০৬. রেল, নৌকা, মহিষের গাড়ি

রেল, নৌকা, মহিষের গাড়ি এবং হন্টনের কথা বলা হলেও ট্রেন থেকে নেমে সরাসরি নৌকা নিয়ে বাড়ির ঘাটে যাওয়া যায়। ঘাটের নাম ইন্দারঘাট, গ্রাম তিলাতলা। তাহের নৌকা নিয়েছে, ঠাকরাকোনা থেকে ইন্দরঘাট যাবে। দুই মাঝির নৌকা। দুই মাঝির একজনের বয়স দশ-এগার। সে আবার দার্শনিক প্রকৃতির। বেশির ভাগ সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রশ্ন করলে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। তার নীরবতা অন্যজন পুষিয়ে দেয়। একটা কথা জিজ্ঞেস করলে দশটা কথা বলে।

তাহের বলল, কতক্ষণ লাগবে? বালক মাঝি উত্তর দিল না, মুখ ঘুরিয়ে নিল। বালক মাঝির বাবা হাসিমুখে বলল, একটানে লইয়া যামু। একটানের মামলা।

টান দিতে পারবেন তো? আপনার নিজের অবস্থা দেখছি কাহিল–ছেলেটাও নিতান্তই শিশু।

বিছনা কইরা দিতাছি। শুইয়। ঘুমান। ইন্দরঘাটে ঘুম থাইক্যা ডাইক্যা তুলব। সাথের মেমসোব আফনের কী লাগে?

আমার স্ত্রী।

গত বছর একজন মেমসাব দেখছিলাম। হাফপেন্ট পরা। নবীনগর হাটবারে মোটর সাইকেল নিয়া আসছে। একটা কুমড়া কিনছে। কুমড়া এরা খুব ভালো পায়। শখ কইরা খায়।

আপনি নৌকা ছাড়ার ব্যবস্থা করুন তো দেখি।

সব ব্যবস্থা হইতেছে। নূর মিয়ার নৌকায় উঠছেন। আর চিন্তার কিছু নাই।

নৌকা ছাড়ার পর মনে হলো চিন্তার অনেক কিছুই আছে। নূর মিয়া নিজে পিচা করছে না, হাল ধবে বসে আছে। বাচ্চা ছেলে একা দাঁড় টেনে নিয়ে যাচ্ছে। দর্শ পথ যেতে দীর্ঘ সময় লাগবে। দিনে দিনে পৌঁছানোর আশা মনে হচ্ছে ছেড়ে

লিলিয়ান খুব আগ্রহ নিয়ে নদী দেখছে। তার কেমন লাগছে বোঝা যাচ্ছে না। কালো চশমায় তার চোখ ঢাকা। তাহের বলল, কেমন লাগছে লিলিয়ান?

খুব ভালো লাগছে–অদ্ভুত লাগছে। আশা করি খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই জার্নি শেষ হবে না।

না, এই জানি বলতে গেলে অনন্তকাল ধরে চলবে। তুমি ইচ্ছা করলে ঘুমিয়ে পড়তে পার।

আমি ঘুমুব না।

খিদে পেয়েছে?

না।

স্টেশনে কিছু খেয়ে নেয়া দরকার ছিল। অল্পক্ষণের ভেতর খিদে পাবে। তখন নদীর পানি ছাড়া কিছুই খেতে পারবে না।

নূর মিয়া তাদের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, খাওয়া-দাওয়া নিয়া কোনো চিন্তা কইরেন না। বসিরহাট বাজারে নৌকা ভিরামু। বাজার সদাই কইরা রান্ধা চাপামু, খাওয়া-দাওয়া শেষ কইরা বেলাবেলি চইল্যা যামু ইন্দারঘাট। একটানের মামলা।

তাহের দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তার কাছে মনে হচ্ছে নূর মিয়া খুব যন্ত্রণা করবে। তাদের প্রতিটি কথায় অংশগ্রহণ করবে। নিজস্ব মতামত দেবে। রান্নাবান্নায় অনেক সময় নষ্ট করার গরিকল্পনাও নূর মিয়ার আছে বলে মনে হচ্ছে।

স্যার, আপনের পরিবার বাংলা কথা কয়?

হুঁ।

ঐ মটর সাইকেলের মেমসোবও বাংলায় কথা কয়। কুমড়া কিনতে গিয়া পরিষ্কার বলছে–কুমড়ার কত দাম?

ঠিক মতো নৌকা চালান নূর মিয়া। বেশি কথা বলার দরকার নেই।

এইটা স্যার আপনার বলা লাগিব না। বেশি কথার মইদ্যে নূর মিয়া নাই। দেশটা নষ্ট হইতাছে অধিক কথার কারণে।

লিলিয়ান ইংরজিতে বলল, আহা বেচারা কথা বলতে এত পছন্দ করে আর তুমি তাকে কথা বলতেই দিচ্ছ না। বলুক না কথা। কী ক্ষতি তাতে? আমার তো ওর কথা শুনতে ভালো লাগছে।

বুঝতে পারছ?

কিছু কিছু পারছি। যতই কথা শুনব ততই আরো বেশি বুঝব।

তুমি এক কাজ কর–নূর মিয়ার সঙ্গে বসে বসে গল্প কর। আমি ঘুমিয়ে পড়ি।

চারদিকে অসহ্য সুন্দর, এর মাঝখানে তুমি ঘুমিয়ে পড়বে?

কাব্যভাব আমার একেবারেই নেই লিলি। আমি মানুষটা পাথর টাইপ। অনুভূতিশূন্য।

আমি কি এই অনুভূতিশূন্য মানুষটির কাছে একটি আবেদন রাখতে পারি?

হ্যাঁ পার।

আমেরিকায় ফিরে গিয়ে কী হবে? চল, আমরা এখানেই থেকে যাই।

তাহের সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, এই জঙ্গলে থেকে যেতে চাও?

হ্যাঁ চাই।

তোমার মাথা থেকে পোকাগুলি দূর কর লিলিয়ান। তুমি আমার গ্রামের বাড়ি দেখতে চেয়েছিলে বলে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। সেখানে আমি থাকব খুব বেশি হলে তিন দিন। তারপর বাংলাদেশের সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলি ঘুরে ঘুরে দেখব–কক্সবাজার, মুরুসিলেট। তারপর যাব নেপাল। হিমালয়-কন্যা নেপাল দেখার পর আমেরিকা ফিরে যাব।

লিলিয়ান ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে শান্তগলায় প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমার একটা অদ্ভুত কথা মনে হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে আমাদের দুজনের কেউই এই জায়গা ছেড়ে কোনোদিন অন্য কোথাও যেতে পারব না। বাকি জীবনটা আমাদের থেকে যেতে হবে এইখানে।

 

তারা ইন্দরঘাটে পৌঁছল সন্ধ্যার পর। কাকতালীয়ভাবেই পূর্ণিমা পড়ে গেছে। চাঁদ উঠেছে, তবে চাঁদের আলো এখনো জোরালো হয় নি। গাছপালায় সব কেমন ভুতুড়ে অন্ধকার। তাহের বলল, হাত ধর লিলিয়ান, বনের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। এক সময় এটা ছিল সুন্দর বাগান। এখন পুরোপুরি ফরেস্ট। হালুম শব্দ করে বাঘ বের হয়ে এলেও অবাক হবো না। এখনো বের হচ্ছে না কেন সেও এক রহস্য।

বাড়ি দেখে লিলিয়ান একই সঙ্গে মুগ্ধ ও দুঃখিত হলো। বিশাল অট্টালিকা, কিন্তু অন্তিম দশা। বাড়ির পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে। দক্ষিণ দিকের দেয়াল ধসে পড়েছে। পুরো বাড়ি ঘন শ্যাওলায় ঢাকা। দোতলায় উঠার সিঁড়ি ভাঙা, বেলিং ধসে গেছে। একতলার বারান্দায় গোবরের স্তুপ দেখে মনে হয় বৃষ্টির সময় এই জায়গা গরু-ছাগলের আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

তাহের বিরস গলায় বলল, বাড়ি দেখলে লিলিয়ান?

হ্যাঁ দেখলাম।

কোনো কমেন্ট করতে চাও?

চাই।

কবে ফেল।

এই বাড়ি আমার চেনা। আমি এই বাড়ি আগে দেখেছি। তোমাকে আমি লোহার প্যাঁচানো সিঁড়ির কথা বলেছিলাম। তুমি বলেছিলে–এরকম সিঁড়ি নেই। সেই সিঁড়ি কি এখন দেখতে পাচ্ছ? স্বপ্নে আমি অবিকল এই সিঁড়ি, এই বাড়ি দেখেছি।

লোহার সিঁড়ি তাহেরের চোখে পড়ল। বাড়ির যে অংশ ধ্বসে পড়েছে সিঁড়ি সেই দিকে। সিঁড়ির গা ঘেঁসে তেঁতুল পাতার মতো চিকন পাতার একটা গাছ। তাহের বলল, আমি এ বাড়িতে খুব ছোটবেলায় থেকেছি। এই কারণেই সিঁড়ি চোখে পড়ে নি। যাই হোক, তুমি দাবি করছি এই বাড়িই তুমি স্বপ্নে দেখেছ?

হুঁ।

স্বপ্নের সব ভাঙা বাড়ি এক রকম হয়।

লিলিয়ান ক্লান্ত গলায় বলল, হয়তো হয়।

 

তাহেরের দূর-সম্পর্কের চাচা ইস্কান্দর আলী, তার দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। হাতে হারিকেন। এই গরমেও ইস্কান্দর আলীর গায়ে চান্দর। পরনের লুঙ্গিটা সিস্কের, চিকচিক করছে। সঙ্গের ছেলে দুটিব গায়ে গেঞ্জি। দুজনেরই শক্ত-সমর্থ চেহারা। এরা কোনো কথা বলছে না, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লিলিয়নের দিকে। তাকানোর ভঙ্গি শালীন নয়। তাহের একবার ভাবল ধমক দিয়ে বলে, এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? বলল না। নিজেকে সামলে নিল। চাচার দিকে তাকিয়ে বলল, বাড়ির অবস্থা তো শোচনীয়।

ইস্কান্দর আলী কাশতে কাশতে বললেন, পুরানা বাড়ি, এর চেয়ে ভালো আর কী হইব? ভাইঙ্গা যে পড়ে নাই এইটাই আল্লাহর রহমত।

ঠিকঠাক করার জন্যে প্রতি মাসে টাকা পাঠাই।

প্রতিমাসে পাঠাও না। মাঝে-মইদ্যে পাঠাও।

অবস্থা যা তাতে মনে হয় না। এ বাড়িতে থাকা যাবে।

থাকতে পারবা। দুইতলার কয়েকটা ঘর পরিষ্কার করাইয়া থুইছি।

থাকা যাবে?

হ, যাবে। সাথের এই মাইয়া কি তোমার ইসাতিরি?

হ্যাঁ।

খিরিস্তান বিবাহ করছ?

হ্যাঁ।

মেয়ে দেখতে সুন্দর আছে। বিবাহ করছ ভালো করছি। খিরিস্তান বিবাহ করা জায়েজ আছে। নবী করিম নিজেও একটা খিরিস্তান মেয়ে বিবাহ করেছিলেন।

বাবুর্চির ব্যবস্থা করতে লিখেছিলাম। ব্যবস্থা করেছেন?

গোরাম দেশে বাবুর্চি কই পামু? আমার ঘরে রান্ধা হইব। টিফিন বাক্সে কইবা তোমরারে খানা দিয়া যাব। তোমরা থাকবা কয় দিন?

এখনো বলতে পারছি না।

ডাকাইতের খুব উপদ্রব। বেশি দিন না থাকনই ভালো।

আমার সঙ্গে আছে কী যে ডাকাত নেবে?

তোমার ইসাতিরিরে নিয়া যাবে। সুন্দর মেয়েছেলে–হইলদা চামড়া, বিলাতি। ডাকাইতরা খুশি হইয়া তোমার ইসাতিরিরে নিয়া যাবে।

আপনি কি আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছেন?

তোমারে ভয় দেখাইয়া আমার ফয়দা কী? তোমার স্ত্রী মাছ-ভাত খায়, না পাউরুটি খায়?

মাছ-ভাত খায়।

শুয়োরের গোশত খায়?

তাহের ক্ষিপ্ত গলায় বলল, খেলে কী কববেন? শুয়োরের গোশত ব্যবস্থা করবেন?

রাগ হও ক্যান? কথার কথা বললাম। তোমার ইসাতিরি দেখি হাসন্তাছে। সে বাং কথা বুঝে?

তাকেই জিজ্ঞেস করুন।

একলা একলা বাড়িতে ঢুকতেছে, তারে নিয়েধ করা।

নিষেধ করতে হবে না। তার বুদ্ধিাশুদ্ধি আছে।

লিলিয়ান হারিকেন হাতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠছে। মনে হচ্ছে এটা তার অনেকদিনের চেনা বাড়ি।

ইস্কান্দর আলী থু করে তাহেরের পায়ের কাছে একদলা থুথু ফেললেন। তাহের চমকে সরে গেল। ইস্কান্দর আলী হাই তুলতে তুলতে বললেন, খাওয়ার জইন্যে কিছু খরচ দিও। জিনিসপত্র অগ্নিমূল্য। মাছ এক জিনিস পাওয়াই যায় না। একটা মুরগির বাচ্চা হেব দামই তোমার চল্লিশ, পঞ্চাশ।

তাহের দুটা পাঁচশ টাকার নোট বের করল। তিনি বিরসমুখে নোট দুটা হাতে নিলেন। তাহের বলল, উত্তর দিকে ভাঙা দেয়াল ঠিক করার জন্যে টাকা চেয়েছিলেন। পাঠিয়েছিলাম। দেয়াল তো ঠিক হয় নি।

বললেই ঠিক হয় না। ইট, সুরকি, সিমেন্ট আনাইতে হয় শহর থাইক্যা। বর্ষা মৌসুমে নৌক দিয়া আনতে হয়। বিরাট যন্ত্রণা।

টাকাটা কী করেছেন?

আছে, টাকা আলাদা করা আছে।

বাড়িটার এ কী অবস্থা! ভূতের বাড়ি বলে মনে হচ্ছে। আলোর কোনো ব্যবস্থা করেছেন?

দুইটা হারিকেন আছে। মোমবাতি আছে।

একটা টর্চের ব্যবস্থা করুন।

আইচ্ছা করব। বললেই তো হয় না। সব আনতে হয়। শহর থাইক্যা। তোমরারে একটা উপদেশ দেই,–দোতলায় থাকবা। একতলায় নামনের প্রয়োজন নাই।

কেন?

সাপের উপদ্রব। গত চইত মাসে সাপের কামড়ে একটা গরু, মারা গেল।

কার্বলিক এসিডেব ব্যবস্থা করতে পারবেন? এখানে কোনো ফার্মেসি আছে?

না। তুমি বললে ছেলে একটারে শহরে পাঠাইতে পারি। এরা কিছুই করে না। বাদাইম্যা হইছে। শহরে যাইতে বললে ফাল দিয়া উঠে।

দিন, কাউকে পাঠিয়ে দিন।

যাওনের খরচ দেও। আন কী আনা লাগব কাগজে লেইখ্যা দেও। সাপের ওষুধ?

ওষুধে কিছু হয় না–কপালে লেখা থাকলে ওষুধের বোতলের ভিতরে বসা থাকলেও সাপে কামরাইব।

আমি কাগজে লিখে দিচ্ছি। দয়া করে আনাবার ব্যবস্থা করুন। একশ টাকা দিচ্ছি। যাওয়ার খরচ। এতে হবে?

আরো কিছু দেও। একশ টেকা আইজ-কাইল কোনো টেকাই না। তুমি থাক বিদেশে। এই জন্যে বুঝতাছ না। আর একটা কথা, তোমার পরিবাররে নিয়া আমরার বাড়িত একদিন যাওয়া লাগে। বাড়ির মেয়েছেলেরা দেখতে চায়। এরা আবার কার কাছ থাইক্যা জানি হুঁনছে–বিলাতের মাইয়াছেলে পিসাব পায়খানার পরে পানি নেয় না। বড় ঘিন্নাকর, কিন্তু কী আর করা! যে দেশে যে নিয়ম! তোমার আমার কারণের কিছু নাই।

তাহের বিরক্তমুখে বলল, ঠিক আছে আপনি এখন যান। রাতে খাবার পাঠিয়ে দেবেন। খাবার পানি পাঠাবেন।

আইচ্ছা। তোমরা নিশ্চিত হইয়া ঘুমাও। ছেলে দুইটারে বইল্যা দিছি। রাইতে পাহারা দিতে। এরা কাজকাম কিছুই করে না। বাদাইম্যা। যে কয়দিন থাকবা এরা পাহারা দিব। কিছু খরচ-বরচ দিও।

তাহের দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।

লিলিয়ান হারিকেন হাতে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। ইক্কান্দর আলী দোতলার জানালার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার ইসাতিরি বড়ই সৌন্দৰ্য। এইটা বিপদের কথা। ডাকাইতে সন্ধান পাইলে বড়ই খুশি হইব। ইস্কান্দর আলীর দুই ছেলেও গভীর আগ্রহ নিয়ে দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে পলক পড়ছে না।

লিলিয়ান বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে বলল, উপরে চলে আস। দোতলাটা অসম্ভব সুন্দর। মার্বেল পাথরের মেঝে।

 

লিলিয়ানের খুব ভালো লাগছে। সে হারিকেন হাতে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাচ্ছে। তার ভাবভঙ্গি কিশোরীর মতো। যে ঘরে আজ রাতে তারা থাকবে সেই ঘর দেখে সে মুগ্ধ। বিশাল দুটা জানালা। জানালার পাশে দাঁড়ালেই দূরের ব্ৰহ্মপুত্র দেখা যায়। নদীতে চর পড়েছে। চারের ধবধবে সাদা বালি চাদের আলোয় চিকচিক করছে। কী হাওয়া! উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। শোবার ঘরটা কী প্ৰকাণ্ড! যেন ফুটবল খেলাব মাঠ। মাঠেব মাঝখানে খাট পাতা হয়েছে। কালো রঙের একটা খাট, যার চারদিকে রেলিং দেয়া। খাটে সরাসরি উঠার উপায় নেই, এত উঁচু। টুলে পা দিয়ে উঠতে হয়। ঘর ভর্তি ভারী ভারী আলমিরা। লিলিয়ান প্রতিটি আলমিরা খুলে দেখল। সব শূন্য। খাটের মাথার কাছে গোল শ্বেত-পাথরের টেবিল। এ বাড়ির অনেক দরজা-জানালা লোকজন খুলে নিয়ে গেছে। এগুলি নেয় নি কেন?

লিলিয়ান বলল, এই টেবিল, এই খাট যে-কোনো মিউজিয়াম লুফে নেবে। মনে হচ্ছে হাজার বছরের পুরনো।

লিলিয়ানের মুগ্ধতা তাহেরকে স্পর্শ করছে না। সে বেশ ক্লাস্ত। বারান্দায় রাখা বালতির পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে সে বিছানায় বিরসমুখে বসে আছে। এ বাড়িতে রাত্রিযাপন ঠিক হবে কি-না তা বুঝতে পারছে না। সাপের ব্যাপারটা তাকে চিন্তিত করছে।

লিলিয়ান বলল, কথা বলছি না কেন?

কী বলব?

তোমাদের এইসব ফার্নিচারের বয়স কত?

তাহের হাই তুলতে তুলতে বলল, এদের বয়স দুশ বছরের মতো। সবই আমার দাদার বাবা বানিয়েছিলেন। খাটটা বাৰ্মা থেকে কেনা। এই যে বাড়ি দেখছ, এই বাড়িও উনার করা।

খুব ধনী মানুষ ছিলেন?

হতদরিদ্র ছিলেন। পরের বাড়িতে কামলা খাটতেন। সুপারির ব্যবসা করে ধনী হন। মাত্ৰ চল্লিশ বছর বয়সে তিনি লাখের বাতি জ্বলিয়েছিলেন।

লাখের বাতিটা কী?

আমাদের অঞ্চলে নিয়ম ছিল–কেউ লাখপতি হলে লাখের বাতি জ্বালাতে হতো। একটা লম্বা বাঁশের মাথায় হারিকেন জ্বলিয়ে ঘরের উঠানে রেখে দিত। এই হলো লাখের বাতি। দূর থেকে দেখে লোকজন বুঝত এই অঞ্চলে একজন লাখপতি আছে।

এই নিয়ম কি এখনো আছে?

পাগল হয়েছ? এই নিয়ম থাকলে উপায় আছে? আজ কোনো বাড়িতে লাখের বাতি জুলালে কালই ডাকাতি হবে। সেই বাড়িতে যদি তোমার মতো রূপবতী কেউ থাকে তাহলে তো কথাই নেই।

আমার মনে হয় এ বাড়িতে এসে তোমার ভালো লাগছে না।

এখন পর্যন্ত ভালো লাগার মতো কোনো কারণ ঘটে নি।

আমার কাছে কিন্তু অসাধারণ লাগছে।

ভাঙা বাড়ি অসাধারণ লাগছে?

পুরনো বাড়ি ভাঙা তো থাকবেই। এই অঞ্চলের জন্যে পুরনো বাড়ি সুন্দর মানিয়ে গেছে। ঝকঝকে নতুন বাড়ি এখানে মানাতো না। আমি এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাচ্ছি। আর গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে।

ভয়ে?

না ভয়ে না। মনে হচ্ছে এই ঘরগুলিতে কত না স্মৃতি, কত বহস্য–আমি ঠিক করেছি আজ। সারারাত ঘুমুব না।

হারিকেন হাতে এক ঘর থেকে আবেক ঘরে ঘুরবে?

হ্যাঁ।

খুব ভালো কথা। ঘুরে বেড়াও। দয়া করে আমাকে ঘুমুতে দিও। আমি খুব ক্লান্ত হয়ে আছি। ডিনার শেষ হওয়া মাত্র শুয়ে পড়ব।

লিলিয়ান বলল, তুমি আমাকে ক্ৰমাগত মশার ভয় দেখিয়েছ। মশা কিন্তু নেই।

তাই দেখছি। তবে ঘুমুতে হবে মশারি খাটিয়ে। মশা না থাকুক, পোকামাকড় আছে।

আজ রাতে না ঘুমুলে কেমন হয়?

কী বললে?

চল আমরা বারান্দায় বসে জোছনা দেখি।

আর কোনো পরিকল্পনা আছে?

আমার খুব শাড়ি পরতে ইচ্ছা করছে। সুন্দর একটা শাড়ি জোগাড় করতে পারবে? আমাকে শিখিয়ে দেবে কী করে পরতে হয়?

তোমার কি মনে হয় না লিলিয়ান তুমি বাড়াবাড়ি করছ?

না, আমার মনে হয় না।

আমার কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি বাড়াবাড়ি করছি।

লিলিয়ান কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার এরকম মনে হয়ে থাকলে আমি দুঃখিত। আমার যা মনে হয়েছে। আমি তোমাকে বলেছি। তোমাদের এই বাড়িটা ভাঙা। দরজা-জানালা লোকজন খুলে নিয়েছে। তারপরেও এ বাড়িতে পা দেয়ার পর থেকে আমার ভালো লাগছে। এক ধরনের আনন্দ অনুভব করছি। সেই আনন্দ লুকানোর চেষ্টা করি নি। হয়তো সেটা করাই উচিত ছিল।

লিলিয়ান বারান্দায় চলে গেল। তার খুব খারাপ লাগছে। চোখে পানি এসে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখলে তাহের হেসে উঠতে পারে। লিলিয়ান চোখের পানি দিয়ে তাহেরকে হাসাতে চায় না। লিলিয়ান একটা ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে লাগল। তার কাছে কেন জানি মনে হচ্ছে, ঘরগুলি তাকে ডেকে ডেকে বলছে, এসো লিলিয়ান, এসো। আমাকে দেখে যাও।

তাহের এসে লিলিয়ানকে আবিষ্কার করল সর্বদক্ষিণের বারান্দায়। এখান থেকেই লোহার সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে।

লিলিয়ান!

কী?

তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ?

না।

মনে হচ্ছে তুমি রাগ করেছ। আসল ব্যাপার কী জানো, আমার চাচার সঙ্গে কথা বলে মেজাজ হয়েছে খারাপ। কিছুই ভালো লাগছিল না। এই কারণেই তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। কিছু মনে করো না।

আমি কিছু মনে করি নি।

খাওয়া-দাওয়াব পর আমরা ছাদে বসে জোছনা দেখব।

ছাদে উঠার সিঁড়ি আছে?

হ্যাঁ, সিড়ি আছে। তালাবন্ধ। চাচার ছেলেটাকে পাঠিয়েছি। চাবি আনতে।

থ্যাংক ইউ।

তোমার খিদে পেয়েছে লিলিয়ান?

এখনো খিদে পায় নি।

একটা বিরাট ভুল হয়েছে। ওদের বলে দেয়া উচিত ছিল মসলা কম দিতে। এরা প্রচুর মসলা দিয়ে রান্না করবে। ঝালের জন্যে কিছু মুখে দিতে পারবে না।

আমার খাওয়া নিয়ে ভেবো না। তুমি যা খেতে পারবে, আমিও পারব।

সব ঘর দেখা হয়েছে?

হ্যাঁ।

আয়নাঘর? আয়নাঘর দেখেছ?

না তো। আয়নাঘর কী?

ওটা একটা ইন্টারেস্টিং ঘর। আমার দাদার বাবা–দি গ্রেট জাঙ্গির মুনশি, এই ঘর বানিয়েছিলেন। তালাবন্ধ কি-না জানি না। তালাবন্ধ থাকার কথা। চল দেখি–খুঁজে বের করতে হবে–কোন দিকে তাও জানি না।

ঘরটা তালাবন্ধ। বেশ বড় তালা ঝুলছে। কয়েকবার ঝাঁকি দিতেই তালা খুলে গেল। অনেকদিন বন্ধ থাকায ঘরে ভ্যাপসা জলজ গন্ধ। ছোট্ট ঘর, কোনো জানালা নেই। ঘরে ঢোকার একটিই দরজা। সেই দরজা ও নিচু। ঘবেব একদিকের পুবো দেয়াল জুড়ে বিশাল আয়না। অন্য পাশে কাবার্ড।

লিলিয়ান বলল, এত বড় আয়না কোথায় পেলেন?

তাহের হাসতে হাসতে বলল, জানি না কোথায় পাওয়া গেছে। দি গ্রেট জাঙ্গির মুনশি জোগাড় করেছিলেন সাহেব বাড়ি থেকে। অর্থাৎ ইংরেজদের কাছ থেকে। এই ঘরটাব নাম হলো আয়নাঘব। জাঙ্গির মুনশির স্ত্রী তিতালী বেগম এই ঘরে সাজগোজ করতেন। সাজের সময় বাইরের কেউ যেন দেখতে না পায় এ জন্যেই এ-ঘরের কোনো জানালা নেই। লক্ষ করেছ?

হ্যাঁ, লক্ষ করেছি।

ঐ মহিলা অসম্ভব রূপবতী ছিলেন। তিনি তার একমাত্র পুত্রের জন্মদিনে মারা যান। মাত্র ষোল বছর বয়সে।

আহা।

আয়নাঘর উনার খুব প্রিয় ছিল। উনি যখন মোটামুটি নিশ্চিত হলেন যে মারা যাচ্ছেন তখন তিনি তার স্বামীকে বলেন তাকে আয়নাঘরে নিয়ে যেতে। তাই করা হলো। তিনি মারা গেলেন আয়নাঘরে। জঙ্গিব মুনশি দ্বিতীয়বার বিয়ে কবেন নি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি প্ৰায় চল্লিশ বছর বেঁচে ছিলেন। এই চল্লিশ বছর তিনি আয়নাঘর বন্ধ করে রেখেছিলেন। একদিনের জন্যেও খুলেন নি। উনার মৃত্যুর পর আয়নাঘর প্রথম খোলা হয়। এসো লিলিয়ান, খুব সম্ভব খাবার নিয়ে এসেছে। খেয়ে নেই। খিদে লেগেছে। তাছাড়া আমার বেশিক্ষণ থাকা ঠিকও নয়। আযানাঘরে কোনো পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ।

তুমি যাও। আমি এই ঘরে একটু একা একা থাকি।

কেন বলে তো?

দিচ্ছে–দেখ, দেখ।

তাহের বিস্মিত হয়ে বলল, হ্যাঁ দেখলাম। কারণটা কী?

প্ৰায় দেড়শ বছর আগে এই বাড়ির বউ এক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখেছিল। আজ আমি নিজেকে দেখছি। আমিও এই বাড়িরই বউ। এই আয়নাটা আমার।

তাহের বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল। লিলিয়ান বলল, আমি যখন অসুস্থ হয়ে পড়ব তখন তুমি আমাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসবে। আমি চাই আমার মৃত্যু যেন আয়নাঘরে হয়।

সে তো অনেক দূরের ব্যাপার। আপাতত ভাত খাই চল।

প্লিজ, প্লিজ, আমি খানিকক্ষণ এখানে একা থাকব। খুব অল্প কিছুক্ষণ।

তাহের চিন্তিতমুখে বের হয়ে এলো। লিলিয়ান তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে। তাহের লিলিয়ানের কাণ্ডকারখানা কিছুই বুঝতে পারছে না।

রান্নার আয়োজন ভালো। রুই মাছ ভাজা। পোলাও কোরমা। এক বাটি পায়েস। লিলিয়ানের জন্যে একটা কাটা চামচও দেয়া হয়েছে। তবে পোলাও সিদ্ধ হয় নি–চাল চাল রয়ে গেছে। কোরমা রান্না হয়েছে প্রচুর পরিমাণে চিনি দিয়ে। খেতে রসগোল্লার মতো লাগছে। তাহের বিরক্তমুখে বলল, ভাজা মাছ খেয়ো না লিলিয়ান। মাছটা পচা বলে ভেজে ফেলেছে।

খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে পানটাই আরাম করে খাওয়া গেল। মীেবী দিয়ে সুন্দর করে বানানো। লিলিয়ান দুটা পান মুখে দিল। সে বিস্মিত হয়ে বলল, খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে তোমরা ভেজিটেবল খাও কেন তা তো বুঝলাম না।

তাহের বলল, এটা ভেজিটেবল না। এর নাম পান। খাবার পর খেতে হয়। কুৎ করে গিলে ফেললে হবে না। ক্রমাগত চিবিয়ে যাবে। গিলতে পারবে না।

কতক্ষণ চিবাবো?

আধঘণ্টা তো বটেই।

তাতে লাভ কী?

মুখের একটা একসারসাইজ হয়। এইটুকুই লাভ।

ঠাট্টা করছ?

মোটেই ঠাট্টা করছি না। তুমি কি ভেবেছ আমার কাজ শুধু ঠাট্টা করা?

জিনিসটা খেতে আমার ভালো লাগছে।

ভালো লাগলে খাও। আমাদের গ্রামের নতুন বউদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের একটি হচ্ছে পান খেয়ে ঠোঁট লাল করা।

আমি তো নতুন বউ না।

অবশ্যই নতুন বৌ। ছেলেমেয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমাদের দেশের বউদের নতুন বউ ধরা হয়।

কোনো মহিলার দশ বছরেও যদি ছেলেমেয়ে না হয় তাহলে কি তাকে নতুন বউ ধরা হবে?

না। তখন তাকে বলা হবে বাঁজা-মেয়েমানুষ। অমঙ্গলজনক একটি ব্যাপার। সেই মেয়েকে কোনো উৎসবে ডাকা হবে না। সকালবেলা কেউ তার মুখ দেখতে চাইবে না।

তোমাদের নিয়ম-কানুন ভারী অদ্ভুত।

অদ্ভুত তো বটেই। আরো অদ্ভুত কথা শুনবে? আমাদের দেশে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে পাশাপাশি বসে পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকাবে না।

তাকালে কী হয়?

তাকালে তাদের যে সন্তান হবে সে হবে চরিত্রহীন।

আবার তুমি তামাশা করছি। কী জন্যে করছ তাও বুঝতে পারছি। তুমি আমার সঙ্গে &জাছনা দেখতে চাচ্ছ না।

জোছনা দেখতে অসুবিধা নেই। চাঁদের দিকে না তাকালেই হলো।

ছাদে সত্যি সত্যি বসবে। আমার সঙ্গে?

হুঁ বসব। তবে ছাদে না। বারান্দায়। তোমার বিখ্যাত চাঁদ বারান্দা থেকেও দেখা যায়। চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি যদি মুগ্ধ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি কিছু মনে কবো না। ঘুমিয়ে পড়ার সম্ভাবনা নিরানব্বই দশমিক নয় ভাগ।

ইস্কান্দর আলীর মেজো ছেলে বারান্দা ঝাঁট দিচ্ছে। তাহের তাকে বারান্দায় চাদর পাততে বলেছে। এই ছেলেই খাবার নিয়ে এসেছে। বাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে এনেছে। তার বুদ্ধি কোন পর্যায়ের তাহের এখনো ধরতে পারছে না। সে টর্চ কিনে এনেছে, কিন্তু ব্যাটারি আনে নি।

তোমার নাম কী?

ছালাম।

ছালাম না। সালাম?

ছালাম। ছালাম আলী।

ছালাম তোমাকে টর্চের ব্যাটারি। আনতে যেতে হবে, পারবে না?

হুঁ।

দোকান কি অনেক দূর?

হুঁ।

দূর হলে থাক, সকালে এনে দিও।

ছাইকেল আছে।

সাইকেল থাকলে সাইকেলে করে নিয়ে এসো।

তারা ঘুমুতে গেল রাত দুটায়। তাহের বলল, হারিকেন জ্বালানো থাকুক। লিলিয়ান বলল, হারিকেন জ্বালানো থাকলে ঘরে চাঁদের আলো আসবে না। তাহের বলল, তোমার ভেতর এত কাব্যভাব আছে তা কিন্তু আমার জানা ছিল না।

জানা থাকলে কী করতে, আমাকে বিয়ে করতে না?

তাহের হাসল। হাসতে হাসতে বলল, চা খেতে ইচ্ছা করছে। আমার সমস্যা হচ্ছে ঘুমের প্রথম ধাক্কাটা কেটে গেলে ঘুম আসে না। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, বাকি রাতটা তুমি আরাম করে ঘুমুবে, আর আমাকে জেগে থেকে তোমার বিখ্যাত জোছনা দেখতে হবে।

চা সত্যি খেতে চাও? আমার কাছে টি-ব্যাগ আছে, সুগার কিউব আছে। শুধু দুধ নেই।

পানি গরম করবে। কীভাবে?

কাগজ জ্বলিয়ে পানি গরম করব।

কাগজ পাবে কোথায়?

তুমি ডার্টি জোকস-এর যে বইটি এনেছ, সেটা পুড়িয়ে ফেলব। বানাব চা?

মন্দ না। পারলে বানাও।

তুমি চুপচাপ বিছানায় বসে থাক। আমি চা বানিয়ে আনছি।

আমি তোমার পাশে বসি।

লিলিয়ান চায়ের পানি গরম করছে। পাশে বসে আছে তাহের। তার ঘুম কেটে গেছে বলে মনে হচ্ছে না। সে খানিকক্ষণ পরপর হাই তুলছে। লিলিয়ান বলল, তুমি ঐ মহিলা সম্পর্কে আরো কিছু বলে।

কোন মহিলা?

আয়নাঘরে যিনি মারা গিয়েছিলেন।

আমি কিছুই জানি না। খুব রূপবতী ছিলেন, এইটুকু জানি। জাঙ্গির মুনশি বেনারস থেকে একজন আর্টিস্ট এনে তার কিছু ছবি আঁকিয়েছিলেন। সেইসব ছবি দেখলে তার সম্পর্কে আন্দাজ পেতে। তবে ছবিও নেই। উনার মৃত্যুর পর জাঙ্গিব মুনশি তাঁর স্ত্রীর  সব ছবি পুড়িয়ে ফেলেন।

লিলিয়ান কোমল গলায় বলল, উনাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।

তাহের চা খাচ্ছে। কাচের গ্লাসে চা দেয়া হয়েছে। গ্লাস গবাম হয়ে গেছে–চা খাওয়া যাচ্ছে না। তাহের চায়ের গ্লাসে ফুঁ দিতে দিতে বলল, আমার মাব। ধাবণ উনি একবার তিতিলী বেগমকে দেখেছিলেন।

উনি দেখবেন কীভাবে?

মার ধারণা, দেখেছেন। গভীর রাতে আয়নাঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন, হঠাৎ শুনেন আয়নাঘরের ভেতর থেকে ঝুনঝুন চুড়ির শব্দ। আয়নাঘর তালাবন্ধ। চুড়ির শব্দ কীভাবে আসবে? মা খুব অবাক হলেন। উনার সাহসের সীমা ছিল না। চাবি নিয়ে আয়নাঘর খুললেন। মোমবাতি হাতে একা একা আয়নাঘরে ঢুকলেন।

তারপর?

তারপরের ব্যাপার পরিষ্কার জানা যায় না। মা কিছু একটা দেখেছিলেন। কী দেখেছিলেন কিছুই ভেঙে বলেন নি। এরপর থেকে তার অভ্যাস হয়ে গেল।–গভীর রাতে আয়নাঘরের দরজা খুলে সেখানে ঢুকতেন। অনেকক্ষণ থাকতেন। আয়নাঘরের মেঝেতে পাটি পেতে দুপুরে ঘুমুতেন। আমার বাবা জানতে পেরে খুব রাগ করেন। বাবার ধারণা, এই বাড়িটা অভিশপ্ত। এ বাড়িতে থাকলে অকল্যাণ ছাড়া কল্যাণ হবে না। তিনি মাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান।

কোথায় যান?

প্রথম ময়মনসিংহ শহরে যান। সেখান থেকে যান ঢাকায়। ঢাকায় যাবার পর থেকে মার মাথায় পাগলামি ভর করে। তিনি রাতে একেবারেই ঘুমুতেন না। ছটফট করতেন। আর বলতেন— ঐ বাড়ি ফেলে এসেছি, উনি খুব রাগ করছেন। খুব মন খারাপ করছেন। উনার কত শখ বাড়ি ভর্তি থাকবে ছেলেমেয়েতে। তারা হৈচৈ করবে, চেঁচামেচি করবে।

উনি মানে কে? তিতালী বেগম?

হুঁ। মা খুব কান্নাকাটি শুরু করেন বাড়ি যাবার জন্য। বাবা পাত্তাই দেন নি। বাবা বলতেন–ঐ বাড়িতে থাকার জন্যেই তোমার মাথার দোষ হয়েছে। আমি ওখানে তোমাকে নিয়ে যাব না। বাবা নিয়ে যান নি। মার মৃত্যু হয় ঢাকায়।

তোমার কি মনে হয় না তোমার বাবা ভুল করেছিলেন?

না, মনে হয় না। বাবা যুক্তিবাদী মানুষ ছিলেন। মাব মনের ভ্রান্তিকে তিনি আমল দেন নি। তুমি নিশ্চয়ই মনে কর না আয়নাঘরে একজন মৃত মানুষ বাস করে।

জগৎ বড়ই রহস্যময় তাহের।

জগৎ মোটেই রহস্যময় নয়। জগৎ কঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলায় বাঁধা। প্রকৃতি কখনো কোনো নিয়মের ব্যতিক্রম হতে দেয় না। রহস্যের বাস মানুষের মনে। মানুষই রহস্য লালন করে। যেমন তুমি কর। কত আয়োজন করে জোছনা দেখলে। জোছনার যে সৌন্দর্য তার সবটাই তুমি আরোপ কবেছ। জোছনা কী? সূর্যের প্রতিফলিত আলোএকে নিয়ে মাতামাতি করার কিছু নেই। কিন্তু তুমি মাতামাতি কবিছ। তোমার মতো অনেকেই করছে। কবিতা লেখা হচ্ছে। গান লেখা হচ্ছে–আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে… ।

 

লিলিয়ান বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। ছালাম সব কাজ ফেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লিলিয়ানের দিকে। লিলিয়ান বাংলায় বলল, আপনাদের পাঠানো খাবার উত্তম হয়েছে। পান খুবই উত্তম হয়েছে। ছালাম কিছু বলছে না। তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে লিলিয়ানের কোনো কথা তার কান দিয়ে ঢুকছে না। লিলিয়ান বলল, আমি আমাদের এই বাগান প্ৰাতঃকালে পরিচ্ছন্ন করব। আমি কিছু লেবার নিয়োগ করব। দয়া করে আমাকে সাহায্য করবেন। আপনি কি আমার বাংলা ভাষা বুঝতে পারছেন?

ছালাম কিছু বলল না। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল। তাহের বলল, বিদেশী উচ্চারণে তোমার অদ্ভুত বাংলা সে কিছুই বুঝে নি। বোঝাব চেষ্টাও করে নি। আমিই বুঝতে পারি না, আর বুঝবে ছালাম আলী! সে হা করে তাকিয়ে ছিল তোমার দিকে। যাই হোক, এসে বসো এখানে। জোছনা দেখ।

লিলিয়ান বসল। তাহের হাই তুলতে তুলতে বলল, কাঁপাচিনো কফি খেতে পারলে ভালো হতো। যা ঘুম পাচ্ছে বলার না। চাঁদটাকে ঘুমের ট্যাবলেটের মতো লাগছে। যতই দেখছি ততই ঘুম পাচ্ছে। ভালো কথা, জঙ্গল পরিষ্কারের কথা কী বলছ? এইসব মাথা থেকে দূর করা।

না, দূর করব না। আমি বাগান পরিষ্কার করব। বাড়ি ঠিকঠাক করব। আমাদের এত সুন্দর বাড়ি এভাবে পড়ে থাকবে?

সুন্দর দেখলে কোথায়?

আমার কাছে খুব সুন্দর লাগছে।

আচ্ছা ধরে নিলাম সুন্দর। কে থাকবে তোমার এই সুন্দর বাড়িতে?

আমরা দুজন থাকব। আমাদের ছেলেমেয়েরা থাকবে। এরা বাগানে খেলবে। আমি এদের জন্যে দোলনা বানিয়ে দেব। জোছনা রাতে বাচ্চাদের হাত ধরে আমরা নদীর পারে। হাঁটব। আর একটা বড় নৌকা কিনব। নদীর ঘাটে নৌকা বাধা থাকবে।

তাহের হাসতে হাসতে বলল, কী বলছি পাগলের মতো?

আমার মনের ইচ্ছার কথা তোমাকে বলছি।

লোকালয় ছেড়ে আমরা বনে পড়ে থাকব?

হ্যাঁ।

তোমার কী হয়েছে বলো তো লিলিয়ান?

বুঝতে পারছি না।

আমার মনে হয় ঘুমের অভাবে তোমার চিন্তাশক্তি এলোমেলো হয়ে গেছে। ভালো করে ঘুমাও–দেখবে মাথা থেকে ভূত নেমে গেছে। চল শুয়ে পড়ি।

তুমি শুয়ে পড়। আমি খানিকক্ষগ বসি।

আচ্ছা বসো, আমি তাহলে এখানেই শুয়ে থাকি। তোমার যখন জোছনা দেখা শেষ হবে, আমাকে ডেকে দিও।

একটুক্ষণ জেগে থাক না। আমার খুব গল্প করতে ইচ্ছা করছে।

তাহের হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি জেগে থাকার চেষ্টা করছি। তুমি গল্প শুরু কর। আমার পক্ষে গল্প করা সম্ভব না। আমার পক্ষে যা সম্ভব তা হচ্ছে হাই তোলা। ঐ কাজটা আমি দায়িত্বের সঙ্গে করে যাচ্ছি।

তাহের দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল। মনে হচ্ছে সে ঘুমিয়ে পড়েছে।

লিলিয়ান গলার স্বর হঠাৎ অনেকখানি নিচে নামিয়ে বলল, আমি তোমাকে কতখানি ভালোবাসি তা কি তুমি জানো?

তাহের চোখ না মেলেই বলল, জানি।

কীভাবে জানো?

বলতে চাচ্ছি না। বললে তুমি লজ্জা পাবে।

আমি লজ্জা পাব না। তুমি বলো। আমার শুনতে ইচ্ছে করছে।

তোমার শুনতে ইচ্ছা করলেও, আমার বলতে ইচ্ছা করছে না। আমার ঘুমুতে ইচ্ছা! করছে। আমি কি তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তে পারি?

হ্যাঁ পার। আমি সারারাত কিন্তু এখানেই বসে থাকব! তুমি এইভাবেই ঘুমুবে।

তোমার মধ্যে পাগলামির বীজ আছে লিলিয়ান। আমার ধারণা বেশ ভালো মতো আছে।

লিলিয়ান হালকা গলায় বলল, হয়তো আছে। এই মুহুর্তে আমার মনে হচ্ছে কী জানো? আমার মনে হচ্ছে এই যে–তুমি আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছএকজন কেউ তা দেখছে। খুব আনন্দ নিয়ে দেখছে।

সেই একজন কেউটা কে? ভূত-প্ৰেত?

বুঝতে পারছি না, তবে তার উপস্থিতি অনুভব করছি।

এ বাড়িতে তোমাকে বেশিদিন রাখা ঠিক হবে না। তোমার ব্ৰেইন পুরোপুরি নষ্ট হবার আগেই আমাদের চলে যেতে হবে।

ছালাম উঠে এসেছে। তাহের লিলিয়ানোবা কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে দেখেও সে অস্বস্তি বা লজ্জা কোনোটাই বোধ করল না। শুকনো গলায় তাহেরকে বলল, প্যাটারি আনছি।

তাহের তাকিয়ে দেখল। ছালাম দুটি পেনসিল ব্যাটারি নিয়ে এসেছে। তাহেরের কেন জানি মনে হলো সে এটা নিবুদ্ধিতার কারণে করে নি। ইচ্ছা করে করেছে।

আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যাও।

আর কিছু লাগব?

না, আর কিছু লাগবে না।

লিলিয়ান বলল, আজ হঠাৎ তুমি এত গুছিয়ে কথা বলছ কেন? এত লজিক দিয়ে তুমি কখনো কথা বলো না।

তা বলি না, আজ বলছি। কারণ স্মামাব মনে হচ্ছে তোমার নিজস্ব জগতে লজিকের স্থান খুব কম। তোমার লজিক ভালো থাকলে কখনো আমাকে বিয়ে করতে না। আর কবলেও ভালো মতো খোঁজখবর করতে–আমি কে? আমার বাবা-মা কোথাব্য, কভাই বোন… ? কোনো প্রশ্ন না, কোনো কৌতুহান না–স্বপ্নে পাওয়া মানুষের মতো বলে বসলে–আমি আমার জীবনটা তোমার সঙ্গে কাটাতে চাই।

আমি কি ভুল করেছি?

তুমি ভুল করেছ কি-না তা আমি এই মুহূর্তে বলতে পারব না। তুমি নিজেও বুঝবে না। আজ থেকে দশ বা পনের বছর পর ধরতে পারবে।

কীভাবে ধরব?

আমাকে বিয়ে করার সময়, আমার সম্পর্কে তোমার কিছু প্ৰত্যাশা ছিল। আমি যদি তা মেটাতে পারি তাহলে বুঝতে হবে আমাকে বিয়ে করে তুমি ভুল কর নি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমি নিজে এখনো জানি না কোন প্ৰত্যাশা নিয়ে তুমি আমাকে বিয়ে করেছি। জানলে মেটাবার চেষ্টা করতাম।

তোমার প্রতি আমার কোনো প্ৰত্যাশা নেই। আমাকে তোমার পাশে থাকতে হবেএটা হলো নিয়তি।

তাহের সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, নিয়তি হচ্ছে আরেকটা বাজে কথা। যারা দুর্বল মানুষ, অর্থাৎ যারা দুর্বল লজিকের মানুষ–নিয়তি তাদের একটি প্রিয় শব্দ। এই শব্দ আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত। অভিধান থেকে এই শব্দ তুলে দেওয়া উচিত।

লিলিয়ান কোমল গলায় বলল, পৃথিবীর সব ভাষার অভিধানে কিন্তু এই শব্দটি আছে। নিয়তি বলে কিছু একটা আছে বলেই আছে।

তাহের রাগী গলায় বলল, তুমি একটা হাস্যকর লজিক দিলে লিলিয়ান। অভিধানে দৈত্য শব্দটাও আছে। পরী আছে, ড্রাগন আছে, মৎস্যকন্যা আছে। তুমি কি কখনো দৈত্য, পরী বা ড্রাগন দেখেছ? পৃথিবীর কেউ কি দেখেছে?

না, দেখে নি। এত রেগে যাচ্ছ কেন? চল ঘুমুতে যাই।

তাহের মুখে বলছিল তার ঘুম ছুটে গেছে, বাস্তবে দেখা গেল বিছানায় শোয়ামাত্র তার নাক ডাকতে শুরু করেছে। হারিকেন নিভিয়ে লিলিয়ান এসে পাশে শুয়েছে। তার ঘুম আসছে না। জানালা গলে জোছনা এসে পড়েছে তাদের খাটের এক মাথায়। কী সুন্দর যে লাগছে দেখতে! বাইরের বাগানে পাখি ডাকছে। লিলিয়ান কোন বইয়ে যেন পড়েছিল রাতে কখনো পাখি ডাকে না। বইয়ের তথ্য ঠিক না–অনেক পাখিই ডাকছে। বিবির ডাকের সঙ্গেও বোধহয় পাখিব ডাকের এক ধরনের সম্পর্ক আছে। বিঝিব ডাক যখন থামছে তখনই শুধু পাখি ডাকছে। ঝিঝি এবং পাখি কখনোই এক সঙ্গে ডাকছে না।

শোবার ঘরের দরজায় খুঁট করে শব্দ হলো। কে যেন দরজায় হাত বেখেছে। এ ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা যায় নি। দরজার ছিটিকিনিতে জং পড়েছে। কিছুতেই নড়ানো যায় না। কেউ যদি সত্যি সত্যি এসে থাকে। সে অল্প ধাক্কা দিয়েই দরজা খুলতে পারবে। আশ্চর্য তো, দরজা খুলে যাচ্ছে। লিলিয়ান তাহেরের গায়ে হাত রাখল। তাহের ঘুমের মধ্যেই বলল, আহ, কী কর!

লিলিয়ান হাত সরিয়ে নিল। সে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে দরজার ওপাশে কেউ একজন আছে। সে গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখছে। লিলিয়ান বলল, কে?

ফিসফিস কবে কেউ কি জবাব দিল? খুব হালকা স্বর যা বাতাসে ভেসে চলে যায়। লিলিয়ান খুব সাবধানে বিছানা থেকে নামল। এগুলো দরজার দিকে। তার মোটেও ভয় করছে না। বরং ভালো লাগছে।

না, দরজার ওপাশে কেউ নেই। ফাঁকা সিঁড়ি। রেলিং গলে জোছনা পড়ে অপূর্ব সব নকশা তৈরি হয়েছে। নকশার ভেতর দিয়ে হাঁটতে কেমন লাগবে? লিলিয়ান হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে সে আয়নাঘরের সামনে চলে এলো। আয়নাঘরের দরজা ভেজানো। তার ইচ্ছা করতে লাগল ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে। ভেতরটা নিশ্চয়ই অন্ধকার। দরজা খুলে দিলে চাঁদের আলো কি ঘরে ঢুকবে?

লিলিয়ান দরজা খুলল। চাঁদের আলো ঘরে ঢুকেছে। আয়নার একটা অংশ আলোকিত হয়ে আছে। কী সুন্দর লাগছে দেখতে! শোবার ঘর থেকে ঘুমের ঘোরে তাহের ডাকল, লিলিয়ান!

শোবার ঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না। আয়নাঘরের মেঝেতে পাটি পেতে শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে। পাটি ছাড়াও সিমেন্টের মেঝের উপর শুয়ে থাকা যায়। এ ঘরের মেঝে কালো সিমেন্টের। খুব মসৃণ। কেমন ঠাণ্ড ঠাণ্ডা ভাব।

তাহের আবার ডাকল, লিলিয়ান। এবার বোধহয় সে জেগে উঠেছে। লিলিয়ান ক্লান্ত গলায় বলল, কী?

পানি খাব।

আনছি।

পানির গ্লাস নিয়ে লিলিয়ান আবার শোবার ঘরে চলে এলো। তাহেরের গায়ে হাত রেখে মনে মনে বলল, I love you… যদিও মনে মনে বলার প্রয়োজন ছিল না। তাহের ঘুমিয়ে আছে। এই বাক্যটি শব্দ করেও বলা যেত। তবু কিছু কিছু কথা আছে মনে মনে বুলতেই ভালো লাগে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *