০৬. রোদের তেজ মরে আসছে

রোদের তেজ মরে আসছে। এখন আর হাঁটতে ভালো লাগছে না। ঐ চায়ের দোকানটায় গেলে কেমন হয়? এক কাপ চা এখন নিশ্চয়ই খাওয়া যেতে পারে। আজ সে পয়সা নেবে কি না কে জানে। হয়তো নেবে। এশা সঙ্গে থাকলে নিত না। এই পরীক্ষাটাও হয়ে যাক। এশাবিহীন অবস্থায় কী হয়।

চায়ের দোকানির নাম রমজান। গোলগাল মুখ, মাথাভর্তি বাবরি চুল। চোখ দুটি আরো বড়-বড় হলে মধ্যবয়সের কবি নজরুল হিসেবে চালিয়ে দেয়া যেত। রমজান আমার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাল। হাই তুলে বলল, মুনশি, ইনারে চা দে।

চা খাবার সময় লক্ষ করলাম, সে একবারও আমার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। একটা টাকা দিলাম চায়ের দাম। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে ক্যাশবাক্সে রেখে দিল। আমি বললাম, এশ কি এর মধ্যে এসেছিল? ঐ যে মেয়েটা আসে আমার সঙ্গে—রোগা, লম্বা, কাঁধে সব সময় একটা ব্যাগ।

আসে মাঝে-মইধ্যে।

একা?

না, চশমাওয়ালা একজন থাকে সাথে।

ছেলে না মেয়ে?

ছেলে। সুন্দর মতো একজন।

এই বলেই রমজান একটা উপহাসের হাসি হাসল। বোধহয় সে ভেবেছিল এটা শোনার পর আমি উ বলে চিৎকার করে বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ব। রমজান তাকাচ্ছে ট্যারা চোখে। আমি বললাম, চশমা পরা ছেলে? খুব ফর্সা?

হ।

ও হচ্ছে তার স্বামী। ওর নাম মুনীর।

রমজানের মুখ এবার হাঁ হয়ে গেল। এটা শোনার জন্যে সে বোধহয় প্রস্তুত ছিল না। মানুষকে পুরোপুরি বেকুব বানানোর একটা অন্যরকম মজা আছে। কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছে ব্যাটা।

উনার বিহা হইছে?

হবে না? বয়স তো কম হয় নি! একটা ছেলে আছে, দু বছর বয়স—মন্টু নাম।

আফনে উনার কে হন?

কেউ হই না। খাতিরের লোক।

লোকটির দিকে তাকিয়ে চোখ টেপার একটা ইচ্ছা ছিল, কিন্তু পারা গেল না। এই টেকনিকটা শিখতে পারি নি। চোখ টিপলে দুচোখ একসঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়।

আমি বেরিয়ে এলাম। রমজান ব্যাটাকে পুরোপুরি বেকুব বানানো যায় নি। সে গল্পটি বিশ্বাস করে নি। একটা ছেলে আছে বলে আমি ঘটনাটা কাঁচিয়ে ফেলেছি। ঐটা না বললে সে বিশ্বাস করত।

বিশ্বাসযোগ্যভাবে মিথ্যা কথা বলা খুব কঠিন কাজ। আমার চেনাজানার মধ্যে এই কাজটা সবচে ভাল পারে মাসুম। মাসুমের চোখ বড়-বড়। সমস্ত চেহারায় ভালোমানুষি একটা ভাব আছে। সে চট করে নিজের চোখে পানি নিয়ে আসতে পারে। আমরা সবাই জানি মাসুমের স্বভাবই হচ্ছে মিথ্যা কথা বলা। তবু সে যখন কিছু বলে আমরা সঙ্গে-সঙ্গে বিশ্বাস করে ফেলি।

একদিন থার্ড ইয়ারের ক্লাস হচ্ছে। নবী স্যার ক্লাস নিচ্ছেন। মাসুম দরজার সামনে এসে বলল, স্যার, একজন অ্যাকসিডেন্ট করেছে। পিজিতে আছে, খুবই খারাপ অবস্থা-ব্লাড দিতে হবে। বীরুকে একটু ছুটি দিন স্যার। বীরুর রিলেটিভ। বলতে-বলতে মাসুমের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। নবী স্যারের মুখ অসম্ভব করুণ হয়ে গেল। তিনি আমাকে ক্লাস থেকে বাইরে নিয়ে এসে বললেন, ডিপার্টমেন্টের সামনে আমার গাড়ি আছে। ড্রাইভারকে আমার কথার বল, তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। দেশের কী যে অবস্থা, প্রাণ হাতে নিয়ে পথে নামতে হয়। যাচ্ছি কোথায় আমরা?

আমি নিজেও তখনো বুঝতে পারি নি যে ব্যপারটা পুরোপুরি রসিকতা। আমার হাত-পা কাঁপছে। আমি ধরেই নিয়েছি, এ আর কেউ না—নিৰ্ঘাৎ বাবা, তিনি একটা কাণ্ড করেছেন। রিকশা থেকে ঝাঁকুনি খেয়ে পড়ে গেছেন। তখন হয়তো পেছন থেকে একটা ট্রাক এসেছে। ঘাতক ট্রাক। শহর ভর্তি ঘাতক ট্রাকে।

রিকশা থেকে গড়িয়ে পড়ে যাওয়ার ব্যাপারে বাবার নামডাক আছে। বিনা ঝাঁকুনিতেও তিনি গড়িয়ে পড়ে যান। গত মাসেই এই কাণ্ড করে চশমা ভেঙেছেন। সাড়ে তিন শ টাকা লেগেছে চশমা সারাতে। এই টাকার চাপ সামলানোর জন্যে বাড়িভাড়া দেওয়া হয় নি। এখন চাপ দিচ্ছেন বাড়িওয়ালা। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যাতিন বেলা নিজে আসছেন কিংবা তাঁর ভাইস্তাকে পাঠাচ্ছেন। প্রতিবারই মা তাঁদের খুব সমাদর করছেন। চা-বিসকিট এইসব পাঠাচ্ছেন। দরজার আড়াল থেকে বলছেন, সামনের মাসের দুই তারিখে দু মাসেরটা একসঙ্গে মিটিয়ে দেব। এই মাসে একটু ঝামেলা হয়ে গেছে। কিছু মনে করবেন না। এরকম তো কখনো হয় না। উনি বাড়িভাড়ার ব্যাপারে খুব সাবধান।

ইতং বিতং কত কথা মার। এইসব ঝামেলার কথাগুলি আমরা সবাইকে মাকে দিয়ে বলাই। পারুল একবার একটা ঝামেলা বাধালোপাড়ার নাটকে অভিনয় করবে। আমাদের গুষ্ঠিতে কেউ অভিনয়ের অ জানে না, কিন্তু সে পেয়ে গেল নায়িকার পার্ট। নাটকের নাম নয়া ফসল। খুবই বিপ্লবী জিনিস। মোড়ল-মারা নাটক। শেষ দৃশ্যে জাগ্ৰত জনতা গ্রামের মোড়লকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। তখন নাটকের নায়িকা আলুথালু বেশে স্টেজের মাঝখানে ছুটে এসে বলে—এত অল্প রক্তে হবে না। চাই চাই, আরো রক্ত চাই। রক্তের নদী চাই, রক্তের সাগর চাই…ইত্যাদি।

রোজ রিহার্সেল। বিকেলে শুরু হয়, শেষ হতে হতে সন্ধ্যা। একদিন রিহার্সেলে কী হয়েছে কে জানে, পারুল কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরল। নাটক করবে না। নাট্য নির্দেশক, রোজ বাসায় এসে বসে থাকে। পারুল নিজে তার সঙ্গে কথা বলে না, মাকে পাঠায়। মা চিকন গলায় বলেন, ওর তো বাবা, গায়ে জ্বর। হামের মত গুটি-গুটি বের হয়েছে। ধীরেন বাবু ওষুধ দিচ্ছেন। তোমরা অন্য কাউকে দিয়ে নাটক করাও। ধীরেন বাবু বলেছেন—একে মাসখানিক রেস্ট নিতে হবে।

মাসুমের কথায় ফিরে যাই। ব্যাটা তো আমাকে বের করে নিয়ে এল। আমি ঠিকমতো পা পর্যন্ত ফেলতে পারছি না। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি হাসপাতালের বেডে বাবা লম্বা হয়ে পড়ে আছেন। স্যালাইন-ট্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। মা ঘন-ঘন ফিট হচ্ছেন।

মাসুম বলল, তোর কাছে সিগারেট আছে?

তখন বুঝলাম, ব্যাপারটা রসিকতা। মাসুম গলা নামিয়ে বলল, নবী স্যারের গাড়ি নিয়ে যাবি?

কোথায়?

ইয়াকুবের বাসায়। রু দেখব। মারাত্মক জিনিস। খালি বাসা। আমি, তুই আর ইয়াকুব। গেলে চল, সময় নষ্ট করতে পারব না।

স্যারের গাড়ি নিয়ে আমরা পিজি পর্যন্ত গেলাম। ড্রাইভারকে বললাম, ব্যাংক ভাই, স্যারকে বলবেন বড় উপকার হয়েছে। আমরা প্রায় দৌড়ে পিজিতে ঢোকার একটা ভঙ্গি করলাম। শেষ পর্যন্ত অবশ্যি ইয়াকুবের বাসায় যাওয়া হল না। মাসুম উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। কোন পরিকল্পনাই সে দীর্ঘসময় পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে না। উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।

পিজি থেকে বের হয়ে পাশের একটা দোকানে ঢুকে লাচ্ছি খেলাম। লাচ্ছি শেষ করবার পরপরই মাসুম হাই তুলে বলল, দূর, ভালো লাগছে না, বাসায় চলে যাব। ঘুম আসছে।

তুই আমাকে খামোখা ক্লাস থেকে বের করে নিয়ে এলি কেন?

এখন চলে যা, তা হলেই তো হয়! ঘ্যানঘ্যান করছিস কেন?

ইডিয়ট।

তুই শালা আরো বড় ইডিয়ট।

আমাকে আর দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মাসুম লম্বা-লম্বা পা ফেলে বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেল। শিস দিয়ে কী একটা গান গাইছে-ইয়ে মেরা সাংদিল। সাংদিল ব্যাপাটা কী কে জানে।

আমার তেমন কোন বন্ধু-বান্ধব নেই। মাসুমকে মাঝেমাঝে বন্ধু বলে মনে হয়। সেটা বোধহয় ঠিক নয়। সে সবারই বন্ধু—বিশ্ববন্ধু। প্রথম দিনের আলাপেই সে তুমিতে চলে যায়। এবং অবলীলায় বলে—একটা টাকা যদি থাকে দাও তো! বাসভাড়া নেই। অল গন। দ্বিতীয় দিন দেখা হলে সে তুই সম্বোধন করে। এক টাকার জায়গায় পাঁচ টাকা চায়। দিতে না-চাইলে পা ধরতে আসে।

এশার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় মাসুমের মাধ্যমে। টিএসসিতে গিয়েছি কি একটা কাজে, আমাকে দেখে মাসুম ছুটে এল, দোস্ত, আমাকে উদ্ধার কর। গভীর সমুদ্রে পড়েছি। ডিপ ওয়াটার।

কী হয়েছে?

একটা মেয়েকে কবি শামসুর রাহমানের বাসায় নিয়ে যা। আমার নিয়ে যাওয়ার কথা। যেতে পারছি না। আটকা পড়ে গেছি।

শামসুর রাহমান সাহেবের বাসা কোথায়?

আমি কী করে জানব কোথায়? কবি-সাহিত্যিকদের খোঁজ আমি রাখি নাকি। ঐসব হচ্ছে হাই থটের ব্যাপার।

ঐ মেয়েও কি হাই থটের নাকি?

আরে দূর দুর। কবিতা লিখেছে—পড়াতে চায় শামসুর রাহমান সাহেবকে। ভাই। তোর পায়ে ধরছি, নিয়ে যা রিকশা ভাড়া দেব!

কবি-মেয়ে নিয়ে যাব। পথে কোন বিপদে পড়ি কে জানে? যদি কবিতা শোনাতে চায়?

আরে দূর দূর, মেয়েমানুষ আবার কবি হয় নাকি? আয় পরিচয় করিয়ে দিই—ঐ দেখ পিচপিচ করে থুথু ফেলছে। কী সুন্দর করে থুথু ফেলছে দেখছিস? এই মেয়ের থুথু ফেলা দেখেই যে-কোনো ছেলে ওর প্রেমে পড়ে যাবে। কি, প্রেম-প্রেম লাগছে। না।?

আমি মাসুমের সঙ্গে এগুলাম। মাসুম হাসিমুখে বলল, এশা, আমার এই বন্ধু তোমার প্রেমে পড়ে গেছে। গভীর প্রেম।

এশা মাথার চুল ঠিক করতে করতে বলল, কী দেখে প্রেমে পড়ল?

তোমার থুথু ফেলা দেখে। কাইন্ডলি আরেকবার ফেল।

এশা সত্যি-সত্যি থুথু ফেলল। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাকে জিজ্ঞেস করল, আরো ফেলতে হবে, না একটাতেই হবে? আমি জবাব খুঁজে পেলাম না। ধারালো, অথচ সুন্দর জবাব চট করে মাথায় আসে না। আসে অনেক পরে। এশার এই প্রশ্নের তিনটি চমৎকার উত্তর পরদিন আমার মাথায় এসেছিল, অথচ সেই সময়ে বোকা ধরনের একটি হাসি দিয়ে মাসুমের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি ফেললাম। মাসুম সেই দৃষ্টি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে হাসিমুখে বলল, বীরু তোমাকে কবির বাড়িতে নিয়ে যাবে। বিখ্যাত লোকজনদের বাড়িঘর ওর মুখস্থ। এই বলেই সে হাওয়া।

কবির বাসা খুঁজে পেলাম না। আমি নিজেই অবশ্য বাসা খুঁজে পাবার ব্যাপারে তেমন কোনো উৎসাহ দেখাই নি। হয়তো বাসায় যাব, ভদ্রলোক কথাই বলবেন না। কিংবা মেয়েটির মুখের উপর বলবেন কিছু হয় নি। কবিতা চট করে লেখা যায় না। সাধনা দরকার। বেশি বেশি করে কবিতা পড়বে। চিন্ত করবে। চোখ-কান খোলা রাখবে। কবিরা উঠতি কবি দেখলেই চমৎকার একটা ভাষণ দেন। সেই ভাষণ শুনলে গা-জ্বালা করে। বলতে ইচ্ছ করে দূর শালা, কবিতাই লিখব না।

এটা অবশ্যি আমার কথা না। মাসুমের কথা। সে নাকি এরকম একটি ভাষণের পর এক কবিকে এই কথা বলে চলে এসেছিল। মাসুম একজন উঠতি কবি। এশার সঙ্গে সেই সূত্রেই খাতির। কবিতে-কবিতে ধুল পরিমাণ।

কবির বাসা খুঁজে না পেয়ে ফিরে আসছি। এশা বলল, আপনি কি কবিতা পড়েন?

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ কিছুই পড়ি না। পড়বার ইচ্ছাও নেই।

এশা খিলখিল করে হেসে উঠল। আরো অনেকের মতে আমিও হাসি শুনেই এশার প্রেমে পড়ি। ওর থুথু ফেলা দেখে নয়। এত সুন্দর করে যে কেউ হাসতে পারে, আমার ধারণা ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *