ভোর হবার আগে মধুকুপির রাতশেষের ফিকে চাঁদের চেহারা যখন কুয়াশায় ভিজে নরম হয়ে প্রায় মুছে এসেছে, আর ভুখা শিয়ালের চেহারা ছোট ছোট চোরা আবছায়ার মত ছটফটিয়ে সড়কের শিশিরভেজা ধুলো শুঁকে শুঁকে পালিয়ে যেতে শুরু করেছে, তখন দাশু ঘরামির ঘুম ভেঙে যায়। বুঝতে পারে দাশুর সেই পাথুরে বুকটাকে দু হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে আছে মুরলী, যে বুকের সবচেয়ে সাধের আশার প্রতিজ্ঞাকে মুরলীই একটা ভয়ানক প্রশ্নের আঘাত দিয়ে ব্যথিত করেছে।
কিন্তু সে ভয় আর নেই। সেই ভয়টাকে এখন মিথ্যার তামাশা বলে মনে হয়। সে ভয় রাতের বেলাতেই মরে গিয়েছে। দুজনে মিলে সেই শুখা মরিচ আৰ হলুদজলে সিকানো আধ সের মকাইদানার গরম গরম ঘাট্টা একই সঙ্গে একই হাঁড়ি থেকে তুলে নিয়ে খেয়েছে। খেতে খেতে ঝালের জ্বালা লেগে যখন মুরলীর গলা ধরেছে, আর খাওয়া থামিয়ে চোখ বন্ধ করেছে মুরলী, তখন মুরলীর মুখের কাছে জলের ঘটি তুলে ধরেছে দাশু। জল খেয়ে লাজুক হাসি হেসে ফেলেছে মুরলী। তারপর, মুরলীর মুখের সেই লাজুক হাসি যেন মধুকুপির রাতের বাতাসের মত জংলা ফুলের গন্ধ পেয়ে ধীরে ধীরে নিবিড় হয়ে উঠেছে। দাশুর বুকের দিকে অপলক চোখ তুলে তাকিয়েছে মুরলী। মুরলীর চোখের চাহনি আরও কালো হয়ে ছটফট করেছে। দাশুর কাছে এগিয়ে এসে, দাশুর গা-ঘেঁসে বসে, দাশুর কাঁধের উপর অলস মাথাটা নামিয়ে দিয়েছে। দাশু বলেছে-কি হলো মুরলী? মুরলী রাগ করে বলেছে-চুপ কর।
সেই মুহূর্তে দাশুর জীবনের সব আতঙ্ক মরে গিয়ে মধুকুপির রাতের বাতাসে মিশে গিয়েছিল। হেসে উঠেছিল দাশুর চোখ। মধুকুপির রাতের বাতাস আর নীরবতার মধ্যে যেন জাদু আছে। মধুকুপির রাতটা যেন একটা দয়ালু ব্যাধি; পাখি আর পাখিনীকে সারাদিনের ছাড়াছাড়ির অভিশাপ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এক পিজরায় রেখে দেয়।
জেল থেকে ফিরে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত মধুকুপির কোন রাত দাশু ঘরামিকে ঠকায় নি। রোদ আর আলো নিয়ে জেগে থাকা দিনগুলি যেন কঠোর ঠাট্টার হাসি ধমক হতাশা আর সন্দেহের উৎপাত। দাশুর জীবনটাকে ঘরছাড়া আর গাঁঘড়া করবার জন্য টানাটানি করে। কিন্তু রাতগুলি যেন একটু ক্ষমা আর মায়া রাখে। ঘর-ভাঙানো ভয়গুলি যেন হঠাৎ-মায়ায় করুণ হয়ে যায়। তারপর হঠাৎ-চমক্কার একটা আশ্বাস হয়ে দাশু ঘরামির উৎপীড়িত বুকটাকে শক্ত করে দু হাতে আঁকড়ে ধরে; দাশুও সেই স্পর্শের নেশায় যেন দু চোখ ভরে স্বপ্ন দেখে নেয়, সবই ঠিক আছে। ঘর আছে আর ঘরণী আছে; ছেইলা আসছে, জমি আসবে, এত ভয় করবার কি আছে?
ডাক দিয়ে মুরলীর ঘুম ভাঙিয়ে আর জাগা চোখ দুটোকে দু হাত দিয়ে জোরে জোরে ঘষে নিয়ে দাশু বলে—আমি এখন খাটতে বের হব মুরলী।
জোয়ান কিষাণের নির্ভয় অহঙ্কার ঘুম ভাঙতেই তৈরি হয়েছে; দিনমানের কঠোর ঠাট্টা ধমক আর ভয়গুলিকে জয় করবার একটা প্রতিজ্ঞা পাঁজর ঠেলে উথলে উঠেছে। দুরুদুরু ভয় দুরে থাকুক, হাতপায়ের গাঁটগুলিতে অদ্ভুত এক আমোদ সিরসির করে।
জামকাঠের কপাট খুলে ঘরের দাওয়ার উপর এসে দাঁড়ায় দাশু। আকাশের দিকে তাকায়। তারপর চেঁচিয়ে হাঁক দেয়—তুই একটু তাড়াতাড়ি করবি কি মুরলী; উনানে আগুন দিতে পারবি?
মুরলী আশ্চর্য হয়ে বলে-কেন?
মুরলীর বিস্মিত সন্দেহটাকে বুঝতে না পেরে দাশু আবার হেসে ওঠে : খাটতে বের হব, কে জানে কত ক্রোশ দৌড়াতে হবে, কত টাঙ্গি মারতে হবে। হাত-পা একটুক কামাই করে না নিলে খাটতে জোর পাব কেন?
উনানের মুখে শুকনো বাঁশপাতা ঠেসে দিয়ে আগুন ধরায় মুরলী; আর দাশুও টাঙ্গি হাতি নিয়ে তিন লাফে ঘরের বাইরে চলে যায়। এক গাদা বাবলার ছাল হাতে নিয়ে ফিরে আসে। উনানের উপর হাঁড়ি চড়িয়ে বাবলার ছাল জ্বাল দিতে থাকে মুরলী।
কিন্তু ততক্ষণ চুপ করে বসে থাকে না দাশু। একটা হাঁড়ি আর কোদালি হাতে নিয়ে বের হয়ে যায়। দাশু ঘরামির হাতে-পায়ে কাজের প্রতিজ্ঞা যেন প্রচণ্ড এক উৎসাহের নেশা মাতিয়ে তুলেছে। দুই বিঘা চাকরানের মাটি যেখানে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে আছে, সেখানে কমাছড়ানো একটা খাদের মধ্যে জল জমে আছে। হাঁড়ি ভরে জল নিয়ে আসে দাশু। ঝুপঝাপ করে কোদালির মার মেরে বাঁশঝাড়ের কাছ থেকে ভুরভুরে মাটি তুলে নিয়ে আসে। কাদা তৈরি করে দাও। তারপর; ঘরের দেওয়ালের ফাটলের উপর তাল তাল কাদা আছড়ে দিয়ে দু হাত চালিয়ে লেপতে থাকে।
দাওয়ার খুটো আর চালার দিকে একবার তাকায় দাশু। চালার বাতা কাত হয়ে পড়েছে। চোখের গিটগুলি ছিঁড়ে গিয়েছে। টাঙ্গির মাথা দিয়ে খুঁটোটাকে ঠুকে ঠুকে ঘুনের ধুলো ঝরিয়ে আবার চেঁচিয়ে ওঠে দাশু : দু-চার হাত চোপ আছে কি?
মুরলী বলে–না।
না, হলো না। খুঁটোর মাথাটা নতুন চোপের শক্ত গিট দিয়ে বেঁধে দেবার এখন আর কোন উপায় নেই।
-দে তবে, কষজলের হাঁড়িটা দে। বাবলার ছাল সিদ্ধ করা জলের হাঁড়িটা কাছে টেনে নিয়ে আস্তে আস্তে হাত ডোবায় দাশু। বাবলার কষে মজে গিয়ে হাত দুটো আস্তে আস্তে ভোতা হয়ে যেতে থাকে। পা দুটোকেও কষজলে ড়ুবিয়ে বসে থাকে দাশু। আস্তে আস্তে ঝমিয়ে ওঠে পা দুটো। ও-পায়ে এখন কাটা আর কাকর ফুটলেই বা কি? রক্ত ঝরে পড়লেও টের পাবে না দাশু, আর অনায়াসে ক্রোশের পর ক্রোশ ছুটে বেড়াতে পারবে। বেদনাবোধহীন পা দুটো তবু ক্লান্ত হবে না।
ধুলো শান দিয়ে চকচকিয়ে নিয়ে টাঙ্গিটাকে কাঁধের উপর তুলে নেয় দাশু। গামছা দিয়ে শক্ত করে কোমরটাকে বেঁধে নিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে। আমি চললাম মুরলী। ঘরের গোঁজাতে আমার টাকা আছে, নিয়ে আয়।
মুরলী আবার আশ্চর্য হয় : টাকা?
দাশু হাসে। হা রে, তিন টাকা চার আনা এখনও আছে। আমার জেলের রোজগার।
সত্যিই তিন টাকা চার আনা। ঘরের গোঁজার ভিতর থেকে টাকা আর পয়সাগুলি তুলে নিয়ে এসে দাশুর হাতে তুলে দিয়েই ভ্রূকুটি করে মুরলী : তুমি খাটতে চললে?
–হ্যাঁ।
–টাকা আনতে?
–হ্যাঁ।
–তবে টাকা নিয়ে যাও কেন?
—এ টাকা এখন আর আমার নয় মুরলী। এখনই খরচ হয়ে যাবে।
–কিসে খরচ হবে।
–মানত করেছি, জাহিরথানে কুঁকড়া বলি দিব।
-তারপর? মুরলীর চোখের চাহনি দাশুর জীবনের এই নতুন আহ্লাদের গায়ে যেন জ্বালা ধরিয়ে দেবার জন্য কটকট করে ফুটতে থাকে।
–তারপর আর কি? চেঁচিয়ে ওঠে দাশু।
–আমি কি করবো?
–তুই ঘরে থাকবি।
–ঘরে থেকে করবো কি? সেটা বলে যাও।
–কিষাণের মাগ যা করে, তাই করবি।
–কিষাণের মাগ হাঁড়ি ভরে ভাত রাঁধে।
–তুই হাঁড়ি ভরে ভাত রাঁধবি।
–চাল কোথা পাব যে রাঁধবো?
–আমি নিয়ে আসছি। তুই এত ডর দেখাস কেন? বলতে গিয়ে দাশুর চোখেও একটা কঠোর স্পর্ধাময় ভ্রুকুটি ফুটে ওঠে।
মুরলী বলে-বেশ।
বলেই একটা হাঁড়িতে জল ভরে নিয়ে ঠাণ্ডা উনানের উপর চাপিয়ে দেয় মুরলী! তারপর উনানের কাছে শক্ত হয়ে বসে পড়ে।
দাশু—এ কি করলি?
মুরলী বসলাম। তুমি চাল নিয়ে এসো, তারপর ভাত রাঁধবো। তার আগে এখান থেকে। উঠবো না।
মধুকুপির দিনের আলো আবার দাশুর প্রাণের আশা আর অহংকারের উপর ঠাট্টার কামড় বসিয়ে দিয়েছে। জ্বলতে থাকে দাশুর নিঃশ্বাস। কিন্তু না, দাশু কিষাণের পাথুরে বুকের ভিতর আর কোন ভয় দুরুদুরু করে না। উনানের উপর ঐ হাঁড়িটা এমন প্রকাণ্ড কোন হাঁড়ি নয়। দু সের চাল এনে ফেলে দিলেই ভাতে ভরে যাবে হাঁড়িটা। কিন্তু কি মনে করেছে মুরলী, দাশু কিষাণ আজ তার ঘরণীকে পেট ভরে ভাত খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখবার জোর হারিয়ে অমানুষ হয়ে গিয়েছে?
–আমি আসছি। বলতে গিয়ে হেসে ফেলে দাশু।
মুরলীর সেই গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে, বোধহয় মুরলীর মনের একটা অকারণ সন্দেহের দিকে শান্তভাবে একটা তুচ্ছতার হাসি হেসে চলে যায় দাশু।
ঈশান মোক্তারের কুঠি। বড় গুমস্তা দুখন বাবু তার চোখের একটা হিংস্র ভ্রূকুটি সামলে নিয়ে হেসে ফেলে ও পাঁচ বছর কয়েদ খেটে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি দাশু?
দাশু–কোর্ফা হতে চাই, তাতে আবার মাথা খারাপ মনে কর কেন, দুখন বাবু?
দুখন বাবু–কত বিঘার কোর্ফা হতে চাও?
দাশু–পাঁচ বিঘা হলে ভাল হয়।
রশিদার ভোলা হো-হো করে হেসে ওঠে : বুঝলাম। পাঁচ বিঘা কেন দশ বিঘা হলে ভাল হয়। কিন্তু জেল থেকে কত টাকা নিয়ে এলি যে, ভূঁইদার হবার মন করেছিস?
দাশু—এ কথা কেন বলছো রশিদার বাবু?
দুখন বাবু বলে—একশো টাকা সেলামি দিতে পারবে?
রশিদার ভোলা-তারপর আরও চার-পাচটা নজরানা আছে।
দুখন বাবু-তারপর বীজ চাই, হাল চাই। তারপর ছটা মাস তোমাদের মা-ভাতারের খোরাক চাই। কত টাকা আছে তোমার যে কোফা হবার সাধ হয়েছে?
দাশু আতঙ্কিত ভাবে তাকায়-টাকা পয়সা একটাও নাই।
দুখন বাবু-তবে পাগলপনা করছ কেন?
দাশু–কিন্তু আমার যে জমি চাই।
রশিদার ভোলা খেঁকিয়ে ওঠে জমি চাই মানে কি রে? ঈশান মোক্তারের জমিতে মনিষ খাটতে মানে বাধছে?
চুপ করে থাকে দাশু। দুখন বাবু মাথা নাড়ে : মধুকুপির মনিষগুলার আজকাল বড় বাড় বেড়েছে।
রশিদার ভোলা বলে-কয়লার খাদ, নতুন রেল-লাইন আর কারখানাগুলো এদের মেজাজ খারাপ করে দিয়েছে।
দুখন বাবু–নগদ নগদ দেড়-দুই টাকা মজুরি মারে, মেজাজ খারাপ হবে না কেন?
ভোলা-জোয়ানগুলো সব খাদের কাজে গিয়ে ভিড়েছে। শুধু আছে বুড়াগুলা। সেগুলাও আবার আধা ভাগে জোত করতে চায় না।
দাশু–আমি খাদে কাজ নিব না দুখন বাবু। তুমি আমাকে জমি বন্দোবস্ত করে দাও।
দুখন বাবু-কি বন্দোবস্ত করবো বল? আঠারবাইশ করবে? সেলামি লাগবে না।
দাশু–সেটা কি বটে?
দুখন বাবু-ফলনের চাল্লিশের বাইশ তুমি নিবে, আর কুঠি নিবে আঠার। পোয়ালের আধা তোমার, আধা কুঠির।
দাশু–হ্যাঁ, তাই মেনে নিব। আমাকে পাঁচ বিঘা দো-আঁশ বন্দোবস্ত করে দাও দুখন বাবু।
ভোলা কিন্তু বীজ লাঙ্গল তুই দিবি, কুঠি দিবে না।
দাশু–এটা কেমনতর হলো? বীজ লাঙ্গল পাব কোথায়? টাকা কই?
ভোলা-তবে এত জমি জমি করিস কেন? টাকা নাই ত মনিষ হয়ে থাক। কুঠির দাওয়ার উপর লম্বা-চওড়া একটা চৌকি। ঈশান মোস্তারের বড় গুমস্তা দুখন বাবু আর রশিদার ভোলা আবার খাতাপত্র ঘাঁটতে থাকে। ঈশান মোক্তারের বিরাট খাটালের পিছনে গোবরের পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে চুপ করে হাঁটু মুড়ে দাওয়ার মেঝের উপর বসে থাকে দাশু। ঈশান মোক্তারের ভাণ্ডারটাও এই পাঁচ বছরে কত বড় হয়ে গিয়েছে। মাচানের পর মাচান, খড় আর মাইয়ের খোসার এক-একটা পাহাড় মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাণ্ডারের বড় দরজাটাও খোলা। ভিতরে ধানের পাহাড় দেখা যায়।
দুখন বাবু আর ভোলা রশিদারের কথা শুনে দাও কিষাণের জমির স্বপ্ন খানখান হয়ে ভেঙে গিয়েছে! গুলঞ্চের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা সাধের গায়ে আগুন ধরে গিয়েছে। টাকা চাই, নইলে পরের জমির মনিষ হয়ে থাকতে হবে, নিজের জমির মানুষ হওয়া যাবে না।
ভোলা রশিদারের চোখে একটা করুণার ছায়া যেন ছমছম করে ওঠে : যদি ভাগজোত করতে চাস, তবে দশ বিঘা টাড় বন্দোবস্ত করে দিতে পারি দাশু। সেলামি লাগবে না, আর বীজও পাবি।
দাও আক্ষেপ করে–টাঁড় নিয়ে কি হবে?
ভোলা—কোদো ছিটাই কর। যা হবার হবে; আধা মাল কুঠিকে দিবি।
দাশু–তবে তাই দাও।
দুখন বাবু অপ্রসন্ন হয়ে ভ্রুকুটি করে—বেশ, কাল এসে চিঠা নিয়ে যেও; ভোলাবাবু রশি ধরে জমি দাগিয়ে দিয়ে আসবে।
দাশু–কিন্তু…।
দুখন বাবু-কি?
দাশু—আজ একটা কাজ দাও দুখন বাবু। আজ খাটতে বের হয়েছি যে।
দুখন বাবু-এখন কোন কাজ নেই দাশু।
দাশু–একটা গো-গাড়ি দাও।
দুখন বাবু-কেন?
দাশু–জঙ্গলে যাব।
দুখন বাবু হাসের সর্বনাশ! অমন কথাটি মুখে এনো না।
দাশু আশ্চর্য হয়? কেন গো?
দুখন বাবু-কেন জঙ্গলে যাবে? শাল ভাঙ্গতে?
দাশু–হ্যাঁ, একগাড়ি কাচা শাল বাবুরবাজারে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারলে…।
দুখন বাবু-হ্যাঁ, তাতে তোমার দেড় টাকা আর কুঠির দেড় টাকা হবে। কিন্তু তোমার কাছ থেকে দেড় টাকা পেতে গিয়ে যে কুঠির একজোড়া বলদ কানারানীর পেটে চলে যাবে।
দাশু–কানারানী? কোথায় আছে কানারানী?
দুখনবাবু-কোথায় নাই বল? কপালবাবার জঙ্গলে বল, বড়কালুর চটানে বল, ডরানির স্রোতে বল, ডাঙ্গায় বল আর সড়কে বল, বাঘিনটা সবঠাই দিনে রেতে যখন-তখন ছুটাছুটি করছে।
ভোলা বলে—গত বছর এই সময়টা এক হাজার টাকার শিশানের আঁশ এই ভাণ্ডারে জমা করেছিলাম। এই বছর এক ছটাকও জমা হয় নাই।
দাশু–কেন গো ভোলা বাবু?
ভোলাবাঘিনটার ডরে। শিশাল ভাঙতে জঙ্গলে যাবে কে বল্? পচাই পিটাই করবে না, শুধু কাচা ছেচাই করে এনে দিবে, এমন পাঁচ সের ভিজা আঁশের বদলে এক সের চাল হেঁকেছি, তবু কেউ রাজি হয় নাই।
দাশু উদাসভাবে বলে কিন্তু আমাকে একটা কাজ দাও। আমার হাত আছে, পা আছে, টাঙ্গি আছে; আমি বুড়া নই।
দুখন বাবু-আমি জানি, তিনটা ভঁইসের মত তাকত আছে তোমার। কিন্তু কাজ না থাকলে দিব কেমন করে? রোপাই হয়ে গেল, এখন তো আর কোন কাজ নাই।
দাশু–আমাকে পাঁচটা টাকা আগাম দাও।
দুখন বাবু মুখ টিপে হাসে–সে কি হে দাশু? আবার বিয়া করবে নাকি?
দাশু–দাও এখন; আমি ধান কাটাইয়ের সময় রোজ খেটে শুধে দিব।
দুখন বাবু-ঈশান মোক্তারের কুঠি সরকারী রিলিফ আফিস নয় দাশু। ওসব বাজে কথা বলো না।
ভোলা রশিদার বলে—এখানে বসে না থেকে বাবুবাজার যা, না হয় গোবিন্দপুরে চলে যা। মাটি কাট, পাথর বিছাই কর, নয়তো ঘরের চালা মেরামত কর। তুই তো ঘরামির কাজ জানতিস।
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় দাও। আকাশের দিকে তাকায়। বেলা প্রায় দু পহর হল। ছোটকালুর মাথায় শুকনো ঘাস পুড়ে পুড়ে ধোঁয়া ছড়ায়।
ব্যস্তভাবে হনহন করে পথ হাঁটে দাশু। এতক্ষণে একটা ভুল বুঝতে পেরেছে দাও। আজই ঈশান মোক্তারের কুঠিতে গিয়ে জমির জন্য এতটা সময় আইঢাই করা ভুল হয়েছে। আজ এখনই হাতের কাছ পাঁচ বিঘা জমি না হলেও চলবে। গুলঞ্চের বেড়ার স্বপ্ন আর কয়েকটা মাস পরে সত্য হয়ে উঠলেও চলবে। কিন্তু আজ যে এই মুহূর্তে এই টাঙ্গির জোরে, এই শক্ত হাত দুটো খাটিয়ে অন্তত আজকের মত পেট ভরাবার খোরাক পেতে হবে। দাশুর কপালের সুখ, দাশুর বুকের আশা, দাশুর এই হাতদুটোর অহঙ্কার পরীক্ষা করবার জন্য ঠাণ্ডা উনানের উপর হাঁড়ি চড়িয়ে শক্ত হয়ে বসে আছে মুরলী। কোন ভুল নেই, এতক্ষণে মুরলীর চোখ হতাশ হয়ে উঠেছে, মুরলীর ঠোঁটে ক্ষিদের জ্বালা জ্বলছে, মুরলীর মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু কোথায় কাজ? তবে কি গোবিন্দপুরে যেতে হবে? কিংবা বাবুরবাজারে?
ডরানির ঘোট পুলের কাছে এসে থমকে দাঁড়ায় দাশু। বাবুরবাজারের দিকে এগিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না। পুলিস-ফাঁড়ির রামাই দিগোরার যদি মিছা আবার একটা হাঁক দিয়ে আটক করে ধরে, যদি মুন্সীটা এসে পরবী দাবী করে? দরকার নেই, ওপথে এগিয়ে গেলে দাশুর দাগী-জীবনের ব্যথাটাকে নিয়ে আবার টানাটানির খেলা শুরু করবে রামাই আর পুলিসের চৌধুরীজী। ওদিকে গেলে আজ আর ফিরতেই পারা যাবে না। তাছাড়া গেলেই কি কাজ পাওয়া যাবে? সেই ঠিকাদারবাবু আজও বাবুরবাজারে আছে কিনা কে জানে?
দুরুদুরু করে দাশু ঘরামির বুক। টাঙ্গিটা তেতে গিয়ে পিঠের চাম প্রায় ঝলসে দিচ্ছে, কিন্তু দাশুর ভিতরে ঠাণ্ডা ভয়ের বাতাস সিরসির করে। মুরলীর মুখটা মনে পড়তেই দাশুর চোখের চাহনি ভীরু হয়ে যায়। অন্তত সের দুয়েক চাল নিয়ে মুরলীর কাছে গিয়ে দাঁড়াতে না পারলে দাশু ঘরামির ভাগ্য যে আর্তনাদ করে উঠবে; সেই সঙ্গে ধিক্কার দিয়ে হেসে উঠবে মুরলী। কই, মধুকুপির এত তেজ আর দেমাকের মজবুত কিষাণ, মুরলীর মরদ হয়েছে যে, সে মানুষ মুরলীকে উপোষ রেখে মরিয়ে দিচ্ছে কেন? এমন করলে তোমার ছেইলাটাও কি বাঁচবে?
ডরানির ছোট পুলের লোহার উপর যেন মরিয়া হয়ে হাত ঘষে দাশু; বাবলার কষজলে ঝামানো ভোতা হাতে কোন ফোসকা ফুলে ওঠে না। মুরলীর ওই ভয়ানক চোখের সন্দেহের কাছে যেন হার মানতে না হয়, হে কপালবাবা! মুরলীর ওই শূন্য হাঁড়ি ভরে দিতে ক’সের চাল লাগে?
আকাশের দিকে তাকায় দাশু। বেলা বেড়েছে, কিন্তু এখনও সময় আছে। কপালবাবার জঙ্গলের উপর মেঘ ভেসে বেড়াতে শুরু করেছে। কিন্তু বৃষ্টি হবে না বোধহয়। হোক না বৃষ্টি। এই তো মাত্র ক্রোশটাক পথ, ডাঙা ধরে দৌড়ে গেলে ছোটকালুর বাঁয়ে শিশালের জঙ্গ লটাকে পাওা যাবে। এক মণ শিশালের পাতা কাটতে কত বা সময় লাগবে? আর পাতার বোঝা টেনে নিয়ে উরানির স্রোতের কাছে এনে ফেলতে এমন কিছু দেরি হবে কি?
হনহন করে হাঁটতে শুরু করে দাশু!
ঝুপ ঝুপ–ঝপাট। দাশু ঘরামির টাঙ্গির তিন কোপে এক একটা টুসটুসে শিশালের নরম ধড় কাটছাঁটা হয়ে মাটির উপর গড়িয়ে পড়তে থাকে। শিশালের প্রকাণ্ড মঞ্জরীর শুড় থর থর করে কাঁপে; বীজখোল শব্দ করে ফেটে যায়, আর, বীজখোলের রস রক্তের ধারার মত ছিটিয়ে পড়ে মাটি লাল করে।’
ঝুপ ঝুপঝাপাট। নীরব ও স্তব্ধ জঙ্গলের বুকের ভিতরে শুধু দাশু ঘরামির টাঙ্গির শব্দ বিচিত্র এক খাটুনির উৎসবে মত্ত হয়ে একঘেয়ে ছন্দে বাজতে থাকে। বাবলার কষজলে ঝামাইকরা পায়ের পাতায় কত কাটা ফুটে আছে, আর রক্তও ঝরছে; তবু ব্যথা নেই, জ্বালা নেই। দাশু কিষাণের পা দুটো যেন জীবনের একটা প্রতিজ্ঞার উৎসবে নেচে নেচে ঘুরে বেড়াতে থাকে।
বনমোরগের ঝক উড়ে পালিয়ে গেল। দুটো খরগোশ গর্তের ভিতরে মুখ লুকাল। দাও শিশালের রসে-ভেজা টাঙ্গিটাকে মাটিতে মুছে নিয়ে একবার চুপ করে দাঁড়ায়। না, আর দরকার নেই। একটা কচি শালের গা থেকে বুনো লতা ছাড়িয়ে নিয়ে এসে শিশালের পাতাগুলিকে গাদা করে বাঁধে দাশু। ব্যস, এইবার গাদাটাকে টেনে টেনে ডাঙার উপর দিয়ে গড়িয়ে নিয়ে ডরানির স্রোতের কাছে এনে ফেলতে হবে। তারপর হেঁচাই পিটাই আর ধোলাই আছে। তারপর, নিশ্চয়, অন্তত সের দশেক আঁশ পেয়ে যাবে দাশু।
পাতার গাদাদুটো টান দিয়ে মাত্র দু-তিন পা এগিয়েছে দাশু, হঠাৎ কচি শালের আড়াল থেকে একটা ঘম কালো ও রোমশ হিংসুটে ছায়া বের হয়ে, বড় বড় নখ ঝোলানো দুটো থাবা তুলে দু পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ায়। রাগে সাদা হয়ে গিয়েছে ভালুকটার ঘোলাটে চোখ। আর দু কষ দিয়ে সাদা ফেনার বুদবুদ ফেটে ঝরে পড়ছে।
এগিয়ে আসছে ভালুকটা। কালো কষের সাদা ফেনা হাসছে। শুধু এক মুহূর্তের জন্য, তার বেশি নয়, দাশুর বুকটা থরথর করে ওঠে। তার পরেই এক মুঠো ধুলো তুলে নিয়ে ভালুকটার চোখের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়ায় দাশু। দাশুর শক্ত মুঠোয় বাঁধা টাঙ্গিটার ফলা রোদ লেগে ঝিকমিকিয়ে হাসতে থাকে।
কিন্তু ভালুকটা একটা লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে দাশুর টাঙ্গির উপর একটা থাবা চালায়। দাশুও টাঙ্গি চালায়। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য! দাশুর হাত থেকে পিছলে গিয়ে পাথরের উপরে ছিটকে পড়ে আর্তনাদ করে ওঠে টাঙ্গিটা। দাশুর মাথার খুলি আঁকড়ে ধরবার জন্য একটা থাবা তুলে ভালুকটা নাচতে থাকে। কিন্তু সেই মুহূর্তে প্রকাণ্ড একটা ছায়া দাশু ঘরামির পিছন থেকে লাফ দিয়ে পাশের একটা ঝোপের আড়ালে ঢুকে পড়ে আর উশখুশ করে। ভালুকটাও হঠাৎ থাবা নামিয়ে নেতিয়ে পড়ে। চার পায়ের উপর বসে শরীরটাকে কুঁকড়ে ঝোপের দিকে একবার তাকায় ভালুকটা। দাও দেখতে পায় সেই মুখ জীবনে কোনদিন যে মুখ এত স্পষ্ট করে দেখতে পায় নি। ঝোপের পাতার ভিতর থেকে খোঁচা-খোঁচা গোঁফ ভাসিয়ে একটা নিভু নিভু কানা চোখ, আর একটা কটমটে কটা চোখের সবুজ আভা ছড়িয়ে দিয়ে তাকিয়ে আছে সেই বাঘিন কানারানী।
একটা লাফ দিয়ে সরে গেল ভালুকটা। কচি শালের পাশ দিয়ে ছুটে গিয়ে উইঢিবির আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। উশখুশ করে ওঠে ঝোপটা। দেখতে পায় দাশু, কানারানীও নেই। চুপ করে দাড়িয়ে শুনতে থাকে দাও, উইঢিবির ভিড়ের ভিতর দুই জানোয়ারের চাপাচাপা গোমরানো রাগ আর হুটোপুটির শব্দ ছটফট করছে। ধুলোও উড়ছে দেখা যায়। ভালুকটাকে কি তাড়িয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে কানারানী?
টাঙ্গিটা হাতে তুলে নিয়ে দৌড় দিয়ে পালিয়ে যেতে গিয়েই থমকে দাঁড়ায় দাশু, তারপরেই শিশালের পাতার গাদা টান দিয়ে হেঁচড়ে নিয়ে ডাঙার দিকে ছুটতে থাকে।
ডরানির স্রোতের কাছে যখন পৌঁছয় দাশু, তখন আর একবার আকাশের দিকে তাকায়। না এখনও সময় আছে। মুরলীর ধিক্কার মিথ্যে করে দেবার সুযোগ এখনও আছে। বিকেল হয়েছে, এই মাত্র। শিশালের পাতা ছেটাই পিটাই আর ধোলাই করতে আর কতই বা সময় লাগবে?
টাঙ্গির দু কোপে শালের মোটা ডাল কেটে মুগুর তৈরি করে নেয় দাও। ডরানির স্রোতের কাছে শিশালের পাতার গাদা টেনে নিয়ে এসে পাথরের উপর ছড়িয়ে দেয়।
ছেঁচা শিশালের কড়া গন্ধে বিকেলের বাতাসে যেন ঝাজ ধরে যায়। দাশুর হাতের মুগুর শিশালের উপর আছড়ে আছড়ে পড়ে। তেলানো শাঁস জলে ধুয়ে নিয়ে আবার পিটাই করে। ধুপ ধুপ! ধুপ ধুপ! শিশালের শাঁস ছিটকে এসে দাশুর চোখমুখ পিছল করে তোলে। থুতু ফেলতে গিয়ে বার বার জল বমি করে দাও।
আকাশের দিকে তাকায় দাশু। বড়কালুর মাথার কাছে আকাশটা আর লাল নয়। ডরানির জল জঙ্গলের ছায়ায় কালো হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যা হয়ে এল।
ধুপ ধুপ! ধুপ ধুপ! যেন থেঁতলানো শিশালের বুকজ্বালা দুর্গন্ধে মাতাল হয়ে দাশুর হাতের মুগুর শিশাল পিটতে থাকে। ভুলতে পারে না দাও, দাশু ঘরামির ভাগ্যটাকে আজ ঠাট্টা করে একেবারে মিথ্যে করে দেবার জন্য ঠাণ্ডা উনানের উপর শূন্য হড়ি চাপিয়ে অপেক্ষায় বসে আছে মুরলী।
শিশালের আঁশ ধোলাই করতে আরও এক ঘণ্টা সময় গেল। ডরানির জলের স্রোতও ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল। শুধু শব্দ শুনে বোঝা যায়, কলকল করে কোন্ দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে ডরানির জল।
শিশালের আঁশের বোঝা লতা দিয়ে বেঁধে কাঁধের উপর তুলে আর টাঙ্গিটা হাতে নিয়ে ডরানির কিনারা ধরে এগিয়ে যাবার জন্য তৈরি হয় দাও। বোঝাটা দশ সেরের কিছু বেশি হবে বলে মনে হয়। অন্ধকারের মধ্যে দাশুর চোখের খুশিতে একটা প্রতিজ্ঞার জয় ঝিক করে হেসে ওঠে। তার পরেই শিউরে ওঠে দাশুর চোখ।
গাছের আড়াল থেকে দাশু ঘরামির ছায়াময় কালো চেহারার দিকে তাকিয়ে জ্বলজ্বল করছে একটা সবুজ আগুনের চোখ, তার পাশেই একটা নিভু নিভু চোখ।
কানারানী! থমকে দাঁড়ায় আর কেঁপে কেঁপে বিড় বিড় করে দাশু। তারপর আর এক মুহূর্তও দেরি করে না। ডরানির খাতের ঘন অন্ধকারের কাছে বুকের সব কাপুনি আর উদ্বেগ উৎসর্গ করে দিয়ে আস্তে আস্তে চলতে থাকে।
ডাঙার কাছে এসে উঠতেই আর একবার দেখতে পায় দাশু, একটু দূরে ডাঙার ঘাসের উপর লুটিয়ে পড়ে রয়েছে একটা নিভু নিভু চোখ, আর একটা জ্বলজ্বলে চোখ। যেন পাছোঁয়া মাটির গন্ধ শুকতে চায় কানারানী।
ছুটে ছুটে চলতে থাকে দাশু। ডরানির ছোট পুলের কাছে এসে পৌঁছতেই দেখতে পায়, পুলের তলা থেকে হুট করে বের হয় কানারানীর ছায়া সেই খানাপিনার বাঁশবনের দিকে চলে গেল। হাঁপ ছেড়ে ওঠে দাশুর মুখ। কানারানী সত্যিই যে পথ দেখিয়ে পৌঁছে দিয়ে গেল। বড় দয়া কানারানীর!
তারপর ঈশান মোক্তারের কুঠি। ওজন করে বার সের কাচা আঁশের বদলে আড়াই সের চাল দিয়ে দিল ভাণ্ডারের সরকার। ভোলা রসিদার আশ্চর্য হয়ে হেসে ফেলে-তুই বাঘের চেয়েও জবর জানোয়ার বটিস দাশু!
তারপর, সেই জীর্ণ জামকাঠের দরজা। দরজার ফাঁকে ভিতরের আলো দেখা যায়। কপাটে হাত বুকে আস্তে আস্তে ডাক দেয় দাশু–মুরলী।
কপাট খুলে দেয় মুরলী। ঘরে ঢুকেই উনানের দিকে তাকায় দাশু। হ্যাঁ, ঠিকই, মুরলীর প্রতিজ্ঞা একটুও ক্লান্ত বা বিচলিত হয় নি। ঠাণ্ডা উনানের উপর শুন্য হাঁড়ি, দাশু ঘরামির প্রাণের অহঙ্কারকে ঠাট্টা করে মিথ্যে করে দেবার আশায় একটা প্রতিজ্ঞা চোখে মেলে তাকিয়ে রয়েছে।
গামছায় বাঁধা চালের পোঁটলাটা উনানের কাছে ধপ করে ফেলে দিয়ে হাঁপ ছাড়ে দাশুআড়াই সের চাল আছে।
মুরলী-কোথায় পেলে?
দাশু–জিউ-জান দিয়ে খাটলাম, তাই পেলাম।
নাকে কাপড় দিয়ে মুরলী বলে–শিশাল পিটেছে মনে হয়।
দাশু–হ্যাঁ। ভুল করে একটু দেরি করে ফেললাম। না হলে আরও আগেই আসতাম।
মুরলী-কে তোমাকে দয়া করে খাটতে দিলে?
দাশু চেঁচিয়ে হেসে ওঠে-মানুষ নয়, মানুষ নয়, বাঘিন কানারানী দয়া করেছে।
শিশালের রসে ভিজে পিছল হয়ে রয়েছে দাশু ঘরামির বুক পিঠ আর কাঁধ। ঘরের বাতাসও যেন কড়া দুর্গন্ধের জ্বালায় হাঁসফাস করছে। কাটার খোঁচায় রক্তাক্ত দাশুর পায়ের পাতায় এখনো ভেজা-ভেজা রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। মুরগীর চোখ দুটো শক্ত হয়ে মধুকুপির মনিষের এই প্রচণ্ড মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকে।
-তুই এবার একটু হাস দেখি, মুরলী। একজোড়া ভয়ানক উল্লাসের চোখ কাঁপিয়ে হাসতে থাকে দাও।
-কেন হাসবো? মুরলী ভ্রূকুটি করে বিড়বিড় করে উঠতেই মধুকুপির আকাশটা পাল্টা ধমক দিয়ে গরগর করে বেজে ওঠে।
হাঁক ছেড়েছে কানারানী। বড়কালুর আর ছোটকালুর চটানে আহত হয়ে কানারানীর হুঙ্কারের প্রতিধ্বনি এদিক থেকে ওদিকে গড়িয়ে গড়িয়ে বাজতে থাকে।
কাঁপতে কাঁপতে দাশুকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে মুরলী-আমি হাসতে পারবো না।
মুরলীকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে; আর নীরব হয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে দাও। মধুকুপির আকাশের বুক কাঁপানো সেই প্রচণ্ড পাশব হুংকারের গরগর শিহর ক্ষীণ হতে হতে বাতাসে মিলিয়ে যায়। শুধু শোনা যায়, সড়কের নিমগুলি স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে ঝুরঝুর আরামের শব্দ করছে; আর হাই তুলে গা ভাঙছে বাঁশের ঝাড়কট কট, পট পট, কট কট।
শিশালের রসের তীব্র বোটকা গন্ধ মেখে দাশুর যে ভয়ানক উল্লাসের বুক বাঘ বাঘ গন্ধ ছাড়ছে, সেই বুক শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মুরলীর বুকের থরথর কাঁপুনিও আস্তে আস্তে থিতিয়ে, শেষে একেবারে শান্ত হয়ে যায়। দাশুর মুখে সেই অদ্ভুত হাসিও ধীরে ধীরে নরম হয়ে আসে। একটা হঠাৎ-মায়ার আবেশে দাশুর গলার স্বরও গলে যায়। মুরলীর কানের কাছে মুখ এগিয়ে দিয়ে আদুরে সুরে ফিসফিস করে দাশু : খুব হাসতে পারবি। আমি থাকতে তোর কিসের এত ডর?
মুরলীর থরথর ভয়ের বুকটা এইবার যেন হঠাৎ-ঘৃণার জ্বালায় ছটফটিয়ে ওঠে। মধুকুপির মনিষের জীবনটা বাঘ বাঘ গর্বের বোটকা নিঃশ্বাস ছাড়ছে। দাশুর বুকটাকে হঠাৎ একটা ঠেলা দিয়ে দু-পা পিছিয়ে সরে দাঁড়ায় মুরলী।
গামছায় বাঁধা আড়াই সের চাল; পোঁটলাটার দিকে তাকিয়ে মুরলীর চোখ দুটো দপদপ করে। মুরলীর কল্পনার একটা হিসাবের সুখ নষ্ট করে দিয়েছে এই আড়াই সের চালের পোঁটলা। মুরলীর জীবনের যে সাধের জেদ কঠোর গর্বে অনড় হয়ে বসেছিল, সেই জেদ চূর্ণ করে দিয়ে পোঁটলাটা যেন হাসছে আর ঠাট্টা করছে। মিছা এত হিসাব করলি মুরলী, তোর ছাড়া পাওয়ার পথ নাই। এখন চুপটি করে মধুকুপির কিষাণী মাগটি হয়ে, কিষাণ ভাতারের বাঘা খাটুনির ওই উপহার, ওই চাল এখন হাঁড়িতে চড়িয়ে ভাত রাঁধতে লেগে যা।
দাশু বলে–কি হলো?
উত্তর না দিয়ে চুপ করে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মুরলী। হেসে ফেলে দাশু কানারানীর ধমক শুনে ভয় পেলি, কিন্তু আমার উপর রাগ করিস কেন?
রুক্ষস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী-বাঘিনটা আমাকে ধমকাবে কেন? ওটা কি আমার শাশুড়ি বটে?
হো হো করে চেঁচিয়ে হেসে ওঠে দাশু। দাশুর পাথুরে বুকটা যেন একটা অদ্ভুত খুশির উচ্ছ্বাস সহ্য করতে গিয়ে নাচতে থাকে। কী চমৎকার একটা কথা বলে ফেলেছে মুরলী। দাশুর হাসি থামতে চায় না। মুরলীর কালো চোখের তারা দুটো আরও ক্ষুব্ধ হয়ে দাশুর এই বিনা নেশার উল্লাস দেখতে থাকে।
দাশু বলে হা রে, কানারানী তোর শাশুড়ি বটে। তা না হলে…।
ভ্রুকুটি করে তাকায় মুরলী : তা না হলে কি?
দাশু–তা না হলে ওটা আমাকে ওর ছেইলা বলে মানে কেন, এত দয়াই বা করে কেন?
মুখ টিপে হাসে মুরলী, আর মুখ ঘুরিয়ে হাসি লুকোয়। দাশু বলে-তুই হাসছিস, কিন্তু ভুলিস কেন যে…।
মুরলী আশ্চর্য হয় কি?
দাশু–মনে করে দেখ, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যেরাতে ঘরে এলাম, সেরাতে আমি তোর উপর মিছা রাগ করে ঘর ছেড়ে চলে যেতে হাঁটা দিয়েছিলাম। তুই কেঁদেছিলি চেঁচিয়েছিলি; সে রাতে কে তোকে দয়া করেছিল? সে রাতে আমাকে চলে যেতে পথ দেয় নাই কে? সে রাতেই যে তোর পেটে ছেইলা এল, মনে নাই কি?
আবার মুখ ঘুরিয়ে হাসি লুকোয় মুরলী। দাশু বলে কানারানীকে বাঘিন মনে করবি না।
ঠোঁট খুলিয়ে ঠাট্টা করে মুরলী : বনদেবী বটে।
দাশুনমাতা বটে। বরাকরের সেই মাতা বুড়ি, এক রাতের মধ্যেই যে বুড়ির ছেইলা, ছেইলার মাগ আর নাতি মরে গেল। বুড়িও গা ছেড়ে দিয়ে সেই যে জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে ঢুকলে, আর বুড়িকে কেউ দেখতে পায় নাই।
মুরলী-মরে গিয়েছে বুড়ি।
দাশু–না, মরে নাই। আমার কথা বিশ্বাস না হয়, সনাতন লাইয়াকে শুধায়ে দেখিস। তুক মন্তর করে মাতা বুড়িটাই বাঘিন হয়ে গেল। কানারানীর ছেইলা আছে; ছেইলাটিও বাঘিন আছে। নটুবর বলে কানারানীর নাতিও আছে। মুরু পাহাড়ের জঙ্গলে ওরা থাকে। বিশ্বাস না হয় বড় বুড়া রতনকে শুধায়ে দেখিস।
গা-ঝাড়া দিয়ে জোরে একটা হাই তুলে হেসে ফেলে দাশু বলে : কে জানে, আমাকেও কেন ওর ছেইলা বলে মনে করে কানারানী! আমার ঘরের উপর কেন ওর এত দয়া?
মধুকুপির কিষাণের এই অদ্ভুত বিশ্বাসের গল্প শুনতে একটুও ভাল লাগে না মুরলীর। সিস্টার দিদি কতবার এসে কত কথা বলে আর হেসে হেসে ঠিক এইসব জংলী বিশ্বাসের ময়লা ধুয়ে ফেলতে বলেছে। চুপ করে বসে আঙুলের নখ দিয়ে মেঝের মাটির উপর দাগ কাটে মুরলী।
দাশু বলেনে, আর দেরি করিস না। অনেক রাত হযেছে, এইবার বেঁধে ফেল।
মুরলী–না।
বড়কালুর পাথরের চটান সেই মুহূর্তে প্রচণ্ড শব্দ করে গুমরে ওঠে। হাঁক ছেড়েছে কানারানী। হাঁকের পর হাঁক, মধুকুপির অন্ধকার আর বাতাসকে যেন কামড় দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ভয়ানক ধমকের শিহর ছড়িয়ে দিচ্ছে। গর্জনের রেশ সড়ক ধরে গড়িয়ে গড়িয়ে পাকুড়তলা দিয়ে এই ঘরের দিকে ছুটে আসছে।
ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে মুরলী। একটা লাফ দিয়ে সরে এসে দাশুর হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আর কেঁদে ফেলে।
কিন্তু দাশু হেসে ফেলে : নে মিছা রাগ করে না বললি, আবার শাশুড়ির ধমক খেলি?
মুরলীর মাথায় হাত বোলায় দাশু। তারপরেই হাত ধরে মুরলীকে টেনে নিয়ে এসে উনানের কাছে বসে? নে ঝটপট ভাত বেঁধে ফেল। কতক্ষণ না খেয়ে আছিস, তোর কি নিজের জিউ-জানের লেগেও একটুকু ডর নাই?
উনানের কাঠের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। হাঁড়িতে চাল ছাড়ে মুরলী। আর দাশুও তার জীবনের এক নতুন বিশ্বাসের আহাদকে যেন দাউ দাউ করে হাসিয়ে মুরলীর কানের কাছে বাজাতে থাকে ও বড় মজা হয়েছে মুরলী। কানারানীর ডরে জঙ্গলের সব গার্ড, সব বেটা ঠিকাদার ভেগেছে। কেউ আর এই তল্লাটে নাই।
মুরলী আশ্চর্য হয়ে তাকায়। তাতে তোমার মজার কি হলো?
দাশু–টিকিট নিতে হবে না, দস্তুরি দিতে হবে না, ভাগ দিতেও হবে না। জঙ্গলের মাল আনবো আর বেচবো। বড় দয়া কানারানীর।
উনানের আগুনের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকে মুরলী। মুরলীর মুখটা থেকে থেকে কেঁপে ওঠে। চোখে হতাশার জ্বালা ছলছল করে। সত্যিই কি কানারানীর দয়ার জোরে মধুকুপির কিষাণের একটা বাঘা বাঘা গর্ব আর সৌভাগ্য মুরলীর অদৃষ্টকে স্বপ্নছাড়া করে এই ঘরের ভিতরে চিরকাল আটক করে রাখবে?
দাশু বলে-মুখটা ঘুরিয়ে নে মুরলী; মিছা ধোঁয়া লাগিয়ে চোখ দুটোকে জ্বলাস কেন?
মুখ ঘুরিয়ে নেয় মুরলী।
একটা দুটো দিন নয়, পর পর অনেকগুলি দিন, প্রায় একটা মাস ধরে দাশু ঘরামির টাঙ্গি আর পাতুরে শরীরের খাটুনি যেন এক-একটা মত্ততার উৎসবের মত মাতামাতি করে মুরলীর আশা হিসাব আর কল্পনাকে ভয় পাইয়ে চুপ করিয়ে রাখে। কোনদিন চাল, কোনদিন মকাই, কোনদিন মাষকলাই এনে ঘরের শূন্য সরা ডালা আর ঝোরা ভরে ফেলে দাও।
মধুকুপির আকাশে কালো কালো শাওন মেঘ ভেসে বেড়ায়, আর মাঝে মাঝে খুব জোর বৃষ্টি ঝরায়। বড়কালুর বুকের মরা ঝরনার দাগটা আবার প্রাণটা পেয়ে কলকলিয়ে ওঠে।
বড়কালুর পায়ের কাছে বহেড়ার জঙ্গলে সারা রাত ঘরে যে আগুনটা জ্বলেছিল, সেই আগুন শাওনের এক পশলা ঝরানিতে নিভে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে নিশ্চয়। তাজা বহেড়ার গাছগুলি কালো কাঠকয়লা হয়ে জঙ্গলের বুকে ছড়িয়ে আছে। এই তো সুযোগ।
ভোর না হতেই বের হয়ে যায় দাও; আর, এক ক্রোশ বুনো পথ প্রায় এক দৌড়ে পার হয়ে গিয়ে পোড় জঙ্গলের বুকের ভিতরে গিয়ে ঢোকে। টুকরো টুকরো কাঠকয়লার প্রকাণ্ড বোঝা শালপাতা দিয়ে জড়িয়ে আর লতা দিয়ে বেঁধে মাথায় বয়ে নিয়ে আসে। সোজা গিয়ে ঈশান মোক্তারের কুঠিতে কাঠকয়লার বোঝা আছাড় দিয়ে ফেলে। এক বেলার খাটুনির জোরেই সের দুই চাল রোজগার করে ঘরে ফিরে আসে দাও।
তিন-চারটে দিন কাঠকয়লা টেনে টেনে পার করে দেবার পর আবার ভাবতে হয়। মধুকুপির আকাশের মেঘের দিকে, আর মধুকুপির চারদিকের যত জংলা সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকে দাও। মধুকুপির ডাঙা আর ক্ষেতগুলির দিকেও তাকায়।
মনে পড়ে, বহেড়া জঙ্গলের কাছে, যেখান থেকে নতুন রেললাইনের গুরুগুর শব্দ খুব স্পষ্ট করে শোনা যায়, সেখানে শত শত কচি আর বুড়ো খয়ের গাছে একটা জটলা লুকিয়ে আছে। কে জানে, গোবিন্দপুরের কোন্ বাবুর ইজারা হয়ে আছে ওই খয়েরের জটলা?
টাঙ্গিটাকে শানিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায় দাও। পর পর সাত দিন ধরে খয়েরের ডালপালা আর ধড়ের বড় বড় বোঝা ঘাড়ের উপর তুলে নিয়ে ঘরে ফিরে আসে। মুরলী শুধু ঘরের দাওয়ার উপর চুপ করে বসে তাকিয়ে থাকে। দুটো বড় বড় উনান তৈরি করে আর উনানের উপর বড় মাটির হাঁড়া বসিয়ে খয়ের জ্বাল দেয় দাও। খয়েরের কালো কাথ টগবগিয়ে ফোটে। দাশু একাই কাঠের হাত চালিয়ে কাথ ঘাটে। আর, দুটো দিন পরে দুই হাঁড়া চিটা খয়ের ঈশান মোক্তারের ভাণ্ডারে নিয়ে গিয়ে ফেলে। বেশি দরাদরি করে না দাশু। খয়েরের বদলে আধ মণ মকাইয়ের একটা বোঝা কাঁধে বয়ে নিয়ে ঘরে ফিরে আসে।
মাঝে মাঝে, টাঙ্গিটাকে অলসভাবে কাঁধের উপর ফেলে দিয়ে মধুকুপির ক্ষেতের আলের উপর দিয়ে অলসভাবে ঘুরে বেড়ায় দাশু। ঘরে চাল আছে, মকাই আছে; ভাবনা করবার কিছু নেই। দাশুর দুই চোখ যেন আবার সেই পুরনো স্বপ্নে বিভোর হয়ে মধুকুপির মাটি আর কাদার রঙ খুঁজে খুঁজে ঘুরতে থাকে। কোথায় কালো কালো দো-আঁশ, কোথায় সাদাটে বেলে, আর লালচে এঁটেল? দাশুর চোখের দৃষ্টি মাঝে মাঝে থমকে যায়। রানির বাঁকের উত্তর দিকে কী চমৎকার বেলে মাটির গরাঞ্জি এই শাওনেও একেবারে নেড়া হয়ে পড়ে আছে। ছি! কুঠি যদি একটা চিঠা দিত, আর বীজ লাঙ্গল দিত, তবে দাশু যে একা খেটে ওই গরাঞ্জির পাঁচ বিঘা ভরে বেরো ফলাতে পারতো।
অলসভাবে হেঁটে, যেন মধুকুপির মাটির গন্ধে নেশা জমাবার জন্য এক অদ্ভুত পিপাসা নিয়ে ঘুরতে থাকে দাও। অত দুরে কেন, এই তো কত কাছে, পাকা সড়কটার লাগান একটা ঢালুর এটেল বৃষ্টির জলে গলে গিয়ে কেমন সুন্দর লালচে কাদা হয়ে পড়ে রয়েছে। এই জমিটার বিঘা পাঁচেক জমা নিলে ভাল হয়। ধুন্দুল, শশা আর করলা ফলবে ভাল। আর, কার্তিকের শিশির পড়তেই দু বার হাল ফিরিয়ে চষে নিয়ে কপি আর মটর করা যেতে পারে। চারদিকে জিরা ছড়িয়ে দিতেও পারা যাবে। কিন্তু তার আগে ধঞ্চে বুনে একবার মাটির জো পাকিয়ে নিতে হবে, আর চাই গুলঞ্চের বেড়া।
আগে জমা চাল ফুরিয়ে যায়, তারপর মকাইয়ের দানা। সেদিন আবার টাঙ্গিকে শান দিতে দিতে মুরলীর মুখের দিকে তাকায় দাশু : তুই কি ভাবছিস?
মুরলী–কিছু না।
দাশু–ভাবছিস, মকাইয়ের দানা ফুরিয়ে গেল, এইবার কিষাণটা জব্দ হবে।
চমকে ওঠে মুরলী। মুরলীর মনের হিসাবও হঠাৎ বোকা হয়ে যায়। মধুকুপির কিষাণের চোখ দুটোকে যত বোকা মনে করেছিল মুরলী, তত বোকা তো নয়। মুরলীর এই থমথমে মুখভার, ভ্রূকুটি আর সারাদিনেব আনমনা চাহনি দেখে বুঝতে পেরেছে দাশু, মুরলী এখনও যেন দাশুর এই অহংকারের পতন দেখবার জন্য মনে মনে একটা আশা ধরে রেখেছে। দাশু হাসে : তুই মিছা ভেবে মনটাকে দুখাস কেন মুরলী? আমি জব্দ হব না।
অবিশ্বাস করতে পারে না মুরলী। তাই দাশুর এই নরম ঠাট্টার শক্ত খোচা খেয়েও মুরলীর চোখে আর ভুকুটি শিউরে উঠতে পারে না; দাশুর এই প্রচণ্ড খাটুনির মাতলামি দেখে মায়া হলেও চোখে জল আনতে পারে না। কিন্তু দাশুর হাসির সঙ্গে সায় দিয়ে হাসতেও পারে না।
–আমি আসছি। টাঙ্গিটা কাঁধে তুলে ঘর থেকে বের হতে গিয়েই চমকে ওঠে, আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায় দাশু। কড়কড় করে একটা বাজ ফেটেছে। ডাঙার তালগাছে মাথার উপর চিলের ঝাক এলোমেলো হয়ে উড়ছে। আর, কালো মেঘের চাপ গলে গিয়ে জটার মত লম্বা হয়ে কপালবাবার জঙ্গলের উপর ঝুলছে। মধুকুপির ক্ষেত মাঠ আর জঙ্গলের সব সবুজ যেন কালিমাখা হয়ে ঘুটঘুট করছে। মধুকুপির সকালবেলা অন্ধকার ঢাকা পড়ে সন্ধ্যার চেয়েও বেশি কালো হয়ে গিয়েছে।
ডাঙার তালগাছগুলিকে প্রায় শুইয়ে দিয়ে একটা ঝড় ছুটে এল। শিলা ঝরতে থাকে। কনকনে ঠাণ্ডা বরফের গোলকের মত এক-একটা আধসেরী শিলা। ঈশান মোক্তারের খাটালে গরুর চিৎকার করুণ হয়ে ছটফট করতে থাকে। তার পরেই শাওনের অঝোর বৃষ্টির শব্দে মধুকুপির সব শব্দ চাপা পড়ে যায়।
জামকাঠের দরজার কাছে চুপ করে এক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে দাশু। আর ঘরের ভিতরে খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর গম্ভীর মুরলী।
এই বৃষ্টি কি থামবে? দাশুর ভাবনার এই প্রশ্নটাকে যেন ঠাট্টা করে চমকে দিয়ে মধুকুপির আকাশে একটা বিদ্যুতের চমক লিকলিকিয়ে উঠল। তার পরেই আরও জোর বৃষ্টি। দেখতে থাকে দাশু, পাকা সড়কটা যেন একটা স্রোতের ঢল হয়ে গলে গলে ভেসে যাচ্ছে।
কতক্ষণ চুপ করে জামকাঠের দরজার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে দাশু, সেকথা মনে পড়তেই দাশুর ভাবনা দুরুদুরু করে কেঁপে ওঠে। বেশ বেলা হয়েছে, নিশ্চয় চার-পাঁচ ঘণ্টা পার হয়ে গিয়েছে। দেখতে পায় দাশু, একটা মাকড়সা এরই মধ্যে দাশুর হাতের স্তব্ধ টাঙ্গি আর দাশুর মাথার চুলের সঙ্গে একটা জাল জুড়ে দিয়ে তরতর করে আসছে যাচ্ছে আর নাচছে। দাশুর ভাগ্যটা কি আবার একটা পরীক্ষার ভ্রুকুটি দেখতে পেয়ে ভয় পেয়েছে আর অনড় হয়ে গিয়েছে? তা না হলে এই মাকড়সাটা কেন…।
মুখ ফিরিয়ে ঘরের ভিতরে তাকায় দাশু। চমকে ওঠে। ঠাণ্ডা উনানের উপর হাঁড়ি চাপিয়ে উনানের কাছে চুপ করে বসে আছে মুরলী। আঙুলের নখ দিয়ে মেঝের মাটিতে দাগ কাটছে। মুরলীর জীবনের হিসাব আবার দাশু ঘরামির অহংকার ভাঙবার আশায় যেন নতুন হাসি হাসছে।
বিদ্যুৎ চমকায়; দেখতে পায় দাশু, হ্যাঁ ঠিকই, মুরলী যেন মাথা হেঁট করে মুখ লুকিয়ে হাসছে। আজ দাশু ঘরামির এই সাধের ঘর উপোস করবে। এক দানা চাল আনবার সাধ্যি নেই, উপায় নেই দাশুর। আজ আবার মুখ টিপে হেসে হেসে দাশুকে প্রশ্ন করতে পারবে মুরলী, কি গো মধুকুপির কিষাণ, মুরলীকে এইরকমটি না খাইয়ে জ্বালালে তোমার ছেইলাটা বাঁচবে তো?
বৃষ্টির ঝরানির শব্দ ছাপিয়ে আর একটা শব্দ। এই শব্দ যেন বড়কালু আর ছোটকালুর সব পাথর গুঁড়ো করে দিয়ে, মধুকুপির ডাঙার পাঁজর কাঁপিয়ে আর গড়িয়ে গড়িয়ে ছুটে আসছে।
–হুড়পা বান! চেঁচিয়ে ওঠে দাশু। সেই ভয়ানক শব্দের হুড়মুড়ে গড়ানির মধ্যেই চাপাচাপা দুরের আর্তনাদের মত একটা চাপা-চাপা করুণ কলরোল শোনা যায়।-হড়পা বান! হুড়পা বান! সারা মধুকুপির আতঙ্কিত মানুষ চিল্কার করছে আর ঠেঙার বাড়ি মেরে টিন পিটিয়ে হুড়পা বানের হুঁশিয়ারি জানান বাজাতে শুরু করেছে।
পাগল হয়েছে ডরানি। জানে দাশু, বছরে অন্তত একটি দিনে ডরানি এই পাগলপারা কাণ্ডটি করে। কম করে দশটি পাহাড়ের গা থেকে জলের ঢল গড়িয়ে পড়ে ডরানির জলকে হঠাৎ ফুলিয়ে ফঁপিয়ে পাগল করে দেয়। দশ হাত উঁচু জলের হুড়পা নিয়ে দু পাশের জঙ্গল ভেঙে ভাসিয়ে গড়িয়ে আর ঠেলে ডরানির বান ছুটে এসে ঠিক এই মধুকৃপির ক্ষেত আর ডাঙার উপর ছড়িয়ে পড়ে। কিষাণের ঘরের আঙিনার ভিতরেও কলকল করে জলের তোেড় তেড়ে আসে। মাঝে মাঝে মাচানের মানুষও মাচানের সঙ্গে টলমল করে জলের উপর পড়ে। কেউ বাঁচে, কেউ বা লাস হয়ে ভেসে চলে যায়। এক হাঁটু জলের তোড়েও রোগা গরুমহিষ হাঁটু ভেঙে পড়ে যায় আর ভেসে যায়।
চুপ করে দাঁড়িয়ে কি-যেন ভাবে দাশু। কি-যেন মনে পড়েছে দাশুর। ঘরের ভিতর থেকে চোপের দড়ির একটা পুটলি হাতে তুলে নিয়ে বের হয়ে আসে দাশু। তারপর সেই শাওনে বৃষ্টির অঝোর ধারার ভিতর দিয়ে ছুটে চলে যায়।
ডরানির ছোট পুলের কাছে এসে যখন থমকে দাঁড়ায় দাশু, তখন বৃষ্টির জোর একটু ক্লান্ত হয়ে এসেছে। কপালবাবার জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে কি-যেন বিড়বিড় করে দাশু। তার পরেই সড়ক থেকে নেমে ডরানির জলের কিনারায় এক হাঁটু জলের উপর শক্ত হয়ে, চোপের দড়ির মুখে ঢেলা বেঁধে নিয়ে মেছুয়া শিকারীর মত তাক করে দাঁড়িয়ে থাকে।
এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় না। দাশুর কল্পনার আশাকে যেন অজস্র দানে ভরে দেবার জন্য বানভাসি ডরানির জলের উপর দিয়ে বাঁশের ছোট ছোট টাল ভেসে আসতে থাকে। দড়ি ছেড়ে দাও। একবার, দুবার, তিনবার। দুবার ব্যর্থ হয়, তিনবারের খেপ ব্যর্থ হয় লো। বাঁশের একটা বড় টাল আটক করে ডাঙার উপর টেনে তোলে দাশু।
বাঁশের টাল টেনে নিয়ে গিয়ে ঈশান মোক্তারের ভাণ্ডারে জমা দিতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে না। তারপর আড়াই সের চাল নিয়ে মধুকুপির সেই জামকাঠের দরজার কাছে গিয়ে আবার দাঁড়াতে আধ ঘণ্টারও কম সময় লাগে।
দাশু চেঁচিয়ে ওঠে—উনানে আগুন দে মুরলী।
উনানে আগুন দেয়, হাঁড়িতে চাল ছাড়ে মুরলী। তার পরেই হাঁটুতে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলে।
জাহির থানে মোরগ বলি দিয়ে ঘরে ফিরে আসে দাশু।
মুরলীকে একবার শুধাতে ইচ্ছা করে দাওর; এটা তোর কি রকমের ঢং বটে?
হ্যাঁ টং বটে, কিন্তু ঠিক মুরলীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ঢং বলে মনে হয় না। যেন কোন এক প্রচণ্ড তামাসার আত্মা মুরলীর চোখ আর মুখের উপর খেয়ালের ছায়া ফেলে খেলা করছে। তা না হলে এরকম কাণ্ড করবে কেন মুরলী? মুরলীরই মরদ তার এই অদ্ভুত রকমের শক্তশক্ত হাড়মাসের জাদু দিয়ে তৈরি হাত-পায়ের খাটুনি; পাথরের পাটার মত পোক্ত বুকের সাহস, আর শান দেওয়া একটা নির্ভয় টাঙ্গির জোরে দুর্ভাগ্যের এক-একটা কঠোর মতলব ছিন্নভিন্ন করে এই ঘরের প্রাণকে উপোস করা কষ্টের জ্বালা থেকে বাঁচাবার জন্য চাল আর মকাই নিয়ে আসে, তখন কেন কেঁদে ফেলে মুরলী? আর ঘরের ডালা ও সরা যখন শুন্য হয়ে যায়, যখন চাল আর মাইয়ের শেষ দানাও ফুরিয়ে যায়, তখন কেন মুরলীর মুখটা হেসে ওঠে?
নিজেকেও একবার শুধাতে ইচ্ছা করে দাশুর, মধুকুপির কিষাণেরও প্রাণের ঢং এমনতর হয়ে গেল কেন? মুরলী যখন কেঁদে ফেলে, তখন দাশুর মুখটা কেন অদ্ভুত এক অহংকারের আরামে হেসে ওঠে? আর মুরলী যখন মুখ টিপে হাসে, তখন ভয় পেয়ে দুরুদুরু করে কেঁপে ওঠে কেন দাশু কিষাণের পাথুরে বুক?
ছোট মধুকুপির গেঁয়ো প্রাণ আর চেহারার উপরেও কদিন ধরে একটা প্রচণ্ড তামাসার আত্মা যেন খেয়ালের ছায়া ফেলে ফেলে খেলা করছে। মধুকুপির আকাশ রোদের জ্বালায় পুড়ে পুড়ে হাসে, আর মধুকুপির মাটি বানভাসির জলে ড়ুবে আর ভিজে গিয়ে ছলছল করে। পূব আর দক্ষিণের দিক সবচেয়ে বেশি ভেসেছে। বাবলা বনে এক বুক, আর ঢালুর ক্ষেতগুলির উপর এক কোমর জল। উঁচু উঁচু ডাঙার পিঠগুলি শুধু ভেসে আছে। তার উপর শকুনের ঝক জিরোয়। কপালবাবার জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যাবার উপায় নেই। সব খাত জলে ভরে আছে। সাবাই ঘাসের এত বড় জঙ্গলটা পচেই যাবে বলে মনে হয়। পলাশবনের গা ঘেঁষে ড়ুবো ডাঙ্গার উপর বড় বড় জয়টাকের মত মরা গরুর ফোলা-ফাঁপা লাস ভাসে; আর ডাঙার শকুন উড়ে এসে ডানা ধড়ফড়িয়ে পলাশের পাতা ঝরায়।
শুকনো শুধু পশ্চিমটা আর উত্তরটা। নেড়া নেড়া পাথুরে ঢিবি আর কাকুরে ডাঙা ধরে যত খুশি এগিয়ে যেতে পারা যায়, সোজা ভুবনপুর পোঁছে যাওয়া যায়, পায়ে এক ছিটে কাদা লাগবে না। কারণ কাদাই নেই; কটা দিনের শাওনে ঝরানিতে মাটি গলেছিল ঠিকই, কিন্তু এই কদিনের রোদের ঝাঝে সেই গলানি এখন শুকিয়ে খটখটে হয়ে গিয়েছে।
টাঙ্গিটা কাঁধে নিয়ে মিছে তিনটে দিন এদিক ওদিক ঘুরে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মিছে ছুটোছুটি করে ঘরে ফিরে এসেছে দাশু। জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যাবার পথগুলি যদি জলে ড়ুবে না থাকত, তবে অন্তত এই কদিনের মধ্যে মণ দুয়েক বুনো লতা উপড়ে নিয়ে এসে, ছেঁচে পিটে আর পাকিয়ে এক গাদা দড়ি তৈরি করে, আর গিরিমাটি দিয়ে সুন্দর করে রাঙিয়ে নিয়ে ঈশান মোক্তারের ভাণ্ডারে জমা দিতে পারা যেত। কম করেও পাঁচ সের চাল দিত ঈশান মোক্তারের ভাণ্ডারী। কিন্তু মিছে আশা। টাঙ্গি হাতে নিয়ে ডরানির ছোট পুলের কাছে দাঁড়িয়ে আর জঙ্গলের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ঘরে ফিরে এসেছে দাশু।
চার দিনের পর সেই দিন, শেষ এক পোয়া চাল আধ হাঁড়ি জলে ফুটিয়ে নিয়ে ফেনভাত খেয়ে সেঁকুর তুলতে গিয়েই চমকে ওঠে দাশু; আর, মুরলী যেন ভেঁকুর চাপা দিতে গিয়ে হেসে ফেলে।
সে রাতের ঘুমটাও বার বার ছিঁড়ে যায়। দাশুর চোখের উপর অদ্ভুত এক ভয়ের জ্বালা বার বার ছটফট করে। মুরলীর কোমরের উপর হাত রাখতে ভয় করে। এক পোয়া চালের ফেনভাতের আধা ভাগ খেয়ে মানুষের ভুখ মরে না। মুরলীরও ভুখ মরে নি, মুরলীর পেটটা যেন ভয়ানক এক অভিমানে চুপসে রয়েছে। ঘুমন্ত মুরগীর পেটের উপর হাত বোলাতে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে দাশুর বুক। মুরলীর এই পেটের উপর চুমো খেতে গিয়ে যে ধুকপুক শব্দ শুনে কাল রাত্রিতেও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল দাশুর কলিজা, সেই ধুকপুক শব্দও কি চুপসে শান্ত হয়ে গেল? দাশুর ছেইলার প্রাণটাও কি উপোস সহ্য করতে গিয়ে অভিমান করে নিথর হয়ে গিয়েছে?
দাশুর চোখের জ্বালা ভিজে যায়। দু হাত দিয়ে ঘষে ঘষে চোখ মোছে দাশু।
ভোর হয়ে এল বোধহয়। কাক ডাকতে এখনও দেরি আছে। কিন্তু আর দেরি না করে এখনি বের হয়ে যাওয়া ভাল। খাটুনি খোঁজবার একটা উপায় বের করবার জন্য বেশি সময় পাওয়া যাবে। তা ছাড়া, ঠাণ্ডা উনানের উপর হাঁড়ি চড়িয়ে দাশুর মুখের দিকে অদ্ভুত রকনের
একটা দৃষ্টি তুলে তাকাবে মুরলী, সে দৃশ্য দেখবার আগেই বের হয়ে যাওয়া ভাল।
–শুনছিস মুরলী?
–কি বলছে?
–আমি বের হলাম।
মুরলীর হঠাৎ-জাগা চেতনার কোন ধিক্কারের শব্দ শোনবার আগেই, মুরলীর মুখে ঝিক করে সেই রহস্যের হাসি ফুটে ওঠবার আগেই টাঙ্গি কাঁধে নিয়ে বের হয়ে যায় দাশু।
কিন্তু বৃথা, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মধুকুপির খোলা সড়কের এক ক্রোশের হাওয়া আর আলোর মধ্যে দাশু যেন কয়েদীর মত লোহার বেড়ি দিয়ে বাঁধা একটা শাস্তির ভারে অসহায় হয়ে আস্তে আস্তে ঘুরে বেড়ায়; ছটফট করে আর মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে। বানভাসির জল সবে মাত্র সরতে শুরু করেছে। ডাঙার গা থেকে ঝরনার মত জলের ধারা নেমে খাতের ভিতর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। কে জানে আর কতদিন লাগবে, কবে সব জল আবার টেনে নেবে ডরানি, আর জঙ্গলে যাবার পথগুলি শুকিয়ে যাবে?
পলাশবনের কাছে উড়ন্ত শকুনের ঘয়া যখন সন্ধ্যার অন্ধকারে ঝাপসা হয়ে যায়, তখন আস্তে আস্তে হেঁটে ঘরে ফিরে আসে দাও। পুরনো জামকাঠের দরজার উপর হাতের ঠেলা দিয়ে একটা শব্দ করবার সাহসও দাশুর হাতের হাড়মাস থেকে যেন আলগা হয়ে ঝরে পড়ে। গিয়েছে। হাত কাঁপে, বুক কাঁপে দাশুর। পেটের ভিতরে ক্ষুধার জ্বালাটাও যেন ভয় পেয়ে সিরসির করে।
দাশুর জীবনের প্রতিজ্ঞা আজ হেরে গিয়েছে। শূন্য হাতে এই ঘরের ভিতরে ঢুকে আজ শুধু চুপ করে তাকিয়ে দেখতে হবে, মুরলীর মুখের সেই রহস্যের হাসি কাটারির শান দেওয়া হাসির মত জ্বলছে। আজ একেবারে শূন্য হাঁড়ি আর ঠাণ্ডা উনানের দিকে তাকিয়ে দাও ঘরামির এই সাধের ঘরের প্রাণ উপোস করবে, আর ঘুমোতে না পেরে ছটফট করে।
দরজা খুলে দেয় মুরলী। কিন্তু মুরলীর মুখের দিকে তাকায় না দাশু। খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর একটা আহত ও ক্লিষ্ট জীবনের পিণ্ডের মত অনড় হয়ে বসে থাকে।
মুরলীও কোন কথা বলে না। কিন্তু নিঝুম হয়ে মেঝের উপর বসেও থাকে না মুরলী। উঠে যায়; দাওয়ার উপর বসে অনেকক্ষণ ধরে দাঁতন করে আর মুখ ধুয়ে নিয়ে, তারপর ঢকঢক করে এক ঘটি জল খেয়ে যেন একটা শাস্তির হাঁপ ছাড়ে মুরলী। তারপর ঘরের ভিতরে ঢুকে শুয়ে পড়ে।
ছটফট করে উঠে দাঁড়ায় দাও; রেডির তেলের মেটে বাতিটাকে জ্বালিয়ে নিয়ে ঘরের দেয়ালের ও চালার ফাঁকে হাতড়ে হাতড়ে কি-যেন খুঁজতে থাকে।
মুরলী বলে-কি খুঁজছো?
দাশু–আমার কাড়বাশটা আছে কি নাই?
মুরলী–নাই।
দাশু–কেন?
মুরলী-পচে গিয়েছিল, ফেলে দিয়েছি।
তবু কি-যেন খুঁজতে থাকে দাশু। ধামন কাঠের ধনুকের সেই বাঁকটা কি নাই? ধনুকের ততটাও কি পচে গিয়েছে? এক গোছা তীরও তত ছিল।
–কি খুঁজছো? আবার মুখ ফিরিয়ে প্রশ্ন করে মুরলী।
–আমার ধনুকটা আর তীরগুলা কি নাই?
–আছে।
হ্যাঁ আছে। চালার বাঁশের সঙ্গে গোঁজা ধনুকটা আর তিনটা তীর নামিয়ে নিয়ে ধুলো ঝাড়ে দাশু। ধনুকের ছিলার তাঁত ছিঁড়ে গেলেও পচে যায় নি। আর তীরের ফলাগুলি মরচে পড়ে ময়লা হয়ে গিয়েছে, এই মাত্র।
ছিলার ছেঁড়া তাঁতে নতুন করে গিট বাঁধে দাশু। ধামনকাঠের বাকের দুই মুখ টেনে নতুন করে ছিলার ফাসে ফাঁসিয়ে ধনুকটাকে জীইয়ে তোলে। তীরের ফলার মুখগুলিকে ঘষে ঘষে চকচকে করে।
বাতির কাছে তীরের ফলা এগিয়ে নিয়ে দেখতে থাকে দাশু; দাশুর চোখের তারা দুটোও তীরের ফলার মত ঝিকঝিক করে জ্বলতে থাকে। যেন জীবনের এক ভয়ানক অভিশাপের কলিজা বিধে রক্তের ফোয়ারা ছড়িয়ে দেবার জন্য, আর সেই রক্তের লোনা স্বাদ পেট ভরে খেয়ে নাচবার জন্য দাশু কিষাণের চোখের তারায় একটা প্রচণ্ড বুনো আশা নাচতে শুরু করেছে। পেটের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে, বুকের একটা নিঃশ্বাস হঠাৎ যেন গুঁতো খেয়ে শিউরে ওঠে। কিন্তু উপোসের জ্বালা ভুলে গিয়ে একটা কল্পনার নেশায় খুটখাট করে খেলা করতে থাকে দাশু। অলস জিভটাকে এলিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে ঠোঁট চাটে।
একটা শব্দ। ঘরের নীরবতার গুমোট যেন মুখ লুকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠেছে। চমকে ওঠে দাশু। মুরলীর দিকে তাকায়।
মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে আর পাশমোড়া দিয়েছে মুরলী। দু হাতে মুখ ঢাকাও দিয়েছে। ঠিক বুঝতে পারে না দাশু, খিলখিল করে হেসে উঠল, না, খিলখিল করে কেঁদে উঠল মুরলী।
বাতি নিভিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকে দাশু। মধুকুপির রাতের প্রহরের সব ক্লান্তি যেন ঝিঁঝিঁর ডাকের সঙ্গে কান্না মিশিয়ে দিয়ে বাজতে থাকে। দাশুও জাগা চোখের একটা আক্রোশ ঘরের অন্ধকারে লুকিয়ে রেখে চুপ করে বসে থাকে। ভোর হতে আর বাকি কত?