০৬. ভোরবেলা মন্টু এসে উপস্থিত

ভোরবেলা মন্টু এসে উপস্থিত। তার চোখ লাল। জামা কাপড় কাদা-পানিতে মাখামাখি। খালি পা, চোখে-মুখে কেমন দিশেহারা ভঙ্গি। প্রথমেই দেখা হল এষার সঙ্গে। এষা বলল, ব্যাপার কি মামা?

মন্টু থমথমে গলায় বলল, ঐ ব্যাটা আছে না গেছে?

মিস্টার আগস্টের কথা বলছ?

হুঁ।

আমার কাছ থেকে একটা কথা শুনে রাখ। তার ত্রিসীমানায় যাবি না। ভুলেও। ব্যাটার কথা শুনে আমার জীবন সংশয় হয়ে গেল। আরেকটু হলে গাছ হয়ে যেতাম।

গাছ হয়ে যেতে মানে?

ইন ডিটেইলস কিছু বলতে পারব না। মাথা ঘুরছে। রেস্ট নিতে হবে। জুতা জোড়াও গেছে। নতুন জুতা, পাঁচশ টাকায় কেনা। এষা।

জি মামা?

আমি যে ফিরে এসেছি ঐ লোককে বলবি না। খবরদার না। ঐ লোক ডেনজারাস লোক। ভেরী ডেনজারাস। ভুজুং ভাজুং দিয়ে আমাকে প্রায় গাছ বানিয়ে ফেলেছিল।

তুমি এসব কি বলছ মামা।

মন্টু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। এষা বলল, মামা তুমি এক্ষুণি বাবার সঙ্গে দেখা কর। বাবা তোমার জন্যে অস্থির হয়ে আছেন। বাবার ধারণা, তোমার বড় রকমের কোন বিপদ হয়েছে।

বিপদ হতে যাচ্ছিল। অল্পের জন্যে বেঁচেছি।

মতিন সাহেব মন্টুর বক্তব্য মন দিয়ে শুনলেন। মন্টুর গল্প তিনি বিশ্বাস করছেন এমন মনে হল না। আবার অবিশ্বাস করছেন তাও মনে হল না। মতিন সাহেবের এক পাশে এষা অন্য পাশে মিতু। দুজনই গভীর আগ্রহে গল্প শুনছে। এষা গল্পের মাঝখানে দুবার হেসে ফেলল। মন্টু বলল, আরেকবার হাসলে চড় খাবি। একটা সিরিয়াস এক্সপেরিয়েন্স বলছি–আর তুই হাসছিস।

তারপর দুলাভাই শুনুন কি হল। ঐ ব্যাটা ফট করে আমার মাথায় গাছ হওয়ার আইডিয়া ঢুকিয়ে দিল। মনে হয় ম্যাসমেরিজম জানে। যা-ই হোক, গাছ হবার জন্যে আমি একটা ফাঁকা জায়গায় দুহাত উপরে তুলে দাঁড়ালাম। একটু ভয় ভয় করতে লাগল। কি গাছ হব তা জানি না। ব্যাটা কিছু বলে যায়নি। একটু দুঃশ্চিন্তাও হচ্ছে। আমার ইচ্ছা বটগাছ হওয়া। যা-ই হোক, দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বৃষ্টি। ঝুম বৃষ্টি। দাড়িয়ে আছি, পঁড়িয়ে আছি। কেমন অন্য রকম লাগছে। তারপর হঠাৎ লক্ষ্য করলাম পায়ের পাতায় কিড়বিড় করছে। শিকড় গজিয়ে যাচ্ছে বোধ হয়। আমি দিলাম এক লাফ …

এষা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।

মন্টু বলল, এষা তুই এখান থেকে চলে যা। তুই না গেলে গল্প শেষ করব না। কি রকম ইডিয়টের মত হাসছে।

এষা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে উঠে গেল। মতিন সাহেব একবারও হাসলেন না। শীতল গলায় বললেন, মন্টু তুমি গল্পটা গোড়া থেকে বল। কোন কিছু বাদ না

দিয়ে।

ডিকশনারী মুখস্থ থেকে শুরু করব?

ডিকশনারী মুখস্ত মানে?

ব্যাটা তো ডিকশনারী মুখস্থ করে বসে আছে–আপনি জানেন না?

না তো!

এতক্ষণ ধরে আপনাকে আমি কি বলছি–দুলাভাই? ডেঞ্জারাস লোক। ওকে এক্ষুণি বাড়ি থেকে বের করে দেয়া দরকার। তবে খুব ট্যাক্টফুলি কাজটা করতে হবে। ও যেন বুঝতে না পারে।

তুমি গল্পটা বল। আগে আমি গল্পটা মন দিয়ে শুনি। কিছুই বাদ না দিয়ে বলবে।

মন্টু গল্প শুরু করল।

মতিন সাহেব গভীর আগ্রহে গল্প শুনছেন। তাঁর চোখে পলক পড়ছে না।

এষা জুবায়েরকে টেলিফোন করেছে। এষা হাসির যন্ত্রণায় ঠিকমত কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। জুবায়ের বলল, ব্যাপার কি এত হাসছ কেন? হিস্টিরিয়া হয়ে গেছে না-কি?

হিস্টিরিয়া হবার মতই ব্যাপার। আমার ছোট মামা–মানে মন্টু মামা–উনি গাছ হয়ে গেছেন।

উনি গাছ হয়ে গেছেন। কি গাছ বোঝা যাচ্ছে না। উনার ইচ্ছা ছিল বটগাছ হওয়ার। হি-হি-হি…

কি বলছ ভালমত বল তো–গাছ হওয়া মানে?

এখনো পুরোপুরি হয়নি। পাতা বের হয়নি তবে শিকড় সম্ভবত গজিয়েছে।

হি-হি হি….

শোনো এষা, তোমার কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না।

তুমি চলে এসো। মামার কাছ থেকে গল্পটা শুনে যাও।

আমার একটা সমস্যা হয়েছে–অফিসে আটকা পড়েছি। এই মুহূর্তে আসতে পারব না। তুমি বরং এক কাজ কর, আমার এখানে চলে এস। গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। তারপর এক সঙ্গে তোমাদের বাসায় যাব। দুপুরে তোমাদের ওখানে। খাব–এবং তোমার মামার গল্প শুনব। রাখলাম, কথা বলতে পারছি না।

মতিঝিলের একটি হাইরাইজ বিল্ডিং—এ জুবায়েরের অফিস। এগারোতলা ফ্লোরের এক-চতুর্থাংশ। বিদেশী কায়দায় সুন্দর করে সব গোছানো। জুবায়েরের অফিস ঘরের বাইরে ছোট্ট কিউবিক্যালে অল্পবয়স্কা একজন তরুণী। বসার ভাব-ভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে হয় স্টেনো কিংবা রিসিপশনিস্ট। এষাকে দেখেই মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। মিষ্টি করে বলল, স্যার ভেতরে আছেন। আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। এষা এর আগেও দুবার এই অফিসে এসেছে। কোন মহিলা স্টেনো দেখেনি। মেয়েটিকে নতুন নেয়া হয়েছে।

এষ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।

জুবায়েরের ঘর ঠাণ্ডা। এয়ার কুলার চলছে। জানালার সানশেড নামানো। জুবায়েরের টেবিলে একটি টি পট। দুটা খালি কাপ। জুবায়ের বলল, তোমার জন্যে চা বানিয়ে বসে আছি।

থ্যাংক ইউ। একটা মেয়ে দেখলাম। তোমার স্টেনো না রিসিপশনিস্ট?

দুটোই–অফিসের শোভা বলতে পার।

কবে স্টেনো নিয়েছো?

এই মাসেই। আজ এই মেয়ের দ্বিতীয় দিন।

জুবায়ের উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

এষা বলল, দরজা বন্ধ করলে কেন?

নিরিবিলি চা খাচ্ছি, এই জন্যে দরজা বন্ধ করলাম। এই দরজার টেকনিক কি জান? ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করলেই বাইরে লাল বাতি জ্বলে ওঠে। অর্থাৎ রেড সিগন্যাল, প্রবেশ নিষেধ।

এষা শুকনো গলায় বলল, চা খাবার জন্যে রেড সিগন্যাল লাগবে কেন? প্লীজ দরজা খোল।

জুবায়ের বলল, তুমি এমন করছ কেন? আমি লক্ষ্য করেছি আমার সঙ্গে একা হলেই তুমি অস্বস্তি বোধ কর। দুদিন পর আমরা বিয়ে করছি। করছি না?

প্লীজ দরজা খোল। আমার সত্যি অস্বস্তি লাগছে।

অস্বস্তি লাগছে?

হ্যাঁ অস্বস্তি লাগছে। শুধু অস্বস্তি না ঘেন্নাও লাগছে। বাইরে একটি মেয়ে বসে আছে আর তুমি দরজা বন্ধ করে লাল বাতি জ্বালিয়ে দিলে? ছিঃ।

জুবায়ের উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। শীতল গলায় বলল, চা খাও। নকি চাও খাবে না?

এষা চায়ের কাপে চা ঢালল। একটা কাপ এগিয়ে দিল জুবায়েরের দিকে। জুবায়ের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ঠাণ্ডা গলায় বলল, এষা একটা ব্যাপার আমার ভালমত জানা দরকার। তুমি কি আমাকে পছন্দ কর?

হ্যাঁ করি।

আমাকে বিয়ে করার মানসিক প্রস্তুতি কি তোমার আছে?

আছে।

আমার কিন্তু তা মনে হয় না। তুমি সব সময় আমার কাছ থেকে এক ধরনের দূরত্ব বজায় রাখতে চাও। এটা আমি লক্ষ্য করেছি। এটা আমার অবজারভেশন।

তোমার অবজারভেশন ঠিক না।

আমাকে তুমি যদি পছন্দ কর, যদি আমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করার জন্যে মানসিক প্রস্তুতি তোমার থাকে তাহলে আমার প্রসঙ্গে তোমার কোন রকম দ্বিধা থাকা উচিত না। তোমার ভেতর দ্বিধা আছে। বড় রকমের দ্বিধা আছে।

তুমি এসব কি বলছ?

তোমার ভেতর যে কোন দ্বিধা নেই তা তুমি খুব সহজেই প্রমাণ করতে পার।

কিভাবে?

তুমি নিজে উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করবে। লাল বাতি জ্বালিয়ে দেবে। তারপর …।

তারপর কি?

তারপরেরটা তারপর। আপাততঃ প্রথম দুটি কাজ কর।

এষা উঠে দাঁড়াল। শুরুতে তার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল সে দরজা খুলে চলে যাবে। তা সে করল না। দরজা বন্ধ করে শুকনো গলায় বলল, এখন কি? জুবায়ের তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লম্বা লম্বা টান দিচ্ছে সিগারেটে। ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে আছে।

 

সুরমা ছেলের বিছানার কাছে বসে আছেন। সাবেরের আকাশ পাতাল জ্বর। দুজন ডাক্তারকে খবর দেয়া হয়েছে। দুজনের কেউই এখনো এসে পৌছান নি। সুরমা থমথমে গলায় বললেন, তোর এমন অসুখ আমি তো কিছুই জানি না।

তুমি ব্যস্ত থাক–তোমাকে বলিনি।

এমন কি ব্যস্ত থাকি যে অসুখের খবরটাও বলা যাবে না।

সাবের ক্ষীণ স্বরে বলল, বৃষ্টিতে ভেজাটা ঠিক হয়নি। লোভ সামলাতে পারলাম না।

কবে বৃষ্টিতে ভিজেছিস?

কাল রাত তিনটার দিকে। মিঃ আগস্ট বললেন–তিনি বৃষ্টিতে ভিজবেন .. . শুনে আমার খুব লোভ লাগল …

সুরমা সাবেরকে কথা শেষ করতে দিলেন না। কঠিন মুখে একতলায় নেমে এলেন। মিস্টার আগস্টকে পাওয়া গেল না। সে নাকি ঘুরতে বের হয়েছে। আরেকটি দৃশ্য দেখে সুরমা খানিকটা চমকালেন–হরিবাবু বিছানায় উবু হয়ে বসে একা একা লুডু খেলছেন। গভীর মনযোগের সঙ্গে খেলছেন। সুরমা যে ঘরে ঢুকেছেন–এই দৃশ্যটিও তার চোখে পড়েনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *