০৬. রান্নাঘরের পিছনে ঝগড়ুদের ঘর

রান্নাঘরের পিছনে ঝগড়ুদের ঘর আর রান্নাঘরের পাশে গরম জলের ঘর। সেখানে তিনটে বড়ো বড়ো পাথর দিয়ে উনুন করা আছে, তার উপর কেরোসিনের টিনে স্নানের জল গরম করা হয়।

ওই উনুনে কয়লার বদলে কাঠ জ্বালানো হয়। কতরকম কাঠ, তাদের কতরকম রং, কতরকম গন্ধ। মাঝে মাঝে কাঠে আগুন লাগলে কেমন একটা শোঁ শোঁ শব্দ হয় আর সারা ঘর একটা মিষ্টি মিষ্টি গন্ধে ভরে যায়।

ঝগড়ু, বলে, তা হবে না, ও যে কাঠপরিদের চুলের সুবাস।

কাঠপরি হয় না, ঝগড়ু।

কাঠপরি হয় না এটা একটা কথা হল, বোগিদাদা?

কোনোরকম পরিই হয় না, ঝগড়ু, কাঠপরিও না।

তবে তোমাদের বইতে লেখে কেন? দিদিমা কাল যে বই থেকে পড়ে শোনালেন?

সব বানানো গল্প, ঝগড়ু, পরি হয় না।

না হয় না! বইতেও লিখেছে, তবু হয় না! তা ছাড়া আমি দেখেছি।

তুমি নিজের চোখে দেখেছ?

না, ঠিক নিজের চোখে দেখিনি, আমার বাবা দেখেছেন। তবে কি আমার বাবা মিছে কথা বলেছেন?

কোথায় দেখেছেন ঝগড়ু, কবে দেখেছেন?

অনেক বছর আগে, রমুদিদি। দুমকার পাহাড়ে দেখেছেন অবিশ্যি, তোমরা হয়তো বিশ্বাসই করবে না।

না, না, ঝগড়ু, বলোই-না তোমার বাবার কাঠপরি দেখার কথা।

ঝগড়ু জল গরমের উনুনে একটা ফিকে সবুজ রঙের কাঠ গুঁজে দিয়ে বলল, এইরকম কাঠে পরি থাকে, শুকনো মরা কাঠে থাকে না। বলতেই সারা ঘর একটা মিষ্টি ধুনো ধুনো গন্ধে ভরে উঠল।

ঝগড়ু বলল, ভালো করে আগুনের মধ্যে চেয়ে দেখো, বোগিদাদা, যেখানে নতুন ধরেছে সেখানে নয়, যেখানে গনগন করে জ্বলছে সেখানে দেখো৷ কিছু দেখতে পাচ্ছ না, ঘরবাড়ি, গাছপালা?

অমনি রুমু বোগিরও মনে হতে লাগল সত্যি বুঝি আগুনের তৈরি ঘরবাড়ি, গাছপালা দেখতে পাচ্ছে, লাল, একটু একটু নীল, দেয়াল ছাদ ডালপালা কেবলই কাঁপছে, নড়ছে, ভাঙছে আবার গড়ছে। মনে হল আগুনের তৈরি একটা শহরই দেখতে পাচ্ছে।

বোগি চোখ ঢেকে বলল, শুধু কাঠ জ্বালালে নয়, ঝগড়ু, আমি কয়লার আগুনেও দেখেছি যুদ্ধ হচ্ছে, শহর পুড়ে যাচ্ছে, বিরাট বিরাট প্রাসাদ ধসে পড়ছে।

তা হবে হয়তো, বোগিদাদা, দুমকায় আমরা কাঠ জ্বালাই, কয়লার কথা অত বলতে পারব না।

দাদা, তুমি অত কথা বল কেন? বলো ঝগড়ু, তোমার বাবার পরি দেখার কথা।

বুঝলে, বাবার তখন বয়স হয়েছে, হাড়ের ভিতরে শীত আর কিছুতেই যায় না, সারাটা দিন গোল লোহার চুল্লির ধারে বসে থাকেন, হাতের কাছে কাঠের গাদা, থেকে থেকে আগুনে একটা কাঠ গুঁজে দেন, ধোঁয়ায় চারদিক ভরে থাকে, যে আসে তার চোখ জ্বালা করে, তারা বাবাকে শুধোয়, তোমার চোখ জ্বলে না, বুড়ো? বাবা বলেন, আরে বুকের জ্বালাই আর টের পাই না, তা আবার চোখের জ্বালা!

সারা দিন চুল্লির ধারে বসে থাকেন বাবা, আর কাঠির আগায় বিঁধিয়ে রাঙা আলু পুড়িয়ে খান! যে আসে তাকে খাওয়ান। তারা মাঝে মাঝে বলে, রাঙা আলুতে ইঁদুরের দাঁতের দাগ কেন, বুড়ো? তোমাদের খেতে বুঝি ইঁদুর হয়েছে? বাবা চোখে ভালো দেখেন না, রাগ করেন, বলেন, ইচ্ছে না হয় খেয়ো না।

একদিন আগুনের মধ্যে যেই-না কাঠির আগায় বিঁধিয়ে রাঙা আলু ফেলেছেন, অমনি মনে হল যেন আগুনের ভিতরকার ঘরবাড়িতে মানুষ আছে, কে যেন রাঙা আলুটাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পোড়াতে লাগল, লম্বা দাড়ি কে একজন বুড়ো লোক রাঙা আলুতে কামড় দিল। অমনি বাবা তাড়াতাড়ি কাঠি টেনে আনতেই রাঙা আলুর সঙ্গে সঙ্গে বুড়োও বেরিয়ে এল। একটুক্ষণ দেখতে পেলেন, তারপরেই সে ঝুরঝুর করে বাতাসে মিলিয়ে গেল। বলতে চাও এসব বানানো কথা, বোগিদাদা? শুধু বাবা কেন, বনে-জঙ্গলে যারা কাঠ কাটতে যায়, তারা সবাই জানে জঙ্গলে এমন অনেক জিনিস আছে, যাদের কথা কোনো বইতে লেখে না। গাছগাছালির কথা যারা চারটে দেওয়ালের মধ্যে বাস করে তারা জানবে কোত্থেকে?

কিন্তু জন্তুজানোয়ারদের তো মানুষরা ভালোবাসে, তাদের কথা তো জানতে পারে?

কে বলেছে মানুষরা জন্তুজানোয়ার ভালোবাসে? একবার হাতি ধরার খেদায় গিয়েছিলাম। দেখলাম সুন্দর সব পোষা হাতি সাজিয়ে রেখে, বুনো হাতি ধরা হচ্ছে। ভালোবাসে বললে? যারা দলে দলে গাছপালা ভেঙে হুড়মুড়িয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নামে, তাদের পায়ে শেকল পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখলাম।

হাতির বাচ্চার ভীষণ কাতুকুতু তা জান? খররা বুরুশ দিয়ে ঘষে তাদের কাতুকুতু ছাড়িয়ে, পিঠে হাওদা চাপানো হয় তা জান? তা নইলে একটুকু ছুঁলেই তারা হেসে লুটোপুটি। তোমরা কি এগুলোকে ভালোবাসা বল?

রুমু বলল, আমরা কুকুর ভালোবাসি, না দাদা? আমরা ভুলোকে ভালোবাসি। তুমিও তো বলেছ মকার লোকরা বেড়াল বাদে সব জন্তুজানোয়ার ভালোবাসে। 

দুমকার লোকদের কথা আলাদা। একবার দুমকার বনে দাবানল লেগেছিল। দলে দলে জন্তুজানোয়ার ভয়ের চোটে ছুটে বেরিয়ে এল। গাঁয়ের লোকেরাও তাদের ঘর বাঁচাতে ব্যস্ত ছিল, জানোয়ারদের কেউ কিছু বলল না।

একটা ভাল্লুক ছিল, সেরকম ভাল্লুক কেউ কখনো দেখেনি। তার গলার লোমগুলো ছিল সাদা, মনে হত ফুলের মালা পরেছে বুঝি। আর যেমনি তার গায়ের জোর, তেমনি তার সাহস! ওর জ্বালায় কারো মৌচাকে মধু থাকত না, আর কত লোককে যে খুনজখম করেছিল তার ঠিক নেই। কিন্তু এমনি চালাক যে কেউ তাকে মারতেও পারেনি, ধরতেও পারেনি।

দাবানলের দিন সে-ও বন থেকে বেরিয়ে এল, সঙ্গে একটা বাচ্চা, তার পায়ে কী হয়েছে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। পড়ে গেল আমাদের সর্দারের একেবারে সুমুখে। আগের বছর সর্দারের ছেলের পায়ের হাড় চিবিয়েছে ওই ভাল্লুক, সর্দারের হাতে তির-ধনুক।

মেরে ফেলল?

সর্দার ধনু তুলতেই ভাল্লুক তার বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে সর্দারের মুখের দিকে চেয়ে রইল। আর সর্দারও ধনুক নামিয়ে পিছন ফিরে চলে গেল। জন্তুজানোয়ারকে ভালোবাসা চারটি খানিক কথা নয়, দিদি। একটা কুকুর কি একটা বেড়াল ঘরে বেঁধে রেখে তাকে আদর করলেই কি আর ভালোবাসা হল!

রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে রুমু ডাকল, দাদা!

কেন, কী হয়েছে?

মাঝে মাঝে ভুলো কেন পালিয়ে যায়? হয়তো এখানে ওর ততটা ভালো লাগে না?

বোগি উঠে বসল, ভালো লাগে না? এখানে ভুলোর ভালো লাগে না? তুই কি পাগল হয়েছিস?

তবে আসছে না কেন?

বোগি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, আসছে না কারণ আসতে পারছেনা। আর হয়তো আসবেও না!

নিশ্চয় আসবে। একটা পাঁচ-ঠেঙা মাকড়সা আর একটা সোনা রুপোর মাদুলি পেলেই আসবে দেখো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *