০৬. সালমা ফ্লোরেসেন্ট বাল্বটা নিভিয়ে দিল

ঘরে ফিরে সালমা ফ্লোরেসেন্ট বাল্বটা নিভিয়ে দিল। টেবিল বাতি জ্বালাল। মর্গানের এনসিয়েন্ট সোসাইটি বইটি নিয়ে বসল। নৃতত্ত্ব ওর। পাঠ্য বিষয় নয়। তবু নৃতত্ত্বের বই পড়তে ওর ভালো লাগে। আদিম মানুষের জীবনধারার মধ্যে ও অকৃত্রিম গন্ধ খুঁজে পায়।

সালমার মনে হয় সভ্যতার দ্রুত উত্থানে মানুষ পেয়েছে অনেক, কিন্তু হারিয়েছেও কম না। ওই জীবনেরও একটা বুনো গন্ধ ছিল। পলিনেশিয়ানরা খুব করে সালমার মন টানে। ওই রকম একটা জীবনের স্বাদ ও যদি পেত? সেই বিখ্যাত লাইনটা ঘুরে ফিরে মনে পড়ে। They know no other God but love. ভালোবাসা ছাড়া ওরা কোনো দেবতাকে চেনে না। এ ভালোবাসা ওদের প্রকৃতির মতো মুক্ত, উদার। সবুজ জীবন আমন্ত্রণ জানায়। কেমন বন্ধনে আবদ্ধ করে। গলা চেপে ধরে না।

পড়তে পড়তে সালমার মাথা নিস্তেজ হয়ে আসে। জানালার বাইরে কী যেন একটা পোকা একটানা ঝিঁঝি করে ডেকে চলেছে। ওর মনে হয় কোনো এক আদিম অরণ্য থেকে ভেসে আসছে দ্রিম দ্রিম ঢোলের শব্দ। হাঁড়িয়া খাওয়া মাতাল মেয়ে-পুরুষ নাচছে। নাচতে নাচতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। দুচোখের পাতায় তখন রাতের আকাশের তারার ফুলঝুরি নেমে আসে। গাছের পাতা একটাও নড়ে না। যদি ওদের ঘুম ভেঙে যায়।

সালমা টেবিলের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। স্বপ্ন দেখে ও যেন এক বিশাল অরণ্যের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পরনে পাখির পালকের রঙিন পোশাক। হাতে তীর-ধনুক। সালমা যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। পথ আর ফুরোয় না। লতানো গাছ নুয়ে পড়ে গায়ের ওপর। বুনো পাখি ডাকে গাছের আগায়। চারদিকে সূর্য-ঝলমল বনানী। সালমার মনে হয় এমন একটা অপূর্ব পৃথিবীর কামনাই ও করছিল। ও সেই পৃথিবীর একটি মেয়ে হয়ে গেছে। ওর চারপাশে ভালোবাসার দেবতারা গান গাইছে। ঐশ্বর্যময় সেই ভালোবাসায় গা ড়ুবিয়ে ও হাঁটছে। আর কিছুই বুঝতে পারে না।

সকালে সাকিবের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙে। ও জানালা দিয়ে কথা বলে।

অ্যাই দিদিভাই।

কিছু বলবি?

আমরা এয়ারপোর্ট যাচ্ছি।

ভালো।

বাবা তোকে অবশ্য জাগাতে নিষেধ করেছিল, তবু আমি না জাগিয়ে পারলাম না।

সালমা কথা না বলে পাশ ফিরে শোয়। মনে মনে ভাবল, বেলা তাহলে অনেক হয়েছে। একটু পর বাবা নীল আকাশে উড়াল দেবে। প্লেন থেকে পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ অদ্ভুত দেখায়। পুবের। জানালা দিয়ে একফালি রোদ আসছে। এক টুকরো সোনালি নদী যেন। অসংখ্য ধুলো কণা ভেসে বেড়াচ্ছে সে রোদের গায়ে।

সালমা ভাবল ওই ধুলোকণার সুন্দর বাংলা নাম আছে। ত্রসরেণু। চমৎকার। শুয়ে শুয়ে রোদ আর ধুলোর কণা দেখল ও। আস্তে আস্তে রোদের সোনালি নদী সরে গেল। সালমা উঠল। হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা খেল। আনুর মা রাঁধছে। জলিল মিয়া বাগানে।

সালমা শাড়ি পাল্টে রাস্তায় নামল। অনেক দিন রুবা বাবির বাসায় যাওয়া হয়নি। লেকের পাড় পর্যন্ত ও ধীরেসুস্থে হেঁটে এলো।

তোর কথাই ভাবছিলাম সালমা।

কী ব্যাপার বলো তো? কেমন গোছগাছ চলছে দেখছি।

তোর ভাই সিলেটে বদলি হয়েছে সালমা। সামনের সোমবার। আমরা রওনা করছি।

তাই নাকি? সালমা কেমন নিঃসঙ্গ বোধ করল।

তোকে আজ সারাদিন আমার সঙ্গে থাকতে হবে সালমা।

না, আজ থাকতে পারব না।

উঁহু, কোনো ওজর-আপত্তি শুনছি না। চলে তো যাচ্ছি। আবার কখন দেখা হবে কে জানে।

দেখা হবারই বা দরকার কী? সারাজীবন ধরে দেখাশোনা হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।

শোনো মেয়ের কথা। তোর মতো বেশি আমি বুঝি না সালমা। তবে লোকের সঙ্গে জড়িয়ে জড়িয়ে না থাকলে আমার ভালো লাগে না।

তাই থেকো।

সালমার কণ্ঠে উদাসীন নিস্পৃহতা। বেশি কথা বলতে ভালো লাগছে না।

তুই বোস সালমা, আমি তরকারিটা নামিয়ে আসি।

সালমা মোড়া টেনে বারান্দার ওপর বসে। ভাবির বড় মেয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়।

সিলেটে অনেক কমলালেবুর বাগান আছে না ফুপু?

হুঁ।

অনেক পাহাড় আছে, ঝরনা আছে। উহ্ কী মজা হবে!

তোর বকবকানি একটু থামা তো রেখা।

সালমা ধমক দেয়। রাগ হয়। এবং একসময় কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। রুবা ভাবি হয়তো খোঁজাখুঁজি করবে। তারপর গাল দেবে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সংসারের ঝামেলায় বেরোতে পারবে না এবং সালমার সঙ্গেও তার দেখা হবে না।

রুবা ভাবির ওখান থেকে সালমা সোজা বাসায় চলে আসে। প্রচণ্ড দুপুর গাছের মাথায়। লেকের পানি শান্ত। নির্জন রাস্তায় দু-একটা গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। আবার সব চুপ। আশপাশের বাড়ির দেয়াল উপচে মাধবীলতা, বোগনভিলার লতা ঝুলে আছে। ঘুম ঘুম লাগে সালমার। ছায়াচ্ছন্ন নীরবতা দেখলেই ওর চোখ জুড়িয়ে আসে। বাগানের কাঠের গেট খোলা। গাড়ি বারান্দায় একটা ড্যাটসান দাঁড়িয়ে আছে। সালমা বুঝল সাব্বির ভাইয়ের বন্ধু এসেছে। রিকশার ভাড়া চুকিয়ে ও ঘরে ঢুকল। হাত-মুখ ধুয়ে খাবার ঘরে এলো। সাকিব আর খেতে বসেছে।

তোর জন্য আমরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি দিদিভাই।

মা মুখটা গম্ভীর করেই বলল, কোথায় গিয়েছিলে?

বাইরে। সালমা প্লেটে ভাত তুলে নেয়।

তুমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছ লিমা। এভাবে ঘোরাফেরা করা ঠিক নয়।

বড় তো কবেই হয়েছি। সেই দশ বছর আগে।

তুমি জানো তোমার জন্য আমাদের ঘুম নেই। কী তোমার ভবিষ্যৎ, কী তোমার পরিণতি কিছুই বুঝতে পারছি না আমরা।

তুমি এখন ধীরেসুস্থে ভাত খাও তো মা।

সালমা একটুও না রেগে কথা বলে। সরষে বাটা দিয়ে ইলিশ মাছ বেঁধেছে আনুর মা। চমৎকার লাগে। ও জানে এ বাড়িতে ওর প্রিয় খাবারগুলো বেশি রান্না হয়। মার নির্দেশ। মাছের কাঁটা বাছায় বেশি। মনোযোগী হবার দরুন সালমা প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। মার চোখের দিকে তাকায় না। বুঝতে পারে মা একটুক্ষণ খাওয়া বন্ধ করে হয়তো কিছু ভাবছে। দীর্ঘশ্বাসের শব্দ পায় ও। তারপর মার হাত আবার চলতে থাকে। কথা বলে না।

জানিস দিদিভাই, বাবা না যাবার সময়ে বলেছে তোর দিকে বেশি করে খেয়াল রাখতে। তোর জন্য বাবার চোখে পানি ছিল।

তুই থাম তো সাকিব। এসব ও সুঝলে কোনো দুঃখই তো ছিল না।

মা ফোঁস করে ওঠে। সালমা চুপ করেই থাকে। কোনো মন্তব্য করে না। মা ওর প্লেটে আরো দু’টুকরো মাছ উঠিয়ে দেয়। সালমা আপত্তি না জানিয়ে খায়। ও আজ খুব আস্তে আস্তে খায়। মার খাওয়া হলে মা উঠে চলে যায়। সাকিব একটুক্ষণ উসখুস করে আবার বলে, বাবার জন্য তোর মন খারাপ লাগছে না দিদিভাই?

মন খারাপ আবার কিসের?

আমার খুব খারাপ লাগছে। বাবা তোকে যা আদর করে তার এক কণাও যদি আমাকে করত…

সাকিব মুখ নিচু করে। আর কিছু বলতে পারে না। সালমা ভাবল, বাবার কান্নায় সাকিব আজ বিচলিত হয়ে গেছে। বাবা-মার অতিরিক্ত আদর ওকে নষ্ট করছে। ও নিজের করে কিছু ভাবতে পারে না। নরম নরম চেহারা বলে সবাই ভাবে, ও এখনো বুঝি সেই কিশোরই রয়ে গেছে। ওর আচরণের বেশিরভাগটাই কেমন যেন মেয়েলি। ঋজু বলিষ্ঠ দীপ্ত পুরুষের ছায়া খুঁজে ফেরে সালমা। সাকিবের মধ্যে তার এক কণাও নেই। ও হয়তো কোনোদিনই সে ধরনের পুরুষ হবে না, যে পুরুষত্বের দীপ্তি চমকিত না করে, স্থির করে। সেই টেলিফোনের কণ্ঠ শুনে সালমা তেমনি পৌরুষের আঁচ পেয়েছিল। কিন্তু সামনাসামনি আর দেখা হলো না। সাকিব মুখ নিচু করেই ফিরনি খেল। সালমার দিকে তাকাল না। সালমাও কিছু না বলে উঠে এলো।

মুখে এলাচ নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকল সালমা। শুয়ে শুয়ে একগাদা পত্রিকার ওপর চোখ বুলাল। একটা বই টেনে কয়েক পৃষ্ঠা পড়ল। কিন্তু খুব মনোযোগ দিতে পারল না। মনটা উড়ু উড় করছে। সেজন্য কোথাও স্থিরচিত্ত হতে ভালো লাগে না। মনটা অন্য কোথাও অন্য কিছু খুঁজে ফেরে। অনেকদিন ধরে সেই প্রজাপতিটা আর আসে না। সাদা ফকফকে দেয়াল নিরাভরণ নারীর মুখের মতো দেখায়। অনেকদিন রকিব আর আসে না। একবার খোঁজও নেয়নি। টেলিফোনও করেনি। জোর করে হাসল সালমা। মাস দুই যাবৎ ও কোনো ড্রাগস খায়নি। নেশা ওকে কাবু করতে পারেনি। সেই মামদো ভূত ও অতিক্রম করতে পেরেছে। সেই টেলিফোনের বন্ধু টেলিফোন করেনি। আর কোনোদিন করবে কি না ও তা জানে না। সবকিছু মিলিয়ে ভাবতে সালমার বেশ মজা লাগল। ক্রমাগত ও সেই নির্জন দ্বীপের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আর তখনই বুনো আদিম উল্লাস সালমার প্রতি স্নায়ুতে আবাল খেলায় মেতে উঠল।

আপামণি।

কী জলিল ভাই?

দেখবে আস।

কী?

আস না।

সালমা জলিল মিয়ার পিছু পিছু বাড়ির পেছনের বাগানে এলো। অনেকদিন এদিকটায় আসা হয়নি। কেমন একটা সোঁদা গন্ধ সালমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াল। ও চারদিকে তাকাল। হ্যাঁ ঠিকই, ঘাস থেকে আরম্ভ করে গাছের পাতা সবকিছু নতুন নতুন লাগছে। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিল ও। মনে হলো নতুন বাতাস। সতেজ, ফুরফুরে, আনকোরা। জলিল মিয়া খরগোশের বাক্সটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

এই দেখো।

উফ বাচ্চা হয়েছে? কবে হলো, আমাকে এতদিন বলেনি কেন?

সালমা বাক্সের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ছোট ছোট বাচ্চা দুটো কোলে নিল। কী তুলতুলে শরীর! এত নরম কোনো জীবন্ত জিনিস ও আগে কখনো ছুঁয়ে দেখেনি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। ওর আর আশ মেটে না।

দেখো জলিল ভাই, কী সুন্দর! কবে হলো?

গতকাল।

আমাকে আগে বলোনি কেন?

তুমি এদিক-ওদিক যাও, এজন্য আর বলা হয়নি।

কিন্তু, কিন্তু জলিল ভাই আমার সুখ কই?

তোমার সুখ আজ সকালে মরে গেছে।

অ।

সালমার মুখ দিয়ে দুঃখ-ধ্বনি বের হয়। ও এতক্ষণে বাক্সটার দিকে ভালো করে তাকায়। মনে হয় বাক্সটার সমস্ত পরিবেশ বদলে গেছে। বাক্সজুড়ে ময়লা-নোংরা। দুধের আর পানির বাটি উল্টে পড়ে আছে। দুঃখ এক কোনায় চুপচাপ বসে ঝিমুচ্ছে। অন্যদিন হলে ও দৌড়ে সালমার কোলে এসে উঠত। আজ কোনোকিছুতেই আগ্রহ নেই। সালমার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখছে না।

বাচ্চা হবার পরই তোমার ওই খরগোশটা কেমন জানি নেতিয়ে পড়েছিল আপামণি। আজ সকালে এসে দেখি মরে পড়ে আছে। আমি দূরে ফেলে দিয়েছি। জানি, ওটা দেখলে তোমার মন আরো খারাপ। হবে।

সালমা একটাও কথা বলতে পারে না। ঘুরেফিরে খরগোশ দুটোর কথাই মনে হয়। অনেক নির্জন সময়ে ওদের খেলা দেখে ওর সময়। কেটেছে। এখন একটা নেই। তার বদলে দুটো বাচ্চা দিয়ে গেছে। সালমা বাচ্চা দুটো বাক্সের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়।

তোমার চিন্তা নেই আপামণি, ওই পুরুষটার জন্য আর একটা জোড় খুঁজে নিয়ে আসব। সালমা বাক্স বন্ধ করতে গিয়ে জলিল মিয়ার মুখের দিকে তাকাল।

বাচ্চাগুলোর যত্ন নেওয়া দরকার। ওগুলো আবার যেন মরে না যায়।

সালমা উঠে হাঁটতে আরম্ভ করে, কেবলই মনে হয় একটা কথা। ঘূর্ণিতে পড়া পাতার মতো কথাটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। সুখ মরে গেছে। আজ সকালে সুখ মরে গেছে। কখনো কখনো কারো কারো সুখ মরে যায়। সুখ পড়ে থাকে মুখ থুবড়ে। সালমা একবার আঙুরলতার পাশে দাঁড়াল। গাছে ছোট ছোট ফল হয়েছে। ছুয়ে দেখল ও। না কোথাও দাঁড়িয়ে স্বস্তি পাচ্ছে না।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এলো।

নাসিমা ওকে দেখে হাসল, তোর কথাই ভাবছি সালমা।

কী ব্যাপার, সবকিছু নতুন লাগছে নাসিমা’পা?

হ্যাঁ, সবকিছুই নতুন করে ফেলেছি।

নাসিমা মিটমিটি হাসে। রজনীগন্ধার বড় ভঁটার ওপর মুখটা নামিয়ে রাখে। সালমা অবাক হয়। নাসিমা আজ যেন মনপ্রাণ ঢেলে সবকিছু সাজিয়েছে। টেবিলক্লথ, সোফার কভার, পর্দা, ছাইদানি, ফ্লাওয়ার ভাস সবকিছু নতুন। এমনকি ফুল সাজানোটাও। নাসিমা এর আগে কখনো। এমন করে ফুল সাজায়নি।

তুই অবাক হয়েছিস না সালমা?

শুধু কী অবাক? আমি কিছু বুঝতে পারছি না নাসিমা’পা।

আজ আমাদের বিয়ে।

বিয়ে!

সালমা তিড়িং করে লাফ দিয়ে ওঠে। নাসিমাকে জড়িয়ে ধরে একটা ঘুরপাক খায়।

সাব্বির ভাই কই?

ও বেরিয়েছে কিছু কেনাকাটা করতে।

কখন বিয়ে?

সন্ধ্যায়।

কে কে আসবে?

বেশি কেউ নয়। আমাদের কয়েকজন বন্ধুবান্ধব।

আজ তোমাকে আমি সাজিয়ে দেব নাসিমা’পা?

দিস।

নাসিমা অন্য কাজে মন দেয়। সালমা সোফার ওপর এসে বসে। ওর দৃষ্টি সরে সরে যায়। কখনো ফুলদানিতে, কখনো জানালার পর্দায় অথবা কখনো সোফার পিঠে সুতো দিয়ে ফুটিয়ে তোলা ফুলের ওপর। সালমার কেমন অস্থির লাগে। বারে বারে কর্মরত নাসিমাকেই দেখে। নাসিমার গাল দুটো ডালিমের মতো টকটক করছে। এত রং কোথা থেকে এলো! নাসিমাকে সুখী দেখাচ্ছে।

তোমার এখন কেমন লাগছে নাসিমা’পা?

ভেবে দেখিনি তো।

ভেবে দেখো না একবার?

দাঁড়া দেখছি। নাসিমা এক মুহূর্ত চিন্তা করে। এখন আমার নিজেকে খুব অহংকারী মনে হচ্ছে সালমা।

আচ্ছা নাসিমা’পা বিয়ের কি তোমার খুব দরকার ছিল?

ছিল।

কেন?

আমি মা হতে চাই সালমা। ওই শিশুর জন্য আমার জীবনের একটা পরিণতি দরকার।

সালমার মনে হলো নাসিমা’পাকে আজ ভীষণ লাজুক লাজুক দেখাচ্ছে। পিঠের ওপর ফাঁপানো চুলের গোছা উপচে পড়া খুশির মতো মাতোয়ারা। সালমা দৃষ্টি ফেরাতে পারে না। নাসিমা একসময় মুখ তুলে জিজ্ঞেস করে, কীরে?

কিছু না।

সালমা দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। লজ্জাও লাগে। নাসিমা’পা কী ভাবল কে জানে! নাসিমা জীবনের কথা নতুন করে ভাবছে। এক মেরু থেকে আর এক মেরুতে যাত্রা শুরু করেছে। নাসিমার সামনে এখন অনাগত সন্তানের ছবি। তাহলে নাসিমা’পা কি তার ব্যর্থতাকে অতিক্রম করে চলল?

নাসিমা’পা।

বল।

তোমার এই নতুন ভাবনা দিয়ে তুমি কি নিজেকে অতিক্রম করলে, তোমার পরাজয়?

আমি নিজেকে অতিক্রম করলাম। জীবনকে বাদ দিয়ে সুখ খোঁজা যায় না সালমা। অনেক তো দেখলাম, আর কত? পরাজয়ের কথা আমি। ভাবতে পারি না। পরাজিত যারা তারা পিছু হটে। আমি তো পিছু হটিনি। আমি তো সমান শক্তি নিয়ে নতুনকে গ্রহণ করতে যাচ্ছি। সে পথেও আমার জন্য অনেক গন্ধ ছড়ানো গোলাপ আছে।

সালমা হাসল।

তুমি অনেক পারো।

নাসিমা হেসে কাজে মন দিল। বুড়ি ঝি চা দিয়ে গেল সালমাকে। জেসমিন টি। চমৎকার গন্ধ আসছে।

তোমার চাতেও আজ অন্য স্বাদ নাসিমা’পা।

হবেই তো। সব ঢেলে সাজাচ্ছি যে!

হ্যাঁ, এমন জেসমিন টির মতো সুগন্ধময় হও তুমি।

বাব্বা তুই তো বেশ গুছিয়ে-গুছিয়ে কথা শুরু করলি সালমা।

সালমা একটু একটু করে চা খায়। গন্ধটা বেশ আরামদায়ক। নাসিমা টেলিফোনে কাকে যেন আসতে বলছে। তখুনি একগাদা প্যাকেট হাতে সাব্বির ঢোকে।

এই যে সালমা কী খবর?

কগ্রাচুলেশনস সাব্বির ভাই।

হুঁ, তুমি দেখি আগে আগে সব খবর নিয়ে বসে আছ। আমার জন্য কিছু বাকি রাখোনি।

এমন সুখবর কি কেউ বাকি রাখতে পারে সাব্বির ভাই?

তাই তো দেখো নাসিমা, সালমা কিন্তু খুব চালাক হয়ে গেছে। শুধু চালাক নয়, বাকপটুও হয়েছে। দেখো তো সালমা এই কাতানটা তোমার আপাকে কেমন মানাবে?

আমি কেন নাসিমা’পাকেই জিজ্ঞেস করুন না?

ওর কি এখন পছন্দের সময় আছে? ও তো এখন যেটা দেখবে সেটাই পছন্দ করবে। কী বলো নাসিমা?

বেশি বাজে বোকো না। তোমার বন্ধু হাশেমকে আসতে বলা হয়নি?

তুমি বলে দাও। টেলিফোন গাইডের উল্টো পিঠে নাম্বারটা আছে দেখো।

সাব্বির হাত-পা ছড়িয়ে সোফায় এলিয়ে পড়ে। বুড়ি ঝি চা দিয়ে যায়। গুনগুনিয়ে গান গায় সাব্বির। সালমার মনে হয় এখানে থাকলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে ওর। এদের কারোরই নাড়ির সূত্র ধরতে পারছে না ও। এরা আজ অন্য জগতের বাসিন্দা।

মুখটা অমন গম্ভীর করে বসে রয়েছে কেন সালমা?

কই? না। সালমা জোর করে হাসার চেষ্টা করে।

উঁহু তোমার মনটা আজ খারাপ বোধহয়?

মোটই না। সালমা হেসে ওঠে।

বেশ তাহলে গান বাজাও।

সালমা চেঞ্জার চালায়। সাব্বির জুতোসুদ্ধ টেবিলের ওপর পা উঠিয়ে দেয়। পা নাচায় আর চা খায়। পা নাচায় আর গান শোনে।

টেলিফোন করা শেষ করে নাসিমা চেঁচিয়ে ওঠে, তুমি আমার নতুন টেবিলক্লথের ওপর পা তুলে দিয়েছ সাব্বির?

আমার এই পা জোড়ার চাইতে তোমার টেবিলক্লথটাই কি বড় নাসিমা?

কথা তো সেটা নয়। কথা হলো, কেতাদুরস্ত থাকা।

বেশ এই পা নামাচ্ছি। তবে জেনে রেখো নাসিমা, আমার এই খ্যাপামি কিন্তু তোমার সাজানো গোলাপ বনে মাতাল বাতাসের মতো।

তা কি আর জানি না।

নাসিমা সাব্বিরের আনা প্যাকেটগুলো উঠিয়ে নিয়ে শোবার ঘরে চলে যায়। সালমা জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। গান শুনেও শোনে না। মনে ঝড়। আজ ওদের এত আনন্দ কিসের? এর উৎস কোথায়? ভোগ? তা কেন হবে? দুজনেই তো একত্রে বাস করছে। সেটায় তো কোনো বাধা ছিল না। সামাজিক স্বীকৃতি? সেটার জন্য তো ওদের খুব মাথাব্যথা নেই। তবে কী? কিসের জন্য ওদের এত রঙের ঝরনা বইছে? সালমা কিছুতেই উত্তর খুঁজে পায় না। বাইরে আলো কমে আসছে। আমগাছের মাথার ওপর মরা রোদ। সময় এগোচেছ। সালমার বুক কাঁপে। আর কিছুক্ষণ পর–আর কিছুক্ষণ পর। না থাক। দূরে এক সারি সাদা বক উড়ে যায়। আকাশে ঘেঁড়া মেঘের দল।

অ্যাই সালমা, তুমি কী ঘুমোচ্ছ নাকি?

কী যে বলেন সাব্বির ভাই!

সালমা হেসে সহজ হবার চেষ্টা করে।

আপনি আজকে একদম ছেলেমানুষ হয়ে গেছেন।

তাই নাকি?

সাব্বির হেসে ওঠে।

অ্যাই নাসিমা, দেখো সালমা আজ কেমন মুরব্বি হয়ে গেছে।

সালমা তুই আমার এখানে চলে আয়।

সেই ভালো।

সালমা শোবার ঘরে যায়। নাসিমা কাপড়, গয়না, প্রসাধনী সব বের করে খাটের ওপর সাজিয়েছে। শোবার ঘরের দেয়ালে টাঙানো পেইন্টিংটা পর্যন্ত বদলিয়েছে নাসিমা। খাটজুড়ে ফুলের মালা আর। ফুলের পাপড়ি ছড়ানো।

সালমার মনে রকিবের চিন্তা ঘুরপাক খায়। রকিব আর কোনোদিন ওর খোঁজ করেনি। সালমার মনে হয় ওর কোনো ভালোবাসার জগৎ নেই। ভালোবাসার অধিকারকে অস্বীকার করতে গিয়ে ও ভালোবাসা হারিয়েছে।

তুই বোস সালমা, আমি আসি।

নাসিমা ড্রইংরুমে যায়। সালমা শাড়ি, গয়না, প্রসাধনীর দিকে অর্থহীন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে।

সন্ধ্যা ঘনায়। একে একে বন্ধুরা আসে ওদের ছোট বাসায় ঠাসাঠাসি করে লোকে। কাজি আসে। বিয়ে পড়ানো হয়ে যায়। সালমা মনের মতো করে নাসিমাকে সাজায়। মনে হয়, একটা ইচ্ছের পাখির গায়ে পালক পরাচ্ছে ও। সেই ইচ্ছের পাখি নাসিমার লাল বেনারসি শাড়ির মতো উজ্জ্বল ঐশ্বর্যময়। চন্দনের গন্ধ সালমাকে আবিষ্ট করে রাখে। রাতের খাওয়া খেয়ে অতিথিরা চলে যায়। রাত বেশি হয়নি। বাড়ি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সালমা ছটফট করে। একসময় ওদের কাছে বিদায় নিয়ে ও নিচে নেমে আসে। প্রতিটি সিঁড়ির ধাপ এক একটি দীর্ঘ মরুভূমির মতো মনে হয় সালমার। মনে হয় ভয়ানক এক লু হাওয়ার ভেতর দিয়ে পেরিয়ে এলো ও। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, বিধ্বস্ত। বারান্দায় মা আর সাকিব বসেছিল। আজ ওদের কোনো ভয় পেল না সালমা। মার পাশের চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়ল। কৌতূহলী সাকিবই প্রশ্নটা করে আগে, ওপরতলায় কী হলো দিদিভাই?

আজ ওদের বিয়ে হলো।

বিয়ে।

মার বিস্ফারিত দৃষ্টি সালমার মুখের ওপর এসে পড়ে।

বিয়েই যখন হলো তখন এত খেমটা নাচের কী দরকার ছিল?

মা বিচিত্র মুখভঙ্গি করে গুহ করে। সালমা চুপচাপই থাকে। বলবার কী আছে! মার দৃষ্টিভঙ্গিই আলাদা। যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা জাতীয় মনোভাবে কারো সপক্ষে কিছু বলা শোভন নয়। সালমা শব্দ করে হাই ওঠায়।

ঘুমুতে যাও লিমা।

হঠাৎ করেই ও প্রশ্ন করে, তোমরা কি আমার জন্যই বসেছিলে?

নয়তো কী? তোকে যে আমি দোতলায় যেতে দেখেছি দিদিভাই। নইলে তো মা আমাকে বাইরে খুঁজতে পাঠাচ্ছিল।

অ।

সালমা ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে। সাকিবও উঠে চলে যায়। মা বসে থাকে। রান্নাঘরে আনুর মার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মা বসে থাকবে। সালমা দরজা বন্ধ করে দেয়। লাইট অফ করে। তারপর শুয়ে পড়ে। বাতাসে নেটের মশারি কাপে। আমড়া গাছে লক্ষ্মীপেঁচা ডাকে। সালমার ঘুম আসে না। আপ্রাণ চেষ্টা করে, তবু ঘুম আসে না। বৃষ্টির স্রোতের মতো দোতলার ঘরটা ভেসে যায়। এক টুকরো ছবি হয়ে যায়। ওরা এখন কী করছে? সালমা ভাবতে চাইল। বালিশের নিচে থেকে হাতঘড়িটা দেখতে চেষ্টা করল; পারল না। চাদের যে তেরছা আলো ঘরে এসে ঢুকেছে তাতে ঘড়ি দেখা যায় না। বাগানের হাস্নাহেনা গাছ থেকে মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। সালমা জোরে জোরে শ্বাস নিল। না ঠিক তেমন গন্ধ নয়, যে গন্ধ ওদের বিছানায় ছড়ানো ফুলের ভেতর থেকে উঠে আসছিল। সে গন্ধটাও ছিল নতুন। ঘুরেফিরে সালমার মনের ভেতর একরাশ রং কখনো দলা হয়ে, কখনো টুকরো হয়ে ভাসতে লাগল। দোতলার ঘর দুটি যেন রঙের আকাশ হয়ে গেল। সালমা আবার ভাবল, ওরা এখন কী করছে? গান শুনছে না শুয়ে শুয়ে গল্প করছে? নাকি… সালমা আর ভাবতে পারল না। অন্ধকার ঘরে একা একা লজ্জা পেল। লজ্জায় বালিশে মুখ গুজে রইল। মনে হলো, কোনোকিছুই তো ওদের জন্য নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবু ওদের চারপাশে এত বর্ণ কেন? ওরাই বা কেন এত বর্ণোচ্ছল? দোতলায় শব্দ হলো। হয়তো চেয়ার টানার। সালমা কান খাড়া করল। না আর কোনো শব্দ নেই। আবার চারদিক নিঝুম। সালমা বিছানা ছেড়ে উঠল। টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ে মোম বের করে জ্বালল। ঘড়ি দেখল। রাত একটা। বেশ রাত হয়েছে অথচ ঘুম আসছে না। বাথরুমে ঢুকে মুখ হাতে পানি দিল। মোমটা বাতাসে কাঁপছে। সালমা কখনো কখনো লাইটের বদলে মোম জ্বালায়। চোখ ধাধানো আলো ওর ভালো লাগে না। অনেক রাতে সুইচ টিপে লাইট জ্বালালে মনে হয় সূক্ষ্ম অনুভূতি থেকে ও আলগা হয়ে গেছে।

সালমা আবার বিছানায় শুলো। মোমটা নেভাল না। বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে ওটা একসময় নিভে যাবে। যতক্ষণ নিভবে না ততক্ষণ সারা ঘরে একটা লম্বা ছায়া এপাশ-ওপাশ করবে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে অনেক সময় যায়। তবু ঘুম আসে না। এখন কী করছে ওরা। ওরা কি রঙের সাগরে পানসী ভাসিয়েছে? হঠাৎ সালমার চোখের সামনে থেকে দ্রুত অন্ধকার সরতে থাকে। অনবরত থাকে। এ সত্যটা একবারও সালমার মনে হয়নি। আশ্চর্য, কী করে ভুলে গেল ও! আজ রাতে ওরা বীজ বুনবে। উত্তেজনায় সালমা বিছানায় উঠে বসে। বীজ বোনার জন্যই তো ওদের এত আয়োজন। ওদের চারপাশে এত রং। বীজ বোনার জন্যই তো ওদের জীবনে রঙের আবির্ভাব। ওদের চোখে এখন ফসলের স্বপ্ন। ফসলের সোনালি ঐশ্বর্য। এতদিন ওরা যা করেছে তাতে যত আনন্দই থাকুক সৃষ্টির উল্লাস ছিল না। সৃষ্টি আজ ওদের কাছে মহিমান্বিত হবে। ওদের ফসলের জমি বৃষ্টির তোড়ে ভেসে যাচ্ছে।

বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে মোমটা নিভে যায়। সারা ঘরে জমাট অন্ধকার ছড়িয়ে থাকে। সালমা শুয়ে পড়ে। উত্তেজনা শান্ত হয়ে গেছে। প্রশ্নের উত্তর মিলেছে। মূল সূত্রটা ধরতে পারছে না বলে এত গড়বড়। ওদের সারাদিনের আচরণের একটা অর্থ খুঁজে পায় সালমা অথচ এটা ওর আগেই মানে হওয়া উচিত ছিল। শুয়ে শুয়ে নিজের আঙুল কামড়াল। যে সত্যের জন্য জীবনের সমস্ত অর্থটাই পাল্টে নিল ওরা সেটাই সালমার মগজে ঢুকছে অনেক পরে। তবু একটা স্বস্তি পেল ও। কিছু প্রশান্তিও যেন।

আর তখনই রোদ পোড়া-মাঠে আকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির মতো ঘুমের ধারা নামল। আর কিছুই জানল না সালমা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *