যুদ্ধের প্রচারকার্য
রাজনৈতিক ঘটনাবলীর গতিপথ নীরিক্ষণ করতে গিয়ে আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করত এর সংঘবদ্ধ প্রচারকার্যের সজীব দিকটা। মার্কসবাদীরা খুব ভালভাবেই জানত এ যন্ত্র কী করে বাজাতে হয়, এবং বাস্তবক্ষেত্রে তার সঠিক প্রয়োগ। শীঘ্র আমি উপলব্ধি করি যে, সঠিক সংঘবদ্ধ প্রচারকার্যটা শিল্পের পর্যায়ে পড়ে এবং এ শিল্প আমাদের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের কাছে একেবার অজানা। লুইগারের সময়ে খ্রিস্টান–সোশ্যালিস্ট পার্টি একমাত্র এ যন্ত্রের কিছুটা প্রয়োগ করে, এবং তাদের সাফল্যের জন্য তারা যথেষ্ট পরিমাণে এর কাছে ঋণী।
যুদ্ধের সময়েই একমাত্র আমরা বুঝতে পারি যে সংঘবদ্ধ প্রচারকার্য নির্দিষ্ট নীতিতে চালিয়ে গেলে তাতে কী প্রচণ্ড সাফল্য আসে। কিন্তু এবারও দুর্ভাগ্যবশত ব্যাপারটাকে অন্যদিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়, আমাদের দিকের প্রচারকার্য যেভাবে করা উচিত ছিল–বাস্তবে করা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক নিকৃষ্টভাবে। জার্মান খবরাখবর পদ্ধতি এবারেও পরিপূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল–যে কারণে প্রতিটি সৈনিক ব্যর্থ হতে বাধ্য–এবং সেটাই আমাকে সংঘবদ্ধ প্রচারকার্য চালাবার ব্যবস্থার সমস্যা সম্পর্কে ব্যাপকভাবে আগ্রহী করে তোলে। আমার এ বিষয়ে বাস্তব শিক্ষা নেওয়ার প্রচুর সুযোগও ছিল। যদিও দুর্ভাগ্যবশত সেই শিক্ষা খুব ভাল মত দিয়েছিল আমাদের শত্রুরা। আমাদের দিকের দুর্বল দিকটা শত্রুরা খুব ভালভাবে ব্যবহার করেছিল এবং সেই ব্যবহারটা এত সার্থকভাবে রূপায়িত যে, যে কেউ অন্তত এ ব্যাপারে তাদের প্রচণ্ড রকমের প্রতিভাধর বলে স্বীকার করতে দ্বিধা করবে না। শত্রুদের সেই প্রচারকার্যের থেকেই আমি প্রশংসনীয়ভাবে আমাদের করণীয় কাজকে খুঁজে পাই। এর থেকে যে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন,–দুর্ভাগ্যবশত আমাদের পক্ষের তথাকথিত প্রতিভাধরদের সেদিকে কোন আকর্ষণই করেনি। তারা হল এ সবের উর্দ্ধে এসব শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার পক্ষে অনেক বেশি ধূর্ত। যাহোক, তাদের এ শিক্ষার কোন সৎ উদ্দেশ্যই ছিল না।
আমাদের তরফে কি কোনরকম সংঘবদ্ধ প্রচার কার্যের ব্যবস্থা ছিল? দুঃখের সঙ্গে তার উত্তরটা হল নেতিবাচক। এবং যা কিছু এ উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, তা এতই অপ্রতুল এবং ভুলে ভরা যে তা প্রয়োজন মেটাবার পরিবর্তে ক্ষতিই করেছে বেশি। সংক্ষেপে পুরো ব্যবস্থাটাই ছিল অপ্রতুল। মনস্তত্বের দিক থেকেও সমস্ত ব্যাপারটাই ভুলে ভর্তি। যারাই মনোযোগের সঙ্গে জার্মান প্রচার কার্যের ব্যবস্থাটাকে অনুধাবন করেছে, তাদের বিচারে এ মতামত প্রকাশ পেয়েছে, আমাদের জনসাধারণের এমন কি এটার মূল প্রশ্নেও পরিষ্কার কোন ধারণা ছিল না।
প্রচারকার্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়ও বটে। এর সম্পর্কে শেষের বিন্দুর মূল্যায়ণ ধরে এবং কি উদ্দেশ্যে এটা করা হচ্ছে–সেই উদ্দেশ্যটা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণাও থাকা চাই।
এটাকে এভাবে সংঘবদ্ধ করতে হবে, যাতে এর নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে উপনীত হতে তা সাহায্য করবে, এবং একথা স্বীকৃত যে এর উদ্দেশ্য অনুসারে এর কর্মপদ্ধতিরও পরিবর্তন হয়ে যাবে। এবং প্রচারকার্যের চরিত্রও সে ভাবেই গঠিত হওয়া উচিত।
যুদ্ধের সময়ে আমরা যে কারণের জন্য লড়াই করেছিলাম তা যে শুধু মহত্ব ছিল তাই নয়, মানুষ যে কারণে কার্যশক্তি প্রয়োগ করতে পারে, সে কারণের জন্যই আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। আমরা যুদ্ধ করেছিলাম আমাদের দেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তির জন্য; আমাদের ভবিষ্যত মঙ্গলের এবং নিরাপত্তার খাতিরে, জাতির সম্মানের জন্য–বিতর্কমূলক সমস্ত মতামত সত্ত্বেও। একথা অনস্বীকার্য যে এ সম্মানের অস্তিত্ব বাস্তবে ছিল
, যার অস্তিত্বের প্রয়োজন অনস্বীকার্য যে জাতির সম্মান নেই, আজ হোক কাল হোক সে তার স্বাধীনতা এবং মুক্তি হারাবেই। এ ব্যাপারটা ঘটে উচ্চ বিচারকমের পদ্ধতির পথ ধরে, কাপুরুষের দলের স্বাধীনতার কোন দাবি-ই নেই। যে দাস, তার আবার সম্মান কিসের। সে সম্মানের উল্লেখটাই তার পক্ষে পরিহাসের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
জার্মানি যুদ্ধে নেমেছিল তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। সুতরাং যুদ্ধের প্রচারকার্যের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছিল যাতে যুদ্ধ করার উৎসাহটাকে বর্ধিত করা এবং সে যুদ্ধে জয়ের পথ প্রশস্ত করা যায়।
কিন্তু যখন জাতিরা তাদের অস্তিত্বরক্ষার প্রয়োজনে সংগ্রামে রত,–যখন অস্তিত্ব থাকবে কি থাকবে না, এ প্রশ্নের উত্তর অপেক্ষা করছে,–তখন সব রকমের মনুষ্যত্ব এবং রুচি ইত্যাদি বিষয়গুলো একপাশে সরিয়ে রেখে দেওয়াই যুক্তি সংগত। কারণ এসব আদর্শের অস্তিত্ব মানুষের সৃজনশীল চিন্তায় যা তার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। প্রকৃতি তাদের খোঁজও রাখে না। উপরন্তু খুব কম বা অল্প সংখ্যক জাতির এ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকে। মানবতা এবং রুচি বিজ্ঞান বিষয়ক আদর্শগুলো পৃথিবীর জনবসতির সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে যাবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই জাতিও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যারা এর সৃষ্টিকর্তা এবং রক্ষক।
যখন জাতি তার অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রামে রত, তখন এসব আদর্শ হল দ্বিতীয় পর্যায়ের ভাবনা। যে মুহূর্তে জাতি যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে — তখন এগুলো শুধু জাতির মনের জোরই কমিয়ে দেবে; সুতরাং এসব চিন্তা-ভাবনা ঝেড়ে ফেলে দেওয়াই যুক্তিযুক্ত। একমাত্র এটাই দৃশ্যমান যার দ্বারা সংগ্রামে রত একটা জাতিকে বিচার করা যায়।
মানুষের অনুভূতি সম্পর্কে মন্টেকের অভিমত হল যুদ্ধের সময় সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় হল যত সত্বর সম্ভব মত স্থির এবং যত নির্দয়ভাবে যুদ্ধ করা যায়–সেটাই হয় মনুষ্যত্বের সবচেয়ে বড় পরিচয়। যখন কেউ এর উত্তরে রুচিবিজ্ঞান ইত্যাদি বড় বড় কথা বলে, তখন তার একটাই উত্তর দেওয়া সম্ভব। যুদ্ধের সময়ে অস্তিত্বরক্ষাটাই হল সবচেয়ে বড়, তখন অন্য কোন বিষয়ের কথা উল্লেখ করাই উচিত নয়। দাসত্বের জোয়াল হল যা সব সময় কাঁধে চেপে বসে থাকে। এটাই হল মানুষের জীবনের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা যা তাকে একরকম বাধ্য হয়েই সহ্য করতে হয়।
সোয়াবিঙ* ক্ষয়শীলেরা কি জার্মানির আজকের ভাগ্য সম্পর্কে আশাবাদী? অবশ্য কেউই এ প্রশ্নটাকে ইহুদীদের সঙ্গে আলোচনা করতে বলতে বলবে না, কারণ তারা হল আজকের তথাকথিত সাংস্কৃতির সুগন্ধের আবিষ্কারক। তাদের অস্তিত্বই হল ঈশ্বরের সৃষ্টির সবচেয়ে দেহধারী ব্যতিক্রম।
যুদ্ধের সময় এসব আদর্শ যা সুন্দর এবং মানসিকগুণে সমৃদ্ধ তার কোন স্থান নেই। তারা যুদ্ধের প্রচারকার্যের উপযুক্ত মালমশলাও নয়।
যুদ্ধ চলাকালে প্রচারকার্য হল সেই যুদ্ধের শেষকথা। এবং এ সমাপ্তি হল জার্মান জাতির অস্তিত্বরক্ষাও শেষ পর্যায়। সুতরাং প্রচারকার্যের প্রয়োজনীয়তা এবং উদ্দেশ্য এ দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা উচিত। সবচেয়ে নিষ্ঠুর অস্ত্রই হল এক্ষেত্রে সবচেয়ে মানবীয়তার গুণে সমৃদ্ধ, অবশ্য যদি তারা সেই যুদ্ধ দ্রুত শেষ করতে সাহায্য করে। এবং সেইসব পদ্ধতিই সুন্দর এবং সম্মানীয় যা জাতির ঐতিহ্য এবং স্বাধীনতা বজায় রাখে। সম্ভবত এ মনোভাব নিয়েই এ জীবন-মৃত্যু যুদ্ধের প্রচারকার্য চালানো উচিত।
যদি এ জিনিসগুলোই তাদের শাসকবর্গকে বলা হয়, — এবং তারা যদি বুঝতে পারে তবে যুদ্ধের প্রচারকার্য কি ধরনের এবং কোথায় হবে এ নিয়ে অস্ত্র হিসেবে এটাকে ব্যবহার আর দ্বিধা দেখা দেবে না।
কারণ এ প্রচারকার্য আর কিছুই নয় একটা বিশেষ অস্ত্র, যারা এর সঠিক ব্যবহার জানে তাদের হাতে এ অস্ত্রই ভয়ংকর হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হল এর চূড়ান্ত প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে : প্রচারকার্য কাদের উদ্দেশ্যে চালানো উচিত?
প্রচারকার্যের লক্ষ্য হওয়া উচিত সুবিশাল জনতা। বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায় অথবা যাদের আজকে বদ্ধিজীবি বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তাদের কাছে নিছক প্রচারকার্য চলে না; তাদের জন্য প্রয়োজন এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। তবে প্রচারকার্যের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্ক অত্যন্ত ক্ষীণ, যেমন ক্ষীণ শিল্পকলার সঙ্গে প্রাচীরপত্রের–এর সংবাদ বহনের ক্ষমতার দিকটার বিবেচনায় প্রাচীরপত্রের বিজ্ঞাপনে শিল্পীর দক্ষতার প্রকাশ হল তার রেখায় রঙের বৈচিত্রে কত লোককে তা আকর্ষণ করে। যত বেশি লোক আসে–প্রাচীরপত্রের বিজ্ঞাপন তত ভাল বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। যদি জনসাধারণকে এটা আকর্ষণ করে থাকে, তবু কিছুতেই এটাকে শিল্পের পর্যায়ে ফেলা যায় না। প্রাচীরপত্র শিল্প প্রদর্শনীতে শিল্পের বিকল্প কখনই নয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুতরাং যারা শিল্প নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে উৎসুখ, তাদের প্রাচীরপত্র দিয়ে ইচ্ছা পূরণ করা সম্ভব নয়, তারজন্য অন্য কিছুর দরকার। সত্যিকথা বলতে কি, এ উদ্দেশ্য প্রদর্শনী গ্যালারীতে ঘোরাফেরা করার কোন অর্থই হয় না। শিল্পের ছাত্রদের প্রতিটি প্রদর্শিত ছবি খুঁটিয়ে দেখা উচিত, যাতে ধীরে ধীরে তার ভেতর একটা বিচার শক্তি গড়ে ওঠে। ব্যাপারটা প্রচারকার্যের ব্যাপারও একই।
প্রচারকার্যের উদ্দেশ্য কোন এক ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়, জনসাধারণের বিশেষ কোন বস্তুর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করাই হল এর কাজ; একমাত্র এ পথেই তা জনসাধারণের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।
এখানে প্রচারকার্যের শিল্প কুশলতা এত পরিষ্কার এবং জোর করে মানুষের মনের মধ্যে গেঁথে দেওয়া যায়, যা তাদের মনে একটা বিশেষ মতবাদের বিষয়টার বাস্তবতা সম্পর্কে গড়ে তোলে, তার প্রয়োজনীয়তা এবং চারিত্রিক দিকটার সবিশেষ প্রয়োজনীয়তা তার উপলব্ধি করতে পারে।
যেহেতু এ শিল্প এখানেই শেষ নয়, কারণ এর উদ্দেশ্য হল প্রাচীরপত্রের বিজ্ঞাপনের মত; যার দ্বারা সুবিশাল জনসাধারণকে আকর্ষণ করা হয়। ব্যক্তিগত কোন একজনের জন্যে নয়, যে ইতিমধ্যে বিষয়টা সম্পর্কে একটা ধারণা নিয়ে বসে আছে। অথবা বিষয়টাকে বস্তৃতান্ত্রিক দিক দিয়ে বিচার করে একটা ধারণায় উপনীত হতে চায়–কারণ প্রচাররকার্যের উদ্দেশ্যই সেটা নয়। এর আবেদন হওয়া উচিত জনসাধারণের অনুভূতির কাছে, বিচারবুদ্ধির কাছে নয়।
সমস্তরকম প্রচারকার্য জনপ্রিয় উপায়ে পরিবেশন করা উচিত এবং এর বুদ্ধিমত্তার দিকটাও এমনভাবে ঠিক করা উচিত যা অপেক্ষাকৃত কম বুদ্ধিসম্পন্ন জনসাধারণকে ছুঁতে পারে, কারণ এদের উদ্দেশ্যই তো প্রচারকার্য চালানো। সুতরাং এর বুদ্ধিমত্তার দিকটা এমন হওয়া উচিত যাতে সাধারণ জনসাধারণের মধ্যে এটা পৌঁছতে পারে। যখন একটা পুরো জাতিকে এর আওতায় আনা প্রয়োজন, বিশেষ করে যুদ্ধের প্রচারকার্যের সময়ে, তখন উচ্চ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন নেতাকে এড়াবার জন্য এত বেশি মনযোগ দেওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ একটা দল সবসময়ই থাকে যারা সাধারণের চেয়ে অধিক যুক্তিসম্পন্ন।
যত বেশি বৈজ্ঞানিক প্রচলিত ধারায় এবং যত বেশি পরিমাণে তা’ জনতার অনুভূতির উদ্দেশ্যে প্রচারিত করা হবে, তত চরম সাফল্য আসবে। প্রচারকার্যের সত্যিকারের মূল্যায়ন এতেই নিহিত, ছোট্ট বুদ্ধিমত্তা বা শিল্পপ্রেমিক গণ্ডীতে নয়।
প্রচারকার্যের শৈল্পিক দিকটা হল–যার দ্বারা এটা জনসাধারণের কল্পনার দিকটা তাদের সূক্ষ্ম অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে জাগাতে পারে। এর মনস্তত্বের দিকটার গড়ন এমনভাবে হওয়া উচিত যা জাতীয় স্তরে গিয়ে আবেদন জানাতে সক্ষম হয়। এ ব্যাপারটাই আমাদের মধ্যে যাদের বুদ্ধি একেবারে উচ্চস্তরের তারা বুঝতে পারে না, এটাই হল তাদের মানসিক গর্ব বা জড়তার একটা প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
একবার যদি আমরা বুঝতে সক্ষম হই যে এ প্রচারকার্যের প্রবৃত্তিজনক শক্তি কত তীব্র জনসাধারণের ভেতরে, তবে নিচের ফলাফলগুলো আমরা প্রত্যক্ষ করব :
প্রচারকার্যের সংগঠন এবং প্রচার এমনভাবে হওয়া উচিত নয় যে এটা মনে হবে বহু প্রকার বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে গঠিত।
জনসাধারণের ধারণ ক্ষমতা অত্যন্ত পরিসীমিত; এবং তাদের বোঝার ক্ষমতাও দুর্বল। অপরদিকে, তারা যে কোন ব্যাপারে দ্রুত ভুলে যায়। এরকম ক্ষেত্রে, সমস্ত প্রকার কার্যকরী প্রচারকার্যের গণ্ডী কয়েকটা অতি প্রয়োজনীয় ব্যাপারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। এবং যার বহিঃপ্রকাশ হবে বাঁধা ধরা ছকে। এ শ্লোগান ক্রমাগত আবৃত্তি করে যেতে হবে,–যতক্ষণ না পর্যন্ত শেষ মানুষটা এর আওতায় আসে। যদি এ আদর্শকে তুলে বা প্রচারকার্যকে বিমূর্ত এবং সাধারণভাবে উপস্থিত করা হয়, তবে তা কোন কাজেই আসবে না–কারণ জনসাধারণ তা বুঝতে বা মনের ভেতরে ধরে রাখতে সক্ষম হবে না–যে উদ্দেশ্যে প্রচারকার্য চালানো হচ্ছে। সুতরাং সংবাদের পরিব্যপ্তি অনুসারে ধরন-ধারণ, পরিকল্পনা নির্ধারিত করা উচিত, যাতে মনস্তত্ত্বের দিক থেকে এটা প্রচণ্ড রকমের কার্যকরী হতে পারে।
কিন্তু এ শিল্প এখানেই শেষ নয়। কারণ এর উদ্দেশ্য হল একেবারে সেই বিজ্ঞাপনের প্রাচীরপত্রের মত, যার কাজ হল জনতাকে আকর্ষণ করা এবং যাদের ইতিমধ্যেই ব্যাপারটা সম্পর্কে একটি ধারণা সুসংগঠিত হয়েছে বা যারা ইতিমধ্যেই এর বস্তৃতান্ত্রিক দিকটার প্রতি আকৃষ্ট তাদের জ্ঞান বিতরণ–কারণ প্রচারকার্যের উদ্দেশ্য তা নয়; এ প্রচারকার্যের আবেদন হবে জনতার অনুভূতির কাছে, বিচার বুদ্ধির নিকটে নয়।
সমস্ত রকমের প্রচারকার্য জনপ্রিয় উপায়ে পরিবেশন করা উচিত। এবং এর বুদ্ধিমত্তার দিকটা এমন হওয়া উচিত যাতে সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন লোকদের এটা আকৃষ্ট করতে পারে। কিন্তু তার বুদ্ধিমত্তার কিছুটা এমন হওয়া চাই যাতে অতি অল্প বুদ্ধি সম্পন্ন জনতাও এটাকে উপলব্ধি করতে পারে; যাদের উদ্দেশ্যে এ প্রচারকার্য চালানো হচ্ছে। যখন পুরো একটা জাতিকে অখণ্ডভাবে এ প্রচারকার্যের ভেতরে আনার প্রয়োজন, যেটা বিশেষ করে যুদ্ধের প্রচারকার্যের আবশ্যক হয়ে পড়ে, তখন উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন লোকদের এর আওতার বাইরে রাখার জন্য অত বেশি সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন নেই।
প্রচারকার্যের এ বৈজ্ঞানিক প্রচলিত ধারার এবং যত বেশি পরিমাণে এটা জনসাধারণের অনুভূতিকে লক্ষ্য করে প্রচারিত করা হবে,–এর সাফল্যও তত চূড়ান্ত হবে। প্রচারকার্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষার এ-ই হল চরম মূল্য। মুষ্টিমেয় শিল্পী বা বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জনসাধারণের অনুমোদন নয়।
প্রচারকার্যের শৈল্পিক দিকটা হল জনসাধারণের ঘুমিয়ে থাকা কল্পনার সূক্ষ্ম দিকটাকে আবেদন দ্বারা জাগিয়ে তোলা; তার জন্য মনস্তত্ত্বের সেই বিশেষ দিকটাকে খুঁজে বার করা দরকার, যা জাতির জনসাধারণের হৃদয় অধিকার করতে সমর্থ হবে, শুধু আমাদের মধ্যে তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন, তাদের জন্য নয়। কারণ এ সচেতন বুদ্ধিসম্পন্নতা আর কিছুই নয়, নিজেদের সম্পর্কে গর্ব অথবা মানসিক জড়তার লক্ষণ।
একবার যদি আমরা বুঝতে পারি যে এ প্রচারকার্যের প্রবৃত্তিজনক ক্ষমতা জনতার মধ্যে কতখানি সুদূর প্রসারী, তবে নিচের শিক্ষাগুলো তা থেকে পেতে পারি :
প্রচারকার্যের সংগঠন বা পরিচালন এমন হওয়া উচিত নয় যাতে এটা অনেক প্রকারের বৈজ্ঞানিক অস্ত্রশস্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত বলে মনে হয়।
জনসাধারণের ধারণ ক্ষমতা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ; এবং তাদের বোঝার ক্ষমতাও দুর্বল। অপরদিকে তাদের স্মৃতিশক্তি প্রচণ্ডরকমের কম থাকার দরুন তারা সবকিছুই দ্রুত ভুলে যায়। এ কারণে সমস্ত রকমের প্রয়োজনীয় ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। এবং সেগুলোকে যতখানি সম্ভব একই প্রকারে পুনরাবৃত্তি করা উচিত। এসব ধ্বনি ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি করে যেতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না শেষ ব্যক্তিটি এ প্রচারকার্যের উদ্দেশ্যের কজায় এসে ধরা দেয়। এ আদর্শ ভুলে গেলে এ প্রচারকার্যের সমস্ত রকম উদ্দেশ্যই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। কারণ জনসাধারণের পক্ষে তাকে যা বলা হয়েছে তা হজম করা বা মনে রাখা সম্ভব হয়ে উঠবে না। সুতরাং প্রচারকার্যের গুরুত্ব বুঝে নিয়ে তাকে। এমনভাবে প্রচার করা উচিত যাতে জনসাধারণের মনস্তত্ত্বের দিকটাকে এটা সম্পূর্ণভাবে আকর্ষণ করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, শক্রদের মূল্যায়ণ ব্যাঙ্গাত্মক উপায়ে করা ভুল, যা অস্ট্রিয়ায় জার্মানদের পত্রিকাগুলো প্রচারকার্যের উদ্দেশ্য বলে গ্রহণ করেছিল। এ আদর্শগত দিকটাই হল ভুল; কারণ যখন তারা যুদ্ধের সময় শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়ায়, তখন আমাদের সৈন্যদের ধ্যান-ধারণা আলাদা ছিল ওদের সম্পর্কে। সুতরাং শেষ পর্যন্ত ওই ভুলের মাশুল বিধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যখন জার্মান সৈন্যরা বুঝতে পারে যে তাদের বিরোধী পক্ষের সৈন্যরা যথেষ্ট পরিমাণে সুশিক্ষিত, তখন তারা উপলব্ধি করে যে ভুল সংবাদ দ্বারা তাদের প্রতারণা করা হয়েছে। তাই তাদের সংগ্রাম শক্তিকে উদ্বুদ্ধ এবং শক্তিশালী করে তোলার চেয়ে এ সংবাদের কার্যকারীতা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সমস্ত উৎসাহটা ভেঙে পড়ে।
অপরদিকে বৃটিশ এবং আমেরিকান যুদ্ধের প্রচারকার্যের মনস্তত্ত্বের দিকটা যথেষ্ট পরিমাণে অভিজ্ঞ ছিল। জার্মান সৈন্যদের বর্বর এবং হুণদের মত নিষ্ঠুরভাবে চিত্রিত করে তাদের নিজেদের সৈন্যদের যুদ্ধের বর্বরতা এবং নির্দয়তার বিরুদ্ধে সুযোগ্য করে তুলেছিল। যার জন্য তাদের মধ্যে মিথ্যা স্বপ্ন বলতে কিছু ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে যেসব ভয়াবহ অস্ত্রের মুখোমুখি তাদের হতে হয়েছে–তার সংবাদ নিজেদের সরকারের মাধ্যমে আগেই তারা পেয়েছে। সুতরাং সরকারের সততায় তারা আরো অধিক পরিমাণে আস্থা রেখেছে। এ প্রকারে তাদের প্রচণ্ড ক্রোধ এবং ঘৃণা এ কুখ্যাত বিরুদ্ধপক্ষের সৈন্যদের ওপর গিয়ে পড়েছে। জার্মান যুদ্ধাস্ত্রর যে ভয়াবহ ফলাফল হয়েছে, যা তাদের কাছে জার্মানদের এ হুণ এবং বর্বর রূপেই প্রতিফলিত হয়েছে, যেটা সরকারের প্রচারকার্যের মাধ্যমে তাদের আগে থেকেই জানা ছিল। অপরদিকে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে মৈত্রীভাবের কারণে তাদের অস্ত্রে যে ভয়াবহতা সৃষ্টির পক্ষে সক্ষম তা মিথ্যা। দুর্ভাগ্যবশতঃ, জার্মানদের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টোটা ঘটেছে–যারা শেষ পর্যন্ত ঘরের সংবাদকে দলবাজী আর প্রতারণা বলে বাতিল করে দিয়েছে। এ ধরনের ফলাফল সম্ভব হয়েছিল কারণ দেশের সরকার এ প্রচারকার্যকে গর্দভ মস্তিষ্কের বেশি মূল্য দেয়নি এবং তাদের ধারণাই ছিল না যে প্রচারকার্যের জন্য নিপূণ বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন যা খুঁজে বের করতে হয়।
কিভাবে প্রচারকার্য চালাতে নেই–জার্মান যুদ্ধের প্রচারকার্য হল তার অতুলনীয় উদাহরণ এবং মনস্তত্বের দিক থেকে এটা একটা চরম ব্যর্থতার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তও বটে।
তবে যাদের চোখ খোলা ছিল, তারা শত্রুদের নিকট এ বিষয়ে অনেক জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পেয়েছিল; যাদের ইন্দ্রিয় গ্রাহ্যরূপ তখনো কঠিন হয়ে ওঠেনি এবং যারা সুদীর্ঘ সাড়ে চার বছর ধরে শক্রর প্রচারকার্যের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয় আমাদের লোকেরা প্রচারকার্যের সেই প্রথম কারণগুলোই বুঝতে পারেনি, যা প্রতিটি প্রচারকার্যের পরিপূর্ণতার জন্য প্রয়োজন। বিশেষ করে প্রচারিত প্রতিটি সমস্যার শুধু একদিকটাকেই তুলে ধরতে হবে। কিন্তু এ বিষয়ে এত বিস্তর ভুল করা হয়েছে যুদ্ধের শুরু থেকেই যে সন্দেহাতীতভাবে এ বোকামী আমাদের লোকের মুখামীকে সরাসরি প্রমাণ করে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, কয়েকটি নতুন ধরনের সাবানের বিজ্ঞাপনের অভিপ্রায়ের জন্য আমরা যে প্রাচীরপত্রের ব্যবহার করে থাকি, তাতে বিশেষ করে সাবানের চমৎকার দিকটা অবশ্যই তুলনামূলকভাবে অন্য ছাপ মারা সাবানের থেকে তুলে ধরা হয়ে থাকে না। এ বিষয়ে আমরা সবাই একমত হব; এবং রাজনৈতিক প্রচারকার্যও ঠিক এক ধারাতে চলে। প্রচারকার্যের লক্ষ্য সত্যকে সোজাসুজি উদঘাটিত করা নয়, কারণ তা তো অপর পক্ষের দিকে যাবে–আপাতদৃষ্টিতে যা তত্ত্বের দিক থেকে বিচার হয়ে থাকে। এটা শুধু সত্যের সেই দিকটাকেই প্রকাশ করবে যা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সাহায্য করবে।
কে যুদ্ধের উদ্যোক্তা, এ প্রশ্নের আলোচনায় যাওয়াটা হল গোড়াতেই ভুল এবং সেইসঙ্গে একক জার্মানির ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে দেওয়াটাও উচিত নয়–এটাকে প্রমাণ করতে যাওয়াটাও বোকামী। কোনরকম আলোচনা ছাড়াই যুদ্ধ শুরু করার পুরো দোষটা শর্কর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া উচিত।
এবং এ অর্ধ-সত্যের পরিণতিটা কি? সাধারণ সুবিশাল জনতা কুটনীতিজ্ঞ বা অধ্যাপক নয় যে জনসাধারণের ব্যবহার সম্পর্কে তাদের জ্ঞান থাকবে। তাদের মধ্যে এমন জ্ঞানও নেই যার দ্বারা তারা নির্দিষ্ট মতামত গঠন করতে পারে। কিন্তু এ টলমলে মানব সন্তানরা ক্রমাগত এক আদর্শ থেকে, আরেক আদর্শে দোল খায়। যেইমাত্র আমাদের নিজেদের প্রচারকার্য কিছুমাত্র আভাস দেয় যে শত্রুপক্ষেরও কিছুটা বিচারবোধ আছে, তৎক্ষণাৎ আমাদের নিজেদের বিচারবোধ সম্পর্কেই প্রশ্ন উঠবে। শত্রুপক্ষের শেষ কোথায় বা কোথা থেকেই বা আমাদের দোষের শুরু হয়েছে–এ পার্থক্য বিচার করার মত ক্ষমতা জনসাধারণের নেই; এসব বিষয়গুলোতে তারা সন্দেহের দোলায় দোলে এবং অবিশ্বাসী হয়ে পড়ে। বিশেষ করে শত্রুরা যেখানে তাদের উপদেষ্টাদের ঘাড়ে ভুলের বোঝা চাপিয়ে দেয়। শক্রদের প্রচারকার্য যে কথাগুলো বলেছিল, এ ব্যাপারে তার চেয়ে আর বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে, যা সমানুপাতিক এবং ভারসাম্যের দিক থেকে আমাদের প্রচারের থেকে অনেক বেশি উন্নত এবং এগুলোই আমাদের জনসাধারণকে ক্ষিপ্ত করে তোলে, প্রত্যেক শত্রুপক্ষের ওপর অন্যায় করা হচ্ছে বলে ভাবে। এমন কি এ ধারণা এত প্রবল হয়ে ওঠে যে আমাদের জাতির এবং দেশের ধ্বংসের বিনিময়েও তাদের মনোভাব বদলায় না।
স্বভাবতই জনসাধারণ সত্যের এদিকটাতে একেবারেই সচেতন ছিল না। এমন কি তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা বিষয়বস্তুটাকে এ দৃষ্টিকোণ থেকে কখনই বিচার করে দেখেনি।
জাতির মধ্যকার বিরাট একটা অংশ চারিত্রিক দিক থেকে স্ত্রীজনোচিত ছিল এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাবালুতার দ্বারা পরিচালিত, তীক্ষ্ম যুক্তির স্থান সেখানে কোথায়! এ ভাবালুতা কিন্তু জটিল মানসিকতার জন্য নয়। এটা প্রচণ্ড রকমের প্রভেদবুদ্ধিসম্পন্নও নয়। কিন্তু শুধু ভালবাসা বা ঘৃণার প্রতি ইতিবাচক ও নৈতিবাচক ধ্যান ধারণা, যেটা নির্ভুল এবং ভুল, সত্য এবং মিথ্যায় মিশ্রিত। এ ধ্যান ধারণার অর্ধেকটা এরকম, বাকি অর্ধেকটা কিন্তু সেরকম নয়। ইংরেজদের প্রচারকার্য বিশেষ করে এ দিকটাকে চমৎকারভাবে বুঝেছিল এবং সে কারণে অত সুন্দরভাবে তা ক্ষেত্র বিশেষে প্রয়োগেও সমর্থ হয়েছিল।
তারা ব্যাপারটায় কোনরকম দ্বিধার মনোভাব নিয়ে এগোয়নি। যে কারণে কারোর মনে কোনরকম সন্দেহেরও উদ্রেক হয়নি।
জনসাধারণের এ ভাবালুকতার দিকটা যে তারা কত চমষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছিল তার একটা অসাধারণ উদাহরণ হল— তারা শত্রুপক্ষকে যেভাবে বীভৎস এবং নির্দয় বলে চিত্রিত করেছিল বাস্তবে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের বর্ণনার সঙ্গে সমস্ত ব্যাপারটা হুবহু খাপ খেয়ে গিয়েছিল। সেই কারণে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের সৈন্যদের একতাবদ্ধতা আরো বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, যা চরম পরাজয়ের ক্ষেত্রেও বজায় ছিল। উপরন্তু, কাঠের তৈরি যন্ত্রণাদায়ক যন্ত্রবিশেষের মত তারা তাদের শক্ত অর্থাৎ জার্মানদের চিত্রিত করেছিল। ওদের প্রচারকার্যে যুদ্ধের সমস্ত দায়িত্ব যাদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা শুধু নির্দয় বা নিছক মিথ্যাতে পূর্ণ ছিল না, যেভাবে গাণিতিক ছকে বেঁধে তা জনসাধারণের কাছে উপস্থাপনা করা হয়েছিল, জনতা পরিপূর্ণভাবেই তা বিশ্বাস করেছিল। কারণ জনসাধারণের ভাবালুতা সব সময়েই শেষ পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়। এবং সেই কারণেই এ নিছক মিথ্যাকেও তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে।
এ প্রচারকার্যের কার্যকারীতা এত সুন্দর এবং তীক্ষ্মতার সঙ্গে হয়েছিল যে শুধু যুদ্ধের সুদীর্ঘ সাড়ে চার বছর নয়, আজ পর্যন্ত আমাদের দেশের লোকেদের মননশীলতা এবং বিষয়ের প্রতি একাগ্রতা তা অনেক পরিমাণে কমিয়ে দিয়েছে।
আমাদের প্রচারকার্য যে একই রকমের সফলতা লাভ করতে পারেনি, তার জন্য আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কারণ আমাদের প্রচারকার্যের দ্বিধার ভাবের মধ্যেই সে ব্যর্থতার বীজ ছিল। এবং বিষয়বস্তুর অসারত্বই তা জনসাধারণকে মনপ্রাণ দিয়ে সত্য বলে গ্রহণ করতে দেয়নি। একমাত্র আমাদের লক্ষ্যশূন্য রাষ্ট্রনেতারা কল্পনা করত যে তাদের শান্তিবাদীতার আশা উপচে পড়ে এ ধরনের উৎসাহের মূলে জল দিয়ে মানুষকে তার দেশের জন্য মৃত্যুর জন্য পর্যন্ত অনুপ্রাণিত করবে।
সুতরাং আমাদের সৃষ্ট বিষয়বস্তু যে শুধু অসার ছিল তা-ই নয়, ক্ষতিজনকও বটে।
এসব প্রচারকার্যের সঙ্গে যত বেশি প্রতিভাবান ব্যক্তিকেই জড়ো করা হোক না কেন, নিচেকার আদর্শগুলোকে এ সুরে বাঁধতে না পারলে তার কোন অর্থ-ই হবে না। প্রচারকার্যের গঞ্জ বিশেষ কয়েকটা চিন্তাধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত, এবং বারে বারে তাই পুনরাবৃত্তি সাপেক্ষ; এখানে, অন্যান্য অসংখ্য ক্ষেত্রের মত ধৈর্যই হল প্রথম এবং সর্বোত্তম সোপান সাফল্য লাভ করার পক্ষে।
বিশেষ করে প্রচারকার্যের ক্ষেত্রে, মার্জিত রুচি এবং উজ্জ্বল বুদ্ধিমত্তাকে কখনই সামনে স্থান দেওয়াটা উচিত হবে না। কারণ এ গুণগুলো থাকলে তারা সত্যিকারের প্রচারকার্যের গুণগুলোর স্রোতকে সাহিত্যাশ্রয়ী করে তা চায়ের আসরের উপযোগী করে তুলবে। জনতার দ্বিতীয় শ্রেণী সম্পর্কে একটা ধারণাকে সব সময় মনে রাখতে হবে যে: সাধারণ ব্যাপারগুলো তাদের মধ্যে কোন উত্তেজনার সৃষ্টি করতে পারে না। তাই তারা নিত্য নতুন উত্তেজনার খোরাকের জন্য সর্বদা উদগ্রীব হয়ে ঘুড়ে বেড়ায়।
এসব লোকেরা সব বিষয়েই অত্যন্ত তাড়াতাড়ি ক্লান্ত এবং আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। তাই তারা সর্বদাই কোনরকম পরিবর্তন চায়; এবং সেই পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের নিকটজনদের বোকামী থেকে নিজেদের দূরে রাখতে ব্যস্ত থাকে। এমন ভাবসাব করে যে পুরো ব্যাপারটা তারা একাই বোঝে। তথাকথিত উজ্জ্বল বুদ্ধিমানরাই হল প্রচারকার্যের প্রথম এবং প্রধান সমালোচক। নিপুণভাবে বলতে গেলে তাদের ভাবধারাই এ ব্যাপারে বিশেষভাবে দায়ী। কারণ তাদের কাছে পুরো ব্যাপারটাকে আদিম বলে মনে হয়। তারা সবসময়েই নতুন কিছু খোঁজে ফিরে। এজন্যেই তারা জনতাকে সুপরিকল্পিত উপায়ে অনুপ্রাণিত করার যে কোনরকম পন্থারই চিরন্তন শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। যে মুহূর্তে প্রচারকার্য তাদের রুচিসম্মত হয়, সে মুহূর্তে তা অসংলগ্ন হয়ে টুকরো আকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এ তথাকথিত দ্রসম্প্রদায়ের মনতুষ্টি এবং নানা ধরনের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনা এ প্রচারকার্যের উদ্দেশ্য নয়। এর সর্বপ্রধান কাজ হল জনসাধারণকে স্বমতে আনা যাদের ধীরবুদ্ধির জন্য যে কোন জিনিস বুঝতে যথেষ্ট সময় নিয়ে থাকে; একমাত্র ক্রমাগত পুনরাবৃত্তিই সেই জনসাধারণের স্মৃতিতে ব্যাপারটা খোদাই করে দিতে পারে।
প্রচারকার্যের প্রতিটি বার্তার ব্যাখ্যার শেষ সেই একবিন্দুতে; অবশ্য সামনের চিৎকারগুলো বিভিন্ন ধরনের এবং রকমারী দৃষ্টিকোণ থেকে করা একমাত্র এ উপায়ে প্রচারকার্যের দৃঢ়বদ্ধতা এবং গতিময়তা প্রকাশ পাওয়া সম্ভব।
এ পদ্ধতি ধরে এবং তাতে লেগে থেকে দৃঢ়তা এবং সংক্ষিপ্ত উপায়ে এগিয়ে গেলেই শেষে সাফল্য আসতে বাধ্য। এরই পুরস্কারস্বরূপ সে হঠাৎ এবং অবিশ্বাস্য ধরনের সাফল্যের দ্বারে গিয়ে উপস্থিত হবে।
যে কোন বিজ্ঞাপনের, তা রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক যা-ই হোক না কেন তার সাফল্য নির্ভর করে ক্রমাগত এবং কতখানি ধৈর্যের সঙ্গে তা সম্পাদিত হয়েছে।
এ ব্যাপারেও আমাদের শত্রুরা প্রচারকার্যের সংঘবদ্ধতার চমৎকার উদাহরণ স্থাপন করে। এটা মাত্র কয়েকটা বিষয়বস্তু ঘিরে ছিল–যা বিশাল জনসাধারণের উপযোগী এবং ব্যাপারগুলোকে পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছিল ধৈর্যের সঙ্গে একবার যখন বিষয়গুলো এবং যেভাবে তাদের উপস্থাপনা করা হচ্ছে তা পৃথিবী স্বীকার করে নেয়, তখন জনসাধারণই তাতে দৃঢ় সংলগ্ন হয়ে লেগে থাকে। হ্যাঁ, সমস্ত যুদ্ধকাল ধরে। প্রথম দৃষ্টিতে এটাকে বোকামী বলে মনে হলেও পরে মনে হবে সমস্ত ব্যাপারটাই বিরক্তি উৎপাদক; কিন্তু শেষে সবাই বিশ্বাস করবে।
কিন্তু ব্রিটিশ ব্যাপারটায় আরো বেশি কিছু বুঝত। এ অশরীরী অস্ত্রের সাফল্য জনসাধারণের ভেতরে কত গভীরে, এবং কখন তা সময় মত টেনে বার করতে হবে যাতে একটা বিশাল খরচের বিরাট অংশ উদ্ধার করা যায়।
ইংল্যান্ডে প্রচারকার্যকে প্রথম শ্রেণীর হাতিয়ার বলে গণ্য করা হয়, অথচ আমাদের দেশে বেকার রাজনীতিজ্ঞদের কাছে এটা হল শেষ আশার আশ্রয় এবং কর্তব্য পরাজুখ ব্যক্তির কাছে এটা হল আঁটসাট ও উষ্ণ ধরনের নায়কোচিত কাজকর্ম।
সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখলে ব্যাপারটার ফলাফল দাঁড়িয়েছিল নেতিবাচক।
———–
* সোয়াবিঙ হল মিউনিকের শিল্পীদের আস্তানা, যাতে তাদের
ছবি আঁকার স্টুডিও আর পড়াশোনার জায়গা — বিশেষ করে যাযাবর শিল্পীদের।