০৬. শেয়াল দেখা

৬. শেয়াল দেখা

বিকালবেলা সবাই দল বেঁধে আব্বাকে দেখতে এল। বুবুন সবার সাথে আব্বার

পরিচয় করিয়ে দিল, “আব্বা, এই যে ছেলেটা-এর নাম পিয়াল।”

“পিয়াল?”

“হ্যাঁ।”

গাব্বু বলল, “ওর নাম রাখার কথা ছিল শিয়াল, ভুল করে শ-এর জায়গায় প লিখে–হি হি হি—”

আব্বা বললেন, “ধুর! শিয়াল কি কখনো কারও নাম হয়?”

বুবুন গাল্লুকে দেখিয়ে বলল, “আর এর হচ্ছে গাব্ব।”

আব্বা হেসে বললেন, “খালি ঠাট্টা করে! গাব্বু কখনো কারও নাম হয় না।”

সুমি মাথা নেড়ে বলল, “চাচা, আপনি ঠিকই বলেছেন, গাব্বু কারও নাম হয়। কিন্তু বিশ্বাস করেন তবু এর নাম গাব্বু।”

বুবুন সুমিকে দেখিয়ে বলল, “আর এই মেয়েটার নাম সুমি।”

গাব্বু বলল, “বল, এই মেলেটার নাম সুমি।”

আব্বা অবাক হয়ে বললেন, “মেলে?”

“হ্যাঁ। সুমি হচ্ছে অর্ধেক মেয়ে আর অর্ধেক ছেলে। তাই সে হচ্ছে মেলে।”সত্যি?”

“সুমি বড় হলে মনে হয় গুণ্ডা হবে।”

“গুণ্ডা?”

“হ্যাঁ। স্কুলে সেদিন একটা ছেলে তার সাথে ফাজলেমি করেছিল, তাই সুমি তাকে ল্যাং মেরে পানিতে ফেলে দিয়েছিল।”

আব্বা অবাক হয়ে সুমির দিকে তাকালেন। বুবুন বলল, “আব্বা, তুমি গাব্বুর সব কথা বিশ্বাস করো না। গাব্বু সবসময় বাড়িয়ে চাড়িয়ে কথা বলে। একটা উকুন মারলে গাব্বু এসে বলে সে একটা ইঁদুর মেরেছে। ইঁদুর মারলে বলে হাতি মেরেছে।”

আব্বা বললেন, “আর হাতি মারলে?”

“এখনও মারে নাই, কিন্তু যদি মারে তা হলে মনে হয় বলবে ডাইনোসর মেরে ফেলেছেন হয় আব্বা আপন

কথাটা মনে হয় আব্বার খুব পছন্দ হল, আব্বা খুকখুক করে হেসে উঠলেন।”

সুমি জিজ্ঞেস করল, “চাচা আপনার আগের কথা কিছু মনে নেই?”

আব্বা মাথা নাড়লেন, “নাহ্!”

“বুবুনের কথা? চাচির কথা?”

“বুবুন যখন খুব ছোট ছিল সেই কথা একটু একটু মনে আছে।”

“কী করত বুবুন?”

আব্বা ভুরু কুঁচকে কিছু-একটা মনে করার চেষ্টা করে বললেন, “মাথাটা মেঝেতে লাগিয়ে পিছনটা উপরে তুলে পায়ের নিচে দিয়ে তাকিয়ে বলত বুঁদ বুদ বুদ-_”

“বুদ বুঁদ বুদ?” গাব্বু আবার হি হি হি করে হেসে উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু সুমি এমনভাবে চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকাল যে সে আর সাহস পেল না। সুমি জিজ্ঞেস করল, “আপনার আর কিছু মনে নেই? চাচির কথা মনে নেই?”

“চাচি? সেটা কে?”

সুমি বুবুন পিয়াল এবং গাব্বু সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। বুবুন বলল, “আম্মা। আমার আম্মা।”

সুমি জিজ্ঞেস করল, “মনে নেই?”

আব্বা কেমন যেন লজ্জা পেয়ে গেলেন, লাজুক-লাজুক মুখে বললেন, “নাহ্।”

“দেখেন চেষ্টা করে।” সুমি হাল ছাড়ল না, বলল, “বুবুন যে-সময় পিছনটা উঁচু করে বলত বুঁদ বুদ বুঁদ তখন কাছে আরেকজন সুন্দর মহিলা থাকত না? সিনেমার নায়িকার মতো সুন্দর?”

আব্বা আবার খানিকক্ষণ চিন্তা করে চিন্তিত মুখে বললেন, “নাহ্।”

“এটা হতেই পারে না।” সুমি এবারে কেমন যেন রেগে গেল, “চাচা এটা হতেই পারে না। এরকম সুন্দর একজন মানুষের কথা কেমন করে ভুলে গেলেন! নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে। আছে না?”

আব্বাকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখা গেল, মাথা চুলকে মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন, সুমি আবার কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল বুবুন তাকে থামাল। বলল, “সুমি, আব্বার ব্রেনে অপারেশন করেছিল সেজন্যে মনে নাই। এখন তো আর জোর করে মনে করানো যাবে না।”

“তা-ই বলে চাচির মতো সুন্দর একজন মানুষকে কি কেউ ভুলতে পারে? সেটাও কি সম্ভব?” সুমি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই মনে পড়বে। এমনি যদি মনে না পড়ে তা হলে সাহায্য করতে হবে।”

“কীভাবে সাহায্য করবি?”

“জানি না। দেখি চিন্তা করে।”

বিকালবেলা যখন সব বাচ্চারা মাঠে হৈচৈ করে খেলছে তখন বুবুন তার আব্বাকে নিয়ে বাইরে এল। আব্বা হাত পকেটে ঢুকিয়ে মাথাটা একটু নিচু করে কেমন যেন একটু বিচিত্র ভঙ্গি করে খুব মনোযোগ দিয়ে বাচ্চাদের খেলা দেখতে লাগলেন। বাচ্চারা অবশ্য কিছুক্ষণের মাঝেই খেলা বন্ধ করে বুবুনের আব্বাকে দেখতে চলে এল। এর মাঝেই চারিদিকে খবর ছড়িয়ে পড়েছে বুবুনের আব্বা মানুষটা বড় হলেও আসলে একেবারে বাচ্চাদের মতো। এতজন বাচ্চাকাচ্চা যে আব্বাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখছে সেজন্যে আব্বাকে মোটেও অপ্রস্তুত মনে হল না, বরং আব্বাকে কেমন জানি খুশি-খুশি দেখাতে লাগল। নিজের থেকেই জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা সবাই এখানে থাক?”

বাচ্চারা মাথা নাড়ল। আব্বারও মাথা নেড়ে বললেন, “বিকালে খেলাধুলা করতে হয়। তা হলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে।”

ছোট একটা বাচ্চা জিজ্ঞেস করল, “আপনি আমাদের সাথে খেলবেন?”

আব্বা সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলেন। সবাই মিলে কিং-কুইন খেলছিল, তারা আব্বাকে টেনে মাঠে নিয়ে গেল। খেলার নিয়ম-কানুন বুঝিয়ে দেওয়া হল এবং আব্বাকে নিয়ে খেলা শুরু হল। কিছুক্ষণের মাঝেই অবিশ্যি দেখা গেল আব্বা যত উৎসাহ নিয়ে খেলতে নেমেছেন তত উৎসাহ নিয়ে খেলতে পারেন না। বলটা ধরতে সমস্যা হয়, ধরার পরেও কার দিকে ছুঁড়ে মারতে হয় সেটা নিয়েও কিছুতেই মনস্থির করতে পারেন না। কোনোভাবে যদি মনস্থির করেও ফেলেন তার পরেও বলটা ছুঁড়তে চান না পাছে কেউ ব্যথা পেয়ে যায়।

খেলার অবস্থা দেখে গাম্বু বলল, “এর থেকে চল চাচাকে নিয়ে টিলা বেড়িয়ে আসি।”

সাথে সাথে সবাই রাজি হয়ে গেল এবং আব্বাকে নিয়ে সবাই টিলার দিকে রওনা দিল। পিছনের ভোলা মাঠ নিচু জায়গায় জমে-থাকা পানি, ঝোঁপঝাড় এবং টিলা, টিলার পিছনে ছোট নদী–সবকিছু দেখে আব্বা কেমন জানি ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে উঠলেন। ফিরে আসার সময় গাঙ্কু বলল, “চাচা আপনি কি শিয়াল চেনেন?”

“শিয়াল?”

“হ্যাঁ, ঐ যে হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া করে ডাকে?”

আব্বা অনেকক্ষণ ভরু কুঁচকে চিন্তা কের বললেন, “না, চিনি না।”

“এই টিলায় শিয়ালের গর্ত আছে। গর্তের মুখে আগুন দিলে শিয়াল বের হয়ে আসে।”

“সত্যি?”

গাব্বু মাথা চুলকে বলল, “আমরা একবার চেষ্টা করেছিলাম, তখন অবিশ্যি বের হয় নাই।”

সুমি বলল, “অনেক বড় আগুন করতে হবে, আমরা আসলে বেশি বড় আগুন করতে পারি নাই।”

আব্বা অবাক-চোখে সুমি এবং গাব্বর চোখে তাকিয়ে রইলেন। পিয়াল বলল, “আপনি দেখবেন চাচা?”

আব্বা উৎসাহে মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ, দেখব। দেখাও।”

সুমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আজকে তো প্রায় অন্ধকার হয়ে আসছে। আজকে হবে না, কালকে দেখাব।”

আব্বার মুখ দেখে মনে হল ব্যাপারটা আজকেই দেখা যাবে না বলে তার বেশ মন খারাপ হয়ে গেল।

সন্ধ্যেবেলা বাসায় ফেরার সময় বুবুন বলল, “আব্বা!”

“কী হল?”

আমরা যে কালকে শেয়াল দেখতে যাব সেই কথাটা তুমি কিন্তু আম্মাকে বলো না। ঠিক আছে?”

আব্বা মাথা নেড়ে বললেন, “বলব না।” একটু থেমে বললেন, “আমি তো তোমার আম্মার সাথে এমনিতেও কথা বলি না।”

বুবুন জিজ্ঞেস করল, “কেন বল না আব্বা?”

“চিনি না তো তাই।”

.

পরদিন বিকেলে যখন দলটি শেয়াল দেখতে বের হল তখন তাদের সাথে অনেক রকম জোগাড়যন্ত্র নেওয়া হয়েছে। কয়েকজনের হাতে খবরের কাগজের বাণ্ডিল, একজনের হাতে কেরোসিনের বোতল এবং ম্যাচ, গর্তের মুখে শব্দ করার জন্যে কয়েকটা খালি টিন এবং লাঠি। দূর থেকে তাদের দেখে মনে হল একটা অভিযাত্রীর দল।

দলটা ডোবার পাশে দিয়ে হেঁটে যখন টিলার উপরে উঠতে শুরু করল তখন আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আরও কিছু গ্রামের বাচ্চাকাচ্চা তাদের সাথে যোগ দিল। শুধু তাই নয়, এক-দুইজন বয়স্ক মানুষও কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে এল। এর আগে যতবার তারা কোথাও দল বেঁধে গিয়েছে বয়স্ক মানুষেরা খুব সন্দেহের চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থেকেছে, কিন্তু এখন সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। তাদের সাথে আব্বাও আছেন কাজেই সবাই ধরে নিল তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে যাচ্ছে।

মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ আব্বাকে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় চলেছেন সবাইকে নিয়ে?”

আব্বা কিছু বলার আগেই গাব্বু বলল, “শেয়াল দেখতে।”

মানুষটা খুব অবাক হয়ে বলল, “শেয়াল দেখতে?”

আব্বা মাথা নাড়লেন। মানুষটা জিজ্ঞেস করল, “কেমন করে শেয়াল দেখা যাবে?”

আব্বা কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই সুমি বলল, “ শেয়ালের গর্তে ধোঁয়া দিয়ে।”

“ধোঁয়া?”

“হ্যাঁ?”

পিয়াল বলল, “সাথে খালি টিন এনেছি, সেটা পিটিয়ে ঢংঢং করে শব্দ করতে হবে।”

“তা হলেই শেয়াল দেখা যাবে?”

আব্বা মাথা নাড়লেন। মধ্যবয়স্ক মানুষটাকে পুরো ব্যাপারে খুব উৎসাহী দেখা গেল, সেও তাদের সাথে চলল। আব্বা যদি সাথে না থাকতেন তা হলে পুরো ব্যাপারটাই অন্যরকম হত, তারা শেয়ালের গর্তের মুখে আগুন দেবে শুনেই সবাই একেবারে হা হা করে উঠে আপত্তি করত। সাথে আব্বা থাকায় আজকে কোনো সমস্যা নেই।

টিলার উপরে উঠে গর্তের সামনে পুরো দলটি দাঁড়াল। মধ্যবয়স্ক মানুটা উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোন গর্তটা?”

সুমি বড়সড় একটা গর্তকে দেখিয়ে দিল। সেই গর্তেই সামনে খবরের কাগজ স্থূপ করে রাখা হল। সেখানে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেবার সময় মানুষটা মাথা নেড়ে বলল, “তা হলে তো খালি আগুন হবে, ‘ধোয়া তো হবে না!”

বুবুন জিজ্ঞেস করল, “ধোয়া কেমন করে হয়?”

“আগুন যখন ঠিক করে জ্বলতে পারে না তখন ধোয়া হয়। মানুষটা আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল, “তা-ই না স্যার?”

আব্বা অনিশ্চিতের মতো মাথা নাড়লেন। লোকটা বলল, “ভালো করে একটা আগুন জ্বালিয়ে তখন সেটাকে ভেজা লতাপাতা দিয়ে চাপা দিতে হবে।” তারপর সে নিজেই গাছের লতাপাতা আধভেজা খড়কুটো খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেল।

কিছুক্ষণের মাঝেই দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে, আগুনের আঁচে কাছে যাওয়া যায় না। তার উপরে গাছের লতাপাতা, আধভেজা খড়কুটো চাপা দেওয়া হল, সত্যি সত্যি তখন সেখান থেকে ধোঁয়া বের হতে থাকে। গাব্বু খালি টিন হাতে নিয়ে সেটাকে পেটাতে শুরু করল, তার দেখাদেখি অন্যেরাও। শব্দে কানের পর্দা প্রায় ফেটে যাবার অবস্থা। মজা দেখার জন্যে আরও মানুষ জড়ো হয়েছে, তারাও যে যেভাবে পারছে শব্দ করছে, আগুনটাকে খুঁচিয়ে দিচ্ছে, লতাপাতা, খড়কুটো এনে আগুনের উপরে দিচ্ছে।

ঠিক তখন একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটল, গর্তের ভিতর থেকে হঠাৎ বিদঘুঁটে কী-একটা জিনিস ছুটে এল, আগুনের কাছে এসে সেটা এক মুহূর্ত থেমে যায় এবং হঠাৎ করে সেই বিদঘুঁটে জন্তুটার সারা শরীরে অসংখ্যা কাটা খাড়া হয়ে যায়। বাচ্চাকাচ্চা যারা ছিল তারা ভয় পেয়ে চিৎকার করতে করতে দৌড়াতে থাকে, বুবুনের মনে হতে থাকে এখন সেটা বুঝি তাদের উপর লাফিয়ে পড়বে। সবাই ভয় পেয়ে ছোটাছুটি করছিল, আব্বা কিন্তু একটুও ভয় না পেয়ে জিনিসটাকে আরও ভালো করে দেখার জন্যে একেবারে কাছে এগিয়ে গেলেন। সেই অদ্ভুত জন্তু আগুনটাকে পাশ কাটিয়ে বাইরে বের হয়ে এল, তারপর ঝমঝম শব্দ করতে করতে টিলা বেয়ে নিচে নেমে গিয়ে গাছ-গাছালির মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সবাই গলা ফাটিয়ে চাচামেচি করছে আব্বা তখন মুখে হাসি ফুটিয়ে চোখ বড় বড় করে বললেন, “কী আশ্চর্য! শজারু! এটা নিশ্চয় শজারু।”

মজা দেখার জন্য যারা হাজির হয়েছিল তাদের মাঝেও একজন মাথা নেড়ে বলল যে এটা নিশ্চয় শজারুই হবে। শজারুর গায়ে নাকি এরকম কাঁটা থাকে এবং ভয় পেলে তাদের কাঁটাগুলো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।

পুরো এলাকাটাতে যখন সবকিছু নিয়ে খুব হৈচৈ হচ্ছে তখন বুবুন আব্বাকে জিজ্ঞেস করল, “আব্বা, তুমি আগে কখনো শজারু দেখেছ?”

“নাহ!”

“তা হলে এটা তুমি চিনলে কেমন করে? তুমি না সবকিছু ভুলে গেছ?” আব্বাকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখাল, মাথা চুলকে বললেন, “তা তো জানি না!”

“তার মানে আসলে তোমার সবকিছু মনে আছে, তুমি জান না।”

“আমি জানি না?”

“না। চেষ্টা করলে আবার তোমার মনে পড়ে যাবে।”

শেয়াল দেখার চেষ্টা করে যে-দলটা শজারু দেখে ফেলেছে তারা আবার দল বেঁধে ফিরে আসতে থাকে। পিছন দিকে বুবুন, সুমি, পিয়াল এবং গাব্ব। আব্বা কেমন হঠাৎ করে শজারু চিনে ফেলেছেন সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সুমি বলল, “তার মানে যদি চাচাকে হঠাৎ করে কোনোকিছু দিয়ে চমকে দেওয়া যায় তা হলে আবার সবকিছু মনে পড়ে যাবে।”

গাব্বু জিজ্ঞেস করল, “তুই কেমন করে জানিস?”

“আমি একটা উপন্যাসে পড়েছি। নায়িকা সবকিছু ভুলে গিয়েছিল, তখন নায়ক এসে–”

সুমিকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে গাঙ্কু বলল, “আমি একটা উপন্যাস পড়েছি সেখানে নায়ক ব্যাঙ হয়ে গেছে। নায়িকা এসে সেই ব্যাঙকে চুমো দিয়েছে–”

সুমি রেগে গাব্বুর পেটে একটা ঘুসি মারার চেষ্টা করল, কিন্তু গাব্বু সাবধান ছিল বলে সময়মতো লাফিয়ে সরে গেল।

বুবুন বলল, “তোমরা মারপিট করছ কেন? নিজেরাই তো দেখতে পেলে হঠাৎ করে আব্বার শজারুর কথা মনে পড়ে গেল। যদি শজারুর কথা মনে পড়ে যায় তা হলে অন্যকিছু মনে পড়তে অসুবিধে কী আছে?”

পিয়াল মাথা নাড়ল, “নাই। কোনো অসুবিধা নাই। শুধু চমকে দিতে হবে।”

সুমি চিন্তিত মুখে বলল, “কী দিয়ে চমকে দেওয়া যায়?”

গাব্বু বলল, “একটা সাপ ধরে এনে ছেড়ে দিলে কেমন হয়?

“ধুর গাধা! সাপ ব্যাঙ শজারু এইসব চিনিয়ে কী হবে! যদি চাচিকে চেনানো যেত তা হলে লাভ হত।”

“যদি মনে কর আমরা একটা নাটকের মতো করি। চাচিকে আগে থেকে রাজী করালাম। একটা ডাকাত এসে গুলি করল, চাচি গুলি খেয়ে পড়ে গেলেন–”

বুবুন মাথা নাড়ল, বলল, “আম্মা কোনোদিন রাজি হবেন না। আব্বার সামনে একটা নাটকের মতো করা? অসম্ভব!”

পিয়াল পিছিয়ে পড়েছিল, এইবার দুই পা এগিয়ে এসে বলল, “আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।”

“কী আইডিয়া।”

“চাচা তো আসলে সায়েন্টিস্ট। বুবুন তুই বলেছিস না চাচা ফিজিক্সে পিএইচ. ডি. করেছে?”

“হ্যাঁ।”

“সায়েন্টিস্ট মানুষকে চমকে দেওয়া খুব সোজা।”

“কী রকম?”

যদি দেখানো যায় বিজ্ঞানের সূত্র কাজ করছে না তারা চমকে ওঠে?”

বুবুন ভুরু কুঁচকে বলল, “বিজ্ঞানের সূত্র?”

“হ্যাঁ। মনে কর যদি দেখানো যায় আলোর গতি হঠাৎ কমে অর্ধেক হয়ে গেছে কিংবা ইকুয়েল টু এম সি স্কয়ারটা ভুল। কিংবা আর্কিমিডিসের সূত্র ভুল। কিংবা–”

সুমি এবং গাব্বু হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, বুবুন ভদ্রতা করে কিছু বলল না। সুমি দ্রতা নিয়ে মাথা ঘামায় না, সোজাসুজি বলে ফেলল, “পিয়াল, তোর মাথাটা খারাপ।”

“মাথা-খারাপ?” পিয়াল চোখ লাল করে বলল, “কেন বলছিস আমার মাথা খারাপ?

“কেন মাথা-খারাপ সেটা যে বুঝতে পারিস না সেটাই হচ্ছে তার প্রমাণ।”

পিয়াল এবারে রেগে গেল। পিয়াল রেগে গেলে তার কথার মাঝে একটু তোতলামো এসে যায়। তোতলাতে তোতলাতে বলল, “য-য-যদি দেখা যায় মা মা মাধ্যাকর্ষণ কাজ করছে না, বু-বু-বুবুন হঠাৎ হুশ করে আকাশে উঠে গেল–”

“কী বললে? বুবুন চোখ বড় বড় করে বলল, “আমি আকাশে উঠে গেলাম?”

“হ্যাঁ। তা হলে চাচা অবাক হবেন না? চমকে উঠবেন না?”

সুমি এবং গাকেও স্বীকার করতে হল যদি এরকম একটা ব্যাপার ঘটে তা হলে আব্বা রীতিমতো চমকে উঠবেন এবং ভুলে-যাওয়া অনেক কিছু মনে পড়ে যেতে পারে। গাব্বু কানে আঙুল দিয়ে খানিকক্ষণ কান চুলকে বলল, “কিন্তু বুবুনকে হুশ করে আকাশে পাঠাবি কেমন করে? পিঠে রকেট বেঁধে আগুন জ্বালিয়ে দিবি নাকি?”

পিয়াল মাথা চুলকে বলল, “সেটাই চিন্তা করে করতে হবে। সত্যি সত্যি তো আর আকাশে পাঠানো যাবে না, দেখে যেন মনে হয় আকাশে উঠে যাচ্ছে।”

“কিন্তু সেটা করবি কেমন করে?”

পিয়াল আবার মাথা চুলকাল।”দড়ি দিয়ে বেঁধে কপিকল দিয়ে টেনে তোলা যায়। যদি দড়ি রং করে নেওয়া যায় যেন দেখা না যায়।

এরকম সময় আলোচনাটা থামিয়ে দিতে হল, কারণ হাঁটতে হাঁটতে সবাই নিচু জলার মতো জায়গাটায় এসে হাজির হয়েছে এবং ব্যাঙকে চমকে দিলে তারা কীরকম কাণ্ড জ্ঞান হারিয়ে লাফিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে সেটা সবাই আবিষ্কার করে ফেলেছে। আব্বা পিছিয়ে এসে বুবুনদেরকে বললেন, “ব্যাঙেরা খুব জোরে লাফ দেয়।”

বুবুন মাথা নাড়ল। সুমি বলল, “জি চাচা।”

আব্বা খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, “ব্যাঙরা বসে থেকেই লাফ দিতে পারে। দাঁড়াতে হয় না।”

বুবুন একটু অবাক হয়ে আব্বার দিকে তাকাল, ব্যাঙ যে দাঁড়াতে পারে এই জিনিসটাই কখনো তার মনে হয়নি। গাব্বু খানিকক্ষণ আব্বার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হি হি করে হাসতে শুরু করল। আব্বা অবাক হয়ে গাব্বর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “কী হল ছেলে তুমি হাস কেন?”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *