৬. সাম্রাজ্যের পতন
ধর্ম সংস্কারক
তৃতীয় আমেনহোটেপের স্ত্রী এবং চতুর্থ আমেনহোটেপের মাতা রানি “তি” মিশরের অনেক গৌরবের সাথেই আপোস করেন। তিনি এক মিত্তানীয় নারী হিসাবে মিশরের অনেক জটিল ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের প্রতিই সহানুভূতিশীল ছিলেন না। তিনি তার সরল রীতিনীতির প্রতিই অনুরক্ত ছিলেন।
তার স্ত্রৈণ স্বামী (যিনি নিজেও একজন অর্ধ মিত্তানীয় ছিলেন), তার কথার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতেন। তবে তিনি বিশেষ কিছু করতে পারেননি, কারণ তার পক্ষে শক্তিধর মিশরীয় পুরোহিত যারা বহু শতাব্দীব্যাপী ধর্মভীরু মিশরীয় জনগণের কর্তৃত্ব করে এত শক্তিমান হয়ে উঠেছে যে এমনকি ফারাওরাও তাদের ঘাটাতে সাহস পেতনা।
তবে রানি “তি” অবশ্যই তার দলে কিছু লোক টানতে পেরেছিলেন, কারণ তৃতীয় আমেনহোটেপের রাজত্বের শেষ বছরগুলিতে নূতন ধর্মের নিশ্বাস কিছুটা অনুভূত হচ্ছিল। তবে “তি”র প্রথম ধর্মান্তরণ ছিল তার নিজ পুত্র, আর অন্যেরা তাকে অনুসরণ করেছিল এই প্রত্যাশায় যে “সঠিক ধর্ম” অনুসরণ করলে কিছু কিছু সুবিধা ভোগ করা যাবে।
তৃতীয় আমেনহোটেপের জীবকালে তার পুত্র তেমন কিছু করতে পারেননি, তবে ১৩৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নূতন রাজা (জন্মসূত্রে তিন-চতুর্থাংশ মিত্তানীয়) তার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া নূতন মতাদর্শ এবং তার সাথে স্বসৃষ্ট ধারণা সম্প্রচারে শক্ত অবস্থানে চলে গেলেন।
এমনকি তিনি তার নিজের নাম আমেনহোটেপ বদলে ফেললেন, কারণ এতে মিশরীয় দেবতা আমেনের প্রতি অহেতুক শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়, যে দেবতাকে তিনি কুসংস্কার বলে ভাবতে শুরু করেছেন। তার নিজস্ব দেবতা গৌরবমণ্ডিত সূর্য, যার পূজা তিনি শুরু করেন অমিশরীয় পদ্ধতিতে। তিনি তার পূজা করেন মোটেই দেবতা হিসাবে নয়, সচরাচর যেমন মানব বা কোনো প্রাণীর আকৃতিতে, বরং আপন রশিতে ভাস্বর সূর্যগোলক যার উজ্বল কিরণে পৃথিবীতে আলো আর উষ্ণতার সঞ্চারে প্রাণের উদ্ভব হয় (আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ধারণাটা খুব অসঙ্গত নয়)।
তিনি এই গোলকটির নাম দেন “আতন” আর নিজের নামকরণ করেন “ইখনাতন” অর্থাৎ “আতনের সন্তুষ্টি”।
ইখনাতন নামে ইতিহাসে যার পরিচয় তার মূল উদ্দেশ্য ছিল মিশরীয়দের উপর তার নিজস্ব বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়া। ইতিহাসে তিনিই প্রথম ধর্মোন্মাদরূপে পরিচিত, যদিনা আমরা আব্রাহামের ঘটনাটা আমলে নিই, ইহুদি কল্পকথা অনুসারে যিনি তার আপন ধর্মবিশ্বাস প্রতিপাদনের জন্য তার নিজ শহর “উর” এর সব দেবতার মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেন। এই ঘটনাটি ঘটেছিল ইখনাতনের ছয় শতাব্দী পূর্বে।
ইধনাতন আতনের মন্দির নির্মাণ করেন আর তার নূতন দেবতার একটি পরিপূর্ণ পূজাপদ্ধতি প্রণয়ন করেন। এমনকি তিনি সূর্যদেবের চমৎকার একটি স্তোত্রও রচনা করেন, যেটা উৎকীর্ণ পাওয়া যায় তারই এক পরিষদের সমাধিতে। এতে করে ফারাওর সৃজনশীল মনের পরিচয় পাওয়া যায়, আর এই স্তোত্রটি বাইবেলের একটি স্তুতিগানের অবিকল অনুকৃতি।**
[** তুমি আছ আমার হৃদয়ে
আর কেউ নাই যে চেনে তোমাকে
ব্যতিত তোমার পুত্র…
পৃথিবীর আবির্ভাব তোমারই হাতে
তুমি আছ স্ব-মহিমায়
আমরা বাঁচি তোমারই করুণায়
তোমার দৃষ্টিতে রয়েছে পৃথিবী
যাদের উথান ঘটিয়েছ তোমার সন্তানের তরে
তোমারই শরীর থেকে যাদের নির্গমন:
রাজা,.. ইখনাতন,..
প্রধান সহধর্মিণী… নেফারতিতি…]
বাস্তবিক ইখনাতন আতনের এমনই অন্ধ-ভক্ত ছিলেন যে তিনি তাকে শুধু মিশরীয় দেবতাদের অন্তর্ভুক্ত করেই ছাড়েননি, বরং তাকে মিশরের প্রধান দেবতা বানিয়েছিলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আতনই হবে মিশরের একমাত্র দেবতা আর অন্য সব দেবতাদের বিলোপ করতে হবে। এভাবেই ইতিহাসে তিনিই প্রথম একেশ্বরবাদীরূপে পরিচিতি লাভ করেন, যদিনা আব্রাহামকে আমরা একেশ্বরবাদীরূপে স্বীকার করি।
কেউ কেউ বিতর্ক তোলেন বাইবেলের মুসা ইখনাতনের সমসাময়িক। তাই মিশরীয় ফারাও মহান পয়গম্বরের কিছু কিছু ইহুদিতত্ত্ব তার ধর্মে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন। তবে তেমনটা না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি কারণ মুসা ইবনাতনের সময় জীবিত ছিলেননা, জীবিত ছিলেন অন্তত এক শতাব্দী পরে। একথা আমলে নিয়ে অনেকেই মনে করেন বরং মুসাই ইখনাতনের একেশ্বরবাদের ধারণা লাভ করেন এবং তাকে আরও মসৃণ করেন।
ইখনাতন মুসাকে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলেন কি না সেটা অনুমানের বিষয় তবে তিনি মিশরীয়দের শিক্ষা দিতে সক্ষম হননি। থিবিসের পুরোহিতরা তাকে একজন ঘৃণ্য ধর্ম অবমাননাকারী আখ্যায়িত করে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে। কারণ তাদের দৃষ্টিতে একজন ফারাও, যিনি যতটা না মিশরীয় তার চাইতে বেশি বিদেশি, হিক্সসদের সমতুল্য।
সন্দেহ নাই তারা লোকদের দলে টানতে সক্ষম হয়েছিল। মিশরীয়রা বেড়ে উঠেছে মন্দিরের জাঁকজমক আর পুরোহিতদের ভীতিকর আচার অনুষ্ঠান দেখে। তারা চায়নি হঠাৎ বানোয়াট এক সূর্যগোলক এসে সেসব ওলটপালট করে দিক।
ইখনাতন সান্ত্বনা পেতেন তার দরবারে অন্তত সূর্যপূজা হচ্ছে। তার পরিবার ও পারিষদরা সূর্যপূজা করছে। সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা তার স্ত্রী নেফারতিতি। তার স্বামী মহারাজের চাইতে আশপাশের লোকজন তাকে বেশি চিনত- শুধু একটিমাত্র অপকৌশলের মাধ্যমে। অপকৌশলটি এই “বিধর্মী” রাজার মাধ্যমে বিপ্লবাত্মক রূপ নেয়। প্রাচীন রাজবংশের আমল থেকেই বিশেষ স্টাইলে নিজেদেরকে রূপায়িত করতে পছন্দ করত। মাথায় বিচিত্র মস্তকাবরণ, শরীর দৃশ্যমান সামনে থেকে, বাহুদ্বয় শক্ত করে দুপাশে শরীরের সাথে প্রলম্বিত, পদদ্বয়ও সুসজ্জিত। অঙ্গভঙ্গি প্রশান্ত গৌরবমণ্ডিত।
ইখনাতনের মাধ্যমে একটা নূতন বাস্তবতা সামনে এল। ইখনাতন আর নেফারতিতি এক অনানুষ্ঠানিক ভঙ্গিতে সামনে এল, স্নেহের প্রকাশে শিশুদের সাথে ক্রীড়ারত। ইখনাতন যে একজন কুৎসিৎ চেহারার লোক ছিলেন সেটা ঢাকার কোনো চেষ্টা করেননি; তোবড়ানো চোয়াল, ফোলানো পেট আর মূল উরু। সম্ভবত ইখনাতন কোনো দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগতেন, যার কারণে যুবাবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেন।
তবে সবচেয়ে সুন্দর শিল্পকর্ম, চুনা পাথরে অঙ্কিত একটি রঙিন আবক্ষ মূর্তি, যেটি ইখনাতনের রাজধানীতে এক স্থপতির কারখানা খননের সময় উদ্ধার করা হয়। এখন এটা সংরক্ষিত আছে বার্লিন মিউজিয়ামে।
আনুমান করা হয় এটা নেফারতিতির মৃর্তি, আর এটাই মিশরীয় শিল্পের সবচেয়ে সুন্দর দৃষ্টান্ত, যা আজও টিকে আছে। এর অসংখ্য অনুকৃতি নির্মাণ করা হয়েছে আর অজস্র দর্শনার্থী ফটোগ্রাফ নিয়েছে। এটা মানব মনে মিশরীয় শিল্প সৌকর্যের অক্ষয় কীর্তিরূপে চির জাগ্রত হয়ে থাকবে। ভাগ্যের পরিহাস যে নেফারতিতি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে একজন এশীয় রানি।
এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা যে ইখনাতন ও নেফারতিতির বিবাহটিকে আদর্শ বিবাহ বলা যায় না, আর সে বিবাহ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। শেষ পর্যন্ত নেফারতিতি রাজার অসন্তোষ নিয়ে থাকতে চাননি আর তিনি হয় বিচ্ছেদ অথবা স্বেচ্ছা-নির্বাসনে চলে গিয়েছিলেন। থিবীয়দের অনমনীয় প্রতিরোধের মুখে বিচলিত ও হতোদ্যম হয়ে অবশেষে ইখনাতন মহান রাজকীয় নগরী পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৩৬৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি এক নূতন রাজধানী স্থাপন করেন এবং তার পরিবার ও তার ধর্মমতে আস্থা স্থাপনকারীদের নিয়ে সেখানে চলে যান আর এই নূতন নগরী তার দেবতার নামে উৎসর্গ করেন। তিনি থিবিস ও মেম্ফিসের মাঝামাঝি নীল নদের পূর্ব তীরের একটি স্থান নির্বাচন করেন, আর সেটাই তার রাজধানী “আখেতাতুন” (আতনের দিগন্ত)।
এই নগরে তিনি নির্মাণ করেন মন্দির, প্রাসাদ আর তার নিজের ও রাজকীয় পারিষদদের জন্য ভিলা। “আতনের” মন্দিরটি কোনো গতানুগতিক স্থাপনা ছিলনা, কারণ এটা ছিল ছাদবিহিন। তার আরাধ্য সূর্যদেব বাধাহীনভাবে এর ভেতর তার কিরণ বর্ষণ করতে পারত।
আখেতাতুনে ইখনাতন বাস্তব পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এক জগতে বাস করতে শুরু করেন। এক কৃত্রিমতার মধ্যে তিনি নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেন, তার ধর্মীয় মনোভাব তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন আমেনের পুরোহিতদের উৎপীড়নের কাজে। আমেন নামাঙ্কিত সব স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙ্গে ফেলেন, আর দেবতা শব্দের বহুবচন বিলুপ্ত করেন।
ইখনাতনের একোন্মাদনা ধর্ম আর সবকিছু থেকে তার আগ্রহ লোপ করে দেয়। তিনি সামরিক ও বৈদেশিক বিষয়গুলিকে অবহেলা করতে শুরু করেন। এগুলি অত্যন্ত জরুরি বিষয় ছিল, কারণ যাযাবর আগ্রাসীরা পূবদিক থেকে সিরিয়ার দিকে এগিয়ে আসছিল। সিরিয়া থেকে জেনারেল ও রাজপ্রতিনিধিদের বার্তার পর বার্তা আসতে থাকে ইখনাতনের কাছে। তারা সেখানকার বিপজ্জনক পরিস্থিতির কথা জানিয়ে আরও বেশি সৈন্য পাঠাতে অনুরোধ করে।
স্পষ্টতই ইখনাতন এসব অনুরোধে কর্ণপাত করেননি। একজন সৎ শান্তিবাদী শাসক হিসাবে যুদ্ধবিগ্রহের প্রতি তার অনীহা। প্রকৃতপক্ষে তিনি অনুভব করেছিলেন যুদ্ধ বলতে একমাত্র ধর্মযুদ্ধই বোঝায়, আর অন্য সবকিছুই গৌণ। এমনকি তিনি এটাও ভেবেছিলেন, মিশর যদি কষ্টভোগ করে তাহলে সেটা তাদের সত্যধর্ম থেকে বিচ্যুতির ফসল।
কারণ যাই হোক না কেন, মিশরীয়দের ভাগ্যে নেমে আসে দুৰ্ভগ্যজনক অধঃপতন, আর পূর্ববর্তী শতাব্দীতে তৃতীয় থুতমস ও তার উত্তরসূরিদের রাজত্বকালে যে অর্জন ছিল, তা হারিয়ে গেল। ইখনাতনের রাজত্বকালেই সিরীয় সীমান্তে বিভিন্ন হিব্রম্ন গোত্র জাতি গঠন করে। তারা হলো বাইবেলে বর্ণিত মোয়াব, আম্মন, এদম।
এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মরুভূমির উপজাতি গোত্র যারা মিশরকে উত্যক্ত করার চাইতে বেশি কিছু করতে পারত না, তার চাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল উত্তরের এক মহান শক্তির উদ্ভব।
পূর্বদিকে এশিয়া মাইনরে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী একটি জাতি (বর্তমানে অধিকাংশ ইউরোপীয় ভাষা এই ভাষা থেকে উদ্ভূত) শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। বেবিলনীয় রেকর্ড অনুসারে তারা ছিল “হাত্তি,” তবে বাইবেলে তাদের বলা হয়েছে “হিট্রাইট,” শেষোক্ত নামেই সাধারণত তাদের পরিচয়।
সেই সময় যখন মিশর ছিল হিক্সসদের যাতাকলের নিচে, তখন হিট্টাইটরা একজন যোগ্য রাজার অধীনে, ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেছিল। এটাই ১৭৫০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের প্রাচীন হিব্রাইট সাম্রাজ্য। তবে মিতান্নিদের উত্থান, এই প্রাচীন সাম্রাজ্যে ফাটল ধরায়, আর হাশেপসুতের আমলে হিটাইটরা মিতান্নিদের করদরাজ্য ছিল।
তৃতীয় থুতমস মিতান্নিদের ক্ষমতা খর্ব করে দিলে হিট্টাইটদের আরও একবার সুযোগ এল। তারা তাদের হৃত প্রাধান্য পূনরুদ্ধারের সুযোগ পেল, তারা মিতান্নিদের পরাজয়ের সুযোগ নিয়েছিল।
১৩৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সুব্বিলুলিউ নামে এক রাজা হিটাইট সিংহাসনে আরোহণ করেন। সতর্কতার সাথে তিনি রাজ্যের পুনর্গঠন করেন কেন্দ্রীয় শাসন এবং সামরিক শক্তিবৃদ্ধির মাধ্যমে। ইখনাতন যখন মিশরের সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন তিনি নিজে এবং সামগ্রিকভাবে মিশরীয়রা ধর্মীয় কলহে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তখন সুব্বিলুলিউ সুযোগ পেয়ে যান। তিনি মিতান্নিদের বিরুদ্ধে এক কষ্টকর অভিযান পরিচালনা করেন, যখন মিতান্নিদের অবস্থান ছিল মিশরীয়দের মিত্ররূপে।
মিত্তানীয়রা মিশরীয় সহায়তার মুখাপেক্ষি ছিল, তবে সে সাহায্য কখনোই আসেনি। তাদের পতন দ্রুততর হয় আর পরবর্তী এক শতাব্দীর মধ্যে তারা ইতিহাসের পাতা থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তার জায়গায় পত্তন হয় শক্তিশালী হিট্রাইট সাম্রাজ্যের, যা মিশরের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
.
সংস্কার বিফল
১৩৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইখনাতনের মৃত্যু হয় আর তিনি ছয় কন্যা সন্তান রেখে যান, তার কোনো পুত্র সন্তান ছিলনা। তার মৃত্যুর পর তার দুই জামাতা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য রাজত্ব করেন, আর এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই সংস্কারকের অর্জন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় যেন এসবের অস্তিত্বই ছিলনা, টিকে থাকে শুধু ধর্মীয় কোন্দল যা মিশরের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করে।
ইখনাতনের ধর্মানুসারীরা আবার পূর্বের অবস্থানে চলে যায়। আখেতাতন নগরী ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়ে যায়, এবং এক দৈত্যের নিবাস আখ্যায়িত করে ধ্বংস করে ফেলা হয়।
পূরনো ধর্মের পুরোহিতরা আবার শক্তি সঞ্চয় করে আর সবকিছু তাদের কজায় নিয়ে নেয়। ইখনাতনের দ্বিতীয় শাসক জামাতা তুতেনখাতন যিনি ১৩৫২ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ১৩৪৩ পর্যন্ত ফারাও হিসাবে দেশ পরিচালনা করেন, তিনি তার নাম বদল করে রাখেন তুতেনখামেন, যেহেতু আমেন প্রধান দেবতার স্বীকৃতি লাভ করে।
তবু ইখনাতনের এক প্রতিধ্বনি বর্তমান সময়েও শ্রম্নতিগোচর হয়। বহুপূর্বে বিলুপ্ত আখেতাতনের অবস্থানস্থলে বর্তমানে তেল-এল-আমানা গ্রাম। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে এক নারী কৃষক তিনশত মাটির ট্যাবলেট খুঁড়ে বের করে যাতে রয়েছে কিউনিফর্ম অক্ষরে লেখা (যে লিপি পুরাতত্ত্ববিদরা পাঠোদ্ধার করতে পেরেছেন)। এতে মিশর সম্রাটের প্রতি বেবিলনিয়া, আসিরিয়া ও মিতান্নির এশীয় রাজাদের কিছু বার্তা রয়েছে। তারা সম্রাটের কাছে যাযাবরদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সাহায্য চেয়েছে।
কয়েক বছরের মধ্যে সেখানে সতর্ক খনন কাজ শুরু হয়। আখেতাতন শহরটি এক বিরান ভূখণ্ডে নির্মিত হয় আর ইখতাতনের মৃত্যুর পর তা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত হয়। তাই পরবর্তী নির্মাণকাজের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, যাতে ইখনাতনের সংস্কার করা ধর্মের অপরিমেয় নমুনা সংগৃহীত হতে পারে। আরও মিলতে পারে সে সময়ের সামরিক ও কূটনৈতিক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ।
প্রকৃতপক্ষে পুরোহিতদের প্রতিশোধস্পৃহা আর ইবনাতনের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার প্রয়াস এতই তীব্র ছিল যে আমরা যদি এই দলিলপত্র হাতে না পেতাম, তাহলে অনেক কিছুই আমাদের জ্ঞানের বাইরে থেকে যেত। মিশরের ইতিহাস আর ধর্মচর্চার বিষয়ে অনেক কিছুই থেকে যেত অজানা। আমাৰ্না লিপি মিশরে প্রাপ্ত রোজেটা পাথরের পরে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
ইখনাতনের জামাতা তুতেনখামেন আরও এক মহাসম্পদ আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, আর সেটা সাহিত্যের ক্ষেত্রে। তিনি স্বয়ং ছিলেন একজন গুরুত্বহীন ফারাও। সিংহাসনে আরোহণের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর, আর মৃত্যুর সময়ও তিনি কৈশোর কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তৎসত্ত্বেও বেশ জমকালোভাবে তাকে সমাহিত করা হয়।
তার সমাধি অনতিবিলম্বে লুট হয়ে যায়, তবে অবাক কাণ্ড! লুটেরারা ধরা পড়ে যায় আর লুটের মাল ফিরিয়ে দিতে তাদের বাধ্য করা হয়। এমন একটা কথা চালু আছে যে রাজার প্রত্যাবর্তন প্রতিহত হওয়ার সংবাদেই লুটের কাজ বন্ধ হয়, তাই হয়তো এই কবর নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। এর দুই শতাব্দী পরে যখন অন্য একজন ফারাওর জন্য কবর খোঁড়া হচ্ছিল তখন পাথরের টুকরোগুলি দিয়ে এমনভাবে সমাধিটা ঢাকা পড়ে যায় যে তুতেনখামেনের কবরের সমাধিপথ ঢাকা পড়ে যায়।
ঢাকা পড়ার কারণে এটা অক্ষত থেকে যায়। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের মধ্যেই সব পিরামিড এবং সব পাহাড়ী কবর তছনছ হয়ে যায়। কোনো রত্নভাণ্ডারই অক্ষত থাকেনি, শুধু তুতেনখামেনেরটা বাদে।
১৯২২ সালে লর্ড কার্নার্ভন ও হাওয়ার্ড কার্টারের নেতৃত্বে একদল ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক খননকালে দৈবক্রমে এর সমাধিক্ষেত্রের রত্নভাণ্ডার আবিষ্কার করেন, বিশাল বিপুল, চমকপ্রদ। মনোহারিত্ব ছাড়াও মিশরতত্ত্ব গবেষণায় এর অসীম গুরুত্ব রয়েছে। এই আবিষ্কারের মাধ্যমে “ফারাওর রহস্য উন্মোচিত হয়, আর আবিষ্কারের ছয় মাসের মধ্যেই মশার কামড়ে সংক্রমিত হয়ে এবং নিউমোনিয়ার আক্রমণে লর্ড কার্নার্ভন মৃত্যুবরণ করেন। সানডে সাপ্লিমেন্ট এ নিয়ে ঝড় তুললেও মনে হয়না এর সাথে ফারাওর অভিশাপের কোনো সম্পর্ক আছে।
ইখনাতনের দুর্ভাগ্যজনক ব্যর্থতার পরে যে অষ্টাদশ রাজবংশ মিশরে দুই শতাব্দীর গৌরব এনে দিয়েছিল তার বিপর্যস্ত পরিসমাপ্তি ঘটে। তুতেনখামেনের উত্তরাধিকার লাভ করেন “আই” নামের এক ফারাও, যিনি ইখনাতনের বিশ্বাসের কিছু কিছু চালু করার চেষ্টা করেন তবে এর সুফল লাভ করতে পারেননি।
পুরোহিতরা আতন-পূজা উচ্ছন্নের চূড়ান্ত দায়িত্ব অর্পণ করে সেনাবাহিনীর উপর। জেনারেলরা সচরাচর রক্ষণশীল মনোভাবের হয়ে থাকে, যারা সামাজিক পরিবর্তনের বিরোধীতা করে থাকে। এক্ষেত্রে মিশরের সামরিক মর্যাদার হানি ঘটায় তারা বিরক্ত ছিল।
“হোরেমহেব” নামের এক জেনারেল আই এর উত্তরসূরিরূপে ১৩৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফারাও হয়ে বসেন। যার নেতৃত্বে প্রাচীন পদ্ধতি পূর্ণ শক্তিতে প্রত্যাবর্তন করে। তিনি প্রকৃতপক্ষে অষ্টাদশ রাজবংশের কেউ ছিলেন না, তবে তাকে ঐ বংশের একজন বলেই গণ্য করা হয়, কারণ তিনি ইখনাতনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন এবং তার নিজ বংশের সূচনা ঘটাননি।
শৃঙ্খলা ফিরে এল এবং সাম্রাজ্যের পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য নুবিয়ায় অভিযান পাঠানো হলো। তবে সিরিয়ার দিকে হাত বাড়ানো হয়নি। ১৩৩৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শুব্বিলুলিউয়ের মৃত্যু হয় এবং পেছনে রেখে যান এক হিট্টাইট শক্তি হোরেমহেব যাকে ঘাটাতে চাননি।
১৩০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হোরেমহেবের মৃত্যু হয় এবং তার একজন জেনারেল প্রথম রামেসেস সিংহাসনে আরোহণ করেন। ইতিমধ্যেই তিনি বেশ বয়োবৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন, আর মাত্র বছরখানেক রাজত্ব করতে পেরেছিলেন। তবে তিনি তার উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করে যেতে পেরেছিলেন, আর তাই তাকে ঊনবিংশ রাজবংশের প্রথম রাজা বলে অভিহিত করা হয়।
তার পুত্র প্রথম “সেক্তি” উত্তরাধিকার স্বত্বে সিংহাসনে আরোহণ করেন ১৩০৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, আর এবার মিশর আবার পূর্ণ শক্তিতে পুনরাবির্ভূত হলো। তিনি সিরিয়া আক্রমণ করে বুঝিয়ে দিলেন মিশরের শক্তিমত্তা, তবে হিট্টাইটরা তার শক্ত প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াল, আর শান্তির স্বার্থে তাদের সাথে আপোস করতে বাধ্য হলেন। তিনি লিবিয়ানদের উপরও বিজয় অর্জন করলেন, আর থিবিস এবং থিবিস থেকে প্রায় একশ মাইল ভাটিতে আবিডোসে বিশাল বিশাল মন্দির নির্মাণ করেন। তিনি পাহাড়ের ঢালে বিপুলায়তনের এক সমাধি নির্মাণ করেন যেখানে অষ্টাদশ রাজবংশের সম্রাটরা শায়িত (অবশ্য তাদের কবর যদি লণ্ডভণ্ড হয়ে না থাকত)।
হিটাইটরা তখনও সেখানে বহাল তবিয়তে আর তাদের মোকাবেলা করাটা বিশেষ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এটাই ছিল প্রথম সেত্তি আর তার উত্তরাধিকারীর সবচেয়ে বড় সমস্যা, যে পুত্র সকল বাধাবিপত্তি এড়িয়ে এক মহান স্রাটের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পেরেছিলেন।
.
মহান আত্মম্ভর
এই পুত্রটি হলেন দ্বিতীয় রামেসেস, যিনি সিংহাসনের উত্তরাধিকার লাভ করেন ১২৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সে সময় তিনি ছিলেন নেহায়েত এক নাবালক আর তার রাজত্বকাল দীর্ঘায়িত হয় ষাট বছর ধরে, যা শুধু দ্বিতীয় পেপি ছাড়া আর কেউ অতিক্রম করতে পারেনি।
এই রাজত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য আত্মশ্লাঘা। রামেসেসের ক্ষমতা ছিল নিরঙ্কুশ, আর মিশরের পা থেকে মাথা পর্যন্ত তিনি নিজের কৃতিত্বের স্বাক্ষর সম্বলিত স্মৃতিস্তম্ভে ছেয়ে ফেলেন, যাতে উত্তীর্ণ হয় তার কৃতিত্ত্ব আর মহত্ত্বের বিবরণ। এমনকি তার পূর্বসূরিদের স্মৃতিস্তম্ভেও তার কীর্তিগাথা লিপিবদ্ধ করতে দ্বিধাবোধ করেননি।
তিনি বিশাল থিবিসের মন্দির কমপ্লেক্সে (যেটা এখন কার্নাকে) আরও কিছু সংযোজন করেন, ওবেলিস্কগুলির উচ্চতা বৃদ্ধি করেন, আর নিজের বিরাট বিরাট মূর্তি নির্মাণ করান। তার নির্মিত মন্দির কমপ্লেক্সটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ, অন্তত আয়তনের দিক থেকে। এই মন্দিরের হলঘরটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ, ৫৪০০০ বর্গফুটের চাইতে বেশি, এর ছাদটি দাঁড়িয়ে আছে ১৩৪টি পিলারের উপর যার কোনো কোনোটা ১২ ফিট পুরু আর ৬৯ ফিট উঁচু।
তার আমলে থিবিস উন্নতির শীর্ষে পৌঁছে, নীল নদের উভয় তীরে বিস্তার লাভ করে। এর সীমানা প্রাচীর ছিল ১৪ মাইল দীর্ঘ, আর সভ্য জগতের সব প্রান্ত থেকে সম্পদ আহরণ করে এখানে পুঞ্জিভূত করা হয়। অন্য দেশের লোক যারা এসব দেখত বা এর কাহিনী শুনত, তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত।
গ্রিক কবি হোমারের ট্রয়ের যুদ্ধ নিয়ে রচিত মহাকাব্য ঈলিয়াডে থিবিসের উল্লেখ আছে (যিনি এটা রচনা করেন দ্বিতীয় রামেসেসের সময়ের অন্তত তিন শতাব্দী পরে), যে যুদ্ধটি সংঘটিত হয় দ্বিতীয় রামেসেসের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই।
এতে দেখা যায়, হোমার বলছেন, যখন একিলেস সকল উৎকোচ প্রলোভন অগ্রাহ্য করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে, “মিশরের থিবিসের সকল সম্পদ যদি আমার পায়ে ঢেলে দেয়া হয়… যে থিবিসে পীভূত আছে পৃথিবীর সকল সম্পদ… যে থিবিসের একশত গেট দিয়ে একসাথে একশত অশ্বারোহী বের হয়ে আসতে পারে…”
তবে সময় সব কিছুকে জয় করে নেয়, আর বহু পুর্বেই থিবিস লুপ্ত হয়ে যায় আর জমকালো পিবিসের মন্দিরটি এখন ভগ্নপ- তবে ভগ্ন্যুপের মাঝেও চমকপ্রদ। রামেসেসের একটি মূর্তি, যেটি মিশরের সর্ববৃহৎ, সেটি এখন ভগ্নাবস্থায় ভূপাতিত। তার ভূপাতিত মস্তকটিই ইংরেজ কবি শেলিকে উজ্জীবিত করেছিল তার শ্লেষাত্মক কবিতা লিখতেঃ
অদ্ভুত এক ভিনদেশী পথিকের সাথে আমার দেখা
যে বলে: পাথরের দুটি বিশাল দেহহীন পদযুগল
মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে… তার কাছে, বালির উপরে,
অর্ধ নিমজ্জিত ভগ্ন মুখমণ্ডল, যার ভ্রূকুটি
আর বলিরেখ অধরোষ্ঠ আর শীতল কণ্ঠের গর্জন
জানান দেয় এর ভাস্কর তার আবেগ বুঝতে পেরেছিল,
এখনও যা জীবন্ত, নিষ্প্রাণ পাথরে অঙ্কিত,
যে হাত তাদের ব্যঙ্গ করেছিল, যে হৃদয় খাইয়েছিল:
যা খোদিত রয়েছে পাদপ্রস্তরে:
“নাম আমার অজিমান্দিয়াস, রাজার রাজা
তাকাও আমার কাজের দিকে, তুমি শক্তিমান, আর ভগ্নহৃদয়?”
পাশে আর কিছু নাই, চারপাশে
বিপুলায়তন ভগ্নস্তূপ, সীমাহীন শূন্যতা
নির্মল মসৃণ বেলাভূমি, দিগন্তে প্রসারিত।
কাৰ্মাকই একমাত্র স্থান নয় যেখানে দ্বিতীয় রামেসেস আত্মপ্রসাদের স্বাক্ষর রেখেছেন। অনেক দক্ষিণে প্রথম প্রপাত থেকে ১২০ মাইল দূরে, যেখানে মিশরীয় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাতারা সচরাচর যেতে সাহস করেননি, সেখানেও তিনি এক বিখ্যাত মন্দির নির্মাণ করেন।
বর্তমানে যে স্থানটিতে আবু সিম্বেল গ্রাম, শতাব্দীর বিস্মৃতি কাটিয়ে সুইস আবিষ্কারক লুডভিগ ব্রাখার্ড ১৮১২ সালে খনন কাজ চালিয়ে অতীতের এক স্মরণীয় স্মৃতিচিহ্ন আবিষ্কার করেন। সেখানে পাহাড়ের পাদদেশে দ্বিতীয় রামেসেসের বিশাল দুটি উপবেশনরত মৃর্তি আবিষ্কার করেন, যার প্রতিটির উচ্চতা ৬৫ ফিট। সেখানে তার পরিবারের অন্য সদস্যদেরও অনেক মূর্তি পাওয়া যায়। এর সবগুলিই সূর্যদেব “রি”র মন্দিরের সাথে সম্পর্কিত। সূর্য-দেবতা রামেসেসের সবচাইতে শ্রদ্ধেয় দেবতা, আর ফারাওর নিজের নামের অর্থও “সূর্যের পুত্র”। মন্দিরটি এমনভাবে নির্মিত যে সূর্য অবাধে মন্দিরের মধ্যস্থলে স্থাপিত রামেসেসের মূর্তির উপর তার কিরণ বর্ষণ করতে পারে।
১৯৬০ এর দশকে প্রথম প্রপাতের নিকটে এক বিরাট বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছিল, আর সেই বাঁধের উজানে এক বিস্তৃত দীর্ঘ হ্রদ সৃষ্টি হওয়ার কথা। যদি বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেয়া না হয় তাহলে আবু সিম্বেলের মন্দির ও বিশাল মূর্তিগুলি পানিতে ডুবে যাবে। প্রবল চেষ্টা ও বিপুল ব্যয়ে মন্দির কমপেস্নক্সটি উঁচু জায়গায় সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। রামেসেসের আত্মা সত্যি যদি এটা দেখতে পেত তাহলে নিশ্চয়ই পরম তৃপ্তিলাভ করত।
রামেসেসের আত্মপ্রশংসা এতই প্রবল ছিল আর এত দক্ষতার সাথে সেটা রূপায়িত করতে পেরেছিলেন যে মাঝে মাঝে নিজেই নিজেকে বলতেন “রামেসেস দ্য গ্রেট”। আমার মতে তাকে যদি বলা যেত “রামেসেস আত্মম্ভর” তাহলে সেটাই হয়তো যথার্থ হতো।
সামরিক দিক থেকে দেখতে গেলে ধারণা করা হয় দ্বিতীয় রামেসেস তৃতীয় থুতমসের সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিলেন, তবে ধারণাটা ভ্রান্ত। নিশ্চিত করে বলা যায়, চতুর্থ প্রপাত পর্যন্ত নুবিয়া মিশরের নিয়ন্ত্রণে এসেছিল, আর লিবীয়রা
অবদমিতই রয়ে যায়, সিরিয়া এবং তার উত্তরে হিট্টাইট শক্তি অক্ষতই রয়ে যায়। তার শাসনের প্রথম দিকে দ্বিতীয় রামেসেস হিটাইটদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন, আর ১২৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কাদিশে এক ভয়ংকর যুদ্ধে তাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন, যে শহর থেকে এক শতাব্দী পূর্বে কেনানীয় মিত্রবাহিনী তৃতীয় থুতমসের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছিল।
যুদ্ধের ফলাফল অস্পষ্ট। একমাত্র যে বিবরণটি আমাদের হস্তগত, সেটা রামেসেসের দাপ্তরিক শিলালিপি। স্পষ্টতই মিশরীয় বাহিনী অপ্রস্তুতভাবে আটকা পড়ে আর হিট্রাইট অশ্বারোহী বাহিনীর আক্রমণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। পশ্চাদপসরণ শুরু হয়ে যায় আর রামেসেস ও তার দেহরক্ষী আক্রমণের শিকার হয়। হঠাৎ রামেসেস মরিয়া হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন, একাই শত্রুর মোকাবেলা করেন এবং তাদের ঠেকিয়ে রাখেন যতক্ষণ না সৈন্যদল ফিরে এসে তার শক্তিবৃদ্ধি করে। ফারাওয়ের এমন প্রবল মনোবলে উদ্বুদ্ধ হয়ে তার সৈন্যবাহিনী প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ শুরু করে দেয় আর হিটাইট বাহিনীকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়।
আমরা যদি এই কাহিনীকে অবিশ্বাস করতে চাই, তাহলে আমাদের মার্জনা করা যেতে পারে। রামেসেস নিজের সম্বন্ধে সব রকমের মিথ্যা বলতেই পারদর্শী ছিলেন, আর রামেসেসকে হারকিউলেস বা স্যামসনের ভূমিকায় দেখার প্রয়োজন নাই। এটা ভাবারও প্রয়োজন নাই যে কাদিসের যুদ্ধে মিশরীয়দের জয় হয়েছিল। এটা হওয়ার মোটেই সম্ভাবনা নাই কারণ হিব্রাইটরা এই যুদ্ধের পরও আগের মতোই শক্তিশালী ছিল কারণ এর পরেও সতর বছর ধরে তাদের সাথে মিশরীয়দের যুদ্ধ করতে হয়েছিল।
সবদিক দিয়ে বিচার করলে মনে হয় কাদিসের যুদ্ধ ছিল একটি স্বপ্নের যুদ্ধ, আর তা না হলে হিব্রাইটদেরই একটি ক্ষুদ্র বিজয়। রামেসেসের সকল উন্মাদনা সত্বেও ১২০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে একটা শান্তিচুক্তি করতে পেরে মিশর অনেকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল, যেখানে ইউফ্রেতিস নদীর দক্ষিণের অঞ্চলে হিট্টাইটদের আধিপত্য মেনে নেয়া হয়, আর মিশরের সন্নিহিত সিরিয়ার ক্ষুদ্র এলাকার উপরই শুধু মিশরের আধিপত্য বজায় থাকে। একজন হিট্টাইট নারীকে রাজপরিবারে আনার মাধ্যমে চুক্তিটাকে স্থায়ীত্ব দিতে পেরে রামেসেস তৃপ্তি লাভ করেছিলেন, আর এর মাধ্যমে তার রাজত্বের শেষভাগটা শান্তিপূর্ণই কেটেছে।
কাজেই যদি ভাবা হয় দ্বিতীয় রামেসেস তৃতীয় পুতমসের গৌরবের দিনগুলি ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন তবে সে কথাটি ঠিক নয়। তৃতীয় থুতমস মিত্তানীদের পরাজিত করে করদ বানিয়েছিলেন আর রামেসেসের সময় সেখানে ছিল এক অপরাজেয় হিট্রাইট সাম্রাজ্য।
এতৎসত্বেও এই দুই শক্তির মধ্যে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ উভয়ের জন্যই মারাত্মক ছিল। দৃশ্যত তাদেরকে শক্তিমান মনে হলেও তারা বাস্তবে অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছিল, আর তৃতীয় কোনো শক্তির দিক থেকে সামান্য আঘাত এলেই তারা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ত।
একটা প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে দ্বিতীয় রামেসেস ছিলেন একজন “উৎপীড়ক ফারাও,” বাইবেলের এক্সোডাস পর্বে এই কথাটির উল্লেখ আছে যে তিনি ইসরাইলিদের ক্রীতদাস বানিয়ে কঠোর পরিশ্রম করিয়ে নেন। এর একটা কারণ এই যে তিনি ইসরাইলিদের দ্বারা ফারাওর ধনভাণ্ডার “পিথম ও রামসেস” শহর নির্মাণ করিয়েছিলেন। এটাকে সম্ভাব্য বলেই মনে হয়। উনবিংশ রাজবংশের উদ্ভব বদ্বীপের পূর্ব প্রান্ত থেকে। বাইবেলীয় পুরাণ কথা অনুসারে ইসরাইলিরা বাস করত “গোশেনে”। রামেসেস এদিকে দৃষ্টি দিবেন এটাই স্বাভাবিক। নীলনদ যেখানে সাগরে মিশেছে, সেখানে “তানিস” শহরে তিনি একটা মন্দির নির্মাণ করেন আর এর ভেতরে নিজের ৯০ ফিট উঁচু এক মূর্তি স্থাপন করেন আর নির্মাণ করেন সংরক্ষণাগার যার উল্লেখ রয়েছে বাইবেলে। এসব সংরক্ষণাগার কাজে লাগে হিব্রাইটদের বিরুদ্ধে সিরিয়ায় যুদ্ধ পরিচালনার সময় রসদ সরবরাহে। সন্দেহ নাই রামেসেস এসব কাজে স্থানীয় লোকদের বাধ্যতামূলক শ্রম আদায় করতেন।
দ্বিতীয় রামেসেসের দীর্ঘ রাজত্বকাল মিশরবাসীর জন্য কল্যাণকর ছিলনা, যেমনটা ছিলনা দ্বিতীয় পেপির রাজত্বকাল। সমৃদ্ধ স্বস্তিকর নগরজীবনে থেকে মিশরবাসীরা বিপজ্জনক সৈনিক জীবনে যেতে মোটেই ইচ্ছুক ছিলনা যেখানে অর্থের বিনিময়ে বহিরাগতদের সৈনিক হিসাবে পাওয়া সহজ ছিল। শাসকদের কাছেও স্বদেশীদের চাইতে ভাড়াটিয়া সৈন্যই বেশি পছন্দনীয় ছিল, কারণ স্বদেশী সৈন্যরা বিদেশে যুদ্ধে যাওয়ার চাইতে দেশের অভ্যন্তরে অসন্তোষ দমনেই বেশি উৎসাহ দেখাত।
তবে দুটি বড় প্রতিবন্ধকতা অনেক সুবিধাকেই ম্লান করে দেয়। প্রথমত যদি কখনো দেশ সংকটে পড়ে আর ভাড়াটিয়া সৈন্যদের পাওনা পরিশোধ করতে না পারে, তাহলে সেই সৈন্যরা মহা আনন্দে হাতের কাছে যা পাবে তাই লুটপাট করে নেবে, আর তখন তারাই দেশবাসীর কাছে বিদেশি আক্রমণকারীদের চাইতে বড় বিপদ হয়ে দেখা দেবে। দ্বিতীয়ত শাসক যখন যুদ্ধ পরিচালনা ও নিজের সুরক্ষার জন্য ভাড়াটিয়া সৈন্যদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, তখন তিনি সেসব সৈন্যদের হাতের পুতুলে পরিণত হন, আর তখন তিনি এক মৃতদেহ ছাড়া আর কিছু নন। ইতিহাসে এমনটা বারবার ঘটেছে।
.
গৌরবের সমাপ্তি
১২২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্বিতীয় রামেসেসের রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে, মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল প্রায় ৯০ বছর। একটা উপযুক্ত সময়েই তার মৃত্যু। তার রাজত্বের বিস্তৃতি সর্বকালের সর্ববৃহৎ, আর তার সবচেয়ে বড় শত্রু দৈবক্রমে দুর্বল অবস্থায় ছিল। এটা মিশরের প্রত্যক্ষ প্রচেষ্টায় ঘটেনি, বরং অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর গৃহযুদ্ধের ফসল। সে সময় মিশর সমৃদ্ধ, সম্পদশালী আর শান্তিময়। অগণিত পত্নী আর উপপত্নীর এক দঙ্গল পুত্রকন্যা রেখে যান তিনি।
রামেসেসের ত্রয়োদশ পুত্র মানেণ্টা তার উত্তরাধিকার লাভ করেন। ইতিমধ্যেই মার্নেস্টার বয়স ষাট বছরে পৌঁছে গেছে, আর তিনি তার পিতার নিয়মনীতি অনুসরণের চেষ্টা করেন। তিনি মিশরের নিয়ন্ত্রণাধীন সিরীয় অঞ্চলে বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হন। আর সেটা করতে গিয়ে প্রথমবারের মতো ইতিহাসে ইসরাইল নামটা উঠে আসে।
স্পষ্টতই, ইখনাতনের শাসনকালের মতো পূর্বদিকের কেনানীয় শহর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মরু যাযাবররা ছুটে আসতে থাকে। এই জাতিগুলিই ইতিহাসে ইসরায়েলি নামে অভিহিত। তারা দেখেছিল কেনানীয় শহরগুলি মোয়াব, এদন ও আমন রাজ্য পরিবেষ্টিত, ইখনাতনের আমলে যারা ইসরায়েলিদের সমগোত্রীয় ছিল। প্রতিষ্ঠিত রাজ্যগুলি নবাগতদের বিরোধীতা করে। আপাতদৃষ্টিতে মার্নেস্টার সৈন্যবাহিনী যুদ্ধে অংশ নেয় এবং বিজয় লাভ করে। মানেন্টার লিপিতে এই নিয়ে গর্ব করা হয় যে “ইসরাইলিদের ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হয় আর তাদের সব চিহ্ন মুছে ফেলা হয়।“ অবশ্য এই কথাটার মধ্যে অতিরঞ্জন আছে, আর মিশরীয় লিপিতে এধরনের অতিরঞ্জন অস্বাভাবিক নয়।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় লিডিয়াতে মার্নেপ্টার অভিযান সফল হয়েছিল। তবে বজ্রাঘাত নেমে এল অপ্রত্যাশিত এক দিক থেকে। হাজার হাজার বছর ধরে মিশরীয়রা যে দিকটাকে সুরক্ষিত ভেবেছিল সেই সমুদ্রের দিক থেকে।
মিশরীয়রা কখনোই সমুদ্রগামি জাতি ছিলনা, আর সমুদ্রগামি ক্রিটীয়দের তরফ থেকে কখনোই অশঙ্কা দেখা দেয়নি। ক্রিটীয় সভ্যতার দ্যুতি সর্বদা উত্তরে ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের দিকে প্রতিফলিত হয়, ইউরোপের সেই অঞ্চলে এখন যেখানে গ্রীস। মিশরে হিক্সস আধিপত্যের সময়ে গ্রিক ভাষাভাষী জনগণ মূল ভূখণ্ডে নিজেদের সুন্দর উন্নত শহর নির্মাণ করেছিল, আর সেক্ষেত্রে তারা ক্রিটীয় ধারা অনুসরণ করেছিল।
যেখানে ক্রিটীয়রা সবসময় সমুদ্রনির্ভর বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল এবং শান্তির পথ অনুসরণ করেছিল, মূল ভূখণ্ডে গ্রিকরা ছিল তার বিপরীত। তারা যেমন প্রায়ই তীব্র লড়াইয়ে নিয়োজিত ছিল তেমনি উত্তর থেকে লড়াকু জাতির আক্রমণের আতঙ্কে থাকত। তাদের শহরের চারদিকে থাকত অত্যন্ত পুরু দেয়ালের প্রাচীর যাকে বলা হতো “মাইসেনি”। তাই গ্রিক সভ্যতার আদি পর্বকে বলা হতো মাইসেনীয় যুগ।
অবিরাম যুদ্ধবিগ্রহে নিয়োজিত থাকার কারণে মাইসেনীয়রা উচ্চমাত্রার সামরিক কৌশল আয়ত্ত করতে পেরেছিল, আর জাহাজ নির্মাণ করে সমুদ্রে প্রবেশাধিকার অর্জনের পর, কীটবাসীরা আর তাদের মোকাবেলা করতে পারেনি, আর মিশর যখন অষ্টাদশ রাজবংশের অধীনে ক্ষমতার উচ্চ শিখরে, তখন মাইসেনীয় জলদসরা ক্রীট আক্রমণ করে দখল করে নেয়।
তবে এসব অনেক দূরের ঘটনা, আর লবণ সমুদ্র পার হয়ে তাদের মিশরে পৌঁছানো দূরাগত সম্ভাবনা। মিশরীয় সাম্রাজ্যের সোনালি দিনগুলিতে তাদের নিয়ে কেউই তেমন চিন্তিত ছিলনা, মাইসেনীয়দের ক্রীট দখলের দুই শতাব্দী পরেও মিশর নিরাপদেই ছিল। এই পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হতে পারত, তবে মাইসেনীয়রা নিজেরাই উত্তরের দিক থেকে চাপের মুখে ছিল। আরও উত্তরের গ্রিক ভাষাভাষী উপজাতীয় লোকেরা ক্রিটীয় সভ্যতার কোমল মনোভাব আয়ত্ত করতে পারেনি। আর তাদের শক্ত মনোভাবের প্রধান উপাদান ছিল লৌহ।
বিগত দু’হাজার বছর ধরে অস্ত্র বানাবার উপাদান ছিল ব্রোঞ্জ, যদিও শক্ত বর্ম বানাতে লোহা ব্যবহার করা হতো। তবে সমস্যা লোহা ছিল এক দুষ্প্রাপ্য ধাতু, যা শুধু হঠাৎ উল্কাপাতের মাধ্যমেই লাভ করা যেত। আর এটা মোটেই সহজলভ্য ছিলনা। এর জন্য প্রয়োজন হতো অনেক বেশি তাপমাত্রার অগ্নিশিখা আর উন্নত কৃৎকৌশল।
মাইসেনীয়দের জন্য যখন উত্তরের আগ্রাসকদের সামাল দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে উঠল, তখন তারা দক্ষিণ ও পূর্বদিকে দৃষ্টি দিতে শুরু করল। ট্রয়ের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মেনেপ্টার রাজত্বকালে, অথবা তার সামান্য কিছু পরে, যা মাইসেনীয়দের পূর্বদিকে হটিয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছিল। অন্যান্য জলদস্যুরা দক্ষিণ দিকে দৃষ্টি দিয়ে লিবীয় উপকূলে অবতরণ করেছিল। লিবীয় উপজাতিগোষ্ঠীর অত্যুৎসাহী সহায়তায় তারা মিশরীয় ভূমির দিকে অভিযান চালাতে শুরু করে। গ্রিক কল্পকথায় দেখা যায় স্পার্টার রাজা মেনিলাউস, ট্রয়ের যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে কিছুদিন মিশরে অবস্থান করেছিলেন। এটা মিশর উপকূলে বিদেশি শোষণের একটা ধূসর স্মৃতি
ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূল তখন জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। হিভাইটরা যখন আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধে মগ্ন তখন পশ্চিম এশিয়ার একটি জাতি ফ্রিজিয়ানরা পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কিয়ঙ্কালের জন্য সভ্যতার দৌড়ে হিট্টাইটরা মিশরীয়দের সাথে পাল্লা দিচ্ছিল, এবার তারা ইতিহাসের পাতা থেকে চিরতরে হারিয়ে গেল (তবে একটি হিটাইট শহর দুই শতাব্দী পরেও টিকে ছিল সিরিয়ায়, আর ইসরাইলের রাজা ডেভিডের এক সেনাপতি হিটাইট উরিয়াকে, সেখানে দেখা যায়)।
সমুদ্রচারী এসব জাতির আক্রমণে মিশর লণ্ডভন্ড। তবে হিট্টাইটদের মতো মিশরীয়রা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি কিন্তু এদের বিতাড়িত করতে গিয়ে এতই শক্তিক্ষয় হয়েছিল যে তাদের চরণ টলোমলো আর চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। তারা আর কখনোই পূর্বের অবস্থানে ফিরে যেতে পারেনি।
একটা কথা প্রচলিত আছে যে মার্কেন্টাই এক্সোডাসের ফারাও, মুসা নবীর অভিশাপে যার উপরে প্লেগ অবতীর্ণ হয়, আর যিনি লোহিত সাগরে ডুবে মরেন। এটা সত্য হওয়ার কিছুটা সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ সমুদ্রচারীদের দিক থেকে একটা বিপর্যয় অবশ্যই নেমে এসেছিল।
প্রকৃতপক্ষে বিশৃঙ্খলার সময়ে এশীয় আক্ৰামকরা সেই সুযোগ নিয়ে থাকতে পারে। তবে বাইবেলীয় কাহিনীকে অনেকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করলেও প্রাচীন মিশরীয় এমন কোনো প্রাচীন লিপি পাওয়া যায়নি যেখানে দাসত্বপ্রাপ্ত কোনো ইসরাইলিদের বিবরণ পাওয়া যায়, অথবা মুসার আমলের কোনো প্লেগের বিবরণ। কোনো ফারাও সমুদ্রে ডোবার কথাও দেখা যায়না।