০৬. ম্যাগেলান

ম্যাগেলান

৬. গ্রহ

লোরেন অবাক হল যে, চোখ খোলার আগেই কোথায় আছে সেটা সে ঠিক বুঝতে পেরেছে। দু’শ বছর নিদ্রার পর কিছুটা সন্দেহ থাকাটাই বরং স্বাভাবিক। কিন্তু মনে হচ্ছে মাত্র গতকাল সে মহাকাশযানের লগবুকে তার শেষ স্বাক্ষর করেছে। এবং যতদূর তার মনে পড়ে, একটা স্বপ্নও সে দেখেনি। এটা অবশ্য ধন্যবাদ পাবার মতো ব্যাপার।

চোখ বন্ধ করেই সে তার অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলোর দিকে মনোযোগ দিল। নিশ্চিতভাবে সে মৃদু গুঞ্জন শুনছে। মুখের ওপর দিয়ে পরিচিতভাবে বাতাস বয়ে যাচ্ছে, সুন্দর অ্যান্টিসেপ্টিকের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে মুখের চারপাশে।

কেবল ওজনের অনুভূতিটা পাওয়া যাচ্ছে না। সে অলসভাবে তার ডান হাতটা তুলল। সেটা বাতাসে ভাসতে লাগল পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায়।

একটা ফুর্তিবাজ গলা শোনা গেল

-হ্যালো মি. লোরেনসন। দয়া করে তাহলে আপনি আবার আমাদের সঙ্গ দিচ্ছেন। কেমন লাগছে?

লোরেন অবশেষে চোখ খুলে তার বিছানার পাশে ভাসতে থাকা ঝাপসা অবয়বটাকে চিনতে চেষ্টা করল।

-হ্যালো-ডাক্তার। ভালো, আমি ক্ষুধার্ত।

-এটা সবসময়ই খুব ভালো লক্ষণ। তুমি পোশাক পর। খুব তাড়াহুড়ো কোরোনা। আর দাড়ি রাখবে কিনা সেটা নিয়ে পরেই ভেবো।

লোরেন ভেসে থাকা হাতটা তার মুখের দিকে নিয়ে এল। খোঁচা খোঁচা দাড়ির পরিমাণ দেখে সে অবাক হল। অধিকাংশ মানুষের মতোই সে চিরতরে দাড়ি উঠিয়ে ফেলায় রাজী হয়নি। অবশ্য সাইকোলজির একটা খন্ডই শুধু লেখা হয়েছে এ ব্যাপারটায়। তবে এখন মনে হয় ওটা করতে হবে। চিন্তা করো, এই তুচ্ছ ব্যাপারটা কি বিশৃংখলার সৃষ্টি করেছে।

-আমরা কি নিরাপদে পৌঁছেছি?

-অবশ্যই। নইলে তো তুমি ঘুমাতে। সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়েছে। একমাস আগে থেকে মহাকাশযান আমাদের জাগাতে আরম্ভ করেছে আর এখন আমরা থ্যালসার কক্ষপথে। মেইনটেইনেন্স কু-রা সব চেক করেছে। এখন তোমাকে কিছু কাজ করতে হবে। এবং তোমার জন্য আমাদের একটা ছোট চমক আছে।

-নিশ্চয়ই ভালো কিছু।

-আমাদেরও তাই মনে হয়। মূল সভাকক্ষে দু’ঘন্টা পরে ক্যাপ্টেন বে একটা ব্রিফিং দেবেন। তুমি না যেতে চাইলে এখান থেকে দেখতে পার।

-আমি অবশ্যই যাব। সবার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে করছে। তবে প্রথমে কি আমি নাস্তাটা করে নিতে পারি। অনেক দিন তো হলো।

ক্যাপ্টেন সিরডার বেকে নতুন জাগানো পনেরোজনকে অভ্যর্থনা জানানোর সময় কিছুটা ক্লান্ত হলেও আনন্দিত দেখাচ্ছিল। তিনি তাদের তিরিশজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, যারা ক ও খ দলে ভাগ হয়ে কাজ করছে। মহাকাশযানের নিয়ম অনুযায়ী গ দলের ঘুমিয়েই থাকার কথা। তবে অনেকগুলো কারণ তাদের ওখানে থাকতে দেয়নি।

–আমি খুশি যে তোমরা আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। কিছু নতুন মুখ দেখতে ভালোই লাগে। আর এটাও আনন্দের যে আমাদের মহাকাশযান আমাদের প্রাথমিক দু’শ বছরের পরিকল্পনায় বড় কোন অসুবিধা না করেই এই গ্রহে এসে পৌঁছেছে। আমরা এখন থ্যালসায়। একদম ঠিক সময়ে। প্রত্যেকে দেয়ালজোড়া ডিসপ্লে বোর্ডের দিকে ঘুরে তাকাল। এর অধিকাংশটাই বিভিন্ন উপাত্ত আর মহাকাশযানের বর্তমান অবস্থার তথ্য দিয়ে ভরা। কিন্তু সবচে বড় অংশটা মহাশূন্যের দিকে একটা জানালার মতো। এটা একটা চমৎকার নীল-সাদা গ্লোবের ছবি দিয়ে ভরা এবং সম্ভবতঃ প্রত্যেকেই গভীর বিষাদের সঙ্গে পৃথিবীর সঙ্গে মিলটা লক্ষ্য করল। প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর থেকে যেমন দেখা যায় ঠিক তেমনি, প্রায় পুরোটাই সমুদ্র আর ছোট ছোট কয়েকটা স্থলভাগ।

এখানকার ভূ-ভাগটা হচ্ছে তিনটা ঘনসন্নিবিষ্ট দ্বীপ-মেঘ দিয়ে কিছুটা ঢাকা। লোরেন হাওয়াই এর কথা চিন্তা করল, যাকে আর দেখা যাবে না। যার কোন অস্তি তৃই আর নেই। অবশ্য একটা মৌলিক পার্থক্য আছে দুই গ্রহের ভেতর। পৃথিবীর অনেকটাই জমি আর থ্যালসার প্রায় পুরোটাই সাগর।

ক্যাপ্টেন গর্বের সঙ্গে বললেন,–এটা এখানেই আছে। আমাদের মিশনের পরিকল্পনায় যা ধরা হয়েছিল। তবে একটা ব্যাপার হলো যে, তারা আমাদের আশা করেনি। অবশ্যই এটা আমাদের পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করবে।

আমরা জানি যে, থ্যালসা, মার্ক এক ৫০০০ ইউনিট মডেল দিয়ে কলোনীতে পরিণত হয়েছিল। যেটা ২৭৫১ সালে পৃথিবীকে ছেড়ে আসে এবং ৩১০৯ সালে অবতরণ করে। সবকিছু ভালোই চলছিল। একশ ষাট বছর পর আমরা প্রথম সঙ্কেত পাই। থেমে থেমে প্রায় দু’শ বছর ধরে তা চালু ছিল। তারপর হঠাৎই সেটা থেমে যায় একটা বিশাল অগ্নৎপাতের বড় খবর পাঠিয়ে। আর কিছুই শোনা যায় নি। আমরা ধরে নেই যে কলোনীটা ধ্বংস হয়ে গেছে বা এটা কোন পর্যায়ের আদিমতায় ফিরে গেছে–যেটা কিনা অন্যান্য কয়েক ক্ষেত্রে ঘটেছে।

নতুনদের সুবিধার জন্য আমরা এখন পর্যন্ত কি পেয়েছি তা আমি আবারও বলছি। স্বাভাবিকভাবেই সৌরজগৎটায় ঢোকার পর আমরা সব ফ্রিকোয়েন্সীতে শোনার চেষ্টা করেছি। কিছু না, এমনকি পাওয়ার সিস্টেমের অপচয়ের বিকিরণও আমরা পাইনি।

অবশ্য আরও কাছে গিয়ে বুঝলাম যে, সেটা কিছুই প্রমাণ করে না। থ্যালসায় আয়নোস্ফেয়ার অত্যন্ত ঘন। মিডিয়াম বা শর্ট ওয়েভে নীচে অনেক কথাই বলা যেতে পারে, বাইরে থেকে কেউই শুনবে না। মাইক্রোওয়েভ অবশ্য যেতে পারে। তবে হয়তো তাদের তা দরকার নেই, অথবা দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা কোন বীমই ধরতে পারিনি।

যাই হোক সেখানে একটা উন্নত সভ্যতা আছে। রাতের আবহাওয়া ভালো থাকলে আমরা তাদের শহরের আলো দেখতে পাই। ওখানে কয়েকটা ছোট কারখানা আছে। আছে উপকূলীয় যাতায়াত ব্যবস্থা। তবে কোন বড় জাহাজ নেই। আমরা কয়েকটা ছোট বিমানও দেখতে পেলাম পাঁচশ ক্লিকের গতিসীমার মধ্যে। যেটা তাদের যেকোন জায়গায় পনেরো মিনিটের মধ্যে পৌঁছে দেয়।

অবশ্যই এরকম একটা ঘন সমাজে বিমানের খুব একটা দরকার নেই। আর তাদের বেশ ভালো রাস্তা আছে। এখনও আমরা কোন কমিউনিকেশন বের করতে পারিনি। আর কোন স্যাটেলাইটও নেই, এমনকি ভূ-তাত্ত্বিক জরিপের জন্যও। হয়তো তাদের দরকার নেই, যেহেতু তাদের জাহাজগুলো কখনোই দৃষ্টিসীমার বাইরে যায় না। যাবার অবশ্য কোন জায়গাও নেই। অবশেষে আমরা এখানে এসেছি। এটা খুব আকর্ষণীয় অবস্থা আর বেশ চমৎকারও। অন্ততঃ আমি আশা করি। কোন প্রশ্ন? জ্বি, মি. লোরেনসন?

-স্যার আমরা কি যোগাযোগের কোন চেষ্টা করেছি?

-এখনও না। আমাদের মনে হয় তাদের সংস্কৃতির মাত্রাটা না জেনে তাদের সঙ্গে কিছু করাটা ঠিক হবে না। যাই আমরা করি না কেন, সেটা তাদের জন্য বেশ বড় একটা ধাক্কা হবে।

-তারা কি জানে আমরা এখানে আছি?

-সম্ভবত না।

-কিন্তু আমাদের ড্রাইভ তো তাদের নিশ্চয়ই দেখার কথা।

-এটা অবশ্য একটা যৌক্তিক প্রশ্ন। কোয়ান্টাম র‍্যামজেট পুরো শক্তিতে কাজ করলে সেটা হয় মানুষের শ্রেষ্ঠ দৃশ্যমান কৌশল। যা কিনা দেখা যাবেই। এটা আণবিক বোমার মতো উজ্জ্বল কিন্তু মিলিসেকেন্ডের বদলে এটাকে দেখা যায় মাস ধরে। তবে সন্দেহ আছে। আমাদের গর্জনের অধিকাংশটাই হয়েছে যখন আমরা সূর্যের অন্য পাশে ছিলাম। এর ঔজ্জ্বল্যে আমাদের দেখার কথা নয়।

এরপর সবাই যে কথাটা ভাবছে, সেটাই একজন জিজ্ঞেস করল।

–ক্যাপ্টেন, এটা আমাদের মিশনকে কিভাবে প্রভাবিত করবে? সিরডার বে বক্তার দিকে চিন্তিত ভাবে তাকালেন

–এপর্যায়ে এটা বলা দুঃসাধ্য ব্যাপার। আরও কয়েকশ, হাজার মানুষ পুরো ব্যাপারটাকে অনেক সহজ করে দেয়। বা অন্ততঃ আরামদায়ক করে তোলে। কিন্তু যদি তারা আমাদের পছন্দ না করে…

তিনি শ্রাগ করলেন।

-এক পুরোনো অভিযাত্রীর একটা উপদেশ মনে পড়ছে। তুমি যদি স্থানীয়দের বন্ধু ভাব, তাহলে তারাও ভাববে। আর উল্টো ভাবলে উল্টোটা। যতক্ষণ অন্যকিছু প্রমাণিত না হচ্ছে আমরা তাদের বন্ধুবৎসই ভাবব। আর যদি তারা তা না হয়…

ক্যাপ্টেনের ভঙ্গীটা কঠোর হয়ে গেল। তার কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হয়ে গেল এক অধিনায়কের যে কিনা তার মহাকাশযানকে মাত্রই পঞ্চাশ আলোকবর্ষ পেরিয়ে নিয়ে এসেছেন।

-গায়ের জোরই ঠিক এটা আমি কখনোই বলিনি। তবে এটা থাকাটা বেশ স্বস্তির ব্যাপার।

৭. শেষের দিনের প্রভুরা

এটা সত্যি আশ্চর্যের ব্যাপার যে, সে সত্যি সত্যি আবার জেগে উঠেছে এবং জীবনটাও আবার চলছে।

লেফটেন্যান্ট কমান্ডার লোরেন লোরেনসন জানত যে, সে কখনোই সেই ট্র্যাজেডীর হাত থেকে বের হতে পারবেনা, যা কিনা চল্লিশ প্রজন্ম ধরে ছায়ার মতো লেগে আছে এবং তার নিজস্ব জীবনেই তা চূড়ান্তে পৌঁছুবে। প্রথম কয়েকটা দিন সে একটু ভয়ে ছিল। এমনকি ম্যাগেলানের নীচের চমৎকার সামুদ্রিক গ্রহের কোন রহস্য, কোন আশাও তাকে ঐ চিন্তা থেকে বিরত রাখতে পারত না। দু’শ বছর পর স্বাভাবিক ঘুমে কি স্বপ্ন সে দেখবে?

সে এমন একটা দৃশ্যের স্বাক্ষী যা কিনা কেউ কোনদিন ভুলতে পারবে না। আর মানবজাতিকে তা শেষ সময় পর্যন্ত তাড়া করে ফিরবে। মহাকাশযানের টেলিস্কোপ দিয়ে সে দেখেছে সৌরজগতের মৃত্যু। নিজের চোখে সে দেখেছে মঙ্গলের আগ্নেয়গিরিগুলো লক্ষ বছর পরে প্রথম বারের মতো জেগে উঠল। আবহাওয়ামন্ডল উঠে যাওয়ায় ধ্বংস হবার ঠিক আগে শুক্র আবরণহীন হয়ে গেল। গ্যাসীয় দানবটা ভাস্বর হয়ে জ্বলতে লাগল। কিন্তু পৃথিবীর ট্র্যাজেডীর তুলনায় এগুলো কিছুই না। সেটাও অবশ্য সে ক্যামেরার লেন্সের ভেতর দিয়েই দেখেছিল। পৃথিবী কয়েক মিনিটের বেশী টেকেনি সেইসব মানুষদের চাইতে, যারা শেষ সময়গুলো উৎসর্গ করেছিল তাদের তৈরী করতে। সে দেখেছে…

বিশাল পিরামিডগুলো গলিত পাথরে পরিণত হবার আগে কি রকম লাল হয়ে উঠছিল…

আটলান্টিকের তলদেশ সেকেন্ডে পাথরের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং আবারও ডুবে গিয়েছিল মাঝ সমুদ্রের আগ্নেয়গিরিগুলোর লাভার স্রোতে…

ব্রাজিলের জ্বলন্ত অরণ্যের ওপর শেষ বারের মতো চাঁদ উঠেছিল সূর্যের মতোই উজ্জ্বল হয়ে…

দীর্ঘদিন ডুবে থাকার পর এ্যান্টার্টিকা জেগে উঠল, যখন প্রাচীন কিলোমিটার পুরু বরফ গলে গেল…

জিব্রাল্টার ব্রীজের মাঝের শক্তিশালী খিলান জ্বলন্ত বাতাসে উড়ে গেল…

শেষ শতাব্দীতে পৃথিবী ভূতের সঙ্গে যুদ্ধ করল–মৃতদের নয় বরং যারা এখনও জন্মাতে পারে নি। পাঁচশ বছর ধরে জন্মহার এমনভাবে কমিয়ে আনা হয়েছে, মানবজাতি কয়েক মিলিয়নে নেমে গেছে শেষের সে সময়ে। সব শহরগুলো এমনকি দেশগুলোও মরুভূমির মতো পরে রইল। কেননা মানবজাতি গাদাগাদি করে রইল একসঙ্গে ইতিহাসের শেষ ঘটনার জন্য।

এটা ছিল একটা অদ্ভুত বৈপরীত্যের সময়। হতাশা আর উন্মত্ত আনন্দের মধ্যে দোল খাওয়া। অনেকেই বিস্মৃতি পেতে চাইল প্রচলিত ড্রাগস, রমণ আর বিপদজনক খেলায়-স্বীকৃত অস্ত্র নিয়ে, সতর্কভাবে পরিচালিত ছোটখাট যুদ্ধ সেগুলো। ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা, অন্তহীন ভিডিও গেম, সক্রিয় স্বপ্ন, মস্তিষ্ককে সরাসরি উত্তেজিত করা ইত্যাদিও সমান জনপ্রিয় ছিল।

কারণ পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হবার কোন দরকার ছিল না। পৃথিবীর সম্পদ এবং অর্থ খুব পরিষ্কার বিবেক নিয়েই উড়িয়ে দেয়া যায়। বস্তু হিসেবে হিসাব করলে সমস্ত মানুষই কোটিপতি, যা তাদের পূর্বপুরুষরা চিন্তাও করতে পারেনি। বিকৃত একটা গর্বের সঙ্গে তারা তাদের বলত- শেষের দিনের প্রভু। বিস্মৃতির মধ্যে হারিয়ে যেতে অধিকাংশরা পছন্দ করলেও সব সময়ের মতো কিছু মানুষ ছিল যারা তাদের নিজের জীবনেরও পরের কোন লক্ষ্যের প্রতি কাজ করতে আগ্রহী। অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা চলতে লাগল। বিশেষত মুক্ত হয়ে যাওয়া সব সম্পদ দিয়ে। যদি কোন পদার্থবিদ কয়েকশ টন সোনা চাইত পরীক্ষার জন্য, সেটা জোগাড়েই যা সমস্যা হবে কেনায় নয়।

তিনটা ভাব প্রাধান্য পেল। প্রথমটা হলো সূর্যকে সার্বক্ষণীক ভাবে পর্যবেক্ষণ করা। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে নয় বরং ধ্বংসের সময়টার ভবিষ্যৎবাণী একদম নিখুঁত করে করার জন্য, বছর দিন ঘন্টাসহ…

দ্বিতীয়টা হলো ভিনগ্রহের বুদ্ধিমানদের খোঁজা। শতাব্দীর ব্যর্থতার পর যা অগ্রাহ্য করা হয়েছিল এখন তার নিশ্চিত প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা গেল। তবে এমনকি শেষেও আগের চাইতে বড় কোন সাফল্য ধরা পড়ল না। মানুষের এতো প্রশ্ন সত্ত্বেও মহাবিশ্ব তার নোংরা উত্তরই দিয়ে গেল।

আর তৃতীয়টা হল কাছাকাছি নক্ষত্রগুলোকে কোনী করা, যাতে মানব জাতি সূর্যের মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকতে পারে।

শেষ শতাব্দীর শেষ দিকে পঞ্চাশটারও বেশী লক্ষ্যে আগের চাইতে দ্রুত ও আধুনিক মহাকাশযান পাঠান হল। অধিকাংশই ধারণার মতো ব্যর্থ হল, কিন্তু অন্ততঃ দশটা আংশিক সাফল্যের বার্তা পাঠাল। শেষেরগুলোর প্রতি আশা অনেক বেশী থাকলেও সেগুলো পৃথিবী ধ্বংসের আগে পৌঁছুতেই পারবে না। একদম শেষেরটা আলোর গতির বিশ শতাংশে পৌঁছুতে পারে এবং নশ পঞ্চাশ বছরেই সব কিছু ঠিকঠাক চললে লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবে।

লোরেন এখনও চাঁদ ও পৃথিবীর মাঝখানের নির্মানস্থান থেকেই “এক্সক্যালিবারের” উৎক্ষেপনটা স্মরণ করতে পারে। যদিও তখন তার বয়স মাত্র পাঁচ কিন্তু সে জানত এটাই এধরনের শেষ মহাকাশযান। কিন্তু শতাব্দীব্যাপী লম্বা এই পরিকল্পনা, প্রযুক্তির পরিপূর্ণতায় এসে কেন বাতিল হলো তা বোঝার বয়স অবশ্য তার ছিল না। এমনকি পৃথিবীর শেষ যুগগুলোর বিস্ময়কর আবিষ্কার মানবজাতিকে নতুন আশা দেবার সঙ্গে সঙ্গে তার জীবন কিভাবে বদলে গেল সে সমন্ধেও তার বোঝার বয়স হয়নি। অসংখ্য তত্ত্বীয় গবেষণা হলেও কেউই মানুষ চালিত মহাকাশ যাত্রার বাস্তব রূপ দেখাতে পারেনি-এমনকি পাশের নক্ষত্রটি পর্যন্ত। শত বছরের যাত্রায় সময়টা ব্যাপার না। সেটা হিমনিদ্রার মাধ্যমেই মেটানো সম্ভব। লুই পাস্তুর উপগ্রহ হাসপাতালে একটা বাঁদর এক হাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে আছে এবং এখনও সেটার মস্তিষ্কের কাজ স্বাভাবিক। মানুষ যে পারবেনা তাও ঠিক না। কারণ এক সন্দেহভাজন ক্যান্সারের রোগী দু’শ বছরের বেশী ধরে ঘুমিয়ে আছে। শারীরবৃত্তীয় সমস্যার সমাধান আছে। কিন্তু প্রযুক্তির সমস্যাটা দুর্লজ্জ। হাজার খানেক নিদ্রিত মানুষ নিতে পারে এমন একটা মহাকাশযান প্রাচীন সামুদ্রিক জাহাজের মতোই হবে। এধরনের একটা জাহাজ মঙ্গলের পর গ্রহাণুর অফুরন্ত সম্পদ ব্যবহার করে বানানো সম্ভব। কিন্তু বিশাল সময় ধরে কাজ করবে এধরনের। ইঞ্জিন তৈরী হচ্ছে অসম্ভব।

আলোর গতির এক দশমাংশের গতি হলেও সবচে কাছের সম্ভাবনাময় লক্ষ্যে যেতে পাঁচশ বছর লাগবে। ছোট রোবট যানগুলো এই গতি তুলতে পারে। কাছের নক্ষত্রগুলোর দিকে ধেয়ে যায় আর প্রথম বারের উন্মাতাল ঘন্টার বর্ণনা পাঠায়। কিন্তু তারা কোনো ভাবেই তাদের অবতরণের গতিকে কমিয়ে আনতে পারে না। দুর্ঘটনা না হলে তারা তাদের গতিবেগ বাড়িয়েই যায়। রকেট নিয়ে এটা একটা মূল সমস্যা এবং গভীর মহাশূন্য ভ্রমনে এর বিকল্পও কেউ দেখাতে পারেনি। গতি ওঠানোর মতোই গতি নামানোও একই সমস্যা। গতি কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানী নেয়া শুধু যাত্রাকে দ্বিগুন ঝামেলাই দেয় না। এটা অসম্ভব করে তোলে।

একটা মহাকাশযানকে আলোর গতির এক দশমাংশে তোলা যায়। কয়েক মিলিয়ন টন জ্বালানী দিয়ে কাজটা কঠিন হলেও সম্ভব। কিন্তু যাত্রার পর সেই গতি কমাতে আবার মিলিয়ন না তারও বেশী মিলিয়ন মিলিয়ন টন জ্বালানী লাগবে। এটা সম্ভব নয় বলেই কেউ এটা নিয়ে চিন্তা করেনি।

আর এরপরই হল ইতিহাসের সবচে বড় রসিকতা। মানবজাতিকে মহাবিশ্বের চাবি দিয়ে দেয়া হলো এবং মাত্র এক শতাব্দী পেল তারা তা ব্যবহারের জন্য।

৮. পুরোনো সেই দিনের কথা

মোজেস ক্যালডর ভাবল, কি সৌভাগ্যবান আমি। আমি কোনদিন শিল্প কলা এবং প্রযুক্তির প্রলোভনে আকর্ষিত হইনি, যা কিনা হাজার বছর ধরে মানবজাতিকে দেয়া হয়েছে। ইভলিনের ইলেকট্রনিক ভূতকে কয়েক গিগাবাইটের প্রোগ্রামে নিয়ে আসার কোন ইচ্ছে কি আমার ছিল?

সে আমার সামনে আসতে পারত। যে কোন পটভূমিতে আমরা ভালোবাসতে পারতাম এবং এমনভাবে কথা বলতাম যে কোন আগন্তুক বুঝতেই পারত না যে, সেখানে কেউ বা কিছুই নেই।

কিন্তু পাঁচ বা দশ মিনিট পর আমি নিজেকেই জোর করে প্রতারিত করব। আর সেটা আমি কখনোই করব না। যদিও আমি কেন এর বিরুদ্ধে সে সম্বন্ধে আমি নিজেই নিশ্চিত না। আমি সব সময় মৃতের সঙ্গে মিথ্যে সান্তনার বাণী শোনাকে প্রত্যাখান করেছি। এমনকি আমি তার কণ্ঠের সাধারণ রেকর্ড পর্যন্ত রাখিনি। এর চাইতে এইই ভালো। এই নিস্তব্ধতার মধ্যে তাকে দেখা। আমাদের শেষ বাড়ীর ছোট্ট বাগানে। এটুকু অন্ততঃ জানা, যে এটা কোন প্রতিরূপ বানিয়ের তৈরী নয়, এটা সত্যিই হয়েছিল দু’শ বছর আগের পৃথিবীতে। এখানে এখন শুধু আমারই কণ্ঠস্বর। আমার নিজেরই স্মৃতির সঙ্গে কথা বলা-যা আমার মানবীয় মস্তিষ্কে বেঁচে আছে।

ব্যক্তিগত রেকর্ডিং এক। আলফা স্ক্র্যামেবেলর। স্বয়ংক্রিয় মুছে যাওয়া প্রোগ্রাম। ইভলিন, আমরা এখানে। এবং আমি ঠিক প্রমাণিত হইনি। এই মহাকাশযানের সর্বজেষ্ঠ্য ব্যক্তি হলেও আমি এখনও কাজের।

জেগে দেখি, ক্যাপ্টেন বে আমার পাশে। প্রথম অনুভূতিটাই হলো গর্বের। বললাম, ভালো ক্যাপ্টেন। আমি সত্যিই অবাক হচ্ছি। অর্ধেক আশংকা ছিল যে আমাকে অপ্রয়োজনীয় ভেবে না মহাশূন্যেই রেখে আস।

তিনি হাসলেন।

-সেটা এখনও হতে পারে মোজেস। যাত্রা এখনও শেষ হয়নি। তবে তোমাকে আমাদের দরকার। মিশনের পরিকল্পনাকারীরা তোমার চাইতে জ্ঞানী ছিলেন।

-তারা তো আমাকে জাহাজে আভিধানিক দূত হিসেবে আর অআভিধানিক কাউন্সিলর হিসেবে লিখেছিলেন। কোনটায় আমাকে দরকার?

-দুটোই। এবং সম্ভবত তোমার ভূমিকা হবে

-তুমি কুসড়ার শব্দটা ব্যবহার করতে চাচ্ছ! শব্দটা আমার পছন্দ না, আর আমি নিজেকে কোন কিছুর নেতা ভাবতেও পছন্দ করি না। আমি শুধু মানুষকে তাদের নিজেদের জন্য ভাবাতে চেষ্টা করি। আমাকে অন্ধভাবে কেউ অনুসরণ করুক তা আমি মোটেই চাইনি। ইতিহাস অনেক নেতা দেখেছে।

-সবাইতো আর খারাপ না। তোমার নামের নেতার কথাই ধরো।

অতিরিক্ত বলা হয়। অবশ্য তোমার প্রশংসার কারণ আমি বুঝি। কারণ তোমরা দু’জনই গৃহহীন একটা জাতিকে প্রতিশ্রুত ভূমিতে নিয়ে যাচ্ছ। আমার মনে হয় সামান্য কোন সমস্যা হয়েছে।

-তুমি যে সম্পূর্ণ সজাগ তা দেখে আমি আনন্দিত। এ অবস্থায় কোন সমস্যা নেই। থাকা উচিতও নয়। কিন্তু এমন একটা অবস্থা হয়েছে, আর তুমি হচ্ছ একমাত্র কূটনীতিক। তোমার একটা দক্ষতা আছে, যা আমাদের লাগবে বলে ভাবিনি।

তোমাকে আমি বলছি ইভলিন সেটা আমাকে একটা ঝাঁকুনি দিল। আমার চোয়াল ঝুলে পড়তে দেখে নিশ্চয়ই ক্যাপ্টেন বে নির্ভুলভাবে আমার মন বুঝতে পেরেছিলেন।

-না, না আমরা কোন ভিনগ্রহবাসীর কাছে যাচ্ছি না। তবে থ্যালসার মানবজাতি আমাদের ধারণামত ধ্বংস হয়নি। বরং সেটা ভালোই চলছে।

সেটা অবশ্য আরেক আনন্দদায়ক বিস্ময়। থ্যালসা, সমুদ্র-সমুদ্র। যে জগৎটাকে আমি দেখব বলে ভাবিনি। আমি যখন জেগেছি তখন আমি অনেক আলোক বর্ষ দূরে আর শতাব্দী পেরিয়ে এসেছি।

–অধিবাসীরা কেমন? তোমরা কি যোগাযোগ করেছ?

-এখনও না। ওটা তো তোমার কাজ। পেছনের ভুল ভ্রান্তি সম্বন্ধে তুমি ভালো জান। আমরা এখানে তার পুনরাবৃত্তি চাই না। এখন যদি তুমি ব্রীজে আস তাহলে আমি তোমাকে আমাদের অনেক দিনের হারানো ভাইদের সম্বন্ধে হালকা ধারণা দেব।

ইভলিন এটা ছিল এক সপ্তাহ আগে। কি আনন্দের ব্যাপার। কোন অলংঘনীয় এবং নিশ্চিত শেষ সময়সীমার চাপ নেই। থ্যালসা সম্বন্ধে আমরা এখন এতোটাই জানি যে আমরা মুখোমুখি হব। এবং সেটা হবে আজ রাতেই। আমাদের সদিচ্ছা দেখাবার জন্য আমরা পরিচিত জায়গাটাই বেছে নিচ্ছি। প্রথম অবতরণের জায়গাটা পরিষ্কার দেখা যায়। সেটা বেশ ভালো ভাবে রাখা। অনেকটা পার্ক কিংবা হয়তো তীর্থস্থানের মতো। এটা অবশ্য খুব ভালো চিহ্ন। আমি শুধু আশা করছি তারা আমাদের দেবতা ভাবতে পারে, যেটা আমাদের কাজকে সহজই করে দেবে। থ্যালসানরা কি দেবতা সৃষ্টি করছে কিনা আমি বের করতে চাই।

আমি আবার আমার জীবন শুরু করেছি। এবং সত্যি সত্যি তুমি আমার চাইতেও জ্ঞানী ছিলে–তথাকথিত দার্শনিক না হয়েও। যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ তার সাথীদের সাহায্য করতে পারে, ততক্ষণ তার মৃত্যুর অধিকার নেই। অন্যকিছু ভাবাটা হতে স্বার্থপরের মতো… তোমার পাশে চিরতরে শুয়ে থাকা, যে জায়গাটা বহু আগে বহুদূরে আমরা পছন্দ করেছিলাম… এখন আমি মেনে নিয়েছি যে তুমি সৌরজগতে ছড়িয়ে আছ–আমি সারাজীবনে পৃথিবীর যা কিছু ভালোবেসেছি তার সঙ্গেই।

না, এখন কাজের সময় হলো। আর তুমি কি জান তোমার সঙ্গে যখন আমি স্মৃতিতে কথা বলি, তুমি তখন জীবিতই থাক।

৯. সুপারস্পেসের প্রশ্ন

বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানীদের যে মনস্তাত্ত্বিক আঘাতটা সহ্য করতে হয়েছে তা হল “শূন্য” স্থানের মতো ভিড়াক্রান্ত জায়গা আর দ্বিতীয়টি নেই এ সত্যের আবিষ্কার। প্রকৃতি শূন্যতা পরিহার করে অ্যারিস্টোলীয় যুগের এ তথ্যটা সম্পূর্ণ সত্যি এমনকি যখন কোন জায়গা থেকে পদার্থের শেষ অণুটিও সরিয়ে ফেলা হয়, তখনও সেখানে মানবীয় অনুভূতির বাইরে অকল্পনীয় শক্তি ছড়িয়ে থাকে। তুলনা করলে নিউট্রন নক্ষত্রের প্রতি কিউবিক মিলিমিটারে শত মিলিয়ন টনের ভরের সবচে জমাট বস্তুটিও, অধরা ভৌতিক জিনিস “সুপার স্পেসে” একটা ফোম জাতীয় জিনিস। অস্বস্তিটা হল স্পেসে (স্থান) সাধারণ ধারণার চাইতে বেশী কিছু আছে। ১৯৪৭ সালে ল্যাম্ব আর রাদারফোর্ডের ক্ল্যাসিক কাজেই যা বোঝা গিয়েছিল। হাইড্রোজেন পরমাণু–সবচে সরলতম পরমাণু পর্যবেক্ষণের সময় তারা বুঝতে পারলেন কিছু একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে, যখন নিঃসঙ্গ ইলেকট্রনটা প্রোটনকে কেন্দ্র করে ঘোরে। মসৃণ একটা পথে ঘোরার চাইতে এটা অতি আণুবীক্ষণীক স্কেলে সবসময় অবিশ্রান্ত ভাবে ওঠানামা করে। কঠিন সত্যটা হল যে, শূন্যতাটার নিজের ভেতরেই ওঠানামা হয়।

সেই গ্রীকদের সময় থেকে দার্শনিকরা দু’ভাগে বিভক্ত। একদল ভাবে প্রকৃতি মসৃণভাবেই পথ চলে। আর যারা এর প্রতিবাদ করে তারা বলেন, সব কিছুই আলাদাভাবে ধাক্কাধাক্কি করে চলে। আনবিক তত্ত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষেই গেল। আর যখন প্ল্যাংকের তত্ত্ব দেখাল যে এমনকি আলো বা শক্তিও নিরবিচ্ছিন্নভাবে না এসে থোকা থোকা হিসেবে আসে তখন বিতর্কটা সত্যিকার অর্থে শেষ হয়ে গেল।

চূড়ান্ত বিশ্লেষণে দেখা গেল মহাবিশ্ব কণাযুক্ত বিচ্ছিন্ন। খালি চোখে যেমন জলপ্রপাত বা ইটের কণা দুরকম লাগলেও আসলে একই রকম। পানির “ইট” গুলো ছোট দেখে এমনিতে বোঝা যায় না। কিন্তু পদার্থবিদদের যন্ত্রপাতির সাহায্যে খুব সহজেই তা বোঝা যায়।

এরপর বিশ্লেষণটা আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। কণা সমৃদ্ধ এই মহাবিশ্ব কিভাবে এতো অকল্পনীয় রকমের শক্ত যা কিনা এর সূক্ষ্ম অতি আণুবিক্ষণীক জগতেও।

এক সেন্টিমিটারের এক মিলিয়নের এক ভাগকে কেউ সত্যিকার অর্থে কল্পনা করতে পারে না। যদিও মিলিয়নের ব্যাপারটা মানুষ বাজেট বা আদমশুমারীর জন্য আন্দাজ করতে পারে। তাই এক সেন্টিমিটারে প্রায় এক মিলিয়ন ভাইরাসকে রাখা যায় একথাটা কিছুটা হলেও বোঝা যায়।

কিন্তু এক সেন্টিমিটারের মিলিয়ন ভাগের মিলিয়ন ভাগ। এটা একটা ইলেকট্রনের আকারের সমান এবং মানুষের দৃষ্টি সীমার বহু নীচে। বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কিছুটা হয়তো বোঝা যায়, তবে মন দিয়ে এতোটুকুও নয়।

আর মহাবিশ্বে কাঠামোর ঘটনাগুলোর মাত্রা এর চাইতেও অবিশ্বাস্য রকমের ছোট। এততাই ছোট যে তার তুলনায় পিঁপড়া বা হাতির মাপ একই রকম হবে। যদি কেউ এটাকে ফোমের মতো বুদ্বুদ ভাবে (যদিও এটা পুরোটাই বিভ্রান্তিকর তবুও সত্যের জন্য প্রথম প্রথম এমনটাই ভাবা যাক) তাহলে সেই বুদ্বুদগুলো….

এক সেন্টিমিটারের… মিলিয়নের মিলিয়নের মিলিয়নের সহস্র ভাগের এক ভাগ।

এখন চিন্তা করা যাক যে, সেগুলো ক্রমাগত বড় হচ্ছে আর আনবিক বোমার মতো শক্তি বিচ্ছুরণ করছে এবং সেই শক্তিই আবার পুনঃ শোষণ করছে, আবার বের করে দিচ্ছে এবং এভাবে প্রক্রিয়াটা চলতেই থাকছে।

খুব মোটা দাগে ধরলে এটাই বিংশ শতাব্দীর শেষভাগের পদার্থবিদরা মহাবিশ্বের মৌলিক কাঠামো বলে ধরে নিয়েছিলেন। তবে এই আভ্যন্তরীন শক্তিকে বের করেই সঙ্গে সঙ্গে বেধে ফেলাটা এক কথায় বলা যায় কিস্তুত।

তাই এক প্রজন্মের আগেই আণবিক কণার মধ্য দিয়ে এই নতুন পাওয়া শক্তিকে ব্যবহারের চিন্তা করা হল। “কোয়ান্টাম তারতম্য” যার ভেতর মহাবিশ্বের শক্তি লুকিয়ে আছে, তাকে কাজে লাগানো অবশ্যই উঁচুমাত্রায় দুঃসাধ্য কাজ। অবশ্য সাফল্যের পুরস্কারটাও বিরাট।

অন্যসব কিছু বাদ দিলেও, এটা মানবজাতিকে মহাবিশ্বে স্বাধীনতা দেবে। একটা মহাকাশযান-তাত্ত্বিকভাবে অন্তহীনভাবে গতিবেগ বাড়াতে পারবে, যেহেতু নতুন কোন জ্বালানীর দরকার হবে না। বাস্তব সমস্যাটা অবশ্য যেটা এখানে হবে, অদ্ভুত হলেও প্রথম আকাশযানের মতোই। পারিপার্শ্বিক বাধা-মহাশূন্যে যে হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো আছে তাই আলোর গতির চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত যাবার আগে সমস্যা করবে।

২৫০০ সালের পর যে কোন সময়ই কোয়ান্টাম ড্রাইভ সম্ভব ছিল। আর তা হলে হয়তো মানব জাতির ইতিহাসও অন্যরকম হতো। যেভাবে আগেও বহুবার এলোমেলো পদক্ষেপে বিজ্ঞান এগিয়েছে, দূর্ভাগ্যজনকভাবে এবারও ত্রুটিপূর্ণ পর্যবেক্ষণ আর অসংখ্য তত্ত্ব আসল সত্যটিকে প্রায় হাজার বছর পিছিয়ে দিল।

শেষের দিকের শতাব্দীগুলোতে অনেক প্রতিভার জন্ম হলেও অধিকাংশই ছিল ক্ষয়িষ্ণু আর মৌলিক জ্ঞান ছিল খুবই কম। তাছাড়া বিশাল ব্যর্থতার ইতিহাসের কারণে সবাই ধরে নিয়েছিল, মহাবিশ্বের শক্তি ধরার চেষ্টা অযৌক্তিক বিরক্তিকর-যা কিনা তত্ত্বীয় ভাবেই সম্ভব নয়, বাস্তবে তো দূরের কথা। যদিও তত্ত্বীয়ভাবে এটা অসম্ভব প্রমানিত হয়নি, এবং সন্দেহাতীতভাবে তা না হলে আশা কিছুটা থেকেই যায়।

পৃথিবী ধ্বংসের মাত্র দেড়শ বছর আগে ল্যাগরেনজ-১ মধ্যাকর্ষণবিহীন গবেষণা উপগ্রহের বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করলেন যে তারা এতোদিনে খুঁজে পেয়েছেন যে, কেন মহাবিশ্বের শক্তি বাস্তব হলেও বাস্তবে ব্যবহার করা যাবে না। বিজ্ঞানের অস্পষ্ট একটা কোনাকে এভাবে গিট্ট দেয়ার ঘোষণার প্রতি অবশ্য কারও বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না।

এক বছর পর ল্যাগরেনজ-১ থেকে বিব্রত একটা গলা খাকরী শোনা গেল। ঐ প্রমাণে ছোট্ট একটা ভুল পাওয়া গেছে। এরকম অবশ্য অতীতেও কয়েকবার হয়েছে, তবে কখনোই এতো সঠিক মুহূর্তে নয়। একটা বিয়োগচিহ্ন যোগচিহ্ন হয়ে গেল।

এবং সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বিশ্বই বদলে গেল। নক্ষত্রের দিকের রাস্তা খুলে গেল মধ্যরাতের ঠিক পাঁচ মিনিট আগে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *