেট রায় সাহেব জগদানন্দ রায়ের মধ্যস্থতায় আপসে মিটমাট হইয়া যায়। এরূপ শোনা যাইতেছে যে, গরুর মালিক সবজিক্ষেতের মালিকের নিকট গরুর অন্যায় অপকার্যের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিয়াছেন।
পাড়ার কোন এক বকাটে ছেলে শিয়োনামা থেকে সংবাদের সর্বত্র গু স্থানে গ ও গ স্থানে গু লিখে রেখেছিল।
গুরুপল্লী সমাচারে এই ধরনের সংবাদ প্রায়ই প্রকাশিত হত, প্রায়ই তার উপর ফাজিল ছেলের দল নানাবিধ মন্তব্য লিখে রাখত। সংশ্লিষ্ট মাস্টার মশাইদের মধ্যে কেউ কেউ এতে মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেও পত্রিকার সম্পাদক ও মুদ্রাকরের নাম ও পরিচয় গোপন থাকায় নীরবে টিপ্পনী হজম করতেন, প্রকাশ্যে কিছু বলতেন না।
নিশিকান্ত ছিল আমাদের পত্রিকার নিয়মিত লেখক। প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই সে ব্যঙ্গ কবিতা লিখত, আমরা প্রাধান্য দিয়েই তা প্রকাশ করতাম। নিশিকান্ত একবার গ্রাম্য কবিয়ালদের ছড়ার অনুকরণে গুরুপল্লীনামা শীর্ষক একটি ছড়া লিখেছিল। সেই ছড়া সমাচারে প্রকাশিত হবার পর পত্রিকার পাঠকসংখ্যা বেড়ে গেল। পরবর্তী কালে নিশিকান্তর সেই গুরুপল্লীনামা কিছু পরিবর্তিত আকারে কবিগানের সুর সংযোগে শান্তিনিকেতন আশ্রমের বহু আসরে গীত হয়েছে।
তিন মাস ধরে প্রতিদিন গুরুপল্লী সমাচার পূর্ণোদ্যমে চালিয়ে একটা সামান্য কারণেই পত্রিকার অকাল মৃত্যু ঘটল। সেদিন ছিল বুধবার। এখনকার বাংলা দেশের সেরা পত্রিকাগুলির ছুটির দিনের খোরাক যোগাবার জন্যে রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। সমাচারের ছিল বুধবাসরীয় ক্রোড়পত্র, তাতে থাকত গুরুপল্লীর বালখিল্যদের নানাবিধ রচনা : গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, ভ্রমণকাহিনী। মঙ্গলবার সারারাত আমার কেটে গেল পত্রিকা ছাপাতে অর্থাৎ লেখাগুলি শ্রীঅক্ষরে কপি করতে। ভোরে যথারীতি বাঁশঝাড়ে লটকে দিয়েই বাড়ি এসে টেনে এক ঘুম।
বেলা দশটা নাগাদ করদা হন্তদন্ত হয়ে এসে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে বললেন
এই শিগগির ওঠ। এক কাণ্ড হয়েছে। গোঁসাইজী আমাদের পত্রিকার উপর কী সব মন্তব্য লিখেছেন।
ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছেড়েই ছুটলাম বাঁশঝাড়ের দিকে। গোঁসাইজী মন্তব্য লিখেছেন? গোঁসাইজী আমাদের পাড়ারই বাসিন্দা। আমরা ইস্কুলে তাঁর কাছে বাংলা পড়তাম, পরবর্তী জীবনে কলেজে উঠে পড়েছি বৈষ্ণব সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যে তার অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য সেদিনও আমাদের শ্রদ্ধা ছিল, আজও আছে। গোঁসাইজী মন্তব্য লিখেছেন, আর আমাদের পায় কে!
বাঁশঝাড়ে গিয়ে দেখি গুরুপল্লী সমাচার লাল পেন্সিলের দাগে ক্ষতবিক্ষত। বত্রিশটা ভুল বানান আর পনেরটা শব্দের অপপ্রয়োগের উপর লাল পেন্সিলের ট্যাড়া মেরে পত্রিকার এক-কোনায় মন্তব্য লেখা আছে—
মুদ্রাদোষে পত্রিকাটি কণ্টকাকীর্ণ। যে-বালক ইহা নকল করিয়াছে তাহার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। বাংলা পরীক্ষায় তাহার উত্তীর্ণ হইবার কোন সম্ভাবনাই দেখিতেছি না। মন্তব্যের নিচে স্পষ্টাক্ষরে স্বাক্ষর আছে শ্রীনিতাইবিনোদ গোস্বামী।
পত্রিকা প্রকাশের উৎসাহটা গোঁসাইজী সেদিন এক ফুয়ে নিবিয়ে দিলেন। আজ চালশেধরা চল্লিশের পরপ্রান্তে এসে দেখছি আমার জীবনে গুরুর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছে। শুধু বাংলা পরীক্ষায় কেন, জীবনের সব পরীক্ষায় ফেল মেরে অবশেষে আজ যেখানে এসে পৌঁছেছি, সেখানে চারিদিকে এত আলো তবু আমি অন্ধকারে। লেখক আর হতে পারলাম না, যদিও লেখা নিয়ে ঘাটাঘাটি করা আজ আমার নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। বালক বয়সে যা-ছিল আমাদের নেশা, ভাগ্যচক্রের আবর্তনে আজ পেশায় পরিণত হয়েছে। কঙ্করদা আজ ইংরেজী দৈনিক হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম কর্মী আর আমি আজ বিশ বছর যাবৎ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উপর গুরুবাক্যের অমোঘ সত্য প্রতি সপ্তাহে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে চলেছি।