০৬. রাণুর চেয়ে একটু বড়

রাণুর চেয়ে একটু বড়, প্রায় পিঠোপিঠি বোন ভক্তি, সেও বড় সুন্দর, কিন্তু রাণুর মতন তার সৌন্দর্যে তেমন জ্যোতি নেই। ওদের বাবা এই দুই কন্যার অন্য নাম দিয়েছেন, ছায়া ও কায়া। ভক্তি সত্যিই ছায়ার মতন, নির্বাক ও সুস্থির, সে রাণুর সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে, কিন্তু রাণুর কখনও হরিণীর গতি, শান্তি হাঁটে ধীর লয়ে। রাণু যে কোনও মানুষের সঙ্গে অকপটে আলাপ করে নিতে পারে, ভক্তি তখন আড়ালে চলে যায়।

রাণু সময়ে-অসময়ে কবির কাছে চলে যায়, ভক্তি লজ্জায় কবির সঙ্গে ভাল করে কথাই বলতে পারে না।

রথী আর প্রতিমার সঙ্গেও রাণু বেশ ভাব জমিয়ে নিয়েছে। আশ্রমের সকলেই এখন রাণুকে চেনে, কবি যে এই বালিকাটিকে বিশেষ পছন্দ করেন, তাও সবাই জানে। মাধুরীলতার বিয়োগ বেদনা কবির মন থেকে অনেকটা ভুলিয়ে দিয়েছে এই মেয়েটি, সে জন্য সকলেই তাকে অবাধ প্রশ্রয় দেয়।

কবির সেবার ভার পুত্রবধু প্রতিমার ওপর। খাওয়ার ব্যাপারে কবির খুঁতখুঁতুনি আছে, তাই ঠাকুর-চাকরদের ওপর নির্ভর না করে প্রতিমা নিজে তাঁর আহার্য প্রস্তুত করে, নিজেই কবির কাছে নিয়ে যায়।

রাণু রান্নাঘরে এসে প্রতিমার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয় মাঝে মাঝে।

একটা পাথরের গেলাসে ভরা হয়েছে গরম দুধ, একটা রুপোর রেকাবিতে দুটি সন্দেশ ও ছাড়ানো বেদানা।

রাণু জিজ্ঞেস করল, এগুলো আমি নিয়ে যাব প্রতিমাদিদি?

প্রতিমা ভুরু তুলে বলল, ওমা, দিদি বলছিস কী রে? তোর থেকে আমি কত বড়!

রাণু জিজ্ঞেস করল, তা হলে কী বলে ডাকব? বউদিদি?

কাল তুই আমার বরকে কী বলে ডাকছিলি? রথীকাকা না? কাকার বউ বুঝি বউদিদি হয়?

দু’জনেই হাসতে লাগল মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে।

তারপর প্রতিমা বলল, তুই বাবামশাইকে রবিবাবু বলিস? কী পাকা মেয়ে!

রাণু বলল, চিঠিতে লিখেছিলাম। মুখে তো বলি না।

তা হলে কী বলে ডাকিস এখন? কথা বলার সময়?

কিছুই বলি না। এখনও নামটা ঠিক হয়নি।

আমরা বাবামশাই বলি, তুই দাদামশাই বলে ডাকতে পারিস?

রাণু দু দিকে মাথা দোলায়। এ সম্বোধন তার পছন্দ হয় না।

তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, আজ আমি ওঁর খাবার নিয়ে যেতে পারি?

প্রতিমা বলল, তুমি নেবে? ঠিক আছে নিয়ে যাও! ওঁর একটা দোষ আছে, উনি কিছুতেই পুরোটা দুধ শেষ করেন না। সন্দেশও আধখানা কামড়ে ফেলে রাখেন। দ্যাখো, তুমি যদি সবটা খাওয়াতে পারো।

রাণু খুব সাবধানে হাঁটি হাঁটি পা পা করে পাথরের গেলাস ও রেকাবি দু হাতে ধরে উপস্থিত হল কবির কাছে।

ঘরের মধ্যে দুজন ব্যক্তি কবির সঙ্গে আশ্রম-বিদ্যালয় বিষয়ে আলোচনা করছে।

কবি অন্য লোকের সামনে কিছু খান না, তা রাণু জেনে গেছে এর মধ্যেই। সে গেলাস ও রেকাবি টেবিলের ওপর রাখল।

কথাবার্তা শুনে বোঝা গেল, ব্যক্তি দুটির নাম কালীমোহন ও সন্তোষ। কবি মাঝে মাঝে সুরুল, খামার, কৃষি, গোপালন এই সব বলছেন। কবির মুখে এই ধরনের নীরস কথা রাণুর একেবারে পছন্দ হচ্ছে না। দুধ ঠাণ্ডা হয়ে যাবে!

ব্যক্তিদ্বয় অবশ্য একটু পরেই নিষ্ক্রান্ত হলেন।

রাণু দুধের গেলাস কবির মুখের কাছে নিয়ে এল।

কবি যথারীতি একটি চুমুক দিয়েই বললেন, বাঃ বেশ।

রাণু বলল, উহু, ওটুকু খেলে চলবে না। আরও খান!

কবি বললেন, প্রতিমা বুঝি হাল ছেড়ে দিয়ে তোমাকে প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছেন? ঠিক আছে, তোমার সম্মানে আর এক চুমুক দিচ্ছি।

রাণু বলল, সবটা খেতে হবে।

কবি বললেন, তুমি কি আমাকে দুগ্ধপোষ্য শিশু বানাতে চাও নাকি? বাধ্য হয়ে কিছুটা খাই, গো বৎসদের সম্পূর্ণ বঞ্চিত করতে চাই না।

রাণু বলল, বাছুরে আর এ দুধ খাবে কী করে, দোওয়ানো হয়ে। গেছে।

আবার তিনজন দর্শনার্থী উপস্থিত। রাণু সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নিয়ে গেল দুধের গেলাস।

কথা শুরু হল ছাপাখানা বিষয়ে।

আমেরিকার লিংকন শহরের অধিবাসীরা কবিকে একটি ছাপাখানা উপহার দিয়েছিল। অনেক রকম টাইপ ও যন্ত্রপাতিও পৌঁছে গেছে জাহাজযোগে। শান্তিনিকেতনে সেই ছাপাখানাটি এখনও ঠিক মতন চালু হয়নি।

এবারেও কবি আগন্তুকদের সঙ্গে নীরস কথাবার্তা চালাতে লাগলেন, মাঝে মাঝে ইংরিজি শব্দ।

লোক তিনটির মুখ রাণুর চেনা। গতকালই ১লা আষাঢ় উপলক্ষে বর্ষা উৎসব হল, তাতে অনেক সংস্কৃত শ্লোক পাঠ আর গান শুনেছিল সে। কবি ভাষণ দিয়েছিলেন, গান গেয়েছিলেন, মজা হয়েছিল বেশ। এঁদের মধ্যে চশমা পরা ভদ্রলোকটিও গান গেয়েছিলেন।

হঠাৎ কথা থামিয়ে কবি বললেন, এই দ্যাখো, তোমাদের সঙ্গে এই অধীরা বালিকাটির পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি। এর নাম রাণু। চারু, তোমাকে তো এই মেয়েটির কথা লিখেছিলুম, বলতে পারো এ এখন আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। রাণু, এঁরা হলেন, চারুচন্দ্র, সুকুমার আর অজিত।

তারপর চশমা পরা ব্যক্তিটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, তুমি সুকুমারকে চেন না বুঝি? ইনি সুকুমার রায়, ছাপাখানার মস্ত বিশেষজ্ঞ, আর তোমাদের বয়েসীদের জন্য কত চমৎকার সব লেখা লিখেছেন!

রাণু চোখ বড় বড় করে বলল, সুকুমার রায়, মানে সন্দেশ? আমি পড়েছি, পাগলা দাশু, পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা, আর…গান জুড়েছেন গ্রীষ্মকালে ভীষ্মলোচন শর্মা, আওয়াজ খানা দিচ্ছে হানা দিল্লি থেকে বর্মা…।

অজিত বললেন, বাঃ বেশ মুখস্ত আছে দেখছি!

রাণু কবির বাহু ছুঁয়ে সুকুমারকে বলল, আমি কিন্তু আপনাকে ভালবাসি না। শুধু এঁকে ভালবাসি।

তার সরল উক্তি শুনে সবাই হেসে উঠলেন এক সঙ্গে।

কবি বললেন, এ বালিকা ভালবাসা ভাগাভাগি করতে জানে না।

সুকুমার বললেন, ও বস্তুটি ভাগাভাগি করলে তেমন স্বাদ থাকে না। আমি একজন পাঠিকা পেয়েছি, এই যথেষ্ট।

চারুচন্দ্র বললেন, ছাপাখানার বিষয়টা এখন বাকি থাক। গুরুদেবকে তো তৈরি হয়ে নিতে হবে। সন্ধেবেলা সভা আছে।

ওঁরা বেরিয়ে যেতেই রাণু আবার দুধ ও সন্দেশ শেষ করার জন্য চেপে ধরল কবিকে।

কবি বললেন, আর যে খেতে পারছি নে। এরপর লেকচার দিতে হবে। যে-মানুষ বেশি কথা বলে, তাকে লঘু ভোজন করতে হয়।

রাণু বলল, আপনি অত লেকচার দেন কেন? গল্প লেখার নাম নেই, কবিতা লেখা নেই, খালি লেকচার। মোটেই ভাল নয়। এ সব আপনাকে খেতেই হবে!

কবি একটি সন্দেশ মুখে পুরে বললেন, এরপর দেরি হয়ে যাবে। এবার উঠি।

রাণু বলল, আপনি এই ভাবে সভা করতে যাবেন? চুল আঁচড়াননি। কবিদের বুঝি চুল আঁচড়াতে নেই?

কবি বললেন, বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক সময় খুব সাজগোজ করতেন, তুমি তা দেখোনি। এখন আর… সময় মতন কিছুই খুঁজে পাই না, চিরুনি যে কোথায় লুকোয়।।

দেরাজ টেনে খুলে রাণু বলল, এই তো চিরুনি! চুপটি করে বসুন, আমি চুল আঁচড়ে দিচ্ছি।

মা যেমন শিশু সন্তানের গাল টিপে ধরে চুল আঁচড়ে দেন, সেই রকমই ভঙ্গিতে একটি বালিকা চুল আঁচড়ে দিচ্ছে একজন প্রবীণ মানুষের।

কবি সস্নেহে রাণুর পিঠে হাত রেখে বললেন, আমি বুঝি তোমার একটা খেলনা?

রাণু বলল, নড়বেন না। মাথায় কী সুন্দর চুল। দাড়িও ঠিক করে দিচ্ছি।

কবি বললেন, রাণু, তুমি চলে গেলে কে আমার চুল আঁচড়ে দেবে, কে আমায় জোর করে খাওয়াবে?

রাণুদের ফেরার সময় ঘনিয়ে এল।

ফণিভূষণের স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হয়েছে, ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছেন আরও কিছুদিন থেকে যাবার জন্য, কিন্তু তাঁকে তো কাজে যোগ দিতে হবে। কত আর ছুটি পাওয়া যাবে।

রাণু এখানেই থেকে যেতে চায়, সে এখানকার স্কুলে পড়বে। সেই জেদ ধরে সে এমন কান্নাকাটি শুরু করল যে তার বাবা-মা শেষ দিনটিতে তাকে ঘর থেকে বেরুতেই দিলেন না।

কবি নিজে এই পরিবারটিকে ট্রেনে তুলে দেবার জন্য এলেন বোলপুরে। ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে তাঁর মনে হল, না আসাই উচিত ছিল।

রাণু কিছুতেই ট্রেনে উঠবে না। সে ছটফটিয়ে মামার হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করছে আর কাঁদছে। আর আকুল ভাবে কবির দিকে তাকিয়ে বলছে, আমি আপনার কাছে থাকব, আমার বাবাকে বলুন না—

কবিরও বুক মোচড়াচ্ছে, তিনি জোর করে মুখ ফিরিয়ে রইলেন।

প্রায় টেনে-হিঁচড়ে কামরায় তোলা হল রাণুকে। হুইল দিয়ে ছেড়ে দিল ট্রেন।

চলন্ত গাড়িতেও রাণুর কান্না কিছুতেই থামে না।

তার দুই দিদি কত ভাবে মন ভোলাবার চেষ্টা করল তার, রাণু কিছুতেই দেখবে না বাইরের দৃশ্য। এক একটা স্টেশনে ট্রেন থামছে, খাবার কেনা হচ্ছে, সে খেতেও চায় না।

মা এক সময় বললেন, বাবারে বাবাঃ, পারা যায় না এই জেদি মেয়েকে নিয়ে। গুরুদেব আমাদের আবার আসতে বলেছেন, আবার তো আসবি! এত কান্নার কী আছে?

রাণু ফোঁপানি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, আবার কবে আসব?

মা বললেন, আসব শিগগিরি… দেখা যাক যদি পুজোর ছুটিতে সম্ভব হয়।

ট্রেন বর্ধমান ছাড়াবার পর রাণু চিঠি লিখতে বসল।

…এখন গাড়ি চলছে। আমি খুব কাঁদছি। আপনার জন্য মন কেমন করছে। আপনার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। আপনার নাওয়া হয়ে গেছে, কে চুল আঁচড়ে দেবে আপনাকে? …রোজ বিশ্রাম করবেন। আমার সন্ধেবেলা ভাল লাগবে না। আপনারও বোধহয় ভাল লাগবে না। …যদি কিছু সভা হয় তো বেশি জোরে লেকচার দেবেন না। আজ সন্ধেবেলা তো আমি আসব না, আপনি বোধহয় সভা করবেন। এবার যেদিন ছাতে বসবেন সেদিন নিশ্চয় আপনার আমার জন্য মন কেমন করবে। আপনি একলাটি চুপ করে বসে থাকবেন। খানিকক্ষণ আগে আমরা সব জলখাবার খেয়েছি। আপনিও বেশি করে দুধ খাবেন। …সন্ধে হয়ে এসেছে। এখন শান্তিনিকেতনের কথা মনে আসছে। এ সময়ই তো আমার সবচেয়ে বেশি আপনার জন্য মন কেমন করবে। কাশীতে গিয়েও করবে। …আমার গাড়িতে একটুও ভাল লাগছে না। আপনার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে।

কবিও বিষণ্ণ হয়ে রইলেন কয়েকটি দিন। এই এক মাস ধরে সরল সুন্দর বালিকাটি তাঁর মন লাবণ্যে ভরিয়ে দিয়েছিল। মাধুরীলতা চলে যাবার পরেই ওর সঙ্গে দেখা, এ এক আশ্চর্য যোগাযোগ। মাঝে মাঝেই মাধুরীলতা আর রাণু মিলেমিশে গেছে। রথী আর প্রতিমাও মেয়েটিকে ভালবেসে ফেলেছিল।

রাণুর চিঠি পাওয়া মাত্র কবি উত্তর লিখতে বসলেন।

রেলের পথে তোমার যে মন খারাপ হয়েছিল সেই পড়ে আমার বড় কষ্ট হল। তুমি মনে করো না আমি বুঝতে পারিনি। সেই বুধবারের দিন যখন তোমার গাড়ি চলছিল, আর আমি যখন চুপটি করে আমার কোণে, এবং সন্ধেবেলা ছাদে বসে ছিলুম তখন তোমার কষ্ট আমাকে বাজছিল। আমি মনে মনে কেবল এই কামনা করছিলুম যে, বাদলের ওপর যেমন ইন্দ্রধনু তৈরি হয়, তেমনি করে তোমার অশ্রুভরা কোমল হৃদয়ের উপরে স্বর্গের পবিত্র আলো পড়ক, সৌন্দর্যের ছটায় তোমার জীবনের এক দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্ত পূর্ণ হয়ে উঠুক।

আমি আমার জীবনকে তাঁরই কাছে উৎসর্গ করেছি–সেই উৎসর্গকে যে তিনি গ্রহণ করেছেন তাই মাঝে মাঝে তিনি আমাকে নানা ইশারায় জানিয়ে দেন—হঠাৎ তুমি তাঁরই দূত হয়ে আমার কাছে এসেছ। তোমার উপর আমার গভীর স্নেহ তাঁর সেই ইশারা। এই আমার পুরস্কার। এতে আমার কাজের দ্বিগুণ উৎসাহ হয়, আমার ক্লান্তি দূর হয়ে যায়, আমার মনের আকাশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *