আপা,
মার কাছে লেখা তোমার দীর্ঘ চিঠি খুব মন দিয়ে পড়লাম। তুমি আমার স্বভাব জানো, আমি কখনো অন্যের চিঠি পড়ি না। মা আমাকে পড়তে দিল। আমি বললাম, আপাকে লেখা চিঠি আমি পড়ব না। তখন মা বলল, চিঠিটা পড়ে দেখ। আমার মনে হয় লীনার মাথার ঠিক নেই।
আপা, আমারও তাই ধারণা। তোমার মাথা ঠিক নেই। মাকে তুমি কী লিখেছ তা কি তোমার মনে আছে? পুরো চিঠিতে তোমার স্যারের কথা। তোমার ভুবন স্যারময় হয়ে গেছে। যেন তিনি আছেন বলেই তুমি আছ। তেরো-চৌদ্দ বছরের কিশোরী মেয়েদের মতো তুমি যে তোমার স্যারের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছ তা কি তুমি জানো? কিশোরী মেয়েদের একটা সুবিধা আছে তারা হাবুডুবু খায়, আবার একসময় ভেসে ওঠে। হাঁসের মতো শরীর থেকে পানি ঝেড়ে ফেলে প্যাকপ্যাক করতে করতে বাড়ি চলে যায়। এই সুবিধাটা তোমার নেই।
তোমার স্যার খুব বুদ্ধিমান একজন মানুষ। তিনি তোমার মানসিক অবস্থা অবশ্যই ধরতে পেরেছেন। তার উচিত ছিল ব্যাপারটা শক্তহাতে সামলানো। তিনি তা করেননি। কেন করেননি তাও অনুমান করতে পারি। ইট-পাথরও পূজা পেতে পছন্দ করে। আর উনি ইট-পাথর না, বুদ্ধিমান একজন মানুষ। কেউ হৃদয়-মন দিয়ে তাকে পূজা করছে তা তিনি পছন্দ করবেন না এটা হতেই পারে না। আপা শোনো, তুমি তো গান টান পছন্দ কর না। রবীন্দ্রসংগীত নজরুল গীতির মধ্যে তফাৎটা কোথায় তাও বোধহয় জানো না। রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে—
আমি সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়
এই গানটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তোমার জন্যে লিখেছেন। তুমি সকল নিয়ে সর্বনাশের আশায় বসে আছ।
এখন তোমাকে একটা উপদেশ দিচ্ছি। তুমি আমার বয়সে বড়, নয়তো তোমাকে আদেশ দিতাম। উপদেশটা হচ্ছে চাকরি ছেড়ে তুমি ঢাকায় চলে এসো। যেদিন চিঠি পাবে সেদিনই। এক মুহূর্ত দেরি করবে না।
তোমার স্যারকে তুমি প্রাণভোমরা ভাবছ। আসলে তিনি তোমার মরণপাখি। এই পাখি যেই তুমি হাত দিয়ে ছুঁবে অমনি তোমার সব শেষ।
আপা, বুঝতে পারছ কী বলছি? তোমার রেসিপি সরি তোমার না, তোমার গুরুদেবের রেসিপি মো জাপানি খাবার আলিও ওলিও রান্না করলাম। যে কটি অখাদ্য আমি এ জীবনে খেয়েছি তোমার আলিও ওলিও তার মধ্যে একটি। আর এই খাবারের স্বাদের যে বর্ণনা তুমি দিয়েছ, পড়লে মনে হয়–বেহেশতে এই রান্না হয়েছে।
আপা, তুমি এখন যে-অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছ তাতে আমি নিশ্চিত তোমার স্যার যদি গরুর ভূষি অলিভ ওয়েল রসুন এবং শুকনোমরিচ দিয়ে মেখে এনে বলে— এই জাপানি খাবারের নাম ভূষিও আলিও–তুমি গবগ করে খাবে এবং বলবে তুমি তোমার মনুষ্যজীবনে এরচে ভালো খাবার খাওনি।
আমার খুব ভয় লাগছে আপা। তুমি চলে এস, চলে এসো, চলে এসো।
ফিরোজভাই প্রায়ই এসে আমাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। তিনি আগের মতোই হাসিখুশি আছেন, তবে তোমার ব্যাপারে খানিকটা চিন্তিত। সেদিন কথায় কথায় বললেন–তুমি তাকে কোনো চিঠি দাওনি। তুমি তার চিঠির জবাব দিচ্ছ না— এটা কেমন কথা বল তো?
আপা মনে রেখো, বাবার মৃত্যুর পর আমাদের পুরো পরিবার জলে ভেসে যেতে বসেছিল; ফিরোজ ভাই একা সেই ভেসে যাওয়া পরিবার টেনে তুলেছেন।
ভাইয়ার কথা তোমার মনে পড়ে না আপা? আমাদের সবাইকে কী ভালোই না বসিত! ভাইয়া মারা গেছেন— আমরা ভাইয়াকে ভুলেও গেছি। কিন্তু ভাইয়ার এই বন্ধুটি তাকে ভুলেনি। ফিরোজ ভাই মনে কষ্ট পায় এমন কিছু তুমি কখনো করবে না। কখনো না। কখনো না। কখনো না। চিঠি শেষ করার আগে আরো একবার লিখছি— তুমি চাকরি ছেড়ে চলে এসো।
মা তোমার জন্যে শুকনোমরিচের আচার দিয়ে দিয়েছেন। তোমার খাবার জন্যে, তোমার স্যারের খাবার জন্যে না।
আমার কী ইচ্ছা করছে জানো? আমার ইচ্ছা ঐ ভণ্ডটাকে একটা চিঠি লিখে তার ভণ্ডামি দূর করে দি।
তোমার গুরুদেবকে আমি ভণ্ড বলছি, তুমি নিশ্চয়ই রাগে লাফাচ্ছ। রাগে লাফালেও আমার কিছু করার নেই। আমি তাকে ভওই ডাকব। ভণ্ড ভণ্ড ভণ্ড।
ইতি
বীনা।
লীনা সব চিঠিই তিনবার করে পড়ে। প্রথমবার অতি দ্রুত পড়ে। কী পড়ছে বেশিরভাগই মাথায় ঢুকে না। দ্বিতীয়বার ভাবে ধীরেসুস্থে পড়বে। দ্বিতীয়বার প্রথমবারের চেয়েও দ্রুত পড়ে। তৃতীয়বারের পড়াটা ভালো হয়। লীনা তার বোনের চিঠি একবারই পড়ল। পড়ার পর চিঠিটা একপাশে সরিয়ে রেখে কাগজ কলম হাতে নিল। এক্ষুনি বীনাকে চিঠির জবাব দিতে হবে। প্রচণ্ড রাগ লাগছে। বীনাকে চিঠি না-লেখা পর্যন্ত রাগটা কমবে না। সমস্যা একটাই—কী লিখবে কিছু মাথায় নেই। মাথা ফাঁকা হয়ে আছে।
লীনা লিখল–
বীনা,
তোর চিঠি পড়েছি। খুব ন্যায় কথা লিখেছিস। তারপরেও তোর কথা মানলাম। আমি চাকরি ছেড়ে চলে আসছি। স্যারকে তুই ভণ্ড বলেছিস। আমি তাতে মনঃকষ্ট পেয়েছি। ভুল বা অন্যায় যা করার আমি করেছি। আমাকে ভণ্ড বলতে চাইলে বলু। উনাকে কেন বলবি?
এই পর্যন্ত লিখে লীনার মনে হল চিঠি লেখার প্রয়োজন নেই। সে তো চলেই যাচ্ছে। আগামীকাল বীনার সঙ্গে দেখা হবে। যা বলার সামনাসামনি বললেই হবে। লীনা চিঠি ছিড়ে ফেলে চাকরি ছেড়ে দেবার বিষয়টা নিয়ে তার স্যারকে লিখতে বসল। রেজিগনেশন লেটার লেখার কিছু নিয়মকানুন আছে। সে ঐসব নিয়মকানুনের ভেতর দিয়ে সে যাবে না। সহজ সরল একটা চিঠি লিখবে। আজই স্যারের হাতে দেবে। স্যার এমন মানুষ যে চিঠি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবেন না।
লীনা লিখল–
শ্রদ্ধেয় স্যার, আমার সালাম নিন। নিতান্তই পারিবারিক কারণে আমি এই চাকরি করতে পারছি না। আমাকে বাড়িতে থাকতে হবে। আপনার সঙ্গে কাজ করা আমার জীবনের আনন্দময় কিছু ঘটনার একটি। আপনি যে বিশাল কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন আমি নিশ্চিত তা আপনি খুব সুন্দরভাবেই শেষ করবেন। এর সঙ্গে আমি শেষপর্যন্ত যুক্ত থাকতে পারব না এটা ভেবেই আমার খুব খারাপ লাগছে। আপনি ভালো থাকুন এবং সুস্থ থাকুন এই কামনা।
বিনীতা
লীনা।
কোনো বানান ভুল আছে কিনা বের করার জন্যে চিঠিটী লীনা কয়েকবার পড়ল। যদিও বানান ভুল নিয়ে স্যারের তেমন মাথাব্যাথা নেই। বানানভুল নিয়ে হৈচৈ করবে বীনা। স্যার কখনো করবেন না। চিঠি পড়ে স্যার কী করবেন তাও লীনা জানে। তিনি কোনো প্রশ্ন করবেন না। কোনো সমস্যার জন্যে লীনা কাজ ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাও জানতে চাইবেন না। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়বেন— কখন সে যাবে, গাড়ি আছে কি-না এসব জানার জন্যে। চলে যাবার সময় স্যার বলবেন, ভালো থেকো। দুই শব্দের এই বাক্যটি ছাড়া স্যার আর কিছু বলবেন বলে লীনা মনে করে না। না-বলাই ভালো। এরচে বেশি কথা বললে লীনার চোখে অবশ্যই পানি এসে যাবে। সে কাজ ছেড়ে চলে যাচ্ছে অথচ ভেউ ভেউ করে কাঁদছে— এটা হবে অত্যন্ত হাস্যকর একটা ঘটনা। চিঠিটা যে এখনই দিতে হবে এমন কোনো কথা না। লেখা থাকল। কাল ভোরে স্যার যখন নাশতা খেতে বসবেন তখন সে চিঠি দেবে।
লীনা চিঠিহাতে উঠে দাঁড়াতেই বাবুর্চি হোসেন এসে বলল, আপা স্যার আপনাকে ডাকে।
লীনা বলল, স্যার কোথায়?
হোসেন বলল, ডায়নোসর পার্কে। স্যার আমাকে বলেছেন, আপনাকে সাথে করে নিয়ে যেতে।
কী জন্যে জান?
একটা ঘটনা আছে আপা।
চলো যাই।
রাত নটার মতো বাজে। অন্য সময় রাত নটায় ক্যাম্পে প্রচুর আলো থাকে। সারি সারি ইলেকট্রিক বাতি জ্বলে। আজ কোনো বাতি নেই। শুধু ভঁবুর ভেতর আলো জ্বলছে– এর বাইরে কোনো আলো নেই। লোকজনও নেই। সব কেমন ফাঁকা।
লীনা বলল, লোকজন সব কোথায়?
ডায়নোসর পার্কে গেছে আপা। ঐখানেই ঘটনা।
কী ঘটনা?
হোসেন রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসল। কী ঘটনা সে বলতে চায় না। লীনা ভাবছে— স্যারের সঙ্গে যেই থাকে সেই স্যারের মতো হয়ে যায়। হোসেন প্রথম যখন কাজ করতে আসে তখন প্রচুর কথা বলত। এখন কথাবলা কমিয়ে দিয়েছে। এখন কোনো প্রশ্ন করলেই অবিকল সারের মতো করে রহস্যময় হাসি হাসার চেষ্টা করে।
ডায়নোসর পার্কের ঝিলের পাশে প্রচুর লোকজন। অন্ধকারে কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। বিশাল ডায়নোসরগুলিকে কালো পাহাড়ের মতো লাগছে। একজন কে মাঝে মাঝে ডায়নোসরের গায়ে টর্চ ফেলছে, তখন আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে।
হাসান বলল, এখন কেউ টর্চ ফেলবে না।
টর্চের আলো নিভে গেল।
লীনাকে দেখেই হাসান বলল, ম্যাডাম আপনার জন্যেই আমরা অপেক্ষা করছি।
হাসানের কণ্ঠস্বর তরল, আনন্দময়। লীনা চমকে উঠল। কী আশ্চর্য! স্যার তো এমন ভঙ্গিতে কখনো কথা বলেন না। তার লজ্জা লাগছে, আবার খুব ভালোও লাগছে। লীনা বলল, স্যার কী হচ্ছে?
হাসান বলল, ম্যাজিক হচ্ছে। এখন আমরা ম্যাজিক দেখব। আমাদের ম্যাজিক দেখাবেন, দি গ্রেট জাদুকর মিজু।
মিজু হাসানের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। সে তার স্বভাবমতো বিড়বিড় করে কিছু বলল। কেউ তার একটা কথাও বুঝতে পারল না।
হাসান বলল, ডায়নোসরগুলি এখনো কমপ্লিট হয়নি। স্টিল ফ্রেমে কংক্রিট দেয়া হয়েছে। শেপ দাঁড়িয়ে গেছে তবে ফাইন্যাল ফিনিসিং হয়নি। ফিনিশিং হবে, রঙ হবে। মোটামুটিভাবে যে-কাজটা শেষ হয়েছে, তা হল যে জলভূমিতে ডায়নোসর দাঁড়িয়ে আছে সেটা। আলোর ব্যবস্থা করা শেষ। আজকে সবাইকে ডেকেছি ব্যবস্থাটা কেমন পরী করার জন্যে। মিজু আমরা কি শুরু করব?
মিজু আবারো বিড়বিড় করল।
হাসান বলল, ওকে লাইট।
বড় জেনারেটরটা এতক্ষণ বন্ধ ছিল। হাসানের কথার সঙ্গে সঙ্গে জেনারেটর চালু হল। ঘড়ঘড় সঙ্গে বনভূমি কেঁপে কেঁপে উঠছে।
লীনা তাকিয়ে আছে। কোনো কারণ ছাড়াই তার বুক ধ্বকধ্বক করছে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
ঝিলের অন্ধকার পানিতে হঠাৎ যেন কিছু হল। পানি দেখা যেতে শুরু করল। আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটল তখন। পানিতে প্রাণের প্রতিষ্ঠা হল। পানি হয়ে গেল গাঢ় নীল। যেন এই ঝিল পার্থিব জগতের না। সত্যি সত্যি মায়ানগরের মাঝিল। গাঢ় নীল পানি পানি থেকে নীলাভ আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। অদৃশ্য কোনো জায়গা থেকে ডায়নোসরগুলির গায়ে আলো পড়েছে। ডায়নোসরের ছায়া পড়েছে নীল পানিতে। কী অলৌকিক অবিশ্বাস্য ছবি!
লীনা তাকাল হাসানের দিকে। হাসানের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ঝিলের গাঢ় নীল রঙের পানি যেমন সুন্দর–হাসানের চোখের পানিও সেরকমই সুন্দর।
হাসান বলল, লীনা কেমন দেখলে?
লীনা বলল, স্যার আমি আমার জীবনে এমন অদ্ভুত দৃশ্য দেখিনি।
হাসান বলল, শেষপর্যন্ত এই দাঁড়াবে আমি নিজেও কল্পনা করিনি। পানির রঙ গাঢ় নীল থেকে গাঢ় লাল হবে— এই ব্যবস্থা এখনো শেষ হয়নি। শেষ হলে ট্রায়াল দিয়ে দেখব। এখন আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই নীল রঙটাই পারফেক্ট।
আমারো সেরকম মনে হচ্ছে স্যার।
হাসান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, পানির রঙ নীল হবে এটাই স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে আমাদের জায়গাটার নাম মায়ানগর। মায়ানগরের পানির রঙ সবুজ হতে পারে, লাল হতে পারে, বেগুনি হতে পারে। পারে না?
জ্বি স্যার পারে।
আবার সোনালি হতে পারে। কি বলো, পারে না?
জ্বি পারে।
সমস্যা কী জানো চোখে অভ্যস্ত না এমন কোনো রঙ ব্যবহার করলে কিন্তু যে এফেক্ট আমরা আশা করছি তা পাব না। পানির নীল রঙ দেখে আমরা অভ্যস্ত। কাজেই পানির রঙ নীলের কাছাকাছি থাকতে হবে। বলো তোমার এই বিষয়ে কী মত?
লীনা বলল, স্যার আপনি যা বলেন তাই আমার কাছে সত্যি মনে হয়। এখন আপনি যদি বলেন–পানির রঙ কুচকুচে কালো হলে খুব সুন্দর লাগবে। আমার কাছে সেটাই সত্যি মনে হবে।
হাসান বলল, কুচকুচে কালো রঙের পানি দেখে যদি তোমার ভালো না লাগে, তারপরেও কি বলবে আমার কথাই ঠিক?
জ্বি বলব।
কেন বলবে, কোন্ যুক্তিতে বলবে?
তখন আমার মনে হবে, আমার কাছে সুন্দর লাগছে না, কারণ আমার দেখার চোখ নেই।
চলো ফিরে যাই।
চলুন।
ঝিলের পানির রঙ নিয়ে আরেকটা চিন্তা মাথায় এসেছে। চিন্তাটা উদ্ভট, তারপরেও পরীক্ষা করে দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে।
উদ্ভব চিন্তাটা কি আমাকে বলবেন?
না বলব না। লীনা শোননা, আমি ঢাকায় যাচ্ছি। ইয়াকুব সাহেব জরুরি তলব পাঠিয়েছেন। আজ রাতেই দেখা করতে হবে। যত রাতই হোক আমি যেন দেখা করি। তিনি অপেক্ষা করে থাকবেন। আমার টেনশান লাগছে।
কিসের টেনশান স্যার?
ইয়াকুব সাহেব খেয়ালি ধরনের মানুষ। আমাকে যদি বলেন— এই কাজের এখানেই সমাপ্তি। টাকা অনেক বেশি খরচ হয়ে গেছে। আর খরচ করা যাবে না এই নিয়েই টেনশান।
তিনি মাঝপথে কাজ থামিয়ে দেবেন।
তা দিতে পারেন। খেয়ালি মানুষের খেয়াল হল পানির বুদ্বুদের মতো। দেখতে সুন্দর, কিন্তু ক্ষণস্থায়ী। কে জানে তার নাতনী হয়তো খবর পাঠিয়েছে–সে আসবে না।
লীনা বলল, স্যার আপনি শুধুশুধু টেনশান করবেন না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ইয়াকুব সাহেবকে একবার যদি এনে আপনি ডায়নোসর পার্ক দেখান তাহলেই হবে।
বিয়ের কনেকে সাজিয়েগুজিয়ে দেখাতে হয়। প্রজেক্ট শেষ না-হওয়া পর্যন্ত আমি তাকে কিছুই দেখাব না।
শালবনের ভেতর দিয়ে পথ। হাসান আগৈ আগে যাচ্ছে, তার কয়েক পা পেছনে লীনা। হাসানের অভ্যাস অতি দ্রুত হাঁটা। লীনাকে তার সঙ্গে সঙ্গে আসতে কষ্ট করতে হচ্ছে। বুকে হাঁপ ধরে যাচ্ছে। হাসানের হাতে টর্চলাইট। টর্চলাইটের খুব আলো। মনে হচ্ছে জাহাজ থেকে জঙ্গলে সার্চলাইট ফেলা হচ্ছে।
লীনা।
জ্বি স্যার।
শালবনের একটা বিশেষ ব্যাপার কি তোমার চোখে পড়েছে?
আমার চোখ খুব সাধারণ। বিশেষ কিছু আমার চোখে পড়ে না।
জোনাকি চোখে পড়ছে না?
জ্বি স্যার।
অনেকদিন পর জোনাকি দেখলাম। জোনাকি বলে যে একটা অপূর্ব ব্যাপার আছে–ভুলেই গিয়েছিলাম। জোনাকি পোকার চাষ করা গেলে ভালো হত। মায়ানগরে কৃষ্ণপক্ষের রাতে হাজার হাজর জোনাকিপোকা জ্বলছে— অপূর্ব দেখাবে না?
জ্বি দেখাবে।
জোনাকিপোকা কোন্ আবহাওয়ায় দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে তা জানার চেষ্টা করছি। আমেরিকায় আমার এক বন্ধুকে ই-মেইল করেছি ফায়ার ফ্লাই সম্পর্কে প্রকাশিত সব বই যেন পাঠায়। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। দাঁড়াবে খানিকক্ষণ। রেস্ট নেবে?
লীনা কিছু বলল না। হাসান দাঁড়িয়ে পড়ল। হাতের টর্চ নিভিয়ে দিল। চারদিকে ঘন অন্ধকার। শালগাছের মাথার উপরে তারাভর্তি আকাশ ঝলমল করছে।
হাসান বলল, লীনা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি— তুমি কিছু মনে কোরো না। বাই এনি চান্স, তুমি কি এই চাকরি ছেড়ে ঢাকায় চলে যাবার কথা চিন্তা করছ?
লীনা চমকে উঠে বলল, এই কথা কেন বললেন স্যার?
হাসান বলল, আমার সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল। আমার সিক্সথ সেন্স আমাকে এই কথাটা বলছে। অবশ্যি সিক্সথ সেন্স আসলে তো কিছু না–অবচেতন মনের চিন্তা। অবচেতন মন নানান তথ্য সংগ্রহ করে শেষ পর্যন্ত একটা সিদ্ধান্তে আসে। এই সিদ্ধান্ত চেতন-মনকে জানায়। চেতন-মন হঠাৎ সিদ্ধান্তের খবর জানতে পারে সে ভাবে সিক্সথ সেন্স তাকে খবরটা দিয়েছে।
লীনা কিছু বলল না।
হাসান বলল, লীনা আমি তোমাকে ছোট্ট একটা অনুরোধ করি–প্রজেক্টটা শেষ না-হওয়া পর্যন্ত আমার পাশে থাকো। চলো রওনা দেয়া যাক।
হাসান আবারো আগের ভঙ্গিতে দ্রুত হাঁটতে শুরু করেছে। লীনা এখন আর হাসানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুত হাঁটছে না। সে পিছিয়ে পড়ছে। তার জন্যে তার খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। তার ইচ্ছা করছে অন্তত কিছু সময়ের জন্যে একা হয়ে যেতে। শালবনের ভেতর সে একা একা ঘুরবে। কেউ তাকে দেখবে না।
তাঁবুতে পৌঁছেই হাসানের কাছে লেখা চিঠিটা লীনা ছিড়ে কুঁচিকুঁচি করে ফেলল। এবং তার স্বভাবমতো বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ কাঁদল।