ভালোবাসার অনেক জ্বালা, অনেক ঝঞ্জাট। যাদের ভালোবাসা যায়, তাহা হাসলে হাসতে ইচ্ছা করে, দুঃখ পেলে নিজের মনটাও পীড়িত হয়। হবেই। সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়বেই। এর থেকে নিস্তার নেই, মুক্তি নেই। একদিন আমি সব কিছু পেয়েছিলাম, পরিপূর্ণ পরিতৃপ্ত হয়েছিল আমার মন। তারপর সব হারিয়েছি। নতুন করে পরিপূর্ণ হবার সাধ নেই। সাধ্যও নেই। তাছাড়া প্রয়োজনও নেই।
বেশ আছি আমি। দিনগুলো বেশ কেটে যায়। রাজনীতি দলাদলি মারামারি কাটাকাটি। কিছু শুনি, কিছু দেখি, লোকে কিছু বলে যায়। টাইপ রাইটার খটখট করি। টেলেক্স টেলিপ্রিন্টারে চলে যায় অফিসে। পরের দিন কাগজে ছাপা হয় ফ্রম আওয়ার পলিটিক্যাল করসপন্ডেন্ট। আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ ককটেল–ডিনারে সন্ধ্যা, রাত্রিও কেটে যায় বেশ। এছাড়াও আছে বন্ধুবান্ধব, পরিচিতের দল। আর আছে রাধাকিষণ। সব মিলিয়ে বেশ আছি। সুখেই আছি। সুভাষদা বৌদি দেবুরঞ্জনার মতো কিছু লোকের জন্যই আমার ঝামেলা। আমি একা হয়েও একলা থাকি না। এদের কথা ভাবি। ভাবতে ইচ্ছা করে, ভালো লাগে। এদের দেখতে ইচ্ছা করে, এদের সঙ্গে কথা বলতে মন চায়। আরো কত কি! মনের ইচ্ছা, প্রাণের ব্যাকুলতাকে সংযত করা বড় কঠিন। কষ্টকর। অনেক সময় দুঃসাধ্যও বটে।
রঞ্জনা দিল্লি আসে, ব্যাঙ্গালোরে ফিরে যায়। দুতিন মাস অন্তরই আসা-যাওয়া। এর মধ্যে দেবুও এক মাসের ছুটি নিয়ে এসেছিল। ঠিক বেড়াতে নয়, কাজে। পঞ্চশীল কলোনীতে ডক্টর চৌধুরী নিজের বাড়ি তৈরি করছেন। ঐ বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করার জন্যই দেবু ছুটি নিয়ে দিল্লি এসেছিল। দেবু আর রঞ্জনা আসার পরদিনই ভিত পূজা হলো। দেবু বার বার করে আমাকে যেতে বলেছিল। গিয়েছিলাম। পুজো শেষ হবার পর আর্কিটেকটের কাছ থেকে প্ল্যানের নীল কাগজখানা নিয়ে ডক্টর চৌধুরী আমাকে বাড়ির প্ল্যান বুঝাতে শুরু করলেন, এই হচ্ছে সামনের বারান্দা। বাঁ দিকের দরজা দিয়ে ঢুকলেই ছোট্ট একটা সিটিং রুম। ড্রইংরুম হবে এল শেপের। আঙুল দিয়ে দেখালেন এই এল শেপের সাইডে হবে ডাইনিং স্পেস। তবে এখানে আমি ডিনার ওয়াগন ফিট করব না।…
আমি বললাম, খুব ভালো। বাইরের লোককে কিছু ক্ৰকারিজ দেখাবার কোনো মানে হয় না।
দ্যাটস রাইট। সিটিংরুম আর ড্রইংরুমের মাঝখানে যে দরজা দেখছেন…
হ্যাঁ।
ঐ দরজার সামনেই একটা বড় ল্যান্ডিং থাকবে আর ল্যান্ডিং-এর এক পাশ দিয়ে দোতলার সিঁড়ি।
আই সী।
ল্যান্ডিং পার হলেই ডান দিকে কিচেন-প্যান্ট্রি-স্টোর। আর বাঁ দিকে পর পর দুটো বেড রুম। দুটোর সাইজ আঠারো বাই কুড়ি। দুটোর সঙ্গেই অ্যাটাচ বাথ অ্যান্ড টয়লেট।…
আমি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলাম, এই দুটো বেডরুমই বুঝি আপনাদের দু ভাইয়ের?
ডক্টর চৌধুরী হাসতে হাসতে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, আপনার মাথা খারাপ হয়েছে? রঞ্জনা আর ওর ছেলেমেয়েরা আমাকে এত কাছে থাকতে দেবে? আমি থাকব উপরের একটা ঘরে।
আমি হাসলাম।
এর একটা ঘরে রঞ্জনারা, অন্যটায় আমার ফিউচার গার্ডিয়ানরা থাকবে।…
আমি না হেসে পারলাম না।
এটা হচ্ছে ওপেন প্লেস। এর পর এটা স্টাডি। জ্যেঠু এখানে পড়াশুনা করবে আর একেবারে কোণায় হচ্ছে একটা গেস্ট রুম। প্ল্যানটা কেমন লাগল বলুন?
খুব ভালো, কিন্তু আপনার কি ব্যবস্থা হবে?
ঐ তো সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলেই দুটো ঘর। একটায় পড়াশুনা করব আর অন্যটায় শোব।
প্ল্যানের কাগজটার ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিতে গিয়েই জিজ্ঞাসা করলাম এখানে কি হবে?
ও। গ্যারাজ আর সারভেন্টস কোয়ার্টার।
দেবু আমার পাশেই ছিল। আমার কানে কানে জিজ্ঞাসা করল, রঞ্জনাকে জিজ্ঞেস করুন তোত আমি কি গ্যারাজের ওপরেই থাকব?
আমি হাসলাম, এ দুশ্চিন্তার কারণ?
ও আবার আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো, দাদার বাড়ি হলে তো ভয় ছিল না। বাড়ির মালিক তো রঞ্জনা হচ্ছে।
আমাদের দুজনকে এমন ফিসফিস করে কথা বলতে দেখে রঞ্জনা আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি একবার ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
হঠাৎ ডক্টর চৌধুরী একটু গলা চড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, জানেন তো রিপোর্টার সাহেব, এ বাড়ির নাম কি হবে?
কই না তো।
বাড়ির নাম হবে রঞ্জনা।
হাজার হোক খবরের কাগজের রিপোর্টার। কিছু কিছু মিনিস্টার আর এম-পির সঙ্গে এত আজে বাজে আড্ডা দিই আর ইয়ার্কি করি যে মাঝে মাঝে যেখানে-সেখানে বেফাঁস কথা বলে ফেলি। বাড়ির নাম রঞ্জনা হবে শুনেই হঠাৎ বলে ফেললাম, আপনার মতো ভাশুর পেলে বোধ হয় অনেক হিন্দু বিধবাও আবার বিয়ে করতে রাজি হবে।
কথাটা জিব ফসকে বেরিয়ে যেতেই খারাপ লাগল, কিন্তু ওঁরা তিনজনেই হাসলেন দেখে নিশ্চিন্ত হলাম।
বাড়ি তৈরির জন্য দেবু সারাদিনই ব্যস্ত থাকত। সন্ধ্যার পর হয় দাদার সঙ্গে সারাদিনের কাজকর্ম নিয়ে কথাবার্তা বলতো, নয়তো ক্লান্তিতে শুয়েই পড়ত। কলকাতা থেকে আমার এক বন্ধুর দাদা-বৌদি দিল্লি বেড়াতে এসে আমার কাছেই ছিলেন। ওঁদের কুতুব মিনার দেখিয়ে ফেরার পথে। পঞ্চশীল কলোনীতে গিয়েছিলাম। রঞ্জনা আর দেবু দুজনেই ছিল। ঐ একমাসের মধ্যে দেবুরা একদিন আমার এখানে এসেছিল। আমিও বোধহয় দুদিন খেতে গিয়েছি।
এর মাস দুয়েক পরে রঞ্জনা যখন আবার এলো তখন আমি এখানে নেই। আসাম গেছি। ফেরার পথে কলকাতা। ভেবেছিলাম দু-তিন দিন থাকব, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কলকাতা ছাড়লাম নদিন পর। ফিরে এসেই রাধাকিষণের কাছে শুনলাম তিন মূর্তি লেনের মেমসাব অনেক দিন দিল্লিতে। জিজ্ঞাসা করলাম, মেমসাহেব কি টেলিফোন করেছিলেন?
টেলিফোন তো হরদমই করেন। দুদিন এসেও ছিলেন।
তাই নাকি?
জী হাঁ। বড় চৌধুরী সাহেবও দুদিন টেলিফোন করেছিলেন।
ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে এগারটা বাজে। তাহলে খুব বেশি বেলা হয়নি। রাধাকিষণ, আমি বাথরুমে যাচ্ছি। তুমি তিন মূর্তি লেনের মেমসাহেবকে বলে দাও আমি ওখানে খেতে যাচ্ছি।
আমি তাহলে খানা বানাব না?
না।
বেরুতে বেরুতে সাড়ে বারোটা হয়ে গেল। তারপর গ্যারেজে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট করতে গিয়ে দেখলাম ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেছে। তখন আর কি করব! ট্যাকসি নিয়েই চলে গেলাম।
রঞ্জনা আমাকে দেখেই মন্তব্য করল, তাহলে ফিরেছেন দেখছি।
ফিরব না তো কোথায় যাবো?
কোথায় যান, কোথায় থাকেন, তা আপনিই জানেন।
তার মানে?
কথা বলতে বলতেই ড্রইংরুমে ঢুকলাম। রঞ্জনা বললো, সত্যি বেশ আছেন আপনি। কোনো চিন্তা-ভাবনা দায়-দায়িত্ব নেই! যা ইচ্ছে তাই করছেন।
কোথায় যা ইচ্ছে তাই করছি? কাজে আসাম গিয়েছিলাম আর ফেরার পথে কদিন কলকাতায় ছিলাম।
রঞ্জনা কিছু বলার আগেই আমি আবার বললাম, আমি খেতে এসেছি।
আমি জানি। রঞ্জনা একবার আমাকে দেখে বললো, আপনার মতো জার্নালিস্টদের সংসার ধর্ম না করাই ভালো।
সেই জন্যই তো করিনি।
না করে খুব ভালো করেছেন, কিন্তু আমি আপনার মতো কোনো জার্নালিস্টের হাতে পড়লে তো মরেই যেতাম।
ওর কথা শুনে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। কি আজেবাজে কথা বলছ?
রঞ্জনা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, যাই খাওয়ার ব্যবস্থা করি।
খাওয়া-দাওয়ার পর কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে উঠলাম। রঞ্জনাও বাইরে বেরিয়ে এলো। চারপাশ তাকিয়ে আমার গাড়ি দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, গাড়ি কোথায় রেখেছেন?
গাড়ি আনিনি।
কেন?
স্টার্ট নিতে গিয়ে দেখি ব্যাটারি ডাউন হয়ে গিয়েছে।
খবরটা শুনে ও যেন খুশীই হলো, মাসের পর মাস গাড়ি পড়ে থাকলে ব্যাটারীর কি দোষ?
আমি কি বলব? শুধু হাসলাম।
তাহলে কিসে এলেন?
কেন ট্যাক্সিতে।
এখন কি ট্যাক্সি করেই ফেরত যাবেন?
তবে আর কিসে যাব?
দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমি দাদাকে ফোন করে গাড়ি আনিয়ে নিচ্ছি।
কোনো দরকার নেই…
ও আমার কথা না শুনেই বাড়ির মধ্যে চলে গেল। আমি ঐখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। দু-তিন মিনিট পরেই রঞ্জনা বেরিয়ে এলো। একটু বসুন। এক্ষুনি গাড়ি আসছে।
আমি ওর পিছন পিছন ড্রইংরুমে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, কোনো দরকার ছিল না রঞ্জনা।
আপনি চুপ করুন। চু
প করছি কিন্তু ডক্টর চৌধুরী কি ভাববেন বলতো?
দাদার কাছে কিছু চাইলে উনি বরং খুশী হন, তা জানেন?
গাড়ির হর্ন শুনতেই রঞ্জনা উঠে দাঁড়াল। চলুন, আপনাকে ছেড়ে আসি।
তুমিও যাবে?
কেন? কোন আপত্তি আছে?
আমি একা বলে কি মানুষের সাহচর্য পছন্দ করি না?
তার মানে?
চলুন, চলুন। বলতে বলতেই বেরিয়ে গেল। চাকরটাকে বললো, আমি একটু বেরুচ্ছি।
গাড়িতে উঠেই রঞ্জনা জানতে চাইল, অফিস না বাড়ি যাবেন?
কাল থেকে অফিস যাবো।
রঞ্জনা ড্রাইভারকে বললো, সাব কা কোঠী চলো।
গাড়িতে যেতে যেতেই আমি বললাম, রঞ্জনা, আমি তোমার কথাবার্তা ঠিক বুঝি না।
ও একটু হাসল, সহজ সরল কথাবার্তা আপনি বুঝতে পারেন না, তা আমি জানি।
বাইরের দিকে তাকিয়ে আমি চুপ করে বসে রইলাম। বেশ কয়েক মিনিট পরে দৃষ্টিটা হঠাৎ গুটিয়ে ভিতরে আনতেই দেখি ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার চোখে ওর চোখ পড়তেই জিজ্ঞাসা করল, কি ভাবছিলেন?
আমি উত্তর দেবার আগেই আমার বাড়ির সামনে গাড়ি থামল। দুজনেই নামলাম। বেল বাজাতেই রাধাকিষণ দরজা খুলে দিল। ভিতরে ঢুকে বললাম, সো।
রঞ্জনা বসেই জিজ্ঞাসা করল, আমার কথার জবাব দিলেন না?
কোনো কথার?
গাড়িতে আসতে আসতে কি ভাবছিলেন?
সত্যি বলব?
নিশ্চয়ই।
কিছু মনে করবে না তো?
না।
তোমার কথাই ভাবছিলাম।
রঞ্জনা একটু হেসে উঠল, এই প্রথম বোধহয় আমার কথা ভাবলেন?
এর আগেও ভেবেছি।
সত্যি ভেবেছেন?
ভাবব না কেন বল? তোমাদের সবার সঙ্গে যখন আমার এত হৃদ্যতা, তখন তোমার কথা ভাবব না কেন?
আগে জানতে পারলে আমার একটু উপকার হতো।
উপকার হতো মানে?
যখন জানাননি তখন ওসব কথা ছাড়ুন।
আমি আর কোনো কথা না বলে একটা সিগারেট ধরালাম।
রঞ্জনা হাসতে হাসতে বললো, সিগারেটের গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে।
আমি হাসলাম, তাই নাকি?
সত্যি। দারুণ ভালো লাগে।
দেবু সিগারেট খায়?
ও আবার সিগারেট খাবে?
তার মানে?
অত গুড বয় কখনো সিগারেট খায়?
তোমার ভালো লাগে জানলে নিশ্চয়ই খাবে।
আপনি তাহলে ওকে চেনেননি।
আমি আবার চুপ করে সিগারেট টানতে লাগলাম। রঞ্জনাও একটু চুপ করে রইল। তারপর হাসতে হাসতে বললো, হোস্টেলে থাকার সময় আমরা কয়েকজন মেয়ে মাঝে মাঝেই সিগারেট খেতাম।
আমি হাসলাম, সত্যি?
সত্যি নয়তো মিথ্যে বলছি? একটা সিগারেট দিন, খেয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি। ও যেন মজা করে বললো।
আমি হাসতে হাসতেই ওকে একটা সিগারেট অফার করলাম। ও সিগারেটটা হাতে নিয়ে বললো, এ ঘরে না, ভিতরের ঘরে চলুন।
কেন?
হঠাৎ যদি রাধাকিষণ এসে পড়ে তাহলে…
চলো।
দুটি বেডরুমের একটিতে আমি পড়াশুনা কাজকর্ম করি, অন্যটায় শুই। স্টাডিতেই ঢুকলাম। একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললাম, বসো।
রঞ্জনা বসল।
আমি লাইটার জ্বেলে ওর মুখের সামনে ধরতেই ও একটানে সিগারেটটা ধরিয়ে নিল। পর পর কয়েকটা টান দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, অনেক কাল পরে সিগারেট খেতে বেশ লাগছে।
আমি চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
হোস্টেল ওয়ার্ডেন মাঝে মাঝে হঠাৎ আমাদের রুমে এলে কি কাণ্ডটাই হতো!…
কি হতো?
চারজন মেয়ের কেউ না কেউ সিগারেট খেতই। তাছাড়া সবার টেবিলেই সিগারেট-দেশলাই পড়ে থাকত।
তাই নাকি?
হোস্টেলে থাকার যে কি আনন্দ সে আপনি কি বুঝবেন?
আমি হাসলাম।
আপনাকে নিয়েই কি হোস্টেলে কম মজা হতো?
চমকে উঠলাম, আমাকে নিয়ে?
হ্যাঁ, আপনাকে নিয়ে। আপনার জন্য আমাকে সবাই জার্নালিস্ট বলত…
সে কি?
এম. এ. পরীক্ষা দেবার পরই আমার বিয়ে হয়ে গেল, নয়তো আমি ঠিক জার্নালিজম করতাম।
রিয়েলি?
সত্যি বলছি জার্নালিজম আমার খুব ইন্টারেস্টিং লাগে।
ফরেন সার্ভিসের চাইতেও?
অব কোর্স। ফরেন সার্ভিসের সবাই বড় চালিয়াত হয়।
জার্নালিস্টরা হয় না?
সিগারেটটা শেষ হয়ে যেতেই অ্যাশট্রেতে ফেলে দিল রঞ্জনা। বললো, ওসব বাদ দিন। ভাবতে গেলেও মন-মেজাজ খারাপ হয়।
মন-মেজাজ খারাপ হবে কেন?
যাই হোক আপনি সত্যি একটা বিচিত্র মানুষ। আর যাই থাক মন বলে কোনো পদার্থ আপনার নেই।
আমি আর পারলাম না। চেয়ারটা টেনে ওর খুব কাছে গিয়ে বললাম, আমার দিকে তাকাও।
ও আমার চোখের পর দৃষ্টিটা আনতেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার মনের কথাটা খুলে বলবে?
রঞ্জনা বেশ জোরেই হেসে উঠল, এই পৃথিবীতে কোনো মানুষটা মনের কথা খুলে বলে বলুন তো? তাছাড়া আপনাকে বলে আমার লাভ?
লাভ-লোকসানের কথা আমি জানি না। তবে তোমার কথা শুনে বেশ বুঝতে পারি তোমার যেন কি একটা গোলমাল হয়ে গেছে।
তাতে তো আপনার কোনো ক্ষতি হয়নি।
তোমার হয়েছে?
হলে কি আপনি ক্ষতিপূরণ দেবেন?ও আমার প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করতে করতে বললো, আপনার সে ক্ষমতা নেই।
কি এমন ক্ষতি তোমার হলো যে আমি ক্ষতিপূরণ করতে পারব না?
আপন মনে সিগারেট ধরাল, আমি সিগারেট খাচ্ছি বলে রাগ করছেন?
না।
রাগ না করলেও মনে মনে নিশ্চয়ই খারাপ ভাবছেন?
শখ করে সিগারেট খাচ্ছ, খারাপ ভাবব কেন?
খুব জোরে সিগারেটে টান দিয়ে রঞ্জনা একটু মুচকি হাসল, আমি জানি আপনি আমাকে ভালোবাসেন।
নিশ্চয়ই ভালোবাসি। তুমি সুভাষদার মেয়ে। তোমাকে ভালোবাসব না?
আঃ! এর মধ্যে আবার বাবা-মাকে টানছেন কেন?
আমি চুপ করে রইলাম।
রঞ্জনা নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার পিছনে দাঁড়িয়ে বললো, কোনদিন মুখ ফুটে আমার একথা বলতে হবে ভাবিনি, কিন্তু আজ আর না বলে পারছি না…
রঞ্জনা হঠাৎ থামল।
আমি চুপ করে রইলাম। দু এক মিনিট পরে মুখ ঘুরিয়ে দেখি ওর চোখে জল। কাঁদছ কেন রঞ্জনা? কি হয়েছে তোমার?
রঞ্জনা বিদ্যুৎ বেগে সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ফেলেই ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বললো, চলি।
রঞ্জনা। শোন!
আমি ওর পিছন পিছন যেতে যেতে আবার ডাকলাম, একটা কথা শুনে যাও রঞ্জনা। এক মিনিট…
ও দাঁড়াল না। গাড়িতে উঠেই ড্রাইভারকে বললো, সাহাব কা দপ্তর চলো।
রঞ্জনা আমার দিকে একবারও তাকাল না। ড্রাইভার হাত তুলে আমাকে একটা সেলাম দিয়েই গাড়ি স্টার্ট করল। রঞ্জনা চলে গেল। আমি ঐখানেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ পর্যন্ত নড়তে পারলাম না। হঠাৎ আমার সব কিছু অসহ্য মনে হলো। এক মিনিটের জন্য আর দিল্লি থাকতে মন চাইল না।
.
তাড়াতাড়ি বাড়ির মধ্যে এসেই নিউজ এডিটরকে একটা ফনোগ্রাম পাঠালাম, গোয়িং আউট অফ ডেলহি ফর অ্যান ইন্টারেস্টিং নিউজ।
এবার রাধাকিষণকে ডেকে বললাম, আমি খুব জরুরী কাজে বাইরে যাচ্ছি।
ফিন বাইরে যাবেন?
হ্যাঁ।
কব?
আজ।
রাধাকিষণ অনেক কাল ধরে আমার কাছে কাজ করছে। আমাকে ও ভালোভাবেই চেনে, জানে। বুঝল কিছু একটা অঘটন ঘটেছে, কিন্তু হাজার হোক আমি মনিব, ও আমার ভৃত্য। একটি প্রশ্নও করল না।
সন্ধ্যার পর আমি একটা অ্যাটাচিতে কয়েকটা জামাকাপড় ভরে নিয়েই দিল্লি জংশন স্টেশনে রওনা হলাম। রিজার্ভেশন পেলাম না। তবু মুসৌরী এক্সপ্রেসে চড়ে ডেরাডুন গেলাম। পরের দিনই মুসৌরী।
দিল্লি থেকে পালিয়ে এলাম ঠিকই, কিন্তু মন? তার কাছ থেকে কোথায় পালাব। হকম্যানস গ্রান্ড-এ থেকেও ভালো লাগছিল না। দুটো দিন ঘর থেকেই বেরুলাম না। তার পরদিন আর পারলাম না। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে টিকিটের খোঁজ করলাম। সেদিনকার টিকিট ছিল না। পরের দিনের একটা টিকিট কিনে হোটেলে ফিরে এলাম।
চারদিন পর দিল্লি ফিরলাম। বাড়িতে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই রাধাকিষণ আমার হাতে একটা খাম দিল, তিন মূর্তি লেনের মেমসাব দুদিন এসে আপনাকে না পেয়ে এই চিঠি দিয়ে গেছেন।
বিচিত্র চিঠি। কোনো কিছু বলে সম্বোধন নেই। …আপনাকে এই প্রথম চিঠি লিখছি অথচ কিছু বলে সম্বোধন করতে পারছি না বলে ক্ষমা করবেন। তা ছাড়া কি বলে সম্বোধন করব? যা বলে সম্বোধন করতে মন চায় তা তো সম্ভব নয়।
প্রথমবার আপনি যখন বেনারসে এসে আমার সঙ্গে দেখা করলেন, তখনই আপনাকে ভালো লেগেছিল। আপনার মুখের হাসি, উদার দুটো চোখ, প্রাণ-প্রাচুর্য আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আপনি চলে যাবার পরমুহূর্ত থেকেই আবার আপনার আসার প্রতীক্ষায় থেকেছি। বার বার লুকিয়ে লুকিয়ে আপনার ওয়াশিংটনের ফটোগুলো দেখেছি আর ছোট-ছোট টুকরো-টুকরো কাগজে আপনাকে চিঠি লিখেছি। সেসব চিঠি কোনদিন আপনাকে পাঠাইনি। পাঠাতে পারিনি। সাহস হয়নি।
আস্তে আস্তে আপনাকে যত দেখেছি তত বেশি ভালো লেগেছে আর নিত্য নতুন স্বপ্ন দেখেছি মনে মনে। দেখব না কেন? আপনি যেভাবে আমার সঙ্গে মিশেছেন, যেভাবে দিনে দিনে, ধাপে ধাপে আমার কাছে এগিয়ে এসেছেন, আমাকে আপন জ্ঞানে কাছে নিয়েছেন, ভালোবাসার আভাস ইঙ্গিত-প্রমাণ দিয়েছেন, তাতে স্বপ্ন দেখা অন্যায় মনে হয়নি। বরং স্বাভাবিক মনে হয়েছে। মনে হয়েছে আপনাকে ভালোবাসার, আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার অধিকার আপনি আমাকে দিয়েছেন।
তারপর একদিন হোস্টেলের মেয়েদের কাছে ধরা পড়লাম। হাজার হোক এক ঘরে থাকি, একসঙ্গে লেখাপড়া করি, সিনেমা দেখি। বেড়াতে যাই। কতদিন আর ওদের কাছ থেকে লুকিয়ে। রাখা সম্ভব? ওরা কি দারুণ ঠাট্টা-ইয়ার্কি করত তা আপনি ভাবতে পারবেন না। হোস্টেলে তো। কোনোদিন থাকেননি, তাই ভাবতে পারবেন না মেয়েদের ভালোবাসার কথা, প্রেমের কাহিনি ফাস হয়ে গেলে কি কাণ্ড হয়। আমি যখন ফিফথ ইয়ারে উঠি তখন আপনার বয়সীই একজন বাঙালি লেকচারার আমার প্রতি একটু আকৃষ্ট হয়েছেন বলে হোস্টেলের গোয়েন্দা বিভাগে খবর পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গেই ওর কাছে বেনামী চিঠি চলে গেল, আপনার চাইতে অনেক সুন্দর, ব্রিলিয়ান্ট এক জার্নালিস্টের সঙ্গে ওর বিয়ে হবে বলে ঠিক হয়ে গেছে। সুতরাং মন দিয়ে অধ্যাপনা করুন আর রবিবারের আনন্দবাজার-যুগান্তরে পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন পড়ুন।
চিঠিতে কি সব কথা জানান যায়? তাছাড়া দুই ভাইকে ফাঁকি দিয়ে এই চিঠি কি ভাবে লিখছি তা আপনি ভাবতে পারবেন না। অনেক কষ্ট করে এই চিঠি লিখছি। না লিখে পারছি না। আপনি যে কি তা আমি ভেবে পাই না। রাজনীতির এত গোপন খবর জোগাড় করেন অথচ প্রকাশ্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট, উন্মুক্ত আমার ভালোবাসা আপনি বুঝতে পারলেন না? ভালো না বাসলে কোন মেয়ে এভাবে একজন ব্যাচেলারের সঙ্গে মিশতে পারে? সকালে, দুপুরে, সন্ধ্যায়, রাত্রিতে একা একা তাকে সাহচর্য দিতে পারে? শুধু দেহটাই আপনাকে দিইনি, কিন্তু তাছাড়া আর কি দিই নি? সেবা, যত্ন, ভালোবাসা, সম্মান, মর্যাদা–সব কিছুই তো দিয়েছি। আনন্দে, হাসি মুখে দিয়েছি। আর যদি দাবি করতে পারতেন তাহলে হয়তো এই দেহটাকেও না দিয়ে পারতাম না। আপনার মধ্যে অনেক দ্বিধা, জড়তা, সঙ্কোচ থাকলেও আমার মধ্যে ছিল না। একবার নয়, ৰবার তো সুযোগ পেয়েছে। কতদিন শুধু আমি আর আপনি আপনার পড়ার ঘরে, শোবার ঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি বলুন তো। রাধাকিষণ তো সেই পিছনের দিকে নিজের কোয়ার্টারে ঘুমুতো। একবার দাবি করেই দেখতে পারতেন ভালোবাসার অগ্নিপরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণা হই কিনা। যে মেয়ে প্রাণ মন উৎসর্গ করতে পারে, ভালোবাসার জন্য লোকলজ্জা, সামাজিক অনুশাসন উপেক্ষা করতে পারে, তার পক্ষে প্রাণের মানুষের কাছে দেহটাকে বিলিয়ে দেওয়া কিছু দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। ভালোবাসার খেসারত দিতে গিয়ে শুধু মেয়েরাই সমাজের কাছে কলঙ্কিনী হয়, ছেলেরা নয়। কখনই নয়। ভালোবাসার বিনিময়ে দুর্নাম সহ্য করার সাহস বা ক্ষমতা আপনাদের হয় না। হবে না।
আমি ভেরে পাই না আপনি কি? পশু? নাকি দেবতা? হয় আপনার মধ্যে শৌর্য, বীর্য, ভালোবাসার ক্ষমতা, মন কিছুই আপনার নেই; নয়তো আপনি এমন কোন মেয়ের দেখা পেয়েছেন, ভালোবাসা পেয়েছেন, নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছেন, যার কাছে আমি অতি সাধারণ। অতি নগণ্য। হয়তো তুচ্ছ বা ঘৃণ্য। কোনোটা ঠিক বলুন তো? বলতে পারেন কেন আপনি আমাকে এভাবে উপেক্ষা করেছেন? এভাবে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে? কোনো অধিকারে সারা জীবনের জন্য আমার মনে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন?
থাক গে। ভেবেছিলাম আর আপনার এখানে আসবনা, কিন্তু না এসে পারলাম না। দুদিন এলাম দেখা হলো না। শুনলাম আপনি হঠাৎ জরুরি কাজে বাইরে গেছে। কাজটা যে কত জরুরি তা আর কেউ না বুঝুক আমি বুঝেছি। আমার জন্যই আপনার এই দুর্ভোগ। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি ব্যাঙ্গালোরে ফিরে যাচ্ছি। দাদার জন্য দিল্লিতে আমার আসতেই হবে। তবে কথা দিচ্ছি আপনাকে আর বিরক্ত করব না।
চিঠিটা পড়ে তো অবাক হলামই, তবে আরো বেশি অবাক হলাম নিচের লেখাটুকু দেখে– মিসেস দেবব্রত চৌধুরী।
.
তারপর কত কি হলো! ডক্টর চৌধুরীর বাড়ির গৃহপ্রবেশের নিমন্ত্রণ এলো। দেবু নিজেই এসেছিল। দাদা বার বার বলে দিয়েছে আপনাকে আসার জন্য।
আমি খুব গম্ভীর হয়ে উত্তর দিয়েছি, আসব তো নিশ্চয়ই; তবে খবরের কাগজের কাজ করি তো! কখন যে কোনো কাজে আটকে যাই কিছু ঠিক নেই।
দেবু হাসতে হাসতে বলেছে, তাছাড়া বাড়িটা তো আপনাদেরই রঞ্জনার। সুতরাংনা এলে চলবে না।
অত করে বলার দরকার নেই। যদি খুব জরুরী কোনো কাজে আটকে না যাই তাহলে আসবই।
আমি যাইনি। যেতে পারিনি। রমার সামনে মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস আমার হয়নি। দেবু যখন নেমন্তন্ন করতে এসেছিল তখনই জানতাম যাব না। কিছুতেই যাব না কিন্তু বলতে পারিনি। কি বলব? বলব, দেবুবাবু, আপনার স্ত্রী রমা আমাকে ভালোবাসত। এখনও ভালোবাসে। একদিন সে আমাকে সব কিছু বিলিয়ে দিতে পারত। ভালোবাসার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণা হবার জন্য সে উন্মুখ হয়ে আমার কাছে এসেছে, কিন্তু আমি কিছুই দিতে পারিনি। ওকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিয়েছি। একেবারেই কিছু দিইনি। ভালোবেসে প্রত্যাখ্যাত হবার মতো অপমান আর নেই। এর চাইতে বড় ব্যর্থতা, পরাজয়, মেয়েদের জীবনে আসতে পারে না। আমার কাছে রমা এই অপমানে অপমানিত হয়েছে। ওর কাছে মুখ দেখাব কি করে? কোনো সাহসে? প্রেমে প্রত্যাখ্যাত মেয়ে আহত কেউটে বা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের চাইতেও ভয়ঙ্কর। মারাত্মক। আমি আপনাদের এই আনন্দের দিনে যেতে পারব না দেবুবাবু। আমাকে ক্ষমা করবেন।
আমি শিক্ষিত। ভদ্রলোক। ভদ্রসমাজে বিচরণ করি। তাই মনের কথা বলি না। বলার মতো চারিত্রিক দৃঢ়তা, সাহস আমার নেই। অভ্যাস নেই। বরং মনের কথা চেপে রেখে বানিয়ে বানিয়ে মিষ্টি মিষ্টি মিথ্যা কথা বলতে ওস্তাদ। তাই দেবুবাবুকে এসব কিছুই বলিনি। আমি ওর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি। উনি ভেবেছেন আমি নিশ্চয়ই যাব। এমন আনন্দের দিনে আমি ওঁদের পাশে দাঁড়াব না? তাই কি কখনও হয়?
সুভাষদা মস্কো থেকে ফিরে এলেন। আগেই চিঠি পেয়েছিলাম কিন্তু তবুও এয়ারপোর্টে যাইনি।
যে কারণে দেবুদের গৃহপ্রবেশের দিন যায়নি, ঐ একই কারণে পালাম যাইনি। কিন্তু পালামে গিয়ে ওঁদের অভ্যর্থনা করার জন্য মনটা সত্যি বড় ব্যাকুল হয়েছিল। সুভাষদার সংসারে যে মর্যাদা, ভালোবাসা পেয়েছি তার তুলনা হয় না। কত মানুষের সঙ্গেই তো আলাপ হয় কিন্তু কজন এভাবে। আমাকে আপন করে নিয়েছেন? একজন অপরিচিত সাংবাদিকের কাছে এভাবে নিজেদের বিলিয়ে দিতে পারেন? খুব কম। প্রায় দুর্লভ। আমার জীবনের অনেক দৈন্য, অভাব, অপূর্ণতা এরা ভরিয়ে দিয়েছে। এদের কাছে আমার ঋণ অশেষ। সীমাহীন। কল্পনাতীত। মাতৃ ঋণ যদি শোধ করা না যায় তাহলে এদের ভালোবাসার ঋণই বা শোধ করা যাবে কি ভাবে? স্নেহ-ভালোবাসার ঋণ কখনই শোধ করা যায় না। আমি ওঁদের ঋণ থেকে মুক্ত হতে পারব না। চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হব। তাই শুধু কৃতজ্ঞতার বোঝা বহন করা ছাড়া আমার দ্বারা আর কিছু হবে না। আমার সঙ্গে আলাপ হবার পর ওঁরা যতবার দিল্লি দিয়ে আসা-যাওয়া করেছেন, প্রত্যেকবার আমি উপস্থিত থেকেছি। শত কাজের মধ্যেও না যাবার কোনো কারণ হয়নি। হবে কেন? আমি যখন আমেরিকা থেকে ফিরি তখন সুভাষদা আর বৌদি ওঁদের গাড়িতে আমাকে নিউইয়র্ক পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমার মতো একজন সাধারণ সাংবাদিকদের জন্য অন্য কোনো ভারতীয় ডিপ্লোম্যাট আর তার স্ত্রী এত কষ্ট করবেন? কেউ না। শত শত ভারতীয় ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে আমার আলাপ, বন্ধুত্ব, ঘনিষ্ঠতা। বিদেশে কত অলস সন্ধ্যা এঁদের সঙ্গে কাটাই। আড্ডা দিই, সিনেমা-থিয়েটারে যাই, লাঞ্চ-ডিনার খাই, হুইস্কির বোতল শেষ করি, কিন্তু সুভাষদা-জয়ন্তী বৌদির মতো কেউ স্বেচ্ছায় হাসি মুখে আমাকে। বিদায় জানাতে আসেন না এয়ারপোর্ট। আমি আশা করি না। আশা করা অন্যায়। সেই সুভাষদা আর জয়ন্তী বৌদি আসছেন কিন্তু গেলাম না। ভাবলেও অবাক লাগে। সুভাষদা রিটায়ার করে ফিরছেন। আর কোনোদিন পালাম এয়ারপোর্ট দিয়ে আসা-যাওয়া করবেন না। তিন-চার বছর পর। পর স্বদেশ-বিদেশের মধ্যে আর খেয়া পারাপার করবেন না। অন্যবার কোনো কারণে এয়ারপোর্টে না গেলেও হয়তো কিছু মনে করতেন না। ভাবতেন, বুঝতেন আমি কোনো কাজে আটকে পড়েছি, কিন্তু এবার মনে মনে একটু আহত নিশ্চয়ই হবেন। হয়তো ভাববেন রিটায়ার করেছে বলে আমি আর ওঁদের গুরুত্ব বা মর্যাদা দিচ্ছি না। হয়তো মনে করবেন আমি ওঁদের উপেক্ষা করলাম। আমি পাল্টে গেছি। আমি আর ওঁদের চাই না। আমার জীবনে ওঁদের ভূমিকা শেষ। জানি না আরো কত কি ভাববেন। এসব ভাবনা হওয়া স্বাভাবিক। অন্যায় নয়। আমি কিছু বলতে পারব না।কিন্তু বিবেক? বিবেকের কাছে তো আমাকে জবাবদিহি করতেই হবে। কি বলব বিবেককে? বলব, আমি ভীরু কাপুরুষ, আমি অকৃতজ্ঞ? বলব, আমি রমার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার মতো মনের জোর, চরিত্রের দৃঢ়তা হারিয়েছি? তাই কি কখনও হয়? ওঁরা এয়ারপোর্টে নেমে নিশ্চয়ই আমার কথা জিজ্ঞাসা করবেন, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারবেন না। যে বলতে পারে সে তত আমার নামও উচ্চারণ করবে না।
টেলিফোনেই সুভাষদাকে বললাম, এয়ারপোর্টে যেতে পারলাম না বলে নিশ্চয়ই রাগ করেছেন?
রাগ করব কেন? তবে আশা করেছিলাম তুমি থাকবেই।
নিশ্চয়ই আশা করবেন। আপনারা আমাকে এতো ভালোবাসেন আর এইটুকু আশা করবেন না?
একবার ভাবলাম হয়তো চিঠি পাওনি, কিন্তু যাদের চিঠি দিয়েছিলাম তাদের মধ্যে শুধু তোমাকেই দেখতে না পেয়ে মনে হলো চিঠি ঠিকই পেয়েছ।
ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে চিঠি পাঠিয়েছেন। না পাবার তো কোনো কারণ নেই।
তোমার বৌদি অবশ্য বলছিলেন নিশ্চয়ই কোনো জরুরি কাজে আটকে গিয়েছে।
বৌদির ফিফথ সেন্স রিয়েলি খুব স্ট্রং।
তা ঠিক। আমি অনেকবার তার প্রমাণ পেয়েছি।
আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলাম, বৌদি পাশে আছেন?
না।
আপনার কথাগুলো বৌদি শুনলে খুব খুশী হতেন।
কথাগুলো শুনলে বলতো, আমি ওকে শোনাবার জন্যই প্রশংসা করছি।
বৌদি কি কোনো কাজ করছেন?
কাজ আবার কি করবে? নিশ্চয়ই ভিতরের ঘরে বসে রমার সঙ্গে গল্প করছে।
দেবু এখানে আছে নাকি?
না, ও তো এখানে নেই। গৃহপ্রবেশের পর পরই ব্যাঙ্গালোরে চলে গেছে।
তাই নাকি? ও চলে গেছে, তুমি জানতে না?
না।
সুভাষদা একটু বিস্ময়ের সঙ্গেই জিজ্ঞাসা করলেন, দেবু যাবার আগে তোমার সঙ্গে দেখা করেনি?
না। বোধহয় সময় পায়নি।
সময় পায়নি একটা কোনো কথাই নয়। এখান থেকে তোমার ওখানে ঘুরে আসতে কতক্ষণ আর সময় লাগে?
নিশ্চয়ই এমন কোনো কাজে জড়িয়ে পড়েছিল যে…।
এই কথার পুনরাবৃত্তি করছিলাম বলে সুভাষদা প্রশ্ন করলেন, তুমি এর মধ্যে ওদের এখানে এসেছিলে নাকি?
না দাদা, আমিও আর যেয়ে উঠতে পারিনি।
সুভাষদা ডিপ্লোম্যাট। কূটনীতিবিদ। বেশি কথা না বললেও অনেক কথা বুঝতে পারেন। অনুমান করতে পারেন। তাই বোধহয় ঐ বিষয়ে আর কিছু জানতে চাইলেন না। জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার। বৌদির সঙ্গে কথা বলবে?
নিশ্চয়ই।
একটু ধরো, ডেকে দিচ্ছি।
একটু পরেই বৌদি টেলিফোন তুলে নিলেন। অনেক কাল পরে টেলিফোনে বৌদির গলা শুনেই চমকে উঠলাম। ঠিক রমার মতো শোনাল। বললেন, তোমার দাদার কাছে শুনলাম কাজে আটকে পড়েছিলে বলে এয়ারপোর্টে আসতে পারনি।
এমন কাজের চাপ পড়েছে যে কি বলব?
শুনলাম এই নতুন বাড়িও তুমি দেখতে আসনি।
আমার এক কলিগ চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় একা আমার উপর সব কাজের চাপ পড়েছে…
আমি তোমার দাদাকেও ঠিক এই কথাই বলছিলাম…
যাই হোক টেলিফোনেই একটা অনুরোধ করব। রাখবেন তো?
তোমার অনুরোধ রাখব না? বল কি ব্যাপার।
কাল আপনারা দুজনে আমার এখানে খাবেন।
কখন?
দিনে অথবা রাত্রে। যখন আপনাদের সুবিধে।
আমাদের আবার অসুবিধে কি? দুপুর বেলাতেই আসব।
খুব ভালো।
.
ওঁরা যখনই দিল্লি এসেছেন তখনই দুএক বেলা আমার বাসায় থেকেছে, খেয়েছে। তবে শুধু ওঁরা দুজনে কখনই আসেননি। এসেছে দেবুকে নিয়ে, রমাকে নিয়ে। দেবু দিল্লিতে না থাকলে রমাকে নিয়েই এসেছেন। কি দারুণ আনন্দে যে সময়টা কেটে যেতে তা ভাবলে অবাক লাগে। একবার সুভাষদা আগের দিন রাত্রেই আমার এখানে চলে এলেন। এসেই বললেন, রাত্রেই তোমার এখানে চলে এলাম।
খুব খুশী হয়েই বললাম, খুব ভালো করেছেন, কিন্তু বৌদি কোথায়?
তোমার বৌদি বা রমা আসেনি। আমি একলাই চলে এলাম।
ওঁদের নিয়ে এলেন না কেন?
ওরা এলে কি আমরা ঘুমুতে পারতাম? ঘুমুবার জন্যই তো তোমার এখানে চলে এলাম।
ওরা সকালেই আসবে তো?
কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।
তার মানে? অন্য কোন প্রোগ্রাম আছে নাকি?
প্রোগ্রাম আবার কি থাকবে?…
তাহলে আসার ঠিক নেই মানে?
একবার শুনছিলাম ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠেই চলে আসবে। তারপর একবার শুনলাম লাইক রিয়েল গেস্টস ঠিক একটায় আসবে…
আমি হাসতে হাসতে বললাম, একটার সময় এলে আমি বাড়িতে ঢুকতে দেব নাকি?
ওদের ঢুকতে দেবে কি না দেবে, সে তুমিই জান, আমাকে তো বিরক্ত করবে না?
সুভাষদা আমার ঘরে ঘুমুচ্ছেন। আমি আমার স্টাডিতে ডিভানের উপর চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছি। হঠাৎ কানের কাছে খুব মিহি মিষ্টি ডাক শুনলাম, উঠবেন না? চা নিয়ে এসেছি।
দুতিনবার। ঘুম ভেঙে গেলেও ঘোর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। ভাবলাম বোধহয় স্বপ্ন দেখছি।
উঠুন। চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে।
চাদর সরিয়ে দেখি রমা। তুমি?
হ্যাঁ আমি।
কখন এলে?
অনেকক্ষণ।
বৌদি কোথায়?
বাথরুমে।
তুমি চা নিয়ে এলে যে?
ঘুম থেকে উঠে আমার মুখ দেখতে নেই বুঝি?
না। অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে।
তার মানে?
তার মানে এর পর আর অন্যের মুখ দেখলে সহ্য করতে পারব না।
আপনার অভ্যাস খারাপ করার ক্ষমতা আমার নেই।
কথার মোড় ঘোরালাম, তোমার বাবাকে চা দিয়েছ?
এত ভোরে বাবাকে চা দেব?
কেন? কটা বাজে?
সাড়ে ছটা।
সাড়ে ছটা। আমি আঁতকে উঠি। তাহলে তোমরা কখন এসেছ?
আধ ঘন্টা আগে।
রাত্রে কি ঘুমোওনি?
আপনার জন্য কি ঘুমুবার উপায় আছে?
আমার জন্য ঘুমুতে পার না?
না।
তার মানে?
সব কথার মানে বলতে পারব না। নিন উঠুন। চা খেয়ে নিন।
বৌদি বাথরুম থেকে বেরুবার পর বললাম, স্বামীর জন্য যদি এভাবে ভোরবেলায় ছুটে আসেন তাহলে মেয়ে-জামাই কি শিখবে বলুন তো?
বৌদি হাসতে হাসতে বললেন, ওদের যা কিছু শেখাবার তা তুমি যথেষ্ট শেখাতে পারবে। আমাকে কিছু শেখাতে হবে না।
রাধাকিষণকে নিয়ে বৌদি বাজারে গেলেন। কিছুতেই আমাকে যেতে দিলেন না। মা বললো, মা যখন এসেছেন তখন সংসারের ব্যাপারে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না।
আমি বললাম, উনি কদিনের জন্য বেড়াতে এসেও সংসারের ঝামেলা সহ্য করবেন? আমাকে যদি দায়িত্ব দিতে না চাও তাহলে তুমি তো নিতে পারতে।
ও স্পষ্ট বললো, আমি টেম্পোরারী দায়িত্ব নিই না।
আমি আর সুভাষদা বসে বসে শুধু পলিটিক্স আলোচনা করেছি, চা-কফি খেয়েছি, সিগারেই টেনেছি। মাঝে মাঝে কিচেনের কাছে গিয়ে বলেছি, ইফ দেয়ার ইজ এনি ডিফিকাল্টি লেট মী মো।
টিপ্পনী কাটার সুযোগ রমা ছাড়ে না, আমার উপর মাতব্বরী করেন বলে কি মার উপরেও মাতব্বরী করবেন?
তোমার উপর আমি মাতব্বরী করব? এত সাহস আমার নেই!
জয়ন্তী বৌদি হাসেন।
সুভাষদা একা ঘরে বসে থাকতে পারেন না। হেলতে দুলতে কিচেনের সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, বাজার-টাজার যেতে হবে নাকি?
জয়ন্তী বৌদি হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন কি দায়িত্বশীল লোক দেখেছ! পৌনে বারোটার সময় বাজার যাবেন কিনা জিজ্ঞাসা করছেন।
আমি বললাম, বৌদি, একে বলে সেকেন্ড লাইন অব ডিফেন্স। বাই চান্স যদি আপনি কিছু ভুলে যান…
তুমি, চুপ করো তো। তোমাকে আর ওর মোসাহেবী করতে হবে না!
সারপ্রাইজিং! সবাই বলে আমি আপনার আর রমার মোসাহেবী করি।
রমা রেগে যায়, এইসব বাজে কথা বললে কিন্তু ভালো হবে না।
যে কথাই বলি না কেন, তুমি আমার ভালো করবে না। সুতরাং ও ভয়ে কম্পিত নয় জার্নালিস্টের হৃদয়!
সুভাষদা হাসতে হাসতে ড্রইংরুমে চলে গেলেন। বৌদিও রান্নায় মন দিলেন। রমা বললো, জার্নালিস্টদের হৃদয় থাকে নাকি?
একবার সুভাষদা ফরেন সেক্রেটারির সঙ্গে জরুরি পরামর্শের জন্য কায়রো থেকে কয়েক দিনের জন্য দিল্লি এলেন। রমা তখন বেনারসে, কিন্তু কিছুতেই সুভাষদার পক্ষে বেনারস যাওয়া সম্ভব ছিল না। অথচ কায়রো থেকে দিল্লি এসেও মেয়ের সঙ্গে দেখা হবে না, তাও হয় না। আমার কাছে সুভাষদার টেলিগ্রাম এলো, রিচিং মনডে আর্লি মর্নিং ফর আর্জেন্ট কনশালটেশন। রমা রিচিং সানডে অর মনডে বাই এয়ার। সুভাষদার টেলিগ্রাম এলো শুক্রবার সকালে। শনিবার দুপুরে অফিস বেরুবার সময় রমার টেলিগ্রাম এলো, রিচিং মনডে ভায়া লখনৌ অ্যাটেন্ড পালাম।
সুভাষদা আর রমা পাঁচদিন আমার কাছেই ছিলেন। তিনজনে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট খাবার পর সাড়ে নটায় সুভাষদা সাউথ ব্লক যেতেন। একটা দেড়টা-দুটোয় লাঞ্চে এসে আবার তিনটের মধ্যে ফিরে যেতেন। তারপর ফিরতে ফিরতে সাড়ে ছটা-সাতটা হয়ে যেতো। রোজ রাত্রে আমরা তিনজনে বাইরে খেতাম। একদিন নাইট শোতে সিনেমাও দেখেছিলাম। তারপর একই দিনে ওঁরা দুজনে পালাম থেকে চলে গেলেন।
ওই একবারই রমা আমার বাড়িতে থেকেছে। রাধাকিষণ সংসার চালাতো। আমি অফিসে গিয়ে বুড়ি ছুঁয়েই চলে এসেছি। থাকলেও এক ঘণ্টার বেশি কোনদিন থাকিনি। বাকি সময় বাড়িতে বসে বসে রমার সঙ্গে গল্প করেছি, আড্ডা দিয়েছি।
আমরা এসে আপনার কাজের খুব ক্ষতি করছি, তাই না? খবরের কাগজ পড়তে পড়তে নামিয়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল।
জীবনে কিছু ক্ষতি স্বীকার না করলে তো লাভও করা যায় না।
এ ক্ষতির বিনিময়ে কি আর লাভ করছেন?
আমি সিগারেট ধরিয়েই বললাম, এভাবে তোমার সঙ্গে আড্ডা দিতে পারছি, এটাই কি কম লাভ?
আমাকে খুশী করার জন্য এসব কথা বলে কি লাভ?
তোমাকে খুশী করার জন্য তো বলছি না। বলছি আমার মনের কথা।
রমা আবার একটু হাসল, বললো, যাই বলুন, আপনার কথা ভাবলে আমার অবাক লাগে।
কেন?
হঠাৎ কিভাবে আলাপ হলো, ঘনিষ্ঠতা হলো ভাবলে অবাক লাগে।
আমিও মাঝে মাঝে এই একই কথা ভাবি। কত ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গেই তো আলাপ, কিন্তু কেউ কি তাদের এমন সুন্দরী মেয়েকে আমার হেপাজতে রাখবে?
কেউ বুঝি আপনাকে বিশ্বাস করেন না?
তুমিও দেখছি ডিপ্লোম্যাটদের মতো কথা ঘোরাতে ওস্তাদ হয়েছ।
.
সেই আমি রমাকে আসতে বললাম না। বলতে পারলাম না। শুধু সুভাষদা আর বৌদিই এলেন। রাধাকিষণ অনেক কিছু রান্না করেছিল। অনেক গল্পগুজব করলাম ওঁদের দুজনের সঙ্গে, কিন্তু কিছুতেই সেই আগের মতো আনন্দ পেলাম না। হলো না। অনেক সহজ সরল করে মেলামেশা করলেও মনে মনে সব সময় একটু অস্বক্তিবোধ না করে পারলাম না। বিকেলের দিকে যাবার সময় সুভাষদা শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা না করে আর পারলেন না, ডক্টর চৌধুরী বা দেবু বা রমা কি তোমার সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করেছেন?
আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলাম, না না, ওঁরা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবেন কেন?
তাহলে তুমি কি কোনো ব্যাপারে দুঃখ পেয়েছ?
সে রকম কিছু তো ঘটেনি।
যাই বল ভাই কিছু একটা ঘটেছে।
কিছুই ঘটেনি। তবে আপনাদের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠতা আছে তা তো ওঁদের সঙ্গে হতে পারে না, হবে না।
দ্যাটস্ ট্রু বাট…
ডক্টর চৌধুরী ইজ রেয়েলি সামবডি অব ডেলহি। আমার মতো জার্নালিস্টের পক্ষে ওখানে খুব বেশি যাতায়াত করা ঠিক নয়। তাছাড়া আমার এক কলিগ চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় আমার উপর ভীষণ কাজের চাপ পড়েছে। সত্য কথাটা চাপার জন্য গড় গড় করে অনেক কথা বললাম।
বৌদি চুপ করে আমাদের কথা শুনলেন, একটি কথাও বললেন না। ট্যাক্সিতে চড়বার আগে শুধু বললেন, রমা যদি কোনো অন্যায় করে থাকে তাহলে ক্ষমা করে দিও।
না, না, বৌদি, রমা কিছু অন্যায় করেনি।
করা উচিত নয়, কিন্তু করতেও তো পারে। ভুল করেও মানুষ অন্যায় করে।
না, না, ও কিছুই করেনি।
.
সুভাষদা আর বৌদি দশদিন দিল্লি ছিলেন। একদিন ডক্টর চৌধুরী আমাকে নেমন্তন্নও করেছিলেন। পাছে ওঁরা আমাকে সন্দেহ করেন, একদিনের জন্য আগ্রা চলে গিয়েছি। আমি রঞ্জনাকে বিরক্ত করিনি।