হাজী একরামুল্লাহ বললেন, মা আমি যে তোর মঙ্গল চাই এটা কি তুই জানিস?
হামিদা বলল, আসল কথাটা বলে ফেল মামা। ভনিতা করছ কেন?
হাজী সাহেব বললেন, আমি তোর মঙ্গল চাই এটাই আসল কথা।
হামিদা বলল, ঠিক আছে তুমি আমার মঙ্গল চাও। আমার প্রতি এই শুভকামনার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।
এ রকম ক্যাটক্যাট করে কথা বলছিস কেন মা? আয় আমরা সহজভাবে কিছুক্ষণ আলাপ করি। চিন্তায় তোর চোখ মুখ ছোট হয়ে গেছে। এ রকম অবস্থায় থাকলে কিছুদিনের মধ্যে তোর সব চুল পেকে যাবে। তুই একটা সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিস। আয় তোর সমস্যার সমাধান করি।
তুমি আমার সমস্যার সমাধান করবে?
আমি একা করব কীভাবে। তুই আমি আমরা দুজনে আলাপ করব। দরকার হলে আলাউদ্দিনকে ডাকব।
উনাকে ডাকবে কেন?
তোর সমস্যাটা তো তাকে নিয়েই। তাকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু তার সঙ্গে থাকছিস না।
হামিদা বলল, মামা আমি যে তোমার এখানে আছি তাতে কি তোমার অসুবিধা হচ্ছে? একটা বড় ঘর একা দখল করে আছি। অসুবিধা হবার কথা। যদি হয় খোলাখুলি বলে আমি চলে যাব।
কোথায় যাবি? নিজের বাসায় ফিরে যাবি?
না। মেয়েদের কোনো হোস্টেলে গিয়ে উঠব। চাকরিজীবী মহিলাদের জন্যে ঢাকা শহরে অনেক হোস্টেল তৈরি হয়েছে।
তোর নিজের বাড়িতে তুই যাবি না?
না। মামা তোমার কথা কি শেষ হয়েছে? আমি এখন উঠ। আমার মাথা ধরেছে। দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে থাকব।
হাজী সাহেব বললেন, আচ্ছা যা।
হামিদা বলল, শেষ কোনো কথা থাকলে বলতে পার।
হাজী সাহেব বললেন, এ রকম দুটফট করলে তো শেষ কথা বলতে পারব। শান্ত হয়ে সে। নে একটা পান খা।
মামা আমি পান খাই না।
খেয়ে দেখ ভালো লাগবে। মিষ্টি পান।
হামিদা বলল, পানটান কিছু খাব না। শেষ কথা কী বলতে চাচ্ছে বলো। আমি মন দিয়ে শুনছি।
হাজী সাহেব একটা পানি মুখে দিলেন। হামিদার পিঠে হাত রেখে নরম গলায় বললেন, আমি তার মঙ্গল চাই।
হামিদা অস্পষ্টভাবে হাসল।
হাজী সাহেব বললেন, তুই যদি আলাউদ্দিনের সঙ্গে বাস করতে না পারিস তাহলে বিয়ে ভেঙে দেয়া উচিত। বিয়ে তো কোনো খেলা না। সিরিয়াস ব্যাপার। যদি তুই ভাবিস বিয়েটা ভুল হয়ে গেছে, তাহলে সেই ভুল হজম করতে হবে কেন?
হামিদা ক্ষীণস্বরে বলল, তুমি এই লাইনে কথা বলবে আমি বুঝতে পারি নি। থ্যাংক য়ু।
হাজী সাহেব বললেন, বিয়ে ভেঙে দেবার আগে তোক কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হবে ভুল হয়েছে।
পুরোপুরি নিশ্চিত কীভাবে হব?
পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হলে তার নিজের বাড়িতে গিয়ে আলাউদ্দিনের সঙ্গে বাস করতে হবে। তাকে কাছাকাছি থেকে কিছুদিন দেখতে হবে। তোদের দুজনকে যে এক ঘরেই বাস করতে হবে তা তো না। তুই একটা ঘরে থাকবি। আলাউদ্দিন অন্য একটা ঘরে থাকবে। আলাউদ্দিন অবুঝ না। তাকে বললেই সে বুঝবে। আমি তোকে বেশি দিন থাকতে বলছি না। এক সপ্তাহ থাকলেই হবে।
এক সপ্তাহ?
হ্যাঁ এক সপ্তাহ। মা রাজি হয়ে যা। আমি বুড়ো মানুষ, আমি তোর কাছে হাতজোড় করছি।
হামিদা বিরক্ত হয়ে বলল, যাত্রা থিয়েটার করবে না মামা। হাতজোড় করা। আবার কী? ঠিক আছে আমি থাকব এক সপ্তাহ।
তাহলে একটা তারিখ ঠিক করে ফেলি। কবে যাবি সেই তারিখ।
ঠিক কর।
বুধবার, নয় তারিখ। ঠিক আছে? বুধবার নয় তারিখ সকালে তোকে আমি ঐ বাড়িতে রেখে আসব।
বুধবার কেন? বুধবার কি বিশেষ কোনো দিন?
একটা দিন ঠিক করতে হয় এই জন্যে ঠিক করা।
হামিদা ছোট্র নিঃশ্বাস ফেলে বলল–আমার ধারণা কী জানো মামা? আমার ধারণা তুমি আলাউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে আগেই আলাপ করে এই দিনটা ঠিক করে এসেছ। তার সঙ্গে কথা বলে সব ঠিকঠাক করে এসেছ আমার কাছে। আমি কি ভুল বললাম?
হাজী সাহেব জবাব দিলেন না।
হামিদা বলল, মামা আমার বুদ্ধি কেমন?
হাজী সাহেব বললেন, তোর বুদ্ধি ভালো। মাশাল্লাহ।
হামিদা বিছানায় শুয়ে আছে। তার মাথায় চাপা যন্ত্রণা হচ্ছে। মাথাব্যথার ওষুধে এই যন্ত্রণা যাবে না। মাথার ভোতা যন্ত্রণা বিয়ের পর থেকেই শুরু হয়েছে। বাড়ছে কমছে, পুরোপুরি কখনো যাচ্ছে না। হামিদা এখন প্রায় নিশ্চিত এই যন্ত্রণা কখনো যাবে না। কোনো কিছু নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকলে যন্ত্রণা সাময়িকভাবে ভুলে থাকা যায়। ব্যস্ত রাখার মতো কিছু হামিদা খুঁজে পাচ্ছে না।
দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছে। হামিদ বিরক্ত গলায় বলল, কে?
হাজী সাহেবের কাজের মেয়ে বলল, ভাত খাইতে আসেন।
হামিদা বলল, আমি রাতে কিছু খাব না। তুমি মামিকে গিয়ে বলবে খাওয়া নিয়ে একটু পরে পরে আমাকে যেন বিরক্ত না করে। আমার ঘরেও যেন খাবার না পাঠায়। বুঝতে পারছ কী বলছি?
জি।
এখন যাও। খবরদার আবার ফিরে আসবে না। আমার মেজাজ খুবই খারাপ। আবার যদি তুমি ফিরে আস, কিংবা অন্য কেউ ভাত খাওয়া খাওয়ির জন্যে সাধাসাধি করতে আসে তাহলে আমি কোনো একটা হোটেলে গিয়ে উঠল।
হামিদা বিছানা থেকে উঠে দরজার ছিটকিনি লাগাল। কাগজ কলম নিয়ে। মেয়েদের চিঠি লিখতে বসল। এখানে কী ঘটছে মেয়েদের জানানো প্রয়োজন। তার বিয়ের পর মেয়েদের সঙ্গে টেলিফোনে দুতিন মিনিট করে কথা বেশ কয়েকবার হয়েছে। তাতে তাদেরকে তেমন কিছুই বলা হয় নি। পুরো ব্যাপারটা ভালো মতো উজানাতে হবে। চিঠি লিখতে হবে সাবধানে, কারণ মেয়েরা এই চিঠি শুধু যে নিজেরা পড়বে তা না— তাদের স্বামীদেরও পড়াবে। বিবাহিত মেয়েদের কাছে একান্তই ব্যক্তিগত কোনো চিঠি পাঠানো যায় না। তারা আহ্লাদ দেখানোর জনেঃ ব্যক্তিগত সবকিছুই স্বামীকে দেখায়। চিঠি একটা লিখে ফটোকপি করে দু মেয়েকে পাঠালে হবে না। দুজনকে আলাদা করে লিখতে হবে।
হামিদার মাথার যন্ত্রণা বাড়তে শুরু করেছে। আরো বাড়ার আগেই চিঠি শেষ করা দরকার। মেয়েদেরকে চিঠিতে অনেক আহাদ আহ্লাদী কথা লিখতে হয়। মাথার যন্ত্রণা বেড়ে গেলে আহ্লাদী কথাগুলি আসবে না।
আমার প্রিয় মা ‘রু’,
কেমন আছ গো মা মণি? কেমন চলছে তোমার সংসার? জামাই কেমন আছে? তার পায়ের পাতায় কোড়া হয়েছিল বলেছিলে। সেটার অবস্থা কী? মা গো তুমি মোজা নিয়মিত ধুয়ে দাও তো? তোমার ওয়াশিং মেশিন আছে। কাপড় ধোয়া সমস্যা হবার কথা না। আল্ডার গার্মেন্টস প্রতিদিন ধোয়া প্রয়োজন। সুজির হালুয়ার রং শাদা হয়ে যাচ্ছে কেন জানতে চেয়েছিলে। সুজি সামান্য ভেজে নিতে পার। অনেকে আবার জাফরান দিয়েও রং করে। হলুদ দিয়ে রং করতে যেও না। হলুদের তিতা একটা স্বাদ আছে। মিষ্টি জাতীয় খাবারে হলুদ দেয়া যায় না। কাচা হলুদের রস একি ফোঁটা দিল সুন্দর রঙ হয়। তোমাদের দেশে কাচা হলুদ আছে কি-না, তা তো জানি না।
এখন নিজের প্রসঙ্গে আসি। কিছু কিছু কাজ আছে, মানুষ জানে কাজটা ভুল, তারপরেও কাজটা করে। কাজটা করার পর ভুলটা যে কত বড় তা ধরতে পারে। তখন আর ভুল শোধরানোর উপায় থাকে না। আমি এ ধরনের একটা ভুল করে ফেলেছি। এখন আমার মাথা আউলা হয়ে আছে। মাথা আউলা শব্দটা তোমার বাবা ব্যবহার করতেন। মানুষটা নেই কিন্তু সে তার অনেক কথাবার্তা ছড়িয়ে রেখে গেছে। ঐ যে বিখ্যাত লাইন— পাখি উড়ে চলে গেলেও পাখির পালক পড়ে থাকে।
আমি আমার নিজের ভুলের কথা ইনিয়ে-বিনিয়ে লেখার জন্যে তোমাকে চিঠি লিখতে বসি নি। তোমার সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টাও করছি না। সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টাটা আমার কাছে সব সময় খুব অরুচিকর মনে হয়েছে। তোমার বাবার মৃত্যুর পর তোমাদেরকে নিয়ে আমি যখন গভীর জলে পড়ে গেলাম তখন অনেকেই সহানুভূতি দেখাতে এগিয়ে এসেছিলেন। রাগে আমার এখন গা জ্বলতো। এখনো জ্বলে। আমি একটা সমস্যায় পড়েছি। এই সমস্যার সমাধান আমি নিজেই করব। তার জন্যে তোমাদের কাছে কখনো মাল না। এবং আমি আশা করব যে আমি দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি এই ভেবে তোমরা আমাকে সহানুভূতি দেখতে আসবে না।
এখন কিছু অদ্ভুত ঘটনা তোমাকে বলি। ঘটনাগুলি কাকতালীয়। কিন্তু একের পর এক কয়েকটা কাকতালীয় ব্যাপার ঘটবে তাও আমি মানতে পারছি না। ব্যাপারটা কী শান— আগের কথামতো আলাউদ্দিন সাহেব এক সকালে তার বাবুর্চিকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। আমার সঙ্গে দেখা হলো না। তিনি জিনিসপত্র নামিয়ে বাজারে চলে গেলেন, জরুরি কী সব কেনাকাটা না-কি বাকি আছে। তার সঙ্গে দেখা হলো দুপুরে। তিনি জিলাপি এবং বেলি ফুল নিয়ে এসেছেন। কাকতালীয় ব্যাপারটা বুঝতে পার? বুঝতে পারা উচিত। তোমাদেরকে আমি অনেকবার বলেছি– জিলাপি এবং বেলি ফুল তোমার বাবার খুবই পছন্দের জিনিস। সে বাজারে গেলেই খুঁজে পেতে জিলাপি নিয়ে আসত। বেলি ফুলের সিজনে সে বেলি ফুল ছাড়া বাসায় এসেছে এরকম কখনো হয় নি। আলাউদ্দিন নামের মানুষটা বেছে বেছে প্রথম দিনেই জিলাপি এবং বেলি ফুল আনবে কেন? আচ্ছা ধরে নিলাম। কাকালীয়। আমাদের পৃথিবীতে বিস্মিত হবার মতো কাকতালীয় ব্যাপার যে ঘটে না তা-না। অবশ্যই ঘটে। পর পর ঘটে না।
দ্বিতীয় কাকতালীয় ব্যাপারটা সেদিনই ঘটল। আলাউদ্দিন সাহেব হঠাৎ এক সময় আমাকে জামিলা ডাকতে লাগলেন। তোমাদের আমি বলেছি যে তোমার বাবা ঠাট্টা করে আমাকে ডাকতেন— মিসেস ঝামিল। আমি শুধু ঝামেলা করি, এই জন্যেই আমার নাম মিসেস ঝামিলী। জামিলা এবং ঝামিলা এই দুটি নাম কী পরিমাণ কাছাকাছি তা কি বুঝতে পারছ? উনি যখন অবিকল তোমার বাবার মতো গলায় আমাকে জামিলা ডাকলেন আমি এতই মাক হলাম যে মাথায় একটা চক্কর দিয়ে উঠল। উনি কেন আমাকে জামিলা ডাকলেন তার একটা ব্যাখ্যা দিলেন। ব্যাখ্যা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হলো না। আমার কাছে মনে হলো (এখনো মনে হচ্ছে) ব্যাখ্যার বাইরে অন্য কিছু আছে। সেই অন্য কিছুটা যে কী হ। ধরতে পারছি না।
আলাউদ্দিন সাহেব সঙ্গে করে একজন বাবুর্চি নিয়ে এসেছেন। নাম কুটু মিয়া। অলিউদ্দিন সাহেবের আচার ব্যবহার এবং চলাফেরায় কোনো রহস্যময়তা নেই। তিনি আর দশটা মানুষের মতোই, কিন্তু কুটু মিয়া নামের মানুষটা অন্যরকম। প্রথম দেখাতেই আমি তাকে যতটা অপছন্দ করেছি আর কাউকে এর একশ ভাগের এক ভাগ অপছন্দও করি নি। তাকে দেখে প্রথম যে ধারণাটা হয় তা হলো এই লোক মানুষের সমাজে বাস করে না, এ বাস করে ম্যানহোলের। ভেতরের কোনো জগতে। সে আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াল। চায়ে মুখ দিয়েই মনে হলো কোথাও কোনো গগোল মাই। কারণ চা-টা ছিল মশলা চা। তোমাদের জন্ম হবার আগে তোমাদের বাবা একবার মামাকে নিয়ে চারদিনের জন্যে কাঠম গিয়েছিলেন। সেখানেই আমি প্রথম। মশলা চা খাই। সেই চায়ের স্বাদ আমার মুখে লেগে ছিল। কুটু মিয়া বেছে বেছে অবিকল সেই চা-ই কেন বানিয়ে দিল? ঘটনা কী?
ঘটনা অবশ্যই আছে। ঘটনার ব্যাখ্যাও আছে। আমার মাথা তোমার বাবার ভাষায় আউলা হয়ে আছে বলে ঘটনার ব্যাখ্যা বের করতে পারছি না। আমি নিশ্চিত একদিন পারব। তোমার মাথায় কোনো ব্যাখ্যা এলে আমাকে চিঠি লিখে জানি।
এখন আলাউদ্দিন সাহেব তাঁর বাবুর্চিকে নিয়ে আমার বালায় বাস করছেন। আমি চলে এসেছি বড় মামার বাড়িতে। এই অবস্থা কত দিন চলবে বুঝতে পারছি না।
এদিকে আবার আরেক সমস্যা আমার বাড়ির এক তলায় যে ভাড়াটে থাকতেন, ইঞ্জিনিয়ার শফিক সাহেব, উনি গতকাল সকালে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি প্রায় সাত বছর ছিলেন। তার মতো ভালো ভাড়াটে পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাকে আমি বড় ভাইয়ের মতো দেখতাম। বিপদে আপদে তার সাহায্য নিতাম। তিনি চলে যাওয়ায় আমি খানিকটা অসহায় বোধ করছি। তার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণটিও বিচিত্র। তিনি যা বললেন সেটা হচ্ছে— আলাউদ্দিন সাহেব কুটু মিয়াকে নিয়ে যেদিন ঐ বাড়িতে উঠলেন সেদিন সন্ধ্যায় রাস্তার একটা কালো কুকুর এসে বাড়ির বারান্দায় স্থায়ী হলো। সন্ধ্যার পর থেকে ঐ কুকুর বাড়ির চারদিকে চক্কর দেয় এবং মানুষের মতো করে কাঁদে। বাড়ির চারপাশে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে কুকুর বিড়ালের কান্না খুবই অশুভ বলে বিবেচনা করা হয়। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মা অস্থির হয়ে গেলেন। কুকুরটাকে দূর করার চেষ্টা করা হলো— লাঠি দিয়ে তাড়া করলে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার চলে আসে।
পরদিন এই কালো কুকুরটার সঙ্গে আরো দুটা কুকুর যুক্ত হলো। দিনের বেলা এরা কিছু করে না। চুপচাপ বারান্দায় বসে থাকে। সন্ধ্যা মিলার পর থেকেই বাড়ির চারপাশে হাঁটা শুরু করে এবং কান্না শুরু করে। শফিক সাহেব মিউনিসিপালিটিকে খবর দিলেন। ওরা কুকুর ধরা গাড়ি নিয়ে এলো কিন্তু কুকুর ধরতে পারল না। শফিক সাহেব বাজার থেকে মাংস কিনে এনে তাতে বিষ মিশিয়ে খেতে দিলেন। ওরা সেই মাংসে মুখ দিল না।
গত মঙ্গলবার থেকে কুকুরের সংখ্যা হয়েছে চার। এর মধ্যে একটা কুকুর শফিক সাহেবের মেজো মেয়ে এবং কাজের বুয়াকে কামড়েছে। উনার বাচ্চারা কুকুরের ভয়ে ঘর থেকে বের হতে পারে না এমন অবস্থা। উনারা যে চলে গেছেন আমি তাদের দোষ ও দিতে পারছি না। আবার একের পর এক কুকুর এসে জুটছে এটাও মেনে নিতে পারছি না। আগে তো কখনো এই সমস্যা হয় নি। এখন কেন হচ্ছে?
বড় মামার সঙ্গে কথা বলেছি— উনি একজন দারোয়ানের ব্যবস্থা করেছেন। যার একমাত্র কাজ হলো কুকুর আটকানো। আজ সকালে খবর পেয়েছি দারোয়ানকে কুকুর কামড়েছে। একসঙ্গে দুটা কুকুর দুপায়ে কামড়ে ফালা ফালা করে দিয়েছে। নানান জায়গা থেকে খাবলে গোশত নিয়ে নিয়েছে। বড় মামা তাকে নিয়ে মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এসেছেন। তাকে পেথিড্রিন ইনজেকশান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে লাখা হয়েছে।
এই হচ্ছে অবস্থা। খুব যে ভালো অবস্থা না, তা তো বুঝতেই পারছ। তবে এইসব নিয়ে তোমরা মোটেই দুশ্চিন্তা করবে না। আমি নিশ্চিত প্রতিটি সমস্যারই আমি সমাধান করব। আমি যে খুব শক্ত মেয়ে তা আর কেউ জানুক বা না জানুক তোমরা দুই বোন জানোকাজেই দুশ্চিন্তা করবে না। আগামীকাল সকালে আমি আমার নিজের বাড়িতে যাব। কুকুরের সমস্যাটা কী নিজের চোখে দেখে আসব। অফিস থেকে দশ দিনের ছুটি নিয়েছিলাম। আগামীকাল ছুটি শেষ। অফিস করতে হবে ভেবেই খারাপ লাগছে। আমার এক মাসের রিক্রিয়েশন লিভ পাওনা আছে। ভাবছি এ ছুটিটা নেব। এবং সব হলে তোমাদের দুবোনকে দেখে আসব। আমার মাথার আউলা ভাব দূর করার জন্যে এটা খুবই দরকার। মা। তোমরা ভালো থেকো। আল্লাহ পাকের দরবারে এই আমার প্রার্থনা।
হামিদা চিঠি শেষ করে উঠল। মাথার চাপা যন্ত্রণাটা এতক্ষণ ছিল না। এখন। আবার শুরু হয়েছে। ক্ষিধেও লেগেছে। নিচে গিয়ে কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না। হামিদা বাথরুমে ঢুকে ভালো মতো হাতে মুখে পানি দিল। দুটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে। বিছানায় শুয়ে পড়ল। গত এক সপ্তাহ ধরেই তার ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। তার কাছে মনে হচ্ছে অনেক দিন হয়ে গেল সে তৃপ্তি মতো ঘুমুতে পারছে না। কে জানে হয়তো। এই জীবনে সে আর কোনোদিনও তৃপ্তি নিয়ে ঘুমুতে পারবে না।
অনেক দূরে কোথায় যেন কুকুর ডাকছে। ভারী গলায় ডাকছে। শহরে কুকুরের ডাক শোনা অস্বাভাবিক কিছুই না। কিন্তু এই কুকুরটা কি অন্যরকম করে ডাকছে? হামিদা পাশ ফিরল। তার নিজের উপরই বিরক্তি লাগছে। সে এমন দুর্বল। হয়ে যাচ্ছে কেন? কুকুর যেভাবে ডাকে এই কুকুরটাও সেইভাবেই ডাকছে। কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছে ডাকটা অন্যরকম। মন দুর্বল হলে এ রকম হয়। স্বাভাবিককে মনে হয় অস্বাভাবিক। হামিদা মাথা থেকে কুকুরের ডাকটা সরাবার চেষ্টা করল। সরানো যাচ্ছে না। কুকুরটা ডেকেই যাচ্ছে। এই ডাক বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত হামিদা। ঘুমুতে পারবে না।
দরজায় টোকা পড়ল। হামিদা বলল, কে?
হামিদার কাজের মেয়ে আসিয়া ভীত গলায় বলল, আফা আমি।
হামিদা বলল, কী চাও এত রাতে?
আফনের খাওন আনছি।
আমি তো বলে দিয়েছি রাতে খাব না।
মামি পাঠাইছে। সাথে দুধ আনছি। কিছু না খাইলে দুধটা খান।
হামিদা দরজা খুলল। তার ভালোই ক্ষিধে পেয়েছে। কিছু না খেলে ঘুম ও আসবে না। কুকুরটা ভালো যন্ত্রণা করছে। এখনো ডাকছে। মনে হয় তার গায়ে গরম মড়ি ফেলে দিয়েছে কেউ। ব্যথা না কমা পর্যন্ত সে ডাকতেই থাকবে। হামিদা বলল, লতিফঃ তুমি কি কুকুরের ডাক শুনতে পাচ্ছ? বিশ্রী করে একটা কুকুর ডাকছে।
লতিফা বলল, কুত্তার ডাক তো শুনি না আফা।
অনেক দূরে একটা কুকুর ড্রাকছে, শুনতে পাচ্ছ না?
জি না।
হামিদা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। লতিফা কিছু শুনতে পাচ্ছে না। কিন্তু কুকুর ঠিকই ডাকছে। একটা কুকুরের সঙ্গে আরো কয়েকটা কুকুর যুক্ত হয়েছে। আসলে ঘটছে কী?
হামিদা চোখ মুখ শক্ত করে বলল, ভাত দুধ কিছুই খাব না। নিয়ে যাও।
হামিদা চেয়ারে এসে বসল। আর তখনই সে বুঝতে পারল কুকুর দূরে কোথাও ডাকছে না। কুকুর ডাকছে তার মাথার ভেতর। এই লক্ষণ ভালো না। বিরাট অসুস্থতার লক্ষণ। হামিদার এখন উচিত অতি দ্রুত ভালো কোনো ডাক্তারকে দেখানো।
আলাউদ্দিন বললেন, কুটু কুকুরগুলি বড় যন্ত্রণা করছে।
কুটু বলল, জ্বি স্যার।
আলাউদ্দিন বলেন, রাত হলেই ঘেউ ঘেউ। তোমার বিরক্ত লাগে না?
কুটু বলল, কুকুরের কারণে কেউ এদিকে আসে না এইটা একটা ভালো দিক।
তা ঠিক। আমরা নিরিবিলি আছি, তাই না কুটু? কেউ আমাদের বিরক্ত করছে। হাজী সাহেব পাণ্ডুলিপির খোজে আমার কাছে আসবেন না।
জ্বি স্যার।
এদিকে জামিল আসছে না। এটাও খারাপ না।
জ্বি স্যার, এইটাও ভালো। আমার মনে হয় উনি আর এই বাড়িতে আসবেন না।
না এলে আমাদের তো কিছু করার নাই। আমি নিশ্চয়ই বলতে পারি না আসতেই হবে। না এলে হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা। তুমি আমার স্ত্রী। লিগ্যাল ওয়াইফ।
জ্বি না এরকম বলবেন কেন? আমরা কিন্তু আমাদের মতো। উনি থাকবেন উনার মতো।
আলাউদ্দিন আনন্দিত গলায় বললেন, অবশ্যই।
কুটু বলল, না কি এখন খাইবেন না আরো পরে দিব?
আজকের খানা-টা কী? নতুন কিছু?
জি।
কী রান্না করেছ বলো দেখি।
গরুর মাংস।
ভেরি গুড। আজ সকাল থেকেই গরুর মাংস খেতে ইচ্ছা করছিল। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। ঝাল ঝাল গরুর মাংস, সঙ্গে আলু। তুমি কি মাংসে আলু দিয়েছ?
জ্বি স্যার।
মাঝে মাঝে তোমার কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয় তুমি মনের কথা বুঝতে পার। সত্যি করে বলো তো, তুমি মনের কথা বুঝতে পার?
কুটু প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, খানা খাইতে কি দেরি হইব স্যার?
আলাউদ্দিন বললেন, তাড়াহুড়া করার দরকার কী! ধীরে সুস্থে পাই। এখন যে জিনিসটা খাচ্ছি তার নাম কী?
এর নাম স্যার জিন।
অতি সুস্বাদু। পাইলট স্যার কি এই জিনিস খেতেন?
জ্বি খাইতেন। উনার পছন্দের জিনিস ছিল জিন এবং রাম।
রাম আবার কী?
মিষ্টি জাতীয়। খাইতে ভালো।
তোমার সঙ্গে থেকে অনেক কিছু শিখলাম। রাম, লক্ষণ, সীতা… হা হা হা। রাম তো খাওয়া হয় নি। একদিন ব্যবস্থা করা।
জি আচ্ছা।
আমি একা একা এতসব ভালো জিনিস খাচ্ছি— আমার খারাপই লাগে। তুমি থাও না কেন? তুমিও খাও। কোনো অসুবিধা নেই। আমার কাছে সব মানুষ সমান। বাবুর্চিও যা খাদ্যমন্ত্রী ও তা। যাও, একটা গ্লাস নিয়ে এসো। খেতে খেতে দুজনে গল্প করি।
আমি এইসব জিনিস খাই না স্যার।
খাও না?
জ্বি না।
কোনোদিনই খাও নি?
জ্বি না।
আফসোস, একটা ভালো জিনিস থেকে বঞ্চিত থেকে গেলে। খুবই আফসোসের কথা। কুটু শোন, তোমার কি গরম লাগছে?
স্যার আইজ গরম ভালো পড়ছে।
এক কাজ কর— বাঘটাৰে পানি দাও। পানির মধ্যে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি।
এখন রাইত একটা বাজে। এত রাইতে বাথটাবে নামবেন?
কোনো অসুবিধা আছে?
জি না।
আমি ঠিক করেছি আজ বাথটাবেই ঘুমাব। কেন ঠিক করেছি বলতে পারবে?
গরম লাগছে এই জন্যে।
হয় নাই। দশে শূন্য পেয়েছ। আজ বাথটাবে গোসল করব, কারণ হলো— মানুষের যখন যা করতে ইচ্ছা হয় তা করা উচিত। মানুষ আর বাজে কত দিন! ঠিক না?
জ্বি।
একটা কচ্ছপ তিনশ বছর বাঁচে। আর মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখ। যাট হয়েছে কী শেষ। আমার হয়েছে তিপ্পান, আর মাত্র সাত বছর বাকি। কাজেই আমি ঠিক করেছি এখন থেকে যা করতে ইচ্ছা করবে তাই করব? কে কী চিন্তা করছে
এইসব নিয়ে ভাবব না।
জি আচ্ছা।
বাথটাবে পানি লাগাও। গ্লাস শেষ হয়ে গেছে, এই জিনিস আরো দাও।
জি আচ্ছা।
আমাদের সুখের দিন শেষ হয়ে আসছে কুটু। বুধবার জামিল চলে আসবে।
তাই না?
জি।
চলে এলেও কিছু করার নেই, সব নিয়তি।
জ্বি স্যার নিয়তি।
কুকুরের ডাক মনে হয় একটু কমেছে।
জ্বি কমছে।
সর্বমোট কয়টা কুকুর?
এখন আছে পাঁচটা।
এরা কী করছে? বাড়ির চারদিকে চক্কর দিচ্ছে?
জ্বি স্যার।
খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা। এদের কারণে বাইরের কেউ আমাদের কাছে আসতে পারছে না— এই একটা ভালো দিক। তুমি এখন থেকে এদের এক থালা করে খাবার দিও। জীবে দয়া করে যেই জন, সেই জন সেবিচ্ছে ঈশ্বর। কথাগুলি কে বলেছে ভুলে গেছি কিন্তু খুবই দামি কথা। রোজ এদের ভালোমন্দ খাওয়াবে।
জ্বি আচ্ছা।
বাথটাবে কি পানি দেওয়া হয়েছে?
আপনার সঙ্গে কথা বলছি তো স্যার।
বাথরুমে যাই নাই।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। বাথরুম থেকে কথা বলো। গ্লাসটা খালি। তাড়াতাড়ি তোমার জিনিস নিয়ে আস। টাইম ইজ শর্ট। অর্থাৎ সময় সীমিত। মাত্র আট বছরেই সব শেষ। আমার আছে মাত্র সাত বছর। বিরাট আফসোস।
রাত তিনটা। বাথটাবে শরীর ডুবিয়ে আলাউদ্দিন শুয়ে আছেন। বাড়ির সমস্ত বাতি নেভানো। তবে বাথরুমে সামান্য আলো আছে। শোবার ঘরে টিভি চলছে। টিভি স্ক্রিনের নীলাভ আলো বাথরুমে পর্যন্ত এসেছে। কুটু মিয়া বাথটাবের পাশে বসে আছে। আলাউদ্দিন চোখ মেলতে পারছেন না। তাঁর কথাও জড়িয়ে আসছে। প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। তবে তিনি ঘুমুচ্ছেন না— কষ্ট করে জেগে আছেন। তিনি খুবই আনন্দ। পাচ্ছেন। ঘুমিয়ে পড়লেই তো সব আনন্দ শেষ। আনন্দ উপভোগ করতে হলে। জেগে থাকতে হয়।
কুটু?
জ্বি স্যার।
বড় আনন্দ লাগছে কুট। শুধু চোখ মেলে রাখতে পারছি না— এইটাই সমস্যা।
চোখ বন্ধ কইরা রাখেন স্যার।
রাতে আর ভাত খাব না।
জ্বি আচ্ছা।
এখন থেকে একবেলা ভাত খাব। কুকুরদের যখন খেতে দিবে তখন আমাকেও দিও। ওরা যা খাবে আমিও তাই খাব। কুকুর বলে ওদের অবহেলা করা ঠিক হবে না। কবি বলেছেন— জীবে দয়া করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। কুকুর ও একটা জীব।
জ্বি।
পাইলট সাহেব কি কুকুর পছন্দ করতেন?
খুবই পছন্দ করতেন। উনার তিন জাতের কুকুর ছিল। এ্যালশেশিয়ান ছিল, জার্মান একটা কুকুর ছিল থাবরা নাকী, আর দুইটা কুকুর ছিল পর্তুগালের। মেয়ে কুকুর। উনি ঐগুলারে আদর কইরা ইকড়ি মিকড়ি নামে ডাকতেন।
উনার বিদেশী আর আমার দেশী নেড়ি কুত্তা। যাই হোক, আমার কাছে দেশী বিদেশী সবই সমান। গাহি সাম্যের গান। আমার চক্ষে দেশী বিদেশী কোনো ভেদাভেদ নাই… আচ্ছা কুটু শোন, প্রায়ই ভাবি একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করব। পরে আর মনে থাকে না। এখন মনে পড়েছে। জিজ্ঞেস করি?
জ্বি স্যার করেন।
পাইলট সাহেব ছাড়াও তো কুয়েতি এক ভদ্রলোকের বাড়িতে তুমি কাজ করতে। তার কথা তো তুমি কিছু বলে না। উনি লোক কেমন ছিলেন?
অতি ভালো লোক ছিলেন স্যার। উনার তিন স্ত্রী ছিল। স্ত্রীদের সঙ্গে বনিবনা হইল না। আলাদা বাড়ি বানায়ে থাকা শুরু করলেন।
শুধু তুমি আর উনি?
জি।
উনার বাড়িতে কি বাথটাব ছিল?
উনি আশীর মানুষ, উনার বাড়িতে বাথটাব তো থাকবই। উনার বাথটাবের সব ফিটিংস ছিল সোনার।
বলো কী?
উনার বাথরুমে সোয়ানা ছিল, জুকুচি ছিল।
ঐগুলা কী?
সোয়ানা হইল পানির গরম ভাপ গোসলের ব্যবস্থা। আর জুকুচি বাথটাবের মতো পানির বুদবুদ হয়। শইলে পানি দিয়া আপনা আপনি ম্যাসাজ হয়।
উনার নাম কী?
শেখ আব্দাল রহমান। অত্যন্ত পরহেজগার আদমি ছিলেন স্যার। যখন উনার শরীরে গোটা গোটা ফোসকা উঠল, উনি বিছানা থেইকা উঠতে পারেন না–তখনো নামাজ কাজা করে নাই। শুইয়া শুইয়া আঙুলের ইশারায় নামাজ পড়ছেন।
আলাউদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, উনার শরীরেও ফোসকা উঠেছিল না কি?
কুটু বলল, জ্বি।
সালাউদ্দিন বললেন, ফোসকার ভেতরে পোকাও ছিল?
জ্বি।
এটা খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা তোমার ভাগ্যে সব ফোসকাওয়ালা লোক পড়ে যাচ্ছে।
জ্বি। এইটা ভাই মনটা খারাপ।
আলাউদ্দিন কুটুকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন, মন খারাপ করবে না। তাদের কপালে ছিল ফোসকা। তুমি আমি কী করব বলো। তোমার আমার কিছুই করার নাই…।
বাক্য শেষ করার আগেই আলাউদ্দিন ঘুমিয়ে পড়লেন। মাঝে মাঝে কুকুরের চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গে। তিনি ভীত গলায় ডাকেন— কুটু।
কুটু তার ঘর থেকে সাড়া দেয়— জ্বি স্যার।
আলাউদ্দিন সাহেবের ভয় কেটে যায়, তখন তার গল্প করতে ইচ্ছা করে।
তাঁর কাছে মনে হয় আহারে মানব জনম বড়ই মধুর। আল্লাহপাক মানুষ বানিয়ে তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে বলেই না তিনি এত আনন্দ করতে পারছেন। মুরগি বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠালে তো কুটু মিয়া জাতীয় কেউ একজন তাকে রান্না করে ফেলত। লোক খেয়ে বলত— মজা হয়েছে তবে ঝাল একটু বেশি। গরু বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠালে লোকজন তার শরীরের চামড়ায় জুতা বানিয়ে হাঁটাহাঁটি। করত। তার কত সৌভাগ্য মানুষ হয়ে তিনি পৃথিবীতে এসেছেন। পাইলট স্যারের মতো ভাগ্যবান হতে পারেন নাই। জীবনে কখনো বিমানে চড়েন নাই পাইলট হওয়া তো দূরের কথা। পাইলট না হয়েও তিনি যা পেয়েছেন তাও তো কম না। এই পরম সৌভাগ্য নিয়ে কথা বলার জন্যে তিনি ছটফট করতে থাকেন। এক সময় অস্থির হয়ে ডাকেন, কুটু কুটু কুটু।
কুটু সাড়া দেয় না। কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করতে থাকে।