০৬. মতির জ্বর পুরোপুরি সারেনি

মতির জ্বর পুরোপুরি সারেনি। এম্নিতে ভাল, একটু হাঁটাহাঁটি করলেই মাথা ঘুরতে থাকে, গা গরম মনে হয়। সবচে বড় সমস্যা হল গলা বসে গেছে। গলা দিয়ে হাসের মত ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ বের হচ্ছে। ইরতাজুদ্দিন সাহেবের নাতনীকে গান শুনাবার কথা ছিল। গলা না সারলে কিছু করার নেই। পরাণ ঢুলীর ঢোলটা আগেভাগে শুনিয়ে দেয়া যায়। শুধু ঢোল ভাল লাগবে না, ঢোলের সঙ্গে সঙ্গত করার কোন কিছু নেই। বেহালা সে বাজাতে পারে। পরাণের সঙ্গে বাজানো সম্ভব না–তার হচ্ছে জোড়াতালির ব্যাপার। নিদালাইশের আবদুল করিমকে নিয়ে এলে সব সমস্যার সমাধান হয়। জ্বর-শরীরে যাবে কি ভাবে? তাও না হয় গেল–আবদুল করিমের টাকাপয়সার খুব খাই। আগে টাকা তারপর কথা। মাগনার কারবার নাই। অনুরোধ উপরোধ যাই করা হোক–আবদুল করিম বলবে–

মাগনার কাম জলে যায়
পুটি মাছে গিল্যা খায়।

মাফ কইরা দিয়েন। বেহালার তার ছিঁড়া, জোড়া দেওনের ব্যবস্থা নাই।

একশ টাকার একটা নোট হাতে ধরিয়ে দিলে অবশ্যি ছেঁড়া তার সাথে সাথে জোড়া লেগে যায়। সেই টাকা জোগাড় করাই সমস্যা। কোথায় সে পাবে একশ টাকা?

তার নিজের হাত একেবারে খালি। ইরতাজুদ্দিন সাহেব তাঁর নাতনীকে নিয়ে আসার জন্যে তাকে খরচা বাবদ পঞ্চাশটা টাকা পাঠিয়েছেন। সম্বল বলতে এই। টাকাটা নিতে মতির খুবই লজ্জা লেগেছে। না নিয়েও পারেনি। গান বাজনা বাবদ সে তো আর আগেভাগে টাকা চাইতে পারে না।

মতি নিন্দালাইশে যাওয়াই ঠিক করল। আবদুল করিমের দুপা জড়িয়ে ধরলে। যদি কিছু হয়। সম্ভাবনা নেই বললেই হয়, তারপরেও… কিছুই তো বলা যায় না। জগৎ চলে আল্লাহপাকের ইশারায়। আল্লাহপাক যদি ইশারা দিয়ে দেন আবদুল করিম চলে আসবে। তার গানের দলেও যোগ দিতে পারে। আবদুল করিমকে পাওয়া গেলে শক্ত একটা দল হয়।

উঠানে ঝাঁট দেয়ার শব্দ। কে ঝাঁট দেয়? মতি চাদর গায়ে বইরে এসে দেখে কুসুম। গাছ কাপড়ে শাড়ি পরে প্রবল বেগে উঠান ঝাঁট দিচ্ছে। মতি বিস্মিত হয়ে বলল, কর কি?

কুসুম বলল, কি করি দেখেন না? চউখ নাই–কানা?

বলেই কুসুমের মন খারাপ হয়ে গেল। কি বিশ্রি করেই না সে কথাগুলি বলল! অথচ আজ সে প্রতিজ্ঞা করে এসেছে, যেভাবেই হোক একটা কাজ সে আজই করবে। সারা পৃথিবীর মানুষ তাকে বেহায়া বললেও করবে। তার গায়ে থুথু দিলেও করবে। কাজটা হচ্ছে–সে মতির কাছে গিয়ে বলবে–এই যে অধিকারী সাব! আফনে গানের দল করছেন। দল নিয়া দেশে-বৈদেশে ঘুরবেন। আমি ঠিক করছি, আমিও আফনের দলের লগে যামু। দেশ-বৈদেশ ঘুরমু। আফনেরার রান্ধনেরও তো লোক দরকার। দরকার না?

খুবই মোটা ইংগিত। এই ইংগিত যে বুঝতে পারবে না সে মানুষ না–খাটাশ। মতি বোধহয় পারবে না। জগতে অনেক বুদ্ধিমান মানুষ আছে যারা প্রয়োজনের সময় খাটাশের মত হয়ে যায়। সে নিজে যেমন হয়েছে। কি কথা বলতে এসে কি বলছে।

মতি বলল, উঠান ঝাট দেওনের দরকার নাই কুসুম।

দরকার নাই ক্যান? বাড়ি পতিত ফেলাইবেন?

মতি কিছু বলল না। অকারণে খানিকক্ষণ কাশল।

কুসুম বলল, জ্বর কমছে?

হ্যাঁ।

জ্বর কমছে তয় খেতা শইল্যে দিয়া আছেন ক্যান?

মতি জবাব দিল না। কুসুম বলল, কথা কন না ক্যান? জ্বরে জিবরা মোটা হয় গেছে? না কথা বলা বিস্মরণ হইছেন?

তুমি রাগারাগি করতেছ কেন কুসুম? মিষ্টি গলায় কথা বলা তুমি জান না?

আফনের সঙ্গে আমি মিষ্টি গলায় কথা বলব ক্যান? আফনে আমার কে? আফশে কি আমার পারতের লোক?

মতির মন খারাপ হয়ে গেল। এই মেয়েটা অকারণে তার সঙ্গে ঝগড়া করে। এত সুন্দর একটা মেয়ে, অথচ কি বিশ্রি স্বভাব! শ্বশুরবাড়িতে মেয়েটা খুব কষ্টে পড়বে।

জ্বর হইছে, ভিতরে গিয়া শুইয়া থাকেন। হা কইরা খাড়াইয়া আছেন ক্যান?

মতি ঘরে ঢুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কুসুমের চোখে পানি এসে গেল। এটা সে কি করেছে? সে হাতের ঝাঁটা ফেলে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এখন সে কি করবে? চোখের পানি মুছে মতির ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে সে কি বলবে–মতি ভাই, আফনেরে খুব একটা শরমের কথা বলতে আসছি। কথাটা হইল…

না, কথাটা আজ বলা যাবে না। কথাটা বলতে গেলেই সে কেঁদে-কেটে একটা কাণ্ড করবে। সে সবাইকে তার চোখের পানি দেখাতে রাজি আছে, শুধু একজনকে না। মতি আবার বের হয়ে এসেছে। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। মতি বলল, কি হইছে কুসুম?

কই কি হইছে?

কানতেছ কেন?

আমার পেটে হঠাৎ হঠাৎ একটা বেদনা হয়। তখন কান্দি।

কও কি? অসুখ হইছে, চিকিৎসা করবা না?

কুসুম চোখ মুছতে মুছতে বলল, গরীবের এক অসুখ, তার আবার এক চিকিৎসা। গরীবের চিকিৎসা হইল কাফনের কাপড় দিয়া শইল ঢাকা।

অসুখের কোন গরীব-ধনী নাই কুসুম। অসুখ সবের জন্যেই সমান। চান্দের। আলো যেমন গরীব-ধনী সবের জন্যেই এক, অসুখ-বিসুখও…

চুপ করেন মতি ভাই। জ্ঞানের কথা কইয়েন না। চান্দের আলো আর পেটের বেদনা দুইটা এক হইল?

মতি উৎসাহের সঙ্গে বলল, আসল কথা এইটা না কুসুম। আসল কথা হইল–কিছু কিছু সময় আছে যখন গরীব-ধনী এক হইয়া যায়–যেমন ধর, তুমি আর ইরতাজুদ্দিন সাহেবের বড় নাতনী। তোমরার দুইজনেরই হইল কলেরা। তখন কিন্তু দুইজনেই এক হইয়া গেলা।

না, এক হব কেমনে? উনার চিকিৎসা হবে। দুনিয়ার বেবাক ডাক্তার ছুইটা আসবে। অষুধ, পথ্য, সেবা। আর আমারে ফালাইয়া থুইবে উঠানে।

তোমার এই পেটের বেদনা কি অনেক দিন ধইরা চলতেছে?

হাঁ।

খুব বেশি?

মাঝে মাঝে খুব বেশি। তখন ইচ্ছা করে কেরোসিন কিন্যা শাড়িত ঢাইল্যা আগুন দিয়া দি। তখন ঘরে কেরোসিন থাকে না বইল্যা আগুন দিতে পারি না। মাঝে মইধ্যে পানিতে ঝাঁপ দিয়া পড়তে ইচ্ছা করে। পানিতে ঝাঁপ দেই না–পানিতে ঝাঁপ দিলে মরণ হইব না–সাঁতার জানি।

মতি বলল, ইরতাজুদ্দিন সাবের বড় নাতনী যে আছে–ইনারে তুমি একবার দেখাও। খুবই বড় ডাক্তার। ইরতাজুদ্দিন সাব বলছেন উনি ডাক্তারি স্কুল থাইক্যা সোনার একটা মেডেল পাইছে।

কথায় কথায় ইরতাজুদ্দিন সাবের নাতনী, ইরতাজুদ্দিন সাবের নাতনী বলতেছেন ক্যান? মেয়েটা খুব সুন্দর?

মতি উৎসাহের সঙ্গে বলল, খুবই সুন্দর। চেহারা যেমন সুন্দর ব্যবহারও সুন্দর। অতি মধুর ব্যবহার। অত বড়ঘরের মেয়ে ব্যবহারে বুঝনের কোন উপায় নাই। মনে হইব নিজেরার মানুষ। আমার কথা বিশ্বাস না হইলে একদিন নিজে গিয়া আলাপ কর–দেখবা কত খাঁটি কথা বলছি।

কুসুম তাকিয়ে আছে। গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে সে মতির উত্তেজনা দেখছে।

বুঝলা কুসুম–ইনারে গান শুনাইতে হবে। গানের একটা আসর করব। ভাবতেছি নিন্দালাইশের আবদুল করিম ভাইরে খবর দিয়া আনব। আমি, করিম ভাই, আমরার পরাণ কাকা–আরেকবার যদি পাইতাম ব্যাঞ্জো বাজানীর কেউ…

ব্যাঞ্জো বাজানীর লোক নাই?

উহুঁ।

তাইলে তো আফনের বেজায় বিপদ।

করিম ভাই আইলে অবশ্য বিপদ কাটা যায়। একশ টেকার কমে উনি আসব। আমার কাছে আছে মোটে পঞ্চাশ…

উনার কাছে গিয়া চান।

কার কাছে চাব? ইরতাজুদ্দিন সাবের নাতনীর কাছে? ছিঃ ছিঃ! কি বল তুমি!

কুসুম বলল–অখন যাই। বেলা হইছে। মতি বলল, আমি কি উনারে বলব তোমার চিকিৎসার কথা?

কুসুম কঠিন গলায় বলল, আগবাড়াইয়া মাতাব্বরি কইরেন না। আফনের কিছু বলনের দরকার নাই।

হঠাৎ রাইগা গেলা কেন?

কুসুম জবাব দিচ্ছে না–হন হন করে এগুচ্ছে। মতি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে।

 

মনোয়ারা তাঁর বাড়ির উঠোনের জলচৌকিতে বিষন্ন ভঙ্গিতে বসে আছেন। তার শরীর এবং মন দুটাই খুব খারাপ। শরীর দীর্ঘদিন থেকেই খারাপ, এটা এখন আর। ধর্তব্যের মধ্যে না। মন খারাপটাই এখন প্রধান। মুম খারাপের কারণ–কুসুমের। বাবার কোন খোঁজ-খরব পাওয়া যাচ্ছে না। এক মাসের উপর হয়ে গেল। এর মধ্যে কোন সংবাদ নেই, চিঠিপত্র নেই। নৌকা নিয়ে এর আগেও সে বের হয়েছে। একবার তো তিনমাস পার করে ফিরেছে। কিন্তু খর পাঠিয়েছে। টাকাপয়সা পাঠিয়েছে। এবার কোন সাড়াশব্দই নেই।

রোজ রাতে শোবার সময় মনোয়ারার মনে হয়–মাঝরাতে দরজায় ধাক্কা দিয়ে কুসুমের বাবা বলবে–বৌ, উঠ দেখি। দরজা খুলে দেখা যাবে জিনিশপত্র নিয়ে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। এই এক স্বভাব মানুষটার। খালি হাতে কখনো আসবে না। টাকাপয়সা যা কামাবে, বলতে গেলে তার সবই খরচ করে আসবে। হাতের চুড়ি, আলতা, গন্ধ তেল, সাবান। এই সব জিনিশের চেয়ে নগদ টাকা অনেক বেশি দরকার। লোকটা তা বুঝে না। মনোয়ারাও কিছু বলেন না। শখ করে এনেছে, আনুক। রোজগারী মানুষের শখের একটা দাম আছে না? তাছাড়া মেয়ে দুটি জিনিশ পেয়ে বড় খুশি হয়। কুসুম এত বড় ধামড়ি এক মেয়ে, সেও আলতা-সাবান চিরুনী হাতে নিয়ে লাফ ঝুঁফ দিতে থাকে। মনোয়ারা ধমক দেন–ঐ কুসুম, করস কি তুই? বাপের সামনে বেহায়ার মত লাফ দিতাছস। মোবারক তখন মৃদু গলায় বলে–সব জিনিস দেখন নাই বৌ। দুই-একটা লাফ দিলে কিছু হয় না। মনোয়ারার ধারণা, কুসুমের বাবা মেয়ে দুটির লাফালাফি ঝাপাঝাপি দেখার জন্যেই আজেবাজে জিনিশ কিনে পয়সা নষ্ট করে।

মনোয়ারার পিঠে রোদ এসে পড়েছে। রোদে গা জ্বলছে, কিন্তু জলচৌকি ছেড়ে উঠতে পর্যন্ত ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে তার গায়ে উঠে দাঁড়াবার শক্তিটাও এখন আর নেই। মানুষটা কোন খবর পর্যন্ত দেবে না–এটা কেমন কথা? তিনি কুসুমকে পাঠিয়েছিলেন সেলিম বেপারীর কাছে। সে দেশে-বিদেশে ঘুরে–কুসুমের বাবার কোন খবর যদি পায়! কুসুম এখনো ফিরছে না। মনোয়ারার মন বলছে, কুসুম কোন একটা ভাল খবর নিয়ে আসবে। তিনি ঠিক করলেন, কুসুম না ফেরা পর্যন্ত তিনি রোদ থেকে উঠবেন না।

কুসুম ফিরেছে। মনোয়ারা অবাক হয়ে দেখলেন কুসুমের হাতে একটা ঝাটা। সে কি ঝটা হাতে বেপারীর বাড়ি গিয়েছিল? তার কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল, মনোয়ারা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কুসুম, তুই বেপারী বাড়ি যাস নাই?

না।

কই গেছিলি?

মতি ভাইরে দেখতে গেছিলাম।

কি জন্যে?

জ্বরে মানুষটা মইরা যাইতেছে, একটা চউখের দেখা দেখব না? এটা তুমি কেমন কথা কও মা?

তোর বাপের যে কোন খোঁজ নাই এইটা নিয়া তোর কোন মাথাব্যথা নাই। তুই কেমন মেয়ে রে কুসুম?

খারাপ মেয়ে।

মতিরে দেখতে গেলি ঝাড়ু হাতে?

হুঁ। উল্টা-পাল্টা কিছু কইলে ঝাড়ু দিয়া মাইর দিমু–এই ভাইব্যা ঝাড়ু নিয়া গেছি।

মনোয়ারা চুপ করে গেলেন। মেয়ের লক্ষণ ভাল বোধ হচ্ছে না। জ্বীনের আছর হচ্ছে কিনা কে জানে। মানোয়ারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, কুসুম আবার বেরুচ্ছে। মনোয়ার গলার স্বর কোমল করে বললেন, কই যাস কুসুম?

বেপারী বাড়িত যাই। বাপজানের খোঁজ লইয়া আসি।

থাউক, বাদ দে।

কুসুম থামল না, হন হন করে বের হয়ে গেল। সে ঠিক করেছে বেপারী বাড়ি সে যাবে ঠিকই তবে যাবার আগে মতি ভাইয়ের বাড়ি হয়ে যাবে। হাসিমুখে দুটা কথা বলে যাবে।

কুসুম মতিকে পেল না। মতি জ্বর গায়েই নিন্দালিশ চলে গেছে। আবদুল করিমের সঙ্গে কথা বলবে। তার মন বলছে আবদুল করিম বায়না ছাড়াই আসতে রাজি হবে।

 

আবদুল করিম খুব মন দিয়ে মতির কথা শুনল। মাঝখানে একবার শুধু বলল, আপনের গলাত কি হইছে, শব্দ বাইর হয় না? মতি বলেছে, ঠাণ্ডা।

ও আচ্ছা, বলেন কি বলতেছেন।

মতি যথাসম্ভব গুছিয়ে তার বক্তব্য বলল। গানের আসর সে করছে। ঢাকা শহরের বিশিষ্ট কিছু মানুষ গান শুনবে। সে যে গানের দল করেছে তার নাম ফাটবে। এই দলে আবদুল করিমের মত প্রতিভ না থাকলে কিভাবে হয়?

আবদুল করিম বলল, গানের দলের কথা বাদ দেন। আসর হইতেছে তাঁর বিষয়ে বলেন। বায়না কত?

বায়না-টায়না নাই। খুশি হইয়া তারা যা দিব সবই আফনের। কথা দিলাম।

তারা খুশি হইব এইটা বলছে কে?

ভাল জিনিশে খুশি হয় না এমন মানুষ খোদার আলমে আছে?

গান-বাজনা ভাল জিনিশ আফনেরে বলছে কেংগেনবাজনা হইল শয়তানী বিদ্যা।

আইচ্ছা, সেটা যাই হোক–আফনের যাওন লাগব।

আবদুল করিম উদাস গলায় বলল, মতি মিয়া–

মাগনার কাম জলে যায়
পুটি মাছে গিল্যা খায়।

আফনে বাড়িত যান–আমার বেহালার তার ছিঁড়া।

মতি আরও কি বলতে যাচ্ছিল। আবদুল করিম তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল। তবে অনাদর করল না। দুপুরে যত্ন করে ভাত খাওয়াল। তার ছোট মেয়ে ভাত তরকারি এগিয়ে দিচ্ছিল, তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল–ভাল কইরা যত্ন করবে ফুলি–ইনি মতি মিয়া। বয়স অল্প। অল্প হইলে কি হইব–গলা মারাত্মক। গানের দল করছে। যে-সে মানুষ না, দলের অধিকারী।

মতি ফুলির দিকে তাকিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। ফুলি বলল, অধিকারী সাব, আমরারে গান শুনাইবেন না?

মতির জবাব দেবার আগেই আবদুল করিম প্রচণ্ড ধমক লাগাল–সম্মান রাইখ্যা কত বল ফুলি। আদবের সঙ্গে কথা বল। মুখের কথা বলতেই গানে টান দিব? বেয়াদব। গান অত সস্তা?

মতি অস্বস্তির সঙ্গে বলল, ছোট মানুষ।

ছোট মানুষ বড় মানুষ কিছু না। আদবের বরখেলাপ আমার না-পছন্দ। গানবাজনার বিদ্যা অতি কঠিন বিদ্যা। এর অসম্মান দেখলে আমার মাথাত আগুন জ্বলে।

আবদুল করিমের বাড়িতে খাওয়ার আয়োজন অতি সাধারণ। কিন্তু বড় যত্ন করে খাওয়াল ফুলি। পর্দার আড়ালে থেকে সব লক্ষ্য করলেন ফুলির মা।

দুপুরে খাওয়ার পরপরই রওনা হওয়া গেল না। আবদুল করিম বিছানা করে দিয়েছে। পান-তামাকের ব্যবস্থা করেছে।

পান-তামুক খাইয়া শুইয়া জিরান। শইলের যত্ন করেন। গান বাজনা পরিশ্রমের ব্যাপার। পরিশ্রমের জন্যে শইল ঠিক রাখতে হয়। ঐ ফুলি, হাতপাখা লইয়া আয়। চাচারে বাতাস কর।

না না, বাতাস লাগব না। বাতাস লাগব না।

আফনে আমরার বাড়ির মেহমান। কি লাগব না লাগব সেইটা আমি বিবেচনা করব।

আবদুল করিমকে আনতে না পারার দুঃখ মনে পুষে মতিকে ফিরতে হল। কোন রকমে শখানেক টাকার ব্যবস্থা করতে পারলে–একটা আসরে বসা যেত। কোথায় পাওয়া যায় শখানেক টাকা…!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *