॥ ৬ ॥
শশাঙ্কবাবু খবর দেওয়াতে কিছুক্ষণের মধ্যেই জলপাইগুড়ি থেকে পুলিশের লোক এসে তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। এখন বিকেল পাঁচটা। আজ আকাশ পরিষ্কার। আমরা মহীতোষবাবুর নিজের বাগানের অদ্ভুত ভাল চা খেয়ে ঘরে বসে আছি। ফেলুদা ভুরু কুঁচকে পায়চারি করছে, মাঝে মাঝে আঙুল মটকাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে একটা চারমিনার ধরিয়ে দু’-চারটে টান দিয়েই টেবিলের উপর রাখা পিতলের ছাইদানিটায় ফেলে দিচ্ছে। লালমোহনবাবু ইতিমধ্যে বার তিনেক মাটিতে শোয়ানো বাঘের মাথাটা পরীক্ষা করেছেন; বিশেষ করে দাঁতগুলো।
‘ভদ্রলোকের সঙ্গে যদি আরেকটু আলাপ করার সুযোগ হত!’
ফেলুদা এ কথাটা আপন মনে আরও কয়েক বার বলেছে। সত্যি, তড়িৎবাবুকে ভাল করে চেনার আগেই তিনি খুন হয়ে গেলেন। খুনের কারণ কী হতে পারে, তড়িৎবাবুর সঙ্গে কারুর শত্রুতা ছিল কি না, এই সব না জানলে পরে ফেলুদার পক্ষে রহস্যের কিনারা করা মুশকিল হবে নিশ্চয়ই।
বারান্দার ঘড়িতে পাঁচটা বাজার কয়েক মিনিট পরেই মহীতোষবাবুর একজন চাকর— যার নাম জানি না— এসে খবর দিল, নীচের বৈঠকখানায় আমাদের ডাক পড়েছে।
আমরা তিনজনে বেশ ব্যস্তভাবেই নীচে গিয়ে হাজির হলাম। মহীতোষবাবু আর শশাঙ্কবাবু ছাড়াও আরেকটি ভদ্রলোক সোফায় বসে আছেন। পোশাক দেখে বুঝলাম ইনি পুলিশের লোক। মহীতোষবাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন—
‘ইনি ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। আপনিই প্রথম ক্ষতচিহ্নটা দেখে খুনের কথাটা বলেছেন জেনে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাইলেন।’
ফেলুদা নমস্কার করে মিস্টার বিশ্বাসের উল্টোদিকে সোফাটায় বসল, আমরা দুজন একটু দূরে আর একটা সোফায় বসলাম।
মিস্টার বিশ্বাসের গায়ের রং রীতিমতো কালো, মাথায় চকচকে টাক, যদিও বয়স বোধহয় চল্লিশ-টল্লিশের বেশি নয়। সরু একটা গোঁফও আছে, তার দুটো দিক আবার লম্বায় সমান নয়। ছাঁটবার সময় বোধহয় একটু অসাবধান হয়ে পড়েছিলেন। ভদ্রলোক তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ফেলুদার দিকে দেখে বললেন, ‘আপনি শুনলাম শখের ডিটেকটিভ।’
ফেলুদা একটু হেসে বুঝিয়ে দিল, কথাটা ঠিক।
বিশ্বাস বললেন, ‘আপনাদের আর আমাদের মধ্যে তফাতটা কোথায় জানেন তো? আপনারা কোথাও গেলে পরে সেখানে খুন হয়, আর আমরা কোথাও খুন হলে পরে সেখানে যাই।’ কথাটা বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হেসে উঠলেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস।
ফেলুদা আর কথা না বাড়িয়ে একেবারে কাজের কথায় চলে গেল। বলল, ‘খুনের অস্ত্রটা পাওয়া গেছে কি?’
বিশ্বাস হাসি থামিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, ‘না। তবে খোঁজা হচ্ছে। জঙ্গলের মধ্যে খানাতল্লাসির ব্যাপারটা কীরকম কঠিন সে তো বুঝতেই পারছেন। তার উপর আবার ম্যান-ইটার। পুলিশরাও তো মানুষ—মানে, ম্যান—বুঝলেন তো? হোঃ হোঃ হোঃ।’
বিশ্বাস মশাই এত হাসছেন দেখে ফেলুদাও যেন জোর করেই একটু হেসে আবার গম্ভীর হয়ে বলল, ‘ছুরির আঘাতেই মরেছিলেন কি তড়িৎবাবু?’
বিশ্বাস বললেন, ‘সেটা তো আর এখন বোঝবার উপায় নেই। লাশের যা অবস্থা, এমনিতেই বাঘে খেয়ে গেছে অনেকটা। তার উপর এই গরম; পোস্ট মর্টেমে কোনও ফল হবে বলে মনে হয় না। আসল কথা হচ্ছে— কোনও ব্যক্তি তড়িৎবাবুকে কোনও ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে খুন করেছিল, বা খুন করার চেষ্টা করেছিল। তারপর বাঘে কী করেছে না করেছে সেটা আমাদের কনসার্ন না। তার জন্য যা স্টেপ নেবার সেটা নেবেন মিস্টার সিংহরায়।’
মহীতোষবাবু গম্ভীরভাবে মেঝের কার্পেটের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এর মধ্যেই আশপাশের গ্রামে প্যানিক আরম্ভ হয়ে গেছে। আমার লোকও তো জঙ্গলে কাঠ কাটার কাজ করে। আরও দু’ মাস কাজ রয়েছে, তারপর বর্ষা নামলে বন্ধ। অবস্থা গুরুতর সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু তড়িৎকে এভাবে আক্রমণ করল কে এবং কেন, সেটা না জানা অবধি আমি অন্য কিছু ভাবতেই পারছি না। অবিশ্যি আমিই তো আর একমাত্র শিকারি নই এ অঞ্চলে। বনবিভাগ থেকে শিকারির ব্যবস্থা করা কঠিন হবে না।’
মিস্টার বিশ্বাস গলা খাকরিয়ে একটু নড়ে বসে বললেন, ‘আমার কাছে রহস্য একটাই— এত রাত করে জঙ্গলে গেলেন কেন আপনাদের তড়িৎবাবু। খুনের একটা খুব সহজ কারণ থাকতে পারে। তড়িৎবাবুর পকেটে কোনও মানিব্যাগ বা টাকা-পয়সা পাওয়া যায়নি। তার ঘর খুঁজে সেখানেও পাওয়া যায়নি। এ অঞ্চলে গুণ্ডা বদমাইশের তো অভাব নেই। এ অঞ্চলে কেন বলছি— সারা দেশেই নেই— হোঃ হোঃ হোঃ। তাদেরই কেউ এ কুকীর্তিটা করে থাকতে পারে। স্রেফ রাহাজানি আর কী।’
ফেলুদা একটা সিগারেট ধরিয়ে শান্তভাবে বলল, ‘মাঝ রাত্তিরে জঙ্গলের মধ্যে তড়িৎবাবুর মতো একজন নিরীহ লোকের কাছ থেকে টাকা বার করে নিতে কি ছুরি মারার দরকার হয়? মাথায় একটা লাঠির বাড়ি মেরেই কার্যসিদ্ধি হয় না কি?’
বিশ্বাস কাষ্ঠহাসি হেসে বললেন, ‘তা হয়তো হয়। কিন্তু তড়িৎবাবুকে খুন করার জন্য কী কারণ থাকতে পারে বলুন। মোটিভটা কোথায়? তড়িৎবাবু ছিলেন মিস্টার সিংহরায়ের সেক্রেটারি, লেখাপড়া নিয়ে থাকতেন, পাঁচ বছর হল এখানে এসেছেন, কারুর সঙ্গে মেলামেশা নেই, এ বাড়ির লোকের বাইরে কারুর সঙ্গে আলাপ পরিচয়ও নেই। গুণ্ডা বদমাইশ ছাড়া তার উপর এ ধরনের আক্রমণ করবে কে? এবং কেন করবে?’
ফেলুদা ভুরু কুঁচকে চুপ করে রইল। বিশ্বাস বললেন, ‘সাদাসিধে রাহাজানির ব্যাপারটা আপনাদের মতো শখের ডিটেকটিভদের অ্যাপিল করবে না জানি। তা বেশ তো, আপনি রহস্য চান, রহস্যও তো রয়েছে। বার করুন তো দেখি, তড়িৎবাবুর মতো লোক মাঝরাত্তিরে জঙ্গলে যায় কেন।’
শশাঙ্কবাবু চুপচাপ একটা আলাদা সোফায় বসেছিল। ফেলুদা যে কেন মাঝে মাঝে আড়চোখে ওঁর দিকে চাইছিল সেটা বুঝলাম না। মহীতোষবাবুর চেহারায় এখনও সেই ফ্যাকাশে ক্লান্ত ভাবটা রয়েছে। বার বার খালি মাথা নাড়ছেন আর বলছেন, ‘কিছুই বুঝতে পারছি না…। কিছুই বুঝতে পারছি না…।’
আরও মিনিটখানেক বসে থেকে আমরা তিনজনে উঠে পড়লাম। মিস্টার বিশ্বাস বললেন, ‘আপনি নিজের খুশি মতো তদন্ত চালিয়ে যেতে পারেন মিস্টার মিত্তির। তাতে আমি কিছু মাইন্ড করব না। হাজার হোক— ক্ষত চিহ্নটা তো আপনিই প্রথম দেখেছিলেন।’
বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে ফেলুদা দোতলায় গেল না। গাড়িবারান্দা দিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে ডানদিকে ঘুরে পুরনো আস্তাবল আর হাতিশালের পাশ দিয়ে একেবারে বাড়ির পিছন দিকে গিয়ে হাজির হলাম আমরা। পিছন ফিরে উপর দিকে চাইতেই দোতলার একসারি জানালার মধ্যে একটা থেকে দেখলাম লালমোহনবাবুর তোয়ালেটা ঝুলছে। এটা না হলে কোনটা যে আমাদের ঘর সেটা চেনা মুশকিল হত। আমাদের ঘরের ঠিক নীচেই একতলার একটা দরজা রয়েছে। এটাকে খিড়কি দরজা বলা যেতে পারে। এটা দিয়েই নিশ্চয় কাল রাত্রে বেরিয়ে তড়িৎবাবু জঙ্গলের দিকে গিয়েছিলেন।
সামনে বিশ-পঁচিশ হাত দূরে একটা খোলার চালওয়ালা ছোট্ট একতলা বাড়ি রয়েছে। তার সামনে আট-দশজন লোক জটলা করছে। তার মধ্যে একজনকে আমরা আগে দেখেছি। এ হল মহীতোষবাবুর দারোয়ান। বাড়িটাও সম্ভবত দারোয়ানেরই। ফেলুদার পিছন পিছন আমরা এগিয়ে গেলাম বাড়িটার দিকে। দূরে কালবুনির জঙ্গল দেখা যাচ্ছে, তার শাল গাছের মাথাগুলো অন্য গাছের উপর উঁচিয়ে রয়েছে। জঙ্গলের পিছনে দেখা যাচ্ছে ধোঁয়াটে নীল ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি।
বাড়িটার কাছাকাছি পৌঁছতে দারোয়ান আমাদের সেলাম করল। ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম কী?’
‘চন্দন মিসির, হুজুর।’
বুড়ো লোক, মাথার চুলে কদম ছাঁট, পিছনে টিকি, চোখের পাশের চামড়া কুঁচকে গেছে। কথা বলার ঢং দেখেই বোঝা যায় খৈনি খায়।
‘কদ্দিন কাজ করছ এখানে?’
‘পঁচাশ বরিস হইয়ে গেলো হুজুর।’
চন্দন মিসিরের কথায় বুঝলাম, তড়িৎবাবুর মৃত্যুর চেয়ে মানুষখেকো বাঘ নিয়ে এখানকার লোকেরা অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পাগলা হাতি নাকি প্রায়ই বেরোয়, কিন্তু মানুষখেকো বাঘ গত ত্রিশ বছরের মধ্যে এই প্রথম। চন্দনের মতে এখানে কিছু লোক বেআইনিভাবে চোরা শিকার করে, তাদের কারুর গুলিতে হয়তো বাঘটা জখম হয়েছিল, আর সেই থেকেই ওটা ম্যান-ইটার হয়ে গেছে। অনেক সময় বেশি বয়সে বাঘের দাঁত ক্ষয়ে গেলেও ওরা ম্যান-ইটার হয়ে যায়। আবার মাঝে মাঝে দেখা যায় যে শজারু ধরে খেতে গিয়ে তার কাঁটা এমনভাবে চোখে-মুখে ঢুকে গেছে যে, তার ফলে কাবু হয়ে বাঘ জানোয়ার ছেড়ে আরও সহজ শিকার মানুষের দিকে গেছে।
ফেলুদা বলল, ‘এখানকার লোকেরা কি চাইছে যে মহীতোষবাবু বাঘটাকে মারুন?’
চন্দন মিসির তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘সে তো চাইবে, লেকিন বাবু তো এ জঙ্গলে শিকার করেননি কখনও। আসামে করিয়েছেন, ওড়িশায় করিয়েছেন—এ জঙ্গলে করেননি।’
খবরটা শুনে আমরা সকলেই অবাক হলাম। ফেলুদা বলল, ‘কেন, এখানে করেননি কেন?’
চন্দন বলল, ‘এই জঙ্গলে বাবুর দাদাজি (ঠাকুরদা) বাঘের হাতে মরলেন, বাবুর বাবা ভি বাঘের হাতে মরলেন, তাই বাবু এখানে না করে দুসরা জায়গা দুসরা জঙ্গলে চলে গেলেন।’
মহীতোষবাবুর বাবাও যে বাঘের হাতে মরেছিলেন সেটা এই প্রথম শুনলাম। ফেলুদা জিজ্ঞেস করাতে চন্দন বলল যে, মহীতোষবাবুর বাবা নাকি মাচা থেকে বাঘকে গুলি করেছিলেন, আর দেখে মনে হয়েছিল বাঘটা মরে গেছে। মিনিট দশেক পরে মাচা থেকে নেমে বাঘের দিকে যেতেই সেটা নাকি ভদ্রলোককে আক্রমণ করে সাংঘাতিকভাবে জখম করে। ক্ষত সেপটিক হয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই নাকি ভদ্রলোক মারা যান।
খবরটা শুনে ফেলুদা কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে মাটির দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর খোলার বাড়িটার দিকে দেখিয়ে বলল, ‘তুমি ওই বাড়িতে থাক?’
‘হাঁ, হুজুর।’
‘রাত্তিরে ঘুমোও কখন?’
চন্দন প্রশ্নটা শুনে একটু থতমত খেয়ে ফেলুদার দিকে চাইল। ফেলুদা এবার আসল প্রশ্নে চলে গেল।
‘কাল রাত্তিরে যে বাবু খুন হলেন—’
‘তোড়িতবাবু?’
‘হ্যাঁ। উনি বেশ বেশি রাত্তিরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে জঙ্গলের দিকে গিয়েছিলেন। তুমি তাকে যেতে দেখেছিলে কি?’
চন্দন মিসির বলল, গতকাল না দেখলেও তড়িৎবাবুকে সে তার আগের দিন, এবং তারও আগে বেশ কয়েক দিনই সন্ধ্যেবেলা জঙ্গলের দিকে যেতে দেখেছে। গতকাল তড়িৎবাবুকে না দেখলেও আরেকজনকে দেখেছে।
কথাটা শুনে ফেলুদার মুখের ভাব বদলে গেল।
‘কাকে দেখেছিলে?’
‘তা জানি না হুজুর। তোড়িতবাবুর টর্চের মুখটা বড়—তিন সেলের পুরনো টর্চ। আর এটা ছিল ছোট টর্চ, তার মুখ ছোট। তবে তাই বলে আলো কম নয়।’
‘তুমি কেবল আলোই দেখেছ? আর কিছু দেখনি?’
‘নেহি হুজুর। আউর কুছ নেহি দেখা।’
ফেলুদা আরও কী বিষয়ে জানি একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, এমন সময় দেখি মহীতোষবাবুর চাকর ব্যস্তভাবে দৌড়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
‘বাবু আপনাদের ডেকেছেন। বললেন জরুরি দরকার।’
আমরা ফিরে এসে দেখি, মহীতোষবাবু গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। ফেলুদাকে দেখামাত্র বললেন, ‘আপনার অনুমান ঠিক। তড়িৎকে গুণ্ডা-বদমাইশে মারেনি।’
‘কী করে জানলেন?’
‘যে অস্ত্রটা দিয়ে তাকে মারা হয়েছিল সেটা আমাদেরই বাড়িতে ছিল। কাল যে তরোয়ালটা আপনাকে দেখিয়েছি, সেইটা। সেটা আর ঠাকুরদার আলমারিতে নেই।’