মহাকাব্য মহাভারত
এ আলোচনার মুখ্য লক্ষ্য হল পৃথিবীর মহাকাব্যগুলির মধ্যে মহাভারত-এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন। আলোচনার প্রধান অংশটিতে এই শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড নির্ণয়ের চেষ্টা আছে। কিন্তু তার আগে কতকগুলি প্রাথমিক কথা আছে, মূলত মহাভারত রচনা প্রসঙ্গে। গত চল্লিশ বছর ধরে পণ্ডিতেরা দেখিয়েছেন যে, মহাভারত রচনায় অন্তত তিনটি স্তর আছে। এর প্রথমটি হল মূল ক্ষত্রিয়কাহিনি। তার পরে তার সঙ্গে সংযোজিত হল কতকগুলি চিরন্তন নৈতিক কাহিনি: দয়া, ক্ষমা, অহিংসা, আশ্রিতবাৎসল্য, সত্যনিষ্ঠা, আত্মসংযম, ইত্যাদি চিরন্তন মানবিক গুণগুলিকে প্রতিপাদন করে এমন কিছু কাহিনি ক্ষত্রিয়কাহিনিতে সন্নিবিষ্ট হল। বুঝতে অসুবিধা হয় না, কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধকাহিনি যথেষ্ট পরিমাণ যশ ও জনপ্রিয়তা অর্জন করার পরে মূল কাহিনিটিকে জনশিক্ষার বাহনরূপে ব্যবহার করার উদ্দেশেই এই কাহিনিগুলির সংযোজন। এ কাহিনিগুলি বহু শতাব্দী ধরে প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতস্তত গাথা ও আখ্যানরূপে লোকমুখে সঞ্চারণ করছিল; সেই কারণে সামান্য রূপান্তরে এদের দেখা পাই বৌদ্ধ ও জৈন ও ব্রাহ্মণ সাহিত্যে।
পণ্ডিতেরা বলেন মহাভারত রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকের মধ্যে এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কাল (যদি বাস্তবে সে যুদ্ধ কখনও ঘটে থাকে) মোটের উপর খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকে। আখ্যানে গাথায় কাহিনিটি যখন ছোট ছোট খণ্ডে সাহিত্যিক রূপ পরিগ্রহ করছিল তখন বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম, উপনিষদের ভাবধারা এবং নানা সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের অভ্যুত্থানে ও বৈদেশিক আক্রমণে ভারতবর্ষের অন্তর্জগতে প্রকাণ্ড কতকগুলি ঢেউ এসে লাগছিল। এরই মধ্যে এক সময়ে মূল যুদ্ধকাহিনি মহাকাব্য রূপ পেল এবং নৈতিক কাহিনিগুলির সংযোগে নিটোল একটি আকৃতি ও প্রকৃতি লাভ করল, কারণ নৈতিক কাহিনি তো কোনও শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের নয়, চিরন্তন ও মানবিক; ফলে তার দ্বারা ক্ষত্রিয় কাহিনির স্বতন্ত্র চরিত্রটি নষ্ট হল না। মনে হয়, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের পূর্বেই এ দুটি মিলে একটি পূর্ণাবয়ব মহাকাব্য হয়ে ওঠে। খ্রিস্টিয় প্রথম ও চতুর্থ শতকের মধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের এক বিপুলায়তন সংযোজন শুরু ও শেষ হয়, একে বলা হয় ব্রাহ্মণ্য সংযোজন। কলেবরগত ভাবে যুদ্ধকাহিনি ও নৈতিককাহিনি মিলে সম্পূর্ণ মহাভারত-এর এক তৃতীয়াংশেরও কম, ব্রাহ্মণ সংযোজন দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি। এই শেষতম অংশে কিছু কিছু আছে মানুষের মুখে চলে আসা কয়েকটি অমর কাহিনি, যেমন রুরু-প্রমদ্বরা, নল-দময়ন্তী, সাবিত্রী-সত্যবানের কাহিনি, রামোপাখ্যান, শকুন্তলা, দুষ্যন্ত কথা ইত্যাদি; এগুলি রসোত্তীর্ণ এবং সাহিত্যিক গৌরবে সমৃদ্ধ। কিন্তু পরিমাণগত ভাবে এ ধরনের উপাখ্যান পুরো ব্রাহ্মণ্য সংযোজনের খুব বড় অংশ নয়। বাকি অধিকাংশ কাহিনি সাম্প্রদায়িক দেবতার মহিমা, তীর্থমাহাত্ম্য, আচার অনুষ্ঠান, পতিব্রতাধর্ম, বর্ণাশ্রমধর্ম, কিছু দর্শন, দৈব, কর্ম ও জন্মান্তরবাদ এবং সর্বোপরি ব্রাহ্মণের মহিমাকীর্তন; অর্থাৎ ব্রাহ্মণকে রুষ্ট করলে কী ভয়াবহ পরিণতি হয় এবং তুষ্ট করলে ইহলোকে-পরলোকে কী রকম সুখস্বাচ্ছন্দ্য হয় তার বিবরণ। সাহিত্যিক নিরিখে এ অংশের রচনা নিকৃষ্ট, বিষয়গত ভাবে একে বলা যায় অভিপৌরাণিক, অর্থাৎ যে ধরনের কথা পরবর্তী যুগে পুরাণ নামে স্বতন্ত্র সাহিত্য হয়ে উঠবে তারই সূচনা এতে।
পুনের সংশোধিত সংস্করণে মহাভারতে পঁচাশি হাজারেরও বেশি শ্লোক আছে, আঞ্চলিক সংস্করণের কোনও কোনওটিতে তার চেয়ে অনেক বেশি শ্লোক ছিল, তাই মহাভারতের একটি নাম শতসাহস্রী বা লক্ষশ্লোকী। (২১৪ গুপ্ত সনে অর্থাৎ ৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে বাগেলখণ্ডে রাজা সর্বনাথের খোহ শিলালিপিতে মহাভারত-কে শতসাহস্রী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ফ্লিট-এর কর্পাস অব ইনস্ক্রিপশন্স, ৩য় খণ্ড, ১৩৭ পৃষ্ঠা)। মহাভারত রচনা যে তিনবার সম্পূর্ণ হয় সে কথা মহাভারতেই আছে: চতুর্বিংশতিসাহস্রীং চক্রে ভারতসংহিতাম/ উপাখ্যানৈর্বিনা তাবদ্ভাতরং প্রোচ্যতে বুধৈঃ।। (১:১:৬১) ক্ষত্রিয় কাহিনির আদি সংস্করণে চব্বিশ হাজার শ্লোক ছিল (লক্ষ্যণীয়, রামায়ণ-এও চব্বিশ হাজার শ্লোক)। অন্যত্র শুনি: মন্বাদি ভারতং কোচিতাস্তীকাদি তথাপরে/তথোরিচরাদন্যে বিপ্রাঃ সমগধীয়তে।।(১:১:৫০) দেখতে পাচ্ছি, মনুর কাহিনি দিয়ে আরম্ভ বর্তমান গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় থেকে আস্তিকের কাহিনি দিয়ে শুরু আদিপর্বে ত্রয়োদশ অধ্যায় থেকে এবং উপরিচর থেকে শুরু ছাপ্পান্ন অধ্যায় থেকে; তিনটি আরম্ভ তিনবারের। অধ্যাপক সুখংকর বলেন, শেষবারের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য সংযোজনের রচয়িতা ভৃগুবংশীয় ব্রাহ্মণরা। (ভি এস সুখথংকর: ক্রিটিকল স্টাডিজ ইন দ্য মহাভারত। পুনা/১৯৪৪)
প্রথম ক্ষত্রিয়কাহিনি— যেটি আদি ও অকৃত্রিম বীরকথা— তার নাম ছিল জয়, এটি ছিল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের একটি কাব্যময় ইতিহাস। অথবা, রচনার পরে যখন ইতিহাসটি কাব্যগুণে ভাস্বর হয়ে উঠল তখন মানুষ তার নাম দিল জয়: ‘জয়ো নামেতিহাসোহয়ং শ্রোতব্যে বিজিগীষুণা— “যিনি জয়কামনা করেন এই জয় নামক ইতিহাস তাঁর শোনা উচিত।’ (১:৫৬:১৯) কিছু পরে শুনি: ‘যথা সমুদ্রো ভগবান যথা চ হিমবান গিরিঃ/খ্যাতুবুভৌ রত্ননিধি তথা ভারতমুচ্যতে।।— ভগবান সমুদ্র ও হিমাচল যেমন রত্ননিধি, তেমনই রত্ননিধি ভারত।’ (১:৫৬:২৭) মনে হয় ক্ষত্রিয়কাহিনি ও নৈতিককাহিনির সংযোগে মহাকাব্য যে-রূপটি পরিগ্রহ করে তাকেই ভারত নাম দেওয়া হয়েছে। বাকি সর্বত্রই এর নাম মহাভারত: ‘ত্রিভিবর্ষৈঃ সদোখায়ী কৃষ্ণদ্বৈপায়নো মুনিঃ/মহাভারতমাখ্যানং কৃতবানিদমুত্তমম।।— তিন বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন মুনি এই উত্তম মহাভারত রচনা করেন।’ (১:৫৬:৩২)
নানা ভাবেই মহাভারত-এর তিনটি পর্যায়ের কথা উঠেছে এবং মিলিয়ে দেখলে মনে হয় চব্বিশ হাজার শ্লোকে জয় নামক যুদ্ধকাহিনি রচনা করে ব্যাস তাঁর চার শিষ্যকে শোনান ও প্রধান শিষ্য শুক বৈশম্পায়নকে বিশেষ করে শেখান (বিশম্পার পুত্র শুক; ভাবে কণ্ঠস্থ করতে পারতেন বলেই কি শুক নাম?)। তার পরে জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে ঋষি ও ব্রাহ্মণদের অনুরোধে বৈশম্পায়ন সে কাহিনি বিবৃত করেন। মনে হয়, এই সময় মহাকাব্যে যুক্ত হয়েছিল ঋষিকাহিনিগুলি— যেগুলি চিরন্তন মানবিক গুণ ও নীতিকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশে রচিত। যুদ্ধ তখন দূর অতীতের স্মৃতি, কিন্তু সেই জনপ্রিয় যুদ্ধকাহিনির সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধের কাহিনিগুলোকে যুক্ত করে সমগ্র কাব্যটিকে জনশিক্ষার বাহন করে তোলা হল; এবার তার নাম হল ভারত, ভারতবংশের ইতিহাস। এই কাব্যটি রসোত্তীর্ণ সুসংহত একটি কাহিনি, এটি লোকমুখে ছড়াতে লাগল কয়েক শতাব্দী ধরে। গুপ্তযুগের সূচনার দুই এক শতাব্দীর মধ্যে এর শেষতম, অর্থাৎ বর্তমান রূপটি নির্মিত হয় ভৃগুবংশীয় উগ্র ব্রাহ্মণদের হাতে; সাম্প্রদায়িক দেবতা ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের কাঠোর অনুশাসন-সংবলিত দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি অপেক্ষাকৃত অপকৃষ্ট রচনা এই ব্রাহ্মণ সংযোজন। এ অংশে উগ্র ব্রাহ্মণ্যতার নীরস অংশ পরিণামে এত বেশি যে পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা অনেকেই অবজ্ঞাভরে মহাভারত-কে ‘শিথিলকলেবর অপাঠ্য গ্রন্থ’ আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু আগেই বলেছি, এই প্রক্ষেপেরও একটি অংশে আছে কয়েকটি অমর কাহিনি যা শিল্পোত্তীর্ণরূপে জনমানসে দীর্ঘকাল প্রোথিত ছিল, এবার গাথা-উপাখ্যানের বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্ত করে মূল কাহিনির সঙ্গে তাদের গেঁথে দেওয়া হল। এই সংযোজন খ্রিস্টিয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকেই মোটের ওপর শেষ হয়েছিল, যদিও আঞ্চলিক প্রক্ষেপ হয়তো আরও কিছু কাল ধরে চলেছিল। এই শেষ কাব্যরূপটির আখ্যাতা সৌতি উগ্রশ্রবা লোমহর্ষণি (লোমহর্ষণের পূত উগ্রশ্রবা), যিনি জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে বৈশম্পায়নের ভারত-কাব্য আবৃত্তিকালে একজন শ্রোতা ছিলেন। শৌনকের দ্বাদশবর্ষব্যাপী সোমযাগ সত্রে সমবেত জনতার অনুরোধে ইনি এই বিপুলকলেবর কাব্যটি শোনান; তখন এর নাম মহাভারত। মোটের ওপরে আদি, সভা, বন ও বিরাট পর্বের সামান্য অংশ এবং উদ্যোগ থেকে স্ত্রী পর্ব পর্যন্ত প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে হল জয়, অর্থাৎ প্রথম ক্ষত্রিয় মহাকাব্যের রূপ। ভরত অংশে এই পর্বগুলির মধ্যে এবং হয়তো শান্তিপর্বের কিছু অংশের নৈতিক কাহিনিগুলি অনুপ্রবিষ্ট হয়। আদি থেকে বিরাটের বাকি অংশ এবং শান্তি থেকে স্বর্গারোহণ সম্পূর্ণতই দ্বিতীয় ব্রাহ্মণ অর্থাৎ ভৃগুবংশীয় ব্রাহ্মণদের সংযোজন, তার পরে এর নাম মহাভারত।
মহাভারত নিজেকে অন্য অনেক নাম দিয়েছে, কিন্তু কখনও মহাকাব্য বলেনি; একবার শুধু বলেছে, কাব্যং পরমপূজিতম (১:১:৬১); মহাকাব্য আখ্যাটি পরবর্তী যুগের প্রণতি সূচিত করে। মহাভারত নিজের সম্বন্ধে বলেছে, “অর্থশাস্ত্রমিদং পুণ্যং ধর্মশাস্ত্রমিদং পরম/মোক্ষশাস্ত্রমিদ প্রোক্তং ব্যাসেনামিতে বুদ্ধিনা।। মহাভারত নিজেকে অর্থশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র ও মোক্ষশাস্ত্র বলে অভিহিত করেছে।’ (১:৫৬:২১) নিজেকে পুরাণও বলেছে: দ্বৈপায়নেন যৎ প্রোক্তং পুরাণং পরমর্ষিণা; (১:১:১৫)বলেছে ইতিহাস, ভারতস্যেতিহাস্য পুণ্যাং গ্রন্থার্থসংযুতাম্; (১:১:১৭ ) অথবা, ইতিহাসমিমং চক্রে পুণ্যং সত্যবতীসূতঃ; (১:১:৫২) বলেছে সংহিতা, সংহিতা শ্রোতুমিচ্ছামো ধর্মাং পাপভয়াপহাম; (১:১:১৯) বলেছে বেদ, বেদমিমং বিদ্বান; (১:১:২০৫) বলেছে উপনিষদ, অত্রোপনিষদং পুণ্যাং কৃষ্ণদ্বৈপায়নোহব্রবীৎ (১:১:১৯১); আর বলেছে আখ্যান, যো বিদ্যাচ্চতুরো বেদান সাঙ্গোপনিষদান্ দ্বিজঃ/ন চাখ্যনমিমং বিদ্বান্নৈব স স্যাদ্বিচক্ষণঃ।।(১:১:২৩৫) কিংবা ইদং সর্বৈঃ কবিবৈরাখ্যানমুপজীব্যতে (১:১:২৪১), অর্থাৎ শাস্ত্রগ্রন্থ ও ইতিহাসরূপেই মহাভারত পরিচিত হতে চেয়েছে। কারণ, তখনকার ভারতবর্ষ জ্ঞান ও উপলব্ধির যে দুটি প্রকাশকে চিনত— শাস্ত্র ও ইতিহাস, সেই দুটি আখ্যাই সে মহাভারতকে দিয়েছে। কয়েক শতাব্দী পরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যখন স্মৃতি ও কিংবদন্তীতে পর্যবসিত ও শতশত উপাখ্যানে পল্লবিত, তখন স্বভাবতই সমস্ত মহাকাব্যটিকেই একটি সুবিস্তৃত আখ্যান বলে মনে হবে; আখ্যান ছিল ইতিহাসেরই অঙ্গ।
মহাভারত রচনা করে ব্যাস তাঁর চার শিষ্য পৈল, জৈমিনি সুমন্ত ও বৈশম্পায়নকে শোনান ও বৈশম্পায়নকে বিশেষ ভাবে শেখান। ইদং দ্বৈপায়নঃ পূর্বং শুকমধ্যাপয়দ্দিবজঃ; (১:১:৬৩) নারদ শোনান দেবতাদের, অসিত দেবল পিতৃপুরুষদের, আর শুক গন্ধর্ব যক্ষ রাক্ষসদের— নারদোহশ্রাবয়দ্দেবানসিতো দেবলঃ পিতৃন/গন্ধবর্যক্ষরক্ষংসি শ্রাবয়ামাস বৈ শুকঃ। (১:১:৬৪)/এ গ্রন্থের মহিমা বোঝাতে বলা হয়েছে, চত্বার একতো বেদা ভারত চৈবমেকতঃ— ‘একদিকে চারটি বেদ আর একটি মহাভারত’ (১:১:২০৮); অর্থাৎ ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বেদ ও মহাভারত তুল্যমূল্য। এতে কী আছে? ভারতানাং মহজ্জন্ম মহাভারতমূচ্যতে; (১:৫৬:৩১) অথবা, কুরুণাং চরিতং মহৎ— ভরতবংশের বা কুরুকুলের মহনীয় চরিতকথাই মহাভারত। (১:৫৬/১)
মাত্র একটি স্থানে মহাভারততার নামের ব্যুৎপত্তি বলেছে: মহত্ত্বদ্ভারত্ত্বচ্চ মহাভারতমুচ্যতে— মহত্ত্ব এবং ভারততত্ত্ব থাকার জন্যেই এর নাম মহাভারত।’ (১:১:২০৯) স্পষ্টতই ব্যুৎপত্তি নির্বাচন বা ব্যাকরণশাস্ত্রমতে এটা ভুল, কারণ ভারবত্ত্ব থেকে ‘ভারত’ হতে পারে না। তবে কেন একথা বলা হয়েছে? এখানে ছন্দে, কিছু গদ্যেও সংলাপে, বর্ণনায়, আখ্যানে, নাটকীয় ঘটনার বর্ণনায় কাহিনির বিবরণে, তর্কে, উপদেশে, প্রহেলিকায়, তত্ত্বলোচনায়, নানা ভঙ্গি ও বিভিন্ন ধরনের বিষয়বস্তুর সমাবেশ। এছাড়া কলেবরগত ভাবে, বিষয়মাহাত্ম্যে, স্থানের পরিসরে, কালের ব্যাপ্তিতে, নানা জাতি উপজাতির উপাখ্যানে মহৎ এক যুদ্ধবর্ণনায়, মহৎ এক বংশের অভ্যুত্থান, সমৃদ্ধি ও অবক্ষয়ে বর্ণনায় এর মহত্ত্ব তো স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু ভারবত্ত্ব? এও কি সেই বিস্তার, ইত্যাদিরই ভার? তা মনে হয় না; মনে হয় এত ভার— গুরুত্বের, গৌরবের, ব্যাপ্তির গভীরতার— পৃথিবীর আর কোনও মহাকাব্যেই নেই। সেই জন্যে ভ্রান্তি ব্যুৎপত্তি দিতেও দ্বিধা নেই কবির। তাঁর এ সাহসের কারণ হল, ব্যাকরণে না হোক অন্য স্তরে এই ভারবত্ত্ব শব্দটি চূড়ান্ত সার্থকতায় মণ্ডিত।
মহাকাব্য কাকে বলে সে সম্বন্ধে আমাদের সকলেরই খানিকটা ধারণা আছে। তবু সামান্য সমালোচনার প্রয়োজন এই জন্যে যে রঘুবংশ, প্যারাডাইস লস্টও মহাকাব্য, আবার মহাভারতও মহাকাব্য। অথচ এদের মধ্যে জাতিগত পার্থক্য আছে এবং হয়তো সে পার্থক্যেরও নানা পর্যায় আছে। পরবর্তীকালের মহাকাব্যগুলির মধ্যে রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, রাবণবধ, কিরাতার্জনীয়, শিশুপালবধ, বেও উলফ, প্যারাডাইস লস্ট, ফাউস্টও দ্বাদশ শতকের স্পেনের (রাড্রিগো ডিয়াথ অব জ্বিহ্বার-এর) এল সিড, ইত্যাদি একটি স্তরের, পরস্পরের মধ্যে বেশি কিছু পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও। এগুলির ঊর্ধ্বে হয়তো দ্বাদশ শতকে অস্ট্রিয়ায় রচিত জার্মান মহাকাব্য নিবেলুঙ্গেনলিড, কয়েক শতাব্দী পরের ফিনল্যান্ডের কালেহ্বালা, নরওয়ের সাগাগুলি, দশম শতকের স্ক্যান্ডিনেভিয়ার গদ্য এজ্জা ও পরবর্তী কালের ছন্দ-এড্ডা। এগুলির ঊর্ধ্বে স্থান হয়তো খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের ভার্জিলের ঈনীড এবং কাব্যমূল্যে এরই সগোত্র হয়তো খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে রচিত পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্য সুমেরীয় গিলগামেশ। কাব্যের দিক থেকে বাল্মীকির রামায়ণও হোমারের অডিসি সম্ভবত এগুলির ঊর্ধ্বে স্থান পায় এবং তাদের ঊর্ধ্বে ইলিয়াড। কিন্তু মনে হয়, তারও বহু ঊর্ধ্বে অবস্থিত মহাভারত। জানি, এ স্তরবিন্যাস নিরাপদও নয়, নিরঙ্কুশও নয়; শুধু বলতে চাই, মহাকাব্য হিসেবে মহাভারত পৃথিবীর আর সব মহাকাব্যের বহু ঊর্ধ্বে। কিসে? মহাত্ত্বাদ্ভারবত্ত্বাচ্চ।
বিষয়গাম্ভীর্য, বর্ণনাকৌশল, চরিত্রচিত্রণ ইত্যাদিতে অন্যান্য দেশের মহাকাব্যও যথেষ্ট উৎকর্ষের পরিচয় দেবে। প্যারাডাইস লস্ট-এ স্যাটান ও ঈশ্বরের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে অবশ্যই যথেষ্ট মহনীয়তা আছে; দুটি চরিত্রই বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র। রঘুবংশ-তে একটি বংশের বিমূর্ত কল্পনা নায়কের স্থান নিয়েছে এবং ধীরে ধীরে বীররস পৌঁছেছে উদাস শোক ও চূড়ান্ত অবক্ষয়ের গ্লানি ও বিষণ্ণতায়। নিবেলুঙ্গেনলিড-এ, শৌর্য, সম্মানবোধ, প্রতিহিংসা ইত্যাদি বীরকাহিনির উপজীব্যের মাধ্যমে একটি গৌরবযুক্ত জীবনবোধ ফুটে উঠেছে। গদ্য এড্ডা ও গিলগামেশ-এ সৃষ্টিতত্ত্ব ও মানুষের জীবন সম্বন্ধে ভুয়োদর্শিতা ও কাব্যগত মহিমা অবশ্যই আছে। দান্তের দিহিনা কৰ্ম্মেদিয়া ও ইনফের্নো-তে মরণোত্তর অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক নৈতিক মূল্যয়বোধ ও জীবনের নানা উপলব্ধির সার্থক তাৎপর্যপূর্ণ রূপায়ণ আছে। যেমন ঈনিড-এ রোম রাজ্য গঠনের প্রাক-ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে বীর ঈনিয়াসের নিঃসঙ্গ, আপাতবঞ্চিত জীবনপরিক্রমার কাহিনি গভীর তাৎপর্যে মণ্ডিত। রামায়ণ-এ এবং অডিসি-তেও নানা বঞ্চনার আবহের মধ্যে দুটি বীরের চরিতকথায় আশ্রয় পেয়েছে বেশ কিছু চিরন্তন উপাদান। ইলিয়াড তাৎক্ষণিক আবেদনগুলিকে অতিক্রম করে আমাদের নিয়ে যায় নানা বীরের জীবনের উত্থানপতনের অন্তরালে নিহিত কয়েকটি মানবিক সত্যের সীমানায়।
আর মহাভারত? কাব্যমূল্যেই সে অনন্য। মনে রাখতে হবে, দুই তৃতীয়াংশের বেশি যে ব্রাহ্মণ্য সংযোজন তার অধিকাংশই কাব্যমূল্যে যৎসামান্য; তা সত্ত্বেও মহাভারতকাব্যমূল্যেই অনুপম। সেই কাব্যমূল্যের কয়েকটি দিক দেখাবার চেষ্টা এ প্রবন্ধে। প্রকৃতিবর্ণনাই হোক আর মানুষের রূপবর্ণনাই হোক, শুধু বর্ণনামাহাত্ম্যে কোনও কাব্য মহাকাব্য হয়ে ওঠে না। তবু বর্ণনার বিভিন্ন ধরনের উৎকর্ষ সব মহাকাব্যেই আছে। রামায়ণ, মহাভারত ও হোমারে এর একটি স্বতন্ত্র স্বাদ আছে: বর্ণনা সেখানে সতেজ, স্পষ্ট, সবল; ঋজুতাই তার বৈশিষ্ট্য। কখনও কখনও বিচিত্র অভিজ্ঞতার একত্র সমাবেশের ফলে এই বর্ণনাগুলিতে নতুন একটি মাত্রা আসে। মহাভারত-এর প্রকৃতি বর্ণনায় এমন কোনও বৈশিষ্ট্য নেই যা রামায়ণ-এ বা পুরাণে অনুপস্থিত। নদীগিরিবন, সূর্যচন্দ্রের উদয়-অস্ত, দুর্গম, ভয়াল অরণ্য, উত্তুঙ্গ পর্বত এবং প্রকৃতির কান্তকোমল রূপ প্রসঙ্গক্রমে বহুবার মহাভারত-এ বর্ণিত হয়েছে। কখনও কখনও দু-একটি বর্ণনা দৃষ্টি আকর্ষণ করে; যেমন, ‘দেবদারুবনরাজি যেমন মেঘকে ধরবার জন্যে পাতা একটি জাল— বনানি দেবদারুণআং মেঘানামিব বাগুরা।’ (৩:১৭৮:১০) হোমারের মতো মহাভারত-এও কয়েকটি অপরিবর্তিত বিশেষণ বা বিশেষণাশ্রিত বাক্যাংশ বর্ণনাকে মধ্যে মধ্যে প্রত্যক্ষ ও জীবন্ত করে তোলে। ভীষ্মের শৌর্যব্যঞ্জক আকৃতি, অর্জুনের বীরকান্তি, ভীমসেনের প্রাকার-তোরণের মতো স্কন্ধদেশ ও বলিষ্ঠ বাহু, যুধিষ্ঠিরের স্থির গম্ভীর ভাব, গান্ধারীর তেজস্বিনী মূর্তি ছোটখাট, বিশেষণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সত্যবতী অসিতলোচনা, কালো তাঁর চোখ দুটি। প্রমদ্বরা জ্বলন্তীমির চ শ্রিয়া, সৌন্দর্যে যেন জ্বলছে তাঁর দেহকান্তি শকুন্তলা শ্রীরিব রূপিণী শ্রীমতী চারুহাসিনী। জুয়ায় দ্রৌপদীকে পণ রাখবার সময়ে যুধিষ্ঠির তাঁর বর্ণনা করেছেন: নৈব হ্রস্বা ন মহতী ন কৃশা নাতিরোহিণী/ নীলকুঞ্চিতকেশী চ…/ শারদোৎপলপত্রাক্ষ্যা শারদোৎপলগন্ধয়া/ শারদোৎপলসেবিন্যারূপেণ সীসমানয়া।। (২:৬৫:৩৩, ৩৪)— তিনি শ্যামা পদ্মপলাশাক্ষী নীলকুঞ্চিতমূর্ধজা।… নীলোৎপলসমো গন্ধো যস্যাঃ ক্রোশাৎ প্রবায়তি (১:১৫৫:৪২, ৪৩), শ্যামবর্ণা, পদ্মপলাশনেত্রা, নীল তরঙ্গিত কেশ, নীলপদ্মের সুরভি যেন লেগে আছে তাঁর সর্বাঙ্গে।’ দুঃশাসন দ্যুতসভায়— দীর্ঘে সীলেম্বথ চোমিমৎসু জগ্রাহ কেশেষু নরেন্দ্রপত্নীম— দীর্ঘ নীল ঢেউ-খেলানো কেশরাশি ধরে রাজবধূ দ্রৌপদীকে আকর্ষণ করেছিলেন।’ (২:১৭:২৯) এই দীর্ঘদেহ শ্যামাঙ্গী নীলকুঞ্চিতকেশা মেয়েটিকে যেন চোখে দেখা যায়। দ্রৌপদীর বর্ণনায় তাঁর দীর্ঘ দেহ, তরঙ্গিত কেশ, নীলপদ্মের মতো চোখ, অঙ্গে পদ্মগন্ধ আর নীলপদ্মের নানা অনুষঙ্গ ফিরে ফিরে এসেছে। স্বর্গে গিয়ে যুধিষ্ঠির যখন তাঁকে দেখলেন তখনও তিনি কমলোৎপলমালিনী, জানালেন তিনি স্বয়ং পদ্মা। অর্থাৎ কবির মনের মধ্যে শ্যামাঙ্গী দীর্ঘদেহা পদ্মনেত্রা দ্রৌপদীর রূপের সঙ্গে কোথায় যেন নীলপদ্মের শোভা মিশে গিয়েছিল।
মহাভারতের বর্ণনায় মাঝে মাঝে সামান্য অলংকারের স্পর্শে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বর্ণনীয় বস্তু: যুদ্ধের সময়ে কুরুকুল ভস্ম হয়ে যাচ্ছে অর্জুনের শরবর্ষণের প্রবলতায়— মহাবনে মৃগগণা দাবাগ্নিত্রাসিতা যথা— যেন মহাবনে দাবাগ্নির ভয়ে ব্যাকুল জন্তুরা।’ (৮৮:৮০:১৯) অথবা সঞ্জয় বলছেন, ‘বিশাল পর্বতগাত্রে বেণুবন যেমন দাবানলে রাত্রে জ্বলে ওঠে, সশব্দে ফেটে যায় বাঁশগাছগুলো, তেমনই ধৃতরাষ্ট্র, তোমার পক্ষের সৈনিকরা শরপীড়িত হয়ে বিনষ্ট হচ্ছে— মহাগিরৌ বেণুবনং নিশি প্রজ্বলিতং যথা/তথা তব মহাসৈন্যং প্রাস্ফুটচ্ছরপীড়িতম।। (৮:৮০:৮০) ভীষ্মের কাছে ভীষ্মের মৃত্যুর উপায় জানতে চাইলেন যুধিষ্ঠির; ভীষ্ম উত্তর দিলেন; মৌন ভাবে, ‘যেন পরলোকে যাওয়ার জন্য দীক্ষিত হয়ে— তথোক্তবতি গাঙ্গেয়ে পরলোকায় দীক্ষিতে। (৬:১০৭:৯০) সঞ্জয় যুদ্ধরত দ্রোণের বর্ণনা করেছেন দুর্যোধনের কাছে: আকর্ণপলিতশ্যামো বয়সাশীতিপঞ্চকঃ/রণে পর্যচরদ্রোণো বৃদ্ধঃ ষোড়শবর্ষবৎ।। ‘পঁচাশি বছর বয়স দ্রোণের কানের কাছে পর্যন্ত চুল পেকে গেছে; দুর্যোধন, এই বৃদ্ধ (তোমার জন্যে) ষোলো বছরের কিশোরের মতো যুদ্ধ করছেন। (৭:১৬৫:১০৩) কৃপ কর্ণকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করার ধৃষ্টতা: ‘ডান হাত তুলে তর্জনী দিয়ে ক্রুদ্ধ বিষাক্ত সাপের মুখ খুলে তাঁর বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে চাইছ?— আশীবিষস্য ক্রুদ্ধস্য পারিখমুদ্যম্য দক্ষিণম/অবমুচ্য প্রদেশিন্যা দংষ্ট্রামাদাতুমিচ্ছসি।’ (৪:৪৯:১৩) রূপকটি বিবক্ষিত বিষয়টিকে যেন স্পষ্ট প্রত্যক্ষগোচর করে তুলেছে। যুদ্ধে দ্রোণ ‘নির্ঘুম অগ্নির মতো জ্বলতে লাগলেন।— ররাজ স মহারাজ বিধমোগ্নিরি জ্বলন।’ (৮:১৯:৩৫)
যুদ্ধ করতে করতে যখন ক্ষত্রিয়বীরের মৃত্যু হয় তখন মহাভারত-এ বারেবারেই বর্ণনা পাই— বসন্তকালে ফুলে ভরে-ওঠা একটি বনস্পতি যেন ভেঙে মাটিতে পড়ে গেল। কর্ণের পুত্র বৃষসেনের মৃত্যুর বর্ণনা: স পার্থবাণাভিহতঃ পপাত রথাদ্বিবাহুবিশিরা ধরায়াম/সুপুষ্পিতো বৃক্ষবরোহকিতায়ো বাতেরিতঃ শাল ইবাদ্রিশৃঙ্গাৎ।।— নববসন্তে ফুল ফোটা প্রকাণ্ড একটি শালতরু যেন গিরিশৃঙ্গ থেকে উন্মুলিত হল।’ (৮:৮৫:৩৬ বঙ্গবাসী সংস্করণ। সংশোধিত সংস্করণে বর্জিত হলেও বহুল প্রচারিত জনপ্রিয় বঙ্গবাসী সংস্করণে পাঠ থেকে এ প্রবন্ধে মধ্যে মধ্যে প্রয়োজন মতো উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। বিশেষত প্রখ্যাত টীকাকার নীলকণ্ঠ এই পাঠেরই টীকা করেছেন। বঙ্গবাসী বলে উল্লিখিত না হলে বাকি সমস্ত উদ্ধৃতিই পুনে সংশোধিত সংস্করণ থেকেই দেওয়া হয়েছে।) কর্ণের মৃত্যু: তদুদ্যদাদিত্যসমানবচং শরন্নভোমধ্যগভাস্করোপমম/ বরাঙ্গমূর্ব্যামপতচ্চমুপতের্দিবাকরোহস্তাদিব রক্তমণ্ডলঃ।। (৮:৬৭:২৪)… যথা কদম্বকুসুম কেশরৈঃ সর্বতো বৃত্তম/চিতং শরশতৈঃ কর্ণং ধর্মরাজো দদর্শ সঃ।। (৮:৯৬:৩৩ বঙ্গবাসী)— মাঝ-আকাশ থেকে নির্মেঘ শরতের উজ্জ্বলন্ত সূর্যমণ্ডল যেন রক্তাক্ত হয়ে অস্তাচলে ঢলে পড়ল, …যেন কেশরাচ্ছন্ন কদম ফুল মাটিতে খসে পড়ল।’ ভীম ও দুর্যোধন যুদ্ধক্ষেত্রে রক্তাক্ত দেহে যুদ্ধ করছেন: দদৃশাতে হিমবতি পুষ্পিতৌ কিংশুকাবিব (৯.৫৭:৩১)— হিমালয়ে (লাল) ফুলফোটা দুটি কিংশুকতরুর মতো দেখাচ্ছে দুজনকে। বারে বারে ক্ষত্রিয় বীরের মৃত্যুর সঙ্গে বসন্তের ফুলফোটা কর্ণিকার, কিংশুক, শাল্মলী, অশোক বা পলাশের মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপমা পাই। বসন্তের পুষ্পতরুর চূড়ান্ত সার্থকতা তার রক্তপুষ্পে আচ্ছন্ন হয়ে বিকশিত হয়ে ওঠার লগ্নে, তেমনই ক্ষত্রিয়বীর যখন সর্বাঙ্গে অস্ত্রাঘাতের রক্তাক্ত চিহ্ন নিয়ে মৃত্যুবরণ করে সে দিন তারও চরম সার্থকতার লগ্ন।
ভরদ্বাজের শরবর্ষণে পীড়িত পাণ্ডবরা কাঁপছে, ‘যেমন কাঁপে শীতকালে কৃশ গাভীরা— শিশিরে কাম্পমান বৈ কৃশা গাব ইব প্রভো। (৭:১৩০:৬)। ঘটোৎকচের পুত্র অঞ্জপর্বার নিষ্প্রাণ দেহ যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে গেল, ‘যেন দুর্ভাগার ব্যর্থ মনোরথের মতো— অভাগ্যস্যৈব সংকল্পস্তন্মোঘমপতডুবি। (৭:১৫৪:৭৯ বঙ্গবাসী) যুদ্ধে সেনাপতি কর্ণের ওপরেই যখন কৌরবদের সমস্ত ভরসা তখন তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে আবির্ভূত হলে সকলে তাঁকে দেখল ‘যেমন করে শীতে কাতর মানুষ দেখে সূর্যকে— শীতার্তা ইব ভাষ্করম। (৮:২২:১৪) এর মধ্যে সূর্যের উপমাটিতে ব্যঞ্জনাও আছে, কারণ কর্ণ সূর্যেরই সন্তান। অর্জুন কর্ণকে বিদ্রূপ করে বলছে, শৃগালও যদি বনে শশ-পরিবৃত হয়ে বাস করে তবে সে নিজেকে সিংহ বলে মনে করে; কিন্তু কতক্ষণ? যতক্ষণ সিংহকে না দেখে— শৃগালোহপি বনে কর্ণ শশৈঃ পরিবৃতো বসন/মন্যতে সিংহমাত্মানং যাবৎ সিংহং ন পশ্যতি।।’(৮:২৭:৪৫)। নকুল বীরের মতো যুদ্ধ করতে করতে দুঃখসন্তপ্ত হয়ে সরবে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন ‘যেন কলসীর মধ্যের সাপ— কুম্ভ স্থ ইব পন্নগঃ।’ উদ্যোগপর্বে বিদুর উপাখ্যানে বিদুর তাঁর নিশ্চেষ্ট পুত্র সঞ্জয়কে ধিক্কার দিয়ে বলছেন, ‘অলাতং তিন্দুকস্যেব মুহূর্তপতি হি জ্বল/মা তুষাগ্নিরিবানচিধুমায়স্ব জিজীবিষুঃ।।— তিন্দুক (কেন্দু) কাঠের আগুনের মতো অন্তত এক মুহূর্তও সতেজে জ্বলে ওঠ, শুধু বেঁচে থাকতে চেয়ে তুষের আগুনের মতো স্ফুলিঙ্গহীন ভাবে দীর্ঘকাল ধূমায়িত হয়ো না।’ (৫:১২৬:১৮) ক্ষত্রিয়পুরুষের নিশ্চেষ্টতায় ক্ষত্রিয়নারীর ক্ষুদ্ধহৃদয়ের সমস্ত ধিক্কার ওই দুটি উপমায় প্রকাশিত। স্ত্রীপর্বে মৃত দ্রোণাচার্যকে দেখে গান্ধারী বলছেন, ‘প্রচণ্ড অগ্নির মতো যিনি শত্রুসেনা দহন করতে করতে এগিয়ে যেতেন, তিনি আজ নিহত হয়ে ভূপতিত, যেন নির্বাপিত অগ্নি— শান্তচিরিব পাবকঃ।’ (১১:২৩:৩০) স্বর্গারোহণপর্বে মৃত যোদ্ধাদের বিষয়ে যুধিষ্ঠির ইন্দ্রকে প্রশ্ন করছেন, ‘আর সেই সব মহারথ যোদ্ধারা কোথায় যাঁরা যুদ্ধের আগুনে শরীর আহুতি দিলেন?— জুহুবুর্যে শরীরানি রণবহ্নৌ মহারথাঃ।’ (১৮:২:২) যুদ্ধের সঙ্গে বারেবারেই অগ্নি, অগ্নিকাণ্ড ও দাবানলের উপমা দেখা দিয়েচে, এর তাৎপর্য পরে আলোচনা করছি।
যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে দুর্যোধন এক নিরস্ত্র অবস্থায় যুদ্ধ করতে করতে বলছেন ‘সর্বোপকরণৈহীনং বর্মশস্ত্রাদিবর্জিতম্/একাকিনং যুধ্যমানং পশ্যন্তু দিবি দেবতাঃ।।— বৰ্ম, অস্ত্ৰ ইত্যাদি সমস্ত উপকরণ চলে গেছে, তবু আমি একাকী যুদ্ধ করছি, আকাশের দেবতারা চেয়ে দেখুন আমাকে।’ (৯:৩৩:৫৩) এই শৌর্যে দুর্যোধন সে দিন যেন দেবতাদেরও অতিক্রম করে গেলেন। শিখণ্ডির আড়াল থেকে অর্জুন শরনিক্ষেপ করছেন, ভীষ্ম অস্ত্রত্যাগ করে বললেন, ‘এ বাণ ত শিখণ্ডীর নয়, এ অর্জুনের; কাঁকড়াবিছের ছানা যেমন করে মাকে দংশন করে মেরে ফেলে সেই ভাবে এ বাণ আমার মর্মমূল বিদ্ধ করছে।’ (১২:১১৯:৬৫ বঙ্গবাসী)। অপত্যধর্ম পদদলিত, আড়াল থেকে অর্জুন পিতামহকে মৃত্যুবাণ হানছেন, তাই এ বাণের বিষ শুধু ভীষ্মের শরীরকে নয়, তাঁর হৃদয়কেও বিদ্ধ করছে দুঃসহ জ্বালার যন্ত্রণায়।
সম্পূর্ণ নিরালংকার কবিত্ব, হৃদয়াবেগের কাছে যার সরাসরি আবেদন নেই, তেমন নিদর্শনও মহাভারতে প্রচুর পাই। শল্যপর্বে বলরাম অর্জুনকে ধিক্কার দিয়ে বলছেন: ‘অন্যায় ভাবে ধার্মিক রাজা দুর্যোধনকে হত্যা করে তুমি পৃথিবীতে অপযশস্বী হবে শঠ যোদ্ধা বলে— হত্ব ধর্মেণ রাজানং ধর্মাত্মানং সুযোধনম্/ জিম্মযোধীতি লোকেঽস্নিখ্যাতিং যাস্যসি পাণ্ডব।।’৯:৫৯:২৩ ) যুদ্ধকালে দ্রোণ অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ শুনে যখন উন্মাদের মতো পাণ্ডবদের হত্যা করে চলেছেন তখন ভীম তাঁকে বলেছেন: ‘একটি পুত্রের মৃত্যুর প্রতিহিংসায় অধর্মপথে বহু সৈন্য হত্যা করছেন, ক্ষাত্রধর্মে থেকে যাঁরা যুদ্ধ করছেন আপনি ব্রাহ্মণ হয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করছেন, আপনার লজ্জা হয় না, আচার্য?— একস্যার্থে বহুন্ হত্বা পুত্রসাধর্মবিদ্যয়া/স্বকর্মস্থান বিকর্মস্থো ন ব্যাপত্রপসে কথম্।।’(৭:১৬৫:২১)। যুদ্ধের শেষদিন দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন: গচ্ছ ভুক্ষ ত্বং রাজেন্দ্র পৃথিবীং নিহতেশ্বরাম্/হতযোধাং নষ্টরত্নাং ক্ষীণবপ্রাং যথাসুখম্।।— পৃথিবীর যশস্বী রাজারা ও যোদ্ধারা আজ মৃত। বসুন্ধরার ঐশ্বর্য নিঃশেষিত, এর পরিখাও নষ্ট হয়ে গেছে; যাও মহারাজ, এই পৃথিবীকে যথেচ্ছ ভোগ করে সুখী হও।’ (৮:৩১:৫১) এ কথায় কি শুধুই শ্লেষ? এক ধরনের অতলান্ত বিষাদ, গ্লানি ও আত্মধিকারও তো এতে ধ্বনিত হচ্ছে; জয়ী হলে এই পৃথিবীকেই তো কৌরবরা নিজেরা পেতেন, যাতে ভোগ করবার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, যার কোনও ঐশ্বর্য, কোনও গৌরব নেই। আশ্রমবাসিক পর্বে বনে চলে যাওয়ার আগে নিজের ও গান্ধারীর হয়ে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে বলছেন: বৃদ্ধোহয়ং হতপুত্রোহয় দুঃখিতোহংয় নরাধিপঃ/পূর্বরাজ্ঞাশ্চ পুত্রোহয়মিতি কৃত্বানুজানথ।। ইয়ঞ্চ কৃপণা বৃদ্ধা হতপুত্ৰা তপস্বিনী/গান্ধারী পুত্রশোকার্তা যুস্মান্ যাচতি বৈ ময়া।। তেষামস্থিরবুদ্ধীনাং লুব্ধানাং কামচারিণাম্/কৃতে যাচেহদ্য বঃ সর্বান্ গান্ধারীসহিতোহনঘান্।।— এই হতপুত্র বৃদ্ধ রাজা, আমি পূর্ব রাজাদের বংশধর; এ কথা মনে রেখে আমাকে বনে যাওয়ার অনুমতি দাও। দুর্ভাগিনী অসহায় পুত্রশোকার্তা বৃদ্ধা গান্ধারী ও আমি, নির্দোষ তোমাদের কাছে মিনতি করছি।’ (১৫:৯:৭-৯, বঙ্গবাসী) এখানে কবিত্বের সূত্রটি আছে প্রকরণে: অন্ধ বৃদ্ধ, রাজা ও রুদ্ধনয়না গান্ধারী, দুজনেই শতপুত্রের মৃত্যুতে মুহ্যমান, জীবনে বিতৃষ্ণ, পুত্রদের স্বেচ্ছাচারের গ্লানিতে পরম কুণ্ঠিত, বিজয়ী ভ্রাতুষ্পুত্রদের কাছে দীন ভাবে শুধু একটি প্রার্থনাই করছেন: বাকি কটা দিন অরণ্যে বাস করব, সেই অনুমতিটুকু দাও। এর আর্তিও যেমন মর্মস্পর্শী, প্রার্থনার অকিঞ্চিৎকর দৈন্যও তেমনই।
মহাভারত-এর বহু চিরন্তন সত্যের প্রকাশ আছে অসংখ্য শ্লোকে; এগুলি নানা যুগের নানা অঞ্চলের ভূয়োদর্শিতার ফসল। এ প্রাজ্ঞভাষিতের কয়েকটি উদাহরণ দিলেই বাঝা যাবে এক ধরনের নিরাসক্ত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জীবনকে যাঁরা দেখতে পেরেছিলেন তাঁরাই সমকালের ক্ষুদ্র সমস্যাকে পেরিয়ে জীবনে কিছু মৌলিক সত্যে পৌঁছতে পেরেছিলেন। শান্তিপর্বে যুধিষ্ঠির ভীমকে বলেন, ‘যে রাজা অখিল পৃথিবীকে শাসন করবেন তাঁরও তো মাত্র একটিই উদর; কী তুমি যুদ্ধের প্রশংসা করছ, ভীম?— য ইমামখিলাং ভূমিং শিষ্যাদেকো মহীপতিঃ /তস্যাপ্যুদরমেকং বৈ কিমিদং ত্বং প্রশংসসি।।’ (১২:১৭:৩) ‘পাপ করে ফেলে নিজেকে অমানুষ মনে করা উচিত নয়; সূর্য যেমন রাত্রিশেষে উদিত হয়ে অন্ধকারকে বিনষ্ট করে তেমনই সৎকর্মের দ্বারা দুষ্কর্ম বিনষ্ট করা যায়।’(১২:১৪০:৩১-৩৩) ‘কেউ এক খণ্ড কাঠের ওপর ভর করে গভীর মহানদী পেরিয়ে যাচ্ছে, সে তো কাষ্ঠখণ্ডটিকেও নদী পার করাচ্ছে।’ (১২:১৩৬:৬০) ‘মহাসমুদ্রে যেমন দুটি কাষ্ঠখণ্ড ভাসতে ভাসতে কাছাকাছি আসে, আবার একটু পরে ভাসতে ভাসতে দুদিকে চলে যায়, এ পৃথিবীতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগও সেই রকম— যথা কাষ্ঠঞ্চ সমেয়াতাং মহোদধৌ/সমেত্য চ ব্যাপেয়তা তদ্বদ্ভূতঃ। (১২:২৮:৩৬)
যুদ্ধের মহাকাব্য, যেখানে বিপদকে শিরে নিয়ে ক্ষত্রিয়ের জীবন কাটে সেখানে স্বভাবতই শুনি, ‘ন সংশয়মনারুহ্য নরো ভদ্রাণি পশ্যাতি/সংশয়ং পুনরারুহ্য যদি জীবতি পশ্যাতি।।— সশংয়কে স্বীকার না করে কেউ মঙ্গল লাভ করে না; সংশয় পেরিয়ে যদি বেঁচে থাকে তবেই মঙ্গলের দেখা পায়।’ (১২:১৩৮:৩৪) কোন শত্রু সবচেয়ে ভয়াবহ এ বিষয় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, ‘সাহসভরে যারা যুদ্ধে উদ্যত, যারা প্রাণের আশা একেবারে ছেড়েছে, তাদের সামনে দাঁড়াবার সাধ্য স্বয়ং ইন্দ্রদেবেরও নেই— সাহসোৎপতিতানাঞ্চ নিরাশানঞ্চ জীবিতে/ন শক্যমগ্রতঃ স্থাতুং শত্রুণাপি ধনঞ্জয়।। (৯:৫৯:১৬ বঙ্গবাসী) অনুরূপ কথা, পুনে সংশোধিত সংস্করণে উশনা-গীতায়: পুনরাবর্ত মানা ভগ্নানাং
ভগ্নানাং জীবিতৈষিণাম্ / ভেতব্যমরিশেষাণামেকায়নগতা হি তে।।’ (৯:৫৭:১৩)। পিতৃহত্যায় প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ অশ্বত্থামাকে কূপ যখন রাত্রে ঘুমোতে বললেন তখন অশ্বত্থামা বললেন, ‘আতুর, ক্রুদ্ধ, অর্থচিন্তাকারী বা প্রেমার্ত মানুষের ঘুম কই?— আতুরস্য কুতো নিদ্রা নরস্যামর্ষিতস্য চ/অর্থাংশ্চিন্তয়তশ্চাপি কাময়ানস্য বা পুনঃ।। (১০:৪:২১) দ্রোণপর্বে ধৃতরাষ্ট্রের অনুশোচনা শুনে সঞ্জয় বললেন, ‘এখন অনুতাপে কী হবে? প্লাবন ভেঙে আসবার পর সেতু বাঁধবাদ্দর চেষ্টার মতোই নিষ্ফল এ বিলাপ— গতোদকে সেতুবন্ধো যাদৃগয়ং তব/বিলাপো নিষ্ফলো রাজন্ মা শুচ ভরতর্ষভ।।’ (৭:৬২:২) জনক রাজা বলেন, ‘আমার সম্পদ অনন্ত, কারণ আমার কিছুই নেই; আমার রাজধানী মিথিলা নগরী দগ্ধ হলেও আমার কিছুই দগ্ধ হয় না— অনন্তং বত মে বিত্তং যস্য মে নাস্তি কিঞ্চন/মিথিলায়াং প্রদীপ্তায়াং ন মে দহ্যতি কিঞ্চন।।’ (১২:২৩:১৫ বঙ্গবাসী) ‘অন্যমনস্কে ফুল তুলছে যে মানুষটি, মৃত্যু তাকেও সহসা গ্রাস করে, যেমন নেকড়ে বাঘ টেনে নিয়ে যায় ভেড়ার ছানাকে— পুষ্পাণীব বিচিন্বন্তমন্যত্র গতমানসম্/বৃকীবোরণমাসাদ্য মৃত্যুরাদায় গচ্ছতি।।’ (১২:১৭৫:১৩ বঙ্গবাসী) ‘বুড়ো মানুষের চুল, দাঁত, চোখ, কান জীর্ণ হয় না, জীর্ণ হয় শুধু তৃষ্ণা— জীর্যন্তি জীর্যতঃ কেশা দত্তা জীর্যন্তি জীর্যতঃ/চক্ষুঃশ্রোত্রে চ জীর্যেতে তৃষ্ণৈকা নতু জীর্যতে।।’ (১৩:২০:২১ বঙ্গবাসী) ‘অপ্রিয় অথচ হিতকর কথার বক্তাও দুর্লভ, শ্রোতাও দুর্লভ— প্রিয়স্য হি পথ্যস্য বক্তা শ্রোতা চ দুর্লভঃ।’ (২:৬৪:১৭ বঙ্গবাসী) বাল্যবন্ধু দ্রুপদ রাজা হলে পর দ্রোণ রাজসভায় গিয়ে তাঁকে ‘সখা’ সম্বোধন করে কথা বলতে শুরু করতেই দ্রুপদ থামিয়ে দিয়ে বললেন: ‘ন দরিদ্রো বসুমতো নাবিদ্বান্ বিদুষঃ সখা/হুরস্য ন সখা ক্লীবঃ সখিপূর্বং কিমিষ্যতে।।— দরিদ্র কখনও ধনীর বন্ধু হয় না, অপণ্ডিত পণ্ডিতের বা নিবীর্য বীরের সখা হয় না; তুমি ‘সখা’ সম্বোধন করতে চাইছ কেন?’ (১:১২২:৭) জীবনে মানুষকে অনুরূপ অভিজ্ঞতার সামনে বারবার আসতে হয়, কিন্তু এখানে কী নিরাবরণ নিষ্ঠুর প্রকাশ সে সত্যের। এমনই জীবনের নানা ক্ষেত্র, নানা সংকট ও অবস্থা সম্বন্ধে ভুয়োদর্শীদের অসংখ্য প্রাজ্ঞভাষিত ছড়িয়ে আছে সারা মহাভারত-এ।
এ পর্যন্ত দেখা গেল মহাভারত-এ নানা ধরনের কবিত্ব পরিমাণগত ভাবে কত প্রচুর এবং কাব্যমর্যাদায় কত সমৃদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে এত অজস্র উদাহরণ আছে যে নির্বাচন করাই দুঃসাধ্য, তাই অল্প কয়েকটি উদাহরণ দিয়েই ক্ষান্ত হতে হল। এই যে এ পর্যন্ত যা দেখানো হল তা প্রায় মহাকাব্যেই অল্পবিস্তর আছে এবং তার দ্বারা মহাভারত-এর কাব্যত্বই প্ৰতিপন্ন হয়, মহাকাব্যত্ব নয়। মহাভারত-এর প্রকৃত উৎকর্ষ অন্যত্র।
এই উৎকর্ষের বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হলে প্রথমেই চোখে পড়ে যে মহাভারত-এ মূল ক্ষত্রিয়কাহিনিতে ঘটনার মধ্যে অতিলৌকিকতার কোনও প্রভাবই নেই। ইলিয়াড-এর সঙ্গে এখানে মহাভারতে প্রকাণ্ড একটা প্রভেদ আছে। যদিও ইলিয়াড-এর ঘটনার গতি অতিলৌকিকতাকে বাদ দিয়েও একই খাতে প্রবাহিত হতে পারত তথাপি ইলিয়াড-এর কাহিনির মধ্যে দেবতাদের হস্তক্ষেপ ওতপ্রোত ভাবে অনুস্যূত হয় আছে। মহাভারত-এ তৃতীয় অংশে অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য সংযোজনে দেবতারা খুব প্রত্যক্ষ ভাবেই বিদ্যমান এবং কখনও কখনও নেপথ্য থেকে ঘটনার কর্ণধারের ভূমিকাতেও দেখা দিচ্ছেন। কিন্তু যেহেতু মূল মহাকাব্য রচনার অনেক পরবর্তী কালের সংযোজন এ অংশ, সে জন্যে এই অতিলৌকিক উপাখ্যানগুলি কাহিনির মর্মে প্রবেশ করেনি। তাই মূল (ক্ষত্রিয়) কাহিনি একান্ত ভাবে দেবতানিরপেক্ষ ও মানবিক সীমার মধ্যে নিহিত। ফলে দেবতার ভূমিকা মূল কাহিনির ক্ষেত্রে আগন্তক বা আপতিক এবং সম্পূর্ণরূপে পরিহার্য। মানুষের চরিত্রের অন্তর্নিহিত শুভ ও অশুভবুদ্ধি, নৈতিক জয়পরাজয়ই কাহিনিকে নিয়ন্ত্রিত করছে। শেষতম ব্রাহ্মণ্য সংযোজনেই কৃষ্ণ প্রবেশ করেন মহাভারত-এ, প্রধান দেবতারূপে। মূল মহাকাব্যে তিনি পাণ্ডবদের সখা, অর্জুনের পরম সুহৃদ ও যুদ্ধক্ষেত্রে সারথি। এ কৃষ্ণ দ্বারকার রাজা, যদুবংশের বৃষ্ণিবীর; মানবিক পরিসরের বাইরে এঁর কোনও অস্তিত্ব তখনও ছিল না, এবং ক্ষত্রিয়কাহিনিতে তার কোনও প্রয়োজনও ছিল না (লক্ষণীয় অপর ক্ষত্রিয় মহাকাব্য রামায়ণ-ও তার আদিমতম রূপে সম্পূর্ণ ভাবে মানবিক। আদিকাণ্ডে তার নায়ক নির্বাচন প্রসঙ্গে শুনি, যে সব গুণ এ নায়কের প্রয়োজন তা দেবতাদের মধ্যেও দুর্লভ, তাই এতে রইল নরচন্দ্রমা রামচন্দ্রের কাহিনি’)। মহাকাব্যের প্রকৃত তাৎপর্যই তো এখানে; সে মানুষের সমস্যা মানুষেরই নৈতিক আত্মিক ও আবেগনিষ্ঠ উপলব্ধির সাক্ষ্য বহন করে, সেই জন্যেই এক যুগের কাহিনি সর্বযুগের আত্মিক সম্পদের ভাণ্ডার হয়ে ওঠে। মহাভারতে কৃষ্ণ প্রধান দেবতারূপে অবতীর্ণ হওয়ার পর জয়-পরাজয় আর বীরনিষ্ঠ রইল না, কৃষ্ণনিষ্ঠ হয়ে উঠল: যতঃ কৃষ্ণস্ততো জয়ঃ। ক্ষত্রিয়ের নীতি পদদলিত হল; কৃষ্ণের পরামর্শে প্রত্যেকটি কৌরব মহারথীকে অন্যায়-সমরে প্রাণ দিতে হল। মানবিক ও ক্ষাত্রনীতির ওপরে আরোপিত হল অন্য এক নীতি: কৃষ্ণই পরিমাপক হলেন ন্যায়-অন্যায়ের, নিয়ামক হলেন শুভ-অশুভের। মানবায়ত্ত মূল্যবোধ কৃষ্ণে প্রতিহত হল। বর্তমান প্রবন্ধ মূল ক্ষত্রিয় কাহিনিকে অবলম্বন করে রচিত, তাই কৃষ্ণ মহাকাব্যে দেবাতিদেব ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে মহাভারতের যে রূপটি ছিল তারই বিশ্লেষণ এ প্রবন্ধে।
যদিও মহাকাব্যটি যুদ্ধকেন্দ্রিক তবু এর অন্তর্গঢ় রসটি বীর বা রৌদ্র নয়। আনন্তবর্ধন বলেছেন মহাভারতের মূল রসটি শান্তরস (এই তথ্যটি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যে আমি অধ্যাপক হেমন্তকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে ঋণী)। এ কাব্যের এতটা অংশ জুড়ে যুদ্ধ-হানাহানি আছে যে এর মূল রসকে শান্ত বললে সহসা বিস্মিত লাগে। কিন্তু তলিয়ে ভাবলেই এ কথার তাৎপর্য স্পষ্ট হয়। মূল মহাকাব্যের ঘটনাতে যুদ্ধ, কিন্তু ক্রান্তদর্শী কবির যে নির্ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কাব্যটি জন্ম নিয়েছে যুদ্ধ সেখানে নিতান্তই বহিরঙ্গ, যে ধীর ও গভীর দৃষ্টিতে সেখানে জীবন-পর্যবেক্ষণ তা শান্তরসেই গিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। আপাত-প্রতীয়মান স্তরে যুদ্ধ এখানে নিন্দিত এবং আরও গভীর স্তরে কুরুক্ষেত্রের সংগ্রাম যেখানে মানুষের চিত্তপটে শ্রেয় ও প্রেয়ের সংঘাতের প্রতীক, সেখানেও শেষ পর্যন্ত রস তো শান্তই। এ সংগ্রাম চিত্তের গভীরে অনুষ্ঠিত হয়, এর জয় পরাজয় নৈতিক এবং যে সমাহিত জীবনবোধে এর পর্যবসান তা যথার্থই শান্তরসেরই অনুষঙ্গ বহন করে।
মহাভারত-এর চরিত্রচিত্রণে কয়েকটি বৈশিষ্ট চোখে পড়ে। প্রথম বৈশিষ্ট্যটিকে এক কথায় বলা যেতে পারে বাস্তবানুগতা; কারণ জীবনে যেমন, মহাভারত-এও তেমনই, অবিমিশ্র ভাল বা অবিমিশ্র মন্দ চরিত্র নেই। দুটি মাত্র ব্যতিক্রম: বিদুর ও শকুনি; যেমন জীবনেও লক্ষ্যে এমন ব্যতিক্রম হয়তো বা দু’ একটি দেখা যায়। নায়কের ভূমিকায় আমরা হয়তো নিজের অগোচরে অবিমিশ্র ভাল চরিত্রই আশা করি; কিন্তু মহাভারত-এ তেমন চরিত্র নেই। না, যুধিষ্ঠিরও নয়; যদিও ব্রাহ্মণ্য সংযোজনের গ্রন্থকার একমাত্র তাঁকেই সশরীরের স্বর্গে নিয়ে গেছেন। শাস্ত্রে দ্যুতক্রীড়াকে ব্যসন বলা হয়েছে; সে দিক থেকে পাশা খেলায় আসক্তি তাঁর অপরাধ। তাছাড়াও শুধু যে দ্রোণাচার্যকে প্রাণঘাতী মিথ্যা বলেছিলেন তা নয়, পাঁচ ভাইয়ের স্ত্রীকে একা পণ রাখবার অধিকারও তাঁর ছিল না। এ সব ছাড়া আরও ছোটখাট ত্রুটি হয়তো তাঁর চরিত্রে লক্ষ্য করা যায়; অন্যদের ক্ষেত্রে এ কথা আরও সত্য। কিন্তু ভাল-মন্দে দোষেগুণে মিলিয়ে চরিত্রসৃষ্টি এ তো রামায়ণ, ইলিয়াড ও অন্যান্য কয়েকটি মহাকাব্যেও আছে। কারণ এ ভাবে উপস্থাপিত করলে তবেই চরিত্রগুলি শ্রোতা বা পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, পাঠকের বুদ্ধি এবং আবেগের সংবেদন সহজে চরিত্রগুলিকে ঘিরে আবর্তিত হতে পারে।
মহাভারত-এ চরিত্রচিত্রণের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল এর প্রত্যেক মুখ্য চরিত্রই দ্বিধাগ্রস্ত। এখানেও ব্যতিক্রম ওই বিদুর ও শকুনি। অন্যান্য মুখ্য চরিত্রগুলি প্রত্যেকেই নৈতিক সমস্যার সম্মুখীন এবং প্রত্যেকেই একা নিজের বোধ ও বুদ্ধি দিয়ে সমস্যার সমাধান করেছে। এই দ্বিধা কোথাও ভাল ও মন্দের মধ্যে, শ্রেয় ও প্রেয়ের মধ্যে, কোথাও বা শ্রেয় ও শ্রেয়স্তরের মধ্যে। ধৃতরাষ্ট্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব পুত্রস্নেহ ও ন্যায়বিচারের মধ্যে, অর্থাৎ শ্রেয় ও প্রেয়ের মধ্যে। তিনি হেরে গেছেন নৈতিক সংগ্রামে; সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় পরাজয় মেনে নিয়েছেন। গান্ধারী একই সমস্যার সম্মুখীন হয়ে হার মানেনি; বিদুর ও সঞ্জয়ের মতো তিনি যখনই সুযোগ পেয়েছেন ধৃতরাষ্ট্রকে কর্তব্য সচেতন করে দিতে চেয়েছেন। পারেননি— এই তাঁর মর্মন্তুদ ব্যর্থতা ও বেদনা। বিদুর, সঞ্জয়, গান্ধারী ও যুধিষ্ঠির মিলে মহাভারত রচনার প্রথম পর্বে ধর্মের ভূমিকায় অবতীর্ণ। পরবর্তী ব্রাহ্মণ্য সংযোজনে এলেন কৃষ্ণ; সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মের এক মাত্রা যুক্ত হল মহাভারত-এ। যুধিষ্ঠিরের দ্বন্দ্ব ক্ষাত্রধর্ম ও মানবধর্মের সংঘাত, অর্থাৎ শ্রেয় ও শ্রেয়স্তরের সংঘাত। দুটিই ধর্ম, কোনও একটিকে বেছে নিলেই তিনি নিন্দনীয় হন না, অপরাধীও হন না। কিন্তু বুদ্ধোত্তর ভারতে বেছে নেওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে: ক্ষত্রিয়কূলে জন্মে যিনি মনেপ্রাণে যথার্থ অহিংস এবং অহিংসাকেই যিনি শ্রেয়স্তর জ্ঞান করেন তাঁর অন্তর্দ্বন্দ্ব সত্যিই মর্মান্তিক। সিংহাসনে অধিকার যতই বিসংবাদিত হোক সে অধিকার সর্বপ্রযত্নে রক্ষা করা ক্ষত্রিয়ের অবশ্যকর্তব্য। এতাবৎকাল সব ক্ষত্রিয়ই এই নীতি মেনে বিনা দ্বিধায় যুদ্ধ করেছেন; কেউ জিতেছেন, কেউ বা হেরেছেন, তবে দুটিই শুভ পরিণতি, কারণ, ‘জয়ে স্যাদ্বিপুলা পৃথ্বী/ধ্রুবঃ স্বর্গঃং পরাজয়ে।’ (৮:৮৪:১৫) কালেহ্বালা, এল সিড, নিবেলুঙ্গেনলিড, ঈনীড, ইলিয়াড, এমনকী অডিসি-তেও এই অধিকারের জন্যে সংগ্রাম এবং শৌর্যধর্মে এ সংগ্রাম অবশ্যকর্তব্য। যুধিষ্ঠিরের সমস্যা হল তাঁর অন্তর্নিহিত মানবিকতা অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী এবং আত্মীয়কুলের রক্ত পেরিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করাটাকে কোনও মতেই ন্যায়ধর্ম বলে স্বীকার করতে পারছে না। রাজ্যে অধিকার তাই তাঁর কাছে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর মনে হচ্ছে। তাই উভয়পক্ষ যখন যুদ্ধে উদ্যত, শুধু শঙ্খধ্বনি হলেই যুদ্ধ শুরু হবে, তখন জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব, জয়লাভ হলে যিনি সিংহাসনটি পাবেন তিনি ছুটে গিয়ে আচার্যদের পায়ে পড়ছেন: এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ বন্ধ করুন। পারলেন না রক্তপাত রোধ করতে; তাই যুদ্ধের শেষে দুর্যোধনের মৃত্যুর সময়ে অশ্রুপ্লাবিত নেত্রে দুর্যোধনকে বলছেন: ‘নাত্মানুশোচনীয়স্তে শ্লাঘ্যো মৃত্যুস্তবাধুনা/ বয়মেবাধুনা শোচ্যাঃ সর্বাবস্থাসু কৌরব।।— দুর্যোধন, তুমি অনুশোচনায় কষ্ট পেও না, তোমার মৃত্যু তো বরণীয়, এখন আমরাই সর্ব অবস্থায় শোচনীয় হয়ে রইলাম।’ (৯:৫৯:২৭ বঙ্গবাসী) এই অন্তর্দ্বন্দ্ব অল্পকালের জন্যে অর্জুনকেও স্পর্শ করেছিল, যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বক্ষণে। শ্রীকৃষ্ণ সুদীর্ঘ বক্তৃতা ও অতিলৌকিক জাদু দিয়ে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়ে অর্জুনের অন্তঃ সংঘাতের অবসান ঘটান।
কুম্ভীর অন্তর্দাহের গভীর যন্ত্রণা একেবারে অসহ্য হয়ে উঠলে এসেছিলেন জ্যেষ্ঠ কানীন পুত্র কর্ণের কাছে, যাঁর সঙ্গে যুদ্ধে উদ্যত তাঁর পাণ্ডব পুত্ররা; কর্ণ তাঁর অনুরোধ রাখেননি। তাই কি যুধিষ্ঠির সিংহাসন লাভ করলে হতপুত্রা কর্ণমাতা হতপুত্রা গান্ধারীর সঙ্গে আশ্রমবাসে গেলেন? কর্ণ তাঁর সূতকুলে জন্ম যেন মনে থেকে মেনে নিতে পারেননি। তাঁর অন্তরে বহুবিধ সংঘাত, দুর্যোধনের থেকে তিনি নিজেকে শৌর্যবান ও কৃতী মনে করতেন, অথচ জন্মসত্ত্বে তাঁর হীন পরিচয়, পদে পদে তা নিয়ে লাঞ্ছনা। ভীষ্মের চেয়ে তিনি নিজেকে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা বলে মনে করতেন, অথচ ভীষ্ম, দ্রোণের মৃত্যু না হলে সেনাপতি হতে পারবেন না। সহজাত কবচকুণ্ডল ইন্দ্র হরণ করলেন, দানবীররূপে কর্ণের অভিমানের সুযোগ নিয়ে, তাঁর মাথার ওপরে খঙ্গের মতো উদ্যত ছিল গুরু পরশুরামের অভিশাপ। কর্ণ যেন নিজের অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর কথা জানতেনই এবং এই জানার পরিপ্রেক্ষিতেই উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে তাঁর অতুলনীয় বীরত্ব। পরাজয় আসন্ন জেনেও দুর্যোধনের পক্ষ ত্যাগ না করাতেই নৈতিক সংগ্রামে তাঁর জয়ের মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়। কর্ণ তাঁর দানবীরত্বের, যোদ্ধা হিসেবে তাঁর যোগ্যতার বা শৌর্যের কোনও মর্যাদাই পাননি।
দ্রোণ শক্তিমানের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন দ্রুপদের ওপরে প্রতিশোধ নিতে; পরে শক্তিমান অন্যায়কারী জেনেও আর পক্ষত্যাগ করতে পারেননি। প্রিয়শিষ্য অর্জুনের অভিমান দূর করতে একলব্যকে নিষ্ঠুর শাস্তি দেন, হয়তো বিবেকের বিরুদ্ধেই। যুদ্ধের আরম্ভে তাঁকে অন্তর্দ্বন্দ্বে পীড়িত হতে দেখি। ভীষ্ম প্রথম জীবন থেকেই নৈতিক সংঘাতের সম্মুখীন হয়েছিলেন; পিতাকে সুখী করতে নিজের সব সুখের সম্ভাবনা স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করেন, শ্রেয় এবং প্রেয়ের দ্বন্দ্বে জয়ী হন। পরে সত্যবতীর অনুরোধেও প্রতিজ্ঞাচ্যুত হননি। জীবন তাঁকে বিশেষ কিছুই দেয়নি, ধৃতরাষ্ট্রের সন্তানদের অভিভাবকের পদটি ছাড়া এবং এখানেই তাঁর ব্যর্থতার সূচনা— দুর্যোধন যে ন্যায়নীতি বর্জন করেছেন, ধৃতরাষ্ট্র যে অন্ধ পিতৃস্নেহে অন্যায়ের প্রশ্রয় দিচ্ছেন এ সব জেনেও তিনি তাঁদের সঙ্গেই রইলেন। কৌমার্যটুকু অক্ষুণ্ণ রাখা ও মাঝে মাঝে সৎপরামর্শ দেওয়া ছাড়া তাঁর আর কোনও কৃতিত্ব নেই। মহাকাব্যে তাঁর ভূমিকা প্রায় নেপথ্যেই রইল, তাঁর সৎপরামর্শে কেউ কোনও দিন কর্ণপাতও করেনি। বস্তুত, আশ্রমবাসই তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক ছিল, তাতে তিনি অন্যায়ের সাহচর্য এড়াতে পারতেন। সম্পূর্ণ বিনা স্বার্থেই তিনি দুর্যোধনের সহকারী হলেন, ধৃতরাষ্ট্রের নৈতিক অন্ধত্বকে মেনে নিতে বাধ্য হলেন। এই সব অপরাধের তীক্ষ্ণ অনুশোচনায় তাঁর শরশয্যা তো পাতা হয়েছে বহু দিন পূর্বেই।
কুন্তী রাজমাতা রাজবধূ, কিন্তু তাঁরও জীবন কেটেছে গ্লানি ও বঞ্চনায়। মাদ্রী ব্যর্থযৌবনা তরুণী, সুন্দরী রাজবধু; অকালে সহমৃতা হলেন বিনা দোষে, কিন্তু স্বেচ্ছায়। মহাকাব্যের আদিতেই সত্যবতীকে কেন্দ্র করে ভাগ্যের নিষ্করুণ পরিহাস সুপরিস্ফুট। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধটা যা নিয়ে ঘটল— সিংহাসনে অধিকার— আরম্ভ থেকে সে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলে ভাগ্যের বিদ্রূপ বোঝা যায়। সত্যবতীকে কামনা করলেন শান্তনু; সুযোগ বুঝে সত্যবতী দাবি করলেন, তাঁর পুত্র সিংহাসনের অধিকারী হবে। শান্তনু ক্ষুব্ধ হলেন, জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবব্রতেকে কোন অপরাধে বঞ্চিত করবেন তার ন্যায্য অধিকার থেকে? এ সমস্যার সমাধান করলেন দেবব্রত নিজেই, আমরণ কুমার থাকবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এই নিষ্ঠুর মূল্যে পাওয়া অধিকার কী ভোগ করতে পারলেন সত্যবতী? চিত্রাঙ্গদ বিচিত্রবীর্যের জননী কত দিন দুটি তরুণী বিধবা পুত্রবধূ নিয়ে প্রাসাদে ব্যর্থ দিন যাপন করলেন। কিন্তু কী অদম্য আকৃতি তাঁর রাজমাতা হওয়ার! সংকোচ ত্যাগ করে সেই বঞ্চিত ভীষ্মকেই অনুরোধ করলেন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী দিতে; ভীষ্ম অসম্মত হলে ব্যাস। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র বা পাণ্ডু কারও ঔরসপুত্রই তো শেষ পর্যন্ত সিংহাসনে এলেন না, এলেন কুন্তীর গর্ভের ক্ষেত্রজ পুত্র যুধিষ্ঠির।
দ্রৌপদী রাজনন্দিনী, রাজকুলবধূ, পঞ্চ মহাবীরের পত্নী, দুরূহ এক সমদর্শিতার পরীক্ষা তাঁকে দিতে হয়েছে সারা জীবন ধরে। তাঁর মনে ক্ষত্রিয় বীর সম্বন্ধে যে আদর্শ ছিল স্বামীদের আচরণে তার নানা ব্যত্যয় দেখে তিনি বারে বারে প্রতিবাদ করেছেন, ফলে প্রচলিত অর্থে পতিব্রতা ধর্মের সঙ্গে তাঁর চরিত্রগত বিরোধ ছিল। প্রয়োজন মতো স্বামীদের, এমনকী ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকেও, তিনি ভর্ৎসনা করেছেন। প্রচণ্ড অপমান সহ্য করেছেন অসহায়ের মতো: নাথবতী অনাথবৎ। জীবন কি অর্থহীন বোধ হয়নি এই তেজস্বিনী বীরাঙ্গনার কাছে? তাঁর বহু উক্তিতে তাঁর অন্তর্দাহের তীব্র জ্বালা প্রকাশ পেয়েছে।
দেখতে পাচ্ছি, মহাভারত-এ কোনও চরিত্রই চরিতার্থ নয়। যা তাঁরা চেয়েছেন তা কেউই পাননি, অথবা যখন যেমন ভাবে চেয়েছেন তখন তেমন ভাবে পাননি। সেই দিক থেকে দুর্যোধনের মৃত্যুবরণ যুধিষ্ঠিরের সিংহাসন লাভের চেয়ে অনেক সহজ ছিল। দুর্যোধন প্রথম থেকেই জানতেন জয়ের কোনও আশাই নেই তাঁদের পক্ষে। শৈশব থেকেই ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্র বারংবার পাণ্ডবদের কাছে শৌর্যে পরাহত হয়েছে। দুর্যোধন রাজপুত্র, সিংহাসনে তাঁর এ রকম দাবি ছিলই। সে দাবির স্বীকৃতির জন্যে তিনি আমরণ যুদ্ধ করে গেছেন। দ্যুতসভার প্রকাণ্ড অন্যায় অনুষ্ঠানের পর থেকেই তাঁর বিবেক নীরব হয়েছে, কাজেই যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর নতুন কোনও নৈতিক সমস্যা ছিল না, ক্ষত্রিয়বীরের মতো যুদ্ধ করেই তিনি মৃত্যুবরণ করলেন এবং প্রত্যেক কৌরব মহারথীর মতো অন্যায় সমরেই তাঁর মৃত্যু ঘটল। যুদ্ধের পূর্বে দু’ পক্ষই প্রতিশ্রুত ছিলেন, প্রতিপক্ষ সময় চাইলে তাকে আক্রমণ করবেন না এবং কখনওই অধোনাভি আঘাত করবেন না। কর্ণ সময় চেয়ে পাননি; ভীষ্ম অস্ত্রত্যাগ করলেন অর্জুনের রথে শিখণ্ডিকে দেখে, কারণ ক্ষত্রিয় স্ত্রীহত্যা করে না; দ্রোণ পুত্রের মিথ্যা মৃত্যু সংবাদে অস্ত্রত্যাগ করেন; ক্লান্ত দুর্যোধনকে দ্বৈপায়ন হ্রদ থেকে বিদ্রুপবাণে জর্জরিত করে তুলে এনে অধোনাভি আঘাত করে হত্যা করা হল।
বিদুর ও সঞ্জয়ও ব্যর্থ চরিত্র, ন্যায়নীতির প্রতিষ্ঠাকল্পে এঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করেও সম্পূর্ণ ভাবে ব্যর্থকাম হন। শকুনিও ব্যর্থ; সিংহাসনে দুর্যোধনের অধিকার প্রতিষ্ঠা তো হলই না, সমগ্র কুরুকুলই ধ্বংস হল। ব্যাসের পৌত্ররাই কৌরব-পাণ্ডবরূপে দু’পক্ষে যুধ্যমান এবং ব্যস নিজে সে কাহিনি রচনা করেছেন! সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীর জীবনে কী দুঃসহ গ্লানি। সব মুখ্য চরিত্রের জীবনই ব্যর্থতায় পর্যবসিত এবং এইখানে রামায়ণ, অডিসি, ইলিয়াড, নিবেলুঙ্গেনলিড ও গিলগামেশ-এর সঙ্গে মহাভারত-এর মিল: স্বল্প সুখভোগের পরেই দুঃখের ছায়া নেমে আসে প্রত্যেকটি নায়কের জীবনে। কারণ, মহৎ কাব্য সুখ দিয়ে সৃষ্ট হয় না, সুখে জীবনজিজ্ঞাসা নেই। এবং এই জীবনজিজ্ঞাসাতেই কাব্য প্রকৃত তাৎপর্য লাভ করে, সমকালকে অতিক্রম করে সর্বদেশের, সর্বকালের মানুষের কাছে কথা বলতে পারে।
কী সেই কথা? না, জীবনের অর্থ কী, কেন বাঁচি। তলিয়ে ভাবলে জীবনের নিজস্ব ও আত্যন্তিক কোনও মূল্যই নেই। কিন্তু এ কথা স্বীকার করা মাত্রই মানুষ অন্য একটি দুরতিক্রম্য দায়িত্বের সম্মুখীন হয়, তা হল: জীবনকে অর্থবহ করে তোলাই মনুষ্যত্বের লক্ষণ। এই দায়িত্ব যে যত পরিমাণে পালন করতে পেরেছে, তার মনুষ্যজীবন ততটাই সার্থক। মনে পড়ে, মহাভারত-এর বনপর্বের সেই উপাখ্যান, যেখানে সর্বাপেক্ষা দীর্ঘজীবীর সন্ধানে বেরিয়ে চিরঞ্জীব মার্কণ্ডেয় এলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছে। তাঁর নির্দেশে প্রাবারকর্ণ উলুকের কাছে। সেখান থেকে নাড়ীজঙ্ঘ বকের কাছে এবং তার নির্দেশে অকৃপার কচ্ছপের কাছে। অবশেষে অমরতার একটি সংজ্ঞা পাওয়া গেল: ‘দিবং স্পৃশতি ভূমিঞ্চ শব্দঃ পুণ্যস্য কর্মণঃ/যাবৎ স শব্দো ভবতি তাবৎ পুরুষ উচ্যতে।।— পূণ্যকাজ বা সুকৃতির যশোধ্বনি আকাশ ও পৃথিবীকে স্পর্শ করে, সে শব্দ যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই পুরুষ পুরুষ বলে অভিহিত হয়।’(৩:১৯৮:১৩) শুভকাজ, মানুষের পক্ষে মঙ্গলকর কাজের দ্বারাই মানুষ অমরত্ব লাভ করে এবং সে পুণ্য বা শুভকর্মের স্মৃতি যতদিন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে ততদিনই শুভকারী অমর।
চরিত্রচিত্রণে মহাভারত-এর আর একটি বৈশিষ্ট্য হল, প্রত্যেক মুখ্য চরিত্রই ব্যর্থকাম, ভাগ্যের হাতে নিপীড়িত, অনেকটা গ্রিক নাটকের নায়কের মতো। অথচ গ্রিক মহাকাব্যের মতো দেবতারা এখানে মুখ্য ঘটনার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সক্রিয় নন; অন্তত মূল ক্ষত্রিয়কাহিনিতে তো নয়ই। এখানে মানুষ নিজের কৃত ন্যায়-অন্যায়ের ফল ভোগ করে, জয়-পরাজয় দেবতাদের পক্ষপাতিত্বে নির্ণীত হয় না। দেবতাদের মধ্যস্থতা বা হস্তক্ষেপের সব কটি কাহিনিই পরবর্তী ব্রাহ্মণ্য সংযোজনে আছে। কিন্তু মূল কাহিনির সব মুখ্য চরিত্র সম্বন্ধেই বলা চলে তাঁরা যা চেয়েছিলেন তা পাননি এবং প্রত্যেকেই গভীর নিষ্প্রতীকার মর্মযন্ত্রণায় দগ্ধ হয়েছেন। ভবভূতির ভাষায় আমাদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, ভগবান ব্যাস, এবং কিং তে কাব্যার্থঃ?” এই কি তোমার কাব্যার্থ? এই নিরন্ত অতল ব্যর্থতা দেখাবার জন্যেই কী এ মহাকাব্যের অবতারণা? এক অর্থে সত্যই এ-ই মহাভারত-এর প্রতিপাদ্য। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিতে, ‘মানুষের জীবনকে দোলায়িত কর তুমি দুঃসহ দ্বন্দ্বে/ডান হাতে পূর্ণ কর, সুধা/বামহাতে চূর্ণ কর পাত্র/দুঃসাধ্য কর বীরের জীবনকে/মহৎ জীবনে যার অধিকার।’ (পৃথিবী, পত্রপুট)
কিন্তু মহাভারত শুধু ব্যর্থতাবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলে আড়াই হাজার বছর ধরে এই অম্লান মহিমায় এ কাব্য ভারতবর্ষের চিত্তলোকে বিরাজ করত না। এই অতল ব্যর্থতার সঙ্গে আরও দুটি বস্তু আছে। একটি হল, প্রত্যেক মুখ্য চরিত্রই একান্ত নিঃসঙ্গ। অর্জুন, চরিত্রের দিক থেকে যাঁর গৌরব বেশি নেই, একমাত্র তিনিই পেয়েছিলেন একটি অন্তরঙ্গ সুহৃৎকে, কৃষ্ণকে তিনি মনের কথা বলতে পারতেন। কিন্তু আর সকলেই একাকী; ইংরেজিতে যাকে বলে ট্র্যাজিক আইসোলেশন, তা এঁদের জীবনের প্রথম থেকেই আছে। কুন্তী প্রথম দিকেই পাণ্ডু ও মাদ্রীকে হারালেন, আর সকলেই মনের দিকে তাঁর দূরের মানুষ। ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর মধ্যে বিবেকের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর, তার দু’পারে দু’জনেই একা। দ্রোণ, ভীষ্ম, কৰ্ণ আপন আপন ভূমিকায় স্বতন্ত্র ভাবে নিঃসঙ্গ; তাঁদের মনের কাছাকাছি কেউ নেই। যুধিষ্ঠির যে-অন্তর্দ্বন্দ্বে বিক্ষত তাকে বোঝবার সাধ্যই তাঁর আশপাশের কারও ছিল না, সাহচর্য দেওয়া তো দূরের কথা। পঞ্চ মহাবীরের বধূ দ্রৌপদী স্বয়ম্বর সভায় লক্ষ্যভেদী অর্জুনের কণ্ঠে মাল্যদান করবার সময়ে ওষ্ঠে স্মিতহাস্য ও হাতে শ্বেতপুষ্পমাল্যটি নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু ভাগ্যের বিড়ম্বনায় তাঁর চাওয়া ও পাওয়ার মিল হল না, তাঁর নিঃসঙ্গতা হয়ে রইল অপরিমেয়।
এই ব্যর্থতাবোধ, এই গভীর নিঃসঙ্গতা এর অবতারণা করবার সার্থকতা কী? নিঃসংশয়ে বলা চলে মহাকবি এ সব দেখাতেন না যদি না এ সব অতিক্রম করে আরও কিছু দেখাবার অভীপ্সা ও সাধ্য তাঁর থাকত। মহাকাব্যটি যে স্তরে গিয়ে এ সবকে অতিক্রম করেছে সেখানেই সে মহত্ত্ব ও ভারবত্ত্ব অর্জন করে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে। শান্তিপর্বে নিঃসঙ্গতার প্রসঙ্গে একবার শুনি, শূয়তে ত্রিলোককৃত ব্রহ্মা প্রভুরেকাকী তিষ্ঠতী— ‘শোনা যায় ত্রিভুবনের স্রষ্টা ব্রহ্মা একাকী বিরাজ করেন।’ এ হল তুষারমৌলি হিমালয়ের একাকিত্ব; যে-মানুষ পৃথিবীকে বরণীয় কিছু দেয় তারও নিত্যসঙ্গী এই একাকিত্ব। একাকিত্ব দেখানোর একটি স্মরণীয় প্রসঙ্গ মহাভারতে আছে: যুদ্ধশেষে যুধিষ্ঠির নৈতিক দ্বিধায় দোলাচলচিত্ত, রাজা হয়ে সিংহাসন ভোগ করতে অনীহা তাঁর। নিজের অপরাধবোধ ও রাজত্বে অনীহা প্রকাশ করলে ভীমসেন তাঁকে বললেন: “যত্র নাস্তি শরেঃ ন মিত্রৈন চ বন্ধুভিঃ/আত্মনৈকেন যোদ্ধব্যং তত্ত্বে যুদ্ধং সমায়াতম্…এতজ্জিত্বা মহারাজ কৃতকৃত্যো ভবিষ্যসি।।— ‘যে যুদ্ধে শরনিক্ষেপ নিষ্ফল, মিত্র, বন্ধু থেকেও লাভ নেই, সে যুদ্ধ উপস্থিত। এ যুদ্ধে জয়লাভ করে তবেই তুমি কৃতকাম্য হবে।’(১২:১৬:২১, ২২)
চরিতার্থতার এই সংজ্ঞা মহাভারত-এ: সকলের অলক্ষ্যে নিজের বিবেকের সঙ্গে একক সংগ্রামে জয়লাভ করা। এই যুদ্ধই এ মহাকাব্যে চরম ও অন্তিম যুদ্ধ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে যুধিষ্ঠির এ যুদ্ধের সম্মুখীন হলেন; আগেও হয়েছিলেন, কিন্তু এই শেষবার। প্রত্যেক প্রধান চরিত্রের জীবনেই বাইরে রণক্ষেত্রের যুদ্ধের চেয়ে এটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম। প্রতিপক্ষ এখানে নিজের মধ্যেই বাস করে: লোভ, দম্ভ, ঈর্ষা, অহমিকা, নৈতিক অন্ধত্ব এ সবের সঙ্গে যে সংগ্রাম সেখানে মানুষ সম্পূর্ণ একা; সে সংগ্রাম কঠোর, মরণান্তিক। এই সংগ্রামের রূপায়ণের মধ্যে মহাভারত কাব্যমূল্যে চিরন্তন সমুজ্জ্বলতা অর্জন করেছে। সম্পূর্ণ অন্য এক ধরনের কাব্য নিহিত আছে এই স্তরে।
যুদ্ধের সময়ে ভীষ্ম কৌরব পক্ষ সমর্থন করেছেন, নিজে বীরের মতো যুদ্ধ করে বহু পাণ্ডব বীরকে হত্যা করেছেন। সেই ভীষ্ম মৃত্যুকালে দুর্যোধনকে বলছেন, ‘যুদ্ধং মদন্তমেবাস্তু তাত সংশাম্য কৌরবৈঃ— আমার মৃত্যুর সঙ্গেই যুদ্ধ শেষ হোক, বৎস, কৌরবরা শান্ত হোক।’ (৬:১১৬:৪৬) আরও বলেছেন— ‘পৃথিব্যাং সর্বরাজানো ভব¥দ্য নিরাময়াঃ— পৃথিবীর সব রাজা আজ রোগমুক্ত হোক।’ (৬:১১৭:২) রোগ হল যুদ্ধের বাসনা। পিতামহ ও প্রথম সেনাপতি বৃদ্ধ ভীষ্ম ক্ষমা চাইলেন কর্ণের কাছে, রুষ্ট ভাবে তাঁকে কঠোর কথা বলার জন্যে; কর্ণ যুদ্ধ করার অনুমতি চাইলে বললেন, ‘বলবীর্যকে আশ্রয় করে যুদ্ধ কর, কিন্তু মনে কোনও অহংকার রেখো না— যুদ্ধস্ব নিরহংকারো বলবীর্যব্যপাশ্রয়ঃ’। ৬:১১৭:৩২) যুদ্ধে লোকক্ষয় দেখে আত্মগ্লানিতে তাঁর নিজের অহংকার চলে গেছে, সমস্ত বৈরভাব ঘুচে গেছে। জিঘাংসা, লোভ ও প্রতিহিংসাকে স্বরূপে দেখেছেন বলেই নম্র ভাবে উদ্ধত কর্ণের কাছে ক্ষমা চাইতে আজ তাঁর বাধল না।
দ্রোণ মৃত্যুর আগে বলছেন, ‘পাণ্ডবদের মঙ্গল হোক, আমি শস্ত্রত্যাগ করলাম।’ (৭:১৬৫:২৫২) যিনি প্রবল বিক্রমে কৌরব সেনাপতির ভূমিকায় যুদ্ধ করেছেন দিনের পর দিন তিনি মৃত্যুর আগে ‘একাগ্রচিত্ত হয়ে সমস্ত প্রাণীকে অভয় দান করলেন— অভয়ং সর্বভূতানাং প্ৰদদৌ যোগযুক্তবান্।’ (৭:১৬৫:২৫) কর্ণের রথচক্র কাদায় বসে গেছে, সময় চেয়ে পেলেন না, ‘ক্রোধে তাঁর চোখে জল এল— গ্রস্তচক্রস্তু রাধেয়ঃ কোপাদশূণ্যবর্তয়ৎ।’ (৮:৬৬:৬০)। দুর্যোধন নিজের সুখী ও কৃতী জীবন স্মরণ করে মৃত্যুকালে বারবার বললেন, আমার চেয়ে ভাল মৃত্যু আর কার?— কো নু স্বন্ততরো ময়া।’ (৯:৬৩:১৯-২৫) কিন্তু প্রচণ্ড লোকক্ষয়ে তাঁরও মনে দুঃখগ্লানি এসেছিল, তাই মৃত্যুর পূর্বাহ্নে জীবিত আত্মীয়দের দিকে চেয়ে বললেন, ‘আমার সৌভাগ্য এই যে এই জনক্ষয় থেকে তোমরা ক’জন বেঁচে আছো দেখে যেতে পারছি।’ (৯:৬৪:২৬) ধৃতরাষ্ট্র আগেই জানতেন যে পাণ্ডবদেরই জয় হবে। আদিপর্বে তাঁর সেই দীর্ঘ বিলাপের ধ্রুবদই ছিল, ‘তদা নাশংসে বিজয়ায় সঞ্জয়।’ কিন্তু যেটা জানতেন না তা হল যুদ্ধের অবসানে তাঁর নিজের জীবনটাই তাঁর কাছে অর্থহীন ও দুর্বহ হয়ে উঠবে। বলছেন, “কিং নু বন্ধুবিহীনস্য জীবিতেন মমাদ্য বৈ/লুনপক্ষস্য ইব মে জরাজীর্ণস্য পক্ষিণঃ।।— বন্ধুবিহীন অবস্থায় এই প্রাণটা দিয়ে আমার আর কী হবে? আমি যেন আজ ডানা-ভাঙা একটা বুড়ো পাখি।’ (৯:১:১১ )
অত্যন্ত দৃপ্ত, বলগর্বিত ভীম যুদ্ধের শেষে অধোনাভি আঘাত করে দুর্যোধনকে হত্যা করার জন্য গান্ধারীর কাছে ক্ষমা চাইছেন: ‘অধর্মো যদি বা ধর্মপ্রাসাত্তত্র ময়া কৃতঃ। আত্মানং ত্রাতুকামেন তন্মে তং ক্ষন্তুমর্হসি।।— ধর্মই হোক অধৰ্মই হোক তখন যা করেছি তা ভয়ে, আত্মরক্ষার জন্যেই করেছি। আমার সে অপরাধ আপনি ক্ষমা করুন।’ (১১:১৪:২) শৌর্যে দাম্ভিক ভীম আজ তাঁর প্রাণভয়ে আত্মরক্ষার জন্য কৃত অপরাধ স্বীকার করছেন, ক্ষমা চাইছেন। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির গান্ধারীকে বলছেন: ‘পুত্রহস্তা নৃশংসহোহম্ তব দেবি যুধিষ্ঠিরঃ/শাপাইঃ পৃথিবীনাশ হেতুভুতঃশপস্ব মাম্।।— আমি নৃশংস, আপনার পুত্রদের হত্যাকারী যুধিষ্ঠির, পৃথিবীর ধ্বংসের নিমিত্ত আমি, আমি অভিশাপের যোগ্য, আমাকে অভিশাপ দিন।’ (১১:১৫:৩) কোথায় রইল সারা জীবনের সঞ্চিত একটিমাত্র অভিমান— ধর্মপুত্রত্বের? নিজের পক্ষের রাজ্যলোভ দমন করতে না পারার সমস্ত দায় একা মাথা পেতে নিলেন। এই স্বীকারোক্তি বক্তা শ্রোতা উভয়ের পক্ষে মর্মন্তুদ; জীবনের নিরাবরণ রূপ যেন উদ্ঘাটিত হল ধর্মপুত্রের আত্মসমালোচনার মধ্যে। যাঁকে পরম ধার্মিক বলে সকলে জেনেছিল, নিজেকে তিনি আজ অপরাধী বলে মেনে নিলেন। এ হল সত্যের নিরঞ্জন রূপ, যেমন কঠিন তেমনই উজ্জ্বল।
দ্রৌপদী, যিনি বীর ক্ষত্রিয় স্বামীদের নিরুদ্যম দেখে বারেবারে ক্ষুব্ধ ও রুষ্ট হয়েছেন, পরুষবাক্যে তাঁদের ধিক্কার দিয়েছেন তিনিও আগে বুঝতে পারেননি যে যুদ্ধে জয় হলেও, পাঁচটি স্বামী জীবিত থাকলেও, সম্রাজ্ঞীপদে তাঁর প্রতিষ্ঠা আসন্ন হলেও জীবন তাঁর কাছে সর্বরিক্ততায় বিবর্ণ, মলিন হয়ে যাবে। গান্ধারীকে বলেছেন, “কিং রাজ্যেন বৈ কার্যং বিহীনায়াঃ সুতৈমম— পুত্রহীনা আমার রাজ্য দিয়ে কী হবে?’(১১:১৫:১৩) সমস্ত কাঙ্ক্ষিত বস্তু পাওয়ার অন্তরালেও কী মর্মান্তিক বঞ্চনা ও ব্যর্থতা। মৃত দুর্যোধনের দেহের পাশে দাঁড়িয়ে গান্ধারী বলছেন, ‘যুদ্ধে যাওয়ার আগে সে আমার কাছে জয়ের আশীর্বাদ চাইতে এসেছিল— অস্মিন্ জ্ঞাতিসমুদ্ধর্ষে জয়মস্বমা ব্রবীতু মে।’ (১১:১৭:৫) আমি পারিনি দিতে; বলেছিলাম যে পক্ষ ধর্ম, জয় সেই পক্ষেই। সেই সত্যনিষ্ঠা আজ মৃত পুত্রের পাশে দাঁড়িয়ে থাকবার সময়ে মাতৃহৃদয়কে দুঃসহ যন্ত্রণা দিচ্ছে। যুদ্ধশেষে ধর্মনিষ্ঠা গান্ধারী আজ কৃষ্ণ সম্বন্ধে কোনও সংকোচ রাখলেন না। দুর্যোধনের সত্যকার স্বার্থও ছিল, দাবিও কতকটা ছিল, কিন্তু কৃষ্ণের তো তা ছিল না, তাই গান্ধারী বললেন: “যস্মাৎ পরম্পরং ঘ্নতো জ্ঞাতয়ঃ কুরুপাণ্ডবাঃ/উপেক্ষিতাতে গোবিন্দ তস্মাদ্ জ্ঞাতীন্ বধিষ্যষি।।/হতজ্ঞাতিহতামাত্যো হতপুত্রো বনেচরঃ/কুৎসিতেনাভ্যুপায়েন নিধনং সমবাপ্স্যাসি।।— জ্ঞাতি কুরুপাণ্ডবরা সকলে মারা যাবে। তোমরা জ্ঞাতিরা মৃত, অমাত্যেরা মৃত, পুত্রেরা মৃত এমন অবস্থায় বনে বিচরণ করতে করতে কুৎসিত ভাবে তোমার মৃত্যু হবে।’ (১১:২৫:৪০, ৪১) এত কঠিন কথা গান্ধারী কখনও বলেননি। পাণ্ডবদের তিনি ক্ষমা করেছিলেন, কিন্তু কৃষ্ণকে ক্ষমা করেননি। তাঁর অভিযোগ যে সম্পূর্ণ সত্য সে কথা মহাভারতকার প্রতিপাদন করেছেন: অভিশাপটি অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল। শতপুত্রের মৃত্যুতে নয়, স্বজনহত্যার মতো নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের প্রশ্রয় দেওয়ার জন্যে কৃষ্ণের প্রতি তাঁর এই অসহিষ্ণু উষ্মা। তাঁর চিত্তে এই হত্যাকাণ্ডের হেতু, অনিবার্যতা, এর অপরিমাণ নৃশংসতা, ইত্যাদি আবেগ গভীর ভাবে মথিত হচ্ছিল, তাই কতকটা যেন স্বভাববিরুদ্ধই তাঁর এই ক্রুর অভিশাপ, কিন্তু তা সম্পূর্ণ ভাবে ন্যায়সঙ্গতও বটে। দেখছি, মুখ্য চরিত্রগুলির মধ্যে বাইরের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় অন্তর্লোকে এক প্রবল বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল।
এই হল জীবনের পুনর্মূল্যায়ন, যার চেয়ে মহত্তর উদ্দেশ্য সাহিত্যের আর হতে পারে না। এই মূল্যায়ন ঘটে কঠিন তাপে, বেদনায়; এতে মানুষের চরিত্রের, তার শ্রেষ্ঠ সত্তার রূপান্তর ঘটে। কারণ, ‘অসন্তপ্তত্ত যতরু প্রত্যেতি প্রকৃতিং পুনঃ— যে কাঠ সন্তপ্ত হয়নি সে তার পূর্বরূপে পুনর্বার ফিরে যায়; পরিবর্তিত বা বিবর্তিত হয় না।’ (২৩:১০২:৩১, বঙ্গবাসী) জয়দ্রথ দ্রোণাচার্যকে প্রশ্ন করছেন, কুরুপাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষা ও অস্ত্রগুরু তো একই, তবু পাণ্ডবরাই সর্বদাই জয়ী হয় কেন? দ্রোণাচার্য বললেন: ‘সমমাচার্যকং তাত তব চৈবার্জুনস্য হি। যোগাদ্দুঃখোচিতত্বাচ্চ তন্মাত্ত্বতোত্তাধিকোহর্জুনঃ।।— তোমার ও অর্জুনের আচার্য একই, কিন্তু, অর্জুনের শিক্ষার সঙ্গে আছে যোগ, আর বিদ্যাকে সে অর্জন করেছে দুঃখের মূল্যে, এইখানেই অর্জুন তোমার চেয়ে বড়।’ (৭:৭২:২৩ বঙ্গবাসী) সঞ্জয় নিরন্তর ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন, ‘তোমার আত্মীয়বিনাশ বর্ণনা করছি, তুমি শান্ত হয়ে দুর্ধর শোককে ধারণ কর— হন্ত তে সম্প্রবক্ষ্যামি সর্বং প্রত্যক্ষদর্শিবান্/শুশ্রুষস্ব স্থিরো ভূত্বা তব হ্যাপনয়ো মহান্।।’ (৭:৬২:১)
এই ভাবে সমস্ত যুদ্ধের বর্ণনা, কৌরবপক্ষের বীরপুত্র ও আত্মীয়বন্ধুদের বিনাশের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্রের প্রায়শ্চিত্ত চলছিল আঠারো দিন ধরে। মোহ ছিন্ন হলে, যুদ্ধের শেষে যুধিষ্ঠির তাঁকে সসম্মানে প্রাসাদে রাখলেও তাঁর মনে হল অরণ্যই এখন তাঁর যথার্থ আশ্রয়। তাঁর অন্তর্দাহ বাড়িয়ে তুলবার জন্য সঞ্জয় তাঁকে বলেছিলেন, ‘স্বয়ং পীত্বা মহারাজ কালকূটং সুদুর্জয়ম্/তস্যোদানীং ফলং কৃৎস্নমবাপুহি নরোত্তম।।— দুঃসহ কালকূট বিষ তুমি স্বেচ্ছায় পান করেছ, মহারাজা এ বারে তার ফল ভোগ কর।’ (৭:১৩৩৩:২ বঙ্গবাসী) আবার স্ত্রীপর্বে যুদ্ধের অবসানে, ‘জনপদিকং দুঃখমেকঃ শোচিতুমর্হসি— সমস্ত জনপদের এ শোক, এ কি তুমি একা বহন করতে পার মহারাজ? সে চেষ্টাও কোরো না।’ (১১:২:১৬) দ্রোণপর্বে শুনি, ‘পৃথিবীকে পাওয়ার জন্যে পৃথিবীপতি রাজারা যুদ্ধ করেছেন, আজ মৃত্যুর পরে সেই পৃথিবীকে প্রিয়বধূর মতো আলিঙ্গন করে নিদ্রিত আছেন— পৃথিব্যাং পৃথিবীহেতোঃ পৃথিবীপতয়ো হতাঃ/পৃথিবীমুপগৃহ্যাঙ্গৈঃ সুপআঃ কান্তামিব প্রিয়াম।।’(৭:১৪৬:৪৭ বঙ্গবাসী) কী নিষ্ঠুর শ্লেষ! এই কী তাঁদের পৃথিবীকে লাভ করা?
যুদ্ধে কার লাভ? ‘যথা বরাহস্য শুনশ্চ যুধ্যতোস্তয়োরভাবে শ্বপচস্য লাভঃ— বরাহ ও কুকুর যুদ্ধ করে মরলে লাভ চণ্ডালের।’ (৭:১৮০:৮ বঙ্গবাসী) কোনও মোহ নেই কবির। যুযুধান জাতিরা চিরকালই ভুলে যায় যে, যুদ্ধে লাভ সম্পূর্ণ অন্য এক শ্রেণির মানুষের। তাই ভীষ্ম ও দ্রোণ দুর্যোধনকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘পৃথিবীং ভ্রাতৃভাবেন ভুজ্যতাং বিজ্বরো ভব— পৃথিবীকে ভ্রাতৃ ভাবে ভোগ কর, তোমার জ্বর ছেড়ে যাক।’ (৫:১২৬:১৮) লক্ষ করি লোভকে জ্বরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, অর্থাৎ এটা সুস্থ অবস্থা নয়। ‘যে একা, ভাল খায়, ভাল পরে, ভৃত্যাদের তার ভাগ দেয় না, তার চেয়ে নৃশংসতর আর কে আছে?—একঃ সম্পন্নমশ্নাতি বস্তে বাসশ্চ শোভনম্/ যোহসংবিভজ্য ভৃত্যেভ্যঃ কঃ নৃশংসতরস্ততঃ।।’ (৫:৩৩:৪৫) এই লোভ থেকেই সে দিন কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের আগুন জ্বলেছিল, আজও জ্বলে। ক্ষত্রিয় মহাকাব্যে স্বর্গের কল্পনা হল, ‘যেখানে শত্রুতা নেই’— স্বর্গোহয়ং নেহ বৈরানি ভবন্তি মানুষাধিপ।’ (১৮:১:১৮)
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রথম দিন দু’পক্ষ সসজ্জ ভাবে উপস্থিত, শঙ্খধ্বনি হলেই যুদ্ধ শুরু হবে; হঠাৎ যুধিষ্ঠির ছুটে গিয়ে একে একে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, শল্য সকলের পায়ে ধরে শান্তিভিক্ষা চাইলেন। বললেন, বন্ধ করুন এ ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ। প্রত্যেকে সে দিন তাঁকে একই উত্তর দিলেন: অর্থস্য পুরুষো দাসো দাসত্ত্বর্থো ন কস্যচিৎ/ইতি সত্যং মহারাজ বদ্ধোহস্ম্যর্থেন কৌরবেঃ/অতত্ত্বাং ক্লীববদ্ধাক্যং ব্রবীমি কুরুনন্দন/ভূতোহস্ম্যর্থেন কৌরব্য যুদ্ধাদন্যৎ কিমিচ্ছসি।।— ‘পুরুষ অর্থের দাস, অর্থ কারও দাস নয়; এইটিই সত্য; মহারাজ, অর্থের জন্যে বাঁধা পড়েছি কৌরবদের কাছে। তাই, যুধিষ্ঠির, ক্লীবের মতো এ কথা তোমাকে বলছি, অর্থে কৌরবরা আমাদের ভরণ করেছে, যুদ্ধ ছাড়া অন্য কিছু চাও তো বল।’ (৬:৪:৪১, ৪২) এঁরা প্রত্যেকেই শস্ত্রবিৎ, শাস্ত্রবিৎ, বিচক্ষণ ও শ্রদ্ধেয়, কিন্তু কোনও না কোনও স্বার্থে এঁরা আশ্রয় নিয়েছিলেন ধৃতরাষ্ট্রের সভায়। দ্রোণ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে, ভীষ্ম স্ববংশের টানে, কৃপ শিষ্যবাৎসল্যে— এবং পরে অন্যায় জেনেও আর কৌরবপক্ষ ত্যাগ করতে পারেননি। কাজেই দুস্তর নৈতিক সংকট যখন উপস্থিত তখন যুধিষ্ঠিরের অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত অনুরোধ রাখতে পারলেন না। ক্লীবের মতো বলতে বাধ্য হলেন, টাকায় বাঁধা পড়েছি, কৌরবরা ভরণ করেছে, আমরা তাদের অন্নদাস; এখন পরাজয়, মৃত্যু তাদের সঙ্গেই হবে আমাদের; সমস্ত অন্যায় জেনেও সেখান থেকে আর সরে আসতে পারব না। ক্ষুদ্র ঐহিক স্বার্থে একবার বিবেক বিসর্জন দিলে কি মর্মান্তিক গ্লানির মধ্যে তার মূল্য শোধ করতে হয় এর চেয়ে তার ভাল উদাহরণ আর চোখে পড়ে না। দুটি কর্তব্যের বিরোধ: এক দিকে অন্নঋণ ও আনুগত্য আর ন্যায়, ধর্ম, শান্তির চেষ্টা আর এক দিকে। কিন্তু পূর্বকৃত অপরাধ তাঁদের সৎপথে ফেরার পথ রুদ্ধ করেছে। জীবনের পুনর্মূল্যায়নে এঁদের জীবনে নৈতিক মূল্যবোধের ও সমস্যার কত বিবর্তনই দেখতে পাওয়া গেল।
শিখণ্ডির আড়াল থেকে বাণ নিক্ষেপ করছেন অর্জুন; তখন, শ্ময়মানস্তু গাঙ্গেয়স্তান্ বাণান্ জগৃহে তদা— উষ্ণার্তো হি নরো যদ্বজ্জলধারাঃ প্রতীচ্ছতি। তথা জগ্রাহ গাঙ্গেয়ঃ শরধারাঃ শিখণ্ডিনঃ।।— প্রচণ্ড গ্রীষ্মের দাবদাহের পরে যে দিন প্রথম বৃষ্টি নামে তখন মানুষ যেমন (ছুটে বাইরে গিয়ে) সারা দেহে সে-ধারাপাতের আরাম উপভোগ করে তেমনই করেই ভীষ্ম ঈষৎ হেসে সারা দেহ পেতে দিয়ে অর্জুনের শরধারা গ্রহণ করলেন।’ (৬:১১৭:২৩, ২৪) দেখতে পাচ্ছি, পলিতকেশ বৃদ্ধের কী মর্মান্তিক উপলব্ধি, জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে। পুত্রপৌত্রপ্রতিম যোদ্ধাদের হত্যা করতে হচ্ছে দিনের পর দিন; অথচ এ স্বজনঘাতী যুদ্ধ তো অনিবার্য ছিল না। সভাপর্বে বৃদ্ধ পিতামহ ক্লীবের মতো রাজকুলবধূ দ্রৌপদীর নির্মম লাঞ্ছনা দেখেছেন নিষ্প্রতিবাদ নীরবতায়, যুদ্ধের পূর্বক্ষণে যুধিষ্ঠিরের ঐকান্তিক মিনতি প্রত্যাখ্যান করেছেন ক্লীবের মতো দৈন্যে; তাই যেন ক্লীববৎ শিখণ্ডির আড়াল থেকে আজ মৃত্যুবাণ আসছে। জীবনের রৌদ্রদাহে তপ্ত ভীষ্ম আসন্ন মৃত্যুকে দেখছেন কাঙ্ক্ষিত দাহশান্তির মতো, পরমা মুক্তির মত। জীবনের যে সব অমীমাংসিত নৈতিক সংঘাতে তিনি পরাস্ত আজ মৃত্যু তার সমাধান আনছে। ইচ্ছামৃত্যুর বর সফল হতে চলল; মৃত্যু আজ তাঁর কাম্য, জীবনই দুর্বহ। ভীষ্মের জীবন যেন কুরুকুলের প্রতীক; নিঃশেষ হয়ে তবে সে জীবনের সব ঋণ শোধ করে দেবে।
যুধিষ্ঠির ধর্মপুত্র, তাঁর ধর্মবুদ্ধিকে সকলে আদর্শস্থানীয় মনে করেছে, অথচ অন্তরের দিকে কত বিধ্বস্ত এই মানুষটি। গীতায় শুনি, ‘ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিদ্দুর্গতিং তাত গচ্ছতি— ‘কল্যাণকারীর কখনও দুর্গতি হয় না।’(৬:৬:৪০) আপাত অর্থে এ কথা তো সত্য হতেই পারে না: কুন্তী, দ্রৌপদী, পঞ্চপাণ্ডব, গান্ধারী এঁরা সকলেই তো কল্যাণকারী, অথচ জীবনে এঁরা কী পেলেন? মনে হয়, মহাভারত দুর্গতির অন্য এক সংজ্ঞা মেনেছে; বলেছে, ‘আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ/আত্মৈব হ্যাত্মনঃ সাক্ষী কৃতস্যাপ্যকৃতস্য চ।।— মানুষের অন্তরাত্মাই তার বন্ধু, শত্রুও সে, তার কৃত ও অকৃত কাজের সাক্ষীও তার অন্তরাত্মা।’(১৩:৭:২৪) অর্থাৎ মানুষের শেষ জবাবদিহিটা তার নিজের কাছেই। এইখানে যে কল্যাণকারী তার দুর্গতি নেই। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি: ‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে/সে পায় তোমার হাতে/শান্তির অক্ষয় অধিকার।’ সমস্ত কল্যাণকারীই এই শান্তিতে অবিচল। শ্রেয় ও প্রেয়ের সংঘাতে যে মানুষ সমষ্টির স্বার্থের কাছে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থকে বলি দিতে পেরেছে বলে নির্মল বিবেকের অধিকারী, তার লাভ চূড়ান্ত ও অনিঃশেষ। ‘যং লব্ধা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ। যস্মিন্ স্থিত্বা ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে।।— যে বস্তু লাভ করে মানুষ অন্য কোনও লাভকে তার চেয়ে বড় মনে করে না, যাতে স্থিতিলাভ করে সে গুরুভার দুঃখেও বিচলিত হয় না।’ (৬:৬:২২)
মহাভারত যদি ধর্মের অন্বেষণ করে থাকে, যে ধর্ম মানুষকে ধারণ করে তার সুখেদুঃখে সর্বসঙ্কটে; সকল নৈতিক সংশয়ে, শ্রেয় ও প্রেয়ের সংঘাতে তার পথ আলোকিত করে ও তার আত্মাকে আশ্রয় দেয় তবে এই সে ধর্ম। বাকি সবই এ মহাকাব্যে বহিরঙ্গ। ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায় লোকানুকম্পয়ৈ মহতো জনকায়স্যার্থায়….’ ললিতবিস্তার-এ সত্যসন্ধানী বুদ্ধ ধর্মের এই মানদণ্ড স্থাপনা করেছেন, ‘বহুজনের মঙ্গলে, বহুজনের সুখে, লোকের প্রতি অনুকম্পায় সকল মানুষের কল্যাণে যা নিযুক্ত।’ এই ধর্মের জন্যে সংকীর্ণ স্বার্থকে যে ত্যাগ করতে পেরেছে সে বাইরে যতই বঞ্চিত হোক না কেন, ‘কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে/শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে/আপন ভাণ্ডারে।’
ধৃতরাষ্ট্র উৎকণ্ঠায় অস্থির হয়ে উঠেছেন যুদ্ধের পূর্বরাত্রে, ব্যাস তাঁকে দিব্যদৃষ্টির বর দিতে চাইলে তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন, বললেন, ‘ন রোচয়ে জ্ঞাতিবধং দ্রুষ্টুং ব্রহ্মর্ষিসত্তম— জ্ঞাতিবধ দেখার অভিরুচি আমার নেই।’ সে রাত্রে ঘুম আসছে না, সঞ্জয়কে বললেন, দিব্যদৃষ্টি পেয়েছ, সঞ্জয়, বল এই সপ্তদ্বীপা বসুমতীর কথা। জম্বুদ্বীপের প্রসঙ্গে একে একে বর্ষগুলির কথা উঠতে বললেন, ‘যদিদং ভারতং বর্ষং যত্রেদং মূর্ছিতং বলম্ /যত্রাতিমাত্ৰলুদ্ধোহয়ং পুত্রো দুর্যোধনো মম। যত্র লুদ্ধাঃ পাণ্ডুপুত্রাঃ— এই যে-ভারতবর্ষ যেখানে বাহুবল অস্ত্রবল নিজেকে প্রকাশ করেছে, যেখানে আমার পুত্র দুর্যোধন অতিমাত্র লুব্ধ। যেখানে পাণ্ডুপুত্ররাও লুব্ধ।’ এই পর্যন্ত শুনে মনে হয় ধৃতরাষ্ট্র এ বার ধিক্কার দেবেন এই দেশকে যেখানে বাহুবল, অস্ত্রবল এবং লোভের এত নির্লজ্জ প্রকাশ। কিন্তু তিনি কথা শেষ করলেন কী বলে? যত্র মে সজ্জতে মনঃ— যেখানে আমার মন আসক্ত।’ কী দুঃসাহসিক সত্যনিষ্ঠা! সমস্ত অন্যায় ও অমঙ্গল এখানেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তবু এই আমার দেশ, মন আমার এখানেই আসক্ত।
স্বর্গারোহণ পর্বে যুধিষ্ঠির কৌরব পাণ্ডব ভাইদের দেখতে চাইলে ইন্দ্র বিদ্রুপ করে বললেন, ‘কিং মানুষং স্নেহমদ্যপি পরিকর্ষসি’—পৃথিবীর মানুষের প্রতি মানুষের যে টান তাকে তুমি স্বর্গেও টেনে এনেছ?’ (১৮:৩:৩১) যুধিষ্ঠির বললেন, তারা যেখানে সেই আমার স্বর্গ, তাদের ছেড়ে এ স্বর্গে আমার বিন্দুমাত্র রুচি নেই। মহাপ্রস্থানের সময়ে ভক্ত সহচর কুকুরটিকে ছেড়ে আসবার প্রস্তাবে যুধিষ্ঠির বললেন, ‘সবাই জানে মৃতের সঙ্গে জীবিতের সন্ধিও নেই, বিগ্রহও নেই; এটি তো আমার জীবিত ভক্ত, একে ছাড়ব কেন?— ন বিদ্যতে সন্ধিরথাপি বিগ্রহো মৃতৈমর্ত্যৈরিতি লোকেষু নিষ্ঠা।’ (১৭:৩:১১) ‘তেমন শ্রীবৃদ্ধি যেন আমার ন হয় যার জন্যে অনুগতজনকে পরিত্যাগ করতে হয়— মা মে শ্রিয়া সংগমনমত্ত যস্যাঃ কৃতে ভক্তজনং ত্যজেয়ম্।’ (১৭:৩:৯) এ হল পৃথিবীর চোখে স্বর্গ দেখা, পৃথিবীর স্নেহমমতার বন্ধন এখানে চূড়ান্ত স্বীকৃতি পেয়ে জয়যুক্ত হয়েছে; এ হল প্রাণীর প্রতি প্রাণের টানের জয় ঘোষণা। এর ঊর্ধ্বে যুধিষ্ঠির উঠতে চাননি এবং দেবদূত বা ইন্দ্র শেষ পর্যন্ত তাঁর মানবিক আকর্ষণ ও আনুগত্যের মর্যাদা দিতে বাধ্য হলেন। মহাকাব্যের ভাষায় কুকুরটি সাক্ষাৎ ধর্ম। মানুষ যাকে আত্যন্তিক প্রয়োজনে জীবনের শেষ পর্যন্ত অবিচ্ছেদ্য ভাবে সঙ্গে রেখে গৌরবান্বিত করে এবং নিঃশেষ মূল্যে মর্যাদা দেয় তাই তো ধর্ম।
পরিশেষে মহাভারত-এর কয়েকটি রূপকের আলোচনা করব যেগুলি সবই প্রত্যক্ষ ভাবে রূবক না হলেও রূপক ব্যঞ্জনা বহন করে। প্রথমত দ্যুতসভা। বৈদিক যুগে রাজসূয় যজ্ঞের আগে ভাবী রাজাকে জুয়া খেলতে হত; এই আনুষ্ঠানিক কৃত্যটি মহাভারতে অন্য তাৎপর্য নিয়ে আসে। ক্ষত্রিয় যোদ্ধার কাছে সমস্ত জীবনটাই একটা বড় রকম জুয়াখেলা, জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর; পরিণত বয়সে আত্মীয়বন্ধু পরিবৃত শয্যায় দেহত্যাগ করা তার ভাগ্যে কমই ঘটত। তাকে সারা জীবন প্রাণপণ যুদ্ধ করতে হত, যা তার ন্যায্য প্রাপ্য তা অর্জন করতে, যা তার শক্তির আয়ত্ত তা জিতে নিতে এবং যার ভোগ্য তা রক্ষা করতে। এতে কখনও জয়, কখনও বা পরাজয় এবং মৃত্যু। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অন্তর্লীন ভাগ্য পরীক্ষা ও তার অনিশ্চিত ফলাফলের ছায়া দেখা যায় এই দ্যুতসভায়। এটি ঘটনাও বটে, প্রতীকও বটে।
মৌষলপর্বে এক গর্হিত কৌতুকের অপরাধে যদুবংশ ধ্বংস হল, লৌহ মুষলের আঘাতে। লক্ষণীয়, মুষল এখানে যেন স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্রের ভূমিকা নিয়েছে। এর পিছনে অবশ্যই গান্ধারীর অভিশাপ আছে, কিন্তু বর্ণনাটি প্রতীকী। যদুবংশীয়েরা উন্মত্তের মতো নিজেদের আত্মীয়বন্ধুদের নিজেরাই হত্যা করতে লাগল; অস্ত্র যেন এখানে অস্ত্রধারীর ভূমিকায়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধও তো ভ্রাতৃঘাতী, সেখানে কৃষ্ণের প্ররোচনায় পাণ্ডবরা ক্ষত্রিয়োচিত এবং বীরোচিত সমস্ত প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে কৌরব মহারথীদের হত্যা করেছিল। মনুষ্যত্ব সে দিন অবনমিত হয়েছিল। মৌষলপর্বে মারণাস্ত্র যেন প্রাণবন্ত হয়ে গান্ধারীর অভিশাপ সফল করল আর এক ভ্রাতৃঘাতী হত্যাকাণ্ডে; কৃষ্ণের বংশের বিনাশেই যেন কুরুক্ষেত্রের যথার্থ উপসংহার।
শান্তিপর্বে একটি কাহিনি আছে: সৃষ্টির পরে ব্রহ্মা যখন সৃষ্টিরক্ষা নিয়ে চিন্তিত তখন একটি নারী দেখা দিল। ব্রহ্মা তাকে সৃষ্টি ধ্বংস করতে বললে সে অশ্রুপাত করল। ব্রাহ্মা করপটে সে অশ্রু ধারণ করলেন, এগুলি ব্যাধি। নারীটি তপস্যায় গেল, ব্রহ্মা তাকে আবার সৃষ্টি ধ্বংসের ভার দিলেন। সে মৃত্যু ভিক্ষা চাইল: মানুষের রিপুই যেন তার ধ্বংসের কারণ হয়, ব্রহ্মা বললেন, তথাস্তু। (১২:২৪৮-২৫০ বঙ্গবাসী) এ-কাহিনি নিশ্চয়ই সব মৃত্যুর ব্যাখ্যা নয়, তবু এই রূপকের মধ্যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সর্বব্যাপী ধ্বংসের একটি রূপক সূত্র নিশ্চয়ই পাওয়া যায়।
তৃতীয় একটি রূপক অগ্নিদাহ; এটি তিনবার এসেছে। প্রথমে জতুগৃহ দাহে, সেখানে উদ্দিষ্ট দাহ্যব্যক্তি অর্থাৎ পাণ্ডবরা ও কুন্তী মুক্তি পেলেন, কিন্তু নিরপরাধ এক নিষাধ পরিবারের ছ’টি মানুষ কুন্তীর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসে প্রাণ হারাল। দ্বিতীয় অগ্নিকাণ্ড খাণ্ডবদহনে; সেখানেও কৃষ্ণ ও অর্জুনের উদ্যোগে বহু নিরপরাধ অরণ্যবাসী প্রাণী প্রাণ হারায়; বেঁচে থাকে তক্ষক, প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে। তৃতীয় অগ্নিদাহ আশ্রমবাসিক পর্বে; সেখানে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী ও সঞ্জয়ের মৃত্যু ঘটে দাবানলে। কিন্তু এ সবের অন্তরালে আর একটি বৃহত্তর অগ্নিকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়েছিল কুরুক্ষেত্রের রণভূমিতে, যেটির প্রতীক বাকি সব অগ্নিকাণ্ডগুলি। কুরুক্ষেত্রে কৌরবকুল ও পাণ্ডবকুল ক্রোধ, লোভ, ঈর্ষা, প্রতিহিংসা, মাৎসর্য ও দম্ভের অগ্নিতে আঠারো দিন ধরে জ্বলে নিঃশেষ-প্রায়। সেই দাবদাহের অন্যতম মুখ্য কর্তা ধৃতরাষ্ট্র, আশ্রমে দাবানলে তাঁর মৃত্যু হল। নিরপরাধ গান্ধারী ও সঞ্জয়ও দগ্ধ হলেন কারণ জীবন তো এমনই, সে কৃপা করে না কৃপাপাত্রকে। আর কুন্তী? নিজের সন্তানদের বাঁচাতে তিনি জতুগৃহে বলি দিয়েছিলেন নিষাদী ও তার সন্তানদের; অগ্নিদাহে মৃত্যু তো তাঁর পাওনাই ছিল জীবনের কাছে। সমস্ত যুদ্ধ বর্ণনার প্রধানত উপমান হল অগ্নি— তার তেজ, দাহিকাশক্তি, শিখা, স্ফুলিঙ্গ, ধূম, দীপ্তি ও প্রলয়ঙ্কর রূপ। এ সব কি শুধু অস্ত্রের ও বীরত্বের উপমান? মনে হয় না; বরং মনে হয়, একটা আগুন সারা মহাকাব্য জুড়েই জ্বলেছে, কখনও প্রতীকে প্রচ্ছন্ন ভাবে তুষাগ্নির মতো, কখনও প্রকাশ্যে দাবাগ্নির মতো। এবং পরস্পরবিরোধী স্বার্থের সংঘাতে লোভের, ক্রোধের ইন্ধনে জ্বলে-ওঠা এই আগুনের দুঃসহ জ্বালার ভেতরে জ্বলে জ্বলে জীবনের শ্যামিকা বা খাদ পুড়ে সৃষ্টি করেছে এই অনুপম স্বর্ণসমুজ্জ্বল জীবনবোধের। বিরুদ্ধে আগেবের যুগপৎ সমাবেশ ও অন্তর্নিহিত আততিই (tension) সৃষ্টি করে মহৎ কাব্যকে। আদর্শ ও বাস্তবের সংঘাত, চরিত্র ও ভাগ্যের সংঘর্ষ, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান, যোগ্যতা ও সার্থকতার পার্থক্য— এই সবের মধ্যে নিহিত সেই আততি যা সৃষ্টি করেছে: এ মহাকাব্যের অন্তর্গুঢ় চাপ ও তাপ, যার থেকে উৎসারিত এর মহত্ত্ব ও ভাবতত্ত্ব।
স্ত্রীপর্বে একটি রূপক পাই। যুদ্ধের শেষে যুধিষ্ঠির যখন অন্তরে বাহিরে সর্বস্বান্ত বোধ করছেন ও বেঁচে থাকার কোনও সার্থকতা খুঁজে পাচ্ছেন না, তখন বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন:
‘এক গভীর অরণ্যে একটি কূপ আছে, এক ব্রাহ্মণ সেই তৃণাচ্ছন্ন কূপটি না দেখতে পেয়ে তার মধ্যে পড়ে গেল। পড়বার সময়ে কুয়োপাড়ের একটি লতাকে ধরে লম্বিল হয়ে রইল, পা ঊর্ধ্বে, মাথা নীচে। কুয়োর পাড়ে একটি প্রকাণ্ড মহাগজ ধীরে ধীরে সে দিকে এগোচ্ছে। এ দিকে যে লতাটিকে অবলম্বন করে লোকটি ঝুলে আছে ইঁদুরে তার গোড়া কাটছে, অর্থাৎ যে-কোনও মুহূর্তে লতাটি উন্মুলিত হবে এবং তখনই লোকটির অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু, কারণ কুয়োর নীচে এক মহাসর্প। …ওপরে লতার পুষ্পিত শাখায় মৌচাক, মৌমাছির ঝাঁক আনাগোনা করছে। এই বিপৎসঙ্কুল অবস্থায় লোকটি নিরুপায় ভাবে লম্বিত আছে… শুধু মধ্যে মধ্যে ওপরের মৌচাক থেকে বিন্দু বিন্দু মধু তার মুখে ঝরে পড়ছে। তাতে তার তৃষ্ণা মিটছে না, বরং বেড়েই চলেছে।’
বিদুর উপসংহারে বললেন, এই হল জীবন, মহারাজ।
মনে রাখতে হবে মূল মহাভারতের আদি সংস্করণ স্ত্রীপর্বেই শেষ হয়েছিল। জীবনে বিতৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে উপলক্ষ্য করে জীবন সম্বন্ধে চিরন্তন তাৎপর্যপূর্ণ এই প্রলম্বিত রূপকটি তাই মূল মহাভারতের অন্তভাগেই স্থান পেয়েছে। রোগব্যাধি, জরা, নানা রিপুর আনাগোনা, নিরন্তর প্রাণসংশয়, আসন্ন অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু, এ সবের মধ্যে জীবন মানুষকে কী দিয়ে মুগ্ধ করে রাখে? ওই মধু। প্রত্যেক জীবনেই কোনও না কোনও উৎস থেকে বিন্দু বিন্দু মধু এসে পড়ছে, তাই এই সর্বতো ভাবে বিপন্ন ও অনিশ্চিত জীবনেও এত আসক্তি মানুষের।
যে দেশ জীবনকে মায়া বলেছে এ তো তার বাণী নয়; ওই মধুটুক তো সম্পূর্ণ সত্যই। তা না হলে অবশ্যম্ভাবী বিনাশের কালো পর্দাটার সামনে দাঁড়িয়ে জীবনের এই জয়গান আসে কোথা থেকে?— মহাভারত-এ মানুষ যে বলছে: ‘জীবন আমাকে কিছু দেবে বলে নয়, আমার শ্রেষ্ঠ সত্তা থেকে আমি জীবনকে কিছু দেওয়ার স্পর্ধা রাখি, এ স্পর্ধা আমার সমস্ত মানুষের হয়ে।’ একমাত্র মানুষই সমস্ত মানুষের ঊর্ধ্বে উঠে জীবনকে মহিমান্বিত করতে পারে। গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়কের মতো বাইরে তার অবধারিত পরাজয় থাকলেও চরম বিজয়ের উৎস তার অন্তরাত্মার মধ্যেই নিহিত; সেখানে সে নিত্যবিজয়ী।
সব মহাকাব্যেই জীবনজিজ্ঞাসা কোনও না কোনও রূপে প্রতিফলিত, যদিও সব মহাকাব্যে তার ব্যাপ্তি বা গভীরতার পরিমাণ এক নয়। আদি মহাকাব্য গিলগামেশ থেকেই দেখি এই জীবন জিজ্ঞাসাই মহাকবির মুখ্য প্রেরণা। কিন্তু মহাভারত-এ যে জিজ্ঞাসা, জীবনের মূল্যবোধের অন্বেষণা এবং চরিত্র, ঘটনা ও উপলব্ধির মধ্যে সে বোধের যে পুনর্মূল্যায়ন, তার প্রসার ও গভীরতা অন্য কোনও মহাকাব্যেই নেই। বোধহয় এ কথা বললেও খুব অত্যুক্তি হবে না যে, বাকি সবকটি মহাকাব্য মিলে মানবিক মূল্যবোধের যে মাননির্ণয়ের চেষ্টা, এক মহাভারত-তেই তা পূর্ণ ভাবে বিকশিত। সুপ্রচুর অবান্তর প্রসঙ্গ থাকা সত্ত্বেও যেখানে মূল মহাকাব্যের জীবনজিজ্ঞাসা প্রতিবিম্বিত, সেখানে তা জীবনবিমুখ নয়, জীবনমুখীন। মহাভারত-এ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত দার্শনিকতা, বৈরাগ্য, ত্যাগের, অনাসক্তির প্রচুর উপদেশ, বিশেষত ব্রাহ্মণ্য সংযোজনের জীবন সম্বন্ধে অনীহার একটা বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। কিন্তু এ সব ছাপিয়ে তো একটি অপরিম্লান ছবি থেকে যায়: চতুর্দিকে বিপৎসঙ্কুল কূপের মধ্যে আলম্বিত ওই মানুষটি, যার মুখে বিন্দু বিন্দু মধু ঝরে পড়ছে বলেই যে জীবনের সব বঞ্চনা, সব দুঃসহ দুঃখ-বিপদ-গ্লানি সইতে পারছে।
মহাভারত বলেছে, ‘গুহ্যং ব্রহ্ম যদিদং তে ব্রবীষ্মি ন মানুষাচ্ছ্রেষ্ঠতরম হি কিঞ্চিৎ— গোপন একটি তত্ত্ব তোমাকে বলি: মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর আর কিছুই নেই।’ (১২:২৮৮:২০) মহাভারত-এর বিরাট অংশ জুড়ে মায়াবাদ ও বৈরাগ্যের এত যে রাশি রাশি শুকনো পাতা সবই উড়ে গেল উপলব্ধির এক প্রবল ঝড়ে। রয়ে গেল শাশ্বত মানুষ— তার দৈন্য, কুশ্রীতা, অপূর্ণতা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, আদর্শ, তার সাধ-স্বপ্ন-বেদনার মর্মান্তিক টানাপোড়েন নিয়ে। তাহলে দেবতা? রবীন্দ্রনাথের বোধে ‘নিদারুণ দুঃখরাতে/মৃত্যুঘাতে/মানুষ চূর্ণিল যবে নিজ মর্তসীমা/তখনও দিবে না দেখা দেবতার অমর মহিমা?’ নিদারুণ দুঃখ সংশয়ের সংঘাতের মধ্যে, নিষ্ঠুর বঞ্চনা ও ব্যর্থতার মধ্যে আপন আন্তর তেজে এসব কিছুকেই জয় করে মানুষ তার মর্ত্যসীমা লঙ্ঘন করে দেবতা হয়ে উঠেছে। বহু চরিত্রে, বহুতর ঘটনার বিন্যাসে এ সত্য প্রতিপাদন করেছে মহাভারত; তাই মহাকাব্যের বিচারে এর স্থান পৃথিবীর সমস্ত মহাকাব্যের শীর্ষস্থানে। প্রথম অধ্যায়েই এ মহাকাব্যের পরিচয়: ‘ভারতস্য বপুতেৎ সত্যঞ্চামৃতমেব চ— মহাভারত হল ভারতের কলেবর, সত্য ও অমৃত।’ (১:১:২০১)