ডঃ আইনুদ্দিন গভীর মনোযোগে সানাউল্লাহর ভূত-বিষয়ক রচনা পড়ছেন। মাঝে মাঝে তার ভুরু কুঁচকে যাচ্ছে। লেখা পড়ে বিরক্ত হচ্ছেন বলে যে এই ঘটনা ঘটেছে তা-না। তাঁর মন আজ অস্বাভাবিক খারাপ। স্ত্রীর সঙ্গে নাশতার টেবিলে একটা সমস্যা হয়েছে। নাশতার টেবিলে কেউ নিঃশব্দে নাশতা খায় না। দুএকটা কথা বলা ভুদ্রতারই অংশ। সেই হিসেবেই তিনি বললেন, একটা বিড়ালের গল্প শুনবে?
তাঁর স্ত্রী রুবা বলল, শুনব।
তিনি বললেন, অতি বিখ্যাত এক বিড়াল।
রুবা বলল, কী রকম বিখ্যাত? কথা বলতে পারে?
তিনি বললেন, কথা বলতে পারে না। সাধারণ বিড়াল। তবে এই বিড়াল একই সঙ্গে জীবিত ও মৃত।
রুবা বলল, সেটা কীভাবে সম্ভব?
তিনি বললেন, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এটাকে সম্ভব করেছে। দাড়াও বুঝিয়ে বলছি। মনে কর আমি সেই বিড়াল। আমার প্লেটে যে ডিমের পোচটা আছে এটা ডিমের পোচ না। এটা হলো একটা রেডিও অ্যাকটিভ বস্তু। এবং তুমি হলে একজন অবজার্ভার। খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অবজার্ভার নির্ভর। তুমি তাকিয়ে থাক বিড়ালটার দিকে। তোমার কী মনে হয়— আমি জীবিত না মৃত? এই বলেই তিনি কয়েকবার ম্যাও ম্যাও করলেন।
রুবা নাশতার টেবিল থেকে উঠে গেল। ব্যাগ গুছিয়ে গাড়ি নিয়ে মায়ের বাড়ি চলে গেল। আইনুদ্দিন বিখ্যাত থট এক্সপেরিমেন্টটা ব্যাখ্যা করার সুযোগই পেলেন না। ঘটনা এখানেই শেষ না। ঘণ্টা দুই পরে তিনি তার শাশুড়ির টেলিফোন পেলেন। আইনুদ্দিনের শাশুড়ি সালেহা বেগম একসময় বাংলা কলেজের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন। তাঁকে প্রমোশন না দিয়ে তাঁর জুনিয়র একজনকে প্রিন্সিপ্যাল করায় তিনি প্রতিবাদ হিসেবে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। নিজের বাড়িতে প্রিন্সিপ্যাল ভাব এখন তাঁর অনেক বেশি। তিনি গম্ভীর গলায় গালি দেবার মতো করে বললেন, কেমন আছ বাবা?
জি ভালো।
তুমি কি আজ নাশতা খেতে বসে বিড়ালের মতো ম্যাঁও ম্যাঁও করছিলে?
জি।
কেন করছিলে জানতে পারি?
আম্মা! নাশতার টেবিলে আমি কিছুক্ষণের জন্যে মানুষ ছিলাম না। আমি হয়ে গিয়েছিলাম শ্রোডিনজারের বিড়াল। যে জীবিতও না, আবার মৃতও না। অবজার্ভার ঠিক করবে সে জীবিত না-কি মৃত। আপনার মেয়ে রুবা ছিল অবজার্ভার। আম্মা, এখন কি আপনার কাছে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়েছে?
পরিষ্কার হয় নি।
আরো খোলাসা করে বলি। এটা ছিল একটা থট এক্সপেরিমেন্ট। চিন্তা পরীক্ষা।
কী পরীক্ষা?
চিন্তা পরীক্ষা। পদার্থবিদ্যায় অনেক বিখ্যাত চিন্তা পরীক্ষা আছে। আপনাকে আরেকটা চিন্তা পরীক্ষার কথা বলি।
আমাকে কিছু বলতে হবে না বাবা। বরং তোমাকে আমি কিছু কথা বলি। তুমি ফিজিক্সের একটা মোটা বইয়ের ভেতর ঢুকে গেছ। সেই বই থেকে বের হতে পারছ না। আমার মেয়ে তোমার সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারছে না, কারণ সে ফিজিক্স বা অংকের কোনো বই না। সে সাধারণ একজন মানুষ। বুঝতে পারছ?
পারছি।
আমার ধারণা বেশ কিছুদিন তোমাদের আলাদা থাকা উচিত।
জি আচ্ছা।
আমি তোমার সম্পর্কে ভালোমতো খোঁজখবর না নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার বাচ্চা মেয়েটার বিয়ে দিয়ে মহা অন্যায় করেছি। তোমাদের বয়সের ব্যবধান বিশ বছর।
আইনুদ্দিন বললেন, আম্মা, আপনি ভুল করেছেন। ব্যবধান বিশ বছর না। উনিশ বছর পাঁচ মাস সাতদিন। আম্মা, কিছু মনে করবেন না। তথ্যগত ভুল আমার পছন্দ না।
সালেহা বেগম ‘প্রতিবন্ধি! ইডিয়েট!’ বলে টেলিফোন রেখে দিলেন।
আইনুদ্দিন শাশুড়ির বলা ইডিয়েট শব্দটায় কষ্ট পাচ্ছেন না। প্রতিবন্ধি শব্দটায় কষ্ট পাচ্ছেন। কারণ আর বাবা তাঁকে স্কুলে ভর্তি করাবার সময় হেডমাস্টার সাহেবকে বলেছিলেন, স্যার, আমার ছেলেটাকে একটু দেখেশুনে রাখবেন। সে মানসিক প্রতিবন্ধি। তাঁর বাবা সেই বছরেই মারা গেলেন। তিনি দেখে যেতে পারলেন না তাঁর ছেলে প্রতিটা প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ফুল প্রফেসর বানিয়ে তাঁকে রেখে দেবার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছিল, তিনি থাকেন নি। দেশে ফিরে এসেছেন। তাঁর দেশে ফেরার কারণও বিচিত্র। বর্ষাকালে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ আর ব্যাঙের ডাক না শুনলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিদেশে এই জিনিষ সম্ভব নয়।
আইনুদ্দিন ভুত বিষয়ক লেখা পড়ে শেষ করে বললেন, হুঁ।
সানাউল্লাহ বললেন, হুঁ মানে কী?
আইনুদ্দিন বললেন, ইন্টারেস্টিং লেখা।
সানাউল্লাহ বললেন, ভূত আছে এটা কি সায়েন্স দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব?
আইনুদ্দিন বললেন, থট এক্সপেরিমেন্ট করে দেখা যেতে পারে।
সানাউল্লাহ বললেন, একটা এক্সপেরিমেন্ট করো না। তোমার মতো ব্রিলিয়ান্ট ফিজিসিস্টের কাছে ভূত প্রমাণ করা কোনো বিষয়ই না।
আইনুদ্দিন বললেন, আমি চিন্তা শুরু করে দিয়েছি। কোন লাইনে এগুচ্ছি শুনতে চাও?
চাই।
ভূতকে শুরুতেই আমি পদার্থ হিসেবে ধরছি। এখন বলো পদার্থের অবস্থা কয়টা?
সানাউল্লাহ বললেন, তিনটা। কঠিন, তরল এবং বায়বীয়।
অইনুদ্দিন বললেন, পদার্থের অবস্থা ছয়টা। চতুর্থ অরস্থা হচ্ছে Plasma State. এই অবস্থায় পদার্থের সব পরমাণু একসঙ্গে চলে আসে এবং সব ইলেকট্রন মেঘের মতো পরমাণুর চারপাশে ঘুরপাক খেতে থাকে।
বলো কী!
প্লাজমা অবস্থা তৈরিতে প্রচুর তাপ লাগে। প্রায় এক লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন। যাই হোক, পদার্থের অবস্থার নাম Bose-Einstein Condense পরম শূন্য তাপমাত্রায় পদার্থের এই অবস্থা হয়। পরম শূন্য অপমাত্রা কত জানো?
না।
আইনুদ্দিন বললেন, পরম শূন্য তাপমাত্রা হলো মাইনাস ২৭৩ দশমিক এক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রায় কোনো বস্তুকে নিয়ে গেলে একটি পরমাণু গুচ্ছ তৈরি হয়। অর্থাৎ সব পরমাণু একত্রিত হয়ে যায়। বেসি কণার ব্যাপারে ব্যাপারটা সহজে ঘটে। বোস কণা চেন?
আরে না। আমি এইসব চিনব কীভাবে?
বোস কণার কৌনিক ভরবেগ অর্থাৎ Intrinsic angular momentum হবে পূর্ণ সংখ্যা। বুঝতে পারছ?
সানাউল্লাহ কিছুই না বুঝে বললেন, জটিল বিষয়, কিন্তু অনেকটা স্পষ্ট হয়ে আসছে।
আইনুদ্দিন বললেন, এখন বলি Fermion কণার কথা। এদের কৌণিক ভরবেগ হয় অর্ধপূর্ণ সংখ্যা। যেমন, ১/২ হতে পারে, ৩/২, হতে পারে, ৫/২ হতে পারে। পরিষ্কার না?
অবশ্যই পরিষ্কার। জলের মতো না হলেও পরিষ্কার।
আইনুদ্দিন বললেন, ফারমিওন কণা নিয়ে যখন সুপার অ্যাটম তৈরি হবে সেটি হবে পদার্থের ষষ্ঠ অবস্থা। এখন কী দেখলে? পদার্থের ছয়টা অবস্থা। ভূত পদার্থের অন্য এক অবস্থা তো হতে পারে। সপ্তম অবস্থা। হতে পারে না?
অবশ্যই পারে।
আইনুদ্দিন চিন্তিত গলায় বললেন, ভূতের কণার কৌণিক ভরবেগ হয়তো Boson বা Fermion-এর চেয়ে আলাদা। খুবই জটিল অবস্থা। তুমি চলে যাও, আমি চিন্তা করতে থাকি। তোমার ভাবি বাসায় না থাকায় চিন্তা করাটা আমার জন্যে সহজ হয়েছে। তুমি একটা কাজ কর। মোড়ের দোকান থেকে ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা এনে রেখে যাও। তোমার ভাবি শুধু যে একা চলে গেছে তা-না। রহমতকেও সঙ্গে নিয়ে গেছে। উদ্দেশ্য আর কিছু না। আমাকে যন্ত্রণা দেয়া।
সানাউল্লাহ ফ্লাস্ক ভর্তি চা, পাউরুটি, কলা, বিসকিট, চানাচুর এবং দুটা সিদ্ধ ডিম আইনুদ্দিনের টেবিলে রেখে আবু করিমের সন্ধানে গেলেন। তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন এই খবর পাওয়া গেছে।
আবু করিম সাহেব বাসায় নেই। তাঁর স্ত্রী ডা. শায়লা তাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে নিয়ে গেছেন। সাইকিয়াট্রিস্টের নাম ডা. জোহরা খানম। হেড মিসট্রেস টাইপ চেহারা। নাকের নিচে লাল চুলের গোঁফ আছে। তাঁর শরীর প্রকাণ্ড। মুখের হা প্রকাণ্ড। যখন হাই তুলেন তখন তাকে শাড়িপরা বাচ্চা হলহস্তির মতো দেখায়।
ডা. জোহরা খানম কয়েকটা কার্ড নিয়ে বসেছেন। কার্ডগুলিতে নানান ধরনের আঁকিবুকি কাটা। পেশেন্ট এইসব কার্ডের দিকে কিছুক্ষণ তাকাবে। তাকানোর পর কার্ডে কী আঁকা আছে বলে তার ধারণা তা সে বলবে। সেখান থেকে সাইকিয়াট্রিস্ট পেশেন্টের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা করবেন।
আবু করিম সাহেব।
জি।
ভালো আছেন?
জি।
আমি খুব সাধারণ একটা সাইকোলজিকেল টেস্ট দিয়ে শুরু করব। এই টেস্ট সম্পর্কে আপনি খুব ভালো জানেন। এই কার্ডটার দিকে তাকান। কার্ডে অস্পষ্ট কিছু ছবি আঁকা আছে। এই ছবিটা দেখে আপনার কী মনে হচ্ছে? ছবিতে কী আঁকা?
আবু করিম দীর্ঘ সময় ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, চালতার আচার। ছোবা ছোবা হয়ে আছে। জ্বাল কম হয়েছে।
এখন বলুন এই ছবিটা কিসের?
আমের মিষ্টি আচার। কাশ্মিরী আচার নাম। যদিও এই ধরনের আচার কাশ্মিরে কখনো বানানো হয় না।
এখন এই ছবিটা দেখুন, এইটাও কি আচারের ছবি?
জি-না।
এটা কিসের ছবি?
হমড়ুর ছবি। হমডুর হাতে এক বোতল আমিষ আচার। তবে সে আমার সব খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। মজা পেয়েছে। মুখভর্তি হাসি।
হমড়ু কে?
হমড়ু হলো সানাউল্লাহর পোষা ভূতের বাচ্চা। সানাউল্লাহর সঙ্গেই থাকে।
সানাউল্লাহ সাহেব কি আপনার বন্ধু?
জি।
আচ্ছা কল্পনা করুন–আপনি, আপনার স্ত্রী এবং সানাউল্লাহ সাহেব একটা নৌকায় করে যাচ্ছেন। আপনি একা সাঁতার জানেন, বাকি দুজন জানে না। হঠাৎ নৌকাড়ুবি হলো। আপনি যে-কোনো একজনকে বাঁচাতে পারেন। কাকে বাঁচাবেন?
নৌকায় কি কোনো আচারের বোতল আছে?
না।
সানাউল্লাহর সঙ্গে কি হমড়ু আছে?
না।
আবু করিম বললেন, আমি কাউকে বাঁচাব না। কারণ আমি সাঁতার জানি না। তবে আমার বন্ধু সানাউল্লাহ আমাকে বাঁচাবে। সে সাঁতার জানে এবং তার মাথা খারাপ হলেও সে লোক ভালো।
মাথা খারাপ বলছেন কেন?
যে ভূত পালে তাকে আপনি মাথা খারাপ বলবেন না?
ডা, জোহরা খানম বেশকিছু পরীক্ষা করলেন। এবং এক পর্যায়ে শায়লাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন— আপনার স্বামীর অবস্থা যথেষ্টই খারাপ। এখনো ভায়োলেন্ট হয় নি, তবে ভায়োলেন্ট হবার সব লক্ষণ পুরোদমে আছে। তাকে ঘরে আটকে রাখতে হবে। কখনোই বের হতে দেয়া যাবে না। নিয়মিত ওষুধ খাওয়াতে হবে। বেশির ভাগ সিডেটিভ। আমার একটা ক্লিনিক আছে। নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন— Hope, আমি সাজেস্ট করব এই মুহূর্তেই ক্লিনিকে ভর্তি করে দেয়া। কেবিন রুম আছে। এসি আছে। কষ্ট হবে না। এক মাস কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। বাইরে থেকে কোনো খাবার আসবে না। খাবার আমরা দেব। খরচ কিন্তু বেশি পড়বে আগেই বলে দিচ্ছি।
আবু করিমকে জোহরা খানমের Hope ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি বিস্মিত হয়ে দেখলেন, কেবিনের বেঙের সঙ্গে তাঁর হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়েছে। হাতপা বাঁধা হবার পর অল্পবয়েসি একটা নার্স সিরিঞ্জ নিয়ে ঢুকল ইনজেকশন দেবার জন্যে। তিনি বললেন, কী ইনজেকশন দিচ্ছ?
নার্স বলল, দাদু! কী ইনজেকশন দিচ্ছি সেটা তো আপনার জানার দরকার নেই।
আবু করিম বললেন, জানার দরকার আছে। আমি একজন ডাক্তার।
নার্স বলল, এখানে যারা ভর্তি হয় তারা সবাই এই ধরনের কথা বলে। কেউ ডাক্তার, কেউ মন্ত্রী, কেউ আবার মিলিটারির জেনারেল। ফিল্ড মার্শাল।
তুমি ডা. জোহরা খানমকে খবর দিয়ে আন। তার সঙ্গে কথা বলা দরকার।
দাদু! উনি প্রয়োজন ছাড়া আসেন না। ইনজেকশন দিয়ে দিচ্ছি, টানা বারো ঘণ্টা ঘুমাবেন।
মা শোন, আমি সত্যি একজন ডাক্তার।
নার্স বলল, ডাক্তার দাদু! আরাম করে ঘুমান। ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছি। এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়বেন।
দাদু ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বর্গী এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দিব কিসে?
আবু করিম টানা দশ ঘণ্টা ঘুমালেন। ঘুম ভাঙার এক ঘণ্টার মধ্যে আরেকটা ইনজেকশন দিয়ে আবারো তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হলো। হাত এবং পায়ের বাঁধন খোলা হলো না।