৬. যখন কেউ চিন্তাও করতে পারে নাই যে মিঠুন এরকম একটা কাণ্ড শুরু করে দিতে পারে
সকাল বেলা কেউ টের পায় নাই দিনটা এই বাসার ইতিহাসের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ একটা দিন হয়ে যাবে! দিনটা শুরু হয়েছে খুবই শান্তভাবে। সকালে সবাই ঘুম থেকে উঠেছে, হাত মুখ ধুয়েছে তারপর নাস্তা করতে বসেছে। মতিনের সকাল বেলা একটা জরুরি অপারেশন করতে হবে সে তাড়াতাড়ি নাস্তা করতে করতে মিঠুনকে ডাকল, এই মিঠুন। তাড়াতাড়ি আয় নাস্তা করবি।
মিঠুন ধীরে সুস্থে এসে গম্ভীর মুখে বলল, আমি নাস্তা করব না।
মতিন কথাটা ভালো করে বুঝল না। বলল, কী করবি না?
নাস্তা করব না।
মতিন ডিমপোচটা মুখে দিয়ে বলল, নাস্তা করবি না মানে?
নাস্তা করব না মানে, নাস্তা করব না।
ততক্ষণে মিঠুনের আম্মু রাণীও ডাইনিং টেবিলে এসেছে, জিজ্ঞেস করল, কী হচ্ছে এখানে?
মতিন পানি খেয়ে কেটলি থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল, তোমার ছেলে বলছে সে নাস্তা করবে না।
নাস্তা করবে না তো কী করবে?
মতিন বলল, আমি জানি না। তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করো।
রাণী মিঠুনকে জিজ্ঞেস করল, মিঠুন, তুই নাস্তা করবি না? শরীর খারাপ?
না শরীর খারাপ না।
তাহলে নাস্তা করবি না কেন?
আমি অনশন করছি।
মতিন তার চায়ে বিষম খেলো। রাণী জিজ্ঞেস করল, কী করছিস?
অনশন। তারপর অনশনের গুরুত্বটা বোঝানোর জন্য হেঁটে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিল।
মতিন চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বলল, তুই অনশন করছিস?
হ্যাঁ।
কেন?
কারো দাবি মেনে না নিলে সবসময় অনশন করে।
তোর দাবি মানা হয় নাই?
না।
কোন দাবি মানা হয় নাই?
আমরা মুক্তিযোদ্ধার ইন্টারভিউ নিতে চাচ্ছিলাম তোমরা যেতে দাও নাই।
মতিন কিছুক্ষণ হা করে মিঠুনের দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু হঠাৎ হি হি করে হেসে উঠল, তারপর বলল, তোমার ছেলেকে আমি যতই দেখি ততই অবাক হই।
মতিন বলল, আমার ছেলে বল না। অর্ধেক ক্রমোজম তোমার।
রাণী বলল, আই ডি এফ করার সময় মনে হয় উল্টাপাল্টা হয়ে গিয়েছিল।
মিঠুন মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। মতিন বলল, কতক্ষণ অনশন করবি?
এটা আমরণ অনশন।
আমরণ?
মিঠুন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ দাবি মানা না হলে আমরণ।
মতিন তার ঘড়ি দেখল, তারপর রাণীকে বলল, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি দেখো কী করতে পার।
রাণী বলল, দেখছি। তারপর নিজের প্লেটে টোস্ট নিতে নিতে গলার স্বর নরম করে বলল, আয় একটু খেয়ে নে। তারপর ভালো করে অনশন করতে পারবি।
মিঠুন মুখ শক্ত করে বলল, কেউ কখনো খেয়ে অনশন করে না।
ঠিক আছে দুধটা খেয়ে নে। দুধ খেলে অনশন ভাঙ্গে না। অনশন করলে লিকুইড খাওয়া যায়।
শুধু পানি খাওয়া যায়। আমি জানি। মিঠুন মুখ শক্ত করে বলল, আমার যখন পানি খাওয়ার ইচ্ছা করবে তখন পানি খাব। আর কিছু খাব না। অনশন।
কথা শেষ করে সে সত্যি সত্যি হেঁটে নিজের রুমে চলে গেল।
রাণী তার প্লেটে দুই টুকরো টোস্ট নিয়ে বসে রইল। তার এখন রেগে উঠার কথা কিন্তু রাগতে পারছে না।
.
রিতুকে মিলি ঘুম থেকে ডেকে তুলল, বলল, এই রিতু, ওঠ।
রিতু চোখ মুছতে মুছতে বলল, কী হয়েছে?
রাণী একটু আগে এসেছিল, বলে গেছে মিঠুন নাকি অনশন করছে। তার কোনো কথা শুনছে না। আমাকে বলেছে তোকে পাঠাতে। তুই গিয়ে একটু বুঝিয়ে বললে মনে হয় খাবে।
কিসের জন্য অনশন- জিজ্ঞেস করতে গিয়ে রিতু থেমে গেল। হঠাৎ করে সে বুঝে গেল মিঠুন কেন অনশন করছে, এবং সাথে সাথে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। ঠিক কী কারণ জানা নেই মিঠুন অনশন করছে জেনে তার মনে হলো সে ঠিকই করছে। তাদের সবারই অনশন করা উচিৎ।
রিতু বিছানা থেকে উঠে বসল। আজকে ছুটির দিন, ছুটির দিনে সে একটু দেরি করে ঘুমায়। কিন্তু এরকম একটা ঘটনার পর সে নিশ্চয়ই আর ঘুমাতে পারে না।
তিতু পাশেই ছিল রিতু বলল, চল তিতু মিঠুনকে দেখে আসি।
তিতু বলল, চল।
দুজন উপর তলায় গিয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। প্রথমে রাণী বিষয়টাকে হালকা ভাবে নিয়েছিল কিন্তু আস্তে আস্তে তার মেজাজ গরম হতে শুরু করেছে। রিতুকে ঢুকতে দেখে বলল, রিতু দেখ দেখি মিঠুনকে বোঝাতে পারিস কিনা। সকালে উঠেই ঢং শুরু করেছে, অনশন!
রিতু মিঠুনের রুমে ঢুকল। সে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে, একটা চাদর দিয়ে বুক পর্যন্ত ঢাকা। রিতু জিজ্ঞেস করল, মিঠুন, কী করছিস?
মিঠুন গম্ভীর গলায় বলল, আমরণ অনশন।
আমরণ?
হ্যাঁ।
মামি কিন্তু রেগে যাচ্ছে।
রাগুক।
কতক্ষণ না খেয়ে থাকবি।
যতক্ষণ দাবি মানা না হবে।
সত্যি?
খোদার কসম।
রিতু বলল, মামি বলেছে তোকে বোঝাতে।
কেউ আমাকে বোঝাতে পারবে না। যেই আমাকে বোঝাতে আসবে সেই হচ্ছে রাজাকার। রাজাকারের চামড়া তুলে নিব আমরা।
রিতু আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে বের হয়ে এল, রাণী জিজ্ঞেস করল, রাজি করাতে পেরেছিস?
নাহ।
রাণী নিজের চুল ঘামচে ধরে বলল, এই ছেলের যন্ত্রণায় আমার জীবনটা একদিন শেষ হবে।
রিতু কিছু বলল না, বলার কিছু নাই, কারণ কথাটা সত্যি। তিতু হঠাৎ করে ফিসফিস করে বলল, আপু।
কী হলো।
মনে হয় আমিও অনশন করে ফেলি।
রিতু অবাক হয়ে বলল, কি বললি?
তিতু বলল, আমিও অনশন করে ফেলব।
রিতু চোখ কপালে তুলে বলল, তুইও অনশন করে ফেলবি?
হ্যাঁ।
রাণী চোখ বড় বড় করে তিতুর দিকে তাকালো বলল, তুইও অনশন করবি?
হ্যাঁ মামি। মিঠুন একলা একলা অনশন করছে, দেখে খারাপ লাগছে।
দেখে খারাপ লাগছে?
হ্যাঁ মামি। যাই মিঠুনকে বলে আসি।
বলে তিতু মিঠুনের ঘরে গেল, মিঠুনের কাছে দাঁড়িয়ে বলল, এই মিঠুন আমিও তোর সাথে অনশন করব।
মিঠুন লাফ দিয়ে উঠে বসল, চোখ বড় বড় করে বলল, সত্যি?
সত্যি।
আমরণ অনশন?
হ্যাঁ। আমরণ।
মিঠুন হাত ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ইয়েস! তারপর একটু সরে বিছানার জায়গা করে দিয়ে বলল, এইখানে শুয়ে পড় তিতু ভাইয়া।
শুয়ে পড়ব?
হ্যাঁ, অনশন করলে শুয়ে থাকতে হয়।
তিতু মিঠুনের পাশে শুয়ে পড়ল। মিঠুন গম্ভীর গলায় বলল, অনশন করলে শুধু পানি খাওয়া যায়। আমি পানি এনে রেখেছি। তোমার পানি তেষ্টা পেলে বল।
ঠিক আছে।
একটু পরে রাণী আর রিতু এসে দেখল, বিছানায় মিঠুন আর তিতু গম্ভীর হয়ে শুয়ে আছে। চাদরটা তাদের বুক পর্যন্ত টেনে রেখেছে। রাণী হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না কিন্তু রিতু হাসি হাসি মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।
.
কিছুক্ষণের মাঝেই খবরটা নিচের তলায় টিটন আর টিয়ার কাছে পৌঁছে গেল। তারা মাত্র নাস্তা করতে বসেছিল, নাস্তা না করেই তারা তিতু এবং মিঠুনকে দেখতে গেল। তাদেরকে দেখে নিচে গিয়ে টিয়া তার আম্মু সীমাকে বলল, আম্মু মিঠুন আর তিতু ভাইয়া অনশন করছে। আমরণ অনশন।
এই বাসায় কেউ কোনো কিছু শুনে অবাক হয় না তাই সীমা বেশি অবাক হলো না। জিজ্ঞেস করল, কেন?
মুক্তিযোদ্ধার ইন্টারভিউ নিতে দেয় নাই সেই জন্যে।
তাই নাকি?
টিয়া মাথা নাড়ল, বলল, আমিও অনশন করব আম্মু।
সীমা শীতল গলায় বলল, তুই কী করবি?
অনশন। অনশন ধর্মঘট।
সীমা কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ টিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, কতক্ষণ করবি?।
যতক্ষণ দাবি মানা না হয়।
সীমা আবার কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ টিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, আমাকে রাগাবি না। সকালে উঠেই একটা ঢং।
টিয়া বলল, আম্মু আমি তোমাকে রাগাতে চাইছি না। কিন্তু মিঠুন আর তিতু ভাইয়া যদি অনশন করে তাহলে আমাদের করা উচিৎ।
কেন?
সব সময় সবকিছু এক সাথে করতে হয়।
সীমা টিটনের দিকে তাকিয়ে বলল, আর তুই? তুই অনশন করবি না?
টিটন মাথা চুলকালো, বলল, সবাই যদি করে ফেলে তখন তো আমাকেও করতে হবে।
করতে চাইলে এখনই বলে ফেল, আমি টেবিল থেকে নাস্তা তুলে ফেলি।
টিটন কোনো কথা না বলে আবার মাথা চুলকালো। তিতু আর সে সমবয়সী। একজন অনশন করছে আরেকজন করছে না, ব্যাপারটা কেমন দেখায়?
সীমা মুখ শক্ত করে বলল, তোরা যদি মনে করে থাকিস আমি তোদের খাওয়ার জন্য সাধাসাধি করব তাহলে কিন্তু অনেক ভুল করছিস। আমি কিন্তু একবারও সাধাসাধি করব না। যদি খাওয়ার ইচ্ছা করে নিজেরা খাবার রেডি করে খেতে হবে। বুঝেছিস?
টিটন আর টিটু এক সাথে মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।
ঠিক তখন মাসুদ বাথরুম থেকে বের হয়ে একটা তোয়ালে দিয়ে হাত মুখ মুছতে মুছতে ডাইনিং টেবিলে এসে বসল। আশেপাশে কী হচ্ছে সে এখনো কিছু জানে না। একটা প্লেট নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল, সবাই কোথায়? নাস্তা করবে না?
সীমা পাথরের মতো মুখ করে বলল, না। তোমার ছেলে আর মেয়ে অনশন ধর্মঘট করছে।
মাসুদ মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, বলল, অনশন ধর্মঘট?
হ্যাঁ।
কেন?
সীমা বলল, সেটা তুমি তোমার ছেলে মেয়ের কাছ থেকে শুনে নাও।
মাসুদ টিটন আর টিয়ার দিকে তাকালো। টিটন ইতস্তত করে বলল, আসলে মিঠুন আর তিতু করছে তো, এখন আমরাও যদি না করি সেটা কেমন দেখাবে।
মিঠুন আর তিতু কী জন্যে অনশন করছে?
ঐ যে কাল রাতের ব্যাপারটা। আমরা যে সবাই যেতে চাচ্ছিলাম একজন মুক্তিযোদ্ধার ইন্টারভিউ নিতে।
মাসুদ এবারে বুঝতে পারল। বলল, ও আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি।
মাসুদকে দেখে মনে হলো বিষয়টা বুঝতে পারার কারণে তার অনেক আরাম হয়েছে। সে মুখ কুঁচালো করে তার প্লেটে রুটি এবং সবজি নিল, তারপর খেতে শুরু করল।
সীমা মুখ শক্ত করে বলল, তুমি কিছু বলবে না?
কী আর বলব? মাসুদ ঘুরে টিটন আর টিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, শুধু কী অনশন নাকি আরো কোনো কর্মসূচি আছে?
টিয়া মাথা নাড়ল, বলল, না নাই।
মানব বন্ধন, গাড়ি ভাংচুর-
না। নাই।
ঠিক আছে। বলে মাসুদ আবার খেতে শুরু করে।
টিটন আর টিয়া একটু অপ্রস্তুত হয়ে নিজেদের ঘরে চলে গেল। সীমা মুখ শক্ত করে বলল, তুমি লাই দিয়ে এরকম বানিয়েছ।
আমি? আমি কখন লাই দিলাম?
এই যে এখন দিলে।
এখন?
হ্যাঁ, একটা ধমক দেবে তা না করে ঠাট্টা করলে।
মাসুদ হাসি হাসি মুখে বলল, বাচ্চা কাচ্চারা ছেলেমানুষী করছে। করতে দাও। যখন খিদে লাগবে তখন নিজেই এসে খেয়ে যাবে।
সীমা কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে রইল।
.
কিছুক্ষণের মাঝেই উপরে খবর পৌঁছে গেল যে টিটন এবং টিয়াও অনশন শুরু করেছে। বাকী আছে শুধু রিতু। সে ঘোষণা দিয়ে অনশন করল না সত্যি কিন্তু কিছু খেল না। মিলি যখন জিজ্ঞেস করল, রিতু বলল, সবাই না খেয়ে আছে, আমি কেমন করে খাই?
মিলি বলল, সবাই কতক্ষণ না খেয়ে থাকবে?
রিতু বলল, কতক্ষণ আর থাকবে? দেখো একটু পরেই যখন খিদে লাগবে অনশন ভেঙ্গে ফেলবে।
.
কিন্তু কেউ অনশন ভাঙ্গলো না। নাস্তার সময় পার হয়ে দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেল, সবাই চুপচাপ বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে রইল। রিতু উপর নিচ করতে লাগল। সে নিজেও না খেয়ে আছে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে কিন্তু অনশন বলে কথা।
তাদের আব্ব আম্মুরা প্রথমে বোঝালেন, তারপর আদর করলেন, তারপর রাগ হলেন, তারপর আবার আদর করলেন। তারপর চেঁচামেচি করলেন তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেরাই কান্না কান্না হয়ে গেলেন।
রাহেলা খাতুন সন্ধেবেলা খবর পেলেন, তারপর যা একটা কাণ্ড শুরু হলো সেটা বলার মতো না। সাথে সাথে উপরে ছুটে গেলেন, মিঠুন আর তিতুকে দেখলেন, তাদের সব কথা শুনলেন, তাদের আদর করলেন, তারপর তাদের নিয়ে নিচে নেমে এলেন টিটন আর টিয়ার কাছে। তাদের দেখলেন তারপর আদর করে সবাইকে একেবারে নিচে নিজের ঘরে নিয়ে এলেন। তারপর রিয়াকে পাঠালেন তার সব ছেলে মেয়ে ছেলের বউ মেয়ের– জামাই সবাইকে ডেকে আনতে। রিয়া কিছুক্ষণের মাঝে সবাইকে ডেকে নিয়ে এল।
রাহেলা খাতুন তার চেয়ারটিতে বসে আছেন অন্যেরা কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে রইল। রাহেলা খাতুন থমথমে মুখে জিজ্ঞেস করলেন, আমার সব নাতি নাতনিরা অনশন করছে ব্যাপারটা কী?
মিঠুন চিঁ চিঁ করে বলল, আমরণ অনশন।
আমরণের দরকার নাই। শুধু অনশনই যথেষ্ট। তারপর অন্যদের জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপারটা কী? বাসায় এত বড় একটা ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে আমি জানি না।
রাহেলা খাতুনের ছেলে মেয়ে এবং বউ জামাইয়েরা ইতস্তত করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত মাসুদ বলল, না মা, আমরা আসলে বুঝি নাই এরা এরকম পাগলামি শুরু করবে।
পাগলামো? রাহেলা খাতুন কেমন যেন রেগে উঠলেন। বললেন, এই বাসায় পাগলামো নিয়ে এর আগে তো কোনো সমস্যা হয় নাই। বাসার নাম দিয়ে রেখেছিস বকিল্লারে খা। এইটা পাগলামো না? দুইটা ছাগল ঘুরে বেড়ায় একটা সবুজ আরেকটা লাল এইটা পাগলামো না? বিড়ালকে রং করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বানিয়েছিস এইটা পাগলামো না? তাহলে এদের পাগলামোতে তোদের সমস্যাটা কী?
মিলি মিন মিন করে বলল, শুধু পাগলামো তো না, একটু রিস্কি। একলা কোন গ্রামে গিয়ে থাকবে বিপদ আপদ হতে পারে।
রাহেলা খাতুন ধমক দিয়ে বললেন, বিপদ আপদ যেন না হয় সেই ব্যবস্থা করবি।
মতিন মাথা চুলকে বলল, না, মানে, ইয়ে-
বাচ্চাগুলো একটা মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করার জন্য একটা গ্রামে যেতে চায় আর তোরা সেই জন্যে সাহায্য করবি না? তোরা জানিস তোদের বাপ যে মুক্তিযোদ্ধা ছিল? যুদ্ধ করতে গিয়ে মানুষটা যে মরেই গেছে সেটা জানিস না ভুলে গেছিস?
সব ছেলে মেয়ে এক সাথে কথা বলে উঠে, কী বলছ মা, তুমি এটা কী বলছ? বাবার কথা ভুলে যাব-
নাকি পুরা দেশ রাজাকারের দেশ হয়ে গেছে সেই জন্যে এখন সেইটা স্বীকার করতে ভয় পাস?
মিঠুন চি চি করে বলল, রাজাকারের চামড়া, তুলে নিব আমরা।
মতিন বলল, মা তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না। কোন গ্রামে যাবে চিনি জানি না, সময়টাও ভালো না। কোথায় থাকবে, কোথায় ঘুমাবে, কীভাবে যাবে কীভাবে আসবে, মানে পুরা ব্যাপারটার তো একটা প্ল্যানিং দরকার।
রাহেলা খাতুন বললেন, যদি প্ল্যানিং নাই তাহলে প্ল্যানিং করবি। দরকার হলে সাথে যাবি। নিজে যেতে না পারলে একটা ব্যবস্থা করে দিবি। তোদের এখন অভাবটা কীসের? আছে কোনো অভাব?
না, তা নাই।
তাহলে?
তারপরেও মানে হুট করে বললেই তো সব হয়ে যায় না- কাউকে করতে হয়।
রাহেলা খাতুন হঠাৎ রেগে উঠলেন, ঠিক আছে তোদের কিছু করতে হবে না। আমি করব। আমি ওদের গ্রামে নিয়ে যাব, ওদের সাথে থাকব। তারপর তাদের নাতি নাতনির দিকে তাকিয়ে বললেন, নে তোরা তোদের ব্যাগ রেডি কর। আমি নিয়ে যাব তোদের। তার আগে খেয়ে নে অনশন ভাঙ।
বাচ্চারা অন্য সময় হলে আনন্দে চিৎকার করত কিন্তু এখন যেহেতু রাগারাগি হচ্ছে মান অভিমান হচ্ছে, বাসার বড় মানুষেরা কথা বলছে তাই কেউ কোনো কথা বলল না, একজন আরেক জনের মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল।
রাহেলা খাতুনের বড় ছেলে বলল, তুমি নিয়ে যাবে কেন মা?
তোরা নিয়ে যাবি না সেই জন্যে আমি নিয়ে যাব। কী ভাবছিস, আমি পারব না?
না না, পারবে না কেন। তুমি চাইলে অবশ্যই পারবে।
হ্যাঁ, সেইটা মনে রাখিস। আমি চাইলে সব পারি। আমি একা তোদের চারজনকে বড় করেছি। খেয়ে না খেয়ে বড় করেছি। আর তোরা বড় হয়ে আমার নাতি নাতনিগুলোকে কষ্ট দিবি সেটা হবে না। সারাদিন থেকে না খেয়ে আছে, কী আশ্চর্য!
মতিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, মা, তুমি যখন আমাদের বড় করেছ আমরা খুবই ভালো ছেলে মেয়ে ছিলাম। তারপর নিজেদের ছেলে মেয়েগুলোকে দেখিয়ে বলল, আর এরা কী ভয়ংকর দুষ্টু তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। এই অনশনের ব্যাপারটা দেখো, সারা পৃথিবীতে তুমি এই বয়সী কোনো বাচ্চা পাবে যে এইভাবে তাদের বাপ মাকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারবে?
টিয়া নিচু গলায় বলল, এইটা তো ব্ল্যাকমেইল না, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ছিল।
সীমা বলল, মা দেখেছেন? আপনি দেখেছেন? কতো বড় ফাজিল দেখেছেন? আমাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শেখায়?
টিয়া একটু বিপদের লক্ষণ দেখে তাড়াতাড়ি রাহেলা খাতুনের কাছে চলে এল। অন্যরাও টের পেলো এখন এটাই সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা তাই তারাও গুটিগুটি তাদের নানি কিংবা দাদি রাহেলা খাতুনের আশে পাশে জায়গা নিল।
মাসুদ বলল, ঠিক আছে মা, তোমাকে যেতে হবে না। আমরা ব্যবস্থা করছি। এক দুইদিন সময় দিতে হবে। আমি একজনকে এদের সাথে পাঠাব দেখে শুনে রাখবে। তবে- বলে মাসুদ থেমে গেল।
রাহেলা খাতুন বলল, তবে কী?
তবে ওদেরকে বল এরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে কিন্তু জীবনেও যেন অনশন না করে।
রাহেলা কিছু বলার আগেই বাচ্চারা চিৎকার করে বলল, করব না। করব না। আর করব না।
মনে থাকে যেন।
রাহেলা খাতুন বলল, আয় এখন সবাই। কী খাবি বল?
মিঠুনের মা রাণী বলল, জিজ্ঞেস করবেন না মা, তাহলে বলবে পিজা না হলে ফ্রায়েড চিকেন। আমি খাবার নিয়ে আসছি।
.
বাচ্চারা খেতে খেতে টের পেল সারাদিন অনশন করলে খেতে যে কী ভালো লাগে সেটা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না।