০৬. মা মা, বাপজান আসছে

মা মা, বাপজান আসছে।

আসছে? বাইরে? ঘরের দরজায় দুদুটো ঠোক্কর খেয়ে বিস্রস্ত শাড়ির আঁচলটা কুড়োতে কুড়োতে বেরিয়ে এলো নবিতুন।

কই, কইরে?

ওদিক দিয়েই তো। আসে, ঘাটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, আককি। আরো কিছু যেন বলবার ছিল আককির। কিন্তু শুনবার সময় কোথায় নবিতুনের। পড়িমরি নবিতুন ছুটে এলো ঘাটার দিকে।

সারেং বাড়ির ঘাটার পুবে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। ধানক্ষেতের ওপারে রাস্তা। সেই রাস্তা ধরেই আসে সারেং। দূর থেকে দেখা যার তার হাতে টিনের সুটকেস, কাঁধে মাঝারি গেছের গাটরি। একসময় রাস্তাটা ছেড়ে সারেং নেমে যায় ধানক্ষেতে। ধানক্ষেতের আলে আলে কোনাকোনি পথ নেয় সারেং বাড়ির ঘাটার দিকে। ক্রমে স্পষ্ট হয় তার রঙ করা টিনের সুটকেসটা। স্পষ্ট হয় গোলাপি সবুজে অথবা অন্য কোন রংয়ের বৈচিত্র্য খোপ খোপ তবনটা, তবন দিয়ে বাঁধা গাটরিটা। আর খুব পরিষ্কার চেনা যায় কদম সারেংয়ের মুখটা।

সারেং বাড়ির ঘাটায় পা রাখে কদম। পা রেখে কাঁধের গাঁটরি আর হাতের সুটকেসটা মাটিতে নামিয়ে রাখে কদম। তারপর পুকুরের পানিতে দুপা ডুবিয়ে আস্তে আস্তে মুখ ধোয়, হাত ধোয়, কুলি করে।

বুকটা ধড়ফড় করছে নবিতুনের। বছরের পর বছর প্রতীক্ষার সেই তীব্র ব্যাকুলতাটা ঠিক সেই মুহূর্তেও যেন ধরে রাখতে পারছে না নিজের ভিতর। ধরে রাখতে পারছে না অভাবিত অপ্রত্যাশিত আনন্দের কম্পনটা।

কত রকমে তাকায় নবিতুন। তাকায় কপালে হাত রেখে, তালুর ছায়ায় চোখের উপর পড়া রোদটাকে আড়াল করে। ভ্রূ নামিয়ে চোখ দুটোকে সুতোর মতো সরু করে। চোখ দুটোকে কচলে বড় বড় করে। কিন্তু, ধানক্ষেতের সোনালি বিস্তার আর ওই রাস্তার ধু ধু এ ছাড়া আর কিছুই তো নজরে পড়ে না নবিতুনের।

ধান কাটার মরসুম চলছে। এখানে-সেখানে খালি গা কিষাণ উপুড় হয়ে মাথা নিচু করে ধান কেটে চলেছে। কেউবা ধান কাটা সার করে ইতিমধ্যেই রবিখন্দের আয়োজন শুরু করেছে। ওরা ছাড়া আর কোন লোক নেই, ক্ষেতেও না, রাস্তায়ও না।

তবু চোখের কোণে দুনিয়ার যত আগ্রহ আর ব্যাকুলতা ঢেলে ওই কিষানদের দেখে নবিতুন। দেখে খুঁটিয়ে, খুঁটিয়ে, দৃষ্টির আগায় তীক্ষ্ণতার শক্তি টেনে। যেন ওদেরই যে কোন একজন যে কোন মুহূর্তে হয়ে যেতে পারে কদম সারেং। না, ওরকম অত্যাশ্চর্য আর অলৌকিক কোন কিছু ঘটে না জীবনে। ধু ধু রাস্তাটার উপর আবার চোখ রাখে নবিতুন।

ধু ধু-টার দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকে নবিতুন। তাকিয়ে তাকিয়ে বুঝি পানি এসে যায় চোখে। আঙুলের পিঠ দিয়ে চোখ কচলায় নবিতুন। হঠাৎ মনে হয় নবিতুনের, আককি ভুল খবর আনেনি তো? কার কাছেই খবরটা পেল আককি।

আককি, খবরটা তুই কোথায় পেলিরে?

আককির উত্তরটা শুনে এতক্ষণের উদ্বেল হওয়া বুকটা ওর যেন ধপ করে বসে পড়ল। আককি যা বলল তার সরলার্থ পিয়লগাছার এক দোকানদারের ভাই, সে গেছল ওর মামার বাড়ি বেড়াতে। ওর মামার বাড়ির কোন এক লোক জাহাজের সুকানি। সেই সুকানি বলেছে কদম আসছে দেশে।

তুই কার কাছ থেকে শুনলি? আককির লম্বা বয়ানটা থামিয়ে দিয়ে অসহিষ্ণু স্বরে শুধায় নবিতুন।

পিয়লগাছার সেই দোকানদারের ভাই ফিরে এসে গল্প করেছে দোকানে। সেই দোকানে তখন বসা ছিল কদুরখিলের বেপারি বাড়ির বুড়ো বেপারি। বামনছাড়ির হাট বারে বেপারির কাছ থেকে অনেকেই কথাটা শুনেছে। আককি এইমাত্র শুনে এলো মিজি বাড়ির পাঠশালায় পড়া আককির বয়সী মেয়েটার কাছ থেকে।

হা আল্লা, এতক্ষণ বলিসনি কেন। দোষটা যেন আককিরই।

মুখটা নিচু করে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে আককি, আর পায়ের আঙুলে ঘাসের দলা পাকিয়ে চলে।

দমে গেল নবিতুন। এত মুখ ঘুরে কি খবর কি হয়ে এসেছে কে জানে। সারেং আসবে, সারেং আসছে। সত্য হোক মিথ্যে হোক, আপন মনকে এতক্ষণ ধরে এ কথাটাই তো বিশ্বাস করিয়ে আসছিল নবিতুন। আর মন যেন হাজার কণ্ঠে সাড়া দিয়েছিল, হ্যাঁ সারেং আসছে, সারেং আসছে। মনের সাড়া পেয়ে বুকটাও বুঝি নেচে উঠেছিল। আশার আনন্দের অধীরতর উদ্বেল তরঙ্গ দৌড়ে গেছিল। বুক উপচে, গা ভাসিয়ে। এক নিমেষে উবে গেল সেই আশা, বিশ্বাস, আনন্দ অধীরতা।

তবু কী আশ্চর্য! মাঠের ওপারে সেই পথটার দিকে চেয়ে থাকে নবিতুন। রৌদ্র বাড়ছে। দূর রাস্তার ধুধুটাও অসহ্য ঠেকছে চোখে। রৌদের ঝিকিমিকির আড়ালে রাস্তাটা দেখা যায় কি দেখা যায় না। তবু স্থির নজরে তাকিয়ে থাকে নবিতুন। নবিতুন কিভাবে ধু ধু রৌদের ধাঁধা থেকে এখুনি উঠে আসবে ওর প্রবাসী নাবিকের মুখ?

একসময় টন টন করে ওঠে চোখ জোড়া। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরে পায়। ধীর পায়ে মেয়েটির হাত ধরে ঘরে ফিরে আসে নবিতুন। ঘরে ফিরে বেড়াটার গায়ে হেলান দিয়ে একতাল অবসানের মতো বসে পড়ে নবিতুন। শুধু অবসাধ নয় ওর গোটা শরীরটাই কী এক ভার যেন। এতক্ষণের অধীরতা, অস্থির প্রত্যাশার উত্তেজনা, সবটাই এখন যেন জড় জমাট পাথর। সে পাথরের চাপে বুঝি ভেঙে পড়বে নবিতুন।

আককির মাথায় আস্তে-আস্তে হাত বুলায় নবিতুন। ওর কোলে মাথা রেখে মাটিতে ঘুমিয়ে পড়ে মেয়েটি। বাপের মতো মুখ পেয়েছে আককি। সে মুখের দিকে অপলক চেয়ে থাকে নবিতুন।

সেই নাক, সেই চোখ, এমন কি চিবুকের সেই কুঞ্জনটুকুও। লোকে বলে যে মেয়ে পায় বাপের গড়ন সে নাকি লক্ষ্মী, ভাগ্যবতী। আহা, তাই যেন হয় আককি। পুতেঝিয়ে ঘরে খামারে লক্ষ্মীবতী হোক আককি।

নবিতুন পেয়েছে মায়ের শ্রী, মায়ের মুখ। এই শ্ৰী, এই মুখটাই বুঝি কাল হলো ওর। লুন্দর শেখের বদনজর, গ্রামের যত গুণ্ডা সাণ্ডার কুই, রাত বিরেতের উপদ্রব, সবই ওই ঢক নকশার শরীর আর কালো মুখের শ্ৰীটার জন্য।

আক্ষেপ হয় নবিতুনের খেদ জাগে। যদি পেত বাপের ঢক, গায়ে বা মুখে কোথাও একটু খানি বাপজানের নমুনা, তবে বুঝি এত দুর্দশায় পড়ত না নবিতুন। ভাগ্যবতী হতো নবিতুন, সুখের ঘরে হেসে খেলে জনম কাটত।

আককির বাড়ন্ত শরীরটার দিকে তাকিয়ে অন্য চিন্তা জাগে নবিতুনের। দশে পড়েছে আককি। কথায় বলে, এগারোয় মেয়ে সেয়ানা, বারোয় মেয়ে বিয়ের লায়েক। এই তো শুনে আসছে নবিতুন। এই তো নিয়ম। তা ছাড়া আককির গড়ন পিটন বড় তেজাল। এই দশেই মনে হয় বিয়ের লায়েক।

কিন্তু একা একা তার কী করবে নবিতুন? এ এক চিন্তা নবিতুনের যা মনে জাগলে চোখে অন্ধকার দেখে ও। নিজের কষ্ট, খবর-না-পাওয়া খসমের দুশ্চিন্তা সবকিছুর উপরে আককির ভবিষ্যতের চিন্তা।

নবিতুন আর ভাবতে পারে না। মেয়ের মুক, কদমের মুখ সবই যেন ঝাপসা হয়ে যায়। কী এক হাহাকারে কেঁদে ওঠে ওর বুকের ভেতর। বুকটা ওর ফেটে যায়। চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসে কান্না। এত কান্নাও জমে থাকে একটি বুকে? দিনেরাতে কতবার কান্নার ঢল নামে নবিতুনের বুক বেয়ে। কান্নার যেন শেষ নেই। কান্না আসে সারেংয়ের মুখটা মনে করে, মেয়ে আককির ভবিষ্যৎ ভেবে।

মেয়ে আককির সাধ একটা নতুন শাড়ি পরবে ও। মায়ের তালি দেয়া পুরনো শাড়ি আর ভালো লাগে না ওর। কান্না পায় নবিতুনের সোনা মাণিকের একটিমাত্র আবদার মিটাতে পারে বলে! কান্না আসে নিজের পোড়াকপালটার কথা ভেবে। এতদিনের এত বছরের এত কান্না তবু হালকা হয় না নবিতুনের বুকটা? তবু কেন ঠাণ্ডা হয় না চোখের জ্বালা, মনের জ্বালা?

আঁচলে চোখ মোছে, মুখ মোছে নবিতুন। কোন থেকে আককির মাথাটা তুলে নেয়, জাগিয়ে তোলে ওকে। বলে নবিতুন, দরজা ভেজিয়ে ঘুমোস মা।

অনেক দেরি হয়ে গেল। চৌধুরী বিবি আজ আর আস্ত রাখবে না। ঘোমটাটা নাক অবধি টেনে বেরিয়ে পড়ে নবিতুন!

চৌধুরী বাড়ির কামটা দাসীর কাম। কিন্তু, কাম-কাজ সেরে নিজের ভাতটা লয়ে বাড়ি ফিরতে পারে নবিতুন। রাত্রে বাড়িতেই থাকে ও। দাসীগিরির সাথে এটুকুই তফাৎ। এই তফাৎটুকুই যেন নবিতুনের মান-ইজ্জত আর আব্রুর নিশ্চিত দলিল।

গুঁজাবুড়ি আর পেটের জ্বালায় চারদিকে যখন অন্ধকার দেখছিল নবিতুন ঠিক সেই সময়ই চৌধুরী বাড়ির কামটা পেয়ে গেছিল নবিতুন। তাই আকাশের দিকে দুহাত তুলে দোয়া মাগে নবিতুন, আল্লা যেন চৌধুরীদের বেহেশত নসিব করে।

কিরে নবিতুন, তোর সারেংয়ের খবর-টবর পেলি? চোখে-মুখে-স্বরে কুৎসিত এক ইঙ্গিত টেনে শুধায় ছোট চৌধুরী। জড়োসড়ো ঘোমটা টেনে পাশ কাটিয়ে চলে যায় নবিতুন।

কথা যেমন বাঁকা, মুখ যেমন খারাপ ছোট চৌধুরীর তেমনি নজরটাও তার বড় বদ। কেমন বদ চোখে তাকায় ছোট চৌধুরী। হিম হয়ে যায় নবিতুনের গাটা। বড় ভয় করে ওর।

রোয়াকের ওধারে বসে আছে চৌধুরীদের বড়বৌ। ছোট দেওরের কথাটা বুঝি কানে গেছে তার। সে কথারই জের টেনে কি এক রস চটকে বলে বড় বৌ—আ-র সারেং। খোঁজ করে দেখগে, কোথায় কয়টা সাংগা করে বসে আছে।

তা আর বিচিত্র কি? ছোটলোকদের তো কামই এই। আজ একে ছাড়ছে, কাল শাদি করছে। ভাবীর সাথে গলা মেলায় ছোট দেওর। ঘরের ভেতর কানে আঙুল দেয় নবিতুন। স্বামী পরিত্যক্তা বধূর কত যে লাঞ্ছনা, কত যে দুঃখ সে কি বুঝে না ওরা? তবু কেন অমন করে কথার বাণ ছুঁড়ে মারে ওরা? ওদের দিলে মহব্বত নেই, দয়া নেই, ভাবে নবিতুন। তা ছাড়া নবিতুনের কদম তো আর সত্যি সত্যি ছেড়ে যায়নি ওকে! বিদেশ করে ফিরতে দেরি হচ্ছে, এই যা।

ওমা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ আবার কি ঢং! বলি, দাঁড়িয়ে থাকলেই চলবে নাকি? কখন আবার মেঘ করবে, চালের গুঁড়িগুলো রৌদে দিবি না? খেঁকিয়ে ওঠে চৌধুরীবিবি।

কখন যে চৌধুরীবিবি এসে পড়েছে ঘরের ভেতর লক্ষ্য করেনি নবিতুন।– এই আসছি, ছোট করে বলে নবিতুন। তারপর বড়বৌর বাচ্চার মুত আর মলের তেনাগুলো লয়ে চলে যায় পুকুরের দিকে।

উঠতে-বসতেই কামের তাগাদা চৌধুরীবিবির। তার যা বকাঝকা গালিগালাজ, সে ওই কামের জন্যেই। শুনতে শুনতে গা-সহা হয়ে গেছে নবিতুনের। আজ মনে হলো বড়বৌ আর ছোট চৌধুরীর বাঁকা হাসি বাঁকা কথার তুলনায় চৌধুরীবিবির বকাঝকাটা বুঝি মিষ্টি কথার আদর। কাজ করতে করতে আজ বড় আনমনা হয়ে যায় নবিতুন। আনমনা কত-কী যে ভেবে চলে! হদ্দ থাকে না সে সব ভাবনার।

কাজ করতে করতেই মনটা যেন ওর নেচে ওঠে। মনটা যেন কথা কয়ে ওঠে। আবার সকালবেলার সেই প্রত্যাশা অধীরতার কম্পনটা জেগে উঠেছে বুকের ভেতর। উদ্বেল ঢেউয়ের মতো ওঠে আর নাবে নবিতুনের বুকটা। ও বেলা না হয় আসেনি সারেং। কিন্তু বিকেলবেলা অথবা রাত্রে? যে কোন সময়ই তো এসে পড়তে পারে সারেং। এসে দেখবে নবিতুন নেই ঘরে। ছিঃ ছিঃ এ কথাটা এতক্ষণ চিন্তা করেনি নবিতুন? দৌড়ে দৌড়ে জলদি জলদি হাত চালিয়ে কাজগুলো সেরে ফেলল নবিতুন। তাড়াতাড়ি বেলা থাকতে থাকতেই ওকে ফিরতে হবে বাড়ি। বারবার নিজেকে ধিক্কার দেয় নবিতুন। সকালবেলা খবরটা যখন পেলই, আজ কাজে না এলেইবা কি হতো?

খবর না দিয়ে আচমকা সারেং যে এসে পড়ে না এমন তো নয়। সেই যেবারে অসুখ করেছিল নবিতুনের, জীবনে ওই একবারই তো অসুখ করেছিল ওর? সেবার তো আচানক রাতের বেলায়ই এসে হাজির সারেং। অসুখে দুর্বল শরীর নিয়ে সাঁঝ রাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল নবিতুন। রাত বোধহয় এক ঘড়িও পার হয়নি। বুঝি ঘুমের ঘোরেই নবিতুন শুনল– বৌ বৌ! ঘুম ভেঙে ধড়ফড়িয়ে উঠল নবিতুন। কান পেতে স্পষ্ট শুনল বৌ বৌ। এ যে ওর সারেংয়ের গলা। দরজার খিল খুলে উঠোনে ছুটে এসেছিল নবিতুন।

আহা, আজও তো রাতের পয়লা কি দোসরা ঘড়িতে সারেং এসে তেমনি করে ডাকতে পারে, বৌ বৌ।

শানকিতে মেপে মেপে দুমালা ভাত দিল চৌধুরীবিবি। ভাতের পাশে দিল এক করসুল সালন। ভাতের উপর দিল দুকরসুল ডাল!

শানকিটাকে আঁচলের তলায় নিয়ে ছোটবৌয়ের ঘরের দিকে গেল নবিতুন! ছোটবৌ খুব ভালো। এত ভালো যে তার কাছে কোন কিছু চাইতে লজ্জা হয় নবিতুনের। যদি কোন কারণে অপারগ হয় ছোটবৌ? কিন্তু আজ সকল লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে হাত পেতেছে নবিতুন। বেশি নয় এক পোয়া চাল চেয়েছে ছোটবৌর কাছে। অবাক হয়েই শুধিয়েছে ছোটবৌ–হঠাৎ তোর চালের দরকার পড়ল কেন রে?

মিথ্যা বলেছে নবিতুন। বলেছে, খোলায় করেই ভেজে খাব।

যাবার সময় নিয়ে যাস, বলেছে ছোটবৌ। আর বোধহয় নবিতুনের এই হঠাৎ জাগা সখটার কথা ভেবে ছোট্ট করে একটু হেসেছে ও।

ঘরের দরজায় আসতেই ছোটবৌ তেনায় বাঁধা চালগুলো সন্তর্পণে তুলে দেয় ওর হাতে। ফিসফিসিয়ে বলে, শানকিতে রেখে ঢেকে ফেল আঁচল দিয়ে। ওই বুড়ি দজ্জালিটা দেখলে পর রক্ষে থাকবে না।

সে কি আর জানে না নবিতুন? আড়াআড়ি তেনার পুঁটুলিটা শানকির ভাতের উপর রেখে আঁচল চাপা দেয় নবিতুন। আড় চোখে একবার দেখে নেয় দূরে দাওয়ায় দাঁড়ানো দজ্জালি বুড়ি চৌধুরীবিবিকে। তারপর এক রকম দৌড়াতে দৌড়াতেই রওনা হয় বাড়ির দিকে।

কত মুখ ঘুরে ঘুরে কী খবর কী হয়ে ওর কানে পৌঁছেছিল সকাল বেলায়, নবিতুন এখন ভুলে গেছে। ভুলে গেছে চৌধুরী বাড়ি আসবার পথে সে যে গেছিল মিজি বাড়ি। মিজি বাড়ির সেই মেয়েটা, সারেং যে আজই আসবে এমন কোন কথা শোনেনি সে। মেয়েটির ভাই, সেই শুনেছে হাঁটুরেদের মুখে, কে নাকি কদমকে দেখে এসেছে খিদিরপুরে! খিদিরপুরে যখন দেখা গেছে কদমকে, তখন নিশ্চয় দেশের দিকে রওনা দেবে ও। হয়তো এটুকুই বলেছিল সেই নাম-না-জানা হাঁটুরে।

কিন্তু এ সবই ভুলে গেছে নবিতুন। সেই যে সকালবেলায় মনকে একবার বিশ্বাস করিয়েছিল সারেং আসছে, মন আবার সে কথাটাই বলতে শুরু করেছে। মন বলছে সারেং আসছে।

সারেং আসবে আর জোগাড়যন্তর রেখে তৈরি থাকবে না নবিতুন? তৈরি নবিতুন। এখন ওর হাতে একপোয়া চাল। মানুষটি এলে তক্ষুনি তক্ষুনি চারটে গরম ভাত ওকে ফুটিয়ে দেবে নবিতুন।

এত তাড়াতাড়ির পরও বাড়ি পৌঁছে নবিতুন দেখল বেলা প্রায় ডুবু ডুবু।

হাঁস দুটোকে পেছন পেছন তাড়া দিয়ে ঘরের দিকে নিয়ে আসছে আককি। মোরগ আর মুরগিগুলো ঘরের ভেতর মাথা গুঁজে বসে আছে দাওয়ায়। ঘরে যাবার যেন ইচ্ছে নেই ওদের।

হাঁস দুটোকে ধরে ফেলল নবিতুন। গলা ধরে দুহাতে দুটোকে উঁচিয়ে তুলল, ওজনের আন্দাজ নিল। ভারি চর্বিদার আর ওজনী হয়েছে হাঁস দুটো। কিন্তু না, সেদ্ধ হতে বড় সময় নেয় হাঁসের গোশত। তাড়াহুড়োয় রাঁধতে হবে, অতএব হাঁস চলবে না। হাঁস দুটোকে ছেড়ে দেয় নবিতুন। থপ করে মাটিতে পড়েই আস্তানার দিকে দৌড় মারে ওরা।

দাওয়ায় উঠে মোরগ আর মুরগিগুলোকে ডানা ধরে তুলে দেখে নবিতুন। কোঁ কোঁ করে প্রতিবাদ জানায় ওরা। দেখেশুনে ডেঁগি মোরগটাকেই পছন্দ করে রাখে নবিতুন। যেমন কচি তেমনি তাজা ডেঁগি। আঁচ লাগতেই সেদ্ধ হয়ে যাবে।

রাত্র এলো। চেরাগে কেরোসিন ঢেলে বাতি জ্বালাল নবিতুন। তারপর মাচাং থেকে কুলো নাবিয়ে তেনায় বাঁধা চালগুলো ছড়িয়ে রাখল কুলোর ওপর। বার দুই আঙুলে-কুলোয় চটাক চটাক শব্দ তুলে ঝেড়ে নিল চালগুলো। আবার ছড়িয়ে দিল। ছড়িয়ে দিয়ে বাছতে লাগল। বাছতে বাছতেই আককির দিকে একবার তাকাল নবিতুন। আককি কি কোন খবর পায়নি? আককির মুখে তেমন কোন আভাস নেই।

আককি তাজ্জব। সন্ধ্যা থেকেই মায়ের কাণ্ডমাণ্ড কিছুই বুঝছে না ও। নবিতুনের বারা বান্দার কাজটা যাওয়ার পর থেকে চেরাগ জ্বলে না ঘরে। ঠেকা বেঠেকায় দরকার পড়তে পাড়ে বলে ছোট বৌর কাছ থেকে একটু কেরোসিন চেয়ে এনেছিল নবিতুন। সেই ঠেকার তেল দিয়ে হঠাৎ চেরাগ জ্বালিয়ে আজ চাল বাছবার কি দরকার পড়ল, বোঝে না আককি।

বাছা শেষ হলে চালগুলো ঘটিতে তুলে রাখল নবিতুন। কয়েকটা চাল কুলোর বেতের ফাঁকে আটকে রয়েছে। নখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে সে চাল কয়টাও বের করল। দুটো কি তিনটে চাল পড়ে গেছে মাটিতে। একটি একটি করে সে চালগুলোও ঘটিতে তুলে নিল। তারপর যাতে ইঁদুর ঢুকতে না পারে। সেজন্য ঘটির মুখে তেনা গুঁজে ঘটিটাকে তুলে রাখল চারের উপর।– আয় আককি খেয়েনি।

আককির মনে হলো, আজ বড় নরম মায়ের ডাকটা।

মায়ে-ঝিয়ে বসল শানকিটার দুপাশে। দুপাশ থেকে হাত চালিয়ে খেয়ে নিল ওরা।

খাওয়া শেষ করেও ঘুমাতে গেল না নবিতুন। চেরাগটা হাতে লয়ে ঘুরঘুর করে ঘরময়। ফেলে রাখা কাজগুলো সব এসে দাঁড়ায় ওর চোখের সুমুখে। ভিটিটা লেপা হয়েছে, সেই কবে। পুব পাশটায় ইঁদুর মাটি খেয়ে খেয়ে একটি সারি খোরল বানিয়েছে। কতদিন ভেবেছে নবিতুন মাটি এনে গর্তগুলো খুঁজে দেবে, ভালো করে লেপে দেবে জায়গাটা। কিন্তু ভাবাই সার! দিনে-দিনে ইঁদুরের গর্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

ঘরে একটিমাত্র ছিকা। একটি দড়ি তার নরম হয়ে পড়েছে। ছিঁড়ে পড়তে পারে যে কোনদিন। মেরামত করবে বলে বড় হিস্যা থেকে দুপাশ পাটও চেয়ে এনেছে নবিতুন। সেও তো কতদিন হয়ে গেল। ছিকাটা এখনো মেরামত হয়নি।

ইস্ এতসব আগোচাল কাণ্ড দখে কী ভাববে সারেং? ভাববে সারেংয়ের ঘর সংসারের দিকে একটুও মন দেয়নি নবিতুন। মনে-মনে এসব ভাবছে নবিতুন আর কানটাকে সজাগ রেখেছে বাইরের অন্ধকারটির দিকে। এখুনি বুঝি শুনতে পাবে দুটো পায়ের শব্দ, একটি গলার আওয়াজ।

মা চেরাগটা নিভিয়ে দাও। তেল ফুরিয়ে যাবে যে।

আককির গলা পেয়ে হঠাৎ যেন হুঁশ আসে নবিতুনের। ফুৎ করে চেরাগটা নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল ও।

শুয়ে শুয়েও কানটা খাড়া রাখে নবিতুন।

নিঝঝুম রাত। কোথাও একটু শব্দ নেই। হঠাৎ গাছের একটি পাতা ঝরে পড়ে বড় হিস্যার টিনের চালে। ছ্যাঁৎ করে ওঠে নবিতুনের বুকটা।

উঠোন দিয়ে দৌড়ে যায় গ্রামের খেকি কুকুরটা। নবিতুনের মনে হয় কে যেন হেঁটে এলো, থমকে দাঁড়াল ওর দোর গোড়ায়।

ছেলেটার পেসাব পেয়েছে। তাই বৌর ঘুম ভাঙাচ্ছে কোরবান– এই এই। নবিতুনের মনে হয় ও যেন শুনল ওর সেই পরিচিত গলার ডাক– বৌ বৌ। এক ঘড়ি। দুঘড়ি। রাতের প্রহরগুলো বুঝি কাবার হয়ে যায়। পাওয়া যায় না দুটো পদশব্দ। কানে বাজে না সারেংয়ের ডাক।

অন্ধকারের চাপে চোখের পাতাগুলো বুজে আসে নবিতুনের। তন্দ্রা নামে দেহ ঘিরে। বেড়ার ফুটো দিয়ে নবিতুন যেন দেখল, এসেছে ওর সারেং। দেখল কত রঙ-বেরঙের জিনিস সারেংয়ের হাতে। শাড়ি জামা চিরুনি চুলের কাঁটা খোঁপার ফুল– সবই নবিতুনের জন্য। আর কত কত সুন্দর বস্তু আককির জন্য।

নবিতুন বুঝি দেখল, বড় কাহিল সারেংয়ের মুখখানি। কেমন শীর্ণ সেই। শালতি শালতি বাহুজোড়া। আহা, তা হবে না? কত সাগর সাঁতরে এসেছে, কত দেশের কত পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে সারেং। তাই তো অমন কাহিল, অমন ক্লান্ত চেহারা। হঠাৎ নবিতুন যেন শুনল সারেং ডাকছে ওকে, বৌ বৌ দরজা খোল। ধড়ফড়ায়ে উঠে বসল নবিতুন। ছুটে গেল দরজার দিকে…।

না। কোথাও কিচ্ছু নেই। উঠোনময় ঘন আঁধারের জাঁকাল রাজত্ব। চারদিকে নিস্তব্ধ। শুধু কয়েকটা ঝিঁ ঝিঁ পোকা অন্ধকারের পায়ে কিসের জন্য যেন মাথা কুটে কুটে একটানা কেঁদে চলেছে। দরজাটা বন্ধ করে ফিরে এলো নবিতুন। শুয়ে পড়ল আবার।

অকস্মাৎ মনে হয় নবিতুনের বৃথা বৃথা এই প্রতীক্ষা। নাবিক ওর হারিয়ে গেছে কোন দূর সাগরের ঊর্মিতলে। সে আর ফিরে আসবে না। গুঁজাবুড়ির কথাটাই বুঝি খেটে গেল। সেই পচা মুখ, কুটনী মাগী গুঁজাবুড়ি, তার কথাটাই বুঝি ঠিক। বুকের উপর হাত রাখল নবিতুন। সেই যে সকাল বেলায় আশা দিয়ে ভরিয়ে নিয়েছিল বুকটা এবং বিশ্বাস করিয়েছিল মনকে, সেই আশা আর সেই অসম্ভবের বিশ্বাসটাকে এখন খুঁজে পায় না নবিতুন। বুকে এখন খাঁ খাঁ এক শূন্যতা। হু-হু কান্না এসে ভরে দেয় সেই শূন্যতা।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে নবিতুন।

বালিশটাকে আঁকড়ে ধরে নবিতুন।

বালিশটা ভিজে যায় নবিতুনের চোখের জলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *