সেদিন ও সকাল থেকেই গম্ভীর হয়েছিল।
এক-এক দিন এইরকম—সকাল থেকে নিজের মধ্যে ডুবে থাকে।
আমি ঘরে আলমারি গোছাচ্ছিলাম।
ও খাটের উপর হেলান দিয়ে বসে একটা ইংরিজি বই পড়ছিল। হঠাৎ জিগ্যেস করল, ছোটবউ, তুমি আমার ‘রাহুর প্রেম’ কবিতাটা পড়েছ?
আমি বললুম, না তো! তুমি তো জানো, তোমার আদ্দেক কবিতাই আমি বুঝতে পারিনে।
ও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আমি ভাবলুম, এ-প্রসঙ্গে আর কোনও কথা হয়তো বলবে না। সত্যি কথা বলতে ও সাহিত্য আলোচনা শুরু করলে আমি অসহায় বোধ করি, অস্বস্তিতে পড়ি।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ও বলল, ‘রাহুর প্রেম’ কবিতাটা অনেক বছর আগে লিখেছিলেম। আমার ‘ছবি ও গান’ বইয়ে কবিতাটা আছে।
–কী আছে তোমার ওই ‘রাহুর প্রেম’ কবিতায়? কী নিয়ে লিখেছ তুমি?
—ওই কবিতায় আমি আমার কথা বলিনি। বলেছিনতুন বউঠানের মনের কথা।
–নতুন বউঠানের মনের কথা? কী কথা?
–বলতে পারো, নতুন বউঠানই কথা বলছেন, সেই কবিতায়। ছোটবউ, আমি জানি, তোমার মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন আছে আমাকে নিয়ে—সেসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো তুমি পেতে এই কবিতায়।
–নতুন বউঠান অনেক বছর হল চলে গেছেন। সবাই তাঁকে ভুলেও গেছে। তাঁর মনের কথা জেনে আমার কী হবে?
ও যেন আমার কথা শুনতেই পেল না। বলতে লাগল, ছোটবউ, আমি তখন দিনরাত পাগল হয়ে ছিলুম। একটা মাতাল অবস্থায় লিখেছিলুম ‘রাহুল প্রেম’ কবিতাটা। তখন যদি তুমি আমাকে দেখতে তো মনে করতে এই ব্যক্তি কবিত্বের খেপামি দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি জানতুম না আমি কোথায় যাচ্ছি। এক অন্ধ প্রেম আমাকে গ্রাস করে ফেলেছিল।
আপনাদের রবীন্দ্রনাথ এবার বেশ কিছুক্ষণ চুপ। আমিও আলমারি গোছানো বন্ধ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি।
জানি না কেন, খুব ভয় করছে আমার।
উনি হঠাৎ বললেন আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে, ‘রাহুর প্রেম’ কবিতাটায় নতুন বউঠানের কণ্ঠস্বর আমি আজও শুনতে পাই ছোটবউ—তিনি আমাকে ছেড়ে যাননি, যাবেন না কোনওদিন। এরপর তিনি কবিতাটার কিছু অংশ স্মৃতি থেকে বললেন—
তিনি তখন আমার কেউ নন, তিনি তখন শুধুই রবীন্দ্রনাথ—
নতুন বউঠানের মনের কথা আমি শুনতে লাগলুম তাঁর কণ্ঠে–
চাও নাই চাও, ডাকো নাই ডাকো,
কাছেতে আমার থাকো নাই থাকো,
যাব সাথে সাথে রব পায়ে পায়ে,
রব গায়ে গায়ে মিশি—
এ বিষাদ ঘোর,
এ আঁধার মুখ
হতাশ নিশ্বাস, এই ভাঙা বুক,
ভাঙা বাদ্য-সম বাজিবে কেবল
সাথে সাথে দিবানিশি।
নিত্যকালের সঙ্গী আমি যে, আমি যে রে তোর ছায়া—
কিবা সে রোদনে কিবা সে হাসিতে
দেখিতে পাইবি কখনও পাশেতে
কভু সমুখে কভু পশ্চাতে আমার আঁধার কায়া।
গভীর নিশীথে একাকী যখন বসিয়া মলিনপ্রাণে
চমকি উঠিয়া দেখিবি তরাসে
আমিও রয়েছি বসে
তোর পাশে
চেয়ে তোর
মুখপানে।
উনি থামলেন, আপনাদের রবীন্দ্রনাথ।
এঁকে আমি চিনি না। ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল উনিও আমাকে চেনেন না।
উনি আমার কেউ নন।
আমিও ওঁর কেউ নই।
অন্য এক প্রেম তাঁকে রাহুর মতো গ্রাস করে আছে সারাক্ষণ।
সেই মেয়ে আজও তাঁকে ছেড়ে যায়নি। কখনও ছেড়ে যাবে না।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে অন্ধকার বারান্দায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলুম। আমার ভীষণ ভয় করছে যে…
কিন্তু কাকে বলব আমার সেই ভয়ের কথা।
এই কথাগুলো আমি নাই লিখতে পারতুম। এই দিনের ঘটনাটা আলগোছা চলে এল।
কিন্তু না বলেও তো পারলাম না।
আমি তো সত্যিই ঘর করলুম একজনের সঙ্গে, তার ছেলেমেয়ের মা হলুম অথচ সে রইল অন্যের ঘরে—এমন একজনের যে এই পৃথিবীতে নেই, তবু সে আছে—আমার আর ওর মাঝখানটি জুড়ে সে আছে।
কোনওদিন সে যাবে না।
তার কাছ থেকে আমাদের দু’জনেরই মুক্তি নেই।
অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি বুঝতে পারলুম, সে আঁধারের মধ্যে অশরীরী আঁধার হয়ে মিশে আছে।
আর তখুনি মনে এল, অন্য একদিনের গল্প—আমার স্বামীর মুখ থেকে শোনা কথা। ওর মতো করে তো বলতে পারব না। নেহাত আটপৌরে কথাও কী সুন্দর করে বলেন।
আমি আমার মতো করে, আবার যখন মনে পড়বে হুবহু, ওর মতো করেও, মিলিয়ে মিশিয়ে বলি—একটু এলোমেলোও হবে। কিন্তু বারান্দায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাঁর কথাই—মানে নতুন বউঠানের ভয়ঙ্কর সেদিনের কথাই যে মনে আসছে।
ও যখন লেখে, বা গানে সুর বসায়, আমি ওর ধারেকাছেও যাই না। সেদিন কী মনে হল, হঠাৎ গেলাম ওর ঘরে, তখন আমরা গাজিপুরে সংসার পেতেছি, বিয়ের বছর চার পরে।
ও আমাকে কাছে পেয়ে লেখা থামিয়ে বলল, অনেকদিন ইচ্ছে করেছি এই পশ্চিম ভারতের কোথাও একটুকরো বাসা নিয়ে ভারতবর্ষের বিরাট অতীত যুগের স্পর্শ লাভ করব।
আমি তেমনভাবে বুঝতে পারিনি ওর কথা। সেকথা নিশ্চয়ই আমার চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল।
আমার বর বললে, ছেলেবেলা থেকে পশ্চিমভারত আমায় রোম্যান্টিক কল্পনার ইন্ধন জুগিয়েছে। ছুটি (মাঝেমধ্যে আমাকে ছুটি বলেও ডাকেন। ছোটবউ থেকে ছুটকি থেকে ছুটি), এত দেশ থাকতে গাজিপুর কেন? দুটো কারণ আছে। শুনেছিলেম গাজিপুর নাকি বিখ্যাত তার গোলাপের খেতের জন্যে। আমি মনে-মনে গোলাপবিলাসী সিরাজ হয়ে গাজিপুরে এসেছি। কিন্তু এসে দেখছি, এ তো ব্যবসাদারদের গোলাপের খেত। এখানে বুলবুলের আমন্ত্রণ কোথায়? আর যেখানে বুলবুল নেই, সেখানে কী করবে কবি? আর যে কারণে গাজিপুরে বাসা বাঁধলুম তা হল, ভেবেছিলেম এখানে ভারতবর্ষের মহিমান্বিত ইতিহাসের স্বাক্ষর পাব। কোথায় তার ছাপ? তেমন কিছুই তো নেই।
—তাহলে গাজিপুর তোমার তেমন ভালো লাগল না, তাই তো?
—ছোটবউ, আমি ঠিক ওইভাবে বলতে চাইনে। আমার চোখে গাজিপুরের চেহারাটা ঠেকছে সাদা কাপড়পরা বিধবার মতো সেও কোনও বড় ঘরের বিধবা নয়।
—তাহলে চলো, জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই ফিরে যাই। আমারও এখানে মন বসছে না। তবে একটা জিনিস ভালো, এখানে তোমাকে একলা পাচ্ছি।
আমার কথার উত্তরে ও বললে, একলা দেখা আর একলা পাওয়া এক জিনিস নয় ছুটি।
আমি ঠিক এরকম কথা বুঝে উত্তর দিতে পারিনে। তাই চুপ করে থাকলুম।
ও বললে, একথা ঠিক, গাজিপুরকে আগ্রা-দিল্লির সঙ্গে তুলনা করাটা ঠিক হবে না। আবার সিরাজ-সমরকন্দের সঙ্গেও তুলনা হয় না। তবু ছোটবউ, গাজিপুরের কাছে আমি ঋণী। কেন জানো?
—কেন গো?
–কারণ গাজিপুরে অক্ষুণ্ণ অবকাশের মধ্যে আমার মন নিমগ্ন হতে পারল। মুক্তি এল মনোরাজ্যে। এই অবস্থায় আমার কাব্যরচনার একটা নতুন পর্ব আপনি প্রকাশ পেল। এই যে বড় বাংলোটায় আছি, গঙ্গার ধারেও বটে, আবার ঠিক গঙ্গার ধারও নয়, প্রায় মাইল খানেক চর পড়ে গেছে, সেখানে যবের, ছোলার, সর্ষের খেত। আমি ঘরের জানলায় বসে দেখতে পাই দূর থেকে। গঙ্গার জলধারা। গুণটানা নৌকো চলেছে মন্থর গতিতে। গোলকচাঁপার ঘনপল্লব থেকে ভেসে আসে কোকিলের ডাক। আমার বিশেষ ভালোলাগে রৌদ্রতপ্ত প্রহরের ক্লান্ত হাওয়া। তুমি কি কখনও ভালো করে দেখেছ ছোটবউ, পশ্চিম কোণে প্রাচীন ওই মহানিম গাছটিকে? তার বিস্তীর্ণ ছায়াতলে বসবার জায়গাটি? আমি দেখি। শুধু তাকিয়ে থাকি। আর আমার মন চলে যায় অনেক দূরের অতীতে। এইরকমই গঙ্গার ধার, রৌদ্রতপ্ত দুপুর, ঠিক এইরকমই একটি নিমগাছ, তার বিস্তীর্ণ ছায়াতল—যেখানে নতুন বউঠানের সঙ্গে চন্দননগরে কত সময় কাটিয়েছি আমি।
ওর কথা শুনে আমার বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। চার বছর আগে চলে গিয়েও তিনি গাজিপুরে এসেছেন আমাদের সঙ্গে। আর আমি ভাবছি বিয়ের চার বছর পরে এই প্রথম সংসারের কোলাহলের বাইরে আমার স্বামীকে আমি একলা পেলাম? সে আর আমি। আর কেউ নেই।
আমাদের বড় মেয়ে বেলি তখন গুটগুট করে ঘরে এসে আমার আঁচল ধরে টানছে। আমি ওকে কোলে নিয়ে আমার বরকে জিগ্যেস করলুম, তোমার নতুন কাব্যের কী নাম দিয়েছ?
—মানসী।
—কাকে উৎসর্গ করলে? না জিগ্যেস করে পারলুম না আমি। ও বললে, সেই তাকে, যে নেই, তবু আছে, আমার সবকিছু নিয়ে আছে। কী লিখেছি জানো?
আমার গলা দিয়ে কোনও শব্দ বেরোল না।
আপনাদের রবীন্দ্রনাথ এখন অনেক দূরের মানুষ। তিনি বললেন,
সেই আনন্দমুহূর্তগুলি তব করে দিনু তুলি
সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণের প্রকাশ।
আমি অনেকক্ষণ নীরব। উনিও চুপ। আমার বুকের মধ্যে কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে রবি ঠাকুর বললে, ছোটবউ, আমি জানি, তুমি কবিতা পড়তে তেমন ভালোবাসো না, তবু ‘মানসী’র প্রথম কবিতার কয়েকটি লাইন তোমাকে শোনাতে ইচ্ছে করছে। আমার মনের এই বেদনা তোমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।
শুধু মনে পড়ে হাসিমুখখানি
লাজে বাধোবাধো সোহাগের বাণী,
মনে পড়ে সেই হৃদয়-উচ্ছাস নয়নকূলে।
তুমি যে ভুলেছ ভুলে গেছি, তাই এসেছি ভুলে।
এমন করিয়া কেমনে কাটিবে মাধবী
রাতি?
দখিনে বাতাসে কেহ নেই পাশে সাথের সাথি!
চারিদিক হতে বাঁশি শোনা যায়
সুখে আছে যারা তারা গান গায়—
আকুল বাতাসে মদির সুবাসে, বিকচ ফুলে,
এখনও কি কেঁদে চাহিবেনা কেউ আসিলে ভুলে?
আমি কোনও কথা বলিনি। ও বুঝল, আমি তো কবিতা বুঝিনে। বেলিকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে চুপচাপ বেরিয়ে গেলুম।
ও যখন চান করতে গেল, আমি ফিরে এলুম ওর লেখার ঘরে।
চারধার শুনশান।
শুধু বাথরুমে জলের শব্দ।
আর দূর থেকে ভেসে আসছে কোকিলের ডাক।
নিজেকে খুব অপরাধী মনে হল, তবু করলাম একটি কাজ–
ওর কবিতার খাতাটা লুকিয়ে দেখতে লাগলেম।
একটি পাতায় শুধু এই কয়েকটি লাইন—খুব তাড়াহুড়ো করে লেখা, যেখানে ও বলেছে ওর জীবনে লুকোনো প্রেমের কথা, পরে হয়তো ও কোনও বড় কবিতায় জুড়ে দেবে এই ক’টা লাইন–
লুকানো প্রাণের প্রেম
পবিত্র সে কত!
আঁধার হৃদয়তলে মানিকের
মতো জ্বলে,
আলোতে দেখায় কালো
কলঙ্কের মতো।।
ওর কবিতার খাতায় আমার চোখের জল পড়ল।
ভাগ্যিস কোনও অক্ষরের উপর পড়েনি।
আমি মুছে দিলুম।
ও বুঝতেও পারবে না।