০৬. মিলি চুপি চুপি

মিলি চুপি চুপি তার স্টিলের আলমারি খুলল। তার ভাবভঙ্গি অনেকটা চোরের মত। দরজা ভেজিয়ে দিয়েছে। সব কটা পর্দা টেনেছে এবং এমনভাবে আলমারির সামনে আছে যাতে চট করে আড়াল করা যায়। তবু তার হাত কাঁপিছে। সে ঘন ঘন তাকাচ্ছে ভেজানো দরজার দিকে।

মিলি ভয়ে ভয়ে তার টিনের কৌটা খুলল। ঘুমের ওষুধগুলি সে গুণবে। মাঝে মাঝেই সে গুণে দেখে কটা হল। এর আগের বার ছিল তেত্রিশটি এরপরও সে ছটি কিনেছে। তার মানে উনচল্লিশটি হওয়া উচিত কিন্তু একচল্লিশটি হচ্ছে। সে আবার গুনতে শুরু করল, ঠিক তখন ঢুকল মতিয়ুর রহমান।

বিদ্যুৎ গতিতে আলমিরা বন্ধ করে মিলি হাসল। ফ্যাকাসে হাসি। তার মুখও শূন্য। মতিয়ুর রহমান কিছু লক্ষ্য করল না। ঘরে একটি ইজিচেয়ার আছে। সে সেখানে বসে সিগারেট ধরাল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, ফ্যানটা বাড়িয়ে দাও তো মিলি!

মিলি ফ্যান বাড়িয়ে দিল।

খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?

মিলি মাথা নাড়ল। সে খেয়েছে। এ বাড়িতে অনেক মানুষ-জন। দু-তিন বারে খাওয়া হয়। সে বাচ্চাদের সঙ্গে প্রথম বারে খেয়ে নেয়। তার শাশুড়ি পছন্দ করেন না। ননদীরা হাসাহাসি করে। কিন্তু সে না খেয়ে পারে না। সন্ধ্যা মিলাতেই তার ভাতের ক্ষিধে পেয়ে যায়।

শুয়ে পড়া যাক তা হলে, কি বল?

মিলি কিছু বলল না। তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইল। মতিয়ুর অন্য রকম ভাবে তার দিকে তাকাচ্ছেন। যার অর্থ পরিষ্কার। সে ঘুমুতেও এসেছে সকাল সকাল। সে এখন বেশ কিছুক্ষণ হালকা গলায় কথাবার্তা বলবে। মিলি কিছু বলার থাকলে শুনবে। মিলি বলল, ভাইয়ার ছেলেটার জ্বর।

তাই নাকি?

হু। বেশ জ্বর।

জুর-টির হচ্ছে চারদিকে। বর্ষার শুরুতে হয় এসব। ডাক্তার দেখাচ্ছে?

দেখাচ্ছে। হয়ত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। তা হলে অবশ্যি ভালই হয়।

ভাল হয় কেন?

ছেলের অসুখের কারণে বাবা-মা কাছে আসবে। সমস্যা মিটে যাবে।

মতিয়ুর কিছু না বলে আরেকটি সিগারেট ধরাল। মিলি টেনে টেনে বলল, বাচ্চাদের অসুখবিসুখে বাবা-মা মাথা ঠিক রাখতে পারে না। তাই না?

জানি না। ওদের তো লিগাল সেপারেশন হয়ে গেছে। হয়নি?

হুঁ। তাতে কি?

মতিয়ুর বলল, বাতিটা নিভিয়ে ব্লু বাতিটা জ্বেলে দাও।

মিলি অস্পষ্টভাবে একটি নিঃশ্বাস ফেলল। কড়া আলো নিভিয়ে নীল আলো জুলাল। দরজা বন্ধ করল এবং মৃদু স্বরে বলল– কাপড় খুলে ফেলব?

মতিউর জবাব দিল না। রাগী চোখে তাকাল। মিলির প্রায় কান্না এসে যাচ্ছিল। সে কান্না থামিয়ে শাড়ি খুলতে শুরু করল। ঘর ভর্তি আলো। সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কি লজ্জার ব্যাপার। মিলি ক্ষীণ স্বরে বলল, এই বাতিটাও নিভিয়ে দেই?

দরকারটা কি, থাক না।

মিলি বড় একটি নিঃশ্বাস গোপন করল। সব বিবাহিত মেয়েদেব জীবনই কি এ রকম? বিশেষ বিশেষ দিনে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে তারাও কি বসে থাকে স্বামীর সঙ্গে? তাদের স্বামীরাও কি সিগারেট টানতে টানতে লজ্জায় জড়সড় হয়ে যাওয়া স্ত্রীর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে? এসব প্রশ্নের উত্তর কোনোদিন জানা যাবে না। কাকে জিজ্ঞেস করবে মিলি? এসব কি কাউকে জিজ্ঞেস করা যায়? ছিঃ। তার নিজের মেয়েটির কথা ভেবে সে এই কারণেই কষ্ট পায়; তার জীবনও কি এরকম তবে? যদি হয় সেটা খুব দুঃখের ব্যাপার হবে। মিলি জানালা দিযে বাইরে তাকিয়ে রইল। মতিয়ুর আরেকটি সিগারেট ধরিয়েছে। এটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার করণীয় কিছু নেই।

বাবু কি কেঁদে উঠল নাকি? মিলি কয়েক মুহূর্ত উৎকৰ্ণ হয়ে রইল! না বাবুর কান্না নয়।  অবশ্যি সে কাঁদলেও মিলির কিছু করার নেই। তবে শাশুড়ী বাবুব দেখা শোনার দায়িত্ব নিয়েছেন। মিলির নাকি শিশু পালনের ক্ষমতা নেই। কবে নাকি বাবু কেঁদে কেঁদে সারা হয়েছে, তার ঘুম ভাঙেনি। হবে হয়ত। মাঝে মাঝে তার খুব ঘুম পায়। এখন অবশ্যি রাতগুলি জেগেই কাটে সারাক্ষণ, মনে হয় এই বুঝি বাবু কাঁদছে। এই বুঝি বিছানা থেকে গড়িয়ে পড়ল।

মিলি।

উঁ।

পানি দাও তো এক গ্লাস।

পানির জগ ও গ্লাস আরেক মাথায়। মিলির কি এই অবস্থায় হেঁটে হেঁটে পানির গ্লাস আনতে যেতে হবে। গায়ে কোনো কাপড় জড়াতে পারবে না। কারণ তাতে মতিয়ুর রাগ করবে। মিলি উঠে দাঁড়াল। আয়নায় তার শরীরের ছায়া পড়ছে। সেই ছায়াটি কি সুন্দর? ওর কাছে কি সুন্দর লাগছে? মিলি জানে না। তার জানতেও ইচ্ছা করে না। সে এগিয়ে যায় পানির গ্লাস আনতে। মতিয়ুর রহমান সিগারেট ফেলে উঠে দাঁড়ায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *