মওলানা ইরতাজউদ্দিন হেডমাস্টার সাহেবের ঘরে ঢুকলেন। তার পেছনে বোকা বোকা চেহারার এক যুবক। যুবকের গা থেকে বিড়ির কড়া গন্ধ আসছে। তার দাঁত হলুদ হয়ে আছে। দাঁত মাজার ব্যাপারটি সে সম্ভবত জানে না, আর জানলেও তার প্রয়োজন বোধ করে না। মাথা ভর্তি চুল। সেই চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। এই চুল সে নিশ্চয়ই উকুনের চাষের জন্যে বড় করছে।
মওলানা বললেন, রহমত! স্যারকে সালাম কর।
রহমত টেবিলের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার ঝাপ দেয়া দেখেও ফজলুল করিম সাহেব আঁৎকে উঠলেন। এর চলাফেরা, কাজ কর্ম সব কিছুর মধ্যেই পশু ভাব আছে। পশুদের গায়ে যেমন কড়া গন্ধ থাকে এর গায়েও আছে। টক টক গন্ধ।
মওলানা বললেন, স্যার এর কথাই আপনাকে বলেছিলাম।
কি বলেছিলেন?
ঐ যে রেশমীর সঙ্গে…
ও আচ্ছা আচ্ছা
মোটরের ভাল মেকানিক। ওস্তাদ কারিগর। অন্যের গ্যারেজে কাজ করে, টাকা পয়সা জোগাড় করতে পারলে সে নিজেই নেত্রকোনা শহরে স্বাধীন ব্যবসা করবে।
ভাল খুব ভাল।
আপনাকে দেখানোর জন্যে খবর দিয়ে এনেছি।
ভাল করেছেন খুব ভাল করেছেন।
মওলানা রহমতের দিকে তাকিয়ে বললেন, রহমত তুমি বারান্দায় একটু দাঁড়াও আমি স্যারের সঙ্গে একান্তে দুটা কথা বলি।
রহমত তার সব কটি হলুদ দাঁত বের করে হেসে ফেলল। ফজলুল করিম সাহেব হাসি দেখেও চমকালেন। এটা তো হাসি না, যেন কামড়াতে আসছে। রহমত বারান্দায় চলে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে বিড়ি ধরাল। বিড়ির কড়া গন্ধে ঘরে থাকাই মুশকিল।
মওলানা বললেন, স্যার ওকে এনেছি রেশমীকে দেখানোর জন্যে। দেখে যদি পছন্দ হয় আজ রাতেই আমি বিয়ে পড়িয়ে দেব। রহমত বৌ নিয়ে চলে যাবে।
কি বলছেন আপনি?
ওর সঙ্গে এরকমই কথা হয়েছে।
হুট করে বিয়ে?
গরীব মানুষদের বিয়ে এরকম হুট হাট করেই হয়।
এর সঙ্গে রেশমীর বিয়ে হতে পারে না।
কেন?
ছেলেটাকে আমার পছন্দ না।
আপনার পছন্দের কথা তো এখানে আসছে না। রেশমীর পছন্দ নিয়ে কথা।
ওর তো পছন্দের প্রশ্নই উঠে না। পছন্দ করার মত কি আছে এই ছেলের মধ্যে?
অনেক কিছুই আছে। ছেলের রোজগার ভাল। ভাল টাকা কামায়। এই জাতীয় ছেলে নেশাভাঙ করে। তার সে বদঅভ্যাস নেই।
ফজলুল করিম সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, খামাখা একটা বিষয় নিয়ে পিড়াপিড়ি করছেন কেন? ছেলেটাকে আমার পছন্দ হয়নি। পও শ্রেণীর মানুষ বলে মনে হয়েছে। জেনেশুনে এমন একজনের সঙ্গে রেশমীর বিয়ে দেয়া যায় না। ওকে চলে যেতে বলুন।
একটু ভেবে বলুন স্যার।
ভেবে বলাবলির কিছু নেই।
জি আচ্ছা স্যার।
স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে এটাও তো খুব আপত্তিজনক কথা। আমার নিষেধ আছে শিক্ষকরাও ছাত্রদের সামনে ধূমপান করবেন না। খারাপ ব্যাপারগুলি ছাত্রদের আগে আকৃষ্ট করে। আপনি বের হয়ে রহমত না কি যেন নাম, তাকে একটা কড়া ধমক দিন, তার পর চলে যেতে বলুন।
জি আচ্ছা।
ওকে বিদেয় করে আসুন আপনার সঙ্গে কথা আছে।
জ্বি আচ্ছা।
ইরতাজউদ্দিন ফিরে এলেন। তাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আমাদের নতুন টিচারকে কেমন লাগছে।
ভাল।
এক শব্দে জবাব দেবেন না। কেন ভাল সেটা বলুন।
যুবক মানুষ। উৎসাহ আছে।
পড়াচ্ছে কেমন?
ভাল।
আপনার যে এক শব্দে জবাব দেবার একটা বিশ্রী অভ্যাস হয়েছে তার কি করা যায় বলুনতো। খোঁজ নিয়েছেন ভাল, না-কি খোঁজ না নিয়েই বলেছেন ভাল।
খোঁজ নেই নাই, অনুমানে বলেছি।
অনুমানে কিছু বলবেন না। যা বলবার অনুসন্ধানের পর বলবেন। প্রথমে অনুমান তারপর অনুসন্ধান এই কাজটা করবেন না। প্রথমে অনুসন্ধান। তারপর অনুমান। বুঝতে পারলেন?
জ্বি স্যার। এখন যদি অনুমতি দেন উঠি।
আচ্ছা যান। ভাল কথা ব্যাঙের ডাকের আরবী কি বলুনতো।
বুঝতে পারছি না কিসের আরবী?
ব্যাঙের ডাকের।
ইরতাজউদ্দিন সাহেব চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন ব্যাপারটা ধরতে পারছেন না। হেডমাস্টার সাহেব আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছেন। মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি তিনি ব্যাঙের ডাকের আরবী জানতে আগ্রহী। মানুষটার মাথায় কি গোলমাল হচ্ছে? মাথার অসুখ হঠাৎ করে শুরু হয় না। আস্তে আস্তে শুরু হয়।
সেকেন্ড পিরিয়ড শুরু হবার ঘণ্টা পড়ল। ঘণ্টা ঠিকমত পড়ল। সুন্দর আওয়াজ হল। হরিপদ স্কুলের ঘণ্টা খুঁজে পেয়েছে। ফজলুল করিম সাহেব ফাইন মাফ করে তাকে চিঠি দিয়েছেন। সেকেন্ড পিরিয়ডে ক্লাস নাইনের সঙ্গে তাঁর ক্লাস-ইংরেজী ফাস্ট পেপার। আজ পড়াবেন কবিতা।
তেত্রিশজন ছাত্র ছিল ক্লাসে, আজ সেখানে বারজন ছাত্র বসে আছে। সব কটা বেঞ্চ ফাঁকা। নীলগঞ্জ হাইস্কুল চালু হয়েছে। ছাত্ররা দল বেঁধে চলে যাচ্ছে। মাত্র দুমাসে এই অবস্থা। সারভাইভেল ফর দি ফিটেস্ট। যে ফিট সে টিকে থাকবে। যে আনফিট তাকে চলে যেতে হবে। এটা জগতের কঠিন নিয়মের এক নিয়ম।
ফজলুল করিম সাহেব ডায়াসের চেয়ারে চুপচাপ বসে রইলেন। পড়ানো শুরু করতে ইচ্ছে করছে না। ক্লাস ভর্তি থাকবে ছেলেমেয়ে তবেই না পড়িয়ে আরাম। অল্প কটা ছেলেকে তিনি কি পড়াবেন? তিনি হাসতে চেষ্টা করলেন। পড়ানো শুরু করার আগে শিক্ষকরা হাসি হাসি মুখে থাকলে ছাত্ররা ভরসা পায়। ছাত্ররা তেমন ভরসা পেল বলে মনে হল না। তিনি বললেন, সবাই দেখি নতুন স্কুলে যাচ্ছে। তোমরা যাচ্ছি না কেন?
একজন বলল, আমরা স্যার যাব না।
ফজলুল করিম সাহেবের ভুরু কুঁচকে গেল। ছেলেটা কথা বলেছে বেয়াদবের মত। উঠে দাড়ায়নি। স্যারের সঙ্গে কথা বললে–উঠে দাড়াবে। যা বলবে স্পষ্ট করে বলবে।
তোমার নাম ফরহাদ উদ্দিন না?
জ্বি স্যার।
শোন ফরহাদ উদ্দিন। তুমি যে বললে, তোমরা যাবে না। শুনে আমি সঙ্গত কারণেই খুশি হয়েছি। কিন্তু কথাগুলি তুমি বলেছে বসে বসে। অত্যন্ত বেয়াদবের মত কাজ করেছ। ভবিষ্যতে আর কখনো করবে না।
জি আচ্ছা স্যার।
এখন বল তোমরা যাবে না কেন?
এই স্কুলই ভাল।
নীলগঞ্জ স্কুল যে খারাপ এটা তো তুমি বলতে পার না। কারণ তুমি ঐ স্কুলে পড়নি। পড়েছ?
জি না।
তাহলে বললে কেন এই স্কুলই ভাল? যা মনে আসে তাই বলে বসবে। কথা বলার আগে অবশ্যই আমাদের অনেক সাবধান হতে হবে। কথা বলাটাও শিক্ষারই একটা অঙ্গ। মনে থাকবে?
জ্বি স্যার!
আজকে আমরা কি পড়ব?
ইংরেজী কবিতা।
কবিতার নাম কি?
The Sands of Dee.
যে কবি কবিতাটা লিখেছেন তার নাম কি? কেউ জান না। জানা উচিত ছিল না-কি? কবির নাম চার্লস কিংসলে। সবাই এক সঙ্গে বল চার্লস কিংসলে।
সবাই এক সঙ্গে বলল, চার্লস কিংসলে।
আবার বল।
ছাত্ররা আবার বলল।
ফজলুল করিম সাহেব বোর্ডের কাছে গেলেন। চক দিয়ে বড় বড় করে লিখলেন Charles Kingsley.কবির নামের নিচে লিখলেন কবিতার নাম The sands of Dee. প্রথমে স্রষ্টা তারপর তার সৃষ্টি। কাজটা কি ঠিক করলেন? সৃষ্টি কি বেশির ভাগ সময়ই স্রষ্টাকে ছাড়িয়ে যায় না? জীবনকৃষ্ণ বাবুর চেয়েও কি জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল অনেক গুরুত্বপূর্ণ নয়?
তিনি মিষ্টি গলায় কবিতার প্রথম চার লাইন আবৃত্তি করলেন।
O Mary, go and call the cattle home.
And call the cattle home,
And call the cattle home,
Across the sands of Dee.
বাবারা বল Dee মানে কি?
নদীর নাম স্যার।
হ্যাঁ। ইংল্যাণ্ডের একটা নদীর নাম। লিভারপুলের কাছে এই নদী সমুদ্রে পড়েছে। এই কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের দেশের এক কবিও অসাধারণ একটা কবিতা লিখেছিলেন। তোমরা কেউ সেটা জান?
ছাত্ররা চুপ করে আছে। কেউ জবাব দিচ্ছে না। ফজলুল করিম সাহেব বিষণ্ণ গলায় বললেন, কবিতাটা তোমরা ক্লাস সেভেনে পড়েছ। তোমাদের পাঠ্য ছিল
শোন মা আমিনা, রেখে দে রে কাজ, ত্বরা করে মাঠে চল
এল মেঘনায় জোয়ারে বেলা এখনি নামিবে ঢল।
নদীর কিনারা ঘন ঘাসে ভরা,
মাঠ থেকে গরু নিয়ে আয় ত্বরা,
করিস না দেরি আসিয়া পড়িবে সহসা অথই জল।
মাঠ থেকে গরু নিয়ে আয় তৃরা মেম্বনায় নামে ঢল।
ফজলুল করিম সাহেব অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। ভাল লাগছে না। কিছু ভাল লাগছে না। ঘণ্টা পড়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি বোর্ডের দিকে তাকালেন। ভুল করেছেন। কবির নামের আগে কবিতার নাম থাকা উচিত ছিল।
আজ বৃহস্পতিবার হাফ স্কুল ফজলুল করিম সাহেব ঠিক করে ফেললেন বাসায় যাবেন না। স্কুলেই সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবেন। রেশমী মন খারাপ করবে। করুক। দুটার দিকে ডাক আসে। ডাকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সরকারি অনুদানের চিঠি পেয়েছেন। চেক আসছে না। মনজুরকে কয়েকটা চিঠি দিয়েছেন। মনজুর চিঠির জবাব দিচ্ছে না। একবার ঢাকা যাওয়া উচিত।
গত মাসে শিক্ষকদের বেতন দিতে পারেন নি। সরকারী ডি, এর টাকাটা দিতে পারলেও হত। সেই টাকাও আসেনি। স্কুলের এমন কোন ফান্ড নেই যে সেখান থেকে টাকা ধার করেন। এত দিনের পুরানো একটা স্কুল অনার বোর্ডের দিকে তাকালে মন ভরে যায়। কত বিখ্যাত মানুষ এই স্কুল তৈরি করেছে।
ফজলুল করিম সাহেব ছাত্রদের দিকে তাকালেন। তারা এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি বললেন, আজ পড়াতে ভাল লাগছে না। খুব মাথা ধরেছে …
বলেই তিনি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। তাঁর মাথা ধরেনি। ছাত্রদের মিথ্যা কথা বলা হল। মাথা না ধরলেও শারীরিকভাবে স্বস্তিবোধ করছেন না। গরম লাগছে। কোটের কারণে গরম লাগছে বোধ হয় …।
ফজলুল করিম সাহেব ক্লাস শেষ হবার ঘণ্টার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। সময় কাটছেই না।
স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। শিক্ষকরা সবাই চলে গেছেন। শুধু মাহবুব সাহেব এবং বিনয় বাবু বসে আছেন। বিনয় বাবু গোপনে কিছু কথা বলতে চান। তিনি টিচার্স কমনরুমে অপেক্ষা করছেন। মাহবুব সাহেব ফজলুল করিম। সাহেবের সঙ্গে কথা বলছেন। তাঁর কথা শেষ হলেই বিনয় বাবু ঢুকবেন।
মাহবুব সাহেব বললেন, স্যার বেতনের কি ব্যবস্থা?
ফজলুল করিম হাসিমুখে বললেন, হবে হবে।
কি ভাবে হবে?
সরকারি ডি এর জন্য আমি নিজেই ঢাকা যাব।
কবে যাবেন?
দুই একদিনের মধ্যে।
সরকারি ভি, এ টা না হয় হল। বাকি বেতনের কি করবেন?
বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে সাহায্যের জন্যে যাব। স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র …বাজার সমিতি গত বছরের টাকাটা দেয় নি …ওদের…
ওদের কথা ভুলে যান। ওরা কিছু দিবে না।
দিবে না কেন?
আর কত দিবে। দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। ওদের একটা প্রস্তাব আছে। স্কুলের কিছু জমি তারা কিনে নিতে রাজি আছে, এ থেকে কিছু টাকা পাওয়া যায়।
সেটা সম্ভব না। জীবন বাবুর দানপত্র করা জমি বিক্রি করা যাবে না।
তাহলে সমস্যার সমাধান কি?
আছে সমস্যার সমাধান অবশ্যই আছে।
সেটা কি বলুন।
স্কুলের ছাত্র বাড়বে, তাদের বেতন থেকে যে আয় হবে…
ছাত্র বাড়বে কিভাবে?
লোকে যখন জানবে এটা ভাল স্কুল তখন দূর দূর থেকে ছাত্ররা আসবে। হোস্টেলে থাকবে…
মাহবুব সাহেব হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, স্যার উঠি। হেডমাস্টার সাহেব তৎক্ষণাৎ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, জ্বি আচ্ছা জ্বি আচ্ছা।
দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি, ক্ষিধে জানান দিচ্ছে। বয়স হয়ে গেলে ক্ষিধের কষ্টই প্রবল হয়ে দাড়ায়। হরিপদকে পাঠিয়ে কোন খাবার টাবার আনলে হত। একটা কলা দুটা বিসর্কিট….
বিনয় বাবু বললেন, স্যার আসব?
আসুন বিনয় বাবু। আপনি এখনো যাননি?
আজ্ঞে না। আপনার সঙ্গে সামান্য কথা ছিল।
বলুন।
বিনয় বাবু বসতে বসতে বললেন, আমার সংসারের অবস্থার কথা তো স্যার আপনি জানেন, অভাবে অনটনে পর্যন্ত হয়েছি। ঘরে বিবাহযোগ্যা কন্যা। বিবাহ দিতে পারছি না। পণ ছাড়া হিন্দু মেয়ের বিয়ে হয় না। এক লাখ দুলাখ টাকা পণ চায়। কোথায় পাব এত টাকা?
জ্বি তা তো ঠিকই। বড়ই দুঃসময়। সবার জন্যই দুঃসময়। তবে পৃথিবীর সব দুঃসময়ই সাময়িক। শীতের পরে বসন্ত আসে এটা জাগতিক নিয়ম।
জাগতিক নিয়ম সবার জন্য না স্যার। আমার বেলায় শীতের পর শীত আসে, তার পর আসে আরো শীত। স্যার আমি জানি আপনি মনে কষ্ট পাবেন কিন্তু না বলে পারছি না …
বলুন কি ব্যাপার?
বিনয় বাবু কিছু বললেন না। পাঞ্জাবীর কোণায় চোখ মুছতে লাগলেন। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আপনি কি নীলগঞ্জ স্কুলে যোগ দিয়েছেন?
বিনয় বাবু হা সূচক মাথা নাড়লেন। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আপনাকে ছাড়া আমি স্কুল চালাব কিভাবে? আপনার মত অংকের শিক্ষক আমি কোথায় পাব?
নতুন শিক্ষক যিনি এসেছেন, মামুন সাহেব তিনি ভাল অংক জানেন। শুধু ভাল না। খুব ভাল। আমি ক্লাশ টেনের ছাত্রদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়েছি।
ও আচ্ছা।
কারো জনোই কিছু আটকে থাকে না স্যার। আমি যা করেছি না পেরে করেছি। এই অপরাধের জন্যে নরকে আমার স্থান হবে। তা হোক, শুধু আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি ঈশ্বরের ক্ষমা চাই না। আপনার ক্ষমা চাই।
আপনি চলে গেলে আরো অনেকেই যাবে।
তা যাবে।
স্কুলটা কি উঠে যাবে?
না উঠবে না। আপনার মত মানুষ থাকলে স্কুল উঠবে না। স্যার উঠি।
বিনয় বাবু হঠাৎ নিচু হয়ে ফজলুল করিম সাহেবকে প্রণাম করতে গেলেন। ফজলুল করিম সাহেব আঁৎকে উঠে বললেন, করেন কি, করেন কি, বয়সে আপনি আমার বড়ই হবেন।
বিনয় বাবু ধরা গলায় বললেন, আমি তো স্যার আপনাকে প্রণাম করছি। আপনার ভেতর যিনি বাস করছেন আঁকে প্রণাম করছি। তিনি নমস্য।
সরকারি চিঠি আজকের ডাকেও আসেনি। ফজলুল করিম সাহেব তাঁর বড় মেয়ের একটি চিঠি পেলেন। মেয়ের চিঠিটা একটু যেন রহস্যময়। মেয়ে লিখেছে–
বাবা,
আমি প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকি বলে তোমাকে নিয়মিত চিঠি লিখতে পারি না। তবে তোমার খোঁজ খবর সব সময় রাখি। সম্প্রতি তোমার বিষয়ে কিছু অস্বস্তিকর খবর পেয়ে অত্যন্ত বিব্রত আছি। আশা করি আমি কি বলছি তুমি বুঝতে পারছ। তোমার সামাজিক মান মর্যাদার দিকে তুমি লক্ষ্য রাখবে এটা আশা করা অন্যায় না। নিঃসঙ্গ মানুষ নিজের নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্যে মাঝে মাঝে উদ্ভট সব কান্ড করে। তোমার এই বয়সে, তুমি এমন কিছু করবে না–এটুক আশা তোমার মেয়ে হিসেবে আমি অবশ্যই করতে পারি।
ফজলুল করিম সাহেব মেয়ের চিঠি কয়েকবার পড়লেন কিন্তু চিঠির মূল বিষয় ধরতে পারলেন না।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মওলানা ইরতাজউদ্দিন বারান্দায় আজান দিয়ে নামাজ পড়ছেন। হেড মাস্টার সাহেব তার ঘরে একা একা বসে আছেন। মওলানার নামাজ শেষ হলে এক সঙ্গে বেরুবেন।
দপ্তরী এসে ঢুকল। করিম সাহেব বললেন, কিছু বলবি? হরিপদ মাথা চুলকে বলল, নতুন মাস্টার সাব লাইব্রেরি ঘরের বেবাক বই নামাইয়া একটা বিষয় করতাছে।
কি করছেন?
এই ঘাটাঘাটি।
করুক। বই সাজিয়ে রাখার জন্যে না। পড়ার জন্য। ঘাটাঘাটি করার জন্য। বুঝলি?
জ্বি স্যার।
এর মধ্যেই খবর হয়ে গেছে। মামুন সাহেব অতি ভাল শিক্ষক। একজন ভাল শিক্ষক ১০০ হাতীর সমান।
ফজলুল করিম সাহেবের বিষণ্ণ ভাবটা কেটে যাচ্ছে। নতুন শিক্ষক স্কুলের লাইব্রেরীর বই ঘাটাঘাটি করছেন। খুবই ভাল লক্ষণ। স্কুল লাইব্রেরীর দায়িত্ব তাকে দিয়ে দেয়া যায়।
বিনয় বাবুর জন্য মনটা খারাপ লাগছে। অতি সজ্জন। অংকের জাহাজ। যে কোন অংক মুখে মুখে করে ফেলতে পারেন। এ রকম শিক্ষক যে কোন স্কুলের জন্যে স্তম্ভের মত।