সতের তারিখ মন্টুর ফাঁসির হুকুম হল। ঠাণ্ডা মাথায় খুন, অনেক আই উইটনেস। কলেজে পড়া বিবেক-বুদ্ধির ছেলে। জজ সাহেব অবলীলায় হুকুম করলেন।
সেপ্টেম্বরের নয় তারিখ মাসি-পিটিশন অগ্ৰাহ্য হল। আমি জানলাম আঠার তারিখ ভোর-রাতে তার ফাঁসি হবে। তার লাশ নিতে হলে সেই সময় জেলগেটের সামনে জেলারের চিঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
বাবা, মা আর রুনুকে নিয়ে মন্টুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।
রোগা হয়ে গিয়েছে মন্টু। আমাদের দেখে অপ্রকৃতস্থের মতো হাসল। বলল, দাদা, মার্সি-পিটিশনটার কোনো জবাব এসেছে?
ওকে বুঝি সে-কথা জানান হয় নি? ভালোই হয়েছে। আমি বললাম, না রে, এখনো আসে নি।
মা, রুনু আর বাবা কাঁদছিলেন। মন্টু বলল, কাঁদেন কেন আপনারা? আমি জানি আমার ফাঁসি হবে না। কাল রাতে মাকে স্বপ্নে দেখেছি। মা বলছেন, খোকা ভয় পাস কেন? তোর ফাঁসি হবে না।
আমি বললাম, মন্টু, তোর কাছে একটি মেয়ে এসেছিল রোগী লম্বা মতো।
মন্টু বলল, ও ইয়াসমিন, আমার সঙ্গে পড়ে।
সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। মন্টু নীরবতা ভঙ্গ করে রুনুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, রুনু মিয়া মরতে ইচ্ছে হয় না।
বাবা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, তোকে কী খেতে দেয় রে?
ভালোই দেয় বাবা। আগে আজেবাজে দিত। কদিন ধরে রোজ জানতে চায়–আজি কী দিয়ে খেতে চান? এ জেলের জেলার খুব ভালো মানুষ বাবা, আমাকে শিবরামের একটা বই পাঠিয়েছেন, যা হাসির!
মা বললেন, মন্টু, বাসার কোনো জিনিস খেতে ইচ্ছে হয় তোর?
না মা, এখানে এরা বেশ রাঁধে।
সেপাই এসে বলল, অনেকক্ষণ হয়েছে তো, আরো কথা বলবেন?
বাবা বললেন, না। বাবা মন্টুর হাতে চুমু খেলেন কয়েক বার। মন্টু কাশল বার কয়। সে মনে হল একটু লজ্জা পাচ্ছে। বের হয়ে আসছি, হঠাৎ মন্টু ডাকল, দাদা, তুমি একটু থাক।
আমি ফিরে এসে মন্টুর হাত ধরলাম। মন্টু কিছু বলল না। আমি বললাম, কিছু বলবি?
না।
ইয়াসমিনের কথা কিছু বলবি?
না-না।
তবে?
মন্টু অল্প হাসল। বলল, তোমাদের আমি বড়ো ভালোবাসি দাদা।
গাছের নিচে ঘন অন্ধকার। কী গাছ এটা? বেশ ঝাঁকড়া। অসংখ্য পাখি বাসা বেঁধেছে। তাদের সাড়াশব্দ পাচ্ছি। পেছনের বিস্তীর্ণ মাঠে স্নান জ্যোৎস্নার আলো। কিছুক্ষণের ভিতরই চাঁদ ড়ুবে যাবে। জেলখানার সেন্ট্রি দু জন সিগারেট খাচ্ছে। দুটি আগুনের ফুলকি ওঠানামা করছে দেখতে পাচ্ছি। তাদের ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। দূর থেকে ছায়া-ছায়া মূর্তি মনে হয়। জেলখানার মাথার গেটের ঠিক উপরে এক শ পাওয়ারের বাতি জ্বলছে একটা। বাতির চারপাশে অনেক পোকা ভিড় করেছে। বাবা বললেন, খোকা, কটা বাজে? বলতে বলতে বাবা বুকে হাত রাখলেন। তাঁর বুক-পকেটে জেলারের চিঠি রয়েছে। সেটি দেখালেই তারা মন্টুকে আমাদের হাতে তুলে দেবেন। মন্টুকে আমরা ঘরে ফিরিয়ে নেব। ঘরে, যেখানে মা আজ সারারাত ধরে কোরান শরীফ পড়ছেন।
বাইরে স্নান জ্যোৎস্না হয়েছে। কিছুক্ষণের ভিতরে চাঁদ ড়ুবে যাবে। আমি আর বাবা ঘোষাঘেষি করে বসে আছি সিমেন্টের ঠাণ্ডা বেঞ্চিতে। মাথার উপর ঝাঁকড়া অন্ধকার গাছ। বাবা নড়েচড়ে বসলেন। তাঁর দ্রুত শ্বাস নেওয়ার শব্দ পাচ্ছি। তিনি একটু আগেই জানতে চাচ্ছিলেন কটা বাজে।
আমরা সবাই মাঝে মাঝে এমনি ঠাণ্ডা মেঝেতে বসে বাইরের জ্যোৎস্না দেখতাম। হামুহেনা গাছে কী ফুলই না ফুটিতা! আমাদের বাসার সামনে মাঠে একটা কাঁঠালগাছ আছে। সেখানে অসংখ্য জোনাকি জ্বলিত আর নিভত। জোনাকি ঝিকিমিকি জ্বালো আলো গান বাজিয়েছিলেন নাহার ভাবী।
আমাদের পলার নাকটা ছিল সিমেন্টের মেঝের মতোই ঠাণ্ডা। মন্টু বলেছিল, দাদা, কুকুরের নাক এত ঠাণ্ডা কেন?
মাস্টার কাকা বাইরে পসে বসে আকাশের তারা দেখতেন। বলতেন, খোকা, আমি তারা দেখে সময় বলতে পারি।
রাবেয়া এক দিন রাগ হয়ে বলেছিল মা আমি সবার বড়ো, কিন্তু কেউ ঈদের দিন আমাকে সালাম করে না।
আমি আচ্ছন্নের মতো তাকিয়ে আছি। আমার শীত করছে। বাবা ভারি গলায় ডাকলেন, খোকা, খোকা।
কি বাবা?
কটো বাজে রে? আমি বাবার হাত ধরলাম। কী শীতল হাত। বাবা থরথর করে কাঁপছেন। আমাদের মাথার উপরের ঝাঁকড়া গাছ থেকে আচমকা অসংখ্য কাক কা-কা ডেকে জেলখানার উপর দিয়ে উড়ে গেল।
ভোর হয়ে আসছে। দেখলাম চাঁদ ড়ুবে গেছে। কিন্তীৰ্ণ মাঠের উপরে চাদরের মতো পড়ে থাকা ম্লান জ্যোৎস্নাটা আর নেই।
মন্টুর ফাঁসিটা কেনো যেন মেনে নিতে পারছি না। অনেক দুঃখজনক ফিনিশিং , হুমায়ুন আহমেদের অপরাপর উপন্যাসগুলোর মতোই।