মুক্তি। শেষ কথা হল মুক্তি। শরীরের মুক্তি মৃত্যুতে। আত্মার মুক্তি মায়াপ্রপঞ্চজাল ছিন্ন করে যাওয়ায়। এই যে বিশাল অনিত্য জগৎ, এই জরা ও বিনাশময় পৃথিবী, আর অনিত্য পৃথিবীর প্রতি এই যে দুরপনেয় টান–তারই নাম মায়া। অনিশ্চয়তার ভোজবাজি। এই ভোজবাজির মধ্যে দিয়ে আত্মাকে টান ছিন্ন করতে করতে যেতে হয়। যত ক্ষয়, যত ক্ষতি হতে থাকে তার, তত সে বন্ধনহীন।
এ এক অদ্ভুত ব্যাখ্যা। আত্মা মুক্ত হতে হতে স্বয়ং উপলব্ধি করে, সে কেউ নয়, কিছু নয়। এক ব্যাখ্যাতীত শক্তির প্রতিবিম্ব মাত্র সত্য নয়। সত্তা নয়। তুমি নয়, আমি নয়। শরীর ধারণ করলেই তুমি আমি। শরীর পুড়ে গেলে, মাটিতে মিশে গেলে ভূত নেই, ভবিষ নেই, নেই বর্তমান, পরমাত্মার প্রতিবিম্ব সমস্ত আত্মাই তখন মিলে মিশে একাকার। জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, লয় নেই, ক্ষয় নেই। শত্রু নেই, মিত্র নেই। শুধু এক অখণ্ড অস্তিত্ব সদাজাগরণে।
এই কথা ভেবে কোনও সান্ত্বনা মেলে না কারও। এ ব্যাখ্যা এক সামান্য পরিতোষ। চিত্তানুভীতির সামান্য সংশোধন। যতক্ষণ পবিত্র গ্রন্থের পৃষ্ঠায় ছাপা থাকে ততক্ষণ পরমাত্মারই মতো সুন্দর, অনির্বাণ।
সে ভাবতে ভাবতে যায়। যদি তার মৃত্যু হয়, যদি সে অনিবার্য স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করে তবে তার আত্মা দেহবন্ধনহীন অসীম বিস্তারে যাবে। সে তখন কোনও শুভদীপ নয়। তার কোনও দায়বদ্ধতা নেই। মায়া-মমতা পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায় নেই। সে তখন হয়তোবা নেই হয়েও এক বিশাল আছে।
সে ভাবতে ভাবতে জনপদ ধরে এগোয়। শহরের এক ঘনবসতি ও প্রাচীন অঞ্চল। সে নস্করদের বাড়ির প্রবীণ পরির দেহভাঁজ দেখে আর পা ফেলে ফেলে এগোয়। এইসব বনেদি বাড়িতে নগ্ন পরিরা উড়ে এসে বসত, আর যেত না কোথাও। স্থির হয়ে থাকতে থাকতে তারা এখন পাথর। কারও নাক টুটে গেছে। কারও ডানা ভাঙা। তবু ঠোঁটে লেগে আছে হাসি। সে মনে মনে পরিদের খোলা, সাদা, মসৃণ বুকে মুখ রাখে আর সুন্দরী মৃত্যুকে কামনা করে আবার। এবং সহসাই তার মনে পড়ে, তাদের পরিবারে মৃত্যুকে জড়িয়ে বসে আছে আরও দু’জন।
সে ফলের দোকান, মাছের দোকান, ফুল, বাসন, খেলনার দোকান পর পর পেরিয়ে যায়। তার চোখে পড়ে ঘনিষ্ঠতা, চোখে পড়ে বিরাগ! চোখে পড়ে নোংরা মাখা শিশু আবর্জনা ঘেঁটে তুলে নিচ্ছে খাবার। শিশুর আগমন সম্ভাবনায় ভারী-পেট মা ফুল আর মালা বিক্রি করছে পা ছড়িয়ে বসে। মুরগি কাটছে ছেলেটি আর ছাল ছাড়াচ্ছে অনায়াসে, পাশেই পাঁঠার মাংস ডুমো ডুমো কাটছে বন্ধু তার। সার সার ছালছাড়ানো দেহ প্রলম্বিত। স্তম্ভিত মাথাগুলি স্থিরচোখে চেয়ে আছে অনুযোগহীন। আর গান বাজছে, মুরগি ও পাঁঠার দোকানে গান বাজছে একযোগে। ঐেকই গান বেতারে চালিয়ে দিয়ে তন্ময় শুনছে—পল পল দিল কি পাস তুম রহতি হো….
এই এত জনবসতি, ঘর-সংসার, তার শুচুকে মনে পড়ছে। শুচু কি ঘর পেলে, সংসার পেলে সুখী হবে? তৃপ্ত হবে? মৃত্যুর আগেও কি জীবনের স্বাদ নেবে আকণ্ঠ? নিতে পারবে?
এত দিন সে মনে করত প্রেম-ভালবাসা আসলে যৌন আগ্রহ ছাড়া কিছু নয়। এর ওকে দেখে ভাল লাগল আর মনে হল ওর একে ছাড়া চলবে না। বৃথা এ জীবন। এই টান, এই না-চলা আসলে যৌনাকাঙক্ষা যা একজনের অন্যজনকে দেখে জাগে। কোনও অজ্ঞাত,রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জাগে এবং লিপ্সা সার্থক না হওয়া পর্যন্ত চাঞ্চল্য থেকে যায়।
শুচুর কি যৌনবােধ আছে? এত অসুস্থতার মধ্যে না থাকাই সম্ভব। আবার থাকে যদি তবে দেবনন্দন সম্পর্কে তার আকাঙ্ক্ষা জাগতেও পারে। কিংবা তার কোনও রাসায়নিক আবেগের উৎসার নেই। সে শুধুই, মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়, এমনই ধারণার গতানুগতিকতায় গা ভাসিয়েছে মাত্র। কিন্তু যদি এমন হয় যে শুচুর যৌনবােধ নেই। কিন্তু প্রেম আছে? তা হলে? শুভদীপের ব্যাখ্যা তবে অচল হয়ে যায়। এমনকী দেবনন্দনকে সে কোনও ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারছে না নিরন্তর বিশ্লেষণের পরও। সুস্থ, স্বাভাবিক, সবল দেবনন্দন কী করেই বা শুচুর প্রতি আকৃষ্ট হয়? নীলচে, ক্ষয়াটে, শীর্ণ শুচুকে দেখে কী ভাবেই বা তার যৌনভাব আসে? হিসেব পায় না সে। তল পায় না। শুচুর মুখ তার মনে পড়ে। বড় বড় চোখের নীচে কালি-পড়া। শিরা-ওঠা হাত ও কণ্ঠ। দু’ ঠোঁটের পাশে, গালে জরার হস্তক্ষেপ।
যন্ত্রণা পেতে পেতে যন্ত্রণাকেই শ্বাস-প্রশ্বাসে নিয়ে নেওয়া সে, শুচুর কারণে অনুভব করেছে এক নতুনতর যন্ত্রণা। আজই সকালে।।
পারিবারিক প্রেম ও সম্প্রীতিকে সে ব্যাখ্যা করেনি কখনও। ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের বা মায়ের প্রতি মেয়ের গাঢ় অবিচ্ছেদ্য টানকে সে গ্রহণ, করেছে চিরসত্য। এর মধ্যে যৌনতা নেই কোথাও, অবিশ্বাস বা অসম্ভাব্যতা নেই কোথাও। পারিবারিক দায়দায়িত্বকে তার মনে হয়েছে আরােপিত কিন্তু সম্প্রীতিকে নয়। | সে কারও সঙ্গে তার এই মত বিনিময় করেনি। কারও বিপরীত যুক্তি দ্বারা আপন যুক্তির খণ্ডন প্রত্যক্ষ করেনি। সুতরাং পবিত্রতার ও সত্যের সবটুকু আলাে সে পারিবারিক স্নেহে-প্রেমে-ভালাসায় প্রক্ষিপ্ত করে অনাত্মীয় মানব-মানবী সম্পর্ককে দেখেছে শুধুইতেশ্রদ্ধেয় যৌনতায়। এই যৌনতাকে সে অস্বীকার করেনি। কিন্তু যৌনতাসম্ভবের মানদণ্ড হিসেবে নির্বাচন করেছে শারীরিক সৌন্দর্য। এমনকী নিজের বােনকে পর্যন্ত এই মানদণ্ডের বাইরে রাখেনি সে।।
আজ সকালে শুধুই তার চা এনেছিল।
মূল দরজা পেরিয়ে তাদের যে একফালি বারান্দা, যেখানে সুবল থাকে আর তাদের জুততা রাখা হয়, সেই সঙ্গে ছেঁড়া কাপড়ের বাক্স, গ্যাসের সিলিন্ডার, ঝাড়ু ইত্যাদি–তারই একপাশে মোড়া পেতে সে খবরের কাগজ পড়ছিল।
এই কাগজ রাখা নিয়ে মা আপত্তি তুলেছে অনেকবার। সে শোনেনি। টিভিতেই তো সারা দুনিয়ার খবর পাওয়া যায়। তাহলে আর পয়সা খরচ করে খবরের কাগজ রাখা কেন! এমনই বক্তব্য মার। সে শুনেছে বহুবার। কিন্তু তর্ক করেনি। সেই কোন ছোটবেলায় খেলার খবরের টানে কাগজ পড়া অভ্যাস হয়েছিল। পুরু মাখন লাগানো পাঁউরুটি দিত মা। সে অন্যমনস্কভাবে পাঁউরুটিতে কামড় দিয়ে মুখভর্তি মাখনের স্বাদ নিতে নিতে পড়ত। ধীরে ধীরে মাখনের ঘনত্ব কমতে লাগল বাড়িতে। একদিন শুধু পাঁউরুটি হয়ে গেল। তারপর তা-ও আর রইল না। রুটি এল। সে এখন কাজে বেরোয় বলে সকালেই ভাত খেয়ে নেয়। অন্যদের সকালেরাতে রুটি। দুপুরে ভাত। মাত্র একপদের রান্না। সে রান্না হতে পারে এমনকী শুধুই আলুসেদ্ধ।
এত কিছুই ছেড়েছে সে। এত কিছুই অভ্যাস করেছে। কিন্তু কাগজ পড়া ছাড়তে পারেনি।
তার সেই প্রিয় অভ্যাস সে যাপন করছিল সকালে। তখন শুচু তার চা নিয়ে আসে। আর একটি মোড়া টেনে বসে পড়ে পাশে। কিছু কথা আছে তার জানায়। সে সহজেই বুঝে ফেলে শুচু দেবনন্দন বিষয়ে বলবে। এবং শুচু তাই বলে। কোনও ভণিতায় না গিয়ে তাকে সরাসরি অনুরোধ করে, সে যেন বিয়েতে আপত্তি না জানায়। সে চুপ করে আছে দেখে ব্যাখ্যা করে যায়। অবিকল মায়ের সুরে, অবলীলায় বলে তার বিয়ে হলে সংসার থেকে একজনের বোঝা তো নেমে যায়।
এ কথা শুনতে প্রস্তুত ছিল না সে। বরং ভেবেছিল শুচু পবিত্র প্রেমের দোহাই দেবে। সে জানে না কেন, তার কান ঝাঝা করে। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়া মা বলেছিল একটা পেট তো কমে যায়। এখন স্নাতক শুচু বলছে একটি ভার কমে। অর্থ এক। অভিব্যক্তি আলাদা।
সে চুপ করে থাকে। খবরের কাগজ থেকে মুখও তুলতে পারে না। ভাবে, কেন এরকম বলছে শুচু। সে কি মায়ের বলা কথাগুলি শুনেছিল কাল? নাকি মা সরাসরি শুচুকেও বলেছে এমন? মা কি এতখানি নিষ্ঠুর হতে পারে? হতে পারে এতখানি নির্মম, স্বার্থপর? সে সরাসরি প্রশ্ন করে বসে, মা কিছু বলেছে কিনা। শুচু জিভ কাটে আর তার নীল জিভ দৃশ্যমান হয়। মা এমন বলতেই পারে না। সে নিশ্চয়তা দেয়। এবং বলতে থাকে আরও। সংসারের পরিস্থিতি সে কি উপলব্ধি করছে না? সে তো সহায়তা দিতে পারছে না এতটুকু। শুধু, কোন ছোটবেলা থেকে ব্যয়সঙ্কুল হয়ে বসে আছে।
সে জানে বিশ্বদীপ মিঠুকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায়। সে, অতএব, উপায় আছে যখন, আর বোঝা হয়ে থাকতে চায় না।
শুভদীপ ভেবেছিল, একবার জিজ্ঞেস করে, যার কাছে যাবে শুচু, বিয়ে করে, সে যদি বোঝা ভাবে স্বয়ং? কিন্তু সামলে রাখে নিজেকে। দেবনন্দনের সততা ও ভালত্ব সম্পর্কে তার দ্বিধা নেই কোনও। অতএব সে দেবনন্দনকে অপমান করতে চায় না। কিন্তু নতুন করে সে উপলব্ধি করে পরিচিত জগৎ-সংসারের অদ্ভুত নিয়ম। জন্ম থেকে আজ অবধি এই পরিবারে প্রতিপালিত শুচু নিজেকে এখানে বোঝা মনে করছে। যেন এ পরিবারে চুক্তি ছিল তার। মেয়াদ ফুরিয়েছে। এমনকী জন্মদাত্রী মাও মনে করছে এমন।
নতুন কোনও পরিবারে গিয়ে, আবার নতুন করে অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে সে। সেই প্রতিষ্ঠায় কোনও গ্লানি নেই, বরং সম্মান আছে। কারণ হাজার বছর আগে মানুষ এমনই একটি রীতি প্রচলিত করেছিল।
শুচু চলে গেলে মিঠু আসবে। এক মেয়ে যাবে। অন্য মেয়ে আসবে। শুধু পুরুষেরা স্থির। তারা বিনিময় হয় না কখনও। তাদের পরিবার পরিবর্তন নিন্দিত। ঘৃণাহ। পুরুষেরা সূর্যেরই মধ্যে থেকে যাবে অবিচল আর মেয়েরা তাকে ঘিরে আবর্তিত হবে।
শুচু তখন উঠে গিয়েছিল পাখির খাঁচার কাছে। খাঁচায় হাত ঢুকিয়ে সুবলের মাথায় হাত বুলোচ্ছিল সে। গাইছিল। সরু কণ্ঠে গাইছিল। শুভদীপের অপার্থিব লাগছিল সমস্ত পরিস্থিতি। অসহ্য লাগছিল। এই গান ও গেয়েছে আগেও। কিন্তু তার এরকম লাগেনি কখনও। খাচার ধাতৃগুলিতে ধাক্কা খেয়ে ফিরে ফিরে আসছিল শব্দগুলি।
ধাঁধার থেকেও জটিল তুমি
খিদের থেকেও স্পষ্ট
কাজের মধ্যে অকাজ খালি
মনের মধ্যে কষ্ট
স্বপ্ন হয়ে যখন তখন আঁকড়ে আমায় ধরো
তাই তো বলি আমায় বরং ঘেন্না করো
ঘেন্না করো
তার অসার লাগে এইসব নিয়ম। অর্থহীন অসহ্য লাগে। পরিবারে প্রত্যেকেরই জন্মগত অধিকার নয় কেন! এমনকী মানসিকতাও নিয়ন্ত্রণ করছে এই সব নিয়ম! সমস্ত কিছুর মধ্যেই লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন। ইস্কুল, কলেজ, চিকিৎসালয়, যানবাহন, পোশাক, চাকরি, পথ ও সময়, বিধান ও রীতি-নীতি—সমস্ত, সমস্তই। পুরুষ ও নারীর আলাদা আলাদা শৌচালয়ের মতো। কিংবা এই পৃথিবী, এই গোটা পৃথিবী, এবং এই সমাজ—যার প্রত্যেকটি রীতিনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে মানুষের মানসিক সংগঠন-আসলে এক শৌচাগার মাত্র। এক বৃহৎ, বিপুল বিস্তৃত শৌচাগার।