২৬.
বিকেলের পরে পুরো কালীগঞ্জ-মোকামপাড়া থমথম করছিল সাদাতের শোকে। থানার ওয়ারলেসে খবর এসেছে অনেক আগে। খবরটা শোনার পর থেকে কথা হারিয়ে দুলু চায়ের দোকানে বসে আছে চুপচাপ। মানোয়ারাকে এমন সংবাদ সে কোনোদিন দিতে পারবে না। আল্লাতালার এ কী নিদান! মাথায় কোনো কিছু ঢুকছিল না তার। জলজ্যান্ত মানুষটা ট্রাক নিয়ে গেল, কপালের কী লিখন, শেষে কিনা সেই ট্রাক বয়ে আনবে তার লাশ।
চা-দোকানী বলল, মন খারাপ করে কী হবে। ঠাণ্ডা পড়চে জব্বর। চা খাও।
হুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে দুলু বলল, দাও এক কাপ। জানো দাদা, মনটা ভালো লাগচে না গো।
-ভালো না লাগারই কথা। দোকানদার আড় চোখে তাকাল, তার চোখের ভাষা অন্য, তুমার তো ভালো হল, ভাই। পাখি এবার তুমার উঠানে দানা খাবে।
তার মানে? ভাঁড়ের চা চলকে গায়ে পড়ল দুলুর, হু-হু জ্বালা করে উঠল, শালা দোজকের কীট, কুথায় কি বলতে হয় জানো না বুঝি? কোন আল্লা তুমাকে মানুষ করে পাঠিয়েছিল কে জানে! তুমি তো কাফেরেরও অধম। আগে জানলে আমি তুমার দোকানে বসতামনি।
দুলু চায়ের ভাঁড়টা রাস্তায় ছুঁড়ে দিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াল।
সাইকেল নিয়ে থানায় গিয়েছিল মানোয়ারার চাচাতো ভাই ফজলু। সে হঠাৎ দুলুকে দেখে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল, খবর শুনেছিস? মানোয়ারার কপাল পুড়ল। সাদাত খুন হয়েছে। আহা রে, বুনটার আমার কি হবে বল তো?
কথা বলার ইচ্ছা করছিল না দুলুর, কী বলবে সে, বলার মতো কিছু বাকি নেই তার। ফজলু তবু ব্যস্ত হয়ে বলল, লাশ রাত আটটায় এসে যাবে। তুই একটু থাকিস।
দুলু ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। মাথাটা ভার হয়ে আছে সেই তখন থেকে। কোনো কিছু ভালো লাগছে না তার। মানোয়ারার উপর তার এখন আর কোনো টান নেই। মানোয়ারা নিজের হাতে খুন করেছে এই সম্পর্ক। নিজেকে আড়ালে সরিয়ে নিয়েছে সে। সে তো চাম এঁটুলি নয় যে জোর করে কারোর গায়ে আটকে যাবে।
ঘরে গিয়ে মন বসল না দুলুর, তার কান খাড়া হয়ে রইল একটা শব্দ শোনার জন্য। এত দূর থেকে মানোয়ারার সুর ভাসানো বিলাপ ভেসে এল বাতাসে। সত্যি কপাল পুড়েছে মানোয়ারার নাহলে গর্ভের সন্তান কেন বাপের মুখ দেখতে পাবে না।
আটটা নয় নটার পরে ট্রাক এসে থামল তেঁতুলতলায়। সঙ্গে দু-জন পুলিশ এবং আরো লোকজন। চাঁদ মহম্মদ পাগলের মতো ঘুরছে খবরটা শোনার পর থেকে আর মাঝে মাঝে চেপে ধরছে চুলের গোছা। বুক ভাসানো আর্তনাদে সে যেন খুঁজে পেতে চাইছে শোকের সান্ত্বনা। মেয়ের মুখোমুখি দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই তার। কেঁদে কেঁদে মেয়েটা তার পাগল হয়ে গেল। এ সময় নুরি বেগম থাকলে মেয়েটাকে সামাল দিতে পারত। ফাঁকা বুকের মাঝখানটা চিনচিনিয়ে উঠল চাঁদ মহম্মদের।
দুল তার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই চিৎকার করে ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁদে উঠল চাঁদ মহম্মদ। কাঁদতে কাঁদতে সে লুটিয়ে পড়ল তেঁতুলতলার ধুলোয়। ততক্ষণে পুরো পাড়া লুটিয়ে পড়েছে সাদাতের লাশের উপর। শ’ মানুষের চিৎকারে ডুবে যেতে লাগল মানোয়ারার হৃদয় নিঃসারিত কান্না।
.
বাঁধের উপর দাঁড়ালে পুরো আকাশ যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে দূরের আখ খেতের উপর। ভিকনাথ দূরের দিকে তাকালো। সাহেবমাঠ থেকে ফিরে তার মাথার কোনো ঠিক নেই। ঘরের দরজায় টিপতালা মারা, খাঁ-খাঁ করছে চারপাশ। এই অবেলায় ঝারি গেল কোথায়?
বউটার পাড়া ঘোরার স্বভাব। ঘরে তার মন মোটে তিতে চায় না। শুধু বাইরপানে টান। কি যে পায় টো-টো করে ঘুরে কে জানে? ভিকনাথ কত দিন তাকে মানা করেছে, কথা শোনে নি। আজকাল তার স্বভাব হয়েছে বেয়াড়া। ভিকনাথ কোনো কথা বললে এ কান দিয়ে শুনে ও কান দিয়ে বের করে দেয়। বেশি বললে খিলখিল করে হাসে। ইচ্ছে করে বুকের কাপড় ফেলে দিয়ে ফাঁদ পেতে বসে থাকে পাখি ধরার জন্য।
বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে তেষ্টায় গলাটা খড়খড় করছিল ভিকনাথের। টিউকলের কাছে গিয়ে মুখ লাগিয়ে আর জল খেতে মন হল না। বয়স হয়েছে, এখন কি ওসব মানায়?
ভিকনাথ ঢালু পথ বেয়ে নেমে গেল বুড়িগাঙের দিকে। জল এখন শান্ত, কালচে সাপের মতো। সেই হিলহিলানো জলের দিকে তাকিয়ে ভিকনাথ ভাবছিল তার পোকাড়ে ভাগ্যের কথা। বিয়ের সময় তার মা বেঁচেছিল। কত করে মানা করল, রূপের ফাঁদে পা দিস নে বাপ। ফর্সা দেখে ঢললি, এটা কি তুর উচিত হল। মনে রাখিস ফরসা হল গিয়ে গুয়ের মালসা। ওদের যত ঘাটবি বদ-ঘেরান বেরুবে। দুর্গন্ধে মরে যাবি বাপ।
মায়ের কথাকে সেদিন কানে তোলে নি ভিকনাথ। ঝারির গালে টোল ফেলা হাসিটাই বারবার করে তাতিয়ে দিল তাকে। বিয়ের আগে ঝারিকে চুমা খেল সে ঝোপের আড়ালে। ঝারিও তাকে কোনো বাধা দিল না। পাখির মতো নরম চোখ তুলে বলল, আবার এসো। এবার এলে রেতের বেলায় এসো। মুরগি মেরে খাওয়াব।
-মুরগি তো আমাদের দেশেও পাওয়া যায়? শুধু মানসোর খাওয়ার জন্য এতদূর কেন আসব?
-তুমার মতলবের কতা বুঝেচি৷ ঝারি আবার গালে টোল ফেলে হাসল, যা খেতে চাও সব পাবা। তবে তার আগে গাছতলায় আমার কপালটা সিঁদুরে ফেটিয়ে দিও। মধু খেয়ে উড়ে গেলে আমি যে তখুন মরব।
ছিঃ, অমন কতা বলো না গো, প্রাণে বড়ো বাজে। আমারে যা ভাবো, আমি তেমনধারা নই গো। সময় এলে মিলিয়ে নিও।
এতদিন ধরে ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে চলেছে ভিকনাথ। কত রাগ মনের ভেতর উথলায়। সব রাগ জল হয়ে যায় ঝারির হাসোন ভরা মুখটা দেখলে। বউটা আগে তো এমন ছিল না। ওই লুলারাম ওর কচি মাথাটা চিবিয়ে খেল। এটা সেটা দিয়ে মনটাও হাতিয়ে নিয়েছে সে।
ঝারি আগে মাঠের কাজে যেত, এখন আর সে যায় না। কেন যাবে? তার আঁচলের গেরোয় এখন সব সময় টাকা বাঁধা। লুলারাম তাকে লুকিয়ে-চুরিয়ে টাকা দেয়। টাকার বদলে ঝারি তাকে সব দেয়। এখানেই মরমে মরে যায় ভিকনাথ। তার হাত-পা রাগে অসাড় হয়ে যায়। মাথার ভেতর দশাতে থাকে বিষপোকা।
দু-জনের একজনকে খতম করে দেবে ভিকনাথ। একটা ফুলে দুটো ভ্রমর থাকবে কেন? একটা আকাশে দুটো চাঁদ কখনও কিহয়? সুফল ও সাথ দিল না। যদি সাথ দিত তাহলে কবে পগারপার হয়ে যেত লুলারাম।
সারাদিন রোদে জ্বলেছে ভিকনাথের শরীর, মাঠের কাজে ঝলসে গেছে রঙ। হাড়মাস কালি হয়ে যাবার যোগাড়। ঘরে এসেও বউয়ের হাতের এক গ্লাস জল পেল না। বউ গিয়েছে শ্যামের বাঁশি শুনে ঢলাতে। মা শীতলাবুড়ি, এ কী যুগ দিলে গো? ডিকনাথের ঠোঁট নড়ে চড়বড়িয়ে। পাগলের মতো সে খুঁজতে থাকে ঝারিকে। হাতের কাস্তেটা সে ফেলে না, শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। এই কাস্তে দিয়ে মাঠে ঘাস কাটতে গিয়ে একটা খরিদ সাপের ড্যাকাকে কেটে ফেলেছিল সে। খরিম সাপের ছায়ের তেজ মা-খরিসের চেয়েও বেশি। সেই তেজী বিষধর সাপকে সে যদি কাটতে পারে তাহলে লুলারাম কোথাকার কোন ছার। একবার দেখা হলে এপার না হয় ওপার। এক কোপের বেশি দু’কোপ নেবে না সে।
আবার রাগটা চলকে ওঠে বুকের ভিতর। মা মাগো শক্তি দাও। মা শীতলা বুড়ি, তুমি এর বিচার করো। মুখের রক্ত উঠিয়ে মারো ওদের। আমার অর্থ নেই, অস্ত্র নেই, কিছু নেই। আমাকে বিচার দাও মা। না হলে আমি পাগল হয়ে যাবো। বাঁধের উপর বুক চাপড়ে দৌড়োবো। আমাকে কেউ ধরতি পারবে না। মা গো, মা। আমার মুখ রেখো মা। আবার নড়ে ওঠে ভিকনাথের ঠোঁট। যেন ঢাকের কাঠি চড়বড় করছে চামড়ায়। এবার বাজনা বাজবে। শিব নাচবে। ডাকিনী-যোগিনী সব নাচবে। ভিকনাথ সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আখখেতের আলোর উপর দাঁড়াল।
হতাশ ভিকনাথ একসময় ঘরের দিকে ফিরে আসে। গাই-বাছুরে মিল থাকলে সে কি করবে? হায়রে কলি, আমার বুকে শেল দে। এ পাপ আমি আর হজমাতে পারছি না। হয় আমাকে নে, নয়তো ওদের নে। এ খেলা সাঙ্গ কর। ঢের হল। বেলা গেল। ভিকনাথের আফসোসবাধের বাতাসে ডাং গুলি খেলে। খলখলিয়ে ওঠে আখগাছের ঢেউ। বেশির ভাগ আখ কেটে নিয়ে গিয়েছে কোম্পানীর লোক। মিল কোম্পানীর পেয়ালা ঘুরে ঘুরে পাহারা দেয়, রাতকালে ডাক ভাসায়, মাঠের অন্য প্রান্ত থেকে সাড়া আসে, জাগো হে, জাগো জাগো।
এভাবেই বয়স বাড়ে সন্ধ্যার। তৃপ্ত হয়ে ঘরে আসে ঝারি। ভিকনাথ আসে তারও কিছু পরে। জোনাকপোকা টিমটিম করে জ্বলছে আলো। লেবুতলার ঝোড়ে ঝি ঝি পোকার উৎস বসেছে। আকাশ ভারত। তুলোবরণ মেঘ উড়ছে। তিনঝুঁটিয়া চুলায় কাঠের হুল ঠেলে দেয় যার, অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে চাফুটেছে টগবগিয়ে, একটা গুনগুনানো সুর ঝারির কমলায়ে ঠোঁটে জলের মুখে ফেনার মতো নরম হয়ে বাজে।
ভিকনাথ ঘরে ঢুকেই কটাশ চোখে তাকাল, চা-পাতার ফুটন্ত গন্ধটা বুকভরে টেনে নিয়ে সে কিছুটা নরম হবার চেষ্টা করল, কুথায় গেছিলে সাঁঝবেলায়?
যাব আর কুথায়। ঘরে জ্বালানি নেই। জ্বাল দেবার কাঠ ঢুনতে গেছিলাম। ঝারির চোখে মিথ্যে ঠেলে উঠল।
মিছে কথা বলতে মুখে বাঁধল না। ভিকনাথ ধীরে ধীরে তাতছিল।
ঝারি ঠোঁট উল্টে বলল, মিচে বলব কেনে? আমার সাথে ভারতী-বউদি গিয়েচিলো। বিশ্বেস না হয় শুধোও গে যাও।
চুলা থেকে চায়ের বাটিটা নামিয়ে গুঁড়া দুধ গুলল ঝারি। একটা জোনাক পোকা উড়তে উড়তে তার মাথার চুলে আটকে গেল। অন্য সময় হলে ঝারি ওই পোকাটাকে ধরে দেশলাইয়ে খালি খোলের ভেতর পুরে রাখত। আজ মেজাজ ঠিক নেই, ভিকনাথ তার মেজাজ বিগড়ে দিয়েছে, ঝারি চোরা চোখে ভিকনাথের দিকে তাকিয়ে ভারমুখ ঝুলিয়ে বসে থাকল।
ভিকনাথের নজর এড়াল না এসব, রাতের কথা ভেবে তার গলার সুর চটকানো কলার চেয়েও নরম হয়ে এল, তুমাকে ঘরে না দেখলে মাথায় আমার বোলতা কেমড়ে দেয়। তা ছাড়া দশ লোকে দশ কথা বলে। আমি যে কুনদিকে যাবো ঠিক বুঝতে পারচিনে।
অতো সন্দেহ নিয়ে বাঁচা যায় না। ঝারি ফুঁপিয়ে উঠল, এত বছর ঘর করচি হর রোজ পাশে শুচ্চি তবু তুমার বিশেস হয় না। বল, কী করলে তুমার বিশ্বেস হবে?
ভিকনাথ ফাঁদে পড়া চোখে তাকাল, তুমাকে আমি ঠিকঠাক বুঝতে পারিনে।
–নিজেকে ঠিক বোঝো তো? চোখ মুছে কোনোমতে বলল ঝারি, কলিজা উপড়ে দিলেও তুমি আমারে বিশ্বেস করবে না। ওই সুফল ওঝা তুমার মাথাটা চিবিয়ে খেয়েছে। জানি নে ওর পিচে পিচে ঘুরে তুমার কি লাভ হয়? এর চেয়ে ঘরের কাজে মন দাও, কাজের কাজ হবে।
কিছুটা কুণ্ঠিত ভিকনাথ ঢোঁক গিলে ঝারির মুখের দিকে তাকাল, কানবার কি আচে? আমি খেটেখুটে ফিরলাম। ঘর বন্ধ। কোন মানুষটার মাথার ঠিক থাকে?
-তা বলে মুখে যে আসে তাই বলবে? ভাড়া করা মেয়েমানুষকেও কেউ অমন ভাষায় কথা বলে না। আমার কুনো যাওয়ার জায়গা নেই, তাই মুখে কুলুপ এঁটে পড়ে আচি। অন্য কেউ হলে অমন সনসারের মুখে লাথি মেরে ড্যাং-ড্যাং করে চলে যেত। আমি পারচি নে বলে আমাকে এত সাতাবে। শীতলা মা তুমার ভালো করবে নি।
–চা দাও দিনি, আর মিলা খ্যাজরম্যাজর করো নি। ভিকনাথ স্বস্তি এবং শান্তি ফিরিয়ে আনতে চাইল ওদের মাঝখানে।
দপ দপ করে জ্বলছিল ডিবরিটা, ময়লা জমেছে সলতেয়। সম্পর্কেও যদি ময়লা জমে তেল পৌঁছাতে পারে না ডগায়। ঝারি হার মানার মেয়ে নয়। সে সাতঘাট চষা মেয়ে। সরু কোমরে হিল্লোল জাগিয়ে বলল, লোকের মুখে ঝাল খেয়ে নিজের মাথায় ঘুঘরো পোকা কেন ঢুকালে বুঝিনে। সত্যি করে বলল তো লুলারামদা আমাদের কি কুনো খারাপ চায়? দায়ে-অদায়ে এগাঁয়ের কেউ তো পাশে দাঁড়ায় না, সে ছাড়া। যে মানুষটা কালো চুলের ভালো করবে তুমি তার পিছে লাগবে? কেমন মানুষ গো তুমি? যে তুমার ভালো করবে তারেই তুমি আছোলা বাঁশ দিবে।
-ওই হারামীটার নাম তুমি আর আমার ছিমুতে নিও না। ওর নাম শুনলে আমার গা চিড়বিড় করে। মুখ বেঁকিয়ে সমস্ত শরীরে একটা অপ্রতিরোধ্য ঘৃণার জন্ম দিল ভিকনাথ, ওর হয়ে ওকালতি করতে তুমার শরম লাগছে না। আমি হলে তো গলায় দড়ি দিয়ে মরতাম। ধাওড়াপাড়ার কেউ ওরে পছন্দ করে না। সব্বাই জানে–ও একটা রাড়ুয়া।
ঝারির বুকের গভীরে মোচড় দিয়ে উঠল ব্যথা, কী যা তা বলচো? কারোর সাথে কেউ কথা বললে খারাপ হয়ে যায় না। এক পাড়ায় গায়ে গা লাগিয়ে থাকি, দেখা হলো তো হাসতে হয়, কথা বলতে হয়। না হলে বনবাদাড়ে থাকা ভালো।
কিছুক্ষণ গুম ধরে থেকে ভিকনাথ অন্ধকারে তাকাল, পেঁচাটা ঘাপটি মেরে বসে আছে চারা জামগাছের ডালে, ওর চোখ দুটো জুলজুল করছে আঁধারে। ওই পেঁচাটার মতো লুলারামকে মনে হল ভিকনাথের। ঝারিকে সে ইঁদুরের মতো ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়েছে তার কাছ থেকে। ঝারিও তার পুরুষ-ঠোঁটের ফাঁকে জিভ ঢুকিয়ে তাপ নেয়। জগৎখালি বাঁধের নীচে ওদের প্রায়ই দেখা যায়। লোকে যা বলে–সব কথা কি বানানো? যা রটে তা কিছু না কিছু বটে।
কপালে ভাঁজ ফেলে ভিকনাথ বলল, তুমি ওর সাথে কথা বলবে নি। তুমি ওর সাথে কথা বললে দশ লোকে দশ কথা শোনায় আমাকে।
-তা তো শোনাবেই। নরম মাটিতে যে বেড়াল বাহ্যি সারে গো! ঝারি অদ্ভুত দক্ষতায় মুখে বিষাদ মাখিয়ে হাসল।
ভিকনাথ নিজেকে শুনিয়ে বলল, গাঁয়ে বাস করলে গাঁয়ের মানুষের কথা শুনতে হবে। তুমাকে নিয়ে কতবার বিচার সভা বসল। কই পাড়ায় আর কুনো বউকে নিয়ে তো এসব হয় না।
আরে কুনো বউতো আমার মতন নজর কাড়া নয়। ঝারি তার কাচবরণ শরীরের দিকে তাকাল। এই শরীরটাই তার কাল হল। সুফল ওঝাও ছিপ ফেলতে চেয়েছিল শরীরের নদীতে। ঝারি তাকে হাসতে হাসতে ফিরিয়ে দিয়েছে। ভরা বুকে জল ছলছল ঢেউ দিয়ে বলেছে, তুমার মেয়ের চাইতে আমি আর ক’ বছরের বড়ো হবো গো। আমাকে মেয়ে না ভাবো, বুন ভাবতে দোষ কুথায়?
সুফল ওঝা মনোক্ষুণ্ণ হয়ে ফিরে গিয়েছে। ঝারি আর এই পাপকথা দু’কান করার স্পর্ধা দেখায় নি। বরং নিজেকে বাঁধ দিয়েছে গোপনে। হাজার ঝামেলার মধ্যেও লুলারামকে হারের লকেটের মতো ঝুলিয়ে রেখেছে বুকের ভিতর। সবাইকে ভুলে গেলেও লুলারামকে সে ভুলতে পারবে না কোনোদিনও।
লুলারাম প্রায়ই বলে, চলো আমরা পেলিয়ে যাই। এত গুজুর পুটুর আর ভাল্ লাগে না। এভাবে লুকিয়ে-চুরিয়ে কি বাঁচা যায় গো?
ঝারির সমস্ত শরীর ঝাঁকা দেওয়া কুলগাছের মতো নড়ে উঠেছে, লুলারামের বুকে আঙুলের নিড়ুনি দিয়ে বলেছে, নিজের সুখের জন্য মেয়ে দুটার কথা কি তুমি ভাববে না। বৌদি নেই। সে থাকলে এট্টা অন্য কথা। বৌদির অবর্তমানে মেয়ে দুটাই তুমার সব। ওদের ব্যা-থা হয়ে গেলে তখন এসব আর একবার ভাবা যাবে। এখন এসব মুখে আনাও পাপ।
ঝারির স্পষ্ট কথা শুনে লুলারাম আর দ্বিতীয়বার এমন কথা মুখে আনার সাহস পায়নি। ঝারি তার চাইতে বয়েসে অনেক ছোট তবু ওর কথাবার্তায় যে বুদ্ধিমত্তার ছাপ আছে তা লুলারামকে অবাক না করে পারে না। তবু চিনচিনে একটা কষ্ট ঝারির জন্য তার ভিতরে চোরাস্রোতের মতো বয়ে যায়।
ঢিলির আত্মহত্যা ঝারিকে প্রচণ্ড দুঃখ দিয়ে গেছে। লুলারামের মুখ চেয়ে সে পাড়া ছেড়ে চলে গিয়েছে দু-মাসের উপর। দু-মাস লুলারাম তার বাপের বাড়িতে এসে দেখা করে গেছে, গোপনে সে বাঁচিয়ে রেখেছে অবৈধ সম্পর্কের বিষগাছ।
ঝারি যত বড়ো মুখ করে বলুক না কেন লুলারামের সাথে তার সম্পর্কটা লতিয়ে পেঁচিয়ে জড়িয়ে গিয়েছে সংসারের গায়ে। তার ঝটকা এসে লাগছে ভিকনাথের অস্থির মনে। সে আরো বিব্রত হয়ে পড়ছে। তার চোখের সামনে সব রাস্তাগুলো অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে।
দু-বেলা দু-মুঠো ভাত ছাড়া সে ঝারিকে আর কি সুখ দিতে পেরেছে। বিয়ের এত বছর পরেও কোল ভরল না ঝারির। ওর শরীরে দোষ আছে, ভূষণীবুড়ি গণনা করে বলে ছিল কথাগুলো। সব গাছে যে ফুল-ফল হয় এমন নয়। ঝারি স্বর্ণলতার মতো একলা, তার চোখ ধাঁধানো রূপ আছে কিন্তু সেই রূপের ব্যবহারিক কোনো প্রয়োগ নেই।
ভিকনাথের তিনকুলে কেউ নেই সেই জন্য খোটা খাওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছে ঝারি। শাশুড়ি-ননদ থাকলে ওরা খোঁটা দিয়ে কানের পোকা বের করে ছেড়ে দিত। সেদিক থেকে ঝারি এখন ঝাড়া হাত-পা। শুধু লুলারাম আক্ষেপ করে বলে, আষাঢ়ে চাষ করে খেততলা ভরবেনি এ কেমুন কথা গো? চলো, গোয়াড়ী গিয়ে তুমারে বড়ো ডাক্তার দেখিয়ে আনি। আমার যে অনেক দিনের সখ তোমার গর্ভে আমার ছেলে যেন খেলা করে।
-যা হবার নয়, তা বারবার বলে আমায় কেনে দুঃখ দাও? ঝারির বুকের মধ্যে কাঁপুনি দেওয়া তোলপাড় শুরু হল।
লুলারাম তার চওড়া কপালে চাঁদের মতো ছোট্ট চুমা খেয়ে বলল, কেন দুঃখ পাও, তুমার এই শরীলে দুঃখ বড়ো বেমানান। যত দিন বাঁচবা মুখে হাসি রেখে বেঁচো, দেখ না মাছেরা কেমুন বেঁচে থাকে, কখনও কানদে না।
ঝারি কুঁকড়ে গেল, তুমি আমারে এত ভালোবাসো তার প্রতিদানে আমি তুমারে কিছু দিতে পারলাম না। মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো। বিথা এ শরীল বয়ে বেড়িয়ে কী লাভ? এর চেয়ে গলায় ফাঁস নেওয়া ঢের ভালো।
কথাটা শোনার পর গভীর বিষাদ আর অনন্ত আক্ষেপে লুলারামের মুখটা উঠে গেল আকাশের দিকে, কী কথা শোনালে গো, এ কথা কানে শোনাও পাপ। তুমি যদি মরার কথা ভাবো আমি তাহলে কী করে বাঁচার কথা ভাবব? তুমার-আমার বাঁচা মরা তো লাঠাই-ঘুঁড়ির সম্পর্ক।
রাত বেড়ে যায় নিজস্ব নিয়মে। জামগাছের পেঁচাটা উড়ে গিয়ে বসে পাশের বাড়ির কুলগাছে। বাসার মধ্যে বসে থাকা পাখিগুলো ঘুম ভেঙে ডেকে ওঠে কিচির মিচির। পেঁচার গায়ের গন্ধে তাদের ভয় বাড়ে বই কমে না।
ভিকনাথ বিড়ি ধরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভাঙনটা সে টের পেয়ে গিয়েছে। ঝারি একটা স্বপ্নের সাঁকোর উপর দাঁড়িয়ে আছে। যে কোনো মুহূর্তে টলে ভেঙে যেতে পারে সেই পলকা সাঁকো।
ভিকনাথকে সে বাধা দেয় না, নিশ্চুপ পায়ে সে হেঁটে আসে বাইরে। শীত হাওয়ার দাপটে কুঁকড়ে আহে গাছের পাতা। শেষ রাতে যদি জ্যোৎস্না ফোটে তাহলে ভোরের ফুলের মতো হেসে উঠবে চরাচর। ঝারি এখনও স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। সম্পর্কটা স্থায়ী হবার পর থেকে সে নূপুর-নোলককে নিজের মেয়ে ভাবতে শুরু করেছে। সে আপন ভাবলে কি হবে–ওরা তাকে শত্রু ভাবে। হাবভাবে জানিয়ে দেয় ওরা তার ছায়া মাড়াতে নারাজ।
লুলারাম নুপুরের ব্যবহারে তিতিবিরক্ত। মেজাজ হারিয়ে একদিন সে নূপুরের গালে চড় মেরেছিল। সেই আঘাতের দাগ তার কিশোরী গালে রক্তখেগো জোঁকের মতো মোটা হয়ে ভেসে উঠল। লজ্জায় ঘর থেকে দু’দিন বেরয়নি নূপুর। মরমে মরে গেল লুলারামও। ঝারি তাকে রাতের বেলায় কত বোঝাল, কাজটা ঠিক করলে না গো, মা মরা মেয়েকে কেউ অমনধারা মারে?
-মারব না? জানো, ও তুমাকে জড়িয়ে কত গালমন্দ করল। লুলারাম বাঘে খেদানো ষাঁড়ের মতন পায়।
-নূপুর যা বলেচে–তাতে তো কুনো ভুল নাই। ঝারির মনটা কেমন হয়ে গেল, ওদের মা নেই, মা থাকলে অন্য কথা। বাপ আচে, বাপও তো ঘরে থাকে না। ফলে মেয়েটার সুখ-দুঃখ কে দেখবে? আমি দেখতে গেলে ওরা তা মেনে নেবে কেন? জানো তো–একগাছের ছাল আরেক গায়ে লাগে না।
ঝারির কথার বাঁধনে অভূত-আশ্চর্য এক সান্ত্বনার মলম লুলারামের অশান্ত বুকে লেপে যায়, তুমি ঠিকই বলেছো, আমি তো এভাবে ভাবিনি। আমি শুধু নিজের সুখের কথা ভেবেচি।
নিজের সুখের কথা তুমি ভাববে তবে বেশি নয়। জানোই তো অমৃত বেশি খেলে হজমায় না, বিষ হয়ে যায়। ঝারির ঝিলিক দেওয়া চোখে সান্ত্বনার হাসি চুঁইয়ে নামল।
লুলারাম গদগদ কণ্ঠে বলল, আমার এ জীবনে মেয়ে আমি কম দেখিনি। অনেক মেয়েকে নেড়ে-ঘেঁটে দেখেচি–তারা শুধু মেয়ে, তার বেশি কিছু নয়। তুমি মেয়ে হয়েও কুথায় যেন জ্যান্ত প্রতিমার শক্তি লুকিয়ে রেখেছো। তোমার ওই শক্তিটাকে আমি দণ্ডবত করি। তোমার শক্তির জোরে আমার যদি কিছু বদল ঘটে।
ঝারি ভ্রূ তুলে বলল, মানুষ নিজে না চাইলে তার কুনো বদল ঘটে না। বদলে যাওয়া অত সহজ কাজ নয়। যারা পারে তারা তো অন্য মানুষ।
লুলারাম বলল, আমি বদলে যাব ঝারি, শুধু তুমি আমাকে এট্টুখানি তাপ চাখতে দিও।
–আমার সবটাই তো তুমার?
–তাহলে ভিকনাথ? মুখ তুলে প্রশ্ন করল লুলারাম।
ঝারি হাসল, ও আমার শরীলটাকে পেয়েছে। ও আমার শরীলটাকেই ভালবাসে, এর বেশি ওর কিছু চাওয়ার নেই। তবে শুনে রাখো–আমি মরে গেলে ও আবার কাউকে বিয়ে করবে। বিয়ে না করে ও থাকতেই পারবে না।
অন্ধকারের হাজার রূপ। ঝারি সেই অন্ধকারের ছবি। শুধু ওর চোখ দুটো আলো জ্বেলে রাখে প্রেম-প্রতীক্ষার।
.
বুড়িগাঙের জলে ঢেউ উঠলে বেড়ে যায় ঠাণ্ডা। তখন আর থাকতে পারে না মুনিরাম, ওর হাতে পায়ের ঘাগুলো রস কেটে টনটনিয়ে ওঠে, অসহ্য যন্ত্রণায় সে আর কঁকিয়ে কেঁদে ওঠে না, চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে হরেকৃষ্ণ হরেরাম গায়।
শীতের শেষটানটা বড়ো ভয়ানক, ধুলো ওড়া দিনের মতো নয়, শেকড় সমেত উপড়ে নিয়ে পালিয়ে যাবার দিন। এই শীতটা পেরলে হয়’ মুনিরাম বিড়বিড়িয়ে ওঠে সব সময়। ইদানীং লুলারাম তার খোঁজখবর নেয় না, সবসময় এটা-সেটা অজুহাতে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ছেলের এই এড়িয়ে যাওয়া হাড়ে হাড়ে টের পায় মুনিরাম, এবং এর কি কারণ সেটাও তার অজানা নয়।
ছেলে যদি কাছে এসে বসত তাহলে যুক্তি দিয়ে দু-চার কথা বলত মুনিরাম। বলত, দায়ের উপর কুমড়ো পড়লে দায়ের কিছু হয় না, কুমড়োই ফালা হয়ে কেটে যায়। বাপরে, সাবধান হ। তুই যার পাল্লায় পড়েচিস, সে তো কুনো সাধারণ মেয়েছেলে নয়। ওর ভেতরে যোগিনী পোরা। আমি জানগুরুর কাচ থিকে খোঁজ নিয়েচি। ওরা বর-বউ দুজনে মিলে এই বিদ্যেটা শিখেচে।
-বলো কি? লুলারাম আকাশ থেকে পড়ল।
মুনিরাম ম্লান মুখে বলল, সত্যি কথা তিতা হয় রে! যদি আমার কথা বিশ্বেস না হয় তাহলে তুই পরীক্ষা করে দেখা যোগিনীর বাঁ-বাহুতে সাপের চোখের চেয়েও চকচকে আঁচিল থাকবে। সেই আঁচিলে হাত ছোঁয়ানো মাত্র ওর শরীলে দশটা হাতির জোর আসবে। ওর কণ্ঠ হয়ে যাবে কোকিলের চেয়েও মিঠে, যা বলবে তাতেই তুই ফাঁদে লটকান ডাহুকের মতন লটকে যাবি।
মুনিরাম যা বলে তার একটাও মিছে নয়। ঝারির কথায় মিছরি গোলা। ওর বাঁ হাতের আঁচিলটায় কতবার যে জিভ ছুঁইয়েছে লুলারাম, যতবারই জিভ ঠেকিয়েছে ততবারই সাপের মতো গা-পাকমোড়া মেরে উঠেছে ঝারি, অমন করো না গো মরে যাব। এ বিদ্যে তোমায় আবার কে শেখাল। তুমার ওই জিভের ডগায় কামদেবতা ভর করেছে। আমাকে পিষে মারো, না হলে আমিও যে ধসে যাব।
জ্যোৎস্নারাতে খোলা মাঠে শরীর যেন খোলা বিল। নদী পেরনো নারী খেগো বাঘের মতো, দাপড়ে-হাঁপড়ে সাঁতরাতে থাকে লুলারাম। ঝারির আহ্লাদী কথায় পৃথিবী বুঝতে পারে–এবার জ্বালামুখী থেকে নিষ্কাশিত হবে ফুটন্ত অগ্নিধারা, ধনধান্যে ভরে যাবে হলদিপোঁতা ধাওড়াপাড়া। বুড়িগাঙের জলে আবার নতুন করে ঢেউ জাগবে, আর সেই ঢেউগুলো হবে ঝারির বুক জাগানো শরীরী ঢেউয়ের চেয়েও মায়াময় জাগ্রত সুন্দর।
লুলারামের মনে প্রশ্নটা অনেকদিনের। পাড়ার লোক বলে-ডাইনি হয়ে গিয়েছে আটকুঁড়া ঝারি। ওর কোল ভরবে কি, ও যে নিজের কোল নিজে খায়। হেইমা, ও যে সর্পজাতক। ওর ভেতরে মাছের মায়ের স্বভাব। ও ঢিলিকে খেয়েছে। তিন-তিনটা বুড়াকে খেয়েচে। ও ভূষণীবুড়িকে খেতে চেয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারল না। দেহ বেঁধে রেখেছিল বুড়িটা। গাঙ বন্ধন, শরীর বন্ধন, মন বন্ধন। কেউ কোথাও নড়বে না, সব যে যার জায়গায় থাকবে। ও মা গো, কী শক্তি গো। প্রকৃতি বাঁচবে তো এই বিপরীত মহাশক্তির কাছে। ঝারি সেই অশুভ শক্তির দাসী হয়ে বেঁচে আছে। ওকে নাড়াঘাটা করলে সবার বিপদ।
কথাটা প্রথম দিকে ছিল ফিসফিসানো পর্যায়ের, পরে তা ধুলোর ঘূর্ণির মতো বাড়তে বাড়তে ছুঁতে চাইছে আকাশ। ঝারির বেতের চেয়েও ছিপছিপে শরীরের দিকে তাকিয়ে ভয়ে নিঃশ্বাস ছাড়ে লুলারাম। সত্যিই কি ঝারি ডাইন হয়ে গিয়েছে? প্রশ্নটাকে হাজার বার হাজার রকম করে দেখতে থাকে সে। ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে যায়। একটা আস্ত রাত ফুরিয়ে যায় চোখের তারায়। ভিকনাথের বউটার চোখের তারায় একটা অস্বাভাবিকত্ব দেখতে পেয়েছে লুলারাম। ভেজা এঁটেল মাটির মতো ওর শরীরের চাকচিক্য এবং নমনীয়তা বেড়েছে ঝারির। পানপাতা মুখটায় কাচবরণ গায়ের রঙ যৌবন্য লালিত্যে আশ্বিনের কচুপাতার মতো টলমল করছে। হাতে প্লাস্টিকের শাখা, পরনে কমা শাড়ি, খালি পা তবু ওর দীর্ঘাঙ্গী শরীরের শান্ত কুয়োর চেয়েও গভীর চোখ দুটো ওকে সবার থেকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। আজকাল ঝারির শরীর থেকে উঠে আসা সুগন্ধটা লুলারামকে পাগল করে দেয় সবসময়।
এত টান ঝারির উপর লুলারামের ছিল না। তখন শুধু শরীর টানত শরীরকে। এখন শরীর মন দুটোই যেন বাঁধা পড়ে গিয়েছে ঝারির কুসুমবনের শরীরে। লুলারাম বুঝতে পারে সে ঝারিকে না দেখতে পেলে পাগল হয়ে যাবে। এক দুর্নিবার আকর্ষণ তাকে চুল্লু খাওয়া ঘোড়ার মতো তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে।
ঝারির প্রতি এই টান দু-মাস আগেও তার ছিল না। ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিল ঝারি, সে হাসিতে ঠোঁট ভিজিয়ে শুধোল, কী ব্যাপার পীরিতের আঠাটা যে তুমাকে আর ছাড়ছে না। এত টান তো এর আগে দেখিনি? তুমার কি পীরিতের ব্যামো হল নাকি?
ঝারির কথাগুলোয় লুলারাম বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পায়। বছর তিনেক আগে মনসা পুজোর মেলা বসেছিল গাঙের ধারে। সেই মেলার দিনে ঝারি যেভাবে সাজল তার বাহার দেখে চোখ ঘুরে গেল অনেকের। সবাই আড়ালে আবডালে বলল, বউটার রূপ দেখেচো গো, যেন জ্যান্ত মনসাদেবী। আহা, কী শরীরের বাঁধুনি, কী তার চলন বলন। সেদিনই পশ্চিমের গুনিন বলেছিল, বউটার সব ভালো শুধু স্বভাব-চরিত্র ভালো নয়। ওর শরীরে আর এট্টা শরীল ঠাঁই নিয়েচে। দেখচো না ওর তাই কেমন রমরমা।
মেলা থেকে কথাটা চাউর হয়ে গিয়েছে গ্রামে। ঝারির শরীরের ভেতর আর একটা শরীর বাড়ছে। তার আত্মাকে চেপে রেখে আর একটা আত্মা দাপটের সঙ্গে চষে বেড়াচ্ছে তার মন। ঝারি এখন সেই মনের দাসানুদাস। সে ভিকনাথের বউ হলে কি হবে তার দেহ থাকে ঘরে, মন থাকে বাইরে। এই অবস্থায় তাকে যে ছোঁবে, সে-ই মরবে। বদ আত্মা তাকে ছেড়ে দেবে না।
শেরপুর-হলদিপোঁতায় পরপর পাঁচজন বিছানা নিয়েছে অসুখে। সবার অসুখ কোনো মামুলি অসুখ নয়। এর মাঝখানে ভিন পাড়ার জলজ্যান্ত ছেলে সাদাতও চলে গেল। এসব কার রোষে হয়? ঢিলিকে কে মারল? ওটা তো শুধু আত্মহত্যা নয়, নিশ্চয়ইএর পেছনে বদ আত্মার প্রভাব রয়েছে। কে সেই বদ আত্মা? কোথায় তার ঘরবাড়ি? সে কেন আসে, কেন যায়, কি তার উদ্দেশ্য এরকম অনেক প্রশ্ন হলদিপোঁতার মানুষ ভয়ে নিজের বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখে। তারা ঝারির দিকে তাকালেও তাদের লুকিয়ে থাকা ভয়টা কিছুতেই কাটে না।
রঘুনাথের সঙ্গে অনেকদিন পরে দেখা হয়েছিল কমলার। দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ-এর শিহরণ খেলে গেল ওদের দুজনের মনের ভেতর। কমলা আর নিজেকে বেঁধে রাখতে পারেনি। লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে সে চলে এসেছিল রঘুনাথের সামনে। তার গায়ে তখন একটা দামী চাদর জড়ানো। গা দিয়ে সুগন্ধি পাউডারের ভুরভুরানো সুগন্ধ বের হচ্ছে। আর সেই সুগন্ধটা রঘুনাথকে প্রেমকাতর চড়াই পাখির চেয়েও উতলা করে তুলছে।
কতদিন পরে কমলা গাঁয়ে ফিরছে কে জানে। কাশীনাথটা হাড় শয়তান। সে কমলার মেলামেশা বন্ধ করার জন্য জোর করে তাকে রেখে এল মামার ঘরে। সেখানে কিছুতেই মন বসছিল না কমলার, প্রায় সময় রঘুনাথের সরল মুখখানা ঘাই দিয়ে উঠত মনের জলাশয়ে।
বারোয়ারী তলার চাতালে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে কমলা আর রঘুনাথ। তার মামাতো ভাই সব্যসাচী তার সঙ্গে এসেছে পাহারাদার সেজে। বড়ো মামা বোনের বাড়িতে আসার সময় পেল না, যা কাজের চাপ। সেই জন্য ছেলেটাকে পাঠিয়েছে মেয়েটাকে দেখে-শুনে পৌঁছে দেবে।
সব্যসাচী গিয়েছে মিষ্টি কিনতে। এই সুযোগটা ছাড়তে চায় না কমলা। রঘুনাথ মন কেমন করা চোখে তাকিয়ে ছিল কমলার দিকে, তার চোখের পাতা পড়ছে না, এক বন্য অস্থিরতা তাকে যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে সবসময়। কমলা শুধোল, ঘর যাবা না? চলো একসাথে যাই।
ফাঁপরে পড়া চোখ মেলে তাকাল রঘুনাথ, আমি সাথে গেলে তুমার কুনো অসুবিধা হবে না তো?
ভরাট মুখে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে পড়ল কমলার, না, না অসুবিধা আবার কি হবে? আমার মামার ছেলে আমার সাথে এসেছে। ও অতো সাতে-পাঁচে থাকে না।
তবু যেন স্বস্তি পেল না রঘুনাথ, বেশ কিছুক্ষণ দম ধরে থেকে সে বলল, তুমি চলে যাবার পর পুরো গাঁ খানা আমার কাছে শ্মশানের মতো মনে হত। দিনটা কেটে গেলেও রাতটা আর কাটতে চাইত না।
-তুমি তো আমার মামার ঘরে যেতে পারতে? প্রশ্নটা করে কমলা ঠোঁট কামড়াল।
–আমি কি ঠিকানা জানি যে যাবো?
–দাদার কাছে ঠিকানা ছিল।
রঘুনাথ আক্ষেপের সঙ্গে বলল, তুমার দাদা আমার সাথে কথা বলে না। ওর সব সময় আমার উপর রাগ রাগ ভাব। মনে হয় আমাকে খুন করতে পারলে ওর বুঝি মন জুড়োত।
–ছাড়ো তো ওসব কথা। কমলা এড়িয়ে যেতে চাইল, আজ রাতে একবার আসবে, তোমাকে একটা জিনিস দেব।
-কি দেবা আগে বলো?
–আগাম তা বলা যাবে না। যদি আসো তাহলে পাবে, নাহলে নয়।
–যা দেবার এখনই দিয়ে দাও। গলায় দাবী ফুটে উঠল রঘুনাথের।
চোখে ঝিলিক মেরে হেসে উঠল কমলা, সবখানে কি সব কিছু দেওয়া যায় গো? আমি দিলে তুমিই বা নেবে কি করে?
রঘুনাথ এ রহস্যের মানে বুঝতে পারল না, সে বোকার মতো তাকাল।
কমলা কি ভেবে ওর গায়ের চাদরটা খুলে দিল রঘুনাথের হাতে, এটা গায়ে জড়িয়ে নাও। আজ বেশ শীত পড়েছে।
শীত তো সব দিন পড়ে।
-সব দিন তো আমি তোমার কাছে থাকি না। আজ কাছে আছি। আজ আমার কথা রাখো। কমলা ভেতরের উচ্ছ্বাস লুকিয়ে রাখতে পারল না।
গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে রঘুনাথ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। কমলা আশেপাশে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল, ভাই আসছে, চাদরটা নাও তো, আর দেরি করো না।
-তুমার শীত লাগবে যে!
গায়ে আমার গরম জামা আছে। তাছাড়া আর কত পোশাক চাই? দেখছ না শীতকালে কেমন মোটা দেখায় আমাকে। কমলা শরীর দুলিয়ে হেসে উঠল।
চাদরটা গায়ে জড়িয়ে পাশাপাশি হাঁটছিল রঘুনাথ। মিহি অন্ধকার নেমে আসছিল চারপাশে। এ সময় পাখ-পাখালির ব্যস্ততা বেড়ে ওঠে, ঘরে ফেরার তাড়ায় ওদের মাথার বুঝি ঠিক থাকে না। বাঁধের নীচের আখখেতে সব সময় বুঝি চড়কমেলার গুঞ্জন। কিছুটা হেঁটে আসার পর রঘুনাথ বলল, জানো, আমার ঢিলিকাকি গলায় ফাঁস নিয়ে মারা গিয়েছে। পাড়ার লোকে বলচে-কাকি মরত না, শুধু ভিকনাথ কাকার বউটার জন্য মরল।
কমলা আঁচলে দাঁত বসিয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল, ফুঁপিয়ে উঠতে গিয়ে নিজেকে বাধা দিল সে, শুনে বড়ো খারাপ লাগছে। আহা অমন মানুষ পাওয়া যায় না। তবে তোমার কাকা বড়ো জ্বালাত। মানুষ সব সহ্য করতে পারে, ভালোবাসা খুন হলে সে আর নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না।
সব্যসাচী টেরিয়ে টেরিয়ে রঘুনাথকে দেখছিল, ওর এক হাতে মিষ্টির হাঁড়ি, অন্য হাতে কালো রঙের একটা ব্যাগ। তার দিকে কোনো খেয়াল ছিল না কমলার, হঠাৎ রঘুনাথের ইঙ্গিতভরা চিমটি খেয়ে সে যেন নড়ে চড়ে উঠলল, শোন, এ হল আমার আদরের ভাই সব্য। আমার একেবারে ন্যাওটা। ও আসল বলে তো আমার আজ আসা হল।
রঘুনাথ সব্যসাচীর চোখে চোখ ফেলে হেসে উঠল, আমার নাম রঘু, রঘুনাথ। বাঁধের ধারে হলদিপোঁতায় থাকি। সেই থেকে ব্যাগটা বইছো, ইবার আমাকে ইট্টু দাও।
সব্যসাচী সংকোচ করছিল, রঘুনাথ জোর করে তার হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নিল। আগুপিছু করে হাঁটছিল ওরা। সব্যসাচী বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে, রঘুনাথ পাতলা অন্ধকারে কমলার হাতটা চেপে ধরল, এট্টু দেঁড়িয়ে যাও।
কমলা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে অবাক চোখে তাকাল, কী হল, কিছু বলবে বুঝি?
ভার হয়ে এল রঘুনাথের চোখ-মুখ, আমার কপালে কি আছে আমি জানিনে। জানিনে আমাদের এই সম্পর্ক কতদিন আর বাঁচবে? চারদিকে দশ লোকে দশ কথা বলছে। আমার আর শুনতে ভালো লাগে না। তুমাকে এট্টা জিনিস চাইবো–দেবে?
-কি? রঘুনাথ কমলার মুখের দিকে নিবিষ্ট চোখে তাকাল, তারপর দুম করে বলে বসল, তুমি আমার হবে? আমাকে ভুলে যাবে না তো?
–এ তুমি কী বলছে? কমলার গলা কেঁপে উঠল অস্বাভাবিক, তোমাকে ভুলে যাবো, এ তুমি কি করে ভাবলে?
অন্ধকারে কমলার ফুলের মতো শরীরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল রঘুনাথ। শরীরও সুগন্ধ ছড়ায় হাসনুহানার মতো। হাওয়া লাগা গাছের মতো কেঁপে উঠল কমলা। মাটি হয়ে তাকে জন্মের মতো আশ্রয় দিতে চাইল রঘুনাথ।
.
২৭.
সকালবেলায় মুনিষ গেলে ফিরতে ফিরতে সাঁঝ নামে গুয়ারামের। কদিন ধরে শীতের যা কামড় তা বুঝি সহ্য হচ্ছে না কারোর। রঘুনাথের গায়ে রঙচঙে চাদরটা দেখে চোখ কপালে তুলে দুর্গামণি শুধালো, কি রে এটা আবার কুথা থেকে পেলি?
রঘুনাথ ঘাবড়াল না, ঢোক গিলে বলল, দিদিমণির বাগান তেড়ে দিয়েছিলাম, দিদিমণি খুশি হয়ে আমায় এটা দিলো। বলল, নিয়ে যা রঘু, গায়ে দিবি। আমি আর দিদিমণির মুখের উপর না বলতে পারিনি।
সব ভালো মানুষগুলা কি হাসপাতালে থাকে? দুর্গামণির চোখে সন্দেহ নেচে উঠল, আমারে একবার হাসপাতালে নিয়ে যাবি তো? মানুষগুলাকে চোখের দেখা দেখব।
-কেনে তুমার আবার কি হলো?
–ভালো মানুষগুলার সাথে আলাপ করে আসবখন। দুর্গামণির সারা শরীরে একটা ভালো লাগা ছড়িয়ে পড়ল যা শীতের রোদের চেয়েও চনমনে, আরামদায়ক।
রঘুনাথ বলল, এ আর কী এমন কথা! যবে মন চাইবে, আমাকে বলো। আমি তুমাকে সাথে করে নিয়ে যাবো। তুমার কুনো অসুবিধা হবে না।
সামনে পরীক্ষা বলে সূর্যাক্ষ আর দ্বীপী বাইরে বেরবার সুযোগ পায় না। ওরা জোর কদমে পড়ছে। কপোতাক্ষ বললেন, এখন আর টিউশনি গিয়ে লাভ নেই। যাওয়া আসায় অনেক সময় নষ্ট হয়। তোমরা নিজেরা পড়ো, তাতে অনেক লাভ হবে।
বাবার কথা মন দিয়ে শুনেছে সূর্যাক্ষ। দ্বীপীও অবাধ্য হয় নি। ওরা রাত দশটা অব্দি একসঙ্গে পড়ে। দশটার পরে সূর্যাক্ষ নিজের ঘরে ফিরে যায়। মীনাক্ষী ভাতের থালা আগলে বসে থাকেন ছেলের জন্য। ভালো রেজাল্ট করার জন্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখছে না সূর্যাক্ষ। তার ইচ্ছে বড়ো হয়ে সে সরকারি দপ্তরে চাকরি করবে, যেখানে মন চায় বেড়াতে যাবে, দ্বীপীকে সে অনেক অনেক সুখে রাখবে। বাবার মতো সে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবে না, এতে সম্মান বৃদ্ধির পাশাপাশি অনেক বদনামও ভাগ্যে জোটে।
দিনসাতেক আগেও রামনগরে ঝামেলা হয়ে গেল শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে। দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে কোম্পানীর অনড় মনোভাব বিচলিত করেছে তাকে। দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল শ্রমিকপক্ষ। একে অন্যের শত্রু এমন মনোভাব নিয়ে ওরা পরস্পরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। একটা খণ্ডযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হল ওখানে যা ভীষণভাবে মনটাকে নাড়া দিয়ে গেল কপোতাক্ষর। তাহলে কাদের জন্য এ লড়াই? কৃষক ঐক্য, শ্রমিক ঐক্যের চরিত্র হারিয়ে গেলে মিথ্যাচার বয়ে বেড়ানোর দায়িত্ব ন্যস্ত হয় অগ্রণী নেতাদের ঘাড়ে। সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সামনে নেতাদের কি কিছু করার থাকে? এত সভা-সমিতির আয়োজন তাহলে বৃথা। গোপন সভার তাহলে কি প্রয়োজন? মানুষের স্বার্থে যদি মানুষ না এগিয়ে আসে তাহলে গতি পায় না আন্দোলন। স্রোত হারিয়ে নদী তখন চৌবাচ্চার সমান। কপোতাক্ষ চেয়েছিলেন মানুষ বুঝতে শিখুক তাঁর কথাগুলো। ওরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। ওদের প্রাপ্য সম্মান ছিনিয়ে নিক।
শেষ পর্যন্ত কপোতাক্ষ তাঁর নিজের কথাকে, পার্টির ভাবনা এবং আদর্শকে সবার মাঝখানে বিলিয়ে দিতে পারলেন না। তাঁর নির্দেশিত শ্রমিক সংগঠন দু-ভাগ হয়ে দুটি শিবিরে ফুঁসে উঠল। সংসদীয় গণতান্ত্রিক নীতিকে অগ্রাহ্য করে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল নিজেদের মধ্যে। হিংসার ঔদ্ধত্য ছোবল ওদের জখম করে পৌঁছে দিল হাসপাতালে। এমন কী সেই রণভূমি থেকে নিষ্কৃতি পেলেন না কপোতাক্ষ। মাথায় তিনটে সেলাই নিয়ে তিনিও ফিরে এলেন ঘরে।
মীনাক্ষী আঁতকে উঠেছিলেন তাঁর মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে, কী হয়েছে গো তোমার? কী ভাবে। মাথা ফাটালে? আহা, একটু সাবধানে কি চলা ফেরা করতে পার না?
কপোতাক্ষ সেদিন মীনাক্ষীর মুখের উপর একটা কথাও বলেননি, বলা শোভন মনে করেন নি, নিজেদের বিরোধের কথা বলে তিনি নিজেকে ছোট করতে চান নি। গ্রামের মানুষকে তাদের মতো করে তিনি বুঝিয়ে উঠতে পারেন নি, এই অক্ষমতা একমাত্র তাঁরই। এর দায় তিনি আর কাউকে দিতে নারাজ। সংগঠনের প্রতি তাঁর আরও মনোযোগ বাড়ানোর প্রয়োজন, নাহলে আন্দোলনের অঙ্কুর শুকিয়ে যাবে। চোখের সামনে সংগঠিত আন্দোলনের শ্মশানযাত্রা দেখতে হবে তাঁকে।
পড়ন্ত বিকেলে রঘুনাথ এসে দ্বীপীদের দরজায় কড়া নাড়ল। শীতের বেলা ব্যাঙাচির লেজের মতো তাড়াতাড়ি ঝরে পড়ে। ইতস্ততভাব কাটিয়ে রঘুনাথ দ্বীপীর মুখোমুখি দাঁড়াল। হাতে পেন নিয়ে দ্বীপী বই ফেলে ছুটে এসেছে তার সামনে।
রঘুনাথ ভাবছিল দ্বীপী হয়ত অসন্তুষ্ট হবে তার উপর। পড়াশোনার ব্যাঘাত সে মেনে নিতে পারবে না। রঘুনাথের ভাবনা পুরোপুরি ভুল প্রমাণিত হল। দ্বীপী সহজ গলায় বলল, কখন এলে? ভালো আছ তো?
মাথা নাড়ল রঘুনাথ, সূর্য কুথায়? ওর সাথে ভেষণ দরকার ছিল।
সে আমি জানি। দ্বীপী কাঁধের দু’পাশের খোলা চুলগুলো নেচে উঠল হাওয়ায়, ভেতরে এসো, আমি সূর্যকে ডেকে আনছি।
সূর্য এসে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, কি রে এতদিন পর উদয় হলি, কোথায় ছিলিস? রঘুনাথ জোর করে হাসল না বরং গম্ভীর হয়ে গেল ওর মুখখানা, কুথায় আর থাকব, পেটের দায়ে ঘুরচি। তোদের মতন আমাদের ভাগ্যে তো আর বাঁধা ভাত নেই।
সূর্যাক্ষ এ প্রসঙ্গে গেল না, কী ব্যাপার হঠাৎ যে এলি? কী দরকার বল? রঘুনাথ আশেপাশে তাকাল, তারপর গলা খাদে নামিয়ে বলল, চল এটু বাইরে যাই। ইখানে বলে ঠিক জুত হবে না।
দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন না করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল সূর্যাক্ষ। আলো মরে আসছে পৃথিবীতে। নিমগাছের ডালে জড়ো হয়েছে রাজ্যের পাখি। ওদের কিচির মিচির ডাকে পুরো এলাকাটায় যেন হাট বসেছে পাখিদের। এ সময়টায় গোরুর পাল পায়ের ধুলো উড়িয়ে লেজ দুলিয়ে গোয়ালে ঢোকে। সূর্যাক্ষ বাঁশবাগানের কাছে এসে ঘন ছায়ায় দাঁড়াল, তোর কাছে বিড়ি হবে? দুপুর থেকে অঙ্ক কষে মাথাটা জাম হয়ে গিয়েছে। বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া না দিলে আর চলছে না।
রঘুনাথ কোনো কথা না বলে ঢোলা পায়জামার পকেট থেকে দুটো বিড়ি আর দেশলাই বের করল। দেশলাই জ্বেলে নিজের বিড়িটা ধরিয়ে অন্য বিড়িটা এগিয়ে দিল সূর্যাক্ষর দিকে, নে ধরা। তবে বেশি টানবিনে। বেশি টানলে কলিজা ঝাঁঝরা হয়ে যাবে।
বেঁচে কি হবে বলতে পারিস?
রঘুনাথের কোনো উত্তর জানা নেই, বোবার মতো সে তাকাল।
সূর্যাক্ষ বলল, অমলকান্তি স্যারের কথা শুনেছিস? ওর নাকি জেল হয়ে গিয়েছে। রঘুনাথ ঠোঁট দিয়ে ইস শব্দ করল, আহারে, অমন ভালো মানুষ আর হয় না। ভালো মানুষের কপালে দেখছি যত কষ্ট।
-হ্যাঁ, তা তো ঠিক। তবে রুখে দাঁড়াতে হবে। সূর্যাক্ষর চোয়াল জেগে উঠল রাগে। রঘুনাথ বিচক্ষণের মতো বলল, তোর বাবার কথা ভাবতো। মানুষটা সারাদিন পার্টি-পার্টি করে নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেল। শেষে কিনা পার্টির লোকই তার মাথা ফেটিয়ে দিল।
সূর্যাক্ষ নিরুত্তর চোখে তাকাল। রঘুনাথ স্পষ্ট করে বলল, এতে শিবনাথবাবুর কারসাজি আচে। সে তোর বাবাকে মোটেও সহ্য করতে পারে না। হরসময় গালি দেয়।
-ওর মরণ আমার হাতে লেখা আছে। আগে চাকরিটা পেতে দে। একটা বন্দুক কিনি, তারপর।
রঘুনাথের মনে পড়ে গেল রুদ্রাক্ষের দিয়ে যাওয়া রিভলভারটার কথা। ওটা খড়গাদায় গুঁজে রেখেছে সে। যন্ত্রটা বেশ ভারী আছে। ছুঁলেই শরীরের রক্ত ফুটে ওঠে। দিন চারেক আগেই রুদ্রাক্ষ ভোরবেলায় হাজির হয়েছিল তাদের ঘরে। উদ্দেশ্য ছিল একটা। ওর মা তুঙ্গভদ্রা অসুস্থ। সবসময় তাঁর বুক ধড়ফড় করে। পাড়া-প্রতিবেশীদের বলে বেড়াচ্ছে–তিনি আর বাঁচবেন না। ছেলের চিন্তায় তাঁর মাথার শিরা ছিঁড়ে যাচ্ছে। বিকেলের পরে এখন অসহ্য মাথায় যন্ত্রণা হয় তাঁর। ঘাড়ের কাছটায় কনকনিয়ে ওঠে ব্যথা। হাসপাতালের ডাক্তার বলে দিয়েছেন, নুন খাওয়া বারণ। খাসি-মাংস ছোঁওয়া যাবে না। ছেলের খোঁজে নীলাক্ষ কলকাতায় গিয়েছিলেন। হোস্টেলে রেখে এসেছিলেন হাতচিঠি। সেই চিঠি রুদ্রাক্ষর হাত পর্যন্ত পৌঁছে যায়। চিঠি পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল রুদ্রাক্ষর। মার সঙ্গে যে করেই হোক দেখা করতে হবে। মনটা কু গাইছিল।
ময়ের টানে গ্রামে ফিরে এসেছে রুদ্রাক্ষ। কিন্তু দুর্ভাগ্য ও ঘর পর্যন্ত যেতে পারেনি। সাদা পোশাকের পুলিশ ওদের বাড়িটাকে লক্ষ্য রাখছে সবসময়। পুলিসের কাছে খবর আছে-রুদ্রাক্ষ ওর মাকে দেখতে একবার আসবেই-আসবে। সেই সুযোগ নতুন দারোগা ছাড়তে নারাজ। যে কোনো মূল্যে রুদ্রাক্ষকে ধরা চাই। বুর্জোয়া সমাজকে বাঁচাতে গেলে এদের ধরে ধরে জেলে ভরা দরকার। এরা নিজেদের বলে প্রলেতারিয়েত। এরা জোর গলায় বলে-শৃঙ্খল ছাড়া এদের আর হারাবার কিছু নেই। এরা ডাক দিয়েছে–দুনিয়ার মজদুরকে একত্রিত হবার জন্য। এরা সর্বহারাদের পক্ষে বিপ্লবের ডাক দিয়েছে। এরা একনায়কতন্ত্রী সরকার চায়। এরা রক্ত চায়, খুন চায়। এরা বস্তুবাদী জীবের কল্যাণ কামনায় অস্ত্র তুলে নিয়েছে হাতে।
রঘুনাথ পকেট থেকে রুদ্রাক্ষর হাত চিঠিটা বের করে আনল, চিঠিটার দিকে পরম মমতার চোখে তাকিয়ে সে বলল, এই চিঠিটা তোর জেঠিমাকে পৌচে দিবি। বলবি-রুদ্রদা ভালো আচে। ওদের যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবে না। সূর্যাক্ষ বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে রইল রঘুনাথের মুখের দিকে, বড়দা, এসেছিল? এটা যেন আমার বিশ্বাস হয় না। ওঃ, আজ ভীষণ হালকা লাগছে। আমি এখন জেঠিমার কাছে যাবো। তুই কি আমার সঙ্গে যাবি?
রঘুনাথ ভাবল, দু’জনে যাওয়া কি উচিত হবে? এক কাজ কর, তুই বরং একা যা। আমি ঘর ফিরে যাই। সাঁঝ নামচে।
হাঁটতে হাঁটতে বাঁধের উপর উঠে এল রঘুনাথ। কাজটা ঠিক সময়ে সারতে পেরে নিজেকে হালকাবোধ হল ওর। আখখেতের পায়ের কাছে অন্ধকার হুমড়ি খেয়ে পড়েছে পায়ে ধরার জন্য। গাঙ-পালানো বাতাসে লুকিয়ে ছিল শীতের কষাঘাত। গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে রঘুনাথ পিছনে ছেড়ে আসা গ্রামখানার দিকে তাকাল। আলোর ছোট ছোট ফুটকিগুলো যেন স্বপ্ন হয়ে দুলছে ওখানে। অথচ ধাওড়াপাড়ার সব ঘরে আলো জ্বলে না এখনও। দেশ জুড়ে মজুত খাদ্যের অভাব। কেরোসিন তেল রেশনও অপ্রতুল।
রুদ্রাক্ষ যেদিন এল সেদিনও ঘর আঁধার ছিল ওদের। রেশন-ডিলার জগতের সঙ্গে গুয়ারামের একচোট বচসা হয়ে গেল। মানুষটা কিছুতেই মানবে না নিজের দোষের কথা। দেবগ্রাম থেকে ঘোড়ার গাড়িতে রেশনের মাল আসে ফি-হপ্তায়। জগত ক্যাশ নিয়ে যায় ওখানে। হিসাব চুকিয়ে সে বাসে ফিরে আসার আগেই তার ড্রামের কেরোসিন নিঃশেষ হয়ে যায় কালোবাজারে। ফাঁকা ড্রাম দেখিয়ে জগতের তখন সহানুভূতি আদায়ের বৃথা চেষ্টা।
এই কারসাজিটা গুয়ারাম নিজের হাতে ধরে ফেলে। ট্যাঙ্গাওয়ালাকে মনের সুখে গাল দেয় সে। ট্যাঙ্গাওয়ালা প্রাণের দায়ে আসল কথাটা উগরে দেয়, তুমারা আমাকে ধরে টানাটানি করে কী করবে? গোড়া কেটে ডগায় জল দিয়ে কী ফল হবে? আড়ত থেকে পুরা মাল কিনে নিয়েছে ইসমাইল। টাকা পেয়ে গিয়েছে জগতবাবু। যদি কিছু বলার হয় তো বাবুকে বলো, তবে বাপু আমার নামটা করো না। আমি ট্যাঙ্গাওলা। গরীব মানুষ। দেখো–আমার পেটে যেন লাথ না পড়ে।
সকালে ঝোলা নিয়ে জগতের রেশন দোকানে গিয়েছিল গুয়ারাম। শুধু কেজি তিনেক গম ছাড়া কেরোসিন তেল, চিনি কোনোকিছু আর পাওয়া যাবে না। কথাটা শুনে মাথায় রক্ত চড়ে গেল গুয়ারামের। প্রতিবাদ করে বলল, এ আমরা মানচি নে, মানব না। দরকার হলে আমি নিজে গিয়ে কপোবাবুকে ডেকে আনব। একি মগেরমুলুক নাকি?
জগত অনেক চেষ্টা করেছিল গুয়ারামকে বোঝাবার কিন্তু ওর গোঁ জগৎছাড়া। গুয়ারামের চিনি না হলেও চলবে কিন্তু কেরোসিন ছাড়া তার চলবে না। বাজারে এখন কেরোসিন হাওয়া। যাও বা মেলে তার দাম অত্যধিক চড়া। ঘরে আলো না জ্বললে মন খারাপ হয়ে যায় গুয়ারামের। অন্ধকারে কেউ কারোর মুখ দেখতে পায় না। সব সওয়া যায় কিন্তু অন্ধকার সহ্য করা যায় না। গুয়ারাম গলা চড়িয়ে বলেছিল, কেরোচিন কুথায়, চিনি কুথায়?
–মাল এবার সাপ্লাই হয়নি। জগতের কুণ্ঠাহীন জবাব।
-কেনে মিচে কতা বলচো? আমি সব জানি গো, আমার চক্ষে ধুলি দিতে পারবে না। গুয়ারাম গলা চড়াল ধীরে ধীরে।
বেগতিক দেখে জগত তাব সঙ্গে আপোষের পথে হাঁটতে চাইল, আরে মাথা গরম করো না, তোমার জিনিস যাতে তুমি পেয়ে যাও আমি সেই ব্যবস্থা করছি। একটু শান্ত হও গো। আমার ব্যবসার পিণ্ডি চটকে দিও না।
কী, তুমি আমাকে লুভ দেখাবে? ছ্যা-ছ্যা-ছ্যা। এ আমি কী শুনচি গো। গুয়ারামের কথায় ক্ষেপে উঠল আশেপাশের ভিড়টা। জগত সেই জ্বলে ওঠা আগুনে জল ঢেলে নিভিয়ে দিতে পারল না।
সাইকেল নিয়ে একজন গেল মানিকডিহি গায়ে। এসব মামলায় কপোতাক্ষর জুড়ি নেই। তিনি এর বিহিত করে ছাড়বেন। দরকার হলে দরখাস্ত লিখে পাঠিয়ে দেবেন বিডিও অফিস নতুবা ফুড-সাপ্লাই অফিসে। গণ-স্বাক্ষরের গুরুত্ব সব অফিসারই দিতে চান।
বাড়ি ফিরে এসে রঘুনাথের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ঘরে কেউ নেই, তালা ঝুলছে। নূপুর এসে উদ্বেগভরা গলায় বলল, আঁধারে জ্যাঠার মাথা কেউ ফেটিয়ে দিয়েছে। কী রক্ত, কী রক্ত। জেঠি জ্যাঠারে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছে। তুমার বুড়াদাদুও গিয়েচে ওদের সাথে।
যার কোন শত্রু নেই, তার এমন আচমকা বিপদে বেশ ঘাবড়ে যায় রঘুনাথ। গুয়ারামের মাথায় কে মারতে পারে লাঠি? কার এত হিম্মোত আছে এ গ্রামে? তার নামটা জানতে পারলে রুদ্রাক্ষর দেওয়া রিভলবারটা কাজে লাগিয়ে দেবে সে। হাতি পুষে শুধু ভুষি খাওয়ানোর দলে সে নেই। সে জানে মারের বদলে মার।
আগে গাঁয়ের লোকে তার দাদুদের ধরে নিয়ে গিয়ে গাছে বেঁধে মারত। কারণে-অকারণে মার খেয়ে খোঁড়া হয়ে ফিরে আসতে হোত ওদের। গাঁয়ের কোন কিছু হারালে যেন ওরাই চোর, ওরাই ডাকাত। বিনা বিচারে চলত বেদম প্রহার। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত উঠিয়ে ছাড়ত। সে কষ্ট চোখে দেখা যায় না। অতীতের গল্প করতে গিয়ে চোখে জল এসে যেত চুনারামের, সেদিন কি পুরাপুরি গিয়েছে দাদুভাই। এখুন ও মানুষকে বিনা কারণে মারে। এখানে যার যত গায়ের জোর তার তত প্রসার। লাঠি যার মোষ তার–এই নীতিতে গাঁ-সমাজ চলছে আজও।
এই সমাজের বদল চায় রুদ্রাক্ষ, কুশল মাস্টার। কপোতাক্ষ তাদের দলে নেই তবে ওর লড়াইও অসাম্যের বিরুদ্ধে। বিদুর রাজোয়ার, লাবণি–ওরাও পিছিয়ে নেই এই চর্চায়।
সবাই বদলের কথা বলে। বদল কখন হবে? রঘুনাথ হা করে শোনে তাদের ভাষণ। ভাষণ শুনে ভরে যায় মন। যারা কেরোসিন খায়, রাস্তা খায়, টিউবওয়েলের টাকা খায় তারা কেমন মানুষ? তারা তো রাক্ষস।
ভোরের আলো ফোঁটার আগে রুদ্রাক্ষ ফিরে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল, কমরেড, আবার দেখা হবে। আমরা সাম্যবাদের লাল সূর্যটাকে তোমাদের ধাওড়াপাড়ায় ওঠাব। জগত রেশন-ডিলারের কালো হাত আমরা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেব। আমাদের দীক্ষিত কমরেডরা গায়ে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন চলছে শুধু বুর্জোয়া-চিহ্নিতকরণ পর্ব। চিহ্নিতকরণ পর্ব সমাপ্ত হলে শুরু হবে শুধু রক্তাক্ত সংগ্রাম। রক্তাক্ত সংগ্রাম ছাড়া ভিক্ষে করে জয় আসবে না। মনে রাখতে হবে–আমাদের এই স্বাধীনতা ঝুটা। আমরা প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেব। এ বিষয়ে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।
রুদ্রাক্ষ চলে যাবার পর মন খারাপ হয়ে গেল রঘুনাথের। ওই মানুষটার কথায় আঁচের আগুন লুকিয়ে আছে। এই আগুনটাকেই ভালো লাগে তার। কিন্তু অভাব তাকে পথ হাঁটতে দেয় না। দুর্গামণির মতো পথ আগলে দেয়, যাবিনে বাপ, ও পথ তোর পথ নয়। বাবুরা যে পথে হাঁটে সে পথ তো আমাদের হাতে বানানো। হাঁসে ডিম পাড়ে, খায় দারোগাবাবুতে। দুর্গামণির চোখে ফুটে ওঠে ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের ভেতর কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে অভাবের হিমকালো সাপ। এমন বিষধর সাপ জ্ঞানপড়ার পর থেকে সে আর দেখেনি। এই সাপকে বশ মানাতে গেলে গাছের শিকড়িতে হবে না, এর জন্য চাই চাদির জুতো। চাঁদির জুতোয় অভাব অনটন বাপ বাপ বলে গাঁ ছেড়ে পালাবে। তাহলে চাদির জুতো আসবে কোথা থেকে? এই প্রশ্নটাই এখন বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে রঘুনাথের ভিতরে। লুলারামের প্রস্তাবগুলোর তার মনে পড়ছে। চাইলে কেউ দেবে না, জোর করে নিতে হবে। যার অনেক আছে তার কাছে জোর করলে কোনো পাপ হয় না। না বলে নিলে তা চুরি করা হয়। কিন্তু ….? রঘুনাথের মন দোটানায় ঝুলে রইল।
বাঁধের গোড়ায় তার দেখা হয়ে গেল লুলারামের সঙ্গে। কী একটা ভাবতে ভাবতে সে যেন পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইছিল। রঘুনাথ পেছন ঘুরে ডাকল, কাকা? ডাকটা আর্তনাদের মতো শোনাল লুলারামের কানে। সে দাঁড়িয়ে পড়ল। গলায় মাফলারটা ফাসের মতো জড়িয়ে সে বলল কে, রঘু নাকি?
-হ্যাঁ, কাকা।
-অসময়ে তুই কুথায় যেচিস?
রঘুনাথ বুঝতে পারল লুলারাম এখনও অব্দি গুয়ারামের কোনো কথাই শোনেনি। শুনলে সে নিশ্চয়ই এমন প্রশ্ন করত না। দাদার জন্য তার প্রাণটা কঁকিয়ে উঠত। রঘুনাথ কাকার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঢোক গিলল, বাবার মাথা কে ফেটিয়ে দিয়েছে বাঁধের গোড়ায়। আমি ঘরে ছিলাম না, মানিকডিহি গিয়েচিলাম। ফিরে এসে দেখি ঘরে তালা মারা। নূপুর আমাকে সব কথা বলতেই আমি এখুন হাসপাতালে যাচ্চি। লুলারাম মরা গাছের মতো দাঁড়াল কিছুক্ষণ তারপর কপাল কুঁচকে বলল, দাদার মাথায় লাঠি মারার মানুষও দেখচি এ গাঁয়ে আচে। হায় ভগবান, আমরা এখুনও কুন দেশে আচি গো……।
তুমি ভেবো না। হাসপাতালে গিয়েচে যখুন সব ঠিক হয়ে যাবে। রঘুনাথ ব্যথায় প্রলেপ দিতে চাইল।
কিছুটা বিরক্ত হয়ে লুলারাম বলল, আমি ভাবব নাতো কি গাঁয়ের মোড়ল ভাববে? এইজন্য আমার সাথে কারোর কুনোদিন পটল না। আমি জানি–এরা আমাদের দাবিয়ে চলে, আমাদের মানুষ বলে ভাবে না। ওরা যখন আমাদের মানুষ ভাবে না, তখন আমি কেনে ওদের মানুষ ভাবব। তাই আমি ওদের শত্রু, ওরা আমার শত্রু। বাধ্য হয়ে আজ আমি রাতের-মুনিষ হয়ে গিয়েচি। তোকেও বলেছি, তুই আমার কথাটা ভেবে দেখিস। মনে রাখিস শুধু সাহেবমাঠে মুনিষ খেটে আমাদের পেট ভরবে না। কোনো নেতা মুত্রি আমাদের কথা ভাবে না। নিজেদের কথা নিজেরা না ভাবলে তলিয়ে যাবি। রঘুনাথ মন দিয়ে শুনল কথাগুলো, তারপর বাবার চিকিৎসার কথা ভেবে সে বলল, কাকা, তুমার কাছে কিছু টাকা হবে, থাকলে দাও। পরে আমি তুমাকে ঘুরোণ দেব।
ঢোলা জামার ভেতর থেকে কতগুলো ভাঁজ করা দশ টাকার নোট বের করে আনল লুলারাম, টাকাগুলো গুনল না, মুঠো করা অবস্থায় ওগুলো রঘুনাথের হাতে দিয়ে বলল, এগুলো নে। আরো লাগলে বলবি। আমি আরো দেব। আর শুন–এগুলান যে দিলাম তা ফেরত দেওয়ার দরকার নেই। এসব পরের টাকা, নিজেদের সেবায় লাগুক। রঘুনাথের মুখ হা-হয়ে গেল কথা শুনে। মানুষটা বলে কি-পরের টাকা? পরের টাকা মানে? মাথাটা কেমন গুলিয়ে গেল রঘুনাথের। লুলারাম তার মনের সংশয় দূর করে বলল, এসব টাকা আমার নয়, এ টাকা আমি রেতের বেলায় মুনিষ খেটে পেয়েছি। এ টাকাও আমার মেহনতের টাকা। এতেও আমার ঘাম মিশে আচে। তুই যা রঘু, দাদা কেমুন আচে জানাস।
.
২৮.
পরপর তিন রাত ঘুমাতে পারেনি বিশু।
মেয়েটা বিছানায় কাতরাচ্ছে, সে ঘুমাবে কী করে? মমতা অস্থির হয়ে বলল, ওগো, কিছু একটা করো। মেয়েটার এ ছটফটানী আর চোখে দেখা যাচ্ছে না। মমতা কথা বলছিল না, যেন ওর গলা ঠেলে বেরিয়ে আসছিল কান্না। বিশুও সংক্রামিত হল মমতার চোখের দিকে তাকিয়ে। কালীগঞ্জ হাসপাতালের বড়ো ডাক্তার বললেন, ওষুধ দিয়ে দিলাম। পেটের ব্যথা না কমলে আবার নিয়ে আসতে হবে। তেমন দরকার পড়লে কৃষ্ণনগরে পাঠিয়ে দেব।
কৃষ্ণনগরের নাম শুনে মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল মমতার। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুচ্ছিল না। আঁচলে মুখ ঢেকে সে ফুঁপিয়ে উঠেছিল ডাক্তারবাবুর সামনে।
তার কান্না দেখে বড়োডাক্তারবাবু বললেন, ঘাবড়ানোর কোনো কারণ নেই। চিকিৎসা চললে আশা করি ভালো হয়ে যাবে।
-তাই যেন হয় ঠাকুর। বিশু হাত কপালে ঠেকিয়ে বিড়বিড়িয়ে উঠেছিল। তখন শীতের দুপুরে রোদ চড়াও হয়ে ঢলিয়ে পড়ছে ঘাসের গতরে। ঝকড়া মাথার খেজুর গাছগুলো আকাশকে ভয় দেখানোর জন্য ব্যস্ত, যেন আকাশের মেঘ নেমে এলে সুঁচলো কাঁটায় ক্ষত-বিক্ষত করে দেবে তাদের দেহ। টগরী কোনো মতে হেঁটে এসেছিল পতাকা তোলার সিমেন্টের বেদী অবধি। ভ্যান রিকশা বা টাঙায় আনার ক্ষমতা ছিল না বিশুর, তাই দড়ির খাটিয়ায় মেয়েটাকে শুইয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত এনেছে সে। এটাই আশেপাশের দশটা গ্রামের নিয়ম।
ওষুধে কাজ দিচ্ছে না–এটা বুঝতে পেরে বিশু কেমন সকাল থেকে মনমরা। মনের কথা সে মনেই চেপে রেখেছে ইট চাপা ঘাসের মতন। কেন না মমতা ঘাবড়ে যায় কথা শুনে, চোখের জল আটকে রাখতে পারে না সে, পাতাঝরা গাছের মতো তাকে তখন উদাস দেখায়। দূরের অনেক কিছু বুঝি দেখতে পায় বউটা।
বিশু মমতার মুখোমুখি দাঁড়াল, নিগুঢ় দৃষ্টিতে বউটাকে দেখে মনটা ম্যাদা মারা হয়ে গেল তার। কোনোমতে বলল, অতো ভাবার কিছু নেই। শরীল থাকলে রোগজ্বালা হবেই।
মমতা যেন কথা শুনছে না এমন ভ্যালভেলানো চোখে তাকাল, ক’দিনে মেয়েটার কেমন দশা হয়েচে দেখো-ওর দিকে তাকানোই যায় না। আহা, কী সোন্দর চেহারা ছিল মেয়েটার। এখন মনে হয় বাজপড়া তালগাছ। বিশু চুপ করে গেল।
মমতা যা বলছে তা বানানো নয়। ও মা। মা’র চোখকে ফাঁকি দেওয়া কি সম্ভব। মনে মনে হাঁপিয়ে উঠছিল বিশু। ভয়ে সে আর হাসপাতালে যায় নি। এবার নিয়ে গেলে ডাক্তারবাবু নির্ঘাত কৃষ্ণনগরে নিয়ে যাবার কথা লিখে দেবেন। একটা ভয় তাকে কুণ্ডলী পাকানো সাপের মতো ঘিরে আছে। একটু এদিক-ওদিক হলেই ছোবল খাবার আশঙ্কা।
ভয়টা টাকার জন্য। এত টাকা আসবে কোথা থেকে। যাওয়া-আসার ভাড়া যোগাতেই জান কয়লা হবার অবস্থা। টগরীর অসুখ বলে মুনিষ খাটতে যেতে পারেনি সে। অন্য সময় হলে মমতাই তাকে ঠেলেঠুলে পাঠাত। আশ্চর্য, এ কয়দিন মমতা কোনো জোরই করল না। যেমন যাচ্ছে যাক, শুধু মেয়েটা সুস্থ হয়ে উঠুক, এই তার মা শীলতাবুড়ির কাছে প্রার্থনা। সকাল থেকে টাকার অভাবে কেয়োর মতো নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে বিশু। লাল চা বানিয়ে মমতা তার কাছে এসে বসল। কাচের গ্লাসটা বিশুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, চা খেয়ে দেয়ে একবার সুফল ওঝার ঘর থিকে ঘুরে এসো। আমার মন বলচে–সিখানে গেলে টগরী আমার ভালো হয়ে যাবে। বিশুর চোখ থেকে তখনও সংশয় পুরোপুরি মেলায় নি।মমতা সামান্য জোর গলায় বলল, হাসপাতালের কড়াকড়া বড়ি-ইনজিসিনে যা না হয় অনেক সময় জড়িবুটি শিকড়িতে তা হয়ে যায়। তাছাড়া সুফল ওঝার ঝাড়ফুকে অনেকের ভালো কাজ হয়েচে। ওর জলপোড়া খেয়ে কত লোকের পেটের ব্যায়ো সেরেচে।
মমতার বিশ্বাসে আঘাত করতে মন চাইল না বিশুর। গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে সে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। গা-হাত-পায়ের হাড় সশব্দে ফুটিয়ে বলল, সুফল ওঝা কি খালি হাতে ওষুধ দিবে গো, ওরও তো সনসার আচে।
ধার-বাকি কথা বলবে, যদি না শোনে এটা সাথে করে নিয়ে যাও। কাঁসার একটা ছোট থালা বিশুর হাতে তুলে দিল মমতা। বিশুর হাত কাঁপছিল থালাটা নিতে গিয়ে। এই কাঁসার থালাটা টগরীর মুখে-ভাতের সময় পয়সা জমিয়ে কিনেছিল বিশু। এটাই তার ঘরের একমাত্র দামী জিনিস। আপদে-বিপদে এই কাঁসার থালাটাকে দেখে অনেক শক্তি আর দুর্মর মনের জোর খুঁজে পায় বিশু।
থালাটা ধরল বটে কিন্তু ওর মন চাইছিল না ওটা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। তার দ্বিধা দেখে মমতা বলল, দিন এলে অমন থালা ঢের হবে। কালীগঞ্জ বাজারের কাঁসারি দোকান তো আর উঠে যাবে নি। যাও, আর ভেবোনি। দেরি হয়ে যাচ্চে।
ঘর থেকে বেরিয়ে এল বিশু। বাঁধের গোড়ায় কদম গাছটাকে এ সময় বড়ো মন মরা দেখায় অথচ মাস চারেক আগেও এই গাছটার রূপ-যৌবন কত নজর কাড়া ছিল। এখন গাছটার সেই চোখ ধাঁধানো চেহারা নেই, অনেকটাই বিশুর মতো এলোমেলো দশা।
কদমগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে সেঁক গিলল বিশু, ওর দু-কানে অদ্ভুত একটা শব্দ এসে ধাক্কা মারল। নিজেকে সামলে নিয়ে বিশু দেখল দুলাল হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছে।
পেছন থেকে দুলালকে ডাকল না সে, এতে যাত্রা খারাপ হয়ে যেতে পারে। সেই কারণে সামান্য জোরে হেঁটে দুলালকে ধরে ফেলল সে।
দুলাল হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করল, কুথায় যাবিরে?
-গাঁয়ের ভেতর। বিশুর জবাবে দুলাল আশ্বস্ত হয়ে বলল, আমিও তো গাঁয়ে যাচ্ছি, ভালোই হল। চল, এক সাথে যাই
-কার ঘরে যাবা গো দুলালদা? বিশু ছেলেমানুষের মতো শুধালো। দুলাল একটু থামল, সুফল ওঝার ঘরে যাবো রে, মার শরীলটা ভালো যাচ্চে না।
-আমিও তো সুফল ওঝার ঘর যাবো।
–কেনে তুর আবার কি হল?
টগরীর পেটে ব্যথা। বেশ কদিন হয়ে গেল। সারচে না।
–তাহলে তো ভালো ডাক্তার দেখানো দরকার। দুলালের মুখে চিন্তার রেখাগুলো ফুটে উঠল, পেট বলে কথা, কোনো কিছু তো বাইরে থেকে দেখা যাবে না। দেখা না গেলেই তো যত ঝামেলা রে! ভয় হয়, কিচু আবার হয়ে গেল না তো!
এ কথায় বিশুর ঝিমুনিভাবটা কাটল না বরং বেড়ে গেল। সে আবার ঢোক গিলে ভীতু চোখে দুলালের দিকে তাকাল। দুলাল বলল, ভয় পাবার কিছু নেই। রোগ যেমন আছে তেমনি তার অসুধও আচে। এখানে না হলে কাটোয়া-বহরমপুর নিয়ে যা। ওখানে শুনেচি বড়ো বড়ো ডাক্তার-বদ্যি আছে। ওরা পেট টিপে রোগ ভালো করে দেবে।
বিশুর মুখে কোনো কথা নেই, সে এসব কথা অনেক আগে থেকেই জানে। জেনেও সে এখন ঠুটো জগন্নাথ। ঘরে টাকা থাকলে সে কি মেয়েটাকে ফেলে রাখত। কবে বাস ধরে চলে যেত শহরে। নিরুপায় বিশুর গলার স্বর বুজে এল, দুলালদা, তুমি তো মুনিষ খাটাতে ভিন দেশে গিয়েচিলে। তুমার কাছে কিছু কি হবে গো?
দুলাল গলা ফাড়িয়ে হাসল না, কেমন দুঃখ-দুঃখ মুখ করে তাকাল, তা গিয়েচিলাম রে ভাই। কিছু টাকা কামিয়ে নিয়ে এলাম আমি আর তোর বউদি মিলে। কিন্তু এমন ভাগ্য–সে টাকা বানের জলের মতো বয়ে গেল। যেদিন ঘরে এলাম ভাই, সেদিন শুনি মার অসুক। হাসপাতালে ধুকছে। তারে নিয়ে কেসনগর যেতে হল। না হলে বাঁচত নি। শুধুমাত্র টাকার জোরে মা’টারে ঘুরোণ আনলাম।
দুলালের গলা ছুঁয়ে নেমে এল দীর্ঘশ্বাস। আশাহত বিশু আর কোনো কথা বলার সাহসই পেল না। বাঁক পেরিয়ে দুলাল বলল, মাকে নিয়ে আবার আমি ঝামেলায় পড়েছি। কী যে জ্বর ধরেছে, সে আর ছাড়চে না রে। ভুগে ভুগে মা আমার হাড় লিকলিকে হয়ে গিয়েছে। কেমুন চিঁ চিঁ করে কথা বলে। তার কথা শুনে আমি আর তোর বউদি ভয়ে মরি। মনে হয় মা-রে কেউ ধরেছে।
-ধরেচে মানে? বিশু চমকে উঠল। ওর গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল।
দুলাল খুঁকখুঁকিয়ে কাশতে কাশতে বলল, তোর বউদি বলছিল মার উপর মনে হয় কুনো আত্মাটাত্মা ভর করেচে নাহলে জ্বর ভালো হবে নি কেন?
-সে কি গো? বিশুর চোখের তারা ভয়ে কুঁকড়ে গেল, তুমার মা তো টুকটাক এসব বিদ্যে জানত। ভূত-প্রেত তো তারে ভয় পায় শুনেছি। তার যদি এমন হয় তাহলে তো ভয়ের কথা।
-সুফল ওঝার কাচে না গেলে এসব সঠিক ভাবে জানা যাবে না। গভীর আস্থায় দুলালের গলা বুজে এল, কোনোমতে সে বলল, দিনকাল খুব খারাপ পড়েচে। এখুন খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই দায়। এর মধ্যে যদি অসুখ-বিসুখ করে তাহলে গোদের উপর বিষফোঁড়া। আমি আর পারচি নে রে ভাই, হেঁপসে উঠেছি।
সুফল ওঝার মাটির ঘরখানায় যেন সব সুখ-শান্তি-সমাধান লুকিয়ে আছে। ধাওড়া- পাড়ার মানুষগুলো এখানে এলে বুঝি ভরসার গঙ্গামাটি খুঁজে পায়। মানুষটা বেঁটে-খাটো কিন্তু ওর নাম-যশ অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ানো। ওর কীর্তি কলাপের কথা বলে শেষ করতে পারে না গ্রামের মানুষ। কর্মের সঙ্গে কিছুটা গুজব মিশে সুফল ওঝা মানুষের চোখে হয়ে উঠেছে পরিত্রাতা।
মাটির ঘরের টিনের চালে রোদ পড়ে ঝিলিক মারছে বহুদূর পর্যন্ত। বিশুর মনে হল যেন ঢেউ খেলানো টিন নয়–কেউ আয়না বিছিয়ে রেখেছে ওর ঘরের চালে। সেই আয়নায় রোদে পড়ে ঠিকরে যাচ্ছে জ্যান্ত চ্যাং মাছের মতো। উঠোনোর উপর কাঠটগরের গাছটার থোকা থোকা ফুলগুলো আকাশের তারার চেয়েও উজ্জ্বল। ওই একটা গাছই উঠোনের শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণ।
বিশু আর দুলাল উঠোন পেরিয়ে মাথা হেঁট করে দাওয়ায় গিয়ে বসল। আগে থেকেই খেজুরপাতার চাটাই বিছিয়ে রেখেছে সুফল ওঝা। সকালবেলায় লোকজনের ভিড় কম হয় না। আশেপাশের গাঁ থেকেও লোক আসে তার কাছে। এখানে না এলে বোঝা যাবে না-মানুষের এত রকমের সমস্যা আছে। সবার সমস্যার কথা শুনে সাধ্যমত বিধান দেয় সুফল ওঝা। তবে সব কেস নিজের হাতে রাখে না। তেমন বুঝলে কেস চালান করে দেয় ঘাসুরিডাঙার জানগুরুর কাছে। জানগুরু কিছু বলা মানে সেটাই গুরুবাক্য, মহাবাক্য। অতএব বিনা সঙ্কোচে শিরোধার্য।
অনেক আগে থেকেই চাটাই জুড়ে বসেছিল ছ-সাত জন। বিশু দেখল এর মধ্যে চেনা জানা দু-জন মেয়েমানুষও আছে। এদের পাশ কাটিয়ে সে আর দুলাল কিছুটা তফাৎ-এ বসে সুফল ওঝা কোথায় গেল দেখছিল।
লোকজন এলেও সুফল ওঝার আসতে একটু দেরি হয়। রোজ সকালে স্নান সেরে সে কামাখ্যা মা এবং মনসাদেবীকে প্রণাম জানায়। শীতলাবুড়ি তার সঙ্গে সব সময় ঘোরে। হাঁড়ির ঝি চণ্ডীর আজ্ঞায় তার এই বাড়বাড়ন্ত। দেব-দেবীদের অস্বীকার করলে তার এই মন্ত্রব্যবসা ধাপে টিকবে না। ভক্তির চাইতে ভড়ং বেশি না হলে মানুষের মনে রঙ ধরে না।
জয় মা চণ্ডী, জয় মা শীতলা, জয় কামাক্ষ্যা’ বলতে বলতে খাটো ধুতি পরে কাঁঠালকাঠের চেয়ারে এসে বসল সুফল ওঝা। বিশু দেখল ওর কপালে মা কালীর হাড়িকাঠের মতো একটা তিলক আঁকা, গোলা সিঁদুর চকচক করছে কপালের চামড়ায়। ওকে না সাধু, না তান্ত্রিক, না মন্ত্রসাধক কোনো বিশেষরূপে চিহ্নিত করতে পারে না বিশু। ওর সরল, বেদনা ভারাক্রান্ত দুই চোখ যথাসম্ভব মুগ্ধতার রেশ লাগিয়ে দেখতে থাকে অপলক। একটা সাধারণ মানুষ নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নিজেকে কি ভাবে বদলে নেয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ সুফল ওঝার মতো বুঝি আর কেউ নেই।
দু’জন প্রতীক্ষারত মহিলা তাদের সমস্যার কথা বলে বুক হালকা করে উঠে দাঁড়াল। সুফল ওঝা তাদের আশ্বস্ত করার জন্য বলল, চিন্তা করো না মা জননীরা, আমি গিয়ে ফুরসৎ মতো তোমাদের ঘরে দেখা করব। তোমাদের আর আমার এখানে কষ্ট করে আসার দরকার নেই।
মহিলা দুটি চলে যাওয়ার পর উশখুশিয়ে পেছন ঘেষড়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল দুলাল। সুফল ওঝা দুলালকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখল, তা বাবা অনেকদিন পরে এলে যে! তা তোমার মেয়ের ঝামেলাটা মিটে গিয়েছে তো? মেয়ে নিশ্চয়ই এখন জামাইয়ের ঘর করচে?
দুলাল কিছুটা অপ্রস্তুত তবু লজ্জিত ঘাড় নেড়ে সায় দিল। সুফল ওঝা কৃতিত্ব নেওয়ার ভঙ্গিতে ডানে-বাঁয়ে নিজেকে আন্দোলিত করে বলল, আমি জানতাম জট খুলে যাবে। বিচুটির বিচি গায়ে রগড়ে দিলে গা কুটকুটায়। তা বাপ তোমার জামাই বাবাজীবনের কুটকুটানির রস আমি মন্ত্রের জোরে শুকিয়ে দিয়েছি। সে শালাকে আমি বেঁধে দিয়েছি। এবার যতদিন সে বাঁচবে, শ্বস নেবে তোমার মেয়ের পা-চাটা কুকুরের মতো বাঁচবে। আর তা যদি না হয় তাহলে তোমরা এই সুফলের নামে কুকুর পুষো।
দুলাল সর্বশরীর দুলিয়ে পাতা ভরা ডালের মতো হায়-হায় করে উঠল, কী যে বলো, সুফলদা! তুমার দয়ায় আমরা এ গাঁয়ে বেঁচে আছি। তুমি না দেখলে আমাদের কে দেখবে বলো। তুমি আমাদের ভগবান গো…!
সুফল ওঝা এমন তোমোদর কথা শুনে রে-রে করে উঠল, মারব এক ধাপ্পড়, অমন পাপ কথা মুখে আনবে না। শোন ভাই, আমি কেউ নই গো, আমি কেবল হাঁড়ির ঝি চণ্ডীর সেবক, মা কামরূপ কামাক্ষ্যার আজ্ঞাবহ দাস। তেনারা আমাকে পেঠিয়েছেন মানুষের সেবা করার জন্য। যতক্ষণ এ ধুলোয় আছি, ততক্ষণ ধুলো মেখে যাবো। তা বলো কিসের জন্য এই অধমের কাচে আসা?
দুলাল তার দৃষ্টিকে মাখা ময়দার চেয়েও নরম করে বলল, অনেকদিন হয়ে গেল, মা’র জ্বর ছাড়চে নি! বড়ো ঝামেলায় আচি, মুনিষ খাটতেও যেতে পারচিনে।
-তুমার আর মুনিষ খেটে কী লাভ, যা কামিয়ে এনেচো? সুফল ওঝা দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে হেসে উঠল, তারপর নিমেষে গম্ভীর হয়ে বলল, ও জ্বর ছাড়বেনি, ও কী সাধারণ জ্বর? তোমাদের পাড়া থিকে মেলা লোক আসছে। সবার মুখে ওই এক কথা। কার গোরু মরচে, কার ছাগল মরচে, কার গাছ শুকোচ্চে! আমি কী করব বলতো?
-তুমাকেই তো সব করতে হবে সুফলদা। গায়ে পড়া হাসি হাসল দুলাল।
সুফল ওঝা আরাম করে বসে দুলালকে বলল, তোমাদের পাড়াটায় কু-নজর পড়েছে। পুরা শেষ হয়ে যাবে পাড়া। দাঁড়াও গণনা করে দেখচি, কার বিষ-নজরে এসব হচ্ছে।
চেয়ার ছেড়ে সুফল ওঝা বেরিয়ে এল বাইরে। উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গোল চক্কর কেটে চারপাশ দেখে নিল একবার। চোখে-মুখে চতুর হাসি ছড়িয়ে ধুতি গুছিয়ে সে ঝপ করে বসে পড়ল উঠোনের মাঝখানে। খামচা দিয়ে তুলে নিল এক মুঠো ধুলো। সেই ধুলো দিয়ে ছক কাটল উঠোনে। ছকের মাঝখানে আঙুল রেখে বিড়বিড়িয়ে উঠল সে, দেখা দে মা, দেখা দে। ডাকিনী-যোগিনী, প্রেত-প্রেতনী দেখা দে, দেখা দে। দোহাই তুদের দেখা দে। বিড়বিড়ানো মন্ত্রের সাথে সাথে ধুলো ওড়ে। ডানে-বায়ে মাথা ঝুঁকায় সুফল ওঝা।
এক সময় চোখ কপালে তুলে সে থেমে যায়। ধুলো ছুঁড়ে দিয়ে মুঠি করে ধরে রুদ্রাক্ষের মালাটা। মেয়েলি গলায় চিঁ-চিঁ শব্দ করে ওঠে, ছেড়ে দে, ছেড়ে দে রে! আর জ্বালাস নে বাপু, ছেড়ে দে।
দরদরিয়ে ঘাম নামে সুফল ওঝার মুখ আর কপাল চুঁইয়ে। একটু আগের শান্ত-শিষ্ট মানুষটা বুঝি অশান্ত হয়ে ওঠে। তার চোখের মণি লাটিমের মতো ঘুরতে থাকে। হাঁপাতে থাকে সে। হাঁপানী থামিয়ে এক সময় গর্জে ওঠে সে, পেয়েছি, পেয়েছি তারে। সে তোদের পাড়ার মানুষ রে। বর-বউ মিলে করচে, মোট দু’জন। উঠোনে জামগাছ আছে। রাতে এট্টা পেঁচা বসে। মুখটা নারকোলের মালাইচাকির মতো, আর চোখ দুটো কাচ-টিপ্পির। সাবধান, ওরা সব খাবে। মানুষ গোরু ছাগল হাঁস মুরগি সব খাবে। শেষে মাটি খাবে, গু-গোবর সব খাবে। সাবধান।
–আমাদের কি হবে সুফলদা? অনেকক্ষণ পরে মুখ খুলল বিশ্বনাথ। সুফল ওঝা অর্ধেক ঘুরে সজোরে তার হাত চেপে ধরল, বিশুরে, গা ছেড়ে পালা। ওরা তোর মেয়েটারে ধরেচে। ছাড়বে নি, ছাড়বে নি। পেটে ব্যথা হয়?
বিশু ঘাড় নাড়ে। সমবেত মানুষের চোখে বিশ্বাসযোগ্যতার আলপনা ভেসে ওঠে। সুফল ওঝা গলা চড়ায়, ভয় পাবি নে। এর চিকিৎসে আছে। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। তবে খরচাপাতি করতে হবে। ঘাসুরিডাঙার জানগুরুর কাছে যেতে হবে সত্বর। তার বেচার নিতে হবে। আমি কিছু বলবনা। আমি প্রতিবেশী, আমার কিছু বলা সাজে না।
-কার কু-নজর পড়েছে শুধু তার নামটা বলল। বিশু তেতে ওঠে।
দুলাল উত্তেজিত, তোমাকে বলতে হবে সুফলদা। তুমার মেয়ের দিব্যি, না বললে চলবে না। সব রসাতলে যাবে। আমাদের ক্ষতি হোক–তুমি কি চাও? সুফল হাড় ফোটাল মটমটিয়ে, না রে ভাই, না। আমি মাটির মানুষ, মানুষের ভালো হোক এটাই চাই।
সুফল ওঝার স্বাভাবিক হতে আরও আধঘণ্টা সময় লাগে। বিশু গালে হাত দিয়ে হাঁটু মুড়িয়ে বসে আছে দাওয়ায়। দুলালের মুখে কোনো কথা নেই। তাদের পাড়ায় কার উঠোনে জামগাছ আছে? বর-বউ, ঘরে কোনো সন্তান নেই? কে সে? দুলালের মাথাটা গুলিয়ে যেতে থাকে। তার কানের পাশটা ঝাঁ-ঝাঁ করে। কপালটা অতিরিক্ত চিন্তায় ছিঁড়ে পড়তে চায়।
সুফল ওঝা ঢের সময় পার করে একটা বিড়ি ধরায়, গলা খেঁকারি দিয়ে শ্লেষ্মটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় দূরে। হলুদ হয়ে যাওয়া কফটা উঠোনে পড়ে জড়িয়ে নেয় ধুলো। বিশু ঘেন্নায় চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সুফল ওঝার দিকে তাকায়, দাদা গো, কিছু এট্টা বেবস্থা করো। আমাদের বাঁচাও।
-বললাম তো ঘাসুরিডাঙার জানগুরুর কাছে যেতে হবে। এত কঠিন কেস আমাকে দিয়ে হবে নি। সুফল ওঝা বিড়িতে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছিল। দুলাল তার কাছে সরে এসে বলল, সুফলদা, জানগুরুকে আমরা তো চিনি নে। তার কাছে যাবো, তবে তুমি এটা হাত চিঠি লিখে দাও।
–ও সবের কোনো দরকার হবে নি। ওখানে গিয়ে শুধু আমার নাম বললেই হবে। সুফল ওঝা গোঁফ নাচিয়ে নির্ভরতার হাসি হেসে উঠল।
পাড়ায় এসে প্রেতাত্মার খবরটা রাষ্ট্র করে দিল দুলাল। বিশু তার সঙ্গে থাকল। টগরীর চিকিৎসার চেয়ে পাড়া থেকে বদ-আত্মার অপসারণ তার কাছে বেশি গুরুত্ব পেয়ে বসল। সেই দলে বুড়োদের সঙ্গে যোগ দিল লুলারাম কেন না নূপুরও কদিন থেকে সর্দি-জ্বরে ভুগে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটা হারিয়ে ফেলেছে।
ঝারি আর ভিকনাথ ভয়ে মরছে কেন না তাদের উঠোনের জামগাছটা গত ক’ বছরে লকলক করে বাড়ছে। উঠোনে জামগাছ থাকা নাকি শুভ নয়। দুলাল গিয়ে নিজের চোখে দেখে এসেছে সব। শুধু লুলারামের ভয়ে সে কথাটা নিজের ভেতর চেপে আছে।
লুলারামের রাগ হলদিপোঁতা ধাওড়ার অনেকেরই জানা। ওর স্বভাব হল সব কিছু চুপচাপ শুনে যাওয়া। তারপর মওকা মতো সব ধারাল তীরগুলো জায়গা মতো ছুঁড়ে দেওয়া। শুধুমাত্র বুদ্ধির জোরে মানুষটা এখনও চাষের কাজে খাটতে গেল না, সে যদি মন করে তাহলে অনেক বাবু-ভাইকে তার নিজের ঘরে খাটাতে পারে। না হলে থানার পুলিশ প্রায় ওর দোরে আসবে কেন? এমন কী দারোগাবাবু পর্যন্ত লুলারামকে সমীহ করে।
নূপুরের অসুখের পর মন ভেঙে গিয়েছে লুলারামের। মুনিরাম খনখনে গলায় বলে, বাপরে এখুনকার জ্বর জ্বালাকে হেলাফেলা করবিনে। হাসপাতালে নিয়ে যা, মেয়েটারে এট্টু ওষুধ-বিষুধ এনে দে।
নূপুর বিছানা নিলে এ ঘরে হাঁড়ি চড়াবে কে? মোলক এখনও হাঁড়িশালে যায় না, ভাত ঝরাতে গেলে প্রায়ই গরম ফেন তার পায়ে পড়ে কাহিল করে দেয় তাকে।
ঘাসুরিডাঙার জানগুরু গৌরচন্দ্র মানুষ হিসাবে মন্দ নয়। তার বিকটদর্শন চেহারাখানা মানুষের মনে প্রথমেই ত্রাসের সৃষ্টি করে। মাঝারি গড়নের জানগুরুর চেহারাটা অল্প মোটা, তবে ডানদিকের গালের খুবলান দাগটা তাকে ভয়াবহতার চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। এক নজর দেখলে অনেকেরই পিলে চমকে যাবার যোগাড়া কালো মানুষটার সারা গায়ে চন্দ্ৰবোড়া সাপের মতো ছোপ ছোপ দাগ। কালো-সাদার সংমিশ্রণে সে এক বীভৎস চেহারা। শুধু শিশু নয়, এ চেহারা দেখলে বয়স্কদেরও পিলে চমকে যেতে বাধ্য। গৌরচন্দ্র তার কটা চোখের মণি ঘুরিয়ে শুধোল, তুমরা কারা গো, কুন গাঁয়ের লোক?
সাহস করে তার সামনে এগিয়ে গেল লুলারাম, হলদিপোঁতা ধাওড়া থেকে আসচি গো।
-অঃ, তা বেশ, তা বেশ। শয়রেটে চুলে হাত বুলিয়ে বাপের বয়সী গৌরচন্দ্র জিজ্ঞেস করল, তা বেটা, তুর নাম কি?
-আজ্ঞে আমার নাম লুলারাম রাজোয়ার।
-ওঃ বুঝেচি! তুর বাপের নাম মুনিরাম, তাই না? গৌরচন্দ্রের চোখ থেকে সংশয়ের মেঘ সরে গেল। বেশ খুশি খুশি মেজাজে সে দাপনা চুলকে বলল, তুর বাপের সাথে বয়সকালে কতবার হাডুডু খেলেচি তার কুনো গোনা গুনতি নেই। তবে মানতে হবে তুর বাপের মতো খেলোয়াড় এ তল্লাটে আর দুটি ছিল না। তা বাপ, তুদের সেই কালো ঘোড়াটা আচে না বেচে দিয়েচিস?
কালো ঘোড়ার প্রসঙ্গ উঠতেই সিঁটিয়ে গেল লুলারাম। কালো ঘোড়ার গল্প পাড়াগাঁয়ে কার না জানা। মুনিরামের অসুখের জন্য ওই কালো ঘোড়াই যে দায়ী একথা আড়ালে আবডালে অনেকে এখনও আলোচনা করে। পাপের শাস্তি মানুষকে এ জীবনেই পেয়ে যেতে হয়। স্বর্গ-নরক এই ধুলোতেই মিলে মিশে আছে।
যে মানুষটা এত জানে সে নিশ্চয়ই মুনিরামের আর সব গুণের কথা জেনে বসে আছে। তার সম্মুখে বেশি মুখ নাড়ানো উচিত হবে না। কেঁচো খুঁড়তে এসে সাপ বেরিয়ে পড়লে মুশকিল।
গৌরচন্দ্র তার কটা চোখ ড্যামা ড্যামা করে লুলারামের দিকে তাকাল, তা বাপ, তুর কি করা হয় শুনি?
লুলারামের যাবতীয় গাম্ভীর্য লুটিয়ে পড়ার দশা, কোনোমতে মাথা নেড়ে সে বলল, কি আর করবো গো, যখন যা পাই তখন তা করি। এসব করে দিন চলে যায় কুনোমতে।
-কুনোমতে কেন রে, তুর দিন তো বেশ ভালোই যাচ্ছে। তুই এখন অমাবস্যায় চাঁদ দেখচিস। তবে সাবধান। গৌরচন্দ্রের চোখ কঠিন হয়ে এক জায়গায় স্থির হয়ে গেল, যে হরিণের পেছনে তুই দৌড়োচ্ছিস সে তো হরিণ নয়, সে হল বাঘ। তুরে খাবে, তুর সনসার খাবে। সোনা ভেবে যারে তুই আঁকড়ে ধরেছিস সে হল কচা কাঠ।
লুলারাম ঘামছিল। সেয়ানা সেয়ানায় লড়াই জমে ওঠার আগেই বিশু এগিয়ে এল ওদের সামনে, জোড়হাত কপালে দুইয়ে বলল, আমাদের ঘোরতর বেপদ গো, আমাদের বিপদ থেকে বাঁচাও। সুফল ওঝা তুমার কাছে পাঠাল। সে খড়ি কেটে দেখেচে গায়ে নাকি প্রেতাত্মা ঘুরচে–
দাপনায় চটাস করে চাটি মেরে লাফিয়ে উঠল জানগুরু, প্রেতাত্মা ঘুরছে নারে ব্যাটা, দুটা মানুষ প্রেতাত্মা পুষে রেখেছে। তারা মানুষের সর্বনাশ চায়। তবে তাদের আমি বেশি বাড় বাড়তে দিবোনি। তাদের ডানা আমি হেঁটে দিব। তুরা যা–
গৌরচন্দ্র তাদের যেতে বললেও কেউ যায় না, সবাই মাটি কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঘাড় নীচু করে। আতঙ্ক ছড়িয়ে গিয়েছে ওদের চোখে-মুখে। কার এত সাহস যে মানুষের ক্ষতি করার জন্য ভূত পুষে রেখেছে।
গৌরচন্দ্ৰ কপাল কুঁচকে বলল, যার ঘরে ভূত-প্রেতের বাস তার ঘরে বাচ্চা-কাচ্চা থাকবেনি। তারা হবে আটকুড়ো, বাঁজা। ঝাড়া হাত-পায়ের মানুষ ছাড়া কার বুকে এত সাহস হবে বল?
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর বেড়ে গেল সন্দেহ। হলদিপোঁতা ধাওড়ায় এমন মানুষ কে আছে যার ছানাপোনা নেই? আটকুড়া, বাঁজা।
বিশু বলল, আমাদের ভিকনাথ গো, ওর তো কুনো ছেলেপুলে নেই!
দুলাল সবিস্ময়ে বলল, ঠিক কথা। তবে
সন্দিগ্ধভাবে তাকাল লুলারাম, তার মুখে আটকে গেল কথা। জানগুরু গৌরচন্দ্র বলল, কার পেটে কী আচে, আমি ছাড়া আর কে জানবে বাপ। নিজেদের মধ্যে খেওখেয়ি করো না, ঠাণ্ডা মাথায় কাজ নিও। তুমাদের হাতে কুনো প্রমাণপত্তর নেই। থানা পুলিশ হলে তুমরা সব জেলে যাবা। আমাকেও পুলিশ ছেড়ে কথা বলবে না। তাই বলছিলাম কী কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলো, কাঁটার বদলে মুড়ো ঝাটাও চলতে পারে তবে ঝাটার বদলে যেন খাড়া না চলে। মনে রেখো রক্তারক্তি হলে ভূমি নষ্ট হয়। ভূমি নষ্ট হলে শান্তি নষ্ট হয়।
খরাবেলায় ফিরে এসে সাঁঝেরবেলায় সালিশি সভার ডাক দিল হলদিপোঁতার মোড়ল। গায়ে কম্বল জড়িয়ে কোনোমতে সভায় এল চুনারাম। মুনিরামের আসার কোনো উপায় ছিল না। তার ঘা-গুলো থেকে রস কাটছিল অনবরত। সে তার অনিচ্ছার কথা জানিয়ে দিল সবাইকে।
সভা শুরু হতেই হ্যারিকেনের বাতি উসকে লুলারাম বলল, ধাওড়াপাড়ার বেপদ গো। মানুষগুলোকে এ বিপদ থেকে বাঁচাতে হবে।
দুলাল রাগে ফুঁসছিল, ছাগল-গোরু না পুষে মানুষে ভূত-প্রেত পুষেচে। যে পুষেচে তারে গাঁ থেকে পগারপার করতে হবে, নাহলে নিস্তের নেই।
ভূত-প্রেতের প্রসঙ্গ উঠতেই বাকি মানুষ যেন শূন্য থেকে পড়ল, এ কেমুন ধারা কথা গো? মানুষ আবার ভূত-প্রেত পোষে নাকি?
-পোষে, আলবাত পোযে। জানগুরু বলেচে। সুফল ওঝা বলেচে। ওদের কথা ভুল হবার নয়। ভিড়ের মধ্যে থেকে কথাগুলো উঠে এল।
রাতের অন্ধকার ছাপিয়ে ভেসে এল ঝিঁঝি পোকার ডাক। আতঙ্কগ্রস্থ একদল মানুষ টিমটিমে আলোয় মাথার চুল ছিঁড়তে বাধ্য হল। বুড়িগাঙের জলের চেয়েও কালো হয়ে আছে ওদের মুখ। চোখ থমথমে।
সভার মাঝখানে উঠে দাঁড়াল বিশু, গলা খেঁকারি দিয়ে বলল, আমার মেয়েটার পেটে অসহ্য ব্যথা। সে বেচারী সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। দাঁড়াবে কি করে? ওর শরীলে কোনো ওষুধ কাজ দিচ্ছে না। যা খাচ্চে সব বমি হয়ে বেরিয়ে যাচ্চে। সচরাচর এমন হয় না। এসব হচ্ছে সব কু-আত্মার জেরে।
জানগুরু আর কী বলল তা শোনার জন্য লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল চুনারাম। দুলাল গলা চড়িয়ে বলল, তাহলে শোন-জানগুরু বলেচে-এ পাড়ার কেউ ভূত-প্রেতনী পুষে রেখেছে। সেই ভূত-প্রেতনী গাঁয়ের মানুষের ক্ষতি করচে। রোগ-জ্বালা সেই জন্য কমচে না। যার হচ্ছে আর সারচে না। মানুষ গোরু ছাগল হাঁস মুরগি সব ফলিডল দেওয়া পুকুরের মাছের মতো মরচে। এমন চললে পুরো ধাওড়াপাড়া সাফা হয়ে যাবে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। চুনারাম কাশি আটকাতে পারল না, মিনিট দুয়েক কাশতে কাশতে তার চোখ থেকে বেরিয়ে এল জল। খড়খড়ে হাতে সেই জল মুছে নিয়ে চুনারাম শুধোল, এ পাড়ায় কার ঘরে ভূত আছে বলে তুমাদের বিশ্বেস।
বিশু কোনো রাখ-ঢাক না করে বলল, জানগুরুর কথা মতো ভূত-প্রেত তো ভিকনাথের ঘরে থাকার কথা। জানগুরু বলেচে-ভূত আছে তার ঘরে যার ঘরে কুনো ছানাপুনা নেই। সভায় উপস্থিত ছিল ভিকনাথ নিজেও। কথাটা শোনার পরে তার সারা শরীর চিড়বিড়িয়ে উঠল। প্রতিবাদ করতে গিয়ে কী ভেবে সে চুপ করে গেল। সভার মধ্যে গুঞ্জন উঠল ধীরে ধীরে। ঢিল মারা পাহাড়ী-মৌচাকের মৌমাছির মতো ছড়িয়ে গেল মানুষ। সবার ক্রোধী চোখ গিলতে লাগল ভিকনাথকে। এতদিনের চেনা মানুষটা এক নিমেষে শত্রু হয়ে গেল সবার। রাগে-ঘেন্নায় অনুশোচনায় থ’ হয়ে গেল ভিকনাথের শরীরখানা।
চুনারাম মুখ উঠিয়ে বলল, সবাই তো শুনলে, কারোর কিছু বলার থাকলে দশের মাঝখানে বলতে পারো। তারপর দশে যা রায় দেবে সভা তা মেনে নেবে। হঠাই হল্লা ফুঁসে উঠল, হাতের মুঠি বাগিয়ে বলল, দোষীর শাস্তি চাই। যে দশের সর্বনাশ চায়, আমরা তারও সর্বনাশ চাই।
চুনারাম সবাইকে শান্ত হতে বলে ভিকনাথের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল, তুর কিছু বলার থাকলে বল। দশে জেনে-বুঝে যে রায় দিবে সেটা তুকে মানতে হবে। এ ব্যাপারে আমার কুনো রায় নেই। আমি সমাজের দাস, দশের কাছে হাত-পা বাঁধা।
ভিকনাথের কাঁদো কাঁদো চোখ-মুখ, কিছু বলতে গিয়ে গলা বেজায় কেঁপে উঠল তার, নিজেরই পেট চলে না, ভূত-প্ৰেতনীর পেট পালবো কি করে গো? বিশ্বাস না হয় তুমরা সব্বাই মিলে আমার ঘরে চলো, নিজের চোখে সব দেখে আসবা। কথা-কানি আর দু-চারটে হাঁড়িকুঁড়ি ছাড়া আমার ঘরে কিচু নাই গো।
তুর বউটা গলায় সোনার হার পরে ঘুরে বেড়ায়, আর তুই বলছিস তুর ঘরে কিছু নাই–এ তো বড়ো তাজ্জব কথা! হাসির ঢেউ উঠল সভা জুড়ে। অসহায় ভিকনাথ বলল, ওটা সোনার হার ন্য গো, ওটা গিল্টি-গয়নার। চকচক করলে কি সোনা হয়ে যায়? আমার বাপ-ঠাকুরদা কুনোদিন সোনার আংটি পরে নি। আমার মার গায়েও কুনোদিন সোনার কুঁচি ছিল না। থাকবে কি করে, রেজা-কামিনের কাজ করে কি সোনার জিনিস পরা যায়?
চুনারাম বুঝতে পারছিল ভিকনাথের কথার সত্য। কিন্তু বুঝতে পারলেও তার যে কিছু করার নেই এটা সে হাবভাবে বুঝিয়ে দিল। এদিকে কেরোসিন ফুরিয়ে এসেছে হ্যারিকেনের, আর মিনিট দুয়েকের মধ্যেই সব তেল পুড়ে গিয়ে দপদপ করবে আলো। ফিতে পোড়ার গন্ধে নাক কুচকাবে অনেকেই। তার আগেই আলো থাকতে থাকতে কথাটার ফায়শালা হয়ে যাওয়া ভালো। চুনারাম গলা চড়াল, তুমরা সব কি চাইচো গো?
ফিসফিস আলোচনা সেরে ভিড়ের মধ্যে থেকে দুলাল বলল, দোষ করলে সাজা তো পেতেই হবে। যারা দশের কথা ভাবে না, তাদের কথা আমরা কেনে ভাবব। ওদের একঘরে করে দেওয়া হোক।
সেই ভালো, সেই ভালো। সবাই একবাক্যে সায় দিল।
বিশু বলল, ওরা সরকারি কলে জল আনতে যেতে পারবে নি। পাড়ার কুনো কাজে ওদের ঢোকা বারণ।
ভিকনাথ কাটা গাছের মতো সিঁটিয়ে গিয়ে শুনছিল, খুব অসহ্য লাগতেই এবার সে আর্তনাদ করে উঠল, উটি করবেন নি গো, মরে যাবো। পাড়ায় তো আমরা ক’ ঘর মাত্তর। আমাদের ভিনো করে দিলে বউটারে নিয়ে আমি যাবো কুথায়?
–তোর বউয়ের কি যাওয়ার জায়গার অভাব? সোঁদর মুখের জন্য তো অনেক কপাট খোলা থাকে। পেছন থেকে কথাটা কে যেন ঢিল মারার মতো ছুঁড়ে দিল। ভিকনাথের কান্না পাচ্ছিল ভীষণ তবু সে কাঁদল না। দম ধরে থাকল অনেকক্ষণ।
চুনারামের মাজাটা কনকন করছিল অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার জন্য। সে হাত নেড়ে নেড়ে বলল, হারকেনের কেরোচিন ফুরিয়ে এল। ইবার আমাদের সভাও শেষ। তাহলে এই কথাই থাকল কাল ভোর হওয়ার পর থেকে ভিকনাথ একঘরে হয়ে যাবে। এ কথার যেন নড়চড় না হয়। নড়চড় হলে আরও কঠিন সাজা দেওয়া হবে। কথাটা যেন মনে থাকে।
তালাই গুটিয়ে সবাই যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন ওদের সামনে এসে মা দুর্গার মতো দাঁড়াল ঝারি, এ তুমরা কি করলে গো? এর চেয়ে আমাদের মেরে ফেললে ভালো হত। আমরা নির্দোষ। তুমাদের পায়ে ধরি গো, বুড়িগাঙের ঘাটটা আলাদা করে দিও না। মাঠ আর ঘাট আলাদা হলে মানুষের যে আর কিছু থাকে না।
একঘরে হওয়ার অভিশাপ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল ঝারি। পিঠে-পরবের দিনে হাঁটুর ফাঁকে মুখ গুঁজে বসে ছিল ভিকনাথ। ঝারি তাকে বলল, যাও না গাঁয়ের ভেতর থিকে ঘুরে আসো। গেল সালে তো কত পিঠে গামছায় করে বেঁধে আনলে এ বছর গেলে নেশ্চয়ই কেউ তুমারে ফেরাবে না।
ছোটকাল থেকে গাঁয়ে ঘুরে পিঠে খেত ভিকনাথ। সবাই মন খুশ করে পিঠে দিত। বলত-পেট ভরে খাও, লাগলে আরো দেব। পোড়া-পিঠের স্বাদ আলাদা। সেই পিঠে দশজনে মিলে না খেলে তার স্বাদ বাড়ে না। বোস বাড়ির বউটা হর সাল গুড়পিঠা আর সরুচাকুলি বানায় ভালো। সরাপিঠা আর ভাপাপিঠা মকর-পরবে সবার ঘরে হবেই হবে। সেদ্ধপিঠা আর পুরপিঠাও হবেই হবে। ও পিঠা না হলে মকরসংক্রান্তির আনন্দ যে ফিকে হয়ে যাবে।
ঝারি নিজেও পিঠে খেতে ভালোবাসে। তবু গাছ পুজোয় পিঠে না দিয়ে এলে তার শান্তি নেই। ভিকনাথের মাথা একেবারে পাগল করে দেবে, কই গো, নুয়াচাল আনলে না যে! মকর পরবের আর বেশি দেরি নাই। কাল নারকেল নুয়া চাল আর নলেন গুড় নিয়ে এসো। আর হ্যাঁ মনে করে কাঁচা দুধ এনো। তুমার বাহ্যি হয়েছিল, মানত করেচি ঠাকুরের কাছে। সে ধার এবার শোধ দিতে হবে।
গায়ে গা লাগিয়ে পরবের দিনগুলো বুঝি শেষ হয়ে এল। ঝারি ভিকনাথকে ঠেলা মেরে হু-হু কান্নায় ভেঙে পড়ল। তার চোখের জলে বেরিয়ে এল ঘামের গন্ধ। নিজের ভেতর সে খুঁজতে লাগল ভূতের গন্ধ।
.
২৯.
দশদিন কেটে গিয়েছে কাজে যায়নি ভিকনাথ। ঘরে চাল বাড়ন্ত। ঝারির আর হাঁটার ক্ষমতা ছিল না। বাঁধ গোড়ায় অনেকদিন পরে দেখা হল তার লুলারামের সঙ্গে। একটা জড়তা নিয়ে কুয়াশা ঢাকা ছাতারগাছের মতো গড়িয়ে ছিল লুলারাম।
ঝারি তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, তুমিও কি মুখ ঘুরিয়ে নেবে এই অসময়? লোকের কথা বিশ্বেস করে এতদিনের সম্পর্কটাকে নষ্ট করে দিতে পারবে তুমি? অনেকক্ষণ পরে মুখ খুলল লুলারাম, অপরাধীর মতো বলল, আচ তুমাদের এই অবস্থার জন্যি আমি দায়ী। সবাই তোমার-আমার সম্পর্কটার কথা জেনে গিয়েছে। এটা কেউ সহ্য করতে পারে না।
পারবে না, এতো জানা কথা। ঝারি ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে হাসল।
–লোকের কুনো দোষ নেই। যত দোষ আমার। লুলারাম ঝারির দিকে মায়াবী চোখে তাকাল, ঝারির রূপ তাকে চুম্বকের মতো টানছে, আগুনপোকার মতো নিজেকে কিছুতেই সামলে রাখতে পারছে না লালুরাম, এক উন্মনা অস্থিরতায় বুজে এল তার গলা। পুরুষের এই মুহূর্তটিকে ঝারি খুব ভালোভাবে চেনে। সে যাবতীয় খেদ ভুলে লুলারামের হাত ধরে টানল বাঁধের নীচে। ঝোপের আড়ালে ঘাসের বিছানায় দেহবিছিয়ে দিল সে। লুলারামকেবলল, শোঁকো, ভালো করে শোঁকো–দেখো আমার গায়ে কুনো ভূতের গন্ধ আছে কি না।
লুলারাম পাগলের মতো শুকছিল। শুঁকতে শুঁকতে বহুদিন পরে সে ডুবে গেল আলোর গহ্বরে। তৃপ্তির ডিঙাটা তখন মাছে ঠুকরান ছিপের ফাতনার মতো নড়ছে। সুখের পলির ভেতর নিজেকে সঁপে দিয়ে সে খুঁজতে চাইল জীবনের আসল ঘ্রাণ।
দুটি শরীর দীক্ষা নিয়ে মাটির টানে ফিরে গেল। আকাশের গঞ্জনা শোনার জন্য শুধু জেগে রইল একাকী চাঁদ।
.
চাপাকলে জল আনতে গিয়ে প্রথম বাধা পেল ঝারি। মুখ বেজার করে কলসিটা নিয়ে পাশে সরে দাঁড়াল সে। মনে মনে ফুঁসছিল সে কিন্তু বাইরে তার কোনো প্রকাশ নেই। এ-গাঁয়ে বউ হয়ে আসার পরই তার ভাগ্যটা গাঙের জলের মতো নানা খাতে বয়ে গেছে। সেই প্রথমদিন থেকে তাকে মাঠের কাজে যেতে দেয়নি ভিকনাথ। মুখ ফুলিয়ে বলেছে, লোতুন বউ তুমি। তুমি খাটতে গেলে লোকে যে আমার মুখে চুনকালি দেবে।
নতুন বউ পুরনো হল তবু ভিকনাথের মন সায় দিল না। ঝারি নিজেও আর গা করেনি মাঠে যাওয়ার। মাঠ-ঘাটের কাজ সবার দ্বারা হয় না। সবাই যা পারে ঝারি তা পারে না। অবশ্য ভিকনাথও চায় না ঝারি ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াক। মুখে দোক্তাগুণ্ডি নিয়ে এখানে-সেখানে পিক ফেলুক। কিংবা নেশায় টলমল হয়ে ঘর ফিরুক। ঝারির ওসব হ্যাপা নেই। সেদিক থেকে ভিকনাথ অনেক সুখী মানুষ। ঝারির মুখের দিকে তাকালে তার পিয়াস মিটে যায়, গাঙধারের ঝাউগাছগুলোর মতো হালকা মনে হয় নিজেকে।
চড়া রোদে আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল না ঝারি। ঘরে ভাত চড়িয়ে এসেছে। চুলার শুকনো কাঠ পুড়ে পুড়ে শেষ হয়ে যাবে একসময়। এ সময় এক কলসি জলের বড়ো দরকার ছিল। মানুষটা খেটেখুটে এলে তাকে অন্তত এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল দিতে পারত সে।
পাড়ার বউগুলো তাকে সরকারি কলটা ছুঁতে দিল না। ঠোঁট উল্টে ভেংচি কেটে বলল, খবরদার এদিকপানে আর আসবা না, এলে পরে তুমার কলসি আমরা আধলা ইটে ভেঙে দেব। মনে রেখো-ধাওড়াসমাজ তুমাদের একঘরে করে দিয়েছে। তুমার সাথে মিশে আমরাও কি মরব নাকি?
ভূত-প্রেতের গল্পটা এখন সারা পাড়াময় চরে বেড়াচ্ছে। জন খাটতে গিয়ে এখন আর শান্তি পায় না ভিকনাথ। আগের মতন ঠাট্টা ইয়ার্কি হাসি মস্করা হয় না মাঠের কাজে। সবাই যেন শামুকের মতো খোলবন্দী করে ফেলেছে নিজেকে। ভিকনাথকে ভাবছে বুঝি বিচুটিগাছ, ছুঁলে যদি গা কুটকুটায়।
এড়িয়ে যাওয়াটা সবার আগে নজরে পড়ে মানুষের। সামান্য ঘাসও বোঝে এড়িয়ে যাওয়ার মর্মজ্বালা। মাঠে এখন জল নেই, তবু বক উড়ে বেড়ায় সাদা ডানা মেলে। বকের ডানার মতো মানুষের মন কেন সাদা হয় না?
নূপুরের জ্বর ভালো হয়ে গিয়েছে চারদিন আগে। মেয়েটা এখন শীতের পালংশাকের চেয়েও তরতাজা। চিন্তা শুধু টগরীকে নিয়ে। ভিকনাথ আর ঝারি রাতের আঁধারে গিয়েছিল মেয়েটাকে দেখতে। মমতা তাদের বসার কথা বললই না। ওর চোখে-মুখে কেমন রাগ-রাগ ভাব। যেন টগরীর অসুখের জন্য ঝারি আর ভিকনাথই দায়ী।
মনখারাপ করে রাতেরবেলায় ফিরে এসেছিল ওরা। ঘরে এসে ঝারি আর কান্নার বেগকে সামাল দিতে পারল না। ভিকনাথের বুকের উপর লুটিয়ে পড়ে সে অঝোরধারায় কাঁদল। গাঁয়ে অপবাদ নিয়ে মাথা উঁচিয়ে বেঁচে থাকা বড়ো দায়। ভিকনাথ ক্লান্ত গলায় বলল, তুমার যদি ইখানে থাকতে মন না চায়, চলো আমরা ইখান থিকে পেলিয়ে যাই। ইখানে আমাদের আছে কি? না ঘর না জমি কিছু নেই। যেটুকু সম্পর্ক ছিল তাও অপবাদের ঘোলা জলে ভেসে গেল। একা একা কি কুনোমানুষ বাঁচতে পারে গো?
–কুথায় যাবে তুমি? ঝারি চোখ মুছে শুধিয়েছিল।
সঙ্গে সঙ্গে ভিকনাথ জবাব দিল, কেনে বসন্তপুর-ধাওড়া। ও জায়গাটা মন্দ লয়। বড়ো গঙ্গার বাতাস আসে। ওখানে কাজের কুনো অভাব হবেনি।
-ওখানে গিয়ে শান্তিতে থাকতে পারবা? ঝারির চোখে সন্দেহ।
ঢোক গিলে ভিকনাথ বলল, শুনেচি ওখানকার মানুষ ইখানকার মতন নয়। ওরা পরের মুখে ঝাল খায় না, নিজে ঝাল খেয়ে চেখে দেখে।
–ওখানে গেলে ভাবছ বদনাম সঙ্গে যাবে না? ঝারি ধারালো চোখে তাকাল, বদনাম কখনো পিছু হাঁটে না, পিছু-পিছু যায়। তুমি ভাবছ ওখানে গেলে শান্তি পাবে তাই না? সে গুড়ে বালি বুঝলে?
ঝারির কথায় দুঃখ থাকলেও এই কঠিন সত্যটাকে মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই ভিকনাথের। মাটি কামড়ে পড়ে থাকার নামই তো বেঁচে থাকা। চলতে চলতে জীবনটা যে হঠাৎ এমন কঠিন হয়ে যাবে সে বুঝতে পারেনি। যখন বুঝতে পারল তখন হাতের বাইরে চলে গিয়েছে নিয়ন্ত্রণ। এরজন্য সে কাউকে দায়ী করে না, দায়ী করে তার পোকায় ধরা ভাগ্যকে।
জলঢালা ভাত খেতে বসে ঝারি বলল, একটা কাজ করলে হয় না।
ভিকনাথ উৎসাহিত হল, কী কাজ?
ঝারি বলল, চলো আমরা জানগুরুর কাছে যাই। ওখানে গিয়ে তার হাতে পায়ে ধরে মত বদল করাব।
–সে মানুষটা সিধা নয়। কুকুরের লেজের মতন তার মনটা বাঁকা। ভিকনাথের ঝড়ে নুয়ানো বিধ্বস্ত গলা।
ঝারি তবু ঘাবড়াল না, সে হোক। তবু আমাদের যাওয়া দরকার। মানুষটার মন ভিজলে আমাদের জীবনটাও ভিজে নরম হয়ে যাবে গো।
সারারাত নানান উৎকণ্ঠা আর চিন্তায় ঘুম হল না ঝারির। এই ঝড় যে কবে থামবে কে জানে। শীতের সকাল দেরিতে মুখ দেখায়। বুড়িগাঙের পাড়ে গাঙশালিকের গলার আওয়াজ ঘরে বসে শুনতে পায় ঝারি। পাখিগুলো সারাদিন ঝগড়া করে, না নিজেদের মধ্যে ভাব জমায় কিছুই বুঝতে পারে না ঝারি। ওরা জন্ম থেকে জোড়ায় জোড়ায় ঘোরে। ওদের ভালোবাসা জল মাটির চেয়েও সত্য।
সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে বাসি মুখে বিড়ি ধরাল ভিকনাথ। কুয়াশার চেয়েও গাঢ় ধোঁয়ার রাশি ঘর পেরিয়ে দাওয়ায় ঝুলে রইল অনেকক্ষণ। এ সময় হাওয়া সব সাহেবমাঠের দিকে চরতে গিয়েছে, রোদ্দুর তাই হলুদ শরীর নাচিয়ে কিকিৎ খেলছে জগৎখালি বাঁধের উপর। রোজ এ সময় অর্জুনগাছের গোড়ায় কামরাঙা ফলের মতো শির-জাগানো কেঠো-ফলগুলো ধুলোয় লুটিয়ে থাকে। অন্যদিন হলে ঝারি যেত ঝুড়ি নিয়ে সেই ফল কুড়োতে। অর্জুনের শুকনো ফলে ভালো আগুন হয়। মাঝে মাঝে ঝারির ঐ একলা গাছটার সঙ্গে নিজের শরীরটাকে মিলিয়ে দেখতে মন চায়। ওর গায়ের রঙের সাথে অর্জুনগাছের ত্বকের রঙও বুঝি মিলে যায়। এত ফর্সা গাছ এ তল্লাটে আর কটা আছে।
ঘর ছাড়তে সামান্য দেরি হলেও ওরা দ্রুত হেঁটে সে দেরিটাকে নিজেদের মতো করে মানিয়ে নেয়। জানগুরুর ঘরের সামনে এসে ঝারি ঢোঁক গিলে বলল, সাহস করে চলে এলাম বটে তবে এখুন বুকটা আমার থিরথির করে কাঁপছে। মনে হচ্চে কাজটা ঠিক হল না।
ভিকনাথ ঝারির মুখের দিকে ভরসার চোখে তাকাল, এসে যখন পড়েছি তখন অত ভেবে আর কি হবে? চলো যাওয়া যাক।
দাওয়ার উপর শিব হয়ে বসেছিল জানগুরু। ঝারি আর ভিকনাথ বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ না দিয়ে লুটিয়ে পড়ল তার পায়ের উপর। ঝারি তার মোহনী সুরে বলল, গুরুজী, আমরা বহু দূর থেকে বহু আশা করে তুমার কাছে এয়েচি। তুমি আমাদের মেরেচো, ইবার তুমি আমাদের বাঁচাও।
–আমি তুদের মেরেচি। কে তোরা? জানগুরু গৌরচন্দ্র ঊর্ধ্বমুখী তাকাল।
ভিকনাথ গাঁয়ের ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে, হাতজোড় করে সে বলল, বাবা গো, তুমার দিব্যি দিয়ে বলচি, আমাদের ঘরে কুনো ভূত-প্রেত নেই। তুমার রায় তুমি ফিরিয়ে নাও, আমাদের বাঁচাও।
-আমি বাঁচাবার কে? বাঁচাবে যে সে তো উপরে উঠে বসে আছে। সে ব্যাটা তো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। অদ্ভুত মুখ করে হেসে উঠল জানগুরু।
ঝারি তার পা ছাড়েনি তখনো, জেদ ধরে বলল, না বাঁচালে আমি তুমার পায়ে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকব। আমি আমার এ জীবন তোমার এখানেই হারাব
-আরে না, না। বলেই জানগুরু গৌরচন্দ্র ঝারির ফুলেল উন্মুক্ত বাহু দুটো দু হাত দিয়ে চেপে ধরল, অমনি তার মুঠো দুটো ঝারির মাখন শরীরে ঢুকে গিয়ে শরীরে উষ্ণপ্রবাহ বইয়ে দিল। এই এত বয়সেও চার টুকরান মাছের মতো অস্থির হয়ে উঠল জানগুরুর শ্যাওলা ধরা মনটা। ঝারির মুখের দিকে এক নজর তাকিয়ে থ হয়ে গেল তার চোখের তারা। ধাওড়াপাড়ায় এমন যাত্রাদলের সখী-চেহারার মেয়ে থাকে? আহা, কতদিন নজরকাড়া সুন্দরীর মুখ দেখেনি সে। বউটা সাত তাড়াতাড়ি পটল তুলে তার যৌবনকে সাপের মাথার মতো থেতলে দিয়ে চলে গেল। কিন্তু সাপ মরল, বিষ রয়ে গেল মনের ভেতর। সেই বিষ দিনে দিনে কাল হল, কাল থেকে হল মহাকাল। কুলবেড়িয়ার বউটার ভূত খেদাতে গিয়ে বদ্ধ ঘরে সবে বউটাকে জড়িয়ে ধরেছিল। সেই ভূতে ধরা বউটাই তার মতিগতি বুঝে না চেঁচিয়ে কামড়ে দিল পুরুষাঙ্গে, খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বলেছিল, যা ঢ্যামনার ছা, তোরে আমি ক্ষামি করে দিলাম। এবার থেকে যার গায়ে হাত দিবি এই ক্ষামি তোকে বারবার চেতন দেবে। নিজেকে না সামলালে মরবি তুই, মরবি। বলেই লাথ মেরে আছড়ে ফেলে দিয়েছিল বাটের উপর, ঘন ঘন শ্বাস ফেলে বাঘিনীর তেজে বলেছিল, যা পালা, দেরি হলে তোর পিঠের চামড়ায় গাঁয়ের মানুষ ঢাক বাজাবে। পড়িমড়ি করে দরজা খুলে জান বাঁচিয়েছিল জানগুরু গৌরচন্দ্র।
এমন ঘটনা তার জীবনে প্রথম নয়। ভূষণী বুড়িও তার যৌবনে শিকার হয়েছিল। ঝাঁড়ফুকের নাম করে গৌরচন্দ্র তার উপর চড়ে বসেছিল ষাঁড়ের মতো। চিকিৎসার অঙ্গ ভেবে মুখে কুলুপ এঁটে সব সয়ে নিয়েছিল ভূষণী। পরে শরীরের তাপ শরীর শুষে নিতেই সে টের পায় বাঁধ ভেঙে গেছে দুজনের। সে যাত্রায় ভুষণী রক্ষা পায় ভাগ্যের জোরে। সব বীজে যে ফসল হয় এমন নয়। ভুষণী দয়ালের চোখে সতীত্ব না হারালেও মনে মনে সে নিজেকে একটা নষ্ট মেয়েমানুষ ছাড়া আর কিছু ভাবত না। দয়াল যখন সরল মনে বলত, তুমি আমার ঘরের নক্ষী গো, তুমি আমার টুসু তুমি আমার ভাদু গো? তখন নাকের সকড়ি টেনে চোখের জলের ছায়ায় উদাস হয়ে যেত ভূষণী। দয়াল তার গায়ে গতরে ভালোবাসার হাত বুলিয়ে দিয়ে বলত, কেঁদো না গো, কেঁদো না, তুমি কাঁদলে আমার দেশ-দুনিয়া আধার হয়ে যায়।
ঝারিকে দু-হাতের ভরে মুখোমুখি দাঁড় করাল গৌরচন্দ্র, ওর চন্দ্রিমাভরা মুখের দিকে তাকিয়ে মরাগাঙে জোয়ার আসা গৌরচন্দ্র বলল, তুই ভাবিস নে, ঘর যা। আসচে অমাবস্যায় আমি তোর ঘর যাবো। যা করার গাঁয়ের দশ মাথাকে শুনিয়ে করতে হবে। এখান থেকে আমি রায় তুলে নিলে চলবেনি। মানুষ তা মানবেই বা কেনে?
ঝারি তার চোখের জল মুছে নিয়ে বলল, তাই যেন হয় গুরুজী। যে শেল আমার বুকে বিঁধে আচে, সেই যন্ত্রণা থেকে আমরা যেন সাত তাড়াতাড়ি রেহাই পাই। আমি জানি তুমি ছাড়া আমাকে কেউ এ যন্ত্রণা থেকে বাঁচাতে পারবে না।
বাঁচাবো রে, বাঁচাবো। ধৈর্য ধর। গৌরচন্দ্র জানগুরু ঝারির মাথায় ভরসার হাত বুলিয়ে দিল।
অমাবস্যার দিনে সভা বসল পাকুড়তলায়। জানগুরু গৌরচন্দ্র তার ঝোলা নেড়ে বলল, আমার কথা নড়চড় হবে নি। আজ আমি হলদিপোঁতায় এয়েচি ভূত নামাব বলে। সবার অনুমতি যদি থাকে তাহলে আমি ভূত খেদিয়ে রাতে রাতেই ঘাসুরিডাঙায় ফিরব।
সবাই হৈ-হৈ করে অনুমতি দেয় গৌরচন্দ্রকে। ভিকনাথ তার ঝোলা বয়ে নিয়ে যায় ঘর অবধি। আঁধার নেমে আসে চারধারে। ভয় এসে ভিকনাথকে ঝাঁকায়। ঝারির শরীরের ভূতটা নাকি ভয়ঙ্কর। অনেকক্ষণ ধরে ঝাড়ফুঁক করার দরকার। ঘরের ভেতর হোম- যজ্ঞ-পূজাপাঠ সব হবে।
গৌরচন্দ্র ঝারিকে ঠেলা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দরজার খিল তুলে দেয়।
চাপা গলায় বলে, আমার দিকে তাকা। লাজ করবি নে।
ঝারি থরথর করে কাঁপছে। বেলকাঠের ধুয়োয় ভরে যাচ্ছে ঘর। মাটির ঘরটায় হাওয়া বাতাস খেলার একটাও খিড়কি নেই। কী ভাবে যেন একটা চামচিকি ঢুকে গিয়েছে ঘরের ভেতর, শুধু ফরফর করে উড়ছে, মাঝে মাঝে নেমে আসছে মেঝের কাছাকাছি।
ঝারির চোখে ধোঁয়া ঢুকে বের করে আনছে জল। সন্মোহনী কণ্ঠে গৌরচন্দ্ৰ হুংকার ছাড়ে, আর লয় রে, আর লয়, তুর ইবার চোখ মুদার পালা। চোখ বুজ, চোখ বুজ। চোখ বুজে তালাইয়ের উপর শুয়ে পড়। তুর সব অঙ্গে ভূত লকলকায়, যার জন্যি তুর ছানাপুনা হচ্চেনি, হলে সব মরে যাচ্ছে…। আমি ভূত খেদাব, তুই চটপট শুয়ে পড়।
লাজলজ্জার মাথা খেয়ে ঝারি ছেঁড়া তালাইয়ে বিছিয়ে দেয় তার শরীর। তার মুখের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে জানগুরু। একটানা মন্ত্র আউড়ে সে তীব্র ফুঃ দেয় ঝারির চোখের উপর, চোখ থিকে যা, চোখ থিকে যা। ক্রমাগত চলতে থাকে ফু-য়ের মহড়া। ফুঁ দিতে দিতে গৌরচন্দ্র নেমে আসে ঝারির খোলা বুকে। ঝারি দু-হাত বুকের উপর চেপে লজ্জাকে ডিঙানোর চেষ্টা করে। গৌরচন্দ্র জানগুরু তাকে সেই সুযোগ দেয় না। ঝারির ভড়ন্ত গোলাপী বুকে সে জানোয়ারের মতন লেহন করতে থাকে জিহ্বা। ঝারি দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে যেতে থাকে। কামাতুর হেসে গৌরচন্দ্র ফিসফিস করে বলে, এবার পেলুবে, এবার পেলুবে। তোরে ছেড়ে গেলে সে, আবার গর্ভ ভরবে তুর। শরীরটা নরম কর, আরো নরম কর। যত নরম হবে শরীল, তত ভুসভুসে হবে দেহ। বুরো মাটিতে চাষ ভালো হয়। বীজ খেলে রে…তুই আবার কানায় কানায় ভরে উঠবি। কথা ফুরোল না তার আগে জ্বলন্ত বেলকাঠের খণ্ডটা তুলে নিয়ে ঝারির নাভিদেশে একবার ছুঁইয়ে চকিতে তুলে নেয় জানগুরু। বিস্ফারিত নয়নে সে দেখতে থাকে ঝারির গোপন-সৌন্দর্য। কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ঝারি বাঁচার জন্য ঠোঁট কামড়ে ধরেছে নিজের, গুরুজী, ইবার আমাকে ছেড়ে দাও গো, আর পারি নে।
-হেরে যাবি, তুকে পারতেই হবে। এ ক্ষণ আর আসবেনি। পা-টারে ঢিলা ছাড়, আর এট্টু আর এট্টু।
ঝারির মাথার ভেতর পাহাড়ী মৌমাছির মতো বনবনিয়ে ওড়ে অপবাদ। অপবাদ তার জন্মগত। এ শরীর তার নিজের হয়েও নিজের নয়। হায় ভগবান। কেন এত রূপ দিলে গো দেহে। যদিও বা দিলে ধরে রাখার মন্ত্র দিলে না কেন?
ঝারি পা আলগা করে শুয়ে আছে আঁধারে, জানগুরু পা দিয়ে উল্টে দেয় ডিবরিটা। কেরোসিনে ভিজে যেতে থাকে মেঝে। চেনা গন্ধ। এ গন্ধ কি শুধু কেরোসিনের?
ঝারি টের পায় শুধু মেঝে নয়, তার শরীরও ভিজে গিয়েছে পুরুষবর্ষণে। মুষলধারার বৃষ্টিপাতে প্লাবিত হতে থাকে সে। শুধু অমৃত নয়, গরলও উঠে আসে মন্থনে। ক্লান্ত শরীরে পেঁচিয়ে ওঠে ঘৃণার সাপ। তবু চুপচাপ হাত-পা এলিয়ে মাটির মতো শুয়ে থাকে সে। মাটিও মা হতে চায়।
গৌরচন্দ্র ধুতি সামলে বলে, মুখের ঘাম মুছে লে। তোর শরীরের ভূত আমি আমার নিজের শরীরে পুরে নিয়েছি। আজ থিকে তুরে আর এট্টা ভূত তাড়াবে। সে তুরে মা-মা বলে ডাকবে। কেউ জানবে না, শুধু তুই জানবি–সে ভূতটার বাপ গৌরচন্দ্র জানগুরু। একথা দুকান হলে তোরে আবার ভূতে ধরবে।
ঘরের খিলকাঠ আলগা করে দিয়ে ঝারিকে চুলের মুঠি ধরে বাইরে এনে হুমড়ি দিয়ে ফেলে দিল গৌরচন্দ্র জানগুরু, গর্জন করে বলল, আর ভয় নেই, ভূত পেলিয়েছে। পেলবে না মানে? বনের বাঘ জব্দ হয়, আর এতো এগার হাত কাপড়ে নেংটো হওয়া মেয়েমানুষ!
.
৩০.
বিশুর মন ভালো না থাকলে ঘুরতে ঘুরতে নদীর ধারে চলে যায় সে। গত রাতেও টগরী পেট আঁকড়ে কাদল। কাঁদতে-কাঁদতে হোক লেগে যাচ্ছিল মেয়েটার। মমতা মেয়ের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিয়ে কপাল চাপড়ে বলল, কার যে কু-নজর লাগলো বুঝতে পারছি না গো। মেয়েটার এত কষ্ট আমার চোখে সয় না। ওঃ ভগবান, তুমি ওর কষ্ট আমারে দাও।
টগরী দাঁতে দাঁত চিপে ব্যথা হজম করার চেষ্টায় ছিল। এ কাজে সামান্য সফল হতে সে বলল, মাগো, আজ বড়ো শিউলির কথা মনে পড়ছে।
আঁতকে উঠল মমতা, নিমেষে চুপসে গিয়ে বলল, ওর কতা মনে আনিসনেমা। ওর কথা ভাবলে আমি এখনও শিউরে উঠি। এত কষ্ট নিয়ে মেয়েটা মরল যা ভাবা যায় না।
ছাতিমগাছে ফুল ফুটেছে থোকা থোকা, ফুলগুলোর এমন শোভা যেন সাদা ফুলগুলো হালকা সবুজ জলে চুবানো। ছাতিমফুলের গন্ধটা হাওয়া বইলে বাড়ে। অনেকদূর পর্যন্ত তার যাতায়াত। অন্যসময় হলে এই সামান্য বিষয়টা নজর এড়িয়ে যেত মমতার। আজ যেন সে নিজেকে এর থেকে মুক্ত করতে পারে না। পথের পাশের ঝাঁকড়া মাথার ছাতিমগাছটাকে মনে হয় যেন তার ঘরের মেয়ে টগরী। এতদিন খেলত ঘুরত হাসত ফলে তার দিকে কেউ তেমন ভাবে ফিরে তাকায়নি। আজ বিছানা নেবার পর থেকে টগরীর গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছে সবার কাছে।
বিকেলে হরনাথ এসেছিল তার ভিটেবাড়ি দেখার জন্য। গাঁয়ে ঢোকার আগে প্রতিবারই সে চুল্লরসে পেট ভরিয়ে আসে। ফলে কথা বলার সময় মুখ দিয়ে ভকভকিয়ে দুর্গন্ধ বেরয়, সামনে কেউ তিতে পারে না। মমতা দুর থেকেই কথা বলছিল, এট্টা কথা বলব দাদা, যদি কিছু মনে না করো।
মমতার লতানে কথায় হরনাথের মনে কোনো দাগ কাটে না, হ্যাঁ হ্যাঁ যা বলো।
কথা শোনার জন্যি তো গাঁয়ে আসি গো।
সাহস পেয়ে মমতা বলল, শ্মশানে কি মানুষ বাস করতে পারে গো। দু-চার দিন থাকলে এক কথা, মাসের পর মাস কি সিখানে থাকা যায়? তাই বলছিলাম ওসব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে ঘরে চলে আসো। কাঁথ দেওয়াল তো ধসে ধসে পড়চে, আবার নতুন করে দেওয়াল গাঁথো।
-নদীর পাড় ধসে গেলে আবার কি পাড় জোড়া যায় গো? হরনাথের ব্যথাতুর চোখ।
মমতা বলল, লোকের শোক বুকে নিয়ে বয়ে বেড়াতে-বেড়াতে তুমি যে একদিন পাথর হয়ে যাবে। এখনও সময় আছে গাঁয়ে ফিরে আসো। আবার ভাঙাঘর নতুন করে জোড়া লাগাও।
হরনাথ মলিন হেসে জবাব দেয়, তা আর সম্ভব নয়। যে ঢেউ চলে যায়, সেই ঢেউ কি ফেরানো যায়?
টগরী শুয়ে শুয়ে হরনাথকে দেখছিল, যত দেখে তত আজব মনে হয় মানুষটাকে। শিউলি বেঁচে থাকতে এই মানুষটা তাদের মেলায় নিয়ে যেত হাত ধরে। পাঁপড়, শুকনো মিষ্টি কিনে দিত খুশি হয়ে। বলত, তোরা খা। আরও লাগলে আরও দেব। বেলুন নিবি, মা?
-না গো, বেলুন নিবোনি। বেলুন নিলে ফেটে যায়। টগরী ঘাড় নেড়ে বলত, বেলুন ফেটে গেলে আমার খুব মন খারাপ করে। বেলুন ফেটে গেলে বেলুনের জান চলে যায়। তখন কিছু আর ভালো লাগে না।
কথায় কথায় হরনাথ জেনে যায় টগরীর অসুখের কথা। সব শুনে হরনাথের মন খারাপ করলেও সে সাহস দিয়ে বলে, বোগজ্বালা কার নেই? ওসব ঠিক হয়ে যাবে গো। গোরা সাধু ইখানে থাকলে তার হাতে-পায়ে ধরে আমি তুমাদের কাছে ঠিক নিয়ে আসতাম। সে তো খপর না দিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল। এখন মা গঙ্গাই জানে সে কুথায় আছে। তবে এট্টা কথা বলি গো, ওই মানুষটার জন্যি আমার বুকটা প্রায় দিন হাহাকার করে। খুব মনে পড়ে ওর কথা।
গোরা সাধুর কথা মমতার কানে গিয়েছে, কিন্তু সময় করে তাকে দর্শন করার সৌভাগ্য হয় নি তার। ওই নির্লোভ মানুষটার কথাতেই অনেক মানুষ আরোগ্যের পথ পেয়ে যেত। কী ভাবে পেত, কেমন করে পেত-এসব তথ্য এখনও অজানা।
হরনাথ টগরীর মুখের দিকে তাকিয়ে আফসোস করে বলল, সবই ভাগ্য! নাহলে তোরই বা কেন এমন হবে। তবে ভাবিস নে মা, সব ঠিক হয়ে যাবে।
টগরী কথা না বলে বোবার মতো তাকাল। হরনাথ শুধালো, বিশুকে দেখছি না তো, সে কথায় পালালো?
পালাবে কেন দাদা, সে তার ধান্দায় গিয়েছে। পেট তো কথা শোনে না, তার জন্য যোগাড় তো চাই। ঘরে বসে থাকলে সে জোগাড় হবে কি করে?
তা ঠিক। তবে হরনাথ থামল, টগরীর চিকিৎসার জন্য ভেবো না, টাকা যা লাগে আমি দেব। দরকার পড়লে আমার এই ভিটেবাড়ি সব বেচে দেব। মেয়ে আগে না ভিটেবাড়ি আগে বল তো?
মমতার হাঁ হয়ে যাওয়া দৃষ্টি, দাদা, তুমি আমার মেয়েটারে এত ভালোবাস?
-ও শুধু তোমার বা বিশুর মেয়ে নয়, ও সবার মেয়ে। ও আমার শিউলির জোড়া। ওকে দেখলে আমি শিউলির দুঃখ ভুলে যাই। হরনাথ স্মৃতির পুকুরে ডুব দিল। মেয়েটা আমার ভাগ্যে সইলো না। বড়ো চোট দিয়ে চলে গেল। ওর কথা আমি এখনও ভুলিনি। ও আমার মনটাকে বড়ো দুবলা করে দিয়ে গেল।
হরনাথ চলে যাওয়ার পর মমতা সংসারের কাজে মন দিতে পারে না। টগরীকে নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। কালীগঞ্জ হাসপাতালের ডাক্তার মুখের উপর বলে দিল, আর দেরি না করে ওকে একবার কৃষ্ণনগরে নিয়ে যাও। গ্রামের হাসপাতালে এর চেয়ে বেশি কিছু করা যাবে না।
বিশু ঘাড় কাত করে শুনল। মমতা বলল, চিন্তা করে আর কী হবে। ডাক্তারবাবু যখন বলচে তখন একবার নিয়ে যাওয়াই দরকার। বাবারও বাবা আচে।
বিশু শুন্য চোখে তাকাল, নিয়ে যাওয়ার কথা আমিও ভাবছি কিন্তু হাত একেবারে ফাঁকা। বাসভাড়া নেই। তাছাড়া আমি একা গেলে চলবে না। সঙ্গে আর কাউকে নিতে হবে। কৃষ্ণনগর মস্ত শহর। সেখানকার আমি কিছু চিনি না।
বাঁধ ধরে ফেরার সময় মমতার মুখে কোনো কথা নেই। ভূত-প্রেতের গল্প এখন ফিকে হয়ে গেছে পাড়ায়। যারা জ্বরে পড়েছিল তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়। সবার সব ঠিক হয়ে গেল শুধু টগরীর শরীরটাই যা সারল না।
বিড়ি ধরিয়ে বিশু বলল, টাকার জন্যি কার কাছে যাওয়া যায় বল তো?
অনেক ভেবে মমতা লুলারামের নামটা বলল। কিন্তু খুশি হল না বিশু। লুলারামকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে। ওর মতন ধান্দাবাজ মানুষ এ পাড়ায় আর দুটি নেই। ও একটা শয়তানের গাছ। মন্দবুদ্ধিতে ওর সঙ্গে পেরে উঠবে কে? অমন মানুষের কাছে টাকা ধার নেওয়ার অর্থ বিপদকে ঘরে এনে তোলা। বিশু তাই নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলল, লুলারামের কাছে টাকা ধার আমি নিবোনি। ও মানুষ ভালো নয়, মতের মিল না হলে ও আমাকে বিপদে ফেলে দেবে। তখন আমও যাবে, ছালাও যাবে।
-তাহলে হরদার কাছে চলে যাও।
মমতার কথা শুনে খুব অবাক হল বিশু, হরদার কাছে যাবো-তার মানে?
-হরদা নিজে ঘর বয়ে এসে বলে গেল টগরীর চিকিৎসা খরচা সে দেবে। দায়ে অদায়ে তাকে যেন খবর দেওয়া হয়।
তবু ইতস্তত ভাব কিছুতেই ঘুচল না বিশুর। সে শ্বাস নিয়ে কিছু সময় অন্যমনস্ক হয়ে ভাবল। তারপর নিজের মনেই বলল, তুমি যখন বলচো তখন আমি যাব। লুলারামের চেয়ে হরদার মন আরও অনেক বেশি সাদা। ভালো মানুষের কাছে হাত পাতলে পাপ হয় না।
বিপদের সময় পাপ-পুণ্য বিচার করতে যেও না। মমতার অসহ্য লাগছিল বিশুর যুক্তিগুলো, আমরা নিজেরা পাপ না করলেই হল। পরের হাঁড়ির খোঁজ নিয়ে নিজেদের হাঁড়ির তলা ফাঁসানো উচিত হবে না। মমতা বিশুর সামনে থেকে উঠে গিয়ে টগরীর বিছানার এক কোণে গিয়ে বসল।
টগরী তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দুম করে বলে বসল, মা, তুমরা আমাকে নিয়ে ভেবো না। আমি ঠিক ভালো হয়ে যাব। আমার মন বলচে আমার খারাপ কিছু হয়নি।
–তাই যেন হয়। ঠোঁট থরথরিয়ে উঠল মমতার।
হরনাথ তার জমানো টাকাগুলো বিশুর হাতে তুলে দিয়ে বলল, একদিন এই টাকা জন্য গাঁ ছেড়ে ভিন দেশে গিয়েচি। এত করেও মেয়েকে, বউকে বাঁচাতে পারলাম না। আমার এই টাকা যদি টগরীর কিছু কাজে লাগে তাহলে আমার চাইতে আর কেউ বেশি খুশি হবে না।
কথাগুলোয় এত দরদ ছিল বিশু আর চোখের জল আটকে রাখতে পারল না, নিজেকে সামলে সে বলল, আগের জন্মে তুমি আমার আপন দাদা ছিলে গো। নিজের দাদা না হলে এভাবে ভাইয়ের বিপদে কেউ এগিয়ে আসে!
হরনাথ বলল, ওসব কথা বলে আমাকে আর লজ্জা দিও না। আমি শ্মশান-ডোম। আমার চিন্তা আর কত ভালো হবে বলল। শ্মশানের ধোঁয়ার চেয়েও কুচুটে আমার মন। তবে কি জানো, মা গঙ্গাবুড়ির দয়ায় আমাদের টগরী ভালো হয়ে যাবে। আর দেরি না করে কালই তুমি ওকে কৃষ্ণনগরে নিয়ে যাও।
শহরের হাসপাতালটা মস্ত বড়ো। দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। বড়ো জায়গায় বড়ো ব্যবস্থা। মমতা বলল, টাকা খরচ হল তো কি আছে? হাতি যেমন খায় তেমন নাদে।
রিপোর্ট দেখে বড়ো ডাক্তার খুশি হয়ে বললেন, ভয়ের কিছু নেই। অপারেশনের দরকার হবে না। ওষুধেই পেটের ব্যথা সেরে যাবে।
হাসপাতালের গেট থেকে বেরিয়ে বড়ো হালকাবোধ হচ্ছিল বিশুর। এতদিনের পাথরচাপা দশাটার যেন মুক্তি ঘটল। মমতা খুশি হয়ে বলল, ডাক্তারবাবু বলেচে-তিন দিন পরে টগরীকে ছেড়ে দেবে। তুমি ঘরে ফিরে যাও। আমি তিন দিন তিন রাত্রি হাসপাতালে কাটিয়ে দেব।
-তা কি করে হয়? ঘরে আমার মন টিকবে? যা হয় হোক-আমি এখানেই থাকব। বিশুর কণ্ঠস্বরে ফুটে উঠল জেদ।
মমতা তাকে চাঙ্গা করার জন্য বলল, চলো, আজ মাটির ভাঁড়ে চা খাবো। রোজ তো ঘরে চা খাই, আজ দোকানের চা-খেয়ে দেখি কেমুন এর সুয়াদ। মনে মনে খুশি হল বিশু। মমতার এত খুশি খুশি ভাব এর আগে তার নজরে পড়েনি। মানুষ কত ছোট ছোট ব্যাপারে আনন্দ পায়, আর সেই আনন্দের ভাগ সে সবাইকে দিতে পারে। এ যেন অনেকটা ফুলের গন্ধ ছড়ানোর মতো।
চা-খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওরা চলে গেল স্টেশনের কাছে। রেলিঙ ঘেরা জায়গাটায় ঝকমক করছে আলো। ওরা কেউ এর আগে ট্রেন দেখেনি। ট্রেনের গল্প শুনেছে দুলুর মুখে। সেই রোমাঞ্চকর গল্প গেঁথে আছে মগজে।
শেয়ালদা থেকে লালগোলা ট্রেন এসে থেমেছে কৃষ্ণনগর স্টেশনে। মাইকে সে কথাই বারবার বলছে ঘোষক।
মমতা সেই লাল চুবানো গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল বিস্ফারিত চোখে। বিশুরও অবস্থা তথৈবচঃ। স্টিম ইঞ্জিনের হুসহাস শব্দ রাগী সাপের নিঃশ্বাস হয়ে আছড়ে পড়ছে বাতাসে।
মমতার মন কেমন করে উঠল, ওগো শুনচো, যাওয়ার সময় দেবগ্রাম অব্দি টেরেনে গেলে হয় না?
বিশু ঘাড় নাড়তেই মমতা উৎসাহভরে বলল, মেয়েটা জীবনে কুনোদিন টেরেন দেখিনি। বে-থা হয়ে গেলে কুথায় গিয়ে পড়বে কে জানে! দু-বেলা খেতে পাবে কি না তাও সন্দেহ।
-তাহলে আমরা যাওয়ার সময টেরেনেই যাব। নাটকীয় গলা করে হেসে উঠল বিশু। মমতা কোন ফাঁকে তার হাতটা ছুঁয়ে দিয়েছে, খুব মজা হবে তাই না? দুলু বলেছিল-টেরেন গান গায় সব সময়।
মনোযোগ দিয়ে শুনল বিশু, টেরেন যে গান গায় এ আমি প্রথম শুনলাম।
–তুমি বুঝি জানতে না? মমতার শরীর ভার বুক সমেত ঝুঁকে এল, টেরেন যে গানটা গায়–সে গানটা আমার জানা। যাচ্ছি যাবো, যাচ্ছি যাবো। কাঁচা তেঁতুল, পাকা তেঁতুল। কু ঝিক ঝিক করমচা। ভয়ে ওড়ে কাদা খোচা। কু ঝিক ঝিক করমচা।
মমতার গান শুনে অনেকদিন পরে প্রাণ খুলে হেসে উঠল বিশু। মেঘ সরে গেল তার আকাশ থেকে।
.
খরার আকাশ যে এমন বৃষ্টির খবর বয়ে আনে কে জানত।
ঝারি শরীরে জাল বিছিয়ে ধরতে চাইছিল সেই সুখের মাছটাকে। মাছটা বারবার ফসকে যায় তার হাত থেকে। একেবারে পালিয়ে না গিয়ে কিছু দূরে গিয়ে সাঁতার কাটে। ঝারি টের পায়, স্পষ্ট টের পায়, তার শরীর জুড়ে সাঁতার দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে সেই দুষ্ট মাছটা। এটা কিভাবে সম্ভব-ঝারি বুঝতে পারে না কিছুতে। নিজের শরীরটাকে তার মনে হয় নিজের নয়। আশ্বিনের তুলো মেঘের মতো এই শরীর এখন হালকা তবু তার নজরকাড়া রূপভঙ্গি এক ফোঁটাও কমেনি।
জানগুরু যাওয়ার সময় একলা পেয়ে বলেছিল, তোরে আমি যে সুখ দিয়ে গেলাম সেই সুখ আমার বউও পায়নি। তবে একথাও ঠিক তুই আমারে যে সুখ দিলি আমার বউ আমাকে একদিনের জন্যি দিতে পারেনি। তোর কোল ভরবে, তুই কোলভরা হবি–আমার আশীর্বাদ রইল।
জানগুরু চলে যাওয়ার পর মনটা উদাস হয়ে গিয়েছিল ঝারির। লুলারাম বা ভিকনাথ যা এত বছরে পারেনি জানগুরু সেই জন্মদাগ রেখে গেল অনায়াসে। বদ্ধঘরে ঝারি টের পেয়েছিল তার শরীরে ভূমিকম্প হচ্ছে, মাটি ফাটিয়ে উঠে আসছে অমৃত, সৃষ্টিময় লাভা উদগীরণে কেঁপে যাচ্ছে সর্বসত্তা। পুরুষ হারে না, নারীও হারে না, এমন দ্বৈরথ এ ভূমিতে খুবই কমই সংঘটিত হয়।
যে ঘৃণা জানগুরুর প্রতি ঝারি জমিয়ে রেখেছিল তা অমৃতমন্থনের অন্তিম মুহূর্তে উবে যায়। ঝারির ক্ষুদ্র জীবন কানায় কানায় ভরে ওঠে, রাতের পদ্মফুলের চেয়েও কোমল হয়ে ওঠে তার তন্বী শরীর। মাটির ঘরে ছড়িয়ে দেয় অপ্রতিরোধ্য সুগন্ধ। তার নির্মেদ রমণীয় শরীর বক্ষদেশের আবরণ ভেদ করে শেষ বর্ষার ছাতুর মতো পুরুষের সুউন্নত বক্ষে লেপটে যায় অনায়াসে। শরীরের কমনীয় কুসুম পাপড়ি মেলে দেয় অজান্তে, এক চৌম্বকীয় ধর্মে সে আকর্ষণ করে পুরুষের আদিম রিপুর তাড়নায় মত্ত হয়ে ওঠা আগুন নদী। দীর্ঘ সাঁতারেও ক্লান্তবোধ করে না জানগুরু। মাটির গভীর থেকে তুলে আনে কামনার জল। ঝারির মুখের কাছে সে মুখ ঘষতে-ঘষতে বলে,এবার তুই মা হবি, জননী হবি। আমি তোকে দেগে দিলাম। তুই তোর নগ্ন স্তনের দিকে তাকলে আমার শরীলের গন্ধ পাবি। আজ থেকে তুই আমার বকুলগাছ।
শরীর ভাঙে না, শরীর গড়ে। ক্রমশ উজ্জ্বল হয় ঝারির দেহশোভা। সেই সুখের দিনটার জন্য শরীরের ঝর্নায় ছিপ পেতে বসে থাকে ঝারি। উন্নত সুগঠিত বক্ষদেশের স্পন্দনে সে অনুভব করে খরার আকাশেও বিন্দু বিন্দু মেঘের সঞ্চার ঘটেছে, সময়ে বৃষ্টি নামবে, ভিজে যাবে কঠিন মাটি, একটি অপাপবিদ্ধ অকুর মাথা তুলে দাঁড়াবে তার নাভিজুড়ে।
ঝারি বুঝতে পারল তার সাধারণ দেহসৌষ্ঠব আজ অসাধারণ হয়ে উঠছে কিসের যাদু ছোঁয়ায়, তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে তার এতদিনের শরীর সাধনা। আগুন কি ঘিয়ের দিকে ছুটে যায় নাকি ঘি-ই আগুনকে জড়িয়ে ধরে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ঝারি আরও কয়েক জন্ম নারী হয়ে জন্মাতে চায়।
তার অনুভূতির কথা বিছানায় টের পেয়ে যায় ভিকনাথ। প্রমত্ত বাসনায় অস্থির ঝারিকে সে পাগলের মতো লেহন করতে থাকে, আঁধারে তার হাত থেমে যায় ঝারির নাভির কাছে। ঝারি খিলখিলিয়ে ফুলভর্তি গাছের ডালের মতো হেসে ওঠে, তুমারে এট্টা খপর দিব, তবে এখুন নয়, আরও কিছুদিন পরে, খবরটা শুনে তুমি নির্ঘাৎ পাগল হয়ে যাবে বলে দিলাম।
এ রহস্য ধাঁধার উত্তর জানে না ভিকনাথ, সে অন্ধকার খায়, অন্ধকারে হাতড়ায়। তারপর ঝারির শরীরে নিজের শরীর নোঙর করে বলে, আমার মন বলছে তুমার মরা গাঙে আবার বান আসবে। আমার পুড়া সার আবার নতুন করে শ্বাস লিয়ে বাঁচবে।
পরের দিন সকালে ঝারি তাকে টানকে টানতে নিয়ে যায় শীতলাতলায়। তারপর দণ্ডবত করে বলে, মনে মনে যা চাওয়ার চেয়ে নাও। আজ যা চাইবা সব পাবা। শীতলাবুড়ি আজকের দিনে কাউকে খালি হাতে ফেরায় না।
ভিকনাথ বুঝেই ঘোরের মাথায় হাতজোড় করে দাঁড়াল। বিপদ কেটে গিয়ে সুখের রোদ উঠছে। মুহূর্তে পাল্টে যাচ্ছে রোদ্দুরের রঙ। রোদ্দুরের রঙ বদল হলে এ শরীরের রঙ বদল হতে কতক্ষণ।
ঝারি হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। তার প্রায় উন্মুক্ত দেহশোভা প্রকৃতি মুগ্ধ হয়ে দেখল। তৃপ্তি ওদের সারা শরীরে চুঁইয়ে নামছে। এমন সংবাদ গায়ের সবাইকে বিতরণ করা প্রয়োজন। বাতাস মেতে উঠল সেই আনন্দযজ্ঞের একজন যথার্থ সাক্ষী হয়ে।
লুলারাম খবর পাঠিয়েছিল রাতের বেলায় ঝারিকে কদমতলায় আসার জন্য। আসব না আসব না করেও দ্বিধা সরিয়ে চলে এসেছে ঝারি। বুড়িগাঙের সুস্থির জলের দিকে তাকিয়ে তার নিজেকে বড়ো চঞ্চলা মনে হল। চঞ্চল মন, পাপের বন। অনেকদিন পরে ঝারির মনে হল–সে ভুল করছে। এ পথে তার আর না হাঁটাই উচিত। ঢিলি বউদি অভিমান নিয়ে চলে গিয়েছে। ভিকনাথও অভিশাপ দিয়ে চলে যাক সে চায় না। আত্মশুদ্ধির অনেকপথ এখনও তার জন্য খোলা আছে।
লুলারাম নেশায় টলতে টলতে অন্ধকার চিরে এগিয়ে এল। কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল ওর। ঝারির হাত ধরে জোরে চাপ দিয়ে বলল, আমি মরে যাব, আমি মরে যাব। তুমারে না পেলে আমার জেবন খড়ের চেয়েও শুকনা হয়ে যাবে। ঝারি, আমি তুমার পায়ে ধরি। চলো ইখান থিকে আমরা পালিয়ে যাই। ইখানে থাকলে বেচারা ভিকনাথ অঘোরে আমার হাতে মারা পড়বে। ঝারির শরীর কেঁপে কেঁপে উঠল। স্তনাভারে ন্যুজ হয়ে বলল, এ গাঁ ছেড়ে আমার আর কুথাও যাওয়া সম্ভব নয়। বুড়িগাঙ কী কুথাও গিয়েছে যে আমিও যাবো?
খুব অবাক হল লুলারাম, তুমার জন্যি ঢিলিকে আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম পাগল বানিয়ে। বউটা আমার জন্যি মরল। তার মরণের জন্য তুমিও দায়ী।
–আমি কেনে দায়ী হতে যাবো। ঝারির চোখ থেকে রাগে তারা খসে পড়ল, সে তুমার পাপে মরেছে। আমি নিজে ভিখারী হয়ে তুমাকে রাজা সাজিয়েচি। রাজার ধর্ম তুমি রাখো নি। মানুষের ধর্মও তুমি রাখোনি। তুমি পাপী। তুমার ছায়ায় আমার এখন দাঁড়ানো উচিত নয়।
-মাগী, তুর এত বড়ো কথা? অন্ধকারে পশুর মতো হাঁপায় লুলারাম।
ঝারি তাকে দুহাত দিয়ে ধাক্কা মেরে গড়িয়ে দেয় বুড়িগাঙের পায়ের নীচে। অন্ধকারে সেগুন কাঠের খুঁটির মতো গড়িয়ে যেতে থাকে লুলারাম। তবু তার মুখে কোনো চিৎকার নেই। লোকলজ্জার ভয়টা তাকে বোবা করে দিয়েছে। বোবারা যদি ভয় পায় সেই ভয় মনের গহীনে শেকড় চালিয়ে দেয় আমৃত্যু। নিকষ আঁধারে লুলারাম খুঁজতে থাকে মৃত্যুর আদি রঙ।