দুপুর থেকে শায়লার মাথার যন্ত্রণা শুরু হল।
চিত্রা বলে গেছে এগারোটার মধ্যে ফিরবে। এখন বলছে এটা দশ। শায়লা অস্থির হয়ে পড়লেন। চিত্রার অনেক বান্ধবীর টেলিফোন নাম্বারই তিনি জানেন। টেলিফোনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। যোগাযোগ করাটা ঠিক হলে কিনা বুঝতে পারছেন না। চিত্রা ঠিকই ফিরে আসলে, মাঝখান থেকে খবর রটবে বিয়ের দিন মেয়ে পালিয়ে গেছে। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা যাক।
ঝামেলা মলিন শুরু হয়। চারদিক বেকে শুরু হয়। উত্তরার বড় আপা আসেন নি। ইসিজি করার পর ডাক্তার তাকে বলেছে কমপ্লিট রেস্টে থাকতে। টেলিফোনেও যেন কারো সঙ্গে কথা না বলেন। তিনি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে তার বাড়িতে শুয়ে আছেন। এই সময় পাশে থাকলে শায়লা তার টেনশানটা ভাগাভাগি করতে পারতেন। তাছাড়া একটা আইটেম তার রান্না করে নিয়ে আসার কথা। সেই আইটেম সম্ভবত আসবে না।
মীরা নিজের ঘরে শুয়ে আছে। কান্নাকাটি করছে। কিছুক্ষণ আগেই মীরার সঙ্গে তিনি রাগারাগি করে এসেছেন। বিছানায় পড়ে কান্নাকাটি করার মতো কোনো ঘটনা ঘটে নি। এইসব নাটকের কোনো মানে হয় না। একটা ছেলে অন্যায় করেছে। শাস্তি পেয়েছে। এখানেই শেষ। শাস্তিটা হয়তো সামান্য বেশি হয়েছে। সেই বেশির দায়িত্বও মীরার না। সে শাস্তি দেয় নি। তাহলে বিছানায় শুয়ে বালিসে মুখ গুঁজে ফোঁপানোর মানে কি? তিনি মীরার ঘরে ঢুকে বলেছেন, মীরা কি হয়েছে?
মীরা ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলেছে কিছু হয় নি।
তুই ফুঁপাচ্ছিস কি জন্যে?
মন খারাপ লাগছে না। খুবই মন কারাপ লাগছে। আমার মন যে কি পরিমাণ খারাপ তুমি বুঝতেই পারবে না।
কেন মন খারাপ হয়েছে? প্রেমিক কানে ধরে উঠ-বোস কছে এই জন্যে?
মা তুমি বুঝবে না।
আমি বুঝব না আর তুই সব বুঝে ফেলছিস? খবর্দার ফুঁপাবি না। উঠে আয়।
না।
না মানে? না মানে কি?
না মানে না। আমি ঘর থেকে কোথাও বের হব না। তুমি আমাকে বিরক্ত করবে না।
শায়লা তখন আর নিজের রাগ সামলাতে পারেন নি। মেয়ের গালে চড় বসিয়ে দিয়েছেন। চড় খুব জোরালো হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে গালে আঙুলের দাগ বসে গেছে। মীরা চুপ করে ছিল। পাথরের মূর্তির মতো বসে মার দিকে তাকিয়েছিল। শায়লার ইচ্ছা করছিল আরেকটা চড় লাগাতে। অনেক কষ্টে নিজের ইচ্ছা দমন করলেন।
এখন শায়লা বারান্দায় বসে আছেন। রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন। দূরে কোনো রিকশা দেখলেই তাকাচ্ছেন। যদি চিত্রাকে দেখা যায়। অন্যদিন একের পর এক রিকশা যায়। আজ তাও যাচ্ছে না। একের পর এক ট্রাক-বাস যাচ্ছে। আচ্ছা চিত্রা কোনো একসিডেন্ট করেনি তো। কোনো ট্রাক হঠাৎ… ছিঃ ছিঃ এইসব কি ভাবছেন?
এত বড় একটা অনুষ্ঠান হবে অথচ বাসায় কেউ নেই। চিত্রার বাবা এক ঘণ্টার ভেতর ফিরবে বলে অফিসে গেছে এখনো ফিরে নি। হয়তো আজো ফিরবে না। রাত দশটার দিকে তাকে দেখা যাবে। বোনের বাসায় গিয়ে ভাত টাত খেয়ে ফিরবে। ততক্ষণে বিয়ে হয়ে গেছে। বরপক্ষের লোকজনের সঙ্গে চিত্রা চলে গেছে।
চিত্রার বাবার বাড়িতে থাকা না থাকা অবশ্যি একই। বাসায় থাকলে ঘরের এক কোনায় ফার্নিচারের মতো পড়ে থাকবে। তবুও তো একটা মানুষ প্রয়োজনে এখানে ওখানে পাঠানো যেত। একশ টাকার কিছু নতুন নোট তার দরকার। মেয়ে শশুর বাড়ি যাচ্ছে মেয়ের হাতে কিছু টাকা দিয়ে দিতে হবে। পুরনো ময়লা নোট না। চকচকে নতুন নোট। ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাংকে গেলে নতুন নোট এখন পাওয়া যাবে না। গুলিস্তানে পুরনো নোট বদলে নতুন নোট দেয়। একশ টাকায় বিশ টাকা বাটা কেটে রাখে। চিত্রার বাবা থাকলে হাজার দুই টাকার নতুন নোট আনানো যেত। মজনু ছেলেটা থাকলেও হত— এইসব কাজে সে খুব পাকা। তার শাস্তিটা না হয় একদিন পরে হত।
মজনুকে নিয়েও তাঁর এখন ভয় লাগছে। যে অপমান তাকে করা হয়েছে এই অপমান ভোলা মুশকিল। কোনো একদিন যদি অপমানের শোধ নেয় তখন কি হবে? দূর থেকে বাড়িতে একটা বোমা মেরে দিল। কিবা এমনও তো হতে পারে— মীরা রিকশা করে যাচ্ছে তার পায়ে এসিড ছুড়ে মারল।
শায়লা বারান্দা থেকে উঠে রান্নাঘরে গেলেন। সব রান্নাবান্না তিনি নিজে করবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। এখন রান্নায় মন বসছে না। জইতরীর মাকে সব বুঝিয়ে এসেছেন। জইতরীর মার দাঁতে ব্যথা শুরু হয়েছে। সে দাঁতের ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতেই রান্না করছে। কি করছে কে জানে। হয়তো লবণের জন্যে কিছু মুখেই দেয়া যাবে না।
শায়লা রান্নাঘরে ঢুকতেই জইতরীর মা বলল, বড় আকা আসছে আমা?
শায়লা কঠিন মুখে বললেন, বড় আপা এসেছে কি আসে নি এটা নিয়ে। তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। তুমি তোমার কাজটা ঠিকমতো কর।
জোহরের অজান হইছে অখনও আফা আসল না। আমার ভালো ঠেকতাছে না আনা।
শায়লা বিরক্ত গলায় বললেন, ও বলেই গেছে দেরি হবে। রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম। কোথাও আটকা পড়ে গেছে।
একটা টেলিফোন করেন আম্মা।
শায়লা বললেন, তোমাকে বুদ্ধি বাতলাতে হবে না। তুমি তোমার কাজ কর। লবণ ঠিকঠাক আছে কি-না এটা দেথ। এতদিনেও তোমার তো লবণের অন্দিাজ হয় না। হয় লবণ বেশি হলে, নয় কম।
শায়লা রান্নাঘর থেকে বের হলেন। চিত্রার একটা মোবাইল টেলিফোন আছে। সরাসরি তার সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা তার মনে হয় নি কেন? এই কাজটা তো তিনি অনেক আগেই করতে পারতেন। তিনি প্রায় ছুটেই টেলিফোনের কাছে গেলেন। অনেক মোবাইল আছে টি এন্ড টির লাইন থেকে কানেকশান যায় না। চিত্রারটাতে যায়। চিত্রার মোবাইল নাম্বার শায়লার মুখস্থ। তারপরেও টেলিফোনের বইটা পাশে নিয়ে বসলেন। হ্যাঁ রিং হচ্ছে। একবার দুবার, তিনবার, চারবার। তারপর হঠাৎ মোবাইল অফ হয়ে গেল। চিত্রা মোবাইল অফ করে দিয়েছে। এর মানে কি? শায়লার সারা শরীর ঝিম ঝিম করছে। তিনি ঘড়ির দিকে তাকালেন দুটা দশ বাজে। একটু আগেই তো ছিল একটা, এত তাড়াতাড়ি দুটা দশ হয়ে গেল কি ভাবে?
মাছের চৌবাচ্চার উপর একটা দাঁড়কাক বসে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাচ্ছে। শুভ কাজে দাঁড়কাক দেখ ভয়ঙ্কর অলক্ষণ।