৬. শাসনকালের প্রথমার্ধ : একটা সাধারণ চিত্র
৬.১ আওরঙ্গজেবের শাসনকালের দুই অর্ধের বৈষম্য
আওরঙ্গজেবের শাসনকাল দুই ভাগে বিভক্ত, যার একেকটার স্থায়িত্ব প্রায় ২৫ বছর করে; প্রথম ভাগটা কাটিয়েছেন তিনি উত্তর ভারতে, আর দ্বিতীয়টা দাক্ষিণাত্যে। এই দুই ভাগের শুরুতে মনোযোগ অবশ্যই ছিল উত্তর ভারতকে ঘিরে, কেবল সম্রাট সেখানে বাস করতেন বলেই নয়, বরং সেখানকার সামরিক আর বেসামরিক উন্নতির ফলে, যখন দক্ষিণ যেন ছিল সুদূর এক অবহেলিত অঞ্চল। শাসনকালের দ্বিতীয়ার্ধে পরিস্থিতি পাল্টে গেল; সাম্রাজ্যের সবকিছু যেন কেন্দ্রীভূত হলো দাক্ষিণাত্যে; সম্রাট, তার দরবার আর পরিবার, সেনাবাহিনীর অধিকাংশ, আর তার সেনা অফিসারেরা বাস করল সেখানে সিকি শতাব্দী, ধীরে ধীরে হিন্দুস্তান ফিরে পেল একটা মাধ্যমিক গুরুত্ব। সেনাপতি আর সেপাইরা দাক্ষিণাত্যের বাধ্যতামূলক নির্বাসনে থাকতে থাকতে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল তাদের বাড়ির কথা মনে করে; স্বদেশ-কাতর এক সভাসদ সম্রাটকে এক লাখ টাকা দিতে চাইল দিল্লিতে গিয়ে মাত্র একটা বছর কাটিয়ে আসার জন্য; রাজপুত সেপাইরা অভিযোগ করল যে বাড়ি আর পরিবার ছেড়ে দাক্ষিণাত্যে থাকতে থাকতে তাদের বংশ প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে। এই সময়ে, প্রভু আর দক্ষ অফিসারদের মনোযোগ বঞ্চিত হয়ে স্বাভাবিকভাবেই উত্তর ভারতের প্রশাসন ভেঙে পড়েছিল; সাধারণ মানুষ আরও গরিব হয়েছিল; উচ্চ শ্ৰেণীরা হারিয়েছিল নৈতিকতা, বুদ্ধিমত্তা আর স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা: শেষমেশ বেশির ভাগ অঞ্চলেই ছিল না আইনের অনুশাসন।
শাসনকালের প্রথমার্ধে ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হয়েছে উত্তর ভারতের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। এই সময় মোগল সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়েছে সর্ব পশ্চিমের কাবুল থেকে ভারতের সর্ব পুবের নামরূপ পাহাড়শ্রেণী পর্যন্ত, তিব্বত পেরিয়ে সর্ব উত্তর সীমানার বিজাপুর পর্যন্ত। ছোট ছোট অনেক অভিযান চালানো হয়েছে সুদূরের বিচ্ছিন্ন জেলাগুলোর আইনভঙ্গকারী চাষি আর গোত্রপ্রধানদের বিরুদ্ধে। এই সময় সম্রাটের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা চরমে ওঠে।
শাসনকালের দ্বিতীয় বছরের শুরুতে (শুরু হয়েছিল ১৩ মে, ১৬৫৯) তাঁর জাঁকজমকপূর্ণ সাম্রাজ্যাভিষেকের পর, আওরঙ্গজেব প্রায় সব সময় দিল্লিতেই বসবাস করতে লাগলেন, রাজধানী থেকেই করলেন রাষ্ট্র পরিচালনা । রাজধানীতেই তিনি গ্রহণ করলেন (১৬৬১-৬৭) বহির্জগতের মুসলমান কূটনীতিকবৃন্দের শুভেচ্ছা। বিদেশি এই সব অতিথির সামনে তিনি করলেন তাঁর ঐশ্বর্য আর ক্ষমতার প্রদর্শনী, যা এমনকি চোখ ধাঁধিয়ে দিল ভার্সাইয়ের জাঁকজমক দেখে অভ্যস্ত মানুষেরও।’ শাসনকালের পঞ্চম বছরে আওরঙ্গজেব ১৬৬২ সালের ৮ ডিসেম্বর দিল্লি ছেড়ে কাশ্মিরে গেলেন, আর সেখান থেকে আবার রাজধানীতে ফিরলেন ১৬৬৪ সালের ১৮ জানুয়ারি। ১৬৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে পিতার মৃত্যুতে তাঁকে যেতে হলো আগ্রা। শাহজাহান যত দিন বন্দী ছিলেন, আওরঙ্গজেব দিল্লির দরবারে নিয়মিত বসলেও কখনোই আগ্রা যাননি।
১৬৭৪ সালে আফ্রিদি বিদ্রোহের ফলে সেনা অভিযান পরিচালনা করতে গেলেন তিনি পেশোয়ারের কাছের হাসান আবদালে। সেখানে ১৬৭৪ সালের ২৬ জুন থেকে ১৬৭৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত কাটিয়ে, দিল্লি ফিরলেন ১৬৭৬ সালের ২৭ মার্চ। ১৬৭৯ সালের প্রথম দিকে মহারাজা যশোবন্ত সিংহের মৃত্যুতে যোধপুরকে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ দেখে গেলেন তিনি আজমীরে। পরবর্তী দুই বছর কাটল তাঁর রাজপুতানায়, আর শাসনকালের পঁচিশতম বছরের শুরুতে রওনা দিলেন তিনি দাক্ষিণাত্যে, যেখানে নিঃশেষ হলো তার জীবন আর সাম্রাজ্য, ২৫ বছরের এক কঠোর পরিশ্রমী অথচ অফলপ্রসূ শাসনকালের পর।
আওরঙ্গজেব প্রথম সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন ১০৬৮ হিজরি সালের ১ জিলকদ (২১ জুলাই, ১৬৫৮); কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় বা জাঁকজমকপূর্ণ সাম্রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১০৬৯ হিজরি সালের ২৪ রমজান (৫ জুন, ১৬৫৯)। দ্বিতীয় বছরে আদেশ দেওয়া হয়েছিল যে সরকারি নথিপত্রে শাসনকালের প্রত্যেক বছরের গণনা শুরু হবে ১ রমজান থেকে।
কিন্তু দেখা গেল, রমজান মাসে ভোজ বা আনন্দ উৎসবের আয়োজন করার। বড়ই অসুবিধা, ফলে চতুর্থ থেকে পরবর্তী বছরগুলোতে সম্রাট সিংহাসনে বসতে লাগলেন রমজান মাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের দিন (মাঝেসাঝে ঈদের পরদিন) থেকে। আর, সেদিন থেকেই চলত ১০ দিনব্যাপী উৎসব । একুশতম বছরে (১৬৭৭) উত্সব, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক তাঁকে উপহার দেওয়া, সাম্রাজ্যাভিষেক বার্ষিকীতে দরবারে যাবতীয় ধরনের প্রদর্শনী বাতিল করে দিলেন সম্রাট।
৬.২ আওরঙ্গজেবের অসুস্থতা ১৬৬২
শাসনকালের পঞ্চম বছরের প্রথম দিকে আওরঙ্গজেব মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কাজ করার জেদ আর ধর্মীয় নিয়মকানুন পালনের কঠোরতার ফলে অসুখ আরও বাড়ল। রমজান মাসের দিনগুলো (১০ এপ্রিল-৯ মে, ১৬৬২) ছিল অত্যধিক গরম আর লম্বা। মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম, ঘুমের অভাব আর দিল্লির গনগনে রোদে সারা দিনের রোজাজনিত অনাহার তাকে ভীষণ দুর্বল করে ফেলল। ১২ মে তাঁর হলো জ্বর; ডাক্তারদের অতিরিক্ত রক্তমোক্ষণে সম্রাট এতটাই দুর্বল হয়ে পড়লেন যে এই সংজ্ঞা হারাচ্ছেন তো এই তাঁর মুখ হয়ে যাচ্ছে মৃতের মতো সাদা। প্রাসাদ আর রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়ল দুশ্চিন্তার ছায়া, ওদিকে সিংহাসন লাভের আশায় মাথা চাড়া দিতে লাগলেন তাঁর পুত্রগণ ।
পাঁচ দিন পর্যন্ত অসুখের কোনো উপশম হলো না। কিন্তু আওরঙ্গজেবের মানসিক শক্তি ছিল এতই বেশি যে সেই সন্ধেবেলা আর পরদিন একটা লাঠিতে ভর করে গিয়ে তিনি জনসাধারণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন, নিলেন রাজকীয় মানের উপহার। অসুখ রইল আরও এক মাস, তবে আশঙ্কা কেটে গিয়েছিল। দুই শুক্রবার, ২৩ আর ৩০ তারিখ, সবার সঙ্গে নামাজ পড়তে একটা ডুলিতে উঠে গেলেন তিনি জামে মসজিদে। তাঁর পূর্ণ সুস্থতা উদযাপিত হলো ২৪ জুন। অসুস্থতার এই দেড় মাস জুড়ে সাম্রাজ্যময় বিরাজ করা সম্পূর্ণ শান্তি আওরঙ্গজেবের শক্তিমান চরিত্রের এক অসামান্য উদাহরণ। বার্নিয়ার বর্ণনা। দিয়েছেন, অসুস্থতার সময় আওরঙ্গজেবের বীরত্বপূর্ণ সহিষ্ণুতার কথা শুনে দানিশমন্দ খান বলে উঠেছিলেন, কী মানসিক শক্তি! কী অপরাজেয় সাহস! আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করুন, আওরঙ্গজেব, আরও বড় বড় সাফল্যের জন্য! আপনার মৃত্যুর সময় এখনো আসেনি?’
আরোগ্যের পর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য তাঁকে কাশ্মির যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলো। তখন কাশ্মির পরিচিত ছিল ভূস্বর্গ’ নামে। ১৬৬৩ সালের মে মাসের শুরুতে লাহোর থেকে যাত্রা করে কাশ্মির উপত্যকায় প্রবেশ করলেন তিনি ভিম্বরের পীর পাঞ্জাল গিরিপথের ভেতর দিয়ে। শ্রীনগরে খুবই শান্তির আড়াইটা মাস কাটানোর পর ফিরতি যাত্রায় লাহোর এলেন সম্রাট ১৬৬৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, আর দিল্লিতে পরবর্তী বছরের ১৮ জানুয়ারি ।
দিল্লি বসবাসের সেই প্রথম বছরগুলোতে, যখন সীমান্তগুলো ছেয়ে যায়নি অশান্তির মেঘে, আওরঙ্গজেব প্রায় রাজধানীর আশপাশে কিংবা দোয়াবে যেতেন শিকারের আনন্দ পেতে, যদিও বৃদ্ধ বয়সে শিকারকে দোষারোপ করেছেন তিনি ‘অলসদের (বেকার) কাজ’ বলে।
৬.৩ বিভিন্ন প্রদেশে অরাজক বিদ্রোহ
আওরঙ্গজেবের শাসনকালের প্রথম সিকি শতাব্দীতে সাম্রাজ্যের সীমান্ত এলাকায় অনেক ছোটখাটো বিজয় অর্জিত হয়েছে। যেমন, পালামৌ, আসাম, কুচবিহার, ইদর, চাটগাঁ, আর তিব্বত বিজয় (এই তিব্বত অবশ্যই লাদাখ বা ছোট তিব্বত)।
আওরঙ্গজেবের শাসনকালের অভ্যন্তরীণ অশান্তি ছিল তিন শ্রেণীর: (ক) উত্তরাধিকার নিয়ে শাহজাদাদের কলহের ফলে সৃষ্ট অবশ্যম্ভাবী পরিস্থিতি, যখন অচল বেসামরিক কর্তৃপক্ষ লুণ্ঠনকারী আর উচ্চাভিলাষী গোত্রপ্রধানদের নির্ভয়ে তাদের আখের গুছিয়ে নিতে প্রলুব্ধ করেছিল। (খ) মন্দির ধ্বংসের বিরুদ্ধে হিন্দুদের বিদ্রোহ, যে-মন্দির ধ্বংসের ঘটনা শাসনকালের দ্বাদশ বছরে সাম্রাজ্য
জুড়েই বিস্তার লাভ করেছিল । (গ) সামন্ত শাহজাদাদের বিদ্রোহ।
আওরঙ্গজেবের গোঁড়ামির প্ররোচনায় হিন্দু বিদ্রোহ, আর শিখদের সঙ্গে তাঁর আচরণ নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করা হবে পরবর্তী কোনো একটা অধ্যায়ে।
বিখ্যাত মানুষদের জাল করার ফলেও অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে। ১৬৬৩ সালের আগস্টে গুজরাটে দেখা গেছে জাল দারা শুকো, ১৬৬৯ সালের মে মাসে মোরাং পাহাড়শ্রেণীতে (কুচবিহারের পশ্চিমে) জাল সুজা, ১৬৭৪ সালে ইউসুফ জাঈয়ের দেশে দ্বিতীয় আরেক জাল সুজা, এমনকি কামরাজে (কাশির) তৃতীয় আরেকটা সুজা ১৭০৭ সালে; এলাহাবাদে জাল বুলন্দ আখতার (সুজার দ্বিতীয় পুত্র) ১৬৯৯ সালের জুলাইয়ে, আর ওই একই বছরের মার্চে দাক্ষিণাত্যে জাল শাহজাদা আকবর।
বিকানিরের ভুর্তিয়া গোত্রের প্রধান রাও করন ছিল শাহজাহানের শাসনকালের শেষ বছরে দাক্ষিণাত্যের মোগল সেনাবাহিনীতে, কিন্তু দারার প্ররোচনায় আওরঙ্গজেবের অনুমতি ছাড়াই ফিরে এসেছিল উত্তর ভারতে। নতুন সম্রাটের সঙ্গে নিয়মমাফিক সাক্ষাতের ধারও সে ধারল না। সুতরাং ১৬৬০ সালের আগস্টে আমির খানের নেতৃত্বে তার বিরুদ্ধে আওরঙ্গজেব পাঠালেন ৯,০০০ সেনার একটা শক্তিশালী বাহিনী। বশ্যতা স্বীকার করে সম্রাটের কাছে ক্ষমা নিল রাও করন (২৭ নভেম্বর)।
পরবর্তী যে-অরাজক রাজা আওরঙ্গজেবের কঠোরতা আঁচ করেছিল, তার নাম চম্পত রাই বুন্দেলা। ১৬৩৫ সালের যুদ্ধের পর বীর সিংহ দেবকে অধিকারচ্যুত করে উর্ঘার সিংহাসনে বসানো হয়েছিল তার বড় ভাইয়ের এক বংশধর দেবী সিংহকে। কিন্তু বীর সিংহের ছোট চাচার বংশধরেরা শাসন করেছিল পূর্ব বুন্দেলখণ্ডের মাহেওয়া। তাদেরই নেতা ছিল চম্পত রাই। যশোবন্তের সঙ্গে জয়লাভের পর আওরঙ্গজেব উজ্জয়িনী আসতে তাঁর সঙ্গে যোগ দিল চম্পত রাই। কিন্তু সুজা খাজওয়ার দিকে অগ্রসর হতেই চম্পত পালিয়ে নিজের দেশে ফিরে গেল। তখন ১৬৫৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহীর বিরুদ্ধে সম্রাট একটা সেনাবাহিনী পাঠালেন শুভকরন বুন্দেলা এবং অন্য রাজপুত সেনা কর্মকর্তাদের অধীনে। তাদের সহায়তা করল রাজা দেবী সিংহ বুন্দেলার অধীন একটা সেনাদল, জায়গিরদারেরা, আর মালওয়ার স্থানীয় সেনা। সবাই বিরুদ্ধে চলে যাওয়ায় চম্পত পালিয়ে বেড়াতে লাগল এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়, আর তার পিছু পিছু ছুটল সম্রাট-বাহিনী।
১৬৬১ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি, পালানো যখন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠল, ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করল চম্পত রাই, আর ওই একই পথ ধরল তার সারা জীবনের সঙ্গিনী, রানি কলি কুমারী। কিন্তু বেঁচে রইল চম্পতের পুত্র ছত্র শাল, যে দীর্ঘদিন যাবৎ মোগলদের ঝামেলা সৃষ্টির পর শেষমেশ নিজ একটা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করল পূর্ব বুন্দেলখণ্ডের পান্নায়।
৬.৪ পালামৌ বিজয়
পালামৌ জেলার অবস্থান বিহারের দক্ষিণ সীমান্তে, যার দক্ষিণ-পুবে ছোট নাগপুর আর দক্ষিণ-পশ্চিমে মধ্য প্রদেশ। এটা একটা বুনো দেশ, এখানে-সেখানে মাথা উঁচিয়ে আছে এবড়োখেবড়ো পাহাড়; বর্ষার পানিতে সৃষ্ট নৌচলাচলের অযোগ্য নদী চাষের উপযুক্ত পানি সরবরাহ করতে পারে না। জেলাটার দক্ষিণ অংশ পুরোপুরিই পাহাড়ে, জঙ্গুলে আর ঊষর; উত্তর অংশের উপত্যকাগুলো অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত আর উর্বরা; কিন্তু জেলাটার কোথাও পাহাড়ের চুড়ো থেকেও ছয়-সাত মাইলের বেশি চোখে পড়ে না। সমভূমি বলতে এখানে কিছু নেই, চারপাশে কেবল পাহাড়ের জটলা, যেগুলোর প্রায় সবই ঘন জঙ্গলে ঢাকা। পাহাড়ের চুড়া থেকে দেখলে মনে হয়, জেলাটা যেন ঢেউখেলানো নিচু জঙ্গলে মোড়া, এখানে সেখানে লাল টালির দু-একটা হাদ, গাছের কুঞ্জ, আর গবাদিপশু ছাড়া জনবসতির কোনো চিহ্ন নেই। জনসংখ্যা এখানে খুবই কম, বাস করে তারা পাহাড়ের খাঁজে বসানো ছোট ঘোঁট আর বিক্ষিপ্ত সব গ্রামে।
সপ্তদশ আর অষ্টাদশ শতাব্দীতে জেলার বেশির ভাগ অধিবাসীই ছিল চিররা গোত্রের, যারা নাকি দ্রাবিড়দের রাজতন্ত উপজাতির একটা শাখা। ১৬৪৩ সালে রাজা প্রতাপ চিরোর পারিবারিক কলহের সুযোগে মোগলেরা তাকে নামিয়ে দিল মনসবদারির পদে, আর তার পূর্বপুরুষের রাজ্যকে পরিণত করল একটা করদ রাজ্যে, যার বার্ষিক কর ধার্য হলো এক লাখ টাকা। এত টাকা নিয়মিতভাবে দেওয়া ছিল রাজার সাধ্যের বাইরে, ফলে কর বকেয়া পড়তে লাগল।
১৬৬১ সালের এপ্রিলে, সম্রাটের আদেশে পালামৌ আক্রমণ করল বিহারের সুবাদার দাউদ খান। সহজেই দখল করল সে কুথি, কুন্দ, আর দেওগান দুর্গ, আর জঙ্গল কেটে পথ করে এগোল রাজধানীর দিকে। ৭ ডিসেম্বর আক্রমণ চালাল সে পালামৌয়ের ২ মাইল সামনের শত্রুদের পরিখায়, তিন দিন তুমুল যুদ্ধের পর পালিয়ে গেল চিরো সেনাবাহিনী। বাকি ২ মাইল জঙ্গল অতি কষ্টে কেটে পথ করে ১৩ তারিখে মোগলেরা আক্রমণ করল রাজার পরিখা। ছয় ঘণ্টা যুদ্ধের পর পালিয়ে গেল শক্র। পালামৌকে সংযুক্ত করা হলো বিহার সুবার সঙ্গে।
১৬৬২ সালে, কাথিয়াড়ের উত্তর-পশ্চিমের হালার রাষ্ট্রের রাজধানী নওয়ানগরের উত্তরাধিকারের কলহের সূত্রেও হস্তক্ষেপ করল মোগলেরা। জুনাগড়ের ফৌজদার ভীষণ এক যুদ্ধের (১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৬৬৩) পর বলপূর্বক দখলকারীকে হত্যা করে, সিংহাসনে বসাল বৈধ উত্তরাধিকারীকে। সম্রাট-বাহিনীর ৬১১জন হতাহত হলো এখানে। কিন্তু এই উপদ্বীপটার বিবাদ অবসান হলো না দীর্ঘ দিন।
১৬৬৪ সালে দারভাঙ্গা আর গোরখপুর থেকে দুটো নৌবাহিনী পাঠানো হলো কুচবিহারের পশ্চিম আর পূর্নিয়া জেলার উত্তরের একটা পাহাড়ে দেশ মোরাংয়ের বিদ্রোহী রাজাকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে। কুমায়ুন পর্বতমালার রাজা বাহাদুর চাঁদের বিপক্ষেও শাস্তিমূলক একটা অভিযান চালানো হলো ১৬৬৫ সালে। দীর্ঘ প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর, ১৬৭৩ সালে সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করল রাজা।
৬.৫ সম্রাটের ইসলামি অধ্যাদেশসমূহ
দ্বিতীয় সিংহাসনারোহণের পরপরই আওরঙ্গজেব গ্রহণ করলেন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দুটো পদক্ষেপ। সিংহাসনের জন্য লড়াইয়ের সময় উত্তর ভারতের অনেক জায়গায় অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল, আর শস্য বিক্রি হচ্ছিল দুর্ভিক্ষকালীন মূল্যে। এই অমঙ্গল বৃদ্ধি পেয়েছিল দেশের ভেতর দিয়ে পণ্যদ্রব্য চলাচলের ওপর কর ধার্য করে; প্রত্যেকটা অগভীর নদী, খেয়া পারাপার, গিরিপথ বা প্রাদেশিক সীমান্তে রাহদারি বা উপশুল্ক নেওয়া হতো পণ্যদ্রব্যের মূল্যের এক-দশমাংশ। আগ্রা, দিল্লি, লাহোর আর বুরহানপুরের মতো বড় বড় শহরে, বিক্রির জন্য বাইরে থেকে আনা যাবতীয় খাবার আর পানীয়ের ওপর আরোপ করা হতো পাণ্ডারি নামের এক শুল্ক । রাজ্যগুলোতে রাহদারি আর পাণ্ডারি উভয়ই বাতিল করে দিলেন আওরঙ্গজেব, এবং জায়গিরদার আর জমিদারদের অনুরোধ করলেন, যেন তারাও এই কাজ করে তাদের তালুক বা জমিদারিতে। তা-ই করা হলো, আর তারপর অভাব আছে এমন প্রত্যেকটা জায়গায় শস্য গেল অবাধভাবে, ফলে শস্যের মূল্য বেশ পড়ে গেল। অনেক ছোটখাটো আর জ্বালাতনকর উপকর (আবওয়াব) বাতিল করলেন আওরঙ্গজেব ১৬৭৩ সালে। [আমার ‘মোগল প্রশাসন’ বইয়ের ৫ম অধ্যায় দেখুন । তামাকের ওপর দ্বারাদেয় শুল্ক (Octroi) বাতিল করা হলো ১৬৬৬ সালে।
আওরঙ্গজেব সিংহাসন দাবি করেছিলেন দারা শুকোর ধর্মহীনতার বিরুদ্ধে নিজে একজন খাঁটি মুসলমান হিসেবে। দ্বিতীয় সাম্রাজ্যাভিষেকের (জুন, ১৬৫৯) পরপরই ইসলামের গোড়া আদর্শ সমুন্নত রাখতে আর জনসাধারণের জীবন কুরআনের আদর্শে যাপন করাতে তিনি জারি করলেন নিম্নলিখিত অধ্যাদেশগুলো :
(১) তাঁর পূর্ববর্তী মোগল সম্রাটগণ তাঁদের নিজ নিজ মুদ্রার ওপর মুদ্রিত করতেন ইসলামের ধর্ম বিশ্বাসের স্বীকারোক্তি (কলেমা)। আওরঙ্গজেব তা নিষিদ্ধ করলেন।
(২) পারস্যের পুরনো রাজাদের অনুসরণে সেই দেশের পরবর্তী মুসলমান। শাসক এবং ভারতের মোগল সম্রাটগণ পালন করতেন নববর্ষের (নওরোজ) আনন্দোৎসব। আওরঙ্গজেব তা নিষিদ্ধ করলেন।
(৩) বিধিনিষেধ আরোপ করলেন তিনি নৈতিকতার (মুহতাসিব) ওপর, যেন মানুষ মহানবীর (মুহম্মদ) গ্রহণীয় জীবন পদ্ধতি গ্রহণ করে এবং তাঁর বর্জনীয় অভ্যাসগুলোকে বর্জন করে; যেমন, চোলাই করা স্পিরিট, গাঁজানো বিয়ার, ভাং এবং অন্যান্য তরল মাদকদ্রব্য পান, জুয়াখেলা, যৌনতার বেসাতি। আফিম আর গাঁজা নিষিদ্ধ করা হয়নি। শাস্তির ব্যবস্থা করলেন তিনি ধর্মবিরোধী মতপ্রকাশ, আল্লাহর নিন্দা, মুসলমানদের নামাজ আর রোজা বর্জনের জন্য।
(৪) ১৬৫৯ সালের ১৩ মে সমস্ত প্রদেশে একটা বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে তিনি ভাং চাষ নিষিদ্ধ করলেন।
(৫) পুরনো, এমনকি প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া সমস্ত মসজিদ মেরামত করে সেগুলোতে ইমাম, মুয়াজ্জিন, খতিব আর পরিচারকদের নিয়োগ দিলেন তিনি নিয়মিত বেতনের ভিত্তিতে।
(৬) শাসনকালের একাদশ বছরের শুরুতে, নিষিদ্ধ করলেন তিনি তার সামনে দরবারের সংগীতজ্ঞদের সংগীত পরিবেশন। ধীরে ধীরে দরবারে সংগীত পুরোপুরি নিষিদ্ধ হয়ে গেল।
সংগীতজ্ঞদের পুত্রেরা এক হাস্যরসের ঘটনা ঘটিয়ে তাদের মুকুট পরিহিত শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিল। এক শুক্রবার আওরঙ্গজেবের মসজিদে যাওয়ার সময় সমবেত হলো দিল্লির হাজার খানেক সংগীতজ্ঞ। সঙ্গে তাদের বিশটারও বেশি শবযান, সবাই গলা ছেড়ে বিলাপ করছে। একসঙ্গে এতজনকে কান্নাকাটি করতে দেখে অনুচর পাঠিয়ে আওরঙ্গজেব জানতে চাইলেন এই মহাশোকের। কারণ। ফোঁপাতে ফোঁপাতে সংগীতজ্ঞরা জবাব দিল যে সম্রাটের আদেশে সংগীত নিহত হয়েছে, আর তাই তারা সংগীতকে নিয়ে যাচ্ছে কবর দিতে । ঘটনা শুনে কঠোর মুখে সম্রাট মন্তব্য করলেন যে কবরটা যেন তারা ভালোভাবে দেয়।
(৭) সম্রাটের জন্মদিনে তার ওজনের সমান সোনা আর রুপা দেওয়ার উৎসব আওরঙ্গজেব বন্ধ করে দিলেন।
(৮) ১৬৬৮ সালে আগ্রা দুর্গের হাতিপুল ফটকের দুই পাশে বসানো জাহাঙ্গীরের দুটো পাথরের হাতি সম্রাটের নির্দেশে সরিয়ে ফেলা হলো।
(৯) ১৬৭০ সালের এপ্রিল মাসে সভাসদদের আদেশ দেওয়া হলো, এখন থেকে তারা যেন আর হিন্দুদের অনুকরণে মাথার কাছে হাত তুলে পরস্পরকে অভিবাদন না জানায়; বরং গলা চড়িয়ে যেন বলে ‘তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক!’ (সালাম আলেকুম)।
(১০) ১৬৭০ সালের মার্চে তিনি তার জন্মদিনের উৎসব বাতিল করলেন; এখন থেকে সম্রাটের বাদক দল সারা দিনের পরিবর্তে বাজাবে মাত্র তিন ঘণ্টা। শাসনকালের একুশতম বছরের প্রথম দিকে (নভেম্বর, ১৬৭৭) তার সাম্রাজ্যাভিষেক বার্ষিকীর আনন্দোৎসব বাতিল করা হলো।
(১১) রাজাদের অভিষেকের সময় তাদের কপালে স্বহস্তে তিলক পরাতেন পূর্ববর্তী সম্রাটগণ। ১৬৭৯ সালের মে মাসে এই প্রথা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলো ওটা হিন্দুগন্ধী বলে।
(১২) দর্শন প্রথাও নিষিদ্ধ করলেন আওরঙ্গজেব। প্রতিদিন সকালে প্রাসাদের ঝুলবারান্দা থেকে বাইরে সমবেত প্রজাদের অভিবাদন গ্রহণের এই প্রথা চালু করেছেন আকবর, যা মেনে এসেছেন তার উত্তরাধিকারীগণ। দর্শনের এই প্রথাটাও হিন্দুগন্ধী, কারণ দিনের কাজ শুরু করার আগে তারা তাদের গৃহদেবতাকে একনজর দেখে যায়।
(১৩) কবর চুনকাম এবং মেয়েদের কোনো পীর বা আউলিয়ার মাজারে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হলো, যেহেতু এগুলো কুরআনের পরিপন্থী।
কিন্তু এক লাফে তার মানুষকে উন্নীত করার এই চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। প্রশাসনও এসব কার্যকর করায় প্রথম প্রথম হলো ভীষণ কড়া, তারপর শিথিল, অবশেষে হাল ছাড়া। জনসাধারণের ভাবনাকে উন্নীত করাতে না পারলে কেবল আইন প্রণয়নে কোনো কাজ হয় না। মানুচি লিখেছেন, “আওরঙ্গজেবের সিংহাসনারোহণের সময় চোলাই স্পিরিট পান করাটা এতই সাধারণ ঘটনা ছিল যে একদিন সম্রাট আবেগভরে বলে ফেলেন, পুরো হিন্দুস্তানে মাত্র দুজন মানুষই সম্ভবত মদ্যপান করে না। তিনি নিজে আর প্রধান কাজি। সত্যিই তখন এমন মানুষের সংখ্যা কম ছিল, যারা অন্তত লুকিয়ে মদ্যপান করত না…মন্ত্রীরা স্বয়ং মদ্যপান করত আর মাতাল হতে পছন্দ করত। সংগীতের বিরুদ্ধে আইনেরও। হয়েছিল ওই একই পরিণতি।
কুখ্যাত জুয়াড়িদের সম্রাট শাস্তি দিয়েছেন। মানুচি উল্লেখ করেছেন যে তিনি আদেশ দিয়েছেন সমস্ত বেশ্যা আর নর্তকীদের হয় বিয়ে নয়ত রাজ্যত্যাগ করতে কিন্তু একই লেখকের বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে যে এই আইন কার্যকর হয়নি। কুৎসিত গান গাওয়া আর বত্সব করার জন্য হোলি উৎসবের ওপর তাঁর নিষেধাজ্ঞা ছিল স্পষ্টতই পুলিশ আইনের আওতায়। ফলে ১৬৬৯ সালে বুরহানপুরে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই শোভাযাত্রাকারী দলের মধ্যে মারাত্মক লড়াই সংঘটিত হওয়ার পর এই আদেশ মুহররমের শোভাযাত্রাও বন্ধ করে দেয়।
১৬৬৪ সালে আওরঙ্গজেব সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেছেন। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা সর্বত্র কার্যকর করার ব্যাপারে সরকার ছিল অসহায়। ক্রীতদাস হিসেবে। হেরেমে বিক্রি করার লক্ষ্যে শিশুদের খোঁজা করার অমানুষিক ঘটনাকেও সাম্রাজ্য জুড়ে দমনের আদেশ (১৬৬৮) দেওয়া হয়েছিল।
৬.৬ দারার প্রিয় ঈশ্বরতাত্ত্বিক এবং সুফিগণের হত্যাকাণ্ড
ইসলামি গোঁড়ামি জোরদার করার ফলে দারার প্রিয় উদারমনা ধার্মিকদের শাস্তি দেওয়ার একটা সুযোগ পেয়ে গেলেন আওরঙ্গজেব। এমনই একজন ছিলেন মিয়া মীরের শিষ্য এবং অতীন্দ্রিয়বাদী কবিতার সাবলীল রচয়িতা শাহ মুহম্মদ বখশি। দারা তাঁকে অত্যন্ত সম্মান আর লালন করতেন; আওরঙ্গজেবের সিংহাসনারোহণের পর তাঁকে সম্রাটের দরবারে ডেকে পাঠানো হয়। কিন্তু পথিমধ্যে লাহোরে তিনি মারা যান ১৬৬১ সালে।
এই শ্রেণীর সবচেয়ে বিখ্যাত শিকার ছিলেন সারমাদ; সুফি এই মানুষটিকে ভারতের সবাই মান্য করত। ইহুদি বংশোদ্ভূত সারমাদ জন্মগ্রহণ করেন পারস্যের কাশানে, আর হিব্রু ধর্মশাস্ত্রে অগাধ দখলের জন্য হন একজন রাব্বি। তারপর ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে তিনি নাম নেন মুহম্মদ সাঈদ। তারপর ভারতে ব্যবসা করতে এসে টাট্টায় তার পরিচয় হয় অভয় চাঁদ নামক এক হিন্দু বালকের সঙ্গে, যার ভীষণ প্রভাবে তিনি রূপান্তরিত হন একজন নগ্ন ফকিরে, আর অভয় চাঁদকে প্ররোচিত করেন তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণের জন্য। দিল্লিতে তিনি দারা শুকোর সহায়তা লাভ করেন, এমনকি তার মাধ্যমে পরিচিত হন শাহজাহানের সঙ্গে।
সারমাদ ছিলেন সর্বেশ্বরবাদী। তার কবিতা কেবল সুফিদের অতীন্দ্রিয়বাদের কথাই প্রকাশ করত না, বরং নির্দিষ্ট কোনো ধর্মে বাধা না পড়ে মানুষকে শোনাত এক সর্বধর্ম-দর্শনের কথা। মহানবীকে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন : কিন্তু তার মত ছিল গোড়ামির ঊর্ধ্বে। তিনি বলেছেন, “ঈশ্বর একটা বস্তুগত বিষয়, মানুষের চেহারা আর শারীরিক গঠনই সেই বস্তুর প্রতীক…সকর্মের পুরস্কার আর পাপের শাস্তি এই পৃথিবীতেই পাওয়া যায়। মানুষের আত্মা তার শেষ জীবনের সমান লম্বা একটা সময় ঘুমের মধ্যে কাটিয়ে দেওয়ার পর আবার জন্মগ্রহণ করে।
মুসলমান তাত্ত্বিকদের একটা দল বিচারে বসে ধর্মবিরোধিতার দায়ে সারমাদকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। তবে এর পেছনে মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক, সারমাদ নাকি দারাকে সিংহাসন লাভের ব্যাপারে সাফল্যের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন।
১৬৭২ সালে প্রথম তিন খলিফাঁকে গালাগাল করার দায়ে মুহম্মদ তাহির নামক একজন শিয়া দেওয়ানের গর্দান নেওয়া হয়। ১৬৬৭ সালে পর্তুগিজ এক ভিক্ষু ইসলাম ধর্মগ্রহণের পর আবার তার নিজ ধর্মে ফিরে গেলে স্বধর্ম ত্যাগের অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়। আহমেদাবাদের বোহরা সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক গুরু সাঈদ কুতব-উদ-দীনকে তার ৭০০ জন অনুসারীসহ হত্যা করা হয় আওরঙ্গজেবের আদেশে।
৬.৭ বহির্বিশ্বের মুসলমানদের সঙ্গে আওরঙ্গজেবের সম্পর্ক
আওরঙ্গজেব সিংহাসনে স্থায়ী হওয়ার পর বহির্বিশ্বের যেসব মুসলমান রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল, তাদের সবাই কূটনীতিক পাঠিয়ে সিংহাসনারোহণের জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানায়।
উত্তরাধিকারের লড়াইয়ের পর আওরঙ্গজেব পরিকল্পনা করেন যে মক্কার মুসলমান নেতা আর ধর্মগুরুদের তিনি টাকায় ডুবিয়ে দেবেন, যেন তারা তাকে ন্যায়সংগত উত্তরাধিকারীর পরিবর্তে পিতৃ সিংহাসনের বলপূর্বক দখলকারী না ভাবে। ফলে ১৬৫৯ সালের নভেম্বরে তার জাঁকজমকপূর্ণ সাম্রাজ্যাভিষেকের পরপরই সাঈদ মীর ইব্রাহিমের হাতে ছয় লাখ ষাট হাজার টাকা তুলে দিলেন তিনি মসজিদ আর মাজারের সাঈদ, উপাসক, পরিচারক এবং মক্কা আর মদিনার ধর্মানুরাগীদের মধ্যে বন্টন করার জন্য। এই ঘটনার পর থেকে মক্কার শরিফ মহানবীর নামে চাঁদা আদায়ের জন্য প্রত্যেক বছর তার প্রতিনিধিকে পাঠাতে লাগল দিল্লির দরবারে। অবশেষে শরিফের লোভ আওরঙ্গজেবকে রাগান্বিত করল । শাসনকালের শেষ দশকে সম্রাট তার উজিরকে চিঠি লিখলেন, মক্কার শরিফ ভারতের সম্পদের কথা শুনে প্রত্যেক বছর প্রতিনিধি পাঠাচ্ছে তার ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে। আমি সেখানে টাকা পাঠাই গরিবদের জন্য, তার জন্য নয়।
আওরঙ্গজেব সিংহাসনের অবিসংবাদিত প্রভু হওয়ার পর তাকে অভিনন্দন জানাতে জাঁকজমকপূর্ণ একটা কূটনীতিক দল পাঠালেন দ্বিতীয় শাহ আব্বাস, তাঁর মাস্কেট বাহিনীর সেনাপতি বুদক বেগের অধীনে (১৬৬১)।
সংগত কারণেই পারসিদের তখন বলা হতো এশিয়ার ফরাসি। সংস্কৃতি, ধ্যান-ধারণা এবং ফ্যাশনের বিচারে তারা ছিল ইসলামি জগতের শীর্ষে। মুসলমানদের সমস্ত কবিতা গড়ে উঠেছিল ফরাসি কবিতার প্রভাবে, এবং কর্ডোভা থেকে কনস্টান্টিনোপল কিংবা দিল্লি থেকে সেরেঙ্গাপট্টমের সমস্ত মুসলমান দরবারে চলত পারসি আচার-আচরণ আর রুচির এক কষ্টকর আর জবরজঙ্গ অনুকরণ। শত্রুর তরবারির চেয়েও পারসি ব্যঙ্গরচয়িতাদের কলমকে সম্রাট বা রাজারা ভয় পেত বেশি। সুতরাং ফরাসি কূটনীতিকদের আগমন-সংবাদে মোগল দরবারে একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো। সম্রাট থেকে প্রহরী পর্যন্ত সবাই অনুভব করল যে এবার তার আর তার দেশের হবে ঋটি পরীক্ষা। আভিজাত্য, রুচি বা আচরণের কোনো রকম ত্রুটি হলে তারা হবে সমগ্র এশিয়ার হাসির খোরাক।
শাহ পাঠালেন ৪,২২,০০০ টাকার উপহার। ১৬৬১ সালের ২৭ জুলাই সম্রাট ৫,৩৫,০০০ টাকার উপহার দিলেন বিদায়ী কূটনীতিক দলকে। ১৬৬৩ সালের ২ নভেম্বর শাহ আব্বাসের চিঠির জবাবসহ একটা ফিরতি কূটনীতিক দল পাঠালেন আওরঙ্গজেব মুলতানের শাসক তরবিয়াত খানের অধীনে, সঙ্গে সাত লাখেরও বেশি টাকার উপহার। চিঠিতে শাহকে ধন্যবাদ জানালেন আওরঙ্গজেব, কিন্তু দাম্ভিক সুরে ঘোষণা করলেন যে মানুষের সাহায্যের কোনো প্রয়োজন তার নেই, যেহেতু তিনি আল্লাহর আনুকূল্যের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল; তাঁর বিস্ময়কর জয়গুলোই তার প্রতি আল্লাহর অপার অনুগ্রহের প্রমাণ।
পারস্য থেকে তরবিয়াত খান ফিরল বিদ্রুপাত্মক এক চিঠি নিয়ে । শাহ আব্বাস লিখেছেন, আমি জানতে পারলাম যে ভারতের প্রায় সব জমিদার বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে, কারণ, তাদের শাসক দুর্বল, অযোগ্য আর সংগতিহীন। বিদ্রোহীদের নেতা হলো কাফের শিবা, যে দীর্ঘ সময় এতই গোপন ছিল যে কেউ তার নাম পর্যন্ত জানতে পারেনি; কিন্তু এখন, আপনার সংস্থানের অভাব আর সেনা প্রত্যাহারের সুযোগে, দৃশ্যমান হয়েছে সে পর্বতের চূড়ার মতো, দখল করেছে অনেক দুর্গ, হত্যা বা বন্দী করেছে আপনার অনেক সেনা, লুণ্ঠন আর ধ্বংস করেছে আপনার অনেক বন্দর, শহর আর গ্রাম, এবং শেষমেশ নামতে চায় আপনার প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। আপনি গ্রহণ করেছেন দিগ্বিজয়ীর খেতাব (আলমগির), অথচ জয় বলতে আপনি করেছেন কেবল আপনার বৃদ্ধ পিতাকে, আর ভাইদের হত্যার মাধ্যমে লাভ করেছেন মানসিক প্রশান্তি। অরাজক মানুষকে দমন করা। আপনার সাধ্যের বাইরে। আমার পূর্বপুরুষেরা ছিল পৃথিবীর রাজাদের বিপদের আশ্রয়,-দেখুন, কীভাবে আমরা সিংহাসনে পুনরাধিষ্ঠিত করেছি হুমায়ুন আর নজর মুহম্মদ খানকে। এখন আপনি, হুমায়ূনের উত্তরাধিকারী, যেহেতু বিপদে পড়েছেন, আমার অসংখ্য সেনাবাহিনী নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ভারতে গিয়ে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা (যা আমার দীর্ঘকালের আকাক্ষা), এবং যাবতীয় সহায়তা দিয়ে অরাজকতার আগুন নেভানো আমার রাজকীয় উচ্চাশা জ্ঞান করছি।’ চিঠি পড়ার পর আওরঙ্গজেবের অক্ষম ক্রোধ গিয়ে পড়ল বেচারি কূটনীতিকের ওপর, তাকে হীনপদস্থ করলেন তিনি কর্তব্য পালনে ব্যর্থতার দায়ে।
শাহ মৃত্যুবরণ করলেন ১৬৬৭ সালের আগস্টে, ফলে পারসি আক্রমণের হুমকির ইতি হলো কথার ভেতর দিয়েই, তবে জীবনের শেষ পর্যন্ত আওরঙ্গজেব একটা সতর্ক দৃষ্টি রাখলেন তাঁর পারসি সীমান্তের দিকে। এ ছাড়া আওরঙ্গজেবের কাছে কূটনীতিক এসেছিল বলখ আর বুখারা (১৬৬১ এবং আবার ১৬৬৭), কাশঘর (১৬৬৪), উরগঞ্জ (খিবা), কনস্টান্টিনোপল (১৬৯০), আর আবিসিনিয়া থেকে (১৬৬৫ এবং আবার ১৬৭১ সালে)। মধ্য এশিয়া এবং আরবের ছোট ছোট গোত্রপ্রধান, আর বসরার তুর্কি শাসকদের সঙ্গেও দিল্লি সরকারের বন্ধুভাবাপন্ন সম্পর্ক ছিল।
কূটনীতিক গ্রহণ আর প্রেরণে সাত বছরেরও কম সময়ে (১৬৬১-৬৭) আওরঙ্গজেব খরচ করলেন ২১ লাখেরও বেশি টাকা, পাশাপাশি ১৬৬৮ সালে ভারতে আশ্রয় নেওয়া কাশঘরের প্রাক্তন রাজা আবদুল্লাহ খানকে দিলেন তিনি ১১ লাখ, আর সাত লাখ মক্কার শরিফকে উপহার বাবদ।
৬.৮ আগ্রা দুর্গে শাহজাহানের বন্দিজীবন
বিজয়ী পুত্রকে আগ্রা দুর্গের দরজা খুলে দেওয়ার পর থেকেই অবশিষ্ট জীবনের জন্য বন্দী হয়ে গেলেন শাহজাহান। একজন রাজাধিরাজের পক্ষে এ রকম পরিবর্তন নিঃসন্দেহে খুব কষ্টকর, আর এটা নিশ্চয় তিনি মেনে নিয়েছিলেন মনের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করার পর। দারা আর সুজাকে লিখা তার প্রত্যেকটা চিঠি আওরঙ্গজেবের লোকেরা আটক করেছে, আর যেসব খোঁজা লুকিয়ে দুর্গের বাইরে চিঠি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে, তাদের দেওয়া হয়েছে কঠিন শাস্তি । এসব ব্যর্থ চেষ্টার ফলে বন্দিজীবন আরও দুঃসহ হয়েছে, শাহজাহানকে এখন সব সময় ঘিরে রেখেছে শত্রুরা। তাঁর সঙ্গে কারও সাক্ষাতের উপায় নেই। তার যেকোনো মন্তব্য সরকারি গুপ্তচর মারফত তৎক্ষণাৎ পৌঁছে যাচ্ছে আওরঙ্গজেবের কানে। লেখার সরঞ্জাম পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হয়েছে প্রাক্তন সম্রাটের কাছ থেকে।
মহান মোগলদের সবচেয়ে জাঁকালো সম্রাটের মর্যাদা লুষ্ঠিত হয়েছে আওরঙ্গজেবের অতৃপ্ত ক্ষমতা লিপ্সার কারণে। আগ্রা দুর্গে রক্ষিত ধনরত্ন নিয়েও অনেক বাদানুবাদ হয়েছে পিতা-পুত্রের মধ্যে। বন্দী সম্রাট কিছুতেই ভুলতে পারেন না যে তিনিই এগুলোর ন্যায়সংগত অধিকারী, এগুলো লাভ করার কোনো নৈতিক অধিকার তাঁর পুত্রের নেই। পিতার যুক্তির জবাবে আওরঙ্গজেব বলেছেন, সম্রাটের সম্পত্তি জনসাধারণের সেবার জন্য…সম্রাট হলেন আল্লাহর মনোনীত তত্ত্বাবধায়ক, যার ওপরে রয়েছে আল্লাহর সম্পদ জনসাধারণের উন্নতিকল্পে বণ্টন করার ভার।
দারা পালিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর স্ত্রী এবং কন্যাদের ২৭ লাখ টাকা মূল্যের গহনা জমা রেখে গিয়েছিলেন আগ্রা দুর্গে। আওরঙ্গজেব সেগুলোও দাবি করলেন। অনেক দিন বাধা দেওয়ার পর অবশেষে হাল ছেড়ে দিলেন শাহজাহান। আগ্রার আত্মসমর্পণের পরপরই সম্রাটের সমস্ত সাজপোশাক, আসবাবপত্র, তৈজস, গহনা আর সম্পদ রাখার কক্ষগুলো সিল করে দিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব।
মুহম্মদ সুলতান চলে যাওয়ার পর খোঁজা মুতামাদ হলো সর্বেসর্বা, আর শাহজাহানের সঙ্গে করতে লাগল অত্যন্ত রূঢ় আচরণ।
তাঁর বন্দিত্বের প্রথম বছরে পিতা-পুত্রের মধ্যে চলল অত্যন্ত বদমেজাজি এক চিঠির আদান-প্রদান। তর্ক-বিতর্কের সময় জুড়েই আওরঙ্গজেব একজন সেরা মুসলমান এবং উত্তম সরকারের ভাব ধরে রইলেন; পিতাকে তিনি দোষারোপ করলেন অযোগ্য এবং অন্যায্য শাসনের জন্য, আর নিজেকে সমর্থন করলেন একজন ন্যায়পরায়ণ এবং বিনয়ী শাসক হিসেবে। তিনি একজন অস্বাভাবিক পুত্র এবং বিদ্রোহী, পিতার এই অভিযোগের আওরঙ্গজেব জবাব দিয়েছেন ।
যত দিন আপনি ছিলেন, আপনার অনুমতি ব্যতীত আমি কিছুই করিনি, কিংবা কখনোই যাইনি আমার এক্তিয়ারের বাইরে। আপনার অসুস্থতার সময় দারা লুণ্ঠন করলেন সমস্ত ক্ষমতা, আর কোমর বেঁধে নামলেন হিন্দুয়ানির উন্নতিসাধন এবং ইসলামের ধ্বংসে। সরকার বিশৃঙ্খলতায় নিমজ্জিত হলো…আমার আগ্রা অভিযানের পেছনে কোনো বিদ্রোহী মানসিকতা কাজ করেনি, আমি দারার অবৈধ দখল, ধর্মহীনতা, আর সাম্রাজ্য জুড়ে পূজার উন্নয়নের শেষ দেখতে চেয়েছিলাম…মুকুটের গুরুভার মাথায় তুলতে বাধ্য হয়েছিলাম আমি, ইচ্ছেই নয়, বরং বিশেষ প্রয়োজনে,–সাম্রাজ্যে শান্তি আর ইসলামের অনুশাসন ফিরিয়ে আনতে।
সম্রাটের দৃষ্টিভঙ্গি আর কর্তব্য বিষয়ে তার নিজস্ব ধারণা উচ্চ, এমনকি নির্বিকার (Stoical): ‘সম্রাটের দায়িত্ব হলো সাম্রাজ্যের সুরক্ষা, আর জনসাধারণের অভিভাবকত্ব, শারীরিক বিশ্রাম উপভোগ বা কামলালসা মেটানো নয়।
চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও তাঁর নিজ সাফল্যকে তিনি বলেছেন তাঁর প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ আর তাঁর উদ্দেশ্যের সততার প্রমাণ। সুতরাং, জ্ঞানী একজন মানুষ হিসেবে শাহজাহানের উচিত আওরঙ্গজেবের জয় মেনে নেওয়া, যার চেয়ে ভালো ঘটনা তার জীবনে আর ঘটতে পারত না!
এই ভণ্ডামিতে চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে শাহজাহান আওরঙ্গজেবকে ডাকাত আখ্যা দিলেন, যে নিজেকে একজন খাঁটি মুসলমান ঘোষণা দিয়ে অন্যের সম্পত্তি লুণ্ঠন করে। নিজের আচরণের সমর্থনে তখন আদর্শবাদের ধোয়া তুলে শাহজাদা বলেছেন: আপনি লিখেছেন যে অন্যের ধন অপহরণ করা ইসলাম ধর্মের বিরোধী। জেনে রাখুন, সম্রাটের সম্পত্তি জনসাধারণের সেবার জন্য…সাম্রাজ্য কারও বংশানুক্রমিক সম্পত্তি নয়। সম্রাট আল্লাহর মনোনীত তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া আর কিছুই নয়, যার রয়েছে কেবল আল্লাহর সম্পদ জনসাধারণের উন্নতির লক্ষ্যে বেঁটে দেওয়ার দায়িত্ব।
তারপর তার নিষ্ঠুর পুত্রকে সাবধান করে দিয়ে শাহজাহান বলেছেন যে তিনি যেন স্মরণ রাখেন, তাঁর পুত্রগণও তাঁর সঙ্গে ঠিক এমন আচরণই করতে পারেন, যেমন আচরণ তিনি করলেন তাঁর নিজের পিতার সঙ্গে। আওরঙ্গজেব জবাব দিলেন: ‘কোনো কিছুই আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া ঘটে না। আপনি যে নিয়তির কথা
উল্লেখ করেছেন, তা আমার বড় ভাইদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। আমি কীভাবে আল্লাহর বিধান এড়াতে পারব? সব মানুষই আল্লাহর কাছ থেকে তার উদ্দেশ্যের প্রতিফল লাভ করে, আর আমার উদ্দেশ্যে যেহেতু ভালো, পুত্রদের কাছ থেকে ভালো ছাড়া অন্য কোনো ধরনের আচরণ পাব না বলেই আমার বিশ্বাস।
কিন্তু তাঁর দাম্ভিক পুত্রের চেয়ে শাহজাহানের ভবিষ্যদ্বাণীই ছিল সঠিক। আওরঙ্গজেবের অন্যায়ের প্রতিশোধ এল তাঁর চতুর্থ পুত্র মুহম্মদ আকবরের কাছ থেকে। ১৬৮১ সালে সেই শাহজাদা যখন বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন, পিতাকে লিখলেন তিনি তিক্ত এবং বিদ্রুপাত্মক একটা চিঠি, যার সঙ্গে শাহজাহানকে লেখা
আওরঙ্গজেবের বর্তমান চিঠিগুলোর রয়েছে এক লক্ষণীয় সাদৃশ্য । এই চিঠিতে আওরঙ্গজেবকে দোষারোপ করা হলো প্রশাসনিক ব্যর্থতার দায়ে, আর পরামর্শ দেওয়া হলো যে পিতাকে সিংহাসনচ্যুত আর দুই ভাইকে হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করার উদ্দেশ্যে এই বৃদ্ধ বয়েসে তার এখন ধর্মকর্ম নিয়ে থাকাই ভালো। সবশেষে আওরঙ্গজেবকে প্রশ্ন করা হলো, কোন যোগ্যতায় তিনি আকবরকে অস্বাভাবিক পুত্র বলছেন, যেখানে তিনি স্বয়ং বিদ্রোহ করেছিলেন তাঁর নিজের পিতার বিরুদ্ধে!
শাহজাহান আর তার পুত্রের চিঠি তিক্ত থেকে তিক্ততর হয়ে উঠল । অবশেষে অভিযোগ বন্ধ করে দিয়ে নিশুপ হয়ে গেলেন বৃদ্ধ সম্রাট।
আঘাতে আঘাতে তার হৃদয় জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। প্রথমে দারা শুকো, তারপর মুরাদ বখশ, আর তারপর সুলাইমান শুকো, সবাইকে খতম করে দিয়েছেন আওরঙ্গজেব । সুজা আর তার সমস্ত সন্তান চলে গেছেন ভয়ংকর মগদের দেশে। কিন্তু এত শোক সত্ত্বেও সম্রাট ধৈর্য হারাননি; জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার হৃদয় ছিল সহিষ্ণুতা এবং অবিচলতার আবাস।’
ধর্ম তাকে সান্ত্বনা দিয়েছে। কনৌজের সাঈদ মুহম্মদ এখন তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী। প্রাক্তন সম্রাটের সময় কাটে এখন আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ, নামাজ, ধর্মীয় বাধ্যতামূলক কাজকর্ম করা, কুরআন পড়া, আর অতীতের মহামানবদের ইতিহাস শোনার ভেতর দিয়ে।
সম্রাটের আরেক সান্ত্বনা ছিলেন কন্যা জাহানারা, যার ভালোবাসা আর যত্ন যেন তাঁর পুত্রগণের নিষ্ঠুরতার প্রায়শ্চিত্ত। মিয়া মীরের শিষ্যা এই শাহজাদি এখন সন্ন্যাসিনীর জীবন কাটান আগ্রা দুর্গের হেরেমে, আর বৃদ্ধ এবং পরিত্যক্ত পিতার শুশ্রূষা করেন একাধারে একজন মা এবং কন্যারূপে। দারা আর মুরাদের এতিম কন্যাগণকেও বুকে আগলে রেখেছেন জাহানারা। আর, এমন আত্মিক সঙ্গ পেতে পেতেই শাহজাহান নিজেকে প্রস্তুত করছেন অপেক্ষাকৃত ভালো এক পৃথিবীর জন্য। মৃত্যুর কোনো আতঙ্ক আর তার মধ্যে নেই, বরং ওটা যেন দুর্দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার এক শান্তিময় পথ ।
৬.৯ শাহজাহানের শেষ দিনগুলো
যে মুক্তির জন্য আকুল হলেও অপেক্ষা করছিলেন তিনি পরম প্রশান্তি নিয়ে, অবশেষে তা এল ১৬৬৬ সালের জানুয়ারিতে। ওই মাসের সাত তারিখে জ্বরে আক্রান্ত হলেন শাহজাহান। শিগগিরই দেখা দিল অন্যান্য জটিলতা। তাঁর ৭৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। মধ্য শীতের তীব্র ঠান্ডা হ্রাস করে ফেলেছে তার প্রাণশক্তি।
২২ জানুয়ারি, সসামবার, রাত নামার পরপরই বলা হলো যে তার আর আশা নেই, যেকোনো সময় শেষ ক্ষণ ঘনিয়ে আসতে পারে। মৃত্যু দুয়ারে এসে গেছে শুনে জীবনে যা কিছু পেয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন শাহজাহান। সম্পূর্ণ শান্তভাবে আপন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া-বিষয়ক নির্দেশ দিলেন তিনি, সান্ত্বনা দিলেন জীবিত দুই স্ত্রী, আকবরাবাদি মহল আর ফতেপুরী মহল, কন্যা জাহানারা, আর তাঁকে ঘিরে বিলাপরত হেরেমের অন্যান্য মহিলাকে। শাহজাহান জাহানারাকে বললেন, তিনি যেন তাঁর সৎবোন পুরুনার বানু আর সেই সব মহিলার দিকে লক্ষ রাখেন, তাঁর মৃত্যু যাদের অসহায় করে দেবে। তারপর অবশিষ্ট উপহার আর স্মৃতিচিহ্নগুলো পরিবার আর ভৃত্যদের দান করে তাদের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শাহজাহান কুরআন পাঠ করতে বললেন। কুরআনের পবিত্র স্তোত্র শুনতে শুনতে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন তিনি অনেক দিন আগে বিদায় নেওয়া তার বেগম, মমতাজ মহলের কবরের দিকে, তারপর বেশ কয়েকবার কলেমা পড়ার পর প্রার্থনা করলেন:
‘হে আল্লাহ! দুনিয়ার মতো আমাকে আখেরাতেও ভালো রেখো, আর রক্ষা কোরো আমাকে দোজখ-যন্ত্রণা থেকে!’ এক মুহূর্ত পরই পরম প্রশান্তিতে অনন্ত ঘুম নেমে এল তাঁর দুই চোখের পাতায়। রাত তখন সোয়া সাতটা বাজে।
মৃতদেহ রাখা হলো অষ্টকোণী বুরুজে (মুসাম্মান বুর্জ)। দুর্গের কর্মচারীরা বুরুজের সিঁড়ির তলার দরজা ভেঙে কফিন বের করে নিয়ে গেল, যে দরজা দেয়াল তুলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল শাহজাহানকে বন্দী করার পর।
তারপর একটা নৌকায় করে কফিন নিয়ে যাওয়া হলো যমুনার ওপারে, তাজমহলে প্রিয়তমা মমতাজ মহলের সমাধির পাশেই সমাধিস্থ হলেন শাহজাহান।
জনসাধারণ শোক পালন করল তাদের প্রিয় সম্রাটের মৃত্যুতে, বারবার তাদের মুখে মুখে ফিরতে লাগল তার সমস্ত গুণের কথা, আর দোষ যা দু-চারটে ছিল, তা মনে রাখল না কেউই।
প্রায় এক মাস পর আগ্রা এসে জাহানারার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন আওরঙ্গজেব, প্রদর্শন করলেন যথাযোগ্য সম্মান । সংগত কারণেই আওরঙ্গজেবের ওপর ভীষণ অসন্তুষ্ট ছিলেন শাহজাহান, কিন্তু বারবার জাহানারার সনির্বন্ধ অনুরোধে অনেকবার অসম্মত হওয়ার পর অবশেষে মৃত্যুর কিছু দিন আগে তার প্রতি করা অপরাধের জন্য আওরঙ্গজেবকে তিনি ক্ষমা করে দেন।
পিতার প্রতি আওরঙ্গজেবের আচরণ তার সমসাময়িকদের নৈতিক বোধেরই কেবল নয়, বরং শাশ্বত সামাজিক শালীনতারও প্রচণ্ড ক্ষতিসাধন করেছে।