৬. সায়েন্টিস্ট যখন ভূয়া
একদিন বিকেলবেলা নান্টু এসে বল্টুকে বলল, “বল্টু ভাইয়া, আমেরিকা থেকে সবুজ ভাইয়া আসবে।”
বল্টু একটা লোহার ওপর তিরিশ গেজের এনামেল কোটেড তার প্যাচাচ্ছিল। সে প্যাঁচটা ধরে রেখে বলল, “সবুজ ভাইয়া কে?”
“একজন সায়েন্টিস্ট। আমাদের একরকমের ভাই।” বল্টু প্যাচানো থামিয়ে বলল, “সত্যিকারের সায়েন্টিস্ট?”
“হ্যাঁ।”
“আমি কোনো দিন সত্যিকারের সায়েন্টিস্ট দেখি নাই। তোর সবুজ ভাইয়া এলে আমাকে ডাকিস, আমি দেখতে যাব।”
.
নান্টু কয়েক দিন পর বল্টুকে খবর দিল যে সবুজ ভাইয়া এসেছে, আর বল্টু তখন তাকে দেখতে গেল। বিজ্ঞান নিয়ে তার কয়েকটা প্রশ্ন ছিল। কেউ সেগুলোর উত্তর দিতে পারছে না, নান্টুর সবুজ ভাইয়াকে সেগুলো জিজ্ঞেস করা যাবে। নান্টুর বাসায় গিয়ে দেখল, চশমা পরা একজন মানুষ টেবিলের ওপর পা তুলে টেলিভিশন দেখছে। বল্টু কখনো টেলিভিশন দেখে না, তার টেলিভিশন দেখতে ভালোই লাগে না। টেলিভিশনে তার সবচেয়ে খারাপ লাগে হিন্দি সিনেমা। সেখানে হয় মোটা মোটা মানুষ একজন আরেকজনকে পেটাচ্ছে, না হলে মেয়েরা আর ছেলেরা একসঙ্গে কোমর দুলিয়ে নাচছে। সবুজ ভাইয়া চোখ বড় বড় করে টেলিভিশনে একটা হিন্দি সিনেমা দেখছে বলে বল্টুর খুবই মন খারাপ হলো। একজন সায়েন্টিস্ট হলে তার যে রকম এলোমেলো চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ভুসভুসে টি-শার্ট আর রং ওঠা জিনসের প্যান্ট থাকা উচিত–সে রকম কিছু নাই। গায়ের রং ফরসা, মুখটা তেলতেলে, চুলগুলো খুব ভালো করে আঁচড়ে সমান করে রাখা।
নান্টু বলল, “সবুজ ভাইয়া, এই হচ্ছে বল্টু ভাইয়া।”
“বল্টু!” সবুজ ভাইয়া হা হা করে হাসতে লাগল, “বল্টু আবার কারও নাম হয় নাকি! কদিন পর শুনব, ছেলের নাম রেখে ফেলেছে ইস্কু!”
কথাটা শুনে বল্টুর খুব রাগ হলো, কিন্তু সে কোনো কথা বলল না। বড়দের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে হয় না, সেটা সে অনেক আগে আবিষ্কার করেছে। সেও তো বলতে পারত, “সবুজ আবার কারো নাম হয় নাকী? কয়দিন পরে শুনব ছেলের নাম রেখেছে বেগুনি!”
মুনিয়া কাছেই ছিল, সে বলল, “আমাদের বল্টু অনেক বড় সায়েন্টিস্ট!”
“তাই নাকি?” সবুজ ভাইয়া চোখ কপালে তুলে বলল, “বল্টু মিয়া, এখন পর্যন্ত কী কী আবিষ্কার করেছ? কী রকম করে নাট-বল্টু টাইট করতে হয়? বেশি টাইট করে আবার প্যাঁচ কেটে যায় নাই তো?” কথা শেষ না করেই সবুজ ভাইয়া হা হা করে হাসতে লাগল। কোনো মানুষ হাসলে তাকে দেখতে ভালো লাগে, কিন্তু সবুজ ভাইয়া যখন হাসতে শুরু করল তখন তাকে কেন জানি দেখতে আরও ভয়ঙ্কর দেখাতে লাগল। ভেতরে ভেতরে বল্টুর রাগ উঠছিল, কিন্তু সে কিছু বলল না।
নান্টু জিজ্ঞেস করল, “সবুজ ভাইয়া, আপনি কী কী আবিষ্কার করেছেন?”
সবুজ ভাইয়া হঠাৎ মুখটা গম্ভীর করে বলল, “তোমরা সেগুলো বুঝবে না।”
মুনিয়া বলল, “তুমি বলে দেখো, সবুজ ভাইয়া। আমাদের বল্টু বুঝবে! সে থিওরি অব রিলেটিভিটির ওপর গবেষণা করেছে। তাই না, বল্টু?”
বল্টু একটু লজ্জা পেল, সেই থিওরি অব রিলেটিভিটির কথাটা বললে এখন মহা লজ্জার ব্যাপার হবে। মুনিয়া আপা অবশ্য আর কিছু বলল না। সবুজ ভাইয়া বলল, “তোমরা ছোট বাচ্চা, রিসার্চের কী বুঝবে? সেমিকন্ডাক্টরের নাম শুনেছ?”
বল্টু মাথা নাড়ল, বলল, “শুনেছি।”
সবুজ ভাইয়া একটু থতমত খেয়ে বলল, “নাম হয়তো শুনেছ কিন্তু সেটা কীভাবে কাজ করে নিশ্চয়ই জানো না।”
বল্টু বলল, “জানি।”
সবুজ ভাইয়া কেন জানি রেগে উঠল, বলল, “কী জানো?”
“কেমন করে ট্রানজিস্টার বানায়, ডায়োড বানায়।”
“এন-টাইপ, পি-টাইপ শুনেছ?”
বল্টু আবার মাথা নাড়ল, বলল, “শুনেছি। এনপি দিয়ে তৈরি হয় ডায়োড। এনপিএন আর পিএনপি দিয়ে হয় ট্রানজিস্টার। সিলিকন হচ্ছে। সেমিকন্ডাক্টর, ফসফরাস দিয়ে বানায় এন-টাইপ, বোরন দিয়ে বানায় পি টাইপ …”
মুনিয়া আনন্দে হাততালি দিয়ে বলল, “দেখেছ, সবুজ ভাইয়া, দেখেছ? আমি বলেছিলাম না, আমাদের বল্টু বিরাট সায়েন্টিস্ট!”
সবুজ ভাইয়া কিন্তু মুনিয়ার মতো খুশি হলো না, উল্টো কেমন জানি রেগে গেল। তাকে দেখে মনে হতে লাগল, বল্টু যেন তাকে অপমান করে ফেলেছে। বল্টুর মতো এইটুকুন একটা ছেলে যে টুকটুক করে সবকিছু বলে ফেলছে, এটা দেখে যে মজা লাগতে পারে সবুজ ভাইয়া সেটা বুঝতেই পারল না, বরং গম্ভীর মুখে বলল, “দেখো মুনিয়া, সায়েন্স বা বিজ্ঞান জিনিসটা আসলে ঠাট্টা-তামাশার জিনিস না। এটা খুব সিরিয়াস ব্যাপার। বিজ্ঞানের দুই-চারটা টার্ম জেনে গেলেই বিজ্ঞান জানা হয় না। বিজ্ঞান জানতে হলে তার ভেতরে যেতে হয়। তার জন্যে দরকার ম্যাথমেটিকস …”
মুনিয়া বলল, “সবুজ ভাইয়া, আমাদের বল্টুর বয়স মাত্র আট! তাকে আরও একটু বড় হতে দাও। সে ম্যাথমেটিকস শিখবে। ক্যালকুলাস শিখবে। জিওমেট্রি শিখবে। তাই না, বল্টু?”
বল্টু কিছু বলার আগে নান্টু মাথা নেড়ে বলল, “বল্টু ভাইয়া আরও কঠিন কঠিন জিনিস শিখবে।”
সবুজ ভাইয়া কেন জানি আরেকটু রেগে উঠল, বলল, “আমি তোমাদের ব্যাপারটা বোঝাতে পারি নাই মনে হচ্ছে। সায়েন্স মানে কিছু জিনিসের নাম মুখস্থ করা না। সায়েন্স মানে হচ্ছে অ্যাটিচ্যুড বা দৃষ্টিভঙ্গি। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। আট বছরের একটা বাচ্চার সেটা হয় না।”
মুনিয়া বলল, “হয় সবুজ ভাইয়া, হয়! তুমি আমাদের বল্টুকে চেনো নাই।”
সবুজ ভাইয়া এবার মুনিয়ার ওপর বিরক্ত হয়ে উঠল, বলল, “তোমাদের সাথে কথা বলা যায় না। কোনো জিনিস তোমরা বুঝতে চাও না, খালি তর্ক কর।” তারপর মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে রাগ-রাগ চোখে বলল, “তুমি কি বিজ্ঞান পড়ো ঠিক করে?”
মুনিয়া ভয়ে ভয়ে বলল, “পড়ি।”
“যাও, তোমার বিজ্ঞান বইটা নিয়ে এসো। দেখি, তুমি কতটুকু বিজ্ঞান জানো?”
ঠিক সে সময় নান্টুর আম্মু বাইরের ঘরে এলেন। সবাইকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “কী নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে?”
সবুজ ভাইয়া বলল, “মুনিয়ার বিজ্ঞান পড়া নিয়ে কথা বলছিলাম, আন্টি!”
নান্টুর আম্মুর মুখটা খুশি-খুশি হয়ে উঠল। সবুজ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ বাবা, তুমি যে কয় দিন আছ এই ছেলেমেয়ের লেখাপড়াটা একটু দেখে দেখি। এত ফাঁকিবাজ হয়েছে যে পড়তেই চায়
সবুজ ভাইয়া মুখটাকে কঠিন করে বলল, “আপনি চিন্তা করবেন না। আন্টি, আমি দেখব!” তারপর মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “মুনিয়া, যাও তোমার বইটা নিয়ে আসো!”
মুনিয়া মুখটা কালো করে তার বই আনতে গেল।
.
দুই দিন পর নান্টু এসে বল্টুকে খবর দিল যে সবুজ ভাইয়ার যন্ত্রণা খুব বেড়েছে। বল্টু বলল, “আমি যেদিন দেখলাম সবুজ ভাইয়া হিন্দি সিনেমা দেখছে, তখনই বুঝেছিলাম সমস্যা আছে।”
নান্টু বলল, “বড় সমস্যা।” বল্টু জিজ্ঞেস করল, “কী করে সবুজ ভাইয়া?
নান্টু বলল, “খালি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। আর প্রশ্নের উত্তর না পারলে শুধু টিটকারি মারে।”
“আর কী করে?”
“খালি আমেরিকার গল্প করে।”
“আর কী করে?”
“সবকিছুকে গালি দেয়।”
“আর কী করে?”
“টেলিফোনে কথা বলে। “আর কী করে?”
“আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ায়।”
বল্টু বলল, “সবুজ ভাইয়া ভুয়া সায়েন্টিস্ট।”
“কেন?”
“আসল সায়েন্টিস্ট কোনো দিন চুল আঁচড়ায় না। আসল সায়েন্টিস্টদের চুল সব সময় আউলাঝাউলা থাকে। আইনস্টাইনের চুল দেখিস নাই?”
নান্টু মাথা নাড়ল, সে আইনস্টাইনের চুল দেখেছে। কেউ বল্টুর ঘরে আসবে আর আইনস্টাইনের ছবি দেখবে না, সেটা তো হতে পারে না।
নান্টু বলল, “বল্টু ভাইয়া?”
“কী।”
“তুমি কি সবুজ ভাইয়াকে কিছু করতে পারবে, যেন আমাকে আর আপুকে ডিস্টার্ব না দেয়।”
বল্টু কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “একটা ইনডাকশন কয়েল বানাচ্ছি। এটা শেষ হলে ইলেকট্রিক শক দিতে পারি।”
“সেটা কবে শেষ হবে?”
“দু-এক দিন লাগবে।” নান্টু একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “অ।”
নান্টু চলে যাওয়ার পর বল্টু অনেকক্ষণ ঘরের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় হেঁটে হেঁটে চিন্তা করল। নান্টু আর মুনিয়াকে সবুজ ভাইয়া এভাবে যন্ত্রণা দিচ্ছে। যদি সে কিছু একটা করতে না পারে তাহলে কেমন করে হবে? বল্টু চিন্তা করে করে শেষ পর্যন্ত একটা পরিকল্পনা করল। পরিকল্পনা করে সেদিন সন্ধ্যাবেলা সে নান্টুদের বাসায় রওনা দিল। সঙ্গে নিল একটা ব্যাগ। ব্যাগে কিছু দরকারি জিনিসপত্র।
নান্টুদের বাসায় গিয়ে দেখল, পড়ার টেবিলে মুনিয়া আর নান্টু। সামনে একটা চেয়ারে সবুজভাইয়া বসে বসে তাদের পড়া ধরছে। তার মুখটা শক্ত হয়ে আছে। দেখে মনে হয় আরেকটু হলেই মুনিয়া না হয় নান্টুকে কামড়ে দেবে।
বল্টুকে দেখে নান্টুর মুখ খুশি-খুশি হয়ে উঠল। সে চোখ বড় বড় করে বলল, “বলু ভাইয়া এসেছে!”
মুনিয়ার মন-মেজাজ খুব খারাপ, সে জিজ্ঞেস করল, “বল্টু, তোমার ব্যাগের ভেতরে কী?”
বল্টু ব্যাগটা টেবিলের ওপর রেখে বলল, “আমি আসলে সবুজ ভাইয়াকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে এসেছি!”
সবুজ ভাইয়া মুখটা বাঁকা করে জিজ্ঞেস করল, “কী প্রশ্ন?”
“বিজ্ঞানের প্রশ্ন।”
সবুজ ভাইয়া এবার মুখটা আরও বাঁকা করে বলল, “ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করো। আমি আজকে মুনিয়াকে নিউটনের সূত্র শেখাচ্ছি। কিছুই জানে না। নো কনসেপ্ট।”
মুনিয়ার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। কিন্তু বল্টু সেটা না দেখার ভান করে বলল, “আসলে আমার প্রশ্ন তিনটী।”
সবুজ ভাইয়া তাচ্ছিল্যের একটা হাসি হেসে বলল, “করে ফেলো।”
“প্রথম প্রশ্ন হলো, আপনি কি এক পায়ে দাঁড়াতে পারেন?”
সবুজ ভাইয়া ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কী বললে?”
“আমি জিজ্ঞেস করেছি, আপনি কি এক পায়ে দাঁড়াতে পারেন?”
“পারব না কেন?” সবুজ ভাইয়া বিরক্ত হয়ে বললেন, “তোমার প্রশ্ন আমি বুঝতে পারছি না।”
বল্টু তখন প্রশ্নটা আরেকটু বোঝাল, “আমরা সবাই তো দুই পায়ে দাঁড়াই। কিন্তু যদি দরকার হয় তাহলে কি এক পায়ে দাঁড়াতে পারব?”
“পারব না কেন?”
“সব জায়গায়? সব সময়?”
সবুজ ভাইয়া বিরক্ত হয়ে বলল, “আরে বাবা, আমি যদি এক জায়গায় এক পায়ে দাঁড়াতে পারি, তাহলে অন্য জায়গায় পারব না কেন?”
বল্টু গম্ভীর হয়ে বলল, “চিন্তা করে উত্তর দেন।”
সবুজ ভাইয়া রেগে উঠল, বলল, “আমার সাথে ঢঙ কোরো না ছেলে। তোমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যে আমার চিন্তা করতে হবে না।”
বল্টু বলল, “আসলে আপনি এক পায়ে দাঁড়াতে পারবেন না। আমি যদি আপনাকে বলি ওই দেয়ালটার পাশে গিয়ে পায়ের ডান দিক আর শরীরের ডান দিক দেয়ালটার সাথে লাগান, তাহলে আপনি আর আপনার ডান পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারবেন না।”
সবুজ ভাইয়া ক্রুদ্ধ চোখে তাকাল, “আর যদি পারি?”
“পারবেন না।”
সবুজ ভাইয়া দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “আর যদি পারি?”
“পারবেন না।”
“তুমি কীভাবে এত শিওর হলে?মনে হলো সবুজ ভাইয়ার নাক দিয়ে আগুন বের হচ্ছে।
“আপনি চেষ্টা করে দেখেন।”
সবুজ ভাইয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আর আমি যদি পারি তাহলে তোমাকে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেব। ঠিক আছে?”
বল্টু বলল, “সেটা আপনার ইচ্ছা!”
নান্টু আর মুনিয়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। আর তার মধ্যে সবুজ ভাইয়া হেঁটে হেঁটে দেয়ালের কাছে গেল। ডান পাটা দেয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে অন্য পা ওপরে তোলার জন্য প্রস্তুত হলো। সবাই সবুজ ভাইয়ার মুখের দিকে তাকিয়েছিল এতক্ষণ। সেই মুখে ছিল এক ধরনের রাগ। হঠাৎ সে রাগটা চলে গিয়ে সেখানে বোকা বোকা একটা ভাব চলে এসেছে। নান্টু আর মুনিয়া দুজনই বুঝতে পারল, সবুজ ভাইয়া এক পায়ে দাঁড়াতে পারছে না। কোনো একটা ম্যাজিক ঘটে গেছে!
নান্টুকে হঠাৎ খুব উত্তেজিত দেখা গেল, সে “আম্মু, আলু, দেখে যাও, দেখে যাও” বলে চিৎকার করতে করতে ঘরের ভেতর ছুটে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে দুজনকেই ধরে নিয়ে চলে এল। দুজনই ভয় পেয়ে গেছেন। জিজ্ঞেস করছেন, “কী হয়েছে? কী হয়েছে?”
নান্টু বলল, “বল্টু ভাইয়া সবুজ ভাইয়াকে ম্যাজিক করে দিয়েছে। এখন সবুজ ভাইয়া আর এক পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারছেন না?”
নান্টুর আম্মু বললেন, “আমি তো জানতাম, বল্টু সায়েন্টিস্ট! সে কি ম্যাজিকও জানে না কি?”
বল্টু বলল, “চাচি, এইটা ম্যাজিক না। এইটাও সায়েন্স। সব মানুষের একটা সেন্টার অব গ্র্যাভিটি থাকে। এক পায়ে দাঁড়াতে হলে শরীর বাঁকা করে সেই পায়ের ওপর সেন্টার অব গ্র্যাভিটিটা আনতে হয়। সবুজ ভাইয়া দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়েছেন তো, তাই শরীর বাঁকা করতে পারছেন না। আর এ জন্যেই ওই পায়ের ওপর দাঁড়াতেও পারছেন না। খুবই সোজা জিনিস।”
নান্টু বলল, “সবুজ ভাইয়া, এই সোজা জিনিস জানে না?”
সবুজ ভাইয়াকে কেমন যেন বোকা বোকা দেখায়। বাঁ পা তুলতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিল। বিড়বিড় করে বলল, “ভেরি স্ট্রেঞ্জ। পিকিউলিয়ার। ইন্টারেস্টিং।”
বল্টু বলল, “চেষ্টা করে লাভ নাই, সবুজ ভাই। আপনি পারবেন না। কেউই পারবে না।”
নান্টু জিজ্ঞেস করল, “আমিও না?”
“না, তুমি না, আমি না, মুনিয়া আপু না, চাচা-চাচি কেউ পারবে না।”
তখন সবাই দেয়ালের কাছে গিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখল, অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, এক পায়ে দাঁড়ানোর মতো খুব সোজা একটা কাজ হঠাৎ করে কেমন অসম্ভব হয়ে যায়!
নান্টুর আব্বু আর আম্মু চলে যাচ্ছিলেন। নান্টু তাদের থামাল। বলল, “আম্মু-আব্বু, তোমরা আগেই যেয়ো না। বল্টু ভাইয়ার আরও দুইটা প্রশ্ন আছে। তাই না, বল্টু ভাইয়া?”
বল্টু মাথা নাড়ল; বলল, “হ্যাঁ, আছে।”
সবুজ ভাইয়াকে এবার কেমন জানি অস্বস্তির মধ্যে দেখা গেল। আমতা আমতা করে বলল, “ইয়ে মানে আবার …”
নান্টুর আম্মু বললেন, “আরে সবুজ, তুমি আমেরিকার এত বড় সায়েন্টিস্ট। এই বাচ্চা ছেলের একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না!”
সবুজ ভাইয়া বলল, “না না, পারব না কেন। একশবার পারব।”
মুনিয়া মনে করিয়ে দিল, “আগেরটা কিন্তু পারো নাই।”
সবুজ ভাইয়া মুনিয়ার কথাটা না শোনার ভান করে বল্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার প্রশ্নটা কী?” তার গলার স্বর শুকনো। কথা বলার সময় জিব দিয়ে একবার ঠোঁট ভিজিয়ে নিল।
বল্টু এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, “আমার একটা সিগারেট আর ম্যাচ দরকার।”
নান্টুর আব্রু পকেট থেকে তার সিগারেটের প্যাকেট বের করে বললেন, “কেন? সিগারেট খাবে নাকি?”
“না চাচা, খাব না।” বল্টু মাথা নাড়ল, বলল, “আসলে আমার দরকার সিগারেটের আগুন।”
“ঠিক আছে, তাহলে আমাকে বলো কখন তোমার আগুনটা লাগবে। ততক্ষণ আমি কয়েক টান খেয়ে নিই।”
নান্টুর আব্বু সিগারেট ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিলেন। নান্টুর আম্মু বিষদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, পারলে এক্ষুণি সিগারেটটা টেনে কুটিকুটি করে ফেলবেন!
বল্টু এবার সবুজ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “সবুজ ভাইয়া, সিগারেট দিয়ে কি আমার শার্টটা পোড়ানো যাবে?”
নার আম্মু বললেন, “ও মা! তুমি শার্টটা পোড়াতে চাচ্ছ কেন?”
বল্টু বলল, “না চাচি, আমি পোড়াতে চাচ্ছি না। আমি শুধু জিজ্ঞেস করছি।”
নান্টর আলু সিগারেটটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সিগারেটের আগুন খুব গরম। ভেরি হাই টেম্পারেচার। কাপড় পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।”
বল্টু সবুজ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি বলেন।”
সবুজ ভাইয়া আমতা আমতা করতে করতে বলল, “হ্যাঁ, ইয়ে, পুড়বেই তো।”
বল্টু তার ব্যাগ থেকে একটা কাপড়ের টুকরো বের করে আনে; তারপর সবুজ ভাইয়াকে বলে, “সবুজ ভাইয়া, আমি কাপড়টা ধরছি, আপনি সিগারেট দিয়ে এটা পুড়িয়ে একটা গর্ত করেন।”
বল্টু কাপড়টা টানটান করে ধরল। সবুজ ভাইয়া নান্টুর আব্বুর কাছ থেকে সিগারেটটা নিয়ে সেটা কাপড়ে ছোঁয়াতেই কাপড়ের মাঝে গোল একটা গর্ত হয়ে গেল। নান্টুর আবু বললেন, “আমি বলেছি না! সিগারেটের আগুন খুব ডেঞ্জারাস।”
বল্টু এবার মুখ গম্ভীর করে বলল, “ঠিক আছে, আপনি কি সিগারেটের আগুন দিয়ে আমার শার্টে একটা গর্ত করতে পারবেন?”
সবুজ ভাইয়ার মুখে এবার একটা বদমায়েশি ধরনের হাসি ফুটে উঠল। হাসি-হাসি মুখে বলল, “পারব। আসো আমার কাছে।”
বল্টু বলল, “আপনি সামনে থেকে সিগারেটটা চেপে ধরবেন আর আমি পিছন থেকে শার্টের কাপড়টা ঠেলে ধরে রাখব।”
নান্টু ভয় পেয়ে বলল, “তোমার আঙুল পুড়ে যাবে, বল্টু ভাইয়া।”
“আঙুল দিয়ে চেপে ধরব না। অন্য কিছু দিয়ে ধরে রাখব।”
“কী দিয়ে ধরবে?”
বল্টু তার পকেট থেকে এক টাকার গোল একটা কয়েন বের করে বলল, “এই কয়েনটা দিয়ে।”
সবুজ ভাইয়া বলল, “তোমার যেটা ইচ্ছা সেটা দিয়ে ধরো।”
নান্টুর আম্মু বললেন, “ও মা! তোমার সুন্দর শার্টটা নষ্ট করবে? না না, পাগলামো করো না।”
বল্টু বলল, “চাচি, আপনি ভয় পাবেন না। সবুজ ভাইয়া আমার শার্ট পোড়াতে পারবেন না।”
“কে বলেছে?”
“আপনি দেখেন!”
বল্টু তখন শার্টের পিছনে এক টাকার কয়েনটা রেখে শার্টটাকে টানটান করে রেখে সবুজ ভাইয়ার কাছে গেল। বলল, “আপনি এখানে সিগারেট ধরে পোড়াতে পারবেন?”
“পারব।”
“কতক্ষণ লাগবে?”
“এক সেকেন্ড।”
বল্টু বলল, “ঠিক আছে। এক সেকেন্ড কেন, আপনাকে আমি পাঁচ সেকেন্ড সময় দিলাম। কিন্তু আপনি পারবেন না।
সবুজ ভাইয়া হাসি মুখ করে বলল, “দেখা যাক।” নান্টুর আম্মু খুব আপত্তি করছিলেন। কিন্তু তার আগেই সবুজ ভাইয়া বেশ হিংস্রভাবে সিগারেটটা বল্টুর শার্টে চেপে ধরেছে। বল্টু বলল, “পুড়েছে, সবুজ ভাইয়া?”
সবুজ ভাইয়া সিগারেটটা ভালো করে চেপে ধরে বলল, “পুড়েছে।” তারপর সিগারেটটা সরিয়ে নিল।
বল্টু পিছন থেকে এক টাকার কয়েনটা সরিয়ে বলল, “আসলে পোড়ে নাই।”
শার্টে লেগে থাকা কালো ছাই সরিয়ে দেখা গেল আসলেই শার্ট এতটুকু পোড়ে নি।
সবুজ ভাইয়ার চেহারা কেমন যেন বোকা বোকা হয়ে গেল।
নান্টু জোরে জোরে হাততালি দিয়ে বলল, “ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ক্লাস!”
নান্টুর আন্ধু বললেন, “কী আশ্চর্য! শার্টটা পুড়ল না কেন?”
বল্টু এক টাকার কয়েনটা দেখিয়ে বলল, “এটার জন্যে! দেখেন এটা কত গরম? সিগারেটের আগুনের পুরো তাপটা এই কয়েনটা নিয়ে নিয়েছে– কাপড়টা পোড়ার জন্যে গরম হতেই পারে নি!”
নান্টুর আলু ও অন্য সবাই কয়েনটা নেড়েচেড়ে দেখল। সবুজ ভাইয়াই শুধু উৎসাহ দেখাল না। তাকে কেমন জানি বোকা বোকা দেখাতে লাগল।
.
নান্টুর আম্মু বললেন, “দেখেছ? আমাদের বল্টু আসলেই এক নম্বর সায়েন্টিস্ট!”
নান্টু বলল, “আমি তোমাকে বলেছি না আম্মু, বল্টু ভাইয়া অনেক বড় সায়েন্টিস্ট।”
মুনিয়া মনে করিয়ে দিল, “বল্টু, তোমার তিন নম্বর প্রশ্নটা শেষ করো।”
নান্টু হাততালি দিয়ে বলল, “তিন নম্বর! তিন নম্বর!”
বল্টু তখন তার ব্যাগ খুলে একটা বড় বাস্কেটবল আর একটা ছোট টেসিন বল বের করে সবুজ ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করল, “আমি যদি বাস্কেটবলের ওপরে টেনিস বলটা রেখে ওপর থেকে নিচে ফেলি তাহলে ড্রপ খেয়ে বল দুইটা কোথায় উঠবে?”
সবুজ ভাইয়া বলল, “কোনো কিছু ওপর থেকে ফেললে সেটা ড্রপ খেয়ে তার থেকে বেশি কখনো উঠতে পারবে না। যে কেউ সেটা জানে।”
বল্টু দাঁত বের করে হেসে বলল, “ভুল! টেনিস বলটা অনেক ওপরে উঠবে।”
সবুজ ভাইয়া বলল, “ননসেন্স! কখনো বেশি ওপরে উঠতে পারবে না। এই দেখো …” বলে বল্টুর হাত থেকে বাস্কেটবল আর টেনিস বল নিয়ে বাস্কেটবলের ওপর টেনিস বলটা রেখে নিচে ছেড়ে দিল।
বল্টু ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল, “সাবধান!” কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, বাস্কেটবল আর টেনিস বল মেঝেতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে টেনিস বলটা একেবারে গুলির মতো উপরে ছুটে গেল। সবুজ ভাইয়া সরে যাওয়ার সময় পেল না। তার নাকে লেগে সেটা ছাদের দিকে উঠে গেল। সেখান থেকে ধাক্কা খেয়ে সারা ঘরে ছোটাছুটি করতে লাগল। সবুজ ভাইয়া নিজের নাক চেপে বসে পড়েছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন ঘুসি মেরে তাকে কাবু করে ফেলেছে।
নান্টুর আম্মু সবুজ ভাইয়ার কাছে ছুটে গেলেন। হাত ধরে টেনে তুলে বললেন, “দেখি! দেখি নাকটা।”
সবুজ ভাইয়া নাক চেপে ধরে বলল, “দেখার কিচুঁ নাই।”
মুনিয়া বলল, “কিন্তু তুমি যে বললে ওপরে উঠবে না। টেনিস বল এভাবে উঠে গেল কেন?”
সবুজ ভাইয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “আগে আমার নাক সামলাই। মনে হয় নাকের হাঁড়িটাই ভেঙে গেছে।”
শার্টের আস্তিনটা চেপে ধরে ককাতে ককাতে সবুজ ভাইয়া বাথরুমের দিকে ছুটে গেল। পিছু পিছু নান্টুর আব্লু গেলেন দেখতে।
নান্টু হাততালি দিয়ে বলল, “ফার্স্ট ক্লাস! ফার্স্ট ক্লাস!”
মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “এটা কেমন করে হলো, বল্টু?”
“খুব সোজা। বাস্কেটবলটা নিচে পড়ে ড্রপ খেয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে, সেটা টেনিস বলকে দিয়েছে ধাক্কা–ক্রিকেট ব্যাটের মতন! সাথে সাথে ওভার বাউন্ডারি!”
নান্টু বলল, “সবুজ ভাইয়ার নাক বোল্ড আউট!” নান্টুর আম্মু বললেন, “ছিঃ! এভাবে বলে না।”
মুনিয়া বলল, “আম্মু, দেখেছ? আমাদের বল্টু সবুজ ভাইয়ার চেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক।”
“তাই তো দেখছি!”
“আমি আর সবুজ ভাইয়ার কাছে আর বিজ্ঞান পড়ব না। যদি দরকার হয় আমি বল্টুর কাছে পড়ব।”
নান্টুর আম্মু হাসলেন, বললেন, “ঠিক আছে।”
মুনিয়া বল্টুর মাথায় চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “বল্টু তুমি আমাকে বিজ্ঞান পড়াতে পারবে না?”
বল্টু বলল, “ধুর আপু! তুমি ঠাট্টা করো না।”
মুনিয়াকে অবশ্যি আর সবুজ ভাইয়ার কাছে বিজ্ঞান পড়তে হল না। মুনিয়া চাইলেও সবুজ ভাইয়ার কাছে আর পড়তে পারত না, কারণ তার পরদিনই সবুজ ভাইয়া তার এক ফুফুর বাসায় চলে গেল। যাওয়ার আগে বল্টুর সঙ্গে আর দেখা হয় নাই। বল্টু নান্টুর কাছে জানতে পারল, সবুজ ভাইয়ার নাকটা নাকি টমেটোর মতো লাল হয়ে ফুলেছিল!