রেণুদের বাড়ি গ্রে স্ট্রিটে, স্টার থিয়েটারের কাছাকাছি। এরই কাছাকাছি আর একটি বাড়িতে শ্রীঅরবিন্দ থাকতেন কিছু দিন। লোকে বলে, সেই বাড়ি থেকেই শ্রীঅরবিন্দ গোপনে শেষ বারের মতন ব্রিটিশ রাজত্ব ছেড়ে চলে যান।
রাস্তা থেকে রেণুদের বাড়ির ভেতরটা কিছুই দেখা যায় না। এই ধরনের বসতবাড়ি পরবর্তীকালে কলকাতা শহর থেকে লোপ পেয়ে যায়। মস্ত বড় কাঠের গেট দিয়ে সামনেটা সম্পূর্ণ ঢাকা, পাল্লার মাঝখানটা কেটে একটা হাফ দরজা–সেখান দিয়ে ঢোকা যায়। ঢুকলেই একটা ছাতঢাকা চওড়া গলি, গলির দু পাশে শ্বেতপাথরের রক তারপর একটা গোল উঠোন, উঠোনের এক দিকে ঠাকুরদালান, অন্য তিন দিকে এলোমলো ঘর–একতলায় অবশ্য কেউ থাকে না। দোতলায় তিনতলায় কত যে ঘর, কত যে মানুষজন তার ইয়ত্তা নেই। গোটা বাড়িটা একটা উপনিবেশের মতন, কে কখন আসছে। যাচ্ছে, তার কোনও হিসেব রাখা অসম্ভব।
ঠাকুরদালানের স্তম্ভের দু পাশে দুটি কালো পাথরের হাতি। ছেলেমেয়েরা ওদের পিঠে চড়ে খেলা করে বলে পিঠগুলো মসৃণ হয়ে গেছে। দালানের ভেতরে শূন্য বেদি, কোনও দেবতার মূর্তি নেই।
এ-বাড়ির ভেতরে পা দিলেই বোঝা যায়, এককালে সচ্ছলতা ও প্রাচুর্যে বাড়িটা গমগম করত, কিন্তু কোনও এক মধ্যরাত্রে কুললক্ষ্মী চুপি চুপি এবাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। আর ফিরবেন না। দেওয়ালের নোনাধরা দাগের মতন দারিদ্র্যের শাখাপ্রশাখাবহুল হাত চতুর্দিকে ছাপ লাগিয়ে দিচ্ছে। এ বাড়ি রং করা হয়নি অনেকদিন। দোতলা-তিনতলার কার্নিশ থেকে বেরোনো বট ও অশ্বত্থ গাছের চারা মহীরূহ হবার স্বপ্ন। দেখছে। তিন তলার একটি ব্যালকনি দেখলে মনে হবে যে-কোনও মুহূর্তে সবসুন্ধু ভেঙে পড়তে পারে-সেখানে কারওর যাওয়া নিষেধ, তবু ছোট ছেলেমেয়েরা খেলার ঝোঁকে সেখানে কখনও কখনও চলে যায়। শিশুদের তো মৃত্যুভয় থাকে না! মেরামত করার বদলে সেই ব্যালকনিটা সম্পূর্ণ ভেঙে দেওয়াই নিরাপদ, কিন্তু কারওর সেটা খেয়াল হয় না।
এই ধরনের একদাধনী বাড়িতে দারিদ্র্যের সঙ্গে সঙ্গে ঔদাসীন্যও এসে জেঁকে বসে। পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই ‘যে রকম চলছে, যতদিন চলছে চলুক,–এই রকম। মনোভাব নিয়ে আছেন, আর দু’-এক জন আবার বিনা উদ্যমে, ফাঁকতালে হঠাৎ বড়লোক। হয়ে যাবার চিন্তায় মশগুল। তখন পর্যন্ত হঠাৎ বড়লোক হবার একমাত্র মরীচিকা ছিল রেস খেলা। কয়েক বছর বাদেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এসে গেলে অবশ্য হঠাৎ বড়লোক হবার আরও অনেক সুযোগ এসে যায়। তবে, অনভিজাত মধ্যবিত্ত এবং বানিয়া সম্প্রদায়ই সে সুযোগ গ্রহণ করেছে বেশি।
গঙ্গার ঘাটে হারিয়ে যাওয়া মেয়ে রেণুকে পৌঁছে দিতে বড়বাবুই এসেছিলেন এ বাড়িতে। বাদলও সঙ্গে এসেছিল। ওরা ভেবেছিল, এবাড়িতে পা দেওয়ামাত্রই একটা হইচই পড়ে যাবে। কিন্তু ঢুকেই যার সঙ্গে দেখা হল, রেণুর সেই কাকা কিছুই খবর জানেন না। ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে বড়বাবু রেণুকে কোলে করে নিয়ে দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকেছিলেন, রেণু তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। চোখের জলে তার জার্মান সিল্কের ফ্রকের বুকের কাছটা ভিজে গেছে। রেণুর বয়স তখন পাঁচের কাছাকাছি–মাথাভরতি কোঁকড়া কোঁকড়া চুল।
রেণুর কাকা বিস্মিত ভাবে বললেন, কী ব্যাপার? আবার বুঝি রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলি। এই মেয়েটা যখন তখন বাইরে চলে যায়—
বড়বাবু গম্ভীর ভাবে বললেন, যাক, তা হলে আপনাদের বাড়ির মেয়ে? ওকে গঙ্গার। ঘাটে পাওয়া গেছে। হারিয়ে গিয়েছিল।
রেণুর কাকা ভুরু তুলে বললেন, গঙ্গার ঘাটে? হোয়াট, দ্যাট ইজ নেক্সট টু ইমপসিবল! এই মেয়েটা, তুই কার সঙ্গে গিয়েছিলি, অ্যাঁ?
রেণুর কাকা চালিয়াত ধরনের মানুষ। চুলে টেরি কাটার খুব বাহার, কানের ডগা পর্যন্ত লম্বা জুলপি, বুকের বাঁ পাশের দিকে বোম লাগানে বড়ুয়া কায়দার পাঞ্জাবি পরা। বড়বাবুকে তিনি একটিও ধনবাদ-বাক্য জানাননি বা বসতে বলেননি। কথাবার্তা হচ্ছিল উঠোনে দাঁড়িয়েই।
বড়বাবু খানিকটা শাসনের সুরে ওকে বললেন, আপনি মেয়েটির বাবা কিংবা মায়ের কাছে খবর পাঠান। আমি এবাড়িতে একেবারে অপরিচিত নই, অনেককাল আগে একবার এসেছি–একটি গানবাজনার আসর হয়েছিল ওই দরদালানে। সুরেশ্বর আমাকে নিয়ে এসেছিল।
কোন সুরেশ্বর?
সুরেশ্বর রায়। ভবানীপুরে থাকে। সে আমার সহোদর ভাইয়ের মতন।
ও, মেজো জামাইবাবু!
একটু বাদেই জানা গেল রেণুর মা ভেতরে অজ্ঞান হয়ে আছেন। বাড়ির এক অংশে কান্নাকাটি হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। আর একটা অংশে কোনও খবরই এসে পৌঁছোয়নি। রেণুর মা, ওই বাড়ির আরও তিন জন মহিলা ও দু’জন দাসী ও একটি দারোয়ান সঙ্গে নিয়ে গঙ্গার ঘাটে গিয়েছিলেন, তার মধ্যেই রেণু কী করে যেন হারিয়ে যায়। সবার ধারণা, সে চুরি হয়ে গেছে। তখন ছেলেধরা মেয়েধরার গল্প আকছার শোনা যায়–ছেলেদের ধরে নিয়ে গিয়ে ভিখিরি বানানো হয়, আর বাঙালি মেয়েদের নাকি বিক্রি করা হয় আরব দেশে। কয়েক দিন আগে এ বাড়ির সামনে নিশির ডাক শোন্ম গিয়েছিল, সেই জন্য আরও ভয়।
তিনমহলা বাড়ির একেবারে ভেতর মহলে নিয়ে বসানো হল ওদের। রেণুর মা হেসে কেঁদে অস্থির হয়ে উঠলেন। কতবার যে বাদলের কাছে গল্পটা শুনতে চাইলেন, তার শেষ নেই। তিনি কক্ষনও বাইরের পুরুষমানুষদের সামনে এসে কথা বলেন না, কিন্তু তখন বড়বাবুর সঙ্গে কথা বলতে একটুও লজ্জা নেই। রেণুর বাবা বাড়িতে ছিলেন না তখন, রেণুর জ্যাঠামশাই এসে বড়বাবুর সঙ্গে রাজনীতি বিষয়ে গল্প জুড়ে দিলেন। তখন দেশের শিক্ষিত মানুষ মাত্রই কংগ্রেস ও লিগ মিনিস্ট্রির ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব চিন্তিত।
সেই থেকে বাদল এবাড়িতে প্রায়ই আসে। বাদলের তখনও কোনও ভাই ছিল না। তার নিজের দিদি ছাড়াও জ্যাঠামশাইয়ের সবকটিই মেয়ে। বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে থেকে থেকে বাদলও পুতুলের বিয়ে ও রান্নাবাড়ি খেলা শিখছিল। মা বলতেন, আমার যা-ও একটা ছেলে হল, তারও মেয়েলি স্বভাব। এরপর ওকে শাড়ি পরিয়ে রাখতে হবে দেখছি!
দিদিদের সঙ্গে মিশে মিশে বাদল ব্রতকথার ছড়া মুখস্থ করে, ফুলের মালা গাঁথে, এমনকী কাটা দিয়ে উল বোনারও চেষ্টা করে। বাড়ি থেকে তার বেরোবার হুকুম নেই, সে আর খেলার সঙ্গী পাবে কোথায়? রেণুদের বাড়িতে একগাদা ছেলেমেয়ে, সারা বিকেল তারা ঠাকুরদালানের সামনের উঠোনে হুটোপুটি করে কিংবা সারা বাড়ি ঝাঁপিয়ে চোর চোর খেলে। দুই বাড়ির মহিলাদের মধ্যে আরও দু-একবার যাতায়াত হবার পর ঠিক হল, বাদল বিকেলবেলা এ বাড়িতে খেলতে আসবে। বাদলদের বাড়ির চাকর তাকে রেখে যায়, এবাড়ির দারোয়ান তাকে পৌঁছে দিয়ে আসে।
এ বাড়িতে রেণুই বয়সে সবচেয়ে ছোট। রেণুর খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো এগারো ভাইবোন তাকে যতটা না ভালোবাসে, তার থেকেও বেশি জ্বালাতন করে। রেণুও বড্ড ছিচকাঁদুনে, কথায় কথায় ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলে। তখন সবাই মিলে সুড়সুড়ি বা কাতুকুতু দিয়ে অথবা চুল টেনে তাকে আরও রাগিয়ে দেয়। অবিলম্বেই বাদল এই খেলাটায় বেশ মজা পেয়ে গেল, এবং অন্য সবার সঙ্গে যোগ দিয়ে রেণুকে কাদাতে লাগল।
এই এগারো জন ছেলেমেয়ের সঙ্গে কখনও কখনও ভবানীপুরের বাড়ির ছেলেমেয়েরাও এসে যোগ দেয়, তখন চেঁচামেচি আর দুপদাপ শব্দে সারা বাড়িতে আর কান পাতা যায় না। জীমূতবাহন এসেই সব ছেলেমেয়েদের নেতৃত্ব নিয়ে নেয়। তার মধ্যে নেতা হবার একটা সহজাত গুণ আছে। লুকোচুরি খেলার জন্য এত বড় বাড়িতে প্রচুর লুকোবার জায়গা–তাও ছেলেমেয়েদের ঠেলাঠেলিতে কখনও শোবার ঘরের আলনা উলটে পড়ে, জলের কলসি ভাঙে, কাঠের সিঁড়ির ওপর পাতা জরাজীর্ণ কার্পেট ছিঁড়ে ফালা ফালা হয়ে যায়।
বাড়ির ছাদখানা ফুটবল গ্রাউন্ডের মতন প্রকাণ্ড। রেণুর চার ভাইবোনের মধ্যে বড়দাদা থাকে দিল্লিতে। সদ্য কলেজে ভরতি হওয়া দাদা সুপ্রকাশ বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদের দেখে কৃপার দৃষ্টিতে। বিশেষত তার কলেজি বন্ধুদের সঙ্গে সে যখন আড্ডা দেয়, তখন ছেলেমেয়েদের গোলমাল করা একেবারে বারণ। কলেজি বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ দাড়ি রাখে এবং মোহিতলাল মজুমদারের চেয়ে নজরুল ইসলাম যে অনেক বড় কবি, এ সম্পর্কে তারস্বরে আলোচনা জুড়ে দেয়। দু’-এক জন আবার তৎকালীন ফ্যাশান অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গজদন্ত মিনারবাসী আখ্যা দিয়ে খুব একচোট নিন্দে করে।
সুপ্রকাশের আর একটি শখ হচ্ছে ঘুড়ি ওড়ানো। এই ঘুড়ি ওড়ানোর ব্যাপারটাকে সে আর্টের পর্যায়ে এনে ফেলেছে। বিশেষ ভাবে অর্ডার দেওয়া শুধু কড়ি টানা দেড়-তে কালো চাদিয়াল ঘুড়িই সে ওড়ায় পাড়ায় অন্য ঘুড়িরসিকরা বলে, ওটা হচ্ছে কালো চাদিয়ালের বাড়ি। তখন বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যেও অনেকের ঘুড়ি ওড়াবার বাতিক ছিল, বাগবাজারে বোসদের বাড়ির মাঠে কিংবা ধর্মতলার ময়দানে সাড়ম্বরে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা হত। সুপ্রকাশ যখন ঘুড়ি ওড়াত, তখন চুপ করে থাকত বাড়ির সব ছেলেমেয়েরা। দুর্ধর্ষ বাজপাখির মতন সুপ্রকাশের কালো চাদিয়াল ঘুড়ি টহল মারত ওই এলাকার আকাশে। কখনও কখনও বাজপাখির মতন ছোঁ মেরে নেমে এসে সেই ঘুড়ি পড়ত অন্য ঘুড়ির ঘাড়ে-সুপ্রকাশের দু’হাত চলত বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রের মতন, বাচ্চারা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠত ভো-মারা!
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাড় ব্যথা হয়ে আসত দলের, কিন্তু সর্বক্ষণ উত্তেজনায় শরীর টং হয়ে থাকত। সুপ্রকাশের ঘুড়ি অন্যরা কেটে দিয়েছে, এমন ঘটনা কচিৎ ঘটেছে। যদি বা কখনও কাটত, সুপ্রকাশের সুতোর হাত্তা ধরতে সচরাচর সাহস করত না কেউ, কোনও হটকারী দৈবাৎ ধরে ফেললেও সুপ্রকাশ বাজখাই গলায় পেঁচিয়ে উঠত, এই এই! মাখা ভেঙে দেব!বাড়ির অন্যান্য ছেলেরা ইট-পাটকেল হাতে নিয়ে তৈরি হয়ে থাকত ছুঁড়ে মারার জন্য।
সন্ধ্যা ঘোর হয়ে এলে, আকাশ থেকে পক্ষীরাও ফিরে গেছে বাসায়–সুপ্রকাশ তখন অনবরত সুতো ছেড়ে ছেড়ে ঘুড়ি আরও বাড়িয়ে যেত। কালো চাঁদিয়াল ঘুড়ি একটু অন্ধকার হলেই আকাশের সঙ্গে মিশে যায়–অতি কষ্টে দেখা যায় শুধু ভেতরের সাদা চাঁদটুকু–অনবরত উঁচুতে উঠে উঠে সুপ্রকাশের চাঁদমাকা ঘুড়ি যেন আকাশের চাঁদ ধরতে যাচ্ছে। ঘুড়িটা সম্পূর্ণ দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে হাতের কাছ থেকে সুতো ছিঁড়ে দিয়ে সুপ্রকাশ সেটাকে পাঠিয়ে দিত নিরুদ্দেশে। একবার আকাশে উড়িয়ে সেই ঘুড়িকে আর মাটিতে নামিয়ে আনত না সুপ্রকাশ। তারপর সে লাটাই গুটিয়ে দলবল নিয়ে ছাদ থেকে নামতে নামতে গুনগুন করে গান গাইত পরম তৃপ্তির সঙ্গে। তার গলায় একেবারেই সুর ছিল না অবশ্য।
মাঝে মাঝে দু-এক দিন বাদল সকালেই এ-বাড়িতে চলে এসে সারা দিন থেকে যেত। তার স্বভাবের মধ্যে মেয়েলিপনা তখনও একটু থেকে গেছে। কিন্তু এ-বাড়িতে এসে সে মেয়েদের বদলে ছেলেদের সঙ্গেই বেশি মেশে। এ-বাড়িতে ছ’টি মেয়ে ও পাঁচটি ছেলে–তারা বিকেলবেলা সবাই একসঙ্গে খেলাধুলো করলেও সকালে দুপুরে তারা আলাদা আলাদা। স্কুল ছুটি থাকলে দুপুরে ছেলেরা ক্যারাম খেলে কিংবা হুটোপুটি করে, মেয়েরা পুতুলের ঘর সাজায়। বাদলের বেশি ভাব রেণুর খুড়তুতো। ভাই বিষ্ণুর সঙ্গে। বিষ্ণু আবার গল্পের বইয়ের পোকা, কত বই সে পড়েছে–বাদল তার নামও জানে না।
এই প্রথম বাদল তার নিজের বাড়ি ছাড়া অন্য একটি পরিবারের মানুষজনকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেল। নিজের বাড়িতে সে কনিষ্ঠ সন্তান, সবাইকেই জন্ম থেকে দেখছে–সুতরাং তাদের অস্তিত্ব আকাশ জল ও হাওয়ার মতন অবধারিত। কিন্তু এ-বাড়ির সকলেই তার চোখে নতুন মানুষ, এদের কথাবার্তা রীতিনীতিও আলাদা। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই বাদল টের পেয়ে গেল, এখানে সবাই এক বাড়িতে থাকলেও সকলের মধ্যেই কেমন যেন একটা আলাদা আলাদা ভাব। এমনকী ছোট ছেলেমেয়েরাও কখনও কখনও এটা আমাদের জিনিস, এটা তোমাদের জিনিস–এই রকম বলে। বাড়ির বউরা চেঁচিয়ে ঝগড়া করে পাড়া মাত করে দেয়। রেণুর বাবারা পাঁচ ভাই তিন বোন, তার মধ্যে বড়ভাই মারা গেছেন, তার বড় দুই ছেলে বিবাহিত, এ-বাড়িতেই আছেন। এক বোন বিধবা হয়ে দুটি সন্তান নিয়ে ফিরে এসেছেন এ-বাড়িতে। তা ছাড়া মাসিমা পিসিমা শ্রেণিরও আছে বেশ কয়েক জন–সবার আলাদা আলাদা ঘর। তিন জন ঠাকুর সারা দিন ধরে রান্না করে যাচ্ছে, বাড়ির যার যখন খুশি খেয়ে নেয়।
রেণুর মা খুব ভালোবাসেন বাদলকে। ইতিমধ্যে বাদলের মা’র সঙ্গেও তার খুব ভাব হয়ে গেছে। রত্নপ্রভা বাদলকে দেখলেই জিজ্ঞেস করেন, হ্যাঁ রে, তোর মাকে নিয়ে এলি না কেন? কালকে ঠিক মাকে নিয়ে আসবি, কেমন? রত্নপ্রভা মানুষটি ছোটখাটো, এবং অসম্ভব ভুলো মন। হা রে, চাবিটা কোথায় ফেললুম দেখ তো! কিংবা, এই যা, দুলটা বোধহয় ফেলে এসেছি কলঘরে–এই করতে করতেই তার সারা দিন কেটে যায়। দুপুরবেলা বারান্দায় শীতলপাটি পেতে বাড়ির অন্যান্য কয়েকটি নারীকে ডেকে খুব মন দিয়ে টুয়েন্টি নাইন খেলতে বসেন–অন্য খেলুড়েরা যে তাঁকে বার বার ঠকাচ্ছে, তিনি বুঝতেও পারেন না। রেণুর বাবা কর্পোরেশনের কাউন্সিলার, সারা দিন তাঁকে দেখা যায় না বাড়িতে।
বস্তুত এ বাড়ির বয়স্ক পুরুষদের প্রায় সকলকেই খুব কম সময় বাড়িতে দেখা যায়। বাড়িটিতে মহিলা ও শিশুদেরই রাজত্ব। রেণুর পরের ভাই অংশুর সঙ্গে বাদলের তেমন ভাব হল না কোনও দিনই। অংশু তার থেকে মাত্র দু’ বছরের বড় হলেও হাবভাব পাকা পাকা। তা ছাড়া অংশু সারা বছরই আমাশয় রোগে ভোগে বলে তার মেজাজটাও খিটখিটে।
কোনও দিন সকালবেলা এসে পড়লে বাদল আগে রত্মপ্রভার কাছেই আসে। রত্নপ্রভা যত্ন করে তাকে খাবার খাইয়ে দেন–তারপর বাদল একছুট্টে চলে যায় বিষ্ণুদের ঘরে। রেণুরা থাকে দোতলায় উত্তরের দিকের ঘরে, আর বিষ্ণুরা থাকে তিনতলায় একেবারে দক্ষিণে। সুতরাং বাদলকে সারা বাড়িটাই পেরিয়ে যেতে হয়– এ-বাড়ির সবকিছুই তার জানা।
বিষ্ণু তার বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে এবং এ-বাড়িতে ভাইদের মধ্যে বিষ্ণুর বাবার অবস্থাই খানিকটা স্বচ্ছল। এক ছেলে বলে বিষ্ণুর আদরের শেষ নেই–কত তার খেলনা, কত রকম তার পোশাক। বিষ্ণুর জন্য নিজস্ব একটি চাকর রাখা আছে, বিষ্ণু একটু হোঁচট খেলেই তার মা হা-হা করে ছুটে আসেন। এত আদরেও কিন্তু বিষ্ণুর মাথা। খারাপ হয়নি–সে ন্যাকা কিংবা আবদারে ছেলে হয়নি। প্রায় শিশুকাল থেকেই সে স্বপ্নদেখা মানুষের দলের অন্তর্গত হয়েছে। সে নানান বই পড়ে এবং মনে মনে সংকল্প করে–একদিন সে সমুদ্রের বুকে জাহাজ ভাসিয়ে ম্যাগেলানের মতন ভূপ্রদক্ষিণ করবে। কিংবা, যে এভারেস্টের চূড়ায় এ-পর্যন্ত কোনও মানুষ উঠতে পারেনি, একদিন বিষ্ণু নিশ্চয়ই সেখানে উঠবে। সে বাদলকে জিজ্ঞেস করে, তুই আমার সঙ্গে যাবি?
বাদলের চোখে এ-বাড়ির সবচেয়ে বিস্ময়কর মানুষ ছিলেন হৈমন্তী। একবার তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না। হৈমন্তীর মতন লম্বা চেহারার মহিলা বাদল আগে কখনও দেখেনি, পরেও দেখেনি। শুধু লম্বা নয়, হৈমন্তীর স্বাস্থ্যও ছিল সেই রকম ভালো, সব মিলিয়ে বিশাল নারী। ওই শারীরিক বিরাটত্বের জন্য মনে মনে হৈমন্তীর নিশ্চয়ই খুব লজ্জা ছিল, কেন না তার মুখখানা ছিল লাজুক শিশুর মতন। অন্য যে কোনও নারীর চেয়ে হৈমন্তী ছিলেন লম্বায় অন্তত আধ হাত উঁচু। ছেলেবেলায় সবকিছুই বড় মনে হয়, বাদলের মনে হত হৈমন্তীর মতো আকারের কোনও মানুষ পৃথিবীতে আর কোথাও নেই, থাকতে পারে না। কিছুদিন আগেই সে স্কুলে জ্যাক অ্যান্ড দ্য বিন স্টকের গল্পটা পড়েছিল। একটা সিম গাছ বেয়ে বেয়ে মেঘের মধ্যে উঠে গেলে সেখানে থাকে এক কৃপণ দৈত্য আর তার বউ। হৈমন্তীকে দেখলেই বাদলের মনে পড়ত সেই দৈত্যের বউয়ের কথা। সেই দৈত্যের বউয়েরই মতন দয়াবতী ছিলেন হৈমন্তী।
তিনতলায় বিষ্ণুদের ঘরের কাছেই হৈমন্তীর ঘর। ঝকঝকে তকতকে করে সাজানো। কেন কে জানে, হৈমন্তীর ঘরে বাড়ির অন্য কেউ বিশেষ আসে না। সমস্ত দিন, বিকেল, সন্ধ্যা ও রাত্রি হৈমন্তীর অসীম নিঃসঙ্গতা ভরা। কোনও কোনও সন্ধ্যাবেলা তার ঘর থেকে ভেসে আসত অর্গানের আওয়াজ, রিডগুলোর ওপর যেন আক্রোশভরে জোরে জোরে চাপ দিচ্ছেন হৈমন্তী। একথা জানতে বাদলের বহু দিন লেগে গিয়েছিল যে হৈমন্তীর স্বামী শঙ্করনাথ এক থিয়েটারের অভিনেত্রীকে নিয়ে আলাদা বাড়ি ভাড়া করে থাকেন রামবাগানে। মাসে একবার কি দু’বার তিনি এ-বাড়িতে আসেন। তখন তার অসম্ভব তিরিক্ষে মেজাজ, টাকাপয়সার হিসেব ছাড়া আর কোনও বিষয়ে কারওর সঙ্গে কথা বলেন না।
একদিন সকালবেলা বাদল যাচ্ছিল বিষ্ণুদের ঘরে, হৈমন্তী তখন উলটো দিকের কলঘর থেকে স্নান সেরে নিজের ঘরে আসছিলেন। গায়ে ভিজে শাড়িটা জড়ানো, সমস্ত শরীরটা স্পষ্ট। বাদলের বুকের ভেতর ছমছম করে উঠল। বাদলের তখন সবে ন’ বছর পূর্ণ হয়েছে, কোনও নারীকে দেখে বুকের ভেতর ছমছমানি জাগার সেই শুরু। লজ্জায় মুখ নিচু করার বদলে সে বিস্মিত ভাবে তাকিয়ে রইল হৈমন্তীর দিকে। মায়ের সঙ্গে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে যে বিস্ময় নিয়ে সে মড়া পোড়ানো দেখে, সেই জাতীয় বিস্ময় নিয়েই সে দেখতে লাগল এই অতি-জীবিত শরীর। মর্মর মূর্তির মতন সুগঠিত হৈমন্তীর দেহে পাতলা ভিজে শাড়িটি জড়ানো–স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তার তাজা বাতাবি লেবুর মতন দুই স্তন, তাদের চূড়ায় গোলাপি আভা। থুতনি থেকে টপ টপ করে জল পড়ছে। পিঠখানা সোনার ঢালের মতন। অত বড় শরীরের তুলনায় আশ্চর্য রকমের সরু কোমর। অনাবৃত পেটে ছোট্ট নাভি। নিতম্বের ওপর শাড়িটা কুঁকড়ে আছে, জঙ্ঘার খাঁজ স্পষ্ট। এইসব রমণীর শরীরে একটা অসম্ভব তেজী আহ্বান থাকে। ইহকাল পরকাল, লুপ্ত করা ডাক শোনা যায়। মসৃণ উরুর কাছে হৈমন্তীর একটা হাত রাখা, অন্য হাতে ভিজে সেমিজ ও ব্লাউজ। সেই দেবদুর্লভ রূপ এক মিনিটের মধ্যে বাদলের চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল। হৈমন্তী বাদলকে দেখতে পাননি। আশেপাশে কোনও পুরুষের উপস্থিতি মেয়েরা ঘুমন্ত অবস্থাতেও বুঝতে পারে। এমনকী পিঠের দিকে তাদের দশ্য-অনুভূতি থাকে। বাদল নেহাত ছেলেমানুষ, তাই খেয়াল করেননি হৈমন্তী।
বাদল এর আগে এই একই রকম অবস্থায় কত বার নিজের মাকে দেখেছে, তার দিদিদেরও দেখেছে। কিংবা আসলে দেখেনি। এই প্রথম সে দেখল, কাকে বলে নারী। কিন্তু ওইটুকু ছেলে তো, প্রথম দেখার ঝাঁপটায় অবসন্ন বোধ করল সে, বেশ কিছুক্ষণ তারপর কথা বলতে পারেনি। তার বোঝার কোনও ক্ষমতাই ছিল না যে তার মধ্যে কী ব্যাপার ঘটে গেল। এর পরেও আরও বেশ কয়েক বছর সে এ ব্যাপারে আবার ঘুমন্ত ছিল। কিন্তু এই দৃশ্যটা তার মনে চিরস্থায়ী হয়ে এঁকে যায়।
বিষ্ণুর সঙ্গে হৈমন্তীর কাছে বাদল তারপর কয়েক বার গেছে। ওদের দেখলে হৈমন্তী খুব খুশি হয়ে উঠতেন, অনর্গল গল্প জুড়ে দিয়ে আর ছাড়তেই চাইতেন না। চাকরকে দিয়ে তেলেভাজা বেগুনি, ফুলুরি আর আলুকাবলি আনতে দিতেন। এইসব খাবারই তার পছন্দ ছিল, বেশি ভালোবাসতেন টক খেতে। আলুকাবলি খেতে খেতে টক আর ঝালের রমণীর সুস্বাদে জিভ দিয়ে টকাস টকাস শব্দ করেন, অবিকল ছেলেমানুষের ভঙ্গিতে–এমনকী খাটে বসে পা দোলানোও সেই রকম। এত বড় চেহারার একটি শিশু, তার জীবনে এই রকম কষ্ট প্রাপ্য ছিল না।
হৈমন্তী যখন বাদলের মাথার চুলে হাত দিয়ে আদর করতেন, বাদল একেবারে লজ্জায় লাল হয়ে যেত। এত লজ্জা তার কোথা থেকে আসে, সে বুঝতে পারে না। হৈমন্তী ঠিক দিদির মতন স্নেহে বাদলের বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, প্রত্যেক দিনই একটা-না-একটা কিছু উপহার দেন। হৈমন্তী বাদলকে একটা চমৎকার মাউথ অর্গান দিয়েছিলেন।
হৈমন্তী সম্পর্কে আর একটি দৃশ্যও বাদলের খুব মনে আছে। শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে একেবারে চলে যাবার আগে হৈমন্তী এ-বাড়ির নৈতিকতায় বেশ একটা ঘা দিয়েছিলেন। তাঁর নিঃসঙ্গতা অসহ্য হয়ে ওঠার পর তিনি সুপ্রকাশের কলেজে-পড়া বন্ধুদের নিজের ঘরে ডেকে নিলেন। একতলার বৈঠকখানা থেকে কী উপায়ে তারা তিনতলায় উঠে এল, সেটা একটা রহস্য বটে, কিন্তু এই ছেলেরা সকাল-বিকেল নিয়মিত আসতে লাগল এখানে। সুপ্রকাশও হঠাৎ খুব ভক্ত হয়ে গেল তার কাকিমার। ওই ঘর থেকে তখন প্রায়ই শোনা যায় হাসির আওয়াজ ও হইহই করে গল্পগুজব, কখনও কখনও কোরাস গান ভেসে আসে। শোনা গেল, হৈমন্তীর ঘরে থিয়েটারের রিহার্সাল চলছে।
বলাই বাহুল্য, বাড়ির সকলে এই ব্যাপার মোটেই ভালো চোখে দেখল না। কিন্তু যেহেতু এ-পরিবারের একজন কেউ সর্বময় কর্তা নেই, ভাইরা সবাই স্বাবলম্বী ও সম্পত্তির অংশ পেয়ে গেছে তাই কেউ কারওর শাসন মানে না। আড়ালে নিন্দা করা ছাড়া আর কোনও শাসনের উপায় নেই। পরনিন্দার ভ্রুক্ষেপ নেই হৈমন্তীর।
একদিন শেষ বিকেলে বাদল ওই বাড়ির সব বাচ্চাদের সঙ্গে নীচের উঠোনে খেলা করছিল, হঠাৎ সচকিত হয়ে দেখল, তিনতলার সেই ভাঙা ব্যালকনিতে এসে হৈমন্তী দাঁড়িয়েছেন, হাসতে হাসতে দুলে পড়ছেন। যে-ব্যালকনিতে শিশুদের যাওয়া নিষেধ, সেখানে হৈমন্তীর মতন বিশাল চেহারার একজন–সবাই ভয়ে আঁতকে উঠল। কয়েক জন যুবক দূর থেকে আতঙ্কিত হয়ে বলছে, এ কী করছেন, এ কী করছেন, চলে আসুন! হৈমন্তী তত বেশি হাসছেন।
কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি অবশ্য। কয়েকটি চাপড়া ঝুপ ঝুপ করে ভেঙে পড়ল নীচে। হাস্যমুখে হৈমন্তী পা ঠুকে ঠুকে আরও ভাঙতে লাগলেন।
বেশ কিছু বছর পর হৈমন্তীর সঙ্গে আবার দেখা হলে বাদল এই দৃশ্যটার কথা উল্লেখ করেছিল। হৈমন্তী তখনও হেসেছিলেন।