০৬. ভিজিটিং আওয়ার

ভিজিটিং আওয়ার চারটায়। বাবা তিনটার সময় উপস্থিত। গেটে আটকে রেখেছিল। তিনি হৈ-চৈ চেঁচামেচি করে চলে এসেছেন।

কি রে, আছিস কেমন?

ভালো। চিঠি পেয়েছেন তো?

হ্যাঁ।

আজই পেয়েছেন?

হ্যাঁ।

বাবা কি বলবেন তার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার ব্যাপারে খোঁজ করবেন, নাকি বাবুলের পাঠান টাকার পরিমাণটা জিজ্ঞেস করবেন? কোনটি তাঁর কাছে বেশি জরুরী? বাবা বললেন, টাকাটা তুলেছিস?

না। ড্রাট জমা দিয়েছে, ক্যাশ হতে সময় লাগবে।

কত দিন লাগবে?

এই ধরেন দিন সাতেক। কত টাকা সেটা তো জিজ্ঞেস করলেন না?

কত টাকা?

লাখখানিক হতে পারে।

বলিস কি।

আরো পাঠাবে। দেখেন, চিঠিটা পড়ে দেখেন।

বাবা চার-পাঁচ বার চিঠিটা পড়লেন। এখনো বোধ হয় ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমি বললাম, রাজার হালে থাকবেন, এখন চিন্তা নেই কিছু। বাড়ি বানাতে চাইলে বানাতে পারেন। কিংবা টাকাটা ব্যাঙ্কে রেখে দিলে ইন্টারেস্ট দিয়ে চলতে পারেন। যেটা ভালো মনে করেন।

বাড়ি বানানই ভালো। একটা স্থায়ী ঠিকানা দরকার। বাবুলও তো দেশে বেড়াতেটেড়াতে আসবে। উঠবে কোথায়? ওঠার জায়গা দরকার তো।

তা ঠিক।

আর কিছু থাক আর না-থাক, একটা বাড়ি সবার থাকা দরকার। একটা ঠিকানা থাকে। মানুষের একটা ঠিকানা দরকার।

ফিলসফারের মতত কথা বলছেন আমাদের বাবা, ফিলসফার এ্যাণ্ড ফ্রেণ্ড। আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। সে মুখে বিস্ময় এবং আনন্দ। যেন চমৎকার একটি স্বপ্ন দেখছেন। এবং বুঝতে পারছেন এটা স্বপ্ন। যে কোন মুহুর্তে ভেঙে যাবে। আমি হালকা স্বরে বললাম, বাবা, অনুকে আপনাদের বাড়িতে এনে রাখবেন। ওর অনেক কষ্ট বাবা অবাক হয়ে বললেন, ওর আবার কিসের কষ্ট? টাকাপয়সা আছে, ঘরবাড়ি আছে। দুইটা নতুন দোকান কিনেছে। উত্তরায় প্লট কিনেছে।

অভাবের কষ্ট ছাড়াও আরো সব কষ্ট আছে বাবা। আমি জানি, ও খুব কষ্ট্রে আছে।

তিনি ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। আমি বললাম, বাবা, আপনি কি চা-টা কিছু খাবেন? ফ্লাস্কে চা আছে।

দে, খাই একটু চা। বড়ো পরিশ্রম হয়েছে।

শুয়ে থাকবেন?

নাহ্‌।

বাবা আগ্রহ নিয়ে চা খেতে লাগলেন। বড় মায়া লাগল। এতটা বয়স হয়েছে। তাঁর, বোঝাই যায় না।

তোর এখানে আরেক জন থাকে না?

ওনার আজ সকালে অপারেশন হয়েছে। ভালো আছেন। বেশ ভালো। ডাক্তাররা যা ভেবেছিলেন, তা না। ভদ্রলোক সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরবেন।

তোর অপারেশন কবে?

এখন ডেট দিতে পারে নি। আরো সপ্তাহ খানেক লাগবে বোধহয়। আপনি আর কিছু খাবেন? এখানে মঞ্জু বলে এক জন আছে, তাকে বললেই সে এনে দেবে। খিদে লাগছে?

হুঁ।

কী খাবেন? ভালো প্যাটিস আছে। আনব?

আনা।

বাবা চেয়ারে পা উঠিয়ে বসে রইলেন। আমি বললাম, টাকাটা ক্যাশ হলেই করিম সাহেব আমাকে খবর দেবেন। তাঁদের ব্যঙ্কেই জমা দিয়েছি। করিম সাহেবকে চেনেন তো? আমার পাশের ঘরে থাকেন।

চিনি।

অপারেশনে আমার যদি ভালো-মন্দ কিছু হয়ে যায়, তাতেও অসুবিধে হবে না। করিম সাহেব ব্যবস্থা করে দেবেন। আপনার নামে চেক লিখে ওনার কাছে দিয়ে রেখেছি।

বাবা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। যেন আমার কথা ঠিক বুঝতে পারছেন না। এমন কোনো রহস্যময় কথা তো আমি বলছি না।

তোর অসুখটা কি?

আপনি জানেন না?

না, তুই তো ভালো করে কিছু বলিস নি।

আমার পেটের নালিতে টিউমার হয়েছে? টিউমারটা খারাপ ধরনের হতে পারে, আবার নাও পারে। পেট না কাটলে ডাক্তাররা বুঝতে পারবেন না।

বাবা উঠে দাঁড়ালেন। থেমে থেমে বললেন, কাল আবার আসব।

দরকার নেই, কেন শুধু শুধু কষ্ট করবেন?

বাবা অদ্ভূত ভঙ্গিতে তাকালেন। আমি নরম স্বরে বললাম, আমার কোন মাসে জন্ম হয়েছিল আপনার মনে আছে? ডিসেম্বর না জানুয়ারি?

কেন?

না, এমনি। কোনো কারনটারণ নেই।

তুই কি কোনো কারণে আমার উপর রাগ করেছিল?

রাগ করব কেন?

টাকা চেয়েছিলি, দিই নি।

ছিল না, তাই দেন নি। রাগ করব কেন?

বাবা অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ক্ষীণ স্বরে বললেন, ছিল, আমার কাছে ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *