০৬. সম্পাতি রহস্য – ষষ্ঠ প্রকরণ

০৬. সম্পাতি রহস্য – ষষ্ঠ প্রকরণ

রামের সহায়তায় বালীকে বধ করে সুগ্ৰীব কিষ্কিন্ধ্যার রাজা হওয়ার পর বর্ষা নামে। শ্রাবণ হতে চার মাস অর্থাৎ কার্তিক মাস পর্যন্ত বর্ষাকাল। বর্ষা অন্তে সীতা উদ্ধারে সুগ্ৰীবের কোন উদ্যোগ না দেখে রাম দূত হিসাবে লক্ষ্মণকে কিষ্কিন্ধ্যায় পাঠায়। রামকে রুষ্ট জেনে সুগ্ৰীব অতঃপর বানর-সৈন্য সমাবেশ করে এক মাস মধ্যে সীতার অনুসন্ধান সেরে প্রত্যাবতনের অঙ্গীকারে চারটি দলকে চারিদিকে পাঠাল। অঙ্গদের নেতৃত্বে হনুমান প্রমুখ সীতা অন্বেষণে দক্ষিণদিকে গিয়েছিল। এর নানা স্থান ঘুরে বিল মধ্যে পথ হারিয়ে পরিশেষে স্বয়ম্প্রভার অনুগ্রহে উদ্ধার পেয়ে বসন্তকালে যখন বিন্ধ্যগিরিতে উপস্থিত হল তখন সুগ্ৰীবের নিদিষ্ট সময়কাল শেষ হয়ে গিয়েছে। কাল উত্তীর্ণ হওয়ায় সুগ্ৰীবেব ক্ৰোধের কথা চিন্তা করে এবং সীতার সন্ধানে ব্যর্থ হওয়ায় হনুমান প্রমুখ প্রায়োপবেশনে প্রাণত্যাগ করার উদ্যোগ করলে তাদের সঙ্গে সম্পাতির সাক্ষাত ঘটে। তখন বসন্তকাল। সম্পাতি ও জটায়ু দুই ভাই। সম্পাতি জ্যেষ্ঠ ও জটায়ু কনিষ্ঠ। পুরাকালে ইন্দ্র কর্তৃক বৃত্ৰাসুর বিনষ্ট হলে সম্পাতি ও জটায়ু ইন্দ্র বিজয় অভিলাষে স্বর্গে গিয়ে ইন্দ্রকে পরাস্ত করে। পরে আকাশ-পথে সূর্যের নিকট উপস্থিত হয়। তখন সূর্য মধ্যস্থান প্রাপ্ত হলে জটায়ু সূৰ্যতেজে অবসন্ন হওয়ায় সম্পাতি নিজ পক্ষদ্বয় দ্বারা ভ্রাতাকে আচ্ছাদন করে। ফলে পক্ষদগ্ধ হওয়ায় সম্পাতি বিন্ধ্যগিরিতে পতিত হয়। ষষ্ঠরাত্রের পর সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে চারিদিকে তাকিয়ে অবশেষে স্থানটি বিন্ধ্য বলে বুঝতে পারে।

এখানে মহাতপ নিশাকর ঋষির আশ্রম ছিল। এই বিন্ধ্যগিরিতে সম্পাতিকে দুৰ্দশাগ্রস্ত হয়ে আটহাজার বছর কাটাতে হয়। ইতিমধ্যে একদিন নিশাকরের সঙ্গে সাক্ষাতের বাসনায় সম্পাতি বিন্ধ্যগিরির শিখরদেশ হতে অবতরণ করে দর্ভসমন্বিত ধরাতলে ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হল। সেখানে বৃক্ষসকল পুষ্পিত এবং উৎকৃষ্ট ফল সমন্বিত হয়ে আছে, সুগন্ধি বায়ু বইছে।

সম্পাতি দেখল নিশাকর কৃতস্নান হয়ে উত্তরমুখে প্রত্যাগমন করছে। নিশাকর সম্পাতিকে দেখে হস্টচিত্তে আশ্রমে প্রবেশ করে পুনরায় বেড়িয়ে এসে সম্পাতির দুরবস্থার কারণ জানতে চাইল। ঘটনা জেনে নিশাকর বলল সম্পাতির সুক্ষ রোমরাজি এবং অন্য বৃহৎ পক্ষদ্বয় উদগত হবে এবং বল বিক্রম চক্ষু প্রাণ প্রভৃতি সকলই পুনঃপ্রাপ্ত হবে। তবে তার আগে তাকে একটি মহৎ কাজ করতে হবে। রাবণ কর্তৃক সীতা হরণের পর সীতা অন্বেষণে রামের দূতগণ এখানে উপস্থিত হলে তাদের রাম-মহিষীর সংবাদ জানাতে হবে। সুগ্ৰীবের সঙ্গে সাক্ষাতের দিন সম্পাতির দুরবস্থার আট হাজার বছর পূর্ণ হয়েছিল। সীতার সন্ধান জানানোর পর সম্পাতির পক্ষোদগম হয়।

 

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন সম্পাতির সঙ্গে সাক্ষাতের বহু পূর্বেই হনুমানরা জানত যে রাবণ জনস্থান হতে সীতাকে হরণ করে লংকায় নিয়ে গিয়েছে। সুতরাং এ বিষয়ে সম্পাতি কাহিনীতে নতুন কোন তথ্যের অবতারণা করা হয়নি। অথচ উদ্দেশ্যহীন ভাবেও নিশ্চয়ই এই কাহিনী বিবৃত হয়নি। এই কাহিনীতে সম্পাতি, জটায়ু ও নিশাকর নামকরণ, বিন্ধ্যগিরি ও জনস্থান, ছয় রাত্রি পরে সংজ্ঞালাভ এবং আট হাজার বছর সময়কাল খুবই তাৎপৰ্য্যপূর্ণ।

বিল হতে হনুমানরা নিষ্ক্রান্ত হয়ে যখন প্রায়োপবেশনে বসেছিল তখন বসন্তকাল। রামায়ণের কালে চৈত্র ও বৈশাখ মাস বসন্তঋতু। সম্পাতি যখন বিন্ধ্যগিরির সমতলে নিশাকরের আশ্রমে উপনীত হয় তখনও বসন্ত কাল। আশ্রমের পুষ্প ও ফলসম্ভার তার প্রমাণ দেয়।

এই কাহিনীর বিল অর্থ রেবতী নক্ষত্র সন্নিহিত নিহারিকা। রেবতী নক্ষত্রকে স্বয়প্রভা বলা হয়েছে। কারণ এই নক্ষত্রের বরিশটি তার ছায়াপথে আচ্ছন্ন থাকায় সঠিকভাবে নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। এজন্য রেবতী নক্ষত্রটিকে রূপকে স্বয়ম্প্রভা নামে অভিহিত করা হয়েছে।

সম্পাতি,—সম্পাত + ইন্‌(ইনি)-১ ব, সম্পাতবান। সম্পাত অর্থ পরস্পর ছেদ বিন্দু। সূর্য ও পৃথিবীর কক্ষপথ যে দুই বিন্দুতে পরস্পরকে ছেদ করে তাকে সম্পাত বা বিষুব বলে। সুতরাং সম্পাতি শব্দে বিষুব স্থান ইংগিত করছে। বিষুব দুটি, বাসন্ত ও শারদ। যেহেতু কাহিনীতে বসন্তকালের উল্লেখ আছে, সেকারণে সম্পাতি বাসন্ত বিষুবর প্রতীক।

শব্দটির আরও একটি অর্থ হয়। সম্পাতি,—সম্পা (বিদ্যুৎ)—অত্যু (গমন করা) + ই কতু। অর্থ হয় যাতে বিদ্যুৎ তথা অগ্নি বিদ্যমান। অর্থাৎ অশ্বত্থ বৃক্ষ। এই বৃক্ষের কাঠে একদা অরণি হত, অতএব এই কাঠের অগ্নি উৎপাদন ক্ষমতা আছে। বসন্ত ঋতুতে অশ্বত্থ বৃক্ষ পত্রশূন্য হয় এবং গ্রীষ্ম ঋতুর প্রথমে নতুন পত্রোদগম হয়। অশ্বত্থ শব্দে অশ্বিনী নক্ষত্র ইংগিত করা হয়। সুতরাং সম্পাতি শব্দে বাসন্ত-বিষুব বুঝানো হয়েছে।

জ্যোতিষশাস্ত্রে বিষুবকে বিন্ধ্য বলা হয়।

জটায়ু অর্থ যার আয়ু জট (সংযত, প্রচুর)। জট অর্থ বট (ন্যাগ্রোধ) বৃক্ষের শাখা-শিকড়। সম্পাতি তথা অশ্বত্থ বৃক্ষের সমকক্ষ জটায়ু অর্থাৎ বট বৃক্ষ। এই বৃক্ষ দীর্ঘজীবি, শাখা-শিকড় সমন্বিত। অশ্বখের মত এর পাতা ঝরে না।

নক্ষত্র জগতে শ্রবণা নক্ষত্রর আকৃতি পক্ষীসদৃশ। এই নক্ষত্রকে অবলম্বন করে পুরাণে গরুড়ের কাহিনী সৃষ্টি হয়েছে। মকররাশির আদিত্যর নাম অরুণ। জটায়ু, সম্পাতি, অরুণ এর গরুড়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। একারণে জটায়ুকে শ্রবণা নক্ষত্রর রূপক ধরা যায়। সুদুর অতীতে শ্রবণ। নক্ষত্রে শারদ-বিষুব এবং পরবর্তীকালে উত্তরায়ণ হত।

নিশাকর অর্থ চন্দ্র। কিন্তু নিশা শব্দের এক অর্থ মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, ধনুঃ ও মকর রাশিসমূহ। কর অর্থ হস্ত-প্রান্ত। সুতরাং নিশাকর শব্দে কর্কট ও মেষরাশির প্রাস্তদ্বয় ইংগিত করছে। অতএব নিশাকরের প্রথম আশ্রম বিন্ধ্যগিরিতে শব্দে বলতে কর্কটরাশির অশ্লেষা নক্ষত্রর শেষপাদ ১২০° (এক শত কুড়ি) অংশে বাসন্ত-বিষুব। নক্ষত্রমণ্ডলে জ্যেষ্ঠ নক্ষত্রর বৈদিক নাম ইন্দ্র এবং রাশিচক্লের ২৪০° (দুই শত চল্লিশ) অংশকে বলা হয় বৃত্র-স্থান। ইন্দ্রর বৃত্রহণন অর্থে বাসন্ত-বিষুব জ্যেষ্ঠ নক্ষত্রে ২৪০° (দুই শত চল্লিশ অংশে)। সম্পাতি ইন্দ্রকে পরাজিত করে, অর্থাৎ বাসন্ত-বিষুব জ্যেষ্ঠা নক্ষত্র অতিক্রম করে অনুরাধা নক্ষত্রে ২২৬°-৪০’ (দুই শত ছাব্বিশ অংশ চল্লিশ কলায়) অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

এবার সম্পাতি সূর্যর প্রতি ধাবিত। সূর্য মধ্যগগনে এলে পক্ষদগ্ধ হয়ে সম্পাতির বিন্ধ্যগিরিতে পতন।

কুম্ভরাশিস্থ আদিত্যর নাম সূর্য। মধ্যগগন অর্থে কুম্ভ রাশির মধ্যভাগ,

৩১৫° (তিনশত পনের অংশ)। অর্থাৎ এই অংশে যখন শারদ-বিষুব, তখন বাসন্ত-বিষুব হবে ১৩৫° (একশত পয়ত্ৰিশ অংশে) পূর্ব-ফল্গুনী নক্ষত্রে।

জটায়ুর পতন হয়েছিল জনস্থানে, অর্থাং শারদ-বিষুব পিছিয়ে এল শ্রবণা নক্ষত্রে ২৯৩°-২০’ (দুইশত তিরানৱই অংশ কুড়ি কলায়)। তাহলে বাসন্ত-বিষুব কর্কট রাশিতে অশ্লেষা নক্ষত্রে ১১৩°-২০’ (একশত তেরো অংশ কুড়ি কলায়)।

কাহিনীতে রাশিচক্লের এই অংশকে নিশাকরের অতীত-আশ্রম বিন্ধ্যগিরি বলা হয়েছে। এখানে নিশাকরের সঙ্গে সম্পাতির সাক্ষাং হয়নি। ‘অতীতের আশ্রম’ বলে এই স্থানে একদা বাসন্ত-বিষুব হত তার ইংগিত দেওয়া হয়েছে। সম্পাতি বিন্ধ্যগিরির শিখর হতে সমতলে নেমে বসন্তকালে নিশাকরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দুঃখের কথা বলেছিল। কাহিনীর স্বরূপ-বদল কারণে অশ্লেষা নক্ষত্রে বাসন্ত-বিষুব ইংগিত করার জন্য বিন্ধ্যগিরির শিখর বলা হয়েছে এবং কালের ব্যবধানের ইংগিত রেখে কৃত্তিকা নক্ষত্রে বাসন্ত-বিষুব সময়ে পৌঁছানো হয়েছে। সম্পাতির দুরাবস্থার আট হাজার বছর যেদিন পূর্ণ হয়, সেদিন হনুমানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল।

অথর্ব-সংহিতা মতে অয়ন ১ বৎসরে ৪৮” (৪৮ বিকলা) পশ্চাদগামী হয়। তাহলে ৮০০০ বছরে অয়ন রাশিচক্রের ১১৩°-২০’ (১১৩ অংশ ২০ কলা) হতে ১০৬°-৪০’ (১০৬ অংশ ৪০ কলা) পশ্চাদ্‌গামী হয়ে অশ্বিনী নক্ষত্রে ৬°-৪০’ (৬ অংশ ৪০ কলায়) বাসন্ত-বিষুব অনুষ্ঠিত হয়েছে সম্পাতি যখন হনুমানদের সীতার সন্ধান দিয়েছিল। সে সময় ৯৬°-৪০ (৯৬ অংশ ৪০ কলায়) পুষ্যা নক্ষত্রে দক্ষিণায়ন, ১৮৬°-৪০’ (১৮৬ অংশ ৪০ কলায়) চিত্র নক্ষত্রে শারদ-বিষুব এবং ২৭৬°-৪০’ (২৭৬ অংশ ৪০ কলায়) উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রে উত্তরায়ণ হত। সম্পাতি দগ্ধপক্ষ হয়ে পতিত হওয়ার ছয় রাত্রি পরে সংজ্ঞা লাভ করে। এই কথার তাৎপর্য অশ্লেষা নক্ষত্রর ১১৩°-২০’ (১১৩ অংশ ২০ কলায়) বাসন্ত-বিষুব কালে পূর্ণিমান্ত বা অমান্ত মাস ধরে বলা যায় সংজ্ঞা লাভের দিন নবমী তিথি ছিল। এই নবমী তিথির ইংগিত দেওয়ার উদ্দেশ্য মনে হয় অশ্বিনী নক্ষত্রর ৬°-৪০’ (৬ অংশ ৪০ কলায়) বাসন্ত-বিষুব ও একদা নবমী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দেখা যায় রামের জন্ম শুক্ল নবমী তিথিতে।

অতএব, সম্পাতি কাহিনী রামায়ণ কালের বিষুব স্থানের নির্দেশ করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *