০৬. বীরত্বের কাজ

০৬.

বৌধায়ন কোনওদিনই কোনও বীরত্বের কাজ করেনি। বীরত্বের কথা দূরে থাক সারাজীবনে তাকে তেমন কোনও কাজই করতে হয়নি। বাবা দাদারা চাকরি-টাকরি করে। বড়লোক না হলেও অবস্থা খারাপ নয়। নিজেদের পুরনো বাড়ি, বাড়িতে টেলিফোন, ফ্রিজ এসব তো আছেই, একটা গাড়িও আছে। আরও কিছুদিন চাকরিবাকবি না করলেও তার চলবে। তাকে বাজার করতে হয় না, রেশন তুলতে বা ইলেকট্রিক বিল দিতে যেতে হয় না, কোনও ফরমাশ খাটতে হয় না, বরং উলটে তাব ফরমাশেই লোকে অস্থির। বড়দা আর মেজদা মাকে বকে, ছোটটাকে একদম গুড ফর নাথিং বানিয়ে রাখলে মা! সামনের বছর তার জাপান যাওয়ার কথা আছে, সেই ভেবে মা এখন থেকেই অস্থির। বারবারই বলে, তুই কি পারবি গিয়ে থাকতে?

ব্যাপারটা আসলে তা-ই। এ বাড়ি আর মা তাকে দুর্গের মতো আড়াল করে রেখেছে। কোনওদিন কোনও ভারী কাজ করেনি বলে এখন সে এক গ্লাস জল ভরেও খেতে পারে না। দোকান থেকে একটু জিনিস বয়ে আনতে হলে সে ঘেমে জল হয়। একবার বাড়ির ওপর রাগ করে নিজের কাজ নিজে করতে গিয়ে গেঞ্জি আর রুমাল কেচেছিল। তাইতে তার বুক ব্যথা করেছিল তিনদিন।

ফোনটা যখন আসে তখন আধশোয়া হয়ে কথা বলছিল বৌধায়ন। বলতে বলতেই উঠে বসে। ফোনটা রাখার পর বিড়বিড় করে ‘রেপ! মলেস্টেশন’ বলতে বলতে সে কই মাছের মতো দাপাতে লাগল বিছানায়। মন্দার কী হবে? এতক্ষণে কী হয়ে গেল না জানি!

বৌধায়নের এই একটা জিনিস আছে। যাকে বলা যায় ফিলিং। অসম্ভব সহানুভূতি তার। অন্যের জন্য অল্পেই অস্থির হয়ে পড়ে। নিজের জন্য যতটা হয় প্রায় ততটাই। কারও কিছু ক্ষতি হবে বা কেউ কোনও কষ্ট পাবে, মরে যাবে এ সে ভাবতেই পারে না। ছেলেবেলা থেকেই সে মাকে জিজ্ঞেস করে আসছে মা, তুমি মরে যাবে না তো? কোনওদিন মরবে না তো!

কাকে খবর দেবে তা মাথায় এলই না তার। মাথার চুল দু’হাতে মুঠো করে ধরে সে গড়াগড়ি দিতে লাগল বিছানায়। তারপর খাড়া উঠে বসল, বিড়বিড় করে বলল, আমি যাব। তারপর ব্যান্ডেজ বঁধা পায়ের দিকে ভয়ার্ত চোখে চেযে রইল সে। নিজের ওপর রাগে ঘেন্নায় নীল হয়ে গেল সে। ঘামতে লাগল অসম্ভব উত্তেজনায়। মন্দা কেন নিজের বাড়িতে ফোন না করে তাকেই করতে গেল? অন্য কাউকে না ডেকে তার পা ভাঙা জেনেও কেন তার কাছেই পাঠাল এস ও এস?

মন্দার বাড়িটা বড় অদ্ভুত। সে বাড়ির কেউ কাউকে দেখতে পারে না। মন্দার বাবা মার মধ্যে গত দশ বছর ধরে নাকি কথাবার্তা নেই। মন্দার সঙ্গে তার বাপ-মায়ের সম্পর্কও ঝগড়ার। মন্দার দুই দাদার একজন ইটালি, অন্যজন সুইজারল্যান্ডে সেটেল করেছে। সংসারের অশান্তির জন্যই তারা আসছে না বলে মন্দার ধারণা। তার আর এক ভাইও পালানোর পথ খুঁজছে। কাকে ডাকবে মন্দা? আর বন্ধুবান্ধব বা পরিচিতদের সঙ্গেও মন্দার তেমন বনিবনা হয় না। বৌধায়নের সঙ্গে যে হয় তাও নয়। তবু বৌধায়ন মন্দাকে পছন্দই করে বোধহয়। এখন বিপন্ন মন্দার জন্য প্রাণ আনচান করে তার।

প্রাণপণে চেঁচিয়ে বৌধায়ন বাড়ির চাকরকে ডাকতে লাগল, নরেন! নরেন!…কোথায় যে যায় রাস্কেলটা!

চেঁচানিতে নরেন এল না, এল জয়তী, সাজছিল। মেয়েদের অভ্যাস সাজের সবশেষে শাড়ি পরবে। জয়তীর ভ্রু আঁকা, লিপস্টিক লাগানো, পাউডার বোলানো শেষ হয়েছে, শাড়ি পরার আগে ব্লাউজটা বদলাতে যাচ্ছিল বোধহয়, কিন্তু সেটা পরার সময় পায়নি। বৌধায়নের জরুরি ডাক শুনে ওই অবস্থাতেই মেঝে কাপিয়ে দৌড়পায়ে এসেছে। শাড়িতে গা ঢাকতে ভোলেনি, তবু পাতলা শাড়ির ভিতর দিয়ে তার কালো গায়ে সাদা ব্রেসিয়ার দেখা যাচ্ছে।

বৌধায়ন মুখ ফিরিয়ে নিল।

কী হয়েছে বুধো?

ভীষণ বিপদ। আমার এক বান্ধবী…চেনো তো মন্দাকে! এইমাত্র ফোন করে বলল, তার ভীষণ বিপদ। যেতে হবে।

তুমি যাবে?

বৌধায়ন ভয়ংকর মুখ বিকৃত করে বলল, যেতেই হবে। এবং এক্ষুনি।

তুমি যাবে কীভাবে? বরং ঠিকানা দাও, আমি যাচ্ছি।

বৌধায়ন আঁতকে উঠে বলে, না। মন্দা ইজ গোয়িং টু বি.ওঃ সে বিচ্ছিরি ব্যাপার। সেখানে একা গেলে তোমারও রেহাই নেই। গাড়িটা আছে?

না তো! বাবা না ফিরলে গাড়ি পাবে কোথায়?

তবে শিগগির ট্যাক্সি ডাকো। শিগগির! একমুহূর্ত সময় নেই।

 বলতে বলতেই বৌধায়ন খাট থেকে এক পায়ে নেমে দাঁড়াল। ডান পায়ের দিকে তাকাল আবার। নিজের গায়ে তার থুথু দিতে ইচ্ছে করছে।

জয়তী খুব দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরোল, চেঁচিয়ে বলল, তৈরি হও, আমিও সঙ্গে যাচ্ছি। শাড়িটা পরা বাকি শুধু।

বৌধায়ন আপনমনে স্বগতোক্তি করল, শুধু শাড়ি নয়, ব্লাউজও। ছিঃ ছিঃ!

ডান পায়ে মেঝেয় ভর দেয় বৌধায়ন, খুব সাবধানে। লাগছে একটু। তবে অসহ্য নয়। খুঁড়িয়ে হাঁটা যাবে। চোট-পায়ে বেশি ভর দেওয়া যাবে না।

পায়জামার ওপর সে একটা পাঞ্জাবি চড়াল ওয়ার্ডরোবের কাছে গিয়ে। সারি সারি প্যান্ট ঝুলছে, কিন্তু গোদা পা ঢুকবে না বলে প্যান্ট পরার প্রশ্নই ওঠে না।

জয়তী দেরি করেনি। বৌধায়ন দরজার কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতেই দেখে জয়তী বারান্দার ওপাশের ঘর থেকে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে পাল্লা টেনে বন্ধ করল। বৌধায়নকে দেখে বলল, ট্যাক্সি এসে গেছে। যেতে পারবে তো?

পারব। শোনো, বাবার রুপো বাঁধানো বেতের লাঠিটা দাও।

ভর দেবে?

 দুটোই হবে। ভর প্লাস অস্ত্র।

 মারপিট করবে নাকি?বলে বড় চোখে তাকায় জয়তী।

দরকার হলে। মন্দা ইজ ইন গ্রেট ডেঞ্জার।

জয়তী এতক্ষণ খুব সিরিয়াস ছিল, এইবার ফিক করে হেসে ফেলে বলল, তুমি? বোলো না, বোলো না।

ভ্রূকুটি কাকে বলে তা সঠিক জানে না বৌধায়ন, তবে কথাটা বইতে পড়েছে। এখন সে খুব প্রাণপণে ভ্রুকুটি করার চেষ্টা করে। বোধহয় ভ্রুকুটিটা হয় কারণ জয়তী কথা না বাড়িয়ে পক্ষিণীর মতো নাচের পায়ে উড়ে গিয়ে লাঠিটা নিয়ে আসে।

বৌধায়ন লাঠিটা নিয়ে বলে, তুমি আবার সঙ্গ নিলে যে!

আমি না হলে কে নেবে? বাড়িতে কেউ তো নেই। নরেনও বাজারে।

 কারও দরকার ছিল না।

বেশি বীরত্ব দেখিয়ো না। কচি খোকার মতো হাঁটি হাঁটি পা পা অবস্থা, আবার কথা ঝাড়ছে। মেয়েটার কী বিপদ বললে না তো!

বৌধায়ন দেয়াল ধরে ধরে এগোয়। মুখ ভয়ংকর বিকৃত। লাগছে একটু। কিন্তু বেশি লাগতে পারে ভয়ে সে প্রতি পদক্ষেপেই কুঁচকে যাচ্ছে। তবু এগোয়। ডানদিকে দেয়ালের কাছ ঘেঁষে এসে জয়তী তার বগলে কাঁধের ঠেকা দিয়ে বলে, শরীরটা ছেড়ে দাও।

পারবে?

না পারলে বলছি?

 বৌধায়ন নাক কুঁচকে বলে, এত সেন্ট মাখো কেন বললা তো! ওসব গন্ধে আমার গা গুলোয়। ছাড়ো।

বেশি বোকো না। ফ্রেঞ্চ পারফিউম। কত দাম জানো?

 দামটাই শিখেছ। নয়নার ফাংশনে গেলে না?

 ড্রপ করছি।

 মারও যে যাওয়ার কথা ছিল তোমার সঙ্গে।

কথা ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে মা ডিসিশন চেঞ্জ করলেন। আমি একা যাচ্ছিলাম।

যাও না।

না। তার চেয়ে এই ফাংশনটাই বেশি ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে।

 ইয়ারকি কোরো না। লাইট ব্যাপার নয়। মন্দা সহজে বিপদে পড়ে না।

 জয়তী আবার সিরিয়াস হয়ে গেল। সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে নামাতে লাগল বৌধায়নকে।

মন্দার বাবার অফিসটা বৌধায়ন চেনে। কয়েকবার ছুটির দিনে মন্দা বেশ কয়েকজন বন্ধু এবং বান্ধবী নিয়ে তার বাবার কঁকা অফিসঘরে গিয়ে এয়ার কন্ডিশন করা ঘরে বসে আড্ডা দিয়েছে। ভারী নিরিবিলি জায়গা এবং নিরাপদও। গরমের দিনে ঠান্ডা ঘরে বসে আড্ডা খারাপ নয়। তাছাড়া অফিসটা মন্দার কাছে নেশার মতো। বাবা না থাকলে ও অফিসে গিয়ে ফাইলপত্র খুলে দেখে, ব্যাবসার অন্ধিসন্ধি বোঝার চেষ্টা করে। মন্দা বলে, আমি হব ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট।

তা হবেও হয়তো মন্দা। ওর সে এলেম আছে। অনেকবার ও বন্ধুদের ব্যাবসা জিনিসটা বোঝাবার চেষ্টা করেছে। তাইতেই বৌধায়ন টের পেয়েছে যে, মন্দা সত্যিই ব্যাবসা বোঝে। কিন্তু মেয়েদের সম্পর্কে বৌধায়নের শ্লোগান, ব্যাক টু কিচেন। আবার রান্নাঘরে ফিরে যাও। বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। পুরুষেরা বহির্জগতে, মেয়েরা রান্নাঘরে।

দশাসই পশ্চিমা ট্যাক্সিওয়ালাকে তাড়া দিচ্ছিল বৌধায়ন, জলদি! জলদি!

জয়তী বলে, ওরকম কোরো না। কোথায় ভিড়িয়ে দেবে।

বৌধায়নের হাত-পা নিশপিশ করে। সে অস্থিরভাবে বসে বসেই একশোবার এপাশ-ওপাশ করতে থাকে।

সুরেন ব্যানার্জি রোডে অফিসবাড়িটার সামনে নামবার সময়ে বৌধায়নের হাত-পা আড়ষ্ট লাগছিল। ভয় ভয় করছে। কিন্তু পিছোনো যায় না। জয়তী কি কোনও ভরসা? ভেবে সে একবার জয়তীর দিকে তাকায়। জয়তী গম্ভীর! তাকে নামিয়ে দাঁড় করানোর পর এখন নিজের উলি শাড়ির আঁচল গোছাচ্ছে।

বৌধায়ন পকেটে হাত দিয়ে বলল, এই রে। টাকা আনতে ভুলে গেছি।

আমি ভুলিনি।বলে জয়তী তার চামড়ার বটুয়া খুলতে থাকে।

পুরুষ সঙ্গে থাকলে মেয়েরা খরচ করে, এটা একদম পছন্দ নয় বৌধায়নের। তবু এখন তো উপায় নেই। ড্রাইভার যখন মিটার দেখে পয়সার জন্য হাত বাড়িয়েছে তখন বৌধায়ন বলল, থাক মেজ বউদি, ট্যাক্সিটা ছেড়ো না। আমাদের বোধহয় দরকার হবে।

এই বলে সে নেংচে ড্রাইভারের জানালায় এগিয়ে গিয়ে খুব বিনীতভাবে বলে, ভাইসাব, এক লেড়কিকো বহুত খতরনাক… খতরনাক…

বলে থেমে সে জয়তীর দিকে ফিরে বলে, খতরনাক মানে কী বলো তো।

পাজি, বদমাশ।

বিপদের হিন্দি কী?

খতরা।–বলেই আবার ফিক করে হাসে জয়তী।

বৌধায়ন গম্ভীর হয়ে বলে, র্যালা দিয়ো না। সপ্তাহে দুটো করে হিন্দি ছবি দেখলে আমারও সব মুখস্থ থাকত।

এই বলে সে ফের ড্রাইভারের দিকে ফিরে বলে, এক লেড়কি বহুত খতরামে পড়া। আপ জারা মেহেরবানি করকে হামারা সাথ আনে সে বহুত উপকার হোগা…

ড্রাইভার অবাক হয়ে গিয়েছিল, এবার বলল, বাংলায় বলুন না! আমি বুঝতে পারি।

বৌধায়ন পিছনে জয়তীর হাসির খুক শব্দ পেল। তবু মাথা ঠিক রেখে বলল, একটি মেয়ে খুব বিপদে পড়েছে। একটু যদি সঙ্গে আসেন। আমরা আপনার গাড়িতেই ফিরব।

ট্যাক্সিওয়ালা একটু ইতস্তত করে। কলকাতার ট্যাক্সিওয়ালারা সাধারণত সওয়ারির মামলায় যেতে রাজি হয় না। কিন্তু বৌধায়নের আহত পা আর মুখের পবিত্রতা দেখে এ লোকটা হঠাৎ রাজি হয়ে গেল। বলল, চলুন, দেখছি।

গাড়ি লক করে লোকটা পিছনে পিছনে উঠে আসে। বৌধায়ন এখন অনেকটা সাহসের সঙ্গে সিড়ি ভাঙতে থাকে। বেশ ব্যথা লাগছে পায়ে। তিরের ফলার মতো গোড়ালি থেকে খচখচ করে ব্যথা উঠে আসছে কুঁচকি পর্যন্ত। কাস্টিং আর ব্যান্ডেজ-ভারী পা তুলতে কষ্ট হচ্ছে। জয়তী তিনতলা পর্যন্ত খুব নিপুণভাবে তার ভার সামলে ঠেলে তুলল।

ওই সামনের ঘরটা।–বলে বৌধায়ন জয়তীর হাত ছাড়িয়ে লাঠিটা বাগিয়ে ধরে এগোল।

পিছন থেকে জয়তী সাবধান করে দেয়, হুট করে কাউকে মেরে বোসো না। এটা প্র্যাকটিক্যাল জোকও হতে পারে মন্দার।

ঠিক ঘরের চৌকাঠেই সুখনের সঙ্গে দেখা। চেনা মুখ, বহুবার তাদের চা দিয়েছে লোকটা।

লাঠিটা দুহাতে শক্ত মুঠোয় বাগিয়ে ধরা ছিল, সেই ভঙ্গিতেই গাঁক করে ওঠে বৌধায়ন, এই শুয়োরের বাচ্চা! মন্দা কোথায়?

সুখনের মুখটা শুনোই ছিল। বৌধায়নের গাল শুনে আর মূর্তি দেখে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল। ভীষণ মিয়োনো গলায় বলল, জি, দিদিমণি তো একটু আগে চলে গেলেন। আমি ট্যাক্সি ধরে দিয়েছি।

বৌধায়ন মেঝেয় লাঠিটা একবার আছড়ে নেয়। রাগে তার গা বি-বি করে ওঠে। মাথায় আগুন। গলায় সেই আগুনের হলকা বেরোয়, ঠিক করে বলল কী হয়েছে? মন্দা আমাকে ফোন করেছিল। আমি ঘর দেখব, রাস্তা ছাড়ো।

সুখন কুণ্ঠিত পায়ে সরে গিয়ে রাস্তা দেয়।

ঘরের মধ্যে একপাল আধা-ভিখারি চেহারার মানুষ সিটিয়ে বসে আছে ভয়ে। প্রত্যেকে সজাগ, সতর্ক জুলজুল করছে চোখ। পালানোর ফিকির ঘুরছে তাদের মগজে। রাতে শুতে এসে বেকার এই বিপদ।

বৌধায়ন প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকায়। এই সমাজের লোকজনকেও সে ভাল চেনে না। প্রথম নজরে মনে হয়, এরা ভয়ংকর বদমাশ, পাজি। রেপ, খুন সব করতে পারে। আবার ভাল করে দেখলে মনে সন্দেহ উশখুশ করে, পাজি হওয়ার মতো যোগ্যতাই তো এদের নেই। তেমন তেমন পাজি হতে গেলেও তো কিছু এলেম চাই। পাইজ্যামির সেই মেধা কি এদের আছে? তবু বৌধায়ন রক্তচোখে চারিদিকে চেয়ে ফের গাঁক করে ওঠে, ওই অফিস দুটোর দরজা খোলল। আমি দেখব। আর এদের আটকে রাখো, কেউ নড়লেই মাথা ফাটিয়ে দেব।

কেউ নড়ল না।

সুখন খুব শুখো গলায় নরম সুরে বলে, চাবি তো দিদিমণি নিয়ে গেছে।

 বৌধায়ন পাগলের দৃষ্টিতে সুখনের দিকে চেয়ে বলে, দু’নম্বরি কথা ছাড়ো। ঠিকসে বলল।

সুখন প্রথমটায় কথা বলতে পারে না, তারপর বলে, এরা সব গরিব গাঁওয়ার আদমি। রোজ রাতে এসে শুয়ে থাকে, সবেরে চলে যায়। দিদিমণি আজ হঠাৎ চলে এসে এদের দেখে ডর পেয়েছিল, আমি তখন ছিলাম না। কোনও হরজা হয়নি, সব ঠিক আছে। বিসোয়াশ করুন।

বৌধায়ন একটা বড় শ্বাস ছেড়ে বলল, ঠিক আছে। মন্দার বাড়িতে ফোন করো। আমি দেখতে চাই ও বাড়ি পৌঁছেছে কি না।

সুখন ডায়াল করে রিসিভার বৌধায়নকে দেয়।

 মন্দা বাড়ি ফিরেছে?

না।–বলেই ওপাশের ভদ্রমহিলা ফোন নামিয়ে রাখলেন।

 চূড়ান্ত অভদ্র ওরা। বরাবরই এইরকম। মন্দা বাড়ি না থাকলে বৌধায়ন ফোন করে কোনওদিন কিছু জানতে পারেনি। এমনই ওদের পারিবারিক সম্পর্ক যে, কেউ কারও নাম পর্যন্ত সইতে পারে না।

ধীর হাতে ফোন নামিয়ে রাখার সময়েই বৌধায়নের রাগের স্টিম বেরিয়ে যাচ্ছিল।

 ঘরের লোকগুলোর মধ্যে যার মুখে বসন্তের দাগ সেই সবচেয়ে বদমাশের মতো দেখতে। বৌধায়ন নেংচে গিয়ে লোকটার বুকে লাঠির একটা রূঢ় খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞেস করে, সুখন ঠিক কথা। বলছে, এই শালা?

লোকটা লাঠির গুঁতোয় ‘কোঁক’ করে উঠে বলে, জি।

তুই কে?

 ঠেলা চালাই! রামব্রিজ দোসাদ।

বৌধায়ন প্রচণ্ড রাগের চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, কিন্তু তার সেই স্টিম আর নেই। তবু গিয়ে সে অফিসঘরের দরজার ঘষা কাচে চোখ রেখে ভিতরটা দেখতে চেষ্টা করে। কিছু দেখা গেল না। তবে মনে হল, ঘরের ঠান্ডা মেশিনটা এখনও চলছে। দরজার কাচে ভাপ, শীতলতা।

বৌধায়ন দরজায় শব্দ করে বলল, মন্দা। মন্দা ভিতরে আছ?

সাড়া নেই।

 বৌধায়ন কুটিল চোখে সুখনের দিকে চেয়ে বলে, ভিতরে এয়ারকন্ডিশনার চলছে কেন?

দিদিমণি বন্ধ করতে ভুলে গেছে।

বৌধায়ন লাঠিটা তরোয়ালের মতো ধরে বলল, আমি আবার পরে মাকে ফোন করব। যদি কোনও গড়বড় হয়ে থাকে তো তোমাকে ছাড়ব না বলে রাখলাম। মাটিতে পুঁতে ফেলব।

সুখনের ভয়-খাওয়া যায়নি, তবু যতদূর সম্ভব দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, কোনও গড়বড় হয়নি। বুটমুট দিদিমণি ভয় খেলেন।

বৌধায়নের পা ঝিলিক দিচ্ছে। কিন্তু রাগের গরমটা রয়েছে। সে ব্যথাটাকে পাত্তা দিল না।

জয়তী দরজার কাছ থেকে বলল, বুধ, চলে এসো। কিছু হয়নি।

বৌধায়ন গড়গড় করে সিংহের মতো ফিরে তাকিয়ে দেখে, দরজায় দশাসই পশ্চিমা ড্রাইভার আর জয়তী দাঁড়িয়ে। ড্রাইভারটার মুখ পুরো বেকুব। জয়তী কিছু গম্ভীর কিন্তু মুখে কোনও উদ্বেগ নেই। বৌধায়ন ফের গাঁক করে ওঠে, কী করে বুঝলে যে কিছু হয়নি?

হলে ওদের মুখ দেখলেই বোঝা যেত! আর মন্দার মাথায় যে একটু ছিট আছে তা আমি ওকে প্রথম দেখেই টের পেয়েছিলাম।

বৌধায়নের রাগের স্টিম যেটুকু ছিল তাও হুশ করে বেরিয়ে গেল। ভারী অবসন্ন বোধ করে সে। আর রাগ কমতেই কুঁচকি পর্যন্ত গোটা পায়ের টাটানি টের পায়। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সে দরজার দিকে এগোতেই জয়তী তাকে ধরে। খুব মৃদুস্বরে বলে, বাব্বাঃ, যা বীরত্ব দেখলাম। আজ সবাইকে বলব।

বৌধায়ন শুধু ব্যথার কাতর একটা ওফ শব্দ করে। প্রচণ্ড কষ্টে সে সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে।

বাড়িতে ফিরে পায়ের অসহ্য ব্যথায় বিছানা নিল বৌধায়ন। ব্যথা যতটা তার চেয়ে অবশ্য সে বেশিই কাতর। সারা বিছানায় গড়ায় আর বিড় বিড় করে বলে, এ পা আর ভাল হবে না। চিরদিনের মতো গেল। ওফ।

বাড়িতে খবরটা রটাতে জয়তী দেরি করেনি। খবর পেয়েই মা প্রায় দৌড়ে হাঁফাতে হাফাতে এসে বলে, তুই লাঠি নিয়ে মারপিট করতে গিয়েছিলি? কী সর্বনাশ।

বৌধায়ন ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলে, এত কথা বলো কেন তোমরা বলো তো?

ওই জখম পা নিয়ে আমাকে একবারও না বলে কয়ে কোন আকেলে তুই গেলি বুধো?

বৌধায়ন কাতরাতে কাতরাতে বলে, কাছে বসে একটু হাতাপিতি করো তো! বোকো না।

হাতাপিতি ব্যাপারটা বৌধায়নের নেশার মতো। মা অবশ্য ঠাকুমার মতো পারে না। গেলবার নব্বই পার করে ঠাকুমা বোল্ড আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেছে। শেষদিন তক শক্ত-সমর্থ ছিল, সিনেমা পর্যন্ত দেখতে গেছে। বৌধায়নের বিশ্বাস ছিল, ঠাকুমা সেঞ্চুরি করবেই। পারল না। সেই ঠাকুমা এই হাতাপিতি ব্যাপারটা খুব ভাল পারত। তুলতুলে নরম তুলোর মতো হাত ছিল তার। কাছে গিয়ে বসলে পাশে শুলে ঠাকুরমার নরম হাত স্বয়ংক্রিয় হয়ে চলে আসত। বৌধায়নের পিছে, গায়ে। পিঠ, বুক হাতিয়ে দিত, খুঁজে খুঁজে তুকুর-পুকুর করে অদৃশ্য গোটা বা ঘামাচি গেলে দিত। ঠাকুমার নখ কখনও বড় হতে পারত না, তাই ভোতা নখের সেই নরম আঁচড়ে আরামে গা শিউরে শিউরে উঠত। এমনই ছিল সেই হাতাপিতির গুণ যে ঘুম এসে পড়ত কখন!

মা অত ভাল না পারলেও চমৎকার নকল করেছে। ভেজা গামছা দিয়ে আগে মা তার ঘেমো মুছিয়ে দিল। তারপর সারা শরীর হাতিয়ে, খুঁটে চুলকে দিতে লাগল। বলল, এমন সর্বনেশে স্বভাব ততা তোর ছিল না কখনও।

হচ্ছে। চিরকাল কি খোকা থাকব নাকি?

 মন্দার কী হয়েছিল?

সে কথার জবাব দিল না বৌধায়ন। কাতরতার নানা শব্দ করে হঠাৎ অবসাদে চিত হয়ে শুয়ে হা-ছাড়া গলায় বিড় বিড় করে বলল, মানুষের জন্মটাই বড় ঝামেলার। আমি যেমন গাছ ছিলাম আর-জন্মে ফের তাই হব।

কী বলছিস?

বৌধায়ন মুখ বিকৃত করে বলল, সবকিছুর জন্য তুমিই দায়ি।

 কীসের জন্য?

 কেন তুমি লেবুবনে গিয়েছিলে? তোমাকে না দেখলে তো আমি মানুষ হয়ে জন্মাতে চাইতাম না। আর জন্মালাম বলেই তো এই ঝামেলা।

আর কোনও কথার জবাব দিল না বৌধায়ন। পাশ ফিরে শুয়ে রইল।

মন্দার বিপদের কথা সে আর ভাবছিল না। কিন্তু তার দমবন্ধ হয়ে আসছিল অন্য এক চিন্তায়। বুকের ভিতরের বড্ড আকুলি ব্যাকুলি।

গভীর রাতেও বার বার ঘুম ছিড়ে যায় তার। পায়ের টাটানো ব্যথা কুমিরের কামড়ের মতো ক্রমে ক্রমে কোমর ধরে ফেলেছে। কিন্তু সে ব্যথাও তুচ্ছ মনে হয়। বুক ছিড়ে ভেতরে অন্যবকম এক রক্তক্ষরণ হয় তার। সে কেন সুখনকে শুয়োরের বাচ্চা বলে গাল দিল? সে কেন ঠেলাওয়ালাটার বুকে ওরকম ভয়ংকর লাঠির খোঁচা দিয়েছিল?

বৌধায়ন জানে সে যে অপদার্থ তার কারণ একটাই। সে কখনও কারও প্রতি নিষ্ঠুর হতে পারে না। কোনওদিনই সে কাউকে মারেনি, গাল দেয়নি তেমন করে। যদি বা দিয়েছে তারপর থেকেই গেছে তার মনের শান্তি, চোখের ঘুম। নিজের বা আর কারও রূঢ়তা সে একদম সহ্য করতে পারে না। কাউকে অপমান করে না সে ভয়ে। করলে সে নিজে কষ্ট পায় সব থেকে বেশি। ঠেলাওয়ালাটার মুখ তার চোখের সামনে হুবহু ভেসে উঠছে বারবার, সুখনের শুকনো গলার কথা শুনতে পাচ্ছে স্পষ্ট। সেইসব স্মৃতি বিষ-বিছের মতো কামড়ায় তাকে এই নিশুত রাতে।

বড় হতাশায় উঠে পেচ্ছাপ করে বৌধায়ন। আবার ঘর ভাসে। ঘেন্নায় সে খাটে উঠে শোয়। পায়ের ব্যথা বাড়ে। পৃথিবীতে মানুষ জন্মের মতো খারাপ কিছু সে আর ভেবে পায় না। ভীষণ জটিল এই জীবন, কুটিলতায় ভরা। কত সরল, সুন্দর জীবন গাছের!

যারা তাকে চেনে তারা সবাই টের পেয়ে গেছে, সে কী ভীষণ অপদার্থ অকর্মণ্য। এমনকী মেজবউদি জয়তী যে ওই বিপজ্জনক ব্যাপারটায় তার সঙ্গে গিয়েছিল তার মানেও পরিষ্কার। মেজবউদি জেনে গেছে, বৌধায়নকে দিয়ে কোনও কিছু হবে না। মেয়ে হয়েও কাপুরুষ দেওরের সঙ্গে গিয়েছিল তাই।

একা ঘরে নিজের উদ্দেশে ছিঃ ছিঃ করে ওঠে বৌধায়ন। না, সে এখনকার পৃথিবীর উপযুক্ত নয়।

.

০৭.

সকালের দিকেই নিত্যপদ এসে খুব উত্তেজিতভাবে বলে, সব বাড়ির দুধ ছানা হয়ে গেছে বাবা!

হরিদেব সেটা ভাল করে জানে। তবু চোখ বড় করে ফোকলা মুখে হেসে বলে, বলিস কী?

সাত-সাতটা বাড়ি ঘুরে এলুম। যারাই বোতলের দুধ উনুনে চড়াচ্ছে তাদেরটাই ভোকাট্টা হয়ে ছানা ছেড়ে দিচ্ছে।

তো কী হবে?-বলে হরিদেব ছেলের দিকে চেয়ে থাকে।

নিত্যপদ মোড়লের মতো বলে, কিচ্ছু হবে না বাবা। ছানাটা বোতলে ভরে কাল সকালে ডিপোতে ফেরত দিলে ডিপোর দিদিমণিরা কার্ডে লিখে দেবে। নষ্ট দুধের বদলে আবার দুধ দেবে।

বটে?-বলে খুব আমোদে হাসে হরিদেব।

এত এত ছানা!–বলে নিত্যপদ হাতের খাবলা দেখায়।

গদাধরবাবু যে ঘরটায় তাকে থাকতে দিয়েছে তার দরজার পাল্লা নেই, জানলা হা-হা করছে। তবে এ ঘরে একটা পুরনো চৌকি আছে, তাতে হরিদেব খুব আরামে শোয় বসে। এখন চৌকির নীচে উবু হয়ে একটা চটের ব্যাগ টেনে এনে সে চার-চারটে বোতল বের করে।

আই বাস!— নিত্যপদ বলে।

হরিদেব ভারী টুলটুলে হাসি হেসে বলে, গদাইবাবুদের দু’ বোতল আর দুই ভাড়াটের দু’ বোতল। ফেরত দিতে দিয়েছে আমাকে। অনেক ছানা। খাবি?

চোখ বড় করে নিত্যপদ বলে, খাব কী? ফেরত দেবে না?

সে কথায় কান দেয় না হরিদেব, বিড়বিড় করে বলে, কাল পর্যন্ত টকে গিয়ে গন্ধ ছাড়বে। জিনিসটা নষ্ট হয়ে যাবে।

বাবুরা ধরবে যে তোমাকে!

হরিদেবকে সবাই ধরে। ঘরে, বাইরে, রাস্তায় হরবখত লোকে তাকে পাকড়াও করে বলে, এটা আনোনি, সেটা দাওনি, অমুক করেছ তমুক হারিয়েছ।

তা লন্ড্রির বিল হারিয়ে ফেলে হরিদেব, জিনিস আনলে ফেরত পয়সার গড়বড় হয়, তেজপাতার বদলে শুকনো লঙ্কা কিনে এনে দেয় লোককে। লোকের কথাতে আর তেমন গা করে না সে। ছেলেকে বলল, খাই আয় দুজনে।

এবার নিত্যপদ খুশি হয়ে বলল, মাইরি বাবা, খাবে!

হরিদেবের আনন্দ ধরে না। একটা কলাইয়ের বাটি বের করে দুটো বোতলের নষ্ট দুধ ঢালে তাতে। পিছল পিছল কটু গন্ধের হড়কানো সাদা কাথের মতো ড্যালা আর জল ঝরে পড়ে। বাটিটা চৌকির মাঝখানে রেখে দু’ধারে বসে বাপ আর ছেলে খায়! খেতে খেতে নিত্যপদ বলে, একটু গুড় বা চিনি হলে বাবা? অ্যাঁ!

এমনিও ভাল। খা।

কাল কী করবে? ছানা ফেরত না দিলে দিদিমণিরা লিখে দেবে না, তখন?

সমীরণবাবু কিছু বলবে না, ধর বউদি একটু খিটমিট করবে। গদাইবাবুদের দুটো বোতল ফেরত দেব।

দিয়ো। নইলে তোমাকে এ বাড়ি থেকে গড়িয়ে দেবে। দিলে যাবে কোথায়? নতুন বউদিটা যা খচ্চর না!

খুব খচ্চর?

মা বলে ঢ্যামনা মাগি।

হরিদেবের ছানার মুখ খুব হাসে। পা তুলে উবু হয়ে বসে বাটি ধরে ছানার জলটা চুমুক মেরে খানিক খেয়ে নিত্যপদর হাতে বাটি দিয়ে বলে, খা।

বাটি শেষ করে নামিয়ে রেখে নিত্যপদ বলে, সমীরণবাবুর ক্রাচিনের পয়সা ফেরত দিয়েছ?

 কেরোসিনের পয়সা? ও! সে কথা হয়ে গেছে। বলেছে দিতে হবে না।

 কবে বলেছে?

 কাল পর কবে যেন!

 নিত্যপদ সন্দেহের চোখে চেয়ে বলে, কাল বিকেলেও আমাকে ধরেছিল মোড়ে। বলল, তোর বাবা কোথায়?

হরিদেব উদাস মুখে একটা বিড়ি ধরায়। সবাই ধরে তাকে। নতুন নয়।

গদাধরবাবুর বাড়ির নীচতলাটা পিজরাপোল। ছারপোকার মতো ভাড়াটেরা গিজগিজ করছে। ঘরেরও অন্ত নেই। দিনরাত জল নিয়ে, এঁটো কাটা, উনুনের ধোঁয়া, এটা সেটা নিয়ে ক্যাচম্যাচ। সেই পিজরাপোল থেকে রোগা একটা বউ বেরিয়ে এসে খনখনে গলায় ডাকে, অ হরিদা! হরিদা!

নিত্যপদ কান খাড়া করে শুনে বলে, বাবা, বেলামাসি ডাকছে টুসিকে ইস্কুল থেকে আনতে যাওনি আজ!

ওই যা। ভুলে গেছি। ক’টা বাজে?

দশটা বেজে গেছে কখন! দেবেখন বেলামাসি, যাও।

হরিদেব মুখখানা গম্ভীর করে বেরিয়ে গিয়ে বলে, এই যাচ্ছি বউদি।

ভুলে যাও কী করে বলো তো! কচি মেয়েটা এখন আসে কী করে? এতক্ষণে কান্না জুড়েছে বোধহয়। মাসের শেষে পাঁচ-পাঁচটা টাকা নাও কি এমনি এমনি? মেয়েটাকে ইস্কুলে দিয়ে এলে সকালে আর আনতে ভুলে গেছ, মাথাটা খেয়েছ নাকি?

কিছু বলার নেই তবু হরিদেব ব্যস্তসমস্ত হয়ে রওনা হতে হতেই বলে, আমার ছেলের বউভাত ছিল কিনা।

বউটি পিছন থেকে বলে, ওমা! সে তো কবে হয়ে গেছে শুনেছি। আর তার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক রে বাবা? না। বুড়োর মাথাটাই গেছে…

হন্তদন্ত হয়ে হরিদেব ইস্কুলবাগে যাচ্ছে, বাড়ির ফটকেই ধরদের বুড়ো গিন্নি ধরে ফেলল, হরি, ব্যাপারটা কী বলল তো শুনি! তোমার মেয়ে মলি বিনা নোটিশে আমার বাড়ির কাজ ছেড়ে দিল, বলে কিনা বেশি কাজ, ছুটি পাই না, সিনেমায় যেতে পারি না। ওদিকে দেখছি সরকারি কোয়ার্টারে এক ছোকরার বাসায় যথাসর্বস্ব করছে পনেরো টাকায়। কাল দেখেছি, রাত দশটার পর কোয়ার্টার থেকে বেরোচ্ছে। এইবেলা সময় পাচ্ছে? সিনেমা দেখতে পাচ্ছে?

হরিদেব তার কী জানে! সে মলির জন্মদাতা হতেও পারে, কিন্তু বাপ নয়। কটকটে কথাগুলো শুনতে শুনতেই হরিদেব হনহন করে হাঁটে। বলবেই লোকে। কত বলে।

ওই আবার মোড়ের মাথায় সমীরণবাবু। কেরোসিনের ফেরত পয়সা! ছেলের বউভাতের কথা আবার বলা ঠিক হবে কি না তা ভাবতে থাকে হরিদেব।

সমীরণবাবু তাকে ধরল বটে তবে কেরোসিনের ফেরত পয়সার কথা না তুলে গম্ভীর গলায় বলে, তোমার ছেলে নিত্যপদ কোথায়? গতকাল মুড়ি আনতে দিয়েছিলাম, কুড়িটা পয়সা ফেরত দেয়নি।

একগাল হেসে হরিদেব বলে, মহা চোর। চুপি চুপি গিয়ে আমার ঘরে ঢুকে যান। বসে বসে ছানা খাচ্ছে। হুটোপাটি করে যান, নইলে পালাবে।

সমীরণ চোটেপাটে বাড়ির দিকে ধেয়ে যায়। খুব হাসে হরিদেব। নেত্যটা আজ ঝাড় খাবে।

খুকিটা ফাঁকা স্কুলের ফটকে দাঁড়িয়ে সত্যিই কাঁদছিল। একেবারে গুয়ের গ্যাংলা একরত্তি মেয়ে। হরিদেব গিয়ে তাকে সাপটে ধরে হাত থেকে টিনের বই বাক্স আর কাঁধের জলের বোতল নিজের হাতে নিয়ে একগাল হেসে বলে, কেঁদো না খুকি, বড় ভুলে যাই যে! বুড়ো হয়েছি তো।

খুকিটা ফোঁপাতে ফোঁপাতে হাত ধরে হাঁটে। বড় কষ্ট হয় হরির।

ঝিলের ধারে মুখোমুখি নেত্যর মায়ের সঙ্গে দেখা। দেখে ভারী আনন্দ হয় হরিদেবের। ছোটলোকের মতো নয় মোটেই তার বউ। পরিষ্কার গা হাত, ফরসা একটা ছাপা শাড়ি পরা, পায়ে স্যান্ডেল। বালিগঞ্জে বড়লোকের বাড়িতে কাজ করে। ষাট-সত্তর টাকা মাইনে, বছরে দু-তিন জোড়া শাড়ি ব্লাউজ, এর ওপর পার্বণী পায়। ভাল অবস্থা যাকে বলে। মাঝবয়সি ভদ্রমহিলার মতো বউকে দেখে ভারী গর্ব হয়!

বিনা ভূমিকায় নেত্যর মা বলল, ছেলের তৃতীয় পক্ষের বউ দেখেছ তো!

দেখেছি।

ও বাড়ি আর যেয়ো না। ঝেটিয়ে খ্যাদাবে। এই আমি ও বাড়ি থেকে আসছি। পদটার কাল থেকে শরীর খারাপ, নাগাড়ে বমি করছে। বউ দেখো গে যাও ফুল-ফুল সেজে বাজারে বেরোল। আমাকে দেখে বলল কী জানো?

খুব যেন মজার ঘটনা এমনি ভাব দেখিয়ে চোখ বড় করে হরিদেব বলে, কী?

বলল, যখন তখন হুটহাট কী দেখতে আসসা বলল তো! সংসার-ভাঙানো ডাইনি কোথাকার! আমি সকলের জন্য যখন তখন রাঁধতে পারব না। আরও কত কথা! শেষে বলে কী, ভালমানুষের মেয়ে হয়ে থাকো তো ছেলের বমি পরিষ্কার করে দিয়ে যাও মুরোদ দেখি, নইলে গোয়েন্দাগিরি করতে আসবে তো ঝ্যাঁটা।

বলল?—খুব অবাক ভাব দেখায় হরিদেব।

 নেত্যর মা ‘হরি’ কথাটা মুখে আনে না, তাই বড় ছেলেকে বরাবর ‘পদ’ বলে ডাকে। বলল, পদটার ঘরে গিয়ে দেখি চার জায়গায় বমি থুপ হয়ে মাছি ভ্যান ভ্যান করছে। সেই রাত থেকে। কেউ পরিষ্কার করেনি। দেখে গা এমন বিড়িয়ে উঠল যে নাকে কাপড় চেপে পালিয়ে বাঁচি না।

ভারী আমুদে হাসি হেসে হরিদেব বলে, খুব তাড়ি টেনেছিল। আমি কাল সন্ধেয় দেখেছি বাজারের রাস্তায় উবু হয়ে বসে তাড়িওলার সঙ্গে খুব জমিয়ে খাচ্ছে। আমাকে ডেকেছিল।

গম্ভীর হয়ে বউ বলে, ও বাড়ি আর যেয়ো না। না খেয়ে থাকো সেও ভাল।

তা ঠিক। তবে কাল দুপুরে হরির বউটা ভাজা মুগের ডালটা যা বেঁধেছিল, চার-চারটে রুটি খেয়ে নিলাম। কাঁচা লঙ্কার এমন বাস ছেড়েছিল কী বলব।

মরণ! তুমি কি মানুষ?

না।

 আপনমনেই মাথা নাড়ে হরিদেব। এ কথাটা সে মানে। হুবহু মানুষ নয় সে। কোথায় কী যেন গলতি আছে একটু। বউয়ের দিকে খুব গর্বের চোখে চেয়ে সে হাসে।

গা বিড়োনো চাপতে নেত্যর মা জর্দা দিয়ে পান খেয়েছে। মুখ থেকে সুন্দর গন্ধ আসছিল। গা থেকেও। বাতাসটা শোকে হরিদেব।

নেত্যর মা বলে, আমি যাচ্ছি। পদকে দেখলে বোলো, আমি আর আসছি না।

 আচ্ছা।

তুমিও যেয়ো না।

আচ্ছা।

নেত্যর মা উলটোবাগে চলে গেল। বারবার পিছু ফিরে সেদিকে দেখল হরিদেব। তারপর খুব অহংকারের হাসি হেসে খুকিকে নিচু হয়ে কানে কানে বলল, দেখলে তো খুকি, এই হল আমার বউ। বুঝলে! আমার বউ। আর আমার ছেলের বউ ভারী ভাল। মুগের ডাল রাঁধে, জানলে খুকি?

.

পোস্টারে লেখা, অনশনের আজ দশদিন।

দেখে হাঁ করে থাকে সমীরণ। দশদিন!

চৌকির ওপর সারি সারি রোগা শরীর পড়ে আছে। নড়ছেও না। বেশ মিষ্টি ফুলের সুবাস পাওয়া যাচ্ছে ত্রিপলের ঘরটায়।

সমীরণ ফিসফিস করে ডাকে, ফজলু! এই ফজলু!

 খুব ক্ষীণ নাকিসুরে জবাব আসে, কে? মলয়বাবু?

না। আমি সমীদা!

ফজলু পাশ ফিরে আস্তে আস্তে চোখের পাতা খোলে। একটা হাত অতি কষ্টে বাড়িয়ে ধরে বলে, একটু তুলবে আমায় সমীদা?

পারবি বসতে?

পারব। আস্তে তুলো। ঝট করে বসলে মাথায় পাক মারে।

ফজলুর হাতের চেটোটা বড্ড ঠান্ডা। সাদা। সমীরণ এক হাত দিয়ে হাত ধরল। অন্য হাতে ফজলুর মাথার নীচে ধরে যত্নে ঠেলে তুলল। ফজলু বসতেই দেখা গেল, তার গলায় একটা রজনীগন্ধার মালা। বসে থাকতেও ফজলুর বুঝি কষ্ট হয়। সমীরণ বলে, আমার গায়ে ঠেস দিয়ে বোস। কাধে মাথাটা রাখ।

ফজলু ক্ষীণ হেসে বলে, না। পারব। অনশন তো সবে শুরু। আরও কতদিন চলবে কে জানে? মলয়বাবু দিল্লি পালিয়েছে।

তা হলে কী হবে?

ফজলু মাথাটা দুহাতে চেপে ধরে হিক্কার মতো শব্দ করে বলে, পালাবে কোথায়? এই বাড়িটাই যে ওর অফিস। একদিন না একদিন আসতেই হবে।

যদি দু’মাস পরে ফেরে?

 তাও ফিরবে তো!

ততদিন কি বাঁচবি ফজলু, না খেয়ে? কেমন বুঝছিস এখন শরীরটা? কেমন লাগছে?

 ফজলুর গোলগাল মুখটা এখন লম্বা হয়ে ঝুলে পড়েছে। মুখের হাড়ের ছাপ ফুটে উঠেছে। চামড়ায়। সেই মুখে একটু হেসে বলল, বিড়ি আছে সমীদা?

দাঁড়া, আনছি।—এই বলে সমীরণ তাড়াতাড়ি গিয়ে এক বান্ডিল বাড়ি আর দেশলাই কিনে আনল। এই একটা জিনিস ফজলু খাচ্ছে। ধোঁয়ায় কোনও পুষ্টি আছে কি না কে জানে, তবু যা হোক পেটে তো যায়।

ফজল বিড়ি দাতে চেপে ধরে বটে কিন্তু দেশলাই ঠকতে পারে না। যতবার বারুদে কাঠি মারে ততবার হাত এদিক ওদিক হয়ে যায়। কাঠিতে বাক্সে ঘষটা লাগে না।

সমীরণ বিড়িটা ধরিয়ে দিয়ে বলে, মরবি যে এরকম করে!

ফজলু খুব মন দিয়ে বিড়ি টানতে টানতে পিছন দিকে চেয়ে লাশের মতো পড়ে থাকা মানুষগুলোকে দেখে চোখ ঘুরিয়ে বলে, বড় একঘেয়ে লাগে। তাছাড়া আমার আর কষ্ট তেমন কিছু নেই।

বাজে বকিস না, শুকিয়ে চারভাগের একভাগ হয়ে গেছিস।

তবু আমার অবস্থা অনেক ভাল। বসতে পারছি, কথাটথা বলছি। ওদের বেশিরভাগই কাল থেকে উঠছে না। আজ খবরের কাগজে ছোট করে আমাদের খবর দিয়েছে, জানো? সকালবেলা মেলা লোজন আমাদের দেখতে এসেছিল, ফুলের মালাটা অনেক দিয়ে গেছে। একজন খবরের কাগজ খুলে খবরটা দেখাল। কিন্তু চোখে সবাই এমন ধাঁধা দেখছি যে পড়তে পারলুম না, তখন সেই লোকটা পড়ে শোনাল। কিন্তু একটুও আনন্দ হল না, বুঝলে! অফিস টাইমের পর বিকেলেও আবার অনেক লোক আসবে, বক্তৃতা দেবে, মালা দেবে। কিন্তু আমরা আজকাল কানে শুনতে পাই না তেমন, ভো ভো করে। গলা বাড়িয়ে মালাটা নেওয়ার মতোও জোর নেই বেশির ভাগের। তাই শোয়া অবস্থাতেই মাথা তুলে মালা গলিয়ে দিয়ে যায়। আমি কিন্তু বসি, মালা নিই, খানিক বক্তৃতাও শুনি। না, সমীদা, আমি সে তুলনায় ভাল আছি।

সমীরণ ফজলুর পেটের খোঁদলে হাত রেখে দেখে। পেটটা কলকল শব্দ করে জানান দিল। সমীরণের দম ফোট লাগে। রুদ্ধ স্বরে বলে, মরবি যে!

ফজলু মাথা নেড়ে বলে, রমজানের মাসে রোজা রাখি। আমার অভ্যেস আছে, বলেছি না তোমায়? রোজার মাস আবার এসে গেল, না গো সমীদা?-বলে ফজলু বিড়ি ফেলে খুব দুরে চোখ মেলে বসে রইল কিছুক্ষণ।

সমীরণ ধীরে ধীরে বদ্ধ শ্বাস ছাড়ে। আর তার নাকে একটা বাঁশির মতো হয়।

 ফজলু দুটো দুবলা হাতে হাঁটু দুটো জড়িয়ে বসেছে। হাঁটুর মাঝখানে ঝুনো নারকোলের মতো মুখ। খুব দূরের চোখে চেয়ে থাকে আনমনে বলল, আমার একটা মতলব আছে সমীদা, জানলে! যদি হাসিল হয় তবে একখানা কাণ্ডই হবে। লোকে সোনার মেডেল দিয়ে যাবে আমায়।

কী কাণ্ড?

মীরাবাজারে একবার একরাম আলি নামে এক ফকির এসেছিল, তোমার মনে নেই? তা সে ফকির বাবা ছিল নিখাগি। দিনের পর দিন অন্নজল ছাড়া দিব্যি বেঁচে ছিল। হাঁটত, চলত, কথা কইত, হাসতও। আমি দিনকতক তার পেছুতে ঘুরেছিলাম। তা সে তেমন পাত্তা দিত না আমায়। অনেক হাতে পায়ে ধরতে সে একদিন বলল, না খেয়ে থাকাটাও একটা অভ্যেস রে। তবে বড় কঠিন সাধনা। হয় কী জানিস? অনেকটা গাছের মতো ব’নে যেতে হয়। শেষে এমন হবে যে ভূঁয়ে দাঁড়িয়ে আছিস, তো সেই মাটি থেকে তোর পা চো করে খানিক রস টেনে নিল শরীরে। রোদুরে হাওয়ায় দাঁড়ালি, তো তোর হাত পা তাই থেকে খানিকটা ভিটামিন ক্যালসিয়াম টেনে নিল। এই করতে করতে আর তখন খাওয়ার দরকার হয় না। আল্লার কুদরতে প্রকৃতিই শরীরের নানা অন্ধিসন্ধি দিয়ে খাদ্য ভরে দেয়।

যাঃ।

মাইরি। বিশ্বাস করো। তা আমার মাথায় আজকাল সেই ফিকিরটা খুব খেলছে। যদি কায়দাটা পাই সমীদা, তবে সব শালাকে মজা দেখাব। যত আমার মতো হাভাতে আছে সবাইকে কায়দাটা শিখিয়ে দেব। চাই কি, শেখানোর জন্য একটা ইস্কুলও খুলতে পারি। সাইনবোর্ডে লিখে দেব, না খেয়ে বেঁচে থাকার কায়দা শিক্ষা করুন। লাখ লাখ শিখতে এসে জুটবে, দেখো।

না খেয়ে খেয়ে তোর মাথাটা গড়বড়ে হয়ে গেছে।

তর্ক করার মতো তাকত নেই ফজলুর। কিন্তু ঝুম হয়ে চোখ বুজে একটা তৃপ্তির হাসি মুখে নিয়ে খানিকক্ষণ বসে থাকে সে। তারপর ক্ষীণ, শোনাসুরে বলে, আমার যেন একটু একটু করে ব্যাপারটা হচ্ছে, জানলে সমীদা। দুদিন যাবত টের পাচ্ছি, বাতাস থেকে আলো থেকে যেন মাঝে মাঝে আমার হাত, পা, গায়ের চামড়া চো করে খানিকটা কী যেন টেনে নিচ্ছে। মনে হয় এখন যদি একবার ভেজা মাঠঘাটে গিয়ে কিছু সময় দাঁড়াতে পারতাম তা হলে ঠিক আমার পা দুটো গাছের শিকড়ের মতো রস টানত কুঁদ হয়ে। মাটি থেকেই তো গাছপালা খেয়ে বাঁচে, সেই গাছপালা খেয়ে তাবত পশুপাখি তুমি আমি বেঁচে আছি। তবে মাটি থেকে সরাসরি খেতে পারব না কেন বললা!

তাই তো! সমীরণ ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবে। দ্বিধায় পড়ে যায়।

ফজলু রোগা মুখে চওড়া হেসে বলে, এই যে সকালবেলা সুমুন্দির পোয়েরা গলায় মালা পরিয়ে গেছে বলির পাঁঠার গলায় যেমন পরায়, এই মালা কি কোনও খাবার জিনিস, বললা! তবু হল কী জানো? যেই আমার গলায় মালা দিল সেই তক্ষুনি যেন ফুলের গন্ধে আমার শরীরের ভিতরটায় লালা ঝরতে লাগল। আমার গলা, কণ্ঠা জিভ ভিজে গেল। পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, মালা থেকে আমার শরীরটা গন্ধ টেনে নিচ্ছে। সারা সকাল ধরে মালাটাকে শুষে এই দেখো এখন একেবারে তুলসী কাঠির মতো শুকিয়ে এসেছে ফুলগুলো।

ফুলগুলো শুকিয়েছে ঠিকই, সমীরণ হাত বুলিয়ে দেখে, তার শরীরটা এক অদ্ভুত অনুভূতিতে শির শির করতে থাকে। সে বলে, বলিস কী?

চোখের দিব্যি।

অবিশ্বাসই বা করে কী করে সমীরণ? তার নিজেরও যে অনেকটা ওইরকমই হয়। ভাল, সুন্দর, পছন্দসই কিছু দেখলে বা শুনলে তার চোখ, কান, গায়ের চামড়া যেন তা গিলে খেয়ে নিতে থাকে। বাস্তবিকই তার পেটের মধ্যেই চলে যায় গোটা ব্যাপারটা। ঠিক খাওয়ার অনুভূতি হয়। সমীরণ তাই খুব বেশি অবিশ্বাস করতে পারে না। তবু সন্দেহবশে বলে, পারবি?

মানুষ কী না পারে বলো! তারাপীঠের কোন এক সাধু নিজের হাগা খেত, বৃত্তান্তটা শশানোনি! ভাবলাম, হয় সেটা ভগবানের মহিমা, নয়তো গাঁজাখুরি। কিন্তু নিজের চোখে যে দৃশ্য দেখলাম কদিন আগে, জানলে? উলটোদিকের ফুটপাথে একটা পাগল বসে থাকে প্রায়ই। হাফ প্যান্ট পরা, খালি গা, বসে বসে একটু একটু হাসে আর আপনমনে বসে বসেই বাহ্যে পেচ্ছাপ করে দেয়। এই কদিন আগে কী দেখলাম জানো? খাচ্ছে।

খাচ্ছে?

মাইরি! চোখের দিব্যি। নিজের মল।

ওয়াক।

ঘেন্না পেয়ো না। কথাটা হচ্ছে, লোকে না পারে কী?

গা বমিবমি করায় সমীরণ উঠে পড়ে। বলে, সাড়ে দশটা বাজতে যায় বুঝি রে। চলি।

আবার এসো।বলে ফজলু হাঁটু থেকে হাতের বাঁধন খুলতেই আপনা থেকে তার শরীরটা ন্যাকড়ার মতো নেতিয়ে পড়ে গেল চৌকিতে।

রায়বাবুর বেশ কয়েকটা কারখানা আছে, তাছাড়া চার-পাঁচরকমের ঠিকাদারির কাজে বিস্তর কুলিও খাটে। কারখানার পেমেন্টের দিন বা কুলিদের হপ্তা দেওয়ার সময়ে রায়বাবু যখন ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে যান তখন সমীরণকে খুবই সতর্ক থাকতে হয়। রায়বাবুর কড়া নির্দেশ আছে, সারাক্ষণ আমার পিছু পিছু গা খুঁকে শুকে থাকবে। তোমার নিশ্বেসের শব্দ যেন শুনতে পাই, আমার গায়ে যেন তোমার শ্বাস টের পাই, চারদিকে খুব নজর করবে। যদি দেখো কেউ সন্দেহজনকভাবে আমার দিকে চেয়ে আছে বা আশেপাশে ঘুরঘুর করছে তো আমাকে আঙুলের খোঁচা দিয়ে জানান দেবে। আর যদি দেখো কেপমারির দল বা ডাকাত বদমাশ গোছের কেউ কাছে ভিড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে তার কোমর পেঁচিয়ে ধরে বলটান দিয়ে পেড়ে ফেলবে।

কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে সমীরণ। রায়বাবু ব্যাঙ্কে যান, টাকা তোলেন, গোনেন, ব্যাগে ভরেন, বেরিয়ে আসেন, সমীরণও রায়বাবুর পিঠের ওপর হুমড়ি খেয়ে চলে, বড় বড় শ্বাস ফেলে রায়বাবুর ঘাড়ে, চারদিকে বড় বড় চোখ করে চেয়ে দেখে। অবশ্য তখনও লাফিয়ে কারও কোমর পেঁচিয়ে ধরে বলটান দিয়ে পেড়ে ফেলার দরকার হয়নি। তবে দরকার হতে পারে ভেবে প্রতিদিন রাতে শোওয়ার সময় এবং ঘুম থেকে উঠে সকালবেলায় বিছানায় পাচটা অভ্যাস করে সমীরণ। মানুষের অভাবে বালিশটাকে বিছানার মাঝখানে একটু থুবড়ে দাড় করিয়ে নানাভাবে নানা অ্যাঙ্গেল থেকে লাফিয়ে ডাইভ খেয়ে কোমর পেঁচিয়ে ধরে বলটান মেরে বালিশটাকে পেড়ে ফেলে সে। অভ্যাসটা রাখা ভাল। কারণ, চারদিকে এত চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই যে যে-কোনওদিন প্যাচটা দরকার হতে পারে।

রায়বাবু নেই, তার বদলে মন্দা আজকাল ক’দিন হল কাজকর্ম দেখছে। ভালই দেখে। তবে সমীরণ আজকাল মন্দার সামনে কিছু ভয়ে ভয়ে থাকে। সেদিন তাকে অফিসে বসিয়ে রেখে গিয়েছিল মন্দা। সে থাকেনি। পরে তাকে সুখন পুরো ব্যাপারটা বলে সাবধান করে দেয়, সমীবাবু, আপনার আমার দু’জনেরই নোকরি না চলিয়ে যায়। মন্দা অবশ্য তাকে কিছু বলেনি আজ অবধি, তবু বড় ভয়ে ভয়ে থাকে সমীরণ।

বাইরের ঘরটায় সন্তর্পণে বসে সমীরণ অপেক্ষা করছিল। রায়বাবু চেম্বারে মন্দা। দরজা বন্ধ। সেদিকটায় একবার চেয়ে আপনমনে দাত দিয়ে নখ খোটে সমীরণ। খুব বেশি কিছু করার নেই।

সমীরণের মনটা বড় খারাপ। ফজলুটা দশদিন ধরে নাগাড়ে না খেয়ে আছে। বাঁচবে তো! নিত্যপদ মুড়ির ফেরত পয়সাটা দেয়নি। কেরোসিনের বিশ পয়সা মেরেছে ওর বাপটা। তার ওপর হরিণঘাটার একবোতল স্ট্যান্ডার্ড দুধ নষ্ট হয়ে গেল, সেটা ফেরত দিতে দিয়েছিল বুড়োটাকে। বুড়ো এখন বলে কিনা, নষ্ট দুধটা বেড়ালে খেয়েছে। বেড়াল নয় নিজেরাই খেয়েছে। সমীরণ জানে। মনটা বড় বিদিকিচ্ছিরি রকমের হয়ে যায় এসব ছ্যাচড়ামির কথা মনে হল। এক বোতল দুধ উশুল হল না, পয়মাল গেল।

এই সবই ঝুঁদ হয়ে ভাবছিল সমীরণ। এমন সময় টিং টিং করে বেল বাজল। তার ডাক।

চেম্বারের দরজা খুলে ভিতরের ঠান্ডায় ঢুকে দাঁড়িয়ে সমীরণ দেখল, মন্দার কানে আজও ফোন। মন্দা কাকে যেন বলছে, না, আমার সঙ্গে তোমার কোনও কথা থাকতে পারে না…শোননা, একটা লম্বা পাড়ি দিয়ে সেইলাররা যখন ডাঙায় নামে তখন তারা মেয়েদের পক্ষে মোটেই নিরাপদ নয়…আমি জানি যে তুমি সাধারণ সেইলার নও, ম্যারিন ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু আমার কাছে অল আর দি সেম…না না, আমি বলে দিচ্ছি রজত, আগামী তিন সপ্তাহ আমার সঙ্গে দেখা করবে না…আমার অনেক কাজ তবু..হঁা…না, আই অ্যাম লুকিং আফটার দি বিজনেস। এক্ষুনি ব্যাঙ্কে বেরোব..আজ পে ডে। দেখা হবে, কিন্তু এখন নয়… না, না প্লিজ…

মন্দা ফোন রাখল। মুখ তুলে বলল, একটু আমার সঙ্গে চলুন।

সমীরণ খাজুরে আলাপ করে মেঘটা কাটিয়ে দেওয়ার জন্য একগাল হেসে বলল, ব্যাঙ্কে তো?

হু। একটু অ্যালার্ট থাকবেন। আজকাল ভীষণ চুরি ডাকাতি ছিনতাই হচ্ছে…

 আহা, হোক। এসব যতদিন আছে ততদিনই তার চাকরি আছে।

.

রায়বাবুর গা শুঁকে শুঁকে চলা সমীরণের অভ্যাস আছে। রায়বাবুর নিয়ম, গায়ে শ্বাস ফেলতে হবে, শাসের শব্দ শোনা যাবে। তবে বোঝা যাবে যে পাহারাদার কাছেই আছে। রায়বাবুর গায়ের গন্ধ যে খুব ভাল তা বলা যায় না। তবে কিনা চাকরি ইজ চাকরি। গা শুকতে বলেছে তো তা-ই সই।

আজ কিন্তু চাকরির সঙ্গে দারুণ সুগন্ধও জুটে গেল। মন্দার গায়ের গন্ধ যে এত ভাল কে জানত?

নিয়মমাফিক সমীরণ মন্দার ঘাড়ে হুমড়ি খেয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে চলতে থাকে। আর এই করতে গিয়ে সে বিদেশি পারফিউম, দামি পাউডার, দুর্দান্ত শ্যাম্পু, এ সবের গন্ধ পায়। সে এমন সুন্দর গন্ধ যে নাক দিয়ে সোজা তার পেটে চলে যেতে থাকে। পেটটায় একটা খাওয়ার অনুভূতি হতে থাকে।

ফজলু যে বলে কথাটা তেমন মিথ্যে নয়। বাস্তবিকই চারদিকের বায়ুস্তরে এরকম নানা খাদ্যই রয়েছে। যদি শুষে নেওয়া সম্ভব হয় তবে আর আলাদা করে খাওয়ার দরকারই হয় না। পারবে কি ফজলু? যদি পারে তবে পৃথিবীর লাখো কোটি লোকের জন্য সেটাই হবে চূড়ান্ত বিপ্লব। খাওয়ারই যদি দরকার না হয় তবে বেকারি, ছাঁটাই, লে-অফ, ক্লোজারের পরোয়া করে কে?

ব্যাঙ্কের সামনে এসে মন্দা গাড়ি থেকে নেমে দরজা লক করল। সমীরণ রাস্তায় নেমেই চারদিকটা তীক্ষ্ণ চোখে জরিপ করে নিল। সবকিছুই সন্দেহজনক। উল্টোদিকের ফুটপাথে একপাল ভিখিরি বসে আছে, তাদের মধ্যে দু’জন ছোকরা, কী মতলব কে জানে! একটা ট্যাক্সি মন্দার গাড়ির পিছু পিছু এসে থামল, ভিতরে একজন ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওলা প্যাসেঞ্জার। ট্যাক্সিটা থামল বটে, কিন্তু লোকটা নামল না, বসে বসে একটা খবরের কাগজ খুলে পড়তে লাগল। কী মতলব কে বলবে? এইরকম চারদিকে হরেক সন্দেহজনক গতিবিধি, আচার-আচরণ। রায়বাবু কি সাধে তাকে গা শুঁকে থাকতে বলে?

রায়বাবুর চেয়ে অবশ্য মন্দার গা শোকা অনেক বেশি আনন্দজনক ব্যাপার। আজ সকালে দুধ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পেটটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। মন্দার গায়ের গন্ধ যেন পেটে সেই দুধের জায়গাটা ভরাট করে দিচ্ছে। ফজলুটা তো মিছে বলেনি!

ব্যাঙ্কের দরজায় উঠতে উঠতে মন্দা একটু বিরক্ত হয়ে পিছু ফিরে বলল, একটু সরে হাঁটুন তো! লোকের শ্বাস গায়ে লাগলে আমি ভীষণ অস্বস্তি বোধ করি।

লজ্জা পেয়ে, সমীরণ একটু পিছিয়ে যায়। গন্ধটার লোভে একটু বেশিই কাছে ঘেঁষছিল সে।

 পিছিয়ে গিয়েও সে অবশ্য তার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয় না। চারদিকে তীক্ষ্ণ চোখ রাখে। সন্দেহজনক নড়াচড়া লক্ষ করে। কাজ দেখাতে হবে। যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। নিজেকে সে রায় আচার্যির সিকিউরিটি অফিসার বলে জানে। লোককে বলেও তাই। বিভাস তাকে শিখিয়েছিল, লোকে জিজ্ঞেস করলে বলবি, আমি মিস্টার রায়ের এ ডি কং। কিন্তু অতটা বলতে সাহস পায় না সমীরণ।

টোকেন নিয়ে মন্দা আলতো হাতে নিজের চুল ঠিকঠাক করছে, সুন্দর বিভঙ্গে দাঁড়িয়ে রাজহাঁসের মতো গ্রীবা বাঁকিয়ে চারদিক দেখছে। খুব অলস বিশ্রামের ভঙ্গিতে কয়েক পা হেঁটে গিয়ে দেয়ালের গায়ে ব্যাঙ্কের ঋণপ্রকল্প সংক্রান্ত একটা পোস্টার আনমনে দেখতে লাগল।

কিন্তু সমীরণ অতটা নিশ্চিন্ত হতে পারে না। চোখের কোণ দিয়ে সে দেখতে পেল, ব্যাঙ্কের সদর দরজার একপাশ দিয়ে খুব আবছাভাবে দাঁড়িয়ে একবার ভিতরে উকি দিল সেই ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওলা ছোকরাটা। দুধসাদা জামা আর প্যান্ট পরা। চোখে একটা হালকা নীল রঙের পরকলা পরে নিয়েছে কখন। খুব নজর রাখে সমীরণ। রায়বাবু বলেন, তেমন কিছু দেখলে লাফিয়ে কোমর পেঁচিয়ে ধরে বলটান মেরে পেড়ে ফেলবে। সমীরণের পাচটা রপ্ত আছে, তবে কোনও মানুষের ওপর এখনও ফলায়নি।

মন্দার টোকেন নাম্বার ডাকা হল। মন্দা এগিয়ে গেল। কাউন্টারের ভিতর হাত বাড়িয়ে বান্ডিল বান্ডিল টাকা বের করে আনছে সে।

আর তখন সমীরণ বিস্ময়ে হাঁ করে দেখে, আশ্চর্য সাহসী সেই ফ্রেঞ্চকাট বেড়ালের মতো পায়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে। বেশ মজবুত বিশাল চেহারা শার্টের খোলা বুক দিয়ে গলায় একটা সোনার চেন দেখা যায়, হাতে ঢিলা করে বাঁধা ঘড়ি কেতরে আছে, আর মুখে একটু হাসি। লোকটার হাতে আপাতদৃষ্টিতে কোনও অস্ত্র নেই বটে, কিন্তু পাকানো খবরের কাগজটা বাঁ হাতে বাগিয়ে ধরা। অসম্ভব নয় যে, ওই খবরের কাগজের ভিতরেই দোলা ছুরি বা নল রয়েছে।

বহুকাল ধরে এরকম একটা পরিস্থিতির জন্যই অপেক্ষা করছে সমীরণ। আজ পর্যন্ত সে কাজ দেখানোর তেমন সুযোগ পায়নি। বুকটা খুব দুরদুর করছে, উত্তেজনায় শরীরে ঝিমঝিম শব্দ হচ্ছে, ভয়ও লাগছে খুব, আবার সুযোেগ সামনে দেখে আনন্দও হচ্ছে খুব।

রায়বাবুর নিয়মমতো এ সময়ে সে পিছন থেকে মন্দার পিঠে আঙুলের খোঁচা দিল। আজকাল মেয়েরা যে সব ব্লাউজ পরে তাতে গোটা পিঠে বুকে ব্লাউজের ন্যাকড়াটুকু খুঁজে পাওয়াই দায়। তাই সমীরণের খোঁচাটা সোজা মন্দার মেরুদণ্ডের নীচ বরাবর হাড়ে মাংসে লাগল।

ও কী!–বলে মন্দা ভীষণ বিরক্ত হয়ে ফিরে দেখে।

কিন্তু তাকে কিছু বলার বা বোঝনোর সময় পায় না সমীরণ। ফ্রেঞ্চকাট নোকজনের পিছনে মাথা নামিয়ে লুকোয়। তার পরের মুহূর্তেই সে মন্দার পিছন দিকটায় বাতাস খুঁড়ে আবির্ভূত হয় এবং হাত বাড়ায়।

সমীরণ বিড় বিড় করছিল, লাফ … কোমর পেঁচিয়ে ধরো… বলটান মারো… পেড়ে ফেলো…

বালিশ লক্ষ করে সে এ তাবৎকাল কম লাফায়নি, কমবার কোমর পেঁচিয়ে বলটান মেরে পেড়ে ফেলেনি। এতদিনে পরিশ্রম সার্থক।

কালীঘাটের কালীকে মনে মনে স্মরণ করে সে অস্ফুট স্বরে ‘জয় কালী’ বলে লাফ দিল। গোলকিপারের ডাইভ দেওয়ার মতো চমৎকার নিখুঁত লাফা লাফিয়েই দু’হাতে লোকটার কোমর পেয়ে গেল সে।

প্রবল গুঁতোয় লোকটা বেসামালভাবে ভাঁজ হয়ে যাচ্ছিল। আর তক্ষুনি পায়ের নীচে জমি পেয়ে সমীরণ প্রাণপণে বলটান মেরে পেড়ে ফেলল।

একেবারে কুমড়ো গড়াগড়ি কাণ্ড। গদাম, ধপাস, ঠকায় নানারকম শব্দ হল। এবং সমীরণ টের পেল, লোকটা চিত হয়ে পড়েছে। সে নিজে লোকটার ওপর পড়ে আছে, কোমর তখনও দু’হাতে ধরা।

চারদিকে বিকট হইচই শব্দ উঠল। হড়াস করে সদর দরজা বন্ধ হয়ে গেল। লোকজন পালাচ্ছে চারধারে।

সমীরণকে কেউ বাহবা দিচ্ছিল না। কিন্তু নিজের নিখুঁত লাফ, কোমর পেঁচানো এবং বলটান দিয়ে পেড়ে ফেলা দেখে সে নিজেই মুগ্ধ হয়ে আপমনমনে বলে উঠল, সাবাশ! চমৎকার!

কিন্তু মুশকিল হল এর পর কী করতে হবে তা রায়বাবু তাকে কোনওদিনই বলে দেননি। বলটান মেনে পেড়ে ফেলা পর্যন্ত সে নিখুঁতভাবে করেছে, কিন্তু এর পরে কী? এইভাবেই কি পড়ে থাকতে হবে? নাকি এর পর লোকটা সম্পর্কে আর কোনও ব্যবস্থা নিতে হবে?

ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল সমীরণ। আর তার দুহাতে ধরা সা-জোয়ান লোকটা ততক্ষণে তার মাথার কুয়াশা কাটিয়ে উঠেছে, পরিস্থিতিটা আঁচ করেছে এবং তারপর সেও এক বলটান দিয়েছে।

এক বলটানেই লোকটা সমীরণের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। তার গায়ে গোরু-খাওয়া জোর। সমীরণ প্রাণপণ চেষ্টাতেও তাকে ধরে রাখতে পারল না।

লোকটা উঠে দাঁড়িয়েছে, আর সমীরণও হামাগুড়ি দিয়ে উঠছে। লোকটা হঠাৎ সেই অবস্থায় পটাং করে ডান পায়ের একটা লাথি চালিয়ে দিল সমীরণের মুখে। সঙ্গে একটা গালাগালও দিল, কিন্তু সেটা ভাল শুনতে পেল না সে। শুন্যে আর একটা বলটান খেয়ে সে পড়ল। মেঝেতে তার হাড়গোড় আর মাংস এ্যাতোনোর শব্দটা স্পষ্ট শুনল সে। মাথাটা ভোম হয়ে গেল।

কিন্তু সমীরণ জানে, এখন যদি সে হাল ছেড়ে দেয় তবে তার অপদার্থতাই প্রমাণ হবে। হেরো বডিগার্ড বা ভূপাতিত সিকিউরিটি অফিসার কোনও কাজের নয়। যদি সে অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে যায় তবে চাকরি নির্ঘাত যাবে।

ভাগ্য ভাল যে লোকটার জুতোয় খুব নরম রবার লাগানো। লাথিটা তাই তুলোর বস্তার মতো লেগেছে। অবশ্য তাই যথেষ্ট। তবু একটা-দুটো ঝাকি মেরে সমীরণ কাত হল এবং হাতে পায়ে ভর দিয়ে চতুষ্পদের মতো উঠে তাকাল চারপাশে।

প্রচণ্ড গোলমালে পুলিশ! পুলিশ!’ বলে কারা যেন চেঁচাচ্ছে। সমীরণ দেখতে পায়, কাচের কাউন্টারের ওপাশে ক্যাশের লোকটা টাকার বান্ডিলের ওপর বুক দিয়ে পড়ে আছে গুলি-খাওয়া মানুষের মতো। আর কাউন্টারের দিকে পিছন ফিরে বুকে অন্তত বিশ হাজার টাকার নানান মাপের বান্ডিল অবহেলায় হাত দিয়ে চেপে রেখে ভারী অবাক হয়ে চেয়ে আছে মন্দা।

মন্দাকে চেয়ে থাকতে দেখেই একটা ঝাকি লাগল সমীরণের শরীরে। চাকরি! সে বডিগার্ড সিকিউরিটি অফিসার আর সেই কঁকিতেই সে সটান দাঁড়িয়ে পড়ে।

লোকটা মন্দার সামনেই দাঁড়ানো। গায়ের ধুলোময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে ইংরিজিতে গালমন্দ করছে। খুব কূটচোখে তার দিকে চায় সমীরণ। হ্যাঁ, আর একটা লাফ, কোমর পেঁচিয়ে আর একটা বলটান মেরে আবার পেড়ে ফেলতে হবে। মন্দা দেখছে। কাজ দেখানোর এই হচ্ছে সময়।

কিন্তু লাফ দেওয়ার আগেই এবার মন্দা এগিয়ে এসে তার হাত ধরে বলল, লাগেনি তো আপনার?

একগাল হাসে সমীরণ, বলে, নাঃ–আর বলতে গিয়েই টের পায়, তার ঠোঁট কেটে দু’ ফালা হয়ে গেছে লাথির চোটে। কলের মতো রক্ত পড়ছে নাক দিয়ে। জামা ভেসে যাচ্ছে রক্তে।

মন্দা বলল, ইস! পরমুহূর্তেই লোকটার দিকে ফিরে বলল, দ্যাট উইল টিচ ইউ এ লেসন।

 লোকটা তোম্বা মুখে গাড়লের মতো হেসে বলে, হু ইজ দা গায়?

মন্দা শ্বাস ফেলে বলে, আমাদের সিকিউরিটি অফিসার। কিন্তু তোমার আক্কেলটা কী বলো তো? তোমাকে বলেছিলাম কিনা যে তিন সপ্তাহের আগে আমি কোনও জাহাজ-ফেরত লোকের সঙ্গে দেখা করি না।

লোকটা মন্দার কথার জবাব দেয় না, এগিয়ে এসে টপ করে সমীরণের হাতটা ধরে বলে, স্যরি। এক্সট্রিমলি স্যরি। আমার দোষ আমি কোনও ওয়ার্নিং দিইনি। জানতাম না তো যে মন্দার সঙ্গে আজকাল স্ট্রং ম্যান থাকে।

স্ট্রং ম্যান! কথাটা নোট করে রাখার মতো। মন্দা শুনেছে কী? একপলক মন্দাকে দেখে নেয়। সমীরণ। মন্দা দেখছে। কিন্তু কী দেখছে? তার ফাটা হাঁ হয়ে যাওয়া ঠোঁট আর চোট-খাওয়া নাক থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে। একটু ভয়ও হচ্ছে আবার সমীরণের। এ লোকটা মন্দার বন্ধু, একে প্যাচ কষাটা কি ঠিক হল? মন্দা কিছু মনে করেনি তো?

সে লোকটার হাত ধরে কী বলতে হবে ভেবে না পেয়ে বলল, না, না, কিছু হয়নি। কিছু মনে করবেন না।

চারদিকে বিস্তর লোক ভিড় করে এসেছে। ভিড় ঠেলে বন্দুক কাধে দারোয়ান এগিয়ে এসে বলে, খাড়া রহিয়ে। পুলিশ আ রহা হ্যায়।

মন্দা লোকটার দিকে চেয়ে বলল, দ্যাট এগেইন উইল টিচ ইউ এ লেসন। যাও এবার জাহাজের ভাত খাওয়ার পর জেলের ভাতটাও খেয়ে এসো। ছিঃ ছিঃ হোয়াট এ সিন!

রজত অবশ্য ঘাবড়ায় না। অতি দ্রুত ফটাফট ইংরিজি বাংলায় সে কথার তোড়ে ভিড় হটিয়ে দেয়। ব্যাঙ্কের বুড়ো ম্যানেজারকে কাধ ধরে খুব আপন করে বুকে টেনে নিয়ে কানে কানে কী বলে বোঝাতে থাকে। এবং ভিড় পাতলা হতে থাকে। উত্তেজনা হ্রাস পায়। সদর দরজা খুলে যায়। ব্যাঙ্কে কাজকর্ম আবার শুরু হয়।

তারা তিনজন বেরিয়ে এসে গাড়িতে ওঠে। সামনে রজত আর মন্দা। পিছনে রক্তঝরা মুখে সমীরণ। তার খুব খারাপ লাগছে না। তবে ব্যাপারটা ভাল হল না মন্দ হল তা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। একবার তার মন বলে, ভালই হল। আবার বলে, না ততটা ভাল কিছু হল না হে। যত যাই হোক নোকটা তো মন্দার বন্ধু!

মন্দা গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, সেইলাররা জাহাজ থেকে নামার পর কিছু দিন ভীষণ সেক্স হাজারে ভোগে রজত। আমি এখন তোমাকে ভয় পাই।

সা-জোয়ান রজত গ্যাল গ্যাল করে হেসে বলে, ননসেন্স। আমি কি মালের জাহাজের খালাসি? আমি প্যাসেঞ্জার লাইনারের ইঞ্জিনিয়ার, মনে রেখো। আই হ্যাড প্লেন্টি অফ গার্লস।

গড!–মন্দা হেঁচকি তুলে বলে, তবে আমার জন্য অত হ্যাংলামি করলে কেন? দেখো তো, প্র্যাকটিক্যাল জোক করতে গিয়ে আমাদের সিকিউরিটি ভদ্রলোকের কী অবস্থা করেছ।

ভদ্রতা করে পিছন থেকে ফাটা ঠোঁটে অতি কষ্টে সমীরণ বলে ওঠে, না, না, কিছু হয়নি।

রজত বলল, আই অ্যাম সো সরি! কী জানো, জাহাজ ইংল্যান্ড ছাড়বার পর থেকেই তোমার কথা এত মনে হচ্ছিল।

এ কালারফুল লাই।

বোকা-হাসিটা মুখে রেখেই রজত বলে, আমি আসায় তুমি খুশি হওনি মন!

মন্দা অফিসের কাছাকাছি একটা ডাক্তারখানার সামনে গাড়ি দাড় করিয়ে পিছন ফিরে সমীরণকে বলে, আপনি বরং কাটা জায়গাটায় একটু ওষুধ লাগিয়ে নিন এখান থেকে। একটা এ টি এস ইঞ্জেকশনও নেবেন। এটা রাখুন।-বলে দশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দেয়।

ভারী কৃতজ্ঞতার সঙ্গে নোটটা নিয়ে নেমে পড়ে সমীরণ। মুখটা ফুলে গেছে। ব্যথা হচ্ছে খুব।

মন্দা মুখ বাড়িয়ে বলল, আর শুনুন, অফিসে থাকবেন। আমার হয়ত আপনাকে দরকার হবে।

এই বলে মন্দা গাড়ি ছাড়ল, আর ছাড়বার মুহূর্তে চাপা গলায় রজতকে বলল, নাউ আই উইল সি হাউ মাচ ইউ মিসড মি!

রজত গ্যাল গ্যাল করে হাসছিল।

.

০৮.

গভীর রাতে লোকটা ট্রাম লাইনের ওপর পড়ে আছে। একটা হাত কাটা, একটা পা খ্যাতলানো, কোমর ভাঙা। কাতরাচ্ছে গভীর গভীরতম মৃত্যুযন্ত্রণায়। নিজের রক্তের পুকুরে সাঁতরাচ্ছে, ড়ুবে যাচ্ছে।

বৌধায়ন চোখ ফেরাতে পারে না, তার ঘাড় শক্ত হয়ে আছে। ফুটপাথে বসে থাকা একটা ভিখিরির মতো চেহারার লোক মুখ থেকে বিড়িটা সরিয়ে থুথু ফেলে থিকথিক করে হেসে বলল, এইমাত্তর লাস্ট ট্রামটা মেরে দিয়ে গেল। ও আর দেখতে হবে না, হয়ে গেছে।

বৌধায়ন রক্ত দেখতে পারে না, কাটা ছেড়া শরীরের দিকে তাকাতে পারে না। কলকাতার রাস্তায় প্রায়ই এখানে সেখানে পড়ে থাকে মানুষজন। তাদের কী হয়েছে তা কখনও জানবার চেষ্টা করে না বৌধায়ন। নিজের মনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ও কিছু নয়, লোকটা বোধহয় ঘুমোচ্ছ। এই ভেবে সে তাড়াতাড়ি জায়গাটা পার হয়ে যায়।

নিজের এই কাপুরুষতা বড় কষ্ট দেয় তাকে। তবু আজ সামনে এই জাজ্বল্যমান দৃশ্যটা দেখে সে পালাতে পারে না। লোকটা এখনও বেঁচে আছে। হাসপাতালে নিলে হয়তো বেঁচে যেতে পারে।

বিদ্যাসাগর কলেরার রুগি কাঁধে করে নিয়ে গিয়েছিলেন, মাদার টেরেসা আজও কুষ্ঠরোগীর সেবা করেন। সে পালাবে?

সাহস নয়, কিন্তু ভীষণ একটা মরিয়া ভাব এল তার। পারতেই হবে। যদি তার নিজের কোনওদিন এ দশা হয় তখনও তো এমনি তাকে পড়ে থাকতে হবে নির্জন রাস্তায়! হলহল করে কলখোলা জলের মতো রঙের ধারায় তৈরি হবে পুকুর।

বৌধায়ন আর ভাবে না। গোড়ালি-ড়ুব রক্তের পুকুর থেকে নিচু হয়ে কাটা, ভাঙা ঘঁাতলানো শরীরটাকে তুলে নিতে চেষ্টা করে। রক্তে ভিজে পিছল শরীরটা হড়কে যায় বার বার, লোকটা। গোঙায়। কী গভীর শব্দ যন্ত্রণার! বৌধায়নের সমস্ত শরীর অন্যের রক্তে, স্বেদে, শরীরের ঘামে ভিজে যেতে থাকে। ঘেন্নায়, ভয়ে তার শরীর কাপে রি-রি করে। কিন্তু প্রাণপণে দাঁতে দাঁত দিয়ে সে লোকটাকে কাঁধে নেয়।

কোনদিকে কত দূরে হাসপাতাল তা জানে না বৌধায়ন। ভারী নির্জন রাস্তা। ঠিক নির্জন নয়, ফুটপাথ থেকে আনাচ কানাচ থেকে কাঙাল, গরিব, বদমাশের চোরা-চোখ তাকে লক্ষ করে। শেয়ালের মতো ধূর্ত চোখ সব। চোখগুলি শ্রদ্ধায় বা বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয় না, কেবল নিস্পৃহ কঠিন দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকে দেখে। তারপর উদাস ভঙ্গিতে তারা চোখ ফিরিয়ে নিয়ে হাই তোলে।

বৌধায়ন হাঁটতে থাকে। লোকটা ঝুলছে গোঙাচ্ছে। কাটা হাতটা ফিতের মতো পাতলা একটু চামড়ার সঙ্গে লেগে ঝুলছে। থপ করে হাতটা খসে পড়ে গেল। নিচু হয়ে ঠান্ডা, শক্ত হাতটা কুড়িয়ে নেয় বৌধায়ন। হাতটা বেশ লম্বা। অনেকটা লাঠির মতো সেটাতে ভর দিয়ে দিয়ে এগোতে পারে সে।

হাসপাতালের রাস্তা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না বৌধায়ন। এই বিপুল মধ্যরাতের শহরে কোনদিকে যে নিকটবর্তী হাসপাতাল তা সে জানেও না।

পিছু পিছু একটা লোক আসছে টের পেয়ে বৌধায়ন ফিরে তাকাল। বেঁটেখাটো ধূর্ত একটা লোক। আসলে শেয়াল। গোঁফের ফঁাকে হাসছে। চোখে মিটমিটে জোনাকি।

কে?

কিছু নয় স্যার।

ওর আংটিটা আর ঘড়িটা নেব স্যার?

বৌধায়নের দম বন্ধ হয়ে আসে। কাটা হাতটা তুলে সে কুকুর তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলে, হ্যাট! হ্যাট!

লোকটা সরে যায়।

 কিন্তু আশ থেকে পাশ থেকে ছায়ার মতো লোকেরা আসছে। অদ্ভুত লোক সব। ঠিক মানুষ নয়। শেয়ালের মতো। তাদের একজন চাপা স্বরে বলে, লাভ নেই। ওর হয়ে গেছে। টেরিলিনের জামাটা খুলে দিন না! নইলে হাসপাতালের ধাঙড়রা তো নেবেই।

বৌধায়ন কাটা হাতটা তোলে লাঠির মতো! কিন্তু তার গায়ে রত্তি জোরও নেই। সে ঘামছে। প্রবল এক মানসিক জোরে সে চেঁচিয়ে বলে, খবরদার!

কিন্তু হাসপাতাল কোন দিকে? হাসপাতাল কত দূর?

এক-আধটা বেশি রাতের ট্যাক্সি আশপাশ দিয়ে ধীর গতিতে চলে যাচ্ছে। প্রাণপণে কাটা হাতটা তুলে ধরে বৌধায়ন ট্যাক্সি থামাতে বলে। আতঙ্কিত ট্যাক্সিওয়ালারা থামে না।

লোকটা গভীর স্বরে পেট থেকে গোঙানি তুলে আনে। একবার বলে জল’, আর একবার বলে বাড়ি যাব’। দিগভ্রান্ত বৌধায়ন প্রাণপণে হাঁটে। কোথায় যাচ্ছে তা বুঝতে পারে না।

তার পিছনে লোভী শেয়াল-মানুষেরা দল বাঁধছে, জোট বাঁধছে ফিসফিস করে কথা বলছে, হাসছে খিকখিক করে। বৌধায়ন কাটা হাতটা তুলে বলে, হ্যাট! হ্যাট!

কিন্তু লোকগুলো ঘিরে আসে। মেঘের মতো ঘনিয়ে ওঠে চারদিকে। থমথম করতে থাকে চারপাশ। বিপদ!

বৌধায়ন আতঙ্কে পাগল হয়ে যায়। কাঁধ থেকে লোকটাকে ফেলে দিতে চেষ্টা করে সে। কিন্তু লোকটা তখন একটা হাত আর দুটো পায়ে তাকে আঁকড়ে ধরেছে প্রাণপণে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে বৌধায়নের। সে চেঁচাতে থাকে, বাঁচাও! বাঁচাও!

.

এত ভোরে ঘুম ভাঙে না বৌধায়নের। দুঃস্বপ্নটা দেখে ভাঙল। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙলে মানুষের যা যা হয় তারও তাই তাই হল। যেমন প্রথমটায় সে কিছুক্ষণ বুঝতেই পারল না, ব্যাপারটা সত্যি না মিথ্যে। তারপর স্বপ্ন বুঝেও অনেকক্ষণ আতঙ্ক গেল না তার। তারপর জল খেল। আবার ঘুমোবার চেষ্টা করল।

সারা সকালটা গুম হয়ে ছিল সে। স্বপ্নের পর প্রথম জ্যান্ত মানুষ দেখল সে, যখন জয়তী চা দিতে এল।

বিনা ভূমিকায় বৌধায়ন বলল, কলকাতায় স্বরূপটা কি জানো?

 জয়তী খুব অবাক ভান করে বলে, না তো! বলবে?

বৌধায়ন মুখ বিকৃত করে ডান পা-টা সরিয়ে বলল, বোসো, বলছি।

তাহলে একটু অপেক্ষা করো, ঘড়িটা হাতে পরে আসি।

কেন?

 ঘুঘুটা কতক্ষণ ডাকবে কে জানে। কিন্তু ঘুঘুর ডাক শুনতে গিয়ে আমার কর্তার অফিসের বেলা না বয়ে যায়।

বৌধায়ন রেগে গিয়ে বলে, এ বাড়িটা কী বলো তো? একজনও সিমপ্যাথাইজার নেই আমার। সারাদিন একা ঘরে পড়ে থাকি, একটা জ্যান্ত লোকের মুখ দেখি না। এর পর বাস্তবিক আমার ভূতের ভয় করতে শুরু করবে।

জয়তী তার ঘুম-ভাঙা মসৃণ মুখে মধুর একটু হেসে বলে, তোমার জন্য সিমপ্যাথিতে রাতে আমার ভাল ঘুম হয় না, জানো?

ওঃ! রাতে কেন ঘুম হয় না সে আমার জানা আছে। বেশি বোকো না। নিজে ঘুমোও না, বুধাদিত্য বেচারাকেও ঘুমোতে দাও না। জানি।

জয়তী ব্যথিত মুখে বলে, ছিঃ! গুরুজনদের সম্পর্কে অসভ্য ইঙ্গিত করতে নেই। কলকাতার স্বরূপটা কী বলছিলে যেন! আচ্ছা, না হয় একটু বসেই যাই।

জয়তী বসল। বৌধায়ন চা শেষ করে কাপটা নামিয়ে রেখে বলে, হেসো না, সবটা শোনো। স্বপ্ন হলেও ইট ওয়াজ দা রিভিলেশন অফ টুথ। কী দেখলাম জানো? আমি মাঝ রাতে একটা আহত লোককে কাধে বয়ে নিয়ে যাচ্ছি… হাসপাতালে… কিন্তু রাস্তা চিনতে পারছি না.. আর অবিকল শেয়ালের মতো কিছু লোক সেই উনডেড লোটার ঘড়ি আংটি আর জামাকাপড় কেড়ে নেওয়ার জন্য তাড়া করেছে… আমি লোকটাকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু লোকটা তখন আমাকে ছাড়ছে না… তাকিয়ে আছে যে।

আমার চোখে পাপ নেই।

তা না থাক, কিন্তু ব্যঙ্গ আছে। তুমি কি সিরিয়াস জয়তী?

 আবার জয়তী?

সরি। বউদি। ব্যাপারটা কী জানো? আমি স্বপ্নটা অ্যানালাইজ করে দেখলাম, কলকাতা এখন। একজ্যাক্টলি ওই স্বপ্নের মতো। কলকাতাকে দুঃস্বপ্নের শহর কে বলেছিল বলো তো!

নেহেরু।

তোমার মাথা। বলেছিল… বলেছিল— বৌধায়ন চোখ তুলে ভাবে।

প্যাটেল। জয়তী বলে।

বৌধায়ন হতাশ হয়ে বলে, প্যাটেল বললে কাউকেই বোেঝায় না। কোন প্যাটেল? বল্লভভাই হতে পারে, আরও কত প্যাটেল আছে।

জয়তী করুণ মুখ করে বলে, তুমি কি শেষ পর্যন্ত সংসারে থাকবে বুধো? বুদ্ধের মতো গৃহত্যাগ করবে না তো!

মানে?

আজকাল যে মানুষের জন্য তোমার ভীষণ প্রাণ কাঁদছে। জেগে ঘুমিয়ে সব সময়েই যে তুমি মানুষের বিপদে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছ। ব্যাপারটা কী বলল তো? স্বপ্নে উনডেড লোককে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছ, এই সেদিন বিনা স্বপ্নে মন্দাকে উদ্ধার করতে লাঠি নিয়ে… ছিঃ ছিঃ… বাবা রে বাবা! পারোও তুমি।

বৌধায়ন নিমীলিত চোখে চেয়ে বলে, আমি কত মহৎপ্রাণ মানুষ ছিলাম তা আজ বুঝলে না জয়তী, কোনওদিন বুঝবে। এখন যাও কর্তাকে নেকারবোকার পরিয়ে, চোখে কাজল টেনে, হামি খেয়ে অফিসে পাঠাও গে যাও। তোমরা ফিলানথ্রপির বোঝো কী? আত্মসুখী সংসারী সব।

জয়তী টপ করে বৌধায়নের ডান পা চেপে ধরে বলে, হামি খাওয়ার কথাটা উইথড্র করবে কি বলো! না করলে…

বৌধায়ন প্রাণপণে পা-টা স্থির রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে ডান পাটার দিকে চোখের ইঙ্গিত করে বলে, আর ও ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়। বুঝলে? পা কমপ্লিটলি সেরে গেছে। আজ সোনলা ওয়াকিং এ বেরোচ্ছি।

জয়তী পা ছেড়ে দিয়ে বলে, সাবালক হলে তাহলে! আসলে ব্যথা না আরও কিছু। ঢং করে ক’দিন অন্যদের সিমপ্যাথি আদায়ের চেষ্টা।

যা সিমপ্যাথি দেখিয়েছ আর বোলা না। যাক গে, আজ সবাইকে ক্ষমা করছি। আজ আমার মিসা থেকে মুক্তি। আজ সমস্ত পৃথিবীটা আমার। যাও বৎসে, তোমার স্ত্রী-সর্বস্ব স্বামীটাকে হামি দিয়ে অফিসে পাঠাও গে।

কাপের তলানি চা-টুকু নিখুঁত লক্ষ্যে বৌধায়নের মুখে ছুঁড়ে দিয়ে জয়তী ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আজ সত্যিই বেরোল বৌধায়ন। বাড়ির বাইরে পা দিয়েই তার মনে হল, কী মুক্ত এই পৃথিবী! কী বিশাল প্রসারিত চারিধার!

একটু খোঁড়াচ্ছে সে এখনও। গোড়ালির হাড়ের গভীরে একটু ব্যথা ঘাপটি মেরে আছে। তবু বড় ভাল লাগছিল তার। এখন সে একা বেরোতে পাবছে। কত জায়গায় যাওয়ার আছে তার! কতজনার সঙ্গে দেখা করার আছে!

প্রথমে কোথায় যাবে, কার সঙ্গে দেখা করবে তা ঠিক করতে পারছিল না সে। একবার ভাবল, রেনি পার্কে বড়দার নতুন কেনা ফ্ল্যাটে গিয়ে ওদের সঙ্গে কাটিয়ে আসে, আবার ভাবল কোনও বন্ধুর কাছে গেলে কেমন হয়? শেষ পর্যন্ত ঠিক করল বিছানায় দীর্ঘ বন্দিদশা থেকে মিসা থেকে যে মুক্তি, আজ সে বহু দূর পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে সেই অবারিত মুক্তিকে অনুভব করে বেড়াবে। অসুখ বা দুর্ঘটনা বা জেল না হলে বোঝাই যায় না যে বেঁচে থাকাটা কী ভীষণ ভাল!

সকাল থাকতে থাকতেই বেরিয়ে পড়েছে বৌধায়ন। কারণ, নতুন করে একা একা, স্বাধীনভাবে চারধার দেখবে সে এতদিন পরে। সকালের আলোটাই ভাল। সব কিছু তাতে অন্যরকম দেখায়।

সে বড় রাস্তায় একটা ট্যাক্সি পাকড়াও করল আর মানিকতলা থেকে শিয়ালদা আসতে আসতে সে তিনটে বাচ্চা ন্যাংটো ছেলেমেয়েকে ফুটপাতে রাস্তার দিকে পিছন ফিরে বসে হাগতে দেখল। দেখল, রাস্তায় স্নান চেহারার ক্ষয়া আধমরা মানুষ গিসগিস করছে। স্টেটবাসের গায়ে পুরু ধুলোর মলিন আস্তরণ। নতুন সিনেমার পোস্টারে হুমদো হুমদো নায়ক-নায়িকার বিকট চড়া রঙের ছবি ঝুলতে দেখল সে। তার নীচে রাস্তার হাইড্র্যান্টের ঘোলা জলে স্নান করছে বুড়ো বাচ্চা কিছু মানুষ। অত রঙের নীচে বড় বেমানান। দেখল, বস্তিকে আড়াল করে বিশাল আধুনিক বাড়ি উঠছে। ফরসা জামা চড়িয়ে হেঁড়া গেঞ্জি ঢাকা দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে ফোলোবাবু কলকাতা।

মুক্ত মিসা-বন্দির চটকা ভেঙে গেল বৌধায়নের। সে সিটে এলিয়ে থেকে চোখ বুজল। তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, ময়দান।

কোথাও অবশ্য নামল না, বৌধায়ন। চক্কর মারতে লাগল এদিক সেদিক। ময়দান ছাড়িয়ে চলে এল দক্ষিণে। এক জায়গায় ট্যাক্সি দাড় করিয়ে রেখে চা আর অমলেট খেয়ে এল। ঘুরতে ঘুরতে আবার ময়দান, চৌরঙ্গি।

ট্যাক্সির ভিতরটা নিজের শ্বাসে ভেপে উঠছে দেখে বৌধায়ন ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। একটু হাঁটবে স্বাধীনভাবে। বেড়ানো যাকে বলে। মুক্তি যাকে বলে। খোলা আলো আর বাতাস নিবিড় আলিঙ্গনে ভালুকের মতো চেপে ধরুক তাকে।

আর এসপ্ল্যানেডে মেট্রোর উলটোদিকেই তার জন্য ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছিল দৃশ্যটা। ঘুরে ঘুরে সে এল এইখানেই।

তেমন কিছু নয়। রোজই দেখা যায়। তবু এতদিন বাদে বড় কাছ থেকে আবার দেখল বৌধায়ন। মেট্রোর উলটোদিকে গাছতলায় একটা বোগা ভিখিরি ছেলের শ্বাস উঠেছে। শুধু হাফপ্যান্ট ছাড়া তার পরনে কিছু নেই। সেই হেঁড়া হাফপ্যান্ট দিয়েও তার নুঙ্কু দেখা যায়। তার চেয়েও অশ্লীল দৃশ্য হল, তার বুকের পাঁজরের ওপর দিয়ে সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার হৃৎপিণ্ডের ঢেউ। এত রোগা মানুষ হয়? আজ পর্যন্ত যত রোগা লোক দেখেছে বৌধায়ন তার মধ্যে এ সবচেয়ে বেশি নম্বর পাবে। গায়ে তেলচিটে ময়লা, গাঁটে গাঁটে অজস্র মাছি-বসা ঘা। একটা ন্যাকড়ার ফালিও জোটেনি বলে সোজা পথের শানের ওপর পড়ে আছে কাত হয়ে। মুখের সামনে শুকনো বমি, মলে মাখামাখি নিম্নাঙ্গ।

চলে যাওয়াই উচিত বৌধায়নের। তবু পাঁচ হাত দূরে সে ক্ষণকালের জন্য হলেও থামল। নিজেকেই জিজ্ঞেস করল, পারবে বৌধায়ন, ওকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেতে?

না।

স্বপ্নে কাল কিন্তু একজন আহতকে নিয়েছিলে তুমি।

আমাকে আবার স্বপ্নের মধ্যে নিয়ে যাও। তাহলে পারব। স্বপ্নে পারি। স্বপ্নে সব পারি।

বাস্তবে পারো না?

কিন্তু আমি মানুষের জন্য ভীষণ ফিল করি। আমি বিশ্বাস করি, এর জন্য কিছু করা দরকার। খুব দরকার। বিদ্যাসাগর পেরেছিলেন, মা টেরেসা পারেন। আমি কেন যে পারি না!

কিন্তু বুঝে দেখো বৌধায়ন, ও ছেলেটা তোমার জন্যেই পড়ে আছে না কি? তোমাকেই কি ডাকছে না? ও মরে যাচ্ছে বৌধায়ন। সারা দিন ওর পাশ দিয়ে কত লোক হেঁটে চলে যাবে। ফিরে তাকাবে, হয়তো একটু থামবে, ইতস্তত করবে কেউ কেউ। কিন্তু চলেই যাবে শেষ পর্যন্ত। তুমিও যদি তাই করো তবে তুমিও ভিড় হয়ে গেলে, সাধারণ হয়ে গেলে ইনসিগনিফিক্যান্ট হয়ে গেলে।

স্বপ্নে পারি। আমাকে আবার স্বপ্নে নিয়ে যাও।

 পৃথিবীর প্রতিটি দুঃখী মানুষ তোমাকে যে ডাকছে বৌধায়ন।

আমাকে কেন? আমাকেই কেন? যা করার সরকার করুক। জানো না, আমেরিকায় এরকম হয়? রাশিয়ায় হয় না। ইউরোপে হয় না। শুধু এই জঘন্য দেশে হয়। আমি কী করব?

বৌধায়ন আস্তে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। না, সে পারবে না। সে মহৎ নয়। সে বড় সাধারণ। আর এই বোধ তার বুক খামচে ধরে থাকে অনেকক্ষণ।

বৌধায়ন ভাবে, আজ পারল না সে। কিন্তু একদিন পারবে। একদিন সে ঠিক পারবে। পৃথিবীর আর্ত মানুষেরা তার জন্যই হয়তো অপেক্ষা করছে। একদিন সে-ই হয়তো হবে মানুষের মুক্তিদাতা?

বেলা দশটা নাগাদ বৌধায়ন মন্দার বাবার অফিসের তিনতলার সিঁড়ি ভেঙে উঠে এল।

সেই থেকে রাগ করে বৌধায়ন আর কখনও মাকে ফোন করেনি। কিছু জানতে চায়নি। আশ্চর্য এই যে মন্দাও তাকে খবর দেয়নি কিছু। যদি মন্দাকে পায় আজ তবে কিছু কথা শোনাবে সে।

সামনের ঘরটায় সমীরণ নামে সেই লোকটা বসে আছে। তাকে দেখে একটু থমকে গেল বৌধায়ন। লোকটার ওপরের ঠোঁটে একটা মস্ত স্টিকিং প্লাস্টার প্লাস্টারের তলা দিয়েও ফোলা কাটা রক্তাক্ত মাংস দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো লাল। চুল উসকো খুসকো।

লোকটা বসে ছিল, তাকে দেখে উঠে দাঁড়ায়।

 বৌধায়ন ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করে, মন্দা আসেনি?

না।

কখন আসবে?

লোকটা বিক্ষত মুখে কষ্ট করে বলে, কাল সকাল থেকে বসে আছি। বলেছিলেন ফিরবেন। ফেরেননি।

স্তম্ভিত হয়ে বৌধায়ন বলে, আপনি কাল থেকে আছেন?

লোকটা হাসবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ। উনি বলেছিলেন, আমাকে দরকার হতে পারে। যেন থাকি।

অথচ আসেনি?

না।

 রাগে আপন মনে খানিকটা গরম হয়ে গেল বৌধায়ন। বিড়বিড় করে বলল, কী চায় ও? কী চায়?

আজ্ঞে?

কিছু খেয়েছেন?

খেয়েছি। রুটি তরকারি। রাতে সুখন দিয়েছিল।

 আজ?

পাউরুটি আর চা।

 মন্দা কোনও খবর দেয়নি?

বেলা তিনটায়, রাত আটটায় আর সাড়ে এগারোটায় ফোন করেছিলেন।

কী বলল?

শুধু বললেন, আমি যেন থাকি। আমাকে ওঁর দরকার হবে।

আপনি তো মশাই ক্যাসাবিয়াঙ্কা। ও বলল বলেই আপনি বসে রইলেন?

কী করব? চাকরি।

বৌধায়ন লম্বা কাঠের বেঞ্চটায় বসল। দাতে দাত চেপে রাগ সামলাতে লাগল। আর বসে বসে জগতের যত কিছু অন্যায় আর অবিচারের কথা ভাবতে লাগল। এক্ষুনি কিছু একটা করা উচিত। সব কিছুর একটা আমূল ওলট পালট দরকার।

একটু বাদে রাগটা থেমে গেল খানিকটা। নরম স্বরে সে লোকটাকে জিজ্ঞেস করে, আর কিছু খাবেন? আমি খাওয়াতে পারি।

খুব লজ্জিত ভঙ্গিতে লোকটা বলে, না। তারপর একটু চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বলে, খাওয়াটা কোনও সমস্যাই নয়। এমন দিন আসবে যখন মানুষ না খেয়েই থাকতে পারবে। খুব গোপনে একটা এক্সপেরিমেন্ট চলছে।

ব্যাপারটা বুঝতে পারল না বৌধায়ন। আর একটু খোলসা করে বলতে বলল। কিন্তু ঠিক এ সময়ে সিড়িতে খুব দ্রুত লঘু পায়ের শব্দ হল। পরমুহূর্তেই ঝড়াক করে একরাশ সুগন্ধ, সৌন্দর্য আর চঞ্চলতা নিয়ে ঘরে এল মন্দা।

বৌধায়ন! হোয়াট এ সারপ্রাইজ! ওঃ ওঃ বৌধায়ন, তোমার কাছে আমার একটা ক্ষমা চাওয়া বাকি আছে। আই অ্যাম সরি, ভেরি ভেরি সরি ফর দ্যাট ইনসিডেন্ট।

বৌধায়ন গম্ভীর গলায় বলে, মন্দা, তুমি এই ভদ্রলোককে কাল থেকে অফিসে আটকে রেখেছ। আগে ওঁর কাছে অ্যাপোেলোজাইজ করো।

সে কী!— বলে মন্দা নাগরদোলার মতো পাক খেয়ে সমীরণের মুখখামুখি হয়ে বলে, আপনি কাল বাড়ি যাননি?

না। আপনি থাকতে বলেছিলেন।

কিন্তু তা বলে বাড়ি যাবেন না কেন? থাকতে বলেছিলাম, কিন্তু সে তো সারা রাত নয়। এ মা। কী বোকামি বলুন তো! ছিঃ ছিঃ আমারই দোষ।

সমীরণ মনে মনে মাকে ভালবাসে। হ্যাঁ, বাসে। কোনও ভুল নেই। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, মন্দা কি ঘটনাটা মনে রেখে রায়বাবুকে জানাবে? রায়বাবু কি বুঝতে পারবে যে সমীরণ কী ভীষণ সিনসিয়ার। কত সৎ! কাজের লোক! আর এই রকমভাবে বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে পারলে সে কি রায় আচার্যির পার্টনার হতে পারবে না? যদি হতে পারে তাহলে মন্দা…? একদিন মন্দাকে কি সে …? মানে মন্দা তাকে কি…?

সমীরণ খুব বিনয়ের সঙ্গে বলে, আমার কোনও অসুবিধে হয়নি।

তা বলে বাড়ি যাবেন না কেন বলুন তো? চাকরির জন্য কে সারা রাত খামোকা থাকে বলুন? যাঃ আমার ভীষণ লজ্জা করছে। আই অ্যাম সো সরি!… জানো বৌধায়ন, ব্যাপারটা কী, আমি আজকাল ভীষণ, কী বলব আনক্যানি ফিল করি। একা হলেই মনে হয়, কী একটা বিপদ ঘটবে। মনে হয় কে যেন পিছু নিয়েছে… সেই যে তোমাকে ফোন করেছিলাম… (খিল খিল করে হাসি) ইস, বোলো না বোলো না সে যা একখানা কাণ্ড না! একদম বুন্ধুর মতো। .. এসো এ ঘরে বসবে এসো। অনেক কথা আছে…

বলতে বলতে মন্দা গিয়ে দরজায় চাবি ঢোকায়। মুখ ঘুরিয়ে সমীরণকে বলে, আমি কিন্তু ধরে নিয়েছিলাম, আপনি ঠিক চলে যাবেন। কেন গেলেন না বলুন তো? এখন যে কী ভীষণ লজ্জা করছে আমার। তার ওপর কাল রজত আপনাকে বিশ্রীভাবে উনডেড করেছে। এ টি এস নিয়েছিলেন তো?

সমীরণ ব্যগ্রভাবে বলে, না, না, ও কিছু নয়। আমার ওসব অভ্যাস আছে। কাল যে টাকা দিয়েছিলেন তার থেকে চার টাকা বাইশ পয়সা ফিরেছে।

রাখুন তো৷ ফেরত আর কী!…জানো বৌধায়ন, কাল রাতের ব্যাপারটার জন্য তুমি আমাকে দোষ দেবে জানি, ইউ আর সো মাচ মরালিস্ট, কিন্তু জানো তো রজত সঙ্গে থাকলে ইউ ডোন্ট ফিল দা টাইম। ও এত টগবগে করে রাখে যে ক’টা বাজল তা খেয়ালই থাকে না। আমি যে লাস্ট ক’টার সময় সমীরণবাবুকে টেলিফোন করেছিলাম তা-ই মনে নেই। দুপুর থেকে হুল্লোড়। সুব্রত এল, বিজিত এল, লোপা এল, তারপর কেবল হুল্লোড়। একটা রেস্টুরেন্ট থেকে আমাদের খুব ভদ্রভাবে বেরিয়ে যেতেও বলেছিল, জানো? কিন্তু একটু বোর করেনি। কী যে দারুণ ডাইনামিক না রজত। আর কী ড্রিংক করতে পারে জানো? কারও অত মুরোদ নেই। দুপুর থেকে একটানা খেয়ে গেল উইদাউট ব্যাটিং অ্যান আই লিড। রাত বারোটার সময়েও পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়েছিল। এক রাতে কত খরচ করল জানো? আমরা পাঁচজন ছিলাম, পাঁচজনের জন্যে রজত বিল মেটাল দেড় হাজার টাকার কিছু বেশি।

বৌধায়ন একটু হেসে বলে, দম নাও মন্দা। দম নিতে একদম ভুলে যাচ্ছ।

যাঃ ফাজিল! খুব বেশি বকছি নাকি? কিন্তু ভেবো না এটা কালকের এফেক্ট। কাল বেশি খাইনি। আমি আর লোপা প্রথম একটু একটু জিন আর লাইম খাচ্ছিলাম, পরে রজত জোর করে একটু হুইস্কি খাইয়েছে। বেশি নয়। বেশি খেলে আমার তো মাথা ধরে।

বৌধায়ন মন্দার পিছু পিছু ভিতরের চেম্বারে ঢোকে। মন্দা এয়ারকন্ডিশনার চালু করে। কলিং বেল টিপে বলে, চা খাবে তো?

বৌধায়ন মন্দার দিকে চেয়ে ছিল। আজকাল মেয়েদের দিকে তাকালেই তার দৃষ্টি এক্সরের মতো হয়ে যায়। স্তন, পেট, নিতম্ব সব অনুভব করে সে। আব আর এইটে সে একদম সইতে পারে না। ক্যাতক্যাতে কিছু মাংস আর মাংস। কিছু স্বেদ, শ্লেষ্ম, খাসবায়ু। অথচ মেয়েরা নিজেদের মাংস ভাবতে কত পছন্দ করে আজকাল। মন্দার দিকে চেয়ে সেই ব্যাপারটাই টের পায় বৌধায়ন। সে জানে, সুন্দর এই মন্দাকে কাল মাথামোটা রজতটা ঘেঁটেছে। ইচ্ছে মতো ঘেঁটেছে মাংসের ভূপ। আজকাল পুরুষেরা মেয়েদের মদের মতো খায়, মাংসের মতো চিবোয়, পোশাকের মতো পরে। মেয়েরাও উপভোগ্য খাদ্য পানীয় পরিধেয়র মতো সাজিয়ে দেয় নিজেদের।

বড় একটা শ্বাস ফেলে বৌধায়ন বলে, ওই ভদ্রলোককে আজ বরং ছেড়ে দাও। ছুটি দিয়ে দাও।

 জিভ কেটে মন্দা বলে, ঠিক। ইস, কী বিশ্রী কাণ্ড বলো তো! আসলে লোকটা ভীষণ রিলায়েবল। খুব সাহসীও। ওয়াচ ডগের মতো।

দরজা খুলে সুখন উকি দেয়। মন্দা বলে, চা—

তারপর বৌধায়নের দিকে চেয়ে বলে, ঠিক বলেছ। ওকে বরং ছেড়ে দিয়ে আসি। এক মিনিট।

.

০৯.

মন্দা দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই সমীরণ দাঁড়াতে চেষ্টা করে।

মন্দা দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে তার সামনে ধীর পায়ে এসে দাঁড়ায়। কিছু বলে না প্রথমে। খুব অবাক ও সুন্দর চোখে তার দিকে চেয়ে থাকে। মুখে টেপা একটু হাসি।

সমীরণ গোপনে একবার চোখ কচলে নেয়। ভুল দেখছে না তো?

 অস্ফুট আবেগের স্বরে মন্দা বলে, ইউ আর সো কারেজিয়াস!

সমীরণ ভীষণ আনন্দে লাল হতে থাকে।

মন্দা তেমনি মুগ্ধ চোখে চেয়েই ধীর স্বরে বলে, আপনার মতো একজন লোক যদি সব সময়ে আমার সঙ্গে থাকে তো আমার আর কোনও ভয় থাকে না। আই নিড ইউ, আই নিড ইউ ভেরি মাচ।

বড় আফসোস হয় সমীরণের, এসব কথা রায়বাবু শুনছেন না। শুনলে ভাল হত।

মন্দা এগিয়ে এসে দুটো অসম্ভব নরম হাতে তার দু’হাত তুলে নিয়ে বলে, প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করুন। ভীষণ অন্যায় করেছি। ইচ্ছে করলে শাস্তিও দিতে পারেন। যা খুশি।

ভীষণ ব্যাকুল হয়ে ফাটা ঠোঁটে রক্ত ঝরিয়ে সমীরণ বলে ওঠে, না, না।

প্লিজ! রাগ করবেন না। আমি কাল থেকে আপনার ফ্যান হয়ে গেছি। দ্যাট ওয়াজ এ গ্রেট পারফরম্যানস। তাছাড়া আমার কথা ভেবে সারা রাত আপনি অফিসে কাটিয়েছেন! কী অদ্ভুত মানুষ আপনি বলুন তো?

সমীরণ শুধু বলতে পারল, না, না।

মন্দার চোখে কি একটু জলের চিকমিকি? কে জানে? কিন্তু ওর গা থেকে সেই অসম্ভব সুন্দর গন্ধটা কেঁপে এসে দম বন্ধ করে দিচ্ছে সমীরণের। আনন্দে আবেগে সে বধির হয়ে যাচ্ছে, অন্ধ হয়ে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে।

সমীরণের মুখে নিজের সুগন্ধী, পরিষ্কার শ্বাস ফেলে গভীর স্বরে মন্দা বলে, আজ আপনি বাড়ি চলে যান।

এটার জবাবেও সমীরণ অভ্যাসবশে না, না করে উঠতে মন্দা হঠাৎ তার হাত দু’খানা ছুঁয়ে বলল, প্লিজ!

একটা আনন্দের গ্যাস-বেলুনের সুতো ধরে ঝুলতে ঝুলতে সমীরণ অফিস থেকে বেরোল। তার পা মাটি ছুঁল না, সিড়ি ভাঙল না।

.

বাইরে বিরাট পোস্টারে লেখা, আজ অনশনের এগারো দিন।

আজ ফজলুদের ত্রিপলের বাইরে খুব ভিড়। কাল বিকেলে শ্রমমন্ত্রী এসেছিলেন। তিনি ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। আজ মুখ্যমন্ত্রী আসবেন। কাগজে কাগজে আজ ফজলুদের ছবি ছাপা হয়েছে। বড় করে খবর বেরিয়েছে। লিখেছে, শ্রমমন্ত্রীর অনুরোধে অধিকাংশ অনশনব্রতী তাঁদের অনশন ভঙ্গ করলেও ফজল আলী, রাজু মিস্ত্রি এবং খগেন রায় রুবি আয়রন ফাউন্ড্রির ক্লোজার, ছাটাই ও হস্তান্তরের বিরুদ্ধে অন্তিম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

খবরের কাগজে কাল রাতের খবর ছেপেছে। আজ সকালে আরও এগিয়ে গেছে ঘটনা। সকালবেলায় মারা গেছে খগেন রায়। রাজু মিস্ত্রির পেটের আলসার ফেটে নাকমুখ দিয়ে রক্ত ছুটছিল বলে তাকে আজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। বাকি আছে কেবল ফজল আলী। অর্থাৎ ফজলু।

বাইরে বিশাল জমায়েত থেকে ধ্বনি উঠছিল, সংগ্রামী ফজল আলী জিন্দাবাদ। বিপ্লবী রাজু মিস্ত্রি জিন্দাবাদ। শহীদ খগেন রায় যুগ যুগ জিও।

চোখে জল এসে গেল সমীরণের। আবেগে কেঁাত দিয়ে একটা কান্না গলায় উঠে আসে। ফজলুর কত নাম হয়েছে।

ঢুকবার মুখে একজন তোক পথ আটকে বলে, ভিতরে যাওয়া বারণ আছে দাদা।

সমীরণ জলভরা চোখে চেয়ে অস্ফুট স্বরে বলে, ও আমার গায়ের ছেলে। কত নামডাক হয়েছে ফজলুর। একটু দেখে যাব।

অনিচ্ছার সঙ্গে লোকটা সরে পথ দেয়।

ভিতরে ফজলুকে প্রথমটায় দেখতেই পাওয়া গেল না। রাশি রাশি মালার তূপ আর ফুলের তোড়ার মধ্যে কোথায় হারিয়ে আছে ফজলু! ছোট্ট ঘেরা জায়গাটায় তীব্র ফুলের সুবাস ঘনিয়ে উঠেছে। কী মাতলা গন্ধ!

সমীরণ ডাকল না, কিন্তু ডাকটা উঠে এল তার আত্মার গম্ভীর থেকে, ফজলু! ফজলু রে! শুনছিস?

প্রথমে কেউ সাড়া দিল না। তারপর আস্তে একটা ফুলের তোড়া পড়ল। খসে গেল একটা দুটো মালা। আর সেই সাদা তাজা রজনীগন্ধার ভিতর থেকে ফজলুর মড়ার মতো বাসি মুখ বেরিয়ে আসে অল্প একটু। ভুতুড়ে নাকি স্বরে, ক্ষীণ গলায় সে বলে, কে? মলয়বাবু?

না রে। আমি সমীদা।

বোসো।

সমীরণ বসে রুমালে মুখের ঘাম আর চোখের জল মোছে। রবারের বলের মতো কান্নাটা আটকে ছিল গলায়, সেটাকে গিলে ফেলল সে। স্পষ্টতই সেটা তার পেটে চলে গেল।

ফজলুর মাথার রুখু চুলে হাত বুলিয়ে সমীরণ বলল, পারবি না ফজলু। আজ একজন মারা গেছে।

ফজলু হাসল। ওর মুখের চামড়া শুকিয়ে খুলির সঙ্গে এমনভাবে লেপটে গেছে যে কঙ্কালের মুখ ফুটে উঠছে স্পষ্ট। ফজলু বলল, কায়দাটা না জানলে তো মরবেই। ইচ্ছে চাই বুঝলে। খুব জোরালো ইচ্ছে চাই।

কীরকম?

আলোতে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ভাবতে হয়, এই যে আমার হাত আলো থেকে প্রোটিন নিচ্ছে। আমার চামড়া বাতাস থেকে ক্যালসিয়াম নিচ্ছে। মাটিতে পা রেখে ইচ্ছে করতে হয়, আমার পা দুটো মাটি থেকে রস শুষে নিক। ওরকম মনে করলে, খুব জোর করে ইচ্ছযুক্ত হলে তবে হয়। আমার হচ্ছে।

পারবি ফজলু?

পারব কী গো! পারছি। প্রায় পেরেই গেছি। প্রথমটায় একটু আস্তে আস্তে হয়। অনভ্যাস তো। কদিন পর দেখবে, না খেয়েই ক্রমে ক্রমে শরীরে জুত পাচ্ছি। তখন উঠব, হাঁটব গান গাইব। কিছু শক্ত নয়। ভেবো না।

বিড়ি খাবি ফজলু?

 আছে? দাও তবে।

 বিড়ি কিনেই এনেছিল সমীরণ। ফজলুর ঠোঁটে লাগিয়ে ধরিয়ে দিল যত্নে।

 ফজলু বিড়িটা টানতে পারছিল না। চোয়ালের জোর নেই, ঠোঁট ঝুলে পড়েছে। তবু দু’-তিনটে টান দিয়ে বলল, কত ভিটামিন চারদিকে! শ্বাস দিয়ে ঢুকে পড়ছে ভিতরে। আর ক’দিন পরেই ইস্কুল খুলব, শেখাব। একটা বই লিখব, কী করিয়া না খাইয়া বাঁচিয়া থাকিতে হয়। ঘরে ঘরে গীতা, বাইবেল, কোরানের মতো লোকে সে বই পড়বে। দেখো।

পারবি ফজলু?

 পারব। পেরেই গেছি প্রায়। প্রথমটায় যা একটু কষ্ট। বড় একঘেয়ে লাগে। আমি একটু চোখ বঁজে থাকি সমীদা?

থাক। বলে সমীরণ ওঠে।

আবার রজনীগন্ধায় ঢেকে যায় ফজলু। বাইরে ভিড় বাড়ছে। বিশাল দুটো মিছিল এসে জড়ো হল এইমাত্র। রাস্তা জ্যাম। গাড়িঘোড়া বন্ধ।

.

সমীরণের যা অবস্থা তাতে রোজ আধ লিটার করে দুধ খাওয়া তার পোষায় না। তবে কিনা তার চাকরিটা স্বাস্থ্যের জন্যই। সে হল গিয়ে বডিগার্ড, এ ডি কং, সিকিউরিটি অফিসার। তাই পাঁচ কথা ভেবে সে ‘জয় কালী’ বলে আধ লিটার দুধের কার্ড করেছিল। সেই মহার্ঘ দুধের এক বোতল কাল নষ্ট হয়েছে, ছানাটা মেরে দিয়েছে লোভী বুড়োটা আর তাদের ছেলেটা। তার ওপর আজকের দুধটা আনাই হল না, মালিকের মেয়ের খেয়ালে আটকা রইল অফিসে। পয়সাটা পয়মাল। মনটা তাই খচ খচ করে সমীরণের। আবার মন্দার কথা ভাবতে ভাবতে বুকটা বেলুন হয়ে যায়। তখন আর দুধের কথা মনে থাকে না। তখন আনন্দটাই যেন দুধ হয়ে গলা দিয়ে পেটের মধ্যে বগবগ করে চলে যেতে থাকে।

এই ভ্যাপসা গরমেও বুড়োটা উঠোনে বসে রোদ পোয়াচ্ছে আর পায়ের কড়ার চামড়া খুঁটছে। এক মনে।

সমীরণ ধমকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার ছেলে মুড়ির পয়সাটা ফেরত দিল না যে বড়?

বুড়ো সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে বলে, দেয়নি? মহাচোর হয়েছে মশাই। নষ্ট দুধের ছানাগুলো কাল সব মেরে দিল।

সে তোমারও আশকারা আছে। ওকে বোললা, পয়সা না দিলে ছাড়ব না কিন্তু। আর কেরোসিনের ফেরত পয়সাটা?

সবিস্ময়ে বুড়ো বলে, দিইনি? বড় ভুলে যাই দাদাবাবু। কিছু মনে রাখতে পারি না। আমার বউ এসেছিল কিনা! ছেলের বিয়ে গেল।

সমীরণ গনগন করতে করতে গিয়ে ঘরের তালা খোলে। কিন্তু আজ তার মনে তেমন রাগ ওঠে না। মনটা দুধে ধোয়া। বুকটা বেলুনের মতো ফুলছে। আজ সবাইকেই তার বড় মায়া হচ্ছে। দয়া করতে ইচ্ছে করছে।

.

কোনও ভাল কাজ করেছে বলে তো হরিদেবের মনে পড়ে না।

তবু কী কারণে কে জানে, সমীবাবু দুপুরবেলায় ডেকে খানিকটা পাতকুড়োনো ভাত দিল কলাইয়ের থালায়। বলল, খেয়ে বাসনগুলো মেজে দিয়ো।

আজ্ঞে। ভারী খুশি হয় হরিদেব। খিদেটা লেগেছিল বটে। কিন্তু এমন ভুল যে সেটার কথাও খেয়াল রাখতে পারে না। আজ সকালেই কি, না কি কাল বেহানে নন্দীবাড়ির রেশন তুলে দিয়ে পাঁচখানা গরম রুটি আর পটলপোস্ত খেয়েছিল?

খুব খিদে লাগলে যখন অসহ্য হয়ে পড়ে তখন সে গিয়ে হরিপদর সংসারে হামলা করে। ছেলের বউ কেমন তা দেখেওনি ভাল করে, তবে কিনা বউটা দেয়। ঝাটালাথি মারে না। কিন্তু কাল হরিদেবের বউ নিজে এসে সে বাড়িতে যাওয়া বারণ করে দিয়ে গেছে। বড় কষ্ট যাবে কদিন। সমীবাবুর পাত কুড়োনো ভাত ক’টা পেয়ে আজ বড় ভাল হল।

ছায়ায় গেলে শীত করে। এবার জাড়টা কি তাড়াতাড়ি পড়ল? এটা কোন মাস তা মনে পড়ে না। রোদে বসে কোলের কাছে থালা নিয়ে খুব যত্ন করে ভাত ক’টা মাখতে থাকে হরিদেব। মাখতেই থাকে। অনেকক্ষণ ধরে। মুঠোভর ভাত খেলেই ফুরিয়ে যাবে। চারটে কাক চারদিকে তিনধা নাচন নাচছে। কক’ কা” শব্দ করে কাছে নেচে নেচে আসে, ভয় খেয়ে আবার চার পা পিছিয়ে যায়। গা-শোকা বেড়াল আছে একটা, গন্ধে গন্ধে সেটা এসে উরুতে ঘষটায়।

উঠোনে বসে হরিদেব প্রথম গরাসটা মুখে দিতে না দিতেই কোখেকে নিত্যপদ ‘বাবা’ বলে ডাক দেয়। পরমুহূর্তেই অবাক গলায় বলে, খাচ্ছ?

আয়।

নিত্যপদ এসে বসে মুখোমুখি। হাতটা প্যান্টের গায়ে মুছে নিয়ে একটা গরাস রসগোল্লার মতো পাকিয়ে মুখে ফেলে বলে, আজ রান্না হয়নি।

কেন?

দাদার বউটা কেটে পড়ল যে!

কখন?

সকালবেলায়। দাদা শেষরাতে খুব ঠেঙিয়েছিল। দাদা বলেছে, আবার বিয়ে করবে।

এটা কোন পক্ষ ছিল রে? চারটে হল না?

না। এ মাগি ছিল তিন নম্বর।

হরিদেব হেসে বলে, খুব চোর হয়েছিস। সমীবাবুর মুড়ির ফেরত পয়সা দিসনি! দেবেখন সমীবাবু ধরতে পারলে।

তুমি যে কেরোসিনের পয়সা দাওনি। তার বেলা?

আমারটা নেবে না। তোকে পেলে বলেছে হাড় ভাঙবে।

ইঃ, এমন দৌড় মারব।

হরিপদ নিত্যপদর দৌড়ের কথা শুনে খুব হাসে। তার হাতের ফঁাকে আঙুল ঢুকিয়ে নিত্যপদ গরাস চুরি করছে। টের পেয়েও কিছু বলে না সে। খাক। কারটা কে যে খায়!

এঁটো হাত চেটে হরিদেব বলে, ও বাড়ি থেকে একটা কঁাথা এনে দিবি? এবারে বড় শীত পড়ে গেল।

শীত! যা ভ্যাপসা গরম পড়েছে। শীত কোথায়?

তবে আমার শীত করছে কেন?

তুমি তো এবার মরবে। মরার সময় লোকের গা ঠান্ডা হয়ে আসে কিনা।

হরিদেব খুব হাসে। চোখে জল এসে যায় হাসতে হাসতে। বলে, তোকে বলেছে!

মা বলেছে, তোর বাপের যা হাবভাব দেখছি, আর বেশিদিন নয়। এবার টেঁসে যাবে।

 বউয়ের কথায় ভারী ভক্তির সঙ্গে বড় বড় চোখ করে হরিদেব বলে, বলেছে তোর মা?

হুঁ।

তৰে তাই হবে। কথাটা এনে দিবি?

 দাদার বউটা বিছানাপত্র নিয়ে যায়নি কিছু। একটা তুলোর কম্বল আছে দেখেছি বিছানায়। চুরি করে এনে দেবোখন।

চুরির কথায় ভারী আমোদ হয় হরিদেবের। খুব হাসে। তার আঙুলের ফঁক-ফোকর দিয়ে কচি কচি আঙুল ঢুকিয়ে নিত্যপদ গরাসের ভাত চুরি করে নিচ্ছে! সব নিয়ে নিল। তারপর হরিদেবের হাতটাকে পাত থেকে তুলে যত্ন করে মাটিতে রেখে থালাটা চেঁছে চেটেপুটে খেতে লাগল। ভারী আনন্দের চোখে চেয়ে থাকে হরিদেব। তার বউ বলেছে যে, সে এবার মরবে। বড় বাড়িতে কাজ করে তার বউ, মাস গেলে ষাট-সত্তর টাকা পায়, ঘোয়া শাড়ি ব্লাউজ পরে, বাবুদের বাড়ির মেয়ের মতো থাকে। তার কথার দামই আলাদা। সে তো আর মিথ্যে বলবে না। বউয়ের কথা ভেবে ভারী অহংকার হয় তার।

হরিদেব ভারী হাসতে হাসতে বলে, আমি ম’লে ছেরাদ্দ করবি?

নিত্যপদ মুখ ঊর্ধ্বপানে তুলে হাতের তেলো চাটতে চাটতে বলে, হ্যাঁ-আঁ। নানকুদার বাপ মরলে নানকুদা কালীঘাটে গিয়ে যেমন মন্ত্র পড়ল, মাথা কামাল, ঠিক সেরকম হবে বাবা?

 সত্যি করবি?–ভারী অবাক হয়ে বলে হরিদেব।

দাদা ঠিক করবে, দেখো। করতে না চাইলে মা বকে বকে করাবে। দেখো।

হরিদেব ভারী অবাক হয়। তার জন্য হরিপদ আর নিত্যপদ কালীঘাট যাবে, মন্ত্র পড়বে, মাথা কামাবে, অ্যাঁ? তার জন্য এতটা করবে লোকে? এত কিছু করবে? ঠিক যেন বিশ্বাস হতে চায় না। তবে ভাবলে ভারী অহংকার হয়।

.

১০.

শাবানা আজমির পায়ের তলায় বসে আছে খলিলের মা।

এত সুন্দর শাবানা আজমির নাচের ভঙ্গিটি যে পোস্টারের ছবিতেও যেন নূপুরের রুনুঝুনু শোনা যায়। ল্যাম্পপোস্টের গায়ে পোস্টার লাগানোর চৌকো বাক্সটা ঢিলে হয়ে নীচে নেমে পড়েছে। এখন শাবানা আজমি হাতের নাগালে। এত কাছে যে তার গায়ের সুগন্ধ পাওয়া যায় বুঝি।

পুরনো কাগজওয়ালাটা সৌন্দর্যের ভিখারি নয়। সে তাই মন দিয়ে লম্বা নোংরা নখ দিয়ে পোস্টারটা খুঁটে খুঁটে তুলে নিতে থাকে।

খলিলের মা প্রাণপণে ডাকছে, ও বাবারা! ও বাবারা আমার! কিছু দিয়ে যাও!

একসময়ে তার নাম ছিল জোহরা। সে নাম ভাল করে মনেও পড়ে না। খলিলও মরে গেছে। কবে! ধোঁয়ার মতো মনে পড়ে। তবে তার জোহরা নামটা আর নেই। এখন শুধু খলিলের মা। সঙ্গী সাথীরা তাই ডাকে।

খলিলের মা কাগজওয়ালার দিকে বিরক্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলে, গায়ে পা লাগছে, দেখছ না নাকি? সরে দাঁড়াও।

কাগজওয়ালাটার আঙুলে উঠে আসছে শাবানা আজমি। অমন সুন্দর নাচের বিভঙ্গ কোমর থেকে বুক পর্যন্ত ফেড়ে গেল। শুধু শাবানার করুণ মুখশ্রী চেয়ে দেখে খলিলের মাকে।

আর একজনও দেখছিল খুনখুনে বুড়িটাকে। আহা রে! মরার আগে কয়েকটা দিন মাত্র বেঁচে আছে বুড়িটা। জীবনে কখনও কি পেট ভরে খেয়েছে? ভালবাসা পেয়েছে? কোনও সুখাদ্যের স্বাদ কি ওর মনে পড়ে?

খলিলের মা বিলাপ থামিয়ে নতুন লোকটার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে বলে, কী বাবা? কোথায় নে যাবে বাবা আমাকে?

লোকটা দু’ হাত বাড়িয়ে বলে, চলো বুড়ি মা, অনেক খাওয়াব তোমাকে। যাবে?

নে যাবে? ও বাবা, বলে কী! নে যাবে! তা ক্ষেতি নেই। ক্ষেতি কী? তাকে দিয়ে আর কোনও কাজ হবে? বয়সকালের মেয়েমানুষ নয় ইজ্জত কেড়ে নেবে, পয়সা কড়ি নেই যে কাড়বে। তবে ক্ষেতি কী?

কোথা যাব বাবা?

 আমার বাড়ি।

একগাল হাসে খলিলের মা। বলে কী? পিরের থানে শিন্নি গো! ই কী? এ বাবার যে মটোর আছে গো! ই বাবা! সব সত্যি তো? খোয়াব নয় তো! নেবে আমাকে সত্যি?

তা নেয়।

শাবানা আজমির সুন্দর করুণাঘন মুখশ্রী লোপাট হয়ে যায় নোংরা নখের খাবলায়। জায়গাটা শ্রীহীন হয়ে গেল অনেকটা। আবার নোংরা খুনখুনে বুড়িটা চলে যাওয়ায় জায়গাটার কুশ্রীতাও ঘুচে গেল কিছু! একটা সাম্য এল, সমতা দেখা দিল আবহাওয়ায়।

খলিলের মা’র গায়ের ট্যানাটা হাজারও বার জলে ভিজে গায়ে গায়ে শুকিয়েছে। পরতে পরতে গায়ের ঘাম আর ময়লা সেঁধিয়ে হাকুচ হয়ে বসে গেছে। চিমসে গন্ধে টেকা দায়। হাতের পায়ের গাঁটে গাঁটে ময়লা জমে আছে ঘায়ের মামড়ির মতো। হাতের তেলোয় থিকথিকে নোংরা বসে চামড়ার মতো হয়ে গেছে।

একবার ওয়াক তুলল বৌধায়ন। তাড়াতাড়ি স্টার্ট দিল গাড়িতে। সে বড় একটা সিগারেট খায় না। এখন মনে হল, একটা সিগারেট ধরালে ভাল হত। বুড়িটা গাড়ির মেঝেতে বসেছে উবু হয়ে। সাহস করে তাকে আর সিটে বসতে বলল না সে। বুড়ি ভয়ে আর ভরসায় গদগদ হয়ে বলছে, ও বাবা! কোথায় নেচ্ছ মোরে? মারধর করবে না তো? হেই বাবা! দুটো খেতে দেবে তো?

ফুৎ করে কাপড়ে নাক ঝাড়ে বুড়ি। তারপর থুথু ফেলে।

বৌধায়ন সঁতে দাঁত চেপে গাড়ি চালাতে থাকে। তাকে এই ঘেন্না জয় করতেই হবে। তাকে হতেই হবে মানুষের মুক্তিদাতা।

তাদের গ্যারেজঘর আর জলের পাম্পঘরের মাঝখানে বেশ খানিকটা জায়গা। বুড়িটাকে সেইখানে এনে তুলল বৌধায়ন। তারপর সিঁড়ি ভেঙে ওপরে গিয়ে খুব গম্ভীর মুখে রান্নার লোককে বলল, ঠাকুর একথালা ভাত বাড়ো তো। বাইরের লোক আছে।

কয়েক মুহূর্ত সারা বাড়িতে খবর রটে গেল। আর বেঁধে গেল বিরাট হইচই। মা, বাবা, দাদা, বোন সবাই চেঁচামেচি করতে থাকে।

এটা কি লঙ্গরখানা নাকি?…দুটো ভাত দিবি তো দে, তা বলে রাখবি নাকি ওকে? কোথাকার পাগল রে?…বুধোর মাথাটা একদম গেছে মা, ওকে শিগগির বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দাও।…সেজদার যা কাণ্ড, আজ আমি দুপুরে খেতেই পারব না।

জয়তী কিছুই বলছিল না, শুধু মস্ত চোখে চেয়ে দেখছিল আর মৃদু মৃদু হাসছিল।

গা জ্বলে গেল বৌধায়নের। কিন্তু সে তো জানতই যে এসব কাজে বাধা আসে, প্রতিরোধ আসে। ভেঙে পড়লে চলে না। সে প্রাণপণে শান্ত রইল। মাকে বলল, তা হলে আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা। আমি চলে যাই…

এ কথার ওপর কথা চলে না। বাড়ির গনগনে মেজাজ মিইয়ে গেল।

বুড়িটা রয়ে গেল।

 পরদিন সকালবেলাতেই নরেনের চেঁচানি শোনা গেল, হেগেছে! হেগেছে! ওই দেখো আবার পোঁটলায় লুকোচ্ছে।

সবাই গিয়ে দেখে বুড়ি তার মল একটা পুরনো খবরের কাগজে জড়িয়ে আঁচল চাপা দিয়ে বসে আছে। জায়গাটায় একটা তরল কিছু মুছে নেওয়ার চিহ্ন আর দুর্গন্ধ।

মা বৌধায়নের কাছে এসে বলে, এবার কী করবি?

 খুব স্নান শুকনো মুখে বৌধায়ন বলে, আমি? আচ্ছা, না হয় আমিই পরিষ্কার করব। ওর দোষ কী? ওকে তো কেউ পায়খানাটা দেখিয়ে দেয়নি।

খুবই সাহসের কথা। বীরোচিত। কিন্তু বলেই সে পেটের ভিতর গোঁতলানো টের পায়।

মা ঠোঁট উলটে বলে, দেখিয়ে দিলেই কী? ওরা যেখানে খায় সেখানেই হাগে বাবা। স্বভাব যাবে কোথায়?

নরেন মেথর খুঁজতে বেরোল। বৌধায়ন বসে ভাবতে লাগল।

পরদিনই আবার গণ্ডগোল। ধীরেনকাকুর বাড়ির সব বেড়াতে এসেছিল সন্ধেবেলায়। তারা যখন চলে যাচ্ছে তখন নীচের প্যাসেজে বুড়ি তাদের পথ আটকে ভিক্ষে চেয়েছে, ও বাবা! বাবাগো! কিছু দেবে বুড়ো নাচারকে?

মা বলল, কী কাণ্ড!

 বাবা চেঁচাতে থাকেন, বের করে দাও! বের করে দাও।

পরদিন দুপুরেই খলিলের মা নির্জন বাড়িটা একটু ঘুরে-টুরে দেখবে বলে ওপরতলায় চলে এল। এ ঘর সে ঘর বেড়িয়ে দেখল। খাওয়ার ঘরে গিয়ে ফ্রিজের দরজা খুলে ফের বন্ধ করে দিল ভয়ে। বারান্দায় অযত্নে ফেলে রাখা একজোড়া রবারের চটি দেখে বড় পছন্দ হয়ে গেল তার। এরা কত বড় মানুষ, চটিজোড়া বোধহয় ফেলে দিয়েছে ভেবে পায়ে গলিয়ে ফটাফট হেঁটে নেমে গেল নীচের তলায়।

চটি নিয়ে হইচই ঝিমিয়ে পড়ার আগেই খলিলের মা এক সন্ধেবেলা বাড়ির কেউ খাওয়ার আগেই রান্নাঘরে হানা দিয়ে ঠাকুরকে বলল, গরম গরম রুটি সেঁকার কী বাস বেরিয়েছে গো বাবা। দাও দু’খানা খাই।

মা ধেয়ে এল রাতে বৌধায়নের ঘরে, তুই ভেবেছিসটা কী?

 বৌধায়ন সব শোনে। গম্ভীর মুখে বলে, এতে অস্বাভাবিক কী আছে? এরকমই হওয়ার কথা।

এক দুপুরে খলিলের মা চুল শুকোতে দোতলার ব্যালকনিতে গেছে। জয়তী হাসিমুখে বেরিয়ে এসে বলল, কী গো? তোমার কি একটা কাপড় চাই?

একগাল হেসে খলিলের মা বলে, দেবে?

 জয়তী একটু পুরনো শাড়ি এনে দিয়ে বলে, একটু পাউডার-টাউডার মাখবে নাকি?

 বস্তুটা কী তা ভাল বুঝতে না পেরে খলিলেব মা বলে, একটু তেল থাকে তো দাও।

জয়তী দিল। এমনকী বাথরুমে নিয়ে গিয়ে সাবান দিয়ে হাত মুখ ধুতেও শেখাল। একটু ঘেন্না হল বটে তবু নিজের হাতে বুড়িকে আচ্ছা করে পাউডার মাখাল, কাজল টেনে দিল চোখে, টিপ পরাল। বুড়ি হেসে কুটিপাটি। বুড়িকে বশটশ করে বলল, তা যে-বাবু তোমাকে আদর করে নিয়ে এল তার একটু সেবা করো না কেন? যাও না। কোণের ঘরে শুয়ে আছে, গিয়ে একটু পা টিপে দিয়ে এসো। ডান পায়ের গোড়ালিতে বাতের ব্যথা, টিপলে আরাম পায়।

বুড়ি খুব রাজি! নতুন শাড়ি পেয়েছে, তেল পেয়েছে, সাবান মেখেছে, সেজেছে। হেসে বলে, সে হীরের টুকরো ছেলে। তুমি কি তার মা নাকি?

জয়তী মিষ্টি করে হাসল শুধু। মাগ মানে সে জানে। কিন্তু ভাঙল না।

.

বৌধায়ন অঘোর ঘুমে। সারা গায়ে টোপা টোপা ঘাম। ডান পা সম্পর্কে সে ঘুমের মধ্যেও সচেতন থাকে। পা খানা বিশাল একটা পাশবালিশের ওপর সাবধানে রাখা।

হঠাৎ সেই অতি অনুভূতিশীল ডান পায়ের গোড়ালির গোছের ওপর আচমকা প্রবল আক্রমণে সে আঁতকে ককিয়ে জেগে উঠল।

আর জেগে উঠে সে নির্জন দুপুরে চোখের সামনে জলজ্যান্ত ভূত দেখে প্রাণভয়ে চেঁচিয়ে উঠল, কে? কে? কে?

বুড়ি বড় আদর দেখিয়ে হেসে উঠে পা দাবাতে দাবাতেই বলল, এখন একটু আরাম হচ্ছে বাবা?

প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি বৌধায়নের যে এ লোকটা সেই নাচার বুড়ি। কিন্তু পায়ের প্রচণ্ড ব্যথায় ‘ওফ’ বলে চেঁচিয়ে বালিশ আঁকড়ে ধরেই সে টের পেল, এই কাজল, পাউডার মাখানো টিপ পরা বুড়িটা স্বয়ং ডাইনি।

এক ঝটকায় পা টেনে নিয়ে সে বাঘা গলায় হুংকার ছাড়ল, গেট্টাউট! গেট্টাউট! ভাগো হিয়াসে! বেরোও!

বুড়ি থতমত খেয়ে বলল, কী হল বাবা, লাগল?

 চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে বৌধায়ন, কে তোমাকে এ ঘরে ঢুকতে বলেছে?

বুড়ি ভালমানুষের মতো বলে, চুরি চামারি করতে ঢুকিনি বাবা। তোমার মাগমশাই যে বলল, তেনার পায়ে ব্যথা, টেপো গে যাও। কোনও দোষঘাট হলনি তো বাবা? তোমার মাগমশাইকে ডেকে পুছ করো না।

মাগমশাই! বৌধায়ন কথাটা ধরতে পারছিল না। রাগে ভিতরটা গনগন করছে। তবু গলা এক পর্দা নামিয়ে মুখ ভয়ংকর বিকৃত করে বলে, কে বলেছে বললে?

তোমার মাগমশাই গো। ওই যে সুন্দর মতো মেয়েছেলেটা।

মাগমশাই! বৌধায়ন মাগ মানে জানে, কিন্তু সঙ্গে মশাইটা কেন? তার ঠাকুমা মেয়েছেলে মার্কা পুরুষকে মাগিমশাই বলত, কিন্তু মাগমশাইটা কী?

গলা ফাটিয়ে বৌধায়ন ডাকতে লাগল, বউদি! এই মেজবউদি!

জয়তী দৌড়ে আসে।

কী হয়েছে বুধো?

একে কে ঘরে ঢুকিয়েছে? কোনও চালাকি কোরো না।

বুড়ি বলে ওঠে, এই তো গো! তোমার—

চোপ!-বলে ধমক মারে বৌধায়ন!

জয়তী থমথমে মুখ করে বলে, ছিঃ বুধো। গরিব নাচার বুড়িটাকে কখন থেকে অপমান করছ বললা তো? গরিব বলে কি সম্মান নেই? বেচারাদের কত কষ্টের জীবন!

বৌধায়ন স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, মাগমশাই মানে কী?

আমি কি ডিকশনারি যে সব কথার মানে জানব?

বলবে কি না! ইজ ইট হিন্দি?

না।

তবে?

মাগ মানে বউ। আর মশাইটা বোধহয় সম্মানসূচক শব্দ হিসেবে সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে।

তার মানে তুমি আমার বউ?

ও তাই ভুল করে ভেবেছে।

বৌধায়ন চোখ বন্ধ করে বলে, এটাকে এক্ষুনি বের করে দাও। ইস! পাউডার! কাজল! টিপ। অ্যান্ড শি ইজ নিয়ার অ্যাবাউট এইট্টি!

ছিঃ বুধো! ও যাবে কোথায় এখন? এনেছ যখন থাক।

বৌধায়ন লাফিয়ে উঠে রাগে চেঁচাতে থাকে, বের করে দেবে কি না? না কি নরেনকে ডাকব? আই মে ইভন কল দি পলিস।

দিচ্ছি বাবা, দিচ্ছি। তুমি শুয়ে থাকো তো! খুব লেগেছে নাকি?

ব্যথায় নীলবর্ণ হয়ে বৌধায়ন ডান পা-টা বুকে তুলে নেয়। তারপর কাতরাতে থাকে।

.

আগে রুবি আয়রন ফাউন্ড্রির কর্মীদের অনশনের খবর বেরোত ছোট্ট করে। কিন্তু আজকাল প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে খবর ছাপা হচ্ছে। চারদিকে চাপা গুঞ্জনে ফজল আলীর নাম শোনা যাচ্ছে।

.

ব্লু রুমে পার্টি দিল রজত। আর বেশিদিন সে নেই। তার জাহাজ বম্বে থেকে শিগগিরই ছাড়বে!

বৌধায়ন পার্টিতে হাজির হতে না হতেই চারপাশ থেকে সবাই চেঁচিয়ে ওঠে, হিয়ার কামস দা গ্রেটেস্ট সেভিয়ার অফ হিউম্যানিটি। হিয়ার কামস বৌধায়ন দা বুদ্ধ! হিয়ার কামস দা লিবারেটার।

বৌধায়ন মুখ বিকৃত করে। এখনও পায়ের হাড়ে-মজ্জায় সেই ব্যথা। রক্তের প্রতিটি কণিকায় রাগের আগুন। জয়তীই খবরটা রটিয়েছে। সে মন্দাকে খলিলের মা’র খবরটা দেয়। তারপর সেটা জলের মতো ছড়িয়ে গেছে। এখন বৌধায়নের ড়ুবজল।

রজত তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে, যে যাই বলুক আই ফিল প্রাউড অফ ইউ। এবার দেশে এসে দুটো ইভেন্ট আমাকে দারুণ ইমপ্রেস করল। একটা তোর ব্যাপারটা, অ্যাবাউট দ্যাট ওল্ড লেডি। যদিও শেষটায় অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স হয়ে গেছে, কিন্তু তাতে তোর দোষ নেই। আর দ্বিতীয়টা হল ফজল আলীর ফাস্টিং। দি নিউজ ইজ নাউ অল ওভার দা ওয়ার্ল্ড। আমি পরশুদিন গিয়ে মালা দিয়ে এসেছি। ফজল ইজ স্টিল হ্যাংগিং অন ইট। আই অ্যাম প্রাউড অফ হিম।

হাউ টাইগরিশ!–মন্দা বলে, দিস ইজ দা জাস্ট টাইম আই শুড রিয়েলি বি ইন লাভ উইথ সামওয়ান। অ্যান্ড হি ইজ দি গ্রেট ফজল আলী।

সুব্রত মাথা নিচু করে বসেছিল এতক্ষণ। মুখ তুলে বলল, আমেরিকা থেকে টি ভি টিম এসেছে ফজলের ছবি নিতে। পেঙ্গুইন বই বের করছে, দি হাঙ্গার আর্টিস্ট। ওই নামে কাফকার একটা গল্পও আমি পড়েছি।

এইরকম কথাবার্তা চলতে থাকে। খুব বেঁচে যায় বৌধায়ন। ফজল আলীর অনশন না ঘটলে এতক্ষণ খলিলের মা’র প্রসঙ্গ চলত।

প্রথম রাউন্ড হুইস্কিটা সকলেই গ্লাস তুলে ফজল আলীর নামে উৎসর্গ করে। কিছুক্ষণ মদ্যপানের পরই সুব্রতর চোখ ছলছল করতে থাকে, ঠোঁট কাপে এবং হঠাৎ সে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে, ওঃ ফজল আলী ইজ সো গ্রেট!

আরও দু-একজনও সেই কথা বলে। এবং কাদে। কান্নাটা পুরো রু রুমে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। চারদিকে লোকেরা গ্লাস তুলে ফজল আলীর স্বাস্থ্য পান করে। ফজল আলীর নামে চোখের জল ফেলে।

বৌধায়ন মদ খায় না। সারাক্ষণ সে মুখ বিকৃত করে বসে রইল আর ভাবতে লাগল, সারা দেশ যখন অভাব আর দারিদ্রে ড়ুবে যাচ্ছে, তখন হাজার হাজার টাকার মদ ..

কী ভাবছ?—মন্দা জিজ্ঞেস করে আস্তে।

বৌধায়ন তার হাতের শেরির গ্লাসটা কেড়ে নিয়ে ছাইদানে উপুড় করে দিয়ে বলে, লজ্জা করে না মন্দা?

মন্দা হাসল। বলল, তোমার মন এখন দয়ার দুধে ভরা।

বৌধায়ন ঘৃণাভরে বলল, আই হেট অল দিজ থিংস। আমি তোমাকেও ঘেন্না করছি মন্দা।

 মন্দা অবাক হয়ে বলে, বটে! ঠিক আছে, কী করতে হবে বলো!

জবাব দেয় না বৌধায়ন। গুম হয়ে বসে থাকে। কোথাকার কে এক ফজল আলী, সামান্য শ্রমিক, গোটা দেশের মনোেযোগ কেড়ে নিল। সে পারল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *